Showing posts with label home. Show all posts
Showing posts with label home. Show all posts

2.3.24

অদৃশ্য পরী

 ----দেবর সাহেব, তো বিয়ে করবে কবে? বয়স তো কম হলোনা ৷

----আপনার মত সুন্দরী কাউকে পেলে বিয়েটা শীঘ্রই করে ফেলতাম ৷
-----সমস্যা নাই তো, আমাকেই বিয়ে করো!
----কেমনে? আপনার বিয়ে হবার আগে বলতে পারলেন না?
----একটা উপায় কিন্তু আছে, তোমার চাচাতো ভাই মানে আমার স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে, ভাগিয়ে কাজী অফিসে নিয়ে বিয়ে করবে ৷৷
----না থাক ৷ আমার ভাইটাকে কষ্ট দিতে চাইনা ৷ বেচারা ভালবেসে বিয়ে করেছে আপনাকে ৷ মন ভাঙ্গা ঠিক হবেনা ৷
আমি আবার কারো মন ভাঙ্গা পছন্দ করিনা ৷
----বুঝতে পারছি কেন পিছিয়ে গেলে?
----কি বুঝতে পারলেন?
----তোমার প্রেমিকা আছে নিশ্চয় ৷ তার জন্যই এতদিনের অপেক্ষায় তুমি ৷ নিশ্চয় সেই মানুষটার অপেক্ষাতে থেকে বিয়ে করতে দেরি করছো ৷ তা কে সে?
সে কি বিয়ে করতে চাচ্ছেনা?
----না, ভাবী; এখনো আমার লাইফে তেমন কেউ আসেনি ৷ আমি আসলে এমন একজনকে চাই যে আমার ধূলোমলিন পৃথিবীটাকে রঙিন করে তুলবে ৷ অগোছালো জীবনটাকে নিজ হাতে গুছিয়ে দিবে ৷ আর আমাকে নিজের চেয়ে বেশি ভালবাসবে ৷ এমন কারো দেখা মেলেনি ৷ হয়তো তার আজও জন্মই হয়নি ৷ জন্ম নিলেও সে আমার কাছে ধরা দিচ্ছেনা ৷ আড়ালে রয়ে গেছে!
----ওহ! চিন্তা করোনা, একদিন ঠিকই পেয়ে যাবে তাকে ৷ ইশ! আমার যদি একটা বোন থাকতো ৷ তার সাথে হয়তো তোমার সেটিংটা হয়ে যেত ৷
----হা হা, হয়তো!
----তো, ৯ বছর পর গ্রামের চাচার বাসায় এলে ৷ তোমার চাচাতো বোনের সাথে দেখা হয়েছে?
----না তো! সে কই? দেখলাম না তো ৷ সেই সকালে এসেছি ৷ এখন বিকেল ৷ তার তো এখনো দেখা পেলাম না ৷ অনুর কথা স্পষ্ট মনে আছে ৷ ও খুব দুষ্টু ছিল ৷ ওর দুষ্টুমির কথা আজও মনে পড়ে ৷ আসলে ভোলার নয় ছোটবেলার স্মৃতিগুলো!
----আমার ননদকে একনজর দেখলে হয়তো ফিট খেয়ে যেতে পারো ৷ তবে একটা সমস্যা আছে, ও একটু কনজারভেটিভ মাইন্ডের ৷ আড়ালে থাকতে পছন্দ করে ৷ হয়তো লজ্জায় তোমার সাথে দেখা করছে না!
----ওহ, এই ব্যাপার ৷ সমস্যা নাই ৷ একবার দেখা হলেই ওর লজ্জা আমি ভেঙ্গে দিবো!
-----শুভকামনা স্যার!
-----হা হা হা!
.
.
শীতের ঋতুতে গ্রামে আ়সাতে উপকারই হয়েছে ৷ প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছি, আর শীতের বৈচিত্র খুব ভালভাবে টের পাচ্ছি ৷ ডিনারের সময় হলে চাচী ডাক দিলেন খাওয়া দাওয়ার জন্য ৷ খাবার টেবিলের দিকে গেলাম ৷ রুমে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম আপাতমস্তক ঢাকা, শুধুমাত্র চোখ দুটো খোলা একটা মেয়ে চাচার পাশের চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে ৷ মেয়েটাকে দেখে কপালে চোখ উঠলো আমার ৷ ভ্রু-কুঁচকে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম ৷ আর ভাবতে লাগলাম সে কে? অনু নাকি? অনুই হবে ৷ ভাবী বলেছিল অনু রক্ষণশীল টাইপের মেয়ে ৷ ভাবীর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালাম ৷ আমার দৃষ্টি বিনিময় দেখে ভাবী মিষ্টি করে হাসলো ৷ অতঃপর মাথা নাড়িয়ে বুঝালো, “সে ই অনু!"
.
কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবতে লাগলাম নিশ্চয় এই মেয়ে কখনো আমাকে চেহারাটা দেখতে দিবেনা ৷ আমি যে চাচাতো ভাই সেটা কি ভুলে গেছে সে? আমার সাথে এতটা পর্দানশীল মনভাব নিয়ে না চললেও পারতো! অনুকে উদ্দেশ্য করে ভাবীর দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের স্বরে বললাম,
----ভাবী, পাত্রীকে দেখতে এসে যদি তার মুখটা দেখতে না পারি তাহলে বিয়েটা কেমনে হবে?
.
আমার কথা শুনে চাচা বিষম খেলেন অতঃপর কাশতে লাগলেন ৷ একগ্লাস পানির কিছু অংশ খেয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
----অনু, নেকাপটা সরিয়ে তোর ভাইকে চেহারাটা দেখা ৷ সে তো বাইরের কেউ না ৷ আমাদের পরিবারেরই একজন!
.
একটু ভাব ধরে মিনমিন কন্ঠে বললাম,
----না চাচা থাক ৷ অনু হয়তো লজ্জায় মুখ দেখাতে চাচ্ছেনা ৷ ছোটবেলা থেকেই ওর একটু লাজ বেশি ছিল ৷ এটা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানতো না ৷ শুধু রাত্রে দুজনে ঘুমানোর সময় অনু আমাকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমাতেই পারতোনা!
.
চাচা, চাচী ও ভাবী আমার কথা শুনে শব্দ করে হাসলেও অনু রেগে আগুন হয়ে চেয়ার ছেড়ে থমথমে পায়ে চলে গেল!
নারীর মন রহস্যময় ৷ রাগটাও রহস্যময়ী ৷ হঠাৎ করে রেগে যায় ৷ রাগলে ভাল-মন্দ না ভেবে রাগের সদ্বব্যবহার করে ৷ যদিও সদ্বব্যবহারটা কখনো কখনো বিপদের কারণ হয়!
চাচী নরম স্বরে বলল,
----নীল, ওর ব্যবহারে কষ্ট পেওনা ৷ আসলেই আমার মেয়েটা খুবই রক্ষণশীল ৷ ও তো ওর দুলাভাইয়ের সামনেও মুখ না ঢেকে কখনোই দেখা সাক্ষাৎ করে নি ৷ ওর এমন আচরণে ওর দুলাভাই রাগ করে কথায় বলেনা ওর সাথে!
.
চাচীর কথা শুনে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম ৷ বোধহয় পিচ্চিকালের ক্রাশের চেহারাটা দেখতে পারবোনা!
ডিনার শেষ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ৷ ভাবী এসে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো অনুর রুমের পাশের রুমে ৷ এই রুমেই ঘুমাতে হবে ৷ ভাবী মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে চলে গেল ৷ আমি সাজানো গুছানো বিছানার উপর গা এলিয়ে দিলাম ৷ অতঃপর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম ৷ জানি এত সহজে ঘুম চোখের কোণে ধরা দিবেনা ৷ উপায় মোবাইলে কোনো বই পড়া ৷ দ্য ভিঞ্চি কোড বইটা পড়া শুরু করলাম ৷ আগেও বেশ কয়বার পড়েছি ৷ বারবার বইটি রাতের বেলায় এজন্যই পড়ি যাতে তাড়াতাড়ি ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে পারি ৷ পড়তে লাগলাম মনোযোগ দিয়ে ৷ হঠাৎ, দরজায় খটখটানির আওয়াজ শুনতে পেলাম ৷ পড়লাম ঝামেলায় ৷ কম্বলের ভেতর ঢুকে পড়েছি, শীতল গা গরম হয়ে উঠেছে ৷ এখন কম্বল থেকে উঠলে মজাটা নষ্ট হয়ে যাবে ৷ রাগ হচ্ছিল ৷ রাগে গজগজ করছিলাম ৷ নিশ্চয় ভাবীর কাজ ৷ সে কোনো দরকারেই হয়তো দরজায় কড়া নাড়ছে ৷ কিন্তু আমার যে কম্বল ছেড়ে উঠতে মন চাচ্ছেনা এটা তাকে কেমনে বুঝাই? যদি বলি উঠতে পারবোনা, তাহলে রাগ করবে ৷ রেগে থাকলে পরবর্তিতে তার হেল্প পাবোনা ৷ মনকে মানাতে বাধ্য করলাম যে দরজাটা খুলতেই হবে ৷ খটখটানির আওয়াজ বেড়ে চলছে ৷ অনিচ্ছা সত্বেও বিরক্তি ভাব নিয়ে কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে উঠলাম ৷ দরজার সামনে গেলাম ৷ দরজাটা আস্তে করে খুললাম ৷ কিন্তু আশ্চর্য কেউ নেই ৷ তাহলে এতক্ষণ দরজায় কড়া নাড়লো কে? ধুর, এতরাতে কে ফাইজলামী করে? দরজাটা বন্ধ না করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম ৷ ভাবলাম বৈদ্যুতিক বাতিটা বন্ধ করে দিই ৷ ওটা জ্বালিয়ে রেখে শুধু শুধু বিদ্যুৎ বিল বাড়বে ৷ বন্ধ করে দিলাম বাতিটা ৷ বাতি বন্ধ করার বেশকিছুক্ষণ আবলতাবল ভাবলাম ৷ এবার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে কম্বলের ভেতরে খুশির চোটে প্রবেশ করলাম ৷ মোবাইলে আলো ছিল বিধায় দরজা বন্ধ করতে ঝামেলা হয়নি ৷ এবার মোবাইলে বইটা পড়তে শুরু করলাম ৷ আচমকা আমার গায়ে মানুষের দেহের পরশ অনুভব করলাম ৷ পুরো শরীরটা ছ্যাৎ করে উঠলো ৷ গায়ে ইরইর ভাব শুরু হলো ৷ চোখ পিটপিট করতে করতে ভাবতে লাগলাম কম্বলের ভেতর কে ঢুকলো? বিড়াল টিড়াল নাকি? কিন্তু বিড়ালের শরীর মানুষের মত হবে কেন? তাও এত কোমল ও নরম! আঁতকে উঠলো মনটা ৷ অস্বাভাবিক কিছুর সম্মুখীন হচ্ছি নাকি? ভূত টূত? না এটা কি করে হয়? ভূতের কি শরীর আছে নাকি? তবে কি পরী? আমার কম্বলের ভেতর কোনো রুপসী পরী ঢুকে পড়লো নাকি?
হাত থেকে ফোনটা পড়ে গিয়েছে, ফোন তোলার বিন্দুমাত্র সাহস ও ইচ্ছা নাই ৷৷ ফোন তোলার ভাবনা বাদ দিয়ে কম্বলের নিচে কে এটা নিয়ে ভাবনায় ডুব দিলাম ৷
ভাবতে ভাবতে অকস্মাৎ, আমার টিশার্টের ভেতরে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়ে কে যেন আমার কোমড়ের উপর দিকে শুরশুরি দিতে লাগলো? বড় ধরণের শক খেলাম ৷ ধারাক করে উঠলো বুকটা ৷ ঠান্ডা আঙ্গুলের পরশে গায়ে শীতলতা ভর করলো ৷ কেঁপে উঠলো শরীর ৷ নিশ্চয় কোনো পরীর আগমন ঘটেছে আমার কম্বলের ভেতর ৷ অন্যথায় কোনো মানুষের সাহস হবেনা এরকমটা করার ৷ ভয় ভয় মন নিয়ে চোখ পিট পিট করতে করতে কম্বলটা গা থেকে সরিয়ে ফেললাম ৷ ওমনি কে যেন আমার গায়ের ওপর ভর দিয়ে বসলো ৷ ভয়ে আতঙ্কে রক্ত পানি হয়ে গেল ৷ থরথরে কাঁপনের সৃষ্টি হলো ৷ কি সর্বনাশ! এ তো সত্যি সত্যি কোনো পরীর আগমন ঘটেছে ৷ কিন্তু, আমার কাছে কি চাই সে? অামি কি দোষ করলামৱ তার সাথে? জমিজমা নিয়েও তো শত্রুতা নেই ৷ কোনো কালে তার সাথে প্রেমের সম্পর্কও ছিলনা, ব্রেকআপ ট্রেকআপ করিনি ৷ ধোঁকা দিইনি ৷ তাহলে কেন যে আমার কাছে এসে ভয় দেখাচ্ছে এটাই তো বুঝতে পারছিনা ৷ ভাবলাম ফোনের আলো দিয়ে তার মুখটা দেখবো ৷ কিন্তু ফোনই তো খুঁজে পাচ্ছিনা ় বিপদের সময় প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হারিয়ে যায় ৷ তখন জিনিসগুলোর হাত পা গজায় ৷ তারপর দৌঁড়ে দৌঁড়ে হেঁটে হেঁটে কই যেন লুকিয়ে থাকে ৷ আমার ফোনটাও বোধহয় লুকিয়ে গেছে ৷ পরীর অত্যাচার বেড়ে চলছিল ৷ স্পর্শকাতর অঙ্গে সে তার আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করছিল ৷ আমার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল ৷ এই পরীর অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার পথ খুঁজছিলাম ৷ কিন্তু কোনো পথও খুঁজে পাচ্ছিনা ৷ আমি তো এখন অন্ধের ন্যায় ৷ চারপাশটা অন্ধকারে ঘেরা ৷ ঘরে আলো থাকলে তো পথের দিশা পেতাম ৷ এই নিশিতে কোথাকার কোন ভয়ানক পরীর আগমন ঘটলো এটা যদি জানতে পারতাম তাহলে হয়তো পরীটার অনিষ্ট থেকে বাঁচতে পারতাম ৷ গায়ের কাঁপন বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ পরীটা ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করলো ৷ হতবাক হলাম ৷ ভয়ের মধ্যেও হতভম্ব ভাবের উদয় হওয়াতে ভয়টা কিঞ্চিৎ কমে গেল ৷ পরীরা কথা বলতে জানে এটা আমি অনেক শুনেছি কিন্তু পরীরা যে এভাবে ফিসফিস করে কথা বলে জানা ছিলনা ৷ তাছাড়া পরীটার কন্ঠস্বর হ্নদয় জুরানো ৷ হ্নদয় শীতল করে দেওয়া কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি ৷ পরীটা হ্নদয়হরণ করা কন্ঠস্বর নিয়ে বলছিল,
----আজ থেকে আমি আপনার পিছু নিলাম ৷ আর ছাড়বোনা ৷ আপনি আমাকে না চাইলেও আমি আপনার খুব নিকটে থাকবো ৷ পাশেপাশে থাকবো ৷ আমি জানি এখানে আপনি ১ মাস থাকবেন ৷ এই ১টা মাস ধরে আপনাকে আমি বিরক্ত করবো, আপনার উপর অত্যাচার করবো আর খুব খুব ভালবাসা দিবো,আদরমাখা ভালবাসা ৷ এখন একটু ভালবাসা মাখবেন গায়ে? কি দিবো ভালবাসা?
.
পরীর কথা বলার ধরণ দেখে ক্রমেই ভয়টা কই যেন হারিয়ে যাচ্ছিল ৷ এটাই তো আমি চাই ৷ ভয়কে আমি ভয় পাই, প্রচন্ডভাবে ৷ তাই ভয় মন থেকে দূর হওয়া মানেই ভাললাগা কাজ করা ৷ নিশ্চয় এই পরী ভয়ানক কোনো পরী নয় ৷ প্রেমময়ী পরী হবে ৷ তাকে দেখতে কেমন এটার জন্য মুখ দেখা জরুরি ৷ কিন্তু কেমনে দেখবো? পরীর গায়ে হাত দিয়ে দেখবো নাকি? তার দেহের গঠণ মানব নারীর মতন নাকি অস্বাভাবিক? কিন্তু সাহস ও ইচ্ছা হচ্ছেনা তার গায়ে হাত দেবার ৷ মনকে জিজ্ঞেসা করলাম, “কিরে পরীর গায়ে হাত দিবো নাকি? হাত দিলে সে কি রাগ করবে? যদি চড় থাপ্পর মারে তখন?" আমার মন উত্তর দিলো, “আরে ভয় পাইস না, আমি তো আছি ৷ তোরে থাপ্পর মারলে আমি তোর ত্বক ও মস্তিষ্ককে বলবো ব্যথা না পেতে!" মনের কথায় সাহস হলো ৷ এবার নিশ্চিন্তে পরীর গায়ে হাত দেওয়া যায় ৷ তার গায়ে হাত দেবার আগেই পরী আমার বুকের সাথে তার অন্যরকম কোমল দেহ পিষ্ঠ করে রাখলো ৷ নিশ্চয় তারও বুক রয়েছে ৷ আমার শরীরের সাথে আষ্টেপিষ্ঠ জড়িয়ে থাকায় সেটা টের পেলাম ৷ তার গায়ে হাত দিলাম ৷ আরে, এটা তো দেখি মেয়ে মানুষের মত পিঠ ৷ তারমানে পরীদের দেহ মানব নারীর মতই!
আমি কিছু বলতে যাবো ৷ তখনই ফোনের আলো জ্বালিয়ে আমার মুখ বরাবর আলো ধরলো ৷ অতঃপর চিল্লাতে চিল্লাতে পরীটা বলল,
----আমার মুখ দেখার এত শখ তাইনা? জীবনে কখনো মেয়েদের মুখ দেখেন নাই? আমি ভাবছিলাম শহরে বসবাস করে আপনি ভদ্র স্বভাবের হয়ে আসছেন ৷ কিন্তু না, আমার ধারণা ভুল ছিল ৷ আপনি আসলে একটা ইতর!
.
পরীর এত রাগ কোথা থেকে এলো বুঝলাম না ৷ আর সে কার মুখ দেখার কথা বলছে? আমি কখন তাকে বললাম মুখ দেখবো? বলেছি তো মনে মনে ৷ এটা সে কেমনে জানলো? তারমানে পরীরা মনের কথা জানতে পারে? এক মিনিট... সে কি অনুর চেহারা দেখার কথা বলছে? কিন্তু এরজন্য তো অনুর রাগ করার কথা ৷ পরীটা কেন রাগ করছে? তারমানে.... ও এই ব্যাপার! এতক্ষণ তাহলে অনুই আমার সাথে ফাইজলামী করেছে? সে না পর্দানশীল! হঠাৎ, আমার সাথে এরকম রগরগে আচরণ কেন করলো? না, এসব তো ভাল নয় ৷ হঠাৎ, সে আমার শরীর থেকে সরে গেল ৷ বিছানা থেকে নেমে সুইচবোর্ডের নিকট গিয়ে বাতি জ্বালালো ৷ ঘরটা আলোকিত হয়ে গেল ৷ রুমের এককোণে একটি মেয়ে দাঁড়ানো ৷ তার দিকে নজর পড়া মাত্র আমি এক মিনিটের জন্য যেন স্তব্দ হয়ে গেলাম ৷ এত বেশি সুন্দরী মেয়ে আমার চোখ কখনো দেখেনি, অন্তরও কখনো কল্পনা করেনি ৷ একটা মেয়ে এরকম ভয়ংকর মাপের সুন্দর হয়! এটা আগে জানা ছিলনা আজ বাস্তব চোখে দেখছি ৷ এখন বুঝতে পারছি কেন অনু নিজেকে আড়ালে রাখে ৷ ক্লাস ৮ এ তাকে শেষবার দেখেছিলাম ৷ সেসময় অনু সুন্দরী ছিল কিন্তু এরকম ছিলনা ৷ হয়তো তখন সে যুবতী ছিলনা, যৌবনে পা দেওয়ায় সৌন্দর্য তাকে ঘিরে ধরেছে ৷ কিন্তু আমি আবার বেশি সুন্দরী মেয়েদের সহ্য করতে পারিনা ৷ অনুর চেহারা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম ৷ সে আমার নিকট খুবই ধীরেধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো ৷ আমার চোখের দিকে মায়াভরা তার ঐ কাজল কালো আঁখির দৃষ্টির যোগসূত্র ঘটিয়ে, মুখে চেপে রাখা মিষ্টি হাসি হেসে আমার ফোনটা হাতে দিয়ে মৃদ্যুস্বরে বলল
----এইযে নেন আপনার ফোন ৷ আর হ্যাঁ, আমাকে দেখেছেন তো? এবার খুশিতে লম্বা একটা ঘুম দেন ৷ আরেকটা কথা বলি, সবাই ভাবে আমি রক্ষণশীল ৷ আসলে এমন কিছুই না ৷ আমাকে ছেলেরা যাতে বিরক্ত করতে না পারে এজন্যই এরকম বেশভূষা ৷ আমার তো মন চাই সালোয়ার কামিজ কিংবা পশ্চিমাদের মত পোশাক পড়ে ঘুরতে, যেরকমভাবে আপনার সামনে দাঁড়ানো আমি ৷ কিন্তু এভাবে রাস্তায় বেড়োলে কুকুর, বিড়ালেরা কুদৃষ্টি দিবে এটা আমি চাইনা ৷ আর হ্যাঁ, মনের ভেতর পরীদের প্রতি চিন্তাভাবনা পুষে রাখা বাদ দেন ৷ আপনি এতো পরীদের নিয়ে ভাবেন কেন? দেখবেন পরীকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে আবার পাগল যেন হয়ে যান না!
.
কথাটা বলেই অনু রুম থেকে বের হয়ে গেল ৷ আমার বুক থেকে বিশাল একটা শীতল বরফের ন্যায় পাথর সরে গেল ৷ এখন হালকা লাগছে ৷ তবে অনুর প্রতি কেমন একধরণের দুর্বলতা জেগে বসতে চাচ্ছে অবচেতন মনে ৷ নানা রকম আজেবাজে চিন্তাভাবনা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম!
.
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো দরজার খটখটানি শব্দে ৷ কিন্তু আশ্চর্য দরজা খোলায় আছে ৷ শুধু শুধু শব্দ কেন করছে? কে করছে শব্দ? অনু নাকি ভাবী? উঁচু গলায় বললাম, “ভেতরে আসতে চাইলে আসুন এত নাটক করতে হবেনা ৷"
অনু ভেতরে আসলো হাতে চায়ের কাপ নিয়ে ৷ আমার হাতে চা- দিয়ে ভেংচি কেটে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল ৷ অনুর দিকে এখন খুব ভাল করে লক্ষ্য করলাম ৷ তার চুল ভেজা ছিল ৷ ভেজা চুলে অপ্সরীর মত লাগছিল ৷ তাছাড়া গায়ে হলুদ ও হালকা সবুজ রঙয়ের মিশেলে তৈরি করা ট্রান্সপ্যারেট শাড়িতে তাকে লাস্যময়ী লাগছিল ৷ তার মুখে হাসি লেগেই থাকে, এজন্য হয়তো সৌন্দর্যের মাধুর্যতা আরো ভালভাবে ফুটে ওঠে! চা খেতে খেতে অনুকে নিয়েই ভাবনার সাগরে প্রবেশ করলাম!
.
কুয়াশা ঢাকা ভোরের সৌন্দর্য উপভোগ করার মধ্যে অন্যরকম ভাললাগার আবেশ লুকানো রয়েছে আর আজকে আমি এই ভাললাগাটা হ্নদয়ের ক্যানভাসে রঙ তুলিতে মাখতে চাই ৷ রঙ হবে ভোরের কুয়াশা আর তুলি হবে ভোরের শীতল ঈষৎ উড়তে থাকা বাতাস ৷ আর ক্যানভাস হবে আমার পুরো দেহ ও মন ৷ না, স্যান্ডেল পায়ে দিলাম না ৷ খালি পায়ে হাঁটতে লাগলাম ৷ গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিলাম ৷ গ্রামে তো নদী আছে, পরিচিত গ্রাম ৷ নদীর পাশে একটা জঙ্গল রয়েছে ৷ আয়তনে খুব একটা বিশাল না, তবে পুরো জঙ্গলটা শেষ করতে মিনিট ২০ লাগে ৷ খারাপ না ৷ জঙ্গলটার জমিনে পা মাড়াই না অনেক বছর হলো ৷ শীতের প্রখরটা বাড়ায় খোলা পা শিরিরে ভেজা ঘাষে লাগতেই শরীরটা মোচড় মেরে উঠছিল প্রতিবার ৷ তবে অন্যরকম ভাললাগার অনুভূতি ঠিকই টের পাচ্ছি ৷ এখন যদি পাশে মনের মানুষ থাকতো তাহলে ভাললাগাটা আরো বেড়ে যেতো ৷ এটার আক্ষেপ থাকলেও ভাললাগাটা ঠিকই বিদ্যমান আছে, মনের মানুষ নেই তো কি? প্রকৃতির সৌন্দর্য তো ঠিকই রয়েছে ৷ অবশেষে নদীর ধারে পৌঁছলাম ৷ নদীর বুক থেকে হিমশীতল বাতাস হো হো করে উড়ে আসছিল ৷ মনে হচ্ছিল সমস্ত বাতাসের দল আমাকে লক্ষ্য করে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে ৷ বাতাসও চালাক হয়ে গেছে,চালাক দেশের মানুষদের চালাকির অভিজ্ঞতা এরাও অর্জন করেছে ৷ নদীর অন্তরকাঁপানো ঠান্ডা পানি ও পানির গা ঘেঁষে আচড়ে আসা বাতাসের পরশ ও কুয়াশার মধুর শুভ্রতা গায়ে মাখলাম ৷ নদীর ধারের প্রচন্ড শীতল বালির উপর খোলা পা রাখতে মৃদ্যু কষ্ট লাগলেও মৃদ্যু সুখ অন্তরে টের পাচ্ছিলাম ৷ অতঃপর চললাম জঙ্গলের দিকে!
জঙ্গলের ভেতরে আজ প্রবেশ করতেই ভয় করছে ৷ অনেক বছর পর পা মাড়ালাম ৷ ভয় হওয়া স্বাভাবিক ৷ সাপ টাপ থাকলে কামড় দিলে শেষ ৷ মনে ভয় আর বুকের কাঁপন নিয়ে ধীর পায়ে চলতে লাগলাম ৷ জঙ্গলের গাছগুলো ও এর পাতাগুলো এত সুন্দর যে চোখ সরানো দায় ৷ বনের একপাশে পৌঁছে দেখতে পেলাম ভাঙ্গা একটা নৌকাকে ৷ গাছের পাশে নৌকাটাকে পড়ে থাকতে দেখে জোশ লাগছে ৷ ৷ আবছা লাগছে দেখতে, কারণ কুয়াশা ৷ কুয়াশায় স্পষ্টভাবে দেখা সম্ভব না ৷ আচমকা কার যেন মধুর কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম ৷ নারী কন্ঠস্বর ৷ গান গায়ছে ৷ অসম্ভব সুন্দর কথামালায় গাওয়া মধুর কন্ঠের মনছোঁয়া গান ৷ আমার হ্নদয় জয় করে নিলো গানটা ৷ গানের গায়িকাও ৷ কিন্তু কে গায়ছে গানটা? অকস্মাৎ, নৌকার পাশে একটা মেয়েকে দেখতে পেলাম ৷ সাদা একটা শাড়ি গায়ে ৷ মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিনা ৷ তবে মেয়েটা শ্যামবর্ণের এটা টের পাচ্ছি ৷ মেয়েটার প্রতি মায়ার জন্ম হলো ৷ এখনো সে গান গায়ছে ৷ এই গানই হয়তো তার প্রতি মায়া তৈরি হবার মূল কারণ! আজকে আমি চিন্তিত নই কারো মায়ায় জরানোর দোষে ৷ হ্যাঁ, মায়ার জালে জরানো দোষের, তবে এখন কেন যেন দোষের মন হচ্ছে না ৷ এই মেয়ের মায়ায় পড়া কিংবা তার প্রেমে পড়া দোষের হবেনা বলে দুটা মনই সায় দিচ্ছে ৷ মেয়েটার সাথে কথা বলা জরুরি ৷ নৌকার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ভাবনায় ডুব দিয়েছিলাম ৷ দৃষ্টি যখন আবারো নৌকার উপর পড়লো তখন আর মেয়েটার অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না ৷ মুহূর্তের মধ্যে সে কই হাওয়া হয়ে গেল?
দিকভ্রান্তের মত মেয়েটাকে খুঁজতে লাগলাম ৷ কিন্তু পেলাম না ৷ একরাশ হতাশা নিয়ে চলছিলাম বাসার দিকে ৷ তবে রাস্তায় দেখা হয়ে গেল অনুর সাথে ৷ মুখ ঢাকা তবে বোরখার রঙ দেখে বুঝতে পারছি সে ই অনু ৷ তাছাড়া তার দেহের গড়ণ ও চোখটাও পরিচিত হয়ে গেছে ৷ অনু কই যেন যাচ্ছিল? আমি মিষ্টি হেসে বললাম,
----কই যাবে এখন?
অনু তীক্ষ্ণকন্ঠে জবাব দিলো,
----সেটা আপনাকে কেন বলবো?
.
চলবে....
.
#অদৃশ্য_পরী (পর্বঃ ১)
লিখাঃ Sifat Arnab Rehan.

#অদৃশ্য_পরী (পর্বঃ ২)
লিখাঃ Sifat
Arnab Rehan.
.
----কই যাবে এখন?
অনু তীক্ষ্ণকন্ঠে জবাব দিলো,
----সেটা আপনাকে কেন বলবো?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে বললাম,
-----জানা জরুরি, এত সকালে একা একা কই যাও এটা চাচাতো ভাই হিসেবে আমার জানার অধিকার আছে ৷ বলা তো যায়না, মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরী তুমি, বখাটে ছেলেপুলে কিডন্যাপ করে নিয়ে যেতে পারে ৷ আমি চাইনা কোনো বখাটে আমার ক্রাশটার কোনো ক্ষতি করুক!
.
অনু চেঁচিয়ে উঠে বলল,
----চুপ করেন তো ৷ বেশি কথা বলেন ৷ শহরে কাটিয়ে এসে বাচাল হয়ে আসছেন ৷ বাচাল টাইপের মানুষদের আমি দু-চোক্ষে দেখতে পারিনা ৷ সামনে থেকে সরেন!
অনুর চটাং চটাং কথা বলা শুনে অবাক চোখে তাকালাম ৷ চোখ উঁচিয়ে আওয়াজ নিচু করে বললাম,
----সরবোনা, তুমি কই যাও সেখানে যাবো ৷ চলে যেতে বললেও যাবোনা আমি!
----যাবেন না মানে? ফাইজলামী পায়ছেন? আমি তো যাচ্ছি বান্ধবীর বাসায় ৷ আপনিও কি সেখানে যাবেন?
----হুম, যাবো; তাতে তো সমস্যা দেখছিনা!
