27.12.23

বস বর সিজন ২

 #বস_বর

Writer : Eti Chowdhury
.
.
.
.
-বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে ইতিকেই করব। এমনিতেই দিনের ১৮ ঘন্টা ও আমার সাথে থাকে বিয়ের পরে না হয় বাকি ৬ ঘন্টাও থাকবে।
-তুমি কি ভেবে কথা বলছো?
খুব ঠান্ডা গলায় জানতে চায় জাহেদ চৌধুরী।
-না ভেবে কথা বলার মানুষ আমি নই বাবা তা তুমি ভালো করেই জানো।
-তা জানি তব.....
বাবা-ছেলের কথার মাঝে হুট করেই মিসেস রেহানা চৌধুরী বলে উঠলেন,
-ইতিকে মেনে নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
-সেটা নেই বুঝলাম বাট ইতিকি রাজি হবে?
জানতে চায় জাহেদ চৌধুরী। তার জবাবে রোদ বলে,
-হবে না কেনো? আমি কি দেখতে অসুন্দর নাকি হ্যান্ডসাম নই? আমার জন্য মেয়েরা পাগল আর ও আমাকে রিফিউজ করবে? তোমার কি আমার উপর ডাউট আছে নাকি বাবা? ডোন্ট ফর গেট মিস্টার চৌধুরী আই এম রোদ, রোদ চৌধুরী।
কথাটা বলেই তুরি বাজাতে বাজাতে রোদ বেড়িয়ে গেলো বাসা থেকে। রোদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলেন মিস্টার ও মিসেস চৌধুরী।
জাহেদ চৌধুরী আর রেহানা চৌধুরীর একমাত্র ছেলে রোদ আহমেদ চৌধুরী। চৌধুরী গ্রুপের একমাত্র ওয়ারিস। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক সে একাই। যেকোনো পরিবার এক কথায় মেয়ে দিতে রাজি রোদের জন্য। তবে রোদের কাছে বিয়ে মানে একটা অসহ্য যন্ত্রনা। আর এই যন্ত্রণার টনিক সে এখন খেতে চায় না। এখন কেন পারলে সারাজীবনেও সে বিয়ে করবে না। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয় কারণ বাপ-দাদা আর নিজের করা এতো সয়-সম্পত্তির জন্য হলেও নতুন উত্তরাধিকারী প্রয়োজন। নাহলে যে কষ্টের ধন পোকায় খাবে। বউ নামক নারী প্রাণীটার ঘ্যানঘ্যান, সংসারের অশান্তি রোদ একদম নিতে চায় না। তার মতে সে উন্মক্ত থাকবে চিরকাল। মুক্ত গগণে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিবে। বিদেশে লেখাপড়া করায় তার চিন্তা ধারাও অনেকটা বেশি আধুনিক। তবে দেশের প্রতি, নিজের পরিবারের প্রতি তার প্রবল টান আছে ছোট বেলা থেকেই। আর আছে বলেই তো বিদেশ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে লেখাপড়া করে ভালো ভালো অফার পেয়েও সব ছেড়ে দেশে এসে বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছে বাবার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে। আর বাবার ব্যবসার সামলানোর জন্যই। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে বিজনেস মার্কেটিং এর উপর কোর্স করেছে সে তাই তো আর দু'বছর বেশি সে বাহিরে ছিলো। নিজেকে উপযুক্ত করে নিয়েই দেশের মাটিতে পা রেখেছে সে দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার জন্য। মুক্ত জীবন-যাপন করলেও রোদের ভিতরে কোথাও একটা ঘর কুনো ছেলে আছে। যে পরিবারের আর দশজনের সাথে মিলেমিশে, হেসে-খেলে থাকতে চায়। কোন একাকিত্ব রোদের পছন্দ নয়। তবু কোথাও না কোথাও সে একা। আর তার এই একাকিত্বর কারণটা কি তা সে ছাড়া আর কেউ জানে না। এটা বুঝতে পেরেই মিস্টার এন্ড মিসেস চৌধুরী ছেলের পিছনে হাত ধুয়ে পরেছে তাকে এবার একলা থেকে দোকলা করার জন্য। মানে রোদকে বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনার জন্য।
গত একমাস যাবত বাবা-মা দুজন রোদের পিছনে পরেছে বিয়ে করার জন্য। এতো বড় একটা বাড়ি অথচ কথা বলার কেউ নেই। বাড়িটা যেন পানিতে পরে আছে। বাপ-ছেলে তাও অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে কিন্তু মিসেস চৌধুরীর দম বন্ধ হয়ে আসে এই মস্ত বড় বাড়িটায়। শখ করে চৌধুরী সাহেব ডুপ্লেক্স বাড়ি করেছিলেন। ইচ্ছে ছিলো ছেলেমেয়ে দিয়ে বাড়ি গমগম করবে কিন্তু আল্লাহ তায়ালার হয়ত সেই মর্জি ছিলো না। তাই রোদের জন্মের পর অনেক চেষ্টা করার পরেও আর কোন সন্তান হয়নি তাদের। যদিও পরে একবার মিসেস চৌধুরী কনসিভ করেছিলেন কিন্তু প্রায় যখন তার পাঁচমাস চলে সে সময় একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দরুণ তাদের সেই সন্তান আর পৃথিবীর মুখ দেখতে পারিনি। আর ঐ ঘটনার পর ডাক্তাররাও জানিয়ে দিয়েছিলেন মিসেস চৌধুরী মানে রোদের মা আর কখনো কনসিভ করবেন না। তাই এখন দুজনেই চাচ্ছেন ছেলে বিয়ে দিয়ে বউ ঘরে আনতে। আর নানি-পুতি দিয়ে বাড়িটা ভরে উঠুক। বাবা-মা হিসেবে অনেক উন্মক্ত মস্তিকের মানুষ তারা৷ ছেলের সাথে বন্ধুর মতো সম্পর্ক তাদের। ছেলে যদি কাউকে পছন্দ করে তুলেও নিয়ে আসে তাতেও তাদের আপত্তি নেই। তারা তাকে সাধরে গ্রহণ করবেন। নিজের মেয়ের মতো করেই রাখবেন।
ছেলে চলে যেতেই মিস্টার আর মিসেস চৌধুরী একে অপরের মুখ চাওয়া-চায়ি করেন। মিসেস চৌধুরী বলেন,
-আচ্ছা আমার মাথায় তো কখনো এটা আসেনি।
-কোনটা?
-এই যে ইতির কথা। মেয়েটা কত লক্ষি। অফিসের পরেও আমি যখনি ডাকি আমার কাছে চলে আসে। আমায় কত ভালোবাসে।
-শুধু তোমায় কি বলছো। অফিসের প্রতিটা দায়িত্ব কত নিষ্ঠার সাথে পালন করে তা তো তোমাকে আগেই বলেছি আর সব সময় বলিও। এই মেয়ে ঘরে এলে ঘরটা ভরে যাবে আমাদের তুমি দেখেনিও।
-হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছো। কত লক্ষি মেয়ে।
-শুধু নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য, যেন কারো উপর নির্ভর করতে না হয় সেজন্যই জয়েন করেছে আমাদের কোম্পানিতে। তা নাহলে আমি ওর ফ্যামিলি ব্যাগগ্রাউন্ডও দেখেছি যথেষ্ট ভালো। খুব ভালো ফ্যামিলি থেকে বিংল করে সে।
-তুমি যা বলছো সব যদি ঠিক থাকে তাহলে তো বুবুজানের সাথে কথা বলা দরকার।
-তা তো বলা দরকারই তবে তার আগে কি একবার ইতির থেকে জানা দরকার নয় কি ও রাজি কি না? আর...
-আর কি?
-আর আমাদের ছেলে কথাটা সিরিয়সি বলল নাকি বলা প্রয়োজন তাই বলে আমাদের চুপ করিয়ে সে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো।
-হুমম,,, তাও ঠিক বলেছো তুমি।
মিস্টার ও মিসেস চৌধুরী দুজনেই গভীর চিন্তায় পরে যায় বিষয়টা নিয়ে।
"বিয়ে!!! বিয়ে!!! বিয়ে!!!
বাবা-মার আর কোন চিন্তা বা কোন কাজ নেই এই এক বিয়ে ছাড়া। মনে হয় বিয়ে ছাড়া দুনিয়াতে কিছুই নেই"। মনে মনে এসব কথা ভাবতে ভাবতেই অফিসে ডুকে রোদ। নিজের কেবিনে ডুকতে গিয়ে কি মনে করে যেন কেবিনে না ডুকে স্টোরের দিকে যায়। দিমি লাইট জ্বলছে স্টোরে। হালকা ধুলাও পরেছে। রোদ প্যান্টের পকেট থেকে রুমালটা বের করে নাকে ধরে নিলো। ধুলায় এলার্জি আছে তার। রোদ দু কদম সামনে যেতেই,
-আআআআ....
মুহুর্তের মধ্যে কি হলো তা রোদ নিজেও বুঝতে পারেনি। স্টোরে ডুকতেই কারো শব্দ পেয়ে সে অনুযায়ী ভিতরে ডুকে রোদ দেখে ইতি উপরে। মই দিয়ে উপরে উঠেছিলো মেয়েটা পরে যায় যায় অবস্থা তা দেখে রোদ সামনে আগায় আর ঠিক তখনি মেয়েটা পরে যায় রোদ দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলে।
-আল্লাহ এখন আমার কি হবে? কোমড়টা বুঝি গেলো। এখন আমার কি হবে.....
চোখ মুখ খিচে বিড়বিড় করে প্রলাপ বকছে ইতি। কি বলছে ঠিক মতো শুনা যাচ্ছে না তাই রোদ ইতির মুখের কাছে কান নিয়ে যায় মেয়েটা কি বলে তা শুনার জন্য। ইতির কথা শুনে হো হো করে হেসে দেয় রোদ। রোদের হাসি শুনে ইতির হুদিস হয়। চোখ খুলে নিজেকে রোদের কোলে আবিষ্কার করেই বিষম খায় সে৷ চোখ গুলো যেন খুলে এখনি বের হয়ে আসবে এমন অবস্থা। কিন্তু রোদের সেদিকে খেয়াল নেই সে হো হো করে হেসেই যাচ্ছে। রোদের হাসির শব্দ এতোটাই যে তা বাইরে থেকে রাফসান শুনতে পায়।
-ছাড়ুন আমাকে!!!
বলেই হাত-পা নাচাতে থাকে ইতি। এতোক্ষণে রোদেরও হুস হয়। ইতিকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় সে। ইতির প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তা সে কল্পনাতেও ভাবেনি। তবে রোদ সময় মতো না এলে আজ ইতির একটা হাড্ডিও আস্তো থাকত না। তাই লজ্জা-শরমকে বক্সে রেখে রোদকে একটা থ্যাংকস দেয়া দরকার তাই যেই ইতি রোদকে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য মুখ খুলবে ওমনি রোদ চেচিয়ে উঠে,
-এই মেয়ে এই অফিসে কি পিয়ন নেই নাকি? এতো গুলো পিয়নকে বেতন দেই কেন? আর তোমাকে কে বলছে ওদের কাজ করার জন্য? নিজের কাজ কম হলে আমাকে বলো সমস্ত অফিসের সব কাজ ধরিয়ে দিবো। তখন আর নিঃশ্বাসও নিতে পারবে না। কে বলছে নিজেকে পন্ডিতি করে ছাদে উঠতে? ঘরে মার জ্বালা অফিসে এর জ্বালা...এখনি জ্বালানো শুরু পরে যে কি করবে যত্তোসব....
কথা গুলো বলতে বলতে আর রাগে ফুসতে ফুসতেই রোদ স্টোর থেকে বেরিয়ে যায়। রোদের কথা শুনে ইতি যেন একদম বোকা বোনে গেলো। আকাশ থেকে পরি পরি অবস্থা মেয়েটার।
-যাক,, শালা এটা কি ছিলো? ভাবলাম তাকে ধন্যবাদ দিবো উল্টো সে আমাকে বোকে গেলো? তাকে আমি সেঁধে বলেছি নাকি আমাকে বাঁচাতে আবার কত্তগুলো কথা শুনিয়ে গেলো। আর কি বলল ঘরে মার জ্বালা অফিসে এর জ্বালা কেন ভাই আমি কি তার বউ লাগি নাকি যে তাকে জ্বালাব?
নিজের সাথেই কথা গুলো বলছিলো ইতি আর তখনি রাফসানের আগমণ ঘটে।
-নাহ,, তুমি তার বউ না তবে আমার বউ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে তোমার।
এই মুহুর্তে রাফসানের এমন কথা শুনে ইতির মেজাজটা আরো ১৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে বিগড়ে গেলো। রাফসানের বুকে ঘুষি দিয়ে বলে,
-এতোক্ষণ কোথায় ছিলে এখন আসছো মজা নিতে তাই না? যাও ভাগো হবো না তোমার বউ।
বলেই রাফসানকে ধাক্কা দিয়ে স্টোর থেকে বেরিয়ে যায় ইতি। রাফসানও পিছন পিছন যায়। মেয়েটা সেই ক্ষেপেছে। আজ কপালে তার খারাপি আছে এটা নিশ্চিত রাফসান। এমনি মেয়েটার ভালো লাগার কথা বুঝতে অনেক সময় নিয়েছে সে তারপর এভাবে হুটহাট প্রায়শই রাগিয়ে দেয় রাফসান ইতিকে।
একি কলেজে লেখা পড়া করত ইতি আর রাফসান। ব্যাচ মেট ছিলো তারা। কখন সেভাবে মিশা হয়নি তাদের। সাধারণ হাই হ্যালো ছিলো মাত্র। তাদের ব্যাচের ফেমাস বয় ছিলো রাফসান। মেয়েরা বলতে গেলো প্রায় পাগল ছিলো রাফসানের জন্য। অনেকেই মনে মনে রাফসানের উপর ক্রাশিত ছিলো। কেউ বা মনে মনে ভালোও বাসত। তবে এই ফেমাস বয় রাফসানটাই মনে মনে পছন্দ করত ইতিকে। কিন্তু যদি ইতি ফিরিয়ে দেয়। ফেমাস বয়কে কেউ রিজেক্ট করবে তা ভেবেই কখনো ইতিকে মনের কথা বলা হয়নি রাফসানের। সাহস করতে পারেনি কখনো। ইতি যে রাফসানকে পছন্দ করে না তা নয়। বা আহামরি তারা প্রেম করছে সেটাও নয়। এখানে জয়েন করেই আবার অনেকদিন পর রাফসানের সাথে দেখা হয় ইতির। তখন রাফসান মনে মনে ভাবে হয়ত তার কপালে ইতিই আছে তাই তো আল্লাহ তায়াল আবার তাদেরকে একে অপরের সামনা সামনি করে দিয়েছে কারণ কলেজ শেষ করার পর রাফসান আর ইতিকে খুঁজে পায়নি। মেয়েটা যেন হওয়া হয়ে গিয়েছিলো। কলেজের পরে ইতিকে হারিয়ে রাফসান ইতিকে পাওয়ার সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিলো। তখন নিয়তিকে মেনে নিয়ে ছিলো সে। কিন্তু এতো বছর পর এসে আবার ইতিকে পাবে এটাও সে ভাবেনি। তাই তো এক বছর আগে যখন রাফসান জয়েন করল আর জয়েনের প্রথম দিনই এসে ইতিকে দেখলো। তখনই মনে মনে ঠিক করে নেয় এবার আর সে ইতিকে হাত ছাড়া করবে না। নিয়তি হয়ত তার পাশেই আছে। তাদের কলেজ জীবনের অসমাপ্ত না বলা প্রেম কাহিনিটা হয়ত পূর্ণতা পাবে এ জন্মে।
ইতি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের কেবিনে চলে যায়। কিন্তু মেয়েটা এটাই বুঝতে পারছে না তার রাগটা আসলে কার উপর। রোদের উপর সে বাঁচিয়ে কথা শুনালো তাই নাকি রাফসানের উপর যে সময় মতো এসে তাকে ধরেনি তাই। সেটাই বুঝতে পারছে না আপাততো ইতি তার রাগটা আসলে কোথায়। রোদের বলা কথাটা নিয়ে ভাবতে না চাইলেও মাথায় কথাটা বারি খাচ্ছে বার বার ইতির। টেবিলে রাখা পানিটা নিয়ে গটগট করে গ্লাসটা খালি করে দেয় সে। দিয়ে কেবিনের দরজা বরাবর তাকাতেই দেখে গ্লাসের অপর পাশে রাফসান দাঁড়িয়ে আছে। সরি বলার চেষ্টা করছে ছেলেটা। এই মেয়েটারও হয়েছে এক জ্বালা। একবার কোন কিছুর জন্য ক্ষেপে গেলে আর রক্ষা নেই। রাগ মাথা থেকে নামতেই চায় না। আর রাগ হলেই ইতি পানি খায়। প্রচুর পানি খায়। খায় না মূলত পান করে সাধারণ ভাষায় যাকে আমরা বলি খায়। আর বার বার অন্দরমহলে যাতায়াত করে। মেয়েটার এই অভ্যাসটা খুবই হাস্যকর যদিও তার নিজের কাছে তা প্রচন্ড বিরক্তি কর। ইতি বসা থেকে উঠে একটা ফাইল হাতে নিয়ে কেবিনের বাইরে আসতে যেই রাফসান কিছু বলতে যাবে তখনি ইতি রাফসানের রাস্তা কেটে অন্য দিকে হাটা শুরু করে দেয়। রাফসান বেচারা পিছন থেকে ডাকে তাতেও কোন কাজ হয় না।
ইতি রাফসানের ডাক উপেক্ষা করে সোজা কনফাররেন্স রুমের দিতে চলে যায়। ভিতরে প্রবেশন করতে নিলেই রিমি পিছন থেকে বলে,
-ম্যাম।
ইতি পিছন ঘুড়ে দেখে রিমি,
-হ্যাঁ রিমি বলো?
-এমডি স্যার তার কেবিনে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। মিটিং শুরু হতে সময় আছে।
-ঠিক আছে।
করিডরের অন্য মাথায় রাফসান এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে বামে মোড় নিয়ে করিডরের শেষ কেবিনটাই এমডির। ইতি এক পলক রাফসানকে দেখে নিয়ে এমডির কেবিনের দিকে পা বাড়ায়। আর মনে মনে বলে, "থাকো দাঁড়িয়ে। বুঝো মজা আমাকে রাগানোর"। বলেই ইতি চলে যায়।
কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখে এমডি অর্থাৎ রোদ আর আদি কিছু নিয়ে ডিসকাস করছে। রোদের কেবিনটা বিশাল। কোম্পানির এমডির কেবিন বিশাল আর বিশেষ তো হবেই। রোদ তার চেয়ার রেখে কেবিনের একসাইডে সোফা সেট করা সেখানে সিঙ্গেল সোফাটায় বসে আছে। তার পাশের বড় সোফায় আদি বসে আছে। ইতিকে আসতে দেখে আদি সেখান থেকে সরে অন্য পাশে গিয়ে বসে। ইতিকে দেখে রোদ বলে,
-বসো।
ইতি বসতে বসতে বলে,
-ডেকে ছিলেন আমায়?
-হুম, ভাবলাম একবার ক্লসগুলো রি-চেক করে নেই। সব ঠিক আছে কিনা বা কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করা প্রয়োজন হয় কিনা।
-ঠিক আছে।
ইতি এই কোম্পানির কমিউনিকেশন ডিপার্মেন্টের হেড তবে তা ইন্টারনাল। আর আদি মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের হেড। এই কোম্পানির অনেকগুলো সেক্টর। ইম্পোর্ট-এক্সপোর্ট, পাবলিশিং থেকে শুরু করে অনেক কিছু নিয়ে তারা কাজ করে। সব কিছু নিয়েই চৌধুরী গ্রুপ অব কোম্পানি৷ তাদের নিজেস্ব মিল, কারখানা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী সবই আছে। আর এই সব কিছুর একমাত্র উত্তরসূরী রোদ একাই। দক্ষতায় যেমন প্রখর সে তেমনি চেহারা সুরতেও মাশাআল্লাহ চমৎকার দেখতে সে। হ্যান্ডসাম ছেলে কেমন হয় রোদকে দেখলে তা আলাদা করে জানার প্রয়োজন পরে না কারো। তার দেখনি হোক আর চার্ম কোনটাই কম নয়। আবার চারিত্রিক দিক দিয়েও সে কম যায় না। বড়দের শ্রদ্ধাভক্তি করা, ছোটদের স্নেহ করা, ভদ্রতা সবই জানে সে। মেয়েদের সম্মান করার ব্যাপারেও পিছিয়ে নেই রোদ। আবার যদি বলা হয় বদদের শায়েস্তা করা সেটা খুব আনন্দের সাথে করে সে। সুযোগ পেলেই নিজের মাসালের যাদু দেখাতে পিছ পা হয় না রোদ। সব কিছু মিলিয়ে যে কোন মেয়ের পছন্দের, পছন্দের বললে কম হয়ে যাবে যে কোন মেয়ের স্বপ্নের মানুষটার মতো একজন পুরুষ মানুষ এই রোদ চৌধুরী।
রোদ, ইতি আর আদি তারা নিজেরা ডিসকাস করছিলো এমন সময় রিমি প্রবেশ করে বলে,
-কনফারেন্স রুম রেডি স্যার মিটিংয়ের জন্য।
-ঠিকাছে।
বলেই রোদ ইতি আর আদিকে বলে, "তোমরা যাও আমি একটু পরেই আছি। ছোট্ট একটা কাজ করে আসছি"।
-ওকে।
ইতি আর আদি বেরিয়ে যেতেই রোদ ইন্টারকমে কল দেয়। লাইনের অন্যপাশে কল রিসিভ হতেই রোদ বলে,
-এখনি একটু আমার কেবিনে আসো আর্জেন্ট।
ইতি কনফারেন্স রুুমে ডুকতে নিয়েই দেখে আদি থেমে গেছে। তা দেখে ইতি নিজেও থেমে গিয়ে পিছন ঘুড়ে দাঁড়িয়ে আদিকে জিজ্ঞেস করে,
-কি হলো?
-হয়নি তবে যেন কোন সময় হতে পারে।
-মানে?
-মানে মনে হয় স্যার যে জন্য রয়ে গেলো আমারও একি কারণ।
-কি সব যা তা বলছো।
-আর দূর জান বাঁচানো ফরজ আগে। তুমি যাও আমি আসছি।
-কোথায় যাচ্ছো। স্যারকে কি বলবো?
-অন্দরমহল যাচ্ছি। স্যার জিজ্ঞেস করলে বলবা উনি যে জন্য পরে বের হয়েছেন আমিও একি কারণে যাচ্ছি।
আদি আর অপেক্ষা না করে নিজের কেবিনের দিকে দৌড়ে দেয়। ইতি হেসে দিতেই তার সাথে রিমিও হেসে দেয়। ইতি পাশে তাকিয়ে দেখে রিমিও এতোক্ষণ উপস্থিত ছিলো এখানে কিন্তু সে বুঝতেই পারেনি। রিমি হাসি থামিয়ে বলে,
-চলুন ম্যাম।
-হুম চলো।
আদি এসে দেখো রোদ এখনো আসেনি। মনে মনে বেঁচে গেছে ভেবে নিজের সিটে বসে পরে সে। তার পাশেই ইতি। ইতি আদিকে দেখে হেসে দেয়। রিমিও মুখ টিপে টিপে হাসছে। তবে কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না কারণ যতোই হোক ওরা রিমির সিনিয়র। এক একজন এক এক ডিপার্টমেন্টের হেড আর রিমি রোদের এ্যাসিস্ট্যান্ট। পদের দিকে অনেক নিচে হলেও ওরা সবাই রিমিকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করে। ইতিকে হাসতে দেখে আদি আস্তে আস্তে বলে,
-চুপ করো। তোমার ইমার্জেন্সি হোক তখন বুঝবা কেমন লাগে।
তখনি রোদ প্রবেশ করে। তাকে দেখে আদি থেমে যায় আর কথা বাড়ায় না। ইতিও কোন জবাব দেয় না।
রোদ আসতেই চৌধুরী গ্রুপের পক্ষ থেকে ইতি প্রজেন্টেশন দেয়। যা বরাবরের মতোই সাকসেসফুল হয়। কারণ রোদ তার প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ বড় থেকে ছোট ডিল এর প্রস্তুতি সে নিজের হাতে নেয়। যেন কোন কমতি না থাকে। রোদ বিশ্বাস করে কেবল মাত্র বড় ডিল দিয়েই নয় কোম্পানিকে সুষ্ট ও সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে বড় ছোট সব গুলো ডিলকেই সমান গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। এবং অর্জন করতে হবে৷ ছোট বলে বা ভেবে কোন ডিল হাত ছাড়া করা যাবে না। যার উদাহরণ আজকের ডিলটা। যা নিজের দক্ষতা ও সকলের সঙ্গ দিয়ে সে আবার নিজের করে নিয়েছে। সাধারণত সাইনিং অন্য কোন দিনে করা হয় কিন্তু আজ একেবারে সাইনিং হবে। আর একেবারে সাইনিং হওয়ার কারণে মিটিংটা অনেক লম্বা যায়। প্রায় ৪ ঘন্টার উপরে। সেখানেই শেষ নয়। ডিল ফাইনাল হওয়ার দরুণ সেখান থেকেই তারা লাঞ্চের জন্য বেরিয়ে যায়। আর বাধ্যতামূলক ইতি, আদি আর রিমিকেও যেতে হয় প্রায় সব সময়। বিশেষ প্রয়োজন বা ক্ষেত্রে রোদ না করলে তারা যায় না অন্যথায় তাদেরকেও যেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে লাঞ্চ অফিসে আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই ডিলটার ডিলাররা কোরিয়ান আর রোদ এই প্রথম কোন কোরিয়ান কোম্পানির সাথে কাজ করছে তাই সে রিস্ক নিতে চায়নি সেজন্যই মিটিং শেষ করে হোটেল লা মেরেডিয়ানে জন্য বেরিয়ে যায় লাঞ্চ করার উদ্দেশ্যে।
.
পর্ব-২
.
.
.
.
অনেক ক্ষেত্রে লাঞ্চ অফিসেই আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই ডিলটার ডিলাররা কোরিয়ান আর রোদ এই প্রথম কোন কোরিয়ান কোম্পানির সাথে কাজ করছে তাই সে রিস্ক নিতে চায়নি সেজন্যই মিটিং শেষ করে হোটেল লা মেরেডিয়ানে জন্য বেরিয়ে যায় লাঞ্চ করার উদ্দেশ্যে।
লাঞ্চ সারতে সারতে ভবিষ্যৎ অনেক পরিকল্পনা নিয়েই তারা আলোচনা করতে থাকে। আজ রোদের সাথে ইতি, আদি আর রিমি তিনজনই এসেছে। রোদই বলেছে আসতে। ইতি যখন কনফারেন্স থেকে বের হয়ে অফিস থেকে বের হচ্ছিলো তখন আশে রাফসানকে খুঁজলে পায় না। হয়ত কোন কাজে ব্যস্ত তাই আর দেখা পায়নি সে। এটা ভেবেই বেরিয়ে যায় ইতি। মিটিং করতে করতেই ইতির রাগ পরে যায়। মিটিংয়ে আসার আগে যে রাগ ইতির ছিলো এখন তার ছিটে ফোঁটাও নেই। লাঞ্চ প্রায় শেষের দিকে। ইতি উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য। রোদ কথা বলতে বলতেই তার চোখ ইতির দিকে যায়। চট করে সে চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে গিয়ে এক প্রকার ছুটেই ইতির দিকে যায়। গিয়ে ইতিকে পিছন থেকেই ধরে ফেলে। ধরে ফেলে বলতে জড়িয়ে ধরে না। ইতির একটা হাত ধরে তাকে থামায়। আর ইতিকপ একদম নিজের কাছাকাছি টেনে নেয়। রোদ হুট করে করা এমন কান্ডে ইতির বিষম উঠে যায়। ইতি মনে মনে বলছে, "লোকটার হুট করে হলোটা কি? আমাকে টেনে ধরল কেন?" ইতি কিছুই বুঝতে পারছে না রোদ কি করছে বা করতে চাইছে।
রোদ নিজের মুখটা ইতির কানের কাছে নিতেই ইতি যেন সাথে সাথে জমে গেলো। রোদের কড়া পারফিউমের তীব্র ঘ্রাণ ইতির নিঃশ্বাসের সাথে গিয়ে বুকের ভেতর তোলপাড় করে দিচ্ছে। মুহুর্তের মাঝেই যেন মেয়েটা একদম বরফের ন্যায় জমে গেলো। কিন্তু রোদ চায়টা কি?
রোদ নিজের মুখটা ইতির কানের কাছে নিয়ে বলে,
-এতো কেয়ারল্যাস কেন তুমি? নিজের প্রতি কি সামান্য কেয়ারফুলনেন্স নাই।
রোদ কি বলছে না বলছে তার আগা-মাথা কোনটাই ইতির মস্তিষ্কে ধরছে না এখন। নিজেকে একপ্রকার হালকা লাগছে তার।
রোদ নিজের ব্লেজারটা খুলে সামান্য কিঞ্চিৎ পরিমাণ পিছন সরে ইতির কোমড়ের সাথে তা বেঁধতে লাগে। রোদের এমন কান্ড দেখে ইতি যেন বিষ্ময়ের সপ্তম আকাশে উঠে যায়। রোদ তার ব্লেজারটা ইতির কোমড়ে বাঁধতে বাঁধতে আবার নিজের মুখটা ইতির কানের কাছে নিয়ে গলার স্বর নিচে রেখেই বলে,
-ইউ সুড বি মোর কেয়ারফুল ডিউরিং ইউর পিরিয়ড ডেটস।
কথাটা শুনার সাথে সাথে ইতির চোখ গুলো যেন ইয়া বড় বড় রসোগল্লার মতো হয়ে যায়। যেন চোখগুলো এখনি বেরিয়ে আসবে তার। এমন একটা কান্ড এখনি ঘটা লাগলো তাও এখানে আর সেটা এই মানুষটারই চোখে পরা লাগল। লজ্জায় ইতির মাথা কাটা যাচ্ছে। এমন ঘটনায় কেন পরা লাগল তার। রোদ ব্লেজারটা ইতির কোমড়ে বেঁধে দিয়ে একটা হাত ইতির বাহুতে রেখে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
-তুমি এখানেই দাঁড়াও আমি আসছি।
"নারী নামক এই প্রাণীটা এখনই এতো জ্বালাচ্ছে পরে যে কি করবে" কথাটা নিজের সাথে বিড়বিড় করতে করতেই রোদ ভিতরের দিকে যায়।
রোদ চলে যেতেই ইতি লজ্জায় নিজের হাত দিয়ে মুঝ ডাকে আর বলে, "আল্লাহ কেন? কেন আমার সাথেই এটা হতে হলো? রিমিও তো ছিলো। উনি না দেখে রিমিও তো দেখলে পারত"৷ ইতি সন্দেহের বসেই উঠে ওয়াশরুমে যাচ্ছিলো চেক করার জন্য কিন্তু এদিকে যে এমন বেজ্জতি কাহিনি হয়ে যাবে তা সে ভাবতেই পারেনি।
রোদ আসছি বলেই আবার টেবিলে ফিরে গিয়ে আদিকে বলে ক্লাইন্টদের যেন হোটেল পৌঁছে দিয়ে রিমিকে নিয়ে সে অফিসে চলে যায়। তার জরুরী কাজ আছে তাই ইতিকে নিয়ে সে বের হচ্ছে বলেই বিদায় নিয়ে নেয় রোদ।
ইতিকে যেখানে দাঁড়াতে বলেছিলো। সেখানে এসে বলে,
-চলো।
চলো বলেই রোদ সামনের দিকে হাটতে থাকে। কিন্তু ইতি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ইতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে রোদ থেমে গিয়ে পিছন ফিরে বলে,
-কি হলো?
ইতি আমতা আমতা করতে থাকে,
-না মানে ক কোথায় যাবো?
-বাসায় যাবা।
-বাসায়!!!!
-হ্যাঁ। তো আর কোথায় যেতে চাও? এখন এই অবস্থায়।
-না প্লিজ আমি আপনার বাসায় যাবো না।
-আমার বাসায় কেন যাবে?
-কিহ?
-আবার কি মানে?
-আপনার বাসা যাবো না তো কোথায় যাবো?
-তোমার বাসায়।
ইতি যেন আরো বেশি অবাক হয়। বলে,
-আপনি আমার বাসা যাবেন?
এবার যেন সত্যি রোদ বিরক্ত হয়ে যায়। বলে,
-আমি কেন তোমার বাসায় যাবো?
-তাহলে?
-তাহলে তুমি তোমার বাসায় যাবে।
-আর আপনি?
-আমি তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাবো।
-ওহ। আচ্ছা।
-এবার যেহেতু বুঝতেই পেরেছো তাহলে দাড়িয়ে না থেকে চলো যাই। অলরেডি ৪টা বাজে।
-হুম।
রোদ সামনে আগাতে থাকে ইতি তার পিছন পিছন। বের হতে হতে রোদ ড্রাইভারকে কল দিয়ে দেয় ওরা বের হওয়ার আগেই ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে আসে। রোদ গাড়ির কাছে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দাড়ায় ইতির জন্য। ইতি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে রোদের দিকে। একজন হ্যান্ডসাম, সুদর্শন পুরুষ যখন কারো জন্য গাড়ির দরজা খুলে দাড়ায় তখন তাকে দেখতে অনেক বেশি লোভনীয় লাগে। যেমনটা এই মুহুর্তে রোদকে লাগছে দেখতে। তাও সেই পুরুষ যদি কোন যুবতী মেয়ের জন্য গাড়ির দরজা খুলে তাহলে তাকে আরো অনেক বেশি লোভনীয় লাগে। ইতির কাছে এই ব্যাখ্যাটা ভিন্ন।
ইতি এসে চুপচাপ গাড়িতে বসে পরে। রোদ অন্য পাশ দিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে ইতির পাশেই বসে।
ইতিকে তার বাসার সামনে নামিয়ে দেয়। গাড়ি থেকে নামায় সময় ইতি বলে,
-একটু অপেক্ষা করলে আমি অল্প সময়ের মধ্যেই চেঞ্জ করে আবার অফিসে যেতে পারি।
রোদ নিজের হাত ঘড়িটা দেখে বলে,
-প্রয়োজন নেই। প্রায় ৫টা বাজে। আজ আর তোমার যেতে হবে না। টেক রেস্ট।
ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলে রোদ। ইতিকে নামিয়ে দিয়ে রোদ অফিস চলে যায়।
রোদ বিড়বিড় করে কি বলছিলো সেটাই ভাবছে ইতি নিজের ব্যালকুনিতে বসে। কিন্তু কিছুই মাথায় আসছে না কারণ কথাটা সে এতোটাই ধীরপ বলেছে যে ইতি তা ঠিকমতো শুনতে পারেনি। ইতি ফ্রেস হয়ে ফোন চেক করতেই দেখে রাফসানের একটাও মিসডকল নেই। মিটিংয়ে ডুকার আগে ইতি ফেন সাইলেন্ট করেছিলো পরে আর জেনারেল করা হয়নি।
রাফসানের কোন মিসডকল না দেখে ইতির মাথাটা আবার বিগড়ে যায়। ফোনটাকে বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে ইতি রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
অফিসের সব কাজ শেষ করে রোদের বাসায় ফিরতে প্রায় রাত ৯টা বেজে যায়। কাজ তো আর শেষ হয় না তবে সাময়িক শেষ বলা যায় আর কি। রোদ ভেতরে ডুকতে ডুকতেই গলার টাইটা খুলতে থাকে। ড্রইং রুমেই জাহেদ চৌধুরী রোদের বাবা বসে ছিলেন। ছেলেকে ডুকতে দেখেই সে বলেন,
-আজকেও তোর লেট।
রোদ বসতে বসতে বলে,
-হুম, কাজ ছিলো বাবা।
-আর তোকে ঘরে বাঁধার জন্যই তোর বিয়ে দেয়াটা এখন বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে।
বলতে বলতেই এক গ্লাস লেবু দেয়া হালকা ঠান্ডা পানি ছেলের দিকে এগিয়ে দেয় রেহানা চৌধুরী। একটানে পানির গ্লাসটা খালি করে দিয়ে রোদ বলে,
-এসব চিন্তা বাদ দাও। একটা কেন দশটা বিয়ে দিলেও আমাকে ঘরে বাঁধতে পারবে না তোমরা। তোমাদের ছেলে মেয়ে পাগল নয় যে একটা মেয়ে সারাদিন চোখের সামনে থাকলেই তাকে গিলে খাওয়ার জন্য আমি সারাদিন ঘরে বসে থাকব।
-কি যা তা বলছিস।
-ঠিকিই তো বলেছে। ছেলে মানুষ ঘরে বসে থাকে কি চলে নাকি? আর বউ তো ভালোবাসার মানুষ। আমার ছেলে ঠিকি বলেছে।
ছেলের সাথে সম্মতি জানায় জাহেদ চৌধুরী।
রোদ আর কথা না বাড়িয়ে উপরের দিকে পা বাড়া। পিছন থেকে রেহানা চৌধুরী বলে,
-জলদি ফ্রেস হয়ে আয় ডিনার দিচ্ছি।
-আসছি মা।
ইতি ঠিক মতো ডিনারটাও করতে পারেনি। এক তো পেট ব্যথা করছে। এই দিনগুলোতে অনেক কষ্ট হয় মেয়েটার। ব্যথাটা একটু বেশিই করে। তার উপর বেচারির ভাবতেই লজ্জা করছে কাল অফিসে গিয়ে ঐ মানুষটার সম্মুখীন হতে হবে তাকে। রোদকে এভয়েড করার কোন উপায়ও নেই ইতির কাছে। কারণে রোদের সাথে প্রতিদিন কোন না কোন কাজ তার থাকেই। যেহেতু ইতি কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টে আছে। তাই সব কিছু তার রোদকে তো জানাতেই হয়। কিভাবে রোদকে ফেস করবে ভাবতেই লজ্জায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। মাথার ভিতর ভোন ভোন করছে। বমি বমি পাচ্ছে।
-তুই সিওর তো?
ডিনার টেবিলে খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করেন জাহেদ চৌধুরী। রোদ প্লেট থেকে মুখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-এখন কি প্রমাণ দিতে হবে যে আমি সিওর?
-তা নয়। আমরা বুবজানের সাথে কথা বলেছি। উনি এখন আসতে পারবেন না তাই আমাদের যা ভালো মনে হয় তাই করতে বললেন।
-হুম।
-হুম কি?
-আহা বাবা। আর কি শুনতে চাও এখন কি না করে দিবো তাহলে বুঝবা যে আমি সিরিয়স?
-সেটা নয়। কত আয়োজন করা লাগবে আর....
-কোন আয়োজন করা লাগবে না।
-মানে?
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন রেহানা চৌধুরী। জাহেদ চৌধুরীও সাথে সাথেই ছেলের মুখে প্রশ্ন ছুড়ে দেন,
-আয়োজন করা লাগবে না মানে কি?
-মানে আমি এখন এই মুহুর্তে কোন তাম ঝাম চাই না। কাজ আছে আমার।
-কাজ তো সারা জীবন থাকবে তাছাড়া এই ডিলটা তো...
-তাছাড়া জানি এই ডিলটা অন্যসব ডিলের মতো তেমন বড় নয় কিন্তু এই ডিলটা আমার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কোম্পানির ইতিহাসে আমার বাবা-দাদারা কখনো কোন কোরিয়ান কোম্পানির সাথে কাজ করেনি এটাই প্রথম। আর ইউ নো আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছেন ইউর ফাস্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্যা লাস্ট ইম্প্রেশন। তাই আমি আমার ফাস্ট ইম্প্রেশনটা নষ্ট করতে চাই না। ইনফ্যাক্ট আমি চাই এই প্রথম কাজটার প্রপোজাল আমরা দিয়েছি তাদের কিন্তু পরবর্তী সব বড় বড় কাজ গুলো নিয়ে যেন ওরা নিজেরাই আমার কাছে এপ্রোজ করে।
-বাবা কে ব্যবসা শিখাচ্ছিস তুই?
-একদম নয়। আমি কেবল আমাদের কোম্পানির এডমির অবস্থা কোম্পানির চেয়ারম্যানকে বোঝাচ্ছি। তাই আপাততো কোন হামতাম হবে না। আর যা রয়ে যাবে তা কিছুদিন পরে করে নেয়া যাবে। আফটার অল রোদ চৌধুরীর বিয়ে। জাহেদ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র। মাহাতাব চৌধুরীর বংশ ধরের বিয়ে বলে কথা। আসে পাশের চৌদ্দপুরুষ তা মনে না রাখলে কি হয় নাকি।
-এই না হলে আমার ছেলে।
বলেই বাবা-ছেলে দুজনেই হাসিতে ফেটে পরে।
সকাল থেকে একবারও ইতি রোদের কেবিনে যায়নি। অবশ্য সেটা নিয়ে রোদের তেমন কোন মাথা ব্যাথাও নেই। সে যে ইতির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তাও নয়। রোদের তো এখনি মনে হচ্ছে তার জীবনের যন্ত্রণাগুলো হয়ত শুরু হয়ে গেছে। নারী মানেই তার কাছে একটা উটকো ঝামেলা। কেন যে বিয়ের এই প্রথাটা শুরু হলো তা ভেবে পায়না রোদ। বিয়ের কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো নাকি।
কিছু ইনফরমেশনের জন্য রোদ ইতির কেবিনের ইন্টার কমে কল দেয়। কিন্তু কলটা রিসিভ হয় না। আবার কল দেয়। দ্বিতীয়বারও একি অবস্থা। তৃতীয়বারের সময় রোদ রিমিকে কল দেয়। রিমি কলটা রিসিভ করতেই রোদ বলে,
-ইতি কি তার কেবিনে নেই? তাকে বলো আমার কেবিনে আসতে।
-স্যার, ম্যাম যেতে পারবে না।
রোদ ফোনটা ছেড়ে দিতে নিয়েছিলো কিন্তু রিমির কথা শুনে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কেন?
-ম্যাম তো আসেনি আজ।
-কেন?
-তার নাকি শরীর ভালো না।
-গতকালই তো ভালো ছিলো। আমি নিজে নামিয়ে দিয়ে এলাম। হুট করে কি হলো?
-তা জানি না স্যার।
-তুমি কল দিয়ে জিজ্ঞেস করো কি হয়েছে। আরর জেনে আমাকে জানাও।
-স্যা....
রিমি কিছু একটা বলতে নিয়েছিলো কিন্তু রোদ তা না শুনেই ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখে। রিসিভার নামিয়ে রেখে ভাবে, "কালই তো ভালো ছিলো আজ আবার কি হলো হুট করে"।
রিমি পরে যায় মহা যন্ত্রণায়। ইতি আজ অফিস আসেনি জানতে পেরেই রিমি তাকে কল দিয়েছিলো তাকে। যদিও এটা তার দায়িত্ব নয়। কিন্তু ইতির সাথে রিমির সম্পর্ক ভালো আর সেই সুবাধেই রিমি কল দিয়েছিলো। রিমি কল দেয়ায় তাকে সবটাই বলেছে ইতি। পেট ব্যাথার জন্য বিছানা থেকে উঠতে পারছে না মেয়েটা তাই অফিসে যেতে পারেনি। আর এই কথা রিমি রোদকে কিভাবে বললে। এমনিতেই রোদের কিউরিসিটি সব কিছুতেই বেশি যার জন্য অনেক সময় রিমিকে বেকায়দায় পরতে হয়। হুটহাট এটা সেটা নিয়ে প্রশ্ন করে ফেলে রোদ আর রিমি বেচারি বিপাকে পরে যায়। রোদ বাহিরে থাকায় সেখানে সবকিছু অনেক বেশি খোলা মেলা কিন্তু এদেশে তা নয়। এখানে এখনো মামুষ অনেক কথা মুখ ফুটে বলতে লজ্জা পায়। অন্য সব বিষয় না হয় বাদই দেয়া যায়। প্রেম, ভালোবাসা আর পছন্দের কথাই তো মানুষ এখনো মুখ ফুটে বলতে পারে না। বুক ফাটে তবু মুখ ফাটে না অবস্থা। আর অন্যসব কথা কিভাবেই বা বলবে। রিমি ঠিক করে নেয় সারাদিনে আর না পারতে রোদের সামনে সে যাবে না। আজকের দিনটা অন্তত সে রোদকে এড়িয়ে চলবে। পরেরদিন ইতি চলে এলে বেঁচে যাবে মেয়েটা। কিন্তু কপালে দুর্গতি থাকলে যা হয় আর কি। রোদ ফোন রাখার প্রায় ২০ মিনিট পরেই রিমির ডাক পরে রোদের কেবিনে। বেচারি মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে যায়। রোদের কেবিনে যেতে যেতেই সে ঠিক করে নেয়। ইতির বিষয় কিছু জানতে চাইলে বলে দিবে পেট ব্যাথা। তাও আর কিছু জানতে চাইলে বলবে পেট খারাপ তাই পেট ব্যথা। মনে মনে রিমি নিজেকে সাবাসি দিয়ে রোদের কেবিনে প্রবেশ করে বলে,
-স্যার ডেকেছেন?
-হুম গতকাল কিছু ফাইল দিয়েছিলাম সেগুলো কোথায় দাও।
রিমি ফাইলগুলো বের করে রোদের সামনে দিয়ে বলে,
-আর কিছু স্যার?
-নাহ, আর কিছু না যাও।
-ওকে স্যার।
পিছন ঘুরে খুুব সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে রিমি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রোদ পিছন থেকে ডাকে তাকে,
-রিমি।
রিমি সেখানেই থেমে গিয়ে রোদের দিকে ঘুড়ে দাড়ায়।
-ইয়েস স্যার?
-ইতিকে কল দিতে বলেছিলাম। দিয়েছো?
-জ্বি স্যার।
-কি বলল?
-ম্যামের পেটে ব্যথা তাই আসতে পারেনি। বলেছেন কাল চলে আসবেন।
রোদ মনে মনে ভাবে, "হুট করে পেট ব্যথা?" আবার পরক্ষণেই মনে হয় তার "এসময় তো পেট ব্যথা করাটাই স্বাভাবিক"। রোদ রিমিকে৷ বলে,
-প্রয়োজন নেই। ওকে বলে দিও যেন ঠিক মতো বিশ্রাম নেয় আর প্রয়োজনে কালও আসা লাগবে না বেশি খারাপ লাগলে। বলে দিও তুমি।
-ওকে স্যার।
-এখন যেতে পারো।
রিমি আর কিছু বলল না। চুপচাপ রোদের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। কেবিনের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে যায় রিমি। আর ভাবতে লাগে, "এটা কি হলো? এই মানুষটার সব কিছুতে এতো কিউরিসিটি অথচ এই বিষয়ে কিছু জানতে চাইল না কেন?" রিমি নিজেই অবাক হয়ে গেলো। মানুুষ যখন নিজের চরিত্রের বিপরীতে কোন কাজ করে তখন তার আশেপাশের মানুষগুলো হকচকিত হয়। আর হওয়াটাই স্বাভাবিক।
.
পর্ব-৩+৪
Writer : Eti Chowdhury
.
.
.
.
রিমি আর কিছু বলল না। চুপচাপ রোদের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। কেবিনের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে যায় রিমি আর ভাবতে লাগে, "এটা কি হলো? এই মানুষটার সব কিছুতে এতো কিউরিসিটি অথচ এই বিষয়ে কিছু জানতে চাইল না কেন?" রিমি নিজেই অবাক হয়ে গেলো। মানুষ যখন নিজের চরিত্রের বিপরীতে কোন কাজ করে তখন তার আশেপাশের মানুষগুলো হকচকিত হয়। আর হওয়াটাই স্বাভাবিক।
দুদিন পরে ইতি অফিসে আসে। রোদ অফিস ঢুকতেই করিডর দিয়ে যাওয়ার সময় একবার ইতিকে দেখে কিন্তু কিছু বলে না চলে যায়। ইতি তখন রিমির সাথে কথা বলছিলো। উল্টা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় সে রোদকে দেখেনি। রিমি দেখে যেই নড়ে-চড়ে উঠে তা দেখে ইতি বলে,
-কি হলো?
-এমডি স্যার।
ইতি পিছন ঘুড়তে নিয়েও থেমে যায়। হুট করেই দুদিন আগের ঘটনাটা মনে পরে যায় তার। কয়েক মুহুর্তের জন্য তা ভুলে গিয়েছিলো সে।
ইতি নিজের কেবিনে এসে আবার ফোনটা চেক করে কিন্তু রাফসানের ফোন এখনো বন্ধ। গেলো কোথায় সে? অফিসেও দেখছে না সকাল থেকে। রিমিকে জিজ্ঞেস করেছিলো কিন্তু সে কিছুই বলতে পারেনি। হয়ত অফিস আসেনি বা অন্য কোন কাজে বাইরে আছে। কারণ রাফসান কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টের ইন্টারন্যাশনাল সাইডটা দেখে। তাই অনেক সময়ই রাফসানের বাইরে যাওয়া পরে যদিও সব সময় সে ইতিকে জানিয়ে যায়। সময় না পেলে অন্তত একটা ম্যাসেজ দিয়ে যায়। আর গিয়েও যোগাযোগ করে। কিন্তু এবার হলোটা কি। অপেক্ষা করা ছাড়া আপাততো ইতির কিছুই করার নেই। মাথা বিগড়ে আছে মেয়েটার। যে কোন সময় বাস্ট করবে সে। আর এই মেয়েটা যখন বাস্ট করে তখন কোন না কোন অঘটন ঘটিয়েই ছাড়ে। নিজের কেবিনে বসে বসে রাগ কন্ট্রোল করার জন্য পানি খাচ্ছে ইতি খাচ্ছে না পান করছে। যদিও আমরা জানি মানুষ চাইলেও পানি খেতে পারবে না কেবল পান করতে পারবে তাও কথায় আছে না মানুষ সেটাই বলে যেটা বলে সে সাছন্দ্য বোধ করে এতে সে ভুল বলল কি সঠিক সেটা নিয়ে মানুষের মাথা ব্যথা নেই সে তার মন্তব্য বা কথা অপরজনকে বুঝাতে পেরেছে কিনা সেটাই তার জন্য মুখ্য বিষয়। আর পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ কোথাও না কোথায় এই একটা ক্ষেত্রে এক।
কেবিনের দরজায় কড়া নড়তেই ইতি দেখে রিমি,
-এসো রিমি।
-ম্যাম স্যার আপনাকে ডাকছে।
-এমডি স্যার?
-জি।
-আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি।
রিমি বেরিয়ে যেতেই ইতি ভাবনায় পরে যায়। যে মানুষ সব সময় ইন্টার কমে ফোন দিয়ে ডাকে সে আজ অন্য কাউকে দিয়ে খবর পাঠায় ঘটনা কি। বলছিলাম না মানুষ তার ন্যাচারের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কাজ করলে তা আশে-পাশের মানুষগুলোর কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। ইতিরও এখন তাই মনে হচ্ছে। আবার সাথে সাথেই ইতি ভাবে সে হয় বেশি ভাবছে। রিমি তার এ্যাসিসটেন্ট তাকে দিয়ে সে যে কাউকেই খবর দিতে পারে আর সব সময় সে যা করে সেটা যে কখনো পরিবরর্তন হবে না তা নয়। মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। রোদের কেবিনের দিকে যেতে যেতে ইতি আবার ভাবনায় পরে যায়। সেদিনের ঘটনা নিয়ে। সেই প্রসঙ্গে কথা উঠলে কি বলবে সে। ভাবতে ভাবতেই ইতি গিয়ে রোদের কেবিনের দরজার দাঁড়ায়। রোদ তখন উলটো হয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। কথা এমন যে রোদ বলছে,
-এটাই ঠিক হবে। আর ঠিক হবে বলেই বলছি।
-……………….
-এখনো আরো ৫ ঘণ্টা বাকি বাবা তোমাদের যা পিপারেশ নেয়ার নিয়ে নাও। আমি যেহেতু বলছি আজ যাবো তার মানে আজি যাবো আর কোন কথা হবে না। আজ মানে আজই।
-……………….
-কোন তাড়াহুরো হচ্ছে না বাবা। সব কিছুই প্ল্যান মোতাবেক হচ্ছে। তুমি তো জানোই তোমার ছেলে প্ল্যান ছাড়া কোন কাজ করে না।
পিছন থেকে ইতি যতোটা বুঝল রোদ তার বাবার সাথে কথা বলছে। হুট করেই ইতির মনে হয় এভাবে পিছনে দাঁড়িয়ে কারো কথা শুনা ঠিক নয় তার উপর মানুষটা তার কোম্পানির এমডি এটা তো আরো ঠিক হচ্ছে না তাই ইতি রোদের কেবিনের দরজায় বারি দেয়। শব্দ পেয়েই রোদ পিছন ঘুড়ে দাঁড়ায়। ইতিকে দেখে সে ফোনে বলে,
-যেভাবে বললাম রেডি থেকো। আমি রাখছি।
রোদ ফোন রাখতেই ইতি বলে,
-স্যার ডেকেছিলেন?
-হুম। এসো।
ইতি রোদের কাছে যেতেই রোদ একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলে,
-এই ফাইলটা দেয়ার জন্য। রিপোর্টটা একটু জলদি লাগবে।
ইতি ফাইল দেখতে দেখতে বলে,
-ঠিক আছে স্যার। আজ না হলেও আমি কালকের মধ্যে দেয়ার চেষ্টা করছি।
-আজ লাগবে না।
ইতি ফাইল থেকে মাথা তুলে বলে,
-ঠিক আছে কাল পেয়ে যাবেন।
-কাল তুমি দিতে পারবে না।
-সরি?
-কিছু না।
ইতি আর কিছু বলে না। বেরিয়ে যেতে নিয়ে আবার ফিরে দাঁড়ায় সে।একটা কথা রোদকে বলার জন্য তার মাথায় ঘুড়-পাক খাচ্ছে সেই তখন থেকে। ইতিকে আবার ঘুড়ে দাড়াতে দেখে রোদ জিজ্ঞেস করে,
-কিছু বলবে?
-না মানে...
-বলো শুনছি।
-সেদিন...
-সেদিন কি?
-না আসলে...
-আসল না নকল, সেদিন না ঐদিন সেটা তো তুমি কথাটা বললেই বুঝবো। সো এতো না ঘুড়িয়ে বললেই বুঝতে পারি তাই না। আর বলতে না চাইলে ইউ কেন লিভ।
ইতির রাগটা আমার মাথায় উঠে চাপে। সে তার জীবনে অনেক মানুষ দেখেছে কিন্তু এর মতো দেখেনি। আল্লাহ কি একে বানানোর সময় ইমোশন নামক বস্তুটা দিতে ভুলে গেছেন নাকি এর মাঝে ইমোশন নামক বস্তুর পরিমাণ এতোই কম যে তা কাজ করে না। ইতি চট চট করে বলতে লাগে,
-সেদিন আমার হেল্প করার জন্য আপনার এতো দামী ব্লেজারটা নষ্ট না করলেও পারতেন।
রোদ নিজের চেয়ারের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলো আর ইতির অবস্থান গেষ্টের চেয়ারের কাছে। তাদের মাঝে দূরত্ব বলতে বিশাল একটা টেবিল। রোদ সেখান থেকে সরে এসে ইতির সামনে এসে দাঁড়ায়। ইতির চোখে চোখ রেখে বলে,
-আমি কার জন্য কি করব আর কি করব না সেটা হয়ত আমার ডিসিশন কারো থেকে শুনে আমার কিছু করতে হবে না।
রোদের জবাব শুনে ইতির বিগড়ে যাওয়া মস্তিষ্কটা আরো এক দফা বেশি বিগড়ে গেলো। তাই ত্যাড়া ভাবেই সে জবাব দিলো,
-তবু এটার কোন প্রয়োজন ছিলো। আপনার ব্লেজারটা অনেক দামী।
-একি কালার আর ফেবরিক্রের আমি একসাথে তিনটা সুট সেলাই সো একটা নষ্ট হলেও আরো দুটো আছে। ব্লেজারের অভাব পরবে বলে জনে হয় আমার।
দাঁতে দাঁত চেপে ইতি বলে,
-স্টিল আমি নিজের হাতে ক্লিন করে আবার ড্রাইতে পাঠিয়েছি তাও হয়ত আপনি সেটা আর ব্যবহার করতে পারবেন না তাই আমি সেইম কালার আর ফেবরিকের ব্লেজার আপনার জন্য সেলাই করিয়ে দিবো।
কথাটা বলে ইতি বেরিয়ে যেতে নিলেই রোদ পিছন থেকে খোপ করে ইতির হাতটা ধরে ফেলে। আর বলে,
-এমন হাজারটা ব্লেজার সেলাই করার সুযোগ পাবে এখন এসবের কিছুই করা লাগবে না বাসায় গিয়ে রেস্ট করো। আজ এমনিতেও অনেক ধকল যাবে তোমার।
-কিহ?
-যা বললাম তাই করো যাও।
বলেই রোদ ইতির হাতটা ছেড়ে দেয়। রোদের কথার আগা মাথা কিছুই ইতির মাথায় ধরছে না। কি ভুলভাল বকছে কে জানে। রাগে কটমট করতে করতে সে আবার নিজের কেবিনে এসে বসে। ও কেন বাসায় যাবো আর রোদই বা কেন ওকে রেস্ট করতে বলছে কোন কথাই ইতির মাথায় ধরছে না। কোন কারণ ছাড়া কেউ ইতিকে কিছু বললে মেয়েটার একদম সহ্য হয় না। কারণ ছাড়া কেউ কখনো কোন কথা বলে না৷ সবার কথার পিছনে একটা না একটা কারণ থাকেই। এটাই জগতের নিয়ম৷ আর এই নিয়মের ভিতরে আমরা সবাই৷ তাই ইতি অনেক চেষ্টা করছে রোদের বলা কথাটার মানে বুঝতে কিন্তু কিছুই তার মাথায় ধরছে না। যখন হাজার চিন্তা করেও কোন কথার কোন যোগসূত্র ইতি মিলাতে পারছে না তখন গিয়ে আবার রাগটা বেচারা রাফসানের উপরেই পরে। রাগে করমর করে দাঁত কিড়মিরে ইতি নিজের সাথেই বলে,
-সব দোষ তোমার। এবার এলে তোমার ঘাড়ের হলডি একটাও আস্তো রাখবো না দেখেনিও।
এই একটা কথা ইতি খুব ছোট বেলায় শিখেছিলো ঘাড়ের গলডি ভেঙে ফেলবে। ছোটবেলায় প্রায় দুবছর এই কথাটা সে বলতো কিন্তু এর মানে জানত না৷ পরে যখন জানল নিজেই বেক্কল হয়ে গেলো। অথচ না জেনে এই কথা সে কত মানুষকেই না বলেছে। মানেটা জানার পরে আর অভ্যাসটা বদলায়নি। কথাটা এখনো বেফাস ইতির মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর সে বলেও মনে মনে একটা পৈশাচিক আনন্দ পায়। কৃতকর্মে করতে না পারুক অন্তত মুখে তো বলতে পেরেছে।
-যাবো না আমি বাসায়। আমি কেন বাসায় যাবো?
রোদের বলা কথাটাই মাথায় ঘুড়ছে ইতির তাই বিশেষ কাজ নেই তবু এটা সেটা নিয়ে বসে পরল সে। রোদ কেন তাকে কোন কারণ দর্শানো ছাড়া বাসায় যেতে বলল। আর কিসের ধকল কি যাতা বলল লোকটা সেটা সেই ভালো জানে। কিন্তু আজ আর যাই ঘটুক না কেন ইতি সময়ের আগে বাসায় যাওয়া তো দূরের কথা পারলে সময়ের অনেক পরে যাবে সে। সেও দেখতে চায় কি এমন হবে।
রোদ ফাইল থেকে মুখ তুলে দেখে ঘড়ির কাটা প্রায় ৫টা ছুই ছুই অবস্থা। ফাইলটা কমপ্লিট করেই চেয়ারের উপর থেকে কোটটা নিয়ে কাঁধে দিয়ে মিস্টার পার্ফেকসনেস্টের মতো কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাত দুটো প্যান্টের পকেটে দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় রোদ। রোদের বের হবার পথেই ইতির কেবিন পরে। সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় রোদ ইতির কেবিন থেকে আদিকে বের হতে দেখে। আদি বের হবার সময় কেবিনের দরজা খুলতেই বাহির থেকে রোদ দেখে ইতি ভিতরেই আছে। তার মানে রোদ বলার পরেও সে বাসায়নি। রোদ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বেরিয়ে যায়।
প্রায় ৬টা বাজে সেদিকে ইতির খেয়াল নেই। কেবিনের দরজায় কারো শব্দ করায় ইতি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে আদি। ইতিকে কাজে মগ্ন দেখে বলে,
-বালিকে ঘর বাড়ি সব ত্যাগ করে কি সন্নাসী হওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?
-না ভাই এজন্মে সে ইচ্ছে পোষণ করি না।
-তাহলে কয়টা বাজে সেদিকে কি খেয়াল আছে?
ইতি একপলক ঘড়ি দেখে বলে,
-এই যা ৬টা বেজে গেলো প্রায়। সব বের হয়ে গেছে তাই না?
-সবাই তো আর তোমার মতো কাজকে জীবন যৌবন সপে দেয়ার পন করেনি তাই বহু আগেই সব বেরিয়ে গেছে। জীবনটাকে একটু সকাল ১০ থেকে ৫ টার ডিউটির বাহিরে রেখে ইনজয় করার জন্য।
আদির কথা শুনে ইতি হেসে দেয়। হাসতে হাসতেই কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে সে। ইতি বেরিয়ে আসতেই আদি বলে,
-চলো আমি তোমাকে না হয় নামিয়ে দেই।
-না প্রয়োজন নেই ড্রাইভার এসেছে আমাকে নিতে। আর না এলে আমি নিজেই তোমাকে বলতাম আমাকে নামিয়ে দিয়ে আসতে।
-আচ্ছা চলো না হয় অফিসের গেইট অবধি দিয়ে আসি।
-তা অবশ্য করতে পারো।
ইতির আগে থেকেই আদি এখানে চাকরী করছে। ইতি এসে আদিকে পেয়েছে। প্রায় দুবছর হলো ইতি এখানে আছে। অনেক ভালো একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে গেছে তাদের মাঝে। স্কুল, কলেজ আর ভার্সিটির পর আদিই ইতির এতো ভালো বন্ধু। এছাড়া চেনা জানা থাকলেও সবার সাথে তেমন একটা মিশে না সে। সবার সাথে ঘনিষ্টতা খুব কমই তৈরি করে সে।
নিচে নামতে নামতেই ইতি ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে দেয়। অফিসের ইন্ট্রান্সে গাড়িয়ে নিয়ে এসে দাঁড়ায় ড্রাইভার।
বাসার গেইটে এসে কলিংবেল দিচ্ছে ইতি কিন্তু কারো কোন হুদিস নেই। বিরক্তি নিয়ে নিজের ব্যাগে হাত দেয় ইতি৷ সব সয়ম তার কাছে একটা এক্সট্রা চাবি থাকে সেটা বের করার জন্য গেইট খুলবে বলে। কিন্তু ব্যাগে হাত দিয়ে ইতির বিরক্তিটা কয়েক রাশ বেড়ে গেলো। আজই ভুল বশত চাবিটা ব্যাগে নেই এছাড়া সব সময়ই চাবিটা তার সাথে থাকে। পরক্ষণেই আবার মনে পরে ইতির গতকালই সে ব্যাগ পাল্টেছে তাই হয়ত চাবিটা ব্যাগে নেই। বিরক্তি নিয়ে একাধারছে কলিংবেল চাপতে থাকে ইতি। আরো মিনিট দুয়েক পরে ইতির মা মিসেস তামান্না আনজুম এসে দরজাটা খুলে দাড়ায়। মাকে দেখে ইতি মুখ আরো একটু বেশি কালো করে বলে,
-বাসায় কি ডাকাত পরেছে যে ভয়ে কেউ দরজা খুলছো না।
-যতসব অলুক্ষণে কথা।
-তাহলে কোথায় ছিলো এতোক্ষণ লাগলো কেন?
-এটা তোর শাস্তি ছিলো দেড়ি করে বাসায় ফিরার জন্য।
-উফ মা তুমি না...
মিসেস তামান্না আনজুমকে ঠেলে ইতি ভিতরে প্রবেশ করে নিজের রুমের দিকে যেতে নিয়েই আবার থমকে দাঁড়ায়। ড্রইং রুম থেকে ভেসে আসা কন্ঠগুলো ইতির পরিচিত মনে হচ্ছে তাই সে আর নিজের রুমের দিকে না গিয়ে বামে মোড় নিয়ে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ায়। পিছন থেকে মিসেস আনজুম বলেন,
-ঐদিকে কোথায় যাচ্ছিস। আগে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আয়।
ইতি মায়ের কথায় কর্ণপাত না করে ড্রইং রুমে ডুকতেই বেক্কল হয়ে যায়। চোখগুলো ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছে ইতি। এটা সে কি দেখছে। মিস্টার এন্ড মিসেস চৌধুরী সাথে তাদের বদ ছেলেটাও। ইতি সাথে সাথেই বিষম খায়। এমন বিষম খায় সে যে তার হিচকি উঠে যায়। ইতিকে ড্রইং রুমে ডুকতে দেখেই রোদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রোদ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের গায়ের ব্লেজারটা ঠিক করতে করতে ইতির দিকে তাকায়। আর কিঞ্চিৎ মিটমিট করে হাসতে থাকে। রোদকে দেখে ইতির মুখ দিয়ে হুট করেই বেরিয়ে আসে,
-আপনি এখানে কেন?
