গল্প— #জলতরঙ্গ পর্ব:-০১
লেখক—moyej uddin
তেরো দিনের ছোট বাচ্চাসহ পাত্রীকে বিয়ে করতে এসেছে কবির। হবু বউ একবার কোলের বাচ্চাকে শান্ত করছে, আরেকবার পাত্রপক্ষের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। এর চেয়ে অদ্ভুত দৃশ্য বোধহয় কবির এর আগে কখনো দেখেনি। ছোটমামা দেখেশুনেও এমন পাত্রী দেখাতে নিয়ে আসবে, তা কখনো কল্পনাও করেনি সে।
কথায় কথায় জানতে পারে-বিয়ের পাত্রীর নাম সুনেরাহ। প্রায় পাঁচমাস আগে সুনেরাহ প্রেগন্যান্ট থাকাকালীন তার প্রাক্তণ স্বামী অনিক দূর্ঘটনায় মারা গেছে। সেই থেকেই বাবার বাড়িতে আছে সে। কবীর কী প্রশ্ন করবে-সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। এমনকি এবাড়িতে আসার পর যখন জানতে পেরেছে, সুনেরাহ'র তেরোদিনের ছোট একটা মেয়ে বাচ্চাও আছে,সেই থেকে সে যেন একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে।
প্রায় মিনিট চারেক কেটে যাবার পর সে একরকম বিরক্তি আর সঙ্কোচে সুনেরাহ'র দিকে তাকালো। সদ্য মা হওয়া এক নারীকে যেন মনে হচ্ছে প্রস্ফুটিত পদ্ম। কয়েক সেকেন্ড সে তো দৃষ্টিই ফেরাতে পারলো না। সুনেরাহ'র হয়তো ঠিক এমনই সুন্দর হয়ে থাকার উচিত জন্ম জন্মান্তর ধরে। কবিরের মা রাফিয়া রহমান পাশ থেকে ছেলেকে সামান্য ধাক্কা দিয়ে বললেন,
—তুই কী সুনেরাহ'র সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাস? অবশ্য সেটাই উচিত। অফিস থেকে এভাবে জোর করে ধরে নিয়ে চলে এসেছি।
কবির জবাব দিতে যাবে, কিন্তু তার আগেই সুনেরাহ হঠাৎ বলে উঠলো,
—তার আর দরকার নেই। কারণ আমি এই বিয়েটা করছি না। আমার মেয়ের বয়স মাত্র তেরোদিন। ডেলিভারির ঘা শুকোয়নি আজও। আর এরমধ্যে আমি বিয়ে করবো? অসম্ভব। রাগিব ভাইয়া, এইসব পাগলামির মানে কী বলো তো? আমি তো তোমাকে একবারও বলিনি যে,আমার মেয়ের জন্য দ্বিতীয় বাবা এনে দাও। তাহলে হঠাৎ এই বিব্রতকর পরিস্থিতি কেন?
সুনেরাহ তার ভাইয়ের দিকে বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু এতে যেন রাগিবের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে বোনের দিকে শান্তভঙ্গিতে চেয়ে কিছু একটা ইশারা করে। সুনেরাহ ব্যাপারটা কোনোভাবেই ধরতে পারে না। বছর দেড় হলো তার মা মারা গেছে। বাবা মারা গেছেন আরও আগে। বর্তমানে শশুরবাড়ি ছেড়ে এই রাগিবের বাড়িটাই তার শেষ সম্বল। যদিও বাপের বাড়ির সম্পত্তিতে তার যথেষ্ট অংশীদারিত্ব রয়েছে। তবে রাগিবের হাবভাব খুব একটা সুবিধের লাগে না। বিধবা বোনকে কোনোরকমে তাড়াতে পারলেই বাঁচে সে।
রাগিবের টনক না নড়লেও কবিরের কাছে সুনেরাহ'র কথাগুলো ভীষণ ভালো লাগলো। তার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে সাথে সাথে এই সুযোগটা লুফে নেবার চেষ্টা করতো—এ ব্যাপারটা শতভাগ নিশ্চয়তার সাথেই বলা যায়। কিন্তু সে এর ধারেকাছেও নেই! কতটা আত্মসম্মানী হলে কোনো মেয়ে এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও নিজের কাঠিন্য ধরে রাখতে পারে, সেটাই বড় প্রশ্ন। সে রাগিবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—মিস সুনেরাহ যদি রাজি থাকেন, তবে এই বিয়েটা করতে আমার বিশেষ কোনো আপত্তি নেই। আমি উনার সঙ্গে জীবন সাজাতে রাজি।
কবিরের কথায় সুনেরাহ যেন হতভম্ব হয়ে গেল। একজন অবিবাহিত ছেলে তার মত বিধবা এক বাচ্চার মাকে এত সহজে বিয়ে করতে রাজি হবে,সে ভাবনাতেও আনতে পারেনি। তাছাড়া ঘরে ঢোকার সময় পাত্রীর অবস্থা শুনে কবিরের মুখের প্রকাশভঙ্গী তার দৃষ্টি এড়ায়নি। সে তখনই টের পেয়েছিল-এই মানুষটা তার প্রতি আগ্রহী হবে না। কিন্তু হঠাৎ করেই দাবার গুটি এমন তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারে, ব্যাপারটা সে ঠিক বুঝতে পারে না। সে নির্বাক হয়ে কবিরের চোখের দিকে চেয়ে থাকে। কবির আবার বললো,
—আমি সিরিয়াস। সুনেরাহ,আপনার সাথে আলাদাভাবে কথা বলা যাবে?
সুনেরাহ একবার ভাইয়ের দিকে তাকালো। এই মুহুর্তে কী বলা উচিত আর কী করা উচিত-সে জানে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে অজান্তেই মাথা নেড়ে সায় দিলো। এরপর ছোট মেয়েটাকে কোলে নিয়ে সোজা উঠে গেল নিজের ঘরের দিকে। কবিরও তার পিছু নিলো।
ঘরে ঢুকে কবির খেয়াল করে দেখে, ঘর জুড়ে অন্য একটি পুরুষের স্মৃতি লেপ্টে আছে। অগণিত ছবি, একটি কফি রঙের ব্লেজার ঝুলছে দেওয়ালে। একপাশে সুনেরাহ'র সাথে ভদ্রলোকের বেশ ঘনিষ্ঠ ছবি দেখে তার আর বুঝতে বাকি রইলো না,এটা আসলেই সুনেরাহ'র প্রাক্তণ স্বামী।
-আপনার স্বামীকে আপনি প্রচন্ড ভালোবাসতেন। তাই না?
-হুম, তা বাসতাম বৈ কী।
-ভদ্রলোকের নাম কী ছিল, বলা যাবে?