----না, আপনাকে সঙ্গে নিয়ে বান্ধবীর বাসায় যাওয়া যাবেনা ৷ আমার বান্ধবী খুব চালাক প্রকৃতির ৷ তাছাড়া সে কৌতূহলী , জেরা করতে ভালবাসে ৷ আপনাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে ও ভাববে আপনি আমার প্রেমিক হন কিংবা হবু বর ৷
----আরে ভাবুক, তাতে কি? ভাবলেই তো প্রেমিক হয়ে যাবোনা ৷ আর তোমাকে কিছু কথা বলার আছে ৷ হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো বলা যাবে ৷
----আপনি বাসায় যাচ্ছিলেন যান ৷ সকালের নাস্তাটা করেন গিয়ে ৷
----নাস্তা করতে হবেনা ৷ জঙ্গলের ভেতরে একটা পেয়ারা গাছ ছিল ৷ কয়েকটা পেয়ারা পেড়ে খেয়েছি ৷
----তাহলে বাড়ি যাবেন না?
----না!
.
অনু রাস্তায় দাঁড়িয়ে এদিকে সেদিক উঁকিঝুকি মেরে দেখছিল কেউ আসছে কিনা! তার তাকানো দেখে আমিও কৌতূহলী চোখে এদিক সেদিক উঁকি দিলাম ৷ না কেউ নেই ৷ কাউকে আসতে দেখছিনা ৷ কুয়াশার কারণে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা ৷ আবছা আবছা গাছপালার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি ৷ গাছপালাকে দেখা যাচ্ছে শুভ্রবৃক্ষের ন্যায় ৷ গাছগুলোর আসল সৌন্দর্য অগোচরেই রয়েছে বলা যায় ৷ অন্যমনস্ক হয়ে কুয়াশায় জরানো গাছপালার দিকে তাকিয়ে রইলাম ৷ আচমকা অনু আমাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরলো ৷ টের পেলাম অনু তার মুখ থেকে নেকাপটা সরিয়েছে ৷ ক্রমশ সে তার দেহটাকে আমার শরীরের সাথে এমন ভাবে মিলিয়ে দিচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল মিশে যাবো তার মোলায়েম ও শিমুল তুলার ন্যায় দেহের ভাঁজে ৷ অাকস্মিকভাবে তার এমন জড়িয়ে ধরার ফলশ্রুতিতে শরীরে শিহরণ জাগালেও, মনে রাগের সৃষ্টি করলো ৷ এমনটা আশা করিনি ৷ তার এরকম পাগলামী আচরণ মোটেও শোভনীয় নয় ৷ ক্ষণিককাল অনু আমাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরার পর নরম মোলায়েম কন্ঠে বলল,
----হুম, এবার যান ৷ শান্তি পেয়েছেন তো? এবার ভাল মানুষের মত বাড়ি যান ৷ আপনার চোখ দেখে বুঝেছিলাম আপনি কি চান? সেটা উপহার দিয়েছি ৷ কি ভাললাগেনি?
.
আমার যেন রাগে শরীর জ্বলছে ৷ এমন লাগছে যে মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে ৷ অনু নিজেকে আমার শরীর থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে ৷ এখন স্বস্তি বোধ করছি ৷৷ তাকে তীক্ষ্ণকন্ঠে বললাম,
----অনু তোমার কি লজ্জা শরম নাই? এমন আচরণ তো তোমার থেকে আশা করিনা ৷ কত মার্জিত বেশভূষা গ্রহণ করেছো অথচ অযথা আচরণ করছো ৷
----হুহ হুহ, আপনার লেকচার দেওয়া শেষ হয়েছে? তাহলে যান, এবার বাড়িতে যান!
----হুম, যাচ্ছি ৷ তোমার সাথে কোথাও যাওয়ার মানেই নিজেকে ছোট করা ৷ যদি তোমার বান্ধবীর বাড়ি যাই, আর সেখানে গিয়ে যদি তুমি জড়িয়ে ধরার বদলে চুমু খেয়ে বসো তাহলে আমার প্রেস্টিজের সাড়ে বারোটা বেজে যাবো!
----তো যান খাম্বার মত এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? নাকি আবারো উষ্মতা পেতে চাচ্ছেন?
.
কথাটা বলেই অনু হাসতে লাগলো ৷ হাসিটা অবশ্যই আশ্চর্য সুন্দর ৷ মুগ্ধতা ছড়ানোর মত হাসি ৷ গালে কিঞ্চিত টোল পড়ে, এটা হাসির সৌন্দর্যকে একটু বাড়িয়ে তুলেছে ৷ অনুর হাসি ভুবন ভুলানো, তবে সবাই তার হাসিতে এই ভুবনকে ভুলবেনা ৷ তারা ভুলবে, যারা অনুকে অনুভব করতে পারবে এবং এরাই মূলত অনুর হাসির মায়ায় পড়ে জগৎয়ের সবকিছুকে নিমিষে ভুলে যাবে ৷ কিন্তু আমি অন্তত অনুর হাসিতে মুগ্ধ হয়ে ভুবনকে ভুলতে পারছিনা ৷ তার প্রতি আসলে সেরকম কোনো অনুভূতিই নেই ৷ হয়তো মোহের চক্করে পড়ে ক্ষণিকের জন্য তৈরি হয়েছে ভাললাগা, কিন্তু প্রেমে পড়ার মত একবিন্দু অনুভূতিও নেই এই মনে ৷ আমি তো নিজেই অবাক হয়ে যাই আমার কঠিন মনের অনুভূতির মারপ্যাচ দেখে!
ভাবনায় ডুব দিয়ে এতসব চিন্তা করছিলাম ৷ হঠাৎ ভাবনার সাগর ছেড়ে বাস্তবে ফিরে অনুর দিকে দৃষ্টি দিলাম ৷ মেয়েটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ৷ মায়াভরা দৃষ্টি বিনিময় ৷ তার চোখে জাদু রশ্নি দেখতে পাচ্ছি ৷ আমি নিশ্চিত, ঐ চোখ দিয়ে যদি কোনো নরম মনের পুরুষের দিকে সে তাকায় তাহলে তার তাকানোতেই ঘায়েল হয়ে যাবে সেই পুরুষ ৷ চোখ দিয়েই নারীরা পুরুষদের ঘায়েল করে ৷ যে নারীর চোখ দেখে পুরুষ তৃপ্ত হয়না, সেই পুরুষ কঠোর মনের হয় ৷ আর এমন পুরুষের কপালে কঠিন স্বভাবের বউ জোটে!
অনুর চেহারা বরাবর কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে চলতে লাগলাম ৷ বেশ কিছু পা ফেলার পর কি মনে করে যেন পিছন ফিরে তাকালাম ৷ পিছনে তাকিয়ে দেখি অনু নেই ৷ সে হয়তো গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হযেছে জোরালো পায়ে ৷ কুয়াশার জন্য তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছেনা ৷ সোজা পথ ধরেই গেল নাকি অন্যপথ দিয়ে গেলে এটা দেখারও জো হলোনা!
.
.
চাচার বাড়ি পৌঁছে সোজা ড্রয়িং-রুমে প্রবেশ করলাম ৷ খাবার টেবিলে সবাই উপস্থিত ৷ শুধু চাচা নেই ৷ ভাল হয়েছে ৷ চমকে উঠলাম অনুকে দেখে ৷ সে এখানে কেন? তার না বান্ধবীর বাসায় যাবার কথা! তারমানে যায়নি? নিশ্চয় অন্য পথ দিয়ে আমাকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি চলে আসছে ৷ কিন্তু এরকম করে কি লাভ হলো তার? বিস্ময়ের আঁখির দৃষ্টি অনুর চোখে ডুবলো ৷ সে এখন অন্য বোরখা পড়ে আছে ৷ চোখ বাদে পুরো চেহারা আবৃত আছে ৷ হতভম্বরের চোখে তাকাতে ভাললাগছিল ৷ অনু মাথা নিচু করে আছে ৷ আজব ব্যাপার! একটু আগে দুষ্টুমি করলো, তখন লজ্জা ছিলনা ৷ এখন জগতের সব লজ্জা তাকে ঘিরে ধরেছে ৷ যেন সে লজ্জাবতী ৷ আমি চোখের আঁচর কেটে তাকে চুপসে দিয়েছি ৷ এজন্যই সে এমন লাজুকরাণীর ভান ধরেছে ৷ অনুর পাশে চাচী দাঁড়ানো ছিলেন ৷ তিনি আমাকে দেখেই হাস্যজ্জ্বল মুখে বললেন,
----নীল আসো, নাস্তা করো ৷
.
চাচীর কথামত চেয়ারে বসে পড়লাম ৷ রুটি, গোশতের ঝোল প্লেটে দিলো ভাবী ৷ ভাবীর দিকে আড় চোখ তাকিয়ে ফের অনুর দিকে নজর দিলাম, অতঃপর দৃষ্টিটা পুনরায় ভাবীর দিকে নিক্ষেপ করে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, “অনু এমন কেন?"
ভাবী আমার চোখের ইশারা না বুঝে কপালে ভাঁজ ফেলে বুঝালো সে কিছু বুঝেনাই আমার ইশারা! গলা ঝেড়ে হালকাভাবে কাশি দিয়ে উচ্চস্বরেই বললাম,
----ভাবী, আমার চাচাতো বোনটার আচরণে কষ্ট পাচ্ছি ৷ সে আমাকে হতাশ করছে ৷ বারবার মুখ ঢেকে রাখছে কেন? এমন তো না যে তাকে দেখে প্রেমে পড়ে যাবো!
তাহলে এতো ঢেকেঢুকে থাকতে হবে কেন?
.
খাবার টেবিলে চাচা ছিলনা বলে কথাটা এত সহজে বলতে পারলাম ৷ চাচী ঠিকই আমার কথায় লাজুক হাসি হাসলো ৷ অনু যেন রাগে গজগজ করছে ৷ চোখের দিকে নজর দিয়ে দেখলাম অনুর চোখদ্বয় রাগের চোটে রক্তিম হয়ে গেছে ৷ বুঝতে পারলাম সে শুধু নরম স্বভাবের দুষ্টু মেয়েই নয়, সেইসাথে কঠোর স্বভাবের রাগী মেয়ে ৷ কিন্তু বুঝিনা, রাতে ও একটু আগে যে মেয়ে চেহারা দেখালো, রোমান্স করলো সেই মেয়ে এখন এতো খোলসে আবৃত হয়ে গেল, বুঝছিনা এসবের মানে!
.
নাস্তা শেষ করে বাসার পিছন সাইটের বাগানের দিকে গেলাম ৷ অসংখ্য গাছ বাগানে দেখতে পেলাম ৷ কুয়াশা হারিয়ে গেছে সূর্যের প্রখর আলোয় ৷ একারণে গাছগুলোর পাতা স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি ৷ ফল গাছের সংখ্যা অধিক ৷ ফল গাছের মধ্যে পেয়ারা গাছ সংখ্যায় বেশি দেখছি ৷ ছোটবেলা থেকে নেশা ছিল পেয়ারার প্রতি ৷ পেয়ারা পেলে খুশি মনে খেতাম সেসময় ৷ আজ গাছে পেয়ারা দেখামাত্র দুটা পেয়ারা গাছ থেকে পাড়লাম ৷ গাছগুলো তেমন উঁচু না হওয়ায় গাছে উঠতে সমস্যা হলোনা ৷ গাছের শক্ত ডালে দাঁড়িয়ে থেকে পেয়ারা খাচ্ছিলাম ৷ হঠাৎ, খিলখিল করে হাসতে থাকা নারী কন্ঠের হাসি শুনতে পেলাম ৷ হাসির শব্দ পরিচিত মনে হলো ৷ অনুর হাসির শব্দের মত লাগলো ৷ গাছ থেকে মাটির নিচে তাকিয়ে দেখি অনুই দাঁড়ানো ৷ সেই হাসছিল শব্দ করে, এখন নিঃশব্দে হাসছে ৷ কিন্তু তার বেশভূষা দেখে আঁতকে উঠলাম ৷ নিজের চোখকে এখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল ৷ ভাবলাম চোখ দুটো নষ্ট হয়ে গেছে ৷ এছাড়া তো এমনটা দেখার কথা ছিলনা ৷ চোখে ডলা দিয়ে ফের তাকালাম অনুর দিকে ৷ কিন্তু না, ঠিকই তো দেখছি ৷ চোখে সমস্যা নাই ৷ অনু সাদা টিশার্ট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷ পড়নে শর্টস জিন্স ৷ আমার মনটা ইরইর করছে অনুকে দেখে ৷ কেমন যেন লাগছে দেহের ভেতর ৷ তাকাতে লজ্জা লাগছে কিন্তু নির্লজ্জ চোখ বারবার ওর দিকেই নজর দিচ্ছিল ৷ মনও বলছিল, “দেখতে থাকো ৷ সমস্যার তো কিছু নাই ৷ শহরে তো এটা কমনই ৷ গ্রামের কাউকে প্রথমবারের মত এভাবে দেখে নাও ৷ অভূতপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে পশ্চিমা পোশাকে কেমন লাগে এটা দেখাতেই হয়তো সে তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ৷ খবরদার তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরাবেনা ৷ দৃষ্টি তার দিক থেকে সরালেই সে ভাববে তাকে ভাললাগছেনা ৷ এতে সে কষ্ট পাবে ৷ অথচ তাকে আকর্ষণীয় লাগছে!! এটা তার মনে সায় দিতে তাকিয়ে থাকো, অপলকে"
মনের আবলতাবল কথাতে সম্মোহিত হয়ে গেলাম ৷ অনুর রুপসাগরের ঢেউয়ের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে থম মেরে তাকিয়ে রইলাম ৷ হঠাৎ, অনু চেঁচিয়ে উঠে বলল,
----এবার নজর সরান ৷ অনেক দেখেছেন ৷ চোখ কানা হয়ে যেতে পারে ৷ আমার রুপ আগ্নেয়গিরি অগ্নিপাতের স্ফুলিংগের লাভার ন্যায় মারাক্তক তেজদিপ্ত ৷ চোখে অগ্নির ঝলকানী লাগলে চোখ শেষ ৷ তখন আর পৃথিবী দেখতে পারবেন না ৷ আমার জন্য এত সাধের পৃথিবী দেখা থেকে বঞ্চিত হন, চাইনা ৷ বুঝলেন?
.
আমার কান শুধু অনুর কথা শুনলো ৷ কিন্তু স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারলোনা ৷ কিছু কিছু সময় নারীর রুপে মোহগ্রস্ত হয়ে গেলে পুরুষেরা বোবা হয়ে যায় ৷ নির্বাক সিনেমার মত কথা বের হয়না মুখ দিয়ে ৷ এমনকি নিশ্চল হয়ে যায় ৷ কথা তো বলতে পারেই না, নড়াচড়াও করতে পারেনা ৷ আমার অবস্থা এমন হয়েছে ৷ অনুর দিকে এখনো তাকিয়ে আছি নৈস্বর্গিক সুখ লুটিয়ে নিতে ৷ কিন্তু আমি বোবাবেশ ধরে দাঁড়িয়ে আছি দেখে অনু গলার স্বর উঁচু করে ধমক মেরে বলল,
----কি ব্যাপার! কথা বলছেন না কেন? ভূতে ধরেছে? কি ঢিল মারবো? একদম মাথায় লাগাবো ৷ মারবো?
.
এবারো কথার উত্তর দিলাম না ৷ অনু আমার প্রতিক্রিয়া না দেখে হাতে একটা ঢিল নিয়ে ছুঁড়ে মারলো আমার দিকে ৷ বুক বরাবর ঢিলটা লাগলে মোহের জগৎকে দূরে ঠেলে বাস্তবে ফিরে তোরজোর কন্ঠে অনুকে বললাম,
----অনু, কি করছোটা কি? পাগল হলে নাকি? ব্যথা পেলাম তো ৷ ইশ!
অনু তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
-----উহ! ব্যথা পায়ছে ৷ ভাল হয়েছে ব্যথা পেয়েছেন ৷
----তুমি তো এত নিষ্ঠুর ছিলে না!
----নিষ্ঠুর হতে হয়েছে ৷ যাহোক, এখন বলেন আমাকে এমন ড্রেসে কেমন লাগছে? আবেদনময়ী কিংবা গর্জিয়াস লাগছে না?
----কেমম লাগছে সেটা বলবোনা ৷ তবে শুনে নাাও তোমাকে পর্দানশীল হিসেবেই ভাল মানায় ৷ কিছু কিছু নারীর নিজস্বতা রয়েছে, তাকে ঐ নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বৈচিত্রেই মানায় ৷ তুমি সেই বৈচিত্র থেকে বেড়িয়ে এসেনা ৷
----হয়েছে এতো জ্ঞান দিতে হবেনা ৷ আমি কারো জ্ঞান নিইনা! থাকেন গাছে, পেয়ারা খান ৷ আমি গেলাম!
----এক কাজ করো ৷ গাছে উঠে পড়ো ৷ দুজনে মিলে পেয়ারা খাই ৷ ভাললাগবে!
----না, আপনি থাকাকালিন গাছে উঠলে বাড়ির কেউ দেখে ফেললে ভাববে আপনার সাথে ভাব হয়ে গেছে ৷ তখন দেখা যাবে জোর করে আপনার সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে ৷৷ আমি আবার আপনার মত ভেজা বিড়ালকে বিয়ে করতে কিছুতেই চাইনা!
----কিহ? আমি ভেজা বিড়াল?
----তো কি? উপরে উপরে সাধুগিরি দেখান, ভেতরে তো লুচ্চাদের মত স্বভাব ৷ আপনি নিশ্চয় এখন ভাবছেন, ইশ! অনু যদি আরো একটু রগরগে ড্রেস পড়তো!
----নাউজূবিল্লাহ! আমি কখন এমনটা ভাবলাম?
----চুপ করেন ৷ ঐ যে ঐদিকে তাকান গাছে একটা পাঁকা লাল টকটকে আম পেঁকে আছে!
.
আমি অন্যদিকে ফিরে বারবার পেয়ারা খুঁজছিলাম ৷ কিন্তু পরে মনে হলো আরেহ অনু তো পেয়ারার কথা বলেনি, আমের কথা বলেছে ৷ পেয়ারা গাছে আম পাঁকবে কেমনে?
রাগান্ন্যিত চোখ নিয়ে অনুর দিকে তাকাতে চেহারাটা ঘুরালাম ৷ কিন্তু অনুর অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না ৷ পালিয়েছে সে!
.
গাছ থেকে নেমে চললাম আমার রুমের দিকে ৷ রুমে প্রবেশ করতেই আম্মুর ফোন এলো ৷ রিসিভ করে কথা বলতে লাগলাম ৷ আম্মু উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
----তোর জন্য সুখবর আছে ৷
আমি কৌতূহলী কন্ঠে বললাম,
----কিসের সুখবর মা?
----পাশের বাসার সেই মেয়েটা, মানে অনিতার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে ৷
----এটা খুশির খবর কেমনে হয়?
----কি বলিস? খুশির সংবাদ না? আচ্ছা, আগে পুরোটা শোন ৷ এখন অনিতার বাবা, মা চাচ্ছে তোর সাথে বিয়েটা দিতে ৷ তুই তো বলতিস মেয়েটা খুব ভালো ৷ আমি জানি তুই মেয়েটাকে পছন্দ করিস ৷ যদি তুই বিয়েতে মত দিস তাহলে বিয়ের দিন তারিখ পাকা করতে পারি!
.
একটু রাগস্বরে বললাম,
----কিহ? তোমার মাথা ঠিক আছে মা? আমি করবো অনিতাকে বিয়ে? তুমি না মা! .
আম্মু হতাশার কন্ঠে বলল,
----তুই তো বলতিস মেয়েটা খুব ভাল ৷ তাছাড়া অনিতা আমাকে অনেক দিন বলেছে সে তোকে পছন্দ করে ৷ এজন্য ভাবলাম..
----মা, থাম ৷ অনেক বলেছো, এবার ফোনটা কাটো!
.
ফোনটা কেটে গেল ৷ আম্মুর মুখ থেকে আজগুবি কথাগুলো শুনে বিরক্ত আমি ৷ মুড অফ হয়ে গেল ৷ এখন মুড ভাল করার উপায় বাইরে থেকে ঘুরে আসা! যদি জঙ্গলে সেই মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে খুব ভাল হতো ৷ মনও চাচ্ছে তার সাথে দেখা হোক ৷ খুব কাছাকাছি হয়ে দু'টা কথা বলা যাবে ৷ কিন্তু তার সাথে কি দেখা হবে?
ঢাকা থেকে আনা ক্যামেরা নিয়ে রুম থেকে বের হলাম ৷ ভাবী আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে মৃদ্যুস্বরে বলল,
----নীল, কই যাও?
আমি উত্তর দিলাম,
----এইতো, একটু নদীর দিকে যাবো ৷ অনেক বছর পর গ্রামে আসা ৷ একটু গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে যাই ৷
----সঙ্গে অনুকে নিয়ে যাও, ভাল হবে ৷
----না না, ওকে নেওয়া যাবেনা ৷ ও কেমন যেন!
----কেমন? যাহোক, যেমনই হোক, তাকে নিয়ে যাও ৷ সে বাইরে খুব কমই বের হয় ৷ কিন্তু তোমার সাথে ঠিকই যাবে ৷ আমি বলছি সে যেন তোমার সাথে যায় ৷
.
পড়ে গেলাম বিপাকে ৷ ভাবী তো জোর করেই অনুকে আমার সাথে পাঠিয়ে দিচ্ছে ৷ ভাবী তাকে ডেকে আনলো ৷ অনু আপাতমস্তক ঢেকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ৷ ভাবী তাকে আমার সঙ্গে যেতে বলল ৷ অনু হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললোনা ৷ কিছুক্ষণ চুপ থেকে একদম নিচু স্বরে সে আমাকে বলল,
-----চলুন!
.
অনুর কথার মধ্যে ভদ্রতা আর সম্মানের নিদর্শন দেখলাম ৷ এটা আমাকে মুগ্ধ করলো ৷ নারী আসলেই রহস্যময় ৷ কখন যে কোন রুপ ধারণ করে বুঝা মুশকিল ৷ একটু আগে সে ছিল পশ্চিমা নারী, লজ্জার লেশমাত্র ছিলনা ৷ এখন সে এতটাই পর্দানশীল হয়েছে যে লাজরঙ্গা লজ্জাবতীর মত লাগছে ৷ তাছাড়া তারমধ্যে সৌজন্যবোধের অন্যরকম নিদর্শন খুঁজে পেলাম!
অনুকে সঙ্গে নিয়ে নদীতে গিয়ে পৌঁছলাম ৷ রোদের কারণে নদীটার সৌন্দর্য দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে ৷ তাকিয়ে দেখছি নদীর পানির সৌন্দর্য ৷ নদীর ভেতরের নৌকাগুলো নদীর সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দিয়েছে ৷ দেখতে দারুণ লাগছে ৷ চোখের তৃপ্তি দিচ্ছে ৷ অনুর দিকে তাকালাম ৷ সে এখনো লাজুক ভাব নিয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মত দাঁড়িয়ে আছে ৷ মৃদ্যু স্বরে তাকে বললাম,
----শোনো, তুমি এখানে থাকো, আমি জঙ্গলে যাবো!
.
অনু মাথা ঝাকালো ৷ তারমানে সে এখানে থাকবে ৷ আমি চলে যাওয়াতে তার সমস্যা হবেনা!
.
মনে মনে সেই মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে জঙ্গলে গিয়ে পৌঁছলাম ৷ জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়লাম ৷ হঠাৎ, সেই মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে গেল ৷ আমার থেকে ২০-২৫ হাত দূরে দাঁড়ানো সে ৷ আমাকে দেখে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলো ৷ আর আমি মনমুগ্ধের মত বিমোহিত নয়নে তাকে দেখছি ৷ ভাললাগছে ৷ তাকে দেখামাত্র মুহূর্তেই এ হ্নদয়ের গহীনে কেমন অদ্ভুত রকমের ভাললাগা তৈরি হয়ে গেল ৷ শরীরে কি অসাধারণ ভাললাগার অনুভূতিই না টের পাচ্ছি! মেয়েটার কাছে যেতে পা বাড়ালাম ৷ কিন্তু মেয়েটা ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে ৷৷ আচমকা গাছের আড়াল হয়ে গেল সে ৷ পিছু নিলাম তার ৷ কিন্তু তাকে আর খুঁজে পেলাম না ৷ বুঝতে পারছিনা সে এই জঙ্গলে কি করে? তার বাড়ি কোথায় জানা খুব জরুরি ৷ কিন্তু জানতে পারবো কেমনে? ক্যামেরাতে তার একটা ছবি তুলতে পারলে ভাল হতো ৷ অনুকে দেখালে সে ঠিকই বলতে পারতো মেয়েটার কথা ৷ আরো কিছুক্ষণ জঙ্গলের ভেতর হাঁটলাম ৷ আর মেয়েটাকে খুঁজতে লাগলাম ৷ হাঁটতে হাঁটতে অপরিচিত একটা ফল গাছের সামনে পড়লাম ৷ গাছের ডালগুলো ফলের ভারে ঝুলে পড়েছে ৷ অন্যরকম ফল ৷ এরআগে কখনো দেখিনি ৷ লাল টকটকে ৷ আপেলের মত লাগছে ৷ লাফিয়ে একটা ফল পাড়লাম ৷ দারুণ দেখতে ৷ আপেলের সাদৃশ একদম ৷ নিশ্চয় স্বাদও আপেলের মত হবে ৷ লোভ শামলাতে পারলাম না ৷ কামড় দিলাম ফলে ৷ দুটা কামড় দিয়ে সেটা তৃপ্তি সহকারে খেতে লাগলাম ৷ কিন্তু না এই ফলের স্বাদ আপেলের মত নয়, এটা তো টক লাগছে ৷ হঠাৎ করে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো ৷ এরপর কিছু মনে নেই!
অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম ৷ জ্ঞান ফিরে দেখি আমি জঙ্গলের ভেতরেই শুয়ে আছি ৷ পাশে অনু বসে আছে ৷ নীল শাড়ি পড়া ৷ তার গায়ে বোরখা না দেখে অবাক হলাম ৷ অনু ধীরকন্ঠে বলল,
----হুম, চলেন এবার বাড়িতে যাওয়া যাক ৷ দুপুর হয়ে গেছে ৷ আপনি কমপক্ষে ৩ ঘন্টা অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন ৷
চমকে ওঠা অভিব্যক্তিতে তাকে বললাম,
----এতক্ষণ, অজ্ঞান ছিলাম? একটা ফল খেয়ে এই অবস্থা!
-----ওটা বিষাক্ত ফল ৷ খাওয়া মাত্র বেহুশ হয়ে যায় মানুষ ৷ আপনি কেন খেতে গেলেন?
-----ভুল করেছি ৷ তো চলো বাড়ি যাওয়া যাক ৷
----আপনি যান, আমি আসছি!
----কি বলো, এই জঙ্গলে তোমাকে একা রেখে যাবো?
-----আরে আমি আসছি তো ৷ যান আপনি!
.
অনুকে রেখেই বাড়ির দিকে গেলাম ৷ বাড়িতে পৌঁছেই দেখি অনু বারান্দায় বসে কাঁদছে ৷ মুখ ঢাকা রেখেই কাঁদছে ৷ তার কান্নার কি কারণ হতে পারে?
ভাবী আমাকে দেখে নিচু আওয়াজে বলল,
----ও কাঁদছে বিয়ের কথা চলছে ওর কয়দিন ধরে ৷ আজ বিকেলে পাত্র আসবে! কিন্তু অনু বিয়ে করতে চাচ্ছেনা ৷ মাত্র এইচএসসি পাশ করে বেড়িয়েছে ৷ ঢাকায় যাবে ভর্তি পরীক্ষা দিতে ৷ প্রস্তুতি নিয়েছে ৷
ভাবীর কথা শুনে অবাক হলাম ৷ আমি আট বছর আগে গ্রামে যখন ছিলাম তখন অনু ক্লাস ৮ এর ছাত্রী ছিল ৷ এখন তার অনার্স শেষ করার কথা ৷ অথচ সে কেবল এইচএসসি দিলো? তারমানে পড়া বাদ দিয়েছিল নাকি? ভাবীকে এটা জিজ্ঞেসা করলে সে বলল,
----অনুর লেখাপড়া স্থগিত ছিল ৪ বছর ৷ তুমি হয়তো জানোনা অনু....
.
চলবে....
.
আগের পর্ব লিংক

(পর্বঃ ৩)
লিখাঃ Sifat Arnab Rehan.
.
----অনুর লেখাপড়া স্থগিত ছিল ৪ বছর ৷ তুমি হয়তো জানোনা অনুকে এসিড মারা হয়েছিল ৷ মুখ কিছুটা ঝলছে গিয়েছিল ওর ৷ দীর্ঘ ১ টা বছর ট্রিটমেন্ট করা হয় ৷ মুখের একপাশে ঝলছে যাওয়ায় অনুর সার্জারি করা হয় ৷ এতে চেহারা পাল্টে যায় পুরোপুরি ৷
.
অনুর এতবড় সর্বনাশ করা হয়েছে অথচ আমি জানতাম না ৷ এরকম একটা কথা কিভাবে লুকিয়ে রাখলো তারা? ভাবীর থেকে এই সত্যটা জানতে পেরে মনঃকষ্টের উদয় হলো ৷ বিষাদে মনটা ভরে উঠলো ৷ নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ৷ ভাবীকে বিতৃষ্ণার কন্ঠে বললাম,
----বুঝলাম না, আমাকে কেন এটা জানানো হলোনা?
.
ভাবী চোখে মুখে চিন্তার ছাঁপ ফেলে বলল,
----এর কারণটা তো আমি জানিনা ভাই ৷
----কিন্তু অনুর এতবড় সর্বনাশ কে করলো?
----অনুর ভার্সিটির একটা বখাটে ছেলের কাজ ওটা ৷ ভার্সিটিতে অনু ১ মাস ক্লাস করেছিল ৷৷ এরমধ্যে ছেলেটার নজরে পড়ে যায় ৷ খুব বাজে প্রকৃতির ছিল ছেলেটা ৷ কোনো সুন্দরী মেয়ের দিকে তার নজর পড়লে সেই মেয়েকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতো ৷ ফ্লর্ট করে কিংবা টাকার লোভ দেখিয়ে মেয়েদের কাবু করতো ৷ কিন্তু অনুকে সে কিছুতেই প্রেমের প্রস্তাবে রাজি করাতে পারছিলনা ৷ বদ-চরিত্রের বখাটে এই ছেলেটার বাবা ছিল শহরের সরকারি কলেজের শিক্ষক ৷ উচ্চবিত্ত হওয়ায় ছেলেটা কোনো কিছুকে পরোয়া করতোনা ৷ শেষবার যখন অনুকে ছেলেটা বাজে কাজের জন্য প্রস্তাব দেয় তখন অনু তাকে ক্যাম্পাস ভর্তি শিক্ষার্থীর সামনে কষে থাপ্পর মারে ৷ ঐদিন ছেলেটা অনুকে কিছু না করলেও পরদিন ক্যাম্পাসে অনুর মুখে এসিড নিক্ষেপ করে ৷ ভাগ্যিস ছাত্রছাত্রীরা বিষয়টা অবলোকন করেছিল ৷ যাদের নিকট পানির বোতল ছিল তারা ততক্ষণাত অনুর চেহারায় পানি ঢালে ৷ ক্ষণিক পর কয়েকজন ছাত্রী ধরাধরি করে অনুকে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে অনবরত চেহারাতে পানি ঢালে ৷ এরপর তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয!