নিজের কথায় নিজেই জিহবাতে কামড়ে ধরে ইতি। সবার সামনে এভাবে না বললেও পারত সে। রোদ কোন জবাবই দেয় না। ইতিকে দেখে তার বাবা রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল আবু আনজুম আরাফাত বলেন,
-কি ব্যাপার মামুনি কখন থেকে অপেক্ষা করছি আজ এতো লেইট?
-অফিসে কাজ ছিলো বাবা।
বলেই ইতি রোদের দিকে তাকায়। রোদ মনে মনে বলছে, "আমার প্ল্যানের বাইরে একটা কাজও হবে না। আগেও হয়নি, এখনো হবে না। তুমি লেট করে আসো এটাই তো চাইছিলাম। আর তোমার লেট করে আসাটা আমার জন্যই সব চাইতে বেনিফিসিয়াল মাই ডিয়ার উড-বি ডট ডট ডট"।
ইতি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কি বলবে বা কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে বুঝতে পারছে না। ইতির বাবা বলেন,
-যাও তুমি ফ্রেস হয়ে আসো বাহির থেকে এসেছো।
ইতি আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে যায়। ইতি রুমে ঢুকতেই পিছন পিছন তার ভাবী ইস্পৃহাও ডোকে তাকে দেখে ইতি বলে,
-এসব কি?
-একটু পরেই জানতে পারবি। নে এখন রেডি হয়ে নে।
-কিন্তু ভাবী....
-ভাই তোর সব কিন্তুর উত্তর আমি পরে দিবো এখন তৈরী হয়ে ড্রইং রুমে আয় প্লিজ না হলে বাবা আমাকে আস্তো রাখবে না। এমনি তুই কখনো লেট করিস না আজকেই তোকে লেট করা লাগলো। তোর বসের জন্য তোকে কলও দিতে পারছিলাম না। সে বার বার নিষেধ করল বলল সময় মতো তুই চলে আসবি। এই তোর সময় মতো আসা তাদের আসার দেড় ঘন্টা পর। এখন রেডি হয়ে আয় প্লিজ।
কি হচ্ছে কেন হচ্ছে ইতি কিছুই বুঝতে পারছে না। তাই বুঝার বৃথা চেষ্টা করল না। ফ্রেস হতে যাওয়ার আগে আরেকবার ফোনটা হাতে নিয়ে রাফসানের নম্বরটা ডায়েল করে কিন্তু সেই একি অবস্থা ফোনটা বন্ধ। ফোন রেখে ফ্রেস হয়ে রেডি হয়ে আবার ড্রইং রুমে চলে গেলো ইতি। কারণ শত হলেও ইতির বসও তার ফ্যামিলি এসেছে সে না থাকলে কি হয়।
মিস্টার চৌধুরী ব্যাস আড্ডা জমিয়ে ফেলেছেন ইতির বাবার সাথে। ইতি আবার ড্রইং রুমে আসতেই মিসেস চৌধুরী ইতিকে নিজের পাশে নিয়ে বসায়। গাঢ় একটা পিত রঙের সেলওয়ার সুট পরেছে ইতি। সে খেয়ালই করেনি রোদও আজ পিত রঙের সুট পরেছে।
ইতির পরিবারের সাথে রোদের পরিবারের আগের থেকেই পরিচয় আছে। পরিচয় না থাকলে কি এভাবে হুটহাট কেউ আসতে পারে নাকি। যদিও রোদের বাবা অনেক বার বলেছিলো আগে যোগাযোগ করে তাদের সবটা বলে তারপর নাহয় দেখাস্বাক্ষাতের ব্যাপারে আগাতে। কিন্তু এক্ষেত্রে যে বাপ জাহেদ চৌধুরী নয় স্বয়ং রোদ নিজেই। তার এক কথা সে এতো ঢোল পিটাবে না। যা হবার সরাসরি গিয়ে কথা বলেই হবে। তাই হুট করেই আজ এসে উপস্থিত হয় তারা। আর পূর্ব পরিচয় থাকায় বেশি একটা অসুবিধা হয় না। অফিসের বিভিন্ন পার্টিতেই তাদের দেখা হয়েছে। এই যেমন মাস দেড়েক আগেও অফিসের এনুয়াল পার্টিতেও ইতির সম্পূর্ণ র্পরিবার ইনভাইটেড ছিলো এবং তারা সবাই গিয়েও ছিলো। মিস্টার এবং মিসেস চৌধুরী ইতিকে এমনিতেই অনেক আদর করে আর সে হিসেবে তার ফ্যামিলি যথেষ্ট আপপায়ণ পেয়ে এসেছে সব সময়। আর রোদকে ইতির বাবা খুব ভালো করেই চিনি। এক তো মেয়ের বস তার উপর বর্তমান সময়ে একজন ইয়াং বিজনেস টাইকুন হিসেবে পরিচিত সে। আর পাত্র হিসেবে রোদকে কোন বাবাই অপছন্দ করার প্রশ্নই আসে না।
কথার মাঝেই হুট করে ইতির বাবা ইতির মা ও ভাবিকে ডেকে নিয়ে ভিতরের দিকে যায়। ইতি ড্রইং রুমেই থাকে সবাই একসাথে চলে গেলে খারাপ দেখায় এটা ভেবে। কিন্তু সবাই কেন ভেতরে গেলো সেটাই বুঝতে পারছে না। ইতির ভাই তাসিন আনজুম কিছু কাজে বান্দরবন রয়েছে তাই সে আজ উপস্থিত নেই। বাবার মতোই সে আর্মিতে রয়েছে। যদিও ইতির বাবার ইচ্ছে ছিলো মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন কিন্তু মেয়ের আপত্তি থাকায় সে আর মেয়েকে জোর করেননি।
বেশ অনেকটা সময় পর সবাই আবার ড্রইং রুমে ফিরে আসে। কথার এক প্রসঙ্গে ইতির বাবা রোদের বাবাকে বলেন,
-আপনাদের আনা প্রস্তাবে আমাদের আপত্তি নেই।
ইতি বাবার কথা শুনে থ মেরে যায়। কি বলছে কিছু বুঝতে পারছে না সে। রোদের মা সাথে সাথেই বলেন, "আলহামদুলিল্লাহ"। রোদ মনে মনে হাসছে সে জানত এটাই হবে। নিজের উপর তার কনফিডেন্স আছে সম্পূর্ণ। রোদের বাবা বলেন,
-আপনারা চাইলে নিজেদের মতো করে খোঁজ খবর যা নেয়ার নিতে পারেন।
-না তার আর প্রয়োজন নেই। আমরা আগে থেকেই সব জানি। মেয়েকে চাকরী করতে এলাও করেছি তাই বলে সে কোথায় যাচ্ছে কার আন্ডারে কাজ করছে বাবা হিসেবে নিজের পাওয়ারকে কাজে লাগিয়ে যতোটা জানা প্রয়োজন তার চাইতে অনেকটা বেশিই খবর নিয়ে রেখেছি আমি আগেই।
-তাহলে আমাদের আরেকটা কথা আছে।
-জ্বি, অবশ্যই বলুন।
-আমরা ইতিকে আংটি পরিয়ে যেতে চাই আজ যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে তাহলে।
আংটির কথা শুনে যেন ইতির মাথায় বাজ ভেঙে পরল। এতোক্ষণে সে বুঝল আসল ঘঠনা কি। অফিসে রোদের বলা কথার আগা-মাথা সব এখন ইতির কাছে স্পষ্ট। "এই জন্য সে বলছিলো আমার উপর ধকল যাবে" মনে মনে বলছে ইতি। কিন্তু ইতির জন্য আরো এক দফা ধাক্কা অপেক্ষা করছিলো। হুট করেই রোদ দাঁড়িয়ে গিয়ে ইতির বাবাকে বলে,
-আঙ্কেল আমি কিছু বলতে চাই।
-জ্বি, বাবা বলো।
-আসলে আমি বাবার মতো এতো ঘুড়িয়ে পেচিয়ে কথা বলতে পারিনা তাই সরাসরি বলছি। আপনাদের আপত্তি না থাকলে, আপনারা রাজি থাকলে আজি আমি ওকে আংকটি পরাবো আর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ডিলে কাজ করছি যা ইতি নিজেও জানে সেও এই কাজের সাথে জড়িত। আজ প্রথম নয় এরপর আরো বেশ কয়দিন ওর বাসায় ফিরতে লেট হবে। আর ওর একার নয় আমারও লেট হবে। তাই আপাততো তামজাম করে বিয়ে করাটাও পসিবল হবে না। তাই যদি আপনারা রাজি থাকেন তাহলে ১ সপ্তাহ পর জুম্মার দিনে খেজুর খুরমা দিয়ে আপাততো শরীয়ত মোতাবেক আমাদের বিয়েটা হবে আর এই কাজটা হয়ে গেলে পরেই আমরা ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করব। এতে আপনারা রাজি থাকলে আজই আংটি পরানো হবে।
রোদের কথা শুনে ইতি যেন আকাশ ফেটে থেকে পরল। ইতি জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকালে সে বলেন,
-আমি একটু আমার মেয়ের সাথে কথা বলতে চাই।
বলেই ইতির বাবা তাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসেন। ইতি কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না তা দেখে তার বাবা নিজেই বলেন,
-ওরা তোমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। পাত্র হিসেবে রোদ কোন অংশে কম নয়। আমারও তাকে পছন্দ। মেয়ের জামাই হিসেবে এমন ছেলে কে না চায়। আমি টাকা পয়সার কথা বলছি না। অন্য সব দিক দিয়ে সে উত্তম। আদব-কায়দা, আচার-ব্যবহার, চরিত্র সব দিক দিয়ে সে ভালো। আমার এই বিয়েতে কোন আপত্তি নেই। যদিও তোমার কোন পছন্দ থাকতো বা তুমি প্রেম করতে তাহলে হয়ত আমি আপত্তি করতাম বা ভেবে দেখতাম কিন্তু আমি এই খোঁজও রেখেছি তাই আপত্তি করার মতো কোন কারণ পাচ্ছি না। আশা করি তোমার বাবাকে তুমি ফেরাবে না। আর যদি রাজি থাকো তাহলেই বেরিয়ে ড্রইং রুমে এসো। তোমার আপত্তি থাকলে আসার প্রয়োজন নেই। বাবা হিসেবে মেয়ের মনের বিরুদ্ধে আমি কোন ডিসিশন নিতে চাই না।
বলে ইতির মাথায় হাত রেখে ইতির বাবা বেরিয়ে যায়। ইতি সেখানেই বসেছিলো। হুট করে কি থেকে কি হয়ে গেলো সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এমনটা কেমন হলো। রোদ তার পরিবার কবে আর কখন থেকে এসব চলছে। বাবার মুখের উপর না করার সাহস ইতির নেই। এটা নয় যে আপত্তি করলে সে শুনবে না। যে কোন ডিসিশনে মতামত দেয়ার স্বাধীনতা ইতির আছে এটা তার বাবাই তাকে শিখিয়েছেন। কিন্তু এখন ইতি আপত্তি করলে তার বাবা কষ্ট পাবে এটা সে খুব ভালো করে জানে। মাথা কাজ করছে না ইতির। বাবাকে এতো বড় কষ্ট সে কিভাবে দিবে। কিন্তু ঐদিকে বদ রোদটা ১ সপ্তাহ পরেই বিয়ের কথা বলছে। এতো দ্রুত কেন সব কিছু হচ্ছে ইতির সাথে।
অনেকটা সময় নিজের সাথে দ্বিধা দন্দে কাটিয়ে বাবার রুম থেকে বেরিয়ে ইতি ড্রইং রুমে আসে। ইতির আসাতেই সবাই বুঝতে পারে ইতি রাজি। আপাততো রাজি হওয়া ছাড়া ইতির কিছুই করার নাই।
ঘড়িতে রাত ১২টা বাজে। সেই কখন থেকে ইতি রোদের পরিয়ে যাওয়া আংটিটার দিকেই তাকিয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে বস টা কি সত্যি সত্যি তার বর হয়ে যাবে। আংটিটা যেন আঙ্গুলে নয় তার গলার ফাস হয়ে আছে। রাফসানকে বহুবার ফোন দিয়েছে ইতি কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছে না। হুট করে রোদ তাকেই কেন বিয়ে করতে চাইছে। অনেকগুলো প্রশ্ন ইতির মাথায় কিন্তু আপাততো যেটা জানা বেশি প্রয়োজন তা হলো রাফসান কোথায় আর এই খবর একমাত্র রোদই ইতিকে দিতে পারবে। তাই অনেক্ষণ অনেক সাত পাঁচ ভেবে দিবে কি দিবে না করে ইতি দিয়েই দেয় রোদকে ফোন। একবার রিং হতে না হতেই রোদ কলটা রিসিভ করে। যেন সে ফোন হাতে নিয়েই বসেছিলো। ইতির কলটা সে আশা করছিলো। এই কলটা রিসিভ করার অপেক্ষাতেই সে ছিলো। কল রিসিভ করেই রোদ ইতিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলে,
-এতো কিছু না ভেবে মস্তিষ্ককে একটু বিশ্রাম দাও। আর ঘুমিয়ে পরো। ভুলে যেওনা সকালে তোমার অফিস আছে। অফিসে লেট করে পৌঁছালে তোমার ফিওনসি আপত্তি না করলেও বস ব্যাপারটা একদম পছন্দ করবে না। সো গুড নাই।
বলেই একদম ইতিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রোদ কলটা কেটে দেয়। রাগে ইতি দাঁত কামড়াতে লাগে।
.
.
.
.
চলবে.........
বস_বর
পর্ব-৪
Writer : Eti Chowdhury
.
.
.
অনেকক্ষণ অনেক সাত পাঁচ ভেবে দিবে কি দিবে না করে ইতি দিয়েই দেয় রোদকে ফোন। একবার রিং হতে না হতেই রোদ কলটা রিসিভ করে। যেন সে ফোন হাতে নিয়েই বসেছিল। ইতির কলটা সে আশা করছিল। এই কলটা রিসিভ করার অপেক্ষাতেই সে ছিল। কল রিসিভ করেই রোদ ইতিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলে,
-এতো কিছু না ভেবে মস্তিষ্ককে একটু বিশ্রাম দাও। আর ঘুমিয়ে পরো। ভুলে যেওনা সকালে তোমার অফিস আছে। অফিসে লেট করে পৌঁছালে তোমার ফিওন্সি আপত্তি না করলেও বস ব্যাপারটা একদম পছন্দ করবে না। সো গুড নাইট।
বলেই একদম ইতিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রোদ কলটা কেটে দেয়। রাগে ইতি দাঁত কামড়াতে লাগে।
সারারাত ইতির ঘুম হয়নি। কিভাবে হবে। হুট করে এমন একটা ঘটনা ঘটে যাবে সেটা ইতি ভাবতেই পারেনি। আর কিভাবেই বা ভাববে। রোদকে ইতি কখনো ঐ দৃষ্টিতে দেখা তো দূরের কথা ভাবেওনি রোদ সম্পর্কে এমনটা। কিন্তু আজ হঠাৎ কোথা থেকে কী হয়ে গেলো। ইতির এক মস্তিষ্ক একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা ভাবছে আর অন্য মস্তিষ্ক ভাবছে রাফসান কোথায়। সারারাত হন্য হয়ে ইতি রাফসানকে কল দিয়েও পাচ্ছে না। ঘটে ঘাওয়া সমস্ত ঘটনাগুলো নিয়ে চিন্তা করতে করতেই কখন যেন সে ঘুমিয়ে পরে।
ইতি এনিয়ে নিজের কেবিনের সামনে কম হলেও বার পাঁচেক এসেছে। রোদ এসেছে কিনা তা দেখার জন্য৷ কারণ সে যা জানতে চায় তা তাকে শুধু মাত্র রোদ বলতে পারবে আর কেউ নয়। তাই তো সারারাত ঠিক মতো না ঘুমিয়ে সকাল সকাল চোখ খুলতেই কোনো রকমে রেডি হয়ে ইতি অফিসে চলে এসেছে। রোদ সাধারণত এতো লেইট করে না কিন্তু আজ করছে। আর তা দেখেই ইতির প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। ইতির মনে হচ্ছে রোদ আজ ইচ্ছে করে দেরি করছে। ইতি অপেক্ষা করছে বলেই হয়ত সে লেইট করছে।
-সে কি কোন ভাবে আমার মাইন্ড পড়তে পারে নাকি?
আবার মনে হয় কারো মাইন্ড পড়তে হলেও সামনে থাকা লাগে মানুষটার। হয়ত রোদ গতকাল রাতের কলটার জন্য ধারণা করতে পেরেছে যে ইতি তাকে কিছু বলতে চায় আর তাই সে ইচ্ছে করে লেইট করছে। রাতেও কিছু বলতে দেয়নি আর এখন ইচ্ছে করে এমন করছে। সবটাই ইতির ধারণা। তবে রোদ আসছে না দেখে প্রতি মুহুর্তে ইতি অস্তির হয়ে পরছে। ১১ থেকে ১২ বাজে প্রায় রোদ এখনো আসেনি রোদ। আর বসে থাকতে পরছে না ইতি কিন্তু কিছু করারও নেই তার। রোদ না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা তাকে করতেই হবে। কেবিনের দরজায় নক হতেই ইতি দেখে রিমি এসেছে সাথে পিওন। পিওন ইতির টেবিলে মিষ্টি রেখে চলে যায়। মিষ্টি দেখে ইতি রিমিকে জিজ্ঞেস করে,
-হঠাৎ মিষ্টি কেন রিমি? এনি গুড নিউজ? বিয়ে সাদি করছো নাকি?
-জ্বি ম্যাম।
-ওয়াও। কোংগ্রাচুলেশনস।
-কিন্তু আমি না ম্যাম এমডি স্যারের বিয়ে।
ইতি সবেই এক পিস রসে টুইটুম্বুর রসগোল্লা মুখে দিয়েছে আর সাথে সাথে রিমির এমন কথায় তা ইতির মাথায় উঠে যায়। ইতি কাশতে শুরু করে দেয়। ইতিকে এভাবে কাশতে দেখে রিমি ব্যস্ত হয়ে পরে। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয় রিমি। ইতির বিষম লেগে যায়। কষ্ট করে রসগোল্লাটা গিলে ইতি মনে মনে বলে বিয়ে কি আর তার একার বিয়েটা তো আমার সাথেই হবে। বলির পাঠাটা তো আমি নিজেই। আর নিজের বলির মিষ্টি আমি নিজেই খাচ্ছি।
-রসগোল্লা আপনার খুব পছন্দ তাই না ম্যাম?
-হ্যাঁ, হুম খুব পছন্দ।
রিমি চলে যেতে নিলে ইতি পিছন থেকে ডেকে বলে,
-স্যারের কি আজ বাইরে কোথাও মিটিং আছে ?
-না তো ম্যাম কেন ?
-না এমনি। উনি তো কখনো লেইট করে অফিসে আসে না। আজ এতো লেইট করছেন তাই আর কি।
-লেইট করে কেন আসবে? স্যার তো অফিসে আছেন।
-কিহ?
-জি।
-কখন এলেন উনি?
-স্যার আজ অনেক সকালেই এসেছেন সবার আগে। আমি এসে দেখি স্যার অলরেডি চলে এসেছেন।
-ওহ। আমি আরো ভাবলাম স্যার আসেননি।
-কোন প্রয়োজন ছিল কি ম্যাম?
-নাহ তেমন কিছু নয়। কিছু পেপার দেখাবো তাই।
-আমি নিয়ে যাবো কি?
-না প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই যাবো। আমার কিছু বোঝাপড়া আছে।
-কি বললেন ম্যাম?
-না কিছু না। তুমি যাও।
-ওকে ম্যাম।
রিমি চলে যেতেই ইতি হাফ ছেড়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে। আর মনে মনে বলে, লোকটা আজ এতো সকালে এসে বসে আছে আর আমি এখানে বসে পাহারা দিচ্ছি তার আসার।
ইতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে রোদের কেবিনের দিকে যায়।
রোদ নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলো তাই কেউ একজন এসে নক করায় মাথা তুলে না দেখেই তাকে ভিতরে আসতে বলে সে। ইতি রোদের কেবিনে ঢুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রোদ তার সামনে রাখা ফাইলটাতেই মগ্ন। একটা মানুষ এতো মন আর মনোযোগ দিয়ে কাজ করে কিভাবে৷ মাঝে মাঝে রোদকে কাজ করতে দেখলে ইতির মনে হয় তার সামনের মানুষটা আসলে মানুষ নয় কোন রোবট। মানুষ একটুতেই হাঁপিয়ে যায় অথচ এই লোকটা সারাদিন এতো কাজ করেও তার চোখে-মুখে সামান্য ক্লান্তির ছাপ দেখা যায় না। এতো সতেজ থাকে কিভাবে সে। রোদের দিকে তাকিয়ে এসব সাত-পাঁচই ভাবছিলো ইতি। কেউ একজন কেবিনে এসেছে কিন্তু কিছু বলছে না। তিন মিনিট হয়ে গেছে মানুষটা রোদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এবার রোদ ফাইল থেকে মাথা তুলতেই দেখে ইতি তার দিকে তাকিয়ে আছে ভাবলেসহীন ভাবে। মনে হচ্ছে ইতি তার চোখের চাহণি দিয়ে রোদকে গিলে খাচ্ছে। রোদ ফাইলটা রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বুকের উপর হাত জোড়া বেঁধে বসে সেও ইতির দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সেদিকে মনে হয় না ইতির কোন ভাবান্তর আছে। রোদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে সে ইতির এক হাত সামনে তার টেবিলের গেষ্টের বসার চেয়ারে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। হাত দুটো এবার তার পকেটে। ইতির কোন পরিবর্তন না দেখে রোদ এবার একটু কর্কশ কন্ঠে কেশে উঠে। রোদ কেশে দিতেই সাথে সাথে যেন ইতি কেঁপে উঠে। যেন রোদ কাশি দেয়নি ইতির মাথায় বজ্র ফেলেছে। ইতিকে হুট করে এভাবে কেঁপে উঠতে দেখে রোদ হেসে দিতে নিয়েও নিজেকে থামিয়ে ফেলে। এই অফিসে খুব কম মানুষই রোদকে হাসতে দেখেছে। যেটা দেখেছে সেটা বানানো সৌজন্যমূলক হাসি। তাকে মন খুলে হাসতে কেউ দেখেছে বলে মনে হয়। ইতিকে নিজের হুসে আসতে দেখে রোদ জিজ্ঞেস করে,
-সারারাত কি ঘুমাও নি নাকি? চোখ মুখের এই অবস্থা কেন?
আসলেই ইতিকে আজ খুব উস্কখুস্ক লাগছে দেখতে। যেন ঠিক মতো সারারাত ঘুমায়নি সে। বিছানার এপাশ ওপাশ করেই রাত পার করেছে। কিন্তু ইতি অবাক হয় সকাল থেকে কেউ একবারও এটা খেয়াল করেনি কিন্তু রোদ তাকে দেখার সাথে সাথে বুঝে গেলো। লোকটা এতোটা কবে থেকে ফলো করে তাকে। ইতি ভাবনায় পরে যায়। রোদ কি আগে থেকেই ইতিকে এতোটা অবজার্ব করে নাকি গতকাল যা হলো তারপর থেকে। ইতি কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে রোদ আবার বলে,
-কি হলো? জমে গেলে নাকি? আমার এতো হটনেসেও তুমি জমে যাও কিভাবে?
ইতি চোখ-মুখ খিচে নিয়ে রোদের আরো এক ধাপ কাছে এসে বলে,
-দ্যাট নান অফ ইউর বিজনেস।
-ওহ!! রিয়েলি? বাট ইউ নো ওয়াট? আই থিং আই নো মাচ বেটার দেন ইউ ওয়াট ইজ মাই বিজনেস?
ইতি রাগে ফুলতে থাকে। রোদ এমনিতেই অনেক রাগিয়ে দিয়েছে ইতিকে তা সেও জানে। তাই অবস্থা অনুকূলের বাহিরে যাওয়ার আগে তা সামাল দেয়ার জন্য রোদ বলে,
-তা কেন এসেছিলে কিছু প্রয়োজন?
-হ্যাঁ, একটা উত্তর চাই।
-একটার বেশি উত্তর পাবে না বলে দিলাম।
-আপনি উত্তর দিলেই তা বুঝা যাবে।
-বলো শুনছি।
-রাফসান কোথায়?
রোদ মনে মনে এই প্রশ্নটাই এক্সপেক্ট করছিল। সেদিন যখন বাসায় হুট করেই নিজের অজান্তে রোদ বাবা-মায়ের সামনে ইতির কথা বলে ফেলে আর অফিসে এসে ইতিকে পরে যাওয়া থেকে ধরে ফেলে। পরে রোদ স্টোর থেকে বেরিয়ে যেতেই রাফসান আসে। রোদ আবার ফিরে গিয়েছিলো স্টোরে ইতির সাথে কথা বলতে। সেদিন সকালে হুট করেই রোদের মুখ দিয়ে ইতির নামটা বেরিয়ে গিয়েছিল। রোদের কোন প্ল্যান ছিল না। কিন্তু তার একটা বাজে অভ্যাস আছে আর সেটা হলো একবার সে যেই জিনিসে হাত দিয়ে ফেলে তা যে কোন মূল্যে নিজের করে তবেই সে ক্ষেন্ত হয়। আর এতে সে কারো মতামত নেয়ার প্রয়োজনবোধ করে না। তাও সেদিন কথা বলার জন্য রোদ আবার স্টোরে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু স্টোরে ঢুকার আছেই বাহির থেকে সে রাফসানের শব্দ পেয়ে সেখানেই থেমে যায়। বাহিরে দাঁড়িয়েই রোদ রাফসান আর ইতির সব কথা শুনে নেয়। আর ওরা বের হবার আগেই নিজের কেবিনে ফিরে গিয়ে বাবা-মাকে ফোন করে জেনে নেয় ইতিকে পুত্র বধু করতে তাদের কোন আপত্তি আছে কিনা। তারা যখন জানায় তাদের কোন আপত্তি নেই উল্টো ইতিকে তাদের খুব পছন্দ তখনই রোদ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় একদম পাকাপাকিভাবে সে ইতিকেই বিয়ে করবে সেটা বাই হুক অর বাই কুক। আর সেদিন মিটিংয়ে যাওয়ার আগে ইতি আর আদিকে আগে যেতে বলে রোদ রাফসানকেই ফোন করে নিজের কেবিনে ডাকে। সেদিন ইতি আর আদি বেরিয়ে যেতেই রাফসান আসে,
-স্যার আমায় ঢেকে ছিলেন?
-হ্যাঁ, রাফসান এসো।
রোদ একটা এনভালপ রাফসানের সামনে এগিয়ে দেয়। যা দেখে রাফসান বলে,
-এটা কি স্যার।
-খুলে দেখো।
রাফসান এনভালপটা খুলতেই ভেতর থেকে দুটো এয়ার টিকিট বেরিয়ে আসে তা দেখে রাফসান অবাক হয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-এয়ার টিকিট কেন স্যার?
-তোমাকে কোরিয়া যেতে হবে ১৫ দিনের জন্য তাই।
-কোরিয়া কিন্তু কেন স্যার?
রোদ একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলে,
-এই ফাইলটা দেখলেই বুঝবে কেন। আর বাকি ডিটেইলস আমি তোমাকে মেইল করে দিবো। ২ ঘন্টা পরেই তোমার ফ্লাইট তোমাকে এখনি বের হতে হবে।
-দু ঘন্টা?
-হুম, কাজটা জরুরী তাই কিছু করার ছিলো না।
-ওকে স্যার। নো প্রবলেম আমি এখনি বেরিয়ে যাচ্ছি।
-অফিসের গাড়ি নিয়ে যাও।
রাফসান বেরিয়ে যেতে নিলেই রোদ আবার ডাকে,
-রাফসান।
-জ্বি, স্যার?
-এবার আমাদের যোগাযোগ মেইলের মাধ্যমেই হবে। কাজটা অনেক বেশি কনফিডেন্টসিয়াল যার জন্য তোমার নামে কোন সিম রেজিস্ট্রার করা হয়নি। আর তোমার সাথে আমিই যোগাযোগ করব এই কয়দিন। আপাততো কেউ জানবে না তুমি কোথায় গেছো। তুমি ফিরে আসারপর সবাইকে যা বলার আমি বলবো। এখানে তোমার রিটার্ন টিকিটও কাটা আছে। তোমার কোন অসুবিধা হবে না। আর তুমি কোরিয়া গিয়ে পৌঁছালেই আমার লোক তোমাকে রিসিভ করবে এয়ারপপোর্টে। তোমার থাকার সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। তোমার সাথে একজন ২৪ ঘন্টা থাকবে যেন তোমার কোন সমস্যা না হয়।
-ওকে স্যার আপনি একদম নিশ্চিন্ত থাকুন।
রোদ খুব ভালো করেই জানে কোন কাজটা কিভাবে করতে হয় আর কখন করতে হয়। সেদিন সে ইচ্ছে করেই ৪ ঘন্টা সময় নিয়েছিল মিটিং করতে যেন রাফসান যাওয়ার আগে ইতির সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করতে না পারে। ইভেন ইতিও যেন রাফসানের সাথে যোগাযোগ করতে না পারে তাই রোদ সেদিন ইতি, আদি আর রিমিকেও লাঞ্চের জন্য সাথে নিয়ে যায়। কারণ শুধু ইতিকে নিলে ব্যাপারটা সবার দৃষ্টি কটু দেখাবে তাই আদি আর রিমিকে সাথে নেয়া। আর কেবল মাত্র রাফসানকে সরাতেই রোদ যে কাজ মাত্র ২ ঘন্টায় শেষ করতে পারত সেই কাজের পিছনে ৬ঘন্টারও উপরে ব্যয় করেছে। নিজের দামী একটা ব্লেজারও নষ্ট করেছে। কিন্তু এতে রোদের কোন আপত্তি নেই কারণ এইসব কিছুই তার জন্য ইনভেস্টমেন্ট। রোদ মনে করে কোন কিছু এচিভ করতে হলে সেই জিনিসের সাথে রিলিটেড সব কিছুই ইনভেষ্টমেন্ট। আর ইনভেস্টমেন্ট যতো ভালো হবে এর প্রোফিটটাও ততো বেশি হবে আর লাভজনক হবে। আর এই বিয়েটাই রোদের জন্য প্রোফিট। নিজের মুখ দিয়ে নিজের অজান্তে বের হওয়া কথাটাকে বাস্তবে রূপ দেয়াটাই রোদের জন্য সবচাইতে বড় প্রোফিট। আর এই প্রোফিটটার জন্য রোদ এমন হাজারটা দামী ব্লেজার ও হাজারো ঘন্টা ব্যয় করতে পারে। তার প্রোফিটের নমুনা হিসেবে রোদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইতি এখন কেবলমাত্র তার একজন ডেডিকেডেট ইমপ্লই নয় তার বাগদত্তাও। যে আর মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে মিস ইতি আনজুম আরা মিসেস রোদ চৌধুরী হয়ে যাবে আর এটাই রোদের সব চাইলে বড় প্রোফিট।
রোদ ইতির দিকে তাকিয়ে থেকেই সেদিনের ঘটনায় একবার চোখ বুলিয়ে আসে। রোদ একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে,
-যার যেখানে থাকার সে সেখানেই আছে।
রোদের উত্তর শুনে৷ ইতির রাগ ৪৪০ ভোল্টে বেড়ে গেলো। তাও নিজেকে সংযত রেখে ইতি ধৈর্যের সাথে আবার জিজ্ঞেস করে,
-আমি জানতে চাইছি ও এখন কোথায় আছে?
-রাফসান এখন কোথায়? কেন? কি করছে? সব কিছুই কনফিডেন্সিয়াল। আর কোম্পানির কনফিডেন্সিয়াল ব্যাপার আমি যার তার সাথে শেয়ার করতে পারিনা। এটা কোম্পানির রুলস এন্ড রেগুলেশনের বাহিরে। এন্ড ইউ নো এভরি রুলস এন্ড রেগুলেশন অব মাই কোম্পানি মিনস এ লট ফর মি।
ইতি কিছু বলতে নিয়েও থেমে যায় কিছু বলে না। ইতি ভালো করেই জানে রোদ রুলস আর রেগুলেশনের বাহিরে একটা কাজও করবে না আর করাও উচিত নয়। ইতি রোদকে আর কোন জবাব না দিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে রোদ পিছন থেকে ডেকে বলে,
-৪টার সময় রেডি থেকো।
ইতি থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কেন?
-কেন সেটা তোমার ফিওন্সি তোমাকে জানিয়ে দিবে সময় মতো।
ইতির রাগ যেন আরো বেড়ে যায়। আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যায় ইতি।
নিজের কেবিনে গিয়ে রাগ কন্টোল করতে না পেরে ইতি আবার পানি খেতে শুরু করে। রাগে ইতির মনে হচ্ছে পানিটা কারো মাথায় ঢালতে পারলে ইতির মন মেজাজ দুইটাই ঠান্ডা হয়ে যেত নিমিষেই।
৪টা বাজতে আর ১৫ মিনিট বাকি। এমন সময় ইতির ফোনটা বেজে উঠে৷ পেপার চেক করতে করতে ফোন হাতে নিয়েই অবাক হয়ে যায় ইতি। কারণ যে নম্বর থেকে কল এসেছে তা এমডি স্যার লিখে ইতির ফোনে সেইভ করা। রোদ অফিস টাইমে ইন্টার কমে কল না দিয়ে ফোনে কল দিয়েছে ব্যাপারটা ইতির একদম হজম হচ্ছে না। লাস্ট কবে রোদ ইতিকে ফোনে কল দিয়েছিল সেটাও মনে নেই ইতির। ইতি কলটা রিসিভ করতেই রোদ বলে,
-রেডি তুমি?
-মানে? রেডি হবো কেন?
-কেন ভুলে গেলে? বলেছিলাম না ৪টায় রেডি থাকতে।
-কিন্তু কেন?
-সেকি সাতদিন পর বিয়ে শপিং করা লাগবে না নাকি? ডিজাইনারের এপয়েন্টমেন্ট নেয়া আছে। আর আমি লেইট করা একদম পছন্দ করি না।
-সরি আমার কাজ আছে।
-বসকে মেইনটেইন করছো ভালো কথা কিন্তু যার সাথে সাতদিন পর বিয়ে তোমার সেই ফিওন্সিকেও তোমারই মেইনটেইন করা লাগবে অন্য কেউ করবে না। আর অন্য কেউ মেইনটেইন করলে ব্যাপারটা ভালোও দেখায় না। সো গেট আপ। আমি নিচে লবিতে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। ডন্ট বি লেইট।
ইতি কলটা কাটতে নিলে রোদ বলে,
-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার হবু শশুর তোমাকে কল করবে। কিছুক্ষণ আগেই তার হবু জামাতার সাথে তার কথা হয়েছে আর সে জানে তার জামাতা তার মেয়েকে নিয়ে বিয়ের শপিংয়ের জন্য বেরিয়ে গেছে। সো ইউ নো।
.
.৫+৬
পর্ব-৫
Writer : Eti Chowdhury
.
.
.
.
-বসকে মেইনটেইন করছো ভালো কথা কিন্তু যার সাথে সাতদিন পর বিয়ে তোমার সেই ফিওন্সিকেও তোমারই মেইনটেইন করা লাগবে অন্য কেউ করবে না। আর অন্য কেউ মেইনটেইন করলে ব্যাপারটা ভালোও দেখায় না। সো গেট আপ। আমি নিচে লবিতে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। ডন্ট বি লেইট।
ইতি কলটা কাটতে নিলে রোদ বলে,
-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার হবু শশুর তোমাকে কল করবে। কিছুক্ষণ আগেই তার হবু জামাতার সাথে তার কথা হয়েছে আর সে জানে তার জামাতা তার মেয়েকে নিয়ে বিয়ের শপিংয়ের জন্য বেরিয়ে গেছে। সো ইউ নো।
রাগে ইতির নিজের চুল নিজেরই ছিড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আপাততো সে চুলও ছিড়তে পারবে না। সপ্তাহ বাদে বিয়ে তার আর কনের মাথায় চুল থাকবেনা ব্যাপারটা আসলে মানায় না। বেচারি পরেছে দোটানায়। হাতের সামনের ফাইলটাকে তুলে আছাড় দেয় ইতি। তারপর বাধ্য হয়ে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। ইতি আজ পর্যন্ত তার বাবার অবাধ্য কখনো হয়নি সামনেও হবে না। আর যদি সত্যি সত্যি তার বাবা ফোন করে জানতে পারে সে যায়নি ব্যাপারটা আর যাই হোক ইতির জন্য ভালো হবে না। কোন কিছুর বিনিময়ে ইতি তার বাবার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না। আর ইতোমধ্যে ইতির বোঝা হয়ে গেছে রোদ তার বাবার অনেক পছন্দের একজন পাত্র হয়ে গেছে। মেয়ের জামাই হিসেবে রোদকে পেয়ে তার বাবা অনেক খুশি।
ইতি নিচে নেমে বের হতেই মাইক্রো সেকেন্ডের জন্য যেন সে তার হার্টের বিট মিস করে ফেলে। ইতি নিজের অজান্তেই একটা হাত নিয়ে নিজের হার্টের উপর রাখে। রোদকে দেখতে দারুণ লাগছে। চোখে সানগ্লাস দিয়ে একদম সাদা রঙের একটা সুট পরে আছে সে। সাদায় ছেলেদের এতো মানায় ইতির জানা ছিলো না। সাদা সুটে রোদকে এতো দারুণ লাগছে সে যখন চিকেন কাপড়ের ধবধবে সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবি পরবে তখন নিশ্চিয়ই তাকে মারাত্মক লাগবে দেখতে। মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পরবে তার সামনে। এক তো সাদা রঙে ইতির এতো আকর্ষণ তার উপর সে মানে রোদ তার হালকা চাপ দাঁড়ি ওয়ালা ফরসা চেহারায় পরেছে সানগ্লাস। মারাত্মকের চাইতেও মারাত্মক লাগছে তাকে দেখতে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ইতি থমকে গিয়ে রোদকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। হাত দুটো বুকের উপর বেঁধে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। এভাবে দাঁড়ালেও কাউকে দেখতে এতো ভালো লাগতে পারে ইতির জানাছিল না। এই ভালো লাগাটার সাথে যেন সে আজ প্রথম পরিচিত হলো। ইতি সামনের দিকে পা বাড়ায়। ইতিকে আসতে দেখে রোদ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে দাঁড়ায়। ইতির সামনে ফেলা পাটা স্থির হয়ে যায়। সে আরেক দফা নিজের আরেকটা হার্টবিট মিস করে যায় যেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইতি সামনের দিকে এগোয়ও। ইতিকে আসতে দেখে রোদ গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়ায়। ইতি এসে রোদের মুখো-মুখি দাঁড়িয়ে কোন কথা না বলে গাড়িতে ঢুকে যায়। রোদ দরজাটা দিয়ে অন্যপাশে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। ইতি গাড়ির ভিতর থেকেও দেখছিল রোদকে। ইতিকে এমন চুপচাপ দেখে রোদ জিজ্ঞেস করে,
-এনিথিং রঙ?
ইতি মাথা ঝাঁকিয়ে না করে।
-ওকে। ড্রাইভার চলো।
ড্রাইভারকে যেতে বলে রোদ নিজের ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে মনোযোগ দেয়। সময় অপচয় করা রোদ একদমই পছন্দ করে না। ডিজাইনারের ওখানে যেতে ওদের কম হলেও এক থেকে দেড় ঘন্টার মতো লাগবে। দূরত্ব বেশি নয় তবে ঢাকার জ্যাম সম্পর্কে সবার ভালো আইডিয়া আছে। একবার জ্যামে পরলে তা ছুটতে কতক্ষন তা আল্লাহ ছাড়া ভালো কেউ জানে না। তাই এই সময়টা বসে থেকে গাড়ির জানালা দিয়ে অহেতুক জ্যাম না দেখে কাজে লাগানোটাই রোদের কাছে শ্রেয় মনে হয়। রোদ নিজের কাজ করছে। ইতি মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছে সে তো কখনো এর আগে রোদকে এতোটা পর্যবেক্ষণ করেনি তাহলে আজ তার কি হলো। নাকি বিয়ে ঠিক হওয়াতে রোদের প্রতি তার দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টে গেলো। দূর কি সব ভাবছে সে। ইতি আরেকবার রোদের দিকে তাকায় সে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু ইতির তো করার কিছু নেই তাই সে কানে এয়ার ফোন গুঁজে দিয়ে গান শুনলে লাগে সেই সাথে গুন গুন করতে লাগে। ইতির গুণগুনানো রোদের কানে যায়। ইতির কন্ঠের সুরটা বেশ লাগছে রোদের কাছে। রোদ পাশে ঘুরে ইতির দিকে তাকায়। ইতির চোখ পরতেই দেখে রোদ তার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইতি এককানের ইয়ার ফোন খুলে জিজ্ঞেস করে,
-কিছু বলবেন?
-মুখটা কি বন্ধ রাখা যায়? তোমার কাজ নেই তবে আমি কাজ করছি।
ইতি আর কিছু বলে না। মুহুর্তে মেয়েটার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত যে বা যারাই ইতির কন্ঠে গান শুনেছে সবাই খুব প্রশংসা করেছে কিন্তু রোদ উল্টো কি বলল।প্রশংসা নাই বা করত তাই বলে এভাবে বলে কাউকে কোন কিছুতে নিরুৎসাহিত করা ঠিক নয়। ইতি অন্যপাশে ঘুড়ে তাকিয়ে রইল বাহিরের দিকে।
একটার পর একটা ড্রেস দেখেই যাচ্ছে ওরা কিন্তু পছন্দই হচ্ছে না। মিসেস চৌধুরীর শখ তার একমাত্র পুত্র বধু বিয়েতে লেহেঙ্গা পরবে তাই তারা লেহেঙ্গা দেখছে। ইতি যে ডিজাইনেই হাত দিচ্ছে রোদ সেটাই বাদ করে দিচ্ছে। একটাও তার নিজের স্ট্যান্ডার্ডের মনে হচ্ছে না। ইতি নিজেও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে৷ একটা লাল রঙের লেহেঙ্গায় হাত দেয় ইতি তা দেখে রোদ বলে,
-চুজ একোর্ডিং টু মাই স্ট্যান্ডার্ড। তোমার বিয়ে রোদ চৌধুরীর সাথে হচ্ছে চৌধুরী গ্রুপের একমাত্র ওয়ারিসের সাথে আমার কোম্পানির কোন ইমপ্লইর সাথে নয়।
কথাটা বলেই রোদ হাতের ইশারায় একজনকে ডাকে। ইতির ভেতরের রাগটা ধীরে ধীরে আগ্নেয়গিরির রূপ নিচ্ছে। মুখে কিছু বলছে না সে। কখন যে ফেটে পরবে সেই অপেক্ষা। সে যখন ফাটবে রোদকে সহ জ্বালিয়ে ফেলবে মেয়েটা।
রোদের ডাকে মেয়েটা কাছে এসে বলে,
-ইয়েস স্যার।
-এই সব এখান থেকে নিয়ে যাও। আর সব চাইতে এক্সক্লুসিভ শাড়ি দেখাও।
-ওকে স্যার এখনি নিয়ে আসছি।
-ওয়েট।
-ইয়েস।
-ওনলি হোয়াইট কালার।
-বিয়ের জন্য হোয়াইট কালার স্যার?
-ইয়েস৷ ওনলি হোয়াইট।
মেয়েটা চলে যায়। ইতি নিজেও অবাক হয় সাদা রঙের কথা শুনে। অবাক হয়ে ইতি বলে,
-সাদা রঙ?
-হ্যাঁ, কেন আপত্তি আছে?
-আমার কোন আপত্তি নেই তবে মিসেস চৌধুরী বলেছিলেন লাল রঙের কথা।
-মিসেস চৌধুরীটা আবার কে?
-সেকি আপনার মাকে আপনি চিনেন না?
-কয়দিন পর মিসেস চৌধুরী হিসেবে মানুষ তোমাকেও চিনবে সো বুঝবো কীভাবে মিসেস চৌধুরী বলতে তুমি আমার মায়ের কথা বলছো নাকি বউয়ের কথা বলছো। আর আমার মা তোমার জন্য কেবল মিসেস চৌধুরী?
নিজের বলা কথায় নিজেই ইতস্তত বোধ করে ইতি বলে,
-না মানে আসলে এতোদিন তো ম্যাম আই মিন আন্টিকে মিসেস চৌধুরী বলে এসেছি তাই আর কি অভ্যাস.....
-অভ্যাস বদলাও সে তোমার হবু শাশুড়ি কথাটা মাথায় সেট করে নাও। শাশুড়ির পাশ থেকে হবুটা সরতে বেশি সময় বাকি নেই।
অনেকগুলো শাড়ি আনা হয় রোদের দেয়া ইন্সট্রাকশন মোতাবেক। একটা পিওর ইন্ডিয়ান বেনারসি শাড়ি একদম সাদা রঙের প্রথম নজরেই তা রোদের পছন্দ হয়ে যায়। রোদ শাড়িটা ইতির উপরে ধরে ইতিকে দারুণ মানাবে শাড়িটায়। এটাই সিলেক্ট করে রোদ।
আজ ইতির আর রোদের গায়ে হলুদ। যদিও বিয়েটা ইতির বাসায় অনুষ্ঠিত হবে দুই পরিবার আর হাতে গণা কিছু সংখক আত্মীয় থাকবে যারা না থাকলেই নয় আর কি। পারিবারিক ভাবে বাসায় বিয়েটা হলেও গায়ে হলুদ তো হবেই। গায়ে হলুদ ছাড়া কি আর বিয়ে হয় নাকি। যেহেতু সব সাধারণ ভাবেই হচ্ছে তাই গায়ে হলুদ টাও যার যার বাসায় সিম্পল ভাবেই হচ্ছে আলাদা আলাদা। ইদানিং তো আবার চল হয়ে গেছে ছেলে মেয়ের হলুদ একসাথে হয়৷ এসব আদিখ্যেতা রোদের একদম পছন্দ নয় তাই সে সিম্পলভাবে সব করতে বলেছে বাসায়।
ইতি কাঁচা হলুদ রঙের একটা জামদানি শাড়ি পড়েছে। সাথে আসল কাঁচা ফুলের গহনা পরেছে ইতি। দেখতে মাশাআল্লাহ সুন্দর লাগছে ইতিকে। কোমড়ে ফুলের বিছাও পরেছে সে। ইতি ভাবছে এই কোমড়ে ফুলের বিছা পরার আইডিয়াটা কার। কারণ যারই হোক আইডিয়াটা খুব সুন্দর হয়েছে। বেশ লাগছে দেখতে।
গত এক সপ্তাহে ইতি অনেক ভাবেই রাফসানের খবর বের করার চেষ্টা করেছে কিন্তু প্রতিবারই সে বিফল হয়েছে। কোনভাবেই কোন ইনফরমেশন সে বের করতে পারেনি। রোদ চারিদিক থেকেই সব রকম রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে যেন ইতি কোন খবর বের করতে না পারে। আসলে কাঁচা খেলা খেলার অভ্যাস বা রেকর্ড কোনটাই রোদের নেই। তাই ইতি হাজার চেষ্টা করলেও রাফসানকে এখন বের করতে পারবে না। রাফসানের সাথে ইতির কথা বলার খুব প্রয়োজন ছিল কিন্তু মনে হয় সে বিয়ের আগে আর তা পারবে। রোদ চারিদিক থেকেই তাকে ট্রেপ করে রেখেছে।
ইতির গায়ে হলুদ তার বাসার ছাদে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তখন প্রায় ১১টার উপরে বাজে। ইতির ফোনটা বেজে উঠে কিন্তু ইতির দু’হাতেই মেহেদি দেয়া। মেহেদি শুকায়নি। সময় কম হওয়াতে হলুদ আর মেহেদি একসাথেই হচ্ছে ইতির। ফোনটা পরপর দুবার রিং হয়ে কেটে যায়। ফোনটা উপুর হয়ে রয়েছে তাই সে দেখতেও পারছে না কে কল দিয়েছে। ইতি আশেপাশে তাকায় কিন্তু সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। তার কথা শুনার মতো কেউ আশেপাশে নেই। ইতি তার ভাবি ইস্পৃহাকে ডাকে কিন্তু স্পিকারে গান চলায় ইস্পৃহা ইতির ডাক শুনছে না। অনেকক্ষণ ডাকার পর ইস্পৃহার নজর ইতির দিকে পরে তাই সে এগিয়ে আসতেই ইতি চেঁচিয়ে বলে,
-কানে কি তুলা দিয়েছো? কখন থেকে ডাকছি তোমায়।
-কি করব এতো শব্দ। এখন বল ডাকছিস কেন?
-আমার ফোনটা রিসিভ করে দাও কল আসছে সেই কখন থেকে। কে যেন মরে যাচ্ছে আমাকে কল দিতে দিতে।
-এই পাজি মেয়ে এভাবে বলে কেউ।
-আগে দেখো কে এতো কল দিচ্ছে। কার বাড়ি ডাকাত পরল।
ইতি সব সময় এমন ত্যাড়া ত্যাড়া ভাবেই কথা বলে। ইস্পৃহা ফোনের লক খুলতেই দেখে ১০টা মিসডকল। কল লগে গিয়ে ইস্পৃহা বলে,
-ডাকাত না পরলেও এটা ঠিক কেউ মরে যাচ্ছে।
ইস্পৃহার কথার শুনে অবাক হয়ে ইতি বলে,
-মানে?
ইস্পৃহা ফোনটা ইতির দিকে ঘুড়িয়ে ধরতেই সে দেখে রোদের ১০টা মিসডকল। ইতির চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। এক তো এই লোক না পারতে বা প্রয়োজন ছাড়া ইতিকে কল দেয় না আর আজ একে বারে ১০ বার। রোদের নম্বর দেখতে দেখতেই আবার কল আসে তার৷ ইস্পৃহা কলটা রিসিভ করে ইতির কানে ধরে। কল রিসিভ হতেই রোদ বলে,
-কি ব্যাপার কল রিসিভ করতে এতো সময় লাগে কেন? নাকি নিজের গায়ে হলুদে এতোটাই মত্ত্ব হয়ে আছো যে দিন দুনিয়ার কোন খবর নেই।
রোদের কথাশুনে ইতির মাথা বিগড়ে যায়। ইতিও নিজের ত্যাড়ামির বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে বলে,
-আমি না হয় নিজের গায়ে হলুদে মত্ত্ব হয়ে আছি আর থাকতেই পারি দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বিয়ে আমার তাও এতো সিম্পলভাবে হচ্ছে। তা আপনি নিজের গায়ে হলুদ রেখে আমাকে আমাকে কল দিচ্ছেন কেন? নাকি আপনার হলুদ আরো সিম্পল হচ্ছে?
-নিজের বসের সাথে কেউ এমনভাবে কথা বলে জানা ছিলো না।
-মানে?
চমকে যায় ইতি। এই রোদটা যে কখন বস আর কখন ফিওন্সি তাই বুঝতে পারে না ইতি। এই একটা ব্যাপার নিয়ে ইতিকে বেশ জ্বালা পোয়াতে হবে সেটা সে এখনই অনুভব করতে পারছে। ইতিকে চুপ থাকতে দেখে রোদ বলে,
-নিচে দাঁড়িয়ে আছি জলদি এসো।
-কিহ?
অনেকটা চিৎকার করে উঠে ইতি। কিন্তু স্পিকার চলছিল বলে কেউ ইতির চিৎকার শুনতে পায়নি কেবলমাত্র ইস্পৃহা ছাড়া। ইতি বলে,
-কেন?
-কাজ আছে তাই এসেছি। তোমার সাথে প্রেম করতে নয় গ্রো আপ গার্ল। সময় কম জলদি এসো। আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না।
বলেই রোদ কলটা কেটে দেয়। ইতি চোখ বড় বড় করে ইস্পৃহার দিকে তাকায়৷ কাজ আছে বলেই রোদ এসেছে কারণ কাল বিয়ে বলে আজ ভাবি-স্ত্রীকে হলুদের সাজে দেখতে আসার মতো ছেলে রোদ নয়। তাদের তো আর প্রেম বিয়ে হচ্ছে না। বরংচ বলা চলে জোরপূর্বক বিয়ে হচ্ছে। কাজ না থাকলে এখানে এসে রোদ দাঁড়িয়ে থাকত না কখনই। ইতিকে এভাবে তাকাতে দেখে ইস্পৃহা জিজ্ঞেস করে,
-কিরে কি হলো? কি বলল?
-উনি এসেছে?
-মানে?
-মানে স্যার এসেছে।
-সেটা তো বুঝলাম কিন্তু কেন?
-আমি কি জানি কেন। বলল নিচে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে যেতে কি যেন কাজ আছে। বেশিক্ষণ দাঁড়াবেন না এখনি যেত বলল আমাকে। কি করব ভাবি?
-দাঁড়া ভাবতে দে আমাকে।
-জলদি ভাবো ভাবি। নাহলে দেরি হলে আমার খবরই আছে।
-আরে দাঁড়া দাঁড়া ভাবতে দে। পেনিক খাস না আমাকেও খাওয়াস না।
ইস্পৃহা কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
-পেয়েছি চল।
-কিহ?
-শুন
ইস্পৃহা ইতির কানে কানে কিছু একটা বলে তা শুনে ইতি বলে,
-ঠিক আছে।
-উঠ আয়।
ইস্পৃহা ইতিকে নিয়ে স্টেজ থেকে নামতে নিলেই ইতির মা জিজ্ঞেস করে,
-কোথাও যাচ্ছো তোমরা?
ইস্পৃহা খুব ধীরে ধীরে বলে,
-মা ইতির একটু ওয়াসরুম যাওয়া লাগবে তাই নিচে নিয়ে যাচ্ছি।
-ওহহ আচ্ছা নিয়ে যাও। কিন্তু জলদি চলে এসো।
-জি, মা।
ইস্পৃহা শাশড়িকে সামলে ইতিকে নিয়ে বের হতে নিলেই ইতির বাবা জনাব আরাফাত সাহেব ছাঁদের গেইটে ওরে আটকে ধরে,
-কোথায় যাচ্ছো তোমরা?
ইস্পৃহা বলে,
-বা বাবা আমরা....
পিছন থেকে ইতির মা তাদের দেখে ফেলে বলেন,
-ওদের যেত দাও। এখনি চলে আসবে।
-আচ্ছা যাও। দেরি করো না।
একটুর জন্য শশুড়িকে দেখে ইস্পৃহা ঘাবড়েই গিয়েছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইতি বলে,
-ভাবি তুমি বাবাকে এতো ভয় পাও কেন বলো তো?
-বাবাকে ভয় পায় না কে বল তো?
-বাবা তো তোমায় আমার আর সমাপ্তির থেকেও বেশি আদর করে তাও তুমি এতো ভয় পাও তাকে কেন?
-আরে এই ভয় তো সম্মান থেকে আসে। অন্য কিছু নয়। কাল তো বিয়ে তারপর আমিও তোকে জিজ্ঞেস করবনি। চুরি করতে গিয়ে শুশড়ের হাতে ধরা পরলে কেমন লাগে।
-না গো ভাবি আমি তোমার মতো সিচুয়েশনে পরব না। আমার তো আর সাতে পাঁচে কেউ নেই।
-তাও ঠিক বলেছিস।
নিচে নেমেই ইস্পৃহা ইতিকে বলে,
-আমি ভিতরেই আছি তুই কথা বলে আয়। বেশি দেরি করিস না প্লিজ। ধরা পরলে খবর আছে আমার।
ইতি বাইরে গিয়েই দেখে রোদ দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সেই দিনের মতো করেই। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে বুকের উপর হাত বেঁধে। এই লোকটা এভাবেই কেন দাঁড়ায় ইতি বুঝে না। রোদ নিজেও কাঁচা হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেছে। পাঞ্জাবির উপরে একটা চন্দের রঙের কোটি পরেছে সে। এক হাতে রজনীগন্ধার কলি দিয়ে বানানো গাজড়া দিয়ে মুড়ানো রোদের। এতো স্ট্রং পারসোনালিটির একটা মানুষের হাতে ফুল মন্দ লাগছে না অবশ্য। ইতি রোদের দিকে এগিয়ে যায়। রোদ ভালো করে তাকিয়ে থেকে কতক্ষণ ইতিকে দেখে। রোদকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইতি বলে,
-স্যার
-কে স্যার?
ইতি আবার চমকে যায়। বলে,
-মানে?
-মানে তোমার স্যার কোথা থেকে এলো? বস কে এতোটাই মেইনটেইন করছো যে বার বার হবু বরটাকেই ভুলে যাও?
-হবু বর?
-হুম রাত পোহালেই কাল বিয়ে আজ আর ফিওন্সি নামটা ঠিক মানাচ্ছে না। আজ রাতের জন্য হবু বরটাই এপ্রোপিয়েট মনে হচ্ছে।
-আপনি না বললেন কাজ আছে?
-ছিলো। বাদ দিয়ে দিলাম।
-মানে?
-মানে সিম্পল। এসেছিলো তোমার বস বাট এখানে এসে ডিসিশনটা পাল্টে ফেললাম।
-কিসের ডিসিশন?
-বিয়েটা আমার। বউটা আমার। আর সেই আমি ছাড়া দুনিয়ার সবাই তাকে গায়ে হলুদ লাগাবে ব্যাপারটা আমার ইগোতে লাগছিলো তাই নিজের ইগোকে সেটিসফাই করতে ডিসিশন পাল্টে ফেললাম।
ইতি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,
-কি করবেন?
-বেশি কিছু নয়।
বলেই রোদ হাত জোড়া বুক থেকে সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ইতির দুই বাহুতে ধরে নিজের গালের সাথে ইতির গালে ঘষা দিতেই দুজনার গালের সাথে লেগে থাকা হলুদ তাদের জায়গা অদলবদল করে নেয়। সেই সাথে তাদের একে অপরকে হলুদ লাগানোও হয়ে যায়। রোদের গালের সাথে ইতির নিজের গাল লাগতেই ইতি কয়েক মুহুর্তের জন্য নিজের চোখ বন্ধ করে নেয়। রোদের ছোয়া এতোটা কাছ থেকে এর আগে ইতি কখনই পায়নি। রোদের এমন কান্ডে ইতি আরো এক দফা চমকে উঠে। রোদ বলে,
-শুধু আমি হলুদ লাগাব ব্যাপারটা কেমন দেখায় না তাই দুইজনই যেন একে অপরকে লাগাতে পারি তাই করলাম। তুমি তো আর হাত দিয়ে লাগাতে পারবে না তোমার হাতে তো আমার নামের মেহেদি।
রোদের কথা শুনে ইতি নিজের হাতের দিকে তাকায়। আসলেই তার হাতে মেহেদি সে যেন ভুলেই গিয়েছিলো। রোদ এটাও খেয়াল করেছে। রোদ বলে,
-কাজ শেষ এবার যাও। নাহলে কেউ না কেউ তোমায় খুঁজতে খুঁজতে নিচে চলে আসবে। পরে এসে যদি তোমাকে আমার সাথে পায় শেষে ভাববে আমাদের তর সইছে না আর।
কথাটা বলেই রোদ তার বিখ্যাত হাসিটা দেয়। ইতি থ হয়েই আছে। রোদ আবার বলে,
-যাও
-হু, হ জি।
মাথা ঝাঁকিয়ে পিছন ঘুরে ইতি যেতে নিলে রোদ পিছন থেকে ডাকে,
-ইতি
ইতি চট করে পিছনে ঘুরে আর রোদ সাথে সাথে ইতির একটা ছবি তুলে নেয় নিজের ফোনে। ইতি আবার চমকে যায়। একটা মানুষ একি সময়ে কতবার চমকে দেয়ার ক্ষমতা রাখে আল্লাহই জানে। রোদ ফোনটা নিজের পকেটে রেখে এগিয়ে ইতির কাছাকাছি এসে বলে,
-আসছি। কাল আসবো বউ নিতে।
বলেই রোদ তার হাতে জড়ানো রজনীগন্ধা ফুলের গাঁজরাটা খুলে ইতির বেনী করা চুলের খোঁপায় গুজে দিয়ে গাড়িতে উঠে চলে আয়। সে ড্রাইভার আনেনি৷ নিজে একাই এসেছে। ইতি এই প্রথম রোদকে ড্রাইভার ছাড়া দেখল।
ইতি দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। ইতিকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে ইস্পৃহা এগিয়ে আসে,
-কিরে একা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর বস মানে বর কই?
-চলে গেছে।
-তাহলে তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল।
ইস্পৃহা ইতিকে নিয়ে ভিতরে চলে যায়।
.
.
.
.
চলবে.........
পর্ব-৬
Eti Chowdhury
(এম্বিহীনারা গল্প পড়েন।🙄🙄🙄 )
.
.
.
.
-ইতি
ইতি চট করে পিছন ঘুরে আর রোদ সাথে সাথে ইতির একটা ছবি তুলে নেয় তার ফোনে। ইতি আবার চমকে যায়। একটা মানুষ একি সময়ে কতবার চমকে দেয়ার ক্ষমতা রাখে আল্লাহই জানে। রোদ ফোনটা নিজের পকেটে রেখে এগিয়ে ইতির কাছাকাছি এসে বলে,
-আজ আসছি। কাল আসবো বউ নিতে।
বলেই রোদ গাড়িতে উঠে চলে যায়। সে ড্রাইভার আনেনি৷ নিজে একাই এসেছে। ইতি এই প্রথম রোদকে ড্রাইভার ছাড়া দেখল।
ইতি দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। ইতির দৃষ্টি রোদের যাওয়ার দিকে। ইতিকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে ইস্পৃহা এগিয়ে আসে,
-কিরে একা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর বস মানে বর কই?
-চলে গেছে।
-তাহলে তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল।
ইস্পৃহা ইতিকে নিয়ে ভিতরে চলে যায়।
ইতির নিজেকে মাতাল মাতাল লাগছে। না গায়ে হলুদ ছিল বলে সে উল্টা পাল্টা কিছু খায়নি। তার সাথে রোদকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভেবেই নিজেকে মাতাল লাগছে ইতির। আগে তো কখনো এমন হয়নি তাহলে গত একটা সপ্তাহ ধরেই কেন এমনটা হচ্ছে ইতি বুঝতে পারছে না। ইতির এখন রোদকে একটা জটিল গাণিতিক ব্যাখ্যা মনে হচ্ছে যে ব্যাখ্যা সে দিতে পারছে না। প্রশ্নটা এতোই কঠিন যে ইতি বার বার হিসাবে গন্ডগোল পাকিয়ে ফেলছে। ইতি নিজের মাথা নিজেই ঝাঁকি দেয়। তা দেখে ইস্পৃহা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
-কিরে কি হলো? এমন করছিস কেন?
হুট করে ইস্পৃহাকে দেখেও চমকে যায় ইতি। রোদের এমন সব কান্ড ইতিকে এতোটাই চমকে দিয়েছে যে হুটহাট কিছু দেখলেই মেয়েটা চমকে যাচ্ছে এখন।
-কিরে বল?
-কিছু না ভাবি। চুলটা ছাড়িয়ে দাও।
-দিচ্ছি তুই ঘুরে বস।
ইতি ঘুরতে নিলেই ইস্পৃহার চোখ পরে ইতির হাতে।
-ইতুউউউ
ইতির হাত দেখে অনেকটা চিৎকার করে উঠে ইস্পৃহা। তা দেখে ইতি আবার আৎকে উঠে।
-কি হয়েছে ভাবী?
-তোর হাত?
ইতি নিজের হাতের দিকে তাকায় কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। তার হাত স্বাভাবিকই আছে। না কেটে গেছে না ভেঙে গেছে। ইতি ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করে হাত জোড়া ভাবীর মুখের সামনে তুলে ধরে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আমার হাত ভাঙেও নি বা উল্টেও যায়নি। একদম সহিসালামতে জায়গা মতো আছে দেখো।
ইস্পৃহা মুখাটা হালকা বাঁকা করে ইতির হাত ধরে ওর মুখের সামনে নিয়ে বলে,
-তুই দেখ। সব সময় বাজে কথা। হাত ভাঙেও নি বা বাঁকাও হয়নি তা আমিও জানি।
-তাহলে?