-অনিক মুস্তাফিজ। পেশায় একজন ইভেন্ট প্ল্যানার ছিল সে। লাভ ম্যারেজ। দীর্ঘ তিন বছর সংসার করেছি ওর সাথে।
কবির একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভালোবেসে মানুষ বেঁচে যায় শুনেছে। কিন্তু এইভাবেও একটা মানুষ, একটা নারী ম'রে যায়-তা সুনেরাহ'কে দেখে সে খুব করে অনুভব করতে পারছে। সে সুনেরাহ'কে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবে, তার আগেই ছোট বাচ্চাটি হঠাৎ কেঁদে উঠলো। সুনেরাহ প্রাণপণে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বাচ্চার কান্না কোনোভাবেই থামে না। কবিরও বেশ উতলা হয়ে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-ওকে একটু আলগা করে ধরুন। একটু দুপাশে ঘুরিয়ে আদর করে দেখুন তো।
সুনেরাহ কিছুটা অবাক হলেও কবিরের কথামতো বাচ্চাকে সেভাবে ধরলো। আর অদ্ভুতভাবে মেয়েটাও কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যায়। সুনেরাহ এক আকাশ সমান কৃতজ্ঞতা নিয়ে কবিরের দিকে ফিরে তাকালো।
-আপনি কীভাবে বুঝলেন, ওকে এভাবে ধরলে চুপ করে যাবে?
-কেন জানি না, তবে আমার মনে হলো। অনেক আগে আমার ভাইয়ের বউকে মানে চাচাতো ভাবিকে দেখেছিলাম। সেটাই হঠাৎ খেয়ালে এলো। আচ্ছা, আপনার বাবুর নামটা কী?
—অনুদিতি।
—কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করবো?
—আমি জানি, আপনি কী প্রশ্ন করবেন। ডেলিভারির মাত্র তেরো-চৌদ্দ দিনের মাথায় কেন আমার বিয়ে দিতে আমার ভাই এতটা উতলা হয়ে গেছে,সেটাই তো জানতে চান। তাই তো? এ প্রশ্নের উত্তর আমারও জানা নেই। তবে আমার ধারণা, হয়তো আমি এবং আমার মেয়ে তার কাছে বোঝা হয়ে গেছি। নিজের ঘাড় থেকে বোঝা নামাতে পারলে সে হাফ ছেড়ে বাঁঁচবে। বাবা-মা দুজনই মারা যাবার পর একটা মেয়ে তার স্বামীকে নিয়ে একটু স্বস্তি খোঁজে। কিন্তু আমার পোড়া কপালে আমি সেটাও হারিয়েছি। এখন এই অনুদিতিই আমার জীবনের একমাত্র ভরসা।
কবিরের ভীষণ বলতে ইচ্ছে করছে,"আমিও আজ থেকে আপনার শেষ ভরসা হতে চাই"। কিন্তু সে দুঃসাহসে আর জোর পায় না। অচেনা নারীর কাছে নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে মুখ ফুটে বলার আর সাহস পেল না সে। মেয়েদের সম্পর্কে তার বাহ্যিক কিংবা অভ্যন্তরীণ দুইদিক থেকেই জ্ঞান একেবারে শূন্যের কোটায়। সেই জ্ঞান থেকে বলতে গেলে বরং হিতে বিপরীত হয়ে অনাস্থা ঘটে যাবে।
কবির জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখলো। বেশ আয়োজন করেই বর্ষার সন্ধ্যে নেমে আসছে। আকাশ জুড়ে মেঘেদের লুকোচুরি। মনে হচ্ছে এক্ষুণি বৃষ্টি নামবে। কবিরের কেমন যেন সংশয় হতে লাগলো। সে কিছুটা আমতা আমতা করে বললো,
—আমাদের এক হবার সম্ভাবনা আছে?
—আপনি আমাকে করুণা করছেন, তাই না? পুরুষ মানুষ তো সচরাচর বিধবা কিংবা ডিভোর্সি নারীদের প্রতি করুণা করে না। তবে আপনি কেন?
—করুণা নয়, আপনাকে বিয়ে করতে চাওয়ার কারণ আপনার স্নিগ্ধতা। একথা সত্য যে, আমি জানতাম না আমার ছোটমামা আপনার সাথে আমার বিয়ে নিয়ে আলাপ করবেন। আবার আমার আম্মাও এভাবে রাজি হবেন। শুরুতে বরং বিরক্তই হয়েছিলাম। কিন্তু আপনাকে যত দেখছি, কেন জানি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। আপনি এটাকে কী বলবেন?
সুনেরাহ আড়ালে একবার মুচকি হাসলো। কবির আবার বলে,
—আমার সম্পর্কে জানবেন না?
—নাহ। আমরা কী বাইরে গিয়ে বিয়ের বাকি আলাপটা এগোনোর কথা বলতে পারি?
কবির কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে ওর দিকে তাকালো। সুনেরাহ সত্যি সত্যিই ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে? আনন্দে যেন কিছুক্ষণ ওর মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হলো না। সুনেরাহ নিজে থেকেই কিছু বলতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ বিছানার উপর তার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। কবির সেদিকে তাকিয়ে দেখে, নাম্বারটি "ডিয়ার হাজবেন্ড" বলে সেভ করা। কবিরের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে সুনেরাহও মনে হলো বেশ ভয় পেয়েছে।
#জলতরঙ্গ পর্ব:-০২
কবির কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে ওর দিকে তাকালো। সুনেরাহ সত্যি সত্যিই ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে? আনন্দে যেন কিছুক্ষণ ওর মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হলো না। সুনেরাহ নিজে থেকেই কিছু বলতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ বিছানার উপর তার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। কবির সেদিকে তাকিয়ে দেখে, নাম্বারটি "ডিয়ার হাজবেন্ড" বলে সেভ করা। কবিরের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে সুনেরাহও মনে হলো বেশ ভয় পেয়েছে। কবির একদৃষ্টিতে ওর মোবাইলের দিকে চেয়ে আছে। ব্যাপারটা খেয়াল করে সুনেরাহ তড়িৎগতিতে তার ফোনটা পাশে সরিয়ে আড়াল করে কেটে দিলো। সম্পর্ক শুরু হবার আগেই কবিরের মনে সন্দেহ বাসা বাধে। মানুষ মাত্রই যেমন ভুল,তেমন মানুষ সর্বদাই বেঈমানীর আরেক রুপ বহন করে।
কবির কিছুটা কঠিন সুরেই জিজ্ঞাসা করে,
—কোনো সমস্যা, মিস সুনেরাহ? গুরুত্বপূর্ণ কেউ কল করেছে মনে হচ্ছে। সমস্যা নেই৷ আমি ডাইনিংয়ে যাচ্ছি। আপনি কথা শেষ করুন।
—আরে না, না। এমন কিছু নয়। আসলে আজ আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে,এটা আমার প্রাক্তণ শশুরবাড়ির লোকও জেনে গেছে। তাই সেই বিকাল থেকেই কল দিয়ে খোঁজ নিচ্ছে। আর দেখছেন না? কলও করেছে অনিকের সীম থেকে। ওর নাম্বারটা তো আর কখনোই ডিলেট করতে পারিনি।
সুনেরাহ একবার বড় করেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সেই দীর্ঘশ্বাসের ভারি হাওয়া যেন সোজা এসে লাগলো কবিরের বুকের ঠিক মাঝখানে। ছিঃ,ছিঃ, সামান্য এইটুকু কারণে এতক্ষণ তাকে কী না কী ভাবছিল সে! নিজের এই বোকামির জন্য নিজের উপরেই ভীষণ রাগ হচ্ছে ওর। সুনেরাহকে আর কিছু না বলেই লজ্জায় আর সঙ্কোচে মাথা দুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কবির বের হতেই সুনেরাহ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। মোবাইল ফোনটা তাড়াতাড়ি সুইচ অফ করতে গিয়ে আবার রিংটোন বেজে ওঠে। সে কিছুটা ভয়ে ভয়েই কল রিসিভ করে বললো,
— বারবার কল দিচ্ছো কেন? পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে এসেছে, জানো না?
