
#moyej_uddin
জীবনে প্রথম ক্রাশ খাইলাম এক পোলারে দেইখা। পাশের বাসায় নতুন উঠেছে। মা আর ছেলে কথা বলতে আসছিলো। আমি কাকের মতো গান গেয়ে সবে মাত্র গোসল থেকে বের হইসি তখনই বসার রুম থেকে ডাক পড়ল। আম্মা সারাক্ষণ ডাকে। খাইতে গেলে ডাকে, ফোন টিপতে গেলে ডাকে, গোসল করতে গেলে ডাকে। ডাকের শেষ নাই। আমি তো মনে করলাম এখনও হুদাই ডাকতেসে। ওড়না ছাড়া চলে গেলাম। গিয়েই টাসকি খাইলাম। মা ছেলে আমার দিকে তাকাই আছে। আমি তো ভাবলাম মাটিটা একটু ফাঁক হইতো। ঢুইকা পড়তাম। যা হোক, মাটিতে না ঢুকে আপাতত এক দৌঁড়ে রুমে ঢুকলাম। ইস রে, একেবারে ফালুদা হয়ে গেলাম। আম্মা আবার ডাক দিল। এবার ওড়না পরে শালীন হয়েই বের হলাম। আমি যাইতেই আম্মা বলল, সালাম দে। পাশের বাসার আন্টি।
- আসসালামু আলাইকুম।
আন্টি থেকে চোখ আপনাআপনি ক্রাশের উপর পড়ল। আহা! কি মুখ! ঠিক যেন চেরি ফল। এ্যাঁ! হঠাৎ কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম, আন্টি, ওনাকে কি কেউ মেরেছে? ছেলে কথা শুনে আমার দিকে বেকুবের মতো তাকালো। আন্টি হেসে বললেন, কেন?
- গাল গুলো কেমন লাল লাল হয়ে আছে! মনে হচ্ছে যেন চেরি ফল।
আম্মা আমার কথা শুনে মনে হয় ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠেছিল। আমি আর কিছু বললাম না। কারণ ততক্ষণে আমার নিজের গালই চেরি ফল হয়ে গেছে। যাগ্গে। সেই হল প্রথম দেখা।
তারপর রোজ সকালে দেখা হতো স্কুলে যাওয়ার সময়। আমার স্কুল আটটায়। তার কলেজ নয়টায়। সে বের হতো সাড়ে আটটায়। আমিও তক্কে তক্কে থাকতাম। দরজার কাচে চোখ লাগিয়ে রাখতাম। কখন বের হবে। আম্মা চিল্লাই বলতো, তুই কি স্কুল যাবি?
- এই তো বের হচ্ছি।
যেই না সে দরজা খুলত, আমিও দরজা খুলে বের হতাম। ফলে চোখাচোখি। আহা, কি এক অনুভূতি!!!! সে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে ফেলতো। তারপর আমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যেতো। আমিও পিছু পিছু বের হতাম। ও সাইকেলে চড়ে চলে যেতো আর আমি রিকশাকে ডাক দিতাম, এই খালি…… আহা খালি তো আমার মন! প্রেমহীন ভালোবাসা হীন খালি এই হূদয় পূর্ণ করো তোমার ভালোবাসায়!!!!
তবে এই ভালোবাসা বেশিদিন টিকলো না। একদিন আম্মা আব্বাকে বলেই ফেললো, আপনি একদিন ছোঁয়ার স্কুলে যাইয়েন তো।
- কেন?
- জেনে আসিয়েন তো স্কুল কি এক ঘন্টা পিছালো কি না। প্রায় দেখি মেয়ে সাড়ে আটটায় বের হয়।
ব্যাস!!!! আমার সব খালি হূদয়ে আম্মা পানি ঢেলে পূর্ণ করে দিল। আমি আগের মতো সাড়ে সাতটায় স্কুলের জন্য বের হতে লাগলাম। মাঝে এক সপ্তাহ আর দেখা নাই।
.
.
.
.
ছুটির দিনেও আম্মার অত্যাচার থেকে রেহাই নাই। শুক্রবার আম্মা আমাকে দিয়ে এক গাদা কাপড় ধোয়াইলো। কি আরামের একটা ঘুম দিতেসিলাম। ক্রাশের লগে আমার বিয়া। আমি কবুল বলে দিসি, সে দুইবার কবুল বলল, শেষ বারে এসে কইল, ছোঁয়া তুই উঠবি না পানি ঢালমু। আমি বেকুবের মতো ক্রাশের দিকে তাকাই কই, কি কও জামাই। বোধ করি স্বপ্নের কথা বাস্তবে বলে ফেলেছিলাম। তার ফলে আজকে কানটা মনে হয় দেড় হাত লম্বা হয়ে ঝুলছে। যাই হোক, আম্মা ছাদে পাঠাইলো কাপড় নিয়া। এইটা আমার বড়ো বিরক্ত লাগে। একগাদা কাপড় ধুইলেই দোতলা বেয়ে পাঁচতলার ছাদে যাইতে হয়। আমার মতো শুকনা মেয়ে মাসে এমন ব্যায়াম করলে তো আমসি হয়ে যাবো। তখন হালকা বাতাসেই উইড়া গিয়া উগান্ডায় পড়মু। হায় রে!!! কি কষ্ট!!!!! তবু সকল কষ্ট বুকে পাথর চাইপা ছাদে উঠলাম। ছাদে উঠতে উঠতে নিজেকে বাপ্পারাজের মতো দুঃখী লাগতেছিল। তাই মনের দুঃখে নিজে গান বানাই নিজেই কম্পোজ করে গাইতে লাগলাম-
''হায়রে দুঃখের সাগরের জীবন
কাপড় রোদে দিতে ছাদে যাওন
আর ভালা লাগে না।''
গাইতেসি আর কাপড় মেলতেসি। নিজের গান শুইনা নিজেরই কান্দন চলে আসতেছিলো। কিন্তু কিছু একটা দেখে সত্যিই খুশিতে কান্দন চলে আসলো। মনে মনে কইলাম, লাভ ইউ আম্মা। চোখের সামনে ক্রাশ আমার দিকে টাসকি খাইয়া খাঁড়াই আছে। তারে দেইখা এক মুহুর্ত ভাবলাম, সে কি আমার কোকিল কন্ঠ শুইনা ফেলল!!! যাগ্গে, শুনলে শুনসে। বৌয়ের কন্ঠ কেমন তা তো জামাইর জানা দরকার। তাই না! আমি গুন গুন করতে করতে কাপড় মেলতেসি আর সে মনোযোগ সহকারে ফোন টিপতেসে। আমি একই কাপড় কুঁচকাইতেসি, মেলতেসি আর তার দিকে তাকাই আছি। তার হুঁশ নাই। আমারও হুঁশ নাই যে এতক্ষণে খালি একটা বিছানার চাদর মেলসি। পাশ দিয়ে একটা কাক কা কা করে উড়ে যাইতেই হুঁশ হলো। তখন দ্রুত কাপড় সব মেলে দিয়া চলে আসতেছিলাম, সে আমারে পেছন থেকে মধুর স্বরে ডাকল, শুনুন।
কন্ঠ শুনে মনে লাড্ডু ফুটল৷ আহা!!! কি কন্ঠ!? গলা তো নয় যেন মধুর ঝর্ণা!!! আমি নিরীহ প্রাণীর মতো তার দিকে তাকালাম। সে কাছে এসে বলল, আমরা আসলে ওয়াই ফাই নিতে চাচ্ছিলাম। তখন আঙ্কেল মানে আপনার আব্বু বললেন যে আপনাদের রাউটারটা ইউজ করতে। আঙ্কেলকে পাসওয়ার্ডের কথা বলতেই উনি বললেন পাসওয়ার্ড নাকি আপনি জানেন। তাই ওয়াই ফাই পাসওয়ার্ডটা যদি দিতেন।
তার মধুর কন্ঠে আমার মাথায় তখনই সব দুষ্ট বুদ্ধি হাত পা ছুড়ে নাচতে নাচতে আসলো। ইচ্ছে করতেসে একটা ডিংকাচিকা নাচ দেই। কিন্তু ক্রাশের সামনে নাচাটা ঠিক হইবো না তাই নিজেকে সংযত করে বললাম, দিবো, কিন্তু আপনাকে কাছে আসতে হবে। সে আমার দিকে সন্ধিহান চোখে তাকিয়ে বলল, কেন? আমি চোরা চোরা ভাব নিয়ে বললাম, কেউ পাসওয়ার্ড শুনলে ভুল ভাবতে পারে। সে সোজা সরলের মতো বলল, এতে ভুল ভাবার কি আছে। পাসওয়ার্ডই তো চাইছি।
- আপনি সত্যিই চান আমি জনসম্মুখে বলি? আচ্ছা আপনি যখন চান তখন বলছি। I love you.
সে শোনার সাথে সাথে শক খেল। যেন আমি তারে কারেন্টের তারে প্যাঁচাই প্লাগে কানেকশান দিয়ে দিসি। সে বলল, কি? আমি মনে মনে বললাম, বয়রা হয়ে গেল নাকি!? আমি চিৎকার করে বললাম, I love you. সে আবারও আমারে প্রশ্ন করসে, I love you? তখনই যত বিপত্তি বাজলো। নিপার মা কাপড় শুকাড় দিতে আসছিলো। আমাদের আই লাভ ইউর চক্কর শুনে সেও একবার চরকির মতো চক্কর খেয়ে ' খালাম্মা গো' কইতে কইতে চলে গেল। আমরা তার চিৎকারেই ভয় পেয়ে গেলাম। নিপার মা আমার ক্রাশের ঘরে কাম করে। ফলে একান ওকান হইতে সময় বেশি নাই। আমি দৌঁড়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে এলাম। ঘরে ডুকতেই আম্মা চিক্কুর দিয়া কইল, কখন পাঠাইছি দুই খান কাপড় দিতে। তাতেই এক ঘন্টা লাগাইসে। আমার আম্মার কথায় হুঁশ নাই। আইসা আমিও সমান তালে চিল্লাই কইতেসি, আম্মা তোমার ফোন কই?
- ক্যান?
- কাম আছে। তাড়াতাড়ি, সময় বেশি নাই।
আমার হাব ভাব দেইখা আম্মা আমার থেকেও অস্থির হইয়া কইল, কি হইসে। এমন ছটফট করতেসোস ক্যান? আমার এখন কান দেয়ার সময় নাই। আগে ওয়াই ফাই পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করমু তারপর সব। নইলে একেবারে কেলেঙ্কারি হইয়া যাইবো।
আমি স্বস্তি হয়ে ফোনটা রাখতে না রাখতেই দরজার কলিং বেলের শব্দ। আম্মা এসে দরজা খুলতেই উঁকি দিয়ে দেখি ক্রাশের আম্মা বাইরে খাঁড়াই আছে। আমি তো সরমে শেষ। আইজকা ছলেবলে কৌশলে মনের কথা বইলা ফেললাম ক্রাশ রে। ওমা!!! ক্রাশও দেখি দাঁড়াই আছে লগে। আমি তো ডাবল সরমে পইড়া গেলাম। আম্মা ওনাদের ভেতরে আইসা বসতে বলল। আমি মনে মনে ডিংকাচিকা নাচতেসি এমন সময় আম্মার ডাক। আমি ধোঁয়া নিমপাতার মতো মুখ করে সবার সামনে দাঁড়াইলাম। ক্রাশ আমারে কইল, আপনি আমাকে যে পাসওয়ার্ড দিয়েছেন ওটা ভুল। আমি মনে মনে বললাম, হালা, বৌরে কেউ আপনি কয়? তোরে ভালোবাসার কতা কইসি। তওবা তওবা। শালা না জামাই। আমি মিষ্টি করে হেসে বললাম, আরে আর্ধেক শুনলে তো ভুল হবেই। আমি তো শুধু I love you বলে ফেলসি। ওটা সত্যি।
আন্টি একবার আমার আর একবার ছেলের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। আমার ক্রাশের দুই নাম্বার আত্মাটাও মনে হয় আমার কথা শুইনা আকাশে উড়াল দিলো। আম্মা আমার কান ধইরা কইল, মশকরা করিস? আমি কইলাম, আম্মু, আমি পুরা পাসওয়ার্ড দেওয়ার আগেই তো নিপা খালা এমন চিৎকার দিয়ে নিচে চলে এল। আমিও ভয় পেয়ে চলে এসেছি। আম্মা আরো জোরে কান মলে দিয়ে বলল, তাইলে পাসওয়ার্ড কি?
- আ…… কানটা ছাড়ো বলছি। I love you abbu.
ক্রাশ সাথে সাথে মোবাইলে পাসওয়ার্ড লিখে নিল। এতক্ষণে তার মুখে হাসি ফুটল। দুই আত্মা আবার তার দেহে প্রবেশ করল। সে মুখে হাসি টেনে বলল, ওয়াই ফাই কানেকশন হয়েছে আন্টি। ওনার কথা শুনেই যেন সবার প্রাণে পানি ফিরল। আন্টি বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমি মনে মনে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ বলে লাভ নাই। এই পেত্মী থেকে আপনার পোলার মুক্তি নাই। ক্রাশ যেদিকে তাকাইবে, এই ছোঁয়াকে দেখিতে পাইবে।
চলবে…
আমি মনে মনে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ বলে লাভ নাই। এই পেত্মী থেকে আপনার পোলার মুক্তি নাই। ক্রাশ যেদিকে তাকাইবে, এই ছোঁয়াকে দেখিতে পাইবে।
আন্টি কিছুক্ষণ গল্প করেই চলে গেল। আমি নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে ফ্যানের ঘোরা দেখতেসি আর ভাবতেসি ফ্যান সব সময় ডান থেকে বামে ঘোরে কেন? আম্মা খাইতে ডাকল। আমি খাবার নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। তখন কানে এল আম্মা আব্বাকে আজকের ঘটনা তার কথার রঙে রঞ্জিত করে শুনাইতেসে। তার বর্ণনা শুনে আমি মুরগীর ঠ্যাং চাবাইতেসি আর মাথা চাপড়াইতেসি। হায়রে জননী!!!! এ কি করলা? আম্মা সব শেষে এটা যুক্ত করল যে, তোমার মেয়ের ভীমরতি হইসে? নইলে এমনভাবে কেউ পাসওয়ার্ড বলে? ব্যাপারটা কেমন সন্দেহজনক না?
- কেন?
- তোমার মেয়ের মাথায় যে বুদ্ধি ধরে তাতে সে কেমনে অর্ধেক পাসওয়ার্ড বলে, তাও আবার একটা ছেলেকে!? তোমার মেয়ের মতি গতি ভালা না। উঠতি বয়স। নাহ্, তুমি পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দাও।
- আচ্ছা।
আমি রুমে বসে বসে শুনতেসি আর মনে মনে চিল্লাইতেসি এটা তুমি কি কইলা আব্বা? তুমি রাজি হইয়া গেলা!!!! তোমার মেয়ে তার হবু জামাইরে ভালোবাসার কথা কওনে তোমরা এত বড় শাস্তি দিতে পারো না। আমি রুম থেকে চিল্লাই কইলাম, আম্মা আজকে কি লবণ মুরগী দি রানসো? আম্মাও চিল্লাই কইল, ভালো না লাগলে নিজে রাইন্দা খাও। আমি মনের দুঃখে আরেকটা ঠ্যাং আইনা চিবাইতে লাগলাম। আম্মা পিছন থেকে খোঁচা দিয়ে কইল, লবণ না বেশি তাহলে রাতে শুধু তরকারি দিয়ে ভাত খাইস। কথাটা শুনে মনের দুঃখ এক লাফে দশ গুন হইয়া গেল। সেই দুঃখে হাড্ডি গুলা এমনভাবে চিবাইলাম যে বিলাই দেখি কইব, কোন রাক্ষস আজকে মুরগী খাইসে, আমাদের জন্য হাড্ডিটা পর্যন্ত অবশিষ্ট রাখে নাই। শেষ পর্যন্ত আব্বা ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করছে কি না আর জানতে পারলাম না। কারণ আমার নিজের কোনো ফোন নাই।
.
.
.
.
রোজ বিকালে ক্রাশ মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাইতো। আমি ক্রিকেট একদম পছন্দ করতাম না। কিন্তু তার ঠেলায় ক্রিকেট এত ভালোবেসে ফেললাম যে নিজেই বাচ্চাদের একটা ব্যাট বল কিইনা নিয়ে চলে আসলাম দোকান থেকে। এখন প্রত্যেকদিন আমার একই কাজ। সকালে স্কুল, বিকালে ব্যাট বল আর রাতে পড়াশোনা। এই তিন নিয়াই আপাতত আমার সংসার। তারে নিয়া ডাইরিতে হাজার কথা লিখা পুরাই ফেলসি। এটাও লিখসি যে বিয়ার পরে ক্রিকেট টিম বানামু। লাইনটার কথা মনে কইরা নিজেই লজ্জায় মুচকি মুচকি হাসি। ভাবি আমার ক্রাশ জানলে কি কইব!!! একদিন বিকালে ব্যাট বল পাশে রাইখা বিছানায় শুইসি আর ছাদের দিকে তাকাই মুচকি মুচকি হাসতেসি। কোন ফাঁকে এটা আম্মার চোখে পড়ছে খেয়াল নাই। সাথে সাথে আম্মা রাতে আব্বারে কইল, শোনো, তোমার মাইয়া প্রেম করে। আব্বা চোখ কপালে তুলে বললেন, কি বলো!? আমি রুম থেকে আম্মার কথা শুনে চিৎকার দিয়া কইলাম, আম্মু, আজকে নাকি জবার একটা স্পেশাল পার্ট দিবো। আটটা বাজি গেসে। তুমি দেখবা নাকি আমি ডিস এ্যান্টেনা কাইটা দিমু? এই টনিকেই কাজ হইল। আম্মা মুখ বন্ধ কইরা রিমোট খুঁজতে লাগল। কারণ আমি যখন বলসি ডিস এ্যান্টেনা কেটে দিমু, তো কথা না শুনলে তাই করমু। এই নিয়ে দুই বার এমন হইসে। আব্বাকে অনেক বলে আম্মা লোক আনাই ঠিক করাইসে। এইবারও হইলে ডিস লোকদের কাছে লজ্জার আর শেষ থাকবো না। তাই কোনো কথা না শুনলে এই টোটকা রেডি রাখি। যাহা এক ফোঁটাই যথেষ্ট।
আমি পড়ার টেবিলে বসে আছি। সামনে বই খোলা। কিন্তু আমার মন মৌমাছির মতো ক্রাশ নামক ফুলে ঘুরে বেড়াইতেসে আর মধু সংগ্রহ করে বলতেসে, আর আছে মধু? আজ আমি হাঁড়ি ভর্তি করে নিয়ে গিয়ে মৌচাক বানাবো। ফুলও হেসে আমাকে একগাদা মধু দিয়া কইল, লও সখি, এই মধু শুধু তোমার জন্যই জমাই রাখসি। আমিও সেই মধু নিয়া মৌচাকে রাখসি এমন সময় কে যেন ঢিল মারল মৌচাকে। তাকিয়ে দেখি আব্বা দরজার সামনে দাঁড়াই আমাকে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে ডাক দিসে। আমি তাকাতেই বলল, পড়ার বই খোলা রেখে কোন দিকে তাকাই হাসতেছিস?
- কই, আব্বু?
- আমি তোরে ভালো করে চিনি। কার পাল্লায় পড়ছিস?
- তুমিও আম্মুর কথা বিশ্বাস করলা? কোন পাগলে আমার সাথে প্রেম করবো?
আব্বা আমার কাছে এসে সুন্দর করে উপদেশ দিয়ে গেলেন যে বই খোলা থাকলে শয়তানে পড়বো। অতএব পড়ায় মন দাও। আমি মনে মনে কইলাম, যে পড়া, শয়তানও বলব, থাক, তোর পড়া তুই পড়। আমার অন্য কাজ আছে। এটা বলে সেও পালাইব। ভেবেই ফিক করে হেসে দিলাম। আব্বা চলে যাচ্ছিলেন। হাসি শুনে আমার দিকে ফিরে বললেন, আবার হাসিস ক্যান?
- আব্বা, ভাবতেসি।
- কি?
- কালকে কয়টা রসগোল্লা তোমার পেটে গেসে।
এই কথাতেই আব্বা চোরের মতো উঁকিঝুঁকি দিয়ে বললেন, এই, তোর আম্মুকে বলিস না। আসলে দেখে আর লোভ সামলাতে পারি নাই।
- আমি বুঝি, চিন্তা কোরো না, আমার দিক থেকে এই কথা লিক হবে না।
কথায় বলে না যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যে হয়। হঠাৎ কোথায় থেকে আম্মা এসে হাজির। আমার কথার শেষ অংশ শুনেই বললেন, কি লুকাইতেসো বাপে ঝিয়ে মিলা। আব্বা কিছু বলার আগেই বললাম, কালকে কয়টা রসগোল্লা খাইসে সেই সংখ্যাটা বলতে মানা করতেসিলো। আমিও বলসি আমার থেকে এই কথা লিক হবে না। আব্বা সাথে সাথে চোখ রাঙিয়ে আমার দিকে তাকালেন। হাঁড়ি হাটে ভেঙে গেসে। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আবার খেয়েছো!? তোমার না ডায়াবেটিস। ব্যাস শুরু আম্মার ভাষণ। আমিও মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল আর শিখতে লাগলাম। ভবিষ্যতে ক্রাশকে এভাবে বলতে হবে না!? ভেবে এবার আটাশটা দাঁত বের করে হাসতে লাগলাম। আমার হাসি দেইখা আব্বা আম্মা ঝগড়া বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকাই রইল। যেন আমি তাদের মেয়ে না কোনো আজব চিড়িয়া চলে আসছে আমাদের ঘরে। তাদের দিকে তাকিয়ে আমার হাসি বন্ধ হইয়া গেল। আমি পড়ায় মনোযোগ দিলাম।
.
.
.
.
দিন দিন তার প্রতি দুর্বল হইতে লাগলাম। ক্রাশের প্রতি আমার হূদয় ক্রাশিত হইতে লাগিল। আমিও হাল ছাড়ার পাত্রী নই। আমি যখন তার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ খুঁজতেসি তখন সুযোগ নিজেই আমার কাছে এসে কইল, ছোঁয়া, তোর দুঃখে দুঃখিত হইয়া নিজেই চলে আসলাম তোর কাছে। একদিন আন্টি আমাদের পিঠা দিতে আসলেন। আমি তো পিঠার সেই লেভেলের ফ্যান। আমাকে কেউ সারাদিন পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করলে ওগুলো শেষ না করা অবধি আমার দুই পা দরজার দিকে নড়ে না। আমাকে যদি বলে তোকে পিঠাওয়ালার কাছে বিয়া দি দিমু তাইলে হাসতে হাসতে রাজি। তবে সেটা আগের কথা। এখন আমার জামাই আছে, মানে হবু জামাই আছে। এখন পিঠাওয়ালাকে বিয়া করা আমার জন্য জায়েজ নাই। যাই হোক, আন্টি মাত্র পিরিচটা রাখতেই আমি পিঠার সুগন্ধে মৌমাছির মতো উড়ে উড়ে বসার রুমে চলে এলাম। গিয়ে দেখি পিঠাগুলো আমার দিকে জুলুজুলু চোখে তাকাই আছে। কিন্তু আন্টির সামনে নিতে পারতেসি না। হবু শাশুড়ী বলে কথা। যদি দেখে ছেলের বউ রাক্ষসের মতো পিঠা গিলতেসে তাইলে আর জীবনেও ক্রাশ রে এই মুখো হতে দিবে না। আমি খালি পিঠার দিকে তাকাইতেসি আর চরকির মতো আন্টি আর আম্মার চারপাশে ঘুরতেসি। কি কপাল!!! আমার সাধের পিঠা করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাই আছে আর আমিও বুভুক্ষের মতো তাকাই আছি। আম্মা আমার হাবভাব দেইখা কইল, কি রে, কিছু বলবি?
- না।
আম্মা বলল, যা তো ছোঁয়া, তরকারির লবণ দেখে আয়।
আমি মুখ কালো করে রান্নাঘরে চলে এলাম। আরেকটা বিরক্তির কাজ। আমি যতদিন লবণ দেখসি ততদিন আম্মার একটা লম্বা ভাষণ শুনতে হইসে। হায় রে ক্রাশ!!! তোমার জন্য আমার মুখ এখন মিষ্টি না করে নোনতা করতে হবে। কোথায় আরাম করে পিঠা খাইতাম তার জায়গায় তরকারির ঝোল খাইতেসি। আমি লবন দেখে নিজের রুমে চলে এলাম। আম্মা আর আন্টি গল্প করতেসে। আমার ইচ্ছা করতেসে মনের দুঃখে গান গাই। কিন্তু আন্টি কি আমার গলা সহ্য করতে পারবে? কয়েক মুহূর্ত উপরের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করলাম। তারপর ভাবলাম, আমারে পিঠা খাইতে দিতেসে না, বইসা বইসা রসের আলাপ করতেসে। এইটুকু প্যারা তো দেওয়াই যায়। মাত্র গলা পরিষ্কার করে গান গাইব, এমন সময় আমার কান ওনাদের গল্পের দিকে চলে গেল। আমি ঠিক শুনছি? আমার ক্রাশ গাজরের হালুয়ার উপর ক্রাশ? ভালো করে শুনে দেখলাম ঠিকই শুনসি। শুনে আমি কপাল চাপড়াইলাম। আমার ক্রাশের সব সময় আমার অপছন্দের জিনিসগুলাই পছন্দ কেন? আমি গাজর দুই কেন চাইর চোক্ষে দেখতে পারি না। আর সেই গাজরের হালুয়া আমার ক্রাশ খায়। এবার আমার কান্দন আইতেসে। আন্টি কথা বলে চলে গেল। আমি তাড়াতাড়ি আম্মার ফোনে আব্বাকে ফোন করে কইলাম, আব্বু এক কেজি গাজর আনবা। আব্বা আমার কথা শুনে হার্টফেইল করল কি না বুঝলাম না। কারণ ফোনের ওপাশে নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত নাই। আমি কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করতেই আব্বা বলল, তোর শরীর ঠিক আছে তো?
- হ্যাঁ। মনে করে আনবা কিন্তু, পারলে দুই কেজি আনিও।
তারপর আর কথা নাই। আমি তাকাই দেখলাম ফোন কেটে দিসে। আমি ভাবি কি হলো!? ফোনে তো টাকা আছে, তাহলে মনে হয় আব্বা কেটে দিসে। থাক গা। আমি চার হাত পা মেইলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে গাজরের অপেক্ষা করতে লাগলাম। কখন যে ঘুমাই পড়ছিলাম টের পাই নাই। হঠাৎ তাকাই দেখি আব্বা আম্মা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাই আছে। আমি ইশারায় বললাম কি? ওনারাও ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন কি? আমিও আবার জিগাই, তারাও জিগায়। এভাবে কি কি খেলতে খেলতে বিরক্ত হয়ে উঠে বললাম, কি হইসে? আব্বা আমার কপালে হাত দিয়ে বললেন, চল ডাক্তারের কাছে।
- হঠাৎ ডাক্তারের কাছে যাবো কেন?
- শরীর ঠিক নাই।
আমার শরীর অথচ আমিই জানি না আমার শরীর খারাপ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, দুই কেজি গাজর আনসো? আব্বা আম্মা একে অপরের দিকে তাকাই আছে আর আমি তাদের দিকে। আমি ডায়নিংয়ে গিয়ে দেখলাম একটা কালো পলিথিনে কিছু গাজর উঁকি ঝুঁকি দিতেসে। আমি নাক কুঁচকে একটা মোটকা দেখে গাজর ধুয়ে নিয়ে সোফায় বসলাম। আব্বা আম্মা অবাক হয়ে আমার কান্ড কারখানা দেখতেসে। আমি গাজরে একটা কামড় দিতেই দুইজনে আঁতকে উঠল।
চলবে…
আমি নাক কুঁচকে একটা মোটকা দেখে গাজর ধুয়ে নিয়ে সোফায় বসলাম। আব্বা আম্মা অবাক হয়ে আমার কান্ড কারখানা দেখতেসে। আমি গাজরে একটা কামড় দিতেই দুইজনে আঁতকে উঠল। এভাবে আমি প্রথমটা শেষ করে দ্বিতীয়টা ধুঁয়ে নিতেই আম্মা বলল, রেডি হ।
- কেন?
- ডাক্তার দেখাবো। কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে।
আমি চোখ সরু করে বললাম, হঠাৎ?
- যে তুই গাজর বাসায় ঢুকতেই তার চৌদ্দ গুষ্টির উদ্ধার করে দিতি, সে আজ গাজর খাইতেসে।
আমি উদাস উদাস ভাব কইরা দার্শনিক ভঙ্গিতে কইলাম, গাজর খাইলে শরীর সুস্থ থাকে। তাই ভাবতেসিলাম এবার থেকে রোজ দুই না না তিনবেলা তিনটা গাজর খামু। আম্মা আব্বা কি বলবে বুঝতে না পাইরা নিজের কাজে চলে গেল। আমিও নাক মুখ কুঁচকে গাজর খাইতে লাগলাম। চারদিনে আমি দুই কেজি গাজর খেয়ে শেষ করলাম। তিনবেলায় তিনটা না করে ছয়টা করে গাজর খাইতে লাগলাম। আম্মা তো টেনশানে পড়ল, এই মেয়ের কি হল!? একদিন আম্মা নিজের ফোনে ভিডিও দেখতে গিয়া আঁতকে উঠল। মেমরি ভর্তি গাজরের হালুয়ার রেসিপি। অন্তত এদিক ওদিক করে বিশ পঁচিশটা হবে। আম্মা ডাক দিল। তখন আমি রান্নাঘরে গাজরের সাথে যুদ্ধ করতেসি। ডাক শুনে তার কাছে গেলাম। আমাকে দেইখা আম্মা চমকায় উঠল। আমি গাজর বানু হয়ে আছি। দুই হাতে গাজর। মাথায় গাজর কুচি, সারা শরীরের গাজর কুচি। আম্মা কইল, এই অবস্থা কেন?
- রান্না করতেসি।
আম্মা অবাক হইল। যে মেয়ে প্লেট ধোঁয়ার জন্য রান্নাঘরে যাইতে চায় না সে মেয়ে আজ রান্নাঘরে। আম্মা জিগাইল, কি রাঁনতেছিস আবার? আমি নিরাশ হয়ে কইলাম, সর্বাঙ্গে যাহার ছড়াছড়ি তাই রাঁনতেসি। কি জন্য ডাকছো? আম্মা আর কিছু বলল না। আমি বেশ বিরক্ত হয়ে চলে গেলাম। একে তো কখনো রান্না করি নাই, তার উপর গাজরগুলা নিয়া সিদ্দত করতেসি, এর মাঝে আম্মার হুদা ডাকটা ভালো লাগে নাই। যাই হোক, অনেক কষ্টে অনেক চেষ্টার পর গাজরের হালুয়া বানাইলাম। তারপর কাকের গলা ছেড়ে ইচ্ছামতো গোসল করে সেজেগুজে রেডি হয়ে নিলাম। সুন্দর করে চোখে গাঢ় কাজল দিলাম। বাসায় পরার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর লাল জামাটা পরসি। আলমারি খুলে জামা নিলে আম্মা কইব, এখানে কি বিয়া শাদি লাগসে যে নতুন জামা পরছিস।
আমি বড় একবাটি নিয়ে পাশের বাসায় নক করলাম। আন্টি দরজা খুলে বললেন, আরে ছোঁয়া ভেতরে এসো। এখানে আসার পর তো একবারো আসো নাই। আমি মিষ্টি করে সালাম দিলাম। মনে মনে বললাম, একেবারের জন্যই চলে আসমু, আপনার ছেলের লগে বিয়া দিয়া দেন। আন্টি আমাকে সোফায় বসালেন। আমি বাটিটা আন্টিকে দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললাম, এটা আমি বানিয়েছি। ভাবলাম আপনাদেরকেও একটু দিয়ে যাই। বাসায় কেউ নাই? আন্টি বললেন, ওমা! গাজরের হালুয়া! তোমার আঙ্কেল অফিসে। এখনো আসেনি। দাঁড়াও তোমাকে একটু দেই। আমি মনে মনে কইলাম, আঙ্কেলের খবর জাইনা আমি কি করমু। আমার জামাইর খবর বলেন। আমি বললাম, লাগবে না আন্টি, বাসায় আরও আছে। আন্টি তাও ছোট একটা পিরিচে আমাকে দিলেন। তখনই আমার ক্রাশ বাসায় ঢুকল। আমি তার দিকে হা করে তাকাই আছি। গায়ে ফুটবল জার্সি ঘামে লেপ্টে আছে। মুখ পানি দিয়ে ধোয়ায় কপালের চুলগুলো ভিজে কপালের সাথে লেগে আছে। সেগুলো থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। গরমে মুখের সাথে কাল অবধি লাল হয়ে আছে। ওকে আমার চেরি ফল!!!!! তোকে দেইখা আমার মনে গান বাজতেছে, তোরে হেব্বি লাগছে। সে এসে বলল, আম্মু আজকে আমাদের টিম জিতেছে। তারপর আমার পিরিচের দিকে দেখে বলল, গাজরের হালুয়া! বলেই পিরিচটা নিয়ে নিল টেবিল থেকে। আমার দিকে একবার তাকালোও না। আমি মনের দুঃখে বললাম, আমি আসি আন্টি।
- ওমা, চলে যাবে!
আমি যেই দরজা খুলেছি ক্রাশ বলল, এটা কে বানিয়েছে? বাপ রে, লবণ দিয়ে রান্না করেছে নাকি? লবণ ঢালতে তো কার্পণ্য করে নাই।
এমন প্রশংসা শোনার পর পা দুটো আর থাকতে চাইল না, সাথে সাথে বাসায় দৌঁড়। দরজা বন্ধ করে সেটার সাথে লেপ্টে দাঁড়াই আছি। বুকটা ঢিপঢিপ করতেসে। ব্যাঙও মনে হয় এতো জোরে লাফায় না। আমি গিয়ে হালুয়া একটু মুখে দিতেই মুখ বাংলার পাঁচ হয়ে গেসে। আসলেই লবণ দিতে কার্পণ্য করি নাই। আমি পানি দিয়ে ভালো করে কুলি করতেই আম্মার ডাক। আমি আম্মার কাছে গিয়ে দেখলাম আব্বা চলে আসছে এবং উনি কোনো কারণে মুখে চামুচ ঢুকাইয়া আটকে আছে। ঘটনা বুঝতে না পেরে হাতের দিকে তাকাতেই বুঝলাম তার আটকে যাওয়ার কারণ। আমার গাজরের হালুয়ার লবণের কেরামতি। আমি অপরাধীর মতো দাঁড়াই আছি। আম্মা বললেন, গত মাসের জন্য তোর আব্বুকে দিয়ে লবণ কিনাইসিলাম। এখন রান্নাঘরে গিয়ে দেখে আয় তো লবণের ডিব্বা অর্ধেক খালি কেন? আমি মিনমিন করে বললাম, বুঝতে পারি নাই চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলসি। আম্মা তখন মুক্ষম প্রশ্নটা করলেন, তোর আন্টির কেমন লাগছে? আমি বললাম, আন্টি খায় নাই, তার ছেলে খাইসে। বলসে আমি লবণ দিতে কার্পণ্য করি নাই। শুনে আব্বা মুচকি হাসতেসে। আম্মাও মুখ টিপে হাসতেসে। আমি নিজের রুমের দরজার ছিটকিনি আটকাইয়া মনের দুঃখে বাপ্পারাজের মতো গান গাইতে লাগলাম,
গাজরের হালুয়া রে…
কার দুঃখে তুই লবণের সাগরে…
ডুব দিয়ে আমার মান ইজ্জত লুটিলি রে…
রাতে আবার ফ্যানের নিচে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে গাজর চাবাইতেসি আর ভাবতেসি কি করা যায়। ভাবছিলাম গাজর দিয়ে হাত করমু, কিন্তু গাজর আমার খবর করে দিল। কি করা যায়…… হাতের গাজরটারে জিজ্ঞাস করলাম, তুই বল কি করা যায়। হঠাৎ গাজরটাই আমারে আইডিয়া দিল। ব্যাস। আমি খুশির ঠেলায় গাজরের লগে নাচতে নাচতে তার মাথায় কামড় বসিয়ে বললাম, এই ল তোর বকশিস।
.
.
.
.
পরদিন স্কুল থেকে এসেই গোসল করে রেডি হয়ে নিলাম। উঁকি মেরে দেখলাম ক্রাশ কখন বের হয়। তিনটার দিকেই সে ব্যাট বল হাতে বেরিয়ে গেল। আমি আম্মাকে চিল্লাইয়া কইলাম, আম্মু আমি একটু বাইরে যাইতেসি। আম্মা চিল্লাইয়া কিসু কইল। কিন্তু আমি কান না দিয়া বেরিয়ে আসলাম। কলিং বেল টিপতেই আন্টি দরজা খুললেন। আমি হাসিমুখে সালাম দিলাম। আন্টি হেসে বললেন, কি খবর? আমি মুখ ভার করে বললাম, আন্টি, কালকে বুঝতে পারিনি চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছি।
- প্রথম রান্না করলে এমন একটু আধটু হয়।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কি করে বুঝলেন? আন্টি হেসে বললেন, আমিও প্রথম প্রথম এমন করে ফেলতাম। আমি যখন প্রথম বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি এসেছিলাম তখন রান্নার র ও জানতাম না। কোথাও হলুদের জায়গা মরিচ, আদার জায়গায় রসুন, এমন দিয়ে দিতাম। তারপর শ্বাশুড়ি আমাকে যত্ন করে রান্না শিখিয়েছেন।
ওনার কথা শুনে মনটা আনন্দে নাইচা উঠল। আজ আমিও আমার হবু শ্বাশুড়ির কাছে রান্না শিখমু। আমি মুখ কালো করে বললাম, আমাকে গাজরের হালুয়া বানানো শিখিয়ে দেবেন আন্টি? এজন্যই এসেছি। শ্বাশুড়ির কাছ থেকে কবে রান্না শিখবো তা তো জানি না আপাতত আপনার থেকে গাজরের হালুয়া বানানো শিখতে চাই। আন্টি রাজি হলেন কিন্তু তার কাছে গাজর নেই। আমি বললাম, আমি তাহলে বাসা থেকে নিয়ে আসি। আজকে আব্বু এক কেজি গাজর এনেছে। আমি পা টিপে টিপে রান্নাঘরে গিয়ে একটা বাটিতে গাজর নিলাম। যেই না দরজার কাছে গেলাম আম্মা দেখে ফেলল। ডাক দিলেন, ছোঁয়া… আমি দিলাম ভৌঁ দৌঁড়। চলে এলাম আন্টির কাছে। আন্টি আমাকে সুন্দর করে শিখিয়ে দিলেন। আধা ঘন্টায় রান্না শেষ। আমি এক চামুচ খেয়েই বুঝলাম কেন আমার ক্রাশ গাজরের হালুয়ার পাগল! আন্টি আমাকে একবাটি দিয়ে বললেন, চলো খাবে। আমরা বসার ঘরে আসতেই ক্রাশ ঢুকল। আমি তার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলাম। সে সোজা রুমে চলে গেল, একবার তাকালোও না। কষ্টে দুঃখে আমার কান্না চলে আসলো। আন্টি বললেন, খাও।
- জ্বি, আন্টি।
এমন সময় সে এসে বলল, আজকেও গাজরের হালুয়া? কয় মণ লবণ দিয়েছে? শুনেই অভিমান হইলো। মনে মনে কইলাম, এত তাড়াতাড়ি কেমনে আইলো! আন্টি প্রতিবাদ করে বললেন, কি হচ্ছে? আমি বললাম, আপনি তো গেলেন এক ঘন্টাও হয়নি। এত তাড়াতাড়ি আসলেন কি করে? ক্রাশ আমার দিকে ভ্রূ কুঁচকে বলল, তুমি জানলে কি করে? পাহারা দিচ্ছিলে নাকি? আমি পড়লাম ফাঁদে। মনে মনে বললাম, এটা তুই কি করলি, ছোঁয়া। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারলাম!! একে তো কালকের লজ্জায় থাকতে পারতেছিস না। এখন যদি জানতে পারে তুই নজর রাখিস তাইলে তো এখানেই মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যেতে হবে। আন্টি আমাকে বাঁচাই দিলেন, মেয়েটাকে একটু শান্তি করে খেতে দে। আমি দুই চামুচ খেয়েই বললাম, আমার হয়ে গেছে। আপনার রান্না অনেক মজা আন্টি। ক্রাশ বলল, দেখতে হবে না কার আম্মু। ইস্, কতটা হালুয়া নষ্ট করতেসে। বলেই আমার হাত থেকে বাটিটা নিয়ে হালুয়াটা খাওয়া শুরু করল। আমি তো বেকুবের মতো তাকাই আছি। সে খাওয়া শেষ করে বলল, আম্মু, আজকের হালুয়াটা বেস্ট ছিলো। খুব ভালো হইসে। আজকে ভালো করে খেলতে পারিনি দেখে মন খারাপ ছিল। আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল। এটা খেয়েই মন ভালো হয়ে গেছে।
শুনেই আমার মাথায় বাজ পড়ল। আমি দরজার দিকে দৌঁড় দিয়ে বললাম, আমি আসি আন্টি। আরেক দিন আসবো। এক দৌঁড়ে ছাদে। আমার সাধের নীল ফ্রকটা ধুঁয়ে দিয়েছিল আম্মু। আমিই রোদে দিয়ে গেসিলাম। এসে দেখি এখনও বৃষ্টি শুরু হয় নাই। বাতাস ছুটেছে। বাতাস দেইখাই আমি ফ্রকের কথা বেমালুম ভুইলা গেসি। বাতাসে দাঁড়াই আছি। আমার খুশি আর দ্যাখে কে। আমি বাতাসে লাফাইতেসি আর ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাইতেসি। এর মধ্যেই ফোঁটা ফোঁটা করে ঝুম বৃষ্টি নামল। বৃষ্টিতে আমি পাগল হই গেলাম। বাচ্চাদের মতো লাফাইতে লাগলাম। আমার লাফানি দেখলে ব্যাঙও মনে হয় কইব, আমরাও বাচ্চা থাকতে এতো লাফাই নাই। কতক্ষণ লাফাইসি জানি না। এদিকে বৃষ্টিরও থামার নাম নাই। তখন পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, আগে কি বৃষ্টি দেখো নাই? আমি তাকাই দেখি ক্রাশ দাঁড়াই আছে। আমি তো সরমে শ্যাষ। বৃষ্টিতে জামা কাপড় সারা শরীরে সাপের মতো প্যাঁচাই আছে। তারে দেইখাই রশি থেকে আমার জামাটা একটানে নিয়া দৌঁড় দিলাম। ভাগ্য ভালো এত প্যাঁচের পরও হবু জামাইর সামনে উন্ডুস (ধাক্কা) খাই পড়ি নাই। খাইলে আমি মাটির ভেতর ঢুইকাও শান্তি পাইতাম না। আমি এসেই দরজা মেরে দিলাম। বুকের ব্যাঙটা তো দৌঁড় প্রতিযোগিতায় নাম দিসে। আমার শরীর থেকে টপ টপ করে পানি পড়তেসে। আমি ওয়াশরুমে চলে গেলাম। গোসল করতে করতে আম্মার চিৎকার শুনতে পাইলাম।
- এই মেয়ের কি জীবনে কান্ড জ্ঞান হবে না। একে তো এই ভর সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে ভিজে আসছে। সারা ঘর পানিতে ভাসাই দিয়ে এখন গোসল করতেসে।
আমি গোসল করে মাথা মুছতে মুছতে বের হতেই, হাচ্চি……। একবার দুইবার তিনবার… হাঁচতে লাগলাম। আম্মা এসে বললেন, হলো তো। ধর, পাশের বাসার ভাবি এই এক বাটি হালুয়া দিয়ে গেছে তোর জন্য। এটা খেয়ে একটা নাপা খেয়ে নে। আমি রাখলাম টেবিলে। আম্মা খাবার আর ঔষধ রেখে গেল। আমি নাক টানতে টানতে বাটিটা নিলাম। এক চামুচ মুখে দিতেই ক্রাশের কথা মনে পড়ল। সাথে সাথে লজ্জায় বিছানার সাথে মিইশা গেলাম। তাতেই ঘুম।
চলবে…
আম্মা খাবার আর ঔষধ রেখে গেল। আমি নাক টানতে টানতে বাটিটা নিলাম। এক চামুচ মুখে দিতেই ক্রাসের কথা মনে পড়ল। সাথে সাথে লজ্জায় বিছানার সাথে মিইশা গেলাম। তাতেই ঘুম।
আম্মা আব্বার কথা শুনে ঘুম ভাঙল। চোখ খুলতে পারতেসি না। জ্বলতেসে। খুব ঠান্ডা লাগতেসে। শরীর কাঁপুনি দিতেসে। নড়তেই মনে হল গায়ে কম্বল দেওয়া। মাথা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাইতেসে। কানে আসল, আম্মা বলতেসে, একশ চার ডিগ্রি উঠে গেছে। তুমি ডাক্তার ডাকো।
- দাঁড়াও, আমি ফোন করতেসি। এত রাতে যাবো কি করে।
আব্বা ফোনে ডায়াল করল। আম্মা আবার বললেন, মেয়েটা আমার একটা কথাও শোনে না। এখন জ্বর একটা বাঁধাই আনসে। নিজের জামাটাও সামলাই আনতে পারে নাই। জর্জেটের জামা। কেমনে আনসে কে জানে। একেবারে উপর থেকে নিচে ছিঁড়ে ফেলছে। শুনেই আমি পিটপিট করে তাকালাম। তারপরই ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলাম। আমার কান্না শুনে আব্বা আম্মা কাছে আইসা বলল, কি হইসে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? আমি কাঁনতে কাঁনতে কইলাম, আমার এত সাধের জামা!!!!! আম্মা ধমক দিয়া চিল্লাই বলল, একদম কানবি না। জামা একটার দফারফা করে এখন জ্বর বাঁধাই শুই আছে। ঔষধ দিয়ে গেসি সেটাও খায় নাই। জ্বর আসবে না তো কি আসবে। আমি বকা খেয়ে ফোঁপাতে লাগলাম।
সারা রাত জ্বরে ভুগলাম, সকালে একটু কমল। ঘুম ভেঙে দেখি আন্টি পাশে বসে আম্মার সাথে কথা বলতেসে। এই একজ্বরে নেতিয়ে পড়ছি। তবে মনটা খুশি হই গেল। আমার শ্বাশুড়ি আম্মা তো দেখতে আইলো। কি জামাইটা… আমি তাকাতেই আন্টি হেসে বললেন, কেমন আছো? আমি হাসলাম। আন্টি বললেন, কালকে আমার ছেলেটাও বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি বাঁধিয়েছে। ও বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি বললাম তোর জামা কাপড় গুলো তো ছাদে। বৃষ্টি আসলে ভিজে যাবে। দশ মিনিট পর দেখি কাকভেজা হয়ে আসছে। সাথে কাপড়গুলাও ভিজাই আনসে।
আমি তো খুশি। মনে মনে কইলাম, দেখতে হইবো না কার জামাই। মনের কতো মিল!!! কি কানেকশান!!!! আমার সাথে তারও সর্দি হইসে।
- আর বলিয়েন না ভাবি, কালকে একটা জামা ধুয়ে দিসিলাম, ছাদে। মেয়েটা বের হওয়ার সময় বললাম, আসার সময় নিয়ে আসিস। মনে হয় কানেই নে নাই। পরে দেখি পুরা ঘর পানিতে চপ চপ করতেসে। বুঝলাম, মেয়ের কান্ড। বৃষ্টিতে ভিজে আসছে। বারান্দায় জামাটা ঝুলতেসে। ওটাও ভিজা। মেলতে গিয়ে দেখি জামার কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত ছিঁড়া।
আম্মা জামা আইনা সামনে মেইলা ধরল। আমার তো চোখে পানি চইলা আসলো। আমার সবচেয়ে ফ্যাবোরেট জামা ছিল। আমি উঠে হেলান দিলাম। আন্টি সাহায্য করলেন। আমি হাত বাড়িয়ে জামা নিলাম। এমন সময় আমার ক্রাশের গলা শুনলাম। আন্টি বললেন, আমি আসি ভাবি, ছেলে কলেজ যাবে। আমার দিকে ফিরে বললেন, ভালো হয়ে যাস তাড়াতাড়ি। আমি মাথা কাত করলাম। আন্টি যেতেই আমি দৌঁড়ে গিয়া দরজার কাচে চোখ লাগালাম। দেখলাম ক্রাশ বের হইতেসে। আম্মা ডাক দিয়া কইল, ওখানে কি করিস?
- আসি।
ক্রাশ চলে গেলে আমি ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসলাম। আম্মা আমাকে আদার রঙ চা এনে দিলো। আমি বললাম, চা খাইতে ইচ্ছা করতেসে। আম্মা চোখ রাঙাই কইল, চা না খাইলে নিম পাতার রস খাওয়াবো। সব একেবারে বাপ বাপ বলে পালাবে। শুনেই আমার মুখ বেঁকে গেল। একবার খাইসিলাম। সেই ট্যাশ ছিল। করলার আব্বা। আমি আর কিছু কইলাম না। চুপচাপ চা বিস্কুট খেয়ে রুমে চলে গেলাম। বিকালে বারান্দায় বসলাম। সেখান থেকে মাঠ দেখা যায় যেখানে আমার ক্রাশ খেলতে যায়। দূর থেকে দেখতে লাগলাম খেলা। আজকাল গাজর আমার বন্ধু হয়ে গেছে। এখনও হাতে দুইটা গাজর। একটার মাথায় কামড় দিয়ে চিবাতে চিবাতে ভাবতে লাগলাম, আরেকবার গাজরের হালুয়া বানাইয়া নিয়া যামু কিনা? নাহ্, এত বার গেলে সন্দেহজনক মনে হইবো। তাইলে কি করা যায়!!! এমন সময় আম্মা এসে বলল, তুই যাবি? আমি মাঠ থেকে চোখ না সরাইয়া গাজরে আরেক কামড় দিয়ে বললাম, কোথায়?
- তোর জ্বর ছিল দেখে বলি নাই। আজকে ভাবির ছেলের জন্মদিন। আমাদের যেতে বলেছে। তুই যাবি?
শুনেই আমি চিল্লাই কবললাম, তুমি এতক্ষণে বলতেসো! আরো আগে বলবা না? আমি আলমারির দিকে ছুটলাম। কোনটা পরমু, কোনটা পরমু করতে করতে পুরা বিছানা গোয়াল ঘর বানাই ফেললাম। আম্মা তো এসে কয়েকবার বকে গেলেন। আমি কান দিলাম না। আমি গাজর খাচ্ছি আর জামা চুজ করতেসি। শেষ পর্যন্ত আমার গাজর শেষ হইলো আর একটা ফ্রক চুজ করলাম। ফ্রকটার উপরের অংশে কালো মখমলের উপরে লাল কাজ করা। আর নিচের অংশ লাল জর্জেট কাপড়ের। জামাটা পরে চুল আঁচড়ে কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিলাম। ফ্রেন্ডরা বলে আমার স্ট্রেট চুলগুলা খোলা রাখলে নাকি সেই লাগে। তাই করলাম। একপাশে একটা লাল ফুলের ক্লিপ আটকে দিলাম। ফ্রকের গলায় কলার আর হাত পর্যন্ত ঢাকা। তাই কিছু পরা লাগলো না। কানে লাল ছোট ঝুমকার কানের দুল পরলাম। চোখে কাজল দিলাম। ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক দিলাম। তারপর আয়নায় নিজেকে দেইখা নিজেই ক্রাশ খাইলাম। আম্মা দরজার কাছে দাঁড়াই বলল, তোর সাজোন গুজোন হলে বের হবি?
- হ্যাঁ, আম্মু।
আমি রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। আম্মা আব্বা আমার দিকে তাকাই আছে। আমি কইলাম, কি হইসে? এভাবে তাকাই আছো কেন? আম্মা বলল, এত সাজচিস কেন? বার্থে পার্টিতে যাইতেছিস নাকি বিয়েতে?
- আহা, মেয়েরা একটু সাজার শখ হইসে। থাক না। চলো।
আমরা নক করতেই কেউ একজন দরজা খুলল। আমি ঢুকে বেকুবের মতো দাঁড়াই আছি। এত মানুষ!!! পুরো রুম গিজগিজ করতেসে। আমি এদিকওদিক তাকাই আমার বার্থডে ক্রাশরে খুঁজতেসি। দেখলাম এক কোনায় বন্ধুদের সাথে দাঁড়াই গল্প করতেসে। আমার ক্রাশটারে তো হেব্বি লাগতেসে। সাদা শার্ট, হালকা নীল জিন্স, শ্যাম্পু করা চুলগুলো চোখের সামনে পড়ে আছে। ইচ্ছা করতেসে গিয়া সরাই দিয়ে আসি। আমি আগাই গেলাম। আমি যাওয়ার আগেই একটা মেয়ে দৌঁড়ে এসে ওকে জড়াই ধরলো। আমি থমকে গেলাম। মেয়েটা আসতেই আমার ক্রাশ একটা কিটকাট ধরিয়ে দিল। আমার যাইতে অস্বস্তি লাগতেসে। আমি ফেরত যেতে লাগলে আমার ক্রাশ ডেকে বলল, কি হলো, গাজরের হালুয়া। কই যাচ্ছো? আমি পিছন ফিরতেই দেখলাম সে দাঁত কেলাই হাসতেসে। একটা মানুষ এত কিউট হয় কেমনে? ও কাছে এসে বলল, আমার গিফট কই? আমি আমতা আমতা করে বললাম, আনিনি। আসলে জানতাম না। মনে মনে বললাম, আমি আসছি যে হয় নাই? আরও গিফট লাগবো? সে বলল, ওমা, না জানলে আসলে কি করে? ওর ফ্রেন্ডরা বলল, এ কে রে? ও হেসে বলল, গাজরের হালুয়া। মেয়েটা এসে জিজ্ঞেস করল, গাজরের হালুয়া মানে? তখন ক্রাশ রাঙিয়ে চাঙিয়ে আমার হালুয়ার কাহিনী বলতে লাগল। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ তুলতে ভয় লাগল যদি চোখের পানিটা কেউ দেখে ফেলে!!! এতটা অপমানিত আমি জীবনেও হই নাই। ওদের কথার মাঝেই 'আমি যাচ্ছি' বলে চলে আসলাম। একি কি করল আমার ক্রাশ!!! ক্রাশ!!!? আমি নিজেকে নিজে বিদ্রুপ করলাম। চোখ মুছে আন্টির কাছে গেলাম। আন্টি কয়েকজনের সাথে কথা বলছিল। আমি গিয়ে সালাম দিতেই আন্টি বললেন, আরে আমার ছোঁয়া মা যে। কি মিষ্টি লাগছে!!!! আমি বললাম, আন্টি আমার শরীর খারাপ লাগছে। আমি বাসায় চলে যাচ্ছি।
- কি হয়েছে?
- তেমন কিছু না। একটু মাথা ব্যাথা করছে।
- আচ্ছা যাও।
আমি চলে আসলাম। বাসায় ঢুকেই চোখের পানির বাঁধ ভাঙলো। আমি দৌঁড়ে গিয়া বাংলা সিনেমার নাইকাদের মতো নিজের রুমের বিছানায় ঝাঁপিয়ে পরলাম। টানা দুই ঘন্টা পার হইয়া গেল। আমি কাইন্দা কাইটা এক সার হইসি। কাজল লেপ্টে ফুলা চোখগুলো কালো হয়ে পেত্মী হয়ে গেসি। ওয়াশরুমে ঢুকে মুখে পানি দিলাম। সাবান দিয়ে ভালো কইরা ঘইষা মাইজা সব ক্লিন করে ফেললাম। আয়নায় তাকাই দেখি মুখটা ঝকঝক করতেসে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে একটা সুতি জামা পরে সবে শুবো, এমন সময় কলিং বেল বাজলো। আমি ভাবলাম আব্বা আম্মা চলে আসছে। আমি না দেখেই দরজা খুলে রুমের দিকে এগিয়ে বললাম, চলে আসছো? পার্টি শেষ? আমি রুমে যাইতেসি। রাতে খাবো না। আমাকে আর ডাকিও না। আমি রুমে ঢুকে লাইট অফ করে বিছানায় শুয়ে পরলাম। কান্না করায় নাক ভারি হয়ে আছে। নিঃশ্বাস নিতে পারতেসি না। কোনোমতে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। হালকা আলো আসছে বাইরে থেকে। আমি চোখ বন্ধ করলাম। কতক্ষণ পর মনে হইল কেউ আমার দিকে তাকাই আছে। তারপর কপালে কারো ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই জেগে উঠলাম। আমি ডাকলাম, আব্বু… আম্মু… কোন সাড়া নাই। বিছানা থেকে নেমে পুরো ঘর ঘুরে দেখলাম ঘর ফাঁকা। দরজা খোলা। আমি মনে মনে বললাম, কি হইল ব্যাপারটা! আমি দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে এসে লাইট জ্বালিয়ে দেখলাম বিছানার পাশের ছোট টেবিলটায় এক টুকরো কেক। তার উপরে লাভ ইমোজি। কেউ যেন আলাদা করে পিসটা কেটে দিয়েছে। আমি একটু ভাবতে বসলাম, কে এসেছিল!!! কে? আব্বু নাকি আম্মু না অন্য কেউ!!! কোনো ভুত আসছিল নাকি!!! খেয়াল হতেই দেখলাম আমি কেকটা খেয়ে ফেলসি। হায় হায়!!!! ভাবছিলাম একটা ছবি তুইলা রাখমু। ক্রাশের জন্মদিনের কেক। প্লেটের দিকে তাকাই আবার ভাবলাম, আমি খাইসি তো নাকি কোনো পেত্নী এসে খেয়ে চলে গেছে!!!
.
.
.
.
আবার শুক্রবার চলে আসলো। এই কয়দিন ঠিক মতো ঘুম হইতেসে না। ক্রাশের জন্মদিনের পর থেকে যতসব ভয়ানক ভয়ানক স্বপ্ন দেখতেসি। একবার তো দেখলাম, বাসর ঘরে আমার কাছে এসে ঘোমটা তুলে ক্রাশ বলতেসে, কি রে গাজরের হালুয়া বউ, আমার গিফট কই? দেখেই লাফাই উঠছি ঘুম থেকে। আম্মা আজকে আবার কাপড় ধুইসে। আমারে আবার ছাদে পাঠাইলো। আজকে না গান বাইর হইতেসে না বিরক্তি আসতেসে। মাথায় শুধু স্বপ্নটাই ঘুরতেসে। মনে মনে কইলাম, এত কিছু থাকতে গাজরের হালুয়া বউ? বাসর রাতে হালুয়া আমি যদি তোমারে গুইলা না খাওয়াইসি তাহলে আমার নামও ছোঁয়া না। আমি বিড়বিড় করতে করতে ছাদে উঠে টাসকি খাইলাম। ঐদিনের মেয়েটা আমার ক্রাশের গা ঘেঁষে দাঁড়াই আছে আর হেসে হেসে কথা বলতেসে। তাদের হাসি দেইখা আমার সারা শরীরের লোমে দাবানল লাইগা গেল। নরম মনটা বলল, গাজরের হালুয়া বৌ ডাকো তবু আমার কাছে ফিইরা আসো। আমি মনরে ধমক দিয়া কইলাম, এখন পিরিতের সময় না। আগে আচ্ছা মতো ঝাঁটার বাড়ি তারপর পিরিত।
চলবে…
নরম মনটা বলল, গাজরের হালুয়া বৌ ডাকো তবু আমার কাছে ফিইরা আসো। আমি মনরে ধমক দিয়া কইলাম, এখন পিরিতের সময় না। আগে আচ্ছা মতো ঝাঁটার বাড়ি তারপর পিরিত।
আমি গিয়াই কাপড়ের বালতিটা জোরে ছাদে রাখলাম। ওরা একবার আমার দিকে তাকালো। আমি না দেখার ভান করে কাউয়ার মতো গান গাওয়ার শুরু করলাম, কেউ কথা রাখেনি, ভালোবাসেনি……। আমি গান গাইতেসি আর কাপড় মেলতেসি। আমার গান শুনে হোক বা অনিচ্ছায় হোক, মেয়েটা কাছে এসে বলল, হাই, গাজরের হালুয়া। হোয়াটস আপ? আমি তাকে আগাগোড়া দেখলাম। মনে মনে কইলাম, নিজে তো শুঁটকি মাছের পোনা, আবার আমারে আসছে গাজরের হালুয়া ডাকতে। আমি বললাম, ফগরফ টগরফ গাট। মেয়ে আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে বলল, হোয়াট? আমি বললাম, জীবনে তিন গোয়েন্দা পড়নাই? মেয়েটা ক্রাশের দিকে তাকাল। আমি বললাম, বাঙালি?
- ইয়েস।
- তবে বাংলায় কথা বলো। অসব ঢঙের ইংলিশ এই দেশের খাঁটি মানুষ বোঝে না।
আমি কাপড় দিয়া নিচে নাইমা আসলাম। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে কইলাম, ইংলিশ মারতেসে। তোর ভাগ্য ভালো যে ক্রাশ ওখানে ছিল, নাইলে বুঝতি এই ছোঁয়া কি জিনিস। আমার ক্রাশের লগে ঢলাঢলি বাইর করতাম। আমি বালতি রেখে মুখ গোমড়া করে বারান্দায় বসে রইলাম।
দুপুরে খাইতে গিয়া দেখি টেবিলে একটা বাটিতে টেংরা মাছের ঝোল। আমার আরেকটা বালুবাসা। আমি ভাত ছাড়াই খাইতে শুরু করলাম। আম্মা এসে আমার মাথায় চাটি মেরে বলল, আর কেউ খাবে না নাকি একাই সাবাড় করবি? আম্মাকে এডের স্টাইলে বললাম, এই স্বাদের ভাগ হবে না……। আম্মার আমার থেইকা বাটি কাইড়া নিয়া কইল, তোর স্বাদের খেঁতা পুড়ি। যা প্লেট নিয়ে ভাত বাড়। আমি মুখ কালো কারে ভাত বাড়তে বাড়তে বললাম, কখন রান্না করসো, দেখি নাই যে।
- দেখলে তো বিলাইর মতো আসি পাতিল খালি করে ফেলতি। আর দেখবি কেমনে আমি রানলে তো দেখতি।
- তাইলে?
- ভাবি দিয়ে গেল। আজকে নাকি কোন মেহমান এসেছে সে জন্য রান্না করেছে।
- ঐ শুঁটকি মাছের পোনার জন্য…
- কে?
- কেউ না। আমি মাছ খামু না। আমারে গোশত দাও।
- হঠাৎ তোর আবার কি হইল?
আমি গোশত, তরকারি আর ভাত নিয়া রুমে চলে আসলাম। ওরে টেংরা রে… তুইও ঐ শুঁটকির হইয়া গেলি!!! আমার এখন কি হপ্পে। মনের দুঃখ আর শ্যাষ হইল না। ক্রাশ তো আমার হইল না, টেংরাও আমার থেইকা চইলা যাইতেসে। ঐ শুঁটকি রে আমি ভর্তা বানাই খামু। আমার ক্রাশ… আমার টেংরা… আমি হাড্ডি চাবাইতেসি আর কানতেসি। এমন সময় আম্মা উঁকি দিয়া বলল, কিরে, কি হইসে তোর, এমন কুই কুই করতেছিস কেন? আমি চুপ করে বললাম, কিছু না আম্মা, হাড্ডির শব্দ। এইযে দেখো। আমি চাকুষ তাকে হাড্ডির শব্দ দেখাইলাম। যদিও হাড্ডি কুই কুই শব্দে ভাঙে না। তো কি হইসে মড় মড় করে ভাঙলেও তো টপিক ঘুইরা যাইবো।
আমি আর আমার বন্ধু গাজর বিছানায় শুয়ে আছি। টপিক শুঁটকি। কে এই শুঁটকি, জানা দরকার। আমার ক্রাশে ভাগ বসাইতেসে। কতক্ষণ ভাবলাম। বাইরে তাকাই দেখলাম এখনও সন্ধ্যা হয় নাই। তার মানে ক্রাশ এখনও বাইরে খেলতেসে। আম্মা নিজের রুমে শুইসে। আমি গুটি গুটি পায়ে দরজা খুলে পাশের বাসায় নক দিলাম। আমি এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি মারতেসি এমন সময় দরজা খুলল। আমি কইলাম, আন…টি…। আমি চুপ করে গেলাম। আমার ক্রাশ আমার দিকে তাকাই আছে। আমি তো ভাবছি সে খেলতে চলে গেসে। আমার তার উপর প্রসুর অভিমান হইসে। মন চাইতেসে ওর দুই গালে চাইরটা চড় দিয়া আমি কাঁদি। আমি মুখ খোলার আগেই সে কইল, কেমন আছেন, গাজরের হালুয়া? আমি কইলাম, ভালো, চেরি ফল। সে মুখ সুচালো করে বলল, চেরি ফলটা আবার কে? আমি একটু উদাসভাব করে বললাম, আমার সামনে যে খাম্বা দাড়াই আছে সে। ক্রাশ কিছু বলার আগেই ভেতর থেকে মেয়েটা এসে বলল, কে এসেছে? আমি তাকে দেখে রাগে অন্ধ হই গেলাম। কইলাম, চেরির বউ গাজর আসছে৷ সরো। আমি দুইজনকে ঠেলে ভেতরে চলে গেলাম। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা বলল, মেয়েটা কি সাইকো? আমি ওদের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাইলাম। খালি মন্ত্রটা জানতাম, পুইড়া ছাই হই যাইতো। আমি আন্টির রুমে গিয়া বললাম, আসবো?
- আরে ছোঁয়া যে, এসো।
- আন্টি আপনার রান্না সেই লেভেলের ভালো। আমি তো ফ্যান হয়ে গেলাম।
আন্টি হেসে বলল, এই জন্যই আমার কাছে আসা? আমি অভিমানী স্বরে বললাম, এমনিতে আসতে পারি না?
- তা পারো।
- তাহলে?
আন্টি বিছানায় বইসা ছিল। আমি গিয়া ওনার কোলে শুয়ে পড়লাম। বললাম, আন্টি, আম্মু বলছিল মেহমান এসেছে দেখে নাকি আপনি টেংরা মাছের ঝোল রান্না করেছেন। মেহমান কি ঐ মেয়েটা? আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, হুম। আমি জিগাইলাম, কে ও?
- আমার ছেলের বান্ধবী।
এমন সময় ক্রাশ বসার রুম থেকে বলল, আম্মু আমি চাঁদনীকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।
- আচ্ছা যা।
আমি গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। একটু পরে ওদের দেখা গেল। ওরা হেসে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। আমি মনে মনে ভাবলাম, ছোঁয়া রে… তুই সত্যিই বাপ্পারাজ হয়ে গেলি। আমি বললাম, আন্টি আমি আসি। আন্টি বলল, একটু কিছু খেয়ে যা। আমি বললাম, না, আন্টি। আরেক সময়। আমি আসি। আন্টির রুম থেকে বের হয়ে হঠাৎ ক্রাশের রুমের দিকে নজর পড়ল। ভাবলাম, একটু ক্রাশের জগতে ঘুইরা আসি। যেই ভাবা সেই কাজ। ঢুকে পড়লাম চোরের মতো। চারপাশ পরিপাটি। আহা কি সুন্দর আমার চেরি ফলের রুমখানা!!! ঠিক চেরি ফলের মতো। দেয়ালে দেখলাম হ্যাঙ্গারে ক্রাশের কলেজ ড্রেস ঝুলছে। আমি গিয়ে ওটার কাছে দাঁড়াইলাম। তারপর জাপটে ধরে বললাম, যদি পারতাম তোমারে এভাবে নিজের কাছে বাইন্ধা রাখতাম। কিন্তু কপালে কি আছে? আমার মাথায় একটা জিনিস আইল। আমি বহুত খুঁইজা একটা ছোট কেঁচি নিলাম। তারপর ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে শার্টের শেষের বোতামটা কাইটা নিলাম। কি সুন্দর সোনালি বোতাম!!! রাগে ইচ্ছা করতেছিলো শার্টটাই কাইটা দি। কিন্তু দিলাম না। কেঁচিটা আগের জায়গায় রাইখা আমি তার টেবিল দেখতে লাগলাম। হঠাৎ একটা নীল ডায়রীর উপর নজর গেল। ভেতরে কলম রাখা। আমি ডায়রীটার ডালা খুইলা প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাইলাম। ওখানের লেখা দেইখা আমার পুরা জগত থমকে গেল। একি লেখা!!!!!!
তুমি জানো না রে প্রিয়, তুমি মোর জীবনের সাধনা।
তোমায় প্রথম যেদিন দেখেছি, মনে আপন মেনেছি।
ফ্রার্স্ট লাভ