-তোর মেহেদীর রঙ দেখ।
ইতি এতোক্ষণে খেয়াল করল।
-দেখেছিস শুকানোর সাথে সাথে এতো রঙ হয়েছে কাল সকাল অবধি আর রাত অবধি কত রঙ হবে ভাবতে পারছি?
-মানে?
-আরে বোকা মেয়ে। মেহেদীর রঙ হলো স্বামীর ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। তোর বর তোকে অনেক ভালোবাসে তাই তোর হাতের মেহেদী এতো রঙ হয়েছে।
ইতি নিজের হাত জোড়া তুলে নিজের মুখের কাছে কিছুক্ষণ ধরে রেখে পর্যবেক্ষণ করতে লাগে। এই মুহুর্তে ইতিকে দেখলে যে কেউ ভাববে সে হয়ত স্কিন বিশেষজ্ঞ নয়ত মেহেদীর রঙ বিশেষজ্ঞ কারণ এমন ভাবে খুটে খুটে কেউ নিজের বিয়ের মেহেদীর রঙ পর্যালচনা করে বলে মনে হয় না। ইতি এমনভাবে নিজের হাত দেখছে যেন তার হাতের মধ্যে রঙের পাইপ আছে সেটা ফেটে বা লিক হয়ে গিয়ে কোথাও দিয়ে রঙ এসে ইতির হাত এতো লাল হয়েছে। তবে বিষয়টা ইতির মস্তিষ্কেও সামান্য আলোড়নের সৃষ্টি করে। এর আগেও তো ইতি মেহেদী দিয়েছে কই তখন তো মেহেদী শুকানোর সাথে সাথে এতো রঙ হয়নি আজ কেন হলো? ইতিকে কিছু একটা ভাবতে দেখে ইস্পৃহা মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,
-দেখলি তো?
ইতি মুখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কি দেখব?
-তোর বরটা তোকে অনেক ভালোবাসে।
ইতি এবার ম্যাসেঞ্জারের সেই ইমুজিটার মতো চোখ জোড়া উপরের দিকে তুলে ইস্পৃহার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, "ভালোবাসে আর সে? তার মতো হার্টলেস মানুষ হয় নাকি? চিনো না তো জিনিসটা কি তাই ভাবছো এসব ভালোবাসা। হুহ,, এই লোকটাকে আমি খুব ভালো করেই চিনি"। আবার ইতি ভাবনায় পরে যায় আসলেই কি সে রোদকে চিনে? মনে তো হয় না। কারণ যে মানুষটাকে ইতি প্রায় দু'বছর ধরে দেখে আসছে তার সাথে গত এক সপ্তাহের মানুষটাকে ইতি কোনভাবেই মিলাতে পারছে না। ইস্পৃহা ইতির চুল ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে যায়। আর ইতি ভাবনায় ব্যস্ত হয়ে যায়।
রোদ সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে তা এ্যাস ট্রে তে গুঁজে দিয়ে বারান্দা থেকে বেডরুমে আসে। পাঞ্জাবির উপরে পরা কোটিটা অনেক আগেই সে খুলে ফেলেছে। এখন পাঞ্জাবিটা খুলতে নিবে আর এমন সময় রোদের ফোনের নোটিফিকেশন টিউনটা বেজে উঠে। রোদ পাঞ্জাবিটা না খুলেই প্যান্টের পকেট থেকে তার মোবাইল ফোনটা বের করে। তার একটা মেইল এসেছে তাও তার সিক্রেট মেইলে। রোদ তার সিক্রেট কাজের ক্ষেত্রে প্রতিটা কাজের জন্য একটা করে আলাদা আলাদা মেইল এ্যাকউন্ট মেইনটেইন করে যার এ্যাকসেস কেবল রোদের কাছেই থাকে। ইভেন সেই কাজের সাথে জড়িত ব্যাক্তি ছাড়া সেই মেইল সম্পর্কে কেউ জানবে না। কাজ শেষ ঐ মেইল এ্যাকাউন্টও শেষ। রোদ ফোনের লকটা খুলে সোজা মেইলের ইনবক্সে যেয়ে দেখে মেইলটা রাফসান করেছে। রোদ মেইলটা অপেন করে।
সারারাত ইতির বিশেষ একটা ঘুম হয়নি। শেষ রাতে চোখ লাগলেও ফজরের আযানে আবার উঠে যায় মেয়েটা। জীবনটাকে নতুন করে শুরু করতে যাচ্ছে তাই নামাজ পড়বে না তা কি হয় নাকি। নামাজ পড়ে ইতি বারান্দায় এসে বসে থাকে। ভোর হওয়া দেখল আজ অনেকদিন পর। ভোর দেখাটাও ইতির প্রিয় কাজের মধ্যে একটি। হুট করেই যখন নিশ্চুপ, নিশাচর পৃথিবীটা একটু একটু করে আলোকিত হতে থাকে সেই সাথে পাল্লা দেয় নানারকম পাখির কিচিরমিচির শব্দ। অসম্ভব ভালো লাগায় ছেয়ে যায় তখন ইতির মনটা। আজো ছেয়ে গেছে তবে মনের কোণে কোথাও সামান্য একটু বিষন্নতা বিরাজ করছে ইতির। সেটা আর কিছু বা কারো জন্য নয় রাফসানের জন্য। ইতি রাফসানের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল বা অনেক ভালেবাসতো তাকে ছাড়া থাকতে পারবে না বা তারা প্রেম করত ব্যাপারগুলো এমন নয়। সেই কলেজে থাকতেই কলেজের ফেমাসবয় রাফসানের প্রতি ইতির মনে কিছু অজানা অনুভূতির জন্ম হয়েছিল কিন্তু তারা ভালোবাসা ছিল না। ভালোবাসা কি এতো সোজা বা সহজ নাকি যে যেখানে সেখানে হয়ে যাবে। তবে সেটাকে বড়োজোর ভালোলাগার নাম দেয়া যেতে পারে। ইতির ভালো লাগত রাফসানকে। কিন্তু রাফসান ছিল ফেমাসবয়। অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়েদেরকেই সে মুখের উপর না বলে ফিরিয়ে দিতো তাই ইতি কখনো আগ বাড়িয়ে রাফসানকে কিছু বলেনি। সাধারণ হাই/হ্যালো ছাড়া কিছুই ছিল না তাদের মাঝে এমন কি আহামরি বন্ধুও ছিল না। কেউ কখনো তাদেরকে একে অপরের আশেপাশে ঘুর-ঘুর করতে দেখেনি। তারপর ইতি বাবার ট্রান্সার হয়ে গেলো তাই ইতিও চলে গেলো। তারপর তাদের আর কখনো কোনো যোগাযোগ হয়নি। অনেক বছর পর রোদের কোম্পানিতে একবছর আগে ওদের আবার দেখা হয়। সেখান থেকে নতুন সূচনা। তবে তা এখনো বেশি দূর গড়ায়নি। আর তার আগেই সেই গল্পটার ইতি হয়ে ইতির জীবনে রোদের প্রখরতার এক নতুন উপন্যাস রচনা শুরু হয়ে গেছে। সেই উপন্যাসের ইতিটা ইতির জানা নেই। তাই রাফসান আসলে কি দিয়ে ইতি কি শুরু করবে আর কীভাবেই তাকে সবটা বলবে তা শুনে রাফসানই বা কিভবে রিয়্যাক্ট করবে এসব ভেবেই ইতির বিচলিত লাগছে। ইতি আশা করে রাফসান বুঝবে। ছেলেটা অনেক বুঝদার এটা ইতি জানে। যে কোন ঘটনা বা সিচুয়েশন রাফসান হ্যান্ডেল করতে জানে আর ইতি যে তার প্রেমিকা নয় তা রাফসানও জানে তাই আহামরি কোন রিয়্যাকশন রাফসান দিবে না সেটা ইতিও জানে। যা হবে হয়ত এই মুহুর্তে যে খারাপ লাগাটা বা একটা কিঞ্চিৎ অপরাধবোধ ইতির কাজ করছে এমনি একটা খারাপ লাগা রাফসানেরও কাজ করবে তবে তা সাময়িকী কারণ স্থায়ী কোন সম্পর্ক ইতি আর রাফসানের মাঝে ছিল না কখনো।
ইতি বারান্দার রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। হুট করেই বেখেয়ালে এদিক সেদিক তাকাতেই ইতির বাসার সামনের রাস্তায় চোখ যায়। ইতির চোখ সেখানেই থমকে যায়। মোটামোটি দূরত্বে একজনকে দেখছে ইতি। দূর থেকে মানুষটার বডি সেইপ ইতির কাছে রোদের মতো লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে ট্রাউজার প্যান্ট সাথে সিলিভলেস হুডিওয়ালা টি-শার্ট পরে জগিং করছে তবে তার দৃষ্টি এদিকেই। যেন সে ইতিকেই দেখছে। ইতি বারান্দা দিয়ে মাথা বের করে আশে পাশে দেখার চেষ্টা করে পাশের বারান্দায় বা উপরে নিচে কেউ আছে কিনা যদিও কিছু দেখা যাচ্ছে না তাও ইতি বৃথা চেষ্টা করে। আবার সামনে তাকাতেই দেখে মানুষটা চলে যাচ্ছে। ইতি আবার নিজেকে ঝাঁকি দেয়। গত কিছু দিন রোদকে নিয়ে সে বেশি বেশি নয় অতিরিক্তের চাইতেও অতিরিক্ত ভাবছে তাই হয়ত এখন তার হ্যালুসেনেশন হচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলে রীতি আছে হলুদের পরে মানে বিয়ের আগে গোসল দেয়ার। বর্তমানে ঢাকার শহরেও এসব করতে দেখা যায় তবে আগে তা কেবল গ্রামাঞ্চলেই হতো। সমাপ্তি ইতির ছোট বোন। ইতির বাবা-মা ভেবেছিলেন ইতির জন্মের পর আর কোন সন্তান নিবেন না তাই ইতির নাম দিয়েছিলেন ইতি যার অর্থ শেষ। কিন্তু আল্লাহর মর্জির আগে কিছুই নয়। তাই তাদের ইচ্ছা না থাকলেও সমাপ্তি চলে আসে। তাই তারা পরের জনের নামও সমাপ্তি দেন এর অর্থও শেষ। মূলত সমাপ্তির বায়নাতেই ইতির গোসলের আয়োজন করা হয়। সমাপ্তির একটা মাত্র বোন তার বিয়ে এভাবে হচ্ছে কোন ধুমধাম ছাড়াই তাই তার আবদার গোসলের অনুষ্ঠান করতেই হবে। ইতির বাবা বড়াবড়ই ছেলে মেয়েদের কথা ভাবেন তাই এবার তিনি ছোট মেয়ের মন রক্ষার্থে কোন আপত্তি করেননি। গোসলের আয়োজন করা হয়। রোদের পরিবারকে আসতে বলার কথা হলে তারা জানায় এমনিতেই দুপুরে বিয়ে তাই সকাল ৯টার দিকে এসে আবার গিয়ে বর নিয়ে আসতে যদি দেড়ি হয়ে যায় তাই তারা জানিয়ে দেয় যেন ইতির পরিবার নিজেরাই ইতির গোসল দিয়ে দেয়। সকাল ৯টায় ইতিকে গোসল দেয়া হয়। রোদের পরিবার থেকে কেউ আসতে পারেনি ঠিকি কিন্তু আদি আর রিমি এসেছিল। এই দুইজন মানুষ এই বিয়েটা নিয়ে বিপাকে পরে গেছে তারা বরের সাইডে নাকি কনের সাইডে সেটাই ঠিক করতে পারছে না। তাই চুপচাপ দুই সাইডেই তারা ইনজয় করছে। অফিস থেকে আর কেউ থাকছে না কেবল আদি আর রিমি ছাড়া। আদি আর রিমির থাকাটাও রোদের নির্দেশ। কেউ ইতির গোসলে আসতে পারবে না দেখে রোদই আদি আর রিমিকে পাঠিয়েছে ওদের তরফ থেকে অংশ নিতে। ইতির গোসল প্রায় শেষ। এখন তো হলুদটা মানুষ কেবল নামেই দেয়। মূলত চন্দনটাই বেশি ব্যবহার করে। তাই সামান্য হলুদের সাথে চন্দন মিলিয়ে ইতিকে সবাই মন মতো মাখিয়ে দেয়। যেন সবাই যার যার মনের খোব মিটাচ্ছে বিশেষ করে বিবাহিতরা। যাদের বিয়ের সময় তাদেরকেও এভাবেই সবাই চন্দন দিয়ে স্নান করিয়েছিল তারা ইতিকে আচ্ছা মতো চন্দন মাখাচ্ছে। তারপর সবাই মিলে কলস দিয়ে ইতির মাথায় পানি ঢালে। সবাই পানি ঢেলে নিজেরাও পানি নিয়ে ছিটাছিটি করে কিছুক্ষণ। একে একে সব নিচে চলে যায় ছাদ থেকে। বেশি সময় নেই সবাইকে রেডিও হতে হবে। বেশি মানুষও নেই হাতে গণা ক’জন মাত্র সবাই নেমে গেলে ইস্পৃহা ইতিকে নিয়ে নামতে নিলে রিমি বলে,
-ভাবি একটু শুনবেন?
-হ্যাঁ রিমি বলো।
-আমার সাথে একটু আসুন প্লিজ।
ইস্পৃহা ইতির দিকে তাকায় বলে,
-তুই দাঁড়া আমি আসছি।
রিমি ইস্পৃহাকে নিয়ে নিচে চলে যায়। ইতি অনেকক্ষণ একা একাই ছাদে দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্তি ধরে যায় ইতির আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে সে। ভেজা শরীরে কি এতো সময় দাঁড়িয়ে থাকা যায় নাকি তাও আবার শাড়ি পরে। আর দু'মিনিট দেখবে ইতি ইস্পৃহা না এলে সে একাই নিচে নামে যাবে আর নিচে গিয়ে আচ্ছা মতো ভাবিকে গালমন্দ করবে সে। মেজাজটাই খিটমিটে হয়ে গেছে ইতির। দু'মিনিট ভেবেও আরো পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে ইতি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় আর অপেক্ষা করতে পারবে না সে। অনেক অপেক্ষা করেছে এখন একাই নেমে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ইতি দু'হাতে ভেজা শাড়িটা ধরে ছাদের দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই পাথরের মতো জমে যায়। দিনে-দুপুরে ভুত দেখার মতো তাকিয়ে থাকে ইতি। রোদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এই লোক এখানে কি করছে৷ রোদকে দেখে ইতি হিচকি উঠে যায়। হুট করে ইতিকে হিচকি দিতে দেখে রোদ হেসে দিতে নিয়ে নিজেকে সামলে ফেলে। হাসাটা হয়ত ঠিক হবে না। সকাল সকাল মেয়েটাকে সে ৮৮০ ভোল্টে ঝটকা দিয়েছে এতে কিছুতো প্রতিক্রিয়া আসবেই স্বাভাবিক। রোদ ছাদের দরজার সাথে নিজের বাম সাইড হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত জোড়া বুকের উপর ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে৷ রোদকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে ইতি ভাবার কোন কুলকিনারা পায় না। তার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে যায় তখন ঐ সময়ের জন্য। ইতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোদ সামনে এগিয়ে এসে ইতির মুখো-মুখি দাঁড়ায়। রোদকে কাছে আসতে দেখে ইতি আজ সত্যি সত্যি জমে যায়। আজ তো জমে যাওয়ার কারণও আছে। ভেজা শরীরে অপ্রত্যাশিত কিছু দেখলে জমবে না তো কি গলে মোম হয়ে যাবে নাকি। ইতি কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না আর রোদ কিছুই বলছে না। ইতির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে এর মাঝেই। তাও সে কষ্ট করে এক বার ঢোক গিলে গলাটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে এতে বিশেষ কাজ না হলেও ইতির গলা দিয়ে শব্দ বের হয়। ভাঙা ভাঙা কন্ঠে ইতি বলে,
-আ..আপ আপনি এখানে?
রোদ ইতির দিকে আরেক কদম এগিয়ে খানিকটা ঝুঁকে আবার দাঁড়িয়ে বলে,
-গোসলটা আমার বউয়ের তাই গোসল করানোর দায়িত্বটাও আমারই।
কথাটা বলতে বলতেই রোদ ইতির দু'গালে অনেকগুলো চন্দন মাখিয়ে দেয়। আর কথাটা শেষ করেই কলস তুলে ইতির মাথায় পানি ঢেলে দেয়। ইতির মাথায় পানি পরতেই সে চোখ বন্ধ করে নেয়। রোদের পানি ঢালা শেষ হতেই ইতি চোখুলে ফ্যালফ্যাল করে রোদের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা ধূষর রঙের শুতি পাঞ্জাবিতে দারুন লাগছে তাকে দেখতে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে রাতে তার ভালো ঘুম হয়েছে। ভালো ঘুম হলে মানুষের চোখ-মুখ দেখলেই তা বুঝা যায়। এখন রোদকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার ভালো ঘুম হয়েছে। রোদ পানি ঢালা শেষ করে কিছুক্ষণ ইতির দিকে তাকিয়ে থেকে ইতির দিকে আগায়। অনেকটা এমন ভাবে যেন সে ইতিকে জড়িয়ে ধরবে তা দেখে ইতি একপা পিছিয়ে যেতে নিলে রোদ থেমে যায় সাথে ইতিও থেমে যায়। রোদ চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী? ইতি মাথা ঝাঁকিয়ে জানায়, না কিছু না? কারো মুখে কথা নেই। রোদ আবার ইতিকে জড়িয়ে ধরতে নেয় এবার আর ইতি নড়ে না জায়গা মতো জমে বরফ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু রোদ ইতিকে অবাক করে দিয়ে ইতিকে একদমি জড়িয়ে ধরে না। কেবল ইতির দুইপাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরার মতো করে পিছনে হাত নিয়ে যায় আর একপাশ দিয়ে তাকিয়ে ইতির আঁচল দিয়ে নিজের হাত মুছে নেয়। হাতে লেগে থাকা চন্দনগুলো ইতির আঁচলে মুছে নেয় সে। হাত মুছে সরে আসে রোদ। ইতিকে সে স্পর্শ করেনি। রোদ ইতিকে আর কিছু না বলে চলে যেতে নিলে ইতি বলে,
-আপনা আমাকে গোসল দিতে এসেছিলেন?
রোদ থেমে গিয়ে ইতির খানিকটা কাছাকাছি এসে বলে,
-বউ আমার তাকে দুনিয়া সুদ্ধ লোক গোসল করাবে ব্যাপারটা ঠিক আমার হজম হচ্ছিল না তাই নিজেরটা নিজেই করতে চলে এলাম। আমি আবার নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করাতে পছন্দ করেনি।
রোদের কথা শুনে ইতির মেজাজটা আরো খিটমিটে হয়ে গেলো। এর চাইতে সে রোদকে কিছু জিজ্ঞেসই না করত তাহলে বেশি ভালো হতো। রোদ ইতির কানের কাছে মুখ এনে বলে,
-আর মাত্র কয়টা ঘন্টা তারপর তুমি.....
কথাটা শেষ না করেই রোদ বেরিয়ে যায়। রোদ ছাদের দরজা দিয়ে নিচে নেমে যেতেই তার কয়েক মিনিট পরেই ইস্পৃহা ফিরে আসে সাথে রিমিও। ইতির পার্লারে যেতে হবে দেরি হয়ে যাচ্ছে। ইতি থ মেরেই থাকে কিছু বলে না। আর দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে ইস্পৃহাও ইতিকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না। আদি আর রিমিকে পাঠানো। ইস্পৃহাকে রিমির নিয়ে যাওয়া সবটাই রোদের প্ল্যান করা।
বিয়ে যেহেতু কেবল বাসায় হবে দুই পরিবারের উপস্থিতিতে খুরমা-খেজুর দিয়ে তাই রাতের প্রোগ্রাম না করে রোদ দুপুরের সময় করতে বলে। অবশ্য দুপুরে বিয়ে পড়ানোর পিছনে তার বাবা-মাকে দেয়া অন্য কারণ ছিল রোদের। বিয়ে কখন পড়ানো হবে ইতির পরিবার থেকে জানতে চাইলে মিস্টার চৌধুরী, মিসেস চৌধুরী আর রোদকে জিজ্ঞেস করে কখন সময় দিবে। তখন মিসেস চৌধুরী রোদের মা বলেছিলেন এখন যেহেতু গরমের সময় রাতে বিয়ে পড়ানো হলেই ভালো হবে। কিন্তু তাতে বাদ সাধে রোদ। তার এক কথা বিয়ে দুপুরেই পড়ানো হবে। আর এর কারণ জানতে চাইলে সে তার বাবা-মাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়৷ সন্ধ্যায় তার একটা মিটিং আছে তাই তার লেইট হয়ে যাবে আর তখন যদি তার নিজের বিয়ে সে নিজেই এটেন করতে না পারে দেখা যাবে সবাই বসে আছে বিয়ে পড়ানোর জন্য কিছু বর নিজেই অনুপস্থিত ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না। রোদের এমন কথা শুনে মিস্টার ও মিসেস চৌধুরী হাসবে না ছোলের উপর রাগ দেখা সেটাই বুঝতে পারে না। কিন্তু ছেলের সাথে তারা পারবেন না সেটাও তারা জানেন আর এমন কথা তো ইতির পরিবারকেও জানানো যাবে না তাই তারা নিজেদের মতো করে ব্যাপারটা সামলে নেয়৷ আর বিয়ে পড়ানোর সময় দুপুরেই ধার্য করা হয়।
বিয়ে বাসায় হোক বা বাহিরে। অনেক জাঁক যমক ভাবে হোক বা ছিমছাম বিয়ে তো বিয়েই। আর জীবনে তা একবারই হয়। এই দিন তো আর বার বার আসবে না। ইতি সেভাবে এই বিয়েতে একদম রাজি নয় আবার তার আপত্তিও নেই তাই সে কেন এই কফিউশনের জন্য নিজের বিয়ের সাজ নষ্ট করবে৷ তাই কোন কিছুতে বাঁধা না দিয়ে ইতি ইস্পৃহার সাথে পার্লারে চলে যায়। বৌ সেজে আসতে আসতে ইতির পোনে ১ টা বেজে যায়। ইতি এসে শুনে বর পক্ষ অলরেডি চলে এসেছে। এই কথা শুনে ইতি মনে মনে বলে, "এতো তাড়া লোকটার যে জুম্মার নামাজটাও এখানে এসেই পড়তে হলো। কেন নামাজ পড়েও তো রওনা দিতে পারত। কি জানি কি চলছে তার মাথায়"। ইতি নিজের রুমের আয়নার সামনে বসে আছে। রোদের পছন্দ করা শাড়ি পরে। ধবধবে সাদা শাড়ি। শাড়িটাতে ইতিকে এতো মানিয়েছে যা বলার মতো নয়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো এই শাড়িটার সাথে একটা সাদা রঙেরই ওড়না ছিল মাথায় দেয়ার জন্য কিন্তু ইতির মাথায় লাল রঙের ওড়না। ওড়নার অদল-বদল কখন হলো সে জানেই না। তার সামনেই তো সাদা শাড়ি সাথে সাদা ওড়না একটা সেট ছিলো সেটাই নিয়েছিল রোদ। তাহলে সে কখনই বা সাদাটা পাল্টে লালটা নিলো ইতি তা দেখেনি। কিন্তু যখনই করুক না কেন ইতিকে দেখতে বেশি লাগছে। ইতি ক্ষণে ক্ষণে আয়নায় দেখে নিজেকে কল্পনা করছে। তার মাথায় সাদা ওড়নাটা থাকলে তাকে এতো সুন্দর লাগত কি না। এই লাল ওড়নাটা যেন তার বৌ সাজের সৌন্দর্যকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। লাল রঙটার হয়ত একটা আলাদা রূপ আছে। সেজন্যই হয়ত সেই আদিকাল থেকে মানুষ বিয়ের কনের জন্য লাল শাড়ি কিনত, এখনো পরে অনেকেই লাল রঙ। তবে কাল, পাত্র আর পছন্দ ভেদে এখন অনেকেই অন্যসব রঙও ব্যবহার করে যার উদাহরণ স্বরূপ ইতি নিজেই বিয়ের কনে সেজেছে একটা সাদা বেনারসী পরে। তবে নিজেকে দেখে সে অবাক হচ্ছে এই লাল ওড়নাটার জন্য। মনে মনে ইতি বলে, “লোকটার পছন্দ আছে বলতে হয়”। বলেই ইতি মুচকি হেসে দেয়। এই হাসির কারণ ইতির জানা নেই। কারণটা কি ইতির নিজেকে দেখতে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে সেজন্য নাকি রোদের করা পছন্দ দেখে। কারণ আয়নায় ইতি যাকে বৌ সেজে দেখছে সেই মেয়েটাও রোদেরই পছন্দ।
.
.৭+৮
পর্ব-৭
Eti Chowdhury
.
.
.
.
কাল, পাত্র আর পছন্দ ভেদে এখন অনেকেই অন্যসব রঙও ব্যবহার করে যা উদাহরণ স্বরূপ ইতি নিজেই বিয়ের কনে সেজেছে একটা সাদা বেনারসী পরে। তবে নিজেকে দেখে সে অবাক হচ্ছে তার মাথায় দেয়া লাল ওড়নাটার জন্য। মনে মনে ইতি বলে, " লোকটার পছন্দ আছে বলতে হয়"। বলেই ইতি মুচকি হেসে দেয়। এই হাসির কারণ ইতির জানা নেই। কারণটা কি ইতির নিজেকে দেখতে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে সেজন্য নাকি রোদের করা পছন্দ দেখে। কারণ আয়নায় ইতি যাকে বৌ সেজে দেখছে সেই মেয়েটাও রোদেরই পছন্দ।
জুম্মার নামাজ শেষ করে কাজীসহ বাসায় চলে আসে সবাই। সবাই চলে আসতেই বর এসে বর এসে করে সমাপ্তি ইতির রুমে ছুটে আসে। ইতির অনেক বেশি নার্ভাস লাগছে। নার্ভাসনেসে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। কিছুক্ষণ পরেই ইস্পৃহা আর সমাপ্তি আসে ইতিকে ড্রইং রুমে নিয়ে যেতে সেখানেই বিয়ে পড়ানো হবে। ইতির মনে হচ্ছে তার বুকের ভিতর কেউ হাতুড়ি পেটা করছে। অনেক জোরে জোর পিটাচ্ছে কেবল শব্দ হচ্ছে কোন ব্যথা অনুভব করছে না ইতি। ইস্পৃহা আর সমাপ্তি ইতিকে নিয়ে ড্রইং রুমে ডুকতেই রিমি বলে উঠে,
-ম্যাম এসেছেন।
ইতিকে আসতে দেখে সবাই পিছন ঘুরে তাকায়। সবাই ইতিকে দেখায় ব্যস্ত। রোদ বসা থেকে দাঁড়িয়ে খানিকটা এগিয়ে এসে ইতির সামনে হাত মেলে ধরে। ইতি একবার রোদের দিকে তাকায়, একবার রোদের হাতের দিকে তাকায়, আবার সবার দিকে তাকাচ্ছে। সবার দৃষ্টি তখন রোদ আর ইতির দিকে। এভাবে সবার সামনে হাত ধরতে লজ্জা করছে ইতির আবার ভাবছে না ধরলে সবার সামনে রোদকে অপমান করা হবে। আর এই লোকের যে ইগো ভাবতেই চমকে উঠে ইতি। তাই সাত পাঁচ আর না ভেবে চোখ বন্ধ করে রোদের হাতে হাত রাখে ইতি। মনে মনে ভাবে সেও দেখছে না অন্য কেউও দেখছে না। অনেকটা কাকের মতো৷ মস্তবড় ড্রইং রুমের পুরোটাই ফ্লোরে সবার ব্যবস্থা করা হয়েছে বিয়ে পড়ানোর জন্য। সবাই সেখানই দুই ভাগ হয়ে বসেছে। একপাশে কনে পক্ষ আরেকপাশে বর পক্ষ। মাঝে এক হাত দূরত্ব রেখে পাশাপাশি দুটো কুশন রাখা হয়েছে রোদ আর ইতির বসার জন্য। রোদ ইতিকে বাম পাশে বসিয়ে দিয়ে সে ইতির ডান পাশে বসে পরে। সবার উপস্থিতিতেই বিয়ে পড়ানোর কাজ শুরু হয়। প্রথমে মেয়ের বিয়ে পড়ানো হয়। স্বাক্ষর করার সময় বার দুয়েক ইতির হাত কেঁপেছিল। দুবারই সে রোদের দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু রোদের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখতে পায়নি ইতি। পিছন থেকে ইস্পৃহা ঠেলে দিতেই ইতি একবার বাবা, মা, ভাই, বোনের দিকে তাকিয়ে স্বাক্ষর করে দেয়। ইতির পরে রোদকে স্বাক্ষর করতে দেয়া হলে সে হরহর করে স্বাক্ষর করে দেয়। না কারো দিকে তাকায় না এক সেকেন্ড সময় নেয় কিছু ভাবার জন্য। রোদকে এভাবে স্বাক্ষর করতে দেখে ইতির মনে হয় লোকটা এতো কনফিডেন্ট একবার মনে হলো না সময় আছে আরেকবার ভেবে দেখি কিরকম হরহর করে স্বাক্ষর করে দিলো। যেনো কোন ডিল সাইন করছেন সে। বিয়ে পড়ানো শেষ হলে সবাই খুরমা-খেজুর দিয়ে মিষ্টি মুখ করে। ইতি ঝট করে পাশে ফিরে রোদের দিকে তাকায়। একটু আগেও এই মানুষটা কেবল তার বস ছিলো আর কয়েক মুহুর্ত পর সে এখন ইতির বস বর মানে বসও সে আর বরও সে। ভাবতেই অবাক লাগছে ইতির। সত্যি কি বিয়েটা হলে গেলো। নাকি স্বপ্ন দেখছে ইতি। বাস্তবতা গুলিয়ে ফেলছে সে।
বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে শুরু হয় খাওয়া দাওয়ার পর্ব। বেশি দেরি করবে না বউ নিয়ে বেরিয়ে যাবে ওরা। খাওয়া দাওয়া শেষ হলেই ফটোগ্রাফার চেপে ধরে ইতি আর রোদকে ছবি তোলার জন্য। ইতির এতে কোন আপত্তি নেই কিন্তু সে ভাবে হয়ত রোদ আপত্তি করবে ছবি তোলা নিয়ে। এসব কিছু আবার রোদের পার্সোনালিটির সাথে যায় না। কিন্তু ইতি অবাক হলো তখন যখন ফটোগ্রাফার একবার বলার সাথে সাথেই রোদ এসে ইতির পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
-কিভাবে দাঁড়াবো?
রোদ পিছন থেকে ইতির কাঁধে একটা হাত দিয়ে বলে,
-এভাবে চলবে? আর ছবি কি সব ইনডোর তুলবেন নাকি আউট ডোরও তুলবেন?
ইতি রোদকে যতো দেখছে ততোই অবাক হচ্ছে। একটা মানুষের ঠিক আর কতকগুলো রুপ দেখা বাকি আছে ইতির। ইতি এখন নির্ঘাত বুঝতে পারছে এই মানুষটা তাকে প্রতিনিয়ত চমকে দেয়ার বিশেষ ব্যবস্থা করছেন। ফটোশুটের দিকে ইতির মনোযোগ নেই সে রোদকে দেখছে। হুট করেই রোদকে দেখতে তার কাছে দারুণ লাগছে। অনেক বেশি সুন্দর আর ভালো লাগছে ইতির রোদকে দেখতে। এতোক্ষণ সে খেয়ালই করেনি তার সাথে মিল রেখে একটা সাদা রঙের সেরওয়ানি পরেছে রোদ। আজ পর্যন্ত রোদকে ওভার কিছু পরতে দেখেনি ইতি। সব সময় যে কোন অকেশন, পার্টি বা যে কোন ক্ষেত্রেই রোদকে খুব সিম্পল থাকতে দেখেছে ইতি। রোদের সেন্স অব ড্রেসিং চমতকার। যে কোন পার্টিতে নিজেকে ফোকাস করতে জানে সে। আজকেও ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। এই প্রথম রোদকে সেরওয়ানি পরতে দেখে ইতি। অবশ্য ছেলেরা নিজের বিয়ে ছাড়া খুব একটা সেরওয়ানি পরেও না। তবে অন্য সবার মতো অনেক বেশি গর্জিয়াস কোন সেরওয়ানি সে পরেনি। খুবই সিম্পল একটা সেরওয়ানি পরেছে রোদ যার কাঁধের কাছে হালকা লাল রঙের বর্ডার করা। সেই বর্ডারটাই বলে দিচ্ছে ইতির সাথে মিল রেখে রোদ সেরওয়ানি পরেছে। তাকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে দেখতে। ইতির ইচ্ছে করছে এভবেই সে রোদকে দেখুক। আজ এই মুহুর্তে রোদকে দেখতে ইতির একদম বিরক্ত লাগছে না। চোখের পলক না ফেলে ইতি তাকিয়ে আছে রোদের পানে। অনেকটা সময় নিয়েই ইতি রোদকে দেখছে৷ হুট করে ইতি নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেয় মনে মনে, "হুট করে আমার হলো কি? এর আগে তো কখনো তাকে এভাবে দেখেনি আমি। তাহলে আজ কি হলো হুট করে। এতো দেখছি তাও আরো দেখতে ইচ্ছে করছে কেন"। নিজেকে ঝাঁকি দেয় ইতি নিজেই।
প্রায় ৪ টা বাজে সময় হয়ে গেছে কনে বিদায়ের। ইতি তার বাবাকে জড়িয়ে ধরেই রেখেছে ছাড়তে চাইছে না কিছুতেই। ইতির চোখে পানি টলটল করছে। ইতির বাবা রোদের হাতে ইতির হাত দিয়ে বলে,
-আমার মেয়েটাকে দেখো বাবা।
-জ্বি।
রোদ ইতির পাশে দাড়ানোর সময় পেয়েছে অনেকক্ষণ পর। অনেকটা সময় ধরেই রোদ চেষ্টা চালাচ্ছিল ইতিকে কিছু বলার কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিল না। এতোক্ষণে সুযোগ পেয়েছে সে। রোদ ইতির একদম গা ঘেষে দাঁড়িয়ে হালকা ইতির দিকে ঝুঁকে বলে,
-কান্নাকাটির পর্ব জলদি শেষ করে নাও। আমার হাতে সময় কম। এখান থেকে গিয়ে আমার একটা মিটিং আছে। সো...
রোদের কথা শুনে ইতি মাথা তুলে রোদের দিকে তাকায়। এমন একটা সময়ে মানুষটা এমন কথা বলল কিভাবে। একটা মেয়ে তার জন্য নিজের পরিবার, বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সব ছেড়ে চলে যাচ্ছে আর তার কাছে এখন মিটিংটা বেশি। ইতির ইচ্ছে করছে কড়া একটা জবাব দিয়ে দিতে কিন্তু এই মুহুর্তে সে তা করছে পারছে না। জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ইতি মনে মনে ভাবে পরে এর সোধ সে নিবে। আপাততো চুপ থাকাই শ্রেয়। ইতি কিছুতেই যেতে চাইছে না একপ্রকার জোর করেই তাকে গাড়িতে তুলে দেয়া হয়েছে। গাড়িতে উঠার পর ইতি একটা কথাও বলেনি রোদের সাথে। এমনকি রোদ নিজেও কিছু বলেনি। ইতির চোখ দিয়ে পানি পরছে। কাঁদছে সে কিন্তু মুখে কোন শব্দ করছে না। রোদ নিজের ল্যাপটপে মন দিয়েছে। শব্দ করে কাঁদলে যদি রোদ আবার কিছু বলে তাই ভেবে মুখ চেপে রেখেছে ইতি। আপাততো রোদের কেন ত্যাড়া কথা ইতির শুনতে ইচ্ছে করছে না।
-এতো কান্নাকাটির কি হলো? তোমাকে তো দূরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছি না। তোমরা মেয়েরা পারোও বোটে। এতো চোখের পানি আসে কোথা থেকে তোমাদের।
ইতি ঝট করে রোদের দিকে তাকায়। আজ সকালে দেখা রোদ আর এই রোদের মাঝে বিশাল ফারাক অনুভব করছে ইতি এই মুহুর্তে। দুইটা মানুষ কি এক কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধায় ভুকছে সে। বাসায় পৌঁছে ইতিকে গেইটের সামনে রেখে রোদ তরতর করে বাসার ভিতরে চলে যায়। রোদকে এভাবে চলে যেতে দেখে মিসেস চৌধুরী বলেন,
-সেকিরে তুই কোথায় যাচ্ছিস? তোদের দুজনকে তো একসাথে বরণ করব।
-অপেক্ষা করো মা আমি আসছি।
আসছি বলে রোদ উপরে চলে যায়। প্রায় ১০ মিনিট পরেই আবার সেরওয়ানি পাল্টে সুট পরে নিচে নেমে আসে রোদ। এসেই আবার বাহিরে বেরিয়ে যেতে নিলে মিসেস চৌধুরী বাধ সাধেন।
-কোথায় যাচ্ছিস তুই?
-আমার একটা মিটিং আছে মা।
-মিটিং আছে মানে? নতুন বউ দাঁড়িয়ে আছে আমরা তোদের বরণ করব না?
-করো না করল কে? নতুন বউ তো ও আমি না।
-মানে কি রোদ? কোথাও শুনেছিস শুধু বউকে বরণ করতে?
-শুনিনি বলে যে কেউ করবে না তা তো নয় তাই না? যেটা এর আগে হয়নি সেটা আজ হবে। সো প্লিজ মা।
বলেই রোদ হনহন করে বেরিয়ে গেলো। মিসেস চৌধুরী হা করে তাকিয়ে রইল ছেলের কান্ড দেখে। একটা মানুষ কাজকে এতোটা প্রায়োরেটি দিচ্ছে যে নতুন বউকে দরজায় রেখেই চলে গেলো। ইতি হা করে সব দেখতে লাগল। এতে অবশ্য ইতি বিশেষ একটা অবাক বা হতাশ কোনোটা হয়নি। রোদ চোধুরী এমন একজন মামুষ যার কাছে এটা এক্সপেক্ট করাই যায়। অন্যদের ক্ষেত্রে অবশ্য এটা ভাবা যায় না। কিন্তু তার জন্য এটা অতিসাধারণ ব্যাপার। অগত্যা বাধ্য হয়েই ইতিকে বরণ করতে হলো মিসেস চৌধুরীর।
.
.
.
.
চলবে.........#বস_বর
পর্ব-৮
Eti Chowdhury
.
.
.
.
রোদ হনহন করে বেরিয়ে গেলো। মিসেস চৌধুরী হা করে তাকিয়ে রইল ছেলের কান্ড দেখে। একটা মানুষ কাজকে এতোটা প্রায়োরেটি দিচ্ছে যে নতুন বউকে দরজায় রেখেই চলে গেলো। ইতি হা করে সব দেখতে লাগল। এতে অবশ্য ইতি বিশেষ একটা অবাক বা হতাশ কোনোটাই হয়নি। রোদ চোধুরী এমন একজন মানুষ যার কাছে এটা এক্সপেক্ট করাই যায়। অন্যদের ক্ষেত্রে অবশ্য এটা ভাবা যায় না। কিন্তু তার জন্য এটা অতিসাধারণ ব্যাপার। অগত্যা বাধ্য হয়েই ইতিকে বরণ করতে হলো মিসেস চৌধুরীর।
রাত ৯ টা বাজে প্রায়। রোদ এখনো বাসায় ফিরেনি। তাই পরবর্তী কোন আনুষ্ঠানিকতাই করা হয়নি। ইতিকে বরণ করেই মিসেস চৌধুরী রোদের রুমে নিয়ে যায়। খুব গুছানো একটা বিশাল মাস্টার বেড রুম। সাথে এটাচ করা বিশাল বেলকনি ও বিশাল বাথরুম সেই সাথে চেঞ্জিং রুমও রয়েছে। ইতিকে যখন রুমে দেয়া হয় তখন মিসেস চৌধুরী চলে যেতে নিলে ইতি পিছন থেকে ডাকে,
-মিসেস চৌধুরী।
অবাক হয়ে তিনি পিছন ঘুরে বলেন,
-মিসেস চৌধুরী!!
-সরি আসলে অনেকদিনের অভ্যাস তো তাই। আর হবে না।
-বেটার আর যেন না হয়। লোকে শুনলে হাসবে। বউ শাশুড়িকে মিসেস চৌধুরী বলে ডাকছে। আর এখন তো তুমি নিজেও মিসেস চৌধুরী।
শাশুড়ির এমন কথায় স্মিত হাসে ইতি। হেসে বলে,
-আন্টি মানে মা। মা বলছিলাম কি আমি কি একটু ফ্রেস হয়ে নিবো?
-একটু বলছো কি পুরোটাই ফ্রেস হয়ে নাও। তোমার যা বর সে কখন আসে তার নেই ঠিক। আর বাকি আচার-অনুষ্ঠান ও এলেই হবে। আর অনিশ্চিত সময় ধরে কি তুমি ওর জন্য অপেক্ষা করবে নাকি এই পোশাকে। কোন প্রয়োজন নেই। গোসল দিয়ে কাপড় বদলে নাও। আমি আসছি একটু পর।
মিসেস চৌধুরী বেরিয়ে যেতে নিলেই ইতি আবার ডাকে,
-মা।
-হ্যাঁ বলো?
-বলছিলাম কি আমার সুটকেসগুলো? আসলে গোসল করে কি পরব তাই।
মিসেস চৌধুরী হেসে দিয়ে বলেন,
-সুটকেস পরে খুললেও হবে। তোমার পরার কাপড়ের অভাব হবে না তুমি যাও। বাথরুমে বাথ টাওয়াল সবই আছে গোসল সেরে এসো। তুমি বের হবার আগেই আমি তোমার চেঞ্জিং রুমে তোমার পরার জন্য কাপড় দিয়ে দিচ্ছি সাথে যা যা লাগবে সব দিয়ে দিবো।
ইতি মাথা ঝাঁকিয়ে ঠিক আছে সূচক সায় দিয়ে বাথরুমে চলে যায়।
ভাগ্যিস তখন বুদ্ধি করে ইতি শাশুড়ির থেকে অনুমতি নিয়ে গোসল দিয়ে কাপড়-চোপড় বদলে নেয়। নাহলে এতোটা সময় তাকে সেইসব ভারী শাড়ি, গহনা পরে বসে থাকতে হতো। আর সেইসব পরে থাকলে এতোক্ষণে ইতি গুণে গুণে কম হলেও নিম্নে ৪ বার ফিট হয়ে যেত। প্রথম দিন হিসেবেও মিসেস চৌধুরীকে শাশুড়ি হিসেবে মন্দ লাগছে না ইতির কাছে। মানুষটা ভালোই খেয়াল রাখছে ইতির এতো কিছুর মাঝেও। ইতি গোসল দিয়ে রুমেই বসে ছিলো। অনেক ক্লান্ত লাগছিল। রোদের বিশাল নরম বিছানাটা যেন বার বার ইতিকে ডাকছিল তার মাঝে গা টাকে এলিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু নতুন বউ যদি এভাবে বেহায়ার মতো বেড রুমের দরজা দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পরে তাহলে সারাজীবন সব বিয়েসাদির অনুষ্ঠানে ইতিকে এই কথাই শুনতে হবে সে নিজের বিয়ের দিন শশশুড়বাড়ি এসেই ঘুম। এমন অপবাদের বোঝা ইতি নিজের কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়াতে পারবে না তাই কষ্ট হলেও বসে থাকে সে।
কিছুক্ষণ পরেই মিসেস চৌধুরী এসে স্ট্রং এক কাপ কফি দিয়ে যায় ইতিকে। শাশুড়ির এতো আদর করে দেয়া কফিটা না খেলে কি হয়। তবে ইতির মনটা কেমন কেমন করছিল চায়ের জন্য কিন্তু নতুন হওয়ায় কাউকে কিছু বলতেও পারছে না সে। এমনকি এখন উঠে কিচেনে গিয়ে নিজে চা বানাতেও পারছে না। শত হলেও নতুন বউ শাশুড়ি অনুমতি না দেয়া অব্দি ইতি কিভাবেই বা যাবে কিচেনে রান্না করতে। তাই কফির কাপেই চুমুক দেয় সে। কফিটা স্ট্রং অনেক। এতো স্ট্রং কফি ইতি খায় না তবে এই মুহুর্তে বেশ লাগছে তার কাছে। আহা..চুমুকেই যেন শান্তি। আসার পর থেকে একাই বসে আছে ইতি৷ অবশ্য একা বলা যায় না। একটু পর পর এ ও এসে দেখে যাচ্ছে। কথা বলে যাচ্ছে। আর মিসেস চৌধুরী মানে ইতির শাশুড়ি তো আসছেনই বার বার কিছু লাগবে কিনা দেখার জন্য।
বাসায় ঢুকতে ঢুকতে রোদ হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে ৯ টা বেজে ৩০ মিনিট হয়ে গেছে। বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই মায়ের সম্মুখীন হয় রোদ।
-তোর আজকেও লেইট করা লাগল?
-কাজ ছিল মা।
-কাজ! ঘরে তোর সদ্য বিয়ে করা বউ বসে আছে রোদ।
-বউ সারাজীবন থাকবে মা। বউ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। বিয়ে তো করেছিই সারাজীবন পাশে থাকার জন্য।
-তাহলে কি ডিলটা পালিয়ে যাচ্ছিল?
-এইতো বুদ্ধিমানের মতো কথা বললা। ডিলটা আজ না হলে কখনোই হতো না। অন্যরা মুখিয়ে আছে ডিলটার জন্য। আর আমি আমার বাড়াভাত কাউকে দেই না। তা তো জানোই।
-তুই এমন কেন হয়েছিস? তোকে জন্ম দেয়ার সময় কি খেয়েছিলাম আমি আল্লাহই জানেন। তোর বাবাও তো এমন নন।
রোদ আর মায়ের কথা জবাব না দিয়ে উপরে যাওয়ার জন্য সিড়ির দিকে যায়। সিড়িতে পা দিতে নিয়ে থেমে গিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে ইতিকে ডাকে রোদ।
-ইতিইইই..
-আসছিইই স্যারর..
ইতি একা একাই বসেছিল। হুট করে রোদের ডাকে ডানে বামে না তাকিয়ে এক দৌড়ে নিচে নেমে আসে। শেষ সিড়িটায় এসে রোদের মুখো-মুখি দাড়ায় ইতি। হালকা গোলাপী রঙের একটা জামদানী শাড়ি তার পড়নে। সাথে কানে, গলায়, হাতে সব ভারী গহনা খুলে হালকা স্বর্ণালংকার পরেছে। দেখতে একদম গৃহবধূ লাগছে ইতিকে। ইতির চোখে মুখে স্নিগ্ধতার ছোয়া ফুটে আছে। তবে চোখ জোড়া জানান দিচ্ছে তারা ক্লান্তির কথা। ইতি নিজের দাঁত দিয়ে ঠোঁটের একটা সাইড চেপে ধরেছে। এমনটা আজ নতুন নয় এর আগেও দেখেছে রোদ ইতিকে করতে। এমন করে যে মেয়েটা কি মজা পায় আল্লাহই জানে।
-ইয়েস স্যার?
-স্যার!!
নিজের কথায় নিজেই থতমত খেয়ে যায় ইতি। কি থেকে কি বলে ফেলল নিজেই জানে না। এতো দিনের অভ্যাস কি আর এক বেলায় যায় নাকি। এতোকাল তো সে বসই ছিল। হুট করে এক সপ্তাহর ব্যবধানে বস টা যে বর হয়ে যাবে তা কি আর ইতি জানত নাকি। ইতি লক্ষ করে আশেপাশে অনেকেই আছে। এমন দৌড় দিয়েছে মাথার গোমটাটা কিঞ্চিৎ পরে গিয়েছে তার। গোমটা ঠিক করতে করতে ইতি বলে,
-না মানে আসলে ডেকে ছিলেন আমায়?
-না ডাকলে কি এখানে আসতে তুমি?
"আবার লোকটার ত্যড়া কথা শুরু। এর সমস্যা কি আমার সাথে। সহ্য না হলে বিয়ে করল কেন আমায়?" জোরে বলার আপাততো অবস্থা নেই তাই মনে মনেই বলে কথাগুলো ইতি।
-জ্বি, বলেন।
রোদ ইতির হাত ধরে টেনে নিয়ে বাসার দরজায় গিয়ে দাড়ায়।
-মা।
মিসেস চৌধুরী এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
-আবার কি হলো? এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন তোরা?
রোদ তখনো ইতির হাত ধরে রেখেছে ছাড়েনি। ইতি একবার হাতের দিকে তাকায় আবার রোদের দিকে তাকায়।
-কেন তখন তো বেশ বরণ করবে বলে চিৎকার করলে।
-বউ তো বরণ করেই নিয়েছি।
-বর ছাড়া বউ বরণ হয় শুনেছো কোথাও?
রোদের কথায় মিসেস চৌধুরী আর ইতি দুজনই ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
-এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই আবার বরণের ব্যবস্থা কর। বিয়ে তো আর তোমার পুত্রবধূর একা হয়নি। তোমার পুত্রেরও হয়েছে। তাই দুজনকেই বরণ করা লাগবে।
ছেলের সাথে তিনি পারবে না তা মিসেস চৌধুরী জানেন তাই আর কথা না বাড়িয়ে দুজনকে আবার একত্রে বরণ করে নিলেন। এক হিসেবে ভালোই হয়েছে। আধা সম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। মিসেস চৌধুরী দুজনকে মিষ্টিমুখ করিয়ে ভেতরে নিয়ে যান। এই বাড়ির নিয়মানুযায়ী বর বউ বরণের পর তারা একে অপরকে আংটি পরায়। এ কথা শুনে ইতি পরে যায় বিপাকে। সে তো এই নিয়ম সম্পর্কে জানত না। এখন কি হবে? সে তো রোদের জন্য কোন আংটি কিনে আনেনি। মনে মনে ভেবে ফেলে ইতি সেকি ভাইকে ফোন দিয়ে বলবে এখনি একটা আংটি কিনে পাঠাতে। ইতির মুখটা চুপসে গেছে। সবার সামনে এখন কি লজ্জাতেই না পরতে হবে তাকে। সবার চক্ষু আড়ালেই রোদ হালকা ইতির দিকে ঘেষে বলে,
-কাউকে কিছু বলতে হবে না।
ইতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। রোদ আদিকে ডাকে। আদি এসে ছোট একটা ব্যাগ ইতির দিকে বাড়িয়ে ধরলে সেটা কি তা জানতে চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে ইতি। আদি বলে,
-ম্যাম আপনি যে স্যারের জন্য রিং অর্ডার করেছিলেন এটা সেটাই।
ইতি হা হয়ে থাকে সে কখন রিং অর্ডার করল। আর আদি আজ তাকে সোজা ম্যাম বকছেন কেন?
-নাও।
রোদ নিতে বলায় ইতি ব্যাগটা নিয়ে খুলে ছোট একটা রিং এর বক্স বের করল। হোয়াইট গোল্ডের সিম্পল একটা রিং। যা রোদের পার্সোনালিটির সাথে একদম মানায়। যাকে এক কথায় বলে পারফেক্ট ম্যাচ। ইতিকে আর সবার সামনে কোন লজ্জায় পড়তে হয়নি। রোদ সময় মতো সব সামলে নিয়েছে। ইতিকে যে আংটিটা রোদ পরিয়েছে সেটা ডায়মন্ডের এক পাথরের আংটি। এটাও সিম্পল দেখতে। তবে খুব সুন্দর। প্রথম দেখায় পছন্দ হওয়ার মতো। ইতির খুব মনে ধরেছে আংটিটা।
রোদ তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-হয়েছে তোমাদের?
-হ্যাঁ আপাততো আজকের মতো প্রায় শেষ।
রোদ উঠে দাঁড়িয়ে ইতির দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দেয়। সবাই সামনে থাকায় লজ্জা করা সত্ত্বেও মাথা নিচু করেই রোদের হাতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় ইতি। রোদ ইতিকে ৮৮০ ভোল্টের ঝটকা দিয়ে কোলে তুলে নেয় সাথে সাথে।
-একি করছেন কি?
রোদ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-ভুল কিছু করলাম নাকি?
মিসেস চৌধুরী মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললেন,
-একদমই নয়। এটা এই বাড়ির নিয়ম। এই বাড়ির ছেলেরা বউদের কোলে নিয়েই গৃহ প্রবেশ করে।
রোদ উপরের দিকে যেতে যেতে বলে,
-আমাদের ডিনারটা উপরে পাঠিয়ে দিও মা।
ইতির লজ্জায় কোথাও লুকিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। এতো মানুষের সামনে এভাবে না বলে হুট করে কেউ কোলে তুলে নেয় তাও সদ্য বিয়ে করা বউকে। মানলাম না হয় বাড়ির নিয়ম তাও তো মানুষ বলে একবার। এমন লজ্জায় ইতি কখনো পরেনি। লজ্জায় ইতির এই মুহুর্তে পানিতে ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে। থাক এতো ইচ্ছে করেও লাভ নেই সাতার জানে না সে পরে ডুবে গেলে মরে যেতে হবে। রোদ চৌধুরীর কি সেই সময় আছে মিটিং রেখে সে ডুবন্ত বউকে বাঁচাতে যাবে।
বেড রুমে এসেই রোদ ইতিকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। ইতি সরে যেতে নিলেও হাতটা ধরে রাখে সে। ইতি বাঁধা পেয়ে একবার হাতের দিকে তাকিয়ে আবার রোদের দিকে তাকায়। রোদ নিজের কোটের বুক পকেট থেকে বের করে একটা লার্জ সাইজের ডেইরি মিল্ক ইতির সামনে এগিয়ে ধরে। ইতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে বলে,
-তোমার জন্য।
ইতি হাত বাড়িয়ে তা ধরতে নিলে রোদ হাতটা সরিয়ে ফেলে। ইতির হাতটা ছেড়ে দিয়ে ডেইরি মিল্কটা ছিড়ে ইতির মুখের কাছে ধরে সে।
-নাও।
ইতি ছোট করে একটা কামড় বসায় তাতে। বাকিটা ইতির হাতে দিয়ে বলে,
-বউ আমার বরণ তো আমিও করব তাই না।
কোটটা খুলতে খুলতে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে রোদ বলে,
-ওজন যেন আর ১০০ গ্রামও না বাড়ে। এটাই পার্ফেক্ট। চাইলে কিছু কমাতে পারো বাট বাড়ানো যাবে না বলে দিলাম। নাহলে আর কোলে নিতে পারব না।
বলতে বলতেই চলে গেলো রোদ। ইতি কিছু বলে কিনা তা শোনার জন্যও অপেক্ষা করল না। রোদের কথা শুনে হা করে রইল ইতি। লোকটা কি বলে গেলো তাকে। এখন কি ওজন মেপে মেপে রাখতে হবে আর খেতে হবে নাকি তাকে।
.
পর্ব-৯+১০
Eti Chowdhury
.
.
.
.
-ওজন যেন আর ১০০ গ্রামও না বাড়ে। এটাই পার্ফেক্ট। চাইলে কিছু কমাতে পারো বাট বাড়ানো যাবে না বলে দিলাম। নাহলে আর কোলে নিতে পারব না।
বলতে বলতেই চলে গেলো রোদ। ইতি কিছু বলে কিনা তা শোনার জন্যও অপেক্ষা করল না। রোদের কথা শুনে হা করে রইল ইতি। লোকটা কি বলে গেলো তাকে। এখন কি ওজন মেপে মেপে রাখতে হবে আর খেতে হবে নাকি তাকে।
রোদ শাওয়ার নিয়ে একটা টাওয়াল পরেই বেরিয়ে যায়। তাকে দেখে একরকম চিৎকার করে বসা থেকে উঠে পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে যায় ইতি। হুট করে ইতিকে চিৎকার করতে দেখে রোদ জিজ্ঞেস করে,
-কি হলো?
-কি হলো মানে? এটা কি করেছেন?
-কি করলাম?
-নিজেকে দেখেন একবার।
রোদ ইতির সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। তাকে দেখে বড় বড় চোখ করে হাত দিয়ে চোখ ডেকে নেয় ইতি।
-আমাকে দেখাটা তোমার কাজ আমার নয়।
-প্লিজ এভাবে টাওয়াল পরে বের হয় কেউ?
-আমি হই।
-এখন থেকে এই রুমটা আপনার একার নয় আমিও থাকবো। সো এসব আর চলবে না।
রোদ খানিকটা ইতির কাছে ঝুঁকে বলে,
-রুম আমার, বউ আমার, টাওয়ালও আমার ইচ্ছে হলে পরবো না হলে পরবো না।
-ছিঃ
রোদ স্মিত হেসে চলে যায়। ইতি এক চোখ খুলে দেখে রোদ নেই। হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। ইতির চোখে শুধু রোদের অর্ধনগ্ন বুকটাই ভাসছে। এই মানুষটাকে তার এভাবেও দেখা লাগবে ভাবতেই লজ্জায় শরীর শিউরে উঠছে ইতির।
বিছানা ছেড়ে উঠে ইতি বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। রোদ চেঞ্জ করে একটা আসমানী রঙের শুতি পাঞ্জাবি পরেছে। যদিও সে রাতে পাঞ্জাবি পরে না তবু আজ পরল। হয়ত ঘরে নতুন বউ আছে তাই পরল। রুমে এসে ইতিকে না দেখে এদিক সেদিক তাকাতেই রোদ দেখে বেলকনিতে বাতাসে কারো শাড়ির আঁচল উড়ছে। এসময় ইতি ছাড়াত কেউ হবে না। রোদ গিয়ে ইতির পিছনে দাঁড়া। বাতাসে ইতির হালকা ভেজা চুল গুলো উড়ছে। অনেকটাই শুকিয়ে গেছে ইতির চুল অনেক আগে গোসল দিয়েছে বোঝা যাচ্ছে। রোদ সামান্য পিছন দাঁড়িয়ে আছে ইতির থেকে। ইতি একদম পিছনে গেলেই রোদের বুকের সাথে ধাক্কা খাবে। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ইতির শরীর থেকে গিয়ে রোদের নাকে বারি খাচ্ছে। রোদ বোঝার চেষ্টা করছে এটা কি ইতির পারফিউমের ঘ্রাণ নাকি তার শরীরের। প্রতিটা মানুষেরই একটা ঘ্রাণ থাকে। রোদের নিজেরও আছে। হয়ত ইতিরও আছে। খুব ছোট বেলায় রোদ যখন মায়ের সাথে থাকত তখন সে তার মায়ের শরীরেও একটা ঘ্রাণ পেত এখনো পায় যখন মাকে জড়িয়ে ধরে। তাই রোদ বোঝার চেষ্টা করছে ঘ্রাণটা কিসের। তাদের মাঝের দূরত্বটাকে অতিক্রম করে রোদ এগিয়ে গিয়ে ইতির ডান পাশে একটা হাত দিয়ে গ্রিলটা ধরে আর বাম হাতটা ইতির পেটে রাখে। হুট করে নিজের পেটে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠে ইতি। নড়তে নিলে ইতির কানের কাছে মুখ নিয়ে চুলের মাঝে নাকটাকে হালকা ডুবিয়ে দেয় রোদ একটা ছুই ছুই অবস্থা কিন্তু ছুঁয়ে দিচ্ছে না। রোদ বলে,
-এভাবেই থাকো।
রোদ নিজের হাতটা ইতির পেটের উপরে দেয়ার সময় বাতাস এসে ইতির পেটের কাছের শাড়ির অংশ বিশেষ সরে গিয়ে রোদের হাতটা ইতির উন্মক্ত পেটের উপর পরে। জীবনের প্রথম ইতি নিজের শরীরের কোন পুরুষের স্পর্শ পেলো। মেয়েটার ভিতরে তুফান শুরু হয়ে গেছে। বুকের কাঁপনটা যেনো বেড়েই চলেছে। পারছে না সইতে, পারছে না পালিয়ে যেতে। একটু একটু ঘামতে শুরু করেছে ইতি। রোদ কিছু বলছে না ছোট ছোট স্পর্শে ইতির পেটে হাত বুলাচ্ছে। ইতির ইচ্ছে করছে ঝট করে পালিয়ে যেতে। কোথাও লুকিয়ে যেতে কিন্তু পারছে না। ইতির পেট চেপে ধরে রোদ ইতিকে নিজের সাথে খানিকটা চেপে ধরে। ইতির পিঠটা গিয়ে রোদের বুকের সাথে ঠেকে। ইতির কাঁপুনিটা যেনো বেড়েই চলেছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রোদ বলে,
-তা এখানে দাঁড়িয়েই কি বাসর কমপ্লিট করবে বিছানায় যাওয়া লাগবে না বুঝি?
ইতির চোখগুলো আরো বর বড় হয়ে যায় ভাগ্যিস রোদ পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে থাকলে দেখে নিতো আর ইতির লজ্জার শেষ থাকত না। এই মানুষটার সাথে কেবল একটা সম্পর্ক, একটা বাড়ি, একটা রুম নয় একটা বিছানাও শেয়ার করতে হবে ইতিকে। নিজের ঘুমের ধরনের কথা চিন্তা করে একবার ঢোক গিলে ইতি। একটা মেয়ের ঘুমানোর স্টাইল যে এতো বাজে আর বিভৎস হতে পারে তা কেউ ইতির ঘুম না দেখলে বলতে পারবে না। আর ইতিকে এই মুহুর্তে আঁকড়ে ধরে রাখা মানুষটা আজকের রাত গেলেই তা জেনে যাবে। এখনই লজ্জায় ইতির ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে। না জানি মানুষটা জানার পর ইতি তাকে কিভাবে ফেইস করবে। ইতির ঘ্রাণটা রোদের নাকে প্রবলভাবে লাগছে। সে নাকটা ইতির কাঁধের উপর রেখে নিঃশ্বাসের সাথে উপরের দিকে চলে গিয়ে কানের কাছে গিয়ে থেমে যায়। ঘ্রাণটা ইতির গায়ের সাথেই লেগে আছে। খুব কড়া একটা ঘ্রাণ। এটা পারফিউম নয় রোদের বউয়ের ঘ্রাণ তা সে বুঝতে পারছে।
-চলো রাত বাড়ছে এখানে থাকা লাগবে না। রুমে চলো।
বলেই ইতির একটা হাত ধরে তাকে নিয়ে রুমে এসে হাতটা ছেড়ে দেয়। রোদ গিয়ে বিছানার বামপাশে আধশোয়া হয়ে বসে। ইতি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে তা দেখে বলে,
-কি হলো?
ইতি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, "কিছু না"।
-তাহলে কি সারারাত এখানে দাঁড়িয়েই থাকবে?
ইতি আবার মাথা ঝাঁকিয়ে না করে।
-তাহলে শুয়ে পরো।
ইতি বিছানায় বসতে নিলেই রোদ চেঁচিয়ে উঠে।
-ওয়েট ওয়েট ওয়েট।
ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে যায় ইতি।
-এভাবেই শুয়ে পরবে নাকি?
-মানে?
-শাড়ি পরেই ঘুমাবে?
-তাহলে?
-এতো কাপড় নিয়ে ঘুমানো যায় নাকি খুলে ফেলো।
ইতির চোখগুলো যেনো এখন সত্যি সত্যি বেরিয়ে আসবে। লোকটা বলছে কি মাথা নষ্ট নাকি তার।
-চেঞ্জ করে আসো। সিম্পল কিছু পরে নাও।
এই কথা শুনে রিলেক্স হয় ইতি। যাক খারাপ কিছু বলতে চায়নি সে।
চেঞ্জিং রুম ঘেষে বিশাল একটা আলমারি। ইতি ভাবে হয়ত তার জিনিসও সেখানেই রাখা তাই চেঞ্জ করার জন্য কাপড় নিতে আলমারির একটা সাইড কিছুটা খুলতেই দৌড়ে এসে বাঁধা দেয় ইতিকে রোদ। রোদকে এভাবে আসতে দেখে চমকে যায় ইতি।
-কি হলো?
-এটা আমার আলমারি।
-তোহ?
-তো তোমার কাপড় এখন চেঞ্জিং রুমে রাখা আছে এখানে কিছু নেই।
-এই এতো বড় আলমারিটা আপনার একার?