ওপাশ থেকে যে জবাব এলো, তা স্পষ্ট করে শোনা গেল না। তবে মুহুর্তেই সুনেরাহ তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে ডাইনিং রুমে ফিরে আসে।
(২)
সুনেরাহ'র সাথে নিজের একমাত্র ছেলের বিয়ের কথা সম্পূর্ণরুপে পাকাপোক্ত করেই রাফিয়া রহমান বাড়ি ফিরেছেন। আর বাড়ি ফিরেই বিয়ে নিয়ে বেশ তড়িঘড়ি শুরু করে দিলেন। হাজার হোক, তার একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। বিয়েতে কোনো ত্রুটি রাখা যাবে না। কবির কেবলই অবাক হয়ে তার মাকে দেখছে। নিজের মাকে সে যতটুকু চেনে, এই ভদ্রমহিলা কোনো বিধবা,এক বাচ্চার মায়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে দিতে চাইবেন না। তাহলে সুনেরাহ'র মাঝে তিনি কী এমন দেখলেন? কবিরের মনে মায়ের এই বিষয়টা নিয়ে বেশ খটকা লাগে।
রাফিয়া রহমান নিজের বিছানায় শুয়ে আয়েস করে বসে মোবাইলে অপরিচিত কারো একজনের কথা বলছেন।
"ছেলের একটা ব্যবস্থা করেই ছাড়লাম। এই বিয়েই আমার ছেলের ভাগ্য ফেরাবে। আপনি দেখে নিয়েন। যদিও হাতে এখনও যথেষ্ট সময় আছে। কিন্তু তাতে কী? শুভ কাজে দেরি করা ভালো নয়। যত দেরি, তত সংশয়। পরে যদি এমন পাত্রী হাতছাড়া হয়ে যায়? তখন কী করবো আমি!"
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের সমস্ত কথোপকথনই শুনছে কবির। মায়ের এইরুপ আচরণ তাকে আরও যেন ঘেটে দিচ্ছে। এবাড়িতে তার বিয়ে নিয়ে কী এমন বিষয় চলছে! সে রাফিয়া রহমানের দরজায় কড়া নাড়লে তিনি সচকিত ভঙ্গিতে মুহুর্ত সময় চেয়ে রইলেন। কবির ভিতরে ঢুকে মায়ের হাত ধরে জিজ্ঞাসা করে,
—তুমি ঠিক আছো মা?
—একদম। কেন? আমার আবার কী হবে?
—সেটাই তো জানতে চাইছি। মা, একটা সত্যি কথা বলো তো। আমি তোমাকে যতটুকু জানি,তুমি সুনেরাহ'র মত এতগুলো বাহ্যিক দোষে পরিপূর্ণ মেয়ের সাথে আমার বিয়ে তো কখনোই হতে দেবে না। অন্যান্য আত্মীয়দের ক্ষেত্রেও তোমার আচরণ আমি দেখেছি। তাহলে আজ কেন? তাও আবার আমাকেই!
—তোর কী মেয়েটাকে পছন্দ নয়?
—আরে না মা। ওকে আমার অনেক পছন্দ। কত আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মেয়ে। সেই সাথে বুদ্ধিমতীও।
—সুনেরাহ'কে বুদ্ধিমতী মনে হচ্ছে?
রাফিয়া রহমান কিছুটা ভড়কে গেলেন। শেষ কথাটি তিনি যে সুনেরাহ'র ক্ষেত্রে একদমই আশা করেননি, তা তার মুখভঙ্গি দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে। ছেলের সামনে জোরপূর্বক নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন,
—আরে, তুই কী আমাকে এতই নীচু চিন্তাভাবনার মানুষ মনে করিস নাকি? কেউ যোগ্য হলে তার সেই যোগ্যতার কদর করতে জানতে হয়। আমিও তাই করেছি। দেখ কবির, সুনেরাহ'র ব্যাপারে আমি যথেষ্ট খোঁজ খবর নিয়েছি। মোটামুটি বেশ শিক্ষিত, ভদ্র, মানুষের সাথে সম্মান দিয়ে কথা বলে। আশেপাশের মানুষের কাছে তুই যদি মেয়েটার ব্যাপারে প্রশ্ন করিস, সবাই একটাই উত্তর দেবে-"অমন মেয়ে এই যুগে পাওয়া ভার"। তাছাড়া তুই নিজের চোখেই দেখলি না কীভাবে তোর সাথে বিয়ে ক্যান্সেল করতে চাচ্ছিলো!
—হ্যাঁ মা, সবই দেখেছি, বুঝেছিও। কিন্তু তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি না। ছোট মামা কখন আসবেন?
—তোর বিয়ের কেনাকাটা করতে গেছে। পরশুই তো বিয়ে। ঘরোয়াভাবে বিয়ের আয়োজন করছি তো কী হয়েছে? বউমার কোনো কিছুর কমতি আমি রাখতে চাই না, বুঝলি?