.
ঘটনাটা শুনে যতটা না কষ্ট হচ্ছিল তারচেয়ে বেশি রাগ হচ্ছিল ৷ আমি কি দোষ করেছিলাম যে অনুর সাথে এত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল অথচ আমাকে জানানো হলোনা? বখাটে ছেলেটার প্রতি এতটা রাগ হচ্ছিল যে যদি বদমাইশটাকে হাতের নাগালে পাইতাম তো ওরে কাঁচায় কচকচ করে গিলে খেতাম, না পারলে আগুনে পুড়িয়ে মটমট করে খেতাম ৷ যদি ওর মাংস খেতে অসহ্যকর লাগতো তাহলে কুত্তা দিয়ে খাওয়াতাম ৷ জানোয়ারের বাচ্চার এতবড় সাহস কি করে হয়েছিল? ওর কলিজা কতবড়? ওর কলিজাটা টান দিয়ে চিরে ফেলে দেখতে হবে ৷ আমার রাগী সত্তা বলছে, “পশুটাকে এখনই খুঁজতে নেমে পরো, তাকে হাতের নাগালে পেলে কুচিকুচি করে কেটে সেগুলো ওর পরিবারের লোকদের নিকট ফেক্সিলোড করে পাঠিয়ে দিও!" আমার শত্রুর কথা মনে পড়তেই রাগ ক্রমেই বেড়ে চলছিল ৷ রাগকে দমন করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছিল ৷ তথাপিও, রাগটা অন্তরে চেপে শক্তকন্ঠে ভাবীকে বললাম,
----ঐ জানোয়ারটার কি হয়েছিল?
.
ভাবী রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
----বদমাইশটাকে অনু নিজেই খুন করেছে!
.
একথা শুনে স্তব্দ হয়ে গেলাম ৷ বিশ্বাসযোগ্য মনে হলোনা ৷ অনুর মত এতটা সহজ সরল মেয়ে কাউকে খুন করবে এটা কিছুতেই বিশ্বাস করা যায়না ৷ হতবাক হয়ে অনুর দিকে নজর দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ৷ অতঃপর ভাবীর দিকে নজর দিয়ে ভ্রু কুঁচকিয়ে বললাম,
----এটা কি বিশ্বাস করতে হবে? আমি অন্তত পারছিনা বিশ্বাস করতে ৷
.
ভাবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
----রিভেঞ্জ বলতে একটা কথা আছে, বুঝলে? প্রতিশোধের আগুন মানুষের শিরা উপশিরায় মিশে থাকে ৷ সময় মত সেই আগুন দাউ করে জ্বলে ওঠে ৷ তখন সেই মানুষটি অগ্নিমানবে রুপ নেয় ৷ অনু অগ্নিমানবী হয়ে গিয়েছিল ৷ তবে এটা সত্য যে আমি বাদে কেউ জানেনা যে ছেলেটাকে অনুই খুন করেছে!
.
কপালে ভাঁজ ফেলে গভীর ভাবনায় ডুব দিলাম ৷ অনু এখনো কেঁদে চলছে ৷ তার কান্না থামলে ভাল লাগতো ৷ ভাবীকে মৃদ্যুস্বরে বললাম,
---ঠিকই বলেছেন ৷ প্রতিশোধের নেশা মানুষকে হিংস্র বানিয়ে ফেলে ৷ আসলে নারী বা পুরুষ উভয় মানব সত্তার দুটা রুপ রয়েছে ৷ একটা নিরিহ সত্তা আরেকটি হিংস্র ৷ উপযুক্ত সময়ে মানুষ সেই রুপ ধারণ করে ৷ কিন্তু অনু খুনটা কেমনে করলো?
.
ভাবী আড়ষ্ট কন্ঠে বলল,
-----সেটা আমি তো বলতে পারবোনা ৷ অনু এটা আমাকেও বলেনি ৷ তুমি হয়তো তার থেকে জেনে নিতে পারবে ৷
-----না, আমাকে সে কখনোই বলবেনা ৷ আচ্ছা ভাবী, অনুকে তো আজ দেখতে আসবে ৷ পাত্রপক্ষকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?
----ভালোই তো হয় ৷ কিন্তু এটা করা ঠিক হবেনা!
----ঠিক বেঠিক পরে ৷ আমি যে করে হোক পাত্রপক্ষকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করবো!
----বুঝছো না কেন? পাত্র অনুর বাবার বন্ধুর ছেলে ৷ উপজেলা চেয়ারম্যান পাত্রের বাবা ৷ এমন সম্মানিত ব্যক্তিদের অসম্মান করা যাবে? আমি তো ভাবছি বিয়েটা আবার ঠিকঠাক হয়ে না যায় ৷ তাহলে অনুর স্বপ্ন শেষ!
----বিয়ে হবেনা ৷ চিন্তা করবেন না ৷ আমি অন্তত অনুর স্বপ্ন শেষ হতে দিবনা ৷
.
কথাটা বলেই অনুর কাছে গেলাম ৷ সে এখনো চোখের ঝর্ণাধারা ঝরাচ্ছে ৷ মনে হচ্ছে চোখের পানিতে প্লাবিত হয়ে যাবে বারান্দা ৷ নারীরা সামান্য কারণেই কাঁদে ৷ সেখানে মনের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে এজন্য কাঁদবেনা, এটা তো হতে পারেনা ৷ চোখের পানিতে নেকাপটা ভিজে গেছে তবুও সে কান্না থামাচ্ছেনা এমনকি নেকাপও খুলছেনা ৷ আমি বুঝিনা, অনু কি বহুরুপী নাকি? আমরা দুজনে যখন লোকজনের আড়ালে থাকি তখন তার নির্লজ্জতা লক্ষ্য করি ৷ আর যখন লোকজনের সামনে থাকি তখন খোলসে আবৃত হয় সে ৷ গলা ঝেড়ে অনুকে মৃদ্যুস্বরে বললাম,
----হু, হয়েছে অনেক কেঁদেছো ৷ এবার একটু শান্ত হও ৷ চোখ দুটো বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে ৷ তারা একটু বিশ্রাম চাচ্ছে ৷ এতক্ষণ কাঁদলে কি চলে? কিসের জন্য কাঁদছো এত? আমি কথা দিলাম এই বিয়ে যাতে না হয় এজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ৷ দেখো বিয়েটা ঠিকই ভেঙ্গে যাবে ৷ সো, এখন শান্ত হও!
.
অনু হাতের তালু দিয়ে চোখের পানি মুছলো ঠিকই কিন্তু পুনরায় অশ্রুধারার কয়েক ফোঁটা বারি চোখের কোণে এসে জমলো অতঃপর গড়িয়ে পড়তে লাগলো ৷ অনু আমার কথা শুনে নড়েচড়ে বসলো ৷ আমার দিকে রাগী চোখে তাকালো ৷ এখন তার চোখ দুটোকে শিকারী চোখের ন্যায় লাগছে ৷ এবার বিশ্বাস হচ্ছ সে কিসের জোরে খুনী হয়েছিল এবং কিসের ক্ষমতায় কাউকে খুন করেছিলো! তার মনে সাহসের রাজ্য লুকানো আছে, আর সেই সাহসকে পরিচালনা করে তার রাগ ৷ তার রাগের কিঞ্চিৎ রুপ মাত্র লক্ষ্য করলাম ৷ এই মেয়ে প্রয়োজন মত ভয়ানক রুপ ধারণ করতে পারে ৷ অনু অকস্মাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল,
----আপনাকে নাক গলাতে বলিনি ৷ আপনি যে কারণে এই বাড়িতে আসছেন সেই কাজ করেন!
.
অনুর কথা শুনে মাথায় টং করে শব্দ হলো ৷ আঘাত লেগেছে তার কথায় ৷ মুখটা এতটুকু বানিয়ে অনুর কাছ থেকে চলে এলাম!
.
পাত্রপক্ষ বাসায় আসলো ৷ পাত্রপক্ষ আসার পর অনুর কান্না যেন বেড় গেল ৷ মেয়ে মানুষের কান্না আমার সহ্য হয়না ৷ অনুর কান্না আরো সহ্য হচ্ছেনা ৷ হঠাৎ, আমার ফোনে আম্মার কল এলো ৷ ফোনটা রিসিভ করলাম ৷ আম্মু জোরালো কন্ঠে বলতে লাগল,
----নীল কি হয়েছে জানিস?
আমি নরম কন্ঠেই বললাম,
----কি হয়েছে মা?
----পাশের বাসার মেয়েটা..
----হুম, অনিতা ৷ তো তার আবার কি হলো?
----একটা ছেলের সাথে ভেগে গেছে ৷
.
কথাটি শুনে হাসি আর চেপে রাখতে পারলাম না ৷ খিলখিল করে, আবার খিকখিক করে উচ্চ শব্দে হাসতে লাগলাম ৷ আমার হাসির শব্দ শুনে অনুর কান্না বন্ধ হয়ে গেল ৷ যাক, ভালই হলো ৷ আম্মুকে জবাব দিলাম,
----এটা তো খুশির সংবাদ মা ৷ এই খুশিতে এক কাজ করো ৷ গ্রামে চলে আসো ৷ একটা ভোজনসভার আয়োজন করি মা ছেলে মিলে ৷ হা হা হা ৷ এই মেয়ের সাথে তুমি আমার বিয়ে ঠিক করতে চাচ্ছিলে!
----হ রে, মস্তবড় ভুল করতে চাচ্ছিলাম ৷ আর সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটা পালিয়েছে ওদের বাসার ড্রাইভারের সাথে ৷ ড্রাইভারটা নাকি ওর চাচাতো ভাই ছিল!
গ্রামে থাকতো ওর চাচারা ৷ ছেলেটা অর্ধশিক্ষিত ছিল ৷ মেয়েটার রুচি আসলেই খারাপ!
.
এবার কেন যেন হাসি এলোনা ৷ উল্টা বিষম খেলাম ৷ আম্মুকে ফোন কাটার কথা বলে ফোনটা কেটে দিলাম!
.
পাত্রপক্ষ ৪৫ মিনিট ধরে অনুকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে ৷ ওদিকে ভাবী ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অনুকে সাজানোর জন্য ৷ ভাগ্যিস অনু এখন কান্না করছেনা ৷ আমি জানি কেন সে কাঁদছেনা! কোনে নারী পাত্রের সামনে যাবার আগে কাঁদেনা ৷ এসময় কাঁদলে তাদের সৌন্দর্যে এক ধরণের কুৎসিত ভাব চলে আসবে ৷ আর কুৎসিত ভাব এলে পাত্রপক্ষ নিন্দাতে পারে ৷ কোনো নারী চায়না পাত্রপক্ষ তাকে দেখে অপছন্দ করুক ৷ যতই সে বিয়েতে অমত থাকুক, এরপরও তারা চাইবে পাত্রপক্ষ তাকে দেখে অন্তত বলুক পাত্রীকে আমাদের পছন্দ হয়েছে!
মিনিট বিশেক পর অনু গোলাপী রঙের শাড়ি পড়ে বেড়িয়ে এলো ৷ কিন্তু মাথায় লম্বা একটা ঘোমটা দেওয়া ৷ মনে মনে বললাম এখন তো বোরখা পড়বানা ৷ কেন পড়বানা ভাল করে জানি!
অনু বসলো ৷ ভাবী আমাকে চোখের ইশারায় কি যেন বুঝানোর চেষ্টা করলো? কিন্তু আমি বুঝতে অপারগ ৷ আমি বুঝিনি তার ইশারার মানেটা কি? তার ইশারার ভাষাটা যে বুঝিনি এটা আমার অভিব্যক্তিতে টের পেলো ভাবী ৷ সে আমাকে তার কাছে যেতে বললো ৷ গেলাম ৷ ফিসফিস করে সে আমাকে বলল,
----তোমার যে কাজটা করার কথা ছিল সেটা করো এবার ৷ এবার যদি পিছিয়ে যাও তাহলে কিন্তু শেষ ৷ তখন অনু কিন্তু তোমাকে ছাড়বেনা, একদম গিলবে!
.
পাত্রপক্ষের সামনে বসা ছিল চাচা, চাচী, অনুর মামা ৷ এতজন মানুষের সামনে আমি কেমনে বিয়ে ভাঙ্গার চেষ্টা করবো? মহা বিপদে পড়ে গেলাম ৷ যদি বিয়ে ভাঙ্গতে না পারি, তাহলে অনুর মাইরের শিকার হতে হবে ৷ যেভাবে হোক বিয়েটা ভাঙতেই হবে ৷ মনের সাথে গবেষণা শুরু করে দিলাম ৷ কি করা যায় এটা নিয়ে মহা চিন্তা গবেষণা চলতে লাগলো ৷ ধাঁ করে পাত্র মিনমিন গলায় তার মামাকে বলল,
----মামা, পাত্রী কি মুখ দেখাবেনা?
.
এই কথাটার উত্তর দিতে আমার মনটা ব্যাকুল হয়ে গেল ৷ মুখ ফসকে বেড়িয়ে এলো,
----মুখ দেখিয়ে কি হবে? পাত্রী আগে পরে সবসময় আপনার নিকট একটা জ্যান্ত পাথর সদৃশ বৈ-কিছুর রুপে থাকবেনা ৷ সে আপনার নিকট পাথর আর মনটা পড়ে থাকবে আমার কাছে!
.
কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় দিলাম ৷ এতবড় সাহস কেমনে হলো আমার?
আমার সাহসিক কথাগুলো শুনতে পেয়ে সবাই আঁতকে উঠলো বলে মনে হলো ৷ চাচা তো হকচকিয়ে উঠে আমার দিকে চোখ উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলো ৷ ভাবীর দিকে নজর দিয়ে দেখি সে ভ্যাঁবাচেকা খেয়ে আমার চোখ বরাবর দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে ৷ অনু চুপচাপ বসে আছে ৷ তার যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই!
আচমকা চাচা জোরালো কন্ঠে বলে উঠলো,
----নীল কি বলছো এসব?
.
আমি এবার ভয়ে কাঁপছি ৷ নির্বাক হয়ে গেলাম ৷ মুখ আটকে গেছে ৷ কে যেন হাতুড়ির আঘাতে মুখটা ভর্তা বানিয়ে দিয়েছে যাতে কথা বলতে না পারি ৷ আমি কিছু বলছিনা দেখে ভাবী রাগস্বরে বলল,
----নীল কি হলো বাবাকে জবাব দিচ্ছোনা কেন? বলো!
.
জগতের সমস্ত ভয়কে মনেতে আমন্ত্রণ জানিয়ে জোরজবরদোস্তি করে কাঁপা গলায় বললাম,
----জি চাচা, ঠিকই বলছি ৷ অনু আর আমি দুজনে একে অপরকে ভালবাসি ৷ আপনারা যদি অনুকে জোর করে বিয়ে দেন তাহলে অনু বিয়ের রাতেই হারপিক খেয়ে মারা যাবে!
.
হারপিকের কথাটা বলা ঠিক হয়নি ৷ ধুর, অন্যকিছুর কথা কেন বললাম না? বিষের কথা বললেই তো হতো ৷ ভাবী কথাটা শুনে মুখ লুকিয়ে হাসলো ৷ আর অনু নড়েচড়ে বসে গম্ভীর গলায় বলল,
----নীল, একটু স্পষ্ট করে বলো!
.
গলা ভাল করে ঝেড়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম,
----হুম, চাচা; আমরা দুজনে একে অপরকে মনেপ্রাণে ভালবাসি ৷ অনুকে আমি বিয়ে করবো ৷ এরপরও যদি চান ওর অন্যকারো সাথে বিয়ে দিবেন তো দেন ৷ জোর করবোনা ৷ কিন্তু মনে রাখবেন, অনুর মনের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দিয়ে ওর জীবনটা নষ্ট করবেন না!
.
চাচা কিছু বললেন না ৷ তিনি লজ্জায় মুখটা এতটুকু বানিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন ৷ ওদিকে পাত্রপক্ষ কোনো কথা না বলে সোফা থেকে উঠে চলে গেলেন ৷ অনু ঘোমটাটা না সরিয়ে আমাকে থ্যাংকস জানিয়ে রুমে চলে গেল!
চাচা এবার আমার দিকে চোখ দুটো গোলগোল বানিয়ে ক্ষিপ্তস্বরে বললেন,
----এটা কি করলে নীল? তুমি অনুকে পছন্দ করো আগে কেন বললেনা? এমন আচরণ আশা করিনি ৷ তোমার বাবার কাছে বিচার দিবো, অপেক্ষা করো!
.
কথাটা বলেই চাচা ফোঁসফোঁস করতে করতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল ৷ চাচীর চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি ৷ নিশ্চয় তিনি খুশি হয়েছেন ৷ না হয়ে উপায় কি? আমার মত ছেলেকে মেয়ের জামাই হিসেবে পেতে কোন মেয়ের মা না চাই?
.
অনুর মামা আমার দিকে বাকা চোখে তাকিয়ে রইলো ৷ বিড়বিড় করে কি যেন বললো? কি বলতে পারে? নিশ্চয় গালি দিয়েছে!
.
রাত ১০:৩২!
আজকে রাতে শীত একটু বেশিই বলে মনে হচ্ছে ৷ শীতের প্রাদুর্ভাব বেশি হওয়ায় দুটা কম্বল গায়ে জড়িয়েছি ৷ আজকেও ঘুম আসছেনা ৷ হঠাৎ, মনে উদয় হলো গতরাতের কথা ৷ অনুর পাগলামীর কথা স্মরণ হতেই গা'টা শিউরে উঠলো ৷ আজকে তার পাগলামী শুরু হবে কি না কে জানে? হতেও পারে ৷ আজকে তার এতবড় উপকার করলাম, খুশির ঠ্যালায় আবলতাবল কাজ করাটা তার নিকট অস্বাভাবিক হবে বলে মনে হচ্ছেনা ৷ আজও মোবাইলে বই পড়ায় মন দিলাম ৷ হুমায়ূন আহমেদের 'সমুদ্র বিলাস' পড়তে লাগলাম ৷ দৈবাৎ, দরজায় খটখট শব্দের সৃষ্টি হলো ৷ নিশ্চয় অনুই কড়া নাড়ছে ৷ ঘরে বাতি জ্বালানোই ছিল ৷ আজকে ভুল করা যাবেনা ৷ বাতিটা জ্বালিয়েই রাখবো ৷ কম্বল ছেড়ে উঠলাম ৷ যদিও মন চাচ্ছিল না ৷ দরজাটা খুললাম এতে ধারাম করে শব্দ হলো ৷ দরজা খুলে দেখি ভাবী দাঁড়িয়ে আছে ৷ তাকে দেখে ইতস্তত বোধ হলো ৷ চুপসে যাওয়া চেহারা নিয়ে তাকে বললাম,
----ভাবী, কিছু বলবেন?
.
ভাবী কথার জবাব না দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলো ৷ এরপর খুব সহজভঙ্গিতে বিছানায় বসে পড়লো ৷ আমি এখনো চিন্তিত ৷ চুপচাপ দুজনে ৷ মনটা খসখস করছিল আমার ৷ এতরাতে ভাবী কি কারণে রুমে এলো বুঝতে পারছিনা! মনে নানা রকম উদ্ভট প্রশ্ন জাগছে ৷ এক মন তো বলেই দিলো, “শোন, তোর চাচাতো ভাই তো শহরে থাকে ৷ ভাবী একাকীত্বে ভোগে ৷ বোধহয় কিছু সময় তোর সাথে সে সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করবে ৷"
ভাবী আমার ফাজিল মনের ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে নরম কন্ঠেই অনুকে ডাকতে লাগলো ৷ ভাবীর ডাকে অনু রুমে প্রবেশ করলো ৷ এখনো সে বোরখা পড়া ৷ মুখ ঢাকা ৷ কেমনটা লাগে? এখন সে মুখ দেখাতে চাচ্ছেনা কেন?
ভাবী নিচু আওয়াজে আমাকে বলল,
----সে তোমাকে কিছু কথা বলবে ৷ বলেই চলে যাবে!
.
অনু ধীরকন্ঠে কাঁপা গলায় বলতে লাগল,
----আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিয়েটা ভাঙার জন্য ৷ কিন্তু যেভাবে বিয়ে ভাঙলেন এরজন্য পরবর্তিতে ঝামেলায় পড়তে হবে আমাদের ৷ বাবা, মাকে আসল সত্যটা আপনিই খুলে বলবেন ৷ আমরা তো একে অপরকে ভালবাসি না ৷ বিয়ের বিষয়টা তো দূর ৷ কিন্তু বাবা, মা তো তখন অসত্যকে সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছে ৷ এখন যেভাবে হোক তাদেরকে সঠিক বিষয়টা খুলে বলতে হবে ৷ একটা উপকার যেহেতু করেছেন, সেহেতু এই উপকারটা করেন!
.
অনুর কথায় মাথা নাড়িয়ে বুঝালাম আমি সব বলবো ৷ অনু আর কোনো কিছু না বলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল ৷ ভাবীও চলে গেল!
.
.
অনু ও ভাবী চলে যাবার মিনিট বিশেক সময় পর চোখে প্রচন্ডভাবে ঘুম এসে জরো হলো ৷ ঘুমিয়ে গেলাম!
আচমকা, হঠাৎ দরজার খটখটানি শব্দ ৷ ভেঙ্গে গেল ঘুম ৷ খুব ভাল স্বপ্ন দেখছিলাম ৷ রাজরাণী আমার পাশে শুয়ে ছিল ৷ তার রুপের জৌলসে বিমোহিত হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে ছিলাম ৷ রাণী আমার দিকে তার রসালো ঠোটদ্বয় এগিয়ে দিয়ে মধুর চুম্বন উপহার দিতে অগ্রসর হচ্ছিল, ঠিক তখনই দরজার খটখট শব্দ আর আমার স্বপ্নভঙ্গ! রাগে আমার মাথার চুল ছিঁড়তে মন চাচ্ছে ৷ এত ভাল স্বপ্ন কি আর ফিরে পাবো? রাগান্বিত মন নিয়ে চললাম দরজা খুলতে ৷ খুললাম দরজা ৷ যেটা ভাবছিলাম সেটাই ৷ অনু দাঁড়িয়ে আছে ৷ অবাক হলাম না তবে বিরক্ত হলাম ৷ সে একদম স্বচ্ছ পাতলা শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷ শরীরের তক্ব যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি! আজকে একটু বেশিই সেজেছে সে ৷ ঠোঁটে হালকা গোলাপী রঙের লিপিস্টিক ৷ ছোট্ট লাল টিপ কপালে ৷ চোখে কাজল ৷ গালে হালকা মেকআপ ৷৷ গা-ভর্তি গহনা ৷ তাকে যে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে এটা নতুন করে বলতে হবেনা ৷ তবে ঝামেলায় পড়লাম আমার পাগল মনদের আবলতাবল চিন্তা-ভাবনা নিয়ে ৷ তারা অনুর সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে যা ইচ্ছা বলছে ৷ আচমকা অনু আমাকে চমকে দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে ঝাঁপটে ধরলো এবং দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো ৷ তার দেহের মাঝে ঢুকে পড়েছি ৷ মনে হলো মাখনের সাগরে ডুবে ভিজে গেলাম ৷ পিচ্ছিল লাগছে, বারবার সাগর থেকে ওঠার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি উঠে আসতে ৷ উচ্চতায় অনু আমার নাক পর্যন্ত ৷ পায়ের উপর ভর দিয়ে আমাকে ঝাঁপটে ধরে আছে সে ৷ তার নাক আমার নাকের সাথে দেবে আছে ৷ দুজনের নিশ্বাস চলাচল অব্যাহত রয়েছে ৷ অনুর নিশ্বাস গভীর হচ্ছিল ৷ ঘণঘণ নিশ্বাস ফেলছিল সে ৷ তার নিশ্বাসের শব্দে আমার দেহে অস্বাভাবিক কাঁপন তৈরি করে দিলো ৷ নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে অনুর দেহের কাঁপন টের পাচ্ছি ৷ হয়তো তার হ্নদস্পন্দন অত্যাধিক হারে বেড়েছে! কিছু বলছেনা সে ৷ যা বুঝানোর নিশ্বাসের ভাষায় বুঝাচ্ছে ৷ হয়তো নৈঃশব্দের মাধ্যমে সে তার ভাব প্রকাশ করতে চাচ্ছে ৷ কিন্তু আমি তো নৈঃশব্দের ভাষা বুঝিনা নিশ্বাসের ভাষাও না ৷ অনু হয়তো বুঝতে পারে!
আমি কিছু বলছিনা দেখে অনু হঠাৎই ক্ষীণস্বরে বলে উঠলো,
----কিছু বলছেন না কেন? থাক, কিছু বলতে হবেনা ৷ যা করতে বলি সেটা করেন ৷ আমাকে মৃদ্যু ভাবে কপালে একটা চুমুর রেখা এঁকে দিবেন ৷ ব্যাস, আর কিছু চাইনা!
.
চলবে.....
.
আগের পর্ব লিংক

#অদৃশ্য_পরী (পর্বঃ ৪)
লিখাঃ Sifat Arnab Rehan.
.
অনুর আবদার মেনে নেওয়ার কোনো মানেই হয়না ৷ কপালে চুমুর দাবী রাখে একমাত্র মনের মানুষ ৷ অনুকে ভাললাগে এটা যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য যে কখনোই সে আমার মনের মানুষ হতে পারবেনা ৷ তার প্রতি সেরকম কোনো চিন্তাভাবনা তৈরি হয়না আমার মনে ৷ ভালবাসার মত কোনো অনুভূতি কেন যেন জাগ্রত হয়না তার প্রতি ৷ তার পাগলামী আচরণে হয়তো দিশেহারা হয়ে যাই আমি ৷ কিন্তু অবুঝ মনটা কখনো বলেনা তাকে নিয়ে অন্যরকম চিন্তা-ভাবনা করো ৷ ক্রমশ অনু আমার বুকের সাথে তার দেহ চেপে ধরছিল ৷ অস্বস্তি ভাব সৃষ্টি হচ্ছিল আমার দেহ ও মনে ৷ কতক্ষণ এরকম নির্লজ্জতা সহ্য করা যায়? নারীর পরশে পুরুষদের হ্নদয়ে অন্যরকম অনুভব ও শিহরণের আবেশ সৃষ্টি হবে এটা স্বাভাবিক, এটা সীমা ছাড়লে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে ৷ আমি নিজেই অনুর নির্লজ্জতার ফলশ্রুতিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবো বলে মনে হচ্ছে ৷ অস্থির অস্থির লাগছিল ৷ এত শীত তবুও অনুর কারণে শরীরে উষ্মতা ভাব সৃষ্টি হয়ে গেল ৷ অনুর আবদার পূরণ করছিনা দেখে সে ঈষৎ রাগস্বরে বলল,
----কি হলো, কই? দেন না! কপালে চুমু দেওয়া কি দোষের কিছু?
.
তাকে কিছু বলতে পারছিনা ৷ নির্বাক দর্শক হয়ে তার দেহের সাথে মিশে আছি ৷ আমি চুমু দিবো কি? অনুই আমার ঘাড় ধরে আমার ঠোঁট তার কপালে স্থাপন করে জড়তামাখা কন্ঠে বলতে লাগলো, “নেন এবার চুমু দেন ৷ বেশি কষ্ট করতে হলোনা আপনার, এবার শুধু কপালে আলতোভাবে পরশ বুলিয়ে দেন!"
আমি তার কথাকে ভ্রুক্ষেপ করলাম না ৷ চুপচাপ রইলাম ৷ এখনো তার কপালে আমার কাঁপতে থাকা ঠোঁট চেপে রাখা আছে ৷ কেন যেন ইচ্ছা করছেনা জোরাজুরি করতে ৷ তার কপাল থেকে ঠোঁট সরাতেও ইচ্ছা করছিলনা ৷ ঠোঁটের পরশ তার কপালে লাগায় আমার ভেতর অন্যরকম ভাললাগার উদ্ভব হচ্ছিল ৷ ক্ষণে ক্ষণে আমি যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিলাম ৷ তাকে ছাড়তে কে যেন বাঁধা দিচ্ছিল? কোনো অদৃশ্য শক্তি আমাকে অনুর প্রতি আকৃষ্টি করার যাবতীয় চেষ্টা করছিল ৷ অনুর গায়ের কাঁপন কমে গেছে অনেকটা ৷ সে আমাকে হঠাৎ করে ছেড়ে দিলো ৷ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম ৷ দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছিল সেটা হারিয়ে গেল ৷ অনু লাজুক ভঙ্গিমায় আঙ্গুলের নখ তার দাঁতে লাগিয়ে দুষ্টমির দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করছিল ৷ মনে মনে বারবার বলছিলাম প্লিজ চলে যাও প্লিজ ৷ আচমকা, অনু এমন একটা কাজ করলো যেটা আমার বেপরোয়া মন কিছুতেই আশা করেনি ৷ মুহূর্তের মধ্যে সে আমার হাতটা ধরে টান দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো ৷ ধারাম করে বিছানায় পড়লাম ৷ তখন তখন অনু আমার গায়ের উপর চড়ে ঠোঁটেে চুম্বন এঁকে দিলো ৷ আলতো একটা চুম্বন দিয়েই রুম থেকে চলে গেল ৷ সে চলে যাওয়ায় মনটা খুশির চোটে নেচে উঠলেও, কপট রাগের ভাবটা থেকেই গেল ৷ রাগমাখা ও হতভম্বের মিশ্র অভিব্যক্তি নিয়ে শুয়ে রইলাম!
.
.