-হুম।
ইতি চোখ ট্যাড়া করে একবার রোদকে দেখে চলে যায় চেঞ্জ করতে। আর ভাবে, " একজন মানুষের এতো কাপড়? ৫ টা সাইড ভর্তি এতো কাপড় তার?" ইতি ভেবে পায় না এতো কাপড় দিয়ে লোকটা করে কি।
ইতি চলে যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচে রোদ। আলমারির ঐ সাইডটাই খুলে ড্রয়ার থেকে নিজের সব চাইতে জরুরী জিনিসটা বের করে হাতে নেয় সে।
-নাহ, এটা এখানে রাখা আর সেইফ হবে না। এতো দিন আমি একা ছিলাম এখন থেকে ইতিও থাকবে কখন ওর হাতে পরে যায় বলা মুশকিল আর সব সময় আমি বাসায় থাকব না সো এই রিক্সটা আমি নিতে পারব না।
রোদ তার জিনিস নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। যদিও রোদের মা মিসেস চৌধুরী কখনো ছেলের কোন পার্সোনাল জিনিসে হাত দেয়নি কিন্তু ইতি তার বিয়ে করা বউ। এই একটা মানুষের কাছে রোদের পার্সোনাল বলতে কিছু নেই। পৃথিবীর অন্য সবার থেকে সে যা আড়াল করতে পারে ইতি এমন একজন তার কাছে সে তা অনায়াসে প্রকাশ করতে পারে কারণ আল্লাহ তায়ালা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটাকে এভাবেই তৈরী করেছেন। স্বামীর কাছে স্ত্রীর আর স্ত্রীর কাছে স্বামীর গোপন বলে কিছু নেই। তারা একে অপরের কাছে সর্বো প্রকোশ্য৷ রোদও ইতির কাছে কিছুই লুকাবে না কিন্তু আপাততো নয়। সবে বিয়ে হলো কয়টা দিন যাক মেয়েটা এডজাস্ট করুক তারপর রোদ সব বলবে ইতিকে। তাই কিছুটা সময় নিচ্ছে রোদ।
ইতি চেঞ্জিং রুমের দরজা হালকা ফাঁকা করে উকি দিয়ে দেখে রোদ কোথায় বা ঘুমিয়ে পরেছে কিনা। কিন্তু দেখে রোদ নেই। এই সুযোগে দৌড়ে এসে বিছানার চাদর দিয়ে ঢেকে নিজেকে আড়াল করে নেয় ইতি। রোদ এমন একটা পোশাকের কথা বলছিল সে ভাবতেই পারেনি। লজ্জায় আবার ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে মেয়েটার। রোদ যদি দেখে ফেলে। এভাবে কেউ নাইটি গিফট করে পরিধানের জন্য এটা ইতি আগে ভাবতেই পারেনি। আর আগে কখনোই সে নাইটি পরেনি। বাসায় তার বাবা, বড় ভাই ছিলো। তাই এসব পরত না ইতি কখনোই। তবে ইস্পৃহার কাছে শুনত সে রাতে বেড রুমে গিয়ে পরত। তবে তার ভাবী আর তার সিচুয়েশন তো আলাদা। ইতি নিজেকে আড়াল করে নেয়ায় কয়েক মিনিটের মাথায় রোদ বেড রুমে আসে। এসে সোজা বিছানায় বসে নিজের গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে গায়ের উপর চাদর টেনে নিলে ইতি কারেন্টে শখ খাওয়ার মতো তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায়। ইতিকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে রোদ ঘুরে তাকায়। এবার নিজেই বেক্কল হয়ে যায় ইতি। রোদের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য নিজেকে চাদর দিয়ে ঢেকেছিল কিন্তু নিজের বোকামির জন্য দেখে ফেলল লোকটা। রোদ কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকে। ইতির পরনের নাইটির ভেতরের অংশটা হাটুর উপর পর্যন্ত তাই ইতি অনর্থক টেনে ধরার চেষ্টা করছে বার বার। আর উপরের অংশটা একদম নিচ পর্যন্ত লম্বা। তবে মানিয়েছে ইতিকে। রোদ নিজের আন্দাজেই কিনেছিল তবে ভালো মানিয়েছে তার বউকে। রোদ বলে,
-কি হলো দাঁড়িয়ে গেলে কেন? ঘুমাবে না?
ইতি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয়।
-তাহলে এসো।
ইতি তাও দাঁড়িয়ে আছে যাচ্ছে না। ইতির ইতঃস্ততর কারণ বুঝতে পেরে রোদ ইতির দৃষ্টিকে আড়াল করে স্মিত হেসে উঠে ইতির একদম কাছে এসে বলে,
-ভয়ের কিছু নেই আমি তোমাকে কিছু করব না। এটা আমাদের বংশের নিয়ম বিয়ের প্রথম এক সপ্তাহ বাসর হয় না। এক সপ্তাহ পরে বাসর হয়। ছেলেদের ধৈর্য্য পরীক্ষা করা হয় এই রীতি দিয়ে। দেখছ না আমাদের জন্য কোন বাসর সাজানো হয়নি। নাহলো ফুলে ফুলে মো মো করত এই বিশাল বেড রুমটা। সো আই ওন্ট টাচ ইউ। চিন্তা না করে ঘুমিয়ে পরো। টেক রেস্ট সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমার। কাম।
রোদ নিছানায় গিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে পরে। ইতি এতোক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছিল। রোদের কাপড় ছাড়া বুকটা দেখে ইতি থমকে গিয়েছিল। হুট করেই ইতির চোখে একটা নেশা ক্রিয়া করে রোদকে এভাবে দেখে। নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে গিয়ে বিছানায় বসে উল্টো দিকে ঘুরে রোদের থেকে অনেকটা বেশি দূরত্ব রেখে শুয়ে পরে ইতি।
.
.
.
.
চলবে.........#বস_বর
পর্ব-১০
Eti Chowdhury
.
.
.
.
রোদ বিছানায় গিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে পরে। ইতি এতোক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছিল। রোদের কাপড় ছাড়া বুকটা দেখে ইতি থমকে গিয়েছিল। হুট করেই ইতির চোখে একটা নেশা ক্রিয়া করে রোদকে এভাবে দেখে। নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে গিয়ে বিছানায় বসে উল্টো দিকে ঘুরে রোদের থেকে অনেকটা বেশি দূরত্ব রেখে শুয়ে পরে ইতি।
খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস ইতির আছে। নতুন জায়গা হিসেবে ভেবেছিল ইতির হয়ত ঘুমই আসবে না। কিন্তু ক্লান্তি এমন একটা বস্তুর নাম শরীরে ক্লান্তি থাকলে তখন সে জায়গা বা বিছানা দেখে না গা এলিয়ে দেয়ার জায়গা হলেই হলো রাজ্যের ঘুম এসে চোখে বাসা বাঁধে আপনা-আপনি। ইতিরও হয়েছিল একি দশা। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার মিনিট পনেরোর মাঝেই সে ঘুম রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিল।
সবে ইতির ঘুমটা ভাঙতে শুরু করেছে। পুরোপুরি ভাঙেনি। তবে কাঁচা-পাকা ঘুম নিয়েই ইতি বেশ অনুভব করতে পারছে সে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে আছে। শুধু আঁকড়ে নয়। নিজেকে সেই কিছু একটার সাথে সম্পূর্ণভাবে আড়ষ্ট করে রেখেছে। ইতি ভালো ভাবে স্পর্শ করে বুঝতে পারল সে কিছু নয় কাউকে নিজের সাথে আড়ষ্ট করে রেখেছে। তা বুঝতে পেরে ঝটকা খাওয়ার মতোই তড়িগড়ি করে চোখ মেলে তাকায় ইতি। ৮৮০ ভোল্টের বৈদ্যুতিক শখ খাওয়ার মতোই বিষম খায় ইতি। নিজের শোয়া সম্পর্কে ইতির ভালোই ধারণা ছিলো। রাতে যে একটা তুলকালাম হবে সেটাও ইতির জানা ছিল। ইতি বলতে গেলে সম্পূর্ণ প্রায় রোদের উপরেই উঠে গেছে ঘুমের তালে। মেয়েটা ছোট বলে থেকেই এমন। জন্মের পর থেকেই ইতি মা-বাবার বুকের উপরেই নাকি ঘুমাতো সেখান থেকেই এই অভ্যাস মেয়েটার। এতোদিন তো বেচারা নিজের বালিশটার কলিজা বের করেছে আর আজ রোদের বুকের উপরেই চড়ে গেলো। তাদের মাঝে যে দূরত্বটা ছিল সেটার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। ইতি নিজে যে দূরত্ব এঁকেছিল তা সে নিজেই অতিক্রম করেছে। মনে মনে নিজেকেই নিজে তিরস্কার করছে ইতি, "ছিঃ ইতি ছিঃ!! এটা কি করলি তুই? বিয়ে হয়েছে একটা দিনও হয়নি এর মধ্যেই বরের বুকের উপরে উঠে গেলি? ছিঃ!!" মনে মনে কথাটা বলে রোদের দিকে তাকায় ইতি আশ্চর্য রকমের সুন্দর লাগছে মানুষটাকে দেখতে। কি নিষ্পাপ সে চাহনি। ইতির ইচ্ছে করছে গিলে খেতে ঘুমন্ত মানুষটাকে। রোদ হালকা নড়ে উঠতেই ইতি রোদকে ছেড়ে উঠে পরে। রোদের সুঠাম দেহ, শক্ত মাসল, পুরো চওড়া বুকের স্পর্শ বার বার অনুভব করছে ইতি। আস্তে করে বিছানা ছেড়ে উঠে আসে ইতি। পা টিপে টিপে বিড়ালের মতো শব্দবিহীন পদক্ষেপে হেটে চেঞ্জিং রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে মিররের সামনে দাঁড়িয়ে স্মিত হেসে দেয়। কি লজ্জার কান্ড কপাল ভালো আজ রোদ দেখে ফেলেনি। নাহলে কি একটা বিশ্রী কান্ড হয়ে যেত। ইতি তো লজ্জায় আর রোদকে মুখটাই দেখাতে পারত না। বসটা হুট করে বিনা নোটিশে বর হয়ে গেলো আর ইতি তার গায়ের উপর চড়াও হয়ে একরাত ঘুমিয়েও নিলো নির্লজ্জের মতো। এমন লজ্জার কান্ড ভাবতেই গা শিউরে উঠছে ইতির। আয়নায় নিজেকে ভালো করে লক্ষ করতেই ইতি দেখে তার নাইটির উপরের অংশ বিশেষ আর গায়ে নেই কেবল ভেতরের স্লিভলেস অংশটা গায়ে জড়িয়ে আছে। ইসস.. এই অবস্থায় যদি বস মানে বরের থুক্কু রোদের চোখে ইতির পরত তাহলে লজ্জায় সত্যি সত্যি ইতিকে ডুবে যেতে হতো।
সকাল সকাল একটা ফ্রেস গোসল দিয়ে নিলো ইতি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুচ্ছিল সে এমন সময় ঘুম থেকে উঠে রোদ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ইতি তার ভেজা চুল গুলো পিছনে ছুঁড়ে মারতেই তার চুলের পানিগুলো গিয়ে রোদের মুখের সর্বত্র লাগে। আয়নায় রোদকে দেখে ইতি কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,
-সরি। আমি দেখিনি।
রোদ তার কথার কোন জবাব না দিয়ে স্মিত হেসে বাথরুমের দিকে চলে গেলো। রোদের স্মিত হাসাটা ইতির চোখ এড়ায়নি আজ। কিন্তু হুট করে মানুষটা হাসল কেন? হাসার মতো কোন কথা তো ইতি বলেনি। রোদের হাসি নিয়ে ভাবনায় পরে যায় ইতি। ঘুমের কান্ড নিয়ে নয় তো। কিন্তু ইতির স্পষ্ট মনে আছে রোদ ইতিকে ঐ অবস্থায় দেখেনি। কারণ ইতি রোদের আগেই উঠেছে। রোদ আগে উঠলে না হয় দেখতে পেতো। এতো ভেবে কাজ নেই তাই ইতি রেডি হয়ে মাথায় সুন্দর করে কাপড় দিয়ে নিচে চলে যায়। তখন কেবল সকাল ৭টা বাজে। রাতে ভালোই ঘুম হয়েছে ইতির। আর রাতে বেশি একটা দেরিও করেনি ১১ টার পর পরই ঘুমিয়ে পরেছিল। সে হিসেবে ভালোই ঘুম হয়েছে। তবে ফজরের নামাজটা পড়া হয়নি। তার জায়নামাজ তো ব্রিবকেইসে রাখা আর সেটা কোথায় তা ইতি জানে না। তাই ভাবে শাশুরিকে জিজ্ঞেস করে নিবে। নিচে নামতেই ইতি শাশুড়িকে বিশাল ড্রইং রুমটায় বসা আবিষ্কার করেন। তবে সে একা নয় তার সাথে আরো অনেকেই আছে। কেউ হয়ত এসেছে কারণ আগের দিন ইতি এদের দেখেনি। নিচে নামতেই মিসেস চৌধুরী ইতিকে দেখে বললেন,
-সেকি এতো সকাল সকাল উঠে এলে যে? ঘুম হয়নি বুঝি তোমার?
-না মা। ঘুম হয়েছে। আসলে আমার সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস তো তাই।
-আচ্ছা এসো আমার কাছে এসো।
ইতি মিসেস চৌধুরীর কাছে যেতেই তিনি ইতিকে মাঝে বসিয়ে দিয়ে পাশের বয়স্কা মহিলাকে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন,
-এটা তোমার চাচীশাশুড়ি। রোদের বড় চাচী। রোদের চাচাতো বোনের বাচ্চা হয়েছে। গতকালই ডেলিভারি ডেইট ছিল তাই উনি গতকাল আসতে পারেননি। সেখান থেকেই সরাসরি এখানে চলে এসেছেন।
ইতি সাথে সাথে উঠেই চাচী শাশুড়িকে মুখে সালাম দিয়ে সাথে পায়ে হাত দিয়েও সালাম করল। তিনি বাধা দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন,
-থাক মা থাক। মেয়েদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হয় না।
যদিও এটা ঠিক পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা উচিত নয় তাও করল ইতি। শত হলেও শশুড়বাড়ির লোক ইতি রিস্ক নিতে চায় না। শশুড়বাড়ির লোকের কোন ভরসা নেই এদের মুখে এক থাকে তো মনে আরেক। এটা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ক্ষেত্র বিশেষে আলাদা হয়। হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান নয় তেমনি দুনিয়ার সব মানুষও এক নয় এটা ইতি বিশ্বাস করে। বাকি সবাই কেমন হবে তা ইতি জানে না তবে সে এটা বেশ জানে তার শশুর-শাশুড়ি মানুষ দু'জন খুবই অমায়িক। অনেক ভালো তারা। তাদের দিক থেকে তাকে কখনো কোন সমস্যা ফেইস করতে হবে না সেটাও ইতি জানে। একমাত্র ছেলের বউ মাথায় তুলে রাখবে এটা নিয়ে ইতির কোন সন্দেহ নেই। মিসেস চৌধুরী ইতিকে বলেন,
-সকাল সকাল চা খাওয়ার অভ্যাস আছে তো?
চায়ের কথা শুনে ইতির মুখে বিশাল এক হাসি ফুটে উঠল। তা দেখে মিসেস চৌধুরীর বুঝতে বাকি রইল না সে এতো দিনে তার চা খাওয়ার সঙ্গী খুঁজে পেয়েছেন।
-বসো আমি চা করে নিয়ে আসি।
রোদের চাচী জনাবা মনোয়ারা চৌধুরী উঠে ফ্রেস হওয়ার জন্য রুমে চলে যায়। মিসেস চৌধুরী চা বানানোর জন্য যেতে নিলে ইতি হাত ধরে বলে,
-মা আমি চা করি?
-সে কি কথা তুমি কেন করবা?
-প্লিজ করি। বসে থাকতে ভালো লাগছে না।
-তাও কথা সংসার তোমার দু'দিন পর এমনিও সব তোমাকেই দেখা লাগবে। আচ্ছা আসো আমার সাথে তুমি তো সব পাবে না আমি দেখিয়ে দেই তুমি চা করো।
শাশুড়ির প্রস্তাবে ইতি খুশি হয়ে যায়। বউ শাশুড়ি মিলে চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পরে। মিসেস চৌধুরী বলেন,
-বুঝলে বউমা আমার হলো কপাল এতো বছরের জীবনে এই প্রথম চা খাওয়ার সঙ্গী ঝুটল আমার।
এই কথা শুনে অবাক হয়ে ইতি তাকায়। তা দেকে তিনি বলেন,
-তোমার বাবা তো চা খায় না তার আবার সকাল সকাল কফি প্রয়োজন হয়। বিয়ের আগে কত ভাবতাম বিয়ের পর সকাল সকাল বরের সাথে চা খাবো কিন্তু তা আর হলো না। আমরা তো পাঁচ বউ ছিলাম তোমার বাবাই সবার ছোট সে হিসেবে আমি বাড়ির ছোট বউ। কেউ কিছু করতে দিত না। তাই বিয়ের পরেও প্রায় মাস দুয়েকের মতো আমার রান্না ঘরে যাওয়া হয়নি কি যে কষ্ট হয়েছিল আমার দুই মাসের উর্ধ্বে আমি চা পাইনি ভাবো ব্যাপারটা। তোমার বাবার সাথে কফি খাওয়া লাগত। পরে একদিন তিনিই বড় ভাবিকে বললেন আমি কফি খেতে পারি না মানে আমার পছন্দ নয় তারপর থেকে শুরু হলো আবার চা। একটু আগে যাকে দেখলে উনিই রোদের সবচাইতে বড় চাচী। আমাকে অনেক আদর করতেন সবার ছোট ছিলাম তো। যখন বিয়ে হয়ে আসি তখন আমি কেবল অনার্স প্রথম বর্ষ শেষ করেছিলাম তারপরেই বিয়ে। তবে লেখাপড়া ঠিক চালিয়ে গিয়েছিলাম। তোমার বাবার শখ ছিল আমাকে পড়াবেন আর আমিও পড়তে চাইতাম তাই হয়েছিল পড়াটা।
ইতির মনে মনে খুব শখ জাগল এতো অল্প বয়সে তার কেন বিয়ে হয়েছিল তা জানার জন্য কিন্তু এই মুহুর্তে জানতে চাওয়াটা হয়ত বেশি বেশি হয়ে যাবে ভেবে ইতি চুপ হয়ে যায়। ভাবে সময়ের সাথে পরে কখনো জানা যানে। মিসেস চৌধুরী বলতে থাকলেন,
-তারপর আমার ছেলেটা। সেও একদম বাবার মতো। কফি ছাড়া তার চলেই না।
এতোক্ষণে ইতিরও মনটা সামান্য বিষন্ন হয়। তারও তো শখ ছিল বরের সাথে চা খাওয়ার তা তো আর হবে না কারণ স্ট্রং কফি ছাড়া নরমাল কফিও ইতি রোদকে কখনো খেতে দেখেনি আর চা তো অনেক দূরের কথা। ইতির মুখ-চোখের বিষন্নতা বুঝতে পেরে মিসেস চৌধুরী পুত্রবধূর চিবুকে হাত দিয়ে বললেন,
-তোমার তো আমি আছি আমার তো কেউ ছিল না যদিও বাড়ির অনেকেই চা খেতো তবু বরের সঙ্গে ব্যাপারটা অন্য জিনিস। তবে রাত ৩টা বাজেও তুমি চা খাওয়ার জন্য আমাকে পাবে।
ইতি ফিক করে হেসে দিলো শাশুড়ির কথা শুনে। কিছুক্ষণ মিসেস চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ইতি মনে মনে ভাবে, "পৃথিবীর সব শাশুড়িরাই কি এমন হয়? কই অন্য কারো কাছে তো ইতি কখনো শুনেনি শাশুড়ি অনেক ভালো"। নিজের শাশুড়িকে যতো দেখছে অবাক লাগছে ইতির কাছে।
ইতির বানানো চায়ের অনেক প্রশংসা করলেন মিসেস চৌধুরী। আর প্রতিদিনের চায়ের দায়িত্বটাও ইতিকেই দিয়ে দিলেন। নাস্তা রেডি করাও প্রায় শেষের দিকে। ইতি মিসেস চৌধুরীকে বলল,
-আমি উনাকে ডেকে আসি আর রুমটা গুছিয়ে আসি।
-কাকে ডাকবে? রোদকে?
-হুম।
-ও তো বাসায় নেই।
-বাসায় নেই!!
অবাক হয় ইতি।
-হ্যাঁ, জগিং করতে গেছে। জগিং ছাড়া তোমার বরের সকাল হয় না।
-ওহ!! তাহলে আমি একটু রুমটা গুছিয়ে আসি।
-যাও দেরি করো না। রোদের আসার সময় হয়ে গেছে।
-আচ্ছা।
ইতির মনে পরছেনা সে তো রোদকে বের হতেই দেখেনি। সে কখন বের হলো। ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে গিয়ে বিছানার দিকে তাকিয়ে হা হয়ে থাকে ইতি। বিছানার পাশেই ইতির নাইটির উপরের অংশ বিশেষ, রোদর পাঞ্জাবি সবই এলোপাথারি হয়ে পরে আছে। ভাগ্যিস কোন অঘটন ঘটেনি। ভেবে মমে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায় ইতি। বিছানা ঠিকঠাক করে সব গুছিয়ে পিছন ঘুড়তেই রোদের সুঠাম ঘর্মাক্ত বুকের সাথে ধাক্কা খায় ইতি। ঘেমে নেয়ে একাকার রোদ। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব দৌঁড়েছে সে। সামান্য কিছু দূরত্ব ব্যাতিত কোন দূরত্ব নেই তাদের মাঝে। একজন আরেকজনের একদম কাছে। রোদের কান, কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। এই অবস্থাতেও খুব লোভনীয় লাগছে তাকে দেখতে। রোদ ইতোমধ্যে রুমে প্রবেশের পূর্বেই গায়ের টি-শার্টটা খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছে। তাই তার উন্মক বুকটা দেখে প্রবল আকর্ষণ বোধ করছে ইতি। রোদ স্মিত হেসে পাশ কেটে যেতেই ইতির হুদিস হয়। মনে মনে ভাবে, "ছিঃ ছিঃ ছিঃ কি করছিলাম আমি। এভাবে একজন পুরুষকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলাম আমি। দিন দিন ওয়াইল্ড হয়ে যাচ্ছি কেন আমি? আমি তো এমন ছিলাম না কখনোই"। এসব ভেবে মনে মনে নিজে নিজেই বেক্কল হয়ে যায় ইতি।
ব্রেক ফাস্ট করতে বসে ইতিকে দেখে বার বার স্মিত হাসছে রোদ। আর রোদের হাসা বার বার ইতির চোখেই পরছে। এভাবে সকাল থেকে রোদ স্মিত হেসে যাচ্ছে কেন এর কারণ ইতি খুঁজে পাচ্ছে না। আর কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। পাছে না মুখ দিয়ে ঘুমের ব্যাপারটা বেরিয়ে যায় ইতির সেই ভয়ে। রোদ স্মিত হাসছে আর ইতিকে দেখছে সেই সাথে মনে মনে ভাবছে মেয়েটা ঘুমের মধ্যে কিভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে তার উপরে উঠে গিয়েছিল। প্রায় সারারাতই ইতির রোদের বুকের উপরে উঠে ঘুমিয়েছিল আর তা রোদ জানে। ইতিকে ওভাবে মাঝরাতে নিজের বুঝে আবিষ্কার করে অবাক হয়েছিল সে। বার বার নামিয়ে বালিশে শুইয়ে দিলেও ইতি উঠে এসে রোদের উপরেই এসে ঘুমচ্ছিল। শেষে বাধ্য হয়ে ইতিকে বুকের উপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়েছিল রোদ। এতো বছরের জীবনে রোদ কখনো শুনেনি কেউ কারো উপরে উঠে ঘুমায়। জড়িয়ে ধরে হয়ত ঘুমায় কিন্তু উপরে উঠার কথা শুনেনি কখনো। রাতের এসব কথা ভেবেই হাসি পাচ্ছে রোদের।
খাওয়া শেষ করে রোদ ইতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-হলো তোমার চলো।
ইতি অবাক হয়ে তাকায় রোদের দিকে। মিসেস চৌধুরী বলেন,
-কোথায় যাবে এখন?
-কেন অফিসে।
-অফিসে মানে!!
টেবিলে বসা সবার দৃষ্টি রোদের দিকে। ইতির হাতে উঠা খাবারটা আর মুখে যায় না। রোদ বলে,
-অফিস মানে অফিস।
-সে কি কথা রোদ। নতুন বউ অফিস করবে নাকি?
-হুম। বিয়ে হয়ে গেছে বলে কি বাসায় বসে থাকবে নাকি? আর তাছাড়া ওর মিটিং আছে আজ একটা। মিটিংটা খুবই জরুরী তা ওকেই করতে হবে।
-না ও আজ অফিসে যাবে না। ওর মাত্র বিয়ে হয়েছে। তাছাড়া তোর মামারা আসবে দুপুর নাগাদ।
-মা আশ্চর্য কথা বলছো। বিয়ে করেছে বলে কি ওর ক্যারিয়ার নেই নাকি? ঠিক আছে মামার আছে যেহেতু ওর মিটিং শেষ হলেই আমি ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিবো। এর বেশি কিছু করতে পারছি না সরি মা।
মিসেস চৌধুরী আরো কিছু বলতে চাইলে রোদ বাঁধা দিয়ে বলে,
-আর কিছু করতে পারব না মা সরি। আমি রুমে যাচ্ছি আমার কফিটা পাঠাও।
সেই সাথে ইতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-আর তুমিও এসো রেডি হয়ে নাও দ্রুত।
বলেই রোদ চলে গেলো। ইতি পরে গেলো বিপাকে কি করবে এখন। এই কথা তো সে আগে ভেবে দেখেনি। মিস্টার চৌধুরী বললেন,
-যাও মা রোদের কফিটা নিয়ে যাও। রেডি হয়ে অফিস যাও৷ তবে আজ দুপুর নাগাদ চলে এসো যেহেতু সবাই আসছে তোমার জন্যই।
ইতি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে বলে,
-জ্বি বাবা।
ইতি রোদের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে রুমে গেলো।
.
.
পর্ব-১১
Eti Chowdhury
.
.
.
.
সেই সাথে রোদ ইতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-আর তুমিও এসো রেডি হয়ে নাও দ্রুত।
বলেই রোদ চলে গেলো। ইতি পরে গেলো বিপাকে কি করবে এখন। এই কথা তো সে আগে ভেবে দেখেনি। মিস্টার চৌধুরী বললেন,
-যাও মা রোদের কফিটা নিয়ে যাও। রেডি হয়ে অফিস যাও৷ তবে আজ দুপুর নাগাদ চলে এসো যেহেতু সবাই আসছে তোমার জন্যই।
ইতি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে বলে,
-জ্বি বাবা।
ইতি রোদের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে রুমে চলে যায়।
আসলেই বিয়ের পরে অফিসের ব্যাপারটা, জবের ব্যাপারটা ইতি ভেবে দেখেনি। এখন সে কি করবে? আজ কি অফিসে গিয়ে রিজায়েন দিয়ে দিবে নাকি? বিয়ের পরে বউ সংসার রেখে সারাদিন অফিস করবে ব্যাপারটা ইতির নিজেরই বেশি একটা হজম হচ্ছে না তো বাকিরা কিভাবে তা হজম করবে। ভাবতে ভাবতেই কফি হাতে নিয়ে রুমে ঢুকে ইতি। রোদের দিকে চোখ পরতেই ইতি ভাবে রোদ এভাবে তার মায়ের সাথে রিয়্যাক্ট না করলেও পারত। সুন্দর করেই ঠান্ডা মাথায় প্রতিটা ব্যাপারকেই সামাল দেয়া যায় সে যতো ক্রিটিক্যাল ব্যাপারই হোক না কেন। কিন্তু এই লোকটা তো তার উল্টো। ঠান্ডা মাথায় কাজ করে কিভাবে তা হয়ত সে জানেই না। বেডের ঠিক ডান পাশের দেয়ালে লম্বা মিররের সামনে দাঁড়িয়ে রোদ নিজের টাই ঠিক করছে তার পাশেই ইতি রোদের জন্য কফির কাপটা রেখে দেয়৷ কোন কথা বলে না। আপততো কথা না বলাই ভালো হবে মনে করে ইতি। ইতি পিছন ঘুরে যেতে নিলে রোদ বলে,
-অফিসে গিয়ে রেজিগনেশন দিবে এই কথা ভাবনা ভাবনাই থাক। বাস্তবায়ন করার কথা মাথায়ও আনবে না। আগেই জানিয়ে দিলাম।
রোদের কথা শুনে ভুত দেখার মতো তাকিয়ে থাকে ইতি। ইতি মনে মনে এটাই ভাবছিল কিন্তু একথা তো সে কাউকে বলেনি মনে মনেই ভেবেছে তাহলে রোদ জানল কিভাবে নাকি সে মনে মনে এতোটাই জোরালো ভাবে ভেবেছে যে রোদ সবটা শুনে নিয়েছে। ইতিকে শক্ত পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোদ কফির কাপে চুমক দিয়ে পিছন ঘুরতেই মুখ থেকে সবটা কফি বেরিয়ে এলো তার। কফি গলা দিয়ে না নেমে ফিরে এসেছে এতে কোন সমস্যা নেই। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে রোদ সামনে তাকাতেই দেখে তার মুখ দিয়ে ফিরে আসা কফিগুলো সব ইতির চোখ-মুখ, বুকে ছিটকে গিয়ে দাগ করেছে। ইতি চোখ বন্ধ করে নাক ছিটকে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাব ভাব এমন সে নর্দমায় চুবানি খেয়েছে। ইতি আর কোন কথা না বলে ফ্রেস হওয়ার জন্য যেতে নিলে রোদ পিছন থেকে বলে,
-নতুন বিয়ে আর নতুন বউ বলে আবার শাড়ি পরে অফিসে যেও না কিন্তু। আর একটা কথা গেট রেডি ফ্রোম মাই স্ট্যান্ডার্ড। ইতি পিছন না ঘুরে উল্টো দিক থেকেই একটা ভেঙ্গচি কেটে ফ্রেস হতে চলে যায়।
ইতিকে আজ অফিসে দেকে সবাই অবাক হলেও সব চাইতে বেশি অবাক হয় আদি আর রিমি। কেবল অবাকই নয় বড়সড় ধাক্কাও খায়। রিমি তো হুট করে রোদের পিছন পিছন ইতিকে দেখে প্রায় চিৎকার করে বলেই ফেলে,
-ম্যাম আপনি এখানে কেন?
ইতি কি বলবে বুঝতে পারে না। হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। রোদ কোন জবাব না দিয়ে নিজের কেবিনের দিকে চলে যায়। ইতিও আশে পাশে তাকিয়ে দেখে সবার দৃষ্টি তার দিকেই সবাই ইতিকেই দেখছে। তাই কোন কথা না বলে চুপচাপ নিজের কেবিনের দিকে চলে যায় ইতি।
গাড়িতে থাকতেই রোদ ইতিকে বলে দিয়েছিল আজ মিটিং করে বাসায় চলে যাবে সে। রোদের মামারা আসবে তাকে দেখতে তাই। ইতিও মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল।
মিটিং শুরু হতে বাকি আরো ৩০ মিনিট। ইতি রোদের কেবিনে যায়। ইতি গিয়ে রোদের মুখো-মুখি দাঁড়ায়। ইতি দাঁড়াতেই রোদ ফাইলে মুখ গুজে রেখেই বলে,
-বলেছিলাম রেজিগনেশন দেয়ার কথাটা ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ রাখতে। তোমার রেজিগনেশন আমি নিবো না।
ইতি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলে,
-কে বলল আমি রেজিগনেশন দিতে এসেছি?
-তাহলে তোমার হাতে কি?
ইতি পিছনে রাখা হাতের এনভেলপটা আরো শক্ত করে ধরে তারপর তা সামনে এনে রোদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-রেজিগনেশন নয় লিভ এ্যাপলিকেশন বলে এটাকে দেখলেই বুঝবেন।
রোদ ফাইল থেকে মাথা তুলে ইতির হাত থেকে এনভেলপটা নিয়ে ভেতর থেকে পেপার বের করে দেখে ইতি ৭ দিনের ছুটির জন্য দরখাস্ত করেছে। রোদ তার জায়গা থেকে উঠে এসে ইতির সামনে টেবিলে হেলান দিয়ে বসে বলে,
-৭ দিনের ছুটি লাগবে তোমার?
-হ্যাঁ।
-কেন?
ইতি অবাক হয়ে চোখ বড় করে তাকায় রোদের দিকে।
-কেন মানে? নতুন বিয়ে ছুটি লাগবে না?
-বাহ বিয়ে হতেই বর কে ম্যানেজ করা শিখে গেলে। এতোদিন তো কেবল বস কেই ম্যানেজ করছিলে।
বলতে বলতেই হাত দিয়ে ইতির কপালের চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দেয় রোদ। ইতি হালকা শিহরণ অনুভব করে। তার সব কথা যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। রোদ ইতির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
-বিয়ে হতে না হতেই বরের মতো বুদ্ধিমান হয়ে গেলে।
ইতি চমকে তাকায় রোদের দিকে আরেক দফা। বলে,
-ম মানে?
-ভালোই পিপারেশন নিয়ে এসেছো।
ইতি ভ্রু কুচকে তাকায়। রোদ বলে,
-রেজিগনেশনের বদলে লিভ এ্যাপলিকেশন খুব ভালো। যাও মঞ্জুর করে নিলাম তোমার ছুটি। বরকে সময় দাও।
ইতি আর কোন কথা না বলে বেরিয়ে যায় রোদের কেবিন থেকে। ইতির মনে হয় রোদ জাদু টোনা জানে। নাহলে বুঝল কিভাবে ইতি সত্যি সত্যি দুটো এনভেলাপ নিয়ে গিয়েছিল। একটাতে ছিল লিভ এ্যাপলিকেশন আরেকটায় রেজিগনেশন। রোদের সাথে চাকরি না করার ব্যাপারে কথা বলতে চেয়েছিল ইতি কিন্তু রোদকে কিছু বলার আগেই সে সবটা ধরে ফেলে তাই ইতি আর রেজিগনেশন না দিয়ে লিভ এ্যাপলিকেশন দিয়ে দেয়। এ যাত্রায় কোন রকমে বেঁচে যায় ইতি সামনে কি হবে কে জানে।
মিটিং শেষ করে ইতি কনফারেন্স রুম থেকে তড়িগড়ি করে বের হচ্ছিল জলদি বাসায় যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পরবে সে। কিন্তু কনফারেন্স রুমের দরজা দিয়ে বেরিয়েই থমকে দাঁড়ায় ইতি। রাফসান দাঁড়িয়ে আছে কনফারেন্স রুমের ঠিক উল্টো দিকে। পিছন থেকে দেখেই ইতি রাফসানকে চিনে গেছে। হুট করে রাফসানকে এভাবে দেখে ইতি থরথর করে কাঁপতে থাকে। গলা শুকিয়ে আসছে ইতির। রাফসান পিছনে ঘুরতেই দেখে ইতি কনফারেন্স রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাফসানের দৃষ্টি ইতির দিকে পরে আর ঠিক সেসময় রোদ কনফারেন্স রুম থেকে বের হয়ে ইতির পাশে দাঁড়ায়। রোদও রাফসানকে দেখে। রাফসানের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রোদ ইতির দিকে তাকায়। ইতির দৃষ্টিতে রোদ অন্যরকম একটা ভয় দেখতে পারছে। রোদ কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে ইতি রাফসানকে নিয়েই ভয় পাচ্ছে তবে রোদের মুখে কিঞ্চিৎ হাসি এটা ভেবে ইতি জানে না তার হাজবেন্ট জিনিসটা কি। জানলে কোন ভয় ইতির মাঝে ক্রিয়া করত না। রোদ আর সেখানে দাঁড়ায় না চলে যায়। ইতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে রিমি পিছন থেকে বলে,
-কি হলো ম্যাম এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন?
-হ্যাঁ! নাহ না যাচ্ছি।
রোদ নিজের কেবিনে এসে চেয়ারে বসতে বসতে ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে জানায় গাড়ি রেডি করতে রোদ বাসায় যাবে ইতিকে নিয়ে। ফোনটা রাখতেই রোদ ফিরে যায় গতপরশু রাতে মানে রোদের হলুদের রাতে। রোদ সিগারেটটা শেষ করে বেলকনি থেকে রুমে আসতেই তার একটা মেইল আসে। মেইলটা রাফসান করেছিল। সেই মেইলে রাফসান লিখেছিল, "স্যার এখানের কাজ শেষ আর কোন কাজ অবশিষ্ট নেই আপাততোর জন্য। আমার মনে হয় না অহেতুক আরো সাতদিন এখানে থেকে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয়। তাই আমি আগামী কালকের ফ্লাইটেই দেশে ফিরব। দেশে পৌঁছাতে প্রায় মাঝ রাত হয়ে যাবে তাই সরাসরি পরশু অফিসেই দেখা হবে। আপনার অনুমতির অপেক্ষায় আছি"। রাফসানের মেইলের জবাবে রোদ ছোট্ট করে ক্যালকুলেট করে দেখেছিল রাফসান দেশের মাটিতে পা রাখার আগেই ইতি রোদের নামে দলিল হয়ে যাবে। আর যখন অফিসে দেখা হবে ততোক্ষণে ইতি একরাত তার স্বামীর সাথে কাটিয়েও ফেলবে। তাই রোদ তার জবাবে লিখে দেয়, " ঠিক আছে চলে এসো"। রোদ যা যেমনটা ভেবে রেখেছিল ঠিক তেমনটাই হচ্ছে সব।
ইতি নিজের কেবিনে গিয়ে হাত ব্যাগটা নিয়ে ভাবে আজ আর এক মুহুর্তও অফিসে থাকবে না সে। আপাততো ৭ দিন ছুটি আছে পরে রাফসানের সাথে কথা বলবে সে। ইতি ব্যাগটা নিয়ে কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য পিছন ঘুরতেই দেখে রাফসান দাঁড়িয়ে আছে। রাফসানকে দেখে ভুত দেখার মতো তাকিয়ে থাকে ইতি। রাফসান খানিকটা ইতির কাছে এসে বলে,
-কি হলো এমন করে তাকিয়ে আছো যেন ভুত দেখছো। আর তখন কথা বললেনা যে আমি তো তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
ইতি কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
-আ আমি বাসায় যাবো এখন পরে কথা হবে।
ইতি রাফসানকে এড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই রাফসান ইতির হাত ধরে ফেলে। রাফসান বলে,
-এভয়েড করছো আমাকে?
-বললাম তো আমি বাসায় যাবো। পরে কথা হবে।
-তুমি.....
-চলো আমাদের লেইট হচ্ছে।
রোদের হুট করে কথা বলায় রাফসান চুপ হয়ে যায় সাথে ইতির হাতটাও ছেড়ে দেয়। ইতিকে যাওয়ার কথা বলে রোদ আর দাঁড়ায় না চলে যায়। ইতিও একবার রাফসানের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায়। রাফসানকে আর কিছুই বলার সুযোগ দেয় না ইতি।
ইতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে রাফসান। খারাপ লাগছে অনেক ছেলেটার ইতি হয়ত অনেক রাগ করেছে তার উপর এটা ভেবে। ইতিকে না বলে যাওয়া তার উচিত হয়নি।
.
.
.
.
চলবে.........
পর্ব-১২
Eti Chowdhury.
.
.
.
.
-চলো আমাদের লেইট হচ্ছে।
রোদের হুট করে কথা বলায় রাফসান চুপ হয়ে যায় সাথে সাথে ইতির হাতটাও ছেড়ে দেয়। ইতিকে যাওয়ার কথা বলে রোদ আর দাঁড়ায় না চলে যায়। ইতিও একবার রাফসানের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায়। রাফসানকে আর কিছুই বলার সুযোগ দেয় না ইতি।
ইতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে রাফসান। খারাপ লাগছে অনেক ছেলেটার ইতি হয়ত অনেক রাগ করেছে তার উপর এটা ভেবে। ইতিকে না বলে যাওয়া তার উচিত হয়নি। এরপর এই ভুল সে আর করবে না।
বাড়ি ভর্তি মেহমান রাফসানকে নিয়ে ভাবার সময় আর ইতি পায়নি বাসায় আসার পর। রোদ নিজেই ইতিকে নিয়ে এসেছে বাসায়। সে নিজেও আজ আর অফিসে যাবে না। বাড়িতে হৈ চৈ রৈ রৈ অবস্থা। ছোট বেলা থেকেই ইতি জয়েন ফ্যামিলিতে বড় হয়েছে তাই এতো মানুষজন দেখে ইতির ভালোই লাগছে। ৭ দিনের ছুটি নিয়ে নেয়াতে ইতির আপাততো অফিস নিয়ে কোন চিন্তা নেই। হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে ইতির। এর মাঝে অনেকবার রাফসান ইতিকে কল দিয়েছে কিন্তু ইতি আপাততো রাফসানের কল রিসিভ করতে চাইছে না আর করেও না। যা বলার তা সে সরাসরিই বলতে চায়। এভাবে ফোনে কথা বলে কোন কথাই ইতি রাফসানকে বুঝাতে পারবে না। আর ফোনে এতো কিছু বুঝানোও সম্ভব নয়। কারণ অল্প সময়ে এতো কিছু হয়ে গেছে যে তা ইতি নিজেই ঠিক মতো ঠাওর করতে পারেনি। তাই ইচ্ছা করেই রাফসানের কল এভয়েড করছে সে।
ডিনার শেষ করে সব কিছু গুছিয়ে প্রায় রাত ১১টায় ইতি বেড রুমে আসে। ফ্রেস হয়ে রুমে আসতেই ইতি দেখে রোদ রুমের কোথাও নেই। রাতে একদফা স্টাডি রুমে না গেলে রোদের হয় না। তবে আজ সে ডিনারের আগেই স্টাডি রুমে সময় দিয়েছে। সেখানে যে মানুষটার এতো কি তাই ইতি বুঝে উঠতে পারে না। অবশ্য বেশি একটা সময় তো আর হয়নি যে সে এসেছে আস্তে ধীরে সব জানা যাবে। রোদ কোথায় আছে দেখার জন্য ইতির বেলকনির দরজায় এসে দাঁড়াতেই দেখে রোদ দাঁড়িয়ে আছে। ইতি কিছুক্ষণ ইতস্তত বোধ করে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর কিছু একটা ভেবেই ভিতরে প্রবেশ করে। ইতি গিয়ে রোদের পাশে দাঁড়ায়। রোদের পাশে দাঁড়াতেই ইতি চমকে যায়। চমকে গিয়ে ইতি বলে,
-আপনি সিগারেট খান?
রোদ কোন কথা না বলে মুখের সিগারেটটা হাতে নিয়ে সামনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে ইতির চোখে চোখ রাখে। রোদ ইতির দিকে তাকাতেই তার চোখের চাহনি দেখে ইতির বুকের ভেতরটা ধক করে উঠে। উফ.... মানুষটার চোখে কি যেন আছে। ইতি কি যেন একটা দেখতে পায় ঐ চোখ জোড়ায়। খুব গাঢ়, তীব্র কিছু একটা তবে তা কি ইতি তা বুঝে উঠতে পারছে না। রোদ কেবল তাকিয়ে থেকে নিজের দৃষ্টি দিয়েই ইতিকে শেষ করে দিচ্ছে। মানুষটার এমন চাহনি ইতি নিতে না পেরে সেখান থেকে সরে এসে রুমে আসতে নিলে রোদ বলে,
-ওয়েট। কোথায় যাচ্ছো?
ইতি থেমে গিয়ে বলে,
-আসলে সিগারেটের গন্ধ আমার সহ্য হয় না একদম। মাথা ধরে যায় প্রচন্ড। আর মাথা ধরা আমি সহ্য করতে পারি না। তাই...
ইতি আর কিছু বলার আগেই রোদ সিগারেটের আগুনটা নিভিয়ে দিয়ে তা পাশে রাখা এ্যাসট্রেতে গুজে দিয়ে আবার ইতির দিকে তাকায়। বলে,
-থাকো কিছুক্ষণ।
ইতি আবার রোদের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের ঐ চাঁদ টার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-বললেন না? আপনি সিগারেট খান?
রোদ হুট করেই ইতির হাত ধরে একটা হেঁচকা টান দিয়ে ইতিকে একদম নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,
-সিগারেট খাবো না তো কি তোমাকে খাবো?
রোদের কথা শুনে ইতির চোখগুলো যেন এখন সত্যি সত্যি বেরিয়ে আসবে। "লোকটা বলে কি? তার কি মাথা গেলো নাকি? আমাকে খাবে মানে?" এসব ভেবে ইতি নিজেই বিষম খায়। রোদ আরো বলে,
-আজ তোমাকে খাওয়ার পারমিশন নেই তবে কাল। কাল তো আমাদের বাসর কাল খেতে....
সেখানেই থেমে যায় রোদ। ইতির অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে তাকে ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দিয়ে রোদ বলে,
-দেখতেই তো পেলে খাই আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে? এন্ড বাই দ্যা ওয়ে সিগারেট খায় না পান করে।
-হুম,,,
ইতি আর কিছু বলে না তবে তাকে দেখে রোদের মনে হচ্ছে যেন মেয়েটা কিছু একটা নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। হুট করে ইতি বলে,
-আচ্ছা পান করে তরল জাতীয় পদার্থকে আর সিগারেট তো তরল নয় এটার তো ধোয়া নেয়া হয় তাহলে পান করা হবে কেন?
রোদ ইতির দিকে তাকিয়ে হতবাক। এই মেয়ে এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে এসব ভেবে বের করেছে।
-তুমি এতোক্ষণ এসব ভাবছিলে?
-ঠিকি তো ভাবছি। সিগারেট তো পানীয় নয় তাহলে পান করা হবে কেন? এটা ভুল। যে এটা আবিষ্কার করেছেন সে নিজেই হয়ত ডেট এক্স পায়ার গাঞ্জা খেয়ে তা আবিষ্কার করেছে তাই এটা উল্টা পাল্টা করেছে।
রোদ ইতির কথায় আবাক হবে নাকি হাসবে নিজেই বুঝতে পারছে না। এই মুহুর্তে ইতির কথা শুনে রোদ বেচারা নিজেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে না। ইতি রুমে চলে যেতে নিলে রোদ বলে,
-পরশু থেকে কিন্তু অফিস যাচ্ছো মনে আছে তোহ?
ইতি আবার থেমে গিয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-হুম।
একরাশ চিন্তা যেন ইতিকে আবার পেয়ে বসে। কারণ অফিসের কথা মনে হতে সবার আগে রাফসানের চেহারাটাই ইতির চোখে ভেসে উঠে। অফিসে গিয়ে সবার আগে রাফসনেই ফেইস করা লাগবে ইতির৷ মিররের সামনের দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল ইতি। তার যে ফোন বাজচ্ছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই। রাত প্রায় সোয়া ১২টা বাজে। রোদ বেলকনি থেকে এসে দেখে ইতি মিররের সামনে দাঁড়িয়ে তবে তার ফোন বাজচ্ছে সেদিকে মেয়েটার কোন হদিস নেই। রোদ ফোনের কাছে গিয়ে দেখে রাফসান কল দিয়েছে। রোদ ইতির ফোনটা ধরে না। তবে ইতি যে কোনো একটা ভাবনায় ডুবে আছে তা বেশ বুঝতে পারছে। রোদ গিয়ে ইতির পিছনে দাঁড়ায়। ইতির দু'বাহুতে হাত রাখতেই সে কেঁপে উঠে। রোদ আলতো করে ইতিকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
-কি হলো ভয় পেয়েছো?
-হু, নাহ না।
-কিছু ভাবছো?
-না তো কিছু না।
ইতির হদিস হতেই সে দেখে রোদ তাকে প্রায় নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। নিজেকে মানুষটার এতো কাছে অনুভব করে কেঁপে উঠে ইতি। তবে এবার ভয়ে নয় শিহরণে। মিররে রোদকে দেখে ইতির ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে যায়। গলা কাঁপছে ইতির কোন কথা আসতে চাইছে না। রোদ ইতির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
-কিছু যদি নাই হয়ে থাকে তাহলে তোমার ফোনটা যে বেজেই চলেছে ধরছো না কেন?
ফোনের কথা শুনে অবাক হয় ইতি।
-ফোন!!
-হ্যাঁ। দেখেো কে কল করছে এতো রাতে। হয়ত বাসা থেকে।
-হুম।
ইতি জানে এতো রাতে তার বাসা থেকে কেউ তাকে কল দিবে না। তবে একজনের কল দেয়ার সম্ভাবনা আছে। আর সেই একজনটা রাফসান ছাড়া অন্য কেউ নয়। তবে ইতি ভাবছে সে তো তার ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল তাহলে ফোনটা জেনারেল হলো কি করে। সে নিজে তা করেনি এটা তার স্পষ্ট মনে আছে। আর এই রুমে ইতি, রোদ ছাড়া কেউ নেই তাহলে ফোনটা জেনারেল হলো কিভাবে তাহলে কোনভাবে রোদ কি ইতির ফেন ধরেছে। এটা ভাবতেই ইতি রোদের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে। রোদ বলে,
-যাও দেখো।
ইতি ফোনের কাছে এসে ফোনটা হাতে নিতেই দেখে রাফসানের মিসড কল। যা সে মনে মনে ভাবছিল। তবে এখন কোন মতেই সে কথা বলবে না। তাই ফোনটা আবার সাইলেন্ট করতে নিলেই কল আসে ইতির। রাফসানের কল। ইতি ফোনটা সাইলেন্ট করতে পারে না তার আগেই কলটা চলে আসে। ফোনটা বাজচ্ছে ইতি রোদের দিকে তাকায়। ইতিকে তাকাতে দেখে রোদ বলে,
-কি হলো ধরো?
ইতি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে কলটা রিসিভ করে।
-হ্যাঁ।
ফোনের অপর পাশে রাফসান একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। যা ইতি স্পষ্ট শুনতে পায়। রাফসান বলে,
-ফাইনালি তুমি আমার কলটা রিসিভ করলে। আই এ্যাম রিয়েলি সরি দিজ টাইম।
-পরশু অফিসে কথা হবে। রাখছি।
বলেই কলটা কেটে দিয়ে সাথে সাথে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দেয় ইতি। রোদ আর কিছুই জানতে চায় না। তবু ইতি নিজেই বলে,
-রাফসান ছিল। একটু কাজ ছিল নাকি। তাই বললাম একেবারে পরশু অফিসে গিয়ে কথা বলবো।
-হুম।
সব মেহমানরা আরো একদিন আগেই চলে গেছে। সবারই ইতিকে পছন্দ হয়েছে। সবাই খুশি ইতিকে রোদের বউ হিসেবে পেয়ে। কেবলমাত্র মিস্টার চৌধুরীর বুবুজান বাকি। তিনি আসতে পারেননি ইতিকে দেখতে এখনো। একটা সপ্তাহে শাশুড়ির সাথে বেশ গুলেমিলে গেছে ইতি। এতোদিন বিকেলে সবার সাথে বসে গল্প করে কাটানোর কারণে আজ শুয়ে থাকলেও ইতির ঘুম হচ্ছে না। প্রায় ৫ টার দিকে নিজের রুমের দরজায় টোকা পরতেই ইতি উঠে যায়। দেখে মিসেস চৌধুরী এসেছে। তার হাতে দু কাপ চা আর সাথে একটা ডালা। চা খেতে খেতে মানে পান করতে করতে ডালা দেখিয়ে তিনি বলেন,
-আজ তো তোমাদের বাসর সাজানো হবে আর আমি তোমার জন্য পার্লারে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছি। ওরা বাসায়ই আসবে তোমাকে যেতে হবে না। তুমি সব কিছু গুছিয়ে নিয়ো ওরা প্রায় ৮টা নাগাদ চলে আসবে। আর তুমি নিচের গেস্ট রুমে চলে যেও কারণ লোক আসবে তোমাদের রুম সাজাতে।
ইতি কেবল মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয়। ডালা করে মিসেস চৌধুরী ইতির জন্য রাতে পরিধানের কাপড় নিয়ে এসেছেন। লাল রঙের একটা বেনারসি শাড়ি। লাল রঙটা ইতির খুব পছন্দের। তবে রোদের পছন্দের জন্য বিয়েতে তাকে সাদা পরতে হয়েছিল তবে সেটাও দারণ ছিল৷ তবু প্রিয় রঙ বলে একটা ব্যাপার তো থাকেই। ইতি মনে মনে কিঞ্চিৎ খুশি হয় এটা ভেবে, "ভাগ্যিস আজ লাল বেনারসি।" এটা ভেবে আবার লজ্জাও পায় ইতি।
লাল বেনারসি পরে আবার বউ সেজে বসে আছে ইতি। শতশত লাল গোলাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে ইতি আর রোদের বাসর। লাল রঙের সাথে লাল গোলাপটাও ইতির খুবই প্রিয়। ইতি ভাবছে কেবল গোলাপ দিয়ে তাদের বাসর সাজানো হয়েছে কেন? এর পিছনে কি রোদের হাত আছে? থাকার সম্ভাবনাই বেশি মনে করে ইতি। নাহলে কেবল গোলাপ দিয়ে রুমটা সাজাত না সাথে পাতা হলেও দিতো কিন্তু দেয় নি। একটা অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে ইতির ভিতর রোদকে কেন্দ্র করে। লোকটা শক্ত হলেও ইতির সব দিকেই খুব যত্নের সাথে খেয়াল রাখে।
প্রায় পোনে ১১ টা বাজে। এখনো রোদ আসেনি। ১ ঘন্টা হতে চলল ইতি বসে আছে রোদের অপেক্ষায়। এই অপেক্ষায় নিজেই নিজেকে অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে ইতি। রোদ কেমন ধরনে মানুষ তা এই কয়দিনে পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও একটা আন্দাজ করতে পেরেছে সে। রোদ এমন একজন মানুষ সে তার নিজের জিনিস বা তার যা চাই তা নিজের করে নিবে যে কোন কিছুর বিনিময়ে হলেও। ইতির ক্ষেত্রেও সে বিন্দুমাত্র ছাড় দিবে না তা ইতি এতোক্ষণে বুঝে গেছে। "মানুষটা যদি আজকে আমাকে নিজের করে নেয় তাহলে আমি কি তাকে মেনে নিবো না ফিরিয়ে দিবো?" মনে মনে নিজেকে এই প্রশ্নটা করতেই ইতির বুকের ভেতর কেঁপে উঠে। উফফ.. সহ্য এক যন্ত্রনা অনুভব করছে ইতি। তবে এই যন্ত্রনাতেও একটা সুখ সুখ অনুভূতি পাচ্ছে ইতি। তার কি উচিত হবে রোদকে ফিরিয়ে না দিয়ে মেনে নেয়া। রোদ তার অধিকারের দিক দিয়ে এক চুলও ছাড় দিবে না তা ইতি ভালো করেই জানে। আপোষে না হলে রোদ জোর করে হলেও নিজেরটা আদায় করে ছাড়বে তা ইতি বেশ জানে। রোদকে সে ফিরিয়ে দিবে নাকি মেনে নিবে? কি করা উচিত তার। এসব প্রশ্ন মনে মনে নিজেকে করছে আর ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে মেয়েটা। তার ভয় পাওয়াটাকে শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েই রুমে আগমন হয় রোদের। ইতির মাথায় লম্বা ঘোমটা টানা। রোদকে এখনো সে দেখতে পারছে না। আগেই উঠে গিয়ে রোদকে সালাম করবে নাকি রোদ এসে বসলে পরে উঠবে ইতি বুঝতে পারছে না। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ইতির। বসা থেকে উঠতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। মাথার ভিতর ভনভন করছে। মনে হচ্ছে উঠলেই যেন পরে যাবে। রোদ রুমে ডুকে একটু না অনেকটা জোরেই দরজা বন্ধ করল। ইতি চমকে উঠে দরজার শব্দ শুনে। এতো রাতে কেউ এভাবে দরজা লাগায় নাকি তাও বাসর ঘরের। কয়েক কদম সামনে এসে তাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে ইতির ঠিক সামনে তার শাড়ির কুচির উপর মুখ থুবরে পরে রোদ। রোদকে হুট করে এভাবে পরতে দেখে আরো চমকে যায় ইতি। কিন্তু পরে গিয়ে রোদ আর শোয়া থেকে উঠছে না। রোদ ইতির শাড়ির উপর পরেছে উঠছে না দেখে ইতি হালকা রোদের দিকে ঝুঁকে এসে "উহ" বলে নাক ছিটকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সাথে সাথে ইতির চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ইতি চমকে গিয়ে বলে,
-আপনি মদ খেয়েছেন!!!
.
.
পর্ব-১৩
Eti Chowdhury.
.
.
.
.
কয়েক কদম সামনে এসে তাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে ইতির ঠিক সামনে তার শাড়ির কুচির উপর মুখ থুবরে পরে রোদ। রোদকে হুট করে এভাবে পরতে দেখে আরো চমকে যায় ইতি। কিন্তু পরে গিয়ে রোদ আর শোয়া থেকে উঠছে না। রোদ ইতির শাড়ির উপর পরেছে উঠছে না দেখে ইতি হালকা রোদের দিকে ঝুঁকে এসে "উহ" বলে নাক ছিটকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সাথে সাথে ইতির চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ইতি চমকে গিয়ে বলে,
-আপনি মদের খেয়েছেন!!!
রাগে, দুঃখে যেন পাথর হয়ে গেছে ইতি। প্রথমে ভেবেছিল রোদ তার সাথে মজা করছে। কিন্তু না অনেক টানাটানি করার পরেও রোদের কোন হুদিস নেই। আর বিকট গন্ধটার জন্য গা গুলিয়ে আসছে ইতির। একদম সহ্য হচ্ছে না। বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ইতির। রোদ একদম ইতির শাড়ির উপরে পরেছে। তাকে চিল পরিমাণ সরাতে পারছে না ইতি। কিভাবে পারবে? এমন বডি বিল্ডারকে কি ইতির মতো শুটকি মাছ নড়াতে পারে নাকি। ইতির মতো আরো তিনটা ইতি যোগ হলেও মনে হয় না রোদকে নড়াতে পারবে। খুব কান্না পাচ্ছে ইতির কিন্তু সে কাঁদবে না একদম কাঁদবে না। নিজের রাগ, কষ্ট ধরে রাখতে না পেরে বাধ্য হয়ে শাড়িটা রেখেই উঠে পরে ইতি। আগে কাপড় পাল্টে একটা সুতি থ্রি পিস পরে বেলকনিতে চলে আসে ইতি। প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে ইতির এই মুহুর্তে। রোদ নামক মানুষটাকে ইতি একদম বুঝতে পারছে না। কেমন যেন সে। কখনো পাথরের মতো, কখনো তুলার মতো। আসলে মানুষটা কেমন সেটাই বুঝতে পারছে না ইতি। রাগে নিজের কান নিজেই চেপে ধরে ইতি। আর এক মুহুর্ত রোদের কথা সে ভাবতে চায় না। আজ রাতে তো একদমই নয়। "এমন একটা রাতে মানুষটা কিভাবে পারল এমন একটা কাজ করতে। সে কি জানে না আজ আমাদের বাসর? আমি বউ সেজে তাকে গ্রহণ করার জন্য তার পথ চেয়ে অপেক্ষা করছিলাম" মনে মনে এসব আকাশ কুসুম ভেবে আরো বেশি রেগে যাচ্ছিল ইতি। যেন নিজের রাগের আগুণে নিজেই ঘি ঢালছে সে এসব ভেবে। সারারাত ঠিক মতো ঘুম হয়নি ইতির রাগে গা জ্বালা করছিল তার।
রোদের আলো চোখে পরতেই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে রোদের। বিছানায় এলো-পাথারি হয়ে শুয়ে আছে সে। শোয়া ছেড়ে উঠে বসতেই রোদ লক্ষ করে তার নিচে একটা শাড়ি। তার রুমে শাড়ি কার। মাকে ডাকতে নিয়ে রোদের খেয়াল হয় এখন তো সে একা নয় তার বউও আছে। শাড়িটাকে লক্ষ করতেই দেখে এটা ইতিরই শাড়ি বিয়ের আগে কিনে ছিল রোদ তাদের বাসরের জন্য। রোদ নিজের বিয়ের সব শপিং বিশেষ করে ইতির জন্য সব সে নিজেই কিনেছে। এমনকি প্রথম রাতে ইতিকে পরতে দেয়া নাইটিটা থেকে শুরু করে ইতির প্রতিদিনের পরার সব কাপড়-চোপড় রোদের কেনা। উঠে বসতেই রোদের মাথাটা ঝিম করে উঠে। প্রচন্ড ভার ভার লাগছে মাথাটা। হুট করেই মনে হয় ইতি রুমে নেই কোথায় আছে দেখার জন্য আশেপাশে তাকাতেই দেখে কোথাও নেই। ইতিকে খোঁজার জন্য রোদ প্রথমে চেঞ্জিং রুমে দেখে সেখানে নেই তারপর কি মনে করে বেলকনিতে যেতেই দেখে মেয়েটা ঘাড় বাঁকা করে সোফায় বসেই ঘুমিয়ে আছে। ইতিকে দেখে হেসে দেয় রোদ। কিন্তু কথা হলো মেয়েটা এখানে কেন? রাতে কি হয়েছিল? কিছুই মনে পরছে না রোদের। ইতির শাড়িটা বিছানায় পরে আছে। ইতি নিজে বেলকনিতে, চেহারায় একটা বিধ্বস্ত ভাব ফুটে আছে মেয়েটার। তাহলে কি বাই চান্স কাল রাতে ড্রিংসের ঘোরে রোদ ইতির সাথে কোন ফোর্স করেছে। ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন যেন লাগছে রোদের। সে ফোর্স করে আর যাই হোক কারো সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চায় না তাও আবার বিয়ে করা বউয়ের সাথে। এটা ঠিক রোদ সেই সব মানুষদের মধ্যে যারা নিজেরটা আদায় করে নেয়ায় বিশ্বাসী বাই লাভ অর বাই ফোর্স। যেটা আপোষে না হয় সেখানে বল প্রয়োগ করতে পিছ পা হয় না রোদ কখনোই। কিন্তু তাই বলে বউয়ের সাথে ফোর্স করার মতো কাজে রোদ একদম আগ্রহী নয়। আর সবে মাত্র বিয়ে হয়েছে একে অপরের কাছে আসার যথেষ্ট সময় আছে রোদের মতে। মেয়েটা এমনভাবে ঘুমাচ্ছে যে রোদ আর তাকে ডাকতে পারে না। কিন্তু এভাবে ঘাড় ব্যাথা হয়ে যাবে তাই রোদ ইতির কাছে এগিয়ে যায় ওকে রুমে নিয়ে যাবে বলে। ইতির কাছে গিয়ে যেই ওকে কোলে তুলতে নিবে ওমনি সাথে সাথে ইতি চোখ মেলে তাকায়। রোদ তখন ইতির একদম কাছে। ইতি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে। রোদ তড়িৎ গতির বেগে ইতির থেকে দূরে সরে যায়। ইতি বসা থেকে উঠতে উঠতে বলে,
-আপনি এখানে!!
-তুমি সোফায় বসে ঘুমাচ্ছিলে কেন রুম রেখে?
-আমার খেয়াল আছে আপনার?
-কেন আমি কি করলাম?
-থাক সে সব কথা নাই বা বললাম।
বলেই রুমে যাওয়ার জন্য ঘুরতে নিলেই ঘাড় ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে ইতি।
-আআহ
-কি হলো?
নিজের ঘাড় ধরে ইতি। তা দেখে ফিস ফিস করে রোদ বলে,
-এজন্যই কোলে তুলতে নিয়েছিলাম। এখন বুঝো মজা।
-কি বললেন?
-না কিছু না। দেখি কি হয়েছে?
-আপনার দেখা লাগবে না।
বলেই ঘাড় চেপে ধরে রুমে চলে যায় ইতি।
রোদকে ফ্রেস হয়ে বের হতে দেখে এক গ্লাস লেবুর পানি এগিয়ে দেয় ইতি।
-নিন আপনার হ্যাঙ্গওভার কেটে যাবে।
-থ্যাংকস।
ইতি রোদকে আর কোন জবাব না দিয়ে রেডি হতে চলে যায় আজ থেকে অফিস জয়েন করছে সে।
অফিসে এসেও টুকটাক এটা সেটা কাজ নিয়েই ব্যস্ত ইতি। নিজেকে ব্যস্ত রাখছে ইতি এই আর কি। নাহলে ঘুরে-ফিরে রাতের কথাই মনে পরছে ইতির। ঐসব কথা মনে পরছে আর রাগে গদগদ হচ্ছে সে। রোদের রাতে ঘটানো কান্ড মনে পরতেই তার উপর রাগটা বেড়ে যাচ্ছে ইতির। এখন তো রাগে পানিও খেতে শুরু করে দিয়েছে মেয়েটা।
রোদ খুব চেষ্টা করছে রাতে কি হয়েছে সেটা মনে করার জন্য। এটা ঠিক রোদ ইতির প্রতি সম্পূর্ণ লয়েল থাকবে কিন্তু সম্পর্কের শুরুতেই এমন একটা ঘটনা ঘটে গেলো ভেবে কিঞ্চিৎ খারাপ লাগছে ইতির। তবে তার কিছুই মনে পরছে না। রোদ চেষ্টা করছে কিছু মনে করার। আসলেই কি তাদের মাঝে কিছু হয়েছিল নাকি কিছুই হয়নি। রোদ কি ইতিকে ফোর্স করেছিল নাকি সে স্বেচ্ছায় তার কাছে এসেছে নাকি কিছুই হয়নি। কোনটা? এই সব প্রশ্নের উত্তর কেবল ইতিই দিতে পারবে তাকে কিন্তু ইতিকে কিভাবে জিজ্ঞেস করবে রোদ। এমনি সকাল থেকে যে মেজাজ দেখাচ্ছে রোদকে তার উপর যদি জানতে পারে রোদ রাতে নিজের ঘটানো সব ঘটনা ভুলে গেছে তাহলে যে কি হবে আল্লাহই তা ভালো জানেন। অবশ্য রোদ কারো তোয়াক্কা করে না কিন্তু তবুও বউ তো বউই।
-স্যার!!