কবির আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে আসে। তার অগোচরে কিছু তো একটা চলছেই। কিন্তু কী চলছে? পর্তুগাল থেকে "বিজনেস ম্যানেজমেন্ট" নিয়ে পড়াশোনা করে এসেছে সে। যদিও মা এবং ছোট মামার ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়ে কবির তার মামার প্রাইভেট হাসপাতালেই যুক্ত হোক। কিন্তু নানান রকম জোর করলেও কবিরের জিদের কাছে কেউ জিততে পারেনি। পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছে। আর সেই সাথে শুরু হয়েছে তার মায়ের তাকে নিয়ে বিয়ের তোড়জোড়।
বারান্দায় বসে অনেক রাত জেগে প্রায় দুটোর দিকে কবিরের দু'চোখ টেনে আসতে শুরু করে। ঘুমের ঘোরে একরকম টলতে টলতেই সে বিছানায় এসে বসে। দূরের রাস্তায় একনাগাড়ে রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউঘেউ করে ডাকছে। পথে নিশ্চয় কোনো অপরিচিত পথচারী দেখেছে সে। আশেপাশে আর তেমন কোনো শব্দ নেই। জানালার পাশেই কোনো গাছ থেকে একটা দুটো পাতা ঝরে পড়লো। কবিরের মনে হচ্ছে,সেই পাতা ঝরে পড়ার শব্দও সে শুনতে পেল। ঘুম ঘোরঘোর চোখে জোরপূর্বক তাকিয়ে কান খাড়া সে বেশ আগ্রহ নিয়েই পাতা ঝরার শব্দ শোনার চেষ্টা করে। ঠিক এমনই এক মুহুর্তে সুনেরাহ'র নাম্বার থেকে কল এলো। কবির সিনেমার নেশাড়ু অভিনেতাদের মত ঘুমের নেশায় নেশাগ্রস্থ হয়ে ঘাড় কাঁত করে নাম্বার দেখার চেষ্টা করে।
"সুনেরাহ এত রাতে কল দিয়েছে!"
স্ক্রিণে ঘড়ির সময় দেখে সে এমনভাবে আঁৎকে ওঠে যে, মুহুর্তেই তার ঘুম হাওয়ায় মিলে গেল। ওপাশ থেকে সহাস্যে সুনেরাহ জিজ্ঞাসা করলো,
—আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো আপনি এখনও ঘুমোননি। শেষ পর্যন্ত আমার ধারণা সঠিক হলো। তাই না বলুন?
—ঠিক তা নয়। মাত্রই ঘুমোতে যাচ্ছিলাম। ঘুমের ঘোরে মরি মরি অবস্থা আমার।
—মাত্র! এখন রাত দুটো পনেরো বাজে।
কবির সহসা জবাব দিতে পারে না। এতক্ষণ তার সত্যিই যে ঘুম আসছিল না- একথা ধামাচাপা দেবার মত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার চেয়ে মৌনতাই উত্তম। ওপাশ থেকে সুনেরাহ আবার বললো,
—আমারও ঘুম আসছে না। সব কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। এভাবে হঠাৎ করে বিয়ে, শশুরবাড়ি! ছোট ওইটুকু মেয়ে নিয়ে এতকিছু সামলে মানিয়ে নেওয়া। সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। আমি কী করছি, নিজেও জানি না। আমার কী করা উচিত বলুন তো কবির সাহেব। আমার নিশ্চিত হয়ে জানতে ইচ্ছে করছে, আপনি সত্যিই এই বিয়েতে রাজি?
সুনেরাহ'র কথায় কবিরের যেন বড্ড মায়া হলো। সুনেরাহ'কে খুব কাছ থেকে দেখে চোয়ালে হাত রেখে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে—সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো। কিন্তু এবারও বলা হলো না।
—দেখুন, আল্লাহ কার কপালে কী লিখে রেখেছেন,এসব তিনিই ভালো জানেন৷ আর আমার সম্পর্কে যদি কিছু জানার থাকে৷ নিঃসঙ্কোচে আমাকে প্রশ্ন করবেন।
—আচ্ছা, এভাবে আপনার ঘুম নষ্ট করার বিশেষ প্রয়োজন নেই। মেয়েটা উঠে পড়েছে। গুড নাইট।
সুনেরাহ কবিরকে "গুড নাইট" বলার সময়টুকুও দিলো না। নিজের কথা শেষ হবার ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই বোধহয় কল কেটে দিলো। খাটের পাশে হেলান দিয়ে পা দুটি ঝুলিয়ে সে মুচকি হেসে ভাবে আর বলে,
" নতুন করে তো আর কিছু জানার নেই কবির সাহেব। বাকিটা জানাজানি বরং ময়দানেই হয়ে যাবে!"
#জলতরঙ্গ ৩য় পর্ব
সুনেরাহ'র কথায় কবিরের যেন বড্ড মায়া হলো। সুনেরাহ'কে খুব কাছ থেকে দেখে চোয়ালে হাত রেখে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে—সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো। কিন্তু এবারও বলা হলো না। সে বালিশে মাথা রেখে বলে,
—দেখুন, আল্লাহ কার কপালে কী লিখে রেখেছেন,এসব তিনিই ভালো জানেন৷ আর আমার সম্পর্কে যদি কিছু জানার থাকে৷ নিঃসঙ্কোচে আমাকে প্রশ্ন করবেন।
—আচ্ছা, এভাবে আপনার ঘুম নষ্ট করার বিশেষ প্রয়োজন নেই। মেয়েটা উঠে পড়েছে। গুড নাইট।
সুনেরাহ কবিরকে "গুড নাইট" বলার সময়টুকুও দিলো না। নিজের কথা শেষ হবার ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই বোধহয় কল কেটে দিলো। খাটের পাশে হেলান দিয়ে পা দুটি ঝুলিয়ে সে মুচকি হেসে ভাবে আর বলে,
" নতুন করে তো আর কিছু জানার নেই কবির সাহেব। বাকিটা জানাজানি বরং ময়দানেই হয়ে যাবে!"
সুনেরাহ’র মনের খবর কবির জানে না। কে কাকে ঠকাতে চায়, তাও একে অপরের অজানা।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে। কবির গাঢ় খয়েরি রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেছে। তার মাথার মাঝারি সাইজে চুলগুলো কেউ বোধহয় খুব যত্ন করেই আঁচড়ে দিয়েছে। কবিরকে কী ভারি সুন্দর লাগছে আজ। রাফিয়া রহমান নিষ্পলকভাবে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। যেন কতদিন তিনি নিজের ছেলেকে এমন মন ভরে দেখেননি। কবির মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-মা, তোমার ছেলেকে কী চান্দের টুকরোর মত লাগছে?
-উঁহু , আমার ছেলে চাঁদের টুকরোর চেয়েও মূল্যবান। আল্লাহ তোকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখুক বাবা।
-রাখবে, রাখবে। এবার তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বলো তো। তুমি ভিতরে ভিতরে কোন একটা বিষয় নিয়ে একা একাই বুকের ভিতর ক্ষত বানাচ্ছো। সেই ক্ষতটা আসলে কী মা? প্লিজ, আমাকে তুমি মিথ্যে বলবে না। আমি বাচ্চা ছেলে নই,তা তুমি জানো।
রাফিয়া রহমান ছেলের মুখখানা নিজের কাছে এগিয়ে ধরে কবিরের কপালে চুমু খেলেন। তারপর বললেন,
-বেশ, তোকে আমি সব বলব। তবে এখন নয়। বিয়ের পর। এখন এসব ছোটখাটো মন খারাপের কথা বলে তোর মুড অফ করতে চাই না। মায়ের উপর এইটুকু বিশ্বাস রাখ।
কবির আর কথা বাড়ায় না। এমনিতেই বেশ দেরি হয়ে গেছে তাদের। মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে বেরিয়ে পড়ে। রাফিয়া রহমান ছেলেকে একা ছাড়তে চাচ্ছিলেন না,কিন্তু কবিরের ছোটমামার জন্য আর যেতে পারলেন না। বিয়ের সময় পাত্রীর বাড়িতে পাত্রের মায়ের যাবার নিয়ম নেই। যা কিছুই ঘটুক, তা তিনি একাই সামলে নিতে পারবেন।
কিন্তু বিয়ে বাড়িতে ছোটমামা সব সামলাতে পারলেন না। বিয়ে পড়ানোর ঠিক আগ মুহুর্তে সুনেরাহ হঠাৎ কবিরকে ডেকে বসলো। কন্ঠে বেশ কাঠিন্য টেনেই সে বললো,
-আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে।
–মানে? কীসের সন্দেহ!