আমার ক্রাশেরও ফার্স্ট লাভ আছে! আমি কাঁপা হাতে পরের পেইজ উল্টাইলাম। সেখানে হেড লাইন, প্রথম দেখা। আমি মাত্র পড়মু এমন সময় ডায়রীটা উড়াইয়া নিয়া গেল। তাকিয়ে দেখি ক্রাশ দাঁড়াই আছে। আমি ধরা খাওয়া চোরের মতো আমতা আমতা করতেসি আর ও বলল, তুমি কোন সাহসে আমার ডায়রী ধরেছো? আমি পেছনে হাত রেখে বললাম, ইয়ে মানে……
- তোমার হাতে কি?
ও বলার সাথে সাথে হাতের মুঠা শক্ত কইরা কইলাম, কিছু না। তরপরই ভৌঁ দৌঁড় দিয়ে বাসায় চলে আসলাম। সোজা নিজের রুমে। দরজা মাইরা চোখের কল ছেড়ে দিলাম। হায়রে!!! ক্রাশও কারো উপর ক্রাশ!!! ছোঁয়া তুই তো ফক্কা।
.
.
.
.
সন্ধ্যায় যখন রুম থেকে বাইর হইলাম তখন আব্বা আম্মা আমাকে দেইখা আঁতকে উঠলেন। আমারে চেনা যাইতেসে না। আমি তাদের দিকে তাকাই কইলাম, এভাবে কি দেখতেসো? তেঁতুল গাছের শাঁকচুন্নি? আম্মা বলল, কি হইসে তোর? কাঁদছিস কেন? আমি নাক টেনে বললাম, দুঃখে। আমার প্রিয় ফুল শুকিয়ে ঝরে গেছে। মৌচাক বানানোর আর মধু নাই। মৌচাক মধু শুদ্ধা কেউ চুরি কইরা নিয়ে গেছে। আব্বা আম্মা অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকালেন। তাদের মাথায় কিছু ঢুকল না। আমার হেঁচকি উঠে গেল। আমি ঢক ঢক করে পানি খেয়ে গাজরের পুরো পলিথিনটা নিয়ে রুমের দরজা লাগাই দিলাম। ঢুকার আগে কইলাম, আমি ধ্যান করমু, রাতে ভাত খামু না। আমারে ডিস্টার্ব করবা না। তারপর দরজা বন্ধ। আম্মা আব্বারে কইল, মেয়েটার কি হইসে বুঝতেসি না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়ে প্রেম করতেসে।
- আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু কে সেই ছেলে!!!!
আমি দরজা মেরে একটা গাজর ধুয়ে আবার ফ্যানের দিকে তাকাই আছি। ফ্যান ভন ভন করে ঘুরতেসে, তার সাথে আমার চিন্তার চাকাও। কি করা যায়? গাজরটা শেষ করে আয়নার সামনে দাঁড়াইলাম। নিজেকে বলল, না ছোঁয়া না, তুই এভাবে হারতে পারিস না। তোর চেরি কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে আর তুই হা করে দেখবি এ হতে পারে না। কিন্তু কি করা যায়?
বৌয়ের মতো সেজে গুজে একটা বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পাশের বাসায় নক করতেই ক্রাশ দরজা খুলল। আমি বন্দুক তার দিকে ধরে বললাম, চল। ক্রাশ ভয়ে আমার সাথে কাজি অফিস চইলা আসলো। রেজিষ্ট্রি কাগজে জোর কইরা তারে সাইন করাইয়া নিজেও সাইন করলাম। তারপর সেই বিখ্যাত হাসি হু হা হা হা হা……
ধুর! নিজের মাথায় নিজে চাটি মাইরা কইলাম, কি ভাবনা!!! আমি বন্দুক পামু কই? নাহ্, এই বুদ্ধি বাদ। তাহলে কি করা যায়?
আমি ছাদের দরজা মাইরা রেলিং এর উপর দাঁড়াই আছি৷ নিচে ক্রাশ, আন্টি, আব্বা, আম্মা সবাই দাঁড়াই আছে। আমি চিল্লাই কইতেসি, তুমি যদি আমারে বিয়া না করো, তো আমি নিজেকে শ্যাষ কইরা দিমু। ক্রাশ নিচ থেকে কইতেসে, না না, ছোঁয়া এমন করিও না। আমি তোমারেই ভালোবাসি। তুমি নাইমা আসো। তার কথায় নাইমা আসতেই সে থাপ্পড় মাইরা কইল, সাধে কি তোমারে গাজরের হালুয়া বলি?
আমি মাথা নেড়ে কইলাম, নাহ্, বুদ্ধিতে জঙ ধরসে। কিচ্ছু মাথায় আসতেসে না। আমি টেবিল থেকে খুঁজে ক্রাশের বোতামটা বাইর করলাম। সেটা দেখেই আমি বরফের মতো গলে গেলাম। বোতাম টাকে কয়টা কিস কইরা নাচতে লাগলাম। হঠাৎ বাঁধ সাধল বিছানার পায়া। ফলে উস্টা খাই পড়লাম।
চলবে…
আমি টেবিল থেকে খুঁজে ক্রাশের বোতামটা বাইর করলাম। সেটা দেখেই আমি বরফের মতো গলে গেলাম। বোতাম টাকে কয়টা কিস কইরা নাচতে লাগলাম। হঠাৎ বাঁধ সাধল বিছানার পায়া। ফলে উস্টা খাই পড়লাম।
পইড়াই ষাঁড়ের মতো চিল্লাইতে লাগলাম, ওরে বাবা গো, কোমর গেল গো। আব্বা আম্মা দৌঁড়ে এসে বলল, কি হইসে, ছোঁয়া? দরজা খোল। আমি সাথে সাথে চুপ করে গেলাম। বললাম, কিছু হয় নাই। আম্মা বলল, তুই দরজা খুলবি না দরজা ভাঙমু? আমি মুখ বাঁকা করে বিছানা ধরে উঠে দরজা খুললাম। সাথে সাথে আব্বা আম্মা রুমে ঢুকলেন। সন্দিহান কিছু না দেখে আব্বা বললেন, কি হয়েছিল? আমি বিছানায় বসে বললাম, বিছানার সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে গেসিলাম।
- এত বড়ো ধামড়া মেয়ে হইসে এখনও চলতে শিখে নাই। চোখগুলা কি হাতে নিয়ে হাঁটিস?
আব্বা আমার কাছে এসে বসলো। বলল, তুই কি প্রেম করছিস? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আবার এই কথা জিজ্ঞাসা করতেসো।
- তো কি করবে? যা শুরু করেছিস। সত্যি করে বল তো, কার প্রেম পড়েছিস?
আমি দুইজনের দিকে তাকাই আছি। আমার আব্বা আম্মার লাভ ম্যারেজ। তাই মনে করতেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি সুড়সুড় করে সব বলে দেবো। ওটি হচ্ছে না। আগে আমি ক্রাশকে পটামু, তারপর। কিন্তু ক্রাশ!!!!! আমি বললাম, ওসব কিছুই না। আসলে একলা একলা ভালো লাগে না। আর এখনো বিয়ে করারও বয়স হয় নাই। তাই নিজে নিজে সময় কাটাইতেসি। তোমরা যাও তো। আমি পড়মু।
আব্বা আম্মা হয়ত বুঝতে পারছে আমি কিছু কমু না। তাই হতাশ হয়ে বেরিয়ে গেল। আমি দরজা মেরে আয়নার সামনে গিয়া আমার চেইনটা খুলে বোতামটা লাগিয়ে আবার গলায় ঝুলাই দিলাম। বাহ্!!!! কি সুন্দর লাগতেসে। একেবারে পার্ফেক্ট হইসে আমারে। আমার ক্রাশের বলে কথা। আমি বোতামটা হাতের মুঠায় ধইরা টেবিলে বসলাম। ওটাতে একটা চুমু দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলাম।
.
.
.
.
এর মধ্যে আরো এক সপ্তাহ অতিবাহিত হইল। আরেক শুক্রবার আসলো। আমি ঘুম থেকে হাই তুলতে তুলতে উঠলাম। আজকে আম্মা জাগায় নাই। তাইলে আজকে কোনো কাজ নাই। ফ্রেশ হয়ে ধীরেসুস্থে খাবার খাইলাম। আম্মার রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম আম্মা কার সাথে ফোনে কথা বলতেসে। আমি নিজের রুমে এসে একটা গল্পের বই নিয়ে বসলাম। আম্মা আমার রুমে উঁকি দিতেই আমি বললাম, আজকে কাপড় ধুইবা না? আম্মা আমার কাছে এসে বলল, হঠাৎ তোর কাপড় ধোয়ায় এত আগ্রহ?
- এতে আগ্রহের কি আছে? প্রত্যেক শুক্রবারই তো তুমি কাপড় ধোও।
মনে মনে কইলাম, প্রত্যেক শুক্রবারই তো আমার চেরি ফলের লগে ছাদে দেখা হয়। তাই প্রত্যেক শুক্রবার আমার ক্রাশ ডে। তাই এত আগ্রহ।
- তুই তো নিজের কাপড় সব জমাই রাখিস। যা আজকে তুই ওগুলা নিজে ধুবি।
আমি কিছু না বইলা উঠে গেলাম। আলমারি থেকে খুঁইজা ময়লা কাপড় বাইর করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। আজকে কেন জানি প্রতিবাদ করতে মন চাইল না। হয়ত ক্রাশের সাথে দেখা করার লোভ সামলাইতে পারি নাই।
.
.
.
.
কাপড় ধুইতে ধুইতে হাত ব্যাথা হইয়া গেল। দুইটা ভারি বালতি টাইনা টাইনা পাঁচতলায় উঠে হাঁপাই গেলাম। বাপ রে! ক্রাশের চোটে ইচ্ছা মতো কাপড় ধুইসি। এখন অবস্থা টাইট। আমি ঘেমে নেয়ে একাকার। ছাদে বালতি দুটো রেখে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়া চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালাম। নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কতক্ষণ দাঁড়াই ছিলাম জানি না। চোখ খুলে তাকাতেই সারা শরীরে হিম বয়ে গেল। আমার ক্রাশ দাঁড়াই আছে। যদিও আমার দিকে মনে হয় খেয়াল করে নাই। মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখতেসে। হাতে ডিএসএলআর ক্যামেরা!!!! ওয়া!!! হঠাৎ নিজের দিকে খেয়াল হতেই কেমন কেমন লাগল। ঘামে পানিতে পুরা ভিজে আছি। ইস্। আমি কোনোমতে কাপড় মেলে তাড়াতাড়ি যেতেই একটা বড় রকমের উস্টা খাইলাম। আমার মনে হল আমি পড়াতে পুরা বিল্ডিং হয়তো কাঁইপা উঠছে। আমি কি এতই মোটা!? কিছুক্ষণ এটা নিয়ে ভাইবা মাত্র চিৎকার দিমু, মা গো… সাথে সাথে মুখ চেপে ধরলাম। কোনোমতে দেয়াল ধরে উঠে হাঁটতে গিয়া বুঝলাম অবস্থা খারাপ। ভালোমতো পা মচকে গেসে। পেছনে তাকাইয়া দেখি ক্রাশ আমার দিকে তাকাই আছে। আমি মনে মনে কইলাম, সার্কাস দেখতেসে। আমি পইড়া গেলাম আর একটু তুলতেও আসলো না। আমি খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে তার আড়ালে গিয়া সিঁড়িতে বসে পড়লাম। মনে মনে চিৎকার করতেসি, আল্লাহ গো, কি দুনিয়া পাঠাইলা। পইড়া এত ব্যাথা পাইলাম। অথচ একটু আইসা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না!!! আব্বা আম্মা, কি ব্যাথা!!! আমি মনে মনে চিল্লাইতেসি আর এমন সময় সে পেছন থেকে এসে বলল, পুরা রাস্তা মেরে বসে আছো কেন? সাইড দাও। আমি বেকুবের মতো তার দিকে তাকাই আছি। সে আবার ইশারা করে পা সরাতে বললে আমি পা সরাই দিলাম। সে সুড়সুড় করে নেমে গেল। আমার ইচ্ছা করতেছিল ডাক ছেড়ে কাঁদি। যাই হোক, এখন কাঁইদা লাভ নাই। নিচে তো যেতে হবে। আমি রেলিং ধইরা উঠতে গিয়ে আবার বইসা পড়লাম। প্রচুর ব্যাথা করতেসে। তাকাই দেখি কালো হয়ে ফুইলা গেছে। আল্লাহ গো, কি হইল এটা!!! এমনিতে ক্রাশের সামনে পইড়া ইজ্জতের ফালুদা, আর এখন পায়ের ব্যান্ড বেজে আছে। আমি আরেকবার চেষ্টা কইরা হাল ছেড়ে বসে রইলাম। হঠাৎ দেখি কেউ আমার দিকে হাত বাড়াই আছে। তাকাই দেখি ক্রাশ আমার দিকে তাকাই আছে। তারে দেইখাই আমার মনে লাড্ডু ফুটতে লাগল। সে কইল, এত বড় মেয়ে হয়েছে এখনও হাঁটতে শিখে নাই। আমি হ্যাবলার মতো বসে রইলাম। সে আবার কইল, আমি ছবির নায়ক না যে তোমাকে কোলে তুলে নিবো। আমার কাঁধে হাত রেখে উঠো। ও আমার সামনে ঝুঁকতেই আমি ওর কাঁধে হাত রেখে দাঁড়াইলাম। তাল সামলাতে না পেরে পইড়া যাচ্ছিলাম। রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। মনে মনে বললাম, কি মানুষ রে ভালোবাসলাম!!! পড়ে যাইতেসি তাও একটু ধরতেসে না। যাগ্গে, অন্তত আসছে তো। সে আমাকে বাসার দরজার সামনে পৌঁছাই দিয়াই ছেড়ে দিল। আমি পড়ে যাইতে লাগলে দরজা ধরে দাঁড়ালাম। সে নিজের বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বলল, ভালো করে গোসল করো। ইস্, আমাকেও এখন গোসল করতে হবে। বলেই দরজা মেরে দিল। আমার রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে মন চাইতেসে। আমি দরজায় নক করতেই আম্মা এসে দরজা খুলল। আমারে দেখে কইল, কি রে, বালতি কই?
- ছাদে। আমার পা মচকে গেছে। আনতে পারি নাই।
- কিভাবে মচকালো!!!? হাঁটতে তো পারিস না ঠিক মতো। ক্লাস এইটে পড়ে এখনও হাঁটতে জানে না।
- তুমি এখন এসব বলবা না আমাকে ঢুকতে দিবা?
আমি অনেক কষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঢুকলাম ভেতরে। সবার উপর রাগ হইতেসে। বিশেষ করে আমার এই অকম্মা পা দুইটার উপর। যখন তখন খালি উস্টা খায়। আম্মা বাম দিয়ে গেল। আমি ওটা না লাগাই ওয়াশরুমে চলে গেলাম। গায়ে বালতি বালতি পানি ঢালতেসি আর ভাবতেসি, আমার গায়ের গন্ধ এত বাজে যে তারে গোসল করতে হবে!!! আজকে ঢইলা আমি সব গন্ধ দূর করমু। যদি আমার গায়ে এক ফোঁটাও গন্ধ থাকে তো আমার নামও… ধুর বাবা, টুলে বইসা গোসল করা যায় নাকি! সাত নাম্বার বার বালতি পুরানোর সময় আম্মা বাইরে থেকে ডাক দিয়া বলল, কি রে ছোঁয়া বেঁচে আছিস নাকি? আমি চিল্লাই জিগাইলাম, হঠাৎ মরতে যামু ক্যান?
- না, তোর কাকের গলা শুনতে পাচ্ছি না তো তাই ভাবলাম। এখন বের হ। তখন থেকে তো খালি পানি ঢালার আওয়াজ শুনতেসি।
আমি মুখ বাঁকা করে শেষ বালতির পানি গায়ে ঢেলে বের হলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতেসি কি করা যায়। আম্মা এসে জিগালো, বাম লাগাইছিস?
- ও, ভুলি গেসি।
- তোর যে কি মনে থাকে! এই বয়সে যদি এমন ভুলে যাস বুইড়া বয়সে কি করবি? দেখি পা। ইস্ রে, কেমনে পড়ছিস? আল্লাহই ভালো জানেন। পুরা কালো হয়ে গেছে৷ ধর এখন বাম লাগা, আমি বরফ আনি। তোর আব্বু আসলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।
আমি ভালো মেয়ের মতো বাম লাগাই বরফের শ্যাক দিতে লাগলাম। দুপুরে খাওয়া শেষে লুকিয়ে ছাদের দিকে রওনা দিলাম। আম্মা জানলে আমারে ফালাই পিটবো। অনেক ভাইবা একটা ব্যাপার মাথায় আসছে তাই গেলাম ছাদে। গিয়ে দেখি আমি তখন ঠিকই দেখসি। ক্রাশের জন্মদিনের শার্টটা শুকাইতে দিসে। আমি গিয়া দেখলাম ওটা শুকাই চকচক করতেসে। আমি চোরের মতো এদিক ওদিক তাকাই শার্টটা ডাকাতি করলাম। জামার মধ্যে ঢুকাই পা টিপে টিপে নামলাম। এখনো পায়ে ভীষণ ব্যাথা। অনেক কষ্টে রুমে গিয়া দরজা মারতেই আম্মা কইল, ছোঁয়া, কই গেসিলি এই পা নিয়ে?
- ছাদে গেসিলাম। একটা ইম্পর্টেন্ট জিনিস রাখি আসছিলাম। ওটা আনসি।
আমি জামার উপর শার্টটা পরলাম। সাদা শার্ট। বুক পকেটের জায়গায় নীল সুতা দিয়ে অল্প কাজ করা। আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই নিজেকে দেখতে লাগলাম। কলারটা নাকের কাছে টেনে ধরতেই একটা মিষ্টি সুবাস নাকে লাগল। আহা!!! আমার ক্রাশের গায়ের গন্ধ তো জোস। বিয়ার পর ক্রাশরে একেবারে জড়াই ধইরা ঘুম যামু। ইস্!!! ভাইবা লজ্জায় মুখ ঢাইকা ফেললাম। শার্টটা পরে নাচতে লাগলে পাটা মনে করিয়ে দিল, আমি কিন্তু রেগে আছি। আর নাচা গেল না। আমি শার্টটা পইরাই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ক্রাশের গায়ের সুগন্ধে আমার চোখে ঘুম চইলা আসলো।
.
.
.
.
ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার পরে। উইঠা মাত্র বিছানা থেকে নামতে যামু এমন সময় বসার ঘরে হাসির শব্দ শুনতে পাইলাম। নামতে গিয়ে টের পেলাম পায়ের ব্যাথা এখনো কমে নাই। তাকাই দেখি এখনো কালো হই আছে। কোনমতে খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে দরজা খুলতে যামু তখনই গায়ের দিকে নজর পড়ল। আয় হায়!!! ক্রাশের শার্ট এখনো গায়ে।
চলবে…
কোনমতে খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে দরজা খুলতে যামু তখনই গায়ের দিকে নজর পড়ল। আয় হায়!!! ক্রাশের শার্ট এখনো গায়ে। এখন এইভাবে গেলে তো আমার খবর হই যাইতো। আমি তাড়াতাড়ি কইরা শার্ট খুইলা আলমারিতে লুকাই রাখলাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে দরজা খুলে দেখলাম আমার হবু শ্বাশুড়ি আম্মা মানে পাশের বাসার আন্টি এসেছেন। আম্মার সাথে গল্প করতেছেন। আমাকে দেখে ডাকলেন। আমি কোনোমতে গিয়া আন্টির পাশে বসলাম। আন্টি জিজ্ঞেস করলেন, পায়ের কি অবস্থা?
- ব্যাথা আছে এখনো।
- দেখেন না ভাবি, বলসি বিকালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবো আর সে পড়ে পড়ে ঘুমাইসে। কেমন লাগে। পায়ের কি অবস্থা করেছে। পুরা কালো হয়ে গেসে।
- ভাই কোথায়?
- আপনার ভাই, নাস্তা আনতে গেছে। দেখি নাস্তা খেয়ে তারপর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
- ও। জানেন ভাবি, আজকে আমার ছেলের শার্ট চুরি হয়ে গেসে।
- কি বলছেন? কি করে?
- আরে ছাদে ধুয়ে শুকাতে দিয়েছিলাম। কাপড় আনার সময় দেখি শার্টটা নেই। আমার ছেলের প্রিয় শার্ট ওটা।
- কি যে শুরু হল? দিনে দুপুরেও চোরের উৎপাত।
আমি ভিজা বিড়ালের মতো দুইজনের দিকে তাকাইতেসি আর মনে মনে হাসতেসি। নাচতে মনে করতেসে, শার্টটা আমার ক্রাশের ফ্যাবোরেট। ভালো হইসে, ওই চাঁদনী না শুঁটকি ওইটার সাথে এত হেসে হেসে কথা বলে ক্যান? চুরি করসি বেশ করসি। ওর জিনিসের উপর শুধু এই ছোঁয়ার অধিকার আছে। আর কারো না।
এমন সময় আমার ক্রাশ ঢুকল। আমি তখন তারে নিয়া ভাবতেসি। খেয়াল করি নাই। সে এসে কইল, আম্মু, চল। নাস্তা খাবে।
- তুই যা, আমি আসছি। ভাবি, আজকে আমার ছেলে নিজে নাস্তা বানিয়েছে।
শুনেই আমি সাথে সাথে বললাম, আন্টি, আমাকে দিয়েন তো। আমি দেখবো কি রকম নাস্তা বানিয়েছে। ক্রাশ বলল, তোমাকে দিবো কেন? জানো আম্মু, কালকে না আমার কলেজ শার্টের শেষ বোতামটা কেউ চুরি করেছে। শুনেই সাথে সাথে আমার মুখ আমসি হয়ে গেল। আমি আমতা আমতা করে গলায় ঝোলানো বোতামটা হাত দিয়ে ঢেকে বললাম, আন্টি, আমি আসতেসি। রেডি হতে হবে। আমি বের হওয়ার আগে আপনাদের বাসায় যাবো। নাস্তা খেতে।
- আচ্ছা, আসিস।
আমি আঙ্গুল দিয়া চোখ টেনে জিহ্বা বের করে ওরে ভেংচি কেটে নিজের রুমে চইলা আসলাম।
আন্টি চলে যাওয়ার পর আম্মা আমার রুমে আইসা একটু থমকে গেল। তারপর আমার উপর চিক্কুর দিয়া কইল, গোয়াল ঘরও তো তোর রুম থেকে ভালো। কি করছিস? ডাক্তারের কাছেই তো যাবি। এত জামা কাপড় বের করে বিছানার এই অবস্থা করছিস কেন?
- ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি তো কি হইসে? বাইরেই তো যাইতেসি। একটু সুন্দর হয়ে যাইতে হবে না?
- আল্লাহ গো, কি মেয়ে দিলা!?
আম্মা বের হই গেল। আমি মনে মনে হেসে বলতেসি, হি হি, আমি তো ক্রাশের বাসায় যাবো। একটু সাজুগুজুর ব্যাপার আছে না। কি যে কও না আম্মা। আমি বোতামটার সাথে মিলাইয়া একটা সোনালী রঙের থ্রিপিস পরলাম। মাথায় বেণী করে ওটাকে প্যাঁচাই খোঁপার মতো বেঁধে নিলাম। ছোট চুলগুলা মুখের দুই পাশে ঝুলতেসে। আমি চোখে হালকা কাজল দিয়ে ওড়না পরে বের হয়ে আসলাম। আম্মারে চিল্লাই কইলাম, আম্মু, আমি আন্টির বাসায় যাইতেসি। আব্বু আসলে নক দিও। আমি বের হওয়ার সময় আম্মা জিজ্ঞেস করল, তুই সত্যি সত্যি যাচ্ছিস?
- হুম।
আমি নক দিলাম। ক্রাশ দরজা খুলে বলল, কি চাই? আমি কইলাম, খেতে আসছি। সরেন। সে না সরে আমার দিকে তাকাই আছে। আমি ভাবলাম আমার উপর ক্রাশ খাইল নাকি? যেভাবে তাকাই আছে। আমি তো মনে মনে খুশিতে বান্দরের মতো লাফাইতেসি। কিন্তু তার কথা শুইনা আমার মন ফুঁটা বেলুনের মতো চুপসাই গেল।
- এটা কোনো রেস্টুরেন্ট না। যে যেই আসবে তাকে খাওয়াবো। বাপরে, মেয়েরা কতই না ঢঙ করতে পারে। ডাক্তারের কাছে যাইতেসে না প্রেম করতে যাইতেসে বুঝাই যাইতেসে না।
- তাতে আপনার কি। সরেন।
- না।
আমি চিৎকার দিতে লাগলাম, আন্টি……। হঠাৎ ক্রাশ এসে আমার মুখ চেপে ধরল। আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই সে বলল, চুপ। আমি বলেছি না ভেতরে যাওয়া নিষেধ……আউ……। আমি তার হাতে কামড়াই দিলাম। সে ব্যাথায় হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, বাপরে, রাক্ষসী একটা। আমি পায়ের ব্যাথা নিয়া দৌঁড়ে ওদের বাসায় ঢুইকা গেলাম। যাওয়ার আগে ওর দিকে ভেংচি কাইটা আন্টির কাছে চইলা আসলাম।
- এতক্ষণে আসার সময় হলো?
- একটু দেরি হয়ে গেছে রেডি হতে। তার উপর এক বিরাট পাহাড় অতিক্রম করে আসছি।
- পাহাড়!
- হুম, কই, আমাকে দাও না। খিদে পেয়েছে।
আন্টি দুটো পিচ্চি বড়া বের করে দিলেন। আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, মাত্র দুটো!!! তাও এত্তো ছোট!!! এগুলা তো আমার পেটের কোণা দিয়েও যাবে না। আন্টি আমাকে সান্ত্বনা দিয়া বলল, কি করব? আমার ছেলেটা এত ফাজিল। তোমার জন্য রাখতেই দিল না। আমি ফোঁপাতে ফোপাঁতে দুটো বড়া একসাথে মুখে পুরে দিয়া কইলাম, আমারে কেউ ভালোবাসে না। আন্টি বলল, আচ্ছা মা, আর কাঁদে না। আমি কালকে তোমার জন্য বানিয়ে দিবো। আমি উজ্জ্বল মুখে কইলাম, সত্যি?
- হুম।
- তাহলে কালকে বিকালে আমি শিখতে আসবো।
আমি দরজার দিকে তাকাতেই মনে হল কেউ একজন সরে গেল। ভাবলাম চোখের ভুল হয়তো। কিছুক্ষণ পর আব্বা নক করলো দরজায়। আমি আন্টি থেকে বিদায় নিয়ে বাইর হই গেলাম। যাওয়ার সময় বললাম, আন্টি কালকে কিন্তু আমি আসবো। আন্টি হাসলেন।
নয়টার সময় বাসায় আসলাম। পায়ে প্লাস্টার করা। হাড় নড়ে গেছে। হাড় নড়ার আর সময় পাইলো না। আম্মা সাফ জানায় দিসে বিছানা থেকে নামা যাবে না। আমি মুখ গোমড়া করে বিছানায় বইসা আছি। পাটার দিকে তাকাই ইচ্ছা করতেসে লাথি মারি। কিন্তু পা দিয়ে পাকে কেমনে লাথি মারি! আমি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম, কালকেও যদি আম্মা ১৪৪ জারি কইরা রাখে আমি ক্রাশের বাসায় যামু ক্যামনে? যত দোয়া দুরুদ আছে সব পইড়া ফু দিয়া কইলাম, ভালা পা তোরে আর বকুম না। তুই তাড়াতাড়ি ভালা হই যা। রাতে আম্মা এসে খাওয়াই দিলো। এতদিন তার হাতে খাওয়ার জন্য আমি কল্লা পিটতাম। এখন খাওয়াই দিতেসে তাও সব তিতা লাগতেসে। কোন দুক্ষে আগের ভাড়াটিয়া চলে গেসিলো!!!!
.
.
.
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে নামতেই পা ভারি লাগল। তাকাই দেখি প্লাস্টার বাঁধা পাটা আমার দিকে চিনা হাসি দিয়ে তাকাই আছে। আমি মনে মনে কইলাম, পা, তোরে যে কি করতে মন চাইতেসে। আমি আস্তে আস্তে ওয়াশরুমে গিয়া ফ্রেশ হয়ে এসে আবার বিছানায় বসলাম৷ পায়ের কারণে স্কুল যাইতে হবে না এটা আনন্দের বিষয়। কিন্তু ঐ বাসায় যাইতে পারমু কি না সেটাই এখন মুখ্য বিষয়।
আম্মা এসে দেখল আমি বিছানায় বইসা হা হুতাশ করতেসি। জিজ্ঞেস করল, কি অবস্থা? আমি খেয়াল করি নাই৷ তখনও আমি ভবিষ্যতের কথা ভাইবা নিজেরে সান্ত্বনা দিয়েতেসি, একদিনেরই তো ব্যাপার৷ জামাইকে না দেখলে কিছু হবে না। আম্মা ভ্রূ কুঁচকাই কইল, তোর জামাই আসছে কোথা থেকে? আমি চমকাই উঠে আমতা আমতা করে কইলাম, আসলে পায়ের যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার জামাইকে তো খোঁড়া বউ নিয়ে সংসার করতে হবে তো, তাই ভাবছিলাম। আম্মা আমার মাথায় চাটি মেরে বলল, এত দূরে না ভেবে সামনের পরীক্ষার কথা চিন্তা কর।
- ওমা, দূরে চিন্তা না করলে তোমার মেয়ের কি হবে! তোমার ভবিষ্যত জামাই তো মনে দুঃখ পাবে।
- মাইর খাবি। দাঁড়া, তোর জে এস সি শেষ হলেই বিয়ে দি দিমু।
এই রে!!!! কথা অন্যদিকে মোড় নিতেসে। যদি সত্যিই ধরে বেঁধে অন্য কারো সাথে বিয়া দিয়া দেয়। আমি কইলাম, বাদ দাও না আম্মু। আজকে কি নাস্তা বানাইসো?
- দুধে পাউরুটি চুবাই খাবি।
- এ্যাঁ…… দুধ ক্যান।
- দুধ খাবি। তাইলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হবি। নইলে তোর আব্বুকে দিয়ে নিমপাতা আনাবো।
আমি নিমপাতার রস দিয়ে পাউরুটি খাইতেসি। ভাবতেই শিউরে উঠে বললাম, না আম্মু, থাক। এত কষ্ট করা লাগবে না। আমাকে দুধ পাউরুটিই দাও। আম্মা এক মগ দুধ আর পাউরুটি দিয়ে গেল। আমি দুধে পাউরুটি ডুবাই নিয়া চিবাইতে লাগলাম। পাউরুটিও আমার দুঃখে দুধে ঝাঁপ মারে। বাকিটা মুখে যায়। হঠাৎ গাজর বন্ধুর কথা মনে পড়ল। আমি চিল্লাই কইলাম, আম্মু, আমারে গাজর দাও।
- এসে নিয়ে যা। আমি কাজ করতেসি।
এখন নামতে ইচ্ছে করতেসে না। তাই যেভাবে পাউরুটি খাইতেসিলাম, ওভাবেই খাইতে লাগলাম। ক্রাশের জ্বালায় জীবন একেবারে ত্যানা ত্যানা।
চলবে…
এখন নামতে ইচ্ছে করতেসে না। তাই যেভাবে পাউরুটি খাইতেসিলাম, ওভাবেই খাইতে লাগলাম। ক্রাশের জ্বালায় জীবন একেবারে ত্যানা ত্যানা।
দুপুরে খেয়েই শুয়ে রইলাম। বিকালে আর যাওয়া হইলো না। বলতে গেলে আম্মাই যাইতে দিল না। কত সাধ ছিল। ক্রাশের বাসায় যামু। তা আর হইল কই? মুখ বোঁচা করে একটা গল্পের বই নিয়ে বসে রইলাম। হেইডি। বইটা এই নিয়ে দশবার পইড়া ফেলসি। আবার পড়তেসি। নিজেকে হেইডির মতো মনে হইতেসে। হেইডি শহরের বাড়িতে বন্দী ছিল আর আমি নিজের রুমে। দাঁড়া, এই খাঁচা থেকে আমি বের হমুই। কেউ আমারে আটকাইতে পারবো না। আমি মাত্র পাটা নামাইতে ছিলাম। হঠাৎ আম্মার ডাক, ছোঁয়া, পা নামাবি তো খবর আছে। আমি আশেপাশে তাকাই ভাবলাম সিসি ক্যামেরা লাগাইসে নাকি! পরে দেখি আম্মা দরজার সামনে দাঁড়াই আছে। আমি আবার পা উঠাই ফেললাম। বইটা চোখের সামনে মেইলা ধইরা মনে মনে কইলাম, জামাই, আমারে নিয়া চলো। আর ভালা লাগে না।
একটু পরে আম্মারে অনেক বুঝাইয়া সুঝাইয়া বারান্দায় আইসা বসলাম। যাক অন্তত এক পলক পরাণ পাখিটা রে দেখমু। অনেকক্ষণ খেলা দেখলাম কিন্তু ক্রাশ তো নাই। এই আসবো, এই আসবো কইরা বিকাল গড়াই সন্ধ্যা হই গেল। আমি মশার কামড় খাইয়া বইসা আছি। আম্মা ভেতর থেইকা চিল্লাইতেসে, তুই ভেতরে আসবি? নাকি ডেঙ্গু হয়ে কয়েকমাস বিছানায় পড়ে থাকার ইচ্ছা আছে? শুনেই আমি ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিলাম। সত্যিই যদি তাই হয়!!! ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বিছানায় এসে বসলাম। মনটা খারাপ। আজকে কিছুতেই ক্রাশরে দেখতে পারতেসি না।
সাতটার দিকে কলিং বাজল। আমি তখন হেইডি একবার পড়া শেষ কইরা ভাবতেসি আবার পড়মু কি না। আম্মা গিয়া দরজা খুলল। গলার স্বর শুইনা আর থাকতে পারলাম না। বিছানা থেকে ল্যাংচাইতে ল্যাংচাইতে বসার ঘরে চলে আসলাম। আন্টি জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো, ছোঁয়া?
- ভালো। (মনে মনে) আর কেমন আছি। আপনার পোলারে না দেইখা আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত।
- তুমি বলেছিলে আসবে। দেখলাম আসোনি। ভাবলাম পায়ের অবস্থা খারাপ কি না।
- না আন্টি, আমি ঠিক আছি।
- ভাবি, মেয়েটা যে কি করে না। পায়ের হাড় একটু নড়ে গেছে। প্লাস্টার করিয়ে আনিয়েছে ওর আব্বু। ডাক্তার বলেছে বেড রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
- সে তো ভালো কথা।
- ভালো কথা তো ঠিক কিন্তু মেয়ে কি কথা শোনে? দিনে একশবার ওয়াশরুম যাবে।
- আম্মু……
হায় হায় রে!!!! শ্বাশুড়ির সামনে আমার মান সম্মান সব ডুবাই দিল!!! আম্মার তো থামার নামই নাই। বলতেই আছে।
- একবার বারান্দা যাবে। একবার শেলফের কাছে যাবে। একবার এখানে যাবে আবার ওখানে যাবে। কোথাও স্থির হয়ে বসার মেয়ে নাকি।
- আরে, এই বয়সে এমন ছটফটে হয়। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তবে রেস্ট নেবে তাহলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।
- জ্বি আন্টি। (মনে মনে) লাভ ইউ শ্বাশুড়ি আম্মা।
- ও… তুমি না বড়া খেতে চেয়েছিলে। তাই বানিয়ে এনেছি।
- শিখতেও তো চেয়েছি।
- কিহ্!!!! যে মেয়ে রান্নাঘরে যেতে চায় না সে বড়া বানাতে চাইছে।
আম্মা, দোহাই তোমার। আমারে আর ছোট করিও না। তাইলে একসময় অদৃশ্য হই যামু। আর দেখতে পাইবা না। আমি সরমে লাল হইয়া খাঁড়াই আছি। আন্টি আরও কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, ভালো হলে বাসায় আসতে। আমি তো আটাইশ দাঁত বের করে দেখাইলাম। এই ব্যাপারে আমি এক পায়ে খাঁড়া।
একদিন পরই আমার প্লাস্টার খুলে ফেলল। আমি হাজির ক্রাশের বাসায়। বিকাল বেলা। তাই ক্রাশ নাই। আমি আন্টির থেকে আপাতত চা বানানো শিখলাম। তারপর আম্মা আমাকে দমাই রাখলো এই বইলা, যদি আমি বান্দরের মতো লাফালাফি করি তবে ঘরে বাইন্ধা রাখবো। আমিও চুপ কইরা ঘরে পইড়া রইলাম। অবশেষে আমার পা সারলো।
.
.
.
.
কয়দিন পর স্কুল থেকে আইসা শুনলাম চেরির বাসায় মেহমান আসছে। আমার সন্দেহ হইল। তাই বিকালে একটু সাজুগুজু কইরা হাজির হইলাম পাশের বাসায়। গিয়া দেখি আমার সন্দেহ ঠিক। শুঁটকি মাছের পোনা আসছে। তার সাথে দুইটা পোলা। আমার ক্রাশ তাদের লগে সোফায় বইসা কথা বলতেছিল। আমি নক করতেই সে দরজা খুলে বলল, তুমি? আমি কিছু না বলে ঢুইকা পড়লাম। বললাম, আপনার নাকি ঠান্ডা লেগেছে। তাই দেখতে এলাম। প্রতিবেশি হিসেবে তো একটা দায়িত্ব আছে। তাই না? ক্রাশ আমার দিকে এমন কইরা তাকাই আছে যেন আমি আজব চিড়িয়া আকাশ থেইকা টুপ কইরা পড়সি তাদের বাসায়। আন্টি রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কে রে?
- আম্মু, গাজরের হালুয়া এসেছে।
আমি রেগে তার দিকে তাকাইলাম। ফের গাজরের হালুয়া!!!! ওর বন্ধুরা শুনে হাসতে লাগল। মেজাজ সেই লেভেলের গরম হইতেসে। আমি গটগট করে হেঁটে রান্নাঘরে আন্টির কাছে চলে গেলাম। আন্টি আপেল কাঁটছে। আমি যেতেই বললেন, কি খবর ছোঁয়া মা। পায়ের কি খবর?
- ভালো, আন্টি। চা বানাবেন?
- হুম।
- আন্টি, আমি বানাই? ঐদিন যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছেন।
- বানাবে? বানাও। আমি এগুলো দিয়ে আসি।
- আচ্ছা।
আন্টি নাস্তা দিতে চলে গেলেন। আমি চা বানানোর জন্য দুধ দিলাম চুলায়। এমন সময় কেউ একজন বলল, তুমি এখানে এতোবার আসো কেন? আমি তাকাই দেখলাম শুঁটকি খাঁড়াই আছে। আমি পাত্তা দিলাম না। গান ধরলাম, পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়। সে কাছে এসে বলল, এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না, এইটুকু পুঁচকে মেয়ে, নাক টিপলে দুধ বের হবে, আমাকে পাগল বলছো।
- আমি কি কাউকে ইঙ্গিত করেছি? আমি তো গান গাইছি।
আমি চা পাতা আর চিনি দিয়া কাপ পিরিচ ধুতে গেলাম। সে যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়াই একটু পরে চলে গেল। আমি মনের আনন্দে চা ঢেলে নিয়া গেলাম বসার ঘরে। মনে রঙ লাগছে। আজ নিজে হাতে বানানো চা ক্রাশরে খাওয়ামু। আমি সবাইকে চা দিলাম। আন্টি রান্নাঘরে গেলেন আবার। আমি দাঁড়াই আছি। শুঁটকি কইল, আজকে গাজরের হালুয়া আমাদের জন্য চা বানিয়েছে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে কইলাম, আমার নাম গাজরের হালুয়া না। ছোঁয়া। চাঁদনি মেয়েটা পাত্তাও দিল না। সবাই চা মুখে দিতেই উৎসুক চোখে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন হইসে? কারো মুখে কোনো কথা নাই। একটু পরে ক্রাশ বলল, নিজেই খেয়ে দেখো। আমি এত কিছু চিন্তা না কইরা ক্রাশের হাত থেকে কাপ নিয়ে ঢকঢক করে পুরো চাটা খাইয়া ফেললাম। তারপর আমি শ্যাষ!!!! আমার হূদয়টা খান খান হইয়া গেল চায়ের স্বাদে। কাপটা রাইখা কইলাম, আমি বাসায় যাই। আমার কাজ আছে। বলেই দৌঁড়। আসার সময় শুনলাম কেউ বলতেসে, মেয়েটা কেমনে চাটা খেল!? আমি মনে মনে কইলাম, ক্রাশের ঠোঁটের ছোঁয়া থাকলে লবণ মেশানো চাও এই ছোঁয়ার কাছে মধুর থেকেও মিষ্টি লাগবে।
বাসায় এসে মধুর রিয়েকশান বের হইতে লাগল। ইচ্ছা মতো বমি করলাম। বমি শেষে ক্লান্ত শরীরটা বিছানাই দিয়া মনে মনে বললাম, এই কাজ নিশ্চয়ই ঐ শুঁটকির। ইস্, আমার এত শখের চাটায় লবণ মিশাই নষ্ট কইরা দিল। আমি চোখ বন্ধ করে আছি, আম্মা সন্দিহান চোখে এসে আমার কাছে বইসা বলল, কি হইসে রে তোর?
- মাথা ঘুরাই বমি হইসে।
আম্মা শুইনা আঁতকে উইঠা কইল, কি বলিস!? আমিও কইলাম, হ, এখন কি টক খাইতে দিবা? আমার কথা শুইনা আম্মা ওখানেই আইটকা গেসে। আমি বিরক্ত হই আবার কইলাম, ধুর বাবা, কি হইসে? আরে, আমি একগাদা লবণ চা খাইসি। তাই এই অবস্থা। তুমি কি মনে করসিলা? আমি ইয়ে?
মুখ দিয়া আর শব্দটা বাহির করলাম না। আমার কথা শুনে আম্মার মনে হয় রুহ ফিরে আসছে। আমাকে বলল, এমন চা কোথা থেকে খাইলি?
- খাইসি এক জায়গা থেকে। সব হইসে ঐ শুঁটকির জন্য।
- শুঁটকি আবার কে?
- তুমি চিনবা না। এখন কি খাওয়া যায় সেটা বলো। মুখ একেবারে নুনে তেেতা হয়ে গেছে। আম্মু, আব্বু আসে নাই?
- না, কেন?
- আব্বুকে বলো না জিলাপি আনতে।
- এখন? না না। দেখবি পরে নিজেই দশটা খেয়ে ডায়াবেটিস বাড়াই রাখসে।
- তুমি আনতে বলবা না আমি আবার বমি করমু?
আম্মা বিরক্ত হয়ে উঠে বলল, যা খুশি কর। বাপে ঝিয়ে একেবারে জ্বালাই খাইলো।
চলবে…
- তুমি আনতে বলবা না আমি আবার বমি করমু?
আম্মা বিরক্ত হয়ে উঠে বলল, যা খুশি কর। বাপে ঝিয়ে একেবারে জ্বালাই খাইলো।
.
.
.
.
আমি মনের আনন্দে জিলাপী খাইতেসি আর ক্ল্যান্ডারের সামনে দাঁড়াই আছি। মনে মনে হিসাব কষতেসি। আজকে মাসের তেইশ তারিখ। আগামী মাসের মাঝামাঝি আমার প্যারা মানে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। আর আমি যদ্দুর জানি ক্রাশেরও এইচ এস সি পরীক্ষা। আল্লাহ, আমার ক্রাশ যাতে ভালো করে। আমি মনে এই দোয়া করতেসি আর আম্মা আইসা কইল, তোর পরীক্ষার রুটিন দিসে? আমি মনোযোগ দিয়ে ক্ল্যান্ডার দেখতে দেখতে কইলাম, হুম।
- ঝুলাস নাই যে?
- ঝুলাবো।
আমি আঙুল চুষতেসি আর তাকাই আছি। আম্মা বলল, হাতটা মুখ থেকে নামা। নইলে পরীক্ষা দিতে গেলে আর আঙুল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
- আরেকটা খাবো তো।
- আরো একটা!?
- হুম।
- এই নিয়ে কয়টা জিলাপি খাইছিস?
- মাত্র পাঁচটা।
- পাঁচটা কম? এভাবে খাইলে তো বাপের মতো ডায়বেটিস রুগী হয়ে যাবি।
আমি আস্তে আস্তে কইলাম, ডায়বেটিস রুগী হই গেলে তো ক্রাশ আমার দিকে ফিইরা তাকাইবো না। থাক, আর খামু না।
- কি বলিস বিড়বিড় করে?
- কিছু না। তুমি জিলাপি ফ্রিজে তুলে রাখো। পরে খাবো।
আম্মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল। আমি রুটিন ঝুলাইলাম। আজকে থেকে ঠিকমতো পড়তে হবে। শুনছি আমার ক্রাশ নাকি সেই লেভেলের ভালো স্টুডেন্ট। তার বউ হিসেবে তো আমাকেও ভালা করতে হবে। এবার আমি ফার্স্ট হয়ে ছাড়মু। না হলে আমি চেরির বউ না।
পরের সপ্তাহের শুক্রবার আর ক্রাশবার হইলো না। আম্মা কাপড় ধোয় নাই। কিন্তু আমি ছাদ থেকে ঘুরে আসছি। সে ছিল না। তাইলে মনে হয় ধুমাইয়া পড়তেসে। আমারেও পড়তে হবে। আমি তাড়াতাড়ি নাইমা গেলাম। এখন আমি রাত দিন পড়ি। পড়ার আগে ক্রাশের বোতামটারে একটা চুমু দিই। আম্মা আব্বা আমার পড়ার গতি দেইখা খুশি হই গেল।
পরের পুরা মাস আমার সেই খাটুনি আর প্যারা গেল। আমি সেই রকমের পরীক্ষা দিসি। আমারে এবার থামায় কে। শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাসায় আইসা দেখি মিষ্টি খালা (আমি ডাকি) আর খালু এসে বসে আছে। তার সাথে মুনতাহা আর সানজিদা আপু। আমি এসে ওদের দেখে লাফাইতে লাগলাম। আমার আব্বু আম্মুর বিয়েতে নানা নানু দাদা দাদু কারোরই মত ছিল না। তাই বিয়ের পর থেকে ওনারা আম্মুর মুখ পর্যন্ত দেখতে চান নাই। তাই আমিও জন্মের পরে নানা নানু দাদা দাদু কাউকে দেখতে পাই নাই। শুধু দাদা মারা যাওয়ায় আব্বু গেসিলো। আমাদের নিয়ে যায় নাই। কিন্তু আমার মিষ্টি খালার সাথে আমার আম্মুর খুব ভালো যোগাযোগ ছিল। এখনও আছে। মিষ্টি খালা আর আম্মু প্রাণের বোন। তাই হয়ত ছাড়তে পারে নাই। আমি ফ্রেশ হয়ে আইসাই সুখবর শুনলাম। সানজিদা আপুর বিয়া। শুইনাই মন ডিংকা চিকা নাচ দিল। পরশু নাকি বিয়া। আমার পরীক্ষা দেইখা আম্মু বলে নাই। এখন যাইতে হবে। পুরা পরিবার ঐদিনই রওনা দিলাম। দিন চার ইচ্ছা মতো নাচ গান কইরা ফিরলাম। আমার জ্বালায় আব্বা আম্মা থাকতে পারলো না। বিয়ে শেষ হইতেই আমার মন আর টিকলো না। বৌভাতের দিনই চলে আসলাম বাসায়। আমি তো আবার এখন বাসা ছাড়া দুই মিনিটও টিকতে পারি না। বাসায় যতক্ষন থাকি চোখ সব সময় দরজার কাচে শেটে রাখি। ক্রাশ কখন যায়। কখন আসে। সব সময় দেখতে থাকি। কবে যে তার পরীক্ষা শেষ হইবো। এখন আন্টিও কম আসেন। আমি যাই মাঝেমধ্যে।
আজকে গেলাম দুপুরে খেয়ে। গিয়ে দেখি আন্টি কি যেন বাটতেসে। দরজা খুলে একটা হাসি দিয়েই রান্নাঘরে চইলা গেলেন। আমিও পিছু পিছু গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কি বাটছেন?
- কুমড়ার বিচি।
- ও, কি হবে এটা দিয়ে?
- মাছের ডিম যেভাবে রান্না করে ওভাবে রান্না করবো।
- ও।
আমি মনে মনে কইলাম, জীবনে রান্নাঘরে গেলাম না। মাছের ডিম কেমনে রাঁনধে ওইটাই জানি না। কুমড়ার বিচি তো পরের কথা। আন্টি বললেন, ছেলেটার অসুখ, কিছু খেতে পারে না। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে কইলাম, কি হইসে?
- ভেতরে ভেতরে জ্বর।
- এক কাজ করেন। নিম পাতার রস খাওয়ান। আম্মু বলে এটা নাকি অনেক উপকারী।
- ছেলে খাবে?
- খাবে না মানে? তার না পরীক্ষা? ভালো থাকতে হলে খেতে হবে। না খেলে আমি আছি আন্টি। জোর করে খাইয়ে দেবো।
আমি নিমপাতা যোগাড় করে ব্ল্যান্ড করে নিলাম। আন্টি বললেন, দেখো পারো কি না। আমি খুশিতে মনে মনে চিনা হাসি দিতেসি। ঐ চাঁদনীর লগে পিরিত আমি এই নিমপাতার রস দিয়া ধুইয়া দিমু। আমি গ্লাস নিয়ে তার সামনে হাজির হইলাম। আমাকে দেখে সে বই থেকে চোখ তুলে তাকাল। ইশারাই জিজ্ঞেস করল, কি?
- শরবত। আন্টি দিয়েছেন। আপনি খাওয়ার জন্য।
সে উঁকি মেরে বলল, ইস্, নিমপাতার রস!!! খাবো না। আমি রাগ দেখাইয়া কইলাম, আপনি খাবেন না তো আমার শ্বশুর আব্বা খাবে। সাথে সাথে জিভ কাটলাম। সে ভ্রূ কুঁচকায় বলল, কি বললা তুমি?
- কিছু বলি নাই। খাবেন নাকি ঘাড় ধরে খাওয়াবো?
- এত কষ্ট করার দরকার নাই। একটা শর্তে খাবো।
- কি?
- তোমাকে অর্ধেক খেতে হবে।
সাথে সাথে মুখ বাংলার পাঁচ হইয়া গেল। আল্লাহ গো!!! কি কয়!!!! নিমপাতা আমার জন্মের শত্তুর। কিন্তু ক্রাশের অসুখ। তার উপর পরীক্ষা চলতেসে। কি আর করা! নাক টিপে এক নিঃশ্বাসে পুরা অর্ধেক খাইয়া তার দিকে বাড়াই দিলাম। সে উদাস ভাব করে কইল, এটা দিয়ে আমি কি করব? তিতায় গলা দিয়ে স্বর বের হইতেসে না। তবু কইলাম, খান।
- তোমার মুখ দেয়া জিনিস আমি খাবো না।
আমি গ্লাস হাতে বেকুব হই গেলাম!!! এ্যাঁহ্, খাবে না। ঐ দিন আমার খাওয়া গাজরের হালুয়া খাইসে যে তখন মনে ছিল না? আসছে, এখন খাইবো না। আমি বললাম, আমি অন্য একটা গ্লাস আনছি। আমি নিমের গ্লাসটা রেখে বেরিয়ে গেলাম। এসে দেখি নিমের গ্লাস খালি! আমি আবার বেকুবের মতো দাঁড়াই রইলাম। সে শুয়ে আছে চোখ বন্ধ কইরা। মেজাজটা সেই খারাপ হইল। আমি গ্লাস নিয়ে চইলা গেলাম রান্নাঘরে। আন্টি জিজ্ঞেস করলেন, খেয়েছে?
- জ্বি, আন্টি।
- ভালো কাজ করেছ। এবার দেখি কি হয়।
- আন্টি আমাকে রান্নাটা শিখিয়ে দেবেন?
- আমার তো প্রায় হয়ে এসেছে। খুবই সিম্পল। প্রথমে কুমড়োর বিচিগুলোর খোসা ছাড়িয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখবে। তারপর ওগুলো বেটে নেবে। ভাজির কড়াইয়ে পেঁয়াজ কেটে ভাজি করে তাতে লবণ, হলুদ, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, টমেটো সব দিয়ে কসিয়ে নেবে। এর মাঝে বাটা কুমড়োর বিচি পানি দিয়ে গুলে নেবে যাতে কোনো চাক না থাকে। তারপর ওগুলো কড়াইয়ে দিয়ে দেবে। সেগুলো ফুটতে থাকলে একটা ডিম ফাটিয়ে দিয়ে দেবে। এরপর লবণ দেখে পানি শুকিয়ে আসলে নামিয়ে ফেলবে। সোজা না?
সব শুনে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে কইলাম, আমার কিছুই মাথায় ঢোকেনি, আন্টি। আন্টি হেসে বললেন, আচ্ছা, আরেকদিন শিখিয়ে দেবো।
- ঠিক আছে আন্টি। আমি ডায়রী নিয়ে আসবো। সব তুলে রাখব। আজকে আসি।
- আচ্ছা।
আসার সময় আবার ক্রাশের রুমে গেলাম। সে বাচ্চাদের মতো ঘুমাইতেসে। লোভ সামলাইতে পারলাম না। তার কপালে একটা চুমু দিয়ে দিলাম। তারপর আমি চইলা আসলাম। রান্নায় যে এত খাটুনি তা কেমনে জানমু। ক্রাশ তোমারে বালুবেসে জীবন শ্যাষ!
.
.
.
.
আজকে ক্রাশের পরীক্ষা শেষ। প্র্যাকটিকাল না কি ওটাও শেষ। আমার ইচ্ছা করতেসে ক্রাশের কলেজ যামু। গাজর খাইতে খাইতে চিন্তা করতে লাগলাম কি করমু। তখনই মাথায় একটা বুদ্ধি আইলো। আমি আম্মারে গিয়া কইলাম, আম্মু, আমি একটু মার্কেট যামু। আম্মা আমার দিকে পুলিশের মতো তাকাই বলল, ক্যান?
- একটা জিনিস কিনতে হবে।
- কি জিনিস?
- আরে বাবা, এতো জেরা করতেসো কেন? চুরি তো করতে যাইতেসি না। চলে আসমু। রিদিকে নিয়ে বের হমু।
- আচ্ছা যা।
আমি দৌঁড়ে রিদিকে ফোন দিলাম। কইলাম, ওই, তাড়াতাড়ি রেডি হ। মার্কেট যামু।
- এখন? এই দুপুরে? আমি কালো হই যাবো।
- তোর কালোর খ্যাঁতা পুড়ি। তুই বের হবি না আমি জুতার কালি আনমু তোর জন্য।
- ছিঃ ছোঁয়া, তোর বেস্টুকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে পারিস না।
- তুই আর একটা কথা বাড়াইলে শুধু ব্ল্যাক না হোয়াট ব্লু গ্রীন সব মেইল করমু। তুই রেডি হ। আমি দশ মিনিট পরে ফোন দিতেসি।
আমি ফোন কাইটা দিলাম। খুশি মন থেকে উপচাইয়া উপচাইয়া পড়তেসে। আমি সুন্দর করে একটা লাল জামা পরে রেডি হইয়া নিলাম। একটু সাজুগুজুও করলাম। ক্রাশের সাথে দেখা করতে যামু বলে কথা।
চলবে…
খুশি মন থেকে উপচাইয়া উপচাইয়া পড়তেসে। আমি সুন্দর করে একটা লাল জামা পরে রেডি হইয়া নিলাম। একটু সাজুগুজুও করলাম। ক্রাশের সাথে দেখা করতে যামু বলে কথা।
আমি মার্কেটের রাস্তায় না গিয়া কলেজের রাস্তা ধরলাম। রিদি জিগাইলো, ঐদিকে কই যাস?
- একটা জায়গায় যামু।
- কোথায়?
- গেলে দেখবি।
আমরা দেড়টার সময় কলেজ গেটে পৌঁছাই গেলাম। রিদি বলল, এখানে আসলি কেন? আমার চোখ তখন ক্রাশরে খুঁজতেসে। বললাম, দেখতে আসছি। কলেজটা নাকি অনেক সুন্দর। ভাবতেসি এখানে পড়মু। মনে মনে কইলাম, ধুর বাবা, এত বড় কলেজ, ক্রাশরে দেখতেই পাইতেসি না।
এমনসময় রিদি বলল, দেখ, ওখানে কিসের ভীড়। কারো কিছু হইলো নাকি!? চল তো দেখি। রিদি আমারে টাইনা নিয়া গেল। আমি অনিচ্ছার সত্ত্বে গেলাম। দুইজনে ভীড় ঠেলে ঢুকতেই আমি থমকে গেলাম। আমার হূদয় ভেঙে শতটুকরা হইয়া গেল। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা। এ আমি কি দেখতেসি!? এইটা দেখার জন্য আমি আজকে আসছি? আমি আগাইতে পারলাম না। চোখের পানির প্রথম ফোঁটা পড়ার আগেই ভীড় ঠেলে বেরিয়ে দৌঁড় দিলাম বাসার দিকে। তখনই সবার উল্লাস ধ্বনি। আমি কান চেপে ধরে চলে আসলাম৷ আমি শুনতে চাইনা।
বাসায় এসে সোজা নিজের রুমে। আম্মা অনেকবার ডাকল। আমি দরজা খুললাম না। আমি দরজার পাশে ফ্লোরে বইসা আছি। হাতে ক্রাশের ছবি। একদিন চুরি কইরা নিয়ে আসছিলাম ছবিটা। ইচ্ছা করতেসে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলি। কিন্তু সাহস হইল না। কেমনে পারল সে? তাহলে তার ক্রাশ চাঁদনীই ছিল? আজকে চাঁদনী ক্রাশরে প্রপোজ করসে আর সে ফুলটা হাতে নিয়ে নিসে। তারমানে সে প্রপোজ একসেপ্ট করসে৷ হায় রে!!! আমি কোন স্বপ্নের জগতে আছি? নাহ্ আর না। বহুত পাগলামি করসি আর না। তবুও খুব কাঁনদন আসতেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ইচ্ছে মতো কাঁনলাম। কাঁনতে কাঁনতে ভিজা বিড়াল হই গেলাম। মনটা হালকা হইতেই ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে বাইর হইলাম। দুপুরে খাই নাই। আম্মা নিজের রুমে। আব্বা মনে হয় নাস্তা আনতে গেসে। আমি বের হয়ে দেখলাম টেবিলে বাটিতে মিষ্টি রাখা। আমি বাটিটা নিয়ে সোফায় বসে টিভি ছেড়ে দিলাম। মাত্র একটা মিষ্টি মুখে দিয়ে আরেকটা নিসি তখন আম্মা টিভির আওয়াজে রুম থেকে বের হয়ে কইল, খালি পেটে মিষ্টি খাইতেছিস কেন?
- আম্মু এগুলা কিসের মিষ্টি?
- ভাবিরা কয়দিন পর লন্ডন চলে যাবে। ওখানে নাকি ছেলেকে পড়াবে। তাই মিষ্টি দিয়ে গেছে।
শুনে আর দ্বিতীয় মিষ্টিটা গলা দিয়ে নামল না। ওটা মাঝ পথেই আইটকা গেল। আম্মা বলতেই আছে, ওর বাবা লন্ডনে থাকে। ছেলে ভালো পড়াশোনা করছে। এখন শুধু রেজাল্ট দিলেই লন্ডনে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে দেবে। আমি তো…… আম্মা আর কথা শেষ করতে পারল না। বাটি ভাঙার শব্দে চমকে উঠল। আমার হাত থেকে মিষ্টির বাটি পইড়া সাত আট টুকরা হই গেসে। রসে ফ্লোর মাখামাখি। আমি আস্তে করে কইলাম, সরি, আম্মু। তারপর গিয়া রুমের দরজা বন্ধ কইরা দিলাম। আম্মা বহুবার ডেকে কইল, ছোঁয়া কি হইসে তোর? দরজা খোল। আমার উত্তর দেওয়ার সময় নাই। সারাদিন প্রায় না খাওয়ার মতো। এখন মিষ্টি পড়াতে বমি হইতেসে। আমি বমি করে ওয়াশরুম থেকে বের হইলাম। কেন জানি মাথা ঘুরাইতেসে। সব আবছা আবছা। আমি শুয়ে পড়লাম বিছানায়। তারপর আর কিছু মনে নাই।
.
.
.
.
চোখ খুলে দেখি আম্মা আব্বা আমার দুইপাশে বইসা আছে। পায়ের দিকে তাকাই দেখলাম ব্যান্ডেজ। বাটির ভাঙা কাচে কখন পা কাটছে খেয়াল নাই। রুমের দরজা ভাঙা। হাতে স্যালাইন। শরীর দুর্বল। আমি উইঠা বসতে লাগলে আব্বা আম্মা দুজনে উদ্বিগ্ন হইয়া গেল। আমারে হেলান দিয়ে বসাইল। আম্মা জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে?
- শরীর দুর্বল লাগছে।
- সারাদিন না খাওয়া। লাগবে না।
- কি হইসে আম্মু? দরজা ভাঙা।
- কি আর হবে? তুই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি। তুই এত ডাকেও যখন সাড়া দিচ্ছিলি না তখন ভয় পাই গেসিলাম। তোর আব্বু এসে দরজা ভেঙে দেখে তুই বিছানায় পড়ে আছিস। তারপর ডাক্তার ডেকে নিল। ডাক্তার বলছে না খেয়ে শরীর দুর্বল হয়ে এই অবস্থা।
আম্মা বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলল, কি হইসে তোর। এমন অনিয়ম করিস কেন? তোকে নিয়ে কত চিন্তা হয়। তোর কিছু হয়ে গেলে আমরা কি নিয়ে বাঁচবো। আমি আম্মার চোখের পানি মুইছা কইলাম, ওরে আমার কিউট আম্মু রে, এভাবে কেউ কাঁদে? আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কিছু কি হইসে? আমি বললাম, কই না তো। আসলে আজকে কেন জানি খুব মন খারাপ হইসে তাই এমন… আব্বা আমি কথা শেষ করার আগেই বলল, বুঝলে শিমু, আমাদের মেয়ে অনেক বড়ো হয়ে গেছে। দুঃখ লুকাতে শিখে গেছে। এখন কিছু খাওয়াও। আমি কিছু বললাম না। আম্মা বলল, তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি আজকে ওর কাছে থাকবো। আব্বা চলে গেল। আম্মা গেল খাবার আনতে। আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। মনে মনে বললাম, কিসের ক্রাশ? কার জন্য নিজের ক্ষতি করতেসি? আমি আব্বা আম্মার আদরের একমাত্র মেয়ে। আমাকে নিয়ে তাদের জগত। আর আমি কিনা এমন একজনকে নিয়ে জগত গড়তেসি যে কখনো আমার ছিলই না। আমি নিজের চোখের পানি মুছে বললাম, আজ থেকে আমার জগত আমার আব্বু আম্মু। আর কেউ না।
আম্মু খাবার এনে খাইয়ে দিল। পা মেঝেতে রাখতে পারতেসি না। ভালোই কাঁটছে। রক্তে বিছানার চাদরও ভিজে গেসিল। আম্মা ওটা পাল্টাইলো। আমি ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। আম্মাও আমাকে জড়াই ধরে শুয়ে পড়ল। আমার চোখে ঘুম নাই। অন্ধকারে বাইরে থেকে আসা আলো খেলতেসে, ছুটে বেড়াইতেসে জানালা থেকে দেয়াল পর্যন্ত। আমি তাকাই আছি। আমার চোখে ভাসতেসে ক্রাশের সাথে দেখা হওয়ার সময়ে ওর লাল হয়ে থাকা মুখখানা। তারপর আর ভাবলাম না। ডুব দিলাম ঘুমের সাগরে।
.
.
.
.
সকালে দশটায় ঘুম থেকে উঠলাম। উঠতে ইচ্ছে করতেসিলো না। তাও উঠলাম। কালকের কথা মনে পড়তেই কেন জানি পাগলের মতো হাসলাম। তারপর ফ্রেশ হইয়া মাথা আঁচড়ানোর জন্য চিরুনিটা নিলাম। চোখ পড়ল বোতামটার দিকে। একবার ভাবলাম খুইলা ফেলি। আবার ভাবলাম না থাক। মাথায় একটা বেণী বানিয়ে খোঁপা করে ফেললাম। শরীরের আড়মোড়া ভেঙে মাত্র রুম থেকে বের হইতেসি এমন সময় দেখলাম বসার ঘরে আন্টি, ক্রাশ আর একটা লোক বসা। বোধ করি লোকটা ক্রাশের বাবা। ধুর, দুইমাস হইয়া গেল এখনও ছেলেটার নামই জানি না। এখন আর ওর নাম ক্রাশ না। কি ডাকমু? হ্যাঁ, চেরি ফল। তাই ভালা। আমি আসতেই আব্বা আমারে ডাকল৷ আমি এসে বসতেই লোকটা বলল, কেমন আছো? আমি উত্তর দিলাম, ভালো। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে চেন? আমি চেরির দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললাম, ওনার বাবা। আঙ্কেল হেসে বলল, একদম ঠিক। কালকে দেশে এসেছি। তোমার আন্টির কাছে তোমার গল্প শুনতে শুনতে আর তোমাকে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি হাসলাম। ক্রাশ থুক্কু চেরি ফল আমার দিকে তাকাই আছে। হয়ত ভাবতেসে আমি কিসু কমু। কইলাম, আঙ্কেল, আমার না একটু কাজ আছে। আমি রুমে যাচ্ছি।
- আচ্ছা।
আমি রুমে আইসা বিড়বিড় করতে লাগলাম। আম্মার ফোন নিয়া কানে এয়ারফোন গুজতে গুজতে কইলাম, মনে হচ্ছে যেন বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে আসছে। আমি গান শুনতে লাগলাম। গানও ভালো লাগতেসে না। আমি এয়ারফোন খুলে শুনলাম আম্মা বলতেসে, এখনো তো সময় হয়নি। আমরা ভেবে দেখবো। ও… কালকে আমার মেয়ের জন্মদিন। আপনারা আসবেন কিন্তু। হয়ত বেশি বড়ো হবে না। ছোটখাটো করে একটু করবো। এই। ওনারা রাজি হয়ে গেলেন। ওনারা চলে যাওয়ার পর আমি আমার ফ্রেন্ডদেরকে ইনভাইট করলাম। আমার কেন জানি চেরি ফলকে ইনভাইট করাটা ভালো লাগলো না।
বিকালের দিকে আম্মু বলল, আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি। আজকে হয়ত নাও আসতে পারি। তুই এক কাজ কর। রিদিকে বল এসে থাকতে।
- কোথায় যাচ্ছো?
- তোর নানাবাড়ি।
- হঠাৎ?
- শুনলাম তোর নানুর শরীর খারাপ।
- আমিও যাবো।
- আমরা যাবো আর চলে আসবো। অবস্থা খারাপ দেখলে থাকবো।
আমার কেন জানি যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না। তবুও জোর করলাম না। রিদিকে ফোন করে আসতে বললাম। রিদি বলল, আধা ঘন্টা লাগবে। আমি বললাম, আচ্ছা। চারটার দিকে আব্বা আম্মা বের হই গেল। যাওয়ার আগে আব্বা বলল, তোর আম্মুর ফোনটা রেখে গেলাম। দরকার হলে ফোন দিস।
- আচ্ছা।
আব্বা কইল, ভালো থাকিস। সাবধানে থাকিস। আমি হাসলাম। আব্বা আম্মা বের হই গেল। আমি ফোন টিপতে বইসা পড়লাম। পনের বিশ মিনিট পর কলিংবেল বাজল। আমি দরজা খুলে বললাম, এতক্ষণ লাগে? এ্যাঁ!!!! কেউ নাই। নিচে তাকাই দেখলাম একটা বাক্স। আমি বাক্সটা নিয়ে দরজা মেরে দিলাম। টেবিলে রেখে দেখলাম, উপরে আমার নাম দেওয়া। একবার ভাবলাম কে দিল এটা? আমি মাত্র বক্সটা খুলব তখন আবার কলিংবেল বাজল। আমি বক্সটা আম্মুদের রুমে রেখে দরজা খুললাম। রিদি ভেতরে ঢুকে বলল, কি অবস্থা? প্রিপারেশন কেমন?
- কিসের?
- তোর বার্থডের।
- আর অবস্থা।
- কেন? কি হয়েছে?
- কেন জানি ভালো লাগছে না। আব্বু আম্মু না থাকলে ভালো লাগে না।
- ইট'স ওকে। রিদি যখন এসে গেছে তখন আর চিন্তা নেই।
এই ওই কইরা সন্ধ্যা রাত কাটল। দশটার মধ্যে খাইয়া শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসতেছে না। রিদি তো শুতেই নাক ডাকতে শুরু করসে। হঠাৎ বাক্সটার কথা মনে পড়ল। আম্মুর রুমে গিয়া বাতি জ্বালাই বাক্সটা খুললাম। খুলে অবাক হইলাম।
চলবে…
হঠাৎ বাক্সটার কথা মনে পড়ল। আম্মুর রুমে গিয়া বাতি জ্বালাই বাক্সটা খুললাম। খুলে অবাক হইলাম। খুব সুন্দর একটা নীল সুতির শাড়ি। দেখতে জামদানির মতো। তারসাথে একজোড়া নুপুর আর এক গাছি নীল কাচের চুড়ি। সাথে একটা উড়া চিঠি পাইলাম।
' ছোঁয়া, এগুলো তোমার জন্মদিনের গিফট। আমার পক্ষ থেকে। আমি কে? জানতে চাইলে আজকে রাত সাড়ে এগারটায় ছাদে আসো। ও হ্যাঁ, তোমার নীল জামাটা আমার কাছে। তোমার প্রিয় নীল জামা। যদি জামাটা পেতে চাও তবে শাড়িটা পরে সুন্দর করে সেজে আসবে যেভাবে তুমি তোমার মনের মানুষটার জন্য সাজো।'
কে এটা? আমার জামা চোর নাকি!? আমার সাধের নীল জামাটা সেলাই করতে দিয়েছিলাম টেইলারের কাছে। কোন পোলায় নাকি নিয়ে গেছে আমার নাম করে। আমার বিশ্বাস হয় নাই। জামাটার জন্য আমার বহুত দুঃখ হইসে। কিন্তু এই জামা চোর হঠাৎ আমাকে এত সুন্দর শাড়ি দিল ক্যান! সে জানলই বা কি করে আমি চেরি ফলের জন্য সেজেগুজে বের হতাম! ভাব্বার বিষয়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, পনে এগারটা।
জামার টানে হোক বা কৌতুহলে হোক আমি রেডি হলাম। শাড়িটা সেই রকম সুন্দর। ইস্! আমারই নজর লাগি যাইতেসে। কানে নীল ছোট দুল পড়লাম। চোখে কাজল দিলাম। হাতে চুড়ি আর পায়ে নুপুর পইরা বাইর হলাম। তাড়াহুড়ায় চুল বাঁধি নাই। আমি কেন যে এত সাজলাম তাও জানি না। হয়ত চোরের শর্ত মানার জন্য যাতে আমার সাধের জামাটা দিয়ে দেয়?
ছাদে আইসা থমকে গেলাম। ছাদে লাভ শেইপ করে মোমবাতি জ্বালানো। তার মাঝে C + A দেওয়া। সি না হয় আমি। এ টা কেডা? আমি এদিক ওইদিক তাকাইলাম। কেউ নাই। যেই না আমি ফিইরা যামু কে যেন আমার চোখ বাঁইধা দিল। আমি কইলাম, কে? গলা একটু কাঁইপা উঠল। ভয় লাগতেসে। নিজে মনে মনে নিজেরে গালি দিতেসি। খাই দাই কাম ছিল না? একটা চোরের কথায় ছাদে চলে আসলাম। আমি কে কে করতেসি দেখে চোখ বেঁধে দেওয়া মানুষটি শসসসস্ করে শব্দ করল। তারপর আমাকে কোনদিকে টেনে নিয়ে দাঁড় করাইলো। আমার মনে হল আমাকে পর্যবেক্ষণ করতেসে। তারপর আমার খুব কাছে এসে আমার দুই গালে চুমু দিয়ে দিল। আমি বেকুব হয়ে গেলাম। আমার সারা শরীর কেঁপে উঠল। আমি চোখ থেকে কাপড়টা সরাতে যাবো তখন সে আমার দুইহাত পেছনে মুড়ে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলল। আমি ভয় পাওয়া গলায় আবার কইলাম, কে? সে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, লাভার ভ্যাম্পায়ার। আমি কিছু বলার আগেই সে আমার ডান পাশের কাঁধের চুলগুলো সরিয়ে চুমু দিয়া দিল। আমি ওখানেই শ্যাষ। মনে হইল সারা শরীরে কারেন্ট বয়ে গেছে। এমন অনুভূতি জীবনেও হয় নাই। তারপরই চিৎকার দিতে গেলাম। সে মুখ চাইপা ধরল। আমি ব্যাথায় কোকাইতেসি। মনে মনে বলতেসি, সত্যিই কি ভ্যাম্পায়ারের কবলে পড়লাম নাকি! মানুষ হইলে তো কামড় দিতো না। আরে হালার ভ্যাম্পায়ার ছাড়। একটু পরে সে ছাইড়া দিল। তারপর হঠাৎ পাগলের মতো আমার ঘাড়ে গলায় চুমু দিতে লাগল। আমি সহ্য করতে না পাইরা ছটফট করতেসি। সে আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, লাভ বাইট দিয়ে সিল মেরে দিলাম। আজকে থেকে তুমি শুধু আমার। আর কারো না। এই চিহ্নই তোমাকে আমার কথা মনে করিয়ে দেবে। আমার অপেক্ষায় থেকো। আই লাভ ইউ মাই লাভ বার্ড। হ্যাপি বার্থডে ছোঁয়া। নিমিষেই তার ছোঁয়া থেকে মুক্ত হয়ে গেলাম। দ্রুত চোখ খুইলা দেখি কেউ নাই। মোমবাতি গুলা আগের মতোই জ্বলতেসে। ঘাড়ে হাত দিলাম। ইস্ রে। রক্ত বের হইসে মনে হচ্ছে। হাত দিতে পারতেসি না। দ্রুত সিঁড়ির দিকে ছুটলাম। ব্যাটা বাটপার। আমার অবস্থা খারাপ করে দিসে। সিঁড়ি দিয়ে উঁকি দিলাম। কিন্তু অন্ধকারে কাউকে দেখতে পাইলাম না। হঠাৎ কুকুর একটা ডাইকা উঠল। সাথে সাথে আমার বুক কাঁইপা উঠল। সত্যিই ভ্যাম্পায়ারের কবলে পড়লাম না তো!!!
আমি দৌঁড়ে বাসায় ঢুকলাম। দরজা মেরে আম্মুর রুমে চলে গেলাম। আয়নার সামনে যেতেই আঁতকে উঠলাম। ভ্যাম্পায়ার না ছাই। আস্তো একটা মানুষ আমারে কামড় দিসে। আবার কয় নাকি লাভ বাইট। লাভ বাইটের খ্যাঁতা পুড়ি৷ একেবারে রক্ত বাইর করে ফেলসে। আমি মলম লাগাইতে লাগাইতে কাঁনতেসি আর কইতেসি, এবার আমার কি হইবো। আমি সবার সামনে কেমনে যামু!? কে আমার এত বড় সর্বনাশ করলো। এত বড় আকামটা কেডা করল? যদি ঐ হালার লাভার ভ্যাম্পায়াররে পাই আমি তার রক্ত চুইষা খামু। আম্মা গো……। আমি সব খুলে গুছাইয়া রাইখা নাক টানতে টানতে শুইয়া পড়লাম।
.
.
.
.
সকালে ঘুম থেকে জাইগা দেখি রিদি আমারে কোলবালিশ বানাই ফেলসে। আমি ঠেইলা ওরে সরাই দিলাম। সে অপর পাশ ফিইরা শুইয়া পড়ল। কালকে রাতের কথা মনে পড়তেই ঘাড়ে হাত দিলাম। বাপরে!!!! কি ব্যাথা। এখনো হাত দিতে পারতেসি না। ফুইলা ঢোল হই আছে। আমি ফ্রেশ হয়ে বের হতেই আম্মা ফোন দিল। আমি দৌঁড়ে গিয়া ধরলাম।
- কেমন আছো আম্মু?
- ভালো। তুই?
- আছি আর কি। (মনে মনে) আম্মা গো একটা মানুষ নামের ভ্যাম্পায়ার থুক্কু ভ্যাম্পায়ার নামের মানুষ তোমার মেয়ের সর্বনাশ করে দিসে।
- রিদি আছে না?
- হ্যাঁ। পড়ি পড়ি ঘুমাইতেসে।
আম্মা আমার কথা শুইনা হাসল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, নানু কেমন আছে? আম্মা মলিন মুখে জবাব দিল, আছে ভালো।
- নানা ভাই কিছু বলসে?
- নাহ্, তোর মামা, নানা কেউ কথা বলে নাই। তোকে বলছি না তোর নানার জেদ বেশি। সেই পুরানো রাগ এখনও মনের মধ্যে পুষে রাখসে।
- ইট'স ওকে আম্মু। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমরা কখন আসবা?
- নয়টায় রওনা দিবো।
- আচ্ছা। তাড়াতাড়ি আসবা কিন্তু, আমার ভালো লাগতেসে না।
- ওকে, বাবা।
- হ্যালো, ছোঁয়া মা।
- হ্যাঁ, আব্বু বলো।
- তোর কি কিছু লাগবে? কিছু আনবো?
- উম…… জিলাপী এনো।
- আচ্ছা। সাবধানে থাকিস। অপরিচিত কেউ আসলে দরজা খুলবি না। ভালো মেয়ের মতো থাকবি। সময় মতো সব কাজ করবি।
- এমন করে বলছ যেন আজকে আসবে না।
- আসবো তো। আচ্ছা আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। রাখি?
- হুম।
আব্বু ফোন কেটে দিল। আমি ফোনটা রেখে রিদির দিকে তাকাইলাম। মেয়েটা এতো কেমনে ঘুমায়!? অবশ্য আমিও তো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাই। কিন্তু কেন জানি আজকে মনটা অস্থির অস্থির করতেসে।
.
.
.
.
আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই ক্ষতটা দেখতেসি। ইস্, সবাই দেখলে কি ভাববে!? সবচেয়ে বড়ো কথা বলবটাই বা কি? নিশ্চয়ই কালকে ঐটা কোনো রাক্ষস আছিল। উফ্!!!! মলম লাগাইলাম বহু কষ্টে। হাত দিতে পারতেসি না। মলম লাগানো শেষ হইলে আমি রান্নাঘরে গেলাম। কি বানানো যায়? ভাবতেসি এমন সময় কলিং বেল বাজল। আমি খুইলা দেখলাম আন্টি। হাতের ট্রেতে কি যেন ঢাকা দিয়ে আনসে। আমি সালাম দিয়ে সইরা দাঁড়াইলাম। আন্টি ভিতরে ঢুইকা বললেন, কেমন আছো, ছোঁয়া?
- জ্বি আন্টি ভালো।
- তোমার আম্মু ফোন দিয়েছিল। বলল তারা নাকি কালকে ছিল না।
- হ্যাঁ, আন্টি।
- কোনো সমস্যা হয়নি তো?
- না, আন্টি। (মনে মনে) ও শ্বাশুড়ি আম্মা গো, কোন হালার পুত আপনার বৌমার গলার বারোটা বাজাই দিসে।
- আমাকে ডাকতে পারতে।
- আমার এক ফ্রেন্ড ছিল। এখনও ঘুমাচ্ছে।
- ও। এত গরমে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে রেখেছ কেন?
- এমনি। (মনে মনে) প্যাঁচাইসি কি সাধে? বার বার ঘষা লাইগা জ্বলতেসে। ঐ ভ্যাম্পায়র রে আমি আস্তো চিবাই খামু। ব্যাটা ফাজিলের হাড্ডি।
- তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি। তোমার জন্মদিনের গিফট।
- কি আন্টি?
আন্টি ট্রের প্লেটটার ডাকনা সরাতেই আমি বললাম, পায়েস!!! থ্যাংক ইউ আন্টি। আন্টি হেসে বললেন, তুমি নাকি পায়েস পছন্দ করো তাই ক্ষীরের পায়েস করে এনেছি। কাছে এসে বসো। আমি খাইয়ে দেই। আমি গিয়া বসতেই উনি আমাকে যত্ন কইরা খাওয়াই দিলেন। আমি কইলাম, আন্টি আপনি বসেন, আমি চা করে আনি। আন্টি হাসলেন।
আমি রুমে গিয়া রিদিকে ঠেলতে লাগলাম, এই রিদি, রিদি… ওই রিদুর বাচ্চা উঠ। রিদি চোখ ঢলতে ঢলতে কইল, কি হইসে? আমি ওরে টেনে উঠাই বললাম, ওঠ, পাশের বাসার আন্টি আসছে। সাড়ে নয়টা বাজে। তোকে এমন পড়ে থাকতে দেখলে কি কইবো। উঠ। যা ফ্রেশ হয়ে নে। আমি চা বানাইতে গেলাম। রিদি চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকাই আছে। আমি জিগাইলাম, কি হইসে?
- তুই? চা?
- তো?
- পারবি?
- না পারার কি আছে? তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। তোকেও দিবো। টেস্ট করে দেখিস।
আমি রান্নাঘরে চলে গেলাম। চা বানাই ফেললাম চটপট। এখন আমি ভালোই বানাইতে পারি। আব্বা বলসে আমি নাকি ফাটাফাটি চা বানাই। মাত্র কাপগুলো ট্রেতে রেখে চা ঢাললাম। এমন সময় ফোন এলো। ফোন নিয়ে দেখলাম মিষ্টি খালা ফোন দিসে। আমি রিসিভ করে কানে ফোন ধরে ট্রেটা নিয়ে বসার ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বললাম, হ্যালো, মিষ্টি খালা। কি হইসে? আমার হাত থেকে ট্রে পইড়া কাপগুলো টুকরো টুকরো হয়ইয়া গেল। চায়ে ভাইসা গেল ফ্লোর। কান থেকে ফোন পইড়া ব্যাটারি খুলে ছিটকে পড়ল একজায়গায়। আমি চায়ের মধ্যে বইসা পড়লাম। আন্টি দৌঁড়ে এলেন। রিদিও দৌঁড়ে আইল। জিজ্ঞেস করতেসে কি হইসে। আমি পাথরের মতো বইসা আছি। আমার জগতটা ভেঙে গুড়িয়ে গেল চোখের সামনে।
চলবে…
কান থেকে ফোন পইড়া ব্যাটারি খুলে ছিটকে পড়ল একজায়গায়। আমি চায়ের মধ্যে বইসা পড়লাম। আন্টি দৌঁড়ে এলেন। রিদিও দৌঁড়ে আইল। জিজ্ঞেস করতেসে কি হইসে। আমি পাথরের মতো বইসা আছি। আমার জগতটা ভেঙে গুড়িয়ে গেল চোখের সামনে।
এমন সময় কলিং বেল বাজল। রিদি গিয়ে দরজা খুলল। খালু আসছে। আমি তাকাইলাম ওনার দিকে। উনি আমার দিকে তাকাইতে সাহস করতেসে না। আমি আস্তে কইরা উইঠা খালুর কাছে গেলাম। বললাম, আমাকে নিয়ে যাবে? আমি যাবো। চল না খালু। আমাকে নিয়ে চলো। আন্টি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? খালু একটু ইতস্তত করে বললেন, ওর আব্বু আম্মু এক্সিডেন্ট করেছে। ওর আম্মু স্পটডেড। ওর আব্বু আইসিইউতে। যে কোনো মুহূর্তে …… খালুর ফোন এল। কথা বলে আবার সবার দিকে ফিরে বললেন, ওর আব্বুও……
- আমি তৈরী হয়ে নিই, হ্যাঁ? আব্বু আম্মু আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি না গেলে আসবে না।
রিদি এসে আমাকে ঝাঁকিয়ে বলল, ছোঁয়া, তোর আব্বু আম্মু কেউ বেঁচে নেই। একটু কাঁদ। একটু কাঁদ। আমি ওর হাত সরিয়ে বললাম, কে বলেছে আব্বু আম্মু নেই। একটু আগে আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলেছে। আব্বুটাও দুষ্ট হয়ে গেছে। বলেছে আমার জন্য জিলাপী আনবে। একদম এমন কথা বলবি না। আমি এখুনি রেডি হয়ে আসছি।
- ছোঁয়া……
আমি ওর দিকে তাকাতেই ও ভয় পেয়ে সরে গেল। আমার চোখ লাল হয়ে আছে। আমি রুমে চলে এলাম। গোসল করে সুন্দর একটা সাদা জামা পরলাম। মাথাটা বেঁধে বের হয়ে এসে বললাম, চলো খালু। এমনিতে অনেক লেট হয়ে গেছে। আব্বু নিশ্চয়ই আমার উপর অভিমান করে ফেলেছে। আম্মু বকবে। চলো চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি টেনে চললাম খালুকে। উনি আমার দিকে তাকাতেও পারছেন না, কাঁদতেও পারছেন না। আন্টি খালুর থেকে ঠিকানা নিয়ে নিলেন।
.
.
.
.
আমরা সোয়া দশটায় হাসপাতালে পৌঁছালাম। খালু আমাকে একটা কেবিনের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে মিষ্টি খালা, সানজিদা আপু, দুলাভাই, মুনতাহা সবাই কাঁদছে। আমি মিষ্টি খালার কাছে দৌঁড়ে গিয়ে হেসে বললাম, কাঁদছো কেন? আব্বু আম্মু কি তোমাদের বকেছে? মিষ্টি খালা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি জড় পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। খালা ছেড়ে দিতেই আমি কেবিনে ঢুকলাম। দুইটা বেড। সেখানে সাদা কাপড়ে ঢাকা দুটো মানুষ। একটা আমার আদরের আব্বু আরেকটা আমার দুষ্টু আম্মু। আমি আম্মুর কাছে গিয়ে বললাম, আম্মু, এই আম্মু, উঠো বলছি, না হলে কিন্তু ডিসের লাইন কেটে দিবো। তখন আবার লোক এনে ঠিক করাতে হবে। জানো, আজকে আমার হাত কেটে গেছে, দেখো রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তুমি মলম লাগিয়ে দেবে না? কি হল উঠো। আব্বু, এই যে, তুমিও উঠছো না? আমি কিন্তু জিলাপির ভাগ দেবো না। বাসায় কিন্তু ফ্রিজে মিষ্টি আছে। আম্মু তোমার থেকে লুকিয়ে রেখেছে। ওগুলোও দিবো না। ওঠো, ওঠো বলছি। আমি দুই বেডের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। মিষ্টি খালা আমাকে টেনে বের করে আনল। আমি বার বার বলতে লাগলাম, আরে দেখো আব্বু আম্মু উঠবে। আমার সাথে দুষ্টুমি করছে। খুব দুষ্ট হয়ে গেছে। আরে ছাড়ো আমায়, ছাড়ো। সানজিদা আপু আর মিষ্টি খালা আমাকে ধরে রাখল। আমি খালি বলতে লাগলাম, ছাড়ো আমাকে ছাড়ো। না ছাড়লে কিন্তু আব্বু আম্মুকে বলে দেবো। তখন ওরা খুব বকুনি দেখে। কি হল ছাড়ো। ওরা আমার কথা শুনল না। ছাড়লো না একটিবারের জন্য।
রাত আটটা। আমি ঝিম ধরে বসে আছি বসার রুমের ফ্লোরে। বিড় বিড় করছি, আমার আব্বু আম্মুকে কোথায় রেখে এলে। নিয়ে এসো। আমার ভালো লাগছে না। আমি বিড়বিড় করেই চলেছি। সবাই বসার রুমে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মিষ্টি খালা মাঝেমধ্যে মুখ চেপে কাঁদছে। খালু আর আঙ্কেল চুপ করে বসে আছেন। আন্টিও কিছু বলছে না। চেরি ফল একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সারাদিনে একফোঁটা কান্না করিনি। সবার চোখে পানি আর আমার চোখে চৈত্রের খরা।
হঠাৎ কেউ বুঝে ওঠার আগেই চেরি ফল সোফা থেকে উঠে এসে আমাকে এক টানে দাঁড় করালো। তারপরই ঠাস করে সজোরে চড় মারল। সবাই সেই শব্দে চমকে উঠল। আঙ্কেল আন্টি দৌঁড়ে এসে বললেন, এটা তুই কি করলি? আমার মুখে সাথে সাথে পাঁচ আঙুলের লাল ছাপ স্পষ্ট বসে গেল। আমি চেরি ফলের দিকে তাকালাম। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। একবার দুবার তিনবার। গলা ফাঁটিয়ে যতটায় শক্তি ধরল। তারপর ওর বুকে দুই হাত দিয়ে সজোরে মারতে মারতে বললাম, কেনো মারলে আমায়? কেন? কি দোষ আমার? কি দোষ বলো? কি করেছি আমি? যখন তোমাকে আমার জগত বানালাম তখন তোমার জগতে ছিল অন্য কেউ। আমি মেনে নিলাম। সরে এলাম তোমার জীবন থেকে। নিজের জগতটাকে নতুন করে সাজালাম আমার আব্বু আম্মুকে নিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। আমার জগতটাকে মুহূর্তে চুরমার করে দিয়ে পালিয়ে গেছে ওরা। কেন? আমি কেন? আমার সব ভালোবাসাকে কেন কেড়ে নিল এভাবে? কেন আমাকে অসহায় করে দিয়ে সবাইকে চলে যেতে হবে? আমি আর পাগলামি করবো না। বলো আমার আম্মুকে ফিরে আসতে। আমি সবঠিক করে করব। আমি আর আব্বুর লুকিয়ে মিষ্টি খাওয়ার কথা আম্মুকে বলব না। বলো আমার আব্বুকে ফিরে আসতে। কি হল যাও। যাও……
আমি মারতে থাকলাম। ও আমাকে আটকালো না। আমার চোখের পানির বাঁধ ভাঙল। গড়িয়ে পড়তে লাগল অঝোর ধারায়। চেরি ফল আমাকে বুকে জড়িয়ে নিল। আজ যে আমার বড়ো আশ্রয়ের প্রয়োজন। কিন্তু কার কাছে যাবো আমি? আমার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলে ও আমাকে ডাকতে লাগল। আমাকে সরিয়ে নিয়ে দেখল আমি জ্ঞান হারিয়েছি।
.
.
.
.
সকালে চোখ মেলে তাকালাম। আমি বিছানায়। হাত নাড়তেই সুঁইয়ের গুঁতো খেলাম। তাকিয়ে দেখি স্যালাইন দেওয়া। শরীরটা দুর্বল লাগছে। আমি আস্তে করে উঠলাম। টান দিয়ে খুলে ফেললাম সুঁই। কয়েক ফোঁটা রক্ত বের হলো। আমার অনুভূতি নেই। আব্বু আম্মুর সাথে আমার আনন্দ অনুভূতি সব কবরের নিচে চাপা পড়ে গেছে। পুরো রুম অন্ধকার অন্ধকার হয়ে আছে। প্রত্যেকদিন সকালবেলা আম্মু জানালা থেকে পর্দা সরিয়ে দিতো। আজ পর্দা সরানোর কেউ নেই। তাই নিজেই ধীর পায়ে গিয়ে পর্দা সরালাম। চোখে আলো পড়তেই হঠাৎ অসহ্য লেগে উঠল। ভাবলাম আবার পর্দা টেনে দেবো কিনা। কেউ একজন এসে দেখে গেল। বুঝলাম মুনতাহা এসেছিল। একটু পরে মিষ্টি খালা এসে বলল, উঠেছিস? ফ্রেশ হয়ে নে। আমি নাস্তা বানিয়েছি। খেতে আয়। আমি কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। দরজা মেরে ঝর্ণা ছেড়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর পর একজন একজন করে ডেকে গেল। একঘন্টা হয়ে গেল। আমি কারো ডাকেই সাড়া দেইনি। চুপ করে বসে আছি ঝর্ণার নিচে। সবাই শুধু পানির শব্দই শুনতে পেল। আমি বের হচ্ছি না দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। তখনই আমি বের হয়ে এলাম রুম থেকে। আমাকে কাগজের মতো সাদা লাগছে। মুনতাহা আমাকে নিয়ে সোফায় বসালো।
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। আন্টি, আঙ্কেল আর চেরি ফল আমাকে দেখতে এসেছে। আন্টি আমার পাশে এসে বসে বললেন, এই অবস্থা কেন? পুরা সাদা হয়ে আছে। সারা শরীর বরফের মতো ঠান্ডা। কপাল ধরে বললেন, কপাল তো বেশ গরম। মনে হয় জ্বর আসবে। একটা কাঁথা নিয়ে এসো। মুনতাহা কাঁথা মুড়ি দিতেই আমি ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলাম শীতে। মাথা রাখলাম আন্টির কাঁধে। আন্টি বললেন, দেখ, কি জোরে মেরেছিস কালকে। পুরো কালো হয়ে গেছে। মিষ্টি খালা বলল, ও মেরেছে বলে তো পাথর বুক ভেঙে কান্না করেছে। আমার তো এখন ওকে নিয়ে ভয়। আপা দুলাভাইকে খুব ভালোবাসতো মেয়েটা। ওরা চলে যাওয়ায় একদিনে কি যে হাল হল! মিষ্টি খালার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। তিনি মুখ চেপে কাঁদতে লাগলেন। আঙ্কেল বললেন, ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এভাবে থাকলে তো মেয়েটা মরে যাবে। আমি জ্বরের ঘোরে বলতে লাগলাম, আমি আম্মুর কাছে যাবো। আব্বু আমাকে নিয়ে চলো। তোমরা না আমার কাছে আসবে বলেছিলে। কেন এলে না? এখন আমাকে তোমাদের কাছে নিয়ে চলো। আমার কথাগুলো শুনে পুরো বসার ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
.
.
.
.
- কি বুঝলেন?
- দেখুন, ও আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আজ সারাদিনে জ্বর ১০৩ এর নিচে নামেনি। ওষুধ দেওয়ার পর যদি পেসেন্ট রেসপন্স না করে তবে সেটা সমস্যা।
- এখন কি করব ডক্টর? আমাদের তো কিছু মাথায় আসছে না। সদ্য আপা আর দুলাভাই চলে গেছে। বড্ড ভালোবাসতো। নিজেদেরকেই নিজেরা সামলাতে পারছি না। আর ও তো বাচ্চা মেয়ে।
- দেখুন, ওকে বোঝাতে হবে। এভাবে তো স্যালাইন দিয়ে বেশি দিন চলা ঠিক হবে না। আপনারা ওকে বোঝান। ঠিক মতো খাওয়ান। এভাবে করতে থাকলে শরীর দিন দিন দুর্বল হতে থাকবে।
- ওকে ডক্টর, আমরা চেষ্টা করব।
মিষ্টি খালা আর খালু ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আমার কাছে এলেন। আমি হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছি। তাকালেই মাথা ঘুরাচ্ছে। ঝিমঝিম করছে। মিষ্টি খালা আমার কাছে একটা পায়েসের বাটি নিয়ে এসে বলল, দেখ ছোঁয়া, তোর না পায়েস পছন্দ? আমি বানিয়ে এনেছি।
- খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবো না।
- সোনা, এমন করে না। আমি অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি। একটুও খাবি না?
আমি কয়েক চামুচ খেলাম। বললাম, তেতো। মিষ্টি খালা বলল, একটু তো তেতো লাগবে। জ্বর মুখ তো। আরেকটু খা। তাহলে আর জোর করবো না। আমি আরো সাত আট চামুচ জোর করে খেলাম। সাথে সাথে গা গুলিয়ে উঠল। আমি গড়গড় করে বমি করে বের করে দিলাম পেটে যাওয়া পায়েসটুকু। ক্লান্ত শরীরে বললাম, আর পারছি না। নিয়ে যাও সব আমার চোখের সামনে থেকে। আম্মুকে ডেকে দাও। ডেকে দাও। মিষ্টি খালা মুখ চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি তখনও বলছি, আম্মু আব্বুকে ডেকে দাও। আমি তাদের হাতে খাবো।
চলবে…
মিষ্টি খালা মুখ চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি তখনও বলছি, আম্মু আব্বুকে ডেকে দাও। আমি তাদের হাতে খাবো।
.
.
.
.
সপ্তাহখানেক হল আমি হাসপাতালে। এখন একটু সুস্থ আছি। খাওয়া দাওয়াও করতে পারছি। তবুও শরীরে জোর পাই না। ডাক্তার আজকে রিলিজ করে দেবে। আমি বসে আছি বেডে। মিষ্টি খালা এসে বলল, আজকে থেকে তুই আমাদের কাছে থাকবি। আমি মাথা নাড়লাম। উনি আবার বললেন, আজকে তাহলে আমাদের সাথে চল।
- আমি বাসায় যাবো একবার।
মিষ্টি খালা আর খালু একে অপরের দিকে তাকাল। খালু বললেন, আগে আমাদের সাথে চলো পরে একদিন না হয় ওখানে যেও।
- আমি দ্বিতীয় বার ওখানে যেতে চাই না।
- বেশ।
দুপুরের দিকে আমাকে নিয়ে বাসায় এলো। আমি নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। তারপর উঠে বড় একটা লাগেজ বের করলাম। চেইন খুলে আলমারি থেকে জামা কাপড় ঢোকালাম। চেরির শার্টটা নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম। তারপর ওটা একটা জামার ভেতর নিয়ে লাগেজে ঢুকালাম। আম্মুর রুম থেকে বাক্সটা এনে নিয়ে নিলাম। ডায়রী আর কিছু টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিলাম। তারপর দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবির সামনে দাঁড়ালাম। আমার, আব্বুর আর আম্মুর। কি সুন্দর হাসছে! আমি ছবিটা নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। বিড়বিড় করে বললাম, কেন এত তাড়াতাড়ি তোমাদের মেয়েকে এত বড় দুনিয়ায় ফেলে চলে গেলে? আমি ছবিটা নিজের সামনে ধরে আব্বু আম্মুকে চুমু দিলাম। তারপর লাগেজে রেখে চেইন মেরে দিলাম। রুম থেকে বের হয়ে বললাম, চলো। মিষ্টি খালা জিজ্ঞেস করল, খাবি না?
- উঁহু, একসাথে ওখানে গিয়ে খাবো।
- আচ্ছা।
খালু আমার থেকে লাগেজটা নিয়ে নিচে চলে গেলেন। মিষ্টি খালাকে বললাম, নিচে যাও। আমি আসছি। খালাও চলে গেল। আমি পুরো বাসাটার দিকে তাকালাম। আমার চোখের সামনে সব স্মৃতি ভেসে উঠল। আমি এদিক থেকে ওদিক ছুটছি আর আম্মু পেছন পেছন ছুটছে। আম্মু মেরেছে বলে কাঁদতে কাঁদতে আব্বুর কাছে ছুটে গেছি। আব্বু আমাকে আদর করে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। প্রথম আঁকতে শিখেছি বলে পুরো বাসার দেয়াল এঁকে নষ্ট করেছি। আম্মু দেখে অনেক বকেছে। আব্বু একটা ছবি তুলেছিল। সেটা এলবামে আছে। হঠাৎ এলবামের কথা মনে পড়ল। আমি খুঁজে নিলাম এলবামটা। তারপর শেষবার তাকিয়ে তালা মারলাম দরজায়। যেতে গিয়ে চেরিফলের দরজার দিকে চোখ পড়ল। কাছে গিয়ে দরজায় হাত রাখলাম। তারপর দরজায় একটা চুমু দিয়ে বললাম, ভালো থেকো নিজের ভালোবাসাকে নিয়ে। আঙ্কেল আন্টিকে সাবধানে রেখো। অনেক জ্বালিয়েছি। আমি ছিলাম তোমার জীবনে কয়দিনের অতিথি, তাই চলে যাচ্ছি বহুদূরে। আন্টির থেকে অনেক কিছু শিখেছি। থ্যাংক ইউ আন্টি। না বলে যাওয়ার জন্য সরি। আমি নেমে চলে এলাম মিষ্টি খালা আর খালুর কাছে। রওনা দিয়ে দিলাম তাদের বাড়ি।
.
.
.
.
মুনতাহা আর সানজিদা আপু অপেক্ষা করছিল। আমি যেতেই হাসি মুখে আমাকে ঘরে নিয়ে গেল। মুনতাহা আমার সমবয়সী। খালি সারাদিন পটর পটর করে। আমি যেতেই কথার ফুল ঝুঁড়ি নিয়ে আমার পিছু পিছু ঘুরছে। শুধু ওয়াশরুমটাই ছিল একমাত্র ওর থেকে বাঁচার উপায়। খেতে বসেও যখন বকবক শুরু করল আমি বললাম, মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করিস না তো। শান্তি মতো খেতে দে। আমার কথায় সবাই বেশ খুশিই হল। কারণ আজকে অনেকদিন পর নিজ ইচ্ছায় খাচ্ছি। খেয়ে গেলাম মুনতাহার রুমে। এখন থেকে ওখানেই থাকবো। আগে সানজিদা আপু থাকতো। এখন বিয়ে হওয়ায় অন্যরুমে শিফট করেছে। আমাকে আলমারিতে জায়গা করে দিয়ে মুনতাহা বলল, এখানে সব কাপড় চোপড় তুলে রাখ। আমি তোকে হেল্প করছি। আমি আর ও মিলে সব তুলে রাখলাম। বাক্সটা রাখতেই ও বলল, এটা কি?
- আমার জন্মদিনের গিফট।
- আমি দেখবো।
আমি খুলতেই ও বলল, ওয়াও!!!!!! কি সুন্দর শাড়ি!!!! কে দিয়েছে? আমি বললাম, জানি না। মনে মনে বললাম, একটা রাক্ষস ভ্যাম্পায়ার। শাড়ির বদলে আমার ঘাড়ে কামড় দিসে। ও সব দেখে রেখে দিল আলমারিতে।
সন্ধ্যায় সবাই আড্ডা দিতে বসল ছাদে। মিষ্টি খালাদের বাড়িটা একতালা। একটু গ্রাম সাইডে। বাড়িটার চারদিকে চারটা রুম আর মাঝে ডায়নিং। রান্নাঘর আলাদা। আমি থাকবো দক্ষিণ পশ্চিম রুমটাতে। সবাই যে যার মতো বকবক করছে। দুলাভাইও আছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। মুনতাহা খেয়াল করে বলল, কি রে, তারা গুনছিস নাকি?
- উঁহু, দেখছি আর ভাবছি কোনটাকে আব্বু ভাববো আর কোনটাকে আম্মু। আচ্ছা মুন, কোন দুটো উজ্জ্বল তারা আমাদের রুম থেকে দেখা যাবে?
আমার কথা শুনে সবাই চুপ করে গেল। মুনতাহা কথা ঘোরানোর জন্য বলল, ওই বেটি, আমি কি করে বলবো। জানো ছোঁয়া না অনেক ভালো গল্প বলতে পারে। আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম, কে বলল তোকে?
- কে বলবে? আমি বলছি। এখন একটা গল্প শোনা। অনেকদিন শুনি নাই।
- হ্যাঁরে বল না। দেখ ভালো লাগবে হয় তো।
সবাই জোরাজুরি করতে লাগল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুরু করলাম।
- আকাশে তো কত মেঘ। কিছু রঙ তুলির ছেটা রঙের মতো, কিছু বা জমাট। সেই জমাট বাঁধা একটা মেঘেই থাকতো ছোট্ট এক দুষ্টু পরী। সে খুব দুষ্টু ছিল। সারাক্ষণ এদিক ওদিক ছুটে বেড়াতো। তার বাবা মা তাকে সামলাতে হিমসিম খেতে হতো। মাঝে মধ্যে খুব শাসন করতো। কিন্তু তবুও তার দুষ্টমি কমলো না। একদিন ওদের জমাট বাঁধা মেঘে প্রচন্ড বজ্রপাত শুরু হল। পরী দেখে খুব ভয় পেল। কিন্তু ওর বাবা মা ওকে সাহস যুগিয়ে বলল, কিচ্ছু হবে না। তুমি ঘরে থাকো। পরী জিজ্ঞেস করল, তোমরা? তারা বলল, আমরা একটু পরেই চলে আসব। ছোট্ট পরী সারাদিন ঘরে বসে অপেক্ষা করল তার মা বাবার জন্য। এদিকে বজ্রপাত থেমে গেল। ছোট্ট পরী বেরিয়ে এল। কিন্তু তার বাবা মাকে খুঁজে পেল না। ওরা হারিয়ে গেল বজ্রপাতের সাথে।
দুই ফোঁটা পানি চোখ থেকে চিবুকে গিয়ে জমলো। সবাই চুপ। চারদিকের ঝিঁঝিঁ পোকার কোলাহল স্পষ্ট হয়ে জেকে বসছে কানে। মিষ্টি খালা বলল, সবাই নিচে চলো। রাত হয়ে যাচ্ছে। সবাই একে একে নিচে চলে এল। মুনতাহা পাটি গুছিয়ে নিয়ে ছাদের দরজা বন্ধ করে দিল।
রাতের খাওয়া শেষে মিষ্টি খালা, সানজিদা আপু আর মুনতাহা লুডু খেলতে বসল। আমাকেও টেনে নিয়ে গেল। আমি মাত্র মুনতাহার গল্পের বই সংগ্রহে হামলা দিতেছিলাম। কি আর করা। বইসা পড়লাম কালো গুটি নিয়া। মুনতাহা বলল, সাফে সাফে খেলবো। আমি আর ছোঁয়া। মিষ্টি খালা ধরল আমাকে। উনি আমাকে ছাড়া কিছুতেই খেলবে না। আমি বললাম, আমার দলে থাকলে হেরে যাবে তো। তবুও আমাকে ছাড়ল না। খেলা শুরু করলাম। দর্শক খালু আর দুলাভাই। শেষ পর্যন্ত আমার কথাই ফললো। হাইরা গেলাম। মুনতাহা বলল, আরেক বার। এবার আমি আর ছোঁয়া। আবার বসলাম খেলতে। আমাদের দুইজনের তুমুল ছক্কা উঠতে লাগল। ছক্কার চোটে আমদের গুটি লাফিয়ে লাফিয়ে পেকে গেল। পথে যত গুটি পাইলাম সব কেটে সাফ। জিতে গেলাম। বেশ মজাও হল। মিষ্টি খালা দুই বার হেরে গিয়া বলল, আজ আর না। শুয়ে পড়। রাত অনেক হয়েছে। সত্যিই অনেক বাজে। যে যার ঘরে চলে গেল। আমরাও শুয়ে পড়লাম। আমার মাথায় অনেক কিছু ঘুরছে। মুনতাহা বলল, ছোঁয়া, আব্বু বলেছে তোকে ট্রান্সফার করে আমাদের স্কুলে নিয়ে আসবে। খুব মজা হবে তাই না?
- হুম।
- আমরা একসাথে স্কুলে যাবে। একসাথে পড়ব।
- হুম।
ও খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। আমার চোখে ঘুম নেই। আমি তাকিয়ে আছি ছাদের দিকে। ভাবছি, ইস্ যদি ছাদটা না থাকতো। আকাশের তারাগুলো দেখতে পেতাম। মনে মনে বললাম, আম্মু তুমি আর চিন্তা করো না। আজ থেকে আমি আর দুষ্টুমি করবো না। তোমাদের এই দুষ্টু পরীটা অনেক বড়ো হয়ে গেছে। হঠাৎ আম্মুর ফোনে ম্যাসেজের শব্দ। আম্মুর ফোনটা আমার কাছেই রয়ে গেছে। আব্বুরটা এক্সিডেন্টে ভেঙে গেছে৷ ঐ সিমটাও আম্মুর ফোনে ঢুকিয়ে নিয়েছি। আমি লক খুলে ম্যাসেজটা দেখলাম।
' এখনও ঘুমাওনি? জেগে জেগে তারাদের কথা ভাবছো? আর ভাবতে হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। পালিয়ে যাওয়ার আগে তো তোমার মুখটা দেখতে দিলে না। দাঁড়াও যখন তোমার কাছে ফিরে আসবো তখন আর পালাতে দেবো না। ভালোবাসার শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখবো নিজের কাছে।
~ লাভার ভ্যাম্পায়ার'
পড়ার সাথে সাথে মেজাজ খারাপ হল। তার ঐ কচু বাইটের জন্য প্রচুর চুলকানি হইসে। সবাই প্রশ্ন করে পাগল বানাই ফেলসে। কোনোমতে সামাল দিসি। তবে একটু ভয়ও হইল। জানল কি করে আমি এখন কি করতেসি, কি ভাবতেসি!? আমি আশে পাশে তাকিয়ে দেইখা নিলাম। কই, কোথাও কেউ নেই। আমি ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলাম, যদি সামনে আসো তবে তোমার চৌদ্দ গুষ্টির শরীরের এক ফোঁটা রক্তও অবশিষ্ট রাখবো না। সব শুষে নেবো। ব্যাটা ভ্যাম্পায়ার। মেজাজ খারাপ করে ফোনটা রাইখা দিলাম। চোখ বন্ধ করতেই ঘুম। আমার ম্যাসেজটা পেয়ে কারো একজনের মুখে হাসি ফুটল।
.
.
.
.
সকাল সকাল ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে। এই নিয়ে দশবার রিং টোন বাজছে। কে যে ফোন করতেসে। ধুর বাবা। চোখ বন্ধ করে কোনোমতে হাতিয়ে ফোনটা নিলাম। ব্যাটা এখনও বাইজা বাইজা মাথা তুলি ফেলতেসে। কোনোমতে রিসিভ করে বললাম, হ্যালো৷ কে?
- এখনো ঘুমাচ্ছো। ঘুমন্ত সুন্দরী হওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে নাকি? যে কিস করে উঠাতে হবে।
ধমক খেয়ে আমি চোখ খুলে তাকালাম। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম অপরিচিত নাম্বার। আমি আবার বললাম, কে বলছেন আপনি? আপনি হয়ত ভুল নাম্বারে……
- আমি ঠিক নাম্বারেই ফোন করেছি। এখুনি ঘুম থেকে ওঠো না হলে এসে ঘাড়ে আরেকটা কামড় দিবো।
- কে কে? হ্যালো……টুট টুট টুট…… কেটে দিল!!!! শালা ভ্যাম্পায়ার, লাইন কেটে দিলি! আজকে তোর আমি চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়তাম। ঐ দিনের কামড়টা এখনো ভুলি নাই। উফ্!!!!!
চলবে…
- কে কে? হ্যালো……টুট টুট টুট…… কেটে দিল!!!! শালা ভ্যাম্পায়ার, লাইন কেটে দিলি! আজকে তোর আমি চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়তাম। ঐ দিনের কামড়টা এখনো ভুলি নাই। উফ্!!!!!
আমি ঘাড়ে হাত দিলাম। এখনো রক্ত জমাট বাঁধা দাগটা আছে। কামড়ের দাগটা রয়ে যাবে বোধহয়। জামাইরে কি কমু!!! আমার ভবিষ্যত সংসারে এখন থেইকাই আগুন লাগাইয়া দিল। ধুর! সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ কইরা দিল। স্ক্রিনের আলো জ্বালাই মেজাজ আরো খারাপ হইল। মাত্র ছয়টা দুই। এত সকালে আরামের ঘুমটা মাটি কইরা দিল। ইচ্ছে করতেসে নিজের চুলগুলো একটা একটা কইরা ছিঁড়ি। না থাক। বহুত ব্যাথা পামু। তাছাড়া বিয়ের পর জামাই বলবো, বেল বৌ, আমার কাছে আসো, তোমার ফুটবল মাঠে একটু ঢুগঢুগি বাজাই। ভাইবা নিজেই ঢোক গিললাম। বেল বৌ হওয়ার শখ নাই। নাহ, মাথা ঠান্ডা করা লাগবো। ফোনটা বিছানায় রেখে ওয়াশরুমে চইলা আসলাম। মুখে ব্রাশ পুইরা দিয়া ইচ্ছা মতো ঘষতেসি আর রাগগুলো বেচারা ব্রাশের উপর ঝাড়তেসি। মুখ ধোয়া শেষে আয়নায় নিজের দাঁত দেইখা সেই লেভেলের সন্তুষ্ট হই গেলাম। একেবারে হীরার মতো জ্বলতেসে। বেঁচলে বড়লোক হই যামু একদিনে। আমি কল্পনা করলাম, আমার দাঁতগুলা হীরার দামে বেঁচতেসি। আমি দাঁতবিহীন মাড়ি বের কইরা হাইসা হাইসা বলতেসি, হীলাল ডাড লয়ে যান। দাঁতবিহীন আমারে কেমন লাগবো। নিজের অবস্থা ভাইবা নিজেই শিউরে উঠলাম। আল্লাহ গো!!! কি সব ভাবতেসি! ব্রাশের দিকে তাকাই দেখলাম বেচারার অবস্থা করুন। মান ইজ্জত কিচ্ছু রাখি নাই। কালকে মাত্র নতুন বাইর করসি৷ এখন মনে হইতেসে আজকে আরেকটা নামাইতে হবে।
আমি ফ্রেশ হইয়া বাইর হইতেই ম্যাসেজের শব্দ। ফোন খুইলা দেখি ত্রিশটা ম্যাসেজ। বাপ রে…। সিমওয়ালারাও তো এতো ম্যাসেজ দেয় না। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কে এত ম্যাসেজ দিসে। চেনা চেনা লাগতেসে। ম্যাসেজ পইড়া মেজাজ আবার বিগড়াইলো। ব্যাটার সমস্যা কি? কামড়ে আমার ঘাড়ের মাংস তুইলা নিয়া গেসে এখন ম্যাসেজ কইরা কইরা আমার মাথা খাই ফেলতেসে। সে ম্যাসেজ দিসে, জলদি নাস্তা করে নাও। আজকে না টি.সি. আনতে যাবে? সুন্দর করে শালীন হয়ে যাবে। মনে থাকবে? না হলে…
~ লাভার ভ্যাম্পায়ার।
এই শালা কেমনে জানলো এতকিছু! হায়রে!!! ক্রাশের চিন্তায় আমি বেঁহুশ আসিলাম। এখন দেখি ভ্যাম্পায়ারের চিন্তায় আমি অজ্ঞান হমু। ওয়েট, বেহুঁশ আর অজ্ঞান তো একই জিনিস। ধুর ভাল্লাগে না। কি মুসিবত! সব কেমন হেডফোনের মতো জট পাকাই যাইতেসে। ক্রাশের কারনে এতদিন আধাপাগল আসিলাম। এখন মনে হয় পুরা পাগল হয়ে পাবনা যাওয়ার সময় হইসে।
আমি সাড়ে ছয়টার দিকে মুনতাহাকে ঠেইলা উঠাইলাম। বেচারি ঘুমে ঢুলতেসে। সেভাবেই অত্যাচারীদের মতো ওরে ওয়াশরুমে ঢুকাই দরজা মাইরা দিলাম। আমি ওর জন্য বাইরে অপেক্ষা করতেসি। মেয়ে তো বেরই হয় না। ব্যাপার কি!!!! বিশ মিনিট হইয়া গেল। বাথরুম করতে গিয়া ঘুমাই পড়ল নাকি!!!! আমি আস্তে কইরা দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। কেউ নাই! দরজাও আটকায় নাই। অদৃশ্য হইয়া গেল নাকি! জোরে দরজা খুলতেই ধুপ কইরা কিছু পড়ার শব্দ। সাথে সাথে, ওরে বাবা গো, কোমরটা গেল মনে হয়… মুনতাহা ফ্লোরে বইসা বইসা ষাঁড়ের মতো চেঁচাইতেসে। আমি তাড়াতাড়ি আইসা কইলাম, তুই কোথা থেকে আসলি!
- আমি কি উবে গেসিলাম নাকি! এখানেই তো ছিলাম। উরে……
- এখানে কই ছিলি? দেখলাম না যে।
- দরজার পেছনে।
- ওখানে কি করতেছিলি?
- হেলান দিয়ে ঘুম তাড়াইতে ছিলাম। কিন্তু কখন ঘুমাই গেসি টের পাই নাই।
আমি হাসমু না কাঁদমু বুঝতে পারতেসি না। মুনতাহা বলল, এমন হ্যাবলার মতো দাঁড়াই থাকবি না তুলবি? আমি ওকে টাইনা তুলতে ও বলল, আজকে মাজাটা মনে হয় গেল। তোর সঙ্গে আর যাওয়া হবে না। তুই আব্বুর সাথে যাস। ওরে বাবা। আমি ওয়াশরুম থেকে বের হইয়া আসলাম। ও দরজা মাইরা দিল। এই মেয়ে সামনে আমারে কি পরিমান জ্বালাইবো কে জানে! কেউ নাকি ঘোড়ার মতো দাঁড়াই দাঁড়াই ঘুমায়। তাও আবার ওয়াশরুমে! এতদিন আমি সবাইরে জ্বালাইসি এখন এ আমারে জ্বালাইবো। নাহ্, এটা তো হইতে দেওয়া যাবে না। দাঁড়া তোরে আমি টাইনা সোজা করমু। না হইলে আমার নামও গাজরের হালুয়া না। এ্যাঁ…!!!!
.
.
.
.
আমি বের হইয়া দেখলাম সবাই মোটামুটি টেবিলে উপস্থিত। শুধু আমরাই বাকি ছিলাম। আমি বইসা পড়লাম টেবিলে। মিষ্টি খালা আমাকে নাস্তা দিয়ে বলল, মুন কই?
- আসতেসে।
আমি মাত্র মুখে খাবার দিমু তখন মুনতাহা বুইড়া মানুষের মতো কোমরে হাত দিয়া আইসা চেয়ার টেনে বসল। সানজিদা আপু জিগাইল, কি হইসে তোর আবার? আমি রুটি আলুর ঝোলে চুবাইতে চুবাইতে কইলাম, ওয়াশরুমে ঘুমাইতে গিয়া পইড়া গেসে।
- ছোঁয়া……
- এসব কি মুন?
- আরে আব্বু, ও দুষ্টুমি করছে।
ও আমারে গলায় চাকু চালানোর ভঙ্গি করে বুঝাইল, কিল ইউ। আমিও ভেংচি কাইটা কইলাম, বিলাই ইউ। আমাদের কান্ড দেখে মিষ্টি খালা বলল, আসতে না আসতে চুলাচুলি শুরু করবি নাকি? মুন, আজকে স্কুলে যাবি না? ও কোমরে হাত দিয়ে বলল, আম্মু, সেই লেভেলের ব্যাথা পাইসি। আজকে না যাই?
- খালি ফাঁকির বাহানা। ছোঁয়া মা, আজকে তোমার খালুর তোমার সাথে স্কুলে যাবে। টি সি আনতে।
- আচ্ছা।……আমাদের বাসাটা কি করবে কিছু ভেবেছ?
- না। এই ব্যাপারে তুই যা বলবি তাই। আমরা তোর মতের বিরুদ্ধে কিছু করতে চাই না।
- বেঁচে দাও।
সবাই আমার দিকে তাকাইলো। আমি কইলাম, কি হইসে? সবাই এভাবে তাকাই আছো কেন? মিষ্টি খালা বলল, সত্যিই বেঁচে দেবো? আমি রুটির টুকরা মুখে পুরে দিয়া বললাম, আমি কি এমনি এমনি বলসি নাকি? আমি জানি তোমরা এতো বড়লোক নও যে এই পরিবার চালানোর সাথে ঐ বাসাটাও চালাইতে পারবা। দরকার কি বোঝা বাড়িয়ে? ঐ বাসাটা বিক্রি করে যা টাকা হবে সেগুলো আমার জন্য খরচ করবা। তাহলে তোমাদের উপর আমার জন্য আসা চাপটা কমবে। আমি তোমাদের উপর বোঝা হতে চাই না। আমি শেষ টুকরা মুখে পুইরা দিয়া উইঠা গেলাম। সবাই চুপচাপ খাইয়া উঠল। আমি রুমে এসে দরজাটা মাইরা পিঠ ঠেকে দাঁড়াইলাম। কিছু পানি নাকের ডগায় জমলো। আমি সামনে দেয়ালে ঝোলানো ছবিটার দিকে তাকাই বললাম, সরি আব্বু আম্মু।
সাতটার মধ্যে রেডি হইয়া বের হইলাম। দরজা খুললে আগে চেরি ফলের বাসার দরজা দেখতাম। এখন একটা ফাঁকা উঠান নজরে পড়ে। আমি তাড়াতাড়ি ক্যাডস পইরা বাইর হই গেলাম। এখান থেকে স্কুল যাইতে একঘন্টা লাগবে। আজকে শেষ। লেট কইরাই গেলাম। কি আর হইবো? বাসা থেকে বাইর হয়ে একটা অটোতে উইঠা গেলাম। খালু ছুটির পর আসবে। আমার সাথেই আসতে চাইছিল। আমিই বলসি আজকে সব ক্লাস করব। শেষদিন বলে কথা। স্যার ম্যাডামদের একটু প্যারা দিয়া আসি। তাই খালু বলেছে ক্লাস শেষ হলে আসবে।
আমি একঘন্টা পরে আইসা পৌঁছাইলাম। দারোয়ান চাচা গেটে আটকাইলো। আমি একটা মলিন হাসি দিলাম। চাচা কইল, এত লেটে ক্যান আসলা?
- আজকে ঢুকতে দেন, চাচা।
- উঁহু।
- এই শেষবার চাচা, আর জ্বালাবো না।
- এই কথা আগেও বলসিলা।
- আগে তো মজা করে বলসি। আজকের পর থেকে আর জ্বালাবো না, চাচা। সত্যি সত্যি সত্যি তিন সত্যি চাচা। আমি চলে যাবো।
- কই যাবা?
- এখান থেকে দূরে চাচা। আজকে শেষবার দেখতে আসছি। টিসি নিয়ে চলে যাবো চাচা। আর প্যারা দিবো না।
চাচা কিছু বললেন না। মুখ কালো করে সইরা গেলেন। আমি ভেতরে ঢুকলাম। চাচাকে কত প্যারা দিসি। একবার আম চুরি করতে আসছিলাম স্কুলে। চাচার হাতে ধরা খাইয়া সে কি দৌঁড়। আমি আস্তে আস্তে ভেতরে গেলাম। সব স্মৃতি গুলা চোখে ভাসতেসে। কেউ নাই মাঠে। সবাই ক্লাসে। আমি মাঠের মাঝে গিয়া দাঁড়াইলাম। চারদিকে একবার চোখ বুলাইলাম। এতদিন বুঝতে পারি নাই ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট কাকে বলে। আগে আমার জগত জুড়ে কত মানুষ ছিল আর পুরো পৃথিবীতে আজ অসহায় একা আমি।
আমি ধীরে ধীরে আমাদের ভবনে ঢুকলাম। সিঁড়ির রেলিং ছুঁয়ে উঠতে লাগলাম। দেয়ালগুলো আজ আমার দিকে তাকিয়ে হাহাকার করতেসে। জীবনের একটা ঝড় সবকিছুকে আমার থেকে এক ধাক্কায় সরাইয়া নিয়া গেল। আমি রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রথম ঘন্টা মিস করসি। দ্বিতীয় ঘন্টার স্যার এখনো আসে নাই। কেউ কেউ বারান্দায় দাঁড়াই আছে। রিদিকেও দেখলাম। আমাকে দেইখা ও দৌঁড়ে এসে জড়াই ধরল। আমি দাঁড়াই রইলাম। ও মুখে হাসি টেনে বলল, এত দিন পর আসলি। তোকে কত মিস করসি। সেই যে দেখসি তোকে তারপর আর দেখতে পারি নাই। জানিস আজকে রেজাল্ট দিবে। একটু পরে। আমি ওর দিকে নির্জীব বস্তুর মতো তাকাই আছি। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা তারপর এখান থেকে নতুন এক জায়গায় চলে যাবো।
ও আমাকে রুমে নিয়া গেল। আমি বেঞ্চে বসতেই সবাই আমাকে ঘিরে ধরল। সবার শুধু আমার জন্য সমবেদনার বন্যা। আমার মোটেও ভালো লাগল না। স্যার চলে এলেন একটু পরে। আমি হাফ ছাইড়া বাঁচলাম। স্যারের হাতে মার্ক শিট। সবার মাঝে উত্তেজনা ছড়াই পড়ল। আমি শান্ত হইয়া বইসা আছি। স্যার কিছু কথা বইলা রেজাল্ট কার্ড দেওয়া শুরু করলেন। আমার রোল ৮ ছিল। রেজাল্ট কার্ড পাওয়ার পর রিদি বলল, তুই কত হইছিস? দেখি। আমি ওকে রেজাল্ট কার্ডটা দিয়া দিলাম। এটা দিয়া আমি আর কি করমু? ও দেখে উত্তেজিত হয়ে বলল, তুই প্রথম হয়েছিস!!!!! আমি মনে মনে কইলাম, ক্রেডিট আমার না। চেরি ফলের ছিল। রিদি আমার রেজাল্ট কার্ড নিয়া লাফালাফি করতেসে। আমার এটা নিয়া কোনো মাথাব্যাথা নাই। স্যারের ক্লাস শেষে টিফিন টাইম শুরু হতেই আমি নিচে চইলা আসলাম। গিয়া বসলাম দোলনায়। এই দোলনায় কত স্মৃতি জড়াই আছে। আমি দুলতেসি আর স্মৃতিগুলা হাতড়ে বেড়াইতেসি। রিদি এসে বলল, কি হইসে তোর?
- আমি চলে যাবো রিদু।
- কোথায়?
- আজকে টিসি নিতে আসছি।…… চিন্তা করিস না তোর সাথে যোগাযোগ থাকবে।
ওর মুখের দিকে তাকানোর সাহস করলাম না। উইঠা চইলা আসলাম। কখন আবার বাচ্চাদের মতো ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কইরা কাইদা দেয়। মেয়েটারে বড্ড আপন লাগে। বেস্টু বলে কথা।
.
.
.
.
টিসি নিয়া বাসায় আসলাম দেড়টার সময়। সোজা ওয়াশরুম। গোসল কইরা বাইর হতেই মুন আমারে রুবিকস কিউব সাইজের একটা মোটা খাতা দিয়া কইল, এটা তোর।
- কি এটা!?
চলবে…
গোসল কইরা বাইর হতেই মুন আমারে রুবিকস কিউব সাইজের একটা মোটা খাতা দিয়া কইল, এটা তোর।
- কি এটা!?
- ক্লাস রুম ডিটেইলস। শুধু মাত্র তোর জন্য। স্পেশাল। সারাদিন খাইটা তোর জন্য বানাইসি।
আমি টাওয়াল মেইলা দিয়া খুললাম ছোট্ট খাতাটা। বাপরে! এতো মনে হয় সব টিচার আর স্টুডেন্টদের বায়োডাটা। আমি ওরে জিগাইলাম, তুই এত নাড়ি নক্ষত্র জানলি কেমনে?
- আমি মুন, ওকে? পৃথিবীর উপর থেকে সব পর্যবেক্ষণ করি। বুঝতে হবে।
আমি হাইসা প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাইলাম। হেডিং রোল ১। নাম রোহান। ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত আর আঁতেল পোলা। চোখের চশমা দিয়া অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতো সবাইকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। ওরে খাতায় নাম লেখতে দিলে ক্লাসে চলে পিতপতন নীরবতা। তুমি কোন চিপায় মুখ নাড়াইসো কি নাড়াও নাই নামটা খাতায় সিল হইয়া গেছে। তারপর স্যারের হাতে নাম গেলে সেই লেভেলের পিডানি। পড়ার ব্যাপারে বক্তৃতা দিতে তার ক্লান্তি নাই। ঝামেলায় জড়ানো তার কাছে যুদ্ধের সমান। স্যারদের প্রিয় পাত্র। কারো প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নাই একমাত্র বই ছাড়া। আমি মুনরে কইলাম, বাপরে! তোদের রোহান তো সেই লেভেলের পড়ুয়া ছেলে মনে হচ্ছে।
- হুম।
দ্বিতীয় পৃষ্ঠা। রোল ২। নাম রাতুল। ক্লাসের সবচেয়ে স্মার্ট পোলা আর ফাজিলের হাড্ডি। খেলাধুলায় সেই। অনেকের ক্রাশ। আমাদের স্কুলের হেডমাষ্টারের ছেলে। অতএব দূরত্ব বজায় রাখা অতীব জরুরি। ঝগড়ায় সেই লেভেলের পটু। তার থেকে দশ হাত দূরে থাকাটাও রেড জোন। তার সুনজরে যে একবার পড়সে সেই দিন আর রক্ষে নাই। আমি খাতাটা বিছানায় রাইখা ওর পাশে শুয়ে কইলাম, তোর স্কুল তো খুব ইন্টারেস্টিং।
- কচু। গেলে বুঝবা। ঠেলার নাম বাবাজি।
আমি খাতাটা শুয়ে শুয়ে উল্টাইতেসি। মুন বলল, শুন, আজকে থেকে তোর ট্রেনিং শুরু।
- কিসের?
- তোর কাকের গলার। বাপরে কি সুর এই কন্ঠে! আমার দুলাভাইয়ের অবস্থা তো টাইট।
- আরে শোন না। আমি তো ঠিক করেই রাখসি আমার জামাই রে বাসর রাতে ডি জে শুনামু।
- তাইলেই সারছে। আম্মার অর্ডার। আজকে স্যার আসলে তোকে নিয়ে যেতে।
আমি কিছু বলার আগেই খাওয়ার ডাক পড়ল। আমরা খেতে চলে গেলাম। মিষ্টি খালাও আমাকে গান শেখার কথা কইলো। কি জ্বালা!
বিকালে স্যার আসলেন। আমারে টাইনা নিয়া গেল মুন। স্যাররে কইল, স্যার আজকে থেকে ও আমার সাথে গান শিখবে। স্যার দেখতে তো বেশ আলাভোলা মনে হইল। ভালো মানুষের মতো হেসে কইল, ও…… ভালো। তাহলে প্রথমে রেওয়াজ দিয়ে শুরু করি। কি বলো? গানে প্রথমে স্বরলিপি জানতে হয়। যেমন: সা…… বলো।
- সা…
- আরেকটু জোরে।
- সা……
- আরেকটু।
- (চিল্লাইয়া) সা………………
আমার সা এর ঠেলায় পুরা ঘর কাঁইপা উঠল। স্যারও বেতের টুল থেকে পইড়া যাইতে লাগলেন। মিষ্টি খালা আর সানজিদা আপু দরজা দিয়া উঁকি মাইরা দেখতে আসলো ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। মুন আমার পাশে বইসা মুখ চাইপা হাসতেসে। স্যার কোনোমতে টাল সামলাইয়া কইলেন, ইয়ে মানে… ভালো। তবে সকাল বিকাল প্র্যাক্টিস করতে হবে। আমি মনে মনে কইলাম, আমার কাউয়ার গলা সকাল বিকাল শুনলে আশপাশের বাড়ি ফাঁকা হই যাইবো।
সন্ধ্যায় চা নাস্তা কইরা পড়তে বসলাম। সবাই গল্প করতেসে। আমি রুমে এসে আমার টেবিলে বসলাম। আজকে খালু কিছু টুকটাক নিয়া আসছে বাসা থেকে। মনে হয় খদ্দের পাই গেসে বাসাটা বেঁচার জন্য। আমি একবার আব্বা আম্মার ছবির দিকে তাকাইলাম। তারপর ক্রাশের বোতামটা হাতের মুঠোয় নিলাম। এখনো ওটা গলায় আছে। কেন যেন ভুলতে পারতেসি না। দুইটা মাসে আমারে আষ্টেপৃষ্টে পেঁচাই ফেলসে। ওর বোকা বোকা চেহারাটা ভাবতে আমার বেশ লাগে। প্রথম দিন আমার I love you শুইনা যেভাবে বেকুবের মতো তাকাইছিল! মনে পড়তেই আমি মুচকি হাসতে লাগলাম। পেছন থেকে মুন কইল, প্রেম করতেছিস নাকি! এমন মুচকি হাসতেছিস? আমি খেয়াল করি নাই ও কখন রুমে আসছে। আমি কইলাম, খালি প্রেম করলে মানুষ হাসে? মাত্র বয়স চৌদ্দ। এখনো আমার প্রেম করবার বয়স হয় নাই। মুন আমার দিকে অবাক হইবার ইমোজির মতো তাকাই কইল, পুরা বিশ্বে এই বয়সের মাইয়ারা বি এফ নিয়া ঘুরে আর তোর এখনো প্রেম করবার বয়স হয় নাই!? আমি ভ্রূ কুঁচকে কইলাম, তুইও করিস নাকি! সে বিজ্ঞের মতো কইল, আমার সাথে যে প্রেম করবে সে এখনো ইহলোকে আসে নাই। প্রেম করার জন্য পটানো লাগে। আমারে পটানো আর দেয়ালে মাথা ফাটানো একই কথা।
- এ্যাঁহ্, ঢঙ। আয়, পড়বি। বড্ড বেশি ফাঁকিবাজ হই গেছিস।
আমি ওরে কোনোমতে কাটাইলাম। কিন্তু ক্রাশের ছবি কিছুতেই মন থেইকা মুছতে পারলাম না। রাতে শুইয়া শুইয়া যখন ক্রাশের কথা চিন্তা করতেসি তখন ফোনে ম্যাসেজ আসলো। আমি দেইখা চোখ মুখ বোঁচা করলাম। এ কে ভাই! আমার পিছু ছাড়ে না ক্যান! আমি নাম্বারটা সেভ করসি 'ব্যাটা বাটপার'। বেশি সম্মান দিয়া ফেললাম নাকি! যাগ্গে, সে ম্যাসেজ দিসে, ঘুমাই পড়ো। কাল থেকে নতুন স্কুল শুরু। শোনো, কোনো ছেলের দিকে তাকাবে না, কথা বলবে না, মিশবে না। না হলে আসলে তোমাকে বিয়ের পর কি করবো সেটা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবা না। শেষ লাইনটা পইড়া আমার কাশি উইঠা গেল। আমি একগ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে আবার ফোনটা হাতে নিলাম। আমি গাঞ্জা খাইসি নাকি! ভুলভাল দেখতেসি। একি!!! ঠিকই তো দেখলাম। হায় আল্লাহ!!! ক্রাশ গো, আমারে বাঁচাও। এ কোন ভ্যাম্পায়ারের পাল্লায় পড়লাম!!! মনে হইতেসে আমার সব রক্ত শুইষা কাগজ বানাইয়া তারপর ছাড়বো। দাঁড়া তোরে আমি ব্লক কইরা ছাড়মু। আমি ব্লকের অপশান খুঁইজা নাম্বারটা ব্লক কইরা দিলাম। সাথে সাথে আমার মনটা মুরগীর পালকের মতো হালকা হই গেল। আমি বাতাসে উইড়া গিয়া বিছানায় পড়লাম। তারপরই ঘুম।
সকালে আবার রিংটোন। এবার আমি ফোনটারে আছাড় মারমু। কালকেও সকাল সকাল ঘুম ভাঙাইছে। আজকেও। আমি চোখ কঁচলে ভালো করে দেখলাম। আননোন নাম্বার। ধুর ছাতা। এত আননোন নাম্বার থেইকা ফোন আসে ক্যান! আমি কি কথার দোকান খুলসি নাকি? কালকে ঐ ভ্যাম্পায়াররে ব্লক দিলাম। আজকে আবার কেডা! আবার বাজতেছে। আমি রিসিভ করতেই বেকুব হই গেলাম। তারপর ঢোক গিললাম।
- এখনো ঘুমাচ্ছিলে? কটা বাজে খেয়াল আছে? সেই কখন থেকে ফোন করছি। ধরোনি কেন? ভেবেছ ব্লক করেই আমার থেকে মুক্তি পাবে? পারবে না। অলরেডি বিশটা সিম কিনে রেখেছি তোমার জন্য। কয়টাতে ব্লক করবে? তোমাকে আমি সারাজীবনের মতো আমার জন্য সিল মেরে দিয়েছি। তুমি আর কারো না। সকাল বিকাল আমি তোমাকে মনে করিয়ে দেবো। আর এমন করলে দেখো কি করি। You will be mine. এখন তাড়াতাড়ি রেডি হও।
ফোনটা কাইটা দিল। আমি মাছের মতো খাবি খাইতেসি আর ফোনটা কানে নিয়া বইসা আছি। আল্লাহ, দড়ি ফালাও আমি উইঠা যাই। আজকেও মনে হয় আরেকটা ব্রাশ নামানো লাগবো।
.
.
.
.
রেডি হয়ে বের হতেই দুইটা সাইকেল চোখে পড়ল উঠানে। একটা পুরানো আরেকটা নতুন। মুনতাহা পুরানোটায় উইঠা বলল, আজকে আমার সাথে যাবি। কাল থেকে নিজে সাইকেল চালাই যাবি।
- আমি পারি নাকি!
- শিখে নিবি। সেই জন্যই আনাইসি। এখন ওঠ দেরি হই যাইতেসে।
ও আমারে সাইকেলের ব্যাক সিটে নিয়া রওনা দিল। আটটা বাজার পনের মিনিট আগে পৌঁছাইলাম। এখানে ক্লাস সকাল আটটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত। মুন বলল, তিন তলার মাঝের রুমটা আমাদের ক্লাস। তুই যা আমি আসতেছি। ও সাইকেল পার্ক করতে চইলা গেল। আমি হাঁটা দিলাম। স্কুলটা আমার আগেরটা থেকে ছোট। একটা মাঠের দুইপাশে দুইটা বিল্ডিং। শুনসি একটাতে ফোর থেকে সেভেনের ক্লাস হয়। আর আরেকটাতে এইট থেকে টেন। ক্লাস সিক্স থেকে টেন অবধি দুইটা কইরা সেকশান। খালু নাকি আমাদের একসাথে রাখার জন্য সেকশান এ তে ভর্তি করাইসে। আমি তিনতলায় উঠে মাঝের রুমটাতে ঢুকলাম। গিয়া বসলাম ফার্স্ট বেঞ্চের প্রথম সিটে। সাথে সাথে সবাই আমার দিকে এমন কইরা তাকাইলো যেন মুরগী হইয়া শিয়ালের খাঁচায় ঢুকসি। আমার অস্বস্তি লাগতেসে। মুনটা কেন যে আসতেসে না। হঠাৎ একটা ছেলে রুমে ঢুকে আমার দিকে নাক মুখ কুঁচকে কইল, তুমি এখানে বসছো কেন? আমি কইলাম, কেন কি হইসে?
- এটা আমার সিট।
- নামটা তো দেখি নাই। দেখলে বসতাম না।
- এখন সরো। আমি এখানে বসবো।
- কেন? তুমি তো পরে এসেছো তাহলে এখানে বসবে কেন?
- কারন এটা আমার সিট। নতুন নতুনের মতো থাকো। ঝামেলা করো না। ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো। তুমি জানো না আমি কে।
মুন এসে বলল, রাতুল ও বুঝতে পারে নাই। ছোঁয়া ঐ বেঞ্চে চল। আমি মুখে চিনা হাসি দিয়া কইলাম, ও, তুমি রাতুল! তোমার থেকে এটা আশা করি নাই। রাতুল বলল, কেন? আমি উদাস মুখ করে বললাম, আমি শুনছিলাম, তুমি নাকি অনেক দয়ালু। কারো সাথে ঝামেলা করো না। আমি মনে হয় ভুল শুনেছিলাম। মুন চাপা গলায় বলল, ছোঁয়া কি করছিস! রাতুল এদিক ওদিক তাকাল। সবাই আমাদের দিকে তাকাই আছে। হঠাৎ সে কিছু না বলে সুড়সুড় করে ব্যাগ নিয়ে অন্য বেঞ্চে চলে গেল। মুন অবাক হয়ে ফিসফিস করে বলল, এটা তুই কি করলি? আমি শয়তানি হাসি দিয়ে, ঠান্ডা বোমা মারলাম। তুই বুঝবি না। বস সিটে। ও আমার পাশে ব্যাগটা রাখল। একটু পরেই স্যার চইলা আসল। স্যার আমাকে পরিচয় করাই দিলেন। আজ থেকে আমার রোল ৪৩। আজকে প্রথমেই পাইলাম বিজ্ঞান ক্লাস। আমি কালকে অধ্যায়টা পড়ছি। তাই আমার বুঝতে অসুবিধা হয় নি। আমি মনোযোগ দিয়ে দুইটা ক্লাস করলাম। আমার মনে হল রাতুল আমার দিকে তাকাই থাকে। ও আমার পাশের সারিতে দুই বেঞ্চ পরে বসছে। আমি পেছনে ফিরতেই দেখি ও স্যারের দিকে তাকাই আছে। কিন্তু কেন যেন মনে হইতেসে ও এতক্ষণ আমার দিকেই তাকাই ছিল।
দশটায় আধা ঘন্টার টিফিন টাইম। আমি আর মুন নিচে নামতে ছিলাম। তখন হঠাৎ সিঁড়িতে আমারে ধাক্কা মাইরা কইল, একপাশে হাঁটতে পারো না? পুরা পথ মেরে রাখসে। বলেই নিচে নেমে গেল। আমি চুপ করে রইলাম। এ মনে হয় তার ছেঁড়া। দাঁড়া একবার সুযোগ পাইলে সুধে আসলে সব শোধ করমু।
চলবে…
আমি চুপ করে রইলাম। এ মনে হয় তার ছেঁড়া। দাঁড়া একবার সুযোগ পাইলে সুধে আসলে সব শোধ করমু। দুই জনে এসে একটা বেঞ্চে টিফিন খাইতে বসলাম। মুন বক্স খুলতে খুলতে জিগাইলো, রাতুল তোকে সিট ছেড়ে দিল কেন? আমি কইলাম, নতুন কারো সামনে ভালো সাজাটা মানুষের অভ্যাস। আমি যখন বললাম যে আমি ওকে ভালো বলে জানি তখন ও আমার সাথে খারাপ ব্যবহারটা করতে একটু দ্বিধা করতেছিল। মুন বলল, ও। তাই বল। সেইজন্যই তো বলি রাতুল এত সহজে তার জায়গা ছেড়ে দিল কেন। হঠাৎ দেখি ক্লাস ফাইভের একটা ছেলে কাঁদতেসে। মুন দেইখা বলল, আজকেও। আমি জিগাইলাম, ঘটনা কি? ও বলল, ও জিতু, রাতুলদের সাথে ক্রিকেট খেলতে চায়। কিন্তু রাতুল ওকে খেলায় নেয় না। বার বার ধমক দিয়ে তাড়াই দেয়। আমি বললাম, এই ছেলের সমস্যা কি? খালি সবার উপর ক্ষমতা দেখায়। দাঁড়া, আজকেই টাইট দিমু।
মুন যাইতে মানা করল। শুনলাম না। আমি টিফিনটা রাইখা রাতুলের কাছে গেলাম। সে মাত্র ব্যাটিংয়ের পজিশান নিতেছিল। আমি গিয়া বললাম, আমি খেলবো। সে হাইসা উড়াই দিয়া কইল, মেয়ে হয়ে আসছে ব্যাট বল খেলতে। ব্যাট আলগাইসো কোনদিন।
- যদি পারি?
- পারবা না।
- বাজি?
- হুহ্, বাজি। তিনটা বল করবো। যদি একটা সিক্স মারতে পারো তো তুমি জিতা আর যদি না পারো তো আমি যা বলবো তাই করতে হবে।
- আমি রাজি। আর হারলে জিতু তোমার বদলে খেলবে।
- আমিও রাজি।
মুন আমার কানে ফিসফিস করে বলল, ওর সাথে খেলার চ্যালেন্জ নিলি! ও আমাদের স্কুলের বেস্ট ক্রিকেটার। পারবি ওর সাথে? রাতুল বলল, কি হল? ভয় পেয়ে গেলে? আমি ওর থেকে ব্যাট কাইড়া নিলাম। বাপ রে! ওজন আছে। এটা দিয়ে সিক্স মারা চারটি খানি ব্যাপার না। কিন্তু আমাকে তো পারতেই হবে। রাতুল বল নিয়ে আমার দিকে শয়তানি হাসি দিল। আমি ঢোক গিললাম। পারমু তো!? না পারলে কি যে করতে বলে কে জানে। ব্যাটা এক নাম্বারের ফাজিল মনে হইতেসে। আল্লাহ রক্ষা কইরো। ক্রাশের ঠেলায় বাচ্চাদের ব্যাট বল দিয়া খেলসি। এখন এই ভারি ব্যাটে কি পারমু!!!?
রাতুল প্রথম বল ছুইড়া মারল। বল আমার নাগালের বাইরে। মারতে পারলাম না। রাতুল দেইখা হাসল। সাথে তার বন্ধুদেরও সেই হাসি। ইচ্ছা করতেসে সবগুলার দাঁত কপাটি খুইলা হাতে ধরাইয়া দেই। আমি পজিশান নিতে নিতে দ্বিতীয় বলও ছুঁড়ে মারল। আমি টাল সামলাতে গিয়া পইড়া যাইতে লাগলাম। ভাগ্য ভালো পড়ি নাই। রাতুল হাতের মধ্যে বল নিয়া আমাকে দেখাইতে দেখাইতে উপরে ছুড়তেসে আর ক্যাঁচ ধরতেসে। আমি আবার ঢোক গিললাম। লাস্ট বল। আমার সম্মান। না, ছোঁয়া তোকে পারতে হবে। তুই না চেরির বৌ। পারবি পারবি। চেরিকে দেখেছিস না কত্ত ভালো খেলতো। প্রত্যেক ওভারে চার ছক্কা। এই লাতু ফাতু তোর চেরির কাছে কিচ্ছু না। তাহলে আমি কেন ভয় পাইতেসি? আমাকেও পারতে হবে। নইলে আজকের পর আমি মাথা উঁচু কইরা দাঁড়াইতে পারমু না। রাতুল চিনা হাসি দিয়া লাস্ট বল ছুঁইড়া মারল। আমি চোখ বন্ধ কইরা সেই লেভেলের চিক্কুর দিয়া ব্যাট হাকাইলাম। আমার চিক্কুরে সবাই তাকাই আছে। চারপাশ চুপ। আমি তাকাই দেখি সবাই আমার পেছনে তাকাই আছে। আমিও তাকাইলাম। কিছুই তো নাই। সব ঝোপঝাড়। বল কই? সবাই হঠাৎ হইহই করে উঠল। আমি তাকাই আছি রাতুলের দিকে। তার মুখ বাংলার পাঁচ হইয়া আছে। মুন দৌঁড়াই আইসা কইল, বোইন তুই সেই লেভেলের সিক্স মারছিস। শুইনা আমার জান ফিইরা আসল। আমি পারসি। আমি পারসি চেরি ফল। আমি রাতুলের কাছে গিয়া দাঁড়াইলাম। আমি ওর কানের কাছে গিয়া ফিসফিস করে বললাম, অহঙ্কারই পতন। আমি জোর গলায় বললাম, রাতুলের বদলে জিতু খেলবে। তারপর ওর দিকে ফিইরা কাঁধে হাত রাইখা বিজ্ঞের মতো কইলাম, Don't show ego so much. It will kill you. Mind it.
আমি টিফিন বক্সটা নিয়া উপরে চইলা আসলাম। মুনও চইলা আসলো। সব ক্লাস ভালো মতোই শেষ হইল। বাড়িতে রুমে চিৎপটাং হইয়া শুইয়া পড়লাম। ওফ! কি একদিন গেল। স্কুলের প্রথম দিনই অবস্থা টাইট। মুন ব্যাগ রাইখা আমার কাছে চেয়ার টেনে বইসা কইল, চেরি কে? আমি অবাক হয়ে বললাম, কোন চেরি?
- সেটা আমি কি করে বলব? আজকে ব্যাটিং করার সময় চেরি বলে যে এক চিৎকার দিলি। আমার কানের পর্দার বারোটা বেজে গেসে।
- সত্যি! আমি চেরি বলে চিৎকার দিসি?
- না, আমি তো মদ খাইয়া ওখানে দাঁড়াইছিলাম তাই উল্টা পাল্টা শুনসি।
আমি বিড় বিড় কইরা কইলাম, আমার কি হইবো। আনমনেও চেরি, খেয়ালেও চেরি, স্বপ্নেও চেরি। শুধু বাস্তবে নাই। এই চেরিকে কবে ভুলমু। আল্লাহ মালুম। মুন বলল, কি হইল তোর আবার? বিড়বিড় করিস কার সাথে?
- জামাইর সাথে। আমি গোসলে যাইতেসি।
আমি উইঠা কাপড় চোপড় নিয়া ওয়াশরুমে ঢুইকা গেলাম। আয়নার সামনে বোতামটা ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়াই রইলাম। মনে মনে বললাম, তুমি আছো মহাসুখে, আমি আছি হাজার ঝামেলায়। একবার তোমাকে সামনে পাই, বুঝাই দিমু আমি কি ছিলাম। এখন কি হইসি।
গোসল তো করি কাউয়ার স্পেশাল গান গেয়ে। আব্বা আম্মা চলে যাইবার পর কাউয়া সং মুখ বাইর হয় নাই অনেক দিন। আজকে আবার কাউয়া সং গাইলাম ইচ্ছা মতো। আমার কাউয়া সং শুনলে গানের স্যার তো ইয়ে হই যাইবো। যাগ্গে হোক। আমার কি। আমি টাওয়াল মাথায় পেঁচাই বাইর হইলাম। দেখি যেমনের কাপড় চোপড় তেমনি রইসে। মাইয়া গেল কই? আমি ভিজা কাপড় নিয়া ছাদে আইসা দেখি ও কারো সাথে ফোনে ফিসফিস করে কথা বলতেসে। আমি চুপি চুপি গিয়া শুনতে চাইছিলাম। কিন্তু ও টের পাইয়া গেল। আমার দিকে ফিরে বলল, তোর গোসল শেষ?
- না হলে কি তুই ওয়াশরুমে আমার সাথে দাঁড়াই আছিস? কার সাথে কথা বলতেছিলে?
- কারো সাথে না।
- প্রেম করতেছিস নাকি?
- আরে বললাম তো কেউ না। আমি গোসল করতে যাইতেসি।
মুন নেমে গেল। আমার কেমন যেন সন্দেহ হইতেসে। মনে হইতেসে সে প্রেম করতেসে। দাঁড়া আমি খুঁইজা বাইর কইরা ছাড়মু।
.
.
.
.
- হ্যালো…
- হুম বলো।
- ছোঁয়া সন্দেহ করছে। আমাকে ছাদে কথা বলতে দেখে ফেলেছে। তাই এখন ওয়াশরুমে ঢুকে কথা বলতেসি।
ফোনের ওপাশ থেকে হেসে বলল, কি বলেছে?
- বলেছে আমি নাকি প্রেম করছি।
- তাহলে করে ফেলো।
- কি?
- প্রেম।
- আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?
- ছোঁয়া যাতে সন্দেহ না করে তার জন্য এটুকু করতেই পারো।
- আপনাদের দুইজনের জন্য আমি পাগল হয়ে যাবো। আর প্রেম করা কি সোজা কথা? ছেলে পাবো কোথায়?
- আজ বিকাল চারটায় দেখা করবে।
- কার সাথে?
- সেটা পরে জানাবো। আগে একটা জায়গা বলো।
- উম…… আমাদের স্কুল থেকে কিছুদূরে একটা নদী আছে। নাম ময়ূরাক্ষী। সেখানে কিছু ছাউনি আছে। ওখানে দেখা করবো।
- ওকে।
- কিন্তু কার সাথে?
- তোমার প্রেমিকের সাথে।
সাথে সাথে ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিল। মুন মাথা চাপড়াইতে চাপড়াইতে কইল, এই দুইজনের ঠেলায় আমি পাগল হই যামু। এখন নাকি ওদের প্রেমের চক্করে আমারেও প্রেম করা লাগবে!
.
.
.
.
আমি রুমে চক্কর দিতেসি আর মুন ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার অপেক্ষা করতেসি। ও গোসল করে বের হতেই আমি ওরে আটকাইলাম। আমারে দেইখা ওর মুখ শুকাই গেল। আমি কইলাম, এতক্ষণ কি করতেছিলি?
- কি করমু? গোসল।
- কেউ ফোন নিয়ে গোসল করতে যায়?
- আরে একটু দরকার ছিল। তুই কেন যে তখন থেকে এতো জেরা করতেছিস। চল খাবি। আমার খুদা লাগছে।
আমারে কিসু বলার সুযোগ না দিয়া চইলা গেল। আমিও ছাড়ার পাত্রী নই। চিনা জোঁকের মতো ওর পিছে লাইগা আছি। আমি একবার ওয়াশরুম গেসে। বের হইয়া দেখি পাখি ফুরুত। মিষ্টি খালাকে জিগাইতেই কইল, ও একটু বাইরে গেসে। আমি সাথে সাথে দৌঁড় দিলাম বাইরে। ঐ যে সাইকেলে করে যাইতেসে। আমি উসাইন বোল্টের মতো দৌঁড় দিলাম। দেখলাম ও স্কুলের পথ ধরসে। তাই থাইমা একটু নিঃশ্বাস নিলাম। তারপর আবার আগাই গেলাম। স্কুলে আইসা দেখে ও নাই। গেল কই? মনে হয় আরো সামনে। আমি হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর যাইতেই ময়ূরাক্ষী নদী পড়ে। আগে আসছিলাম। ওখানেই ওরে পাইলাম। দেখলাম একটা ছেলের সাথে সামনাসামনি ছাউনিতে বইসা আছে। আমি একটা ঝোপের পেছনে লুকাই ওদের কথা শুনার চেষ্টা করলাম। ধুর ছাতা কিছুই শোনা যাইতেসে না। তাও কান পাইতা রাখলাম।
(ছাউনিতে)
মুন একটানা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ছেলেটা উসখুস করছে। কিছু বলছে না দেখে মুন বলল, আপনাকে কি দুলাভাই পাঠিয়েছে?
- কে? আ…
- শসসসসস্। দুলাভাইয়ের নাম বলা বারণ। …… আপনার নাম?
- রেদোয়ান।…………এক মিনিট…
ওর ফোন আসতেই রিসিভ করল। ফিসফিস করে বলল, এত পিচ্চি মেয়ে পাঠিয়েছিস আমার সাথে প্রেম করার জন্য!? মুন উদাসমুখে নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার বন্ধুও কিন্তু আমার বয়সী মেয়ের প্রেমেই হাবুডুবু খাচ্ছে।
চলবে…
মুন উদাসমুখে নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার বন্ধুও কিন্তু আমার বয়সী মেয়ের প্রেমেই হাবুডুবু খাচ্ছে। রেদোয়ান অপ্রস্তুত হয়ে কেশে বলল, ইয়ে মানে…
- আমি এখানে প্রেম করতে আসিনি। এসেছি আপনার বন্ধুর জন্য। সব নিশ্চয়ই জানেন। ছোঁয়া সন্দেহ করছে। তাই আপনার সাহায্য লাগবে। বেশি কিছু করা লাগবে না। আপনাকে আমার সাথে নিয়ম করে একঘন্টা চ্যাট করতে হবে আর ফোনে মাঝে মধ্যে কথা বলতে হবে। এই…
- আচ্ছা, আমি ভেবে দেখবো।
- এটা হল আমার নাম্বার। যদি রাজি থাকেন তো জানাবেন। বাই।
মুন বেরিয়ে এল ছাউনি থেকে। রেদোয়ান ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে করবে কি না। যেমন বাচ্চা ভেবেছিল তেমন মনে হল না। বরং স্ট্রেট ফরোয়ার্ড।
আমি দেখলাম মুন বাড়ির দিকে রওনা দিসে। কি কথা হইল কিছুই শুনতে পাইলাম না। কচু, শুধু দৌঁড়াই আইসা বলটাই পড়ল। ও বাড়ি পৌঁছানোর দশ মিনিট পরে আমি বাড়ি ঢুকলাম। গিয়া দেখি গানের স্যার আসছে। আমিও গিয়া বসলাম। বার বার ওর দিকে তাকাইলাম। কিন্তু ওর মুখোভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হইল না। কি চলতেসে ওর মাঝে! জানা দরকার।
সন্ধ্যায় মিষ্টি খালা সেই লেভেলের চিৎকার দিয়া কইল, মুন…… ফ্রিজের গাজর কই? মুন আইসা কইল, আমি জানি না। মিষ্টি খালা কোমরে হাত দিয়া কইল, তুই ছাড়া এখানে গাজর পাগল কে আছে? এমন সময় দুই হাতে দুইটা গাজর নিয়া ছাদ থেকে নামতেসি আর মুনের কথা চিন্তা করতেসি। ওদের সামনে আইসা আনমনে একটা গাজরের অর্ধেকে কামড়াই মুখে নিয়া ফেললাম। ওরা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল কইরা তাকাই আছে। আমার খেয়াল হইতেই কইলাম, কি হইসে? মুন কাছে এসে আমারে জোরে চিমটি কাটল। আমি চারশো চল্লিশ বোল্টের একটা চিক্কুর দিয়া ওর থেকে তিন হাত সইরা কইলাম, চিমটি দিস ক্যান?
- আমি স্বপ্ন দেখতেসি কি না তাই দেখতেছিলাম।
- তাইলে নিজেরে চিমটি কাট। উফ!!! কি জোরে চিমটি দিসে। লাল হই গেসে।
মিষ্টি খালা বলল, তুই কবে থেকে গাজর খাস? আমি ভাবতেসিলাম তখনও। তাই হঠাৎ মুখ থেইকা বাইর হই গেল, প্রেম কবে থেকে? চিন্তার বিষয়। মিষ্টি খালা আর মুন একে অপরের দিকে তাকাইলো। আমার খেয়াল হতেই বললাম, কি যেন বলতেছিলা গাজরের কথা? জানো কতদিন গাজর খাই নাই। তাই সব সুদে আসলে মিটাই নিসি।
- মানে?
- যতগুলা গাজর ছিল সব পেটে চালান করসি৷ কি যে ভালো লাগতেসে। কিন্তু এত গাজর খাইও জট ছাড়াইতে পারলাম না। বুদ্ধিতে জঙ ধরে গেছে।
মিষ্টি খালা অবাক হয়ে কইল, এক কেজি গাজর!!!!! মুন তার কাছে গিয়া কইল, আম্মা ওরে মনে হয় কোনো গাজর পাগল ভূতে ধরসে। এখনই ওঝা ডাকো। আমি ধমক দিয়া কইলাম, মুন, তুই চুপ করবি না তোর ঘাড় মটকামু।
আমি রুমের দিকে এগিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলাম, এই মেয়ে প্রেম করতেসে। কিন্তু কতদিন হইতে পারে। কে ছেলেটা? জানা দরকার। যাইতে যাইতে ডান হাতেরটা শেষ করে বাঁ হাতের গাজরে কামড় দিলাম। ক্রাশরে ছাড়লাম কিন্তু গাজররে ছাড়তে পারলাম না।
.
.
.
.
ছয় বছর পর……
- মুন, ওঠ।
- আরে ঘুমাতে দে।
- মুন কি বাচ্চি। উঠবি না পানি ঢালমু।
- যা তো। কালকে কতদূর জার্নি করে আসছি। এখন ঘুমাইতে দে।
- এ্যাঁহ, নিজেই খালি জার্নি করে আসছে। আমি তো উইড়া উইড়া আসছি। কেমনে যে তোরে রেদোয়ান ভাই পছন্দ করছিল। আল্লাহ জানেন। উঠ কইতেসি।
হঠাৎ ওর ফোনের রিংটোন বাইজা উঠল। ও হাঁতড়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, হ্যালো। সাথে সাথে ওর ঘুম উধাও। ও দ্রুত বিছানা থেকে নাইমা বলল, আমি এখুনি আসছি। জাস্ট আধা ঘন্টা। ফোন বিছানায় ছুইড়া মাইরা ওয়াশরুমে দৌঁড় দিল। আমি কল লিস্ট চেক কইরা দেখলাম রেদোয়ান ভাই ফোন দিসিলো। আমি হতাশ হই বললাম, আমি এতক্ষণ গুতাই পারলাম না। আর রেদোয়ান ভাইয়ের এক কলেই মেয়ে ওয়াশরুম! হায়রে!!! বোইনের কোনো মূল্য নাই জামাইর কাছে। আমারে কেউ এক চামুচ পানি দে ডুইবা মরি।
কালকে ভার্সিটি হল থেকে দুইজন আসছি। আমরা একই ভার্সিটিতে ভর্তি হইসে। আমার সাথে সেই লেভেলের ধুমাইয়া পড়াশুনা করছিল ভর্তির আগে। তাই আজকে দুইজনে একসাথে। হলেও একসাথে থাকি তবে সাবজেক্ট আলাদা। আমি সাইকোলজিতে পড়তেসি। মিষ্টি খালা অবশ্য বলছিল মেডিকেলে ট্রাই করতে যেহেতু আমার রেজাল্ট অনেক ভালো ছিল। কিন্তু কেন জানি করি নাই। সাইকোলজিতে চলে গেলাম। আমার জন্য পার্ফেক্ট সাবজেক্ট। বলে না রতনে রতন চিনে, আমি চিনসি পাগল।
আমি ধীরেসুস্থে খাবার টেবিলে আইসা বসলাম। সবাই মুনের দিকে তাকাই আছে। আমিও যোগ দিলাম। সে গোগ্রাসে গিলতেসে। মনে হইতেসে কয়েক বছর না খাইয়া আছে। খাওয়া শেষ কইরা পানি খাইতে খাইতে আমাদের দিকে ইশারা করে জিগাইল, কি? খালু বললেন, এমন করে খাচ্ছিস কেন? আমি গালে হাত দিয়া উদাস ভঙ্গিতে রুটি নিতে নিতে কইলাম, জামাইর ডাক পড়সে, তাই এমন রাক্ষসের মতো গিলতেসে। মনে হয় রেদোয়ান ভাই ওরে খাওয়াইবো না।
- ছোঁয়া…… আমি আসছি।
মুন বের হই যাইতেছিল। আমি কইলাম, রেদোয়ান ভাইয়ের পকেট খালি করবি বলে পার্সটা রেখে যাচ্ছিস? মুন মুখ বোঁচা করে পার্সটা নিয়া দৌঁড় দিল৷ আমি মুখ কালো কইরা রুটি চিবাইতেসি আর ভাবতেসি, আমার আর এ জীবনে হইবো না।
আমি রুমে এসে বিছানায় শুইলাম। ডান হাতে একটা ইয়া মোটা গাজর। এই ছয় বছরে যে কতো গাজর খাইসি!!! তার হিসাব একটা খরগোস করতে করতেও হার্ট অ্যাটাক করবো। আমি সেই রকমের মোবাইল টিপতেসি। টিইপ্পা হের রস কষ সব বাইর কইরা ফেলতেসি। মাঝে মধ্যে মনে হয় মোবাইলের মুখ থাকলে কইতো, বোইন পায়ে পড়ি, আর টিপিস না। আমার শরীরের আর কিছু আস্তো নাই। ওরে আমারে কেউ বাঁচা। এমন সময় ম্যাসেজ আসলো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুললাম।
' ম্যাসেজ দাওনি কেন? বাড়িতে পৌঁছে ম্যাসেজ দিতে বলেছি না। এতটা মন ভোলা হলে চলে? সাবধানে থাকবে। আর মাত্র কয়টা দিন। লাভ ইউ।
~ লাভার ভ্যাম্পায়ার'
আমি ফোনটা নামাই রাখলাম। ছয়টা বছরে দশটা সিম বদলাইছি, পঁচিশটার উপরে নাম্বার ব্লক করসি। কিন্তু এই ভ্যাম্পায়ারের পিছু ছাড়াইতে পারি নাই। কি করে যেন আমার নাম্বারটা তার কাছে পৌঁছাই যায়। মাঝে মধ্যে ভাবি, আমার ফোনে কোনো গোপন এ্যাপস আছে নাকি যার মাধ্যমে সে সব জানতে পারে! সকাল বিকাল টাইম টু টাইম ম্যাসেজ। খাইসি কি না, পড়তেসি কি, কেমন আছি। সাথে একটা বাক্য, আই লাভ ইউ। কিছু বলার না থাকলেও এই লাইনটা প্রত্যেকদিন আসবেই। ক্লান্ত হই গেলাম৷ এখনো পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না কে এটা। একটা দিনও মিস যায় নাই যে সে আমারে সকালে কল দিয়া ঘুম থেকে জাগায় নাই। এখন ভাবি, কে হতে পারে যে আমারে এক মুহুর্ত ভুলতে পারে না। আমিও তো পারি নাই, আমার চেরি ফলরে ভুলতে। মাঝরাতে মাঝেমধ্যে জাইগা গেলে হঠাৎ ওর কথা মনে পড়ে। তখন দুই ফোঁটা পানি পড়া যেন অভ্যাস হয়ে গেসে। আমি বোতামটা ধরে চেরির চিন্তায় ডুইবা গেলাম। তখনই মিষ্টি খালা বলল, বের হবি না?
- হুম। রেডি হচ্ছি।
আমি উইঠা পড়লাম। বিয়ার শপিং করতে হবে। মুন পাগলিটার বিয়া। রেদোয়ান ভাইয়ের সাথে। ছয় বছর ধরে প্রেম করতেসে। প্রথমে অস্বীকার করছিল। কিন্তু একদিন আমার কাছে হাতে নাতে ধরা খাই শিক্ষা হইসে। বেটি আমারে একটা থ্যাংকসও জানাইলো না। আমি মিষ্টি খালা আর খালুরে বিয়ার জন্য রাজি করাইসি। এখন তো আমারে চিনবে না। সব দোষ রেদোয়ান ভাইয়ের। দাঁড়া বিয়ার দিন কোটি টাকা দিলেও জুতা ফেরত দিমু না।
মিষ্টি খালাকে নিয়া বাইর হইতেই আরেক ঝামেলা খাঁড়া। বাপরে!!! ঝামেলার শেষ নাই। মিষ্টি খালা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো রাতুল? বেক্কলটা দাঁত কেলাই বলল, ভালো আন্টি। আপনি কেমন আছেন?
- ভালো।
সে আমার দিকে তাকাই গলায় মধু ঢাইলা বলল, কেমন আছো, ছোঁয়া? আমি তিতা গলায় কইলাম, নিমপাতার রস খাইলে যেমন ভালো থাকে তেমন। আমার এমন কথায় ও কিছু মনে করল না। এতগুলা বছরে কমসে কম দশবার প্রপোজ করসে। একবারও সংসদে বিল পাস হয় নাই। তবুও পিছু ছাড়ে না। আমি আসলে কেমনে কেমনে টের পাই যায়। পরদিন আসি এক পায়ে খাঁড়া। আর ভালো লাগে না।
আমি বললাম, খালা চলো। রাতুল কইল, আমিও ঐদিকে যাইতেসি। চলেন একসাথে যাই। আমি ঘর থেকে আমার স্কুটিটা বের করলাম। যদি আর একবার বলসে আমাদের সাথে যাবে তো এক পা আমার স্কুটির সাথে বাঁইধা টান দিমু। আমি স্কুটিতে উইঠা মিষ্টি খালার দিকে তাকাই আছি। মিষ্টি খালা আমার মতিগতি বুঝতে পাইরা বলল, তোমার সাথে পরে কথা হবে। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। রাতুল মুখ কালো করে বলল, আচ্ছা, আন্টি। সাবধানে যাবেন আর ছোঁয়া……। আরও কিছু বলার আগে ওকে ধুল খাওয়াইয়া বের হই গেলাম।
আজকে কিছু শপিং করলাম। ইস্!!!! কত সুন্দর সুন্দর শাড়ি!!! ইচ্ছা করতেছিল সব নিয়া আসি। আমি গায়ে হলুদের জন্য একটা জামদানি শাড়ি পছন্দ করছিলাম লাল আর সাদা রঙের। সেই সুন্দর। কিন্তু এতো দাম যে শুইনাই আর দ্বিতীয় বার তাকাই নাই৷ ইস্!!! শাড়িটা এতো সুন্দর ছিল!!! যাগ্গে। কি করা। কেনা কাটা করে চইলা আসলাম দুইটার দিকে। এসে ফ্রেশ হতে চইলা গেলাম। কাউয়া সং এখন আর নাই। কয়েক বছরে গানের স্যার ওটাকে অনেক পরিশ্রম করে কোকিল সংএ পরিণত করতে সক্ষম হইসে। কোকিল কন্ঠে গোসল কইরা বাইর হই দেখি বিছানায় একটা প্যাকেট। কৌতুহলী হইয়া ভেতরে উঁকি দিলাম। একটা শাড়ি। বের করতেই আমি খুশিতে ব্যাঙাচীর মতো লাফাইতে লাগলাম। সেই লাল সাদা জামদানি শাড়িটা। আমি কিছুক্ষণ শাড়িটা নিয়া লাফাই হঠাৎ চোরের মতো চোখ সরু কইরা কইলাম, এটা এখানে আইলো কেমনে!
চলবে…
আমি কিছুক্ষণ শাড়িটা নিয়া লাফাই হঠাৎ চোরের মতো চোখ সরু কইরা কইলাম, এটা এখানে আইলো কেমনে! তখন মুন রুমে ঢুকল। আমারে দেইখা কইল, এমন শিয়ালের মতো উঁকি মাইরা আছিস কেন?
- এটা এখানে আসলো কেমনে?
- আমি আনসি।
- ও।
আমি মন খারাপ কইরা শাড়িটা রাইখা দিলাম। ইস্, শাড়িটা এত পছন্দ হইসিলো, এখন তো এটা মুন পরবে। মুন আমার গায়ে শাড়িটা জড়াই দিয়া বলল, তোকে বেশ মানাইসে। চয়েজ আছে।
- আমাকে মানাই কি হবে? পরবি তো তুই।
- কে বলসে? এটা তোর জন্য।
- তুই আমার জন্য এত টাকা খরচ করলি!?
- আমি কেন খরচ করতে যাবো? তোর জামাই…
আমি মুখ সরু কইরা কইলাম, আমার জামাই আসলো কোত্থেকে? বিয়া করবি তুই। মুন আমারে কাটানোর জন্য বলল, আরে, ঐ আর কি। বলে ফেলসি। যা তো এটা পরে আয়।
- এখন?
- হুম। দেখবো তোকে।
- ইস্, দরদ একেবারে বেয়ে বেয়ে পড়তেসে। আমি এখন পরবো না। তোর গায়ে হলুদের দিনই পরবো।
আমি শাড়িটা তুলে রাখলাম। মুন কেন যেন মুখ কালো করে ফোন হাতে বেরিয়ে গেল। বুঝলাম না।
.
.
.
.
দুপুরে খেয়ে আমি বিছানায় শুয়ে ইচ্ছা মতো মোবাইল টিপতেসি। হঠাৎ সারা সায়েম এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। আমি অবাক হইয়া কইলাম, তোরা কোথা থেকে আসলি?
- আম্মুর সাথে।
- সানজিদা আপু আসছে? দাঁড়া দেখা করে আসি।
সানজিদা আপুর দুই ছেলে মেয়ে। সারা আর সায়েম। দুই জনে যমজ। আমি সানজিদা আপুর সাথে দেখা করতে যাইতে চাইলে দুইজনে দুইপাশ থেকে আমার বুকে মাথা রাইখা শুয়ে বলল, আগে আমাদেরকে একটা গল্প শোনাতে হবে। তারপর। কি এক জ্বালা! আমি কইলাম, আমি এসে শোনাই। ওরা ছাড়তে নারাজ। কি আর করা। শুরু করলাম।
- একটা ছোট দুষ্ট পরী ছিল। সে এতো দুষ্ট ছিল যে তার বাবা মা তাকে নিয়ে হয়রান হয়ে যেত। সে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতো। একদিন এক মানুষ ছেলের সঙ্গে দেখা হল। পরীটা দেখেই পছন্দ করে ফেলল। প্রত্যেকদিন এটা ওটার ছলে ছেলেটাকে দেখতে যেতো। একদিন পরীটা জানতে পারল ছেলেটা অন্য একজনকে ভালোবাসে। তখন পরীটা তাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেল। শেষ।
সারা বলল, এটা কোনো গল্প হল? আমি কইলাম, মনে কর এটা গল্পের ট্রেইলার। রাতে কমু। এখন ছাড় তো। আমি ওদের কবল থেকে বাইর হইয়া সানজিদা আপুর কাছে গেলাম। সানজিদা আপু মিষ্টি খালার সাথে কথা বলতেসে। আমি যাইয়া জড়াই ধইরা কইলাম, এই বোনটারে তো ভুইলা গেসো। একেবারে দেখতে আসো না।
- কি করতাম বল, তোর ফাজিল ভাগ্নী ভাগিনায় সারাদিন জ্বালায়।
- দুলাভাই আসে নাই।
- না। ও বিয়ের একদিন আগে আসবে।
- ভালো করসো। চলে আসছো। বিয়ের অবশ্য এখনো এক সপ্তাহ বাকি। আরো কেনাকাটাও বাকি। তুমি আসছো, এবার জমিয়ে বাকি কেনাকাটা করা যাবে।
হঠাৎ মুন আইসা বলল, তোরও তো জন্মদিন আসতেসে পরশু দিন। শুনে আমার মুখ কালো হইয়া গেল। সানজিদা আপু বলল, এখন কথাটা না বললেই নয়? মুন বলল, না। কারণ কালকে আমরা সবাই একটা পিকনিকে যাবো। রেদোয়ান ঠিক করেছে, কালকে ওর পরিবার আর আমার পরিবার ওদের বাংলোতে বেড়াতে যাবো।
- সেটা তো অনেক দূরে। কক্সবাজার। এতো দূর কে যাবে। তোরা যা। আমি যাবো না।
মুন আমারে জড়াই ধইরা কইল, তোমারে তো যেতেই হবে বোনটি। তুমি না গেলে তো মজাই হবে না।
- তোর মতলব কি বল তো।
- আমার মতলব হলো বিয়ের আগে তোমাদের সবার সাথে ঘুরতে যাবো।
- আমি এখন যাবো না।
- তো কি বিয়ের পর আমার হানিমুনে তোকে নিয়ে যাবো?
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম মিষ্টি খালা বলল, আরে বাবা, কি শুরু করলি। ছোঁয়া মা, ঘুরে আয়। মন ভালো থাকবে। এই সময় তো এমনিতেও মন খারাপ করে কাটাস।
- কিন্তু …
- আম্মার অর্ডার পেয়ে গেছো। এবার চলো, কাপড় গোছাবে।
মুন আমারে ঠেলতে ঠেলতে নিয়া গেল রুমে। আমি বড় কইরা নিঃশ্বাস ফেইলা কইলাম, পারলাম না মাইয়াটারে সোজা করতে। আমারেই জ্বালাই ফেলল।
.
.
.
.
রেদোয়ান একটা মাইক্রো ভাড়া করল। ভেবেছিল ওদের বাড়ির গাড়ি করে যাবে কিন্তু পরে সেটা নাকোচ কইরা দিল। রেদোয়ানদের চট্টগ্রামে নিজেদের বাড়ি। ওর বাবা ব্যবসায়ী। একমাত্র ছেলে রেদোয়ান। তাই পছন্দের কথা বলতেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে ওর বাবা মা।
আমরা সবাই রেডি হয়ে দশটার মধ্যে রেদোয়ানের বাড়ি পৌঁছাই গেলাম। আমরা মোট দশজন। একটা মাইক্রোতেই সবাই এঁটে গেলাম। সেখান থেকে রওনা দিলাম সাড়ে এগারটার সময়। মাঝে দেড়টার সময় একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করলাম। তারপর আবার রওনা দিলাম। রেদোয়ানের বাংলোয় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সোয়া চারটা বাইজা গেল। আমি গাড়ি থেকে নেমে আশপাশ তাকাইলাম। জায়গাটা সুন্দর। সবাই নামতেই রেদোয়ান সবাইকে রুম দেখাই দিল কে কোন রুমে থাকবে। রেদোয়ান আর আমাদের রুম পাশাপাশি। আহা! কি প্রেম!!! আমি কোন এক পাগলের প্রেমে পইড়া পুরা জীবনটারে ত্যানা ত্যানা কইরা ফেললাম। না হলে এতদিনে বিয়া সাদি কইরা দশ বাচ্চার মা হইতাম।
ডিনার কইরা সবেমাত্র বিছানায় পিঠ লাগাইলাম। এমন সময় মুন আইসা বলল, এখন শোয়াশুই নাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? সে বলল, সাগর পাড়ে আগুন জ্বালাবে। সবাই ওখানে যাবে। আমি আরো আরাম কইরা শুইয়া কইলাম, তোরা যা, আমি একটু ঘুমাই। মুন আমারে টাইনা উঠাইলো। বলল, সামনে বহুত ঘুমাইতে পারবি। উঠ। দেখি রেডি হইতে হবে। আমি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে কইলাম, এর জন্য আবার রেডি কিসের?
- শাড়ি পরমু।
- তো পর।
- তুইও পরবি।
- আমার কি বিয়া লাগসে? আমি পরমু ক্যান?
- আমার বিয়া লাগসে তাই। এবার ওঠ।
ও ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি, একগাছি কাচের চুড়ি আর একজোড়া নুপুর বাইর করল। আমি অবাক হয়ে বললাম, এগুলা এখানে আনছিস ক্যান? মুন নিজের শাড়ি বের করতে করতে বলল, আজকে এই শাড়িটা পরবি। এটাতে তোকে মানায়। ঐ লাভার ভ্যাম্পায়ারের দেওয়া নীল শাড়িটা। সুন্দর দেইখা যত্ন কইরা তুইলা রাখছিলাম। শাকচুন্নিটা কোন ফাঁকে নিয়া আসছে। আমি শাড়িটা নিজের কোলে নিয়া কইলাম, পরমু না। মুন আমারে মানসিকভাবে ব্ল্যাকমেইল কইরা বলল, আমি তো কয়দিন পরে চলেই যাবো। একটা অনুরোধ রাখতে পারবি না? ছয় বছর আগেও তো পরছিলি। এখন না হয় আবার পরবি। আমি ঘাড়ে হাত দিলাম। এখনও দাগটা আছে। হঠাৎ কইলাম, ওয়েট এ মিনিট। তুই কেমনে জানলি যে আমি ছয় বছর আগে শাড়িটা পরসি। কে বলসে তোরে? মুন আমতা আমতা করে বলল, এটা আবার জানার কি আছে। কেউ তোকে জন্মদিনের গিফট দিসে আর তুই পরবি না। তা হয়? তাই বললাম। আয় আজ তোকে আমি নিজে সাজাবো।
মেয়ের মতিগতি বুঝতে পারতেসি না। থাক, বিয়ার আগে একটা আবদার করসে যখন করুক। ও আমাকে সুন্দর কইরা সাজাই দিল। সাজ শেষে আমারে বলল, তোরে তো পুতুলের মতো লাগছে। দাঁড়া কাজলের টিপ দিয়ে দেই। নজর লেগে যাবে। আমি হাসলাম। ও বলল, এই হাসিস না। হাসিস না।
- কেন?
- মে মার যাউংগি তেরি খুব সুরুত মুসকান দেখকার।
- এমন পিডা দিমু যে এখান থেকে সাগরে যাই পড়বি। যা, রেডি হ।
মুন হেসে তৈরী হতে চইলা গেল। আমি দেখতেসি নিজেকে আয়নায়। এমন কইরা শুধু একজনের জন্যই সাজার ইচ্ছা ছিল এক সময়। আজ সে বিদেশে নিজের ভালোবাসারে নিয়া সুখের সাগরে ডুবে আছে।
.
.
.
.
সব রেডি। কাঠ যোগাড় করে রাখা হইসে। সবাই সাতটার মধ্যেই সাগর পাড়ে পৌঁছাই গেল। আমি আর মুন সবার পরে গেলাম। এমনিতেই আমরা সব সময় লেট করি। আজকেও করলাম। মুন গিয়া রেদোয়ানের সাথে বসল। আমি এক পাশে সইরা বসলাম। তখন থেকে দুইজনে কি নিয়া ফিসফিস করতেসে। ভাবলাম ওদের প্রেম আলাপ শুইনা আমার কি কাম। রেদোয়ানের বাবা মা মিষ্টি খালা আর সানজিদা আপুর সাথে কথা বলতেসে। সারা আর সায়েম নিজেদের মতো করে খেলতেসে। দুইটায় বালু ঘাটাঘাটি করতেসে। ভাবলাম একবার ধমক দিমু কিনা পরে ভাবলাম থাক। প্রথম আসছে একটু বালু পেটে পড়ুক স্মৃতি হিসাবে। আমি একলা বইসা আছি। মাঝেমধ্যে বাতাস লাগতেসে গায়ে। আমার খোলা চুলগুলা বাতাসে এলোমেলো হইয়া আমার মুখে চোখে ডুকতেসে। কি বিরক্তি!!! তার উপর ওরা যেভাবে গল্প শুরু করসে। পরিবেশটা শান্ত থাকলে ভালো লাগতো। কিন্তু এখন ভালো লাগতেসে না। আমি যে একটা মানুষ আছি তাও এদের খেয়াল নাই। ইচ্ছা করতেসে চইলা যাই। উঠেই যাইতেছিলাম। এমন সময় রেদোয়ান বলল, এটেনশান প্লিজ। আজকে আমাদের সাথে আমার এক বিশেষ বন্ধু যোগ দিতে এসেছে। লেট মি ইন্ট্রোডিউস……
চলবে…
এমন সময় রেদোয়ান বলল, এটেনশান প্লিজ। আজকে আমাদের সাথে আমার এক বিশেষ বন্ধু যোগ দিতে এসেছে। লেট মি ইন্ট্রোডিউস……
হঠাৎ আমাদের থেকে বেশ কিছু দূরে পিয়ানোর শব্দ। শব্দটা আমার পেছনে। আমি পিছন ফিইরা দেখলাম একটা মঞ্চের মতো বানানো হইসে। আসার সময় খেয়াল করি নাই। সেখানে একটা পিয়ানো রাখা। আমাদের দিকে উল্টো মুখ কইরা একটা ছেলে পিয়ানো বাজাইতেসে। সাদা শার্ট আর হালকা নীল জিন্স পরা। দুইটা স্পটলাইট তার মাথার উপর জ্বলতেসে। সে 'A Thousand Years' গানটার সুর তুলল। কিছুক্ষণ বাজিয়ে গলা ছেড়ে দিল। বেশ ভালোই গাইতেসে। আমার বেশ ভালো লাগতেসে। পরিবেশটার সাথে গানটা যেন মিশে গেল। কেন জানি খারাপ হইয়া গেল মনটা। চেরি ফলের কথা মনে পড়তেসে খুব। কবে পিছু ছাড়বে ওর স্মৃতি!!!!!!
♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪
Heart beats fast colours and promises
How to be brave?
How can I love when I'm afraid to fall?
But watching you stand alone
All of my doubt suddenly goes away somehow.
One step closer
I have died everyday waiting for you
Darling don't be afraid
I have loved you for a thousand years
I'll love you for a thousand more
Time stands still beauty in all she is
I will be brave
I will not be anything take away
What's standing in front of me
Every breath
Every hours has come to this
One step closer
I have died everyday waiting for you
Darling don't be afraid
I have loved you for a thousand years
I'll love you for a thousand more
All alnoe I believe I would find you
Time has brought your heart to me
I have loved you for a thousand years
I'll love you for a thousand more
One step closer ……
♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪
হঠাৎ দেখলাম গানের মাঝে ছেলেটা পিয়ানো ছেড়ে উইঠা আসল। আরেকজন লোক এসে পিয়ানো বাজানোর দায়িত্ব নিল। ছেলেটার মুখে একটা মুখোশ স্পটলাইটের আলোয় জ্বলজ্বল করতেসে। তাই চেনা যাইতেসে না। সে গান গাইতে গাইতে আমার দিকে এগিয়ে আসলো। আমি তারে দেইখা চমকে উঠলাম। ছেলেটার পরনে আমার চেরি ফলের শার্ট যেটা আমি এতদিন যত্ন কইরা আলমারিতে লুকাই রাখছিলাম। ছেলেটা গান শেষ হতেই আমার সামনে হাঁটু গেড়ে একগুচ্ছ গোলাপ ধরে বলল, হ্যাপি বার্থ ডে, ছোঁয়া। আমি তারদিকে তাকাই আছি আর সে আমার দিকে। বারোটা বাইজা গেসে। সবাই আমার একসাথে উইশ করলো। আমার সেদিকে খেয়াল নাই। এখন মাথায় শুধু একটা জিনিস ঘুরতেসে এই ছেলে শার্টটা পাইলো কোথায় থেইকা। কারন বুক পকেটে ফুলগুলা আন্টি নিজের হাতে সেলাই করছিলো। আমাকে একদিন বলছিল। এই শার্ট দ্বিতীয় কারো হইতে পারে না। কে এই ছেলে? আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ছেলেটার মুখের মুখোশটা খুইলা নিলাম। সাথে সাথে একটা বড়োসড়ো ধাক্কা খাইলাম। দুই পা পিছনে সইরা গেলাম। ও আমার দিকে তাকাই হেসে বলল, কেমন আছো, গাজরের হালুয়া? চে… চে… চেরি ফল!!!!!!!!!!! আমি কখনো কল্পনাতেও ভাবি নাই এমন কিছু। আমি দুই হাত দিয়া মুখ চাইপা ধরলাম। কেউ কিছু বলার আগেই দৌঁড়ে চইলা আসলাম বাংলোয়। প্রথম চোখের ফোঁটাটা না হয় গোপন থাক।
আমি দরজা বন্ধ কইরা দরজার পাশে বইসা আছি। টপটপ কইরা চোখের পানি পইড়া বুকের কাছের শাড়ির অংশটা ভিইজা গেসে। চিবুকের কাছে ফোঁটাগুলো হাত দিয়া ধইরা রাখা বোতামটায় পড়তেসে। আমি মনে মনে বলতে লাগলাম, হঠাৎ এতদিন পরে কেন? কেন আবার আমার সাজানো জগতটাকে এলোমেলো করতে ফেরত এসেছে? আমি তো সবাইকে আঁকড়ে ধরে বেশ ভালো আছি। তোমাকে আঁকড়ে আমি কষ্ট ছাড়া কিছু পাইনি। তাহলে কেন ফিরে আসতে চাইছো আমার জীবনে? আমি দরজার পাশে বইসা মুখ ঢাইকা কাঁদতে লাগলাম। দরজা ওপাশে হঠাৎ ওর ডাক শোনা গেল। দরজায় ধাক্কা মাইরা বলল, ছোঁয়া, দরজা খোলো। দেখো, আমি ফিরে এসেছি। তুমি দরজা খুলবে না? তোমার চেরি ফলকে দেখবে না? ছোঁয়া… প্লিজ দরজা খোলো। ওর গলার স্বরে আমার আরো কান্না পাইতেসে। চোখের পানি ঝর্ণার মতো গলগল কইরা বাইর হইতেসে। ও বলল, ছোঁয়া, তুমি যতক্ষণ দরজা খুলবে না আমি কিন্তু এখানেই দরজার পাশে বসে থাকবো। ও বইসা পড়ল। আমি নিজেকে না বুঝাইতে পারতেসি না থামাইতে পারতেসি। এতদিন কি চাঁদনির সাথে থাইকা সাধ মিটে নাই? আজ আমার কাছে ফেরত আসছে? আমি দরজার এই পাশে আর ও ওই পাশে। মাঝে যেন শত যোজন দূরত্ব!!!
.
.
.
.
চোখ খুইলা দেখি সূর্যের আলো মেঝেতে মহা আনন্দে নাচানাচি করতেসে। কালকে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ফ্লোরে ঘুমাই পড়সি টের পাই নাই। হঠাৎ মনে পড়ল চেরিফল বলছিল যতক্ষণ আমি দরজা খুলমু না ও দরজার ঐপাশে বইসা থাকবে। সত্যিই এখনো বইসা আছে নাকি! আমি সাবধানে দরজা খুইলা উঁকি দিলাম। তাকাই আমি বেকুব হই গেলাম। দেখি কেউ নাই। এ্যাঁহ্, সিনেমার ডায়ালগ মারসে কালকে। আমিও গাধার মতো ভাবছি এখনো বইসা আছে। দরজা মারতে গিয়া এক টুকরা কাগজের দিকে চোখ পড়ল। কাগজটা নিয়া দেখলাম লেখা, আমি ওয়াশরুম গেলাম। পইড়া আমার মাথাটা খারাপ হইল, এই বেক্কলে চিঠিও লেইখা গেসে যে সে ওয়াশরুম যাইতেসে। আর কি কইতাম! বিয়ার পরে তো বৌয়ের থেইকা ওয়াশরুম যাওয়ারও অনুমতি লাগবো তার। আমি কি তার বউ হওয়ার কথা ভাবতেসি নাকি!? এটা সম্ভব না। ভাইবা মন খারাপ হইয়া গেল। আমি আবার দরজা মাইরা ফ্রেশ হইয়া নিলাম।
জানালার কাছে দাঁড়াইতেই মনটা একেবারে ফুরফুরে হইয়া গেল। রুমটা থেকে সাগর দেখা যায়। কি সুন্দর সাগরের ঢেউ আইসা আছড়ে পড়তেসে পাড়ে। আমার তো দেইখা খুশিতে নাচতে মন চাইতেসে। দাঁড়া, আজকে সাগরে গোসল করমু। আমি দরজা খুইলা গুনগুন করতে করতে নিচে নামলাম। নাস্তার টেবিলের দিকে তাকাইতেই মুখ কালো হইয়া গেল। চেরি ফল আমার দিকে তাকাই ভেটকাইতেসে। ইচ্ছা করতেসে ভেটকি মাছটারে ধইরা লবণ মরিচ দিয়া মাইখা তেলে ভাজি কইরা খাই। আমি মুনের পাশে গিয়া বসলাম। ওর খানা দেইখা কইলাম, এমন করে খাইতেছিস কেন? জন্মে জেলি পাউরুটি খাস নাই? মুন আমার দিকে তাকাই মুখ সুচালো কইরা কইল, একদম এমন বলবি না। কালকে তো দরজা মাইরা সেই লেভেলের নাক ডাইকা ঘুম দিসো। আমারে তো ঘুমাইতেই দিলি না রুমে। আমি প্রতিবাদ কইরা কইলাম, আমি মোটেও নাক ডাকি না। আমিও একটা পাউরুটিতে জেলী মাখতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি চেরিফল আমার দিকে তাকাই আছে। আমি মুখ হাতে ভর দিয়া পাউরুটি কামড়াইতেসি আর ভাবতেসি, এভাবে তাকাই আছে কেন? জীবনে কোনোদিন পেত্নী দ্যাখে নাই? আমি আরেক পিস পাউরুটিতে জেলী মাইখা চেরির দিকে আগাইয়া দিলাম। সে সুন্দর কইরা আমার হাত থেইকা কাইড়া নিয়া ওটা বাইচ্চা ইন্দুরের মতো কচকচ কইরা খাইয়া ফেলল। তারপর আবার তাকাইলো আমার দিকে। আমি আরেকটা পাউরুটি দিতে সে ওটাও খাইয়া তাকাই রইলো। আমি আর খাইতে পারলাম না। বেচারার মনে হয় বেশি খিদা লাগসে। আমি একটা প্লেটে দশটা পাউরুটি আর জেলীর বোতলটা ওর সামনে রাইখা কইলাম, এত খিদা লাগসে যখন বেশি কইরা খান। অন্যের দিকে তাকাই পেটেব্যাথা তুলানোর দরকার নাই। আমি যাইতে লাগলে সে আমার হাত ধইরা বলল, জেলী লাগাই দাও না হলে পেট ভরবে না। এ্যাঁহ্, শখ কতো! যেন আমি তার বউ। ভালবাইসা জেলী লাগাই দিমু আর উনি বইসা বইসা গিলবো। আমি কাছে আইসা বললাম, হাত ছাড়েন, জেলী লাগাই দিতেসি। সে হাত ছাড়লো ওমনি আমি ফুরুত কইরা দৌঁড় দিলাম। সে আর ধরার সুযোগ পাইলো না। যাওয়ার আগে তার দিকে ফিইরা একটা ভেংচি কাটলাম। বেশি করলে তারেই জেলী লাগাইয়া কস কস কইরা খামু। হুহ্।
আমি রুমে বইসা দু'ঘন্টা ধরে কোঁকাইতেসি। খিদা লাগসে। সকালে নাস্তায় গাজর না খাইলে আমার প্রচুর খিদা পায়। কি করি? এটা তো আর নিজের বাড়ি না যে যাইয়া ফ্রিজ থেইকা গাজর নিয়া আসমু। মুন বেটিটাও সেই সকাল থেইকা হাওয়া। নাস্তার টেবিলে যে দেখসি আর কোনো পাত্তা নাই। নিশ্চয়ই হবু বরের লগে ঘুরতে গেসে। যাবেই তো। এখন তো আর বোইনরে চিনবে না। আমি আর সহ্য করতে পারতেসি না। নাহ্, আমারে কালা চোর হওয়া লাগবো।
আমি আস্তে কইরা দরজা খুইলা বাইর হইলাম। উঁকি মাইরা দেখলাম কেউ নাই। মনে হইল কোনো কাকপক্ষীও বাড়িতে নাই। ভালো হইসে। আমি নাইমা ফ্রিজের কাছে চইলা গেলাম। খুইলাই দেখি ফ্রিজে থাকা গাজরগুলা আমার সাথে অভিমান কইরা বলতেসে, তোমার এতক্ষণে আসার সময় হইল? আমরা সেই কতক্ষণ ধইরা ওয়েট করতেসি। আমি মনে মনে কইলাম, না, সোনারা। রাগ করে না। এই তো আমি এসে গেছি। আমি মোটা দেইখা গাজর নিয়ে সবে মাত্র একটা কামড় দিয়া পিছন ফিরসি, সাথে সাথে ভয় পাইয়া একটা চিক্কুর দিলাম। আল্লাহ গো! একটা খাম্বা থুক্কু চেরি ফল আমার দিকে চোখ বাঁকা কইরা তাকাই আছে। আমি কি কমু বুঝতেসি না। ধরা খাওয়া চোরের মতো এদিক ওদিক তাকাইতেসি। সে জিগাইল, কি করছো এখানে? আমি আমতা আমতা কইরা বললাম, কি…কি…কিছু না তো। আ…আমি যাই। আমি চইলা যাইতে ছিলাম। সে আমার গাজর ধরা হাতটা টাইনা ফ্রিজের সাথে চাইপা ধরল। আমি আইটকা গেলাম। আমি অসহায়ের মতো গাজরের দিকে তাকাইতেসি আর গাজর আমার দিকে। তোরে খাইতে আইসা কি বিপদেই না পড়লাম। হঠাৎ সে আমার গাজরে ভাগ বসাইলো। আমার কামড়ানো অংশে একটা কামড় বসাইয়া কইল, আচ্ছা, এই জায়গাটা এতো মিষ্টি কেন? চিনিতে ঢুবিয়েছো নাকি? আমি তো লজ্জায় কই লুকামু বুঝতেসি না। বেটা, ছয় বছর বিদেশে থাইকা ইয়ে হই আসছে। আমি সরমে মুখ তুলতে পারতেসি না। সে তো হাতটা ছাড়ার নামই নিতেসে না। সে আমার কাছে এগুতেই আমি পিছিয়ে ফ্রিজের সাথে মিইশা গেলাম। হায় হায় আর যাওয়ার জায়গা নাই। পারতেসি না ফ্রিজের ভেতর ঢুইকা যাইতে। সে আমার বাম কানের কাছে এসে বলল, তোমার গায়ের গন্ধটা আগের থেকেও মিষ্টি লাগছে। কি ব্যবহার করো বলতো? আমি আর দাঁড়াইতে পারতেসি না। খালি মাটিটা ফাঁক হওয়া বাকি। হঠাৎ সে হাতটা ছাইড়া দিল। আমি সাথে সাথে এক দৌঁড়ে রুমে। সেই ছয় বছর আগের ব্যাঙটা আবার ফেরত চইলা আসছে বুকের ভেতর। আইসাই তিরিং বিরিং লাফাইতেসে। গাজররে!!! Crush is coming back……
চলবে…
সেই ছয় বছর আগের ব্যাঙটা আবার ফেরত চইলা আসছে বুকের ভেতর। আইসাই তিরিং বিরিং লাফাইতেসে। গাজররে!!! Crush is coming back……
.
.
.
.
প্রত্যেক বছর আব্বা আম্মাকে এই দিনে একবার দেইখা আসি। আজকে যাইতে পারতেসি না। ইচ্ছা করতেসে ছুইটা যাই। আসতে ইচ্ছা করতেছিলো না কিন্তু মিষ্টি খালার কথা ফেলতে পারি নাই। এখন মন খারাপ হইতেসে। আব্বা আম্মা আমার ভীষণ অভিমানী। নিশ্চয়ই আমার পথ চেয়ে বইসা আছে। আমি মন খারাপ কইরা সাগর পাড়ে হাঁটতেসি। বাপ রে!!!!! কত মানুষ!!!!! একটু শান্তি কইরা কোথাও বসমু তার উপায় নাই। আমি ভেজা বালিতে হাঁটতেসি। একটু পর পর সাগরের পানি পায়ে এসে আছড়ে পড়তেসে। সে এক অন্য ভালো লাগা। আমি ব্যাপারটা উপভোগ করতেসি এমন সময় মনে হইল কেউ আমারে ফলো করতেসে। আমি শিউর হওয়ার জন্য সাগর ছাইড়া পাহাড়ের দিকে রওনা দিলাম। দুইটা পাও আমার সাথে রওনা দিল। আমি বুঝতে পারতেসি কিন্তু দেখতে পাইতেসি না। দাঁড়া ব্যাটারে হাতে নাতে ধরমু। আমি পাহাড়ে উঠা শুরু করলাম। সেও ওঠা শুরু করল। একটা সময় আমি দ্রুত উইঠা লুকাই পড়লাম। পা দুইটা আমারে খুঁজতেসে আর আমি লুকাই মিটিমিটি চিনা হাসি দিয়া বলতেসি এইবার বাছাধন যাইবা কই? তুমি চলো পিছে পিছে, আমি চলি লুকাই লুকাই।
আমি যেখানটাই লুকাইসি সেই জায়গাটা বিপদজনক। একটু থেকে একটু হইলেই খাঁড়া গর্তে। আমি যখনই ধরতে যামু হঠাৎ পা পিছলাই গেল। পড়তে লাগছিলাম গর্তে। কিন্তু একটা হাত পড়তে দিল না। টান দিয়া আমারে বুকের সাথে মিশাই ফেলল। আমারে জড়াই ধইরা আছে তো আছেই। ছাড়ে না ক্যান? গায়ের পারফিউমটা চেনা চেনা লাগতেসে। আরে, আজকে সকালেই তো চেরি ফল যখন আমার কাছে আসছিল তখন এই গন্ধটা নাকে লাগছিল। তাহলে এটা চেরি ফল? কেমন একটা মাতাল করা গন্ধ। সেই ছয় বছর আগে এই মাতাল করা গন্ধে আমি ঘায়েল হই গেসিলাম। আজ আবার হইলাম। না না… এ কি করতেছিস ছোঁয়া!? ঘায়েল হইলে হবে না। এখন রিভেঞ্জ টাইম। আমি ধাক্কা দিয়া তারে সরাই দিলাম। কইলাম, এভাবে জড়িয়ে ধরে আছো কেন? নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়ে মেরে ফেলবে নাকি? চেরি আমার দিকে আগাইতে লাগল, আমি তো ভয়ে শ্যাষ। পেছনে গর্ত, সামনে চেরি। কোন দিকে যাই। সে আচমকা আমারে টাইনা হাঁটা ধরল। যাইতে যাইতে কইল, গর্তে পড়ে মরার শখ হয়েছে, তাই না? আমি মুখ ভার কইরা কইলাম, আপনি আমার পিছু নিসেন কেন? নইলে তো আমি এদিকে আসতামই না।
- আমি পিছু না নিলে তো গর্তে পড়ে ঘাড় বাঁকা হয়ে থাকতে এতক্ষণে।
আমি আর কিসু কইলাম না। সে আমারে হাত ধইরা সোজা বাংলোতে নিয়া আসলো। আজকে আমার সমুদ্র স্নান একেবারে মাটি।
.
.
.
.
আমি বিছানায় গড়াগড়ি যাইতেসি আর ভাবতেসি সবাই এত স্বার্থপর ক্যান? দুপুরের খাবার খাইয়া মুন আবার রেদোয়ানরে নিয়া হাওয়া হই গেসে। রেদোয়ানের বাবা মাও নাই। মিষ্টি খালা, সানজিদা আপু আর সারা সায়েমকে নিয়া ঘুরতে গেসে। যাওয়ার আগে একটু বইলাও যায় নাই। তাহলে হয়ত বাইর হইতাম। ধুর কিচ্ছু ভালা লাগের না। কালকে এত কাঁদলাম কেউ একটু দেখতেও আসে নাই। ইচ্ছা করতেসে চোখের কল ছাইড়া আবার কাঁদি। দাঁড়া, রিদিরে ফোন করি। ফোন খুঁইজা বাইর করলাম বালিশের তলা থেইকা। এই দুঃখের সময় মেয়েটারে বহুত মিস করতেসি। ডায়াল করলাম ওর নাম্বারে। প্রথমবারে ধরল না। আজকে যে সবার কি হইল!? কেউ আমারে মিস করে না। কেউ আমারে ভালোবাসে না। হঠাৎ ফোনের রিংটোন বাইজা উঠল। আমি না দেইখাই খুশিতে গদগদ হইয়া ফোন রিসিভ করে কইলাম, হ্যালো, রিদুকি বাচ্চি, কই তুই?
- রিদির বাচ্চা হল কবে?
এ্যাঁ!!!! ছেলের গলা ক্যান!? রিদি আবার ছেলে হইল কেমনে!? ফোন নামাই দেখি ভ্যাম্পায়ারের ফোন। আল্লাহ গো!!!! একদিন অফ ছিল। আজকে আবার ফোন করসে। আর ভালা লাগে না। এমনেতে মন মেজাজ ভালো নাই, তার উপর এই ব্যাটা বাটপারটা ফোন করসে। সে ওপাশ থেইকা ভাঙ্গা ট্যাপ রেকর্ডারের মতো হ্যালো হ্যালো করতেসে। ইচ্ছা করতেসে রেকর্ডারটা আছাড় মাইরা ভাইঙ্গা ফেলি। আমি ফোন কানে লাগাই বললাম, হ্যাঁ শুনছি।
- ব্যস্ত থাকায় ফোন করতে পারি নি। কেমন আছো?
- ভালো ছিলাম। এখন নেই। (মনে মনে) আরও ব্যস্ত থাক। তাইলে একটু রেহাই পামু। এই ছয় বছরে তো আমার পিছে কত সময় ব্যয় করো নাই।
- কেন?
- সেটা জেনে আপনি কি করবেন?
- জানলে বউকে একটু সঙ্গ দিতাম।
ভ্যাম্পায়ার ব্যাটা, সামনে থাকলে তোরে বেল কইরা সেখানে ডুগডুগি বাজাইতাম। একবার শুধু হাতের কাছে পাই। আমারে বউ করার সাধ জন্মের মতো ঘুইচ্চা যাইতো।
- কি হল? কথা বলছো না যে?
- আমার কিছু বলার নেই। আপনার আর কিছু বলার আছে?
- হুম।
- বলে ফেলেন। আমি ব্যস্ত।
- ভালোবাসি। লাভ ইউ, লাভ ইউ, লাভ ইউ…
তোর লেবু তোর কাছে রাখ। আমি কিনমু না। এমনিতে তোর চুকা লেবুর জ্বালায় আমার দাঁত কিড়মিড় করতেসে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেইলা ফোনটা কাইটা বিছানায় ছুইড়া রাখলাম। বিছানায় চিৎ হইয়া শুয়ে গেলাম। আগে আমি চেরির পিছে ঘুরতাম আর এখন ভ্যাম্পায়ারটা আমার পিছে ঘুরে। হায়রে দুনিয়া! সবাইরে লাভ ট্রায়াঙ্গেলে ফালাইয়া কি যে মজা পাও কে জানে।
আবার ফোন বাইজা উঠল। এবার আর রিস্ক নিলাম না। ফোনটা হাতে নিয়া তাকাই দেখলাম রিদি ফোন করসে। আমি রিসিভ করতেই শুনলাম ও নাক টাইনা বলতেসে, হ্যালো…।
- কিরে!? কাঁদিস ক্যান?
- আরে ঝালে নাক দিয়ে পানি পড়ছে।
- অ।
- কেন ফোন দিয়েছিস?
- তোর সাথে কতদিন কথা হয় নাই। তাই ভাবলাম একটু কথা কই।
- তাই? লাস্ট কবে কথা হয়েছে?
আমি অনেক ভাইবা দেয়াল ঘড়ি দেইখা কইলাম, একদিন সাত ঘন্টা সাইত্রিশ মিনিট পনের সেকেন্ড …… ও আমারে থামাইয়া কইল, তোর ঘন্টা মিনিট কে চায়? কি হইসে বল তো? আমি কাঁদো কাঁদো গলায় ইমোশান ঢাইলা বললাম, সবাই আমারে ফেলে ঘুরতে গেসে। আমি একলা বাসিন্দা ঘরে পইড়া আছি।
- তোকে কি শিকল পরাই গেছে?
- এহ্, শিকল পরাইতে যাবে ক্যান?
- তাহলে তুইও ঘুরে আয়।
- একলা ঘুরতে মন চাইছে না। তুই কি করিস?
- বি এফের সাথে বের হয়েছি। ফুসকা খাচ্ছি। আচ্ছা এখন রাখি। বাইরে থেকে ঘুরে আয়। বাই।
- এই……হ্যালো……টুট টুট…… রিদুকি বাচ্চি……সামনে পেলে তোর বফরে আমি আচ্ছা মতো কেলাইতাম। হায়রে……একজন ঘুরে বর নিয়া ঘুরতে যায় আরেকজন বি এফ নিয়া ফুসকা খাইয়া নাক টানে। মাঝে আমি বেকার মানুষ।
এমন সময় দরজা নক করল কেউ। আমি জিগাইলাম, কে? উত্তর নাই। বিছানা ছাইড়া উঠতে ইচ্ছা করতেসে না। কে যে আইলো। ধুর। গিয়া দরজা খুইলা দেখি আমার এক্স মানে চেরি ফল দাঁড়াই দাঁড়াই হাসতেছে। আমি জিগাইলাম, কোনো দরকার? সে একই ভাবে হাঁস ছাইড়া কইল, হুম। তোমাকে। আমি শুইনা ঢোক গিললাম। বাড়িতে কেউ নাই। এখন উল্টাপাল্টা কিসু কইরা বসলে! শুনসি বিদেশে নাকি এসব কমন ব্যাপার। সকালে যেভাবে টিজ করসে…… যদি ওইসব কিছু শিইখা আসে তো…… ও আমার অতি রঞ্জিত ভাবনায় ছেদ ঘটাইয়া বলল, কি ভাবছো? আমি আমতা আমতা করে কইলাম, ইয়ে মানে…। ও বলল, আরে বাবা, রুমে একলা ভালো লাগছে না। তাই ভাবলাম তোমাকে বলি। চল, বের হবো।
যামু না। তখন আমার সমুদ্র স্নান মাটি কইরা এখন বলতেসে ঘুরতে যাবে। আমি মুখে হাসি টাইনা বললাম, আমি একটু ব্যস্ত। আরেক সময়। বইলাই দরজা মাইরা দিলাম। দরজা মাইরা নিজের চুল টানতে লাগলাম। কি করলাম ইডা আমি! এতদিন যারে নিয়া খালি ভাবতেসি আজকে তারসাথে বাইর হওয়ার সুযোগটা নিজের হাতে বন্ধ কইরা দিসি। আবার যামু? না না, মান সম্মান বইলা একটা জিনিস আছে। থাক। আরেকবার ডাকলে তখন রাজি হইয়া যামু। আমি অপেক্ষা করতেসি ডাক শোনার। সে তো আর ডাকে না। চইলা গেল নাকি! আমি দরজা খুইলা উঁকি দিয়া দেখি কেউ নাই। সবাই আমারে একলা রাইখা চইলা গেসে। আমি নাক টানতে টানতে বাইর হইলাম। সাগরের দিকে রওনা দিলাম আর মাথা চাপড়াইতে চাপড়াইতে কইলাম, ছোঁয়া তোরে দিয়া কিচ্ছু হইব না।
.
.
.
.
আমি মুখ গোমড়া কইরা দাঁড়াই আছি মাইক্রোর পাশে। সবাই তাদের বোঁচকা বুঁচকি গাড়িতে তুলতে ব্যস্ত। আমারটা সবার আগে তুইলা দিসি। আমি দাঁড়াই আছি, আমার গোমড়া মুখের কারণ আমার দিকে মুচকি হাইসা তাকাই আছে। আজকে কতো শখ কইরা সাগর পাড়ে গেসিলাম বিকালে। পিসলা খাইয়া পড়তাম সাগরে তখন আইসা হিরোর মতো ধরল চেরিটা। আমি একটু লজ্জায় লাল হইয়া অভিমানের সুরে কইলাম, আমাকে ধরসো কেন? সাথে সাথে ছাইড়া দিলো একগাদা পানিতে!? একটু মায়াও দেখাইলো না। গোসলের পানি এখনো আমার চুল থেকে পড়তেসে। একেবারে ভালো কইরা সমুদ্র স্নান করাই দিসে। এখন ভেটকাইতেসে দাঁড়াই দাঁড়াই। চেরি রে!!!!! দাঁড়া একবার পাই, তোরে কাইটা লবন মরিচ দিয়া খামু। আচ্ছা চেরি ফল তো মিষ্টি, লবন মরিচ কি লাগবে? আমি ভাবতেসি, মুন এসে কইল, এতো কি ভাবিস বল তো? উঠ। আমি নাকি নাকি গলায় বললাম, আমার পেছনে বসলে বমি পায়। আমি সামনে বসবো। মুন সাফ জানাই দিল সব সিট ব্লক। বলল, তোকে পেছনের সিটেই বসতে হবে। বমি পেলে সমস্যা নাই৷ পেছনের পুরা সিট খালি। তুই শুয়ে বসে ইচ্ছা মতো বমি কতে পারবি। ধর পলিথিন। ও আমারে এক প্যাকেট পলিথিন ধরাই দিল। এই পৃথিবী নিষ্ঠুর!!!!! আমি মনের দুঃখে পেছনের সিটে যাই লম্বা হই শুয়ে পড়লাম। সামনের সিটে রেদোয়ানের মা, মিষ্টি খালা আর সানজিদা আপু। মাঝের ডান সিটে সারা সায়েম আর বাম সিটে রেদোয়ান মুন। আমি মাত্র চোখটা বন্ধ করসি হঠাৎ চেরি ফল এসে বলল, এযে গাজরের হালুয়া। হালুয়ার মতো ছড়িয়ে না থেকে জায়গা দাও। আমি পিট পিট কইরা ওর দিকে তাকাইতেই বলল, নিজে জায়গা দিবে না জোর করে নিবো? ইস্ রে!!!! ক্যান যে বিদেশ থেকে আইলো। তাইলে একটা লম্বা ঘুম দিতে পারতাম শুয়ে শুয়ে। আমি উঠে ডান পাশে জানালার কাছে চইলা গেলাম। চেরি বাম জানালার কাছে গিয়ে বসল। রেদোয়ানের বাবা ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে বললেন, এসি ছাড়বো না জানালা খোলা রাখবে? আমি পিছন থেকে বললাম, আঙ্কেল জানালা খোলা থাক। গাড়ি চলতে শুরু করল। এই সন্ধ্যেবেলায় গোসল করায় শরীরটা কেমন হালকা লাগতেসে। ঘুমও পাইতেসে। বাইরে অন্ধকার। জানালার কাচে মাথা রেখে চোখ বুজতেই কখন ঘুমাই গেলাম টের পাইলাম না।
সকালে চোখ মেইলা দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি। মাথাটা কারো বুকে। সে আমাকে জাপটে ধইরা আছে। আমি পিট পিট কইরা তার দিকে তাকাইলাম। সেও পিট পিট কইরা আমার দিকে তাকাইলো। তারপর যেই না চিক্কুর দিমু ওমনি সে আমার মুখ চেপে ধরে বলল, শসসসসসস্।
চলবে…
আমি পিট পিট কইরা তার দিকে তাকাইলাম। সেও পিট পিট কইরা আমার দিকে তাকাইলো। তারপর যেই না চিক্কুর দিমু ওমনি সে মুখ চেপে ধরে বলল, শসসসসসস্।
ও আমার দিকে কেমন কইরা তাকাই আছে। চোখ গুলো আমারে তার কাছে টানতেসে। আমার অস্বস্তি লাইগা উঠল। ও আমার এলোমেলো চুলগুলা হাত দিয়ে কানের পাশে গুইজা দিয়ে আবার জাপটে ধরে চোখ বন্ধ করল। কি মুসিবত!!!! এখন কেউ চলে আসলে। আমি মনে মনে চিক্কুর দিতেসি, চেরি ফল…… ছাড় আমারে। কিন্তু কেন জানি এই বুকটাতে ইচ্ছা করতেসে সারা জীবন এভাবে রয়ে যাই। চেরি তোমার গায়ের গন্ধটা এত ভালো লাগে কেন? ইচ্ছা করতেসে জড়াই ধরে থাকি। না না, কি করতেসি আমি? এত দিন পর হঠাৎ এসে আমারে এত ভালো মানুষী দেখানোর কারন জানা লাগবো। চাঁদনির সাথে এতদিন থাইকা আমার কাছে আসছে। এত্ত সহজে আমি গলছি না বাছাধন। আমি তারে ঠেইলা উইঠা বসলাম। ও জিগাইল, কি হল? আমি রাগ দেখাইয়া কইলাম, আপনার সাহস তো কম না। আপনি আমার রুমে এসে আমার সাথে এক বিছানায় শুয়েছেন। তার উপর ঘুমের সুযোগ নিয়ে জাপটে ধরেছেন। সে আমার কথায় একটু ভ্রূক্ষেপও করল না। বলল, চাইলে আরো কিছু করতে পারি। দেখতে চাও? আমি তার থেইকা একশ হাত দূরে সইরা বললাম, কিছু করতে গেলে ঠেলে বিছানা থেকে ফেলে দিবো।
- সে তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো।
সে আমার দিকে আগাইতেই আমি চিক্কুর দিয়া বিছানা থেকে নাইমা দরজা খুলে এক দৌঁড়ে পালাইলাম। তখনো সে রুমে বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাসতেসে। বজ্জাত একটা।
.
.
.
.
খাবার টেবিলে সে সরাসরি আমার সামনে বসল। আমি না দেখার ভান কইরা নিজের পেয়ালায় তরকারি বাড়তে লাগলাম। খালু বলল, আচ্ছা, তোমাদের কি মার্কেটিং করা শেষ?
- না খালু।
- তাহলে তোমরা মার্কেটিং সেরে ফেলো। আমি বাকি কাজগুলো মোটামুটি সেরে ফেলেছি। নিমন্ত্রণও প্রায় হয়ে গেছে।
- আচ্ছা।
আমি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চেরির দিকে তাকাইতেসি। হঠাৎ তার সাথে চোখাচোখি হইয়া গেল। আমি নিচের দিকে তাকাই খাইতে লাগলাম। চেরি কইল, আন্টি, ছোঁয়ার মনে হয় বেশি খিদে পেয়েছে। আমি চোখ সরু করে তার দিকে তাকাইলাম। মিষ্টি খালা হেসে বলল, তুমি বুঝলে কি করে? সে মুখের খাবার শেষ কইরা বলল, তখন থেকে আমার খাবারের দিকে বার বার তাকাচ্ছে তো তাই বললাম। আমার পাশ থেকে মুন কইল, আরে, ভাইয়া আপনার বেশি করে খাওয়া দরকার। কালকে কত কষ্ট করে চালের বস্তা কোলে নিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কয়দিন আগেই তো চালের বস্তা এনেছে। কালকে আবার নতুন চালের বস্তা আনল কেন?
- এই চালের বস্তা সেই চালের বস্তা না।
মুন তাড়াতাড়ি খাবার শেষ কইরা কইল, কালকে গাড়িতে তো ভাইয়ার কোলে সেই আরামে ঘুম দিসো। তাতে ভাইয়ার পায়ের অবস্থা টাইট। তার উপর তোমারে কোলে নিয়ে রুমে দিয়ে আসছে। আমি ঐটার কথা বলতেছিলাম। আমি রাগে লজ্জায় লাল হই গেলাম। মুন এজন্যই বলার আগে আমার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়াই কথাটা বলতেছিল। বইলাই কাইটা পড়ল। আমি কারো দিকে না তাকাইয়া চুপচাপ খাইয়া উঠে গেলাম। মুন বইনা, আমার ইজ্জত রাখলো না।
আমি রুমে গিয়া চিৎপটাং হইয়া শুয়ে পড়লাম। মুন দরজায় নক কইরা বলল, আসতে পারি? আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কইলাম, এত ঢঙ না করে ভেতরে আয়। মুন ঢুকতেই বললাম, কালকে কি হইসে বল তো। তোর জামাইর বন্ধু কালকে এখানে ছিল কেন? মুন চেয়ার টেনে আমার সামনে বসে বলল, কালকে তুই যে ঘুম দিছিস। আমরা কতো ডাকলাম। তুই তো ভাইয়ার কোল থেকে মাথাই সরাইতে চাইছিলি না। তারপর ভাইয়া তোকে কোলে করে রুমে এনে শুইয়ে দিল। উনি চলে যেতে লাগলে তুই হাত ধরে তাকে আর যেতে দিলি না। সে চলে যাওয়ার জন্য জোর করতেই তুই ঘুমের মধ্যে বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিয়ে বললি, সবাই আমাকে ফেলে চলে যায়। তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। তাই বাধ্য হয়ে উনি তোর কাছে বসল আর তুই আবার তার কোল দখল করে ঘুমিয়ে গেলি।
- আ আ আ আমি এগুলা বলসি?
আমার গলায় কথা আটকাই যাইতেসি। আমি দেয়ালে মাথা পিটমু না দেয়ালটাকে কমু আজকে এই মাথা তোর সেটাই বুঝতেসি না। ঘুমের মধ্যে এত কাহিনী করে ফেলসি! ইস্! নিজেরে মনে হইতেসে একটা রাম ছাগল। নাহ্, তাতেও লিঙ্গ ভুল। আচ্ছা রাম ছাগলের স্ত্রী লিঙ্গ কি!? রাম ছাগলী না মহিলা রাম ছাগল। ভাব্বার বিষয়। ধুর ছাতা। এই চেরি আসতেই আমার সব ঘোলাই গেল। নাহ্, একে ভাগাইতে হবে, না হইলে আমি আগের মতো পাগল হই যামু।
.
.
.
.
.
দুপুরে সবাই মিইলা শপিংয়ে বাইর হইলাম। কত কি কেনা বাকি। বিয়ের শাড়ি গয়না। মুনের না আমার। ওর তো চিন্তা নাই। ওর সবকিছু রেদোয়ান ভাইরা আগেই কিনে ফেলসে। বিয়েতে কি পরমু সেটা এখনো ঠিক করি নাই। ভাবতেসি লেহেঙ্গা পরমু। আমি মুন রে নিয়া লেহেঙ্গার দোকানে গেলাম। সেখানে গিয়াই আমার মন লাফাইতে লাগল। এটা কিনমু না ঐটা কিনমু! আল্লাহ এতো সুন্দর ক্যান! ব্যস, পরীক্ষায় সব প্রশ্ন কমন পড়লে যেমন জগা খিচুড়ি পাকাই যাই, আমারও সেই অবস্থা হইল। কোনটা কিনমু ঠিকই করতে পারলাম না। তাই মুখ কালো কইরা খালি হাতে বাইর হই আসলাম দোকান থেকে। আজকের দিনটাই মাটি হই গেল। সানজিদা আপুর সাথে জুয়েলারির দোকানে গেলাম। আমি কিচ্ছু কিনতে পারলাম না। শেষে আমি খালি হাতেই বাড়ি ফিরলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি একটা প্যাকেট বিছানায়। আমি গিয়া খুলে দেখলাম একটা খয়রী রঙের ভারি সোনালী সুতায় কাজ করা লেহেঙ্গা। ঐ লেহেঙ্গা গুলা থেকেও সুন্দর। সাথে ম্যাচিং জুয়েলারিও আছে। এগুলা কার? কে দিল? মুন এসে বলল, কি রে নাস্তা করতে আয়।
- মুন, এগুলা কার?
- আমার তো না। তাহলে তোর হবে।
- কিন্তু কে রাখল?
- আম্মু হয়তো। তোর জন্য কিনেছে। খেয়াল করিসনি।
- হবে হয়ত। ( মনে মনে) যেদিন দোকান তেকে ওয়াশরুমে যাই তখনই বাির হইয়া বিছানায় প্যাকেট দেখি। উফ্, ম্যাজিক ম্যাজিক লাগতেসে। এবার থেইকা দোকান থেকে আইসা ওয়াশরুমে বইসা থাকমু।
- কিরে, আবার কি বাবতে বসলি? ছাদে আয়। আজকে ওখানে খাবে সবাই।
- হুম।
আমি সব গুছিয়ে ছাদে আইসা দেখলাম সেখানে সবাই আছে। চেরি ফলটাও যায়নি দেখছি। কেন যে এখানে পইড়া আছে। ইচ্ছে করতেসে ঘুষি মাইরা উগান্ডায় পাঠাই দি। আমি গিয়া বসলাম একপাশে। আকাশের দিকে তাকাইলে আব্বা আম্মার কথা মনে পড়ে। মুন কইল, তুই আকাশের দিকে এমন ড্যাব ড্যাব করে তাকাই আছিস কেন? ওর কথায় সবাই কথা বন্ধ কইরা আমার দিকে তাকাই। আমি জিগাইলাম, কি হইসে? সবাই আমার দিকে এভাবে তাকাই আছো কেন? সায়েম বলল, খালামনি, তুমি খালুর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকাই ছিলা তাই সবাই তোমার দিকে তাকাই আছে। আমি ভ্রূ কুঁচকায় কইলাম, তোর খালু কই থেকে আসলো? সে চেরি ফলের দিকে ইশারা করল। আমি মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে কইলাম, বেকুব, ও কি আমার জামাই নাকি যে খালু ডাকতেছিস? মামা ডাক। মামা। আমি বললাম, আমি ওর দিকে তাকাবো কেন? সানজিদা আপু বলল, মুন যে বলল, তুই আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলি।
- হ্যাঁ, আমি তো আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখছিলাম। এমন করে বলছো যেন আমি আকাশ নামের কারো দিকে তাকাই ছিলাম।
- আমরা তো তাই ভেবেছিলাম।
- এখানে আকাশ নামের কেউ আছে নাকি!
সারা বলল, খালামনি তুমি খালুর নাম যে আকাশ জানো না? ফের খালু। এই দুইটারে শিখাইতে হইবো ও খালু না ও …… ওয়েট এ মিনিট। খালুর নাম আকাশ মানে? আমি চেরি ফলের দিকে তাকাইলাম। সে আমার দিকে কেমন কইরা তাকাই আছে। অন্যদের অবস্থাও একই। আমি মেকি হাসি দিয়া কইলাম, ইয়ে মানে… চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমি গরম করে আনি। ঠান্ডা চা আমি একদম খেতে পারি না। মুন পেঁচা মুখ করে বলল, এই জন্যইতো সব সময় তোকে চা দিলে তুই শরবত বানিয়ে খাস। এইরে… আমি এক দৌঁড়ে নিচে চলে এলাম। এই ছয় বছরে প্রথম জানলাম, চেরি ফলের নাম আকাশ। কেউ আমারে টুকা দাও, আমি বেঁহুশ হই।
.
.
.
.
.
আমি চেরির ছবির দিকে তাকাই আছি। পুরান বাক্সটা আজকে ছয় বছর পর বাইর করলাম। চেরির স্মৃতি গুলা সব এখানে। আমার ডায়রীটা বাইর করলাম। খুলে পইড়া নিজেই হাসতে হাসতে শ্যাষ। তখন বাচ্চাদের মতো কত কিছুই না লিখসি ওরে নিয়া। কই না পাগল আসিলাম। ডায়রীটা থেকে একটা শুকনা গোলাপ পড়ল। আমি গোলাপটা হাতে নিয়া স্মৃতিতে ডুইবা গেলাম। চেরি গাছের প্রথম গোলাপ। চাঁদনির সাথে চেরিকে দেইখা রাগে গোলাপটা কাইটা নিয়া আসছিলাম। কি সুন্দর রঙ ছিল গোলাপটার! আমি ডায়রীটা একপাশে রাখতে একটা চাবির রিং চোখ পড়লো। চাবির রিংটা চোখের সামনে ধইরা ঘুরাইতে লাগলাম। নিজের হাতে লাল পুঁতি দিয়া একটা লাভ বানাইছিলাম। তার সাথে পাঁচটা রঙ বেরঙের ক্রিস্টাল টাইপ ঝুমকা। প্রত্যেকটাতে একটা করে অক্ষর খোদাই করে 'CHOYA' লেখা। ও যাতে বুঝতে না পারে তাই প্রত্যেকটা ক্রিস্টালে একটা করে অক্ষর। এটাকে দেইখা চোখ থেকে একটা ফোঁটা গড়ায় গিয়া চিবুকে জমলো। ওরে বার্থডে গিফট দিতে পারি নাই তাই সেদিন ওকে কলেজে এটা দিতে চাইছিলাম। কিন্তু কিন্তু …… আমি চাবির রিংটা হাতের মুঠোয় নিয়া বুকে জড়াই কানতেসি। ওখান থেকে চইলা আসার পর একবার ওরে দেখতে গেসিলাম। সিঁড়ি দিয়া উঠার সময় শুনতেছিলাম চাঁদনির সাথে চেরিফল তােদর বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলতেছিল। তখন শুনছিলাম ও চেরির সাথে লন্ডন যাবে। আমি উঁকি মারতেই দেখলাম চাঁদনি ওকে জড়াই ধরে দাঁড়াই আছে। আমি সহ্য করতে না পাইরা দৌঁড়ে চলে আসছিলাম। সেই কান্নার প্রতিটা ফোঁটা শুধু চেরির নাম বলতেছিল। কিন্তু সে তো অন্য কারো। তবে আবার কেন মায়া বাড়াতে আসছে? আমি যে আর নিজেকে সামলাতে পারছি না।
চলবে…
সেই কান্নার প্রতিটা ফোঁটা শুধু চেরির নাম বলতেছিল। কিন্তু সে তো অন্য কারো। তবে আবার কেন মায়া বাড়াতে আসছে? আমি যে আর নিজেকে সামলাতে পারছি না।
মুন দরজা ধাক্কাইতেসে। আমি তাড়াতাড়ি সব ঢুকাই রাইখা ভালো করে চোখ মুছলাম। দরজা খুলতেই ও বলল, দরজা বন্ধ করে কি করছিলি?
- কিছু না। ওই আর কি।
- কান্না করছিলি?
- কই? না তো।
- ছোঁয়া, তুই হয়ত জানিস না। তুই একটা খোলা বইয়ের মতো। যাকে বাইরে থেকে পড়া যায়। এই ছয় বছরে আমি তোকে শুধুমাত্র ছয়বার কাঁদতে দেখেছি। তাও খালা খালুর মৃত্যুবার্ষিকীর সময়। এছাড়া আর দেখিনি। যে স্যারদের মার খাওয়ার পরও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি সে কাঁদলে কি টের পাওয়া যাবে না?
- আরে ধুর, চোখে কিছু পড়েছে হয়ত। তাই পানি চলে এসেছে।
ও হঠাৎ আমাকে ওর বুকের মাঝে জড়াইয়া ধরল। আমি অবাক হতেই ও বলল, তুই জানিস, তুই মিথ্যে বললে তোকে কত বোকা লাগে। নে, আমার বুকে তোকে আশ্রয় দিলাম। এবার যত খুশি কেঁদে নে। কেন যেন আমার খুব কান্না পাইল। না চাইতেই আমার শরীর কান্নার ধাক্কায় কাঁইপা উঠল। আমি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম। মুন বলল, বোকার মতো কাঁদছিস কেন জানতে পারি? আমি চুপ করে ওর বুকে মুখ গুঁইজা দিলাম। মনে মনে বললাম, থাংকু, মগন। আমাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য। আমার যে একটা আশ্রয়ের খুব প্রয়োজন ছিল। আমি চুপ করে আছি দেইখা ও আর কিছু বলল না।
রাতে খাবার সময় চুপচাপ খাইতে বসলাম। আকাশ কোথায় বসেছে সেটা খেয়াল করি নাই। আমি সামান্য কটা ভাত নিয়া নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। মিষ্টি খালা খেয়াল কইরা বলল, কি রে, ছোঁয়া। তখন থেকে কি ভেবে চলেছিস? খাচ্ছিস না যে।
- হুম?
আমি কোনোমতে দুইটা খাইয়া উঠে গেলাম। ভালো লাগতেসে না কিছুই। ফ্রেশ হইয়া শুয়ে পড়লাম। এগারটার দিকে কারেন্ট হঠাৎ চইলা গেল। বাইরে বাতাস ছুটতেসে। আমি চোখ বন্ধ কইরা শুয়ে শুয়ে বাতাসের শো শো আওয়াজ শুনতেসি। আমার মনেই তো ঝড় চলতেসে। মুন এখনো রুমে আসে নাই।
একটু পরে রুমে কারো উপস্থিতি টের পাইলাম। মুন হবে। চারদিক অন্ধকার। কিছুই দেখা যাইতেসে না। ওরে বললাম, আমার ফোনে চার্জ নাই। তোর ফোনে ফ্ল্যাশটা অন করিস তো। আমি আবার চোখ বন্ধ করলাম। হঠাৎ মনে হল মুন আমার পাশে এসে বসল। কেন যেন মনে হইতেসে এটা মুন না। কে তাহলে? মিষ্টি খালা? না তাহলে? হঠাৎ আমার মনে ভয় ঢুইকা গেল। অন্ধকারে থাকা ব্যক্তিটা আমার খুব কাছে ঝুঁকে পড়ল। যেন অন্ধকারেও আমাকে দেখতে পাইতেসে। আমি তার নিঃশ্বাসের শব্দ খুব কাছ থেইকা শুনতে পাইতেসি। আচমকা সে আমার কপালে একটা চুমু দিয়া দিল। আমি শিউরে উঠলাম। আমি জানি এটা কে। তার গায়ের গন্ধটা আমাকে জানান দিয়া দিসে। আমি অন্ধকারেই তাকে ঠেলে সরাইয়া দিয়া মুনকে ডাকতে লাগলাম। মুন এসে বলল, কি হয়েছে? ভয় পেয়েছিস? ওর ফোনের আলোয় দেখলাম রুমে কেউ নাই। আমি ইতস্তত কইরা বললাম, ইয়ে মানে… তোর বরের বন্ধু কোথায় রে?
- আকাশ ভাই?
- হুম।
- সে তো অনেকক্ষণ হল নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। কেন?
- না এমনি। (মনে মনে) তবে কি এটা আমার মনের ভুল?
- কি হয়েছে বল তো।
- আরে বাবা, রাত হয়ে গেছে। ঘুমাবি তো। আয়।
- হুম আসছি।
হঠাৎ ওর ফোন বাইজা উঠল। আমি মুখ কালো কইরা কইলাম, বাপরে কত প্রেম! ঝড়ের রাতেও বউকে ভুলতে পারে না। মুন মুখ সরু কইরা কইল, তুই কি করে বুঝলি। আমি বিজ্ঞের মতো চেহারা কইরা আবার বিছানায় শুইতে শুইতে কইলাম, এত রাতে এমন ঝড়ের সময় তোরে কে আর ফোন দিবো? সে আমার দিকে তাকাই ভেটকাইলো। আমি শুইয়া পড়লাম। ও চইলা গেল কথা বলতে বলতে। আমি আবার অন্ধকারে পইড়া রইলাম। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাইতেসে। আমি চোখ মেইলা শুইয়া আছি। গায়ের কাঁথাটা গলা অবধি মুড়ে ছাদের দিকে তাকাই আছি। এত বড়ো মনের ভুল কি করে হইতে পারে?
.
.
.
.
সাগরের গর্জন শোনা যাচ্ছে। আমার পায়ে ঢেউ আছড়ে পড়তেসে। আমি মুখে লজ্জা টাইনা দাঁড়াই আছি। চেরি আমার মুখ তুইলা বলল, ছোঁয়া, তোমাকে আগে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বলতে পারিনি।
- কি চেরি ফল?
- আসলে তোমার ঐ শুঁটকি মাছের পোনার জন্য বলতে পারিনি।
- শুঁটকি মাছের পোনা!? মানে ঐ চাঁদনি?
- হুম।
- তুমি কবে থেকে তাকে এই নামে ডাকো?
- যবে থেকে তুমি আমার জীবনে এসেছ। ছোঁয়া, আই…
- আই…!?
- আই লাভ…
আমি বালুর দিকে তাকিয়ে লজ্জায় তাকাই আছি। লজ্জামাখা কন্ঠে কইলাম, আই লাভ…!?
হঠাৎ চাঁদনি ওর দিকে দৌঁড়াই আইসা কইল, আই লাভ ইউ আকাশ। আমি রাইগা তারে লাথি মাইরা উগান্ডায় পাঠাই দিয়া আবার মুখ লাল করে কইলাম, তুমি কি যেন বলতেছিলা চেরি ফল?
- ছোঁয়াকি বাচ্চি, উঠবি না পানি ঢালমু?
- এ্যাঁ, চেরি ফল! এটা কি ধরনের কথা!? হঠাৎ তোমার কন্ঠ এমন মেয়েলি হয়ে গেল কেন?
হঠাৎ একগাদা পানি আইসা গায়ে পড়ল। আমি চিল্লাই কইলাম, চেরি ফল……। এ্যাঁ!!!! আমি তো ভাবসি আমি সাগরের পানিতে পইড়া গেসি। কিন্তু আমি বিছানায় আসলাম কেমনে! পাশে তাকাই বুঝতে পারলাম এখুনি বিনা মেঘে বজ্রপাত হবে।
- ছোঁয়া, তুমি কি শান্তিতে ঘুমাতেও দিবি না?
আমি অবাক হওয়ার ভান কইরা কইলাম, কি হইসে? রিদি কোমরে হাত রাইখা বলল, ঘুমের মধ্যে কেউ এভাবে লাথি মারে? বাপ রে! কি লাথি! আমাকে বিছানা থেকেই ফালাই দিছিস। আরেকটুর জন্য কোমরটা ভাঙ্গে নাই। তুই স্বপ্নে কাউকে লাথি মারছিলি নাকি?
- ই…… না না। লাথি মারতে যাবো কেন? আমি তো রোমান্স করছিলাম।
- ও, লাথি মেরে রোমান্স করছিলি!?
- রিদি…
কি কমু বুঝতেসি না। আমি তাইলে স্বপ্ন দেখতেছিলাম। ফোনের লক স্ক্রিন টিপতেই দেখলাম বেচারা কবেই মইরা ভেটকাই গেসে। আমি ফোন চার্জে দিয়া ওপেন করলাম। সর্বনাশ! বিশটার উপর কল! কারো কিছু হইল নাকি। তাড়াতাড়ি মিসকল লিস্ট চেক করতেই আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ব্যাটা বাটপারটা ফোন করসিলো। ভালো হইসে ফোন বন্ধ ছিল। তবে একটা জিনিস অদ্ভুত লাগতেসে। লাভার ভ্যাম্পায়ার এই ছয় বছরের একটা দিনও ফোন করতে ভুলতো না। আর এখন তার কললিস্ট চেক করলে ইরিগুলার দেখা যায়। ম্যাসেজও তেমন দেয় না। এত ব্যস্ত!? থাক গে। আমার কি। মুন আবার শুইতে যাইতেছিল। আমি টাইনা তুইলা কইলাম, উঠ, সাতটার উপর বাজে। উনি এখন আবার শুইতেসে। যা ফ্রেশ হয়ে আয়। ইস্, বিছানাটাও ভিজাই ফেলছিস। এগুলা রোদে দিতে হবে। উঠ। ওকে জোর কইরা ওয়াশরুমে পাঠাই দিলাম। আমি বিছানার চাদরটা তুইলা ফেললাম। তারপর দুইজনে ফ্রেশ হয়ে ধরাধরি করে বিছানার তোশক ছাদে দিয়ে আসলাম। নাস্তা করে সবেমাত্র চেয়ারে বসলাম এমন সময় মিষ্টি খালা ডাক দিয়া বলল, ছোঁয়া, তোর মেহমান এসেছে। আমার মেহমান! কে হতে পারে!? আমি ভদ্র হইয়া বসার রুমে গিয়া অবাক। তারপর খুশিতে বত্রিশটা দাঁত বাইর কইরা মনে মনে কইলাম, আমার প্রিয় শ্বাশুড়ি আম্মা!
আমি মুখ হাসি টাইনা বললাম, কেমন আছেন আন্টি? আন্টি হাইসা বললেন, আরে ছোঁয়া। এসো আমার পাশে বসো। আমি গিয়া বসলাম। উনি বললেন, এই ছয় বছরে কত বড়ো হয়ে গেছো। তবে মুখটা আগের থেকে দেখতে মিষ্টি হয়েছে। আমি লজ্জায় মাথা নিচু কইরা বইসা রইলাম। আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো, ছোঁয়া মা?
- আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আঙ্কেল। আন্টি, এই ছয় বছরে তো একবারও খোঁজ নেন নাই। আমি রাগ করসি।
- কে বলেছে নেইনি? তোমার খালার সাথে আমার প্রত্যেক দিন কথা হতো।
- আমার সাথে তো আর কথা বলেননি।
আন্টি হেসে আমাকে বুকে টাইনা নিলেন। আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম। মনে হইতেসে অনেকদিন পর আমি আম্মুর বুকে মাথা রাখসি। কি যে ভালো লাগতেছিল। হঠাৎ কেউ বলল, খালি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলে হবে? আমি কি দোষ করেছি? তাকাই দেখি আকাশ দাঁড়াই হাসতেসে। আমার কেন জানি লজ্জা লাগতেছিল। আমি উঠে বসে বললাম, আন্টি, আজকে থাকতে হবে কিন্তু। আমি কত কিছু রান্না শিখেছি। আজকে বানিয়ে খাওয়াবো। আকাশ মুখ গোমড়া করে বলল, আমি দুইটা দিন আছি, আমাকে একটু রান্না করে খাওয়ায় নাই। সারাদিন ফোন টিপতো। এখন আম্মু আব্বু আসছে আর উনি রান্না করবেন। আমি মুখে রাগ টাইনা বললাম, আমি আজাইরা অতিথিদের জন্য রান্না করি না। আমি আসছি আন্টি। আমি ভেংচি কাইটা ভেতরে চইলা আসলাম। আকাশের মুখে তখনও হাসি।
আমি নাস্তা আনতে আনতে শুনতে পাইলাম মিষ্টি খালা বলতেসে, আমিও জানি। আপা আমাকে ফোনে বলেছিল। ওরা রাজি ছিল। কিন্তু এখন ছোঁয়া বড়ে হয়েছে। ওর মতামতেরও প্রয়োজন।
- অবশ্যই। আমাদের দিক থেকে হ্যাঁ। এবার শুধু আপনাদের মতামত।
- তাহলে মুনের বিয়েটা যাক তারপর।
আমি রুমে ঢুকতেই সবাই মুন আর রেদোয়ানের বিয়া নিয়া কথা বলতে শুরু করল। আমি নাস্তা দিয়া হাসি মুখে একপাশে দাঁড়াইলাম। ভাবতেসি কি নিয়া কথা বলতেছিল? কোথায় আমার মতামত প্রয়োজন। বুঝলাম না।
চলবে…
আমি নাস্তা দিয়া হাসি মুখে একপাশে দাঁড়াইলাম। ভাবতেসি কি নিয়া কথা বলতেছিল? কোথায় আমার মতামত প্রয়োজন। বুঝলাম না।
দুপুরে ওনারা খেয়ে চইলা গেলেন। আমি থাকতে বলছিলাম কিন্তু কাজের বাহানায় চইলা গেলেন। আমি নিজের রুমে শুয়ে ভাবতেসি, আজকে ভালো একটা দিন গেল। হঠাৎ আমার মন কইল, গাজর ছাড়া কেমনে কি? আমি চট কইরা গিয়া ফ্রিজের সামনে দাঁড়াইলাম। কালকে খালু আধা কেজি গাজর আনসে। আমি ফ্রিজ খুইলা বেকুব হই গেলাম। গাজর কই? এতো ধূ ধূ মাঠ। আমার গাজর……!!!!!! আমি কাঁদো কাঁদো মুখ কইরা ফ্রিজ খুইলা দাঁড়াই আছি। আকাশ এসে বলল, ফ্রিজের কি ঠান্ডা লাগছে যে দরজা খুলে তার ভেতর থেকে হাওয়া বের করছো? আমি দ্রুত দরজা বন্ধ করে তাকাই দেখি সে একটা আধ খাওয়া গাজর হাতে দাঁড়াই আছে। আন্টি কতবার বলসে তাদের সাথে যাইতে। সে যায় নাই। আর এখন আমার গাজরে হামলা করে সাবাড় করতেসে। সে গাজরে কামড় বসিয়ে বলল, কি হল? আমি বেচারা গাজরের দিকে তাকাই আছি। সেও আমার দিকে কান্নাভরা দৃষ্টিতে তাকায় আছে আর বলতেসে, ছেড়ে দে শয়তান, তুই আমার দেহ পাবি মন পাবি না।
- ও হ্যালো!
আমার ধ্যান ভাঙ্গতেই দেখলাম গাজর গায়েব। আমি মন খারাপ কইরা বললাম, কয়দিন পরে বিয়ে আর আপনি বর পক্ষ হয়ে এখনও কনে পক্ষের বাড়িতে বসে আছেন এটা কি ভালো দেখায়? সে আমার দিকে আগাইতে আগাইতে বলল, উহু, একদম ভালো দেখায় না কিন্তু কি করবো বলো, আমার সবচেয়ে দামি জিনিসটা তো এখানে।
- মানে?
- কিছু না।
আকাশ চলে যাইতেছিল, যাওয়ার আগে বলল, বসার ঘরে টি টেবিলের উপর একটা কালো পলিথিন আছে। ওটা তোমার জন্য। সে চলে যাইতেই আমি বসার ঘরে গিয়া দেখলাম ওখানে বেশ মোটাসোটা একটা কালো পলিথিন। খুলতেই আমার মনটা লাফাই উঠল। এত্তোগুলা গাজর!
সেদিন বিকালে আকাশ চইলা গেল। আমি তখন হা কইরা পইড়া পইড়া ঘুমাইতেছিলাম। উঠে শুনলাম সে নাকি চইলা গেসে। আমাকে জাগাতে চাইছিল মুন, আকাশ নাকি মানা করসে। আমাকে বাইরে থেকে এক পলক দেইখা চইলা গেসে।
.
.
.
.
মাঝের দিনগুলা কেমনে যেন চইলা গেল। দেখতে দেখতে বিয়ার দিন চইলা আসল। আজকে গায়ে হলুদ। পুরো বাড়িতে মেহমানে পিঁপড়ার মতো গিজ গিজ করতেসে। একটা রুমও খালি পাওয়া যায় না। বাপরে!!!! সবাই শাড়ি গয়না পরতে ব্যস্ত। আমি রুমের এক কোনায় বইসা আছি। মনটা খারাপ। আজকে প্রথম আমি আমার নানা নানুকে দেখলাম। মুনের সাথে যখন কথা বলতে আসছিল তখন আমি মাত্র রুমে ঢুকলাম। তাদের দেখে আমার চিনতে কষ্ট হয় নাই। মিষ্টি খালা নানার চেহারা পাইসে। আর নানু দেখতে প্রায় আম্মুর মতো। নানু মুনকে একটা বালা পরাইয়া দিলেন। আমি যেতেই নানা মুখ কালো কইরা বেরিয়ে গেলেন। আমি একপাশে গিয়ে বইসা রইলাম। নানু আমার কাছে আইসা বসে বললেন, শিমুর মেয়ে তাই না? আমি নানুর দিকে তাকাইলাম। কেন যেন তাকে দেইখা কান্না পাইতেসে। আম্মুর কথা মনে পড়তেসে। আমি মুখ নিচু করে বইসা রইলাম। নানু আমার ডান হাত টাইনা একটা মোটা সোনার বালা পরাইয়া দিয়া বললেন, এটা তোর। আমি বালাটার দিকে তাকাই বললাম, কিন্তু আমার তো বিয়ে না। আর…। নানু হাইসা বললেন, খালি বিয়ে হলে দিতে হবে? তুই হওয়ার সময় তো তোকে দেখতে যেতে পারিনি। তাই আজ দিলাম। নানু চইলা গেলেন। আমি বালাটার দিকে তাকাই বইসা রইলাম।
মুনকে সাজাইতে লোক আসছে। আমি বসে বসে ওরে দেখতেসি। মেকআপ করার সময় আমারে ডাইকা বলল, তুই সাজবি না?
- হুম।
- কখন?
- এই তো, সাজবো।
- দেখ ছোঁয়া, আমি বেশ বুঝতে পারছি তোর কিছু নিয়ে মন খারাপ। আমি কিন্তু তোর সাথে সেজেগুজে স্টেজে উঠবো। না হলে ……
- আচ্ছা বাবা, রেডি হচ্ছি। ভালোই ব্ল্যাকমেইল করতে শিখেছিস।
আমি আলমারি থেকে শাড়ি গয়না বাইর করলাম। সেই লাল সাদা জামদানী শাড়িটা। আটপৌড়ে কইরা সুন্দরভাবে শাড়িটা পড়লাম। মাথায় বড় একটা খোঁপা কইরা তাতে কাঠবেলীর গাজরা লাগিয়ে দুইপাশে তিনটা তিনটা করে গোলাপ গুঁজে দিলাম। মাঝে সিঁথি কইরা দুইপাশে একটু ছোট চুল রাখলাম। সিঁথিতে একটা ছোট সাদা পাথরের টিকলি পরলাম। দুই হাতে লাল কাচের চুড়ি। হালকা সাজ দিয়ে চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক দিলাম। তারপর গয়না পরতেই সাজ কমপ্লিট।
সাতটার দিকে বরপক্ষ আসল। আমরা রেডি হইলাম মুনকে স্টেজে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মুন আমাকে কাছে টেনে ফিসফিস কইরা বলল, আজকে একটু সাবধানে থাকিস। আমি চোখ মুখ কুঁচকাই কইলাম, কেন? সে বিজ্ঞের মতো মাথা নাইড়া নাইড়া বলল, আজকে তোর উপর অনেকে ক্রাশ খাবে। আমি হালকা লজ্জা পাইয়া বললাম, ধুর। সে রাগীকন্ঠে কইল, খবরদার, আমার দুলাভাই ছাড়া যেন তোর আর কারো দিকে নজর না পড়ে। আমি জিগাইলাম, দুলাভাই? সেটা কে শুনি। ও মুখে বাঁকা হাসি দিয়া বলল, দেখতে পাবি। এর মধ্যে ক্যামেরা ম্যান চইলা আসল। আর কথা বলতে পারলাম না। আমার মনে হইতেসে ও কিছু লুকাইতেসে।
.
.
.
.
ওরে স্টেজে উঠাই এদিক ওদিক তাকাইলাম। আকাশ আসে নাই নাকি? চোখ দুইটা ওরে খুঁজতেসে। কিন্তু দেখতেসি না। আমি স্টেজ থেকে নামতে গিয়া হঠাৎ কিছুর সাথে পা বিঁধে গেল। পরতে লাগছিলাম কিন্তু তার আগেই কেউ আমার কোমর জড়াই ধইরা ফেলল। তাকাই দেখি রাতুল তার চৌদ্দ গুষ্টির হইতে প্রাপ্ত দাঁত বাইর কইরা হাসতেসে। আমি তাড়াতাড়ি তার থেইকা নিজেকে ছাড়াই নিলাম। সে বলল, দেখে হাঁটবে তো। আমি বললাম, জন্ম থেকেই আমার পা দুইটা অবাধ্য। কি করতাম। ও আমার কাছে এসে বলল, সমস্যা নাই। তুমি যতবার পড়বা ততবার আমি তোমাকে ধরে ফেলব। যদি এত মানুষ না থাকতো তাহলে ওর কপালে শনি ছিল আজ। আমার হাতে প্রচুর মাইর খাইতো। আমি চলে যাইতে লাগলে সে আমার হাত ধইরা বলল, কোথায় যাচ্ছো? আমি হাত ছাইড়া নিয়া বললাম, গলায় কলসি বাঁইধা পুকুরে মরতে যাইতেসি। তুমি যাইবা? সে উদিগ্ন হইয়া বলল, কেন কেন? কে তোমাকে কি বলসে। একবার নামটা বলো। আমি তাকে স্বর্গে পাঠাই দিবো। আমি মনে মনে কইলাম, বেকুব একটা। বেশি কথা বললে আমিই তোরে স্বর্গে পাঠাই দিমু।
মুন আমারে ডাইকা কানে কানে বলল, আমি না ছাদে একটা জিনিস ফেলে আসছি বিকালে। পরে আর আনা হয় নাই। একটু গিয়ে নিয়ে আসবি? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি জিনিস? ও কইল, গেলেই দেখতে পাবি। যা না। আমি কইলাম, আচ্ছা, দেখতেসি।
- এখনই যা। খুব ইম্পর্টেন্ট।
- আচ্ছা আচ্ছা যাচ্ছি।
আমি বাড়ির ভেতরে গেলাম। ছাদের লাইট জ্বালাই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বিড় বিড় করতেসি, আজকে কখনই বা ছাদে গেল। কি এমন জিনিস ফালাই আসলো। এত ইম্পর্টেন্ট যে এখনই আনতে হবে। কি জানি বাবা। এই মেয়ের কিছুই বুঝি না। ছাদে উঠে অবাক হই বললাম, কি ব্যাপার! দরজা খোলা ক্যান?
আমি ছাদে পা রাখতে না রাখতে কেউ আমার হাত টাইনা দেয়ালের সাথে দাঁড় করাইলো। আমি তো চোখ বন্ধ কইরা ভয়ে কাঁপতেসি৷ চিক্কুরটা দেওয়ার আগেই কেউ মুখ চাইপা ধইরা বলল, ছোঁয়া। তাকাই দেখি আকাশ দাঁড়াই আছে। ওকে দেইখা আজকে আবার ক্রাশ খাইলাম। সেই লাগতেসে। সোনালী কাজ করা হলুদ পাঞ্জাবী পরসে। সাথে চিকন সোনালী ফ্রেমের চশমা আর মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চুলগুলা আজকেও শ্যাম্পু করা। হালকা বাতাসে ওর চোখের উপর নড়তেসে। কিন্তু মুখটার বাচ্চাভাবটা এখনো আছে। আমি তো চোখ ফিরাইতে পারতেসি না। ও আমার মুখ ছাইড়া দিল। তারপর আমার সামনে বইসা বলল, তোমার পায়ের পাতা আমার পায়ের উপর রাখো।
- কেন?
- এত প্রশ্ন করো কেন? রাখতে বলেছি যখন রাখো।
আমি রাখতেই ও পকেট থেকে একজোড়া নুপুর বের করে একটা আমার পায়ে পরাই দিল। আমি অবাক হই বললাম, নুপুর?
- হুম। দেখি আরেকটা পা দাও।
আরেক পায়েও নুপুর পরাই দিয়া উঠে দাঁড়াই বলল, খুব মানিয়েছে তোমার পায়ে। আমি ভাব ধইরা বললাম, দেখতে হবে না পাটা কার। হঠাৎ সে আমার মাথার পাশে দেয়ালে ডান হাত রেখে মাথা নিচু কইরা রইল। আমি বললাম, তোমার কি শরীর খারাপ লাগতেসে? ও মাথা নিচু কইরাই বলল, ছোঁয়া আমি তোমার কাছে কিছু চাই। দিবে? আমি কইলাম, সাধ্যে থাকলে অবশ্যই দিবো। ও মুখ তুলে আমার ঠোঁটের দিকে কেমন করে তাকাল। খেয়াল হতেই আমার পুরা মুখ লাল হই গেল। আমি দুই হাত দিয়ে মুখ চাইপা ধইরা ওর দিকে তাকাইলাম। ও আমার কানের কাছে আইসা ফিসফিস কইরা কইল, আর কতবার আমাকে ঘায়েল করবে তোমার রূপে? আমাকে যে দিন দিন তোমার নেশায় ধরছে। আর তো আটকে রাখতে পারছে না নিজেকে। কি করি বলো তো?
- আমি আমি…
আমার গলা কাঁপতেসে। কি কমু বুঝতেসি না। ওরে আগে এমন দেখি নাই। আচমকা সে আমার কানে আলতো করে ওর ঠোঁট জোড়া ছুইয়ে দিল। সাথে সাথে মনে হইল আমার শরীরে কেউ চারশো চল্লিশ বোল্টেজের তার লাগাই দিসে। ও বলল, তোমার মিষ্টি সুবাসে আজ আবার মাতাল হয়ে গেলাম ছোঁয়া। কেন এত ভালো লাগে? আমি কাঁপতে লাগলাম। আর বেশিক্ষণ থাকলে আমি পাগল হই যামু। আমি ওরে ঠেলে দ্রুত সিঁড়ি দিয়া নাইমা আমাদের রুমে চইলা আসলাম। ওখানে এখন কেউ নাই। সবাই বাইরে। আমি দরজা মাইরা দিয়া হেলান দিয়া দাঁড়াইলাম। এক ডোজেই আমার অবস্থা খারাপ কইরা দিল। সারা শরীর গরম হই গেসে। হার্টটা লাফাইতে লাফাইতে বুক থেকে বের হই যাইতেসে। আমি আয়নার দিকে তাকালাম। এক পলক তাকাতেই আবার চোখ সরাই নিলাম। কি হল আজকে আমার! কেউ আমারে বাঁচাও, আমি যে লজ্জার সাগরে ডুইবা গেলাম।
চলবে…
আমি আয়নার দিকে তাকালাম। এক পলক তাকাতেই আবার চোখ সরাই নিলাম। কি হল আজকে আমার! কেউ আমারে বাঁচাও, আমি যে লজ্জার সাগরে ডুইবা গেলাম।
আমি যখন রুম থেকে বাইর হইলাম তখন নয়টা প্রায় বাজতে চলল। আমি আশেপাশে তাকাইতে লাগলাম। নাহ্, চেরিকে কোথাও দেখা যাইতেসে না। আমি মুনের কাছে গেলাম। মুন জিজ্ঞেস করল, কই ছিলি? আমি মুখে হালকা লজ্জা টাইনা বললাম, রুমে। তুই আমাকে কি জিনিস আনতে বলসিলি? মুন টিস্যু দিয়া মুখ মুছতে মুছতে কইল, কেন একটা ইয়া বড়ো খাম্বা পাশ নাই? আমি লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেইলা কইলাম, তুইও তার দলে নাম লিখাইলি? মুন আমারে পাত্তা না দিয়া বলল, আয় তো, আমাকে মেহেদী লাগিয়ে দে। আমি আরো বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেইলা মেহেদী হাতে নিয়া মনে মনে কইলাম, এখন থেকেই জামাইর বন্ধুর দলে যোগ দেয়া শুরু করসে। বিয়ার পর তো আমারে আর চিনবোই না।
যখন মেহেদী লাগাই উঠলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে এগারটা বাইজা গেসে। আমি উঠেই খাবারের কাছে ছুইটা গেলাম। খিদায় পেটের ইন্দুর চিকা সব যুদ্ধ শুরু করসে। এতক্ষণ তো তলোয়ার যুদ্ধ চলতেছিল। এখন না খাইলে ক্ষেপণাস্ত্র মাইরা বসবো। আমি খাইয়া উভয় পক্ষকে শান্ত কইরা একটা বড়ো হাই তুললাম। সেই ঘুম আসতেসে। আমি সবকিছু চেঞ্জ কইরা শুইতে আসলাম। দেখি রুমের ভেতর মানুষের বন্যা বয়ে গেসে। বিছানায় মানুষ, ফ্লোরে মানুষ, চেয়ারে মানুষ। আমার জায়গা নাই। মুনও দেখি এক কোনে শুয়ে পড়সে। আমি কই যাই? ওর ওখানে একটু খালি আছে মনে হয়। আমি পাহাড় পর্বত ডিঙাইয়া ওর কাছে গেলাম। ইস্, আমি পাই না ঘুমানোর জায়গা আর সে কোলবালিশ নিয়া ঘুমাইতেসে। আমি কোলবালিশটা নিয়া ছুইড়া মারলাম একপাশে। ও ঘুম ঘুম চোখে বলল, তুই আসছিস? নে শুয়ে পড়। বলে আমারেই কোলবালিশ বানাই ফেলল। কিসু বলতে যামু, পরে মনে হইল না থাক আজবাদে কাল তো চলেই যাবে। থাকি না কিছুক্ষণ। আমি শুয়ে রইলাম চুপচাপ। ও হাত দিয়া আমারে জড়াই ধরে আছে।
আমার মনে হল আমি কিছুকে মিস করতেসি। এই কয়দিন একবারও লাভার ভ্যাম্পায়ার ফোন দেয় নাই। ম্যাসেজও না। কেন জানি ওগুলাকে খুব মিস করতেসি। একটানা ছয় বছর পাইতে পাইতে অভ্যাস হই গেসে। একটু পর পর ফোন চেক করি ম্যাসেজ আসছে কি না। কি হল হঠাৎ? আমিই বা কেন এত ভাবতেসি? তাহলে কি আমার ওর প্রতি ফিলিংস চলে আসছে? না না, এটা কি কইরা হয়? চিনি না জানি না। না না, কিন্তু……। কেন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগতেসে। আকাশের প্রতি আমার ঐ সময় থেকে একটা আবেগ কাজ করসে। সেটা কি সত্যি ভালোবাসা ছিল? না শুধুই আবেগ? ভ্যাম্পায়ার আমাকে কেয়ার করতো। যতোই আমি বিরক্ত হই না কেন কেয়ারটা আমার ভালো লাগতো। এই রকম কেয়ার আমি নিজের ফ্যামিলি আর বন্ধ বান্ধব ছাড়া কারো কাছে পাই নাই। আমি কি কনফিউজড হয়ে যাইতেসি যে আমি কাকে ভালোবাসি? পা নাড়তেই আকাশের নুপুর হালকা শব্দ কইরা উঠল। আমি নিজের মনকে জিগাইলাম, তুই কি চাস? কিন্তু মন উত্তর দেওয়ার আগেই আমি ঘুমাই গেলাম।
সকালে ঘুম তাড়াতাড়িই ভাঙল। ফোনটা খুলে দেখি সাড়ে ছয়টা বাজে। একটা ম্যাসেজ! আমি খুশি মনে ম্যাসেজে ঢুকলাম। ধুর বাবা, কচুর সিমওয়ালা। সারাদিন ম্যাসেজ দেয়। উঠতে ম্যাসেজ বসতে ম্যাসেজ। একই ম্যাসেজ যে দিনে কয়বার দেয় তা হেরাও জানে না। ইচ্ছা করে ম্যাসেজগুলা গুইলা ওদের সরবত বানাইয়া খাওয়াই। ধ্যাত। আমি উঠতেই দেখি মুন ভালো মতোই আমারে কোলবালিশ বানাইসে।
- মুন, এই মুন। ওঠ।
- হুম… আরেকটু।
- আরে আজ তোর বিয়ে না? উঠ।
- হুম। আরেকটু ঘুমাতে দে। কালকে ওর সাথে অনেকক্ষণ জেগে ছিলাম।
- ওর সাথে জেগে ছিলি মানে?
- ওর সাথে মানে……
মুনের সাথে সাথে সব ঘুম হাওয়া। মুহুর্তে চোখ ফকফকে হই গেসে। ও উঠে বইসা আমার দিকে বেক্কলের হাসি দিতে লাগল। আমি কোমরে হাত দিয়া মুখ সুঁচালো কইরা বললাম, ব্যাপার কি? তলে তলে কি চলে? ও হাসি চওড়া কইরা বলল, কি কি কিছু নাতো। কি চলবে। কিছু না। আমি হঠাৎ নিজের হাতের দিকে তাকাই চমকাই কইলাম, এগুলা কি? মুন বলল, কি হইসে?
- আমার হাতে মেহেদী দিল কে?
- তোর জামাই।
- মানে? মুন সত্যি করে বল তো তুই কি লুকাচ্ছিস আমার কাছে।
- আরে বাবা, ক'দিন যাক। সব জানতে পারবি।
- মুন…
- একটা ম্যাজিক দেখবি?
- কি?
- দুই হাত একসাথে করে দেখিস। আমি যাই ফ্রেশ হয়ে নিই।
ও উঠে চইলা গেল। কি হইতেসে ভেতরে ভেতরে যা আমি জানি না। আমি দুই হাত একসাথে কইরা চোখ বড়ো বড়ো কইরা তাকাইলাম। আমার দুই হাতের মাঝে I আর U লেখা। দুই হাত একসাথে করলে একটা ভাঙা লাভ জোড়া লাগে। I
U. আমি তাকাই আছি নিজের হাতের দিকে, মুন ফ্রেশ হই বলল, যা, ফ্রেশ হয়ে আয়। খাবো। খিদে পাইসে। তারপর আমার কাছে আইসা বলল, তোর মেহেদী রঙটা কি সুন্দর গাড় হইসে। একেবারে কালশে খয়রী। দেখবি তোর বর তোকে খুব ভালোবাসবে। এমনিতেও তো তোকে চোখে হারায়।