-হ্যাঁ আদি! কিছু বলছো?
-আপনি কিছু নিয়ে কি চিন্তিত কখন থেকে ডাকছি আপনাকে।
-নাহ তেমন কিছু নয় বলো শুনছি।
-বলছিলাম কি স্যার এখন মনে হয় আপনার আর ইতি ম্যামের বিয়ের ব্যাপারটা অফিসে এনাউন্স করে দেয়া উচিত।
-এখন তো কোন প্রোগ্রাম করছি না সেভাবে তাই..
-তাও স্যার। ম্যাম খুব জলি মাইন্ডের একজন মানুষ। এই আমার কথাই ধরুণ কাজ ছাড়াও ইতি ম্যামের সাথে আমার ভালো একটা ফ্রেন্সশীপ আছে এমন অনেকের সাথেই ফ্রি ম্যাম অফিসে। বাট সেটা যতোদিন সে কেবল মাত্র চৌধুরী গ্রুপের শুধু মাত্র ডোমেস্টিক কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট হেড ছিলেন ততোদিনই ঠিক ছিলো। কিন্তু এখন তার আরেকটা পরিচয় আছে। সে চৌধুরী গ্রুপের এমডির ওয়াউফ, চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ তাই সবার জানা উচিত বিষয়টা। যেন মজার ছলেও কেউ তার সীমা না অতিক্রম করে ফেলে। তাকে অসম্মান করা আপনাকে অসম্মান করার বরাবর।
-হুম। ঠিক আছে আমি দেখছি কি করে যায়। তুমি এসো।
ইতি রাগে নিজের সাথে নিজেই প্রলাপ বকছে। এমন সময় ইন্টারকমটা বেজে উঠে। ইতি রিসিভারটা কানে তুলতেই রোদ বলে,
-আমার কেবিনে এসো এখুনি।
বলেই কলটা ছেড়ে দেয় রোদ। ইতিকে হ্যালো বা কিছু বলারও সুযোগ দেয় না।
"লোকটা আসলে কি আল্লাহই জানে। অসহ্য কর মানুষ একটা" বলতে বলতেই রোদের কেবিনের দিকে যাচ্ছিল ইতি। করিডোরের শেষ মাথায় এসে বামে মোড় নিতেই কেউ টান দিয়ে দেয়ালের সাথে হালকা চেপে ধরে ইতিকে।
-কে!!
বলে চেঁচিয়ে উঠতে নিলেই রাফসান ইতির মুখে হাত রাখে।
সকাল থেকেই ইতির সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছে রাফসান। কিন্তু ইতি তো সেই যে এসে নিজের কেবিনে ডুকেছে এরপর থেকে বের হবার নামই নিচ্ছিল না। রাফসান ইতির কেবিনে যায় না তা নয় কিন্তু মেয়েটা রেগে আছে তাই ভয়ে আর যায়নি সে। এতোটা সময় অপেক্ষা করার পর ইতি বেরিয়েছে আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েই ইতিকে আটকেছে রাফসান। আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েই ইতির মান ভাঙ্গাবে সে। রাফসান এসেছে আজ এক সপ্তাহ অথচ ইতি রাফসানের সাথে একটা কথাও বলেনি। আর থাকতে পারবে না রাফসান ইতির সাথে কথা না বলে আর থাকতেও চায় না। তাই আজ কান ধরে উঠবস করা লাগলে তাও করবে রাফসান। ইতির দেয়া যে কোন শাস্তি মেনে নিবে সে তাও আর ইতিকে তার সাথে রাগ করে থাকতে দিবে না।
-আরে চেচিও না আমি।
রাফসানকে দেখে এতোক্ষণে টনক নড়ে ইতির। কাল রাতের ঘটনায় ইতির খেয়ালই নেই আজ তো তাকে রাফসানের সাথেও কথা বলতে হবে। রাফসানকে জানাতে হবে ইতি এখন মিসেস রোদ আহমেদ চৌধুরী। তাদের মাঝে যে সম্পর্কের সম্ভাবনা ছিল তা শেষ হয়ে গেছে।
রাফসান ইতির হাত ধরে বলে,
-চলো আমার সাথে।
ইতি একদম নড়ে না সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ইতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাফসান পিছন ঘুরে বলে,
-কি হলো চলো? এসো আমার সাথে।
-কোথায়?
-স্টোরে যাবো কথা আছে।
-এখানে বলো কি বলবে।
-এখানে বলা যাবে না কেউ এসে পরবে। চলো।
আবার সামনে এগোতে নিলে ইতি দাঁড়িয়েই থাকে।
-কি হলো ইতি?
-সরি এখন আমি কোথাও যেতে পারব না। এমডি স্যার ডেকেছেন আমায়। যেতে হবে আমাকে।
-তাহলে আমি অপেক্ষা করছি তুমি কাজ শেষ করে এসো।
-নাহ।
-না কেন?
-এখন সম্ভব নয়। আমার মিটিং আছে আজ একটা দেরি হয়ে যাবে।
-ইতি প্লিজ আমাকে এক্সপ্লেইন করার একটা সুযোগ তো দাও। একটা চান্স দাও তোমার মান ভাঙ্গানোর। তুমি এভাবে দূরে দূরে থাকলে আমি কিভাবে তোমার মান ভাঙ্গাবো? একটা সপ্তাহ তুমি এলে না। কেন এলে না সেটাও জানালে না। এটা যে কত বড় শাস্তি ছিল আমার জন্য জানো তুমি? দুদিন তোমার বাসার সামনেও গিয়েছিলাম কিন্তু ভেতরে যাওয়ার সাহস হয়নি। যদি তুমি রিয়্যাক্ট করতে আমাকে দেখে তাই তোমাকে সময় দিলাম। অফিসে শুনলাম তুমি ৭ দিন পরে আসবে তাই অপেক্ষা করলাম এই ৭টা দিন। কিন্তু আর না প্লিজ। এবার অন্তত আমার কথাটা শুনো।
ইতি রাফসানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
-আমাকে স্যার ডেকেছে রাফসান। যেতে হচ্ছে এখন।
রাফসানের একটা কথারও উত্তর না দিয়ে চলে যায় ইতি। বেচারা রাফসান পিছনে অসহায়ের কাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একবার ইতি পিছন ফিরে হেসে দিবে এই আশায় কিন্তু না আজ ইতি তা করল না। একবারও সে পিছন ফিরে তাকায়নি।
ইতির নিজেরও খারাপ লাগছে রাফসানের কথা ভেবে। রাফসানকে আগে না জানানোটা ওর সাথে করা বেঈমানি মনে হচ্ছে ইতির। এটা ঠিক হয়নি। প্রেম না করলেও মিউচুয়াল একটা সম্পর্ক ছিল তাদের। যদি পরবর্তীতে তাদের বিয়েও হতো এতে ইতির আপত্তি ছিল না। প্রেম হওয়া হওয়া একটা ভাবছিল। মাঝে রোদটা এসে সব এমন ভাবে লন্ডভন্ড করে দিলো যে ইতির নিজের চুল নিজেরই ছিড়তে ইচ্ছে করছে। তবে ইতির বেশি শান্তি লাগত যাি সে রোদের মাথার চুলগুলো ছিড়তে পারত। মন ভরে চুল ছিড়তো তাহলে সে। এসব ভাবতে ভাবতেই রোদের কেবিনে যায় ইতি।
-আসবো স্যার?
-এসো।
-ডেকেছিলেন?
-হুম, সময় হয়ে গেছে।
-কিসের সময়! ঠিক বুঝলাম না।
-বুঝবে চলো আমার সাথে। সবাই অপেক্ষা করছে।
-সবাই মানে!!
-এসো আমার সাথে।
রোদ বেরিয়ে যেতে ইতিও তার পিছন পিছন যায়।
সবাই হল রুমে একত্রিত হয়েছে। কোম্পানির যে কোন বড় বা বিশেষ কিছুর এনাউন্সমেন্ট এখানেই করা হয়। আজও হয়ত কিছু এনাউন্স করা হবে তাই সবাইকে এখানে ডাকা হয়েছে। রাফসান হলে প্রবেশ করতেই শুনতে পায় কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের হাবিব সাদিকে বলছে,
-এমডি স্যার হয়ত তার বিয়ের এনাউন্সমেন্ট করবে।
এই কথা শুনে রাফসান তাদের সাথে যোগ দিয়ে বলে,
-কি বললে? এমডি স্যার বিয়ে করল কবে?
-এই তো স্যার এক সপ্তাহ আগে। আপনি ছিলেন না কোম্পানিতে তখন গত শুক্রবারে।
-কই এই এক সপ্তাহে তো আমি কিছুই শুনলাম না আর স্যার তো দিব্যি অফিস করছেন।
-হুট করে বিয়েটা হয়েছে। পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে। বাকি আনুষ্ঠানিকতা পরে হবে এমনটাই শুনেছি।
-ওহ। আই সি।
তখনই রাফসান আদি আর রিমিকে হলে প্রবেশ করতে দেখে তাদের দিকে এগিয়ে যায়।
-হাই আদি।
-হাই রাফসান স্যার।
-হঠাৎ এমডি স্যার সবাইকে ডাকলেন কেন?
-সেটা তো এমডি স্যার নিজেই ভালো জানেন।
-তোমরা কিছু জানো না?
-না স্যার বলতে পারছি না।
-আচ্ছা শুনলাম এমডি স্যার নাকি বিয়ে করেছেন।
-হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন।
-হুট করে এভাবে বিয়ে?
-কোরিয়ানদের সাথে ডিলটা নিয়ে বিজি থাকায় আপাততো পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে। কাজ শেষ হলেই অনুষ্টান করা হবে।
তখনি হলে প্রবেশ করে রোদ। রোদকে প্রবেশ করতে দেকে সবাই চুপ হয়ে যায়। রোদ বলতে শুরু করে,
-হ্যালো এভরিওয়ান। যেমনটা সবাই জানেন আর এতোক্ষণে হয়ত বুঝতেও পেরেছেন কিছু একটা এনাউন্স করব বলেই সবাইকে এখানে একত্রিত করা হয়েছে। এর মধ্যেই অনেকেই আমার বিয়ের গুঞ্জন শুনেছেন। কেউ ভাবছেন এটা গুজব। তাই সেটা ক্লিয়ার করার জন্যই মূলত এখানে সবার আগমণ। ইয়েস ইটস ট্রু। রোদ আহমেদ চৌধুরী আর সিঙ্গেল নেই। তার লাইফ পার্টনার বেটার হাফকে সে পেয়ে গেছে। গত সপ্তাহেই পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান পরে করা হবে। তখন আপনারা সবাই আমন্ত্রিত থাকবেন। সো আজ আপনাদের সাথে আমার মিসেস এর পরিচয় করিয়ে দিবো। গাইস ওয়েলকাম মিসেস রোদ আহমেদ চৌধুরী।
কথাটা বলেই ডান হাতটা পাশে মেলে দিতেই পিছনের দরজার দিয়ে ইতি প্রবেশ করে রোদের হাতে হাত রেখে তার পাশে দাঁড়ায়। সবার মাঝে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায় আবার। রোদ বলে,
-ফাইজা আনজুম ইতি আমার ওয়াইফ মিসেস রোদ আহমেদ চৌধুরী। আমার বিয়ে উপলক্ষে আজ আপনাদের জন্য বুফে বুক করা হয়েছে রাত ৯ টায়। সো ইনজয় গাইস।
রোদ ইতির হাত ধরে তাকে নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে যায়। সবাই নিজের মতো বেরিয়ে গেলেও একজন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই। আর সেই একজনটা রাফসান। রাফসান এতোক্ষণ কি শুনল তা একদম বিশ্বাস হচ্ছে না তার। সব যেন গোলাটে লাগছে তার কাছে। এসব কি হয়ে গেলো। ইতি মিসেস রোদ আহমেদ চৌধুরী!!
.
.
.
.
চলবে.........#বস_বর
পর্ব-১৪
Eti Chowdhury
.
.
.
.
-ফাইজা আনজুম ইতি আমার ওয়াইফ মিসেস রোদ আহমেদ চৌধুরী। আমার বিয়ে উপলক্ষে আজ আপনাদের জন্য বুফে বুক করা হয়েছে রাত ৯ টায়। সো ইনজয় গাইস।
রোদ যখন বলল ইতি তার ওয়াইফতা শুনে ইতি হা হয়ে ছিল। বড়সড় রকমের একটা ধাক্কা খেয়েছে মেয়েটা। এই মুহুর্তে এমন একটা ঘটনার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিল না। রোদ নিজেই না করেছে এখন তারা কাউকে বা অফিসে কিছুই জানাবে না। অথচ আজ তার কি হলো কে জানে ইতির সাথে কোন আলোচনা ছাড়াই হুট করে সবাইকে জানিয়ে দিলো। ইতি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে মাথা তুলে সামনে তাকালেই ইতির বুকটা ধক করে উঠে। রাফসান বড় বড় চোখ করে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। রাফসানের দৃষ্টি দেখেই বোঝা যাচ্ছে ধাক্কাটা ইতির জন্য যতটা বড় ছিল রাফসানের জন্য তা কয়েকগুণ বেশি ছিল।
রোদের এনাউন্সমেন্ট এর পর সে ইতির হাত ধরে তাকে নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে যায়। সবাই নিজের মতো বেরিয়ে গেলেও একজন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই। আর সেই একজনটা রাফসান। রাফসান এতোক্ষণ কি শুনল তা একদম বিশ্বাস হচ্ছে না তার। সব যেন ঘোলাটে লাগছে তার কাছে। এসব কি হয়ে গেলো। ইতি মিসেস রোদ আহমেদ চৌধুরী!! কিভাবে সম্ভব তা?
হল থেকে বেরিয়ে লোক চক্ষুর আড়ালে গিয়ে রোদ ইতির হাতটা ছেড়ে দেয়। রোদের হুটহাট এমন ব্যবহারে ইতি বারে বারে অবাকই হচ্ছে। লোকেটা কখন কি করে আর কখন কি চায় সেটাই বোঝা মুশকিল। রোদ হনহন করে নিজের কেবিনে চলে গেলো। ইতিও তার পিছন পিছন গেলো।
-আপনার সমস্যাটা কি বলবেন আমাকে?
ইতির কথায় অবাক হয়ে পিছন ফিরে তাকায় রোদ।
-কার!!
-কার আবার কি? এখানে আপনি আমি ছাড়া কি কেউ আছি নাকি?
-নো।
-তাহলে আমি প্রশ্ন করলে নিশ্চয়ই আপনাকে করেছি।
-হুম।
-তাহলে বলুন?
-কি বলবো?
-আপনার সমস্যাটা কি?
-আমার কিসের সমস্যা?
-বারে ভুলে গেলেন?
-কি ভুলে গেলাম?
-ওকে ফাইন আমিই বলছি।
রোদ পাশে থাকা সোফাটার সাথে হেলে দাঁড়িয়ে হাত জোড়া নিজের বুকের উপর বেঁধে রিলেক্স হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
-বলো শুনছি।
রোদকে এভাবে দাঁড়াতে দেখেই ইতি গোলতে লাগে। মনে মনে ইতি নিজেকে বলে, "লোকটা কেন এভাবে দাঁড়ায়? সে কি বুঝে আই ফিল পেইন টু লুক হিম লাইক দিস"। ইতিকে চুপ করে থাকতে দেখে রোদ বলে,
-কি হলো বলো।
-হ্যাঁ!! হ্যাঁ।
ইতি মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বলে, " নাহ এভাবে গলে গেলে হবে না ইতি। মানুষটা একটা ইতর প্রজাতির প্রাণী। সে এসব করেই তোকে গলাতে চায়। সে খুব বুঝে সে এসব করলেই আমি গলে যাই। গললে হবে না ইতি। যা বলতে এসেছিস তাই বল"।
-আপনি নিজে আমাকে নিষেধ করলেন আমরা এখন অফিসে কাউকে কিছু বলবো না।
-হুম বলেছি তোহ?
-তো এটা কি হলো?
-কোনটা?
-এই যে মাত্র আপনি এভাবে সবাইকে বলে দিলেন। আবার বুফে আয়োজনও করলেন।
-তোহ?
-আবার তো? আপনি নিজে আমাকে না করে আপনি কেন বলে দিলেন?
রোদ নিজের অবস্থান থেকে খানিকটা সরে ইতির কাছাকাছি এসে বলে,
-আমার যেটা রাইট মনে হয়েছে আমি সেটাই করেছি।
-মানে!!
-সিম্পল। তখন মনে হয়েছে বলবো না তাই বলিনি। এখন মনে হয়েছে বলবো তাই বলে দিলাম। এস পার মাই উইস।
-আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করাটাও প্রয়োজন মনে করলেন না?
-তোমাকে জিজ্ঞেস করলে কি তুমি না করতে?
-হয়ত না করতাম।
-সেটা আমার দেখার বিষয় নয়।
রোদ নিজের টেবিলের কাছে যেতে নিলে ইতি পিছন থেকে বলে,
-কিন্তু,,
রোদ হুট করেই ইতির কাছে চলে গিয়ে বলে,
-আর কিন্তু বলে লাভ নেই। তাছাড়া তোমার কিন্তু আমি শুনছিও না। নাও গো টু ইউর কেবিন নাহলে সবাই ভাববে আমরা কাজ বাদ দিয়ে অফিসে লীলা করছে।
-ছিঃ এটা কেমন কথা?
-এটাই ভাববে সবাই। নাও লিভ।
ইতি রাগে কটমট করতে করতে রোদের কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। এই মানুষটার মধ্যে কি সত্যি কোন মায়াটায়া নেই নাকি। ইতি একদম মানুষটাকে বুঝে উঠতে পারে না। রাগে নিজের সাথেই প্রলাপ বকতে বকতে নিজের কেবিনের দিকে যাচ্ছিল ইতি। যেমনি করিডোরের শেষ প্রান্তে এসে মোড় নিবে ওমনি ঝট করে কেউ একজন ইতির হাত ধরে তাকে টেনে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। প্রথমে আৎকে উঠে ইতি কিন্তু পরক্ষণে লক্ষ করতেই দেখে রাফসান ইতির হাত ধরে তাকে নিয়ে যাচ্ছে।
-রাফসান কি করছো?
রাফসান হালকা পিছন ঘুরে মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলে,
-হুসস...
ইতিকে কথা বলতে নিষেধ করে আর কি। রাফসান ইতিকে নিয়ে কেফেটেরিয়ার পিছনের স্টোরে চলে যায়। এই স্টোরটাতে তেমন একটা কেউ আসে না বললেই চলে। রাফসান ইতিকে স্টোরে নিয়ে গিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে।
-আহ!! রাফসান করছো কি? লাগছে আমার।
রাফসান ইতির কথার কোন জবাব দেয় না। কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকে তারপর জোরে জোরে কয়বার নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
-এজন্যই কি আমাকে এড়িয়ে চলছিলে?
ইতি মাথা তুলে রাফসানের দিকে তাকায়।
-আসলে...
-হ্যাঁ বা না।
-আমার কথাটা তো শুনো।
-আমি জানতে চাইছি হ্যাঁ বা না।
-হ্যাঁ।
রাফসান ইতিকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। ইতি নিজেও অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে রাফসানের দিকে। চোখের পলকেই রাফসান পাশের দেয়ালের সাথে হাতে বারি দেয়। ইতি বাধা দিতে নিলে তাকে ধাক্কা দেয়। বেখেয়ালে তাল সামলাতে না পেরে ইতি ছিটকে গিয়ে পরে কিন্তু ফ্লোরে না কারো বুকে। ইতি কার বুকে গিয়ে পরেছে তা দেখার জন্য সে মাথা তুলে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ইতি চমকে উঠে বলে,
-আপনি!!
ইতি রোদের বুকে গিয়ে পরে। রোদ শক্ত ভাবে ইতিকে আগলে নেয়। জিজ্ঞেস করে,
-তুমি ঠিক আছো তো?
-জ্বি।
কারো কন্ঠ শুনে রাফসান পিছন ঘুরে দাঁড়ায়।
-স্যার আপনি?
রোদ ইতিকে ঠিক করে দাঁড় করিয়ে পিছনে দিয়ে সে নিজে সামনে এসে বলে,
-লুক রাফসান। আমি জানি ওর সাথে তোমার একটা ভালো ফ্রেন্ডশিপ আছে কিন্তু তোমার মনে রাখা উচিত ও আমার বউ, আমার। রোদ চৌধুরীর বউ। আর আমার বউকে কেউ ফুল পরিমান হার্ট করবে তা আর কেউ মেনে নিলেও আমি রোদ চৌধুরী সেটা কখনোই মেনে নিবো না। নেভার।
-বাট স্যার...
রোদ হাত তুলে রাফসানকে থামিয়ে দিয়ে ইতির দিকে তাকিয়ে বলে,
-চলো।
চলো বলেই আর কারো কোন কথা বা জবাবের অপেক্ষায় থাকে না রোদ ইতির হাত ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে চলে যায়। স্টোর থেকে বেরিয়ে এসে রোদ বলে,
-যাও তোমার ব্যাগ নিয়ে এসো আমি কেবিন থেকে আমার ফোনটা নিয়ে নিচে গাড়িতে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
-গাড়িতে কেন?
-বাসায় যাবো।
-বাসায়!!
-হ্যাঁ।
-কিন্তু..
-যা বলছি তার করো।
ইতি আর কোন কথা বলে না চুপচাপ নিজের কেবিনে চলে যায়।
ইতির জন্য ব্যাপারটা একটা ধাক্কার মতো কাজ করে। রোদ সময় মতো না গেলে রাফসান সত্যি সত্যি ইতিকে আঘাত করতে পারত। বা তখন রোদ না গেলে পরে গিয়ে যদি ইতির বড় রকমের কোন ক্ষতি হয়ে যেত তখন কি হতো? আপাততো ওর বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করাটাই ঠিক মনে করে রোদ। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ইতিকে নিয়ে বাসায় চলে যায় সে।
সারা রাস্তায় ইতি রোদের সাথে একটাও বলেনি। ইতি শুধু মনে মনে ভাবছে রোদ কিভাবে জানলো ইতিকে রাফসান কেফেটেরিয়ার পিছনের স্টোরে নিয়ে গেছে। কিভাবে জানলো সে? সেখানে তো কেউ যায় না তেমন একটা। তার মানে কি রোদ সর্বক্ষণ ইতির উপর নজর রাখছে? কিন্তু কেন? রোদ কেন তাকে চোখে চোখে রাখবে? এসব ভেবেই মনে মনে অস্থির হচ্ছে ইতি। গাড়ি থেকে নেমে ইতি সোজা উপরে উঠে যায়। ইতি রুমে ঢুকতেই রোদ তার পিছনেই রুমে ঢুকে দরজাটা পা দিয়ে ঠেলে দিয়ে পিছন থেকেই ইতির হাত ধরে টেনে একদম নিজের কাছে নিয়ে নেয়। ইতি চমকে গিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায়।
-তোমাকে কেউ তিল পরিমান কষ্ট দিতে চাইলে তাকে আগে আমার উপর দিয়ে অতিক্রম করতে হবে। এটা ঠিক আমাদের মাঝে কোন প্রেম, ভালোবাসার সম্পর্ক নেই। কখনো হবে কি না তাও জানি না। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা যেমন সত্য তেমন পবিত্র। আর আমি এর পবিত্রতা বজায় রাখার চেষ্টা করব।
রোদ ইতির কপালের চুল গুলো কানের পিছনে গুজে দিয়ে বলে,
-রেস্ট করো। যা হয়েছে তা নিয়ে ভাবতে হবে না আমি আছি সব সময় তোমার আগে, পিছে সবটা ঘিরে। একটা মিটিং আছে সেরে আসছি।
রোদ আবার বেরিয়ে যায়। ইতি হা করে তাকিয়ে থাকে। ঘন্টা কয়েক আগের রোদ আর এই রোদের মাঝে আবার আকাশ পাতাল পার্থক্য অনুভব করছে ইতি। যে একটু আগে ইতির মতামত নেয়া প্রয়োজন মনে করছিল না সে এখন ইতিকে প্রটেক্ট করছে। বিচিত্র প্রজাতির মানুষ এই রোদ চৌধুরী।
ইতি যখন অফিসে রোদের কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় রোদ নিজেও ইতির পিছনে এসেছিল। কেন এসেছিল তা তার জানা নেই হয়ত ইতিকে আটকাতে এসেছিল। আর তখনই সে দেখে রাফসান ইতির হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর তা দেখেই রোদ আবার নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে তার ল্যাপটপে সিসি ফুটেজ অন করে। অফিসের সব সিসি ক্যামেরার কানেকশন রোদের ল্যাপটপে আছে। রাফসান ইতিকে কোথায় নিয়ে যায় তা দেখার জন্যই ল্যাপটপ অন করে সে। আর সেখানেই দেখে রাফসান ইতিকে কেফেটেরিয়ার পিছনের স্টোরে নিয়ে যাচ্ছে। ফুটেজ দেখে রোদ বুঝতে পারছিল ইতি আপত্তি করছিল কিন্তু রাফসান শুনছিল না তার বাঁধা। রাফসান ইতির কোন ক্ষতি না করে বসে তাই সাথে সাথে রোদ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। ভাগ্যিস সে সময় মতো উপস্থিত হয়েছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই রোদ বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
বাকিটা দিন ইতির শুয়ে বসে আর শাশুড়ির সাথে হেসে খেলেই কাটে। শাশুড়ি হিসেবে মিসেস চৌধুরী অনেক বেশি ভালো এটা ইতির মনোভাব। তার সাথে সময় কাটিয়ে ইতি তার মন খারাপটা ভুলেই যায়। রোদের একটা মিটিং ছিল তাই সে বাইরে থেকে ডিনার করে এসেছে। তাই সে ডিনার করবে না জানিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। ইতি শশুড়-শাশুড়ির সাথে ডিনার করে শাশুড়িকে হেল্প করে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে। বিয়ের আগে অবশ্য ইতি ডিনারের পর অনেকটা সময় বারান্দায় বসত। কিন্তু এখন আর তা হয় না। সেটাও রোদের জন্য। কারণ ঘুমতে যাওয়ার আগে রোদ প্রথমে কিছুটা সময় নিজের স্টাডি রুমে দেয় তারপর একনাগাড়ে দুই থেকে তিনটা সিগারেট খায় থুক্কু খায় না ধুমপান করেন। এটা তার অভ্যাস নাহলে নাকি জনাবের ঘুম হয়না ঠিক মতো। ইতির কাছে এসব আজগুবি মনে হলেও কিছু করার নেই তার। আর সিগারেটের গন্ধ ইতি একদম সহ্য করতে পারে না তার প্রচন্ড রকমের মাথা ধরে যায় সাথে সাথে। এই যেমন এই মুহুর্তে ইতি জানে রোদ বারান্দায় সিগারেটের ধোয়া উড়াচ্ছে আর সেটা সে জানে তাই তার মাথাটা ভার হয়ে আসছে। আর সেজন্যই মূলত ইতির বারান্দায় যাওয়া হয় না।
ইতি রুমের লাইট অফ করে দিয়ে শুধু বেড সাইডের ল্যাম্প লাইট অন রেখে শুয়ে পরে। রোদ রুমে আসতেই দেখে চারিদিকে অন্ধকার। শুধু তাদের মাথার উপরের ধিম লাইটটা জ্বলছে আর বেড সাইডের ল্যাম্প জ্বলছে। মরিচ বাতির মতো হালকা আলো জ্বলছে বিছানাকে কেন্দ্র করে তবে বিছানার গন্ডি পেরিয়ে বাকিটা সব গুটগুটে অন্ধকার। রোদ এসে বিছানায় তার সাইডে বসে। একবার ইতির দিকে তাকায় সে। মনে মনে ভাবে ইতি হয়ত তাকে এক্সপেক্ট করছে এই মুহুর্তে। করাটা স্বাভাবিক আগের রাতেই তো সবটা হয়ে গেছে। এটা ঠিক রোদের হুস ছিল না। আর ইতস্তত বোধ করায় সে আর ইতিকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। তাই এখন ইতির রোদকে কাছে এক্সপেক্ট করাটা অস্বাভাবিক নয়। আর আজ যদি রোদ ইতিকে নিজের থেকে সরিয়ে রাখে বরংচ সেটা অস্বাভাবিক দেখাবে। কিন্তু হুট করে কারো গায়ে হাত দেওয়াটাই বা কেমন দেখায়। আবার পরক্ষণেই রোদ ভাবে তো কি হয়েছে ও তো আমার বউ। কিন্তু বউ হয়েছে তো কি হয়েছে। বউ বলেই কি হুটহাট যখন তখন গায়ে হাত দিতে হবে নাকি। নিজের শারীরিক চাহিদা মেটাতে হবে নাকি। সারারাত তার দেহে মত্ত্ব থাকতে হবে নাকি। এসব চরম পর্যায়ের নোংরামি পনা মনে হয় রোদের কাছে। ইতি তার বউ হয়েছে বলেই তো আর রোদের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেয়নি যে রোদ যখন যেভাবে ইচ্ছা ভোগ করবে তাকে। বরংচ তাদের যে পরিস্থিতিতে বিয়ে হয়েছে এতে রোদ চাইছিল ইতিকে আরো সময় দিতে। কিন্তু গতকাল সে মাতাল হয়ে সব পন্ড করে দিয়েছে। এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে রোদের। নাহ এতো ভেবে লাভ নেই। বেড সাইডের ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পরে রোদ। রুমে কেবল ধিম লাইট জ্বলছে। সব কিছু আবছা আবছা লাগছে। রোদ পাশ ফিরে ইতির দিকে ঘুরে শুতেই মেয়েটা তার চোখে পরে। আবছা আলোয় বেশ মায়া মায়া ভাব ফুটে আছে ইতির মুখে। আবছা আলোয় তা বেশ বুঝতে পারছে রোদ। ইতিকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে ঘুমায়নি। রোদ মনে মনে ভাবে ইতি হয়ত কাছে আসতে চাইছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। লজ্জা পাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই রোদ নিজেই ইতিকে টান দিয়ে কাছে এনে প্রায় তার উপরে উঠে যায়। হুট করে কি হয় ইতি নিজেও তা খেয়াল করতে পারে না। রোদ ইতির ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দেয়। ইতির ঘোড় লাগতে থাকে। বিয়ের আজ ৮ দিন শেষ হলো। এই প্রথম সে তার স্বামীর এমন স্পর্শ পেলো। ঘোরে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ইতির। ইতি শক্ত হয়ে বিছানা চেপে ধরে আছে। বুকের ভেতর বরফের কুন্ডুলি হয়ে গেছে ইতির ভয়ে। আতংকে কথা বলতে পারছে না সে। রোদ যেই ইতির ঘাড়ে মৃদু করে কামড়ে ধরে ইতি বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
-আর কিছুদিন সময় নিলে হয় না?
রোদ সাথে সাথেই থেমে যায়। মুখ তুলে ইতির দিকে তাকিয়ে বলে,
-তুমি চাইছো না এখন?
-না মানে নতুন জীবনের শুরুর আগে আরেকটু সময় নিলে হয়ত ভালো হতো।
রোদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সে ভাবে যা হবার তা তো হয়েই গেছে আর সময় নিয়ে কি হবে। সাথে সাথে আবার মনে হয় আসলেই কি কিছু হয়েছিল তাই রোদ এবার জিজ্ঞেস করেই বসে ইতিকে,
-গতকাল রাতে আমাদের মাঝে কিছু হয়নি?
-আপনার কিছু মনে নেই?
-হয়েছে কিনা সেটা বলো?
-নাহ।
রোদ কারেন্টে শখ খাওয়ার মতো তড়িৎ গতিতে ইতির গায়ের উপর থেকে নেমে নিজের জায়গায় গিয়ে উল্টো হয়ে শুয়ে পরে। ইতি পিছন থেকে বলে,
-আপনার কি গতকাল রাতের কথা কিছুই মনে নেই?
-গুড নাইট।
বলে রোদ আর একটাও কথা বলে না। ইতি মিটমিট করে হাসতে থাকে এটা ভেবে আগের রাতের কথা রোদের কিছু মনে নেই। পেটে খিল ধরে হাসি আসছে ইতির কিন্তু সে হাসতে পারছে না।
সাতদিন পরে।
রাসফসান হুট করেই রোদের কেবিনে প্রবেশ করে। রাফসানকে এভাবে দেখে রোদ জিজ্ঞেস করে,
-তুমি এখানে?
.
.
. ১৫+১৬
পর্ব-১৫
Eti Chowdhury
.
.
সাতদিন পরে।
রাসফসান হুট করেই রোদের কেবিনে প্রবেশ করে। রাফসানকে এভাবে দেখে রোদ জিজ্ঞেস করে,
-তুমি এখানে?
-আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো স্যার।
-বসো।
রোদ খুব ঠান্ডা ভাবে তাকিয়ে আছে রাফসানের দিকে। সে হয়ত আন্দাজ করতে পারছে রাফসান কি বলতে বা জানতে চায়।
-বলো কি বলবে?
-আপনি ইতিকে বিয়ে করলেন কেন?
-তোমার কি মনে হয় না প্রশ্নটা তোমার মুখে বেমানান।
-এই প্রশ্নটা আমার মুখেই মানায় স্যার। আমি যতোটুকু জানি ইতির সাথে আপনার এমন কোন সম্পর্ক ছিল না যা থেকে হুট করেই বিয়ে করার মতো একটা সিদ্ধান্ত আপনারা নিবেন। এমনটা তো হবার কথা ছিল না।
-কোনাটা হবার কথা ছিল আর কোনটা ছিল না সেটা দেখা তোমার কাজ নয়। আর আমি হয়ত এটা বলিওনি যে আমার প্রেম বা পছন্দ করে বিয়ে হয়েছে। আমাদের বিয়েটা সম্পূর্ণ পারিবারিকভাবেই হয়েছে।
-কিন্তু ইতি আর আম...
-প্রথমত তুমি যাকে বার বার নাম ধরে সম্বোধন করছো জানি তোমরা একি ডিপার্টমেন্টের দুইটা সাইড দেখছো সেই সুবাদেই বলছো। বাট ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন মিস্টার রাফসান এহসান আপনার এটা মনে রাখা উচিত সে আপনার কলিগ হওয়া ছাড়াও তার বর্তমানে আরেকটা পরিচয় আছে। সে আপনার বসের ওয়াইফ। আর আমার ওয়াইফের অসম্মান আমি সহ্য করব না।
-বাট স্যার...
-বাট আপনার আর আমার ওয়াইফের একটা ভালো বন্ধুত্ব ছিল তা আমিও জানি। আপনারা একে অপরের ক্লোজ ছিলেন। আপনি আমার ওয়াইফকে পছন্দ করতেন এটাই তো বলতে চান। আমি সবটাই জানি রাফসান। নতুন করে আমাকে কিছু বলতে হবে না। আমার ইমপ্লইরা কখন, কোথায় কি করছে বস হিসেবে সেই খবর রাখাটা আমার দায়িত্ব বলে মনে করি আমি। আই থিংক তুমি যা বলতে এসেছো আমি তা জানি সো ইউ কেন গো নাও।
-ইতি নিজেও আমাকে পছন্দ করে স্যার।
-কারেকশন রাফসান পছন্দ করে না। হয়ত একটা ভালো লাগার তৈরী হচ্ছি কিন্তু প্রেম তো করছিলে না তোমরা। কারণ আমার ওয়াইফের মনে তুমি থাকলে সে আমাকে বিয়ে করত না। তার সম্মতি ছাড়া তো আর বিয়েটা হয়নি। তাছাড়া তার মনে যদি তুমি বা অন্য কেউ থাকত তাহলে সে আমাকে বিয়ে করা তো দূরের কথা আমার সাথে এক ঘরে পর্যন্ত থাকত না। আমার রাত গুলোকে রোমাঞ্চকর করত না। সারারাত আমাকে নিয়ে মেতে থাকত না। সো তার মনে যে আপাততো আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই সেটা তার সাথে কাটানো প্রতিটা রাতই বলে দিচ্ছে আমাকে। আর এখন নিশ্চয়ই বলবে না আমার ওয়াইফের চরিত্র খারাপ।
রোদ স্মিত হেসে আবার বলে,
-নাও ইউ কেন গো।
রাফসান আর কোন কথা না বলে বেরিয়ে যায় রোদের কেবিন থেকে। রোদের বলা প্রতিটা কথা কাটার মতো চুবেছে রাফসানের গায়ে। রাফসান বেরিয়ে যেতেই রোদ নিজের সাথেই বলে,
-তুমি যাই বলো আর যাই করো না কেন রাফসান আমার ওয়াইফকে আমি সবসময় ছায়ার মতো প্রোটেক্ট করব ইনশাআল্লাহ।
রোদ মনে মনে ভাবে ইতিকে প্রটেক্ট করতে এমন হাজারটা বানোয়াট কথা বলতে হলেও সে বলবে।
ইতির উপর অনেক বেশি রাগ হচ্ছে রাফসানের। মেয়েটা এভাবে পাল্টে গেল কিভাবে। নিচের ফ্লোরে নামতে গিয়েই সিড়িতে ইতির সাথে দেখা হয় রাফসানের। রাফসান ইতির হাত ধরে তাকে নিয়ে সিঁড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। হুট করে রাফসানের এমন কান্ড দেখে ইতি অবাক হয়ে জানতে চায়,
-কি হলো?
রাফসান ইতির কথার উত্তর দিচ্ছে না শুধু তাকিয়ে আছে। উত্তর দিচ্ছে না দেখে ২/১ বার জিজ্ঞেস করে ইতিও চুপ হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাফসান বলে,
-ভালো আছো তুমি?
-মানে?
-যা জানতে চাইছি তা বলো।
-হুম ভালো আছি।
-তাহলে যা শুনলাম তাই সত্যি?
-কি শুনলে?
-কিছু না।
রাফসান আর কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে যায়। ইতি দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেটার হুট করে হলো কি। এমন কেন করল কে জানে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ইতি নিজের কাজে চলে যায়। তাকে কাজ শেষ করে বের হতে হবে জলদি।
বাসায় এসে ফ্রেস হয়ে শাড়ি পরে নেয় ইতি। বাসায় প্রায় সময়ই সে শাড়ি পরে। আজও পরেছে। যখন ইচ্ছে হয় তখনি শাড়ি পরে। শাড়িতে নিজেকে বউ বউ লাগে ইতির কাছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে লজ্জাও পায় মেয়েটা। আর যখন পিছনের দেয়াল ঝুড়ে ঝুলে থাকা রোদের ছবিগুলোর প্রতিবিম্ব দেখে ইতি তখন লজ্জায় আটখানা হয়ে যায় সে। লজ্জা পেয়ে নিজের আঁচলেই মুখ লুকায় ইতি। রুমের দরজায় কড়া নড়তেই ইতি চমকে উঠে। এসময় তার রুমে আবার কে। তা জানার জন্য জিজ্ঞেস করতেই দরজার অপর পাশ থেকে অতুল বলে,
-ভাবি আমি।
-ওহ অতুল তুই। দাঁড়া আসছি।
দরজা খুলতে খুলতে ইতি বলে,
-কিরে কিছু বলবি?
-আপনার রুমের পর্দা পাল্টাবো।
-ওহ আয় ভিতরে আয়।
অতুল রুমে ঢুকে হাতে নেয়া পর্দাগুলো বিছানায় রাখে। তা দেখে ইতি বলে,
-সে কিরে কালো পর্দা কেন?
-কালো রঙ তাই।
-আরে কালো রঙ তা আমিও জানি। কিন্তু কথা হলো। যবে থেকে এসেছি আমি এসে দেখি সাদা পর্দা। এখন পাল্টে লাগাচ্ছি কালো। সাদা কালো ছাড়া কি আর রঙ নেই নাকি?
-কালো লাগাবো না তো কি লাগাবো।
-লাল। লাল রঙের পর্দা লাগাবি।
-হ্যাঁ, লাল পর্দা লাগাই শেষে ভাইয়া আমার ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে দিক।
-আর যদি লাল না লাগাস তাহলে তোর ঘাড়ের হলডি ভেঙে ফেলব আমি।
-কিহ!! হলডি? সেটা আবার কি জিনিস?
-যখন ভাঙবো তখন বুঝবি তা কি জিনিস। এখন যা লাল রঙের পর্দা নিয়ে আয় বলছি।
-না তা আমি পারব না।
-কি বললি?
-সাদা বা কালো ছাড়া অন্য পর্দা দিলে ভাইয়া আমাকে আস্ত রাখবে না।
-তোর ভাইয়াকে আমি গুল্লি মারি।
-ভাইয়া।
-আবার বলে ভাইয়া। আমার রুমে আমি আমার পছন্দের পর্দা দিবো। যা বলছি।
-ভাইয়া আপনার পিছনে।
ইতি নিজের মুখে হাত দিয়ে চোখ বড় করে পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়। পিছনে ঘুরতেই দেখে রোদ তার একদম পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিকে পিছনে ঘুরতে দেখে রোদ বলে,
-কি যেন বলছিলে?
-ক কই না তো।
-কিছু তো শুনছিলাম।
-না একদম না।
রোদ রুমের ভিতরে প্রবেশ করতে করতে অতুলকে বলে,
-কিরে অতুল ঝগড়া করছিলি কি নিয়ে?
-না ভাইয়া ঝগড়া করছিলাম না তো।
-আমি তো দেখলাম। আমার বউ টা ঝগড়াটে তা আমি জানি। তুই ঝগড়া করছিলি কেন বল।
ইতি অবাক হয়ে বলে,
-কি বললেন আমি ঝগড়াটে?
-তা নয়ত কি? যেভাবে কোমড়ের শাড়ির আঁচল গুজে নিয়েছো। যে কেউ দেখলেই বুঝবে তুমি কোমড় বেঁধে ঝগড়া করছিলে।
ইতি সাথে সাথে নিজের কোমড়ের দিকে তাকায়। আসলেই কথায় কথায় কখন যেন সে নিজের আঁচল কোমড়ে গুঁজেছে তা নিজেই খেয়াল করেনি। কিন্তু মানুষটা তা ঠিকি লক্ষ করেছে। আঁচলটা ছেড়ে দেয় ইতি।
-কিরে অতুল বল কি নিয়ে ঝগড়া করছিলি?
-না ভাইয়া আসলে পর্দা পাল্টাবো কিন্তু ভাবি বলছে...
রোদ ইতির দিকে তাকায়।
-ভাবি কি বলছে?
-ভাবি বলছে লাল রঙের পর্দা দেয়ার কথা। কিন্তু আপনি তো কালো আর সাদা রঙ ছাড়া পর্দা দেন না।
রোদ ইতিকে বলে,
-তাই নাকি? লাল?
-হুম লাল রঙের পর্দা লাগাবো আমি। সব সময় সাদা আর কালো কেমন একটা শোক শোক ভাব থাকে।
-ওহ। অতুল যা তোর ভাবি যা বলে তাই কর।
-সত্যি ভাইয়া?
-হ্যাঁ সত্যি।
-কিন্তু
-এতোদিন রুমটা শুধু আমার একার ছিল। এখন তো রুম আর আমি দুটোই তোর ভাবির তাই সে যা বলবে তাই হবে। লাল বললে লাল। আর যদি বলে পর্দা দেয়া হবে না তাহলে দিবি না। সব কিছু তার। সব অধিকারও তার। রাজা সমেত রাজ্যও তার। তাই এখানে কেবল তার একক শাসন চলবে।
অতুল আর কোন কথা বলে বেরিয়ে যায়। লাল রঙের পর্দা আনার জন্য। অতুল বেরিয়ে যেতেই রোদ খানিকটা ইতির কাছে গিয়ে বলে,
-অধিকার খাটাতে শিখো। সবটাই তোমার।
ইতি বড় বড় চোখ করে রোদের দিকে তাকায়। রোদ নিজের ঠোঁটটা ইতির কানের কাছে নিয়ে বলে,
-সাদা রঙটা যে কত রোমাঞ্চকর তা সুযোগ পেলে একদিন বুঝিয়ে দিবো।
ইতিকে তার কথার ফাঁদে ফেলে দিয়ে রোদ চেঞ্জ করতে চলে যায়। আর ইতি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
.
.
.
.
চলবে........#বস_বর
পর্ব-১৬
Eti Chowdhury
.
.
-কিন্তু ম্যাডাম স্যার যদি জানতে পারে আমার আর চাকরী থাকবে না।
-আহা আপনার স্যার কিছুই বলবে না। আমি বললাম তো।
-না ম্যাডাম স্যার একদম পছন্দ করে না কেউ তার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করুক।
-কেউ আর আমি এক হলাম নাকি?
-কিন্তু
-যা বলছি চুপচাপ তাই করেন। আমার কথা না শুনলেও যে আপনার চাকরি না থাকতে পারে হয়ত সেটাও জানেন।
-সরি ম্যাডাম।
শেষের কথাটা ইতি ভয় দেখানোর জন্যই বলেছে। সত্যি সত্যি তা মিন করে বলেনি। অফিসের সবাই রোদকে এতোটাই ভয় পায় যে তার বিরুদ্ধে বা অপছন্দে কোন কাজ কেউ করতে চায় না। আর ইতি নিজের কাজ আদায় করে নেয়ার জন্যই এমনটা করল। ইতির বলে দেয়া মোতাবেক সব কাজ হয়ে গেলে সে বেরিয়ে যা রোদের কেবিন থেকে। এখন শুধু অপেক্ষা রোদ এসে যখন দেখবে সব কিছু তার রিয়্যাকশনটা কেমন হবে। আর সেই রিয়্যাকশনটা মিস করতে চায় না সে। তাই রোদের কেবিন থেকে বের হওয়ার আগে ইতি তার একটা ফোনের ক্যামেরা অন করে রোদের কেবিনে লুকিয়ে রেখে আসে। যাতে সেখানে সবটা রেকর্ড হয়ে থাকে। ইতি পরে তা বের করে নিবে সুযোগ বুঝে। ইতির ধারণা রোদ এসে সবটা দেখে অনেক চমকিত হবে সেই সাথে অনেক বেশি খুশিও হবে। কারণ তার বলা কথাই ইতি রাখছে।
রোদ সকাল সকালই অফিস থেকে বেরিয়ে যায় তার একটা মিটিং ছিলো। গলার টাইটা লুজ করতে করতে অফিসে ঢুকে রোদ। এখন প্রায় ২ টা বাজে। মাথা বিগড়ে আছে তার। একটুর জন্য ডিলটা তার হাত ছাড়া হয়ে গেলো। রোদ ভালো করেই জানে অবশ্যই ভেতরের কেউ খবর পাচার করেছে। তা না হলে এই ডিল তার হাত ছাড়া হওয়ার প্রশ্নই আসে না। রোদ যদি একবার জানতে পারে কে তার সাথে গাদ্দারি করেছে তাকে তার যোগ্য শাস্তি সে দিবেই। মাথা অনেক বেশি গরম নিয়েই নিজের কেবিনে প্রবেশ করে রোদ। প্রথমে লক্ষ না করলেও পরক্ষণেই রোদ আশে-পাশে লক্ষ করে। সাথে সাথে সে কেবিনের চারিদিকটায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। এটা তার কেবিনই তো নাকি ভুল করে অন্য কারো রুমে এসে গেছে সে। আবার দরজার কাছে এসে কেবিনের দরজায় নিজের নেইম প্লেট দেখে সিওর হয় রোদ এটা তারই কেবিন। কিন্তু তার কেবিনের এই দশা করল কে। পুরো হুলিয়াই পাল্টে ফেলেছে। আরেক দফায় তার মাথাটা বিগড়ে গেলো। তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ রোদ একদম সহ্য করতে পারে না। ঠিম যেমন এই মুহুর্তে পারছে না। তার কেবিনের কোন কিছুতে কারো হাত দেয়াটা রোদ একদম পছন্দ করে না। আর সেখানে কেউ তার কেবিনের উপরো রুপটাই পাল্টে দিয়েছে। কেবিনের একটা সাইড ঘেষে থাকা থাই গ্লাসের উপরে দেয়া সাদা পর্দার রং বদলে তা হয়েছে আকাশী রঙের। রোদের বসার টেবিলটা আগে থাই গ্লাসের সামনে ছিল সেখান থেকে সরিয়ে তা অন্যপাশের দেয়ালের সাথে দেয়া হয়েছে। সোফার জায়গাও বদল হয়েছে। এসব দেখে মুহুর্তে রোদের বিগড়ে যাওয়া মাথাটা আরো কয়েকগুণ বেশি বিগড়ে গেলো। অফিসের পিয়নদের মধ্যে একজনের নাম সাকু। রোদ সাকুর নাম ধরে চিৎকার করে উঠে।
দেলোয়ার হাঁপাতে হাঁপাতে ইতির কাছে এসে বলে,
-ম্যাডাম জলদি চলুন।
ইতি ক্যাফেটেরিয়াতে নিজের জন্য কফি বানাচ্ছিল। দেলোয়ারকে হাঁপাতে দেখে কফির কাপ রেখে বলে,
-কি হয়েছে?
-স্যার ডাকছে আপনাকে।
-ওহ বুঝতে পেরেছি।
ইতি দেলোয়ারের আর কোন কথা না শুনেই রোদের কেবিনের দিকে ছুটে। দেলোয়ার কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু ইতি পাত্তা দেয়নি তাকে। সে রোদের মুখেই শুনবে যা শুনার। ইতি মনের ভিতর অতিরিক্ত আনন্দ নিয়ে রোদের কেবিনে ঢুকতেই চুপসে যায় খানিকটা। রুমের ভিতর পিনপন সাইলেন্স। সাকু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর রোদ উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। সব এতো ঠান্ডা হওয়ার কারণ ইতি বুঝতে পারছে না ঠিক।
-ডেকে ছিলেন আমায়?
রোদ পিছন ঘুরে তাকাতেই ইতির বুকের ভিতর ডিপ করে উঠে। রোদের চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। এর কারণ কি হতে পারে। রোদ তার গলার টাইটা খুলে তা টেবিলের উপর রেখে ইতির একদম মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। ইতির পিছন পিছন দেলোয়ারও এসেছে। সাকু আর দেলোয়ার দুজনই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে যেন তারা কোন চুরি করেছে অথবা অন্যায় করেছে। রোদ এতটা কাছে আসাতে ইতি সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই রোদ ইতির দু'বাহু শক্ত করে ধরে তাকে আটকে ফেলে। ইতির চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে খুব ব্যাথা পাচ্ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।
-এসব কে করেছে?
-আমার লাগছে।
-আমি জিজ্ঞেস করেছি এসব কে করেছে?
-কোন সব?
-আমার রুমের ডেকোরেশন কে পাল্টেছে?
ইতি এতোক্ষণে বুঝতে পারে রোদ কোন কারণে ক্ষেপেছে। ইতি স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেয়,
-আমি করেছি।
-কেন করেছো?
ইতি চুপ করে থাকে। কি বলবে বুঝতে পারছে না।
-বলো কেন করেছো?
-
-আমার অনুমতি নিয়েছো আমার রুমের জিনিসে হাত দেয়ার?
-আমার অনুমতি লাগবে?
-অনুমতি লাগবে না?
-লাগবে?
-না লাগার কি কোন বিশেষ কারণ আছে? ডোন্ট ফরগেইট তুমি আর দশজনের মতোই আমার ইমপ্লই।
-ইমপ্লই!!
-হ্যাঁ, ইমপ্লই। আমার পারমিশন ছাড়া আমার রুমের জিনিসে হাত দেয়ার সাহস পেলে কোথায় তুমি?
-আমি তো...
-বাসায় যেটা ইচ্ছে করতে দিয়েছি বলেই কি তোমাকে মাথায় তুলে নাচতে হবে নাকি আমার? কোন সাহসে বিনা অনুমতিতে আমার কেবিনে হাত দিয়েছো তুমি? বলো? আনসার মি?
ইতির গলার কথা আটকে আছে। বুক উপচে কান্না আসছে তার। নিজেকে অনেক বেশি ছোট মনে হচ্ছে। ইতি ভেবেছিল তাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হচ্ছে। তাছাড়া রোদ নিজেই তাকে বলেছিল অধিকার খাটাতে শিখতে। যে আগের দিন নিজেই অধিকার দিলো আজ সেই বিনা নোটিশে সব অধিকার কেড়ে নিয়ে গেলো আর ইতি টেরও পেলো না। নিজেকে অনেক বেশি ছোট ফিল করছে সে এই মুহুর্তে।
রোদ সাকু আর দেলোয়ারকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
-আর তোরা। তোদের বেতন আমি দেই। তোদের ম্যাডাম নয়। তাহলে আমার পারমিশন ছাড়া এসব করার সাহস পেলি কোথায়? এখন যদি বের করে দেই তোদের দুটোকে? না করে দেই না বের হো তোরা। একবার যেহেতু করেছিস এরপর নিশ্চয়ই অন্য কাজ করতে বাজবে না তোদের। বের হো তোরা আমার অফিস থেকে।
ইতি অবাক হয়ে যায় রোদের কান্ড দেখে। এই মানুষটাই গতকালকের সেই মানুষটা কিনা বুঝতে পারছে না ইতি। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-আই এম সরি স্যার। দোষটা আমার তাই আপনি যদি মনে করেন শাস্তি দিবেন তাহলে আমাকে দিন প্লিজ। অফিস থেকে কাউকে বের করতে হলে সেটা আমাকে করুন। ওদের কোন দোষ নেই। ওরা কেউ এই কাজ করতে চায়নি। আমি ভয় দেখিয়ে ওদের দিয়ে করিয়েছি।
-ভয় দেখিয়ে?
-জ্বি।
-কি এমন ভয় দেখিয়েছিলে তুমি শুনি।
-আম আমি বলেছিলাম আমার কথা না শুনলে ওদের চাকরি থাকবে না।
কথাটা শুনে রোদ হো হো করে হেসে দেয়। হুট করেই হাসি থামিয়ে ইতির চোয়াল চেপে ধরে বলে,
-হু আর ইউ? কে তুমি? কে? তোমার কথা না শুনলে ওদের চাকরি থাকবে না এটা বলার সাহস পাও কই তুমি?
ইতির মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে কেউ একটা ভোতা ছুরি দিয়ে খুবলে খুবলে তার বুকের ভেতরটা ছেঁড়াবেড়া করে দিচ্ছে। তবু নিজের মনের অবস্থা মুখে না ফুটিয়ে নিজেকে শক্ত রেখে ইতি বলে,
-সরি স্যার আমার ভুল হয়ে গেছে। আই ওয়াজ মিসটেকেন। আপনি চাইলে আমি এখনই অফিস থেকে চলে যাবো।
রোদ ইতিকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
-আপাতত আমার চোখের সামনে থেকে দূর হোও।
-আই এম সরি স্যার।
বলেই সাথে সাথে ইতি রোদের কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
কোন মতে এতোক্ষন নিজের চোখের পানিগুলোকে সামলেছে ইতি। কিন্তু আর পারছে না। নিজের কেবিনে এসে পুরো পানির ঝার ধরে পানি খাচ্ছে ইতি তাও ঠান্ডা পানি। পানি খাচ্ছে আর চোখ বেয়ে পানি পরছে তার। এক মুহুর্ত এই অফিসে থাকতে ইচ্ছে করছে না ইতির। তাই সে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে চোখে-মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে পরে অফিস থেকে। বাসায়ও যাবে না সে আজ। কিছুক্ষণ এমনি পথে ঘুড়াঘুড়ি করে বাবার বাসায় চলে যায় ইতি। ইতিকে হুট করে একা দেখে সবাই কম বেশি চমকে যায়। কিন্তু কেউ কিছু বলে না আর জানতেও চায় না। ইতি বাসায় ঢুকেই সোজা কিচেনে চলে যায়। সেখান থেকে আইসক্রিমের বক্স নিয়ে নিজের রুমে চলে যায় সে। তার মন খারাপের একমাত্র সঙ্গী আইসক্রিম। রুমে ঢুকেই দরজা আটকে দেয় ইতি। ইস্পৃহা ইতিকে আটকাতে চাইলেও ইতির মা বাঁধা দেয়। ওর চোখ-মুখ দেখেই বুঝেছে তিনি কিছু একটা হয়েছে তাই আপাতত ওর একা থাকই ভালো হবে ভেবে বাঁধা দেয় ইস্পৃহাকে। তাছাড়া ইতির বাবাও বাসায় নেই। সে এলেই মেয়ের কি হয়েছে জানা যাবে। কারণ সবাইকে উপেক্ষা করলেও ইতি তার বাবাকে উপেক্ষা করতে পারে না।
প্রতিদিন ইতি বিকেল ৪ টার দিকেই বাসায় চলে আসে। আজ ৮ টা বাজে প্রায় এখনো আসেনি। প্রথমে মিসেস চৌধুরী ভাবে হয়ত অফিসে কাজ আছে তাই আসেনি৷ কখন আসবে জানার জন্য কল দিতেই প্রথম দু বার রিং হলেও তৃতীয় বারের সময় ইতির ফোনটা বন্ধ পায় তিনি। আর তখন থেকেই তার দুশ্চিন্তা শুরু হয়। রোদকেও বেশ কয়বার কল দিয়েছেন। এতে বিশেষ কাজ হয়নি। রোদ নিজেও কল রিসিভ করেনি। আর তখন থেকে ড্রইং রুমে পায়চারি করছেন মিসেস চৌধুরী আর তার পিছনেই প্রেসার মাপার যন্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতুল। একটু চিন্তা করলেই তার প্রেসার বেড়ে যায়। না জানি কখন ফিট হয়ে যায়। ঘড়ির কাটায় ঠিক ১১ বেজে ১০ মিনিট। এমন সময় বাসায় ঢুকে রোদ। রোদকে একা দেখে এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে যায় মিসেস চৌধুরী। তেড়ে যায় তিনি রোদের দিকে,
-কিরে বউ কোথায়?
-বউ কোথায় মানে!!
-ইতি কোথায়?
-ইতি কোথায় আমি কিভাবে বলবো? রুমে নেই?
-রুমে তো তখন থাকবে যখন বাসায় আসবে।
-মানে!! ও বাসায় আসেনি!!
-বাসায় এলে কি আমি তোকে জিজ্ঞেস করি?
এতোক্ষণে রোদের হুস হয়। দুপুরের পরে সে ইতিকে আর দেখেনি। কথাও হয়নি তাদের। মেয়েটাকে ঐভাবে কথা শুনানোর পর একবারও তার কাছে যায়নি সে।
-শীট!!
-সত্যি করে বল কি করেছিস তুই?
-পরে বলবো মা। আগে বউ খুঁজে আনি।
বলেই রোদ দৌড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। নিচে নামতে নামতে অফিসের গার্ডকে কল দেয় রোদ। গার্ড তাকে জানায় ইতি সেই দুপুরের পরেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। কোথায় যেতে পারে ভাবতে লাগে রোদ। এদিক সেদিক করে গাড়ি চালাতে থাকে সে আর ইতিকে খুঁজতে থাকে। মাঝ পথেই রোদের একটা কল আসে৷ রোদ ফোনটা হাতে নিতেই দেখে তার শশুর মানে ইতির বাবা কল দিয়েছেন।
-আসসালামু আলাইকুম বাবা।
-ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো বাবা?
-জ্বি বাবা ভালো। আপনি?
-আছি ভালোই।
-বাবা আপনি কিছু বলবেন?
-ইতি এবাসায় এসেছে তুমি কি তা জানো?
রোদ এক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,
-জ্বি বাবা আমি জানি। বলেই গেছে আমাকে। কেন আপনাদের জানিয়ে যায়নি?
-নাহ।
-হয়ত আপনাদের সারপ্রাইজ দিবে বলেই কিছু জানায়নি।
-হুম। চিন্তা করো না ও ঠিক আছে।
-জ্বি বাবা।
-রাখছি।
শশুরের কথায় রোদ আন্দাজ করতে পারে সে কিছু একটা টের পেয়েছেন। রোদ গাড়ি ঘুরায় ইতিকে আনতে যাবে বলে। কিছু দূর গিয়েই আবার থেমে যায় রোদ। এভাবে যাওয়াটা ঠিক হবে না। সবাই বুঝে যাবে কিছু একটা হয়েছে। অহেতুক সবাইকে চিন্তায় ফেলতে চায় না রোদ। তাই বাসায় চলে যায়। নিজের মাকে সবটা বুঝিয়ে বলে রোদ। তবে সত্যিটা নয়। তাকে শুধু এটাই বলে ইতির তার বাসার জন্য মন কেমন করছিল তাই সে যেতে চেয়েছিল কিন্তু রোদ অনুমতি দেয়নি বলে না বলেই চলে গেছে। মিসেস চৌধুরী তার পুত্রবধূকে চিনেন। রোদের বানানো কথা সে বিশ্বাস করতে চায়নি। কিন্তু ইতি ঠিক আছে শুনে আর কথায় বাড়ায়নি সে।
রোদ অনেক্ষন দরজা ধাক্কানোর পরেও ইতি দরজা খুলছে না। গতপরশু দিন বাবার বাসায় এসে রুমের দরজা বন্ধ করেছে ইতি। আগের দিন সকালে সবাই নাস্তা করার জন্য অনেক ডাকে কিন্তু ইতি সোজা বলে দিয়েছিল সে কিছুই খাবে না শুধু একা থাকতে চায়। তাকে কেউ বিরক্ত করলে তার দুচোখ যেদিকে যায় সে সেদিকে চলে যাবে। মেয়ের জিদ সম্পর্কে ইতির বাবার ভালো জ্ঞান আছে তাই সে সবাইকে বলে দেয় তাকে বিরক্ত না করতে। তাই কেউ আর তালে ডাকেনি। কিন্তু তারপর থেকে কেউ আর ইতির কোন শব্দ শুনেনি। ঘন্টা দুয়েক আগে শশুরের কল পেয়ে রোদ ছুটে এসেছে। ইতি দরজা খোলা তো দূরের কথা একটা কথাও বলছে না। তাই বাধ্য হয়ে রোদ দরজা ভেঙে ফেলে। দরজা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করতেই রোদ দেখে ইতি ফ্লোরে পরে আছে।
.
.
পর্ব-১৭
Eti Chowdhury.
.
.
.