সকালে বারান্দায় বসে ছিলাম ৷ হঠাৎ, আম্মু ফোন দিয়ে বলল শহরে ফিরতে হবে ৷ কিন্তু আমি যেতে পারবোনা বলে দিলাম ৷ কিন্তু আম্মু জোর দিয়ে বলার কারণে গ্রামে আর থাকতে পারলাম না ৷ বিষন্ন মন নিয়ে গ্রাম ছাড়তে হলো ৷ অবাক হলাম অনুর আচরণে ৷ আমি চলে যাচ্ছি অথচ তার কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম না ৷ কষ্ট লাগছিল জঙ্গলে দেখা হওয়া সেই মেয়েটির জন্য ৷ সে ই একমাত্র মেয়ে যে আমার মনে প্রথমবারের মত ভালবাসার অনুভূতি তৈরি করে দিয়েছিল ৷ যদি একটাবার কথা বলা যেতো তার সাথে, তাহলে কতই না ভাল হতো ৷ চেয়েছিলাম আজকে তার সাথে দেখা করবো কিন্তু সেটা হলোনা ৷ চাচা, চাচী, ভাবী ও অনুকে বিদায় জানিয়ে বাসস্টেশনের দিকে গেলাম ৷ যে রাস্তা ধরে বাসস্টেশনে যেতে হয় সেই রাস্তার মাঝপথে সেই জঙ্গলের মেয়েটির সাথে দেখা হয়ে গেল ৷ একটা পিচ্চি মেয়ের সাথে সে হেঁটে আসছিল ছোট্ট একটি পথ ধরে ৷ হয়তো এই রাস্তাতে এসে উঠবে তারা ৷ পিচ্চি মেয়েটি ঐ জঙ্গলে দেখা মেয়েটার সাথে কোনো কথা না বললেও আমার হ্নদয়হরণকারীনি অনবরত কথা বলে যাচ্ছিল ৷ আমি মেয়েটিকে দেখামাত্র হাঁটা বন্ধ করে দিলাম ৷ এবং মেয়েটির মায়ার চাদরে জড়ানো মুখখানার দিকে তাকিয়ে রইলাম ৷ মেয়েটা মূল রাস্তাতে উঠেই শাড়ির আঁচলটা বুক থেকে সরিয়ে দুষ্টমিমাখা হাসি হাসলো ৷ তার হাসিতে আমার বুকটা চিনচিন করে উঠলো ৷ অসম্ভব রকমের ভাললাগার ঝড় বুকের জমিনে সৃষ্টি হলো ৷ রক্তের প্রতিটি বিন্দু কণায় যেন ভাললাগার হিমোগ্লোবিন তরঙ্গের ঢেউ খেলে যাচ্ছিল ৷ আমার মন চাইছিল যেভাবে হোক তার সাথে কথা বলতে হবে ৷ কিন্তু সাহসের বিস্তর ঘাটতি লক্ষ্য করলাম ৷ মুখ যেন পাথর হয়ে গেল ৷ পাথর ফাঁটলেও যেমন কথা বের হয়না, তেমনি আমার মুখ ফাঁটলেও কথা বের হবেনা বলে মনে হচ্ছে ৷ দেখতে দেখতে মেয়েটা একদম আমার কাছ দিয়ে চলে গেল ৷ আর বুকে যেন হাজারো চুরিকাঘাত দিয়ে গেল ৷ কষ্টটা প্রখর হচ্ছিল তাকে কিছু বলতে পারলাম না এই দুঃখে ৷ অকর্মন্য মানুষ আমি ৷ আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা ৷ তাকে যদি মনের কথা না বলি তাহলে কেমনে প্রেম হবে? প্রেম তো দূর আগে তো বন্ধুত্বটা হওয়া দরকার ৷ সেটাও তো হবেনা, যদি তার সাথে কথা বলতে না পারি ৷ আপসোস করতে করতে বাসস্টেশনে গিয়ে পৌঁছলাম ৷ বাসে চড়ে সারাটাক্ষণ শুধু মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম ৷ তার নামটাও জেনে নিতে পারলাম না ৷ কতবড় বোকা আমি ৷ তার কি নাম হতে পারে? এটা বলতে পারছিনা তবে আমি নিজে তার একটা নাম দিতে পারি ৷ কি নাম দেবো? উমমম..রাহনুমা তার নাম ৷ এটাই পারফেক্ট!
.
.
শাঁইশাঁই করে বাতাস বইছে ৷ বাতাসের সাথে ধুলোবালি উড়ছে ৷ আকাশে একফালি চাঁদ ৷ চাঁদের আলো দেখে মনে হচ্ছে ঝলমলে আলোর দল হাওয়ায় উড়তে উড়তে চারপাশটাকে আলোকিত করে তুলছে ৷ চাঁদের অপরুপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় আছে? ঈর্ষণীয় সৌন্দর্য থাকলে চাঁদেরই আছে, আর আছে অনুর ৷ কিন্তুু অনুর সৌন্দর্যকে আমি মূল্যহীন মনে করি ৷ যে নারীর যত সৌন্দর্য সে নারী ততোই বিষাক্ত ৷ বিষাক্ত জিনিস ফলদায়ক হয়না ৷ বিষ যেমন অন্যকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে মারে, সুন্দরী নারীও পুরুষদের সেভাবে নিঃশেষ করে ফেলে ৷ এই রজনীতে জোস্ন্যার আলোতে মরুভূমির বালিরাশিকে দেখতে ভাললাগছে ৷ চকচক করছিল বালির কণাগুলো ৷ এসব যেন জগতের শ্রেষ্ঠ তৃপ্তি মিটাচ্ছিল, চোখেরও চরম তৃপ্তি মোহনীয় দৃশ্য অবলোকন করে পাচ্ছি ৷ কুয়াশা নেই এই নিশিতে ৷ আছে চাঁদের মায়াময় আলো ৷ মরুভূমির শীতল হওয়া বালির উপর চিৎ হয়ে শায়িত আছে রুপবতী আমার সেই চাচাতো বোন অনু ৷ তার গায়ে হলুদ শাড়ি ৷ সে যেন পণ করে নিয়েছে আমরা একাকী হলেই সে রগরগে পোশাকে আমার সামনে এসে হাজির হবে ৷ তার গায়ে শাড়ি কিন্তু সেটা স্বচ্ছ পাতলা ফিনফিনে ৷ ধোঁয়াধোঁয়া কাচের এপাশ থেকে অপাশের সবকিছু যেরকমটা দেখতে পাওয়া যায়, অনুর শাড়ি থেকেও তার শরীরের কোমল ত্বক দেখা যাচ্ছিল ৷ শীত যে খুব বেশি তা নয় ৷ তবে শীতের পোশাক ছাড়া গা কাঁপবে স্বাভাবিক ৷ অথচ অনু কাঁপছেনা ৷ শাড়ির আঁচল হাওয়ায় উড়ছে ৷ তার লম্বা লম্বা খোলা চুল বাতাসে উড়ছে ৷ এলোমেলো হয়ে চুলগুলো তার চেহারাতে ঝাঁপটে পড়ছে আবার সেগুলো উড়ে চলে যাচ্ছে ৷ অনুর দিকে তাকাচ্ছি আর চাঁদের দিকে ৷ কে বেশি সুন্দর এটা নিয়ে বড় ধরণের দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম ৷ অনুর মুখে শুরু থেকে হাসি বিরাজ করছিল ৷ কখনো মিটমিট করে হাসছিল কখনো বা মুচকি হাসি ৷ বরাবরই তার হাসি মুগ্ধকর ছিল ৷ চাঁদের উজ্জ্বলতা আর অনুর হাসির মুগ্ধতা দুটোই যেন নিশি রাতের প্রকৃতিকে পূর্ণতা দিচ্ছিল ৷ আমি দাঁড়িয়ে আছি সেই কখন থেকে ৷ এতক্ষণ কেউ কোনো কথা বলিনি ৷ চুপচাপ দুজনেই ৷ আমি চাচ্ছি অনুই যেন আগে কথা বলে কিন্তু সে কিছু বলছেনা ৷ আমি কি বলবো সেটা মুখেই আসছেনা ৷ তাই নির্বাক নিস্তব্দ হয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করছি ৷ তৃপ্ত হচ্ছি তবে শীতে কাঁপছি ৷ আমার গায়ে যে শুধু নীল রঙের পাঞ্জাবী !
হঠাৎ, অনুু বালির উপর থেকে উঠে আমার কম্পমান হাত আঁকড়ে ধরলো ৷ কাঁপতে থাকা হাত অনুর হাতের পরশ পেয়ে নির্জীব হয়ে গেল, কাঁপন থেমে গেল ৷ তবে বুকের কাঁপন থামলোনা ৷ মনে হচ্ছে বুকের কাঁপন আগের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে ৷ অনু আমার হাতটা শক্ত করে ধরার পর টিপে টিপে দেখছিল ৷ হঠাৎ করে উচ্চস্বরে বলল,
----এতক্ষণ এখানে আমরা অথচ কথা বলছোনা ৷ কেন? এতো কিসের ভাব তোমার? ভালবাসি বলে কি তোমার এত ভাব? এড়িয়ে চলে তুমি কি রেহায় পাবে আমার থেকে? কখনো না ৷ আমি তোমাকে ছাড়ছিনা ৷ তুমি যেখানেই থাকবে সেখানেই আমাকে পাবে ৷ হ্যাঁ, ছায়া হয়ে তোমার পাশে পাশে থাকবো ৷ আমার পরশ অপছন্দ তোমার তাইতো ছায়া মানবী হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ৷ তুমি আমাকে ছুঁতে না পারলেও আমি ঠিকই পারবো!
.
অনু কথাগুলো বলা শেষ করেই আমাকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরলো ৷ এতে আমার দেহটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল কেন যেন ৷ লক্ষ্য করে দেখি বুকের ভেতর চাকু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷ ব্যথায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল ৷ ভোঁতা কষ্টে নিশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছিলাম না ৷ চোখ বেয়ে বেদনার অশ্রুধারা অবিরাম ঝরা শুরু হলো ৷ চিৎকার করছিলাম ৷ অথচ অনু পৈশাচিক হাসি হাসছিল ৷ যেন সে আমার কষ্ট দেখে জগতের শ্রেষ্ট সুখ নিচ্ছে ৷ আমার কষ্ট সে উপভোগ করছে ৷ বিষাদে ভরা চেহারা নিয়ে অনুর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে কৃত্তিম হাসি হেসে ভাঙ্গা গলায় বললাম,
“এই তোমার ভালবাসার নমুনা?"
কথাটা শুনে অনু দু ফোঁটা চোখের বারিধারা বিয়োগ করে কাতরকন্ঠে বলল,
“আমি তো ঘর বাঁধতে চেয়েছিলাম ৷ কিন্তু তুমি ঘরটা কেন ভেঙ্গে দিলে? একটা সংসারকে ধ্বংস করার অধিকার তো তোমার নেই ৷ তুমি ভালবাসতে পারলেে না আমাকে? কেন?
.
এটা বলে অনু রহস্যময় হাসি হেসে তার চোখের ভেতর চকচক করতে থাকা চাকু ঢুকিয়ে দিলো ৷ চিৎকার করে উঠলাম!
.
ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার ৷ স্বপ্নের জগতে ছিলাম ৷ দুঃস্বপ্ন ৷ এরকম স্বপ্ন কখনো ভুলক্রমেও দেখিনি ৷ আজকে কেন এমন স্বপ্ন দেখলাম? গা ভিজে গেছে ৷ শ্বাস ফেলছিলাম ৷ পানি খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম হলোনা ৷ রাত ১২টা পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে পার্টিতে উল্লাস করে এসে ঘুমিয়েছি ৷ বেশিক্ষণ ঘুম হয়নি ৷ অথচ এরকম একটা স্বপ্ন দেখে ঘুমই শেষ হয়ে গেল ৷ ভাগ্যিস এটা স্বপ্ন, বাস্তব হলে তো জগতের রুপ রস নেওয়া হতোনা আর!
আজ ১৫ দিন হলো গ্রাম থেকে এসেছি ৷ এই পনের দিনে কখনো রাহনুমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখিনি অথচ প্রতি রাতে অনু স্বপ্নযোগে আমার সাথে দেখা করে ৷ যাকে স্বপ্নে দেখতে চাই তার দেখা মেলেনা অথচ যাকে ভুল করেও কামনা করিনা সে আসে ভয়ানক কিংবা সুখকর স্বপ্নে!
.
.
দুপুরে বন্ধুদের নিয়ে মধ্যাহৃ ভোজ করছিলাম ৷ বাবা, মা বাসায় নেই ৷ দরকারী কাজে বাইরে গেছে তারা ৷ তাই প্রিয় বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি ৷ হঠাৎ করে দরজায় কলিং বেল বাজলো ৷ কাজের লোক রমিজ মিয়া দরজা খুলতেই ড্রয়িংরুমে ঢুকে পড়লো একটি বোরখা পড়া মেয়ে ৷ সে যে অনু এটা বুঝতে কষ্ট হলোনা ৷ এবারও তাকে মুখ ঢাকা অবস্থায় দেখতে পেলাম ৷ একটা বড় ব্যাগও আছে তার সাথো ৷৷ বুঝতে পারছি সে এখানে কি কারণে এসেছে! ভাবী তো বলেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিবে সে ৷ একারণে হয়তো আমাদের বাসায় এসছে ৷ কিন্তু তার তো সেশন অনুযায়ী এডমিশন পাবেনা ৷ অনু আমাকে দেখে চোখ দুটো বড়বড়় বানালো ৷ অতঃপর আমার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল ৷ আমার একটা ছেলে বন্ধু ও দুটা মেয়ে বন্ধুকে দেখে অনু তাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো ৷ অতঃপর আমাকে নিচুস্বরে বলল,
----ভাল আছেন ভাইয়া?
.
রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই অনুর প্রতি ভয়ের উদয় হলো ৷ চাপাকন্ঠে তাকে উত্তর দিলাম,
----ভাল ৷ তো, তুমি কি কারণে এলে? নিশ্চয় ভর্তি পরীক্ষা দিতে ৷ কিন্তু ঢাবিতে তো তুমি এডমিশন পাবেনা!
অনু কপাল কুঞ্চিয়ে বলল,
----কে বললো ঢাবিতে ভর্তি হবো?
----তাহলে?
----এখানে কোনো ভাল প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাবো ৷ আর কখনোই আমি ঢাবির প্রতি ইন্টারেস্টেড ছিলাম না ৷ ভাল ছাত্রীও না যে চান্স পাবো!
----খুব ভাল ৷ যেটা ভাল মনে করো সেটাই করো!
----আঙ্কেল, আন্টি কই? তাদের তো দেখছিনা!
----তারা বাসায় নেই ৷
----ওহ!
----তুমি উপরতলায় যাও ৷ সিড়ি দিয়ে উঠেই একটা রুম পাবে তার পাশের রুমে তুমি থাকবে ৷ ঐ রুমের সাথে এটাচড করা ওয়াশরুম আছে, ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো ৷ তুমি অনেকদূর থেকে আসছো ৷ নিশ্চয় কিছু খাওনি ৷ তাড়াতাড়ি যাও! এসে খাবে ৷ আমি আপাতত খাওয়া বাদ দিলাম ৷ দুজনে একসাথে খাবো!
.
অনু আমার কথা শুনে চলে গেলো ৷ আমার বন্ধুরা আমার দিকে ভূত দেখার মত করে তাকিয়ে আছে ৷ যেন তারা আমাকে এর আগে দেখেনি ৷ আমিও অবাক হলাম তাদের তাকানো দেখে ৷ বিস্ময়ের কন্ঠে বললাম,
----এরকম ভাবে তাকাচ্ছিস কেন তোরা?
.
তারা কেউ কোনো কথা না বলে চুপ করে খেতে লাগলো ৷ তাদের খাওয়া শেষের দিকে বিধায় খাওয়া শেষ করে চেয়ার থেকে উঠে পড়লো ৷ এবং আমাকে বিদায় জানিয়ে বাসা থেকে চলে গেল!
.
বন্ধুরা চলে যাবার পরপরই অনু অন্য একটি বোরখা গায়ে জড়িয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো ৷ এবারো তার চেহারা ঢাকা ৷ তাকে শক্তকন্ঠেে বললাম,
----এখন তো কেউ নেই ৷ এবার অন্তত নেকাপটা খোলো!
.
অনু অপরাধীর স্বরে বলল,
----দুঃখিত ভাইয়া, আমি মুখ দেখাতে পারবোনা ৷
----কেন? এমন তো না যে তুমি আমাকে মুখ দেখাওনি ৷ দুটা দিন তোমাদের বাড়ি ছিলাম ৷ যে কয়বার আমরা দুজনে সবার আড়ালে ছিলাম সে কয়বার তুমি মুখ খুলে তো রেখেছই সেইসাথে আবেদনময়ী রুপে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছিলে ৷ তখন এরকমটা করতে পারলে এখন কেনো নয়, বলো?
.
অনু বোধহয় অবাক হলো ৷ তব্দা খাবার মত ভান ধরে একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ৷ আচমকা চেঁচানো স্বরে বলল,
----কি আজব কথা বলছেন? আমি আপনাকে মুখটাই দেখালাম না, সেখানে আবেদনময়ী রুপে হাজির হবো? কিসব বলছেন! মাথা কি ঠিক আছে আপনার?
.
অনুর কথায় বড়সর ধাক্কা খেলাম ৷ সে অস্বীকার করছে? কিন্তু কেন? কিসের জন্য? হকচকিয়ে উঠে ভ্রু কুঁচকিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম,
----তারমানে তুমি আমার সামনে শাড়ি পড়ে, টিশার্ট পড়ে হাজির হও নি?
----আশ্চর্য! আমি কিসের জন্য এসব পড়তে যাবো? ফাইজালামী করছেন? আমাকে কি মডার্ণ গার্ল মনে হয়? সারাক্ষণ বোরখা পড়ে থাকি সেই আমি টিশার্ট পড়বো, আবেদনময়ী শাড়ি পড়বো এবং সেগুলো পড়ে আপনার সামনে এসে উপস্থিত হবো? ছিঃ ভাইয়া, আপনার থেকে এমন কথা আশা করিনি ৷ আপনি আমার কাজিন হন, অন্যথায় অন্য কেউ হলে আপনাকে কয়টা কটুু কথা বলতাম!
.
অনুর কথায় স্তব্দ হয়ে গেলাম ৷ সে যেভাবে কথাগুলো বলছে এবং সে ওরকমভাবে আমার সামনে আসেনি বলে জোর দিচ্ছেে, এসবের জন্য নিজেকে পাগল বলে মনে হচ্ছে ৷ মনে হচ্ছে ঐ কয়দিন আমি অনুকে নিয়ে ভ্রমের মধ্যে ছিলাম ৷ যা হয়েছিল সবই ছিল ভ্রম ৷ কিন্তু যেটা আমার চোখের সামনে ঘটলো যেগুলো বাস্তবের চেয়েও বাস্তব ছিল সেসব কি করে ভ্রম হয়? তবে কি অনু মিথ্যা বলছে? আমার সাথে ফাইজলামী করার চেষ্টা করছে? এটাই হবে ৷ সে আমার সাথে মজা করে পৈশাচিক সুখ নিচ্ছে ৷ যার ঠোঁটের পরশ এখনো আমার ঠোঁটে লেগে আছে, আর এই ঘটনা কেমনে মিথ্যা হতে পারে? কখনো না ৷ যে মেয়ে মধ্যরাতে এসে হাজির হয়, আমার দেহের পরশ নেবার চেষ্টা করে সেই মেয়ে যে আমার সাথে মিথ্যাচার করে মজা নিবেনা, তার কি ভরসা আছে?
.
আপাতত অনুর কথাা মেনে নিলাম! নিজেকে শান্ত করে ক্ষীণস্বরে তাকে বললাম,
----তারমানে তুমি ঐ দুদিনের মধ্যে তোমার মুখখানা আমাকে দেখাও নি?
অনু বাকা চোখে তাকিয়ে তীক্ষ্ণকন্ঠে বলল,
----জি না ৷ আপনাকে আমি মুখ দেখাই নি!
----তাহলে এখন দেখাও, তোমাকে দেখবো ৷ দীর্ঘ ৮ বছর ধরে তোমাকে দেখিনা!
----দেখে লাভ নেই ৷ আমাকে দেখে আপনি চিনতে পারবেন না!
----কেন?
----আমার মুখে এসিড নিক্ষেপ করা হয়েছিল, ভাবী তো সেসব বলেছে আপনাকে!
----হুম জানি! কিন্তু আমি তোমাকে চিনবোনা কেন? দেখলে ঠিকই চিনবো!
----যেটাই হোক, আমি মুখ দেখাচ্ছিনা ৷ কষ্ট পেলে দুঃখিত!
----না দেখালে ৷ আমি তো তোমাকে দেখেছি!
----কখন? কোথায়?
----সেটা বলবো কেন?
----বলেন না প্লিজ! আমি তো কখনো মুখই খুলে রাখিনি ৷ খাওয়ার সময়ও না ৷ তাহলে আপনি কখন দেখলেন?
----সত্যিটা বলবো?
----অবশ্যই!
----তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে, তখন তোমার মুখ থেকে নেকাপটা সরিয়ে প্রাণ জুড়িয়ে দেখেছি!
.
অনু উচ্চশব্দে হাসলো ৷ হাসতে হাসতেই বলল,
---ভালই জোকস জানেন ৷ আমি তো রাতে ঘুমাতে গেলে বোরখায় পড়িনা! আপনি নেকাপ পেলেন কেমনে?
.
মিষ্টি হেসে বললাম,
----এটা জানতেই মিথ্যা বলেছি ৷ যদি আমি নেকাপের কথা না বলতাম তাহলে বলতে শুতে গেলেও বোরখা পড়ে ঘুমাও ৷ এজন্য চালাকি করলাম ৷ হ্যাঁ, আমি তোমাকে ঘুমানোর সময় দেখেছি ৷ সত্যি বলছি ঘুমন্ত মুহূর্তে তোমাকে অপূর্ব লাগে!
----চুপ করেন! আমি কি দরজা খুলে রেখে ঘুমাই নাকি? রুমে ঢুকলেন কেমনে?
----তুমি রুমে ঢোকার ১০ মিনিট আগে আমি খাটের নিচে ছিলাম!
----কিহ?
----সত্যি বলছি! মিথ্যা যদি বলে থাকি তাহলে আমার কপালে যেন তোমার মত বউ জোটে!
.
অনু আবারো হাসলো ৷ খিলখিলিয়ে হাসি ৷ হাসিতে মুক্তা ঝরছিল কথাটা বলতাম যদি সে মনের মানুষ হতো ৷ তবে এটা সত্য অনুর হাসির শব্দে কলিজায় সুখের বারোতা বাজছে!
.
অনুু হাসি থামালো ৷ চাপা কন্ঠে বলল,
---আমি যে আপনার কপালে নেই এটা ভাল করে জানি ৷ আন্টিকে আব্বু ফোন দিয়েছিল, আমার ঐ বিয়েটা ভেঙ্গেছেন আপনি ৷ এবং আপনি আমি একে অপরকে ভালবাসি একথা আন্টি জেনে যাওয়ায় খুব রেগে গিয়েছিল ৷ একারণেই তো আন্টি আপনাকে গ্রাম ছাড়তে বলেছিল!
.
অনুর কথায় অবাক হলাম ৷ উত্তেজিত কন্ঠে বললাম,
----কি বলছো? আম্মু তো এটা আমাকে বললোনা?
----বলবে কেন? আমি আন্টিকে ফোন দিয়ে সত্যটা জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমাদের মধ্যে কিছুই নেই ৷
----যাক, ভাল করছো ৷ নাহলে আম্মু বড় ধরণের সন্দেহর মধ্যে থাকতো!
.
কথা বলতে বলতে খাবারের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম ৷ দুজনে কথা বলা বন্ধ দিয়ে খাওয়ায় মন দিলাম!
.
রাতে ঘুমানোর সময় অনুর বিষয়টা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম ৷ সন্দেহ হচ্ছিল সেই ঘটনাগুলো নিয়ে, যেই ঘটনাগুলো গ্রামে ঘটেছিল ৷ অনু আমার সাথে রোমান্সকর কতকিছু করলো অথচ এখন সে অস্বীকার করছে ৷ ওসব কিছুতেই অবাস্তব হতে পারেনা ৷ যদি ওগুলো বাস্তব হয় ববং অনুর কথা যদি ঠিক হয় তাহলে ব্যাপারটা দাড়াচ্ছে ঐ মেয়েটা অনুু ছিলনা ৷ হয়তো অন্য কেউ ছিল ৷ কিন্তুু কে সে? তবে কি অনুর কোনো আত্মীয় সে? আত্মীয় হয়ে কেন আমার মত অপরিচিত জনের সাথে ওরকম আচরণ করবে? এতটা সাহস কি হতে পারে কারো
?
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানিনা!
.
.
সকালে ঘুম ভাঙ্গলো অনুর ডাকে ৷ দরজা খোলা ছিল বিধায় যে রুমে ঢুকে অনবরত ডাকছিল ৷ ঘুম থেকে জেগে দেখি অনু শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷ তবে মুখটা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢাকা ৷ শুধু চোখ ও কপাল খোলা আছে ৷ শাড়িতে এতটা আকর্ষণীয় লাগছিল তাকে যেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয় ৷ অনু আসলেই আবেদনময়ী নারী ৷ যদিও সেরকম ভাবে সে শাড়ি পড়েনি তবুও আবেদনময়ী লাগছে তাকে ৷ বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে অনুর চোখ দেখছি ৷ তার চোখের জাদুর মন্ত্রে সম্মোহিত হয়েছি বলে মনে হলো ৷ অন্যথায় চোখ তো এভাবে তার দিকে নজর দিয়ে তাকিয়ে থাকতো না!
অনু আমাকে আবার ডাক দিলে মোহের জগত থেকে উদ্ধার হয়ে চেতনার জগতে পা দিলাম ৷ অনু তীক্ষ্ণকন্ঠে বলল,
----তাড়াতাড়ি রেডি হন ৷ সকালের নাস্তা শেষ করতে করতে তো অফিসের সময় হয়ে যাবে!
.
মৃদ্যুু হাসি হেসে বললাম,
---জি মহারাণী, যাচ্ছি!
.
.
সকালের নাস্তা শেষ করে অফিসে যাবার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হবার সময় অনু বললো তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে ৷ সে নাকি আব্বুুুর অফিসটা পরিদর্শন করবে! তার কথামত অফিসে নিয়ে গেলাম ৷ আমার সঙ্গে অনুকে দেখে অফিসের কর্মচারীরা হা করে তাকিয়ে রইল ৷ হয়তো তারা ভাবছে যেই অফিসে মডার্ণ মেয়ে ছাড়়া জব করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনা সেই অফিসের সিইওর সাথে বোরখাওয়ালীকে দেখা যাচ্ছে, এটা কি করে সম্ভব?
.
অফিস পরিদর্শন করার পর অনু বললো তাকে ভার্সিটিতে নিয়ে যেতে ৷ ঢাকার জনপ্রিয় প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হবে সে ৷ নিয়ে গেলাম সেখানে অফিস ফেলেই ৷ ভর্তিও হয়ে গেল সে!
ভার্সিটি থেকে ফিরলাম ৷ অনু আবার আবদার করলো তাকে সিনেমাহলে নিয়ে যেতে হবে ৷ এবারের আবদারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের হয়ে যাচ্ছিল ৷ কিন্তু অনুর জোরাজুরিতে স্টার সিনেপ্লেক্সে নিয়ে যেতেই হলো ৷ টিকিট কেটে সিনেপ্লেক্সের ভেতর ঢুকে পড়লাম ৷ অনু আমার ডান পাশে বসলো ৷ চলছিল মুভি ৷ হঠাৎ, অনু বললো সে ওয়াশরুমে যাবে ৷ তাকে বললাম ঐ পাশে যাও ৷ সে চলে গেল! অনু চলে যাওয়ায় দুঃচিন্তা হচ্ছিল ৷ মন দিয়ে মুভি দেখতে পারলাম না! অনুর আসার অপেক্ষায় রইলাম!
কিছুক্ষণ পর দেখি বোরখা পড়ে কে যেন আসতে লাগলো আমার দিকে? তাকে দেখে তো মনে হলোনা ওটা অনু! অথচ মেয়েটি আমার ডান পাশের সিটে বসে পড়লো ৷ তাকে বসতে নিষেধ করার সুযোগ হলোনা ৷ সে বসার পরপরই মুখ থেকে নেকাপটা সরালো....
.
চলবে


#অদৃশ্য_পরী (পর্বঃ ৫]
লিখাঃ Sifat Arnab Rehan.
.
মেয়েটা বসার পরপরই মুখ থেকে নেকাপটা সরালো ৷ তার চেহারাটা আমার চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল ৷ অন্ধকারে তার মুখ ভালভাবে দেখা যাচ্ছেনা কিন্তু যখন থিয়েটারের পর্দার প্রতিফলিত শক্তিশালী আলো তার চেহারাতে পড়লো তখন তার চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম ৷ তাকে দেখা মাত্র হকচকিয়ে উঠলাম ৷ ভ্যাঁবাচেকা হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দু-চোখ বরাবর ৷ অবাকের যেন চূড়ায় পৌঁছে গেছি আমি ৷ এটা আমি কস্মিনকালেও কল্পনা করিনি ৷ আমার হ্নদয়ে ভালবাসার প্রদিপ জ্বালিয়ে দিয়েছিল যেই মেয়েটি, যে আমাকে প্রেম নামক শব্দের সাথে পরিচয় করাতে বাধ্য করেছিল ৷ ভালবাসি কথাটির অর্থ বুঝতে ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল ৷ যার মোহে ডুব দিয়ে ভালবাসার ঝিনুক কুঁড়িয়ে মুক্তা সংগ্রহ করেছিলাম সেই মানুষটি আজ আচমকা আমার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে ৷ হ্যাঁ, জঙ্গলে দেখা সেই মেয়েটি যার নাম দিয়েছিলাম রাহনুমা সে এখন আমার পাশে বসা ৷ ভাবতে লাগলাম তাকে নিয়ে ৷ এখানে কেমনে এলো সে? মুভি দেখতেই কি ঢাকায় এসেছে? না এটা তো অযৌক্তিক হয়ে যায়, নিশ্চয় ঢাকায় তার আত্মীয়স্বজন বসবাস করে; তাদের কাছেই এসেছে ৷ হয়তো সময় কাটছিলনা তাই মুভি দেখতে চলে এসছে ৷ কৌতূহল জেগে বসলো আমার মনে তার এখানে আসার হেতু জানার জন্য ৷ ভাবনায় আরো গভীরভাবে ডুবে গেলাম ৷ ভাবনাগুলো কেবল রাহনুমাকে নিয়ে তৈরি হওয়া প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিল ৷ রাহনুমা মুভি দেখায় এমনভাবে মন দিয়েছে আমি যে ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছি সেটাতে তার খেয়াল নেই ৷ আমার প্রতি তার ভ্রুক্ষেপ না থাকলেও সমস্যা নেই ৷ সে যে আমার পাশে আছে এই অনেক ৷ সত্যি বলতে কি খুবই ভাললাগছে তাকে পাশে পেয়ে ৷ না চাইতেই তার সাথে দেখা হয়ে যাবে এটা ভাবনাতেও ছিলনা ৷ মনে প্রশান্তির ঝড় শুরু হয়েছে তাকে দেখার পর থেকে ৷ তবে চিন্তায় পড়ে গেলাম অনুর জন্য ৷ সে ওয়াশরুম থেকে এখানে এলে পাশে এই মেয়েটাকে দেখে রাগে বাঘিনী হয়ে যাবে ৷ তখন পড়তে হবে বিপাকে ৷ রাহনুমা নেকাপটা খুলেই পপকর্ণ খাওয়া শুরু করেছিল এবং মুভি দেখায় মন দিয়েছিল ৷ তাড়াতাড়ি করে পপকর্ণ খাওয়ায় পপকর্ণ শেষ হয়ে গেল ৷ পপকর্ণের নেশায় পড়ে গেছে হয়তো ৷ আবারো হয়তো পপকর্ণ কিনে আনবে ৷ এজন্য সে সিট থেকে উঠলো ৷ আমাকে কিছু না বলেই চলে গেল ৷ এবারো ভুল করলাম ৷ কেন যে পাশে থাকাকালিন তাকে কিছু বলতে পারিনা! সাহস শক্তি দুটোই যেন কোন জগতে হারিয়ে যায় ৷ বলবো বলবো করে তাকে কিছু বলা হয়না ৷ পপকর্ণ নিয়ে যদি আবারো ফিরে আসে তাহলে যেভাবে হোক সাহস করে তার সাথে কথা বলতেই হবে ৷ ধুরুধুরু বুকটাকে শান্ত বানিয়ে তাকে আমার মনের যাবতীয় কথাগুলো বলে দিবো ৷ মুভির পর্দাতে আর নজর যাচ্ছেনা ৷ রাহনুমা আসবে কিনা এই চিন্তায় বিভোর আমি ৷ ওদিকে অনেকক্ষণ হয়ে গেল অনু আসছেনা ৷ ওয়াশরুমে এতক্ষণ কি করে সে? মনে মনে কথাটি বলতে না বলতেই অনু চলে আসলো ৷ হাতে পানির বোতল, এবং পপকর্ণ ৷ বোরখার রং দেখেই বুঝা যায় ওটা অনু ৷ তার মুখ দেখার প্রয়োজন নেই ৷ সে নিজ থেকে মুখ না দেখালে আমার হাজারো আবদারেও মুখ দেখাবেনা ৷ রাহনুমার জন্য মনটা ছটফট করছিল ৷ সে যদি আসতো তাহলে অনুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতাম ৷ তবে অনু বিষয়টা কেমনে নিতো সেটার প্রশ্ন থেকেই যায় ৷ না রাহনুমা এলোনা ৷ মনটা বিষাদে ভরে গেল ৷ সিনেপ্লেক্সের ভেতর আর থাকতে মন চাচ্ছিল না ৷ অনুকে অনুরোধ করে বললাম বাড়ি চলে যাবো ৷ সেও বললো চলেন ৷ আমার আগেই অনু সিনেপ্লেক্স থেকে বের হলো ৷ আমি যখন বের হলাম বাইরে গিয়ে দেখি অনু নেই ৷ আঁতকে উঠলাম তাকে না পেয়ে ৷ আশপাশটা খুব ভালভাবে দেখলাম কিন্তু অনুর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না ৷ আশ্চর্য, মানুষটা গেল কই? ফাইজলামী করছে নাকি আমার সাথে? মুহূর্তের মধ্যে একটা মানুষ গায়েব হয়ে যায় কেমনে? তাকে না পেয়ে কষ্টও লাগছিল আবার রাগও হচ্ছিল ৷ বিষন্ন মনে আমার গাড়ির নিকট গিয়ে দাঁড়ালাম ৷ গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে তাকাতেই দেখি অনু বসে আছে ৷ গাউন পড়ে আছে সে ৷ হলিউড অ্যাক্ট্রেসদের মত লাগছে ৷ এখন ঠিকই সে মুখটা খোলা রেখেছে ৷ অথচ যদি বাসায় সবার সামনে তাকে বলি মুখটা দেখাও তখন ভাব দেখাবে ৷ নিজেকে শালিন মেয়ে প্রমাণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে ৷ এসব করে সে কি মজা পায় বুঝিনা কিছু! অনু দুষ্টুমীমাখা অভিব্যক্তিতে আমাকে ইশারা করছে যেন তার কাছে যাই!