- মুন, তুই কার কথা বলছিস? বলবি আমাকে?
- বলবো বলবো। আগে আমার বিয়েটা হতে দে। যা ফ্রেশ হয়ে নে।
আমি ফ্রেশ হইয়া নাস্তা কইরা নিলাম। সারা সকাল চিন্তা করলাম, কে হইতে পারে? আকাশ? নাকি…… লাভার ভ্যাম্পায়ার কি দেশে আসছে? একবার তো বলছিল বিদেশে থাকে। তার জন্যই কি কোনো ম্যাসেজ বা কল করতেসে না? কিন্তু আসলে তো বলতো। মুন সব জানে। বলতেসে না। দাঁড়া একবার বিয়াটা শেষ হোক। তারপর সব পেট থেকে বাইর করমু।
.
.
.
.
আমি কমিউনিটি সেন্টারে দাঁড়াই দাঁড়াই চারপাশে দেখতেসি কেউ আমাকে নজরে রাখতেসে কি না। কাউকে তেমন সন্দেহ হইল না। আমি দাঁড়াই আছি এমন সময় পেছনে কেউ একজন বলল, আজকে কয়জনের মাথা ঘোরানোর দায়িত্ব নিয়েছো? আমি তাকাই দেখি আকাশ। সোনালী রঙের পাঞ্জাবীতে সাদা চকচকে সুতার কাজ করা। আমি তো ওখানেই ফিদা। কেন যে এত হ্যান্ডসাম লাগে আমার চেরিটাকে। ইচ্ছা করতেসে তুইলা নিয়া যায়। যাগগে, আমিও কম যাই না। খয়রী লেহেঙ্গার সাথে আমার রেশমীর মতো লম্বা চুল ছাইড়া দিসি। সেগুলা কোমর ছাড়াই গেসে। দুই কানের পেছন থেকে রজনী গন্ধার থোকা অর্ধচন্দ্রাকৃতি কইরা চুলের উপর লাগাইসি। সিঁথিতে খয়রী রঙের একটা বড়ো টিকলি আর সাথে ম্যাচিং গয়না। মুখে বিয়ের ভারি সাজ। আকাশ বলল, সব তো ঠিক আছে, কালকের উপহারটা কি এখনো পায়ে আছে? আমি লেহেঙ্গা একটু তুলে দেখলাম। নাহ্, সব ঠিকই আছে। দুই পায়ে নুপুরগুলো ঠিকই আছে। আমি মাথা নিচু কইরা দেইখা সবেমাত্র মাথাটা তুললাম, আকাশে সাথে সাথে আমার ডান গালে একটা কিস করে হাঁটা দিল। আমি রোবটের মতো দাঁড়াই রইলাম। কি হইল এটা? যখন খেয়াল হইল ততক্ষণে আকাশ চলে গেসে। আমি লাল হইয়া একটা চেয়ারে যাই বইসা পড়লাম। বিদেশ থেকে আসার পর হঠাৎ আমার সাথে এমন আচরণের কারণ আমি কিছুই বুঝতে পারতেসি না। তবে কি আকাশ আমায়… তা কি কইরা হয়। ও তো চাঁদনিকে পছন্দ করে। আমার মাথায় কিছু ঢুকতেসে।
বিয়ে বৌভাত সব সুন্দর মতো মিইটা গেল। ও যে এখনো চাঁদনিকে পছন্দ করে সেটার প্রমান বৌভাতের দিনই পাই গেলাম। ঐদিন কোথা থেকে এসে আকাশরে জড়াই ধরছিল। এর মানে ওদের সম্পর্ক এখনো ভালো আর একে অপরকে ভালোবাসে। তাহলে আমার সাথে করা সবকিছুর কি ব্যাখ্যা হতে পারে? বিছানার কিনারায় মাথা ঝুলিয়ে এসব আমি ভাবতেসি আর তখনই মুন আমার রুমে ডুকল।
- কি রে পেত্নী? কেমন আছিস?
আমি উল্টো থেকেই কইলাম, তুই নাই তাই জ্বালাও নাই। শান্তিতেই আছি। বাব্বা, দুইদিনে তো জামাইয়ের আদর পেয়ে সেই তরতাজা হয়ে গেছিস।
- যাহ্, অসভ্য মাইয়া।
- তা বল, কেমন আছিস? শ্বশুর শাশুড়ি কেমন রে?
- খুব ভালো। আসার আগে তো ছাড়তেই চাইছিল না।
- ভালো।
- এবার তোর পালা।
আমি উঠে বসে কইলাম, কিসের পালা? মুন আমার পাশে বইসা বলল, তোকে তরতাজা হওয়ার জন্য জামাই বাড়ি পাঠাবো। দাঁড়া। আমি বিছানা থেকে নাইমা কইলাম, পিটা খাইতে না চাইলে চুপ থাক।
- আচ্ছা, চুপ করব। একটা কথা বলতো।
- কি?
- তুই কাউকে ভালোবাসিস?
- বাসতাম।
- বাসতি? এখন বাসিস না?
- জানি না রে। বুঝতে পারি না। আমার সব তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
মুন কিছু বলল না। আমি বললাম, আজকে নাকি বিকালে মেহমান আসবে। মুন বলল, জানি। আমি জিগাইলাম, কে রে? মুন একটা নিঃশ্বাস পেলে বলল, আসলে দেখবি। চল রেডি হবি। আমি টেবিল থেকে একটা বই হাতে নিয়া বললাম, হঠাৎ কিসের জন্য? মুন আলমারির কাছে গিয়া খুলে বলল, সব এখন বললে তো সমস্যা। ও সেই নীল শাড়িটা বের করল। আমি ওকে বললাম, আবার এই শাড়ি কেন? তোর কি এই শাড়ির উপর নজর পড়সে নাকি। সব সময় আমাকে এই শাড়িটা পড়তে বলিস। মুন জুয়েলারি চুজ করতে করতে বলল, কারন তোকে এই শাড়িতে বেস্ট লাগে। দেখি আয়। রেডি হয়ে নে। ও আমারে ইচ্ছা মতো রেডি করাইল। কেন রেডি করাইতেসে, এত কিছু থাকতে শাড়িই বা কেন কিছুই বুঝতেসি না। যতবড়ো হইতেসে তত মনে হয় মগজের উর্বরতা কমতেসে। কিছুই মাথায় ঢুকে না।
বিকালে কলিং বেল বাজতেই মুন গিয়া দরজা খুলল। আমি উঁকি মাইরা দেখলাম রেদোয়ান ভাই আসছে। আরও কেউ আসছে। আমি দেখতেসি না পর্দার জন্য। মুন আইসা বলল, ঘোমটা দিয়ে আয় আমার সাথে। আমি মুখ গোমড়া করে কইলাম, মনে হয় যেন আমাকে দেখতে আসছে। সর তো। আমি গিয়া দেখি আকাশের আব্বা আম্মা আসছে। সাথে আরেকটা লোক। চিনি না। আমি তো আন্টিকে দেইখা সেই খুশি। গিয়া বললাম, কেমন আছেন, আন্টি?
- ভালো। তুমি?
- আপনি আসছে আর আমি না ভালো হয়ে থাকি?
উনি আমাকে পাশে বসাই বললেন, আমরা একটা কাজে এসেছি এখানে। তোমার খালা কি তোমায় বলেছে?
- না আন্টি। কি কাজ?
- আসলে ব্যাপারটা তোমার আব্বু আম্মু থাকতেই ঠিক করা ছিল। এখন তুমি বড়ো হয়েছ তাই তোমারও মতামত জানতে চাইছি।
- কি বলেন না, আন্টি।
- আমরা আসলে তোমাকে দেখতে এসেছি। তুমি যখন ক্লাস এইটে ছিলে তখনই তোমার আব্বু আম্মুকে তোমার আর আকাশের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম।
কথাটা শুইনা আমি সেই লেভেলের টাসকি খাইলাম। আমার আর চেরির বিয়ের কথা! তাও ছয় বছর আগে!
চলবে…
কথাটা শুইনা আমি সেই লেভেলের টাসকি খাইলাম। আমার আর চেরির বিয়ের কথা! তাও ছয় বছর আগে!
- ছোঁয়া তোমার মনে আছে তোমার জন্মদিনের আগের দিন আমরা তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম?
- জ্বি আন্টি।
- ঐ দিন আমরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম। যেহেতু তুমি অনেক ছোট ছিলে তাই আমরা ওয়েট করতে চাইছিলাম। তোমার বাবা মা বলেছিলেন ভেবে দেখবেন। পরেরদিন সকালবেলা ফোন করে বলেছিলেন যে তারা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি। এই ব্যাপারে তোমার খালা খালুও জানতেন। এখন তুমি যথেষ্ট বড়ো হয়েছ। তোমার নিজস্ব একটা মতামত আছে। তাই আজকে আমরা জানতে এসেছি, তুমি কি এই বিয়েতে রাজি? আমরা কি কথা আগাতে পারি?
আমি চুপ কইরা রইলাম। এই দিনটার জন্য এত বছর অপেক্ষা করসি। একটা 'হ্যাঁ' বললেই আমি আমার চেরি ফলকে নিজের কইরা পামু। কিন্তু মনটা যে বড্ড দোটানায় ফেলতেসে। সে যে কি চায় তা কিছুই বুঝতেসি না। কেন আমি সহজে হ্যাঁ বলতে পারতেসি না। বুঝতেসি না। আমি কইলাম, আন্টি, আমার আব্বু আম্মু চলে গেছে ছয় বছর। তারা সারাজীবন ব্যয় করেছে আমাকে ভালো রাখার জন্য। তাদের সিদ্ধান্ত কখনো ভুল হবে না। সেদিক থেকে হ্যাঁ বলতে পারি। কিন্তু আমার একটু সময়ের প্রয়োজন এটা নিয়ে ভাবার জন্য।
- বেশ তো, সময় নাও। আমাদের সমস্যা নেই। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। উনি হচ্ছে আকাশের মামা।
আমি সালাম দিলাম। আন্টি বললেন, তুমি ভেতরে যাও, ছোঁয়া মা। আমি চইলা আসলাম। শাড়ি গয়না খুইলা বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে গেলাম। হাতে একটা গাজর। চিন্তার চাকা ঘুরতেসে। কেন আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারতেসি না। চার মাসের আবেগ না ছয় বছরের কেয়ার? আমি যতদূর জানি যে চেরিফল আমাকে ভালোবাসে না। তবে এই কয়দিনের আচরন অবশ্য অন্য কথা বলতেসে। আর লাভার ভ্যাম্পায়ার গত ছ'টা বছর বলসে যে সে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমি তাকে কখনো দেখিনি। শুধু ফোনালাপ মাত্র। সব ইয়ারফোনের মতো প্যাঁচাই গেসে। যত খুলতে চাইতেসে জট লাগতেসে।
আমি ফোনটা নিলাম। এখনো লাভার ভ্যাম্পায়ার একবারও ফোন দেয় নাই। আমি ফোন দিলাম। ফোন বন্ধ। ঠিক আছে তো? এত ব্যস্ত যে ফোন বন্ধ!? আমি একের পর এক ফোন দিতে লাগলাম। একই কথাই বলতেসে। তাও ট্রাই করতে লাগলাম। ওদিকে সবাই বসার রুমে কথা বলতেসে। মুন একটু পরে এসে কইল, ছোঁয়া আন্টি তোকে ডাকছে। আমি ঘোমটা দিয়া বসার রুমে গেলাম। আন্টি আমাকে একটা বালা পরাই দিলেন। আমি বললাম, আন্টি, আমি তো এখনো সিদ্ধান্ত জানাইনি তাহলে…
- জানো এটা আমার শ্বাশুড়ি মায়ের। আজ তোমাকে দিলাম।
- কিন্তু কিন্তু ……
- কোনো কিন্তু না। আমি আসি মা।
ওনারা বেরিয়ে গেলেন। আমি ওনাদের চলে যাওয়ার দিকে তাকাই রইলাম। তাহলে কি ওনারা বিশ্বাস করেন আমি তাদের প্রস্তাবে রাজি হই যাবো। কিন্তু আমার মন কেন মানতে চাইতেসে না?
.
.
.
.
আরো দুইটা দিন চইলা গেল। আমি এখনো ডিসিশান নিতে পারলাম না। সারাদিন এক হাতে গাজর খাইতেসি আর আরেক হাতে ফোন। এই লাভার ভ্যাম্পায়ারের সমস্যাটা কি? সেই যে ফোন বন্ধ করসে আর খোলার নামই নাই। আমি এদিকে ডিপ্রেশনে থাম্বেলিনার মতো ছোটো হই যাইতেসি। আজকে মুন চইলা যাওয়ার কথা। ওরে বিদায় দিয়া সবেমাত্র আমি বিছানাই শুইসি। এমন সময় ও হাঁপাইতে হাঁপাইতে আইসা বলল, ছোঁয়া…। আমি ওরে দেইখা ভয় পাইয়া গেলাম। বিছানা থেকে উইঠা ওরে বসাই একগ্লাস পানি দিলাম। ও পানি খেয়ে গ্লাসটা আমার হাতে দিল। আমি গ্লাসটা রাখতে রাখতে কইলাম, কি হইসে? ও বলল, আকাশ ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হইসে। সাথে সাথে গ্লাসটা স্লিপ কাইটা আমার হাত থেকে পইড়া ভেঙে টুকরা টুকরা হই গেল। মুন আরও কিছু বলার আগেই আমি ব্যাগ নিয়া দৌঁড় দিলাম বাইরে। মুন আমারে পিছন থেকে ডাক দিল কিন্তু আমার কানে কোনো ডাকই ঢুকল না।
শহরে ঢুকতেই খেয়াল হইল আমি আসলে কিছুই জানি না। শুধু এক্সিডেন্টের কথা শুইনাই দৌঁড় মারসি। কোথায় ভর্তি, কি অবস্থা, কেমন আছে কিছুই জানি না। আমার মতো গাধি আর কয়টা আছে? আমি ফোন বের কইরা মুনরে ফোন দিলাম। কল রিসিভ করতেই একগাদা ধমক শুনলাম। আমি মুখ বোঁচা করে বললাম, শোন না।
- কি শুনবো? কোনো কান্ডজ্ঞান আছে তোর। কিছু বলার আগেই দৌঁড়ে বের হয়ে গেলি।
- আসলে শুনেই ভয় পেয়ে গেছি। ও মানে তোর জামাইর বন্ধু কোথায় ভর্তি আছে?
- কি তখন থেকে জামাইর বন্ধু জামাইর বন্ধু করছিস। ক'দিন পরে সে তোর জামাই হবে।
- আচ্ছা বাবা, একটু ঠান্ডা হয়ে বল না, কোথায় আছে?
- আমি একটা ঠিকানা ম্যাসেজ করে দিচ্ছি। ওখানে যা। সেখানেই আকাশ ভাই আছে।
- আচ্ছা দে।
মুন একটা ঠিকানা ম্যাসেজ করল। আমি একটা রিকশা ধরাই চইলা গেলাম। গিয়া বেকুবের মতো দাঁড়াই রইলাম। এটা তো কোনো হাসপাতাল না। একটা বড় বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়াই আছি। কয়েকবার ঠিকানা মিলাইলাম। ঠিকই তো আছে ঠিকানা। এটা কার বাড়ি? আমি মুনরে ফোন দিয়া কইলাম, এটা কার ঠিকানা দিয়েছিস?
- তুই পৌঁছে গেছিস। ভেতরে যা।
এই বইলাই মুন ফোন কাইটা দিল। আমি ফোনটার দিকে বিরক্ত হই তাকাইলাম। এই মাইয়া আমারে কখনো কিছুর সবটা বলবে না। আমি গেটে নক করতেই দারোয়ান এসে কইল, কি চাই? কি বলমু? কিসুই তো বুঝতেসি না। কার বাড়ি, কে থাকে। কিছুই জানি না।
- আকাশ আছে?
- আপনি ছোঁয়া?
- জ্বি।
দারোয়ান গেট খুইলা দিল। আমিও ঢুইকা পড়লাম। বাড়িটার দিকে যাইতেই আমার পাঁচ মিনিট লাগল। এত বড় এটা কাদের বাড়ি? আমি দরজায় নক করতেই দেখলাম দরজা খোলা। আমি উঁকি মারলাম। দেখলাম আন্টি সোফায় বইসা আছে। আমি গিয়ে সালাম দিলাম। আন্টি হাইসা বললেন, আরে, ছোঁয়া যে। কি খবর?
- জ্বি আন্টি, ভালো। আমি শুনলাম, ইয়ে মানে ওর নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে।
- তা ছোটখাটো একটা হয়েছে। চেম্বার থেকে বাইকে করে আসার সময় বাইক উল্টে পড়ে গিয়েছিল।
- এখন কেমন আছে?
- আছে কোনো রকম। তুমি দেখে এসো।
- ইয়ে মানে যাবো?
- যাও। কয়দিন পরে তো চলেই আসবে। আজ গেলে কিই বা সমস্যা হবে।
আমি লজ্জায় মাথা নিচু কইরা সিঁড়ি দিয়া উপরে গেলাম। উপরে গিয়া মনে হইল, আন্টিকে তো জিজ্ঞেস করা হই নাই চেরির রুম কোনটা। ধুর বাবা। কি যে করি। আমি রুমগুলাতে উঁকি মারতে লাগলাম। একটাতে দেখলাম কেউ বিছানায় শুয়ে আছে। চিনতে অসুবিধা হইল না। আকাশ বিছানায় শুয়ে আছে। আমি সাবধানে ঢুকলাম। দেখে বোঝা যাচ্ছে ঘুমাচ্ছে। আমি বিছানার কাছে গিয়া দেখলাম পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ। ইচ্ছে করল একবার ছুঁয়ে দেখি। পরে ভাবলাম, থাক, ঘুমাচ্ছে যখন ঘুমাক। ধরলে যদি জেগে যায়।
আমি ওর রুমটা দেখতে লাগলাম। সুন্দর গোছানো। দেয়ালে ওর বড়ো একটা ছবি টাঙানো। ইস্, কি হ্যান্ডসাম লাগছে। তবে সামনাসামনি তো আরও বেশি হ্যান্ডসাম। বলেই নিজের মুখ ঢাইকা ফেললাম। আমি সবকিছু ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ একটা জিনিসে চোখ আটকে গেল। একটা নীল ডায়েরী। আমি হাতে নিতেই চিনতে পারলাম। এটা তো চেরির ডায়রী! যেখানে সে তার চাঁদনির স্মৃতি লিখে রাখসে। আমার মাথায় আগুন ধইরা গেল। ইচ্ছা করতেসে ডায়রীটা টুকরা টুকরা কইরা ফেলি। কিন্তু মন আমার মাথায় বরফ ঢাইলা বলল, কুল, ছোঁয়া কুল। একবার পইড়া দেখ কেমনে কি করসে। আর যাই হোক, আমার মতো লাভ স্টোরি রিডারের এতবড় একটা সুযোগ মিস করা ঠিক হবে না। মনে হইতেসে এই ডায়রীতেই সব রহস্য লুকাই আছে। আমি ডায়রীটা নিয়া রুম থেকে বাইর হই আসলাম। আসার সময় পড়ার রুমটা চোখে পড়ছিল। ওখানে গিয়া চেয়ারে পা তুইলা বসলাম। মনে হইতেসে কোনো জীবন কাহিনী পড়তে বসতেসি। যাহ হোক। আমি শুরু করলাম।
প্রথম পেইজের গানের কলিটা দেইখা একটা হাসি দিলাম। কি প্রেমটাই না ছিল তাদের! ছিল কেন বলতেসি। এখনো আছে। আমি পরের পৃষ্ঠা উল্টাইলাম। ঐদিন চেরি ফল আমার থেকে কাইড়া নিয়া গেসিল। আজকে যে করেই হোক আমি পুরাটা পইড়া শেষ করমু। আমি মনোযোগ দিয়া পড়া শুরু করলাম।
(ডায়রী)