ঘন্টা দুয়েক আগে শশুরের কল পেয়ে রোদ ছুটে এসেছে। ইতি দরজা খোলা তো দূরের কথা একটা কথাও বলছে না। তাই বাধ্য হয়ে রোদ দরজা ভেঙে ফেলে। দরজা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করতেই রোদ দেখে ইতি ফ্লোরে পরে আছে।
বেডের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রোদ। বার বার ইতিকে দেখছে জ্ঞান ফিরল কিনা মেয়েটার। যদিও ডাক্তার বলে দিয়েছেন জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। এক টানা না খেয়ে থাকায় শরীর দূর্বল হয়ে জ্ঞান হারিয়েছে মেয়েটা। রোদের মুখটা শুকনো লাগছে দেখতে এই মুহুর্তে। মনে মনে একটা অপরাধ বোধ তাকে কষ্ট দিচ্ছে। সে মেয়েটাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সেটা রোদ বুঝতে পারছে। সেদিন ওমনটা না করলেই পারত সে। তারই তো বউ। বাসা, অফিস সব জায়গাতেই মেয়েটার দাবি আছে, অধিকার আছে। ঠিক আছে সে কারো হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না তা বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে মেয়েটাকে যা নয় তা বলে দিলো। ইতির বেডের একপাশে তার মা অন্য পাশে শাশুড়ি বসে আছে। বাবা আর শশুর দুজনেই রোদকে চিন্তা করতে নিষেধ করছেন কিন্তু শুধু রোদ জানে সে কেনো চিন্তা করছে। ইতির মুখ একদম ফুলে গেছে। প্রচন্ড জ্বরও এসেছে মেয়েটার। কিন্তু হুট করে এতো জ্বর আসারই বা কারণটা কি। মুখ-টুক ফুলে একাকার অবস্থা। আর মেয়েটাকে এভাবে দেখে রোদ অস্থির হচ্ছে।
এপর্যন্ত বার কয়েক রোদের ফোন এসেছে অফিসে যাওয়ার জন্য। একটা মিটিংয়ের মাঝ থেকেই রোদ হুট করে বেরিয়ে এসেছিল তাই সে কখন যাবে জানার জন্য কয়েকবার ফোন দিয়েছে আদি আর রিমি। প্রথমে ফোন ধরে হাসপাতালে আছে তা জানিয়ে দিয়েছে রোদ কিন্তু এরপর আর ফোন ধরছে না। রোদকে না পেয়ে রিমি মিস্টার চৌধুরী রোদের বাবাকে ফোন দিয়েছে। রোদের অফিস যাওয়াটা জরুরী কিন্তু সে কিছুই জানাচ্ছে না।
-রোদ বলছিলাম কি বাবা তোর তো মিটিং আছে। ক্লাইন্টদের এভাবে বসিয়ে রাখাও ঠিক নয়। ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। তুই নাহয় অফিসে চলে যা। মিটিংটা শেষ করে আয়। আর আমরা তো আছিই বউ মাকে দেখার জন্য।
-না বাবা আমি এখন যাবো না।
রোদ আপত্তি করায় ইতির বাবা রোদের বাবার সাথে সম্মতি পোষন করে বলেন,
-বেয়াই মশাই ঠিকই বলেছেন বাবা। তুমি যাও। কাজটা সেরে আসো। তাছাড়া ডাক্তার তো বলেছেনই জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। আর ততোক্ষণে তোমার কাজও শেষ হয়ে যাবে।
-কিন্তু
-ইতিকে দেখার জন্য আমরা আছি। ওর বাবা-মা, তোমার বাবা-মা। আমরা থাকতে কি ওর কোন অবহেলা হবে? তুমি যাও।
-ঠিক আছে।
বাবা আর শশুরের জোড়াজুড়িতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই রোদ অফিসের জন্য বেরিয়ে পরে। কিন্তু সে আগেই ঠিক করে নেয়। আজকে আর মিটিং করবে না সে। ক্লাইন্টের সাথে কথা বলে আরেকটা মিটিং ফিক্সড করেই বেরিয়ে আসবে আবার।
গাড়িতে বসে সমস্ত পথই রোদ ইতির কথা ভেবেছে, "আমি যদি এমনই করি তাহলে তো আমি ইতিকেও হারাবো। জানি ওকে ভালোবাসি না আমি৷ কখনো বাসবো কিনা তাও জানি না। কিন্তু ও তো আমার বউ। আমার উপর ওর কিছু দাবি আছে, হক আছে, অধিকার আছে। যা আমি চাইলেও অস্বীকার করতে পারব না। আর আমি চাইও না অস্বীকার করতে। আমি তো ওকে মেনে নিয়েই বিয়ে করেছি। আমি আবার মুভ করতে চাই বলেই তো ওর সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিলাম। একা এই নিঃস্বঙ্গ জীবন আমি আর কাটাতে চাই না। আর দম বন্ধ করে জীবন কাটাতে চাই না আমি। তাই তো অতীতের সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে ইতির হাত ধরেছি আমি। তাহলে কেন এভাবে ওকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। শেষে তো ওকে হারাতে হবে আমার। যে একাকীত্ব থেকে বের হতে চাই আমি সেই একাকীত্ব আবার ঘিরে ধরবে আমাকে। ওকে কেন ওর অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি আমি। সম্পর্কের শুরুর আহ্বানটা আমার পক্ষ থেকে হওয়া উচিত ছিল। সেখানে মেয়ে হয়ে ও নিজ থেকে আমার দিকে চার কদম এগিয়ে এসেছে তাও একবার নয় কয়েকবার আর আমি, আমি কিনা ধাক্কা দিয়ে ওকে দশ কদম পিছনে ছুড়ে দিয়েছি। না রোদ সময় আছে এখনো, ওকে আঁকড়ে ধর নাহলে তোর অতীতের আবার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যদি না চাস তাহলে আঁকড়ে ধর ইতিকে। নাহলে ইতিকেও হারাবি তুই। ইতিও তোকে রেখে চলে যাবে যেমন...."
রাত ৮টা বাজে। রোদ সবে এসে হাসপাতালে পৌঁছেছে। অফিসে ঢুকলে আর বের হওয়ার সুযোগ পায় না সে৷ রোদ ভেবে গিয়েছিল সাথে সাথেই চলে আসবে। কিন্তু বাধ্য হয়েই তাকে আজ মিটিংটা করতে হয়েছে। আর সেই কাজে সে এমনভাবেই ফেঁসে গিয়েছিল যে বের হতে পারছিল না। কিন্তু যেই তার বাবা মিস্টার চৌধুরী ফোন দিয়ে বললেন ইতির জ্ঞান ফিরেছে সে বাসায় যেতে চায় রোদ আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা করেনি। হাতে থাকা ফাইলটা সেখানে রেখেই বেরিয়ে পরেছিল। হাসপাতালে আসার সময় রোদ মনে মনে নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়। সে আর কখনোই ইতির উপর ভায়োলেন্স হবে না। তাকে বুঝার সম্পূর্ণ চেষ্টা করবে। সম্পর্কটাকে সুন্দরভাবে শুরু করার চেষ্টা করবে সে। ইতিকে সে আর নিজের থেকে সরিয়ে রাখবে না। নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করবে। এতোটা রাগ রোদের কখনই ছিল না। ঐ ঘটনার পর থেকেই সে এমন হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা হারিয়ে ফেলার ঘটনার পর মানুষগুলো এভাবেই বদলে যায়। তাই রোদও বদলে গেছে। তাকে বদলাতে হয়েছে।
জ্ঞান ফিরার পর থেকে ইতি বাসায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু ডাক্তাররা ছাড়ছে না তাকে। ডাক্তার বলেছিল জ্ঞান ফিরার পর ইতি নরমাল থাকলে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হবে কিন্তু গার্ডিয়ান ছাড়া রোগী ছাড়বেই বা কিভাবে। হাসপাতালগুলোরও তো কিছু দায়ভার আছে। বিনা গার্ডিয়ানে তো পেশেন্ট ছাড়তে পারে না তারা। ইতিকে ভর্তি করার সময় ইতির গার্ডিয়ান রোদ হয়েছিল। বিয়ের পর তো হাজবেন্ডই গার্ডিয়ান হয়। তাই রোদ না আসা পর্যন্ত ইতিকে ছাড়ছে না হাতপাতাল থেকে।
রোদ কেবিনে প্রবেশ করতেই ইতির মা সরে গিয়ে রোদকে জায়গা করে দেয়। রোদ গিয়ে ইতির পাশে দাঁড়ায়। আলতো করে ইতির মাথায় হাত রাখে জ্বরটা কমেছে আগের থেকে তবে এখনো আছো। রোদ জিজ্ঞেস করে,
-এখন কেমন লাগছে তোমার?
ইতি এক পলক রোদকে দেখেই চোখ-মুখ শক্ত করে ফেলে। সাথে সাথেই সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। রোদ বুঝতে পারে তার এমন করার কারণ। মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে অনেক আর পাওয়াটাও স্বাভাবিক৷ তবে রোদ নিজেকে ঠিক সুধরে নিবে। পাশ থেকে মিস্টার চৌধুরী বলেন,
-বউ মা তো বাসায় যেতে চাইছে।
-ডাক্তার কি বলে?
-সব নরমাল সমস্যা নেই।
-তাহলে আমার বউ বাসায় যাবে। আমি ফর্মালিটিস সব শেষ করে আসছি।
বলেই রোদ কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। ইতিকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে।
ইতি একবার বায়না করেছিল বাবার কাছে বাবার বাসায় যাওয়ার জন্য কিন্তু রোদ রাজি হয়নি। আর রোদের সাথে সে একটা কথাও বলছে না এই মুহুর্তে তাই আর কথা বাড়ায়নি সে।
বাড়ির মেইন গেইট দিয়ে গাড়িটা ঢুকে থামতেই রোদ আগে নেমে যায়। সে নেমেই ইতির সাইডের দরজা খুলে দেয়। যেই ইতি বের হতে নেয় ওমনি হুট করে রোদ তাকে কোলে তুলে নেয়। আচমকা রোদের এমন কান্ডে বোকা বনে যায় ইতি। ইতিকে অবাক হতে দেখে রোদ বলে,
-এতো অবাক হওয়ার কি আছে? আমার বউ অসুস্থ তাকে কি আমি পায়ে হাঁটিয়ে নিবো নাকি? অসুস্থ বউকে পায়ে হাটানোর জন্য এই বডি বানিয়েছি নাকি?
একদম বেড রুমে গিয়েই রোদ ইতিকে কোল থেকে নামায়।
রোদ ফ্রেস হয়ে এলে তার ডিনার রুমেই দেয়া হয়। ইতিকে রেখে সে নিচে যাবে না খেতে। তাছাড়া ইতিকেও একদম তরল খাবার দিতে বলেছে ডাক্তার। তাই ইতির জন্য সুপ করে পাঠিয়েছেন মিসেস চৌধুরী। রোদ ইতির মুখের সামনে সুপ ধরতেই সে মুখ ঘুরিয়ে নেয় খাবে না বলে। কিন্তু মুখে কোন কথা বলছে না সে। অবশ্য চাইলেও কথা বলতে পারবে না ইতি। ইতির টনছিলের সমস্যা আছে। ছোট বেলা থেকেই তার ঠান্ডা জাতীয় জিনিস খাওয়া নিষেধ। কিন্তু সেই দিন রোদের করা অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের রাগ সে নিজের উপরেই মিটিয়েছে। নিজের রাগ কন্ট্রোল করার জন্য পুরো বিশাল আকারের এক বক্স আইসক্রিম খেয়ে নিয়েছে মেয়েটা। শুধু তাই নয় ঘন্টার পর ঘন্টা শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়েও থেকেছে যার ফলে ঠান্ডা পেয়ে টনছিল ফুলে গেছে আর ব্যথায় এখন কথাই বলতে পারছে না মেয়েটা। গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না তার।
-কি হলো খাও?
ইতি খাবে না বলে মাথা ঝাঁকায়।
-দেখো খিদায় আমার পেট চো চো করছে। তুমি না খেলে আমিও খেতে পারছি না প্লিজ খেয়ে নাও।
রোদের কথার সুর শুনে ইতি রোদের দিকে তাকায়। ইতিকে তাকাতে দেখে রোদ বলে,
-প্লিজ।
ইতির কেমন একটা মায়া পরে যায়। সে আর মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না রোদের থেকে। আসলেই রোদকে আজ দেখতে কাহিল লাগছে। অন্য দিন থেকে আলাদা লাগছে তাকে আজ। বাধা না দিয়ে খেয়ে নেয় ইতি।
খাওয়া শেষ করেই ইতিকে তার মেডিসিন দিয়ে রোদ বিছানায় উঠে ইতির পাশে বসে। আলতো করে ইতির কপালে একটা চুমু একেঁ দিয়ে রোদ বলে,
-ঘুমিয়ে পরো। তোমার অনেক ধকল গেছে আজ। ঘুমাও।
ইতিকে শুইয়ে দিয়ে রুমের লাইট অফ করে দিয়ে রোদ নিজেও শুয়ে পরে তার পাশে। এর আগে দুজন খাটের দুই প্রান্তে শুলেও আজ মোটামোটি বিছানার মাঝামাঝি শুয়েছে। একটা ছুই ছুই ভাবছে তাদের মাঝে। হতেও পারে রাতে ঘুমের ঘোরে ইতি গিয়ে রোদের বুকে আশ্রয় করে নিবে। আর রোদ শক্ত করে তার বউকে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখবে।
.
.
পর্ব-১৮
Eti Chowdhury
.
.
.
তিনমাস পর একদিন রাত ৮টায়।
-ভাবি আপনি রাখেন আমি করছি।
-তোকে কথা কম বলতে বলেছি। আমি যা বলছি তুই তাই কর।
-আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে পরে ভাইয়া আমাকে বকবে।
-অতুল তুই চুপ থাকত নাহলে তোর কথায় আমি ডিসট্রেক্ট হয়ে নিচে পরে যাবো।
-সেজন্যই তো বলছি।
-আর যদি কথা বলেছিস তো তোকে আমি পাঠিয়ে দিবো।
অতুল আর কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এই তিনমাসে অতুল এতোটুকু তার ভাবিকে চিনে গেছে সে একবার কিছু করবে ভেবে নিলে তারপর আর কারো শুনে না। প্রতিদিনই ইতি ৪ টার পরে পরেই বাসায় চলে আসে। ইদানিং ইতি তার কাজগুলো আদিকে বুঝিয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে। মনে মনে সে অফিস ছেড়ে পাক্কা গৃহিনী হওয়ার প্ল্যান করছে যা এখনো রোদ জানে না। ইতি জানে না রোদ জানার পরে কি বলবে বা রিয়্যাকশন দিবে। অবশ্য আর যাই বলুক না কেন সে ইতি তার তোয়াক্কা করে না। আর এটা গত তিন মাসে ইতি রোদকে হারে হারে টের পাইয়ে দিয়েছে। ঐ ঘটনার পর ইতি রোদের সাথে প্রায় এক মাস কোন প্রকার কথাই বলেনি এমনকি একটা শব্দও নয়। কিন্তু হুট করেই ঐ ঘটনার পর থেকে ইতি রোদের মাঝে একটা পরিবর্তন লক্ষ করেছে। পরিবর্তনটা ইতি খুব করে উপলব্ধি করেছে। যা ইতি রোদের মাঝে গত হয়ে যাওয়া ২ বছরে দেখেনি এমন কিছু সে গত তিন মাসে দেখেছে। ইতি সব চাইতে অবাক হয়েছে এটা দেখে গত তিন মাসে রোদ ইতিকে ছাড়া এক বেলাও খায়নি। অফিসে যত কাজের চাপই থাকুক না কেন সব কাজ সাইড করে রোদ ইতির সাথে লাঞ্চ করেছে। এমনকি প্রতিদিন ইতি অফিস থেকে বের হওয়ার সময় রোদ নিজে নিচে নেমে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে দেয় সাথে এটাও বলে দেয় ইতি যেন তার জন্য ডিনারে অপেক্ষা করে একসাথে খাবে তারা। হুট করে মানুষটার এমন পরিবর্তন। তাও প্রথম এক মাস কোন কথা বলেনি ইতি রোদের সাথে। যদিও সেই এক মাসের প্রায় ১৫/২০ দিনই ইতি টনসিলের জন্য কথা বলতে পারেনি। তারপর একদিন রাতের ঘটনা,
ইতি ঘুমানোর জন্য বিছানায় যেতে নিলেই রোদ হুট করে তাকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরে নিজের কাছে নিয়ে নেয়। ইতির পিঠটা আশ্রয় করে নেয় রোদের বুকে। হুট করে রোদের এমন কান্ডে চমকে উঠে ইতি। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে কন্ঠের কাঠিন্যতা বজায় রেখে বলে,
-কি হচ্ছে কি?
-সেটা তো আমি জানতে চাই।
-মানে!!
-আমাকে ইগনোর করছো কেন?
ইতি মনে মনে অবাক হয় আরো বেশি এটা ভেবে সে তাকে ইগনোর করছে এটা তার চোখে ধরা পরেছে আর তা নিয়ে সে ভাবছেও।
-বলো?
-কিহ?
-আমাকে ইগনোর করছো কেন?
ইতি নিজেকে রোদের বুক থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
-ইগনোর করাটা কি ভুল কিছু হচ্ছে?
-কেন আমাকে ইগনোর করছো?
-শুধু ইগনোর নয় আমার পক্ষে সম্ভব হলে আমি আপনার মুখও দেখতাম না।
-কেন?
-কেন সেটাও বলতে হবে আমাকে? সত্যি আপনি জানেন না? নাকি জেনেও না জানার ভান করছেন?
-কি বলবা সরাসরি বলো।
-আপনার সাথে কথা বলারই ইচ্ছে নেই আমার।
ইতি সরে যেতে নিলে রোদ শক্ত করে ইতির হাতের কনুই বরাবর ধরে।
-আহ!! লাগছে আমার।
-আমার কথার উত্তর না দিয়ে নড়ার সাহস কোথায় পেলে তুমি।
-এই যে এই জিনিসটা। আপনি কি মনে করেন? আপনি যার সাথে যেমন ইচ্ছে ব্যবহার করবেন। যা ইচ্ছে বলবেন। যা ইচ্ছে করবেন। বিকেলে বাসায় অধিকার দিবেন আর পরের দিন দুপুরে অফিসে গিয়ে সেই অধিকার কেড়ে নিবেন? কেন ভাই কেন? আমি কি পানিতে পড়ে গেছি নাকি? ভুলে যাবেন না আমি আমি রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল আবু আনজুম আরাফাত এর মেয়ে, চৌধুরী বাড়ির পুত্রবধূ। আপনাকে কে অধিকার দিয়েছে আমাকে বাইরের কারো সামনে অপমান করার। কোন সাহসে আপনি আমাকে অধিকার দিয়ে আবার তা কেড়ে নিলেন? আমি কি চেয়েছিলাম আপনার কাছে কোন অধিকার? তাড়াহুড়ো করে জোর জবরদস্তির বিয়েটাও আপনি করলেন। আমাকে নিজের সাথে স্বাভাবিক করার চেষ্টাও আপনি করলেন। অধিকারও আপনি দিলেন। কেন আমি বলেছিলাম কিছু? না চেয়ে ছিলাম কোন অধিকার? তাহলে আপনি কোন সাহসে বাইরের লোকের সামনে আমাকে ছোট করলেন? কি ভাবেন কি আপনি নিজেকে? আপনাকে বিয়ে করে কি আমি পানিতে পরে গেছি নাকি? জোর পূর্বক আপনি আমাকে নিজের বউ করেছেন। আমি আসিনি আপনার বউ হতে। বা আপনাকে বিয়ে করতে। শুধু আপনার জন্য আমার মনে কারো প্রতি জন্ম নেয়া অনুভূতিগুলো ডানা ঝাপটাতে পারেনি।
রোদ ইতির ঠোঁটের উপর আঙ্গুল দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-হুস,,তোমার মুখে আমি অন্য কারো নাম শুনতে চাই না।
রোদের হাত সরিয়ে দিয়ে ইতি বলে,
-শুনতে হবে আপনাকে। আপনাকে শুনতে হবে আপনার জন্য আমার মনে কোন অনুভূতি নেই। তবে এই মুহুর্তে যা আছে তা.....
-জানি নেই। আমি জানি। আমি জানি তোমার মনে আমার জন্য কোন অনুভূতি নেই। হতে পারে এই মুহুর্তে তোমার মনে আমার জন্য যা আছে তা কেবল ঘৃণা। তবু তোমার মুখে আমি অন্য কারো নাম শুনতে চাই না। তুমি আমাকেই ভালোবাসবে। শুধু আমাকে। সেটা হোক জীবনের শেষ মুহূর্তে।
ইতির প্রচন্ড রাগ উঠে যায়। সে আর কথা বাড়াতে চায় না তাই চলে যেতে নিলেই রোদ আবার তার হাত ধরে আটকে ফেলে। ইতি থেমে যায়। রোদ তখনও ইতির হাত ধরে আছে। পিছন ঘুরতেই ইতি দেখে রোদ মাথা নিচু করে রেখেছে। ইতি পিছন ঘুরতেই রোদ মাথা না তুলেই মেয়েটাকে অবাক করে দিয়ে বলে,
-সরি।
প্রথমে ইতির মনে হয় সে ভুল শুনছে।
-কিহ!!.
-সরি।
-কি বললেন আপনি?
-আমি সরি।
রোদ মাথা তুলে তাকাতেই তার চোখের দিকে দেখে ইতির মনে একটা মায়া পরে যায় তার জন্য। একটু আগে হওয়া যে রাগ ইতির ছিল, রোদের চোখের দিকে তাকিয়ে যেন নিমিষেই তা পিষিয়ে গেছে। ইতি আর কথা না বাড়িয়ে রোদকে একটা ঝামটি মেরে বলে,
-ঘুমাবো আমি ছাড়ুন। রাত বিরাতে ঢং।
রোদ আর কিছু বলে না। ততক্ষনে সেও বুঝতে পেয়েছে ইতির মান কিছুটা ভাঙ্গতে সে সক্ষম হয়েছে।
গত তিন মাস ধরে ইতির মান ভাঙ্গানোর সম্ভাব্য সকল রাস্তাই অবলম্বন করে যাচ্ছে রোদ।
শশুর-শাশুড়ি ছাড়া বিয়ের পরে এই বাড়িতে এসে অতুলের সাথে ইতির বেশ একটা সম্পর্ক হয়েছে। মুখে ভাবি বললেও অতুল নিজের বোনের মতোই দেখে ইতিকে। যদিও ইতির সব কথাই অতুল শুনে তবু রোদকে সে জমের মতো ভয় পায়। রোদের বাবার একটা ট্রাস্ট আছে আর সেই ট্রাস্টের একটা সংস্থা হলো চৌধুরীবাড়ি এতিমখানা। সেই এতিমখানা থেকে রোদের বাবা-মা অতুলকে নিয়ে এসেছিল ছোট বেলায় রোদের জেদের কাছে হার মেনেই। আর তখন থেকে অতুলও এই বাড়ির একজন।
-ভাবি।
-হ্যাঁ বল।
-এবার আপনি নামেন বাকিটা আমি করে নেই না হয়।
ইতি অতুলকে জবাব না দিয়ে নিজের কাজে মন দেয়।
আজ অফিস থেকে বাসায় ফিরেই ইতি শুনতে পায় তার শাশুড়ি অতুলকে বলছিলেন রোদের স্টাডি রুমটা অনেকদিন পরিষ্কার করা হয় না। রোদের বেশিরভাগ সমস্ত কাজ অতুলই দেখে। তার জিনিসে অতুল ছাড়া অন্য কারো হাত দেয়া রোদ একদম পছন্দ করে না। স্টাডি রুমের কথা শুনেই ইতির মনের ভিতর একটা ইচ্ছে উদয় হয়। রোদ প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় স্টাডিতে কাটায়। কিন্তু সেখানে কি আছে তা ইতি জানে না। কারো অনুমতি নেই স্টাডিতে যাওয়ার এমনকি ইতিরও নেই। এখন রোদও বাসায় নেই এটাই ইতির মোক্ষম সময় কি আছে সেখানে জানার। কিন্তু এতোক্ষন ধরে দেখেও সারা স্টাডিতে রোদের ফাইলপত্র, ডকুমেন্ট শেলফ ভর্তি বই ছাড়া কেবল একটা ডায়রি পেয়েছে ইতি। এছাড়া তেমন কিছুই নেই। আপাতত ডায়রিটাকে নিয়েই ইতির কৌতুহল। কারণ ডায়রিটা একটা বইয়ের আড়ালে রাখা হয়ে ছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কেউ ইচ্ছে করে ডায়রিটাকে আড়াল করতে চেয়েছে। তাই চট করে ইতি ডায়েরিটা নিয়ে নেয়।
-ভাবি।
-অতুল তুই যদি আর একবার ডাকিস তোকে আমি স্টাডির বাইরে দাঁড় করিয়ে দিবো বলে দিলাম।
-ভাবি।
-অতু..
ইতি টুলের উপরে উঠেছিল শেলফের উপরে দেখার জন্য। আচমকা পিছন ঘুরতে নিয়েই পরতে নেয় সে। আর তখনি রোদ ইতির পেটে হাত দিয়ে আটকে ফেলে তাকে পরা থেকে। অবস্থাটা এমন ইতি নিচের দিকে পরতে নিয়ে আটকে আছে আর রোদ নিচ থেকে তাকে উপরের দিকে ঠেলে ধরে রেখেছে যেন পরে না যায়। রোদকে দেখে প্রথমে ভুত দেখার মতো তাকিয়ে থাকে ইতি কিছুক্ষণ তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় ইতি। ডায়রিটা রোদ ইতির হাত থেকে নিতে নিলে সে হাত উপরে তুলে ফেলে।
-ওটা আমাকে দাও।
-উহু।
মুহুর্তেই যেন রোদের চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে রেগে যাচ্ছে আবার। রাগ তাকে আবার চেপে বসছে।
-তুমি আবার আমার জিনিসে হাত দিয়েছো?
-আপনি আবার রেগে যাচ্ছেন।
কথায় আছে না মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাসের দাসত্ব থেকে মানুষ চাইলেই হুট করে বেরিয়ে আসতে পারে না। তাই রোদও পারছেনা। হুট হাট অনেক সময়ই সে রেগে যায় কিন্তু তার রাগ ফেটে পরার আগেই সে নিজেকে সামলে নেয়। কারণ সে নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করেছে সে নিজেকে সুধরে নিবে। তাই নিজেকে শান্ত করে নিয়ে রোদ ঠান্ডা গলায় বলে,
-ডায়রিটা দাও।
-উহু, আমি দেখবো এটাতে কি এমন আছে।
-এটাতে কিছুই নেই। আমাকে দাও।
-কিছু তো আছেই।
-বললাম তো কিছু নেই।
-আপনি আবার রেগে যাচ্ছেন।
-বার বার বলছি দিচ্ছো না কেন?
-আবার ভায়োলেন্স হচ্ছেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রোদ বলে,
-সরি।
-কি!!
-সরি।
-কি বললেন ঠিক বুঝলাম ন।
রোদ হুট করেই টুলের উপরে উঠে একদম ইতির গায়ের সাথে গা লাগিয়ে দিয়ে দাঁড়ায়। মুখটা ইতির কানের কাছে নিয়ে আবার বলে,
-সরি শুনতে পাও না।
-হুম...
ইতি যেন মুহুর্তেই জমতে থাকে। আর সুযোগেই ইতির হাত থেকে রোদ ডায়রিটা নিয়ে নেয়।
-এটা ঠিক নয়। আমি দেখব এটাতে কি আছে।
-এখন নয়। সময় হলে আমি নিজেই তোমাকে দেখাবো।
-না আমি এখন দেখবো।
-বললাম তো এখন নয়।
-না আপনি করে দেখাবেন না।
-রোদ চৌধুরী তার কথার খেলাফ করে না।
ইতি একটু ভেবে তার হাতটা রোদের সামনে মেলে দিয়ে বলে,
-প্রমিজ?
রোদ ইতির হাতটা ধরে বলে,
-আই প্রমিজ। আমি নিজে দিবো দেখতে তোমায়। কিন্তু এখন নয় সময় মতো।
.
পর্ব-১৯
Eti Chowdhury
.
.
.
-প্রমিজ?
রোদ ইতির হাতটা ধরে বলে,
-আই প্রমিজ। আমি নিজে দিবো দেখতে তোমায়। কিন্তু এখন নয় সময় মতো।
রোদ ইতিকে ছেড়ে দিতেই সে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। এতোক্ষন মনে হচ্ছিল কেউ তার গলা চেপে ধরে রেখেছিল তাই দম ফেলতে পারছিল না মেয়েটা। মনে মনে ভাবে, “লোকটা সবসময় আমার সাথে এমন করে”। মুহুর্তেই ইতির মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি খেলে যায় তাকে জব্ধ করার জন্য। ইতি চলে যেতে নিতে আবার থেমে দাঁড়ায়। পিছন ঘুরতেই রোদ বলে,
-কিছু বলবে?
-আ্যাম...বলছিলাম কি।
-কি?
-মানে, না থাক কিছু না।
ইতি আবার চলে যেতে নিলে রোদ পিছন থেকে তার হাত ধরে টান দিয়ে তাকে একদম নিজের বুকে নিয়ে নেয়। আচমকা টানের তাল সামলাতে না পেরে ইতি গিয়ে রোদের বুকে আছড়ে পরে। ইতির চিবুকে হাত দিয়ে মুখ উপরে তুলে রোদ জিজ্ঞেস করে,
-বলো কি বলবে?
-ম...মা
-মা কি?
-মা একটা কথা বলেছিলেন।
-কি কথা?
-বলছিলেন যে
-যে?
-যে তাকে নাতি-পুতির মুখ কবে দেখাবো?
কথাটা বলেই লজ্জা পেয়ে ইতি নিজের মুখ ঢাকে হাত দিয়ে। কথাটা শুনে রোদ প্রথমে থ মেরে যায়। কিঞ্চিৎ ইতস্ততও বোধ করে। তারপর ইতির মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলে,
-মা তোমাকে এই কথা বলেছে?
-হুম।
-সত্যি বলেছে?
-তো আমি কি মিথ্যা বলবো নাকি?
-না তা নয়।
রোদ দু’সেকেন্ড চুপ থেকে হুট করেই ইতিকে কোলে তুলে নেয়।
-এই করছেন কি? পরে যাবো আমি।
-এই এক্সপিরিয়েন্স তোমার আজ নতুন নয়। পরবে না সেটা তুমি ভালো করেই জানো। তোমার বর দূর্বল নয়।
-প্লিজ নামিয়ে দিন।
-নামাবো। সময় মতো নামাবো। এখন একটু চুপ করে আমার বুকে মাথা রাখো তো না হলো দুম করে ফেলে দিবো বললাম।
ইতি ভয়ে চুপসে গেছে। নিজের অজান্তেই রোদের গলাটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে। যদি সত্যি সত্যি রোদ তাকে ফেলে দেয়। ইতিকে কোলে নিয়ে রুমে ঢুকে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে রুমের দরজাটা লাগিয়ে দেয় রোদ। ইতিতে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রোদও তার পাশে আধোশোয়া হয়ে শুয়ে পরে। ইতি উঠতে চাইলে তাকে বিছানায় চেপে ধরে। ইতি বলে,
-কি হলো?
-কি হলো মানে? তুমিই তো বললে।
-আমি কি বললাম?
-বারে মা নাতি-পুতির মুখ দেখতে চেয়েছেন না?
-হুম, তোহ?
-তো আবার কি তাকে নাতি-পুতির মুখ দেখনোর ব্যবস্থা করতে হবে না বুঝি? এবার তো রাতগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। অবশ্য তুমি চাইলে আমরা দেশের ভিতরে বা বাহিরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারি তাহলে তখন আর দিন-রাত কখনোই কেউ আমাদেরকে বিরক্ত করতে আসবে না। আর লাইট অফ করে দেয়ার পর তো রাত ও রাত, দিন ও রাত।
ইতি ধাক্কা দিয়ে রোদকে সরিয়ে দিয়ে উঠে যায়।
-একদন না। অফিসে অনেক কাজ আমার। আমি কোথাও যাবো না।
ইতি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রোদ হা হা করে হেসে উঠে ইতির পিছনে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-মিসেস রোদ চৌধুরী আপনি ভুলে যাচ্ছেন আপনার বরকে জব্ধ করা এতো সহজ নয়। আর আমার মা যদি তার মনে এমন ইচ্ছে পোষন করেনও তাহলে তা সে নিজেই আমাকে বলবেন।
ইস...ইতি কি লজ্জাটাতেই না পরে গেলো। রোদকে জব্ধ করতে গিয়ে নিজেই জব্ধ হয়ে গেলো। রোদ পিছন থেকে জড়িয়ে ধতে দুই হাত দিয়ে ইতির পেট চেপে ধরে রেখেছে সে। আর রোদের স্পর্শে ইতির ভিতরে তুফান চলছে। ইতি মনে মনে বলছে, “লোকটা এমন কেন? সে কি বুঝে না আমি সহ্য করতে পারছি না”। রোদ লক্ষ করে ইতি একদম চুপ হয়ে গেছে। আরেকটু ভালো ভাবে লক্ষ করতেই দেখে ইতি নিজের হাত দিয়ে, নিজের শাড়ির আঁচল ধরে শক্ত করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। ইতির অবস্থা বুঝতে পেরে রোদ ইতিকে ছেড়ে দেয়।
তিনদিন পর অফিসে।
-রাফসান প্লিজ। আমি এর আগেও না করেছি আর এখনো না করছি, সামনেও নাই করবো।
-ইতি তুমি বুঝার চেষ্টা করো প্লিজ।
-কি বুঝবো আমি তুমি বলো? তোমার কথা কি বুঝার মতো কিছু? তুমি কি নিজে বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো?
-আমি যা বলছি তা বুঝেই বলছি। এভাবে একটা জোরের সম্পর্কে থাকার মানে হয় না। তুমি ভয় পাচ্ছো কেন?
-এটা তোমার ভুল ধারণা রাফসান। আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না।
-আমি জানি তুমি ভয় পাচ্ছো আর স্যারের ভয়েই তুমি বার বার আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো।
-তুমি ভুল ভাবছো রাফসান আমি তাকে ভয় পাই না। সে কোন বাঘ নয় যে তাকে ভয় পাবো আমি।
-তাহলে কেন তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো?
-কারণ আমি চাই না তাই। তুমি আমার কলিগ, আমার একজন ভালো বন্ধু এর বেশি কিছুই না।
-মিথ্যে কথা বলছো তুমি।
-আমি সত্যিটাই বলছি।
-না বলছো না। স্যারের সাথে তোমার সম্পর্কটা জোরপূর্বক হয়েছে।
-রাফসান মুখ সামলে কথা বলো। ভুলে যেও না সে আমার হাজবেন্ড।
-দেখো ইতি এভাবে বিনা ভালোবাসার একটা সম্পর্কে থাকার কোন মানেই হয় না। প্লিজ তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে আসো আমার কাছে। ডিভোর্স হিম ইতি ফর গড ছেইক।
-রাফসাননন...এই কথা বলার সাহস পাও কোথায় তুমি?
-ভুল তো কিছু বলিনি আমি।
-অবশ্যই ভুল বলছো। তোমার কাছে বিয়েটা ছেলে খেলা হতে পারে আমার কাছে নয়, আমাদের কাছে নয়। আমি তোমার আর একটা কথাও শুনতে চাই না।
ইতির ইচ্ছে করছিল কষে রাফসানকে একটা চর মারতে তার বিয়ে নিয়ে এমন কথা বলার জন্য। রাগে গট গট করতে করতে নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় ইতি। এতোই রেগে গেছে সে যে অফিসে থাকতে অসহ্য লাগছে ইতির। অফিস থেকেই বেরিয়ে যাবে সে। বেরিয়ে যেতে নিয়ে আবার থেমে যায়। কিছু একটা ভেবে নিজের কেবিনে গিয়ে সেখান থেকে সোজা রোদের কেবিনে যায় ইতি।
-এটা কি?
একটা খাম রোদের সামনে রাখে ইতি। তা দেখেই রোদ জানতে চায় সেটা কি। ইতি চুপ করে থাকে। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রোদ নিজেই খামটা হাতে নিয়ে খুলে দেখে।
-এসব কি ইতি?
-যা দেখছেন তাই।
-আমি এর আগেও তোমাকে না করেছি।
-এতোদিন শুনতে পেরেছি তাই শুনেওছি আপনার কথা। আর পারছি না তাই এটা।
ইতির চেহারা দেখে রোদ স্পষ্ট বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে। আর সেজন্যই মেয়েটা এমন করছে। রোদ নিজের চেয়ার ছেড়ে এসে ইতিকে নিয়ে সোফায় বসায়, সে নিজেও তার পাশে বসে। দুজন পাশাপাশিই বসে আছে।
-কি হয়েছে? আমাকে বলো।
-কিছু হয়নি।
-তাহলে রিজায়্যান দিচ্ছো কেন?
-আমি চাইছিনা আর এখানে থাকতে তাই।
-তাহলে কোথায় থাকবে?
-বাসায় থাকবো। আমি শুধু মন দিয়ে সংসার করতে চাই।
-আমি এটা এক্সেপ্ট করবো না।
-প্লিজ। আমি পারছি না আর কেউ আপনাকে নিয়ে, আমার সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলুক। আমি আর নিতে পারছি না।
-হুম।
ইতি নিজের মাথাটা রোদ কাঁধে ছেড়ে দেয়। খুব কান্না পাচ্ছে তার। গত দিনটা মাস ধরে রাফসান প্রায় প্রতিদিন ইতিকে এভাবে বিরক্ত করে যাচ্ছে। রাফসান ইতির পিছনেই পরে গেছে সে যেন রোদকে ছেড়ে দিয়ে তার কাছে চলে যায়। রোদ আলতো করে ইতিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-রিজায়্যান দিয়ে শুধু সংসার করেই তুমি খুশি থাকবে?
-হুম।
-সত্যি খুশি থাকবে?
-থাকবো। যার এতো ভালো একটা পরিবার আছে, বাবা-মার মতো শশুর-শাশুড়ি আছে, অতুলের মতো ছোট ভাই আছে, আপনার মতো...
-আমার মতো ?
-জানি না।
-বলো না।
-বললাম তো জানি না।
রোদ নিজের হাতটা ইতির কোমড়ে রেখে, ইতিকে নিজের আরো কাছে টেনে নেয়। নিজেকে হালকা লাগছে ইতির রোদের কাছে গিয়ে। রোদ বলে,
-রাফসান কিছু বলেছে তোমার?
বিদ্যুতের ঝটকা খাওয়ার মতো চমকে উঠে ইতি। রোদ বুঝতে পেরে বলে,
-ওকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না আমি আছি। আর আমি থাকতে রাফসান কেন কেউ কিছু করতে পারবে না তোমার। ভয় পেও না।
বেশ কিছু সময় রোদের কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকে ইতি।
-চলো।
-কোথায়?
-তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।
-আমি যেতে পারবো।
-পারবে জানি। তাও আমি চাই দিয়ে আসতে।
রোদ উঠে দাঁড়িয়ে ইতির দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
-চলো।
ইতি হেসে দিয়ে রোদের হাত ধরে।
রোদ ইতিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। রাফসান পিছন থেকে দাঁড়িয়ে তা দেখছিল।
-তুমি আমার ছাড়া কারো হবে না ইতি।
.
.
পর্ব-২০
Eti Chowdhury
.
.
.
রোদ ইতিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। রাফসান পিছন থেকে দাঁড়িয়ে তা দেখছিল।
-তুমি আমার ছাড়া কারো হবে না ইতি।
তিনদিন পর।
সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে ইতিকে না পেয়ে রোদ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হতে রুমে এসে দেখে ইতি রেডি হচ্ছে। ইতিকে এই সময় রেডি হতে দেখে রোদ জিজ্ঞেস করে,
-কোথাও যাচ্ছো নাকি?
-হুম, অফিস।
-অফিস!!
-হুম।
-তুমি না বললে আর অফিস যাবে না। তাহলে?
-সেদিন তো হুটহাট চলে এলাম কারো থেকে বিদায় নেওয়া হয়নি। তাই ভাবলাম সবার থেকে বিদায় নিয়ে আসি।
-ভালো ভেবেছো। রেডি?
-হুম।
-তাহলে চলো।
ইতিকে দেখে সবাই অনেক খুশি হয়েছে। কিন্তু অফিসে আসার পর থেকে সবাইকে দেখলেও রাফসানকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না ইতি। ইতি এসেছে শুনে অনেকেই এসেছে অর সাথে দেখা করতে কিন্তু রাফসান আসেনি। তাই ইতি ভাবে সে নিজেই যাবে রাফসানের সাথে দেখা করতে। রাফসান অফিসে আছে কিনা জানার জন্য ইতি রিমিকে জিজ্ঞেস করে,
-রিমি শুনো।
-জি, ম্যাম?
-রাফসান আসেনি?
-স্যার তো এসেছেন।
-দেখছি না যে?
-স্যার ইদানিং একটু চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করেন দেখছি। কাজের বাহিরে তেমন একটা কথাও বলেন না কারো সাথে।
-আই সি। এখন কোথায় আছে সে?
-তার কেবিনেই আছে।
-ওকে।
ইতি উঠে পরে রাফসানের সাথে দেখা করবে বলে।
-ম্যাম কি এখনি চলে যাচ্ছেন?
-না, আছি আমি।
ইতি সোজা রাফসানের কেবিনে চলে যায়। নক করে বলে,
-আসতে পারি?
রাফসান ফাইলে ডুবে ছিল। ইতির কন্ঠ শুনে চমকে উঠে মুখ তুলে তাকায়। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যার রাফসান।
-আরে তুমি?
-কেমন আছো?
-ভালো। তুমি কেমন আছো?
-আমিও ভালো।
-শুনলাম তুমি নাকি আর জব কন্টিনিউ করছো না?
-হুম, ঠিক শুনেছো?
-তা হঠাৎ এই ডিসিশন কি আমার জন্য?
-না একদম নয়। সংসারের দায়িত্ব নিতে চাই তাই আর কি।
-হুম। ভালো ভেবেছো।
ইতি লক্ষ করে রাফসান তার সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না।
-রাফসান একটা কথা বলি?
-বলো।
-সব ভুলে গিয়ে ভালো থেকো।
-হুম।
-আসি।
আসি বলে ইতি আর রাফসানের উত্তরের অপেক্ষা করে না। চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যেতে নিলেই রাফসান বলে,
-ইতি।
-হুম। কিছু বলবে?
-আসলে আমি বুঝতে পারছি আমি এতোদিন যা বলেছি বা যে আচরণ তোমার সাথে করেছি তা করা আমার একদম উচিত হয়নি। যাই হোক তোমাদের বিয়ে হয়েছে। আসলে সরি বলার মুখটাও আমিও রাখিনি।
-ইটস ওকে রাফসান। তুমি বুঝতে পারেছো সেটাই অনেক আমার জন্য। আর আমি তো আগেই বলেছি তুমি আমার একজন ভালো বন্ধু। তা যেমন আগেও ছিলে, এখনো আছো আর সামনেও থাকবে ইনশাআল্লাহ।
-হুম, আসলে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। স্যার তোমার সাথে যেটা করল, আমাদের সাথে যা করল। এটা রীতি মতো তোমার সাথে বেইমানি ছিল। তাই...
-বেইমানি!!
এমন কথা শুনে অবাক হয় ইতি।
-যাক বাদ দাও সেসব কথা।
-না, কি বলতে চাইছো একটু ক্লিয়ার করে বলো প্লিজ।
-কিছু না বাদ দাও। তুমি ভালো আছো সেটাই অনেক আমার জন্য। সেটা যার সাথেই থাকো না কেন। তুমি ভালো আছো তাই যথেষ্ট।
-রাফসান প্লিজ আমি জানতে চাইছি।
-থাক না ইতি আর এইসব কথা বলে কি লাভ।
-লাভ ক্ষতি পরে দেখবো আগে বলো।
-তখন আমি থাকলে হয়ত স্যারের সাথে তোমার বিয়েটা হতো না। আর তাই
-আর তাই?
-আর তাই স্যার আমাকে এমন কিছু কাজ দিয়ে দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দিয়ে ছিলেন যে কাজের তখন কোন প্রয়োজন ছিল না। আর এমনকি কারো সাথে যোগাযোগ করার কোন উপায়ও তিনি রাখেননি কারণ তিনি জানতেন সুযোগ হলে আমি ঠিকিই তোমার সাথে যোগাযোগ করবো। আমিও কি বোকা স্যারের কথা ভেবে, কোম্পানির কথা ভেবে তিনি যা বলেছেন তাই করেছি অথচ আমি চাইলেই তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম। কিন্তু করিনি স্যার নিষেধ করায়। যা থেকে বুঝ যায় স্যার প্ল্যান করেই সবটা করেছেন, বিয়েটাও। নিজের প্রয়োজন ছাড়া রোদ চৌধুরী কোন কাজ করেন না কখনো। আর তার করা প্রতিটা কাজ তার জন্য এক একটা ডিল যা সে যে কোন কিছুর বিনিময়ে হলেও আদায় করে ছাড়েন।
-প্ল্যান!!
-হুম স্যারের প্ল্যান।
অফিস থেকে আসার পর থেকেই ইতি ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে শক্ত পাথর হয়ে আছে সে। এমনকি আসার সময় সে রোদকে জানিয়েও আসেনি। অথচ কথা ছিল রোদ ইতিকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাবে।
৩ টা বাজতে দেখে রোদ ইতির কেবিনে আসে ইতিকে বাসায় নামিয়ে দিবে বলে। সেই সাথে ইতিকে নিয়ে বাহিরে লাঞ্চ করবে ভাবে সে। বিয়ের ৪ মাস হতে চলল কিন্তু আজ পর্যন্ত রোদ ইতিকে নিয়ে কোথাও যায়নি।
-হলো তোমার?
বলতে বলতেই রোদ ইতির কেবিনে ঢুকে দেখে পুরো কেবিন ফাঁকা। ইতি কেবিনের কোথাও নেই। ইতি কোথায় আছে জানার জন্য রিমির ডেস্কে যায় রোদ। রোদকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রিমি।
-স্যার আপনি?
-ইতি কোথায়?
-ম্যাম তো চলে গেছে অনেক আগে।
-চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে?
-জানতে চাইলে বলল বাসায় যাচ্ছে।
-বাসায়!!
-জি, আপনি জানতেন না ম্যাম বাসায় যাচ্ছে।
রোদ আর কোন কথা বলে না বেরিয়ে যায়। রোদ চিন্তায় পরে যায়, সকাল থেকে তো সবই ঠিক ছিল তাহলে হুট করে হলো কি মেয়েটার। শরীর খারাপ করেনি তো? রোদ সাথে সাথেই ফোন দেয় ইতিকে। কিন্তু ফোনটা বেজেই চলেছে তবে ইতির ধরার নাম গন্ধ নেই। ইতি ফোন ধরছে না দেখে রোদ অতুলকে ফোন দেয়।
-হ্যাঁ ভাইয়া।
-তোর ভাবি বাসায় এসেছে?
-হ্যাঁ, ভাবি তো...
হ্যাঁ, শুনার পর আর কোন কথা না শুনেই রোদ ফোনটা রেখে দেয়। অতুল এটাও বলতে চাইছিল ইতি বাসায় আসার পর থেকেই ছাদে কাঠ ফাটা রোদে দাঁড়িয়ে আছে নিচে নামছে না। অতুল ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকে তা দেখে মিসেস চৌধুরী জিজ্ঞেস করেন,
-কিরে কি দেখছি এভাবে ফোনের দিকে তাকিয়ে?
-না মা কিছু না।
বাসায় আসার পর থেকে ইতি কাঠ ফাটা রোদে দাড়িয়ে আছে। অনেক কাহিল লাগছে নিজেকে তার। রাগে ফেটে যাচ্ছে সে। অনেক বেশি রাগ মেয়েটা ধরে রাখতে পারে না আবার চাইলে কাউকে বলতেও পারে না। ছোট বেলা থেকেই ইতি এমন। রাগ বিষয়টা বেশিক্ষপণ ধরে রাখতে পারে না দূর্বল হয়ে যায় সে। আর চাইলেও তা কারো সাথে শেয়ার করতে পারে না।
রোদ বাসায় আসার সময় বেশ কয়বার ইতিকে ফোন দিয়েছে কিন্তু সে ফোন পিক করেনি। বাসায় ঢুকেই রোদ সোজা বেড রুমে যায় কিন্তু ইতি রুমে নেই। বিছানার উপরেই ইতির ফোনটা রাখা। ফোন হাতে নিতেই দেখে তার ৮/১০ টা মিসড কল। তার মানে ইতি ফোনটা দেখেনি। ইতি কোথায় আছে দেখার জন্য পিছন ঘুরতেই দেখে রুমের দরজায় অতুল দাঁড়িয়ে। রোদ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অতুল বলে,
-ভাবি বাসায় এসেই ছাদে গেছে, এখনো নিচে নামে নি। আর আজ অনেক বেশি রোদ উঠেছে।
কথাটা বলেই অতুল দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়। রোদ আর অপেক্ষা না করে সোজা ছাদে উঠে যায়। ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে ইতি ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে অন্যদিকে মুখ করে। সত্যি আজ অনেক রোদ উঠেছে। কোন পাগলিই এই রোদের মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। রোদ দ্রুত কদমে ইতির কাছে এসে তার হাত ধরে তাকে পিছনে ঘুরায়। অনেক বেশি চিন্তায় পরে গিয়েছিল রোদ ইতিকে নিয়ে। এখন ইতিকে দেখে শান্তি হয় তার।
-এসবের মানে কি?
ইতির চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে রোদ। অনেক বেশি গম্ভীর হয়ে আছে মেয়েটা। সে কাঁদেনি তবু চোখ-মুখ ফোলা লাগছে। মনে হয় কিছু একটা নিয়ে ভিতরে ভিতরে অনেক আপসেট সে। ইতি চুপ করেই থাকে।
-কি হলো কথা বলছো না কেন? এসবের মানে কি? এভাবে না বলে কেউ চলে আসে?
রোদের কথার কোন জবাব না দিয়ে মুখ তুলে তার দিকে তাকায় ইতি।
-বলো? আমাকে জানালে না কেন? কি ভেবেছো আমার চিন্তা হয় না?
-আমাদের বিয়েটা কি আপনার প্ল্যান ছিল?
হঠাৎ ইতির এমন কথায় অবাক হয় রোদ। তবু নিজেকে শান্ত রাখে রোদ। বলে,
-কি হয়েছে তোমার?
-আমাদের বিয়েটা আপনার প্ল্যান ছিল কি না?
-হলোটা কি তোমার? এসব কেন বলছো?
-আমার কথার জবাব দিন, আমাদের বিয়েটা কি আপনার প্ল্যান ছিল?
-এভাবে বললে তুমি কিছু বুঝবে না আগে শান্ত হও তুমি আমি সব বলছি তোমাকে।
-হ্যাঁ বা না।
-আমার কথা শুনো প্লিজ।
-হ্যাঁ বা না।
বলে চেঁচিয়ে উঠে ইতি।
-হ্যাঁ, ছিল আমার প্ল্যান ছিল। কিন্তু আমি...
-তাহলে আমি আপনার জন্য একটা ডিল যা আপনি যে কোন কিছুর বিনিময়ে নিজের করে নেয়ার প্ল্যান করেছিলেন? বিয়ের শপিং, গায়ে হলুদে আমাকে হলুদ লাগানো, গোসলের দিন গোসল করানো, আমাকে অধিকার দেয়া, বিয়েকে কেন্দ্র করে এতোকিছু এই সবটাই আপনার ইনভেস্টমেন্ট ছিল?
-ব্যাপারটা তা নয়। আমাকে বলতে দাও।
-সবটা আপনার ইনভেস্টমেন্ট ছিল কি না? হ্যাঁ বা না।
-ইতি প্লিজ।
-হ্যাঁ বা না রোদ।
ইতি রীতিমতো চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। রোদ এখন হাজার এক্সপ্লেইন করতে চাইলেও ইতি শুনবে না তার কোন কথা। রোদ ইতিকে ধরার চেষ্টা করলে ইতি হাত ঝাড়ি দেয়।
-হ্যাঁ বা না। এটা সত্যি না মিথ্যা?
-হ্যাঁ, সত্যি তুমি যা শুনেছো সবটাই সত্যিই। সব আমার ইনভেস্টমেন্ট ছিল। কিন্তু...
-আমি আপনার জন্য ইনভেস্টমেন্ট ছিলাম?
-প্লিজ আমার কথাটা শুনো।
রোদ আর কিছু বলার আগেই ইতি রোদের বুকের উপর ঢলে পরে। আচমকা মেয়েটা এভাবে পরে যাওয়ায় রোদ আঁতকে উঠে।
-ইতি এই ইতি।
সেন্স হারিয়ে রোদের বুকের উপরেই পরে যায় ইতি। রোদ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ইতিকে।
.
.
পর্ব-২১
Eti Chowdhury
.
.
.
-আমি আপনার জন্য ইনভেস্টমেন্ট ছিলাম?
-প্লিজ আমার কথাটা শুনো।
রোদ আর কিছু বলার আগেই ইতি রোদের বুকের উপর ঢলে পরে। আচমকা মেয়েটা এভাবে পরে যাওয়ায় রোদ আঁতকে উঠে।
-ইতি এই ইতি।
সেন্স হারিয়ে রোদের বুকের উপরেই পরে যায় ইতি। রোদ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ইতিকে।
-চিন্তা করার কিছু নেই। সব নরমাল আছে।
-তাহলে সেন্স হারালো কেন?
-হয় এমন মাঝে মধ্যে। সে বিবাহিত ছোট ঘাটো ঘটনা তার সাথে ঘটতেই পারে।
ইতি সেন্সলেস হওয়ার পর থেকেই অস্থির হয়ে আছে রোদ। ইতিকে কোলে নিয়ে রুমে এসেই ডাক্তারকে ফোন দেয় সে। ইতির চেকাপ করে ডাক্তার রোদকে আশ্বস্ত করে দিয়ে বলেন,
-কোন সমস্যা নেই। রেস্ট করুক ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে। আমি আসছি।
-যদি জ্ঞান না ফিরে তাহলে কি হসপিটালে নিয়ে যাবো?
রোদের অস্থিরতা দেখে ডাক্তার স্মিত হেসে বলেন,
-না তার প্রয়োজন নেই। জ্ঞান ফিরে আসবে। আসি।
রোদ অতুলকে বলে ডাক্তার সাহেবকে এগিয়ে দিতে। ইতিকে ছেড়ে সে নিজে যায় না এগিয়ে দিতে। ডাক্তার আশ্বস্ত করে গেছেন তাও রোদের অস্থির অস্থির লাগছে। যতক্ষণ না ইতির জ্ঞান ফিরবে আর রোদ সবটা বিষয় তাকে বুঝিয়ে বলবে ততক্ষণ তার শান্তি হবে না।
রোদ আর অফিস যায়নি। ইতিকে রেখে তার একদম কোথাও সরতে ইচ্ছে করছে না এই মুহুর্তে। ঘুমন্ত ইতি যে এতো বেশি মায়াবতী তা রোদের জানা ছিল না। এতোদিনে আজ প্রথম রোদ এভাবে ইতিকে লক্ষ করছে। তার বউটা সুন্দর তবে সে মায়াবতী তা তার জানা ছিল না। ঘুমিয়ে আছে সে তবে তার মুখময় ছড়িয়ে আছে হাজার রকম মায়া। সে মায়ায় মোহিত হচ্ছে রোদ তাকে নয়ন ভোরে দেখে। কাপড় বদলে সাদা একটা পাঞ্জাবি পরেছে রোদ। ইতির জন্য বড্ড বেশি চিন্তা হচ্ছে তার। দুপুরে কিছু খাওয়াও হয়নি তার চিন্তায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে মুখে পুড়েছে সে। প্রতিটা টানের সাথে ধোঁয়া ফুসফুস পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় বুকে জ্বালা পোড়া করে নাও তার কিন্তু আজ তার পুড়ছে।
জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে ইতি। শরীর দূর্বল লাগছে অনেক। তবু শোয়া থেকে উঠে বসে সে। চোখে এখনো আবছা দেখছে। আবছা দৃষ্টিতে চারিদিকে দেখতে থাকে। আর কেউ নেই রুমে সেই ছাড়া। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে মেয়েটার। পানি তেষ্টা পেয়েছে অনেক। হাতের কাছে রাখা পানির গ্লাসটা নিতে নিয়ে হাত ফসকে পরে যায় তা। গ্লাসটা পরে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। হুট করে গ্লাস পরে যাওয়ার শব্দ কানে আসতেই তাড়াহুড়ো করে রুমে এসে দেখে ইতির জ্ঞান ফিরেছে, সে উঠে বসেছে। রোদ গিয়ে ইতির পাশে বসতেই ইতি নাক ছিটকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তা দেখে রোদ লক্ষ করে তাড়াহুড়োয় সে খেয়ালই করেনি সিগারেট হাতে নিয়েই সে রুমে চলে এসেছে। আর তার বউয়ের তো সিগারেটের স্মেল সহ্য হয় না।
-ওহ সরি।
বলেই রোদ আবার বারান্দায় গিয়ে আস্তো সিগারেট ফেলে দিয়ে ইতির কাছে ফিরে এসে বসতে বসতে বলে,
-পানি খাবে? ওয়েট।
রোদ আরেকটা গ্লাসে পানি ঢেলে ইতিকে দিতেই কোন কথা না বলে সে একটানে গ্লাসটা খালি করে দেয়। ইতির হাত থেকে খালি গ্লাসটা নিয়ে রেখে রোদ আবার ইতির দিকে তাকায়। মেয়েটা চুপ করেই আছে কোন কথা বলছে না তার সাথে। খানিক ইতস্তত করে রোদ নিজেই বলে,
-আসলে আমি...
-সরি।
হুট করে ইতির মুখে সরি শুনে কারেন্টের শক খাওয়ার মতো শকড হয়ে রোদ মাথা তুলে ইতির দিকে তাকায়। রোদকে ৪৪০ ভোল্টের ঝটকা দিয়ে ইতি বলে,
-সরি।
-তুমি কেন সরি বলছো?
-প্রয়োজন আছে।
-না কোন প্রয়োজন নেই তোমার সরি বলার।
-নাহ আছে। লেট মি সে। আমি সরি হুট করে এতোটা বেশি রিয়্যাক্ট করা আমার উচিত হয়নি। ওভাবে রিয়্যাক্ট না করে ঠান্ডা মাথায় আপনার সাথে কথা বলা উচিত ছিল আমার। প্রশ্ন গুলো এতো হাইপার হয়ে না করে সুন্দর ভাবে গুছিয়ে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। প্রতিটা প্রশ্নের বিপরীতে আপনাকে এক্সপ্লেইন করতে দেওয়া উচিত ছিল। তাই আমি সরি।
রোদ ইতির এক গালে হাত রেখে বলে,
-কোন প্রয়োজন নেই বললাম তো।
ইতির গালে রোদের রাখা হাতে হাত রেখে ইতি বলে,
-জানি আপনার মতে, বাকি সবার মতে আমি অনেক ম্যাচুয়্যার। অনেক সেন্সিবেল। কিন্তু দিন শেষে তো আমি আপনার বউ। হুট করে অন্য কারো মুখে আপনার সম্পর্কে, আমাদের সম্পর্ক নিয়ে এমন কথা আমি ঠিক নিতে পারিনি। হয়তো কথাটা সরাসরি আপনার থেকে শুনলে আমি এতোটা ধাক্কা অনুভব করতাম না যা অন্য কোন তৃতীয় ব্যক্তির মুখে শুনে করেছি। সত্যি ধাক্কাটা আমি নিতে পারিনি তাই ওভাবে রিয়্যাক্ট করে ফেলেছি যা করা আমার একদম উচিত হয়নি।
এবার রোদ ইতিকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-অনেক হয়েছে আর কিছু বলতে হবে না। দোষটা আমার ছিল।
ইতি পাল্টা রোদকে বাঁধা দিয়ে বলে,
-প্লিজ আমাকে আরেকটু বলতে দিন। যে আমাদের এই নতুন সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে কাজ করেছে। জানি না তার উদ্দ্যেশ কি ছিল। তবে তা যাই হোক ভালো বা মন্দ। এতে আমার কিন্তু বেশ ভালো হয়েছে।
-তা কিভাবে?
-আমাদের সম্পর্কের মাত্র শুরু এটা ঠিক। এই কথাগুলো একটা সময় পরে গিয়ে জানতে পারলে হয়তো আমি আরো অনেক বড় আঘাত পেতাম যা সামলে উঠা অনেক বেশি কষ্টদায়ক হয়ে যেত আমার জন্য। তখন নিজেকে সামলাতে পারতাম কিনা তাও জানি না। তবে এখন জানতে পেরে ভালোই হলো আমার বর সম্পর্কে আমার ধারণা হয়ে গেলো। ভুল বোঝাবুঝিটা আগেই কেটে গেলো। তাই এখন আর আমার আর কিছুই জানার নেই। আমি আপনার জন্য যদি ইনভেস্টমেন্ট হয়েই থাকি তাতেও আমার আপত্তি নেই। আপনি ইনভেস্ট করে ছেড়ে দেননি। নিজেরটা নিজে আদায় করে নিয়েছেন। অন্যের মতো না পেয়ে আড়াল থেকে কিছু করেন নি। তাই আমার আর কিছুই জানার ইচ্ছে নেই।
রোদ হালকা একটা হাসির রেখা ঠোঁটের কোণে নিয়ে নিজের হাতে ইতির হাত দুটো ধরে মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,
-তুমি জানতে চাও বা না চাও তাও আমি তোমাকে জানাতে চাই।
-বললাম তো আমি আর কিছুই জানতে চাই না। প্রয়োজন নেই আর।
রোদ ইতির ঠোঁটে একটা আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে বলে,
-হুস,,তোমার প্রয়োজন নাও থাকতে পারে। তবে তোমার বরের প্রয়োজন আছে। এটা ঠিক বিয়ের জন্য রাফসানকে দেশের বাইরে পাঠানোটা আমারই প্ল্যান ছিল। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করাটা নয়।
-মানে!!
-মানে বাবা-মা খুব চাইছিলেন আমি বিয়ে করি। বিয়ে বিয়ে করে পাগল করে দিচ্ছিলেন আমায়। তখন আমি নিজেও জানি না সেদিন কেন হুট করে তোমার নামটাই আমার মুখে এলো। তাও না করে দিবো ভাবছিলাম। কিন্তু বাবা-মা তোমার কথা শুনে যে এতোটা খুশি হবে আমি ভাবিনি। বাসায় তাদেরকে তোমার কথা বলে অফিসে এসে ঠান্ডা মাথায় ভাবার পর যখন ভাবলাম যে না করে দিবো। আর না করার জন্য যখন ফোন করলাম তারা এতো বেশি খুশি, এতো বেশি এক্সাইটেড যে তাদের খুশি দেখে আমি আর না করতে পারিনি। তাদের পারফেক্ট ছেলে হয়েও আমি তাদের কোন সুখ দিতে পারিনি। উল্টো সব চাইতে বড় কষ্টটাই আমি তাদের দিয়েছিলাম। এটা ঠিক তুমি আমার জন্য প্রজেক্ট তবে তা আমার বাবা-মায়ের সুখের প্রজেক্ট, আমার সুখের প্রজেক্ট। তুমি আমার ইনভেস্টমেন্ট তবে তোমাতে আমি আমার জীবন ইনভেস্ট করেছি। তোমাতে আমি আমার সবটা ইনভেস্ট করতে চাই বিলিভ মি। তার বিনিময়ে চাই একটু সুখ আমার বাবা-মায়ের জন্য, আমার জন্য। যান্ত্রিক জীবন কাটাতে কাটাতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি আর পারছি না। এবার এই বুকের ভিতর তোমাকে নিয়ে সুখের দিন কাটাতে চাই। বিয়ের আগে আমাদের সম্পর্ক ছিল না, প্রেম ছিল না তাই বলে কি বিয়ের পর তুমি আমায় ভালোবাসতে পারবে না? আমি কি অন্ধকারেই থেকে যাবো? আই এম সরি কথাগুলো আমি ব্যতিত তোমাকে অন্য কারো কাছ থেকে শুনতে হয়েছে। আমার উচিত ছিল তোমাকে আগেই বলে দেয়া। সব দোষ আমার।
ইতি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল রোদের দিকে। রাগি, মুডি, পাজি রোদটাকে এই মুহুর্তে ইতি একদম খুঁজে পাচ্ছে না। নতুন এক রোদের আবিষ্কার করছে ইতি এখন মানুষটার মাঝে। যে কেবল ইতির হাজবেন্ড। ইতির কাছে সে সুখ কুড়োতে এসেছে। রোদ বলে,
-আমি বাবা-মাকে দেয়া কষ্ট গুচিয়ে দিতে চাই তাদের এতো লক্ষি একটা মেয়ের মতো বউ দিয়ে।
-কষ্ট!
-হুম।
-কি কষ্ট দিয়ে ছিলেন তাদের আপনি?
-বলবো সময় মতো সবটা বলবো আমি তোমাকে।
রোদের দিকে হাত মেলে দিয়ে ইতি বলে,
-প্রমিজ?
রোদ ইতির হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,
-আই প্রমিজ। একটা কথা আজ মাথায় সেট করে নাও। এই এক রোখা, পাজি, বদমেজাজী রোদ চৌধুরীর প্রতিটা নিঃশ্বাসের উপর আজ থেকে তোমার অধিকার, কেবল তোমার অধিকার। এই রোদটা শুধুই তোমার।
রোদের বলা এই কথা শুনে মুহুর্তের মাঝেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় ইতি। লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলে মেয়েটা। ইতিকে লজ্জা পেতে দেখে তাকিয়ে থাকে রোদ। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রোদ বলে,
-কেন আই হাগ ইউ?
রোদের কথা শুনে এবার ইতি ৮৮০ ভোল্টের শখ খেয়ে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকায়। কি বলবে বুঝতে পারছে না। ইতির মুখে লজ্জা, বিস্ময়, আতংক সব মিলে একটা মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। আর তা দেখে বেশ ভালো লাগছে রোদের। ইতির গলায় কথা আটকে গেছে সে আর কোন জবাব দিতে পারছে না। রোদ আর ইতির জবাবের অপেক্ষা না করে একটা হ্যাঁচকা টানে ইতিকে নিজের বুকে টেনে নেয়। রোদের টানে ইতি গিয়ে ধরাম করে তার বুকে গিয়ে লেপ্টে যায়।
.
পর্ব-২২
Eti Chowdhury
.
.
.
-কেন আই হাগ ইউ?