এখনই সুযোগ অনু যে আবেদনময়ী এর প্রমাণ সংরক্ষণ করার ৷ যাতে পরবর্তিতে তাকে প্রমাণ দেখাতে পারি ৷ আমার ফোনটা বের করে ক্যামেরাতে কয়টা ছবি তুললাম, সেগুলো সেভ করলাম ৷ এমনকি ২০ সেকেন্ডের একটা ভিডিও করলাম ৷ এবার আর অনু আমার সাথে চালাকি করতে পারবেনা ৷ ছবি তোলা শেষ করে গাড়িতে প্রবেশ করলাম ৷ ড্রাইভিং সিটে আমি, আর পাশে অনু বসা ৷ গাড়ি চলছিল ৷ অনু আমার বাম হাতটা শক্ত করে ধরে আছে ৷ কিছু বললাম না ৷ প্রশ্রয় দিতে ভাললাগে ৷ সব সময়ের জন্য তার দৃষ্টি আমার চেহারা বরাবর রইলো ৷ যে কয়বার তার দিকে তাকালাম প্রতিবারই দেখতে পেলাম তার চোখে, মুখে অদ্ভুত রকমের হাসি ৷ তার মুখের অভিব্যক্তিতে লক্ষ্য করলাম কি যেন বলতে চায় আমাকে ৷ কিন্তু সাহস করে বলতে পারছেনা ৷ হয়তো আমার মত অবস্থা হয়েছে তার ৷ রাহনুমাকে ভালবেসে ফেলেছি অথচ বারবার সে আমার কাছে আসা সত্বেও তাকে কিছু বলতে পারছিনা ৷ সারা রাস্তাতে অনু মাত্র ২টা কথা বললো ৷ প্রথম কথাটি ছিল, “নীল, যদি আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায় তাহলে কি আমাকে মেনে নিতে পারবেন?"
দ্বিতীয় কথাটি ছিল, “আমার স্বপ্ন বাসর রাতে অন্তত ১ মিনিট আপনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সুখ নেওয়া!"
.
অনুর কথার কোনো প্রতিত্তর না দিয়ে শুধু মিষ্টি করে হেসেছিলাম ৷ আমার ভাবতে অবাক লাগে অনুর মত এত সুন্দরী মেয়ে আমার মত একজন কালো ও অসুন্দর মানুষকে ভালবাসলো? এটা আসলেই অবিশ্বাস্য ব্যপার ৷ বিশ্বাসযোগ্য হোক বা না হোক, আমাকে ভালবাসার অপরাধে তাকে যে কাঁদতে হবে এটা সবসময়ের জন্য চিরন্তন সত্য!
.
গাড়ি চলছিলো ৷ হঠাৎ আমাদের বাসার অনেকটা পথ আগেই গাড়িটা থামিয়ে দিলাম অনুর যন্ত্রণায় ৷ সে জোরাজুরি করছিল যেন আমি গাড়ি থামাই ৷ গাড়ি থামানো হলে অনু আমাকে ঝাঁপটে ধরলো ৷ মনে হলো আমি নিরিহ হরিণ আর সে হিংস্র বাঘিনী ৷ আমাকে খুবলে খেতে শরীরের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ৷ আমার উড়ুর উপর বসে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে কোনোরকম কথাবার্তা না বলে ঘারে, কপালে চুমু দিয়ে যাচ্ছিল ৷ অনু যেন পাগল হয়ে গেছে ৷ তাকে থামানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল ৷ আমিও যেন অপারগ ৷ তাকে থামানোর ইচ্ছা বিলিন হয়ে গেছে ৷ হয়তো আমার মনবৃত্তি চাচ্ছেনা অনুর থেকে রেহায় পেতে ৷ অনুর শরীরের পরশ নিতে অবুঝ মন যেন উত্তপ্ত কড়ায়ের পানির মত হয়ে গেছে, তাকে থামাতে গেলেই যেন নিজের ক্ষতি!
চোখ বন্ধ করে রেখেছি ৷ থরথর করে কাঁপতে থাকা পুরো শরীর ও ধুকধুক করতে থাকা বুক যেন অনুর হয়ে গেছে ৷ সে যেভাবে পারছে আমাকে নিয়ে খেলায় মেতে আছে ৷ হঠাৎ করে সে আমার কপালে আলতো ভাবে চুমু বসিয়ে দিয়ে শরীর থেকে নেমো গেলো ৷ অনু আমার শরীর ছেড়ে দেওয়ায় দম নিলাম লম্বা ভাবে ৷ অতঃপর নিজেকে শান্ত করে তাকে নিচু গলাতেই বললাম,
----এই যে নির্লজ্জতা দেখালে, এটা তুমি হয়তো বাড়িতে পৌঁছেই অস্বীকার করবে ৷ তুমি যে কি এটাই আমি বুঝতে পারিনা ৷ আচ্ছা অনু, তোমার সাথে কি জ্বীন টিন ভর করে নাকি? দু-রকম ব্যবহার কেমনে করো? একই মানুষের দ্বৈত রুপ আসলেই রহস্যজনক ব্যাপার ৷ আমি না বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি তোমার আচরণে!
.
অনু আমার কথার জবাবে একটা কথাও বললোনা ৷ যেন মনে হলো সে কিছু শুনতেই পায়নি ৷ অনুর মুখ থেকে আমার কথার কোনো জবাব না পেয়ে তার প্রতি বিব্রত হলাম সেইসাথে রাগান্বিত হলাম ৷ তীব্র বিতৃষ্ণা ও বিরক্ত ভাব নিয়ে আবারো গাড়ি চালাতে লাগলাম!
.
গাড়ি বাসার সামনে এসে থামানো হলে অনুর আগে আমিই গাড়ি থেকে বের হলাম ৷ আমার রুমে প্রবেশ করার পর ফোনের কথা মনে পড়ে গেল ৷ পকেটে ফোন পেলাম না ৷ নিশ্চয় গাড়িতে রেখে আসছি ৷ ফোনটা নিতে আবারো গাড়ির নিকট যেতে হলো ৷ আমার সিটের পাশে রাখা ছিল, ওখানেই আছে; ওখান থেকেই ফোনটা নিলাম ৷ সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে ৷ শীত অনেকটা কম আজ ৷ কুয়াশা নেই ৷ এজন্য বাইরে কাটিয়ে এসে দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি ৷ তবে খুব ক্লান্ত আমি ৷ কোনোমত ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম!
হঠাৎ, আমার ফোনটা বেজে উঠলো ৷ ফোনের স্কিনে চোখ পড়তে দেখলাম অনু কল দিয়েছে ৷ আরে আশ্চর্য একই বাড়িতে দুজন অথচ সে কল দিচ্ছে! আমার রুমে এলেই তো কথা বলতে পারে ৷ নাকি তার সেই রোগ শুরু হয়ে গেছে ৷ আমার সামনে মুখ দেখায়না, এখন নিশ্চয় সামনাসামনিও হবেনা? খিলখিলিয়ে হাসতে মনে চাইলো ৷ হাসতে হাসতে ফোনটা রিসিভ করলাম ৷ রিসিভ করতেই অনু জোরালো কন্ঠে বলল,
----আপনি কি মানুষ? সিনেপ্লেক্সে একা একটা মেয়েকে রেখে যে চলে গেলেন, এটা কি ঠিক কাজ করেছেন?
.
অনুর কথা শুনে আকাশ থেকে ধপাস করে পড়লাম ৷ মনে হলো দেহে প্রাণ নেই ৷ প্রাণ ছাড়ায় বেঁচে আছি ৷ বুকটা ছ্যাৎ করে উঠেছে তার কথার দাপটে ৷ কি আশ্চর্য রকমের কথা শুনালো আমাকে ৷ মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে নিশ্চয় ৷ মাতই্র আমার সাথে বাসায় এলো, আর এখন বলছে আমি নাকি তাকে সিনেপ্লেক্সে রেখে আসছি ৷ বিছানা থেকে উঠে অনুর রুমে গেলাম, পেলাম না ৷ ড্রয়িংরুম, ওয়াশরুম, ছাদ সবখানে খুঁজলাম তার কোনো হদিস নেই ৷ ফোনে অনবরত অনু কথা বলে যাচ্ছে আর আমি নির্বাক দর্শক হয়ে তার কথা গিলে যাচ্ছি ৷ কান যেন ঝালাফালা হয়ে গেল তার জোরালো কন্ঠের কথা শুনে ৷ বাসায় যখন অনুকে কোথাও পেলাম নাা, তখন নিজেকে যেন সদ্য পাবনা পাগরা গারদ থেকে ফেরা মহাপাগল বলে মনে হলো ৷ অনুকে পাগল বলতাম এখন তো দেখছি নিজেই একটা পাগল ৷ গাড়িতেে নিশ্চয় অনু ছিলনা ৷ কিংবা কেউ ছিলই না, হয়তো ভ্রমে তাকে দেখতে পেয়েছিলাম ৷ অথবা গাড়িতে যে ছিল সে আসলে অনুই না অন্য কেউ ৷ আমি তো কখনো লোকজনের সামনে থেকে অনুর মুখ দেখতে পারিনি ৷ হয়তো অনুকে দেখিই নি কখনো ৷ যাকে দেখেছি সে আসলে অনু নয় অন্য কেউ ৷ আজকে প্রমাণ হবে আমি যাকে অনু হিসেবে চিনি সেই অনু নাকি নেকাপ দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা মেয়েটিই অনু ৷ তাড়াতাড়ি করে আমার গাড়িটা নিয়ে চললাম সিনেপ্লেক্সের দিকে ৷ সেখানে পৌঁছেই দেখি অনু সিনেপ্লেক্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ৷ হতভম্বের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম ৷ এবার আর অবিশ্বাস করার উপায় নাই যে আমি ঐ আবেদনময়ী অনুকেই কল্পনা করতাম ৷ আমার ভিন্নরকম জগতে ঐ অনুর বসবাস ৷ যাকে আমি নানাভাবে কল্পনা করি ৷ এটা হয়তো অন্যরকম মোহ, বিভ্রান্তিকর ভ্রম ৷ কিন্তু আমি কেন তাকে নিয়ে এমন কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করছি? তাকে তো আমি ভালবাসিনা! তাহলে কেন এমন বোকামী আমার?
অনুর দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম সে রাগে গজগজ করছিল ৷ হাত পা স্থির ছিলনা তার ৷ তার ভাবভঙ্গিমা দেখে ভয় লাগছিল ৷ কাছাকাছি হবার সাহস হচ্ছিলনা ৷ আমাকে দেখে অনু নিজেই এগিয়ে আসলো ৷ ভাবছি রাগে থাপ্পর বসিয়ে দেয় কিনা? কিন্তু না, অনু আমার হাতটা ধরে নরম গলায় বলল,
----চলুন, এরকমটা যেন দ্বিতীয়বার না হয়!
.
গাড়িতে চড়ার পর বারবার মাথায় অনুর সাথে ঘটে যাওয়া রোমান্সকর মুহূর্তের কথা মনে পড়ছিল ৷ গাড়িতে সেসময় সে আমার সাথে এতটাই রোমান্সকর ঘটনা ঘটিয়েছিল যে সেগুলো যেন স্মৃতিফলক হয়ে এই মস্তিস্কে ঢুকে আছে ৷ অথচ এটাকে এখন অবাস্তব ও ভ্রম হিসেবে মানতে হচ্ছে ৷ কিন্তু এখনো আমার শার্টে অনুর লিপিস্টিকের দাগ দেখতে পাচ্ছি ৷ এটা কিভাবে অস্বীকার করতে পারি আমি? অনুকে ব্যাপারটা বললে সে কিছুতেই এটা বিশ্বাস করবেনা ৷ এরপরও তাকে সাহস করে বললাম,
----অনুু একটা ঘটনা ঘটে গেছে!
অনু তীক্ষ্ণকন্ঠে বলল,
---কি ঘটনা?
---্আমি তখন তোমাকে নিয়েই বাসায় ফিরেছিলাম ৷ তোমার পড়নে গাউন ছিল ৷ এমনকি তুমি আমাকে কপালে চুমুও দিয়েছিল ৷ অথচ, তুমি বলছো আমার সাথে তখন বাসায় যাওই নি ৷
----আচ্ছা, আপনি কি সত্যিই সুস্থ্য মস্তিষ্কের মানুষ? বুঝিনা আমাকে নিয়ে এতসব চিন্তা আপনার মাথায় কেমনে আসে? দিনে দিনে আপনি আমার নিকট একজন বিরক্তির মানুষ হয়ে উঠছেন!
----এক মিনিটের জন্য নিজেকে পাগল হিসেবে মেনে নিলাম ৷ কিন্তু যদি প্রমাণ করতে পারি যে তুমি তখন আমার গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলে এমনকি আমার সাথে রোমান্সকর মুহূর্ত পার করেছিলে!
তখন কি বলবে? অস্বীকার করবে না তো?
----ওকে, দেখান আপনার প্রমাণ!
.
ঐসময় ফোনে অনুর গায়ে যেরকম গাউন পড়া ড্রেস ছিল, সে অবস্থায় তার কয়েকটা ফটো তুলেছিলাম এবং একটা ভিডিও করেছিলাম ৷ সেটা মোবাইলে সেভ করা আছে ৷ অনুকে দেখালে সেটা আর অবিশ্বাস করতে পারবেনা ৷ ভিডিওটার কথা মনে পড়ায় নিজের কনফিউশনটা কেটে গেছে ৷ এখন নিজেকে সুস্থ্য মানসিক সম্পন্ন লোকই মনে হচ্ছে ৷ আবেদনময়ী অনু আসলে আমার ভ্রম নয় বরং বাস্তব!
ফোন থেকে প্রথম ভিডিওটা বের করে অনুর নিকট ফোনটা দিলাম ৷ অনু মন দিয়ে ভিডিওটা দেখছিল আর মুচকি মুচকি হাসছিল ৷ তার হাসার কারণ বুঝতে পারলাম না ৷ কপালে চিন্তার ছাঁপ ফেলে অনুকে কৌতূহলচিত্তে বললাম,
----কি ব্যাপার হাসছো কেন?
অনু ফিক করে হেসে বলল,
----কি ভিডিও দিলেন এটা? ফাঁকা গাড়ির ভিডিও দেখে কি করবো? আপনি কি বোকা? কিসের জন্য ফাঁকা গাড়ি ও সিট ভিডিও করে রেখেছেন? ওহ বুঝছি বিক্রয় ডট কমে গাড়ি বিক্রির জন্য ভিডিওটা আপলোড দিবেন, তাইতো?
.
অনুর কথায় হতবাক আমি ৷ ঢোক গিলে ফোনটা তার হাত থেকে নিয়ে ভিডিওটা দেখলাম ৷ আসলেই তো ফাঁকা গাড়ি ৷ অনু ঠিকই বলেছে ৷ আমি তাহলে ভ্রমের জগতেই আছি ৷ ফটোগুলো দেখতে হবে ৷ ফটোগুলো অপেন করে দেখি ফাঁকা গাড়ি এবং ফাঁকা সিটের ছবিগুলো ভেসে উঠছে! মুখটা এতটুকু হয়ে গেল আমার ৷ কালই সাইক্লিয়ার্টিস্টের সাথে দেখা করতে হবে ৷ নিশ্চয় পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি ৷ এভাবে চলতে থাকলে পাগলা গারদই শেষ ঠিকানা হবে আমার!
.
অনু আমার বিষন্ন চেহারা দেখে মৃদ্যু স্বরে বলল,
----মন খারাপের কি আছে? আমাকে নিয়ে যত খুশি পারেন কল্পনা করুন, নিষেধ করবোনা ৷ তবে শর্ত একটা!
তোরজোর কন্ঠে বললাম,
----কি শর্ত?
----আপনি ভুলেও অন্য কারো হবার চেষ্টা করবেন না!
----তো কার হবো?
----কারো না ৷ সারাজীবন একা থাকবেন ৷ যেমনটা আমি থাকবো!
----এখন তো আমাকে না, তোমাকেই পাগল মনে হচ্ছে"
----আমি পাগল না, আমি একজন পাগলী ৷ সেটা আপনার জন্য ৷ এবার চুপচাপ গাড়ি চালান ৷ আর হ্যাঁ, আজকে রাতে আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে!
----কি সেটা?
----সেটা রাত হলে জানবেন!
.
.
রাতে রান্না অনুই করলো ৷ বিরিয়ানি রান্না করেছে সে ৷ দুজনে একসাথে খাওয়া শুরু করলাম ৷ অনু আর আমি মুখোমুখি বসে খাচ্ছি ৷ তার চোখ আমার চোখে আর আমার চোখ তার নেকাপ বরাবর ৷ কষ্ট করে খাবে অথচ মুখটা দেখাবেনা ৷ খাওয়া শেষ করে আমি আমার রুমে গেলাম ৷ বই পড়ছিলাম ৷ আচমকা অনু রুমের ভেতর প্রবেশ করলো ৷ বোরখা গায়ে দেওয়া কিন্তু নেকাপ মুখে নেই ৷ ওড়না পেঁচিয়েছে মুখে ৷ অনুর হাতে একগুচ্ছ গোলাপ!
তার লক্ষ্যণ ভাল দেখছিনা ৷ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি তার দিকে ৷ অকস্মাৎ অনু আমার হাতে ফুলগুলো ধরিয়ে দেবার পর আদুরে গলায় বলল,
----আমাকে বিয়ে করবেন? একটা কথায় উত্তর দিবেন ৷ হ্যাঁ, অথবা না!
.
যা ভেবেছিলাম তাই হলো ৷ সে যে প্রেমের প্রস্তাব দিবেনা ভাল করে জানতাম ৷ অবাক হলাম না ৷ খুশি বা রাগান্বিতও হলাম না তার আচরণে ৷ তাকে উত্তর দেবার জন্য ভাবতে হলোনা ৷ সহজ গলায় উত্তর দিলাম,
----না ৷ আমি তোমাকে বিয়ে করবোনা ৷ এক কথাতেই বললাম!
.
অনু বিয়ের প্রস্তাব দেবার পর লাজরঙ্গা হয়ে মাথা নিচু করে ছিল ৷ কিন্তু তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করাই তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল ৷ তার অশ্রুভেজা চোখে যেন দুঃখের অনলের ছাঁপ খুঁজে পেলাম!
অনু একরাশ দুঃখ নিয়ে ধীর পায়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল ৷ তার কষ্ট দেখে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া হলোনা! জানতাম তাকে আমার জন্য কাঁদতে হবে ৷ শুধু শুধু আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল!
.
.
ওয়াশরুম থেকো টাওয়াল জড়িয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে রুমের ভেতরে ঢুকলো অনু ৷ ভেজা চুলে তাকে দেখে চোখ সরাতে পারছিনা ৷ শুধু বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে থাকতে মন চাচ্ছে ৷ পাগল মনটা অনুর ঢেউ খেলানো দেহের রুপে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল ৷ এলোমেলো ভাবনাগুলো মাথায় এসে ঘুরপাক খাচ্ছিল ৷ আচমকা অনু তার গা থেকে টাওয়াল সরিয়ে আমার গায়ের উপর ছুঁড়ে মারলো ৷ অতঃপর অন্য রুম থেকে একগুচ্ছ গোলাপফুল এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
----কি চাস? আমার শরীর? নাকি আমার ভালবাসা?
.
তাকে প্রতিত্তরে কিছুই বলতে পারছিনা ৷ কথা বের হচ্ছেনা গলা দিয়ে ৷ মুখের ভেতর কাঁটা দিয়ে আটকে রেখেছে কে যেন?
অনুর কথার কোনো জবাব দিতে পারছিনা দেখে সে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে অগ্নিমূর্তি রুপ ধারণ করলো ৷ ড্রয়ার থেকে রিভলবার বের করলো ৷ ৷ রিভলবার দেখে আঁতকে উঠলাম ভয়ে ৷ আমার আত্মা যেন শুকে কাঠ হয়ে গেল ৷ ভয়ে প্রাণ একবার দেহ ছাড়ছিল আরেকবার দেহ ছুঁয়ে দিচ্ছিল!
অপ্রত্যাশিতভাবে, অনু রিভলবারের ট্রিগারে চাপ দিলো ৷ বিকট শব্দ হলো ৷ বুলেট বিদ্ধ হলো আমার বুকের বা-পাশে ৷ তরতর করে রক্ত পড়ছে ৷ অথচ আমার ব্যাথা হচ্ছিল না ৷ শুধু হাত-দু'খানা শীতল হয়ে এলো!
আপনাআপনিই ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার ৷ এতক্ষণ ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম ৷ ঘর্মাক্ত ও ঘুম জরানো চোখে দেখতে পেলাম অনু আমার হাত ধরে আছে ৷ সামান্য শব্দ তৈরি করে কাঁদছে সে ৷ তার চোখ দিয়ে অনবরত চোখের জল ঝরছিল দেখে জোরালো কন্ঠে বললাম,
----কি ব্যাপার, কাঁদছো কেন এভাবে?
.
অনুর কান্নার শব্দ যেন বেড়ে গেল ৷ এবার হাউমাউ করে কাঁদছে ৷ অসহ্য লাগছে কান্না দেখে ৷ ধমক মেরে বললাম চুপ করো ৷ অনু ধমক শুনে কেঁপে উঠলো ৷ কান্নার শব্দ কিছুটা কমে আবারো উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলো!
আবারো ধমক মারলে, অনু উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
----আমাকে ভালবাসতে কি সমস্যা আপনার? আমার কিসের অভাব? রুপে,যৌবনে কিসের সমস্যা? সেই ক্লাস ৮ থেকে আপনার পিছু নিয়েছি ৷ কখনোই আমাকে বুঝলেন না ৷ যখন আপনি এসএসসি পরীক্ষা দিলেন, আর আমি ক্লাস ৮ এ তখন আপনাকে আমি একটা চিঠি দিয়েছিলাম ৷ চিঠিটা পেয়ে আপনি যেন হিরো হয়ে গেছিলেন ৷ আমার প্রস্তাব প্রত্যাখান তো করলেন, সেই সাথে মজা করলেন চিঠিটা নিয়ে ৷ পুরো স্কুল, পাড়া প্রতিবেশীর সবাইকে চিঠিটার কথা বলে দিয়েছিলেন ৷ খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন ৷ ঐদিন পর থেকে সবার হাসির পাত্র হয়েছিলাম ৷ এরপরও আপনার প্রতি আমার ভালবাসা একটুও কমেনি ৷ আপনি গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেলেন যেদিন, সেদিন থেকে প্রতিটা দিন আমি সীমাহীন কষ্টে কাটিয়েছি ৷ আমি এসএসসিতে পাশ করার পর থেকে আপনার ঠিকানায় কমপক্ষে ১হাজার টা চিঠি দিয়েছিলাম ৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য আপনি একটা চিঠিরও উত্তর দেননি ৷ আমার তো মনে হয় আপনি চিঠিগুলো খুলেই দেখেন নি!
এত ভালবাসি আপনাকে অথচ আমাকে এড়িয়ে চলেন ৷ আমি স্কুল লাইফে দেখতাম আপনি পর্দায় থাকা মেয়েদের পছন্দ করেন ৷ এজন্য সিদ্ধান্ত নিই আমি পর্দানশীল হয়ে যাবো, তাছাড়া ইসলাম ধর্মের প্রতিও আমার একটা টান ছিল তাই পর্দাকে ধারণ করি ৷ কিন্তু এতেও আপনি আমার প্রতি আকৃষ্ট হলেন না ৷ কিন্তু কেন? আজকে আবারো লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম, এরপরও ফিরিয়ে দিলেন, কেন? কিসের জন্য? আমার দোষটা কোথায়? নাকি ভাবী বানিয়ে বানিয়ে এসিড নিক্ষেপের গল্প বলেছিল সেটার জন্য ভেবে নিয়েছেন আমাকে দেখতে কুৎসিত লাগবে তাই আমার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন না, তাইতো? কিন্তু না, আমাকে কেউ এসিড নিক্ষেপ করেনি ৷ ঐসবই ভাবীর বানানো কথা ছিল ৷ জানেন কিসের জন্য আমি লেখাপড়ায় এত পিছিয়ে? এজন্যই যাতে তাড়াতাড়ি লেখাপড়া শেষ না হয় ৷ লেখাপড়া শেষ হলেই বাবা, মা অন্যকারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে ৷ আর আমি তো চাইনা আপনাকে ছাড়া বিয়ে করতে ৷ আপনি যে অনেক দেরিতে বিয়ে করবেন এটা ভাল করে জানতাম ৷ এজন্য এসএসসিতে ২বার অকৃতকার্য হবার পর ৩ বারের বার পাশ করেছিলাম ৷ কেন অকৃতকার্য হয়েছিলাম জানেন? কারণ প্রতিবারই ফাঁকা খাতা জমা দিতাম ৷ ইন্টারেও ২বার অকৃতকার্য হয়েছিলাম ৷ সবই ছিল আপনাকে ভালবাসার কারণে ৷ এসব কিছুই আপনাকে চিঠির ভাষায় লিখে পাঠিয়েছিলাম,অথচ আপনি চিঠির জবাব দেন নি ৷ কিসের জন্য বলেন তো?
.
অনু কথাগুলো অনেক কষ্টে, ক্রন্দণরত অবস্থায় ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছিল ৷ তার কথায় কষ্টের উদয় হলেও নিজেকে এসবের জন্য দোষী বলে মনে হলোনা ৷ আমি তো তাকে বলিনি এরকম নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসো ৷ ভীষণভাবে অবাক হলাম চিঠির কথা শুনে ৷ সে এতগুলো চিঠি লিখেছিল অথচ, আমি এর কিছুই জানিনা ৷ তীর্যক কন্ঠে বললাম,
----কই আমি তো কোনো চিঠি পাইনি!
.
অনু চোখের পানি মুছতে গিয়ে থেম গেল ৷ অতঃপর জোরালো কন্ঠে বলল,
----মিথ্যাচার করবেন ভাল করে জানতাম ৷ আমি জানি আপনি এখন আর কিছুতেই আমাকে ভালবাসবেন না ৷ আমার কষ্টে বিন্দুমাত্র ব্যথিতও হবেন না ৷ কারণ আপনি অন্যকারো জন্য দিওয়ানা ৷ কিন্তু সে কি আমার চেয়ে পারফেক্ট ছিল? দেখুন তো!
.
কথাটি বলেই অনু তার মুখ থেকে ওড়নাটা সরিয়ে ফেলল.....
.
চলবে....
.
আগের পর্ব লিংক]]\\

#অদৃশ্য_পরী (পর্বঃ ৬)
লিখাঃ Sifat Arnab Rehan.
.
----সে কি আমার চেয়ে পারফেক্ট ছিল? দেখুন তো!
.
কথাটি বলেই অনু তার মুখ থেকে ওড়নাটা সরিয়ে ফেলল!
আমার ছোট্ট এই জীবনে বহু কিছু দেখে অবাক হয়েছি, বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি ৷ কিন্তু অনু তার মুখ থেকে ওড়নাটা সরানোর পর তার চেহারাটা দেখে যতটা অবাক হলাম ততোটা কখনো হইনি ৷ অবাকের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছি ৷ আমি যখন খুব খুশি হই তখন মনপ্রাণ উজার করে নির্বিগ্নে শুধু হাসি, কিংবা চোখের বৃষ্টি ঝরাই ৷ এখন আমি ভাললাগার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি ৷ খুব করে হাসতে মন চাচ্ছে, কিন্তু পারছিনা হাসতে ৷ হাসি যেন আটকে গেছে ৷ চোখের বিন্দু বিন্দু ঝর্ণাধারা ঝরাতে মন চাচ্ছে কিন্তু ঝরছেনা কেন যেন! হ্নদয়ে ভাললাগার নদী প্রবাহিত হচ্ছে সেই নদীতে যেন আমি সাঁতার কাটছি ৷ কিন্তু ভয় হচ্ছে ডুবে যাব কিনা ৷ ভাললাগার পাশাপাশি মনের ভেতর একধরণের চাপা কষ্ট অনুভব করছিলাম ৷ তাকে হারানোর কষ্ট হয়তো ৷৷ তাকে হারিয়ে ফেললাম কিনা এই চিন্তা মাথায় যেন ঘুরপাক খাচ্ছিল ৷ যদি তাকে হারিয়ে ফেলি তখন আর বেঁচে থাকার কোনো আশা থাকবেনা ৷ আর এই ভয়টারই উদয় হচ্ছে ৷ আসলে আমি ভুল করেছি ৷ এতদিন আমি ভ্রমের মধ্যে ছিলাম, অথচ সেটা বুঝতেও পারিনি ৷ জঙ্গলে দেখা মেয়েটিই যে অনু, এটা আজকে জানতে পারলাম ৷ যদি আগেই অনু আমাকে মুখটা দেখাতো তাহলে আজ অনুর থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাবার পর তাকে ফিরিয়ে দিতাম না ৷ ভুলটা আসলে আমারই ছিল, বড় ভুল ৷ এ ভুলের মাশুল দিতে হবে আমাকে ৷ আমি পারতাম ভাবীর সহযোগিতা নিয়ে অনুর মুখটা দেখতে ৷ কিন্তু আমার চেষ্টাই ছিলনা ৷ চেষ্টা থাকবেই বা কেমনে? আমার ভ্রমের জগতে যে মেয়েটাকে কল্পনা করতাম তাকেই তো এতদিন অনু হিসেবে চিনে আসছি, কিন্তু সে যে কল্পনা ছিল এটা সেসময় বুঝতে পারিনি ৷ এতদিন পর সত্যটা উন্মোচন হলো ৷ হতভম্বের দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকিয়ে আছি ৷ মনপ্রাণ উজার করে তাকে দেখছি ৷ তাকে অনু ভাবতে ইচ্ছা করছেনা, সে তো রাহনুমা; আমার রাহনুমা; প্রথম প্রেম!