গাড়ি করে যাচ্ছিলাম। প্রায়ই গান শুনতে শুনতে কলেজ যেতাম। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ড্রাইভার চাচাকে বললাম গান ছেড়ে দিতে। ড্রাইভার চাচা কি এক রোমান্টিক গান ছেড়ে দিল। আমার বিরক্ত লেগে উঠল। তবু কিছু বললাম না। চলুক, দেখি কেমন লাগে। নাহ্, সহ্য হচ্ছিল না। বাড়ি থেকে কলেজ যেতে আধা ঘন্টা লাগে। আমি এই আধা ঘন্টা একেবারে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গেলাম। আমি মাত্র চাচাকে বলতে যাচ্ছিলাম, চাচা কালকে থেকে আর এমন গান দিবা না। হঠাৎ একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল। আমাদের কলেজের পাশেই একটা ফুসকা দোকান আছে। সেখানে স্কুল ড্রেস পরা একটা মেয়ে ফুসকা খাচ্ছে আর ঝালে লাফাচ্ছে। আমার দেখে ভীষন মজা লাগল। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটা ছিল, মেয়েটাকে দেখে হঠাৎ করে আমার গাড়িতে চলা রোমান্টিক গানগুলো ভালো লাগতে শুরু করল। চাচা বললেন, কি হল আকাশ বাবা? নামবা না? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।
- হুম।
আমি নেমে কলেজ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে গেলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটার ফুসকা খাওয়া দেখতে লাগলাম। হঠাৎ একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে এসে ওর জামা টেনে কি যেন বলল। ঐ মেয়েটা ছোট্ট মেয়েটার দিকে এমন মিষ্টি হাসি দিল যে আমার মনে হঠাৎ ঝড় শুরু হয়ে গেল। লজ্জায় আমার কান অবধি গরম হয়ে গেল। আমি নিজের চিন্তায় ডুবে গেলাম। যখন মেয়েটার দিকে খেয়াল করলাম ততক্ষণে সে চলে গেছে। কোনদিকে গেছে সেটা আর খেয়াল করতে পারলাম না।
বাড়িতে এসে অনেকক্ষণ মেয়েটাকে ভোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু কেন যেন মেয়েটার ঐ এক চিলতে হাসি আমার মনে গেঁথে গেল। আমি বিছানায় শুয়ে সেই হাসিতেই হারিয়ে গেলাম।
চলবে…
বাড়িতে এসে অনেকক্ষণ মেয়েটাকে ভোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু কেন যেন মেয়েটার ঐ এক চিলতে হাসি আমার মনে গেঁথে গেল। আমি বিছানায় শুয়ে সেই হাসিতেই হারিয়ে গেলাম। আমি বিকালে চা খেতে যাই। কিন্তু আজ কখন যে তার কথা ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা হয়ে গেল বলতে পারব না। আম্মু আমার জন্য নাস্তা এনে বলল, কিরে আজকে যাসনি যে? আমি অবাক হয়ে বললাম, সন্ধ্যা হয়ে গেছে! আম্মু হেসে বলল, কেন? খেয়াল করিসনি বুঝি?
- হুম।
- কোন কল্পনায় ডুবে গেলি যে খেয়াল করিসনি? খুলে বল তো।
আমি আমার আব্বু আম্মুর সাথে একেবারে ফ্রি। তাই সব খুলে বললাম। সব শুনে আম্মু মুচকি হেসে বলল, বাব্বা! আমার ছেলে তো দেখি প্রেমে পড়তে শিখে গেছে। আমি এক মুহুর্তে থমকে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম।