রোদের কথা শুনে এবার ইতি ৮৮০ ভোল্টের শখ খেয়ে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকায়। কি বলবে বুঝতে পারছে না। ইতির মুখে লজ্জা, বিস্ময়, আতংক সব মিলে একটা মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। আর তা দেখে বেশ ভালো লাগছে রোদের। ইতির গলায় কথা আটকে গেছে সে আর কোন জবাব দিতে পারছে না। রোদ আর ইতির জবাবের অপেক্ষা না করে একটা হ্যাঁচকা টানে ইতিকে নিজের বুকে টেনে নেয়। রোদের টানে ইতি গিয়ে ধরাম করে তার বুকে গিয়ে লেপ্টে যায়।
রোদ অনেক বেশি স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছে ইতির সাথে। ঐ ঘটনার পর রাফসান অনেকবার ফোন দিয়েছিল ইতিকে তার সাথে যোগাযোগ করার খুব চেষ্টা করেছে কিন্তু ইতি সোজাসুজি তাকে ইগনর করে গেছে। রাফসানের সাথে যোগাযোগ না রাখাটাই ঠিক মনে করে সে। ইতি আর রোদের মাঝে স্বামী-স্ত্রীর মতো কোন সম্পর্ক না হলেও একটা ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক ঠিকি তৈরী হয়েছে তাদের মাঝে। আগের থেকে অনেকটা বেশি ভরসা করে, বিশ্বাস করে ইতি রোদকে। রোদের জীবনের সব কিছুতেই ইতির অধিকার সর্বাধিক এখন। এমন কি প্রতিদিন রোদ কোন কালারের সুট পরে অফিস যাবে সেটাও ইতি ঠিক করে দেয়। রোদের মায়ের হাতের রান্না ছাড়া সে খেতে পারে না। তবে এখন প্রতিদিন বউয়ের হাতের কফি ছাড়া তার দিন শুরু হয় না। বউয়ের প্রতি নিজেকে এতোটা ডেডিকেট করছে রোদ যে প্রতিদিন সব কাজ শেষ করে রাতে বউকে সময় দেয়ার জন্য বারান্দায় বসে তার সাথে গল্প করতে করতে বউয়ের চা পানের অভ্যাসটাকেও আপন করে নিয়েছে রোদ। সকালে ইতির হাতের কফি আর রাতে ইতির সাথে বসে চা পান না করলে তার দিনের শুরুটাও ভালো হয় না, শেষটাও ভালো হয় না। এখন রোদ নিজেই ইতিকে সাথে করে শপিংয়ে নিয়ে যায়। যে কোন গেট টু গেদার, পার্টিতে রোদ আর একা যায় না। ইতিকে সাথে নিয়ে যায়। শারীরিকভাবে তারা কাছে না এলেও মনের দিক থেকে তার অনেকটাই একে অপরের কাছাকাছি চলে এসেছে।
দু'দিন হলো রোদ বাসায় নেই। অফিসের কিছু কাজেই কোরিয়া গিয়েছে। একটা মিটিং ছিল। মিটিং শেষ করেই চলে আসবে এমনটা বলে গেছে ইতিকে। এবং তাই করেছে। মিটিং শেষ করেই রওনা দিয়ে দিয়েছে সে। ইতি তার অপেক্ষায় আছে। দু'দিন বাইরে কি খেয়েছে না খেয়েছে কে জানে তাই নিজের হাতে রান্নাবান্না করে ফ্রেস হয়ে রোদের পছন্দ করে কিনে দেয়া হলুদ শাড়িটা পরেছে আজ ইতি। কয়দিন আগের কথা। সেদিন পহেলা বৈশাখ ছিল। আর দশজন সাধারণ কপোত কপতির মতো রোদ ইতিকে নিয়ে সেদিন বেরিয়ে ছিল। আর সব চাইতে অবাক করার বিষয় সেদিন সে গাড়িটা পর্যন্ত নিয়ে বের হয়নি। ইতিকে নিয়ে ধানমন্ডির পথে হেঁটেছিল সেদিন রোদ। জায়গায় জায়গায়, পথে-ঘাটে, রাস্তার ধারে বসা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেলা থেকে অনেক কিছু কিনে দিয়েছিল। সেদিনই ধানমন্ডির লেক ঘেষে বসা মেলা থেকেই হলুদ শাড়িটা কিনে দিয়েছিল রোদ ইতিকে। ইতিকে নিয়ে পাশাপাশি হাঁটছিল সে। তখনি হুট করে এই হলুদ শাড়িটা তার চোখে পরে যা। কল্পনায় সাথে সাথেই এঁকে ফেলেছিল সে তার বউকে অনেক বেশি সিন্ধ লাগবে এই শাড়িটাতে। ইতির চোখের অগোচরেই শাড়িটা কিনে ছিল সে। পরে বাসায় এসে ইতিকে তা দিয়েছিল রোদ। আজ সেই হলুদ শাড়িটা পরেই বসে আছে সে রোদের অপেক্ষায়। এতোদিনে শাড়িটা তার পরা হয়নি। তাই আজ ভাবলো এটা পরে রোদকে একটু চমকে দেয়া যাক। তাই যা ভাবা তাই কাজ৷ রোদ জানিয়েছিল এয়ারপোর্ট থেকে সে আগে অফিসে যাবে একটা মিটিং আছে তার সেটা শেষ করেই একেবারে বাসায় আসবে। ৪টা বাজবে আসগে বলেছিল। কিন্তু ইতি সেজেগুজে তার জন্য অপেক্ষা করছে সেই দুপুর থেকে। এমনকি মেয়েটা কিছু খায়ওনি। একবারে রোদের সাথেই খাবে বলে অপেক্ষা করছে সে। ইদানিং মনে তার সর্বোক্ষণ রোদ রোদই চলে। নিজে নিজেই লজ্জা পায় সে মাঝে মধ্যে এটা ভেবে মনটা তার এতো রোদ রোদ করে কেন। সে তো এমন রোদ পাগল ছিল না তাহলে হুট করে কি হলো। তবে আগের থেকে তাদের বোঝাপড়াটা অনেক ভালো হয়েছে। রোদের অপেক্ষায় রুমে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছিল ইতির। হাতের কাছে টেবিল ক্যালেন্ডারটা পেয়ে পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখতে লাগে। ১ বছর ৪ মাস চলছে ইতি আর রোদের বিয়ে হয়েছে। কম হলেও অনেকটা সময় তারা একসাথে কাটিয়েছে। ভাবতেই অবাক লাগছে ইতির সেদিন হুট করে তাদের বিয়েটা হলো আর দেখতে দেখতে একে অপরকে বুঝতে বুঝতে ১ বছর ৪ মাস হয়ে গেলো। এখন মানুষটাকে আর আগের মতো বিরক্ত লাগে না ইতির কাছে। বরং তার কথা ভাবতে, তাকে নিয়ে চিন্তা করতে, কল্পনায় তাকে নিয়ে ইচ্ছে ঘুড়ি উড়াতে খুব ভালো লাগে ইতির। মনে মনে এসব ভেবে আবার লজ্জা পায় সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৪ বেজে ১০ মিনিট হয়ে গেছে। রোদ এলো কি না দেখার জন্য নিচে নামে সে। ড্রইং রুমে আসতেই দেখে কেউ নেই। এসময় তার শাশুড়ি মিসেস চৌধুরী বিশ্রামে থাকে। অতুল নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে। আর মিস্টার চৌধুরী রোদের বাবা গেছেন তাদের গ্রামের বাড়িতে। তাই খালি খালি লাগছে বাড়িটা। এমনিতেও মানুষ হিসেবে বাড়িটা বড়। ইতি ড্রইং রুমের সোফায় বসতে না বসতেই কলিংবেলটা বেজে উঠে। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে ভূতের মতো অতুল বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। অতুলকে দেখে তাকে থামিয়ে ইতি বলে,
-অতুল তুই দাঁড়া। তোর ভাইয়া হবে আমি দেখছি।
অতুল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আর আগায় না। ইতি গিয়ে দরজা খুলেই চোখ মুখ কুঁচকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
-কাকে চাই?
-কেন আই কাম ইন?
ইতি দরজা খুলতেই দেখে একজন বিদেশি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।
-কেন আই নো হুম ডু ইউ ওয়ান্ট?
-রোদ।
-রোদ!!
-ইয়েস, আই হ্যাভ কেইম টু রোদ। কেন ইউ কল হিম ফর মি।
প্রথমত মেয়েটাকে দেখে ইতি ভ্যাবাচ্যাকা খায়। আর জানতে চাইলে সে বলে সে রোদের কাছে এসেছে। তাই তাকে যে ভেতরে আসতে বলতে সেটাই ভুলে গেছে ইতি।
-কেন আই নো হু আর ইউ?
-আই....
-ইউ আর ক্যাথরিন রাইট?
মেয়েটা কিছু বলার আগেই পিছন থেকে অতুল কথাটা বলে।
- ইয়েস আই এম ক্যাথরিন। ইউ নো মি?
ইতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অতুলের দিকে তাকায়। ইতিকে এভাবে তাকাতে দেখে অতুল বলে,
-আমি ভাইয়ার কাছে উনার কথা শুনেছিলাম। এমনকি আমি তার ছবিও দেখেছি। ভাই আর উনি একসাথে পড়ালেখা করতেন।
-আচ্ছা
ইতি ক্যাথরিনকে বাসার ভেতরে প্রবেশ করতে দিয়ে বসতে বলে। অতুল ক্যাথরিনের জন্য পানি নিয়ে এলে সে পানির গ্লাস হাতে তুলে সবে মুখ দিয়েছে গ্লাসে।
-ক্যাথরিন তুমি?
পিছন থেকে কারো ক্যাথরিনের নাম ধরে ডাকায় ইতি, ক্যাথরিন ও অতুল তিনজনই তাকায় আর দেখে রোদ বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। রোদকে দেখে ইতির মুখে একটা প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠে। ক্যাথরিন পানির গ্লাসটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে উঠে যায়। ইতি নিজেও উঠে দাঁড়ায় রোদের কাছে যাবে বলে। রোদ ওদের দিকে এগিয়ে আসতেই ক্যাথরিন গিয়ে রোদকে জড়িয়ে ধরে আচমকা। ইতি সামনে এগোতে নিয়েও সেখানেই থেমে যায়। আচমকা ক্যাথরিনের এমন কান্ডে রোদ নিজেই চমকে যায়। তাহলে ইতির কি অবস্থা তা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে বুঝতে পারছে না রোদ। ক্যাথরিন রোদকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আই মিসড ইউ সো মাচ রোদ। আই রিয়েলি মিসড ইউ। আই এম সো সরি ডিয়ার ফর বিয়িং সো লেইট। আই এম রিয়েলি সরি।
ইতি অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ রোদের দিকে তাকিয়ে থেকে সোজা উপরে চলে যায়। একটা কথাও বলে না সে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ইতির। রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কিছু না বলে চুপচাপ উপরে চলে যা সে। রোদ ক্যাথরিনকে নিজের থেকে সরিয়ে বলে,
-আই এম টকিং টু ইউ লেটার।
রোদ অতুলকে ইশারা দিয়ে দেয় ক্যাথরিনকে সামলে নিতে। তারপর আর একদন্ডও অপেক্ষা না করে সোজা উপরে চলে যায় রোদ নিজেও। রুমে ঢুকতেই দেখে ইতি নেই। তবে রোদের জানা আছে তার বউ কোথায় থাকতে পারে। মেয়েটার মন ভালো থাকলেও সে বারান্দায় বসে থাকে, মন খারাপ থাকলেও সে বারান্দায় বসে থাকে। বারান্দার সাথে তার কিসের এতো সখ্যতা এটাই বুঝে পায় না রোদ। তবে ইদানিং রোদেরও ভালোই লাগে বারান্দায় সময় কাটাতে। ইতির সাথে রোদের বেশিরভাগ সময়টা এই বারান্দাতেই কাটে তাই বারান্দা রোদেরও প্রিয় জায়গা এখন। বারান্দার দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই রোদ দেখে ইতি গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে ইতিকে দু'দণ্ড দেখে রোদ গিয়ে পিছন থেকে ইতিকে জড়িয়ে ধরে। এখন আর হুটহাট রোদের জড়িয়ে ধরাতে ইতি আপত্তি করে না। বরং বেশ ভালো লাগে তার হুটহাট এই মানুষটার স্পর্শ পেতে। ইতিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ইতির মাথাটা নিজের গালের সাথে ঠেকিয়ে রোদ বলে,
-কেউ বুঝি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
ইতি চুপ করে থাকে।
-খুব অপেক্ষা করিয়েছি বুঝি?
-........
-খুব বেশি অপেক্ষা করালাম রাগ করেছো বুঝি?
-......
রোদ একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে কিন্তু ইতি কোন উত্তর দিচ্ছে না। মেয়েটা খুব বেশি অভিমান করেছে বুঝতে পেরে রোদ ইতিকে আরেকটু বেশি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। নিজের হাতটা ইতির পেটে দিয়ে ছুঁয়ে দিতে লাগে রোদ। রোদের প্রতিটা স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছে ইতি। ইতির এই কাঁপনটা এখন খুব বুঝে রোদ। রোদ নিজেও অনেক উপভোগ করে ইতিকে এভাবে টর্চার করতে। আর সহ্য করতে না পেরে হুট করেই পিছন ঘুরে দাঁড়ায় ইতি তবে মাথা নিচু করে রাখে। রোদ ইতির চিবুক দু আঙ্গুল দিয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
-কেউ কি আজ বলেছে তোমাকে দেখতে দারুণ লাগছে। ঠিক হলদে পাখির মতো।
-ইসস...আপনি না।
সাথে সাথে লজ্জায় লাল হয়ে যায় ইতি। রোদ ইতির মুখটা উপরে তুলে ইতিকে আরেকটু বেশি লজ্জা দেয়ার জন্য নিজের ঠোঁটটাকে ইতির ঠোঁটের কাছে নিতে নিলেই আচমকা হাত দিয়ে রোদের ঠোঁট চেপে ধরে ইতি বলে,
-ঐ মেয়েটা কে?
-এখনই এটা বলা খুব প্রয়োজন ছিল?
-অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। জলদি বলুন মেয়েটা কে।
-আমরা একসাথে পড়তাম।
-সে কেন এসেছে?
-তুমি কি ইনসিকিওর ফিল করছো আমাকে নিয়ে?
ইতি নড়েচড়ে উঠে।
-মোটেই না। আমি ইনসিকিওর ফিল করবো কেন?
-না তুমি ইনসিকিওর ফিল করছো। ইউ আর জেলাস রাইট?
-জ্বি না।
-ইয়েস।
-নো।
-ইয়েস।
-উফফ...আপনি না।
রোদ হেসে দেয় ইতি জেলাস হচ্ছে দেখে। ইতি রাগ দেখিয়ে রোদকে ধাক্কা দিয়ে রুমে চলে যায়।
.
.
পর্ব-২৩
Eti Chowdhury
.
.
.
-না তুমি ইনসিকিওর ফিল করছো। ইউ আর জেলাস রাইট?
-জ্বি না।
-ইয়েস।
-নো।
-ইয়েস।
-উফফ...আপনি না।
রোদ হেসে দেয় ইতি জেলাস হচ্ছে দেখে। ইতি রাগ দেখিয়ে রোদকে ধাক্কা দিয়ে রুমে চলে যায়।
ইতি রুমে চলে আসতেই তার পিছন পিছন রোদও এসে তাকে নিজের বাহুবন্ধ করতে নিলেই ঠিক তখন তাদের রুমে ক্যাথরিন প্রবেশ করে। আশেপাশে কিছু না দেখেই সে রোদকে আওয়াজ দিতে থাকে,
-রোদ হোয়ার আর ইউ?
ক্যাথরিনকে এভাবে রুমে আসতে দেখে ইতি রুদ্ধ হয় খানিকটা। কঠিন মুখ করে দাঁড়ায় সে। ক্যাথরিনের অপ্রত্যাশিত প্রবেশে রোদ ইতিকে ছেড়ে দাঁড়ায়। ইতিকে পিছনে রেখে রোদ সামনে এসে বলে,
-তুমি আমার বেড রুমে কি করছো?
ক্যাথরিন তার ভাঙা ভাঙা বাংলা ভাষায় বলে,
-আমার তোমার সাথে কথা আছে। ইটস ইম্পর্টেন্ট রোদ।
-আমি তো বলেছি পরে কথা বলবো।
-বাট ইটস আর্জেন্ট।
-ইউ হ্যাভ টু ওয়েট।
-বাট..
-প্লিজ ক্যাথ জাস্ট ওয়েট ফর দ্যা রাইট টাইম। অতুল নিশ্চয়ই তোমাকে গেস্ট রুমটা দেখিয়ে দিয়েছে গিয়ে ফ্রেস হয়ে রেস্ট করো। নাও গো।
ক্যাথরিন রোদের কাছে আসতে নিলে রোদ বাধা দিয়ে এক পা পাশে সরে গিয়ে বলে,
-নট নাও।
দরজার আড়ালেই অতুল দাঁড়িয়ে ছিল। রোদের ডাকে সে সামনে এসে দাঁড়ায়। অতুলকে দেখে রোদ আবার বলে,
-ওকে গেস্ট রুমে নিয়ে যা। টেক কেয়ার অব হার।
ইতি পিছনে দাঁড়িয়ে সব দেখছে কিছুই বলছে না সে। ক্যাথরিন রোদের রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিয়ে আবার থেমে গিয়ে ইতিকে দেখিয়ে জানতে চায়,
-হু ইজ সি?
ভাঙা ভাঙা বাংলায় আরো জানতে চায়,
-ও তোমার সাথে, তোমার রুমে কি করছে?
রোদ এক পলক ইতির দিকে তাকিয়ে বলে,
-দ্যাটস নান অব ইউর বিজনেস। নাও প্লিজ লিভ আজ এলন।
ক্যাথরিন আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে যায়। সে খুব ভালো করেই চিনে রোদকে। সে এখন কথা বলবে না বা কিছু বলবে না মানে বলবেই না। সে যতটা সহজ ততটাই কঠিন। রোদকে আপোষ করা খুবই সহজ কিন্তু কোন কারণে সে কষ্ট পেলে বা কারো থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলে তার দিকে ভুলেও তাকাবে না। কষ্ট সহ্য করার অভ্যাস তার আছে। তাই নতুন করে সে আর কষ্ট পেতে চায় না। নিজের কাছের মানুষগুলোকেও আর কোন কষ্ট দিতে চায় না সে। ক্যাথরিন বেরিয়ে যেতেই রোদ পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে ইতি তার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ ইতি শান্ত ভঙ্গিতে রোদের একদম কাছাকাছি এসে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
-বললেন না কেন আমি কে?
-সময় মতো সব বলে দিবো।
ইতি চুপ করে রোদের দিকে তাকিয়ে থাকে তা দেখে রোদ ইতির হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টানে ইতিকে নিজের বুকে নিয়ে বলে,
-তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তো?
ইতি মুখ তুলে রোদের দিকে তাকাতেই রোদ তার আরেক হাত দিয়ে ইতির মুখে আলতো করে ছুয়ে দিতে লাগে।
-বলো ভরসা করো আমায়?
-খুব করি।
-তাহলে নিজের বিশ্বাসটাকে ধরে রাখো। আই ওন্ট ব্রেক ইউর ট্রাস্ট। ট্রাস্ট মি মিসেস চৌধুরী।
-তুই এখানে কেন?
-ভাইয়া।
-কি হলো বল?
রোদ তার স্টাডিতে বসে আছে। অতুল কিছু বলতে এসেও চুপ করে রয়েছে। একতো রোদের স্টাডিতে প্রয়োজন ব্যতিত কারো আসা রোদ একদম পছন্দ করে না। আর অতুল কিছু বলতে এসেও বলছে না বরং সঙ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে আরো বেশি বিরক্ত হচ্ছে রোদ। ঝাড়ি দিয়ে রোদ বলে,
-কি বলবি বল আর না বললে বিদায় হো চোখের সামনে থেকে।
-উনি আপনার সাথে কথা বলতে চায়।
-উনি টা আবার কে?
-ক্যাথরিন।
-ওকে বলে দে আমার সময় হলে আমি ওর সাথে কথা বলবো আর ততক্ষণ ওকে অপেক্ষা করতে হবে।
-সে শুনতে চাইছে না।
-তাকে শুনা। প্রয়োজনটা ওর আমার নয়। সো ওকে অপেক্ষা করতে হবে।
-আই কান্ট ওয়েট এনি মোর রোদ। হোয়াই ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?
রোদ অতুলের সাথে কথা বলছিল আর তখনি স্টাডিরুমে ক্যাথরিন প্রবেশ করে।
-তুমি এখানে কেন এসেছো?
-আমার কথা আছে তোমার সাথে।
-সরি ভাইয়া আমি বুঝতে পারিনি উনি এভাবে চলে আসবে।
অতুল অপ্রস্তুত হয়ে ক্যাথরিনকে বলে,
-আপনি আমার সাথে চলুন ভাইয়া এখন বিজি।
-ইউ গো। আই উইল টক টু হিম নাও।
-প্লিজ মিস ক্যাথরিন।
-থাক অতুল। তুই যা।
-কিন্তু ভাইয়া এখানে?
-ইটস ওকে তুই যা।
অতুল আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।
ইতি কিচেনে কাজে ব্যস্ত।
-কি করছো?
-আহ..
হুট করে পিছন থেকে শাশুড়ির আচমকা শব্দ পেয়ে আঁতকে উঠে ইতি৷ হাত থেকে চামচ পরে যায় তার।
-সে কি ভয় পেলে যে?
-না মা আসলে আপনি কখন এলেন টের পাইনি তাই।
-মনে হয় খুব মন দিয়ে কিছু করছিলে।
-হুম।
-তা কি করা হচ্ছিল?
-চা।
-চা এসময় কয়টা বাজে?
-তার জন্য করছি বলল খুব চা তেষ্টা পেয়েছে তার।
-বাহ ছেলে আমার বউয়ের রঙে রাঙিয়ে গেলো তাহলে।
শাশুড়ির কথায় বেশ লজ্জা পায় ইতি।
-তা আমি এক কাপ পাবো তো?
-সেকি কথা একটুপর তো ডিনার করবেন এখন চা খেলে তো আপনার খুদা নষ্ট হয়ে যাবে মা।
-কিছুই হবে না। আর একদিন কম খেলেও বিশেষ ক্ষতি হবে না।
-তাও মা।
-বুঝেছি এখন তুমি চায়ের জন্য নতুন সঙ্গী পেয়েছো তাই পুরোন সঙ্গীকে ভুলে গেছো।
বলেই গাল ফুলায় মিসেস চৌধুরী। ইতি শাশুড়ির বাহু ধরে বলে,
-একদম নয়। আমি কি আমার এতো ভালো সঙ্গীকে কখনো ভুলতে পারি নাকি? কখনো পারি না। এখনই দিচ্ছি চা।
বউ শাশুড়ি দুজনই হাসিতে ফেটে পরে।
ইতি শাশুড়িকে চা দিয়ে নিজের আর রোদের জন্য চা নিয়ে উপরে চলে যায়। চায়ের আড্ডা তাদের বারান্দাতেই হয়। রুমে যেতে নিয়ে ইতির মনে পরে রোদ তো এখনো স্টাডিতে। তার স্টাডি থেকে বের হতে সময় বাকি আছে আর ততক্ষণে চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। তাই ইতি ভাবে রোদের চা টা স্টাডিতেই দিবে। চা নিয়ে সে স্টাডি রুমের দিকে চলে যায়। এক হাতে চায়ের ছোট ট্রেটা নিয়ে অন্য হাত দিয়ে স্টাডি রুমের দরজা খোলার জন্য ঠেলে দিতে নিলেই ইতি ভেতর থেকে কারো কথার শব্দ পায়। ঠিক কথা নয় আরগিউমেন্ট চলছে মনে হয়। তাই থেমে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করে ইতি।
-রোদ প্লিজ।
-হোয়াট প্লিজ!! তোমার এসব কথায় আমি এখন আর গলবো না। কি ভেবেছো তুমি? তুমি যখন যা বলবে তাই হবে?
-আই সেইড আই এম সরি।
-আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউর সরি এনিমোর।
-প্লিজ রোদ। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড মি।
-ফর গড সেইক ক্যাথরিন স্টপ ইট প্লিজ।
-নো। আই উইল নট। আই স্টিল লাভ ইউ সো মাচ বেবী।
উচ্চ স্বরে হেসে দেয় রোদ। হেসে দিয়ে বলে,
-লাভ!! সিরিয়াসলি ডু ইউ লাভ মি?
-ইয়েস। আই ডু। আই লাভ ইউ।
-নো ইউ ডোন্ট। ইউ ডোন্ট লাভ মি।
-আই লাভ ইউ গড ডেম ইট বিলিভ মি।
-নো আই ডোন্ট বিলিভ ইউ এনিমোর। ইউ ডোন্ট লাভ মি। ইট ওয়াজ আই হু লাবড ইউ। তখন তোমার ভালোবাসা কোথায় ছিল যখন তোমার ভালোবাসার জন্য আমি চিৎকার করেছিলাম দিনের পর দিন, রাতের পর রাত? যখন তোমাকে, তোমার ভালোবাসার পাওয়ার জন্য আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। হোয়ার ওয়াজ ইউ ডেম লাভ? হোয়ার টেল মি?
-আই এম সরি ফর এভরিথিং। ইট ওয়াজ মাই মিস্টেইক। আই ওয়াজ স্টুপিড। আই এম রিয়েলি সরি।
-বাট আই ডোন্ট নিড ইউর লাভ অর সরি এনি মোর।
-ইউ কান্ট লিভ মি রোদ। ইউ কান্ট লিভ মাই লাভ।
-ফর ইউর ইনফরমেশন আই ডিডেন্ট লিভ ইউ। ইউ লিভ মি। ইউ লিভ মাই লাভ। ফর ইউর কেরিয়ার ইউ লিভ এভরিথিং।
-সেটা আমার ভুল ছিল। এন্ড আই রিগ্রেট ফর দ্যাট নাও।
-এখন আমার কিছুই করার নেই। তখন তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলে। আমাদের এতোদিনের সম্পর্ক, ভালোবাসা সব তোমার জন্য মিথ্যে হয়ে গিয়েছিল। এখন তুমি আমার জন্য মিথ্যে হয়ে গেছো। ইউ ডোন্ট এক্সিস্ট ইন মাই লাইফ এনিমোর। আই ডোন্ট লাভ ইউ।
-নো রোদ প্লিজ ডোন্ট রিফিউজ মি।
-লিভ মাই হ্যান্ড ক্যাথ।
-নো আই ওন্ট। ইউ হ্যাভ টু লাভ মি।
-লিভ মি ক্যাথ।
ইতির মনে হচ্ছে কে যেন তার বুকের ভেতর হাতুড়ি নিয়ে জোরে জোরে বারি দিচ্ছে আর তা থেকে খুব জোরে শব্দ হচ্ছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে ইতির। সাসপেন্স ধরে রাখতে না পেরে স্টাডি রুমের দরজাটা হালকা ঠেলে দিতেই তা প্রশস্ত হয়ে খুলে যায়। আর দরজাটা খুলতেই ইতি যা দেখে তার দেখার জন্য সে একদম প্রস্তুত ছিল না। ক্যাথরিন নিজেকে রোদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। যদিও রোদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাও সে রোদের ঠোঁট জোড়াকে নিজের ঠোঁটের আবদ্ধে নেয়ার চেষ্টা করছে। এমন কোন ঘটনার স্বাক্ষী ইতিকে হতে হবে তা সে ভাবতেই পারেনি। আচমকা ইতির হাত থেকে চায়ের ট্রেটা পরে গিয়ে ঝন করে বিকট শব্দ হয়। শব্দ পেয়ে রোদ ভয়ার্ত চোখে দরজার দিকে তাকাতেই দেখে ইতি স্টাডি রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে সব দেখছে। রোদ জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে ক্যাথরিনকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিতেই সে ধাক্কা খেয়ে গিয়ে ছিটকে পরে পিছনে।
-ইতিই...
চেচিয়ে উঠে রোদ ইতির দিকে যেতে নিলে ইতি আর এক দন্ডও সেখানে দাঁড়ায় না দৌড়ে সেখান থেকে নিজের রুমে দিকে ছুটে সে। রোদও ইতির পিছনে যায়। ইতি রুমে ঢুকেই রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়।
রোদের মুখের উপর দরজা মেরে দেয় ইতি। ভেতর থেকে ইতি রুমের দরজা লক করে দেয়। রোদ এসে দরজায় জোরে বারি দেয়।
-ইতি প্লিজ দরজা খোল। আমার কথা শুনো। আমাকে এক্সপ্লেইন করতে দাও প্লিজ ইতি। প্লিজ নিজের কোন ক্ষতি করো না ইতি। ইতি ডোন্ট বি মেড।
.
.
পর্ব-২৪
Eti Chowdhury
.
.
.
রোদ এসে দরজায় জোরে বারি দেয়।
-ইতি প্লিজ দরজা খোল। আমার কথা শুনো। আমাকে এক্সপ্লেইন করতে দাও প্লিজ ইতি। প্লিজ নিজের কোন ক্ষতি করো না ইতি। ইতি ডোন্ট বি মেড।
রোদ অনেক জোরে দরজায় বারি দিতে লাগে। রোদের চিৎকার, চিল্লাচিল্লির শব্দ পেয়ে তার মা ও অতুল নিচ থেকে চলে আসেন। ক্যাথরিনও রোদের পিছনে এসে দাঁড়ায়। মিসের চৌধুরী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলেন,
-কিরে কি হয়েছে?
-কিছু না মা। তুমি চিন্তা করো না।
-তুই এভাবে ইতিকে ডাকছিস ও দরজার খুলছে না এসব দেখেও বলছিস আমি চিন্তা করবো না?
-না করবে না। প্লিজ মা এখন ব্যাপারটা আমাকে দেখতে দাও প্লিজ। অতুল তুই মাকে নিয়ে নিচে যা তো।
মিসেস চৌধুরী যেতে চায় না তবু রোদ জোরাজুরি করে তাকে নিচে পাঠিয়ে দেয়। রোদ আবার ইতিকে ডাকতে লাগে।
-ইতি প্লিজ ওপেন দ্যা ডোর। তুমি যদি আজ উল্টা পাল্টা কিছু করো আমি কিন্তু তোমার খবর করে ছাড়বো বলে দিলাম। তোমার বাপ-ভাইকে আমি ভয় পাই না আগেই বলে দিলাম। সো প্লিজ দরজাটা খুলো। ঠান্ডা মাথায় আমার কথাগুলো শুনো তাহলেই বুঝবা তুমি। ইতি শুনো দরজা খোলো প্লিজ।
-রোদ।
ক্যাথরিনের ডাকে থেমে গিয়ে পাশ ফিরে তাকায় রোদ। ক্যাথরিনকে দেখে রোদের চোখ গুলো কেমন ভয়ংকর ধরনের হয়ে গেছে। মনে হয় এখনি রোদ ক্যাথরিনকে খুন করে ফেলবে। তবু এসবের তোয়াক্কা না করে ক্যাথরিন রোদের সামনে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
-তুমি এভাবে চলে এলে কেন?
ক্যাথরিনের বাংলা ক্লিয়ার নয় তবু সে যথেষ্ট বাংলা জানে তাও রোদের বদৌলতে।
-ক্যাথ এখন এখান থেকে যাও। এই মুহুর্তে আমি তোমাকে দেখতে চাই না।
-তোমাকে দেখতে হবে। তুমি এভাবে যার তার জন্য আমাকে ফেলে আসতে পারো না।
-কি বললে? কি বললে তুমি? যার তার?
-ইয়েস, যার তার। কে এই মেয়ে? আসার পর থেকে দেখছি আমি।
-সি ইজ মাই ওয়াইফ। ও আমার বউ। মিসেস রোদ আহমেদ চৌধুরী ও। এরপর ওর ব্যাপারে কিছু বলা তো দূরের কথা ওর নামটাও আমি তোমার মুখে শুনতে চাই না। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হোও তুমি।
-রোদ প্লিজ।
-আই প্রমিজ ক্যাথ আমার বউয়ের যদি আজ কিছু হয় তোমাকে আমি ছাড়বো না। তুমি জানো না এখানে রোদ চৌধুরী কি জিনিস। রোদ চৌধুরীর এক ইশারায় তোমার সাথে কি থেকে কি হতে পারে। যদি আমার বউয়ের কিছু হয় তোমাকে গায়েব করতে আমার ২ সেকেন্ডও সময় লাগবে না।
রোদের কথা শুনে অবাক হয় ক্যাথরিন। যে রোদ একদিন পাগলের মতো তাকে ভালোবেসেছে সেই রোদ আজ অন্য একটি মেয়ের জন্য তাকে কি সব উল্টা পাল্টা কথা বলছে। ব্যাপারটা কোন ভাবেই মানতে পারছে না ক্যাথরিন।
-রোদ তুমি পাগল হয়ে গেছো। কি সব বলছো তুমি? হেভ ইউ গোন মেড?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি আমার বউয়ের জন্য। রোদকে পাগল করে মরার জন্য তুমি ফেলে চলে গিয়েছিলে। যখন আমি সব সামলে নিয়ে ওকে নিয়ে নতুন করে জীবন সাজাচ্ছি তখন নতুন করে আমাকে শেষ করে দিতে এসেছো তুমি?
-রোদ প্লিজ।
-জাস্ট প্রে ক্যাথ। যেন আমার বউয়ের কিছু না হয়।
খুট করে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ঝট করে ফিরে তাকায় রোদ। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ সব কথাই শুনছিল ইতি। একপর্যায়ে দরজা খুলে সে। দরজা খুলতেই রোদ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে ইতিকে দেখার জন্য। ইতি দরজা খুলে একপলক তাকায় ক্যাথরিনের দিকে। তারপর রোদের দিকে তাকিয়ে রোদের পাঞ্জাবির কলার ধরে আচমকাই তাকে রুমের ভিতরে টেনে নিয়ে ক্যাথরিনের মুখের উপর দরজা মেরে দেয় আবার। ক্যাথরিন সেখানেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রোদকে দরজার সাথে চেপে ধরে রাখে ইতি। এখনো ইতির হাত রোদের পাঞ্জাবির কলারে। রোদ কিছুক্ষণ ইতির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
-তুমি ঠিক আছো তো?
ইতি রোদের প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না। রোদের দিকে তাকিয়ে থেকে ফোঁপাতে থাকে মেয়েটা। রোদ বুঝতে পারছে মেয়েটা যে কোন সময় কেঁদে দিবে। সত্যিই ইতি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। রোদের পাঞ্জাবির কলারটা নিজের মুষ্টিবদ্ধ থেকে ঢিলে করে দিতেই রোদ একটা হেঁচকা টান দিয়ে ইতিকে নিজের বুকে নিয়ে নেয়।
-আই এম সরি।
ইতি রোদের বুকেই দাপাতে থাকে। রোদের বুক থেকে সরার বৃথা চেষ্টা করতে থাকে ইতি। কিন্তু রোদের শক্তির সাথে পেরে উঠে না সে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর রোদ নিজেই ছেড়ে দেয় ইতিকে। বলে,
-থাকবে না তো আমার বুকে? যাও ছেড়ে দিলাম।
রোদ ছেড়ে দিলেও ইতি সরে যায়নি তার বুক থেকে। রোদের উন্মুক্ত বুকের উপরেই পরে রইল সে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ইতি বলে,
-কেন? কেন আমার সাথে এমন করলেন?
ইতিকে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে রোদ ইতির মুখ চেপে ধরে বলে,
-তুমি ভুল কিছু বুঝার আগে আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। কিছু জানাতে চাই। প্লিজ একটা সুযোগ দাও আমাকে। একবার আমাকে এক্সপ্লেইন করতে দাও।
ইতি মাথা তুলে রোদের দিকে তাকায়। রোদ ইতির হাত ধরে ইতিকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
-তুমি এখানে বসো আমি আসছি।
আসছি বলে রোদ রুম থেকে বের হতে নিলে ইতি পিছন থেকে তাকে বাঁধা দেয়ার জন্য তার একটা হাত আঁকড়ে ধরে। রোদ পিছন ঘুরে বলে,
-আমি তোমার কাছেই ফিরে আসছি এক্ষুনি। যাবো আর আসবো প্রমিজ।
ইতি হাত ছেড়ে দিতেই রোদ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তবে বেশি দেরি করে না রোদ। ২ থেকে ৩ মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরে আসে সে। রোদ ফিরে আসে তবে একা নয়। রোদকে দেখে ইতি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রোদ ইতির কাছে এগিয়ে এসে তার ডাইরিটা ইতির হাতে দিয়ে বলে,
-নাও তোমার সব প্রশ্নের উত্তর।
ডাইরিটা দেখে বেশ অবাক হয় ইতি। এই ডাইরিটা রোদ ইতি কেন অন্য কাউকেও ধরতে দিতো না। আর আজ সে নিজেই ডাইরিটা তাকে দিচ্ছে। অবাক হওয়াটা ইতির চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। ইতি বলে,
-এই ডাইরিটা?
-পড়ো সব জানতে পারবে। তোমার সব কৌতুহল, প্রশ্নের উত্তর, অজানা তথ্য সব এখানে আছে। তুমি পড়ো আমি বারান্দায় আছি। তোমার ডাইরি পড়া হলেই আমরা কথা বলবো।
ডাইরিটা বিশেষ বড় নয়। মিডিয়াম সাইজের একটা ডাইরি। প্রথমেই ইতি পুরো ডাইরিটা একবার উল্টে পাল্টে দেখে। পুরোটা ডাইরি জুড়ে লেখা নেই। বলতে গেলো ডাইরির অনেকটাই ফাঁকা। ইতির ডাইরির প্রথম পাতা উল্টাতেই দেখে সেখানে লেখা বেঈমান।
বেঈমান শব্দটা দেখে ইতি অনেক অবাক হয়। শুরু করে ইতি তার স্বামীর অতীতের পাতায় চোখ বুলানো।
আজ থেকে আরো দশ বছর আগের কথা। রোদ পড়ালেখা করতে লন্ডন চলে যায়। সেখানেই তার পরিচয় হয় ক্যাথরিনের সাথে। লাভ এট ফাস্ট সাইট যাকে দেখে। ক্যাথরিনকে দেখে রোদ প্রথম দেখাতেই তার প্রেমে পরে যায়। আগের রোদটা এখনকার রোদের মতো এতো রাগী, বদ মেজাজী ছিল না। সে খুব হাসতো। সারাদিন হাসি,আড্ডা, খেলাধুলা সব কিছু নিয়ে মেতে থাকতো সে। রোদের স্বভাবের জন্য সবার কাছে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের ফেভারিট হয়ে যায় সে। লেখাপড়ায় যেমন ভালো ছিল রোদ তেমনি গান, খেলাধুলা, ফাইট সব কিছুতেই সে ভালো ছিল। একি ভার্সিটিতে পড়লেও আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্টে ছিল তারা। প্রথমে পরিচয় তারপর বন্ধুত্ব দিয়েই শুরু হয়েছিল রোদ আর ক্যাথরিনের সম্পর্ক। বেশিদিন সময় লাগেনি তাদের প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে। রোদ যথেষ্ট ওনেস্ট ছিল তার সম্পর্কে। ক্যাথরিনও ওনেস্ট ছিল। পরিচয়ের ৬ থেকে ৮ মাসের মাথায়ই তারা সম্পর্কে জড়ায়। লন্ডন যাবার পর প্রায় দেড় বছর পর রোদ ছুটিতে বাড়ি ফিরেছিল। আর সেবার বাড়ি ফিরেই রোদ তার বাবা-মাকে ক্যাথরিনের কথা জানিয়ে দিয়েছিল। রোদের বাবা-মা দুজনের একজনও চায়নি ছেলে ভিনদেশী কোন মেয়ে বউ করে আনুক। রোদ তাদের একমাত্র সন্তান তাই ছেলের বউ নিয়ে তাদের অনেক আশা ছিল। ছেলের এহেন কর্মে তারা দু'জনই কষ্ট পেয়েছিলেন। রোদের মা তাকে না করলে এটা নিয়ে তাদের মধ্যে বাক বিরোধিতাও হয়৷ জীবনে প্রথমবার রোদ তার বাবা-মার বিপরীতে গিয়ে কোন কাজ করেছে। তারা অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন। আর এই কষ্ট তাদের দেয়ার জন্য রোদ আজও মনে মনে আফসোস করে। পরে রোদের বাবা-মা আর তাকে কোন বাঁধা দেয়নি। তারা ভেবেছিলেন ছেলে ভালো থাকলে, সুখে থাকলেই হবে৷ ছেলের মত মেনে না নিলে যদি পরে তাদের ছেলে হারাতে হয়। তাই বাধ্য হয়েই তাদের মেনে নিতে হয়েছিল তখন। ঐবার ছুটি কাটিয়ে যাওয়ার পর আর কোন ছুটিতে রোদ বাড়ি আসেনি৷ যেটা নিয়ে রোদের বাবা-মা অনেক বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। রোদ আর ক্যাথরিনের সম্পর্কের প্রায় ২ বছরের মাথায় ক্যাথরিন রোদের সাথে মুভ করে। লন্ডনে রোদ কোন হোস্টেলে থাকতো না। তার লিসেন বাড়ি নেয়া ছিল। ক্যাথরিন সেখানেই রোদের সাথে মুভ করে৷ যেহেতু ক্যাথরিন লন্ডন থেকে বিলং করে তার কালচারে বিয়ের আগে একসাথে থাকাটা আহামরি কিছু নয় তাই সে এতো কিছু ভাবেনি। আর রোদ নিজেও তাদের সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট ওনেস্ট ছিল তাই ক্যাথরিনের সাথে একসাথে থাকতে তারও কোন আপত্তি ছিল না। রোদ চাইলে তখনই বিয়েটা করে ফেলতে পারত কিন্তু বাবা-মাকে ছাড়া সে বিয়ে করে তাদের আর কষ্ট দিতে চায়নি। তবে সব কিছুই ঠিক করা ছিল। রোদ আর ক্যাথরিনের একসাথেই পড়া শেষ হবে। আর পড়া শেষ হলেই রোদ ক্যাথরিনকে নিয়ে দেশে চলে আসবে। দেশে এসেই সবার আগে তারা বিয়ে করবে। রোদ অনেক বেশি ভালোবাসতো ক্যাথরিনকে। ক্যাথরিন যে কম ভালোবাসতো তা নয়। অনেক বেশি ভালোবাসাময় সম্পর্ক ছিল তাদের। তাদের দিন শুরু হতো একে অপরের মুখ দেখে আবার শেষও হতো একে অপরের মুখ দেখে। যখন ইচ্ছা ঘুরতে যাওয়া। হৈ চৈ, হাসি, আনন্দে কাটছিল রোদ আর ক্যাথরিনের জীবন।
সম্পর্কের প্রায় ৭ বছরের মাথায় রোদের পড়া তখন শেষ। সে আর লন্ডনে থাকতে চায় না। এমনিতেও তার কখনোই পরিকল্পনা ছিল না সে লন্ডনে সেটেল্ড হবে। তার ইচ্ছা মতো বাবা-মা তাকে পড়তে দিয়েছে। তাই বাবা-মার ইচ্ছা পূরণ করতে রোদ তার বাবার ব্যবসায় দেখবে যা তার বাবা অনেক কষ্ট করে দাড় করিয়েছেন।
এর মধ্যেই ফাইনালের আগে ক্যাথরিন একটা ফ্যাশন এন্ড স্টাইল কোম্পানিতে ইন্টার্ন হিসেবে জয়েন করেছিল যা পার্মানেন্ট কোন জব ছিল না। সেদিন ক্যাথরিন বাসায় এলে রোদ জানিয়ে দেয় তাকে তারা দেশে ফিরবে। ক্যাথরিনও দ্বিমত করেনি। সে তখনি রোদকে জানিয়ে দেয় পরের দিনই সে অফিসে গিয়ে রিজায়েন লেটার দিয়ে আসবে এবং ক্যাথরিন তার কথা মতো তাই করেছিল। পরের দিন ক্যাথরিন অফিস থেকে এলে রোদ তাকে দেখে নিজের বাহুডোর জড়িয়ে নিয়ে বলেছিল,
-আমি টিকেট চেক করেছি। আমরা চাইলে এই সপ্তাহে বা এই মাসের শেষের দিকেও যেতে পারি।
রোদ আপন মনেই কথা বলতে থাকে। ক্যাথরিন কিছু বলছে না। রোদ লক্ষ করে গতকাল ক্যাথরিনের মাঝে যে উদ্দীপনা সে দেখেছে আজ তার ছিটেফোঁটাও নেই। রোদ ক্যাথরিনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার চিবুকে হাত দিয়ে ক্যাথরিনের মুখ উপরে তুলে জিজ্ঞেস করে,
-কি হয়েছে?
ক্যাথরিন প্রথমে আমতা আমতা করে। রোদ আবার জিজ্ঞেস করে,
-কি হয়েছে আমাকে বলো।
-আমি যেতে পারবো না রোদ।
-হোয়াট!!
.
পর্ব-২৫
Eti Chowdhury
.
.
.
ক্যাথরিন প্রথমে আমতা আমতা করে। রোদ আবার জিজ্ঞেস করে,
-কি হয়েছে আমাকে বলো।
-আমি যেতে পারবো না রোদ।
-হোয়াট!! কি সব বলছো?
ক্যাথরিন চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। ক্যাথরিনকে চুপ থাকতে দেখে রোদ বলে,
-কি হয়েছে?
-ওরা আমাকে অনেক বড় একটা অফার দিয়েছে রোদ। এতো বড় অফার ছেড়ে শুধু মাত্র তোমাকে বিয়ে করার জন্য চলে যাওয়াটা বোকামি ছাড়া কিছুই হবে না। তুমি ভাবো একবার। আমার ক্যারিয়ারের প্রশ্ন এটা।
রোদ ক্যাথরিনের দু গাল দু হাতে চেপে ধরে বলে,
-আমি তো তোমাকে বলছি না তোমার ক্যারিয়ার ছাড়তে। আমি সব করে দিবো তোমাকে ক্যাথ। তোমার নিজের ফ্যাশন হাউজ করে দিবো। তুমি দেখো তুমি বাংলাদেশে টপ করবে।
-বুঝার চেষ্টা করো রোদ। এখানের কালচার আর ওখানের কালচার আলাদা। এখানে আমি যা করতে পারবো তা ওখানে করতে পারবো না।
-তুমি শুধু তোমার শখ পূরণের জন্য করবে। তোমার কাজ করার কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের জন্য যা করা লাগবে সব আমি করবো।
ক্যাথরিন ঝাড়ি দিয়ে রোদকে নিজের থেকে আলাদা করে বলে,
-ইটস নট এবাউট মানি রোদ।
-তাহলে কি চাই তোমার?
-পাওয়ার চাই, পজিশন চাই আমার। নিজের একটা পরিচয় চাই আমার। আমি চাই সবাই আমাকে আমার নামে চিনবে, আমার পরিচয়ে। কেবল মিসেস রোদ চৌধুরী হিসেবে নয়। কেবল বিয়ে করে সংসার করার জন্য আমি নই রোদ।
-আমি আর তুমি কি আলাদা নাকি?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ আলাদা। আমরা দু'জন আলাদা মানুষ রোদ।
এতোক্ষণ অনেক সহ্য করলেও এবার খানিকটা রাগ দেখিয়ে উচ্চ স্বরে রোদ বলে,
-ব্যাস অনেকে শুনেছি এতোক্ষণ। তুমি অনেক বলেছো। যা বলেছো ভুলে যাও। তুমি নিজের পরিচয় করতে চাও করবা। তবে বাংলাদেশে গিয়ে। আমরা এই সপ্তাহেই চলে যাবো। যাও ভেবেছিলাম এই মাসের শেষে যাবো কিন্তু আর নয়। আর সময় নষ্ট করতে চাই না আমি। আর এটাই ফাইনাল কোন কথা বাড়াতে চাইনা আমি। চাই না শুধু শুধু এটা নিয়ে আমাদের ঝগড়া হোক।
কথাগুলো বলে রোদ আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায়। ক্যাথরিন আর রোদের মাঝে এ নিয়ে অনেক মনোমালিন্যতা হয়। তবু রোদ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
যাবার দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রোদ দেখে ক্যাথরিন তার পাশে নেই। হয়ত নিচে আছে বা কিচেনে আছে ভেবে রোদ নিচে নেমে আসে।
-ক্যাথ কোথায় তুমি? ক্যাথ!
ক্যাথরিনের কোন সাড়া শব্দ নেই। অনেক ডেকেও রোদ ক্যাথরিনকে কোথাও পায় না। রোদের অভ্যাস সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে এক বোতল ঠান্ডা পানি পান করে। ক্যাথরিনকে কিচেনে খুঁজতে গিয়ে সেখানেও পায় না। সেল্ফের উপর এক বোতল বরফ ঠান্ডা পানি পায় রোদ। পানিটা বেশিক্ষণ আগে বের করা হয়নি। বরফ অল্প গলেছে। সর্বোচ্চ ২০ মিনিট হবে হয়তো বোতলটা বের করা হয়েছে এর বেশি নয়। পানি খাওয়ার জন্য বোতলটা হাতে নিতে গেলেই রোদ দেখে বোতলের পাশেই পেপার ওয়েট দিয়ে একটা ভাজ করা চিরকুট রাখা। চিরকুটটা দ্রুত হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে রোদ। চিরকুটে লেখা।
"সরি রোদ। পারলে আমাকে মাফ করে দিও। আমি চলে যাচ্ছি। সব ছেড়ে, নিজের ক্যারিয়ার ছেড়ে তোমার সাথে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি পারবো না তোমার জন্য নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে। তাই আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে আটকানোর চেষ্টা করে কোন লাভ নেই, আমি আর ফিরবো না। তাই বাবা-মার কাছে চলে যাচ্ছি। তুমি না বুঝলেও তারা আমাকে বুঝে। তুমি নিজের খেয়াল রেখো। পারলে আমাকে মাফ করে দিও। মাফ না করলেও আমি কষ্ট পাবো না তাও তুমি কষ্ট পেয়ো না। আমি খুব ভালোবাসি তোমাকে রোদ।
ইতি তোমার
ক্যাথ।"
চিরকুটটাকে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না রোদের। তার মনে হচ্ছিল সে কোন স্বপ্ন দেখছে। ঘুম ভাঙ্গলেই দেখবে তার ক্যাথ তার পাশেই আছে। কিন্তু আসলে তা নয়। তার ক্যাথ সত্যি সত্যি তাকে ছেড়ে চলে গেছে। রোদ সাথে সাথে বেরিয়ে যায় ক্যাথকে আটকাতে।
স্টেশনে গিয়ে পাগলের মতো খুঁজতে লাগে রোদ ক্যাথকে শেষে পেয়েও যায়। পিছন থেকে ক্যাথের একটা হাত ধরে টেনে তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে রোদ।
-কোথায় যাচ্ছো তুমি আমাকে ছেড়ে?
ক্যাথরিন রোদকে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে সিরিয়ে নিয়ে বলে,
-আমাকে আটকে কোন লাভ নেই রোদ।
-তুমি কি পাগল হয়ে গেছো ক্যাথ?
-নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবাকে পাগল বলে না রোদ।
-আই লাভ ইউ ক্যাথ। আমি কিভাবে থাকবো তোমাকে ছাড়া।
-কাম অন রোদ। প্লিজ গ্রোআপ। তোমাকে ভালোবাসি তাই বলে এই ভালোবাসার দোহাই দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার শুরু হবার আগেই শেষ করতে পারবো না আমি।
-ক্যাথ!
-শুনো রোদ।
-না তুমি শুনো। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
-মরবে না তুমি। আজ আমি আছি পরে অন্য কেউ চলে আসবে আমার জায়গায়। এটা কোন ব্যাপারই না৷ আমার সময় হয়ে যাচ্ছে রোদ। হাতটা ছাড়ো আমার।
ক্যাথরিন হাত ছাড়তে বললে রোদ আরও শক্ত করে ধরে। একপ্রকার জোরাজুরি করেই রোদের হাতটা ছাড়িয়ে তাকে রেখে চলে যা ক্যাথরিন। রোদ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। নিজেকে কি বলে আখ্যা দিবে বুঝতে পারছিল না রোদ। তার এতোদিনের ভালোবাসা এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল, মিথ্যে হয়ে গেল। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারেনি।
সেদিন আর দেশে ফিরেনি রোদ। কোন মুখ নিয়েই বা সে দেশে ফিরতো। বাবা-মাকে কি বলতো সে? বাবা-মা তো ক্যাথরিনকে মেনে নিয়েছিল। তাদের কি জবাব দিতো রোদ। সারারাত বারে বসে ড্রিংকস করেই কাটিয়ে দিয়ে ছিল রোদ। শুধু সেদিন রাতেই নয়। ঐ ঘটনার পর থেকে রোদের দিন শুরু হতো ড্রিংকস দিয়ে শেষও হতো ড্রিংকস দিয়ে। আসলে তার জীবনে আর কোন দিন রাতের শুরু শেষ ছিল না। সবটাই কেবল কষ্ট ছিল। রোদের অনেক ক্লোজ বন্ধু শাফায়াত অনেক বুঝিয়েছিল রোদকে কিন্তু কাজ হয়নি। রোদ ক্যাথরিনকে ছাড়া বেহাল জীবন যাপন করেছিল৷ ক্যাথরিন চলে যাবার পরেও রোদ ক্যাথরিনের কাছে গিয়েছিল। তার কাছে তার ভালোবাসা ভিক্ষা চাইতে। যেন সে রোদের জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু ক্যাথ সাফ বলে দিয়েছিল। রোদের প্রতি সব ভালোবাসা সে ত্যাগ করে দিয়েছে। তার জন্য তার ক্যারিয়ারটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রোদ অনেক বেশি ভেঙ্গে পরেছিল। বাবা-মার সাথেও ঠিক মতো যোগাযোগ করতো না রোদ। তারা অনেক বেশি দুশ্চিন্তায় পরে গিয়েছিলেন রোদকে নিয়ে। যে ছেলের টিকেটও ফাইনাল সে একেবারের জন্য দেশে ফিরেবে হুট করে কি হলো এক বছরেও সে দেশে ফিরলো না। তারা কিছু জানতে চাইলেও রোদ জানায়নি তাদের। শেষের দিকে তো ঠিকমতো তাদের সাথে যোগাযোগও করতো না রোদ। ক্যাথরিন চলে যাওয়ার একবছর পর একদিন রোদের বাবা-মা লন্ডন চলে আসে ছেলের কি হয়েছে দেখতে। ছেলের এই অবস্থা কোন বাবা-মাই বা সহ্য করতে পারে? তাও রোদের বাবা-মা একদম ভেঙে পরেননি। মূলত রোদের বন্ধু শাফায়েতই রোদের বাবা-মার সাথে যোগাযোগ করেছিল তারা যেন একবারের জন্য হলেও আসে। শাফায়াতের ফোন পাওয়ার পর তারা সময় নষ্ট না করে চলে আসে রোদের কাছে। বাবা-মাকে পেয়ে সেদিন ছোট সেই রোদ হাউমাউ করে কেঁদেছিল। সন্তান বাবা-মাকে যতই কষ্ট দিক না কেন। কোন বাবা-মাই সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সন্তানের কষ্টের সময় তার হাত ছেড়ে দিতে পারে না। রোদের বাবা-মাও পারেনি ছেলেকে এই হালে ছেড়ে দিতে। পরের ফ্লাইটেই রিটার্ন টিকেট কেটে রোদকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন রোদের বাবা-মা।
দেশে এসেও রোদ কারো সাথে কথা বলতো না। ঠিক মতো কিছু খেতো না। কাউকে সহ্য করতে পারতো না। সারাদিন নিজেকে রুমে আটকে রাখতো। অন্ধকার রুমে সারাদিন ল্যাপটপ নিয়ে পরে থাকতো সে। রোদের ল্যাপটপ ভর্তি ক্যাথরিনের হাজার হাজার ছবি। হঠাৎ হঠাৎ ক্যাথ ক্যাথ করে চিৎকার করে উঠতো সে। প্রায় ১ বছরের মতো সময় রোদ নিজেকে গৃহবন্দী করে রেখেছিল। কারো সাথে যোগাযোগ করতো না।
দেশে ফিরার ১ বছর পরের ঘটনা।
একদিন অনেক চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ পেয়ে রোদ নিজের রুম থেকে বেরিয়ে দেখে তার মা মিসেস চৌধুরী নিচে নামার সময় সিড়ি পিছলে পড়ে গিয়ে অনেক ব্যাথা পেয়েছেন। মিস্টার চৌধুরী আর অতুল তাকে অনেক বলছেন হাসপাতালে যাওয়ার কথা কিন্তু সে কিছুতেই যাবেন না। মায়ের এই অবস্থা দেখে রোদ দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে তাকে ধরে বলে,
-মা প্লিজ হাসপাতালে চলো।
মিসেস চৌধুরী ছেলের চিবুক ধরে চুমু খেয়ে বলেন,
-না রে বাবা আমি যাবো না হাসপাতলে।
-এমন পাগলামো করো না মা প্লিজ। এতে তোমার ক্ষতি হবে।
-আর কোন ক্ষতি হওয়ার কি বাকি আছে রে বাবা?
-কি বলছো তুমি এসব রোদের মা?
-ঠিকিই তো বলছি। আমার একমাত্র সন্তান দিনে দিনে প্রতিমুহূর্তে নিজে একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছে আর আমি মা হয়ে তার জন্য কিছুই করতে পারছি না। আমার ছেলে এতো কষ্ট নিজের বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে আর আমি এতোটুকুও কষ্ট সহ্য করতে পারবো না তাহলে কেমন মা হলাম আমি?
রোদ মায়ের কথা শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে আবার হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-আমাকে মাফ করে দাও মা প্লিজ। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে মাফ করে দাও।
-আরে বোকা ছেলে তুই কেন মাফ চাইছিস। মা তোর সাথে একটুও রাগ নইরে বাবা। তুই ভালো থাকলেই আমার চলবে। আমার আর কিছুই চাই না রে বাবা।
-আমি এখন থেকে তোমার সব কথা শুনবো মা। প্লিজ তুমি হাসপাতালে চলো।
-তাহলে কথা দে আমার রোদ আমায় ফিরিয়ে দিবি। এই মৃত রোদ আমার চাই না। আমি আমার ছেলে রোদকে চাই। যে রোদ হাসে, প্রাণ খুলে হাসে। জীবন তার কাছে অনেক সুখের কিছু সেই রোদকে চাই আমার। কথা দে আমার ছেলে আমাকে ফিরিয়ে দিবি।
রোদ কয়েক মুহুর্ত মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-কথা দিচ্ছি মা তোমার রোদ আর কষ্ট পাবে না। সব ভুলে তোমার ছেলে আবার নতুন করে সব শুরু করবে। তোমার ছেলে আবার হাসবে, প্রাণ খুলে হাসবে।
-এই তো আমার ছেলে।
রোদের কপালে একটা মমতাময়ী চুমু খেয়ে রোদের মা বলেন,
-কারো যাওয়া লাগবে না আমার ছেলেই আমাকে নিয়ে যাবে হাসপাতালে। কিরে নিয়ে যাবি তো?
রোদ সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গিয়ে মাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
-আমার মায়ের জন্য তার ছেলেই একশতে একশ।
রোদ আর অপেক্ষা না করে মিসেস চৌধুরীকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। হাসপাতালে গিয়ে মিসেস চৌধুরী শুধু নিজের নয় রোদকেও ডাক্তার দেখায়৷ কারণ লম্বা সময় রোদ অনেক বেশি ড্রিংকস করে কাটিয়েছে। মা হিসেবে মিসেস চৌধুরী ছেলের প্রতি অনেক সচেতন। তাই ছেলের স্বাস্থ্যের চিন্তা তার জন্য সবার আগে।
.
.
পর্ব-২৬
Eti Chowdhury
.
.
.
পরের দিন সকালে নাস্তার টেবিলে রোদের বাবা-মা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অতুলকে পাঠিয়ে ছিলেন রোদকে ডাকতে। অতুল গিয়ে একাই ফিরে এসেছে। রোদ দরজা না খুলেই বলেছে সে ৫ মিনিট পর আসছে। মিস্টার আর মিসেস চৌধুরীকে অবাক করে দিয়ে ৫ মিনিট পরেই রোদ নিচে নেমে এসে তাদের সাথে নাস্তা করতে বসে। তবে তারা অবাক হয় এটা দেখে রোদের পরণে সুট। সে তৈরী হয়ে নেমেছে কোথাও যাওয়ার জন্য। দেশে ফিরার পর প্রথম সে কোথাও যাচ্ছে। কিন্তু রোদের বাবা-মা কেউ কিছুই জানতে চাইছে না তার কাছে। এক পিস ব্রেড এর স্লাইস মুখে পুরে দিয়ে রোদ বলে,
-তোমরা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছো না বা জানতে চাইছো না যে?
মিসেস চৌধুরী বলেন,
-কোন বিষয়ে?
-এই যে আমি এতো তৈরী হয়ে নামলাম। সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছি জানতে চাইবে না?
রোদের বাবা-মা লক্ষ করলেন রোদ যথেষ্ট স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। তার মাঝে আর কোন জড়তা নেই। তাই ছেলের চেষ্টাকে বাহবা দিয়ে মিস্টার চৌধুরী বলেন,
-তা কোথায় যাওয়া হচ্ছে জনাবের সকাল সকাল শুনি।
-অফিসে।
-কি!
মিসেস চৌধুরীর হাত থেকে খাবার পরে যায় রোদ অফিসে যাবে শুনে।
-সত্যি তুই অফিসে যাবি?
-বারে মা তুমি এমন ভাবে অবাক হচ্ছো যেন আমি অফিসে নয় মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছি। নিজের ইচ্ছে মতো লেখাপড়া করতে চেয়েছি তোমরা করতে দিয়েছো৷ কিন্তু এখন সময় হয়েছে বাবার পাশে দাঁড়ানোর। তোমার ছেলে নিজের দায়িত্ব, কর্তব্য যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করবে মা।
মিসেস চৌধুরী ছেলের কপালে আবার মমতার পরশময়ী আদর এঁকে দেন পরম স্নেহের সাথে।
রোদ জানে তার বাবা-মা তাকে মাফ করে দিয়েছে অনেক আগেই কিন্তু রোদ নিজে কখনো নিজেকে মাফ করতে পারবে না। সে তার বাবা-মাকে তাদের জীবনের সব চাইতে বড় কষ্টটা দিয়েছে। এর কোন মাফ হয় না।
পাতা উল্টাতেই শেষ পাতায় লেখা,
"হয়তো নিজেকে ভালো রাখতে চাওয়ার লোভে ইতির জীবনটা নষ্ট করে দিচ্ছি আমি। প্রথমে বাবা-মা এখন ইতি। সবাইকে কষ্ট ছাড়া কিছুই দিতে পারি না আমি। আমি ইতিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। ভালো থাকতে চাই আমি।" রোদের এই লেখার তারিখটা দেখে অবাক হয় ইতি। ইতি যেদিন অসুস্থ হয়েছিল ঠান্ডায় টনসিল ফুলে জ্ঞান হারিয়েছিল সেই সময়ে লেখাটা এটা।
এর পরের পাতাগুলো সব সাদা। আর কিছু লেখা নেই।
শেষ পাতার লেখাগুলো ইতিকে খুব নাড়া দিয়েছে। ইতির এই মুহুর্তে খুব রোদ পাচ্ছে। গলা শুকিয়ে গেলে যেমন মানুষের পানির পিপাসা পায় তেমনি এই মুহুর্তে ইতির খুব রোদ পাচ্ছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরটা রোদ রোদ করছে। রোদকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিতে পারলে তার শান্তি হবে। ডাইরিটা বন্ধ করতে করতে ইতি অনুভব করে তার চোখ জোড়া ভিজে গেছে। অনেক বেশি ভিজে গেছে আজ চোখ জোড়া। পিছন ঘুরে বারান্দার দিকে তাকায় ইতি। তার রোদ সেখানেই অপেক্ষা করছে তার জন্য। বিড়াল হাঁটলে তার পাশের মাংস পেশির জন্য কোন শব্দ হয় না। ইতি এই মুহুর্তে ঠিক বিড়ালের মতোই হাঁটছে। রোদ যেন টের না পায় তাই এমন করে হাঁটছে সে।
বারান্দায় গিয়ে রোদের পিছনে দাঁড়ায় ইতি। রোদ হয়তো সত্যি টের পায়নি ইতির আগমণ। সে একটা চেয়ারে বসে আকাশ দেখছে। আচমকাই ইতি পিছন থেকে রোদের গলা জড়িয়ে ধরে। ইতির উপস্থিতি টের পেয়ে রোদ বলে,
-তোমার পড়া শেষ হলো?
-হুম।
-কি হলো এভাবে জড়িয়ে ধরলে যে? সামনে এসো।
-উহু।
-এসো বলছি।
রোদ ইতির হাত ধরে তাকে সামনে এনে নিজের কোলের উপর বসায়। আজ আর তাদের মাঝে কোন জড়তা নেই। রোদ বলে,
-একটা কথা আমি ডাইরিতে লিখিনি। লিখতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। যতবার চেষ্টা করেছি ততোবারই হেরে গেছি। হাতে জোর পাইনি।
ইতি তাকিয়ে দেখে রোদের দৃষ্টি আকাশের দিকে। ইতির দিকে না তাকিয়েই রোদ বলে,
-শুনবে সেই না লিখতে পারা গল্পটা?