-আপনারা ওবারিতে যাবার পর সত্যিই আমার সাথে একজন নতুন বউয়ের মত ট্রিট করবেন তো? আমার এত দোষ, এত ত্রুটি-সবটাই আপনারা মেনে নিচ্ছেন। পৃথিবীটা এত সহজে বদলে গেছে,এই কথাটা বিশ্বাস করতে কেন জানি প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। আপনি প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে একবার অনুভব করে দেখুন।
কবির ছোট করে একবার শ্বাস ফেলে। নারীর মন খুব সহজে কোনো বস্তু, কোনো ব্যক্তির উপরেই ভরসা করে না। একথা সেও জানে। তবে এও সত্যি যে, একবার ওদের কারো প্রতি ওদের বিশ্বাস জন্মে গেলে, একবার কারো মায়ায় পড়ে গেলে, সারা দুনিয়া বিরোধীতা করলেও ওরা সেই বিশ্বাস আর মায়াটুকুই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। সে নিজের অজান্তেই সুনেরাহ’র একটি হাত নিজের মুঠির মধ্যে আগলে ধরে বললো,
-আপনার এমন দুশ্চিন্তার হেতু আমি উপলব্ধি করতে পারছি। শুধু আপনি নন, এই সম্পর্কটা নিয়ে আমারও সংশয়ের শেষ নেই। কিন্তু সাহস করে কদম উঠাতে তো দোষ নেই। বাকি সব কেমন হবে আমি জানি না, কিন্তু আমি কবির, আমি আজ পর্যন্ত কোনো নারীর সাথে এমন প্রতারণার চেষ্টাও করিনি, যার দরূণ সে দুঃখ পায়। আর সেখানে আপনি তো আমার স্ত্রী হবেন! মিস সুনেরাহ, আমি আপনাকে অভয় দেব না। কিন্তু নিজের উপর ভরসা করে সৎ সাহসটুকু দেব। আমি বুঝতে পারছি, আপনার সমস্ত চিন্তা আপনার মেয়েকে নিয়ে। তাই তো? আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমার বাড়িতে প্রবেশ করার পর ওর আগামীর দিনগুলোর সমস্ত দ্বায়িত্ব আমার উপর থাকবে। আর আমি সেই ব্যবস্থা করবো।
কিন্তু ওর কথায় সুনেরাহ খুব একটা সন্তুষ্ট হলো বলে মনে হয় না। না হবারই কথা। স্বামীহারা সদ্য মা হওয়া একটি অল্পবয়সী নারী খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়। যে লতা হাতের সামনে জোটে, সেটি আঁকড়ে ধরে থাকে। কিন্তু সুনেরাহ কী তাই? সে নিজের বোধ ও আত্মসম্মান নিয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাছাড়া, মাত্র তেরোদিন আগে সে বাচ্চার মা হয়েছে। এর মধ্যেই রাফিয়া রহমান এই মেয়েকেই ছেলের বউ করার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছেন। যদিও সম্বন্ধ পাকা হবার সময় কথা হয়েছে, অন্তত দুইমাস তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হবে না। তারপরেও, হঠাৎ করে ব্যাপার এত সহজে মানিয়ে নেওয়াও অসম্ভব। এদেশের ইতিহাসে এমন অদ্ভুত ঘটনা কী এর আগে ঘটেছে?
কবির তার ছোটমামাকে ডেকে কোথায় জানি কল দিতে বললো। বরযাত্রী বিশেষ নেই। খুব কাছের বন্ধুবান্ধবসহ দুই পক্ষের হিসাবে সর্বোচ্চ আঠারো বা বিশের কাছাকাছি মানুষই হবে। রাগিব চেয়েছিল তার খালাকে কল দিতে। কিন্তু সুনেরাহ কারোর সাথেই যোগাযোগ করতে দেয়নি। সে যখন যাবে, নীরবে চুপিচুপিই যাবে। আর একবার গেলে এবাড়িতে দ্বিতীয়বার ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। হয়তো সেকারণেই কবিরের কাছে আরও অধিক কোনো ভরসা খুঁজছে।
ঘন্টাখানিক বিয়ে স্থগিত করার পর মোতালেব সরকার নামের এক উকিল হাজির হলেন। কবিরই তাকে ডেকেছে। সুনেরাহ একবার উকিলের দিকে আরেকবার কবিরের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকায়। সে যে এখনও ঘোরের মধ্যে আছে, সেটা বুঝতে পেরে কবির বললো,
—সুনেরাহ, আপনাকে বিয়ে করার জন্য আমি টিনেজার ছেলেদের মত পাগল হয়ে যাইনি। কিন্তু সেদিন দেখতে এসে আমরা যখন একে অপরকে পছন্দ করেছি, তাই নিজেদের মধ্যে কোনো খাদ কিংবা সংশয় কোনোটাই রাখতে চাই না। আপনি আমার জীবনে সেরাদের সেরা মানুষটিও নন। তবে যোগ্য মানুষ। বিয়ের পর অনুদিতি আমারও সন্তান। তাই সেই সন্তানের ভবিষ্যত নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমারও। আমার সম্পত্তির অর্ধেক আমি অনুদিতির নামে লিখে দিচ্ছি।
সুনেরাহ হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কবির সত্যি সত্যিই তার মেয়ের নিরাপত্তার জন্য এত বড় একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে! ব্যাপারটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না ওর। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে সে বাধা দিয়ে বলে ওঠে,
—আমরা কী তবে দেনাপাওনা করছি!
—না। ভরসার জায়গাটি পোক্ত করছি। যদিও গতকাল রাতেই আমি এই বিষয়টি ভেবে রেখেছিলাম। আশা করি,এরপরে আমাকে ভরসা করতে তোমার দ্বিধা হবে না। মোতালেব ভাই, আপনি উইলটা সঙ্গে এনেছেন?