আমার তাকানো দেখে অনু রাগান্বিত চোখে আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ৷ তার রাগ হওয়া স্বাভাবিক ৷ একটু আগে তো তাকে অপমানিত করেছি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে ৷ এখন আবার তার দিকে প্রেমময়ী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি ৷ এহেন আচরণে সে রাগবেনা তো কি করবে? অনু উত্তেজিত হয়ে রাগের প্রতিধ্বনীতে আমাকে বলল,
----এভাবে তাকিয়ে থেকে আর লাভ হবেনা ৷ অনেক হয়েছে আমার পাগলামী, আর না ৷ একটা মানুষের ভালবাসা পাবার জন্য অনেক কিছু করেছি, কিন্তু পাইনি ভালবাসা ৷ উল্টো ছোট হয়েছি, অপমানিত হয়েছি ৷ আজকের পর থেকে আর কখনো আপনাকে বিরক্ত করবোনা ৷ আমাকেও কষ্টের আগুনে জ্বলতে হবেনা ৷ আর এই যে আমার মুখটা দেখলেন না? এই মুখটাকেই ভালবেসে যান, আমাকে ভালবাইসেন না ৷ আর ভালবেসে কোনো লাভও হবেনা, মরে গেলেও আমি আর আপনাকে গ্রহণ করছিনা ৷ আমি একবার যেটা বলি সেটাই করি!
.
শেষ কথাটি বলার সময় অনু যেন কেঁদেই দিলো ৷ চোখ থেকে ঝরঝর করে বিন্দু বিন্দু অশ্রুসজল গড়িয়ে পড়লো তার শ্যামবর্ণের গালে ৷ গালের যে অংশে চোখের পানি পড়ছিল সেখানটা লালচে হয়ে যাচ্ছিল ৷ সে ওড়নার একাংশ দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হয়ে গেল ৷
.
এবারও আমি তাকে কিছু বলতে পারলাম না ৷ জঙ্গলে দেখা সেই রাহনুমাই আমার চাচাতো বোন, এরপরও যেন তাকে কিছু বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছি ৷ বুঝতে পারিনা কেন এমন হয়! যদি আজ সে মুখটা না দেখাতো তাহলে তার সাথে হাজারো কথা বললেও কোনো সমস্যা হতোনা ৷ কিন্তু সে মুখ দেখানোর পর যখন প্রকাশিত হলো অনুই আসলে রাহনুমা তখন আমি নির্বাক, নিস্তব্দ এক জড়পদার্থ হয়ে গেলাম ৷ তার নিকট আমি যেন একটা খড়কুটো, বাতাসে উড়ে যাবো তবুও বলতে পারবোনা অনু আমাকে শক্ত করে ধরো; নয়তো হাওয়ার সাথে মিশে যাবো আমি; তোমার থেকে বহুদূরে চলো যাবো, হারিয়ে যাবো আমি ৷ এমনটা বলার শক্তিটাও আমি পাবোনা!
ক্রমে ক্রমে কষ্ট যেন আমাকে ঘিরে ধরছিল ৷ কষ্টের অসংখ্যা তীর বুকের জমিনে বিদ্ধ হবে এটার জন্য প্রতিক্ষা করা ছাড়া কোনো পথ খুঁজে পেলাম না ৷ কান্না করতে মন চাচ্ছিল কিন্তু কান্নাও আমার সাথে খেলা করছে, লুকোচুরি খেলা ৷ আচমকা বিকট শব্দ আমার কানে এলো ৷ অনু ধপাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে, সেটার শব্দই কানে এলো ৷ এভাবে দরজা বন্ধ করায় দুশ্চিন্তা মাথায় এসে ধাক্কা দিলো ৷ কোনো অঘটন ঘটাবে নাকি সে? রাগে, অভিমানে হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে ৷ ক্ষণিক পর কাম্নার শব্দ শুনতে পেলাম, উচ্চশব্দে কাঁদছে ৷ অনুই কান্না করছে ৷ তার মতিগতি ভাললাগছেনা ৷ মেয়েদের আবেগ একটু বেশি ৷ ধৈর্য্যের মাত্রা তাদের বেশি থাকলেও, আবেগপ্রবণ বিষয়ে তারা ধৈর্য্য ধরতে পারেনা ৷ তখন ভাল-মন্দ বাছবিচার না করে ভুল কাজ করে ফেলে ৷ এছাড়া বড় ধরণের কষ্টে নিজেদের শামলাতে পারেনা ৷ বিশেষ করে প্রেমঘটিত বিষয়ে কষ্ট পেলে আরো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ৷ অনু একটু বেশিই আবেগপ্রবণ ৷ তাকে নিয়ে ভয়ের সৃষ্টি হলো ৷ রুমে আর বসে থাকতে পারলাম না ৷ রুম থেকে বেরিয়ে অনুর রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম ৷ দরজায় কড়া নাড়বো কি নাড়বোনা এ নিয়ে মনের সাথে রীতমত যুদ্ধ করলাম ৷ এক মন বলছিল দরজা খুললেই অনু তোকে মারবে, মেরে কাঠের তক্তা বানাবে সেই তক্তা দিয়ে খাট বানাবে সেই খাটে অনু ঘুমাবে ৷ আরেক মন বলছিল দরজায় কড়া নাড়ো এতে অনু খুশি হবে এবং তার মনে তোমার প্রতি ভালবাসা নতুন করে তৈরি হবে ৷ যাবতীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে সাহস করে দরজায় কড়া নাড়লাম ৷ কয়েক মুহূর্ত পর অনু দরজাটা খুললো ৷ এবার সে মুখে ওড়না পেঁচিয়েছে ৷ আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকিয়ে উচ্চশব্দে বলল
----কি, আপনি ভেবেছিলেন আমি আত্মহত্যা করবো? জি না, আমি এতটা বোকা না যে একটা হাঁদারামের জন্য সোনার জীবনটা নিজ হাতে টিপে মারবো ৷ আমাকে জ্যান্ত দেখতে পাচ্ছেন তো? যান এবার!
.
মৃদ্যুভাবে কাশি দিয়ে আমতাআমতা করে বললাম,
----আরে না, আমি কেন ওরকমটা ভাবতে যাবো ৷ এমনিই মনে হলো তোমার সাথে কথা বলি, তাই দরজায় কড়া নাড়লাম ৷ একটা কথা বলেই চলে যাবো!
----কক্ষোনো না, আজ থেকে আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই, যান এখান থেকে ৷ এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে ৷ একটা মেয়ের রুমে কোনো পুরুষের আসা ঠিক না, আপনি উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলতে পারেন!
----কিহ? আমি কেন তোমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করবো? আমি কি ওরকম?
----জি না, আপনি ওরকম না, আপনি সেইরকম ৷ শুধু মেয়েদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকেন ৷ আরে ধুর, আমি কেন আপনার সাথে এত কথা বলছি? যান তো যান, আমার খুব ঘুম পেয়েছে ৷ বাসায় আঙ্কেল, আন্টি থাকলে এতক্ষণ জেগে থাকতে দিতোনা!
----ঘুমাবে ঘুমাও, না করছিনা ৷ আপাতত রুমের ভেতর যেতে দাও ৷
----বললাম না, ঘুমাবো ৷ যান তো!
----যাবো, আরেকটু থাকি না?
----না, যান!
----তাহলে তোমার মুখটা আরেকটু দেখতে দাও
-----এখন আর আমার সাথেৱ প্রেম দেখিয়ে কোন লাভ নেই ৷ অন্যকারো জন্য ঐ প্রেম জমিয়ে রাখেন!
----ইশ! তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো!
----তাতে আপনার কি?
----আমি তোমার ভার্জিন জামাই!
----ওরে আমার ভার্জিন রে! দূর হন!
---- একটা কথা বলো তো, হঠাৎ করে তুমি ফের মুখ ঢেকে রেখেছে কেন? আজব!
-----ইচ্ছা হয়েছে তাই! শোনেন, ৩ পর্যন্ত গুণবো, যদি এরমধ্যে না যান, তাহলে আপনার খবর করবো!
----কি খবর করবে?
----আপনার কপালের মাংস তুলে ফেলবো!
----এটা তো আমার জন্যই ভাল হবে!
.
কথাটা বলা শেষ হয়নি, ওমনি অনু আমার শার্টের কলার ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো ৷ বাঁধাকে উপেক্ষা করে খুব সহজে আমার ঠোঁটে মৃদ্যুভাবে কামড় বসিয়ে দিলো ৷ অতঃপর গভীর ভাবে চুম্বনের আঁচর কাটতে লাগলো ৷ বেশকিছুক্ষণ চলতে লাগলো ৷ আমি নিথর, নিশ্চল মানবের ন্যায় একদম বৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ৷ শরীর কাঁপছে সর্বোচ্চ মাত্রায় ৷ অনুর পরশে রক্তের বিন্দুকণাতেও ভালবাসার পরশের সুখানুভূতি অনুভব করলাম ৷ যেন হারিয়ে গেলাম অচিন গ্রহে, সেই গ্রহের সমস্ত সুখ অনুকে সাথে নিয়ে লুটিয়ে নিচ্ছিলাম ৷ সুখের চাদরে দুজনে জড়িয়ে আছি ৷ অকস্মাৎ, অনু আমাকে ছেড়ে দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো ৷ অতঃপর থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ডুকরে কেঁদে উঠে রাগান্বিত স্বরে বলল,
----যা, তোরে সারাজীবনের জন্য মুক্ত করে দিলাম ৷ এটাই ছিল আমার থেকে পাওয়া তোর শেষ ভালবাসার পরশ ৷ হ্যাঁ, নির্লজ্জের মতই আমার পরশ তোকে উপহার দিলাম ৷ ৷ আজকে পর থেকে আমাকে আর পাবিনা ৷ আমি তোর এই স্পর্শটাকে মনে করেই সারাজীবন কাটিয়ে দিবো!
.
অনু কথাগুলো বলেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো ৷ আমি হতবিহব্বল ও মর্মাহত মন নিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়া অবস্থায় ঝিম মেরে আছি ৷ তাকে কোনো কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি ৷ অনুর কান্নার শব্দ ভেসে আসছে ৷ তার কান্নার শব্দে আমার বুকে যেন তীরের বিষাক্ত ফলা বিদ্ধ হচ্ছিল ৷ আমি হয়তো তার ভালবাসা থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হয়ে গেলাম ৷ তার চোখে আমার জন্য যে পরিমাণ রাগ ও অভিমানের ছাঁপ দেখতে পেলাম, সেই রাগ ও অভিমান ভাঙ্গতে হয়তো আমার জীবন পার হয়ে যাবে! কিন্তু আমাকে ধৈর্য্যহারা হলে চলবেনা ৷ তার অভিমান, রাগ ভাঙ্গার যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে ৷ আজ থেকে সেই চেষ্টা চলবে ৷ চেষ্টাটা ততোদিন পর্যন্ত চলবে যতদিন না সে আমার হাতটা ধরে বলবে, “চলো সুখের নীড়ে বাস করি দুজনে!"
.
এখন আর বিছানাতে যেতে মন চাচ্ছেনা ৷ অনুর কান্নায় মনটা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাচ্ছে ৷ তার কান্নার শব্দ ও চোখের জল প্রমাণ করে সে আমাকে কতটা ভালবাসে ৷ অথচ এটা আমি বুঝিনি ৷ কতটা বোকা ছিলাম আমি ৷ আমি আবারো ভুল করেছি ৷ অনু হয়তো চেয়েছিল আমি যেন তাকে অনু ভেবেই ভালবাসতে শুরু করি ৷ জঙ্গলে দেখা সেই রাহনুমাকে নয় ৷ কিন্তু আমি তো ভুল করলাম ৷ যদি এখন ফের তার মুখটা দেখার কথা ব্যক্ত না করতাম, তাহলে হয়তো সে এতটা কষ্ট পেতোনা ৷ আজ থেকে তাকে অনু ভেবেই ভালবেসে যেতে হবে ৷ সেই অনুকে ভালবাসবো যাকে আমি ৮ বছর আগে দেখেছিলাম ৷ যাকে আমি চাচাতো বোন হিসেবে জানি ৷ সেই অনুকে ভালবাসবো যে আমাকে আজ প্রথমবার তার চেহারা দেখালো ৷ তাকে নয় যাকে জঙ্গলে দেখে পাগল হয়েছিলাম!
.
.
অনুর কান্না থামছিলনা ৷ আমি যে তাকে বলবো, “কেঁদোনা" এই কথাটাও কেন যেন মুখ দিয়ে বের হচ্ছেনা ৷ হঠাৎ করে অনুর কান্না বন্ধ হয়ে গেল ৷ চমকে উঠলাম ৷ অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি সে?
পরে মনে হলো হয়তো ঘুমিয়ে গেছে ৷ আমার চোখেও যেন জগতের যাবতীয় ঘুম এসে জরো হয়েছে ৷ অনুকে নিয়ে অলিক কল্পনা হ্নদয়ের ক্যানভাসে আঁকতে আঁকতে ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করলাম!
.
.
টং দোকানের চা খাবে বলে অনু আবদার করেছে ৷ গাড়িটা থামিয়ে দুজনে দোকানের দিকে গেলাম ৷ দু-কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম ৷ অনুর মুখে মুগ্ধতার হাসি ৷ তার হাসি দেখলে প্রকৃতির সমস্ত কিছুর সৌন্দর্য যেন বেড়ে যায়, যা অসুন্দর তাও যেন সুন্দর লাগে ৷ কোকিলের সুরেলা কন্ঠের মত কাকের কন্ঠকেও সুমিষ্ট মনে হয় ৷ সবই অনুর হাসির ভাললাগার রহস়্য ৷ মানুষটা আমাকে প্রতিনিয়ত সুখের পরশ উপহার দিয়ে যাচ্ছে ৷ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করছিলাম ৷ অনু নির্লিপ্তে তৃপ্তির সাথে চা পান করছিল ৷ আমার চোখ বরাবরের মত তার চেহারার দিকেই রইলো ৷ সে আর মুখ ঢেকে রাখেনা, আমার আবদারে; তবে গায়ে বোরখা ঠিকই জরানো থাকে ৷ অনুর চা পান শেষ হলে গাড়িতে উঠে অগ্রসর হতে হলো ছোট্ট একটা নদীর দিকে ৷ আজ অনু নদীর সৌন্দর্যে বিলিন হতে চায় ৷ নদীতে পৌঁছলাম ৷ আঁকাবাকা নদী ৷ নদীর অন্যপাশে দীগন্তজোরা ধান ক্ষেত ও অনেকগুলো ঘর ৷ এপাশের এক পাশে লম্বা নারিকেল গাছের সারি! নদীর পানি শুকিয়ে গেছে বলা যায় ৷ তবে নৌকা চলছে ৷ একটা বড় আকারের নৌকা দিয়ে মানুষদের পারাপার করা হয় ৷ নদীতে পৌঁছে অনুর আবদার অনুযায়ী চলতে হলো ৷ তার আবদার নৌকাতে চড়বে সে ৷ তবে মাঝি হতে হবে আমাকে ৷ কঠিন চাওয়া পূরণ করতে হবে ৷ কি আর করা!
এক মাঝির নৌকা এক ঘন্টার জন্য ভাড়া নিলাম ৷ দুজনে নৌকাতে উঠলাম ৷ নৌকা চালাচ্ছিলাম কিন্তু ঠিকমত পারছিলাম না ৷ নৌকা এদিক সেদিক আঁকাবাকা চলছিল ৷ অনু এসব দেখে হাসিতে ভেঙ্গে পড়ছিল ৷ তার হাসি দেখে মনে হচ্ছে হাসতে হাসতে বেহুশ হয়ে যাবে সে ৷ নৌকায় চালাবো নাকি তার হাসি দেখবো বুঝে উঠতে পারছিনা!
তার হাসি দেখা বাদ দেওয়া মানে স্বর্গ সুখ হাতছাড়া করা ৷ ঈষৎ টোল পড়া ফর্সা গালের হাসি আমার বুকটা ভাললাগায় ভরিয়ে দেয় ৷ এই ভাললাগার সুখ যেন স্বর্গীয়!
.
অপ্রত্যাশিতভাবে মুহূর্তে পুরো আকাশটা ঘণকালো মেঘে ছেঁয়ে গেল ৷ যেন বৈশাখী আকাশের মেঘ ৷ ঝড় আসবে এমন লাগছে ৷ অথচ এটা শীতকাল ৷ আচমকা আকাশে মেঘ জমার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না ৷ আমার মনে ভয় ঢুকে গেল ৷ অনুকে দেখে চিন্তিত মনে হলোনা ৷ সে তৃপ্তিতে আছে ৷ তাকে বাড়ি যেতে বললাম, কিন্তু সে যাবেনা বলছে ৷ বৃষ্টি নামবে বলে সাবধান করলাম, সে জবাব দিলো বৃষ্টিতে ভিজবে আজ!
নিরুপায় হয়ে নৌকা চালিয়ে যেতে হলো ৷ কয়েক মুহূর্ত পরই ঝুম বেগে বৃষ্টি নামা শুরু হলো ৷ মুষলধারে বৃষ্টি ৷ কয় ঘন্টা যে বৃষ্টি চলতে থাকে কে জানে? নদী থেকে কিছুটা দূরে রাস্তা, সেখানে গাড়ি রাখা আছে ৷ গাড়িতে গেলে হয়তো ভেজা কাপড় বদলিয়ে নতুন কাপড় পড়া যাবে কিন্তু অনু যেতে চাচ্ছেনা ৷ আমার গাড়িতে প্রয়োজনী কাপড় রেখে দিই, অনুকে বিষয়টা বললে নৌকা থেকে না যাবার জন্য পণ করলো ৷ ভিজতে লাগলাম দুজনে ৷ ভিজে একাকার ৷ বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন তীরের ফলার মত ৷ প্রতিটা শিলা বৃষ্টির মত বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে তীব্র বেগে লাগছিল ৷ কাকভেজা হয়ে অনুর দিকে তাকিয়ে আছি ৷ বৃষ্টিভেজা অনুর ফর্সা গালটার দিক থেকে চোখ সরানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও জাগছেনা! অনুও আমার দিকে প্রেমময়ী গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ৷ তার ঠোঁট কাঁপছে ৷ শরীরও কাঁপছে মৃদ্যুভাবে ৷ আমার শরীর যতটা না শীতের জন্য কাঁপছে তারচেয়ে বেশি কাঁপছে অনুর প্রতি অন্যরকম অনুভূতি তৈরী হওয়ায় ৷ খুব করে মন চাচ্ছিল তাকে শক্ত করে বুকের জমিনে চেপে ধরে রাখতে ৷ কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছিনা ৷ বলার সাহস হারিয়ে গেছে ৷ আচমকা অনু নিজেই আমাকে আষ্টেপিষ্টে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিলো ৷ আমার মনের চাওয়া হয়তো সে মন দিয়ে পড়তে পারে, তাকে চাওয়ার কথাটা না বলতেই নিজে থেকে আমার চাওয়াটা পূরণ করলো ৷ অনু জড়িয়ে ধরায় মুহূর্তেই শীত উধাও হয়ে গেল ৷ তার দেহের পরশে আমার পুরো শরীর যেন উষ্মতায় ভরে গেল!
আচমকা অনু আমাকে ছেড়ে দিলো ৷ অপ্রত্যাশিতভাবে সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে নৌকা থেকে নদীর ঠান্ডা পানিতে ফেলে দিলো ৷ বড়সর ধাক্কা খেলাম তার এমন আচরণ দেখে ৷ সে এমন দুষ্টুমি কেন করলো বুঝলাম না? অতঃপর কোনো কথা না বলে সে নৌকার বৈঠা দিয়ে আমার মাথায় সজোরে আঘাত করলো ৷ চিৎকার মেরে উঠলাম!
.
.
ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার ৷ তারমানে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম ৷ এমন ভয়াবহ স্বপ্নের প্রভাবে আমার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে ৷ তিন রাত্রী এমন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখলাম ৷ এই স্বপ্নগুলোর কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছিনা ৷ বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখতে তো স্বপ্নের অর্থ বুঝা যায় অনু আমার অনিষ্ট করবে ৷ কিন্তু কিসের জন্য সে আমার ক্ষতি করতে যাবে?
.
মেঝেতে বালিশ ছাড়ায় শুয়ে ছিলাম, কিন্তু এখন আমার মাথার নিচে বালিশ ও গায়ে একটা কম্বল দেখতে পাচ্ছি ৷ নিশ্চয় অনুই আমার মাথার নিচে বালিশ ও গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিয়ে গেছে ৷ বুঝতে পারলাম সে আমার প্রতি খুবই যত্নশীল ৷ যতই অভিমান করে বলুক, সে আমাকে ভুলে যাবে, সত্যিকার অর্থে সে কখনোই ভুলতে পারবে না ৷ বারবার সে আমার জীবনে ফিরে আসবে, আসতেই হবে ৷ আমি তাকে যতটা না ভালবাসি, তারচেয়ে বেশি সে আমাকে ভালবাসে!
তবে আমি চাই আজ থেকে আমিই যেন তাকে বেশি ভালবাসি, আমার ভালবাসা যেন তার ভালবাসার কাছে জয়ী হয় ৷ আর এই চেষ্টা শুরু হবে আজ থেকে!
.
.
খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গায় ছাদে গেলাম এক্সারসাইজ করতে ৷ হঠাৎ অনু ছাদে চলে এলো ৷ তার গায়ে ইয়োগা ড্রেস শোভা পাচ্ছে ৷ খুবই উত্তেজক লাগছিল তাকে ৷ তবে এই অনু আসলে আসল অনু নয়, এটা সেই আবেদনময়ী অনু ৷ যেটা আমার ভ্রম ৷ এখন আমি আচমকা অনুকে নিয়ে ভ্রমের জগতে পা দিয়েছি ৷ জানিনা এই সমস্যাটা কবে কেটে যাবে ৷ কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে বড়ধরণের দ্বিধায় আছি যে ভ্রমে বা কল্পনায় যাদের দেখা যায় তাদের কি স্পর্শ করা যায়? স্পর্শ করলে তারা কি সেই জায়গাতে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে? যদি তা না হয় তাহলে আমি কেমনে অনুকে স্পর্শ করতে পারছি? নাকি এটা আসলে কোন ভ্রমই নয়, বাস্তব? যদি বাস্তব হয় তাহলে এটা নিশ্চয় অনু নয় ৷ অনু তো রাহনুমা ৷ সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে ৷ তাহলে এই আবেদনময়ী মডার্ণ মেয়েটা কে?
আজ থেকে তাকে ভিন্ন নামে ডাকবো ৷ না না এটা ঠিক হবেনা ৷ তারচেয়ে ভাল তাকে অনু-২ বলে ডাকা ৷ অনু-২ যখন আমার কাছাকাছি এলো তখন ক্ষ্যাপাস্বরে তাকে বললাম,
----এই মেয়ে সত্যি করে বলো তো তুমি কে?
অনু-২ আমাকে ভ্যাঙ্গাতে ভ্যাঙ্গাতে বলল,
----এই মেয়ে সত্যি করে বলো তো তুমি কে?
----আরে আমাকে ভ্যাঙ্গাচ্ছো কেন?
----তো কি করবো? বোকা একটা, এতদিন আমার ভালবাসার পরশ নিয়ে এখন বলছে আমি কে? মন চাই মারি একটা ৷ কিন্তু আমার লক্ষ্মী বাবুটাকে মারবো না, শুধু আদর করবো ৷ আসো তোমাকে একটু আদর করি ৷
.
কথাটা বলেই অনু-২ আমার হাতটা ধরে টেনে তার বুকে জড়িয়ে নিলো ৷ অতঃপর কপালে মৃদ্যুভাবে চুমুর রেখা এঁকে দিলো ৷ এরপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
----দেখো কেমনে শরির চর্চা করতে হয় ৷ আমার দেখাদেখি তুমিও করো!
.
অনু-২ এর কথায় কান না দিয়ে ছাদ থেকে চলে যাচ্ছিলাম ৷ সে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে ক্ষিপ্তস্বরে বলল,
----কই যাও, আমি যেটা বলছি সেটা করো ৷ আজ বেশি কিছু করতে হবে না ৷ দশবার বুকডাউন দিবে, আমিও দিবো ৷ আমার দেখাদেখি করবে, বুঝলে?
.
এটা সহজ হওয়ায় দশবার বুক ডাউন দিলাম ৷ অতঃপর ছাদ থেকে চলে এলাম!
.
.
সকালের
নাস্তা রেডি করতে কিচেনে অনু রান্না করায় বাস্ত হয়ে পড়েছে ৷ কিচেনে প্রবেশ করে তার রান্না করা দেখছিলাম ৷ এবার তার মুখ ঢাকা আছে ওড়না দিয়ে ৷ এটা নিয়ে ভাবলাম না ৷ তার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চলুক, মন খুশিমত চলুক ৷ অনুর পিছে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বললাম,
----কি রান্না করছো?
.
উত্তর পেলাম না ৷ আবারো প্রশ্ন করা হলে কোনো উত্তর পেলাম না ৷ এবার তার গায়ের সাথে আমার গা লাগিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বললাম,
----ওহ, পরোটা ভাজতেছো ৷ আচ্ছা, আর কি রাঁধবে?
.
অনু তাচ্ছিল্যকর কন্ঠে বলল,
---এত ডং দেখান কারে? আমি কি আপনার বউ লাগি? আর কোন সাহসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন? সরে দাঁড়ান বলছি ৷ না না, শুধু সরেই দাঁড়াবেন না, রুম থেকে বের হন!
.
নরম কন্ঠে জবাব দিলাম,
----হুম, তুমি তো আমার বউই হও ৷ বউ বলেই তো গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি ৷ শুধু গা ঘেঁষা কেন? তোমাকে ঝাঁপটেও ধরতে পারি ৷ কি দেখবে কেমনে জড়িয়ে ধরি তোমাকে?
.
অনু তেড়ে উঠে হাতে কুন্তি দেখিয়ে চেঁচানো গলায় বলল,
----আপনি এখান থেকে যাবেন নাকি খুন্তির ছ্যকা দিবো? খুন্তি উত্তপ্ত আছে ৷ গায়ে লাগলেই পুড়ে একদম ছাই হয়ে যাবে আপনার কালো কুচকুচে ত্বক!
.
অনুর ওড়নায় পেঁচানো মুখে গালটা টেনে আদুরে গলায় বললাম,
----ঠিক আছে লক্ষ্মী বউ, আমি যাচ্ছি!
.
.
অনুর সাথেই ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে নাস্তা করছিলাম ৷ তখনই বাবা, মা বাসায় চলে আসলো ৷ তাদের দেখে আমার চেয়ে অনুই বেশি খুশি হলো ৷ কিন্তু বাবা, মা অনুকে দেখে চিনতে পারলোনা কেন যেন? যখন তাদের বললাম এটা তো অনু তখন চিনতে পারলো ৷ এমনকি তারা যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল ৷ তবে তাদের চোখে মুখে কেমন যেন দ্বিধাদ্বন্দ্বের ছাঁপ লক্ষ্য করলাম ৷ আম্মু তো বলে উঠলো, “৬ মাসের মধ্যে অনুর চেহারা এরকম পাল্টে গেল? অনু তো এরকম দেখতে ছিলনা ৷" এটা বলেই, আম্মু, আব্বু ওয়াশরুমের দিকে গেল ৷ বেশকিছুক্ষণ পর তারা সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলের নিকট এলো ৷ আমরা দুজন খাওয়া দাওয়া স্থগিত রেখেছিলাম বাবা, মায়ের সাথে খাবো বলে ৷ অনু আম্মুর কথা শুনে কেমন যেন হয়ে গেল? হয়তো আম্মুর কথায় কষ্ট পেয়েছে ৷ ইতস্ততবোধ করছিল সে ৷ তবুও মুখে কৃত্তিম হাসির সৃষ্টি করে কপালে ভাঁজ ফেলে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করছিল ৷
আম্মু, আব্বু চেয়ারে বসে পড়লো ৷ তারা নাস্তা করতে লাগলো ৷ আম্মু অনুর সাথে নানা রকমের কথা বলছিল আর খাচ্ছিল ৷ তাদের দুজনের কথার মধ্যে আমাকে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল ৷ আম্মু আমাকে নিয়ে প্রশংসামূলক কথা বললেও অনু আম্মুর নিকট আমার নামে শুধু বদনাম ছড়াচ্ছিল!
.
আম্মু হঠাৎ বলল,
----অনু, আমি সেদিন ভাইজানের থেকে যখন শুনলাম তুই আর নীল একে অপরকে ভালবাসিস তখন এটা শুনে খুব রাগ হয়েছিল ৷ তোদের ভালবাসা মেনে নিতে পারছিলাম না কেন যেন? কিন্তু পরে তো তুই ফোন করে বললি নীলের সাথে তোর কিছুই নেই ৷ কয়দিন ধরে তোদের দুজনকে নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেছি ৷ আসলে তোদের মধ্যে প্রেম থাকলে ভালোই হতো ৷ আমার ছেলেটাকে যার তার সাথে বিয়ে দেবার চিন্তা মাথায় আনি ৷ কিন্তু এটা কখনো ভাবিনি যে আমার ছেলের একটা চাচাতো বোন রয়েছে ৷ যে কিনা পরীদের মত সুন্দরী ৷ নীলের সাথে তোকে সত্যিই খুব মানাবে ৷ আমি চাই তুই আমার ছেলের বউ হয়ে ঘরে আস ৷ ঘরটাকে আলোকিত কর ৷ তোর মত এত লক্ষ্মী, সুন্দরী মেয়ে আর আছে নাকি? যদিও বর্তমানে তুই একটু কালো হয়ে গেছিস ৷ সমস্যা নেই ক্রিম মাখলেই আগের মত হয়ে যাবি!
.
আম্মুর কথা শুনে অনু মিটমিট করে হাসলো আর আমার দিকে চোখ টিপেটিপে তাকিয়ে দেখছিল ৷ আম্মুর কথার জবাবে সে ক্ষীণস্বরে বলল,
----কিন্তু আন্টি, আমি তো আপনার ছেলেকে বিয়ে করতে পারবোনা ৷ ওনার মত বোকাকে বিয়ে করা মানে জীবনটা নষ্ট করে দেওয়া!
আম্মু মিষ্টি হেসে বলল,
----আমার ছেলেটা বোকা বলেই তো তোর হাতে তুলে দিতে চাচ্ছি ৷ তুই তাকে চালাক বানাবি ৷ কি পারবিনা?
.
পাশ থেকে আব্বু গম্ভীর গলায় বলল,
----মমতা, তোমার ছেলে মোটেও বোকা না ৷ তুমি বলছো অনুর সাথে তার প্রেম নেই ৷ কিন্তু আমি তো তোমার ছেলের চোখ দেখে বুঝতে পারছি সে অনুকে মনপ্রাণ উজার করে ভালবাসে! আর অনু মামনীও আমার ছেলেটার জন্য পাগল ৷ আমি চাচ্ছি এখনই ওরা বিয়েটা না করুক, আগে চুটিয়ে প্রেম করুক ৷ এখন না করলে কবে করবে, বলো?