প্রায় দু'সপ্তাহ হয়ে গেল। আমি কিছুতেই ওকে ভুলতে পারলাম না। একটা হাসিতে সে আমাকে পাগল করে দিল। আমিও হাল ছাড়ার পাত্র নই। আমি তাকে খুঁজে বের করেই ছাড়বো। ওর গায়ে গার্লস স্কুলের পোশাক ছিল। আমি ঐ ক্লু দিয়েই শুরু করলাম। কলেজ শেষ করেই ওখানে চলে যেতাম। কিন্তু একটা দিনও ওর দেখা পেলাম না। যেন সে জেনেশুনেই আমি পৌঁছানোর আগেই বাসায় চলে যেত। তাই প্রত্যেকদিন মন খারাপ করে বাড়ি ফিরতাম। আমি আসলেই আম্মু হাসিমুখে বলত, কি রে, আমার বৌমাকে পেলি না বুঝি? আমি আম্মুকে আনন্দে জড়িয়ে ধরতাম। এমন মা কয়জনের জোটে? আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, পাগল ছেলে আমার।
বছরের শেষ দিন বের হলাম বন্ধুদের সাথে। পুরো শহর আলোয় জ্বলজ্বল করছিল। বন্ধুরা বলল, মোহাম্মদীয়ার দোকানের চা নাকি সেই বিখ্যাত। যদিও এখান থেকে যেতে পনের বিশ মিনিটের হাঁটা রাস্তা। আমার কেন যেন যেতে ইচ্ছে করছিল না। আমি নানা বাহানা দিলাম না যাওয়ার জন্য কিন্তু রেদোয়ান কিছুতেই আমাকে ছাড়লো না। জোর করে নিয়ে গেল। দোকানে কিছুটা ভীড় আছে। আমি চা খাচ্ছি আর বাইরে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটা মেয়ের দিকে। হ্যাঁ, সেই মেয়েটা। আমি রেদোয়ানকে ম্যানেজ করে উঠে বের হয়ে এলাম। অনেকটা দূর থেকে ফলো করতে করতে গেলাম। সে তার বান্ধবীর সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিল। একটু পরে ও ওর বান্ধবী থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাসার পথ ধরল। দশ মিনিট পর ও একটা পাঁচ তলা বাসায় ঢুকে পড়ল। আমিও দৌঁড়ে ঢুকলাম। দেখলাম ও সেই বাসার দোতলায় থাকে। আমি তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। বাসাটা থেকে বের হতেই একটা টুলেট চোখে পড়ল। বাসা ভাড়া দেওয়া হবে। এই সুযোগ। বাড়িতে এসেই আম্মুকে সব বললাম। আম্মু বলল, তুই যখন চাচ্ছিস তবে ঐ ভাড়া বাসাতেই আমরা ভাড়া উঠবো। আমারও আমার বৌমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে যাকে দেখে আমার ছেলেটা এমন পাগল হয়ে গেল।