মোতালেব সরকার উইলের সমস্ত কাগজপত্র কবিরকে বুঝিয়ে দিলেন। কবির সেগুলোতে স্বাক্ষর করে সুনেরাহ'র হাতে তুলে দেয়। এরপর তার আর কিছুই বলার থাকে না। অবশ্য বলতেও হলো না। ঠিক যেমন হাঙ্গামার গতিতে প্রশ্ন উঠেছিল, তেমন গতিতেই নীরবতা বজায় রেখে দুজনের বিয়ে পড়ানো হয়ে গেল।
ছেলে যে পাত্রীপক্ষের বাড়িতে এমন বিচ্ছিরি কান্ড করে বসে আছে, তা রাফিয়া রহমান জানতেন না। এমনকি ছোটমামাও ভেবেছিলেন, তার বোনের পরামর্শেই কবির এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও ক্ষণিক মুহুর্তের জন্য সে অবাক হয়েছিল। কিন্তু তার যে বোন এমন একটি মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেখানে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও বিশেষ কোনো ব্যাপার না। তবে ছোটমামার ভুল ভাঙলো, যখন বোনের কাছে যেচে গিয়ে কবিরের কথা জানায়।
—কী! তুই নিজে থেকেও এসব করতে দিলি? তুই জানিস না, সুনেরাহ'র সাথে আমি কেন কবিরের বিয়ে দিলাম? মেয়েটা সর্বোচ্চ দুই তিনমাস এ বাড়িতে থাকবে। তারপর? ও তো নাই হয়ে যাবে। ওর বদলে এখন আমাকে ওর ওই বাচ্চার দেখাশোনা করা লাগবে!
#জলতরঙ্গ পর্ব:-০৪/শেষ
—কী! তুই নিজে থেকেও এসব করতে দিলি? তুই জানিস না, সুনেরাহ'র সাথে আমি কেন কবিরের বিয়ে দিলাম? মেয়েটা সর্বোচ্চ এক দুইমাস এ বাড়িতে থাকবে। তারপর? ও তো নাই হয়ে যাবে। ওর বদলে এখন আমাকে ওর ওই বাচ্চার দেখাশোনা করা লাগবে!
রাগে-দুঃখে রাইমা তালুকদার ফেরিওয়ালার বেলুনের মত ফুলে উঠলেন। যেন এক্ষুণি নিশ্বাস ছাড়লে দম আটকে মারা যেতে পারেন। তার নিজের ভাই এমন গাধার মত কাজ করে আসবে,তা কল্পনার বাইরে ছিল। কড়া করে ধমক দিয়ে তিনি ভাইকে ঘর থেকে বের করে দিলেন। কত কাঠখড় পুড়িয়ে, রাগিবকে চাপ দিয়ে সুনেরাহ'র এইরকম শারিরীক অবস্থায়ও বিয়ের বন্দোবস্ত তিনি করেছেন। যা করেছেন, সবটাই কবিরের জন্য। কবিরের ভালোর জন্য। ছেলের ভালো করতে গিয়ে তার বোকাসোকা অতি ভালো মানুষ ছেলে এটা কী করে এলো? যদি সুনেরাহ'ই বেঁচে না থাকে, তবে তার বাচ্চাকে পেলেপুষে কী আন্ডা পাবেন!
অন্যদিকে কবিরের ঘরে ছোট মেয়েকে নিয়ে শুয়ে আছে সুনেরাহ। বিয়ের শাড়ি বলতে খুব সাধারণ আর পাতলা একটা শাড়ি পরেছিল। এখন সেটাও নেই। তার পরিবর্তে ঢিলাঢালা ধাঁচের একটা পোশাক গায়ে জড়িয়ে রেখেছে সে। ঘরে ঢুকে কবির এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে টের পায়, মেয়েটার শরীরের অবস্থা খুব বেশি ভালো না। মা এমন তাড়াহুড়ো না করলেও তো পারতেন। অনুদিতির বয়স দুই মাস পার হলে তখন কী এমন ক্ষতি হত?
কবিরকে দেখে সুনেরাহ নড়েচড়ে বসলো। কিন্তু কথা বললো না। কবির নিজে থেকেই বিছানার পাশে পা ঝুলিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করে,
—কী ভাবছ?
—ভাবছি অনেক কিছুই। আমাকে কোন পাগলে কামড়ালো, আর আমি ড্যাংড্যাং করে বিয়ে করতে রাজি হলাম! এইটুকু বাচ্চা আমার। তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছি কেন জানেন? আপনার মা আমার সাথেই আপনার বিয়েটা দিতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। আর তার চেয়েও হতবাক লেগেছে, আপনি অনুদিতির নামে কীভাবে এতকিছু লিখে দিতে পারলেন! আমি যদি বিয়েতে রাজি না হতাম?
—হা হা হা। মায়ের কথাটা এখনও জানি না। তবে আমি কবির। তোমাকে সেদিন কী বলেছিলাম, মনে আছে? আমার সম্পর্কে খোঁজ নিতে। আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে ভালোবাসি। আর আমার প্রতি অন্যের বিশ্বাস তৈরি করতেও। তুমি আমাকে ঠকাতে পারো, এমন কিছু কেন জানি মনের মধ্যে উঁকি দেবার সাহসই পায়নি। কারণ,তুমি ছলনাময়ী হলে শুরুতেই বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যেতে। আমাকে ফেরাতে না। একটা সুন্দর মনের মানুষকে চিনতে কী এর চেয়ে বেশি জানার মত কষ্ট করতে হয়?
সুনেরাহ মাথা নিচু করে একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কবির অতি বোকাসোকা একটি মানুষ। অথবা সরল। অথচ এই সহজ সরল মানুষটিকেই তার ধোকা দিতে হবে। কবির জানতেও পারবে না—এতক্ষণ পর্যন্ত যা কিছু হচ্ছে, তা কেবল সুনেরাহ'র ইচ্ছেতেই। উঁহু, নিজে বাঁচতে হলে এসব মানবতাকে পেট থেকে উগরে ফেলাটাই বাঞ্চনীয়। সে একবার কবিরের দিকে চেয়ে সামান্য হাসির চেষ্টা করলো। কবির আবার প্রশ্ন করে,
—কিন্তু আপনি নিজের শরীরের এই অবস্থায় ব্যাপারটা মেনে নিলেন,এটাই আমার কাছে বড় আশ্চর্যের বিষয়। আমাকে এখনই ভালো যে বাসতে পারবেন না,তা জানি।
—রাগ। রাগিব ভাইয়ের উপর রাগ আর জিদ। আমার বাচ্চার বয়স স্বল্প। অন্যদিকে, আমার ভাই আমার উপর মানসিক অত্যাচার শুরু করেছিল। অবশ্য অনুদিতি জন্মের আগে থেকেই চলছিল এসব। কিন্তু ও হবার পর আর এক সেকেন্ডও যেন রাগিব ভাই ওর বাড়িতে রাখতে ইচ্ছুক ছিল না। আমার এইরকম শারীরিক অবস্থায় এখনই চাকরি করাও সম্ভব নয়। অবশ্য গেলে বন্ধুদের কাছে কোথাও যেতাম। কিছুমাস থাকার পর চাকরি নিতাম। কিন্তু আপনি যত সুন্দর করে আপনার উপর ভরসা তৈরি করিয়েছেন, এর চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত আর কী নেওয়া উচিত ছিল আমার?