.
আব্বুর কথা শুনে অনু যেন লজ্জায় লাজরঙ্গা হয়ে গেল ৷ লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে রইলো!
.
.
খাওয়া দাওয়া শেষ করে অফিসে যেতে বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম ৷ তখন আম্মু আমাকে থামিয়ে দিলো ৷ আবার অনু ভার্সিটিতে যেতে লাগলে তাকেও থামিয়ে দিলো ৷ আম্মু নাকি আমাদের দুজনকে নিয়ে আনন্দঘণ সময় কাটাবে!
.
নাস্তা করার সময় অনুর মুখ খোলায় ছিল ৷ ভার্সিটিতে যাবার সময় সে বোরখা পড়েছিল ৷ কিন্তু আম্মু তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো বোরখা খুলে আসো ৷ কিন্তু অনু বোরখা খুলতে চাচ্ছিল না ৷ আম্মু বারবার বলা সত্বেও না ৷ বুঝলাম না, সে এখন কেন বোরখা খুলতে চাচ্ছেনা? আমার আম্মুর নিকট বোরখা খুলতে কি সমস্যা তার?
.
চলবে.....
.
আগের পর্ব লিংকঃ
#অদৃশ্য_পরী (পর্বঃ ৬)
লিখাঃ Sifat Arnab Rehan.
.
----সে কি আমার চেয়ে পারফেক্ট ছিল? দেখুন তো!
.
কথাটি বলেই অনু তার মুখ থেকে ওড়নাটা সরিয়ে ফেলল!
আমার ছোট্ট এই জীবনে বহু কিছু দেখে অবাক হয়েছি, বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি ৷ কিন্তু অনু তার মুখ থেকে ওড়নাটা সরানোর পর তার চেহারাটা দেখে যতটা অবাক হলাম ততোটা কখনো হইনি ৷ অবাকের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছি ৷ আমি যখন খুব খুশি হই তখন মনপ্রাণ উজার করে নির্বিগ্নে শুধু হাসি, কিংবা চোখের বৃষ্টি ঝরাই ৷ এখন আমি ভাললাগার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি ৷ খুব করে হাসতে মন চাচ্ছে, কিন্তু পারছিনা হাসতে ৷ হাসি যেন আটকে গেছে ৷ চোখের বিন্দু বিন্দু ঝর্ণাধারা ঝরাতে মন চাচ্ছে কিন্তু ঝরছেনা কেন যেন! হ্নদয়ে ভাললাগার নদী প্রবাহিত হচ্ছে সেই নদীতে যেন আমি সাঁতার কাটছি ৷ কিন্তু ভয় হচ্ছে ডুবে যাব কিনা ৷ ভাললাগার পাশাপাশি মনের ভেতর একধরণের চাপা কষ্ট অনুভব করছিলাম ৷ তাকে হারানোর কষ্ট হয়তো ৷৷ তাকে হারিয়ে ফেললাম কিনা এই চিন্তা মাথায় যেন ঘুরপাক খাচ্ছিল ৷ যদি তাকে হারিয়ে ফেলি তখন আর বেঁচে থাকার কোনো আশা থাকবেনা ৷ আর এই ভয়টারই উদয় হচ্ছে ৷ আসলে আমি ভুল করেছি ৷ এতদিন আমি ভ্রমের মধ্যে ছিলাম, অথচ সেটা বুঝতেও পারিনি ৷ জঙ্গলে দেখা মেয়েটিই যে অনু, এটা আজকে জানতে পারলাম ৷ যদি আগেই অনু আমাকে মুখটা দেখাতো তাহলে আজ অনুর থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাবার পর তাকে ফিরিয়ে দিতাম না ৷ ভুলটা আসলে আমারই ছিল, বড় ভুল ৷ এ ভুলের মাশুল দিতে হবে আমাকে ৷ আমি পারতাম ভাবীর সহযোগিতা নিয়ে অনুর মুখটা দেখতে ৷ কিন্তু আমার চেষ্টাই ছিলনা ৷ চেষ্টা থাকবেই বা কেমনে? আমার ভ্রমের জগতে যে মেয়েটাকে কল্পনা করতাম তাকেই তো এতদিন অনু হিসেবে চিনে আসছি, কিন্তু সে যে কল্পনা ছিল এটা সেসময় বুঝতে পারিনি ৷ এতদিন পর সত্যটা উন্মোচন হলো ৷ হতভম্বের দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকিয়ে আছি ৷ মনপ্রাণ উজার করে তাকে দেখছি ৷ তাকে অনু ভাবতে ইচ্ছা করছেনা, সে তো রাহনুমা; আমার রাহনুমা; প্রথম প্রেম!
আমার তাকানো দেখে অনু রাগান্বিত চোখে আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ৷ তার রাগ হওয়া স্বাভাবিক ৷ একটু আগে তো তাকে অপমানিত করেছি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে ৷ এখন আবার তার দিকে প্রেমময়ী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি ৷ এহেন আচরণে সে রাগবেনা তো কি করবে? অনু উত্তেজিত হয়ে রাগের প্রতিধ্বনীতে আমাকে বলল,
----এভাবে তাকিয়ে থেকে আর লাভ হবেনা ৷ অনেক হয়েছে আমার পাগলামী, আর না ৷ একটা মানুষের ভালবাসা পাবার জন্য অনেক কিছু করেছি, কিন্তু পাইনি ভালবাসা ৷ উল্টো ছোট হয়েছি, অপমানিত হয়েছি ৷ আজকের পর থেকে আর কখনো আপনাকে বিরক্ত করবোনা ৷ আমাকেও কষ্টের আগুনে জ্বলতে হবেনা ৷ আর এই যে আমার মুখটা দেখলেন না? এই মুখটাকেই ভালবেসে যান, আমাকে ভালবাইসেন না ৷ আর ভালবেসে কোনো লাভও হবেনা, মরে গেলেও আমি আর আপনাকে গ্রহণ করছিনা ৷ আমি একবার যেটা বলি সেটাই করি!
.
শেষ কথাটি বলার সময় অনু যেন কেঁদেই দিলো ৷ চোখ থেকে ঝরঝর করে বিন্দু বিন্দু অশ্রুসজল গড়িয়ে পড়লো তার শ্যামবর্ণের গালে ৷ গালের যে অংশে চোখের পানি পড়ছিল সেখানটা লালচে হয়ে যাচ্ছিল ৷ সে ওড়নার একাংশ দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হয়ে গেল ৷
.
এবারও আমি তাকে কিছু বলতে পারলাম না ৷ জঙ্গলে দেখা সেই রাহনুমাই আমার চাচাতো বোন, এরপরও যেন তাকে কিছু বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছি ৷ বুঝতে পারিনা কেন এমন হয়! যদি আজ সে মুখটা না দেখাতো তাহলে তার সাথে হাজারো কথা বললেও কোনো সমস্যা হতোনা ৷ কিন্তু সে মুখ দেখানোর পর যখন প্রকাশিত হলো অনুই আসলে রাহনুমা তখন আমি নির্বাক, নিস্তব্দ এক জড়পদার্থ হয়ে গেলাম ৷ তার নিকট আমি যেন একটা খড়কুটো, বাতাসে উড়ে যাবো তবুও বলতে পারবোনা অনু আমাকে শক্ত করে ধরো; নয়তো হাওয়ার সাথে মিশে যাবো আমি; তোমার থেকে বহুদূরে চলো যাবো, হারিয়ে যাবো আমি ৷ এমনটা বলার শক্তিটাও আমি পাবোনা!
ক্রমে ক্রমে কষ্ট যেন আমাকে ঘিরে ধরছিল ৷ কষ্টের অসংখ্যা তীর বুকের জমিনে বিদ্ধ হবে এটার জন্য প্রতিক্ষা করা ছাড়া কোনো পথ খুঁজে পেলাম না ৷ কান্না করতে মন চাচ্ছিল কিন্তু কান্নাও আমার সাথে খেলা করছে, লুকোচুরি খেলা ৷ আচমকা বিকট শব্দ আমার কানে এলো ৷ অনু ধপাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে, সেটার শব্দই কানে এলো ৷ এভাবে দরজা বন্ধ করায় দুশ্চিন্তা মাথায় এসে ধাক্কা দিলো ৷ কোনো অঘটন ঘটাবে নাকি সে? রাগে, অভিমানে হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে ৷ ক্ষণিক পর কাম্নার শব্দ শুনতে পেলাম, উচ্চশব্দে কাঁদছে ৷ অনুই কান্না করছে ৷ তার মতিগতি ভাললাগছেনা ৷ মেয়েদের আবেগ একটু বেশি ৷ ধৈর্য্যের মাত্রা তাদের বেশি থাকলেও, আবেগপ্রবণ বিষয়ে তারা ধৈর্য্য ধরতে পারেনা ৷ তখন ভাল-মন্দ বাছবিচার না করে ভুল কাজ করে ফেলে ৷ এছাড়া বড় ধরণের কষ্টে নিজেদের শামলাতে পারেনা ৷ বিশেষ করে প্রেমঘটিত বিষয়ে কষ্ট পেলে আরো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ৷ অনু একটু বেশিই আবেগপ্রবণ ৷ তাকে নিয়ে ভয়ের সৃষ্টি হলো ৷ রুমে আর বসে থাকতে পারলাম না ৷ রুম থেকে বেরিয়ে অনুর রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম ৷ দরজায় কড়া নাড়বো কি নাড়বোনা এ নিয়ে মনের সাথে রীতমত যুদ্ধ করলাম ৷ এক মন বলছিল দরজা খুললেই অনু তোকে মারবে, মেরে কাঠের তক্তা বানাবে সেই তক্তা দিয়ে খাট বানাবে সেই খাটে অনু ঘুমাবে ৷ আরেক মন বলছিল দরজায় কড়া নাড়ো এতে অনু খুশি হবে এবং তার মনে তোমার প্রতি ভালবাসা নতুন করে তৈরি হবে ৷ যাবতীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে সাহস করে দরজায় কড়া নাড়লাম ৷ কয়েক মুহূর্ত পর অনু দরজাটা খুললো ৷ এবার সে মুখে ওড়না পেঁচিয়েছে ৷ আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকিয়ে উচ্চশব্দে বলল
----কি, আপনি ভেবেছিলেন আমি আত্মহত্যা করবো? জি না, আমি এতটা বোকা না যে একটা হাঁদারামের জন্য সোনার জীবনটা নিজ হাতে টিপে মারবো ৷ আমাকে জ্যান্ত দেখতে পাচ্ছেন তো? যান এবার!
.
মৃদ্যুভাবে কাশি দিয়ে আমতাআমতা করে বললাম,
----আরে না, আমি কেন ওরকমটা ভাবতে যাবো ৷ এমনিই মনে হলো তোমার সাথে কথা বলি, তাই দরজায় কড়া নাড়লাম ৷ একটা কথা বলেই চলে যাবো!
----কক্ষোনো না, আজ থেকে আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই, যান এখান থেকে ৷ এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে ৷ একটা মেয়ের রুমে কোনো পুরুষের আসা ঠিক না, আপনি উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলতে পারেন!
----কিহ? আমি কেন তোমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করবো? আমি কি ওরকম?
----জি না, আপনি ওরকম না, আপনি সেইরকম ৷ শুধু মেয়েদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকেন ৷ আরে ধুর, আমি কেন আপনার সাথে এত কথা বলছি? যান তো যান, আমার খুব ঘুম পেয়েছে ৷ বাসায় আঙ্কেল, আন্টি থাকলে এতক্ষণ জেগে থাকতে দিতোনা!
----ঘুমাবে ঘুমাও, না করছিনা ৷ আপাতত রুমের ভেতর যেতে দাও ৷
----বললাম না, ঘুমাবো ৷ যান তো!
----যাবো, আরেকটু থাকি না?
----না, যান!
----তাহলে তোমার মুখটা আরেকটু দেখতে দাও
-----এখন আর আমার সাথেৱ প্রেম দেখিয়ে কোন লাভ নেই ৷ অন্যকারো জন্য ঐ প্রেম জমিয়ে রাখেন!
----ইশ! তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো!
----তাতে আপনার কি?
----আমি তোমার ভার্জিন জামাই!
----ওরে আমার ভার্জিন রে! দূর হন!
---- একটা কথা বলো তো, হঠাৎ করে তুমি ফের মুখ ঢেকে রেখেছে কেন? আজব!
-----ইচ্ছা হয়েছে তাই! শোনেন, ৩ পর্যন্ত গুণবো, যদি এরমধ্যে না যান, তাহলে আপনার খবর করবো!
----কি খবর করবে?
----আপনার কপালের মাংস তুলে ফেলবো!
----এটা তো আমার জন্যই ভাল হবে!
.
কথাটা বলা শেষ হয়নি, ওমনি অনু আমার শার্টের কলার ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো ৷ বাঁধাকে উপেক্ষা করে খুব সহজে আমার ঠোঁটে মৃদ্যুভাবে কামড় বসিয়ে দিলো ৷ অতঃপর গভীর ভাবে চুম্বনের আঁচর কাটতে লাগলো ৷ বেশকিছুক্ষণ চলতে লাগলো ৷ আমি নিথর, নিশ্চল মানবের ন্যায় একদম বৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ৷ শরীর কাঁপছে সর্বোচ্চ মাত্রায় ৷ অনুর পরশে রক্তের বিন্দুকণাতেও ভালবাসার পরশের সুখানুভূতি অনুভব করলাম ৷ যেন হারিয়ে গেলাম অচিন গ্রহে, সেই গ্রহের সমস্ত সুখ অনুকে সাথে নিয়ে লুটিয়ে নিচ্ছিলাম ৷ সুখের চাদরে দুজনে জড়িয়ে আছি ৷ অকস্মাৎ, অনু আমাকে ছেড়ে দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো ৷ অতঃপর থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ডুকরে কেঁদে উঠে রাগান্বিত স্বরে বলল,
----যা, তোরে সারাজীবনের জন্য মুক্ত করে দিলাম ৷ এটাই ছিল আমার থেকে পাওয়া তোর শেষ ভালবাসার পরশ ৷ হ্যাঁ, নির্লজ্জের মতই আমার পরশ তোকে উপহার দিলাম ৷ ৷ আজকে পর থেকে আমাকে আর পাবিনা ৷ আমি তোর এই স্পর্শটাকে মনে করেই সারাজীবন কাটিয়ে দিবো!
.
অনু কথাগুলো বলেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো ৷ আমি হতবিহব্বল ও মর্মাহত মন নিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়া অবস্থায় ঝিম মেরে আছি ৷ তাকে কোনো কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি ৷ অনুর কান্নার শব্দ ভেসে আসছে ৷ তার কান্নার শব্দে আমার বুকে যেন তীরের বিষাক্ত ফলা বিদ্ধ হচ্ছিল ৷ আমি হয়তো তার ভালবাসা থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হয়ে গেলাম ৷ তার চোখে আমার জন্য যে পরিমাণ রাগ ও অভিমানের ছাঁপ দেখতে পেলাম, সেই রাগ ও অভিমান ভাঙ্গতে হয়তো আমার জীবন পার হয়ে যাবে! কিন্তু আমাকে ধৈর্য্যহারা হলে চলবেনা ৷ তার অভিমান, রাগ ভাঙ্গার যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে ৷ আজ থেকে সেই চেষ্টা চলবে ৷ চেষ্টাটা ততোদিন পর্যন্ত চলবে যতদিন না সে আমার হাতটা ধরে বলবে, “চলো সুখের নীড়ে বাস করি দুজনে!"
.
এখন আর বিছানাতে যেতে মন চাচ্ছেনা ৷ অনুর কান্নায় মনটা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাচ্ছে ৷ তার কান্নার শব্দ ও চোখের জল প্রমাণ করে সে আমাকে কতটা ভালবাসে ৷ অথচ এটা আমি বুঝিনি ৷ কতটা বোকা ছিলাম আমি ৷ আমি আবারো ভুল করেছি ৷ অনু হয়তো চেয়েছিল আমি যেন তাকে অনু ভেবেই ভালবাসতে শুরু করি ৷ জঙ্গলে দেখা সেই রাহনুমাকে নয় ৷ কিন্তু আমি তো ভুল করলাম ৷ যদি এখন ফের তার মুখটা দেখার কথা ব্যক্ত না করতাম, তাহলে হয়তো সে এতটা কষ্ট পেতোনা ৷ আজ থেকে তাকে অনু ভেবেই ভালবেসে যেতে হবে ৷ সেই অনুকে ভালবাসবো যাকে আমি ৮ বছর আগে দেখেছিলাম ৷ যাকে আমি চাচাতো বোন হিসেবে জানি ৷ সেই অনুকে ভালবাসবো যে আমাকে আজ প্রথমবার তার চেহারা দেখালো ৷ তাকে নয় যাকে জঙ্গলে দেখে পাগল হয়েছিলাম!
.
.
অনুর কান্না থামছিলনা ৷ আমি যে তাকে বলবো, “কেঁদোনা" এই কথাটাও কেন যেন মুখ দিয়ে বের হচ্ছেনা ৷ হঠাৎ করে অনুর কান্না বন্ধ হয়ে গেল ৷ চমকে উঠলাম ৷ অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি সে?
পরে মনে হলো হয়তো ঘুমিয়ে গেছে ৷ আমার চোখেও যেন জগতের যাবতীয় ঘুম এসে জরো হয়েছে ৷ অনুকে নিয়ে অলিক কল্পনা হ্নদয়ের ক্যানভাসে আঁকতে আঁকতে ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করলাম!
.
.
টং দোকানের চা খাবে বলে অনু আবদার করেছে ৷ গাড়িটা থামিয়ে দুজনে দোকানের দিকে গেলাম ৷ দু-কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম ৷ অনুর মুখে মুগ্ধতার হাসি ৷ তার হাসি দেখলে প্রকৃতির সমস্ত কিছুর সৌন্দর্য যেন বেড়ে যায়, যা অসুন্দর তাও যেন সুন্দর লাগে ৷ কোকিলের সুরেলা কন্ঠের মত কাকের কন্ঠকেও সুমিষ্ট মনে হয় ৷ সবই অনুর হাসির ভাললাগার রহস়্য ৷ মানুষটা আমাকে প্রতিনিয়ত সুখের পরশ উপহার দিয়ে যাচ্ছে ৷ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করছিলাম ৷ অনু নির্লিপ্তে তৃপ্তির সাথে চা পান করছিল ৷ আমার চোখ বরাবরের মত তার চেহারার দিকেই রইলো ৷ সে আর মুখ ঢেকে রাখেনা, আমার আবদারে; তবে গায়ে বোরখা ঠিকই জরানো থাকে ৷ অনুর চা পান শেষ হলে গাড়িতে উঠে অগ্রসর হতে হলো ছোট্ট একটা নদীর দিকে ৷ আজ অনু নদীর সৌন্দর্যে বিলিন হতে চায় ৷ নদীতে পৌঁছলাম ৷ আঁকাবাকা নদী ৷ নদীর অন্যপাশে দীগন্তজোরা ধান ক্ষেত ও অনেকগুলো ঘর ৷ এপাশের এক পাশে লম্বা নারিকেল গাছের সারি! নদীর পানি শুকিয়ে গেছে বলা যায় ৷ তবে নৌকা চলছে ৷ একটা বড় আকারের নৌকা দিয়ে মানুষদের পারাপার করা হয় ৷ নদীতে পৌঁছে অনুর আবদার অনুযায়ী চলতে হলো ৷ তার আবদার নৌকাতে চড়বে সে ৷ তবে মাঝি হতে হবে আমাকে ৷ কঠিন চাওয়া পূরণ করতে হবে ৷ কি আর করা!
এক মাঝির নৌকা এক ঘন্টার জন্য ভাড়া নিলাম ৷ দুজনে নৌকাতে উঠলাম ৷ নৌকা চালাচ্ছিলাম কিন্তু ঠিকমত পারছিলাম না ৷ নৌকা এদিক সেদিক আঁকাবাকা চলছিল ৷ অনু এসব দেখে হাসিতে ভেঙ্গে পড়ছিল ৷ তার হাসি দেখে মনে হচ্ছে হাসতে হাসতে বেহুশ হয়ে যাবে সে ৷ নৌকায় চালাবো নাকি তার হাসি দেখবো বুঝে উঠতে পারছিনা!
তার হাসি দেখা বাদ দেওয়া মানে স্বর্গ সুখ হাতছাড়া করা ৷ ঈষৎ টোল পড়া ফর্সা গালের হাসি আমার বুকটা ভাললাগায় ভরিয়ে দেয় ৷ এই ভাললাগার সুখ যেন স্বর্গীয়!
.
অপ্রত্যাশিতভাবে মুহূর্তে পুরো আকাশটা ঘণকালো মেঘে ছেঁয়ে গেল ৷ যেন বৈশাখী আকাশের মেঘ ৷ ঝড় আসবে এমন লাগছে ৷ অথচ এটা শীতকাল ৷ আচমকা আকাশে মেঘ জমার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না ৷ আমার মনে ভয় ঢুকে গেল ৷ অনুকে দেখে চিন্তিত মনে হলোনা ৷ সে তৃপ্তিতে আছে ৷ তাকে বাড়ি যেতে বললাম, কিন্তু সে যাবেনা বলছে ৷ বৃষ্টি নামবে বলে সাবধান করলাম, সে জবাব দিলো বৃষ্টিতে ভিজবে আজ!
নিরুপায় হয়ে নৌকা চালিয়ে যেতে হলো ৷ কয়েক মুহূর্ত পরই ঝুম বেগে বৃষ্টি নামা শুরু হলো ৷ মুষলধারে বৃষ্টি ৷ কয় ঘন্টা যে বৃষ্টি চলতে থাকে কে জানে? নদী থেকে কিছুটা দূরে রাস্তা, সেখানে গাড়ি রাখা আছে ৷ গাড়িতে গেলে হয়তো ভেজা কাপড় বদলিয়ে নতুন কাপড় পড়া যাবে কিন্তু অনু যেতে চাচ্ছেনা ৷ আমার গাড়িতে প্রয়োজনী কাপড় রেখে দিই, অনুকে বিষয়টা বললে নৌকা থেকে না যাবার জন্য পণ করলো ৷ ভিজতে লাগলাম দুজনে ৷ ভিজে একাকার ৷ বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন তীরের ফলার মত ৷ প্রতিটা শিলা বৃষ্টির মত বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে তীব্র বেগে লাগছিল ৷ কাকভেজা হয়ে অনুর দিকে তাকিয়ে আছি ৷ বৃষ্টিভেজা অনুর ফর্সা গালটার দিক থেকে চোখ সরানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও জাগছেনা! অনুও আমার দিকে প্রেমময়ী গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ৷ তার ঠোঁট কাঁপছে ৷ শরীরও কাঁপছে মৃদ্যুভাবে ৷ আমার শরীর যতটা না শীতের জন্য কাঁপছে তারচেয়ে বেশি কাঁপছে অনুর প্রতি অন্যরকম অনুভূতি তৈরী হওয়ায় ৷ খুব করে মন চাচ্ছিল তাকে শক্ত করে বুকের জমিনে চেপে ধরে রাখতে ৷ কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছিনা ৷ বলার সাহস হারিয়ে গেছে ৷ আচমকা অনু নিজেই আমাকে আষ্টেপিষ্টে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিলো ৷ আমার মনের চাওয়া হয়তো সে মন দিয়ে পড়তে পারে, তাকে চাওয়ার কথাটা না বলতেই নিজে থেকে আমার চাওয়াটা পূরণ করলো ৷ অনু জড়িয়ে ধরায় মুহূর্তেই শীত উধাও হয়ে গেল ৷ তার দেহের পরশে আমার পুরো শরীর যেন উষ্মতায় ভরে গেল!
আচমকা অনু আমাকে ছেড়ে দিলো ৷ অপ্রত্যাশিতভাবে সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে নৌকা থেকে নদীর ঠান্ডা পানিতে ফেলে দিলো ৷ বড়সর ধাক্কা খেলাম তার এমন আচরণ দেখে ৷ সে এমন দুষ্টুমি কেন করলো বুঝলাম না? অতঃপর কোনো কথা না বলে সে নৌকার বৈঠা দিয়ে আমার মাথায় সজোরে আঘাত করলো ৷ চিৎকার মেরে উঠলাম!
.
.
ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার ৷ তারমানে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম ৷ এমন ভয়াবহ স্বপ্নের প্রভাবে আমার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে ৷ তিন রাত্রী এমন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখলাম ৷ এই স্বপ্নগুলোর কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছিনা ৷ বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখতে তো স্বপ্নের অর্থ বুঝা যায় অনু আমার অনিষ্ট করবে ৷ কিন্তু কিসের জন্য সে আমার ক্ষতি করতে যাবে?
.
মেঝেতে বালিশ ছাড়ায় শুয়ে ছিলাম, কিন্তু এখন আমার মাথার নিচে বালিশ ও গায়ে একটা কম্বল দেখতে পাচ্ছি ৷ নিশ্চয় অনুই আমার মাথার নিচে বালিশ ও গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিয়ে গেছে ৷ বুঝতে পারলাম সে আমার প্রতি খুবই যত্নশীল ৷ যতই অভিমান করে বলুক, সে আমাকে ভুলে যাবে, সত্যিকার অর্থে সে কখনোই ভুলতে পারবে না ৷ বারবার সে আমার জীবনে ফিরে আসবে, আসতেই হবে ৷ আমি তাকে যতটা না ভালবাসি, তারচেয়ে বেশি সে আমাকে ভালবাসে!
তবে আমি চাই আজ থেকে আমিই যেন তাকে বেশি ভালবাসি, আমার ভালবাসা যেন তার ভালবাসার কাছে জয়ী হয় ৷ আর এই চেষ্টা শুরু হবে আজ থেকে!
.
.
খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গায় ছাদে গেলাম এক্সারসাইজ করতে ৷ হঠাৎ অনু ছাদে চলে এলো ৷ তার গায়ে ইয়োগা ড্রেস শোভা পাচ্ছে ৷ খুবই উত্তেজক লাগছিল তাকে ৷ তবে এই অনু আসলে আসল অনু নয়, এটা সেই আবেদনময়ী অনু ৷ যেটা আমার ভ্রম ৷ এখন আমি আচমকা অনুকে নিয়ে ভ্রমের জগতে পা দিয়েছি ৷ জানিনা এই সমস্যাটা কবে কেটে যাবে ৷ কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে বড়ধরণের দ্বিধায় আছি যে ভ্রমে বা কল্পনায় যাদের দেখা যায় তাদের কি স্পর্শ করা যায়? স্পর্শ করলে তারা কি সেই জায়গাতে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে? যদি তা না হয় তাহলে আমি কেমনে অনুকে স্পর্শ করতে পারছি? নাকি এটা আসলে কোন ভ্রমই নয়, বাস্তব? যদি বাস্তব হয় তাহলে এটা নিশ্চয় অনু নয় ৷ অনু তো রাহনুমা ৷ সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে ৷ তাহলে এই আবেদনময়ী মডার্ণ মেয়েটা কে?
আজ থেকে তাকে ভিন্ন নামে ডাকবো ৷ না না এটা ঠিক হবেনা ৷ তারচেয়ে ভাল তাকে অনু-২ বলে ডাকা ৷ অনু-২ যখন আমার কাছাকাছি এলো তখন ক্ষ্যাপাস্বরে তাকে বললাম,
----এই মেয়ে সত্যি করে বলো তো তুমি কে?
অনু-২ আমাকে ভ্যাঙ্গাতে ভ্যাঙ্গাতে বলল,
----এই মেয়ে সত্যি করে বলো তো তুমি কে?
----আরে আমাকে ভ্যাঙ্গাচ্ছো কেন?
----তো কি করবো? বোকা একটা, এতদিন আমার ভালবাসার পরশ নিয়ে এখন বলছে আমি কে? মন চাই মারি একটা ৷ কিন্তু আমার লক্ষ্মী বাবুটাকে মারবো না, শুধু আদর করবো ৷ আসো তোমাকে একটু আদর করি ৷
.
কথাটা বলেই অনু-২ আমার হাতটা ধরে টেনে তার বুকে জড়িয়ে নিলো ৷ অতঃপর কপালে মৃদ্যুভাবে চুমুর রেখা এঁকে দিলো ৷ এরপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
----দেখো কেমনে শরির চর্চা করতে হয় ৷ আমার দেখাদেখি তুমিও করো!
.
অনু-২ এর কথায় কান না দিয়ে ছাদ থেকে চলে যাচ্ছিলাম ৷ সে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে ক্ষিপ্তস্বরে বলল,
----কই যাও, আমি যেটা বলছি সেটা করো ৷ আজ বেশি কিছু করতে হবে না ৷ দশবার বুকডাউন দিবে, আমিও দিবো ৷ আমার দেখাদেখি করবে, বুঝলে?
.
এটা সহজ হওয়ায় দশবার বুক ডাউন দিলাম ৷ অতঃপর ছাদ থেকে চলে এলাম!
.
.
সকালের
নাস্তা রেডি করতে কিচেনে অনু রান্না করায় বাস্ত হয়ে পড়েছে ৷ কিচেনে প্রবেশ করে তার রান্না করা দেখছিলাম ৷ এবার তার মুখ ঢাকা আছে ওড়না দিয়ে ৷ এটা নিয়ে ভাবলাম না ৷ তার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চলুক, মন খুশিমত চলুক ৷ অনুর পিছে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বললাম,
----কি রান্না করছো?
.
উত্তর পেলাম না ৷ আবারো প্রশ্ন করা হলে কোনো উত্তর পেলাম না ৷ এবার তার গায়ের সাথে আমার গা লাগিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বললাম,
----ওহ, পরোটা ভাজতেছো ৷ আচ্ছা, আর কি রাঁধবে?
.
অনু তাচ্ছিল্যকর কন্ঠে বলল,
---এত ডং দেখান কারে? আমি কি আপনার বউ লাগি? আর কোন সাহসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন? সরে দাঁড়ান বলছি ৷ না না, শুধু সরেই দাঁড়াবেন না, রুম থেকে বের হন!
.
নরম কন্ঠে জবাব দিলাম,
----হুম, তুমি তো আমার বউই হও ৷ বউ বলেই তো গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি ৷ শুধু গা ঘেঁষা কেন? তোমাকে ঝাঁপটেও ধরতে পারি ৷ কি দেখবে কেমনে জড়িয়ে ধরি তোমাকে?
.
অনু তেড়ে উঠে হাতে কুন্তি দেখিয়ে চেঁচানো গলায় বলল,
----আপনি এখান থেকে যাবেন নাকি খুন্তির ছ্যকা দিবো? খুন্তি উত্তপ্ত আছে ৷ গায়ে লাগলেই পুড়ে একদম ছাই হয়ে যাবে আপনার কালো কুচকুচে ত্বক!
.
অনুর ওড়নায় পেঁচানো মুখে গালটা টেনে আদুরে গলায় বললাম,
----ঠিক আছে লক্ষ্মী বউ, আমি যাচ্ছি!
.
.