আমরা একসপ্তাহের মধ্যে নতুন বাসায় উঠলাম। ঠিক মেয়েটার বাসার সামনের বাসাটা। সব গোছগাছ শেষ হলে আম্মু আমাকে বলল, চল, বৌমাকে দেখে আসি। আমি তো শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। আমি তৈরী হয়ে নিলাম। আম্মুকে নিয়ে নক করলাম পাশের বাসায়। একজন আন্টি দরজা খুলল। আম্মু বলল, আমরা পাশের বাসায় নতুন এসেছি তাই পরিচিত হতে এসেছি। আন্টি আমাদেরকে ভেতরে বসালেন। বললেন, তারা তাদের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে থাকেন। তখনই তিনি ডাক দিলেন, ছোঁয়া, এদিকে আয়।
ছোঁয়া। আমার ভালোবাসার নাম ছোঁয়া……
আমার হাত থেকে ডায়রীটা পড়ে গেল। আমি থমকে বইসা রইলাম। চোখ থেকে একফোঁটা পানি গড়াই পড়ল। আনন্দের পানি। আকাশ, আকাশ আমাকে ভালোবাসতো!!!!!!! আমি তার ক্রাশ ছিলাম। আমি… আমি…। কি করব বুঝতে পারতেসি না। খুশিতে পাগল পাগল লাগতেসে। এতদিন জানতাম চাঁদনি ওর ক্রাশ তাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু আজ জানতে পারলাম ওই বোকা হাদাটা আমার উপর ক্রাশ খাইছিল। একবার বললোও না। আগে জানলে বগলদাবা কইরা নিজের কাছে রাইখা দিতাম। ভাইবাই হাসি পাইল আমার। আমি ডায়রীটা নিচ থেকে তুইলা আবার পড়া শুরু করলাম।
(ডায়রী)
ও আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। হয়ত খেয়াল করেনি যে কেউ ওদের বাসায় এসেছে তাই যেভাবে ছিল ওভাবেই চলে এসেছিল। আমি ওকে দেখে পাগলের মতো তাকিয়ে রইলাম। সদ্য গোসল করে আসায় ভেজা লম্বা চুলগুলো থেকে একটু আধটু পানি পড়ছে। মুখের পাশের ছোট চুলগুলো লেপ্টে আছে। একটা হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হালকা গোলাপী ফ্রক পরেছিল। ওকে ওকে…… অন্যরকম সুন্দর লাগছিল। ইচ্ছে করছিল ওকে একটু ছুঁয়ে দেখি। অনেকক্ষণ পানিতে থাকায় ওকে সাদা সাদা লাগছিল। আর ওর ঠোঁট জোড়া……
- এ্যাঁ…… ও খেয়াল করছিলো আমি যে ওড়না ছাড়া ছিলাম!!!!!!!!!!! ( মুখ সুচালো করে) হুহ্, ছয় বছর আগেও ব্যাটা লুচু ছিল। দেখো কিভাবে লিখেছে। ইস্!!!!!!!
আমি লজ্জায় লাল হই গেলাম। এরপর নিজেকে কন্ট্রোল করে কইলাম, নাহ্ এভাবে চললে আর পড়া লাগবে না।
(ডায়রী)
ও দৌঁড়ে ভেতরে চলে গেল। আমার ইচ্ছে করছিল ওকে আমার সামনে বসিয়ে রেখে সারাজীবন ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ও এবার ওড়না পরে ভদ্র হয়ে এল। আমি লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না। ও আম্মুকে সালাম দিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আমাকে কেউ মেরেছে কি না। আমি ওর দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। আম্মু হেসে কারন জানতে চাইলে ও বলল, আমার গাল দুটো নাকি চেরি ফলের মতো হয়ে আছে। বলেই ও হঠাৎ লজ্জা পেয়ে গেল। আমি ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। যদিও ও ফর্সা না। কিন্তু ওর লজ্জা পাওয়া মুখটা আমার পুরো হূদয়কে নাড়িয়ে দিল।
আমি বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বার বার ওর লাল হয়ে যাওয়া মুখটা ভেসে উঠল। আম্মু আমার কাছে এসে বলল, আমার বৌমাকে পছন্দ হয়েছে। দেখতে আসলেই কিউট। তবে এখন ওর বয়স কম। বাচ্চা মেয়ে। তাই ওকে সময় দেওয়া উচিত। কি বলিস?
- হুম।
আমি রাজি হয়ে গেলাম। আসলেই ওর বয়স কম। আমি ওর জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি আছি।
আমি মন খারাপ কইরা বললাম, আকাশ…… আমি আমি …… ক্ষমা করে দিও আমায়। তোমাকে ভুল বোঝার জন্য। ক্ষমা করে দিও।
(ডায়রী)