কবিরের ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ফুটে ওঠে।
তবে সেই হাসি খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। বুকের উপর মাঝেমাঝেই তীব্র যন্ত্রণা হয়। এই যন্ত্রণা তার নতুন নয়। ডাক্তারের চিকিৎসায় কিছু সময় ভালো থাকে, আবার কিছু সময় এভাবেই সহ্য করে।
তবে তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির ব্যাপার হলো- ইদানীং সুনেরাহ'র শরীর অধিক খারাপ হতে শুরু করেছে। বিছানা থেকে ওঠে না, ডেলিভারির ব্যথা কমার বদলে হঠাৎ বাড়ছে।
ছেলের বিয়ের ছত্রিশ দিন পর একদিন রাফিয়া রহমান নিজের ছেলে কবিরকে না ডেকে গোপনে সুনেরাহ'র ঘরে ঢুকলেন।
—দেখো বউমা, তোমার ডেলিভারির ব্যথা নাকি বাড়ছে? লক্ষণটা কিন্তু ভালো ঠেকছে না। তোমার জরুরিভাবে ডাক্তার দেখানো উচিত। আজ বিকালে আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
—মা,আপনার ছেলে তো আমার চেয়েও বেশি অসুস্থ। আমার চেয়ে ওর ব্যাপারটা আগে দেখলে ভালো হত না?
—কী যে বলো তুমি। কবির পুরুষ মানুষ। তাছাড়া ওর মামা সবসময় ওর ব্যাপারটা দেখে। কিন্তু তুমি পরের মেয়ে। এখানে এসে তোমার নিজের কাছে নিজেকে যেন কখনোই দূরের মানুষ মনে না হয়। শাশুড়ী নয়, একজন মা হিসেবে তোমার দেখ-ভালো করাটা আমার দায়িত্ব, সুনেরাহ।
-না মা, আমার তা মনে হয় না। কবিরের ব্যাপারটাই আপনার আগে দেখা উচিত। ওর ট্রিটমেন্ট হলে এরপর আমি ডাক্তার দেখাবো। প্লিজ,আমার উপর আর কোনো জোর করবেন না মা। আমার স্বামী সুস্থ হলেই আমার স্বস্তি।
রাফিয়া রহমান নানানভাবে বুঝিয়েও সুহেরাহ'কে রাজি করাতে পারলেন না৷ কিন্তু তিনি তো এটা চাননি। মনে মনে ক্ষোভে আর বিরক্তিতে নিজের ঘরে ফিরে ছোটভাইকে ডেকে পাঠালেন। আতিক-উল্লাহ বোনের ঘরে ঢুকতেই রাফিয়া রহমান ভাইয়ের দিকে তেড়ে এসে বললেন,
—আমার আমও গেল, ছালাও গেল। তোর মত গাধাকে এতবড় দায়িত্ব দিয়ে কী লাভ পেলাম?
—কেন? সুনেরাহ কী সব জেনে গেছে?
—ওইটাই তো খালি বাকি আছে। যার জন্য দুনিয়ায় এত এত ভালো মেয়ে থাকতে ওরে পছন্দ করলাম। যার জন্য রোজ রোজ মেডিসিন মিশিয়ে ওকে খাওয়ানোর রিস্ক নিয়েছি, আর এখন তীরে এসে আমার তরীটাই ডুবে যাবে? সুনেরাহ যদি ডাক্তারের কাছে না যায়, তাহলে আমার ডাক্তার কীভাবে ওকে অপারেশনের কথা বলবে? আমার কবিরকে আমি কীভাবে বাঁচাবো?
মাসখানেক আগে কবিরের ডাক্তারি রিপোর্টে জানা যায়-তার ফুসফুসের কার্যক্রম একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে। কবিরের শরীরে নতুন করে কোনো ডোনারের অরগ্যান ট্রান্সপ্লান্ট করা ছাড়া
সুস্থ হওয়া সম্ভব নয়। ব্যাপারটা রাফিয়া রহমান কবিরকে জানায় না৷ কবির অত্যন্ত সহজ সরল এবং দুর্বল মনের ছেলে। নিজের সম্পর্কে এসব জানলে সে আরও অসুস্থ হয়ে যাবে। তার ইচ্ছে-আপাতত কোনোভাবে তাকে বুঝিয়ে দ্রুত অপারেশন করবে। কিন্তু তার আগে ম্যাচিং অরগান প্রয়োজন। শত চেষ্টার পরেও কারোর অরগ্যানই ম্যাচ করে না৷ শেষ পর্যন্ত এই সুনেরাহ'ত অরগ্যান ম্যাচ করে, তখন সে হাসপাতালে প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট করাতে গেছিল। পরবর্তীতে রাফিয়া রহমান খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন-মেয়েটার স্বামী মারা গেছে, মাস কয়েক পরেই বাচ্চা হবে।
সেই মুহুর্ত থেকেই রাফিয়া রহমান একটু একটু করে নানান মাধ্যমে রাগিবকে উস্কে দিয়েছেন। তার পরিকল্পনা ছিল- কবিরের সাথে ওকে বিয়ে দিয়ে সুনেরাহ'কে আলাদা একটা মেডিসিন দিবে। আর সেই মেডিসিনের প্রভাবে সুনেরাহ অসুস্থ হয়ে গেলে তারই ঠিক করা ডাক্তারের মাধ্যমে সুনেরাহ'কে একটা অপারেশনের কথা বলে অরগ্যান সরাবে। এতে সুনেরাহ মারা গেলেও আলাদাভাবে মেডিকেল রিপোর্ট দেবার জন্য ডাক্তারের টিমও ঠিক করে রেখেছেন তিনি। অথচ সুনেরাহ'কেই এখন সে রাজি করাতে পারছে না!
ভাইয়ের উপর রাগারাগি করে রাফিয়া রহমান ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। তার হাতে খুব বেশি সময় নেই। কিন্তু এমন দুশ্চিন্তার মুহুর্তে তিনি টেরই পাননি, সুনেরাহ গোপনে তার সম্পূর্ণ কথোপকথনের ভিডিও করে নিয়েছে। আর সেই ভিডিওটিই সে কবিরকে দেখায়। তিরস্কার করে বলে,
—তার মানে আমার সাথে এত সখ্যতা, এত সম্মান, এত ভালোবাসার মূল কারণ এই ছিল কবির? আপনাকে আমি ভরসা করেছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম। আর আপনি আপনার মায়ের সাথে মিলে আমার জীবনটাই শেষ করে দিতে প্ল্যান করেছেন?