ইতি কিছু বলার বা কোন জবাব দেওয়ার আগেই রোদ বলতে শুরু করে,
-দেশে ফিরে আসার পরেও এক বছর আমি নিজেকে দুনিয়া থেকে আলাদা করে রেখেছিলাম তাই লেখা আছে কিন্তু কেন করেছিলাম সেটা লেখা নেই। লন্ডন থেকে বাবা-মা যখন আমায় নিয়ে এলেন তার ১ মাস পরের কথা। আমার বন্ধু শাফায়াত একদিন ফোন করলো। ওর ঐ ফোনটা না এলেই হয়তো ভালো হতো জানো। সেদিন ও আমাকে ফোন করে বলল, "রোদ পারলে আমাকে মাফ করে দিস বন্ধু হয়ে তোর ভালো দেখতে গিয়ে আমি হয়তো তোরই অনেক বড় একটা ক্ষতি করে ফেলেছি।" শাফায়াত কি বলছিল বুঝতে পারছিলাম না আমি। ওর কথার মানে জানতে চাইলে ও বলেছিল,"ক্যাথরিন প্রেগন্যান্ট ছিল।" বিশ্বাস করো ইতি আমি যে কি খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই খেয়াল করলাম শাফায়াত বলেছে "ক্যাথরিন প্রেগন্যান্ট ছিল।" এর মানে কি? আরকে আমি কেন কিছু জানি না। শাফায়াতের কাছে জানতে চাইলে ও বলেছিল, "ক্যাথরিন তোর কাছ থেকে চলে যাওয়ার মাস দুইয়ের পরের কথা। ক্যাথরিন প্রেগন্যান্ট এটা জানতে পারে আর..আর এবোর্সন করে ফেলে।" মুহুর্তেই যেন আমার দুনিয়াটা উল্টে গেলো। মাত্র কয়টা সেকেন্ডে আমার সব আমার তছনছ হয়ে গেলো। আমি পাগল হয়ে শাফায়াতের কল কেটে দিয়ে ক্যাথকে কল দিতে লাগলাম কিন্তু কিছুতেই ওকে পাচ্ছিলাম না। বহুবার কল দেয়ার পর যখন ক্যাথ আমার কলটা পিক করলো। ক্যাথ ফোন রিসিভ করতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, "এমন কাজটা কিভাবে করলা তুমি? আমার বাচ্চাটাকে মেরে দিলা? কিভাবে পারলা ক্যাথ। ও আমার সন্তান ছিল। আমার অংশ। আমার রক্ত। কেন এমনটা করলা তুমি? একবার কেন আমাকে বললা না? কেন জিজ্ঞেস করলে না আমায়? ক্যাথ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলেছিল, "তোমার কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে রোদ? ঐ মুহুর্তে বাচ্চা নেয়া অসম্ভব ছিল। আর তোমাকে বললে তুমি আমাকে জোর করতে বাচ্চা নেয়ার জন্য তা আমি জানি। তাই কিছু জানাইনি তোমাকে। তোমার জন্য এই বাচ্চা জন্ম দিতে গেলে আমার ক্যারিয়ার, ভবিষ্যৎ সব শেষ হয়ে যেতো। তোমার চাইতে, তোমার ভালোবাসার চাইতে, তোমার বাচ্চার চাইতে ঐ মুহুর্তে আমার ক্যারিয়ার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার জন্য। রাখছি আমি ভালো থেকো।" সেদিন শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম আমি জানো। আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছে। একটাবার বলেও নি আমাকে। আমার বাচ্চা জানো ইতি আমার বাচ্চা।
রোদ খুব শান্ত ভাবে কথাগুলো বলল। যেন তার ভিতরে কোন অনুভূতিই ক্রিয়া করছে না। আসলেই করছে না। এতো বড় ধাক্কা খাওয়ার পর মানুষটা সত্যিই শোকে পাথর হয়ে গেছে।
প্রথমে বাচ্চার কথা শুনে ইতির বুকের ভিতর একটা তোলপাড় শুরু হয়েছিল তা যেন নিমিষেই শান্ত হয়ে গেলো।
ইতির চোখ বেয়ে পানি পরছে। মেয়েটা হাউমাউ করে কাঁদতে চাইছে খুব। নিজের প্রিয় মানুষের কষ্ট সে আর সহ্য করতে পারছে না। মানুষটার বুকের হাহাকার ইতি আর নিতে পারছে না। ইতির চোখের পানি দেখে ভেজা চোখ দুটো আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে রোদ বলে,
-প্লিজ যে গল্পটার জন্য আমাকে দিনরাত কাঁদতে হয়েছে আমি চাই না আমার বউ সেই গল্প পড়ে কাঁদুক। এখন তুমি বলো আমাকে কি শাস্তি দিবে? তুমি যা শাস্তি দিবে আমি তাই মেনে নিবো। শুধু বলো না আমাকে ছেড়ে চলে যাবে প্লিজ। আর হারানোর মতো ক্ষমতা, মনের জোর কোনটাই আমার নেই। আমি তোমাকে আঁকড়ে বাঁচতে চাই। প্লিজ আমাকে একটা সুযোগ দাও।
ইতি কিছুক্ষণ রোদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
-যা শাস্তি দিবো মেনে নিবেন তো?
-কথা দিচ্ছি সব মেনে নিবো বিনিময়ে শুধু তুমি পাশে থেকো।
ইতি রোদের মুখোমুখি এসে বলে,
-আমাকে আপন করে নিন। নিজের করে নিন আমায়। আজ রাত থেকে, এই মুহুর্ত থেকে আমাদের মাঝে আর কোন দূরত্ব থাকবে না। ঘুচে দিন সব দূরত্ব। রোদ ইতি আর দুই দেহ থাকবে না। এই রাতকে সাক্ষী রেখে তারা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। আমি আপনার হতে চাই। শুধু আপনার। আপনার আত্মার ভাগীদার, আপনার দেহের অংশীদার।
-এটাই কি আমার শাস্তি?
-হুম, এই শাস্তি আপনাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
রোদ আচমকাই ইতিকে কোলে নিয়েই চট করে উঠে দাঁড়ায়।
ইতিকে কোলে নিয়ে রুমে চলে আসে রোদ। কোল থেকে ইতিকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে, রোদ ইতির পাশের বসে বলে,
-আমি এই শাস্তি সারাজীবনের জন্য মাথা পেতে নিলাম।
রোদ ইতির আরেকটু কাছ ঘেষে বসে। ইতির বাম কাঁধের আঁচলে হাত দিয়ে ডান কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দেয় রোদ। পরম মুগ্ধতায় চোখ বুজে আসে ইতির। এক হাত মুঠ করে অন্য হাতে শাড়ির আঁচল খামচে ধরে ইতি আবেশে। রোদ ইতির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলে,
-শুধু আজকের রাতটাই একটু অপেক্ষা করো প্লিজ। কথা দিচ্ছি এটাই শেষ অপেক্ষা।
কথাটা বলেই সরে যায় রোদ। লজ্জায় ইতি লাল হয়ে গেছে।
.
.
পর্ব-২৭
Eti Chowdhury
.
.
রোদ ইতির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলে,
-শুধু আজকের রাতটাই একটু অপেক্ষা করো প্লিজ। কথা দিচ্ছি এটাই শেষ অপেক্ষা।
কথাটা বলেই সরে যায় রোদ। লজ্জায় ইতি লাল হয়ে গেছে।
সারারাত ক্যাথরিনের ঠিক মতো ঘুম হয়নি। রোদ আর তার নেই। নিজের বোকামির জন্য সে রোদকে হারিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ গেস্ট রুমের দরজায় কেউ টোকা দিতেই হয়তো রোদ এসেছে ভেবে খুশি হয়ে দরজা খুলেই কিছুটা চমকে উঠে ক্যাথরিন। রোদ নয় তার মা এসেছে।
-আসতে পারি কি?
মিসেস চৌধুরী ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি চাওয়ায় ক্যাথরিন দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়। রুমের ভিতরে প্রবেশ করে একটা চেয়ারে বসতে বসতে মিসেস চৌধুরী বলেন,
-আমি রোদের মা।
-চিনি আমি আপনাকে।
-হুম, এসো বসো। তোমার সাথে দুটো কথা বলি।
মিসেস চৌধুরীর মুখো-মুখি একটা চেয়ার টেনে ক্যাথরিন বসতেই তিনি বলে,
-আমি একটু বাইরে যাচ্ছি এসে হয়তো আমাদের আর দেখা হবে না তাই ভাবলাম তোমার সাথে দুটো কথা বলে যাই। আসলে কথা নয় আমার তোমাকে ধন্যবাদ বাদ দেয়ার ছিল।
অবাক হয়ে ক্যাথরিন মিসেস চৌধুরীর দিকে তাকাতেই তিনি আরও বলেন,
-আসলে তখন তুমি আমার ছেলেকে কষ্ট না দিলে আমার ছেলেটার জীবন আজ এতো সুন্দর হতো না। ইতির মতো এতো লক্ষি একটা মেয়ে আমার ঘরের বউ হয়ে আসতো না। বুঝতেই পারছো কি বলতে চাইছি।
মিসেস চৌধুরী বসা থেকে উঠতে উঠতে বলেন,
-আশা করি দুদিন পর ফিরে তোমাকে আর দেখবো না। এতদিন যেমন দূরে ছিলে আগেও তাই থেকো। আসি, ভালো থেকো।
নিজের কথা বলে আর অপেক্ষা করলেন না মিসেস চৌধুরী।। ক্যাথরিনকে চমকিত অবস্থায় রেখে তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে এসেই মিসেস চৌধুরী অতুলকে ডাকলে তার কন্ঠ পেয়ে ইতি কিচেন থেকে বেরিয়ে আসে।
-মা কিছু লাগবে আপনার?
-তোমাকেই ডাকার জন্য।
ইতি লক্ষ করে মিসেস চৌধুরী বেস পরিপাটি হয়ে আছেন। সকাল সকাল মিসেস চৌধুরীকে তৈরি দেখে ইতি জানতে চায়,
-মা আপনি কোথাও যাচ্ছেন?
-হ্যাঁ। আমি তোমার বাবার কাছে যাচ্ছি দুদিনের জন্য।
-হঠাৎ?
-এমনি তার কথা খুব মনে পরছে তাই।
-অতো দূর আপনি একা যাবেন? আজ না হয় থাক। আপনার ছেলে আজ বাড়ি ফিরুক তাকে সাথে নিয়ে না হয় যাবেন।
তার প্রতি বউয়ের চিন্তা দেখে হেসে দিয়ে ইতির হাত ধরে মিসেস চৌধুরী বলেন,
-চিন্তা করো না রোদ জানে। অতুল যাচ্ছে আমার সাথে।
-ওহ তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু...
-আবার কিন্তু কি?
-এতো বড় বাড়িতে আমি একা থাকবো?
-একা কেন থাকবে আমার ছেলেটাকে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি তো। তাকে দিয়ে একটু নিজের যত্ন আত্তি করাও। তুমি তার বউ এটা তাকে ও বাকি সবাইকে বুঝিয়ে দাও।
শাশুড়ির কথা শুনে লজ্জা পেয়ে যায় ইতি। ইতির শাশুড়িও পেয়েছে একজন ঠিক বান্ধবীর মতো।
অতুল এসে বলে,
-মা চলো ভাইয়া এসে গেছে।
মিসেস চৌধুরী ইতির মাথায় হাত রেখে বলেন,
-একদম চিন্তা করো না রোদ আমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। তুমি নিজের আর আমার ছেলের যত্ন নিও। দুদিন পরেই চলে আসবো। আর একটা কথা আপদটাকে বিদায় করার ব্যবস্থা করো। কোন দূর্ঘটনা আমি চাই না। হাত ফসকে গেলে হারাবে কিন্তু তুমি।
ইতি মিসেস চৌধুরীর আরেকটা হাত শক্ত করে ধরে চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করে।
দুপুরের খাওয়ার সময় অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। রোদ এখনো আসেনি। বাড়িতে কুকুড় বিড়াল থাকলেও মানুষ তাদের খেতে দেয় সেখানে ক্যাথরিন তো মানুষ। জলজ্যান্ত একজন মানুষকে ইতি উপেক্ষা করে কিভাবে। একটু আগেই ইতি ক্যাথরিনকে খাওয়ার জন্য ডেকে এসেছে। ক্যাথরিনের কোন শব্দ সে পায়নি। আসবে কিনা তা ইতির জানা নেই। তার উচিত মনে হয়েছে সে ডেকে এসেছে।
টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছে ইতি ক্যাথরিনের অপেক্ষায়। বেশ কিছুক্ষণ পর ক্যাথরিন বেরিয়ে আসে। খাবার টেবিলের কাছাকাছি আসতেই ইতি স্মিত হেসে একটা চেয়ার দেখিয়ে দেয়। ক্যাথরিন বসতেই ইতি তার জন্য খাবার বাড়তে নিলে সে বাঁধা দিয়ে বলে,
-আমি খাবো না কিছু। আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।
ভাত বাড়ার চামচটা নিচে নামিয়ে রাখতে রাখতে ইতি বলে,
-কিন্তু আমার আপনার কাছে কিছু জানার নেই আর না আমি জানতে চাই। তবে আপনাকে কিছু বলার আছে আমার।
ক্যাথরিন মাথা তুলে ইতির দিকে তাকাতেই ইতি বলতে লাগে,
-মা আপনাকে কিছু না কিছু বলেছে এটা আমি সিওর। আর সে কি বলেছে বা বলতে পারে তা আমার জানা আছে। এই বাড়িতে বিয়ে করে তাকে শুধু শাশুড়ি নয় একজন বন্ধবীর মতো পেয়েছি আমি। তাই সে কাকে কি বলতে পারে সেটা আমি জানি। তার মতো কঠিন করে হয়তো আমি কিছু বলতে পারবো না। আপনি যেতে না চাইলে বেরও করে দিতে পারবো না তার কারণ কোথাও না কোথাও আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ কারণ আপনি সরে না গেলে মানুষটা কখনো আমার হতো না। এতোদিন পর কেন আপনি ফিরে এসেছেন জানি না কিন্তু আপনি কি হারিয়েছেন তা আপনি না জানলেও আমি জানি। কারণ আমি তাকে পেয়েছি।
-সত্যি পেয়েছো?
ক্যাথরিনের প্রশ্নে স্মিত হেসে ইতি বলে,
-পেয়েছি বইকি। যে মানুষটার দিন গুলো আর আমাকে ছাড়া দিন হয় না। যে মানুষটার আমার গাঁয়ের গন্ধ ছাড়া ঘুম হয় না। যে মানুষটার আমার দেহের উষ্ণতা ছাড়া রাত গভীর হয় না সে তো আমারই তাই নয় কি?
বছর দেড়েক আগে একদিন এমন কিছু কথাই বানিয়ে বলেছিল রোদ রাফসানকে যেন সে ইতির থেকে দূরে থাকে আজ একই রকম কিছু কথা ইতি ক্যাথরিনকে বলছে যেন সে রোদের থেকে দূরে থাকে। ইতির কথাগুলো যেন খুব আঘাত দিচ্ছিলো ক্যাথরিনকে। তবু ইতি বলতে থাকে,
-খুব রাগ হয়েছিল আমার খুব। ইচ্ছে করছিল তাকে খুন করে ফেলি। তার সন্তান অন্য কারে গর্ভে এসেছিল ব্যাপারটা একদম মানতে পারিনি আমি। সে আমার, তার সন্তানও আমারই গর্ভে আসবে অন্য কোন বেগানা মহিলার গর্ভে নয়। খুব রাগ হয়েছিল। আমার আত্মসম্মানে লেগেছিল খুব তাও তাকে মাফ করে দিলাম কেন জানেন? তার ভাগের শাস্তি সে পেয়ে গেছে। মরাকে নতুন করে মারার কোন মানে হয় না। আমার সাথে করা তার সেই বেঈমানির শাস্তি তার ঐ অনাগত সন্তান পেয়েছে। তাই তাকে দেয়ার মতো আর কোন শাস্তি আমার কাছে অবশিষ্ট ছিল না। আর এখন চাইলেও কেউ তাকে আমার কাছে থেকে কেরে নিতে পারবে না।
-রোদ আমায় ভালোবাসতো।
-বাসতো বাসে না। এখন তার সবটা কেবল আমি। আপনি আমার জীবনের সবচাইতে প্রিয় মানুষটাকে তার জীবনের সব চাইতে বড় কষ্ট দিয়েছেন। তাও কিছুই বলবো না আপনাকে আমি তার কারণ একটাই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। আপনার জন্যই আমি তাকে পেয়েছি।
-তুমি....
-বলেছি আপনার কোন কথা শুনতে চাই না। বেড়াতে চাইলে বেড়ান কেউ না করবে না তবে আমাদের জীবনে প্রবেশ করার চেষ্টা করবেন না। তাহলে আপনাকে উপড়ে ফেলে দিতে আমার দুই মিনিটও লাগবে না। এখানে রোদ আহমেদ চৌধুরী কি সে সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই। আর তার বউ হিসেবে আমি কত দূর যেতে পারি সে সম্পর্কে আপনি ভাবতেও পারবেন না। তাই আমার হাজবেন্ডের দিকে ভুলেও নজর দেয়ার চেষ্টা করবেন না, চোখ উপড়ে ফেলবো আমি আপনার।
শেষ কথাটা বলার সময় একটা পৈশাচিক হাসি ছিল ইতির ঠোঁটে। ইতির মতো মেয়ের মাঝেও এমন রূপ বিদ্যমান ভাবাই যায় না। স্বামী জিনিসটাই এমন। কোন তৃতীয় ব্যাক্তি তার দিকে নজর দিলে কোন স্ত্রীই সহ্য করবে না।
কারো পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকাতেই ইতি দেখে রোদ আসছে। রোদকে আসতে দেখে ইতি উঠে এসে রোদের কাছে আসে। রোদ বলে,
-অনেক অপেক্ষা করেছো বুঝি?
-না তেমন নয়। খাবার দেই?
-এক মিনিট।
এক মিনিট বলে রোদ ক্যাথরিনের সামনে গিয়ে বলে,
-যা বলেছিলাম করেছো?
-হুম।
-ওকে বাইরে ড্রাইভার অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। তোমার থাকার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি আমি। যতদিন ইচ্ছা থাকো সব খরচ আমার কিন্তু ভুলেও আমি কিংবা আমার বউয়ের আশেপাশেও আসবে না। তোমার জন্য আমাদের জীবনে কোন অশান্তি চাই না আমি। একদিন আমার থেকে আমার সব কেড়ে নিয়েছিলে তুমি। আবার নতুন করে তোমাকে আমি আমার কোন ক্ষতি করতে দিবো না। আর কখনো আমার চোখের সামনে আসবে না। এখন আসতে পারো তুমি।
ক্যাথরিনকে আর কিছুই বলার সুযোগ দেয় না রোদ। ক্যাথরিন বেরিয়ে যেতেই রোদ ইতির কাছে গিয়ে আলতো করে ইতির কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে,
-আমি ফ্রেস হয়ে আসছি তুমি খাবার দাও প্লিজ। প্রচুর ক্ষুদা পেয়েছে।
-এখনই দিচ্ছি।
-আর শুনো সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থেকে একটু বাইরে যাবো।
-কোথায়??
-গেলেই দেখে নিও।
খাওয়া দাওয়ার পরে বিকেলে বিশ্রাম করছিল ইতি। রোদ অফিসে যাওয়ার আগে জানিয়ে যায় তাকে সন্ধ্যার পর এসে পিক করবে সে। তবে কোথায় যাবে কিছুই জানায় না। ইতি জানতে চাইলে শুধু বলে আজ খুব বিশেষ কিছু৷ ইতি আর কথা বাড়ায় না।
ঠিক সন্ধ্যা বেলাই রোদ এসে ইতিকে পিক করে নিয়ে যায়। ইতি বেশ অবাক হয় যখন তাকে নিয়ে রোদ নাম করা একজন মেকওভার আর্টিস্টের কাছে আসে। কি হচ্ছে ইতি কিছু বুঝতে পারছে না। ইতিকে ও তার জন্য আনা ব্যাগগুলো হ্যান্ড ওভার করে দিয়ে ইতিকে রোদ বলে,
-গাড়ি আর ড্রাইভারকে রেখে যাচ্ছি। তুমি রেডি হয়ে বাসায় চলে এসো আমার একটু কাজ আছে রাগ করো না প্লিজ।
ইতি মুখে কিছু বলে না শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয়। রোদ ইতিকে রেখে বেরিয়ে যায়।
ইতি তৈরি হয়ে বাসায় আসতে আসতে বেজে যায় রাত সাড়ে ১০ টা। বাসায় এসে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই ইতি থ হয়ে যায়। সব লাইট অফ করা কেবল ছোট ছোট কিছু স্পট লাইট অন করা। ইতি চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে মস্ত বড় ড্রইং রুমটা সাদা গোলাপে মো মো করছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে গিয়ে ইতি নিজের দিকেও একবার চোখ বুলায় তার পরনে একটা সাদা ভারী জামদানী। আপাদম্তক সাদায় মোড়ানো সে। মুহুর্তেই যেন একটা শীতল হাওয়া ইতির বুকের ভেতর খেলে গেলো। স্পট লাইটের অল্প আলোয় উপরে উঠতে লাগে ইতি। রোদকে কোথাও দেখছে না সে। গলা দিয়ে শব্দও আসছে না ইতির আপাতত। তাই চুপচাপ সে উপরে উঠতে থাকে। আজ যেন আবার নতুন করে বউ সেজে ইতি। নিজের রুমের সামনে গিয়ে থেমে যায় ইতি। দরজাটা দেয়া সে কি করবে বুঝতে পারছে না। অপেক্ষা করবে নাকি রোদকে ডাকবে। কিছুই মাথায় আসছে না দেখে ইতি দরজায় আলতো করে ধাক্কা দিতেই তা খুলে যায়। সম্পূর্ণ দরজা ঠেলে ইতি ভেতরে প্রবেশ করে যেন তব্দা মেরে যায়। সে যেন কোন সাদার দুনিয়াতে আছে। সমস্ত রুম জুড়ে যেন সাদার ছড়াছড়ি। বিছানাটা শতশত সাদা গোলাপ দিয়ে সাজানো। সম্পূর্ণ রুম সাদা দিয়ে ডেকোরেট করা। জানালা পর্দা ডুব সাদা পর্দা দিয়ে মোড়ানো। চারিদিকে এতো সাদা দেখে ইতির যেন নেশা ধরে যাচ্ছে। আচমকাই পিছন থেকে রোদ ইতিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-বলেছিলাম না সুযোগ পেলে বুঝিয়ে দিবো সাদা কত রোমাঞ্চকর একটা রঙ। আজ তোমার আমার মিলনের একমাত্র সাক্ষী হবে এই সাদা রঙটাই। সাদা পবিত্রতার চিহ্নকে সাথে নিয়ে তুমি আমি আমাদের পবিত্র সম্পর্কের শুরু করবো।
ইতি লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। রোদ ইতিকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দেয়। ইতি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভিষন লজ্জা করছে, ভিষণ। লজ্জায় সে রোদের দিকে তাকাতেই পারছে না। রোদ ইতির চিবুকে আঙ্গুল দিয়ে মুখটা উপরে তুলে ধরে ইতির গালে একটা চুমু খায়। আলতো করে ইতির কানের কাছে মুখ নিয়ে রোদ বলে,
-মে আই?
ইতি মুখে কিছু বলতে পারে না। লজ্জায় রোদের বুকে মুখ লুকায় সে।
কিছু সময় পর ইতি রোদকে ছেড়ে বসতেই রোদ তার একটা হাত ইতির পায়ের পাতার উপরে রাখে। ইতি পা সরিয়ে নিতে চাইলে রোদ শক্ত করে ধরে ফেলে। চাইলেও আর ইতি সরতে পারবে না। একটু একটু করে রোদ ইতির দিকে অগ্রসর হতে থাকলে ইতির নিঃশ্বাস ঘন থেকে ঘন হতে থাকে।
আজ আকাশে কোন মেঘ নেই তবু তুফান হচ্ছে ইতির বুকে। এই তুফানে তারা দুজন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ইতির প্রতিটা ঘন নিঃশ্বাস গিয়ে রোদের বুকে আছড়ে পড়ছে। সে নিঃশ্বাসের তরে মাতাল হয়ে রোদ আরও বেশি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। ছুঁয়ে দিচ্ছে তার বউকে খুব গভীর থেকে গভীর ভালোবাসায়।
.
.
পর্ব-২৮
Eti Chowdhury
.
.
আজ আকাশে কোন মেঘ নেই তবু তুফান হচ্ছে ইতির বুকে। এই তুফানে তারা দুজন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ইতির প্রতিটা ঘন নিঃশ্বাস গিয়ে রোদের বুকে আছড়ে পড়ছে। সে নিঃশ্বাসের তরে মাতাল হয়ে রোদ আরও বেশি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। ছুঁয়ে দিচ্ছে তার বউকে খুব গভীর থেকে গভীর ভালোবাসায়।
আজ ইতির সকাল হয় রোদের বুকে। ভয়, লজ্জা, সংশয় সব কিছুকে যেন সে একরাতেই জয় করে ফেলেছে।
ঘুম ভাঙ্গতেই ইতি রোদকে ছেড়ে উঠতে চাইলে রোদ ইতিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে৷ ইতি হুড়মুড়িয়ে রোদের বুকের উপর আছড়ে পরে৷
-কি হচ্ছে টা কি?
-কোথায় যাওয়া হচ্ছে আমাকে ফেলে?
-সেকি সকাল হয়েছে ফ্রেস হবো না? তোমার নাস্তা বানাবো না?
-এভাবে উঠে যাবে?
-এভাবে মানে?
রোদ ইতির উন্মক্ত পিঠটাকে আলতো পরশে ছুঁয়ে দিতেই কেঁপে উঠে মেয়েটা। ভাগ্যিস রোদটা আটকে ধরেছে এতে ইতি নিজেই লজ্জার হাত থেকে বেঁচে গেছে। সে খেয়ালই করেনি চাদরটা ছাড়া কাপড়ের ছিটে ফোঁটাও তার গায়ে নেই। এভাবে উঠে গেলে ইতি নিজেই লজ্জা পেতো। রোদ আবার দুষ্টুমিতে মেতে উঠতে চাইলে ইতি বাঁধা দিয়ে বলে,
-একদম নয়।
-একটু প্লিজ।
-একটুও না।
পাশে রাখা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ইতি উঠে যেতে নিলে রোদ পিছন থেকে ডাকে তাকে,
-ইতি!
ইতি থেমে গিয়ে বলে,
-কিহ?
-একটা জিনিস চাই আমার।
-কি চাই?
-কথা দাও আমাকে ফিরিয়ে দিবে না?
ইতি রোদের কাছে গিয়ে বলে,
-বলো না কি চাই?
-আমার একটা ছোট্ট ইতি চাই প্লিজ। খুব জলদি চাই৷
হুট করে বাচ্চার কথা শুনায় লজ্জা পেয়ে যায় ইতি। রোদ বলে,
-প্লিজ না করো না।
ইতি রোদের কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে বলে,
-একটা নয় ইনশাআল্লাহ পুরো ফুটবল টিম বানাবো আমরা।
-সত্যি?
-সত্যি সত্যি সত্যি।
-তাহলে চলো এখনই প্রসেসিং শুরু করে দেই।
-একদম নয়।
ইতি রোদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পালিয়ে যায়।
রোদ নাস্তা করে অফিসে চলে যায়। ইতি বাসায় একা তার ভালোই লাগছে না। একা একা বোর হয়ে কিছু শপিংয়ের জন্য বেরিয়ে যায় সে। অবশ্য যাওয়ার আগে সে রোদ জানিয়ে যায়। রোদ বলেওছে সে নিজেই ইতিকে বিকেলে শপিং মল থেকে পিক করে নিবে৷ তাই ইতি শপিং শেষ করে শপিং মলের বাইরেই রোদের জন্য অপেক্ষা করছে। রোদ আসবে তাকে নিতে।
রোদের আসতে ১ ঘন্টার মতো দেরি হয়ে গেলো। আর তার খবরই আছে কিন্তু শপিং মলের সামনে রোদ ইতিকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। আশেপাশেও দেখে রোদ কিন্তু ইতি নেই কোথাও৷ ফোন দিচ্ছে ফোটাও বন্ধ। হঠাৎ মেয়েটা গেলো কোথায়। সে তো বাচ্চা না যে হারিয়ে যাবে। ঘন্টাখানি আগেও কথা হয়েছে রোদের সাথে ইতির। ইতি বলেছে সে অপেক্ষা করছে। এখন রোদের ভয় লাগতে শুরু করেছে৷ প্রায় ১ ঘন্টা হয়ে এলো রোদ ইতিকে খুঁজেছে কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না।
১ ঘন্টা পর রোদের ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজে লেখা, "ইতিকে চাইলে দেওয়া ঠিকানায় চলে আয়। কিন্তু একা।" রোদ এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে ম্যাসেজে উল্লেখ করা ঠিকানায় চলে যায়। একটা কনস্ট্রাকশন সাইড রোদ অর্ধনির্মিত বিল্ডিং-এর ৫ তলায় চলে যায়৷ উপরে উঠেই রোদ ইতি ইতি করে ডাকতে থাকে কিন্তু কোন সাড়া পায় না সে৷ কিছুটা ভিতরে আসতেই রোদ দেখে একটা চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে ইতিকে। জ্ঞান নেই মেয়েটার। রোদ দৌড়ে ইতির কাছে যায়৷ রোদ ইতিকে ডাকতে লাগে। কিন্তু ইতির জ্ঞান ফিরছে না।
-ওয়েলকাম স্যার।
কারো শব্দ পেয়ে পিছন ঘুরে দাঁড়াতেই রোদ দেখে রাফসান।
-রাফসান তুমি?
-জ্বি স্যার আমি।
-আমার ইতির যদি কিছু হয় আমি তোমাকে মেরে ফেলবো রাফসান।
-আপনার নয় ও আমার ইতি আমার। আপনি ওকে কেড়ে নিয়েছেন আমার থেকে।
-ও তোমার হলে আমি কখনোই ওকে কেড়ে নিতে পারতাম না।
রোদ ইতির হাতের বাঁধন খুলে দেয়। ইতিকে আবার ডাকতে লাগে।
-আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে স্যার।
রোদ আবার পিছন ঘুরে দাড়াতেই রাফসান ডাকে,
-ক্যাথরিন।
ক্যাথরিনকে বেরিয়ে আসতে দেখে রোদ আরও অবাক হয়। পিছনে ইতির জ্ঞান ফিরে আসে।
-ক্যাথ তুমি এখানে?
-হ্যাঁ, আমি। এই মেয়ের জন্য তুমি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছো আজ এই মেয়েকেই আমি শেষ করে দিবো।
-উপস,,, ভুল বললেন মিস ক্যাথরিন। আমার ইতির কিছু হলে আপনার রোদকেও আমি ছাড়বো না। আপনার রোদ ততক্ষণই অক্ষত থাকবে যতক্ষণ আমার ইতি ভালো থাকবে। আশা করি ডিলের কথা ভুলে যান নি।
রাফসানের কথা শুনে অবাক হয়ে রোদ জানতে চায়,
-কিসের ডিল?
-ওয়েল স্যার মিস ক্যাথরিনের সাথে আমার ডিল হয়েছে সে আমার ইতির কোন ক্ষতি করবে না আর আমিও আপনার কোন ক্ষতি করবো না। আমি ইতিকে নিয়ে চলে যাবো আপনি ক্যাথরিনকে নিয়ে ভালো থাকবেন যেমনটা আগে ছিলেন।
-এটা তোমার স্বপ্নই থেকে যাবে রাফসান। ইহকাল আর পরকালের জন্য ইতি শুধু রোদের।
ইতির কন্ঠ শুনে রোদ পিছনে তাকতেই দেখে তার জ্ঞান ফিরে এসেছে। ইতি চেয়ার ছেড়ে উঠার চেষ্টা করতেই রোদ গিয়ে ইতিকে ধরে।
ক্যাথরিন একটা বন্দুক ইতির দিকে তাক করে বলে,
-রোদ আমার না হলে কারো হবে না।
এতে রাফসান বাঁধ সাধে। রাফসান ক্যাথরিনকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে একটা ফায়ারিং হয়। গুলি কারো গায়ে লেগেছে কিনা দেখার জন্য সামনে তাকালেই দেখে গুলিটা গিয়ে রোদের গায়ে লেগেছে। ইতি রোদের পিছনে থাকায় প্রথমে বুঝতে পারেনি। যেই রোদ পিছন দিকে ইতির উপর ঢলে পরে তখন ইতি দেখে রোদের গায়ে গুলি লেগে রক্ত ঝড়ছে। ইতি চিৎকার করে উঠে।
-রোদদদ....
ইতির কোলের উপর পরে যায় রোদ। তখনই আদি সেখানে চলে আসে পুলিশ নিয়ে। রোদকে কেউ ফোন বা ম্যাসেজ দিয়ে একা আসতে বলবে বলেই সে চলে আসবে এতোটা বোকা সে নয়। সব ব্যবস্থা করেই সে এসেছে। ইমার্জেন্সি হতে পারে ভেবে এম্বুলেন্সও আনা হয়েছে। রাফসান আর ক্যাথরিনের পালানোর কোন রাস্তাছিল না তারা চেষ্টাও করেনি পালানোর। ইতি রোদকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করেই যাচ্ছে।
রোদকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে। গুলি লেগেছে সাথে অনেক রক্তও ঝড়েছে তার। ইতির ভিষণ ভয় করছে, না জানি কি হয়। একাধারে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে সে।
-ম্যাম প্লিজ আপনি নিজেকে সামলান।
-ওর কিছু হয়ে গেলে আমি কি করবো রিমি বলো?
-স্যারের কিছুই হবে না ম্যাম আপনি দেখে নিয়েন।
অপারেশন শেষ হলে ডাক্তাররা জানায় গুলি তারা বের করে ফেলেছে কিন্তু রোদের অনেক রক্ত ঝড়েছে তাই আপাতত তার জ্ঞান না ফিরা অব্দি কেউ কিছু বলতে পারছে না। রোদকে কেবিনে দেয়া হয়েছে। রোদের অবস্থার কথা শুনে মিস্টার ও মিসেস চৌধুরীও চলে এসেছেন সেদিন রাতেই। ইতি শাশুড়িকে পেয়ে সে কি চিৎকার। হাউমাউ করে কান্না করেছে মেয়েটা। শুধু একটা কথাই বার বার বলেছে রোদের কিছু হলে সে বাঁচবে না। দু দুবার জ্ঞান হারিয়েছে ইতি। মেয়েটা অনেক বেশি দূর্বল হয়ে গেছে। তাও কেউ তাকে কিছু খাওয়াতে পারছে না। রোদের জ্ঞান না ফেরা অব্দি সে কিছুই খাবে না।
অপারেশন ঠিকঠাক হয়ে গেলেও রোদের জ্ঞান ফিরছে না। ডাক্তাররা আশংকা করছে ৭২ ঘন্টায় জ্ঞান না ফিরলে হয়তো রোদ কোমায় চলে যাবে। এই কথা শুনার পর থেকে ইতি রোদের পাশেই বসে আছে তার একটা হাত ধরে। কেউ উঠাতে পারছে না ইতিকে। কিছুতেই সে রোদকে রেখে কোথাও যাবে না।
দুদিন হয়ে গেছে রোদের জ্ঞান ফিরেনি। ইতি পাগল প্রায় হয়ে গেছে। রোদের পাশে থেকে নড়ছে না সে। কেউ জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারছে না। পাগলের মতো প্রলাপ বকছে মেয়েটা। রোদের বুকে মাথা রেখে বসে আছে ইতি। আর বিড়বিড় করে বলছে,
-এই রোদ উঠো না প্লিজ। বাসায় যাবো আমি তোমাকে নিয়ে। এখানে আর ভালো লাগছে না আমার। তোমার না ছোট্ট ইতি চাই। এভাবে হাসপাতালে শুয়ে থাকলে ছোট্ট ইতি কিভাবে আসবে? উঠো না, চলো না তোমার জন্য ছোট্ট ইতি আনবো।
বলতে বলতেই ইতির চোখের পানি পরে রোদের বুক ভিজে যায়। রোদকে ছাড়া ইতির পক্ষে আর থাকা সম্ভব নয়।
-তোমার ইতি তোমাকে ছাড়া বাঁচবে না রোদ। উঠো না প্লিজ.....
-এই ইতি আর কত ঘুমাবি? এখন তো উঠে যায়।
এক গ্লাস পানি মুখের উপর ঢেলে দিতেই তড়িগড়ি করে উঠে বসে ইতি। শোয়া থেকে উঠে বসেই নিজের চারিদিক দেখতে লাগে সে। এই মুহুর্তে কোথায় আছে সে বুঝতে পারছে না।
-কিরে এতো ঘুমায় কেউ? বন্ধের দিন বলে কি সারাটা দিন ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিবি। তোর না আজ অফিসে কিসের পার্টি আছে যাবি কখন তুই?
ইতির মায়ের কথা তার কিছুই পাল্লায় পরছে না। সে তো হাসপাতালে ছিল রোদের কাছে এখানে এলো কিভাবে? কিছুই মাথায় ধরছে না ইতির। ইতিকে এভাবে বসে থাকে দেখে ইতির মা বলেন,
-উঠে পর মা। তোর বাবার জন্য এই এক জ্বালা যেকোন বন্ধের দিনে সে ছেলে মেয়েদের সকালে ডাকতে দিবে না। সারা সপ্তাহ তার ছেলেমেয়েরা অফিস করে, কলেজ করে ক্লান্ত থাকে তাই বন্ধের দিন তারা লাট সাহেবের মতো ঘুমাবে। নে এখন জলদি উঠে পর।
বকবক করতে করতে ইতির মা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ইতি এখনো কিছুই বুঝতে পারছে না তার সাথে কি হচ্ছে? ইতির ফোনটা বেজে উঠতেই ফোন হাতে নিয়ে দেখে অফিস থেকে কল। রিসিভ করতে অন্যপাশ থেকে বলে,
-ম্যাম আপনি কোথায়? সেই কখন থেকে কল করছি আপনাকে।
-আপনি কে?
-ম্যাম আমি তওহিদ।
-কোন তওহিদ?
-কি হলো ম্যাম আপনার আমি আপনার অফিসের তওহিদ বলছি। আপনি কখন আসবেন সেন্টারে?
-কিসের সেন্টার?
-ম্যাম আজ হলো কি আপনার? আজ আমাদের অফিসের পার্টি আছে চেয়ারম্যান স্যার আর ম্যাম ওরগানাইজ করতে বলেছেন।
-কিসের চেয়ারম্যান?
-ওহ ম্যাম হলো কি আজ আপনার?
ইতি ফোনটা কান থেকে নামিয়ে দেখে নম্বরটা তওহিদ অফিস দিয়ে সেইভ করা। ইতি চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে সে নিজের রুমেই আছে। এটা তার বাসা। আর যে ফোন করেছে সে ইতির অফিসে কাজ করে আর আজ সত্যি তাদের একটা পার্টি আছে। সব মনে পরছে ইতির। ফোনটা কানে নিয়ে ইতি বলে,
-হ্যালো তওহিদ?
-জ্বি ম্যাম আমি তওহিদ।
-কোথায় তুমি?
-আমি তো সেন্টারে চলে এসেছি ম্যাম। আপনি কোথায়? চেয়ারম্যান স্যার আর ম্যাম বিশেষভাবে আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছেন আজকের জন্য।
-ওহ সরি আমি.... আমি এখনই আসছি।
ইতি ফোনটা রেখে দৌড়ে মায়ের কাছে যায়। গিয়ে দেখে তার মা রান্না ঘরে।
-আম্মু আমাকে ডাকোনি কেন?
-কিভাবে ডাকবো? তোর বাবাই তো ডাকতে দেননি।
-ইসস... কত দেরি হয়ে গেলো আমার।
ইতি বেরিয়ে আসতে নিলে তার মা ডেকে বলে,
-ইতি শুন।
-হ্যাঁ মা?
-তোর কি শরীর খারাপ করেছে রে মা??
-না তো মা।
-মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে। তুই তো এতো ঘুমাস না।
-কতক্ষণ ঘুমিয়েছি মা??
-সেই কাল সন্ধ্যায় ঘুমালি বললি রাতে উঠে খেয়ে নিবি। তোর বাবা, আমি বউ মা কত ডাকলাম তুই উঠলিই না। সেই সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে এখন উঠলি দুপুর ২ টা বাজে।
-এতো লম্বা ঘুমিয়েছি আমি?
-তাই তো অবাক লাগছে আমার।
ইতি আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে যায়। বের হতে হবে তাকে।
নিজের রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে ইতি। সব কিছু কেমন ঘোলাটে লাগছে তার কাছে। সে ঘুমিয়ে ছিল। তার মানে এতোক্ষণ সে যা দেখেছে সব ইতির স্বপ্ন ছিল। সবটাই কল্পনা। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখেছে ইতি। তার তো বিয়ে হয়নি। রোদ! তার মানে রোদ নামে কেউ নেই??
.
.
.
চলবে………



পর্ব-২৯
Eti Chowdhury
.
.
নিজের রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে ইতি। সব কিছু কেমন ঘোলাটে লাগছে তার কাছে। সে ঘুমিয়ে ছিল। তার মানে এতোক্ষণ সে যা দেখেছে সব ইতির স্বপ্ন ছিল। সবটাই কল্পনা। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখেছে ইতি। তার তো বিয়ে হয়নি। রোদ! তার মানে রোদ নামে কেউ নেই??
ইতিকে জলদি বের হতে হবে তাই সে দ্রুত তৈরি হয়ে নেয়। বন্ধের দিন ইতিদের বাসায় সবাই একটু দেরি করে দুপুরের খাবার খায়। ডাইনিং রুমের সামনে থেকেই ইতি তার মাকে বলে বেরিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু এতে বাঁধ সাধে তার বাবা। বাঁধা দিয়ে তিনি বলেন,
-আগে খাবে তারপর যাবে।
-খেতে বসলে সত্যি আমার দেরি হয়ে যাবে বাবা।
-হোক।
-কিন্তু...
-কিন্তু কিন্তু না করে খেতে বসো।
ইতির বাবাকে সমর্থন করে তার ভাবী ইস্পৃহা বলে,
-বাবা ঠিকি বলেছে ইতি। যতোক্ষণে দেরি হবে বলছিস ততোক্ষণে তোর খাওয়াও হয়ে যাবে। বসে যা আমি ভাত বেড়ে দিচ্ছি।
-আচ্ছা ভাত বাড়তে হবে না ভাবী তুমি একটু ড্রাইভারকে বলো গাড়ি বের করতে তা নাহলে সত্যি দেরি হয়ে যাবে।
-ঠিক আছে তুই খা আমি বলে দিচ্ছি।
ইতির গন্তব্য বাড়িধারা কনভেনশন হল। গাড়িতে বসে ভাবনার অতলে ডুবে আছে সে। একদম ভালো লাগছে না তার কিছু। একরাতের ঘুমে সে এতো কিছু কিভাবে স্বপ্নে দেখলো। একজন মানুষকে ঘিরে এতো কিছু দেখা কিভাবে সম্ভব ইতির মাথায় আসছে না। স্বপ্নে দেখা রোদ নামক মানুষটার কথা মনে পরতেই ইতির কেমন যেন নিজেকে নিঃস্ব লাগতে লাগে। সে তো কখনো এই নামটা শুনা তো দূরের কথা এমন কোন মানুষকে চিনেও না। তাহলে কেন সে এমন একটা স্বপ্ন দেখলো। রোদ নামে কেউ নেই। কোন মানুষ নেই। এমন কাউকে কেন্দ্র করে ইতি নিজের জীবনের এতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে এমন স্বপ্ন কিভাবেই বা দেখলো। বিষয়টা ইতির নিজের কাছেই অস্বাভাবিক লাগছে। আরেকবার ক্লিয়ার হওয়া দরকার তার। তাই ইতি তার মাকে ফোন দেয়। মা ফোন ধরতেই ইতি বলে,
-মা আমি কি সত্যি একরাত ঘুমিয়েছি??
-মানে? কি বলছিস এসব?
-না মানে এমন তো নয় যে আমি একরাত নয় অনেক দিন ঘুমিয়ে ছিলাম।
-কি সব আবোল তাবোল বকিস বলতো ইতি? তোর হলোটা কি? একটু আগেই তো দিব্বি ভালো বেরিয়ে গেলি এর মাঝে কি হলো তোর?
-না কিছু না মা।
-তুই বাসায় চলে আয়।
-আসবো পার্টিটা শেষ করেই চলে আসবো। আচ্ছা মা আরেকটা কথা বলো তো।
-কি কথা?
-গতকাল ঘুমের মাঝে কি আমি উল্টা পাল্টা কিছু বলেছি বা করেছি?
-নাহ তো। আমরা তো তোকে কত ডাকলাম। তুই তো কোন সাড়াই দিলি না।
-ওহহ,, আচ্ছা রাখছি মা।
ইতি ফোনটা রেখে আবার ভাবনায় পরে যায়। স্বপ্নে তো সে নিজের পরিবারের সবাইকে ঠিক দেখেছে কিন্তু এতোগুলো নতুন মানুষ যাদের সে কখনো দেখেনি তাদের কিভাবে সে স্বপ্নে আবিষ্কার করলো কিছুই বুঝতে পারছে না ইতি। নিজেকে এক প্রকার উন্মাদ উন্মাদ মনে হচ্ছে ইতির কাছে। রোদ নামক মানুষটার শেষ অব্দি কি হলো? এভাবে অর্ধেক স্বপ্নই বা ইতি কেন দেখলো? সে কি বেঁচে আছে নাকি.... উফফ কিছুই ভাবতে পারছে না ইতি। অসহ্য লাগছে তার কাছে সব। হুট করেই ইতির মনে হয় এমন তো নয় ইতির কোন এক্যাসিডেন্ট হয়েছে আর তার স্মৃতি চলে গেছে সেজন্য সবাই তার থেকে সব লুকাচ্ছে। আসলে রোদ আছে হয়তো তার দেখা ডুব কিছু তার সাথেই ঘটে যাওয়া ঘটনা কিন্তু সবাই লুকচ্ছে তার থেকে কোন কারণে। ইতি আবার তার মাকে ফোন দেয়।
-হ্যালো মা।
-কি বল?
-আরেকটা কথা বলো না।
-আবার কি কথা?
-এমন কি কিছু হয়েছে যে কোন ঘটনায় বা কোন বড় ধরনের শকড পেয়ে আমার আগের স্মৃতি মুছে গেছে তাই তুমি, তোমরা সবাই আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো।
-কি সব যা তা বলছি ইতি তুই? আজ তোর হলোটা কি বলবি তুই আমায়। এক তো অস্বাভাবিক ভাবে ঘুমালি। ঘুম থেকে উঠে উল্টা পাল্টা বকছিস। এখন ফোন দিয়েও কি সব বলছিস তুই। বলতো আমায় সত্যি করে তোর হলোটা কি?
-না মা কিছু না।
-তাহলে এসব বলছিস কেন?
-সত্যি আমার কিছুই হয়নি? আমার স্মৃতি যায়নি?
-তোর স্মৃতি যাবে কেন? আমার তো মনে হচ্ছে তোর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।
-আচ্ছা।
ইতি তার মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দেয়।
নিজেকেই বোকা বোকা লাগছে ইতির। কতটা বোকা হলে এমন বোকা বোকা প্রশ্ন করতে পারে কেউ৷ আসলেই তো বোকার মতো প্রশ্ন করল ইতি তার মাকে। ইতির স্পষ্ট মনে আছে গতকাল অফিস থেকে অনেক বেশি ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে কোন রকমে শাওয়ার নিয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ক্লান্তিতে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছিল ইতির চোখে। তাহলে তার কেন স্মৃতি যাবে। নিজেকে চরম বোকা মনে হচ্ছে ইতির এমন উদ্ভট চিন্তা ভাবনা করার জন্য। ইতি তার অবচেতন মনে চাইছে তার স্বপ্নে দেখা সেই রোদ নামক মানুষটা কেবল তার স্বপ্ন না হয়ে বাস্তব হোক। কিন্তু সে কে? কিছুই জানে না ইতি। কেনই বা ইতি তাকে স্বপ্নে দেখলো। রোদ নামক মানুষটাকে নিয়ে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে যায় ইতি। কিন্তু তার ভাবনার শেষ হয় না। ড্রাইভারের ডাকে হদিস হয় ইতির।
-মামুনি পৌঁছে গেছি।
-হু?
-পৌঁছে গেছি।
-ওহ! আচ্ছা।
-আমি কি থাকবো না চলে যাবো।
-আপনি থাকেন একেবারে আমিসহ বাসায় যাবো।
ড্রাইভারকে থাকতে বলে ইতি গাড়ি থেকে বেরিয়ে কনভেনশন হলে চলে যায়। ডেকোরেশনের সব কাজ শেষ। কিছুক্ষণ পরেই সবাই আসতে শুরু করবে। ইতি শেষ সময় সব একবার দেখে নিবে। ইতিকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে বিশাল হলের অন্যপাশ থেকে তওহিদ দৌড়ে আসে।
-ম্যাম এসেছেন আপনি?
-হুম, সরি আমার জন্য তোমাকে হয়তো ঝামেলায় পরতে হলো।
-না ম্যাম কোন ঝামেলা নয়। আমি তো চিন্তায় ছিলাম সকাল থেকে ফোন করছি কিন্তু আপনার কোন খবর নেই। ম্যাম আপনি ঠিক আছেন তো?
-হুম আমার কি হবে?
-না মানে আপনার চোখ মুখ ফুলে আছে তাই।
-ওহ ঘুমিয়ে ছিলাম তাই।
-ওকে ম্যাম চলেন আপনি সব একবার দেখে নিবেন।
-হ্যাঁ চলো দেখে নেই। সবাই চলে আসবে।
ইতি আর তওহিদ সামনের দিকে এগোতে নিলো তওহিদ থেমে গিয়ে বলে,
-তবে ম্যাম একটা কথা।
-কি কথা??
-আপনাকে কিন্তু আজ দারুণ লাগছে দেখতে।
তওহিদের মুখে নিজের প্রসংশা শুনে হালকা লজ্জা মূলক হাসি দেয় ইতি। তা দেখে তওহিদ আরো বলে,
-সত্যি বলছি ম্যাম এই সাদা রঙটায় আপনাকে অনেক বেশি মানিয়েছে।
"সাদা রঙটা" শুনে ইতি একবার নিজের দিকে তাকায়। সত্যি তো সে আজ সাদা পরেছে। ইতি এতোটাই চিন্তায় মগ্ন ছিল যে সে কি পরেছে কোন রঙের জামা পরেছে সে দিকে তার কোন খেয়ালই ছিল না।
সত্যি আজ ইতিকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে দেখতে। সম্পূর্ণ সাদা রঙের কটন কাপড়ে সাদা গ্লিটারের এম্বোজ কাজ করা থ্রিপিস পরেছে সে সাথে একটা ফুলকারি রঙ বেরঙিন ওড়না। কানে সিলভার রঙের ঝুলানো ঝুমকা। ডান হাতে একটা হাত ঘড়ি। গলাটা খালি। কোমড় অব্দি চুলগুলোকে বাঁধন মুক্ত করে রেখেছে সে। চোখে মোটা করে কালো রঙের আইলাইনার দিয়েছে। ঠোঁটে হালকা নুড লিপস্টিক। গালে হালকা করে দেয়া হাইলাইটারটা যেন আরো বেশি ফুটিয়ে তুলেছে ইতিকে। সব মিলিয়ে দারুণ লাগছে মেয়েটাকে দেখতে।
ইতি এই কোম্পানির সেক্রেটারি। ১ বছর হয়েছে সে জয়েন করেছে। আর তওহিদ তাকে এসিস্ট করে। তার সব কাজে তাকে হেল্প করে। আজ কোম্পানির চেয়ারম্যান স্যার আর মেডামের পক্ষ থেকে এই পার্টি আয়োজন করা হয়েছে কিন্তু কেন তা কেউ জানে না। একে একে সবাই আসতে শুরু করেছে। প্রায় ৫ টা বাজতে চলেছে কিন্তু এখনো চেয়ারম্যান স্যার আর মেডাম আসেননি। তারা কখন আসবে তা এনিয়ে ৩ বার জিজ্ঞেস করেছে তওহিদ ইতিকে। ৪ বারের বার জিজ্ঞেস করতে এলে ইতি তওহিদকে ঝাড়িয়ে দিয়ে বসে। ঝাড়ি খেয়ে তওহিদ সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে। কিন্তু ইতি ভাবে তার আসলেই খবর নেয়া উচিত তারা কখন আসবে। সবাই তো তাদের জন্যই অপেক্ষা করছে। তাই ইতি তার হ্যান্ড পার্স থেকে মোবাইল বের করে কল লগে ঢুকতেই আবার তওহিদ এসে হাজির।
-ম্যাম।
-আবার এসেছো তুমি?
-না আমি আসিনি?
-মানে?
-মানে চেয়ারম্যান স্যার আর মেডাম চলে এসেছেন।
-ওহ আচ্ছা চলো।
ইতি চেয়ারম্যান স্যার আর মেডামকে রিসিভ করে নিয়ে আসে।
সবার সাথে প্রাথমিক খোঁজ-খবর, কথা বার্তা বলছিলেন চেয়ারম্যান স্যার এমন সময় তার একটা কল আসেন। ফোনে কথা বলা শেষ করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় তিনি আর ইতিকে বলেন,
-ইতি আমি কিছু একটা এনাউন্সমেন্ট করবো বলেছিলাম ব্যবস্থা করেছো?
-জ্বি স্যার আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। এক মিনিট প্লিজ।
ইতি তওহিদ কে ডাকে।
-জ্বি ম্যাম।
-তোমাকে বলেছিলাম মাইকের ব্যবস্থা করতে।
-করেছি তো।
-নিয়ে এসো। স্যার কিছু বলবেন।
-এক্ষুনি নিয়ে আসছি আমি।
তওহিদ সব ব্যবস্থা করতেই ইতি চেয়ারম্যান স্যারের দিকে মাইকটা বাড়িয়ে দেয়। চেয়ারম্যান স্যারকে মাইক হাতে দাঁড়াতে দেখে সবাই চুপ হয়ে যায়। সবাই উৎকন্ঠা হয়ে থাকেন সে কি বলবে শুনার জন্য। চেয়ারম্যান স্যার বলতে শুরু করেন,
-আসলে আজ আমি কোন ফরমাল ইস্পিচ দিবো না। আমার জীবনের কিছু প্রাপ্তি আপনাদের সাথে ভাগ করবো। তার আগে আমি আমার অর্ধাঙ্গিনীকে অনুরোধ করছি সে কি কষ্ট করে এসে আমার পাশে একটু দাঁড়াবেন।
চেয়ারম্যান মেডাম নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে স্যারের পাশে দাঁড়ায়। স্যার মেডামের একটা হাত ধরে বলেন,
-এই মানুষটা আমার সব কিছুর সঙ্গী। আমার সুখ, দুঃখ, প্রাপ্তি সব কিছু। সে শুধু আমার সংসারই সামলায়নি। আমার পাশে থেকে আমার এতো বড় এই ব্যবসাকেও হাতে হাত রেখে সামলেছে সে। তাকে ছাড়া এতো বড় ব্যবসা, মিল, ফ্যাক্টরি, কারখানা, দেশ-বিদেশে এতো খ্যাতি কোনটাই হয়তো আমি অর্জন করতে পারতাম না। তাকে ছাড়া হয়তো এতো কিছু সম্ভব হতো না। জীবনের অনেকটা সময় আমি ব্যবসা নিয়ে অনেক ব্যস্ত ছিলাম। ব্যবসার কাছে আমি দেশের বাহিরে থাকতাম আর সে এখানে একা সংসারও দেখতেন আবার ব্যবসাও দেখতেন। তাই তখনই ঠিক করে ছিলাম জীবনের কোন এক সময়ে আমার সবটা সময় আমি তার নামে করে দিবো। আজ আমাদের ৩৫ তম বিবাহ বার্ষিকীতে তাকে উপহার হিসেবে আমি আমার জীবনের অবশিষ্ট সময়টা তার নামে দলিল করে দিচ্ছি। অর্থাৎ আমি রিটায়ারমেন্টে যাচ্ছি। আজ শুধু আমাদের বিবাহ বার্ষিকী নয় সেই সাথে আমি আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিবো আপনাদের নতুন সিইওর সাথে।
তওহিদ বার বার লক্ষ করে ইতি আসার পর থেকেই অনেকটা মন মরা হয়ে আছে। চেয়ারম্যান স্যারের কথায় তার মন নেই। ভয়ে জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিলো না সে। ইতিকে বস হিসেবে তওহিদের অনেক পছন্দের তাই সে আর জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারে না তবে ব্যাক্তিগত কিছু নয়। অনেক আমতাম করে জিজ্ঞেস করেই বসে সে,
-ম্যাম আপনার কি মন খারাপ কোন কারণে?
প্রথমে ইতি তওহিদের কথা খেয়ালই করে না। তাই তওহিদ আবার ডাকে,
-ম্যাম।
-হু, কিহ?
-কি হয়েছে আপনার??
-কই কিছু না তো।
-কিছু না বললেই হলো। অবশ্যই আপনার কিছু হয়েছে কেমন মন মরা হয়ে আছেন আপনি।
-না কিছু হয়নি। তুমি এদিকটা একটু দেখো আমি আসছি। খাওয়ার সব ব্যবস্থা হয়েছে কিনা দেখে আসি।
-নতুন সিইও আসছেন আপনি থাকবেন না? ওয়েলকাম করবেন না তাকে?
-তুমি আছো না? আমার হয়ে ওয়েলকাম করে নাও। আমি পরে আবার ওয়েলকাম করে নিবো।
-ওকে ম্যাম। আমি আছি সব জানাবো আপনাকে।
ইতি যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে হল থেকে বের হবে বলে সামনের দিকে আগায়। তখন পিছনে চেয়ারম্যান স্যার বলেন,
-এই হলো আপনাদের নতুন সিইও। এখন থেকে এই কোম্পানির সব দায়িত্ব তার। আমাদের একমাত্র ছেলে রোদ আহমেদ চৌধুরী।
"রোদ আহমেদ চৌধুরী" নামটা শুনার সাথে সাথে ইতি থমকে দাঁড়ায়। সামনের দিকে উঠা তার কদম সেখানেই থেমে যায়। ইতি ঠিক শুনেছে কিনা ভুল শুনেছে বুঝতে পারছে না সে। রোদ চৌধুরী এখানে কিভাবে? ভয়ে ইতি চুপসে গেছে। পিছনে ঘুরে দাঁড়াবার সাহসটাও সে পাচ্ছে না। তবু সে যে নাম শুনলো তা কি সঠিক শুনলো নাকি ভুল তা যাচাই করার জন্য পিছন ঘুরে দাঁড়ায় ইতি। পিছন ঘুরে যেন ভূত দেখার মতো জমে যায় সে। এটা সে কি দেখছে? কাকে দেখছে? কল্পনায় দেখা মানুষের চেহারা মনে থাকে কিভাবে বুঝে উঠতে পারছে না ইতি। কল্পনায় দেখা একজন মানুষের নাম, চেহারা, শরীরের গঠন এতোটা হুবহু মিলে যায় কিভাবে?? ইতি বুঝতে পারছে না এটা কি সত্যি বাস্তবতা নাকি কোন গল্পকথা। এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা তো কেবল গল্পকথাতেই ঘটে থাকে। বাস্তবে তা কিভাবে সম্ভব?
চেয়ারম্যান স্যার তার হাতের মাইকটা ছেলের হাতে দিয়ে দেয়। রোদ চৌধুরী বাবার হাত থেকে মাইক নিয়ে বলে,
-ওয়েল আজ আর নিজেকে বা কোম্পানিকে নিয়ে কিছুই বলবো না। আজকের দিন শুধু আমার বাবা-মায়ের। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আমার দায়িত্ব গুলোকে নিষ্ঠার সাথে পালন করার। আমার বাবা-মায়ের আদর্শ সন্তান হওয়ার।
বলেই রোদ মাইকটা ছেড়ে দেয়। সবার কড়োতালিতে চারিদিক মুখোরিত হতে থাকে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে ইতি রোদকে দেখছে। এটা কিভাবে সম্ভব। কল্পনায় দেখা একটা মানুষের নাম, চেহারা, শারীরিক গঠন এমন কি গলার কন্ঠটাও মিলে যায় কিভাবে? ইতির কল্পনায় দেখা রোদ চৌধুরী এই মুহুর্তে তার চোখের সামনে ভাসছে তাও কল্পনা নয় বাস্তবতায়। এটা কিভাবে সম্ভব ইতি বুঝতে পারছে না। সে কি এখনো ঘুমিয়ে আছে। সব যেন গুলিয়ে আসছে ইতির। এতোক্ষণে রোদ আহমেদ চৌধুরী নামক মানুষটা ইতির দিকে চোখ তুলে তাকায়। দূর থেকেই সে যেন দেখছে ইতিকে। এবার রোদ চৌধুরী নিজেও ইতির দিকে আগাতে থাকে। ইতির হৃৎস্পন্দন যেন বাড়তে থাকে। রোদের বাড়তি প্রতিটা কদমের সাথে ইতির মনে হচ্ছে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ধবধবে সাদা রঙের কমপ্লিট সুট পরেছে সে। তাকে দেখে চোখের পলক ফেলতে পারছে না ইতি। স্বপ্নে দেখা এই মানুষটা বাস্তবে আরও ৩৬০ ডিগ্রি বেশি সুন্দর। পুরুষরা কি সুন্দর হয় নাকি? কিন্তু রোদ চৌধুরী নামক মানুষটাকে সুন্দর না বলে ইতি থাকতে পারছে না। এতো রূপ কেন এই পুরুষের ইতির মাথায় ধরছে না।
ইতি যেন নড়তেও ভুলে গেছে। রোদ চৌধুরী একদম ইতির মুখোমুখি এসে এক মুহুর্ত ইতির চোখে চোখ রেখে তাকে পাশে কেটে চলে যেতে নিলেই ইতি উল্টো ঘুরে পিছনের দিকে পরে যেতে নিলেই রোদ চৌধুরী তড়িৎ গতিতে পিছন ঘুরে ইতির ডান হাতটা নিজের বাম হাত দিয়ে ধরে ফেলে। ইতি পরে যায় না তবে পিছনের দিকে ঝুলে থাকে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির ঝলক নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের সেই হাসিটাকে প্রশস্ত করে নিয়ে রোদ চৌধুরী ইতির দিকে তাকায়। একটা হ্যাঁচকা টানে রোদ ইতিকে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসে। রোদের হুট করে টান দেয়ায় ইতি নিজেকে সামলাতে না পেরে গিয়ে রোদের বুকের উপর আছড়ে পরে। ইতির কানের কাছে মুখ নিয়ে রোদ চৌধুরী আলতো করে বলে,
-এতো টুকুতেই চমকে গেলো আমার উডবি মিসেস রোদ আহমেদ চৌধুরী?
রোদের মুখে "উডবি মিসেস রোদ আহমেদ চৌধুরী" শুনে চোখগুলো বড় বড় করে মাথাটা কিঞ্চিৎ উপরে তুলে তার দিকে তাকায় ইতির। রোদে এক হাতে ইতিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ইতির ডান পাশ দিয়ে গিয়ে তার বাম কোমড়ে ঠাই হয়েছে রোদের হাতের। ডান হাতটা সে ইতির চিবুকে রাখে। আশ্চর্যের সপ্তম আকাশে উঠে ইতি হা হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আপনি?
-তোমার বস বর।
.
.
.
সমাপ্তি।
হয়তো ইতির মনের ইচ্ছে শক্তি অনেক বেশি ছিল। তাই তার দেখা স্বপ্নের মানুষটা তার কল্পনার জগৎ রেখে তার বাস্তবতায় এসে হাজির হয়। হয়তো এরপরে বাস্তবতায় তাদের একটা সুন্দর ভালোবাসা বাসির গল্প হবে। নিজেদের একটা ভালোবাসার দুনিয়া হবে।
একটা অসমাপ্ত তবে সমাপ্ত প্রেমের গল্প।
লেখিকার কথাঃ এবারের বস বর এর গল্পটাকে ইতির কল্পনায় রেখে দিলাম। বাকি থাকলো বাস্তবতায় তাদের গল্পের কথা। সবাই জানে রোদ আর ইতি মানেই অফুরন্ত ভালোবাসার গল্প। তাই বাস্তবতাটাকে সবাই নিজের মতো করে সাজিয়ে নিন আমার দেয়া কল্পনার রঙ তুলি দিয়ে।
আজকেও কিন্তু সবাই অনুভূতি জানাতে ভুলবেন না।












No comments:

Post a Comment

অদৃশ্য পরী

  ----দেবর সাহেব, তো বিয়ে করবে কবে? বয়স তো কম হলোনা ৷ ----আপনার মত সুন্দরী কাউকে পেলে বিয়েটা শীঘ্রই করে ফেলতাম ৷ -----সমস্যা নাই তো, আমা...