আমি কলেজ যাওয়ার জন্য আটটার আগে রেডি হয়ে দরজার কাছে গিয়ে বসে থাকতাম। কখন ও বের হবে। কিন্তু ও বের হতো সাড়ে আটটায়। যখন আমি বের হতাম। কয়দিন এভাবেই চলল। আমি ভাবলাম, ওর স্কুল তো আটটায়। ও সাড়ে আটটায় বের হয় কেন? তবে আমার ভালোই লাগতো। ওর দুটো চোখ দেখে দিনটা শুরু করলে দিনটা কেন যেন ভালো যেতো। হঠাৎ ওর সাড়ে আটটায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আমিও ওকে আড়াল থেকে দেখতে লাগলাম। শুক্রবার একটা কারনে ছাদে গিয়েছিলাম। একটু পরে দেখলাম ও এক গাদা ভেজা কাপড় নিয়ে হাজির। আমি না দেখার ভান করে রইলাম। তবে ওর কান্ড দেখে হাসি পাচ্ছিল। একই কাপড় বার বার মেলছিল। একটু পরেই ও সব কাপড় দিয়ে চলে যেতে লাগলে ডাক দিলাম। ওয়াই ফাই নেয়ার বাহানায় ওর সাথে কথা বললাম। তখনই বুঝলাম আমার মিষ্টি বউটা ভীষণ দুষ্টু। আমাকে পাসওয়ার্ড দেওয়ার বদলে I love you বলে চলে গেল। আমি অবাক হওয়ার ভান করে আবার জানতে চাইলাম। ওর মুখ থেকে আবার I love you শুনে যেন আমার পুরো পৃথিবীটাই রঙিন প্রজাপতির মতো উড়তে লাগল। বুঝলাম ছোঁয়াও আমাকে একটু একটু পছন্দ করে ফেলেছে। এমন সময় নিপা খালা এসে ঝামেলা করে দিল। আম্মুর কাছে এসে রসিয়ে রসিয়ে কত কথা বলল। নিপা খালাকে দেখে ছোঁয়া তখনই দৌঁড়ে নিচে চলে এল। আমি বাসায় ঢুকতেই আম্মু হেসে বলল, কিরে বৌমা থেকে প্রপোজ পেয়ে গেলি নাকি? আমি হেসে বললাম, তোমার বউ মা ভীষণ দুষ্টু। এখন ব্যাপারটা সামাল দিতে হবে নইলে নিপা খালা সারা দুনিয়ায় রাষ্ট্র করে বেড়াবে। আমি আর আম্মু গিয়ে ব্যাপারটা মিটমাট করে এলাম।
আমি ডায়রীটা বুকে জড়িয়ে নিয়া বললাম, চেরি তো ভালোই সেয়ানা। আমার তাকে প্রপোজ করতে বয়েই গেছে। কিন্তু করে তো ফেলছিলাম। কি আর করা।
(ডায়রী)

আমার সেদিন ফুটবল টুর্নামেন্ট ছিল। আমার টিম খেলায় জিতে ছিল। আমি হাসিমুখে ঘরে ঢুকতেই দেখি ছোঁয়া এসে বসে আছে। টেবিলে গাজরের হালুয়া। আমার সবচেয়ে ফেবারেট খাবার। আম্মু বলল, ছোঁয়া নাকি নিজে বানিয়েছে। আমি তো মহা আনন্দে গিয়ে পেয়ালাটা নিয়ে নিলাম। সে হঠাৎ বলল, চলে যাবে। আমি একচামুচ খেয়ে বুঝে ফেললাম, প্রথম রান্না করেছে আর ইচ্ছা মতো চিনির জায়গায় লবন ঢেলেছে। আমি তাকে সুন্দর মতো একটা বাঁশ দেওয়া প্রশংসা করতেই সে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল। ভাবলাম বেশি হয়ে গেল নাকি?
রাতে আম্মুকে বললাম, ওকে তোমার রান্নার ট্রেনিং দেওয়া লাগবে বিয়ের পরে। না হলে এভাবে সারাজীবন লবন গাজরের হালুয়া খেতে খেতে বয়রা হয়ে যাবো। আম্মু আমার কথা শুনে হাসলেন।
আমি এই জায়গাটা পড়ে থাইমা গেলাম। মনে মনে কইলাম, দাঁড়া বিয়ার পর লবন গাজরের হালুয়া না নিমের পাঁচন দিয়া গাজরের হালুয়া রান্না কইরা খাওয়ামু। নিমের কথা ভাইবা নিজেই মুখটা বাঁকা কইরা ফেললাম।
(ডায়েরী)