কিন্তু কবির ওর কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। সে তো কখনোই এসবের কিছুই জানতো না। তার এতবড় অসুখের কথা শুনে যতটা না অবাক হয়, মায়ের এতখানি ভয়ংকর পরিকল্পনা দেখে তার চেয়েও অধিক হতবাক হয়ে গেল। সে সুনেরাহ'কে বারবার বুঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। এতবার অনুরোধ করার পরেও সুনেরাহ তাকে বুঝতে চাইছে না? আজকের এই মানুষটিকে আজ চিনতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে মাকেই ডেকে এনে সবটা বলতে বাধ্য হয় এবং তাকে যে এসবের কিছুই জানানো হয়নি, তার জবাবদিহিতাও চাইলো। ছেলের কাছে আজ আর সমস্ত ঘটনা তিনি লুকোতে পারলেন না। সমস্তই তাকে খুলে বলতে হলো।
নিজের এই অবস্থা জেনেও কবির সুনেরাহ'কে কথা দেয়,
—তার অপারেশন হোক বা না হোক,সে সুনেরাহ'কে ঠকাবে না।
কবির তার কথা রেখেছে। ফুসফুস ড্যামেজের শেষ পর্যায়ে চলে গেলেও সুনেরাহ'র ক্ষতি সে করেনি। এমনকি, নতুন করে ডোনারও আর পাওয়া সম্ভব হয়নি। ধুঁকে ধুঁকে জীবনের শেষ দিনের শেষ মুহুর্তে এসে শুধু সুনেরাহ'র হাত ধরে একবার অনুরোধ করেছিল,
—সুনেরাহ, আমি কী তোমার মনে একটুও জায়গা পাইনি?
সুনেরাহ জবাব দেয় না৷ শুধু বুক ভারি করা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সেদিন। কবিরের মৃত্যুর পর প্রায় এক সপ্তাহ সে এক মুহুর্তের জন্যও ঘরের বাইরে বের হয়নি। তবে যেদিন হয়েছিল, সেদিন রাফিয়া রহমানও টের পাননি। রেস্টুরেন্টে বসে সে তার প্রাক্তণ স্বামী অনিক মুস্তাফিজের সাথে চিৎকার করে বলে,
—এবার খুশি হয়েছো তুমি?
—মনে হচ্ছে রাগ ঠিকরে পড়ছে! দেখো সুনেরাহ, আমি যা করেছি, তা আমাদের ভালোর জন্যই করেছি।
মূলত অনিকের এক্সিডেন্ট হলেও সে মারা যায়নি। সুনেরাহ'র সাথে মনোমালিন্য হবার পর সে রাগ করে ভাইয়ের বাড়িতে চলে আসে। আর এরপরেই তার প্রেগন্যান্সির রিপোর্টের সূত্র ধরে রাফিয়া রহমান কবিরের সাথে সুনেরাহর ম্যাচিং খুঁজে পান। কিন্তু রাফিয়া রহমান জানতেন না- কবিরের বন্ধু ভদ্রমহিলার ঠিক করা ডাক্তারের এসিস্ট্যান্ট। সব জানার পর সে নিজেই পরিকল্পনা করে নিজের এক্সিডেন্ট করায়। মর্গ থেকে লাশ নিয়ে নতুন রিপোর্ট তৈরি করে। তারপর সুনেরাহ'র সাথে মিলেই এই সমস্ত মৃত্যুর নাটক সাজায়। অনিক খুব ভালো করেই জানতো- রাফিয়া রহমানের মত স্বার্থপর মহিলা সুনেরাহ'র এই পরিস্থিতির শতভাগ ফায়দা নিবেন। আর অনিকও তার পরিকল্পনা সাজায়, সুনেরাহ'কে ওবাড়িতে পাঠিয়ে কবিরের ইমোশনাল মনের সুযোগ নেবার।
তারপর একদিন সুযোগ বুঝে তার মায়ের পরিকল্পনা ফাঁস করে দেবে। হলোও তাই। তারা দুজনেই খুব ভালো করে জানতো- রাফিয়া রহমান যেভাবে সুনেরাহ'কে ডেকে যেচে খাবার দিতেন , তা সুনেরাহ'কে অসুস্থ করার জন্যই। আর তাতে মেডিসিন থাকতে পারে,সেটাও সন্দেহ করেছিল। কিন্তু সুনেরাহ সেসবখায়নি। তবে অসুস্থ হবার ভান ঠিকই ধরেছে।
যার ফল আজকের এই বিজয়।
অনিক বললো,
—মানুষের কাছে তো আমি মৃত। তবে আমরা দুজন অস্ট্রেলিয়া চলে যাবো। সেখানে নতুন করে জীবন শুরু করবো। তুমি মেয়ের অভিভাবক হিসেবে সম্পত্তির ভাগ বুঝে নেবে।
—তোমার যেখানে ইচ্ছে, সেখানে যাও। আমি তো কবিরের বাড়িতেই থাকবো।
—মানে?
—মানে খুব সোজা। যে স্বামী তার বউকে দিয়ে এমন জঘন্য কাজ করাতে পারে, সে পরবর্তীতে আমার উপরেই আবার কিছু করবে না-তার কী নিশ্চয়তা আছে! দুনিয়ার কাছে কাগজে কলমে তুমি মৃত। চাইলেও আমার কিছুই করতে পারবে না। ওদিকে রাফিয়া রহমানের সম্পত্তি পেয়েছি মাত্র তিনভাগের এক ভাগ। কে জানে? এখন এই একাকী নিঃসঙ্গ স্বামী সন্তানহারা মহিলাকে ইমোশনালি পটাতে পারলে সবটাই আমার আর অনুদিতির নামে করে দেয় কি-না!
—তুমি আমার সাথে এটা করতে পারো না সুনেরাহ। সব প্ল্যান আমার ছিল, আমিই কলকব্জা নেড়েছি বলে পেয়েছ।
—প্ল্যান তোমার ছিল বলেই তো এত সাহস পাচ্ছি। মৃত মানুষ জীবিত প্রমাণিত হলেও বিশেষ লাভ হবে আর। যদি ভাবো, আমাকে মেরে ফেলবে-তাহলে সেই দুঃসাহসও করো না৷ অনুদিতি আমার কাছেই থাকবে। আর হ্যাঁ, মরহুম অনিক সাহেব, আমি সুনেরাহ সব পারি। স্বামী থাকা অবস্থায়ও যখন আরেকটি পুরুষকে বিয়ে করতে পেরেছি, তার মৃত্যুর কারণ হতে পেরেছি, সেখানে তোমার মত দু'পয়সার স্বামীকে ছাড়তে পারবো না? হা হা হা। আল বিদা মরহুম পতিদেব।
অনিক বারবার সুনেরাহ'র নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিন্তু সুনেরাহ আর পিছন ফিরে তাকায় না। সে এখন ভয়ংকর এক খেলায় নেমেছে, যার শুরুটা অনিকই হাতে ধরে শিখিয়েছিল।
(সমাপ্ত)