পরদিন ঠিকই আবার চলে এল আম্মুর কাছে রান্না শিখতে। ভালোই গাজরের হালুয়া রান্না করেছে আজ। আমি খেলতে গিয়েছিলাম। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ায় চলে এসেছিলাম। ভাগ্যিস এসেছিলাম। না হলে মিষ্টি মুখটা দেখতেই পেতাম না। ফ্রেশ হয়ে এসে ওকে একটু খেপালাম। তাতে মুখ ভার করে পেয়ালায় থাকা গাজরের হালুয়া এক চামুচ খেয়ে বলল, আন্টি আমি যাই। আমি গাজরের হালুয়া নষ্ট করার বাহানায় ওর থেকে পেয়ালাটা নিয়ে নিলাম। ও আমার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। আমার হঠাৎ খেয়াল হল, ওকে দেখেছিলাম আজকে জামা রোদে দিয়ে এসেছে। এখন বাইরের যা অবস্থা, যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি চলে আসবে। কথা বলার বাহানায় বুঝিয়ে দিতেই ও এক দৌঁড়ে ছাদে চলে গেল। আম্মু বলল, আমারও নাকি কিছু কাপড় ছাদে। ব্যস, আমিও চলে গেলাম ছাদে। গিয়ে দেখি বৃষ্টি চলে এসেছে। ও বাচ্চাদের মতো বৃষ্টিতে ভিজছে। ইচ্ছে করছিল ওকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলি, ছোঁয়া, তোমার মাঝে কি আছে যা আমাকে চম্বুকের মতো টানে? হঠাৎ খেয়াল হলো, যেভাবে ভিজছে, জ্বর না হয়ে যায়। আমি বলল, আগে কি বৃষ্টি দেখো নাই? ও আমাকে দেখেই লজ্জা পেয়ে জামা নিয়ে এক দৌঁড়ে নিচে চলে গেল। আমি হেসে ফেললাম। কারণ বউটা আমার যে জামাকে বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্য এসেছিল সেই জামাটাই ভিজিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও আমার ভেজা কাপড় নিয়ে চলে এলাম। ফলে আমাকেও ভিজতে হলো।
আম্মু আমাকে দেখে বলল, কি রে এমন ভিজেছিস কেন? ইস রে, যা তাড়াতাড়ি চেঞ্জ কর। ঠান্ডা লেগে যাবে। আমিও জামা চেঞ্জ করে ফেললাম। কিন্তু লাভ হল না। সর্দি ধরে গেল। আমার সামান্য ভেজায় এই অবস্থা তাহলে ছোঁয়ার কি অবস্থা কে জানে।

আমি সকালে আম্মুকে বললাম, তুমি একটু দেখে এসো। আম্মু এসে বলল, ওর জ্বর হয়েছে। মেয়েটা আসলে বাচ্চা। আমি মনে মনে বললাম, আমার কাছে একবার আসুক তারপর ইচ্ছা মতো ওকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো। হি হি হি……। তারপর জ্বর হলে একসাথে নাপা এক্সট্রা খেয়ে কাঁথা গায়ে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকবো।
চলবে…
জ্বর হলে একসাথে নাপা এক্সট্রা খেয়ে কাঁথা গায়ে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকবো।
শুনলাম কালকে ও যে জামা রোদে দিয়েছিল ওটা নাকি ছিঁড়ে গেছে। আর জামাটার জন্য নাকি বউটা আমার কেঁদে কেটে এক সার। দাঁড়াও আগে বিয়েটা হতে দাও তারপর তোমাকে একগাদা কিনে দেবো।

আজকে আমার বার্থডে আর আমার বউটা জ্বরে পরে আছে ঐ বাসায়। ধুর, ভালো লাগে না। আম্মুর কথায় সুন্দর করে সেজে রেডি হয়ে নিলাম। বিকালে থেকে সব বন্ধু বান্ধবরা আসা শুরু করে দিল। সন্ধ্যার একটু পরে আমি আমার বার্থডের সবচেয়ে দামি গিফটটা পেলাম। দেখলাম ছোঁয়া এসেছে। ওকে দেখে আমি আবার ক্রাশ খেলাম। এত সুন্দর একটা মানুষ কি করে হতে পারে। আমার দুষ্টু মিষ্টি বউটাকে ডানা কাটা পরী লাগছিল। চোখই ফেরাতে পারছিলাম না। ও কাছে আসতেই আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। এমন সময় চাঁদনি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল৷ আমি নিজেকে ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটা কিটকাট দিলাম। ভেবেছিলাম আমার বউটারেও দিবো। কিন্তু সেই সময় ও চলে যেতে লাগল। আমি ডাক দিলাম গাজরের হালুয়া বলে। সেটা শুনে সবাই জানতে চাইল আমি কেন ওকে এই নামে ডাকলাম। আমি সবাইকে লবনের কাহিনী বললাম। ছোঁয়া হয়ত কষ্ট পেয়ে চলে গেল। কিন্তু ও যদি জানত কেন আমি ওকে গাজরের হালুয়া নাম দিয়েছি! গাজরের হালুয়া আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। আর ওযে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষদের একজন। আমার দুষ্টু মিষ্টি বউ। তাই যে ওকে আমি এই নাম দিয়েছি।
আকাশ, এত ভালোবেসেছিলে আমায়? একবার যদি মুখ ফুটে বলতে তখন। আমি ডায়রীটার দিকে কতক্ষণ তাকাই থেকে পড়া শুরু করলাম। এখনও যে অনেকটুকু বাকি। অনেক না জানা অনুভূতি অনুভব করা বাকি রয়ে গেছে।
( ডায়রী)
বউটা আমার রাগ করে চলে গেল নিজের বাসায়। আমি কেকের লাভ ইমোজি দেওয়া অংশটা সুন্দর করে কেটে ওদের বাসায় গেলাম। নক করতেই ছোঁয়া এসে দরজা খুলে দিল। একবার ফিরেও দেখল না কে এসেছে। বলল সে রাতে খাবে না। বলেই নিজের রুমে গিয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি ওর পিছু পিছু রুমে গেলাম। বুঝলাম গাজরের হালুয়া বলায় খারাপ লেগেছে অনেক। কেন যেন ওর ভার হয়ে থাকা মুখটা দেখে নিজেকে আটকাতে পারলাম না। তাই কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে কপালে একটা চুমু দিয়ে চলে এলাম।
- তার মানে ঐদিন আমি ঠিকই ধরেছিলাম। আব্বা আম্মা না চেরি ফল এসেছিল কেক দিতে। ডাকাতের মতো এসে চোরের মতো পালিয়ে গেল কেকটা দিয়ে।
(ডায়রী)

আমার জন্মদিনের পরে একদিন ছোঁয়ার বাসায় গিয়েছিলাম। ও ছিল না। আন্টি বললেন বসতে। তারপর রান্নাঘরে চলে গেলেন। আমি ওর রুমে উঁকি দিলাম। কেমন যেন বাচ্চা বাচ্চা স্মেল আসছিল ওর রুম থেকে। আমি হেসে ওর টেবিলের কাছে গেলাম। ওখানে ওর ডায়রী পড়ে ছিল। খুলে একটু পড়েই বুঝলাম ছোঁয়া আমাকে খুব পছন্দ করে। জেনে খুবই খুশি লাগছিল। তবে হাসিও পাচ্ছিল ওর বাচ্চা লেখা দেখে। বাসায় এসে মনের আনন্দে নাচতে লাগলাম।
পরদিন শুক্রবার। চাঁদনি বাসায় এসেছিল। ছাদে যাবে বলে বায়না ধরল। আমিও গেলাম। একটু পরে দেখি আমার বউটা কাপড় নিয়ে হাজির। সে অনেক জোরে বালতি রেখে তার অদ্ভুত কন্ঠে গান গাইতে লাগল৷ চাঁদনি ওর সাথে ভাব জমাতে চেয়েছিল কিন্তু সে কড়া কথা শুনিয়ে চলে এল নিচে। আমার ওর কান্ড দেখে হাসি পেল।
বিকালবেলা ছোঁয়া বাসায় এসে হাজির। আমাকে হয়ত আশা করেনি। দেখে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন গাজরের হালুয়া? ও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ভালো চেরি ফল। ও আমাকে চেরি ফল নাম দিয়েছি। শুনে আমার ভীষণ ভালো লাগল। তবু না বুঝার ভান করে বললাম, চেরিফলটা কে? ও আমাকে ইঙ্গিত করল। চাঁদনি জিজ্ঞেস করল, কে এসেছে? ও রেগে বলল, চেরির বউ গাজর আসছে। বলে ভেতরে চলে গেল। আমার বেশ ভালো লাগল শুনতে। একেবারে টিক কথা বলেছে। চাঁদনি বুঝতে পারেনি ও কি বলেছে। চাঁদনি আমার ক্লোজ ফ্রেন্ডদের একজন। বুঝতে পারলাম ওর হিংসে হচ্ছে চাঁদনিকে আমার এত কাছে দেখে।
আমি চাঁদনিকে এগিয়ে দিয়ে যখন নিজের রুমে এলাম দেখি ছোঁয়ার হাতে আমার ডায়রী। প্রথমে দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। সব পড়ে ফেলল নাকি! তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে ডায়রীটা নিতেই ও ধরা খাওয়া চোরের মতো তাকাল। তখন আমার ওকে দেখে হাসি পাচ্ছিল। আমাকে দেখে হাত দুটো পেছনে লুকিয়ে ফেলল। আমার মনে হল ও কিছু লুকাচ্ছে। আমি মুখ গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করতেই এক দৌঁড়ে পালালো। ডায়রী খুলে দেখলাম ও বেশিদূর পড়তে পারেনি। প্রথম পৃষ্ঠা পড়ছিল মাত্র।
আমার কলেজ প্যান্টে একটা দরকারি কাগজ ছিল। ওটা নিতে গিয়ে দেখি আমার কলেজ শার্টের শেষ বোতামটা নেই। দেখে বোঝা যাচ্ছে কেউ সুন্দর করে কেটে নিয়ে গেছে। ছিঁড়ে পড়ে গেলে তো সুতা থাকত। বুঝলাম কাজটা কার। কিন্তু কেন কেটে নিয়ে গেল বুঝলাম না।

প্রত্যেক শুক্রবার দুপুরে ছাদে আমি ওর দেখা পাই। আজকেও গেলাম। আমার ডি এস এল আর ক্যামেরাটা নিয়ে। ওটা নিয়েই খুটখাট করছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়লো ছাদের দরজার সাথে দেয়ালের দিকে। ছোঁয়া দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে হাঁপাচ্ছে। ওকে দেখে আরেকটু হলে আমার হাত থেকে ক্যামেরাটা পড়ে যেত। কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। ও যখন চোখ খুলল আমি সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ও তাড়াহুড়ো করে কাপড় দিয়ে চলে যাচ্ছিল। এমন সময় খুব জোরে পড়ে গেল। ভেবেছিলাম গিয়ে ধরে তুলব। কিন্তু আমি এখন বোঝাতে চাই না যে আমি ওকে ভালোবাসি। সময় হলে বলব। তাই ওর দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ও টু শব্দ না করে উঠে চলে গেল। আমি আর থেকে কি করব? ছাদের দরজার কাছে এসে দেখলাম ও বসে আছে সিঁড়িতে। আমি ওকে সরতে বললে ও পা সরিয়ে আমাকে জায়গা করে দিল। আমি নেমে গেলাম। কিন্তু পরে মনে হল বেশ ভালোই চোট পেয়েছে। একলা যেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। গিয়ে দেখি ও কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে আছে। পা মোচকে কালশে হয়ে গেছে। আমি গিয়ে বললাম আমার কাঁধে হাত দিতে। ও আমার কাঁধে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর এত কাছে আমি কখনো যাইনি। ওর ছোঁয়া আর ঘামে ভেজা মিষ্টি গন্ধ আমাকে মাতাল করে ফেলছিল। নেশা হয়ে যাচ্ছিল। ওদের বাসার সামনে আসতেই ওকে ছেড়ে দিলাম। আর এক মুহূর্ত থাকলে কি যে করে ফেলতাম নিজেই জানি না। ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম আমাকেও এখন গোসল করতে হবে। বলে বাসায় ঢুকে দরজা আটকে কাচে চোখ রাখলাম। দেখি ও মুখ গোমড়া করে বাসায় ঢুকে গেল। আমি মুচকি হাসলাম। শার্টটা ওর গায়ের পানিতে ভিজে গিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল রেখে দেই। কিন্তু নিপা খালা হতে দিল না। পরদিনই শার্টটা ধুয়ে রোদে দিয়ে দিল।
সেদিন বিকালে কাপড় আনতে গিয়ে দেখি আমার বার্থডেতে যে শার্টটা পরেছি ওটা হাওয়া। প্যান্টটা আছে শার্ট নেই। কাজটা কার খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। বাসায় গিয়ে আম্মুকে বললাম, তোমার বউমা এখন থেকে দখল করা শুরু করে দিয়েছে। আম্মু হেসে বলল, কি হয়েছে?
- আমার শার্টটা নিয়ে গেছে।
- কি করে বুঝলি?
- অন্য কেউ হলে পুরো সেট নিয়ে যেত। এখানে শুধু শার্টটাই গায়েব।
আম্মু হাসলেন। সন্ধ্যায় আম্মুকে বলে ছোঁয়াদের বাসায় পাঠালাম। দেখতে ওর কি অবস্থা। তার একটু পরে আমি নাস্তা বানিয়েছি এটা বলার বাহানায় ওদের বাসায় গেলাম। দেখি ছোঁয়া আম্মুর সাথে বসে আছে। হঠাৎ ওর গলার চেইনের দিকে নজর গেল। সেখানে আমার কলেজ ড্রেসের বোতামটা ঝুলছে। এবার বুঝলাম বোতামটা আনার কারন। আমি সবার সামনে বোতাম চুরির কথা বলতেই ও সাথে সাথে হাত দিয়ে বোতামটা লুকিয়ে রুমে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলল ও ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার আগে আমাদের বাসায় আসবে আমার নাস্তা খেতে। আমিও ওয়েট করতে লাগলাম।
নক করতেই দরজা খুলে আমি এক মুহূর্ত থমকে গেলাম। আর কতবার ও আমাকে ঘায়েল করবে। এবার তো ওকে কাছে পাওয়ার আগেই হার্ট ফেল করব। আমি বললাম, ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে না প্রেম করতে যাচ্ছে। সে আমাকে পাত্তা না দিল। আমি ওর সাথে তর্ক শুরু করলাম যে বাসার ভেতর যেতে দেবো না। এক পর্যায়ে ও আম্মুকে ডাকতে লাগলে আমি মুখ চেপে ধরলাম। দুষ্ট বউটা কামড়ে দিল! যদিও ওর রূপের মোহে ব্যাথা টের পাইনি। তাকিয়ে দেখি একেবারে দাগ দিয়ে ফেলেছে। আমি কিছু বলার আগেই ভেতরে চলে গেল। আমি দরজার আড়াল থেকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। ও খেয়াল করতেই সরে পড়লাম। একটু পরে আঙ্কেল এসে নিয়ে গেল।

পরদিন আম্মু গিয়ে ওকে দেখে আসল। বউটা আমার পড়ে একেবারে পায়ে হাড় নাড়িয়ে ফেলেছে। প্লাস্টার করতে হয়েছে। তারপরের কয়েকদিন আর দেখা পেলাম না। তাই একদিন আম্মুকে যেতে বললাম। আম্মু আরেকদিন দেখে এল। শুনলাম এখন ভালো আছে। পরেরদিনই প্লাস্টার খোলার সাথে সাথে আম্মুর থেকে চা বানানো শিখে গেল। আমি একবারও চাঁদ বদন মুখটা দেখার সুযোগ না।
কয়দিন পর বিকালে আমাকে দেখতে চাঁদনি, রেদোয়ান আর সৌরভ আসল বাসায়। আমার হালকা জ্বর হয়েছিল তাই। একটু পরে কলিং বেল বাজল। গিয়ে দেখি ছোঁয়া হাজির। ও মনে হয় আমাকে আঘাত করার জন্য ওর সৌন্দর্যের মিসাইল তাক করে থাকে। ও আমাকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। আম্মু জিজ্ঞেস করতেই বললাম গাজরের হালুয়া এসেছে। শুনেই মুখ বাঁকা করে চলে গেল রান্নাঘরে। আমি সোফায় এসে বসলাম। আম্মু নাস্তা দেওয়ার একটু পরে ও চা নিয়ে আসলো। বুঝলাম ও বানিয়েছে। চাটা মুখে নিতেই যেন বয়রা হয়ে গেলাম। গাজরের হালুয়ার মতো এখানেও লবন। ও উৎসুক হয়ে বলল, কেমন হয়েছে। আমি বললাম, খেয়ে দেখো। ছোঁয়া আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার হাতে কাপের পুরো চাটা খেয়ে নিল। তারপর সাথে সাথে দৌঁড়ে চলে গেল। আমি মনে মনে বললাম, খেলো কি করে চাটা?

আমার এইচএসসি পরীক্ষা চলে এল। আমি পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তাও প্রত্যেক শুক্রবার আমি ছাদে যেতাম। গিয়ে দরজা বেয়ে উপরে উঠে বসে থাকতাম। যাতে ছোঁয়া ছাদে আসলে আমি ওকে এক পলক দেখতে পাই। কিন্তু ও আমাকে দেখতে পাবে না। এভাবে শুক্রবারের অল্প কিছু সময় ওকে চোখের দেখা দেখতাম। ও এসে আমাকে খুঁজতো। আমি নেই দেখে আবার চলে যেত।
আমার প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার সময় আবার জ্বর এল। আমি পড়ছিলাম এমন সময় রান্নাঘরে ছোঁয়ার গলা পেলাম। তার আরও কিছুক্ষণ পরে ও একটা গ্লাস নিয়ে রুমে ঢুকল। আমি উঁকি মেরে দেখলাম নিমের রস৷ ও আমাকে খেতে বলল, আমি শর্ত দিলাম ওকে অর্ধেক খেতে হবে। প্রথমে মুখ বাঁকা করলেও পরে অর্ধেকটা খেয়ে নিয়ে আমাকে দিল। আমি বললাম ওর খাওয়া খাবো না। ও আরেকটা গ্লাস আনতে গেল। এই ফাঁকে আমি খেয়ে নিলাম বাকি অর্ধেকটা। কেন যেন নিমের রসটাও মিষ্টি লাগল। হয়ত ওর ঠোঁটের ছোঁয়া লেগেছে বলে।
খেয়েই শুয়ে পড়লাম বিছানায়। ও এসে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। তারপর খালি গ্লাস নিয়ে রাগ করে চলে গেল। আমি মুচকি হাসলাম। কিছুক্ষণ পরে ও আবার এল। আমি ঘুমানোর ভান করে পড়ে আছি। এমন সময় ও আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে গেল। ও চলে যেতেই আমি ছাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, আজকের দিনটা আমার বেস্টদিনের একটা হয়ে গেল তোমার ঐ আলতো ছোঁয়ায়।

পরীক্ষার শেষদিন। পরীক্ষা দিয়ে বের হতেই চাঁদনি বায়না ধরল মাঠে যেতে। বন্ধু বান্ধবরা ঘিরে ধরল। আমি জানতাম চাঁদনি আমাকে পছন্দ করে। সে দিন ও আমাকে প্রপোজ করে বসল। আমি ওর ফুলটা নিতেই সবাই ভাবল আমি একসেপ্ট করেছি। আমি ফুলটা নিয়ে বললাম, তুই এত কষ্ট করে ফুলটা এনেছিস তাই নিলাম। কিন্তু আমি তোকে ভালোবাসতে পারব না। আমি অন্য কাউকে সেই কবে মন দিয়ে বসে আছি। সরি রে। চাঁদনি হয়ত ব্যাপারটা জানত। তাই মুখ কালো করে রইল। হঠাৎ ভীড়ে দেখলাম ছোঁয়ার ফ্রেন্ড রিদি দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাছে গিয়ে বললাম, তুমি এখানে? ও বলল, ছোঁয়াও নাকি এসেছিল। কিন্তু এখন আর দেখছে না। বাসায় চলে গেছে হয়ত। আমি বুঝলাম ও আর্ধেক দেখেই চলে গেছে। হয়ত ভুল বুঝেছে আমায়।
' তুমি ঠিকই ধরেছিলে। সত্যিই আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম আকাশ। তাই আজ আমাদের মাঝে এত দূরত্ব।' আমি দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাইলাম। ঘড়িটা টিক টিক কইরা আগাই যাইতেসে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেইলা আবার ডায়রীটা খুলে পড়ার শুরু করলাম। আজ যে আমার সব রহস্যের জট খুলে যাইতেসে।
চলবে…
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেইলা আবার ডায়রীটা খুলে পড়ার শুরু করলাম। আজ যে আমার সব রহস্যের জট খুলে যাইতেসে।
(ডায়রী)
বাসায় এসে শুনলাম আমরা দেড় সপ্তাহের ভেতর লন্ডন চলে যাবো। সেই উপলক্ষে নাকি মিষ্টি দিয়ে এসেছে ছোঁয়াদের বাসায়। আমি ভাবতে লাগলাম, এতদিনে যতটুকু ধারণা, ওর মনে আমার জন্য একটা জায়গা তৈরী হয়েছে। এটা বেশ বুঝতে পারছি। এতকিছুর পর এই খবরটা পেয়ে ওর রিয়েকশান কি হতে পারে। পরদিন সকালে উঠে দেখি আব্বু লন্ডন থেকে চলে এসেছে। আব্বু এসেই বলল, আজকে ছোঁয়ার সাথে পরিচিত হয়ে আসবে। আমরাও গেলাম। আমরা সোফায় বসে আছি। আন্টি ছোঁয়াকে ডাকলেন। ও আসতেই আমার বুকটা ধক করে উঠল। একদিনে কি হাল হয়ে গেছে। শুকিয়ে গেছে একেবারে। ও এসে বসল। আমি তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ওর শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। এত ভালোবাসে আমায় যে কালকের ঘটনায় এত কষ্ট পেয়েছে! ও একটু কথা বলেই চলে গেল ভেতরে।
আব্বু আম্মু আন্টিদের সাথে কথা বলা শুরু করলেন। আব্বু বিয়ের প্রস্তাব দিতেই চমকে গেলাম আমি। এটা ভাবিইনি। আব্বু বললেন, বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে রাখছেন। ছোঁয়াকে ওনার পছন্দ হয়েছে কিন্তু যেহেতু ও এখনো ছোট তাই অন্তত আমি নিজের পায়ে দাঁড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। আন্টিরা হ্যাঁ না কিছু বললেন না। বললেন ভেবে দেখবেন। তারপরই বললেন, কালকে ছোঁয়ার জন্মদিন। আসতে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম।

ওকে জন্মদিনে কি দেওয়া যায় তা মাথার মাঝে ঘুরপাক খেতে লাগল সারা সকাল। দুপুরের দিকে বের হয়ে শপিংমলে গেলাম। অনেকগুলো দোকান ঘুরে একটা নীল শাড়ি খুব পছন্দ হলো। নিয়ে নিলাম ওটা। তারসাথে এক ডজন নীল কাচের চুড়ি আর এক জোড়া নুপুর নিলাম। বাসায় এসে একটা চিঠিসহ সুন্দর করে প্যাক করলাম। এমন সময় আন্টি এসে বললেন, ওনারা ছোঁয়ার নানা বাড়ি যাচ্ছেন। একটু দেখে রাখতে। আমি অপেক্ষায় রইলাম। ওনারা বের হওয়ার একটু পরেই বাক্সটা রেখে দরজা নক করে বাসায় চলে এলাম। দেখলাম ছোঁয়া বাক্সটা নিয়ে গেছে।
আমি এটুক পইড়া থ হই রইলাম। মুখ দিয়া কিসু বাইর হইতেসে না। আমি যা ভাবতেসি তাই! তাইলে তো…… আমি ঢোক গিইলা আবার পড়া শুরু করলাম।
(ডায়রী)

ওর নীল জামাটা টেইলারের কাছে দিয়ে এসেছিল। আমি ওর নাম করেই নিয়ে এসেছিলাম। ওই জামার কথা বলে ওকে রাত সাড়ে এগারটায় শাড়ি পরে রেডি হয়ে আসতে বললাম ছাদে। আমি এগারটায় গিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে লাভ শেইপ করে রাখলাম। তার ভেতর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে C + A লিখলাম। নুপুরের আওয়াজ শুনতেই লুকিয়ে পড়লাম। ছোঁয়া এল। এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগল। কাউকে দেখতে না পেয়ে যেই না চলে যাচ্ছিল আমি একটা কাপড় দিয়ে ওর চোখ বেঁধে দিলাম। ও ভয় পেয়ে কে কে বলে উঠল। আমি ওকে থামিয়ে টেনে নিয়ে এলাম ছাদের মাঝে। চাঁদের আলোয় ওকে দেখে আর নিজেকে আটকাতে পারলাম না। ওর দুই গালে দুটো কিস দিয়ে দিলাম। ও আবার ভয় পাওয়া গলায় বলল, কে? আমি ওর দুইহাত ধরে পেছনে মুড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেললাম। আমি নিজের পরিচয় গোপন করে ওর কানে কানে বললাম, আমি লাভার ভ্যাম্পায়ার। তারপরই আমার ছোঁয়ার নেশায় ধরে গেল। আমি ওর গলায় একটা কিস করলাম। সাথে সাথে ও কেঁপে উঠল। সেই কাঁপুনি যেন আমাকে আরো পাগল করে দিল। তারপর আমার কি হল জানি না। ওর নেশায় ডুবে গেলাম। আমি ওর মুখ চেপে ধরে একটা লাভ বাইট দিয়ে দিলাম। ইচ্ছে মতো ওর গলায় ঘাড়ে কিস করতে লাগলাম। তারপর ওর কানে ফিসফিস করে বললাম, লাভ বাইট দিয়ে সিল মেরে দিলাম। আজ থেকে ও শুধু আমার। এমন সময় হাত ঘরিটা বারোটার জানান দিল। আমি সবার আগে ওকে বার্থডে উইশ করলাম। একসময় ওর ঠোঁটের দিকে নজর পড়ল। ওর লাল ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। এগিয়ে গেলাম সেই নেশা ধরানো ঠোঁটের দিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে ছেড়ে দিলাম ওকে। চলে এলাম বাসায়। দরজায় উঁকি মেরে দেখলাম একটু পরে ছোঁয়াও বাসায় চলে এল।
আমি ঘাড়ে হাত দিয়া দাঁত কিড়মিড় কইরা ডায়রীর দিকে তাকাইলাম। আমার মগজে আগুন জ্বলতেসে। তাহলে আমি ঠিকই ধরসি। লাভার ভ্যাম্পায়ারই হলো আকাশ। পরিচয় লুকিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ রাখসে। ঐদিন কামড়ে আমার ঘাড়ের অবস্থা বারোটা বাজাই দিসে। আমি কত্ত ভয় পাইসিলাম। সবাই আমারে প্রশ্ন করে করে অস্থির বানাই ফেলসিলো। আমি যে এমন একটা ফাজিলের প্রেমে পড়সিলাম বুঝতে পারি নাই। এমনিতে দেখতাম সাধু বিড়াল হই ঘুরতো। দাঁড়াও, বিয়েটা হতে দাও। বুঝাই দিবো কত ধানে কত চাল।
ঘড়ির দিকে তাকাই দেখলাম আধা ঘন্টা হয়ে গেসে। আর পড়ার দরকার নাই। একসাথে অনেক ডোজ পেটে পড়সে। তাতেই ব্লাস্ট হই যাইতেসে। বাকিটা পড়লে ফাইটা পড়মু। আমি ডায়রীটা নিয়া আকাশের রুমে এসে দেখি চাঁদনি ওর পাশে বসে আছে। আমার মগজ একটু পরে রাগে গইলা যাইবো। আমি নিজেকে শান্ত করে বলল, আরে চাঁদনি আপু, কেমন আছো?
- তুমি এখানে?
- আরে আন্টি তো তোমাকে নিচে ডাকছে কি জন্য যেন।
- আমি তো এইমাত্র নিচ থেকে আসলাম।
- আমি কি করে বলব। যাও গিয়ে দেখো।
আমি ওরে ঠেলে উঠাই দরজার কাছে নিয়া গেলাম। সে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি বললাম, আরে আগে দেখো আন্টি কি বলেন। ততক্ষণে গাজর বউ তার চেরি বরের কাছে থাকুক। সে বলল, মানে? আমি আমার বহুমূল্যবান মুলা দাঁত দেখাইয়া দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। আপদ বিদায় করলাম। আমি ডায়রীটা আগের জায়গায় রেখে চেরির কাছে এসে বসলাম। ব্যাটা এখনো ঘুমাচ্ছে। ইস্, ঘুমালে কি নিঃস্পাপ লাগে। ভেতরে তো ফাজিলের হাড্ডি। ঘুমাচ্ছে দেখে কপালে একটা চুমু দিয়ে দিলাম। মাথা তুলতেই দেখে ও আমার দিকে পিটপিট করে তাকাই আছে। তারমানে ও জাইগা ছিল! লজ্জায় কিছু বলতেও পারতেসি না। উঠে চইলা যাচ্ছিলাম সে আমার হাত ধরে টান মারল। আমি তাল সামলাতে না পাইরা ওর বুকের উপর পইড়া গেলাম। সে আমাকে জাপটে ধইরা বলল, একটু আগেই তো বললে গাজর বউ চেরি বরের কাছে থাকবে। তাহলে যাচ্ছো কোথায়?
- ছাড়ুন আমাকে।
- আমার ডায়রী পড়ে তো সব জেনেই নিয়েছো। তাই আজ থেকে নো ছাড়াছাড়ি।
- ইস্… ভ্যাম্পায়ারই একটা। কামড়ে আমার ঘাড়ের অবস্থা বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
- তুমি চাইলে আবার করতে পারি।
- পাগল নাকি! ছাড়ুন না হলে আমি কিন্তু কামড়ে দেবো।
- দাও না। এই ছয় বছর তো তার অপেক্ষাতেই আছি। কবে তুমি নিজ থেকে আমার কাছে আসবে।
- হুহ্।
বাইরে চাঁদনি এসে দরজায় ধাম ধাম বাড়ি মারতে লাগল। আকাশ বিরক্ত হয়ে বলল, এই মেয়ের কাণ্ডজ্ঞান নেই। কোথায় শান্তিতে রোমান্স করছি তা না আমার রোমান্সের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। আমি জোর কইরা উইঠা যাইতেছিলাম। সে আমার দুই গাল ধরে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, আমি আর ওয়েট করতে পারছি না। এই সপ্তাহতেই তোমাকে নিজের কাছে আনার ব্যবস্থা করছি। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে দৌঁড়ে দরজা খুইলা বেরিয়ে গেলাম। চাঁদনি ঢুকে বলল, কি করছিলি রে তোরা দুইটা মিলে?
- রোমান্স করছিলাম। চাঁদনি তোকে তো আমি আগেই বলেছি আমি ছোঁয়াকে ভালোবাসি। কেন তাও বার বার ফিরে আসিস?
চাঁদনি কিছু বলল না। চইলা গেল রুম থেকে। আকাশ আরাম কইরা আবার বিছানায় শুইয়া পড়ল। তার মাথায় এখন কতকিছু ঘুরতেসে। বিয়ে, রোমান্স, বাচ্চা কাচ্চা।
আমি বাড়িতে এসে রুমে গিয়া বিছানায় লাফাই পড়লাম। একটু পর পর মুচকি মুচকি হাসতেসি আর লজ্জায় বালিশে মুখ ঢুবাইতেসি। মুন এসে বলল, কি রে, আকাশ ভাই কেমন আছে?
- ভালো। সামান্য চোট পেয়েছে।
- ও। দেখতো এই শাড়িগুলো কেমন লাগে।
আমি অবাক হইয়া বললাম, শাড়ি কবে কিনলি? মুন বলল, গতকালকেই আকাশ ভাই রেদোয়ানকে দিয়ে পাঠিয়েছিল। তোকে দেখাইনি। আমি কইলাম, আমি তো বলিনি আমি বিয়েতে রাজি। মুন বলল, সেটা আমিও বলেছি। আকাশ ভাই বলেছে তুই নাকি রাজি হয়ে যাবি। তোকে নিয়ে নাকি টেনশান নেই। তাই বিয়ের কাজগুলো সেরে ফেলতে বলেছে। এর মধ্যে কার্ডও ছাপানো হয়ে গেছে। আমি মনে মনে বললাম, বলবেই তো। আমি কি আর জানতাম নাকি যে দুইজনকে নিয়ে টানা পড়েনে পড়েছিলাম। তারা আসলে একজন। মুন আমাকে শাড়ি গয়না দেখাতে লাগল। যাওয়ার আগে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর না শ্বশুর বাড়ি যাওয়র কথা। ও বলল, এই শুক্রবার তোর বিয়ে তাই রয়ে গেলাম।
.
.
.
.
আমি বউ সাইজা বসে আছি বাসরঘরে। শেষ পর্যন্ত ক্রাশের সাথেই আমার বিয়াটা হয়েই গেল! আমাকে একটা ফ্ল্যাটে আনা হইসে এবং আমি এই ফ্ল্যাটটাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। এটা সেই ফ্ল্যাট যেখানে আমি আব্বা আম্মার হাত ধরে হাঁটতে শিখসি, যেখানে প্রথম আমি চেরি ফলকে দেইখা ক্রাশ খাইসি আর যেখান থেকে আমি আমার আব্বা আম্মারে চির বিদায় দিসি। হ্যাঁ, আমি এখন আমাদের ছয় বছর আগের ফ্ল্যাটে আমার রুমে বইসা আছি। আমি জানতাম না আকাশ এই ফ্ল্যাটটা কিনসে। চারদিকে তাকাই বুঝতে পারলাম এখানের একটা জিনিসও নাড়ানো হয় নাই। ছয় বছর আগে যেমন ছিল তেমনই আছে সব। কিন্তু কিছু জিনিস তো খালু নিয়া গেসিলো। তাহলে এগুলা আসল কেমনে? আমি পড়ার টেবিলটার কাছে গেলাম। হঠাৎ একটা জিনিস চোখে পড়ল। আগে পাগলামি কইরা টেবিলের একপাশে ছোট্ট কইরা লিখসিলাম ক্রাশ + ছোঁয়া। ওটা এখনো আছে। তার মানে খালু একই দেখতে জিনিস কিনে নিয়া গেসিলো ঐ বাড়িতে। এই ফ্ল্যাটের একটা জিনিসও নাড়ানো হয় নাই। সব আগের মতো যত্ন কইরা রাখা হইসে! এতো ভালোবাসে আকাশ আমারে!
কিন্তু আমি তো আমার শোধ নিয়া ছাড়মু। এই ছয়টা বছর আমি ওর থেকে আলাদা থাইকা কত কষ্ট পাইসি। সেটা কেবল আমি জানি। আমি ভারি শাড়ি আর গয়না খুইলা একটা থ্রিপিস পইরা সাহেবাদের মতো বিছানায় বইসা আছি। একটু পরে আকাশ রুমে ঢুইকা আমারে এভাবে দেইখা থতমত খাইল। হয়ত ভাবছিল আমি শাড়ি গয়না পইরা লজ্জাবতী লতার মতো বইসা থাকবো বিছানায়। ওটি হইতেসে না। আমি গম্ভীর কন্ঠে কইলাম, দরজা মারো। ও বাধ্য ছেলের মতো দরজা মাইরা আমার কাছে এসে বসতেই বললাম, খবরদার, একদম কাছে আসবে না। ও অবাক হয়ে বলল, কেন? আমি মনে মনে কইলাম, তুমি কাছে আসলে যে তোমার সুগন্ধে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না। মুখে বললাম, আজকে থেকে ছয় বছর পর তুমি আমার কাছে আসবা। ও মুখ গোমড়া করে বলল, কেন? আমি বললাম, এই ছয় বছরের শোধ নিবো। আমি কত কষ্ট পাইসি জানো? আকাশ চিনা হাসি দিয়া বলল, সব ফেরত নিবা বুঝি?
- হুম। সুদে আসলে ফেরত নিবো।
চলবে……
#পর্ব_২৯ (শেষ পর্ব)
আকাশ চিনা হাসি দিয়া বলল, সব ফেরত নিবা বুঝি?
- হুম। সুদে আসলে ফেরত নিবো।
সে দাঁত কেলাই বলল, তাহলে আমার কিসগুলা ফেরত দাও। যদি পরিমানে কম পড়ে আমি বলে দেবো। আমি শুইনাই লজ্জায় মিইশা গেলাম। 'তুমি তুমি …', কি কইতাম? প্রতি উত্তরে দেওয়ার মতো কিছু রাখল না। একটু পরে সে চোখ নাচাইয়া বলল, এমন জানলে ঐদিন তোমাকে কিস করেই ফেলতাম। তাহলে আজকে সুদে আসলে অন্তত সেই কিসটার বদলে দুই তিনটা ফেরত পাইতাম প্রতিশোধ হিসেবে।
আমি মাথা নিচু কইরা রইলাম। সে আবার আগাইতেই আমি কইলাম, যা বলসি তা শুনবা। চুপচাপ সোফায় গিয়ে শোও। নাইলে আমি আব্বুকে এখানে পাঠিয়ে আম্মুর কাছে চলে যাবো। ও মুখ কালো করে সোফায় চলে গেল। আমি মুচকি হাইসা শুয়ে পড়লাম বিছানায়। ওকে পাহারা দিতে দিতে কখন যে নিজেই ঘুমাই পড়সি বলতে পারবো না।
.
.
.
.
সকালে ঘুম ভাঙতেই বুকে ভারি কিছু অনুভব করলাম। দেখি চেরি আমার বুকে মাথা রাইখা ঘুমাইতেসে। আরে? আমি কি কোলবালিশ নাকি! সবাই আমারে কোলবালিশ বানায় ক্যান? আমি নড়তেই আকাশ আমার দিকে তাকাইলো। আমি চোখ গরম কইরা তাকাই রইলাম। যখন দেখি তখনই সে জাইগা থাকে। তাইলে ঘুমায়টা কখন? ও পাত্তা না দিয়া আবার আমার বুকে মাথা গুঁজে দিয়া বলল, কি ভাবছো, তুমি বললেই এত সহজে তোমাকে আমি ছেড়ে দেবো। মোটেই না। এই ছয় বছর অনেক অপেক্ষা করেছি। এখন সব উশুল করে তবে তোমার ছুটি।
আমার জামাটা পেটের কাছ থেকে সইরা গেসিলো। ও ওখানে আঙুল নাড়িয়ে বাচ্চাদের মতো খেলতে লাগল। আমার তো সেই রকম কাতুকুতু লাগতেসে। তার উপর ওর ছোঁয়ায় আমার অবস্থা টাইট। ও আমাকে এমন ভাবে জাপটে ধরে আছে না পারতেসি নড়াচড়া করতে না পারতেসি স্থির থাকতে। এমন সময় আম্মু এসে বাঁচাই দিল। দরজায় নক করে বলল, আকাশ উঠেছিস? ছোঁয়াকে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। সবাই নাস্তার জন্য ওয়েট করছে। আকাশ অনিচ্ছার সত্ত্বেও আমাকে ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হইতে চইলা গেল। আমি হাফ ছাইড়া বাঁচলাম। তবে ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে যে লুক দিল, আমারে কাছে পাইলেই খবর আছে। আমি ঢোক গিললাম।
সারাটা দিন চইলা গেল ব্যস্ততায়। ওদের গুষ্টিতে এত লোক! একের পর এক আমারে দর্শনীয় বস্তুর মতো দেখে যাইতেসে। আমি ভারি কাপড় গয়না পরে থাকতে থাকতে টায়ার্ড। রাতের দিকে পরিবেশটা হালকা হইল। অনেকে আকাশদের বাড়িতে চইলা গেল। আমরা ফ্ল্যাটটে রয়ে গেলাম। আজকে আমি রাতের খাবারে গাজরের হালুয়া তৈরী করলাম। সবাই সেই রকম প্রসংশা করল। ডিনার শেষ করে আমি আম্মুর কাছে গিয়া বললাম, আম্মু, কালকে থেকে তুমি আমাকে রান্নার ট্রেনিং দিবে। আম্মু হাসলেন। আমি আম্মুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। আম্মু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমি বললাম, আজকে না আমার আম্মুর কথা খুব মনে পড়ছে। আমাকে এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো কোলে শুলে।
- আমিও তো তোর আম্মু। তাই না?
- হুম। তুমি আমার আরেকটা বেস্ট আম্মু।
- হয়েছে, আর পাম দিতে হবে না। যা রুমে যা। না হলে ছেলে আমার তোকে না দেখে পাগল হয়ে যাবে।
- হোক। জানো আম্মু এতদিন ও আমাকে ফোন করে করে পাগল করে ফেলেছিল। এখন ও হোক পাগল। পাগল হলে ওকে ঘরে বেঁধে রেখে আমি আর তুমি একসাথে সারাদিন গল্প করব।
আমি একটা আচারের বয়াম আইনা আম্মুর সাথে গল্প করার শুরু করলাম। আমি জিগাইলাম, আচ্ছা, আম্মু, আপনাদের বাড়ি থাকতে এই ফ্ল্যাটে কেন আনা হল আমাকে? আম্মু হেসে বললেন, আমার পাগল ছেলেটা চাইছিল তোমার নতুন জীবনটা তোমার বাবা মায়ের ছোঁয়ায় শুরু হোক। তাই বৌভাতটা এখানে করতে চাইছিল। আমি মনে মনে বললাম, তোমাকে পেয়ে আমি ধন্য আমার চেরি ফল। হয়ত মিথ্যা রাগ দেখিয়ে তোমাকে দূরে রেখেছি। কিন্তু আমি জানি আমি বেশিদিন পারবো না এই দূরত্ব রাখতে। বড্ড ভালোবাসি যে তোমায়। বড্ড বেশি। আমরা দুইজনে আচার খাইতেসি আর জমিয়ে গল্প করতেসি। এর মাঝে আকাশ দুইবার দরজার সামনে চরকি কাইটা গেল। আম্মু একটু পরে হেসে বললেন, যা না মা। ছেলেটা এই নিয়ে দুইবার দেখে গেল।
- না, আম্মু ওর শাস্তি চলছে। ছয় বছরের শাস্তি। আজকে আমি তোমার কাছেই ঘুমাবো। আব্বুকে বলো ওর কাছে যেতে।
আম্মু আমার কোনো কথা শুনলেন না। জোর কইরা আমাকে পাঠাই দিলেন। আমি মুখ কালো করে রুমে ডুকে দেখি ও রুমে নাই। কই গেসে কে জানে। মধ্যরাতের দিকে হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় শুরু হল। সেই রকমের বৃষ্টি হইতেসে। সাথে বিদ্যুৎ চমকাইতেসে। আমি জানালার কাছে গিয়া দাঁড়াই বৃষ্টি দেখতেসি। বৃষ্টি হালকা ছিটা গায়ে পড়তেসে। এটা আমার ভালো লাগে। এমন সময় আকাশ এসে পাশে দাঁড়াইলো। আমি বাইরে তাকাই আছি। সে কইল, জানালা বন্ধ করে দাও।
- কেন?
- বিদ্যুত চমকাচ্ছে তো।
আমি ভ্রূ কুঁচকায় কইলাম, ভয় করছে নাকি তোমার? সে বিদ্রুপ করে বলল, আমি আবার ভয় পাই নাকি? তবে আমার আদরের বউটা যদি ভয় পায়। তাই……
- ঢঙ।
হঠাৎ খুব জোরে ঠাডা পড়ল। আমি চমকায় উঠলাম। আকাশ মনে করছিল ওরে জড়াই ধরমু। কিন্তু ছোটবেলা থেকে অভ্যাস আছে। যখনই এমন বিদ্যুত চমকাইতো আম্মা আব্বার মাঝে শুয়ে চোখ বন্ধ কইরা শব্দ শোনার জন্য অপেক্ষা করতাম। তাই চোখ বন্ধ কইরা রইলাম। তাকাতেই দেখলাম সে মুখ কালো কইরা আমার দিকে তাকাই আছে। আমি জিগাইলাম, কি হইসে? ও একইভাবে বলল, তুমি সত্যিই ভয় পাও না। আমি আবার বাইরে তাকাই বললাম, না। বেচারা মনে হয় দুঃখ পাইল। তারপর হঠাৎ আমার সামনে বসে আমার পায়ের পাতা ওর নিজের পায়ের উপর রাখল। তারপর একজোড়া নুপুর পরিয়ে দিল। আমি চিনতে পারলাম নুপুর জোড়া। এই নুপুর জোড়া ও আমাকে ছয় বছর আগে বার্থডে গিফট হিসেবে দিয়েছিল।
আমি পা নামিয়ে বললাম, জানালাটা মেরে দাও। আমি যাই। ও খুশিতে গদগদ হয়ে জানালা মেরে দিল। কারেন্ট নাই। ঝড় শুরুর একটু আগেই চইলা গেসে। রুমের দরজাও বন্ধ। পুরা রুম অন্ধকার। বাইরে থেকে যা আলো আসতেসে ওটাতেই সব আবছা দেখা যাইতেসে। আমি মোবাইলটা মাত্র হাতে নিসি লাইট জ্বালানোর জন্য, আকাশ আমাকে পিছন থেকে জড়াই ধরল। আমি কাঁইপা উঠলাম। আমি কইলাম, ছাড়ো বলতেসি। নইলে কামড়াই দিমু। সে আমাকে আরো চাইপা ধইরা কইল, দাও, সমস্যা নাই। কিন্তু আজকে তোমাকে ছাড়ছি না। কি রোমান্টিক একটা ওয়েদার।
- তোমার রোমান্টিকের খ্যাঁতা পুড়ি। তোমার রোমান্সের জ্বালায় ছয়টা বছর একটু শান্তি পাই নাই।
- সে তুমি যাই বলো। আজকে নো ছাড়া ছাড়ি।
ও আমার কোমর জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলল, এখন থেকে তুমি এই নুপুর জোড়া পরে থাকবে। আমি সব সময় তোমার উপস্থিতি টের পেতে চাই, ছোঁয়া। ভালোবাসি ছোঁয়া। আমার থেকেও বেশি। একবার বলো না ভালোবাসি। আমার সুড়সুড়ি লাগতেসে। আমি না নিজেকে ছাড়তে পারতেসি না সে ছাড়তেসে। আমারে আষ্টেপৃষ্টে জড়াই ধরসে। দাঁড়াও, এত ভালোবাসার পরেও তোমার মাফ নাই। ছয় বছরের হিসাব যদি সব সুদে আসলে মিটাই না নিসি তবে আমিও চেরির বউ না। অজান্তে আমার মুখ থেকেই বাইর হয়ে এল, ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি…
.
.
.
.
সাত বছর পর……
পাঁচ বছরের পর্ষী আমাদের রুমে দৌঁড়াই এসে বলল, আম্মু জানো।
- কি?
- পাশের বাসায় না নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে।
আমি নিজের রুমে কাপড় গোছাইতেছিলাম। কাজের সময় এত বকর বকর ভালো লাগে না। কিন্তু কি করা। একটামাত্র আদরের মাইয়া। আমি কইলাম, পুরান ভারাটিয়া গেলে তো নতুন ভারাটিয়া আসবে।
- জানো ওখানে একটা ছেলে আছে।
আমি ভ্রূ কুঁচকায় কইলাম, তো কি হইসে?
- কি কিউট!!!!! মুখগুলা লাল লাল।
আমি ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠলাম। রাগার ভান কইরা কইলাম, খবরদার, একদম ওর সাথে মিশবা না। ওর কাছে যাবা। মেয়ে আমার মন খারাপ কইরা চইলা গেল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মেয়ে দেখি আমার পথে হাঁটা ধরতেসে। আমি ওর বাপরে ভালোবাইসা পুরা জীবন বহুত জ্বলসি। এখনো জ্বালায়। আমার মাইয়ারে আর জ্বলতে দিমু না। আমি কাপড় চোপড় গুছাই আলমারিতে রাইখা বারান্দায় আইসা দাঁড়াইলাম। যদিও জ্বালায় অনেক তবুও ভালোবাসার মানুষটারে তো কাছে পাইসি। এটাই বা কম কিসের। সবার কপালে তো তাও জোটে না।
এমন সময় আকাশ আসল। সে দেখল আমি গলার চেইনে ঝুলানো ওর বোতামটা ধরে বারান্দায় দাঁড়াই আছি। ও পাশে দাঁড়াই বলল, কি ভাবছো?
- পুরান কথা মনে পড়ছে।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কইল, আমারও মনে পড়ছে। ঐ সময় এই বোতামটাকে যত আদর করেছো এই সাত বছরে মনে হয় আমারেও তত আদর করো নাই।
আমি ভেংচি কেটে কইলাম, এ্যাঁহ্, ভালোবাসা উপচাই পড়তেসে। বেশি করলে একেবারে উগান্ডায় পাঠাই দিমু। সে হঠাৎ আমারে পেছন থেকে জড়াই ধরে বলল, ওলে আমার দুষ্টু বউটা লে।
- আরে কি করছো, ছাড়ো, পর্ষী চলে আসবে।
হঠাৎ সামনে তাকাই দেখি পর্ষী বড় বড় চোখ করে আমাদের দিকে তাকাই আছে। আমি আকাশকে ঠেইলা সরাই দিলাম। মেয়ে দৌঁড়ে চইলা গেল। আমি আকাশের দিকে রাইগা তাকাইলাম। সে আমার দিকে একটা বোকা হাসি দিল। কিন্তু মেয়ে ছুটে কোনদিকে গেল? গিয়া দেখলাম ও ছাদে গেছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে দেখতেসি মেয়ে প্রত্যেক শুক্রবার ছাদে যাওয়ার জন্য বায়না করে। আমি মানা কইরা দেই। এত ছোট মেয়ে একলা ছাদে যাওয়া বিপদ। আমি সারাদিন কাজ করি। ঘর গুছাইতে গুছাইতে দিন চলে যায়, তাই সময় পাই না। আকাশও সারাদিন কাজ করে এসে ক্লান্ত থাকে। আজকে মেয়ে নিজে নিজে চইলা গেল। আমরাও পিছু পিছু গিয়া ছাদে উপস্থিত। গিয়া দুইজনে বেকুবের মতে দাঁড়াই আছি। পর্ষী ওর থেকে বড়ো একটা পিচ্চি পোলারে পেছন থেকে শক্ত করে জড়াই ধরে আছে। ছেলেটা নিজেকে ছাড়াইতে পারতেসে না। আমি ডাক দিলাম, পর্ষী। আমার ডাকে ওকে ছাইড়া দিল পর্ষী। ছেলে দৌঁড়ে মায়ের কাছে চইলা গেল। ছেলের মা আরেকজনের সাথে গল্প করতেসে। এত খেয়াল নাই। আমি পর্ষীর কাছে গিয়া হাঁটু গেড়ে কইলাম, তুমি ওকে জড়াই ধরসো কেন?
- আব্বুও তো তোমাকে জড়াই ধরসে।
আমি পেছন ফিরে রাগী চোখে আকাশের দিকে তাকাইলাম। আকাশ দাঁত কেলাই হাসতেসে। আমি আবার পর্ষীর দিকে তাকাই বললাম, তোমার আব্বু আর ঐ ছেলে কি এক?
- হুম। আব্বু তোমাকে ভালোবাসে আর আমি ঐ ছেলেকে ভালোবাসি।
উত্তর শুনে আমি ভ্যাবাচেকা খাইলাম। আকাশ উদাস উদাস ভাব কইরা বলল, তোমার মেয়ে বলে কথা। আমি মুখ বাঁকা করে বললাম, শুধু আমার না। আমাদের দুইজনেরই মেয়ে। মনে মনে কইলাম, তবে আমাদের আপগ্রেডেট ভার্সান।
...........................................সমাপ্তি 