অনুর সাথেই ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে নাস্তা করছিলাম ৷ তখনই বাবা, মা বাসায় চলে আসলো ৷ তাদের দেখে আমার চেয়ে অনুই বেশি খুশি হলো ৷ কিন্তু বাবা, মা অনুকে দেখে চিনতে পারলোনা কেন যেন? যখন তাদের বললাম এটা তো অনু তখন চিনতে পারলো ৷ এমনকি তারা যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল ৷ তবে তাদের চোখে মুখে কেমন যেন দ্বিধাদ্বন্দ্বের ছাঁপ লক্ষ্য করলাম ৷ আম্মু তো বলে উঠলো, “৬ মাসের মধ্যে অনুর চেহারা এরকম পাল্টে গেল? অনু তো এরকম দেখতে ছিলনা ৷" এটা বলেই, আম্মু, আব্বু ওয়াশরুমের দিকে গেল ৷ বেশকিছুক্ষণ পর তারা সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলের নিকট এলো ৷ আমরা দুজন খাওয়া দাওয়া স্থগিত রেখেছিলাম বাবা, মায়ের সাথে খাবো বলে ৷ অনু আম্মুর কথা শুনে কেমন যেন হয়ে গেল? হয়তো আম্মুর কথায় কষ্ট পেয়েছে ৷ ইতস্ততবোধ করছিল সে ৷ তবুও মুখে কৃত্তিম হাসির সৃষ্টি করে কপালে ভাঁজ ফেলে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করছিল ৷
আম্মু, আব্বু চেয়ারে বসে পড়লো ৷ তারা নাস্তা করতে লাগলো ৷ আম্মু অনুর সাথে নানা রকমের কথা বলছিল আর খাচ্ছিল ৷ তাদের দুজনের কথার মধ্যে আমাকে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল ৷ আম্মু আমাকে নিয়ে প্রশংসামূলক কথা বললেও অনু আম্মুর নিকট আমার নামে শুধু বদনাম ছড়াচ্ছিল!
.
আম্মু হঠাৎ বলল,
----অনু, আমি সেদিন ভাইজানের থেকে যখন শুনলাম তুই আর নীল একে অপরকে ভালবাসিস তখন এটা শুনে খুব রাগ হয়েছিল ৷ তোদের ভালবাসা মেনে নিতে পারছিলাম না কেন যেন? কিন্তু পরে তো তুই ফোন করে বললি নীলের সাথে তোর কিছুই নেই ৷ কয়দিন ধরে তোদের দুজনকে নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেছি ৷ আসলে তোদের মধ্যে প্রেম থাকলে ভালোই হতো ৷ আমার ছেলেটাকে যার তার সাথে বিয়ে দেবার চিন্তা মাথায় আনি ৷ কিন্তু এটা কখনো ভাবিনি যে আমার ছেলের একটা চাচাতো বোন রয়েছে ৷ যে কিনা পরীদের মত সুন্দরী ৷ নীলের সাথে তোকে সত্যিই খুব মানাবে ৷ আমি চাই তুই আমার ছেলের বউ হয়ে ঘরে আস ৷ ঘরটাকে আলোকিত কর ৷ তোর মত এত লক্ষ্মী, সুন্দরী মেয়ে আর আছে নাকি? যদিও বর্তমানে তুই একটু কালো হয়ে গেছিস ৷ সমস্যা নেই ক্রিম মাখলেই আগের মত হয়ে যাবি!
.
আম্মুর কথা শুনে অনু মিটমিট করে হাসলো আর আমার দিকে চোখ টিপেটিপে তাকিয়ে দেখছিল ৷ আম্মুর কথার জবাবে সে ক্ষীণস্বরে বলল,
----কিন্তু আন্টি, আমি তো আপনার ছেলেকে বিয়ে করতে পারবোনা ৷ ওনার মত বোকাকে বিয়ে করা মানে জীবনটা নষ্ট করে দেওয়া!
আম্মু মিষ্টি হেসে বলল,
----আমার ছেলেটা বোকা বলেই তো তোর হাতে তুলে দিতে চাচ্ছি ৷ তুই তাকে চালাক বানাবি ৷ কি পারবিনা?
.
পাশ থেকে আব্বু গম্ভীর গলায় বলল,
----মমতা, তোমার ছেলে মোটেও বোকা না ৷ তুমি বলছো অনুর সাথে তার প্রেম নেই ৷ কিন্তু আমি তো তোমার ছেলের চোখ দেখে বুঝতে পারছি সে অনুকে মনপ্রাণ উজার করে ভালবাসে! আর অনু মামনীও আমার ছেলেটার জন্য পাগল ৷ আমি চাচ্ছি এখনই ওরা বিয়েটা না করুক, আগে চুটিয়ে প্রেম করুক ৷ এখন না করলে কবে করবে, বলো?
.
আব্বুর কথা শুনে অনু যেন লজ্জায় লাজরঙ্গা হয়ে গেল ৷ লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে রইলো!
.
.
খাওয়া দাওয়া শেষ করে অফিসে যেতে বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম ৷ তখন আম্মু আমাকে থামিয়ে দিলো ৷ আবার অনু ভার্সিটিতে যেতে লাগলে তাকেও থামিয়ে দিলো ৷ আম্মু নাকি আমাদের দুজনকে নিয়ে আনন্দঘণ সময় কাটাবে!
.
নাস্তা করার সময় অনুর মুখ খোলায় ছিল ৷ ভার্সিটিতে যাবার সময় সে বোরখা পড়েছিল ৷ কিন্তু আম্মু তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো বোরখা খুলে আসো ৷ কিন্তু অনু বোরখা খুলতে চাচ্ছিল না ৷ আম্মু বারবার বলা সত্বেও না ৷ বুঝলাম না, সে এখন কেন বোরখা খুলতে চাচ্ছেনা? আমার আম্মুর নিকট বোরখা খুলতে কি সমস্যা তার?
.
চলবে.....
.
আগের পর্ব লিংকঃ

#অদৃশ্য_পরী ( পর্বঃ ৮ এবং #শেষ_পর্ব)
লিখাঃ Sifat Arnab Rehan.
.
এতদিন তাহলে অনু আমাকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছিল? কিন্তু কেন? কি পেলো সে এসব করে?
ভাবা বাদ দিয়ে রুমের ভেতর ঢুকলাম ৷ ঢোকামাত্র অনু আমাকে দেখেই হুড়মুড় করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো ৷ থমকে ওঠা ভাব নিয়ে ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ৷ কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে শামলে নিয়ে কিছুই হয়নি ভাব ধরে আড়ষ্ট কন্ঠে বলল,
----এত ভোরে আমার রুমে কেন আসছেন?
.
অনুর ধোঁকাবাজি আমার চোখে ধরা পড়ায় তার প্রতি প্রচন্ড পরিমাণে রাগের উদয় হচ্ছিল ৷ রাগ শামলানো দায় হয়ে যাচ্ছিল ৷ বিষাক্ত দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম ৷ অনু ভীত-সন্ত্রস্তের অভিব্যক্তিতে মাথা নিচু করে রইলো ৷ ঈষৎ ভাবে কাঁপছিল সে ৷ রাগান্বিত স্বরে তাকে বললাম,
----এগুলো কি দেখলাম? ছিঃ তুমি এতবড় ধোঁকাবাজ অথচ আমি কখনো টেরই পাইনি ৷ কেমনে পারো, হ্যাঁ?
.
অনু থতমত খেয়ে বলল,
----মানে কি? কি বলতে চাচ্ছেন?
----মেকআপ করে নিজের আসল চেহারা পাল্টিয়ে আমাকে বশে আনার মানেটা কি? তুমি ভাবছো তোমার ধোঁকাবাজি কখনো ধরা পড়বেনা?
----আপনার কথার আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা ৷
.
.
আর সহ্য হচ্ছিলনা ৷ অনু শুধু ধোঁকাবাজই না সে বড় অভিনেত্রীও বটে ৷ আমার সাথে অভিনয় করার চেষ্টা করছে ৷ রাগে আমার মাথায় রক্ত উঠে আসছিল ৷ রক্ত যেন টগবগ করছিল, ফুটন্ত পানিত মত করে ৷ লুকিং-গ্লাসের সামনে যে টেবিল সেটার উপর রাখা ছিল বাটি ৷ তার পাশেই ছিল পানির গ্লাস ৷ গ্লাসটা হাতে নিয়ে, অনুর মুখে পানি ছুঁড়ে মারলাম ৷ চমকে উঠলো সে ৷ কিন্তু আমি কোনো পরোয়া করলাম না ৷ তার মাথা চেপে ধরে, ডান হাত দিয়ে মুখে ডলা দিলাম ৷ যেন পাউডারের স্তর মুখের ত্বক থেকে উঠে আসছিল ৷ হাতে আরো একটু পানি নিয়ে আবারো মুখে ডলা দিয়ে পুরো মুখই পরিস্কার করে ফেললাম ৷ অনু নির্বাক, নিস্তব্দ ৷ তবে ভয়ে কাঁপছে ৷ চোখ একদম লাল হয়ে গেছে ৷ অপরাধবোধে তার মুখ লাজরঙ্গা হয়ে গেছে ৷ চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল এখনই সে কান্না করে দিবে ৷ অনুতপ্ত সে ৷ সেই অভিব্যক্তি চোখে, মুখে লক্ষ্য করা গেল!
অনুর চেহারাতে আর রাহনুমার মুখচ্ছবি নেই, তার চেহারাতে সেই মডার্ণ অনুর মুখচ্ছবিই ফুটে উঠেছে ৷ এতদিন অনু আমাকে এভাবে ধোঁকা দিয়ে গেলো? সে বলেছিল তাকে নিয়ে আমি ভ্রমের মধ্যে ছিলাম, মডার্ণ যে মেয়েটি আমার সাথে রোমান্স করতো সে বাস্তবের কোনো মেয়ে ছিলনা, সেটা ছিল আমার ভ্রম, কল্প জগতের নারী ৷ অথচ আজ স্পষ্ট যে ঐ সমস্ত ঘটনা ভ্রম ছিলনা, সবই ছিল বাস্তব ৷ অনুই আমার সাথে ওসব করতো ৷ কিন্তু এটা অস্বীকার করলো কেন সে? আমি তো স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছিলাম ৷ মিথ্যাচার করে কি পেলো সে?
ক্ষ্যাপাস্বরে অনুকে বললাম,
----আমাকে এতদিন সহজ সরল বোকাসোকা রুপে দেখেছো ৷ রাগী চেহারাটা দেখোনি তবে আজ দেখবে যদি আমার সমস্ত প্রশ্নের জবাব সত্যি সত্যি না বলো! বলো, কিসের জন্য তুমি রাহনুমার রুপ নিলে?
.
অনু কান্না করতে লাগলো ৷ শব্দ করে কাঁদছে তবে উচ্চশব্দ হচ্ছেনা ৷ একপর্যায়ে ভাঙ্গা গলায় বলতে লাগল,
----আমি এই ছোট্ট জীবনে শুধু ভুল করে গেলাম ৷ জীবনের প্রথম ভুল ছিল আপনার চাচাতো বোন হয়ে জন্ম নেওয়া ৷ দ্বিতীয় ভুল আপনাকে ভালবেসে ফেলা ৷ এরপর থেকে শুধু ভুলই করে গেছি ৷ বিশ্বাস করুন আমি নিজের অজান্তে আপনাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম ৷ যখন বুঝতে পেরেছিলাম আপনাকে আমার ভাললাগে তখন থেকে চেষ্টা করেছিলাম আপনাকে এড়িয়ে চলবো, কিন্তু পারিনি ৷ পারিনি বলেই ক্লাস ৮ এ আপনাকে প্রোপজ করেছিলাম চিঠির মাধ্যমে ৷ আপনি চিঠি পেয়ে আমাকে অপমানিত করেছিলেন ৷ বিষয়টাকে ফান হিসেবে নিয়েছিলেন ৷ পাড়া প্রতিবেশী স্কুল, এমনকি আমাদের দু পরিবারের সবার নিকট বিষয়টি বলে দিয়েছিলেন ৷ আর আমি হয়েছিলাম সবার হাসির পাত্র ৷ এরপরও আমি আপনাকে কিছুতেই ভোলার চেষ্টা করিনি ৷ আরো কিসের জন্য যেন আপনার প্রতি ভালবাসা বেড়ে গিয়েছিল ৷ মন তো আর আমার খেয়াল খুশি মত চলেনা ৷ ইন্টারে ভর্তি হবার পর থেকে আপনাকে অসংখ্যবার চিঠি দিয়েছিলাম, একটা চিঠিরও উত্তর দেন নি ৷ আমি বুঝে উঠতে পারিনি আমার কিসে সমস্যা ৷ যেখানে স্কুল, কলেজের অসংখ্য ছেলে আমার জন্য পাগল ছিল ৷ আমার গ্রামের প্রায় সব ছেলেরা দিওয়ানা ছিল সেখানে আপনি আমাকে পাত্তা দিতেন না ৷ চারটা বছর লেখাপড়া পিছিয়ে যায় আপনার জন্য ৷ যেটার কারণ আগেই আপনাকে বলেছি ৷ আমি খুবই জিদ্দি হওয়ায় পণ করেছিলাম যেভাবে হোক জেনে নিবো আপনি কেমন টাইপের মেয়ে পছন্দ করেন ৷ দীর্ঘ ৮ বছর তো আপনি ঢাকায় ছিলেন ৷ আপনার এত খোঁজ খবর পেতাম কিন্তু আমি যেসব প্রশ্নের জবাব পাবার আশায় আপনাকে চিঠি দিয়েছিলাম সেই চিঠিগুলোর জবাব আপনার থেকে পাইনি ৷ যখন জানতে পারলাম আপনি কয়দিন পরই গ্রামে আসবেন তখন একটা বড়সর পরিকল্পনা করলাম ৷ ১ বছর আগে আমি রুপচর্চা ও পার্লারের মেকআপ, ও ফ্যাশন সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করেছিলাম ৷ আপনি যখন গ্রামে এলেন তার ৫দিন আগে পরিকল্পনা করেছিলাম নিজেকে আপনার সামনে আমি ৩টা রুপে হাজির করবো ৷ একটা পর্দানশীল, আরেকটা সাদাসিদা বাঙ্গালি নারী ও আরেকটা আধুনিক মেয়ের ৷ ৮ বছরের মধ্যে আপনি আমাকে ছবিতেও যে দেখেন নি এটা আন্টির থেকে শুনেছিলাম ৷ এটা শুনে আমার প্ল্যানটা আরো সহজ হয় ৷ এই যে তিনটা রুপে হাজির হয়েছিলাম এটার একটা বিশেষ কারণ ছিল ৷ ক্লাস ৮ পর্যন্ত আমি নিজেকে খুব অগোছালো ভাবে উপস্থাপন করতাম ৷ আসলে বয়স অল্প ছিল তো তাই সাজুগুজু ভাললাগতোনা ৷ এজন্যই হয়তো আপনি আমাকে পছন্দ করতেন না ৷ আপনি কেমন মেয়ে পছন্দ করেন এটা জানতেই তিনটা রুপে হাজির হওয়া ৷ আর আমার পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করে এটা প্রকাশিত হলো যে আপনি সাদাসিদা বাঙালী নারী পছন্দ করেন ৷ এজন্যই নিজেকে মডার্ণ হিসেবে আপনার নিকট উপস্থিত হলে আমাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন ৷ জানতাম আপনি কখনোই আপনার চাচাতো বোনকে ভালবাসবেন না ৷ এরপরও এই নাটকটা করতেই হলো ৷ নাটক করার ফলে আপনি ভালবেসে ফেললেন শ্যামলা বাঙালী গোছের মেয়েটাকে ৷ অন্তত নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিবো যে সাদাসিদা বাঙ্গালী নারীর রুপ ধারণের ফলে প্রিয়তম মানুষটির ভালবাসা পেয়েছিলাম ক'টা দিনের জন্য ৷
.
রাগ যেন বেড়ে গেল ৷ দাঁত কটমট করে অনুকে ফের বললাম,
----এসব করার কোনো মানেই হয়না ৷৷ তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও! ভেবোনা আর কখনো আমার ভালবাসা পাবে ৷ তাই চলে যাও এ বাড়ি থেকে ৷ যাবার আগে কয়টা প্রশ্নের জবাব দাও, তিনটা রুপে হাজির হয়েছিলে বেশ ভাল কথা ৷ কিন্তু, আমার সাথে নির্লজ্জতা কেন করেছিলে? রাতে রুমের ভেতর, গাড়িতে ওরকম নির্লজ্জতার মানে কি ছিল?
.
অনু শীতল অশ্রুর নোনাজল মুছে ক্রন্দণরত অবস্থায় চাপাকন্ঠে বলল,
-----আজ আর সত্যটা বলতে কোনো বাঁধা নেই ৷ আপনাকে যেহেতু চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেললামই, তাহলে সব স্পষ্ট করে বলি ৷ আমি অন্যসব মেয়েদের মত না যে ভালবাসি যাকে তাকে মনের কথা বলে দিলাম,আর সে প্রস্তাব পেয়ে রিজেক্ট করল আর ওমনি তাকে খুব সহজে ভুলে গেলাম ৷ কিন্তু না আমি এমন না ৷ যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাবো মনের মানুষকে আপন করে পাবার জন্য ৷ একারণে প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছি ৷ আমার এ মন প্রাণ দেহ হয়তো আপনার হবে নাহয় একাকী সারাজীবন কাটিয়ে দিব ৷ জানেন, আমি কখনো সন্তানের মা হতে পারবোনা? সে ক্ষমতাটা আল্লাহ আমাকে দেন নি ৷ এটা জানার পর আমি এতটা কষ্ট পেয়েছিলাম যে ওতটা কষ্ট আমার ছোট্ট জীবনে কখনো পাইনি ৷ ভালবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার পর এরকম একটি অসহ্যকর দুঃসংবাদ পেয়েছিলাম আমি ৷ এমনিতেই আপনি আমাকে এড়িয়ে চলতেন ৷ যদি জানতেন আমি কখনো মা হতে পারবোনা, তখন তো আমাকে আরো এড়িয়ে চলতেন ৷ কিন্তু কি জানেন? আমার না আজও বিশ্বাস হয়না যে আমি মা হতে পারবোনা ৷ লজ্জার কথা হলেও সত্য যে আমি চেয়েছিলাম আপনার সাথে শারিরিক সম্পর্ক করে পরীক্ষা করব যে সত্যিই আমি সন্তান জন্ম দিতে পারবো কি না! কিন্তু শারিরিক সম্পর্ক করতেও মন শায় দিচ্ছিল না ৷ বারবার ঐ পথ থেকে সরে আসছিলাম! কিন্তু সেদিন রাতে আমি আমার আশা পূর্ণ করে ফেললাম, অথচ আপনি টের পাননি! কারণ আপনি ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন ৷ এই অপরাধের জন্য আমাকে খুন করলেও করতে পারেন, এতে আমার আপত্তি নেই!
.
অনু কখনো মা হতে পারবেনা এ কথা শুনে খুব কষ্ট পেলাম ৷ কষ্টে যেন বুকটা ফেঁটে যাচ্ছিল ৷ কিন্তু সে আমার সাথে শারিরিক সম্পর্ক করেছে একথা শুনে তার প্রতি ঘৃণা হচ্ছিল ৷ সে এমনটা করলো কেমনে? কিন্তু কেন যেন বিষয়টাকে সত্য বলে মনে হচ্ছেনা ৷ অনুর এত এত পাগলামীর কথা শুনে মনে হচ্ছে সে সত্যিই আমাকে ভালবাসে ৷ কিন্তু তার এরকম ভালবাসার কোনো মুল্যই হয়না ৷ কারো ভালবাসা পাবার জন্য কেউ এতসব পাগলামী করতে পারে এই প্রথমবার জানলাম ৷ আমার মন থেকে অনুর প্রতি বিন্দুমাত্র ভালবাসা আর জমা নেই ৷ হয়তো কখনো তার প্রতি আর ভালবাসার জন্মও নিবেনা ৷ মিথ্যার সাথে অসত্যকে মিলালে সত্যের অবমাননা হয় ৷ ভালবাসার মত পবিত্র সত্যকে নিয়ে অনু জঘন্য মিথ্যাচার করেছে ৷ তার এহেন মিথ্যাচারে আমার ভালবাসাকে অপমানিত করা হয়েছে ৷ আমি মিথ্যা ভালবাসা চাইনি কখনো ৷ আর চাইবো ও না ৷ আমি তো রাহনুমাকে ভালবেসেছিলাম ৷ প্রকৃতপক্ষে রাহনুমার অস্তিত্বই নেই ৷ আমার ভালবাসা অস্তিত্বহীন থাক ৷ এই হ্নদয়ে যেনো আর কারো জন্য ভালবাসা না জাগে!
.
অনুর সাথে আর কথা বলারই ইচ্ছা হলোনা ৷ তাকে কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম!
.
.
সকালে ব্রেকফার্স্ট না করে অনু ব্যাগ গুছিয়ে আমাদের বাসা থেকে চলে যেতে লাগলে আম্মু তাকে থামিয়ে দিয়ে শক্তকন্ঠে বলল,
----হঠাৎ কি এমন হলো যে চলে যাচ্ছো? তোমার বিষয়টা আমি নীলের থেকে শুনেছি ৷ ভুল করেছো এটা মেনে নাও ৷ এভাবে রাগ করে বাসা থেকে চলে যাওয়া কি রকমের ভদ্রতা!
.
আম্মুকে থামিয়ে দিয়ে চেঁচানো গলায় বললাম,
----তারমত নির্লজ্জ ও মিথ্যাবাদী মেয়ের এ বাড়িতে থাকার কোনো অধিকার নেই ৷ তাকে চলে যেতে দাও মা!
.
আম্মু কোনো কথা বললোনা ৷ অনু ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল!
.
.
দীর্ঘ ২ বছর পরঃ
তানিয়া নামের একটা মেয়েকে মায়ের পছন্দমত বিয়ে করেছি ৷ কিন্তু আপসোস! সুখ নামের জিনিসটা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে ৷ মাত্র ৩ মাস হলো বিয়ে করেছি অথচ দুজনের মধ্যে কোনো রকমের ভালবাসা শ্রদ্ধাবোধ নেই ৷ সে একজনকে ভালবাসতো ৷ তাকে বিয়ে করতে না পেরে আমাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি ৷ এমনিতে স্বামীর অধিকারটা পাচ্ছি তার থেকে তবে শ্রদ্ধাবোধ, ভালবাসাটা সে আমাকে দিতে অপারগ ৷ এরপরও আশায় আছি সে একদিন আমাকে বুঝবে ৷ বিবাহিতা স্ত্রী বলে তাকে কষ্ট দিতে পারিনা ৷ তার সমস্ত আবদার মিটানোর চেষ্টা করি ৷ কিন্তু এতেও তার মন পাচ্ছিলাম না!
.
২ বছরের মধ্যে অনুর সাথে কোনো কথা হয়নি, তার সম্পর্কে কিছু জানিও না ৷ অনু আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাবার পর তাদের পরিবাবের সাথে আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায় ৷ তাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ৷ তবে আজ ২ বছর পর জানতে পারলাম অনুর কোলে ১ বছরের একটি বাচ্চা রয়েছে ৷ মেয়ে সন্তান ৷ তার নাম রাখা হয়েছে পরী ৷ অনু মা হয়েছে শুনে খুশিই হলাম ৷ সে সংসার জীবনকে বেছে নিয়েছে শুনে প্রশান্তি পেলাম ৷ কিন্তু, হঠাৎ করে মনে পড়লো অনুর সেই কথা সে বলেছিল কখনো সে মা হতে পারবেনা ৷ অথচ সে এখন মেয়ে সন্তানের মা ৷ এটা কিভাবে সম্ভব? হয়তো সেসময় অনু আমাকে মিথ্যা বলেছিল! কিন্তু কেন? তার প্রতি নতুন করে ঘৃণা জন্ম নিলো!
.
এর দুদিন পর খবর পেলাম অনু ১ বছর ধরে মানসিক হসপিটালে ভর্তি ছিল ৷ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ৷ তবে ৭দিন হলো সে ছাড়া পেয়েছে ৷ এও জানলাম অনু ১ বছর আগে আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিল, যেটার উত্তর নাকি সে পায়নি ৷ সেই ১ বছর আগের চিঠিতে যা লিখা ছিল ঠিক সেসব লিখে অনু আবারো আমার নিকট নতুন একটা চিঠি লিখেছে ৷ অনুর মামাতো বোন আমাকে খবরগুলো দেবার পাশাপাশি চিঠিটা ধরিয়ে দিলো!
অনু চিঠিতে লিখেছে,
“প্রিয়তম,
আমি জানি তুমি অনেক সুখেই আছো ৷ আমার সে কপাল না যে সুখে থাকবো ৷ তবে এক মুঠো সুখ তুমি ধার দিতেই পারো, যদি আমার এই চিঠির জবাব দাও ৷ এই চিঠির জবাব পেলে আমি নির্লজ্জের মত আবারো তোমার দুয়ারে পা মাড়িয়ে হাতে পায়ে ধরে শেষবারের মত তোমার ভালবাসা ভিক্ষা চাইবো ৷ আমি মানছি তোমার সাথে মিথ্যাচার করেছিলাম, ধোঁকাবাজি করেছিলাম কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার প্রতি আমার ভালবাসা একটুও মিথ্যা ছিলনা ৷ খুব কষ্ট হচ্ছে জানো? ভালবাসা পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা যে কতটা বেদনার সেটা আমি বুঝতে পারছি ৷ সেদিন তোমার বাসা ছেড়ে চলে আসার সময় বুক ফেঁটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল ৷ ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ডাকবে ৷ আমার হাত ধরে বলবে ঠিকআছে তোমার ভুলগুলো মাফ করে দিলাম ৷ কিন্তু তুমি আমাকে ডাকোনি, উল্টো আমাকে অপমানিত করে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ৷ এরপরও আমার মন বলছিল তোমার কাছে ফিরে যাই ৷ কিন্তু ধৈর্য্য ধরে তোমার বাসা ছেড়েছিলাম ৷ আজ শেষবারের মত বলছি তুমি আমার ভুলগুলোকে শুধরে আমাকে মেনে নাও ৷ আমি যে পারছিনা আর তোমাকে ছেড়ে থাকতে, খুব কষ্ট হচ্ছে ৷ চিঠির জবাবটা দিও দয়া করে ৷ জবাব পেলে ভাববো আমাকে মেনে নিয়েছো!
ইতি,
তোমার অনু!
.
.
চিঠি পড়ে আপনাআপনি চোখের বৃষ্টিধারা তড়িৎ গতিতে ঝরতে ঝরতে গাল ভিজিয়ে ফেলছিল ৷ ঝাঁপসা চোখে এতক্ষণ চিঠি পড়ছিলাম ৷ আজকে মনটা চাচ্ছিল অনুর কাছে ছুটে যেতে ৷ কিন্তু আমার হাত পা যে বাঁধা ৷ আমি যে অন্যাকারো ৷ আমি বিয়ে করেছি এই খবর হয়তো অনু জানতে পারেনি ৷ আকাশ পরিমাণ কষ্ট বুকে এসে ধাক্কা মারছিল ৷ আর বুক ফেঁটে যেন তছনছ হয়ে যাচ্ছিল ৷ আমারই ভুল ছিল ৷ অনুর ঐরকম ভুলের জন্য তাকে এতবড় শাস্তি দেওয়া মোটেও ঠিক হয়নি ৷ তারসাথে অন্যায় করেছি আমি ৷ ভালবাসা পাবার জন্য মানুষ কত কি করে ৷ অনু সেরকমই করেছিল ৷ আর সেটাতো আমার জন্যই ৷ কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি ৷ আপসোস হচ্ছে এতদিন পর এটা উপলদ্ধি করে ৷ এখন এসব ভেবে তো লাভ নেই!
.
আমার বিয়ের ২ মাস পর আম্মু স্ট্রোক করেছিল ৷ স্ট্রোক করার পর প্যারালাইসডও হয়ে যায় ৷ তবে পুরো শরীর না, দুটা পা অচল হয়ে গেছে ৷ আজকে আম্মু আমাকে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ডেকেছে ৷ সে কথা বলতে পারে, তবে স্বাভাবিকভাবে নয় ৷ ভেঙ্গে ভেঙ্গে ৷
আম্মু প্রথমে আমার নিকট ক্ষমা চেয়ে নিলো ৷ অতঃপর অনুতপ্তের স্বরে বলল,
---নীল, অনুকে এতবড় শাস্তি দেবার ফল আমি পাচ্ছি ৷ তার কোন দোষ ছিলনা ৷ আমার কথামত সে সব কাজ করেছে ৷ অনু ক্লাস ৮ এ থাকতে তোকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল এটা জানার পর অনুর উপর নজরদারী শুরু করি ৷ সে ইন্টারের ছাত্রী হলে তোর জন্য তার ভালবাসা বেড়ে গেল ৷ হাজারো চিঠি তোর জন্য লিখেছিল, সমস্ত চিঠি আমিই সরিয়েছিলাম যাতে তোর হাতে না পড়ে ৷ তুই ৮ বছর পর যখন গ্রামে গেলি তার ৬ মাস আগে অনুর বাসায় গিয়েছিলাম ৷ তার মুখ থেকে স্পষ্টভাবে শুনেছিলাম যে সে তোকে ভালবাসে ৷ এরপর আমি অনুর সাথে একটা বিশ্বাসঘাতকতা করার পরিকল্পনা আঁটি ৷ আমি কখনো চাইনি অনুকে তুই ভালবাস, সে তোর হোক ৷ এজন্য অনুকে উল্টাপাল্টা বুদ্ধি দিই ৷ অনুকে বলেছিলাম , “অনু তুই আগে জেনে নি আমার ছেলে কেমন টাইপের মেয়ে পছন্দ করে ৷ এরপর সেরকম ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে তার নিকট গিয়ে হাজির হ ৷ যদি তার চাওয়ামত হতে পারিস তাহলে তোকে সে গ্রহণ করবে!"
অনু আমার বুদ্ধির কথা বুঝে উঠতে পারছিল না ৷ পরে তাকে বুদ্ধিটা বুঝিয়ে দিলাম সহজভাবে,
“তুই তো মেকআপ করা জানিস ৷ এক কাজ কর, নীল তো ৬ মাস পর গ্রামে ছুটি কাটাতে যাবে ৷ ঐসময় তার নিকট এমনভাবে হাজির হবি যাতে সে তোকে দেখে পাগল হয় ৷ এক কাজ করতে পারিস, প্রথমে আধুনিক মেয়ের রুপে হাজির হবি, এতে কাবু না হলে পর্দানশীল মেয়ে, এতেও নাহলে বাঙ্গালী সাধারণ মেয়ের রুপে হাজির হবি ৷ যদি এটা করতে পারিস তো আরো ভালো হয়, সেটা হচ্ছে তুই একসাথে তিনটা রুপেই নীলের নিকট হাজির হবি ৷ এতে সে যেকোনো একটা রুপের বেশে দেখে পাগল হয়ে তোকে মেনে নিবেই নিবে!"
এই মোতাবেক কাজ করতে থাকে সে ৷ এমনকি সে অনেকটা সফলও হয় ৷ কিন্তু অনুর প্রতি তুই যখন সত্যি সত্যি ফিদা হয়ে গেলি তখন আমি এটাকে মেনে নিতে পারলাম না ৷ তোদের দুজনের প্রেমের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করি ৷ প্রথমে নীলার সাহায্য নিয়ে তাকে বাসায় এনে ঐসব নাটক করতে বলি ৷ এতে তেমন কিছুই হয়নি ৷ কিন্তু কাজ হয় আমার বড়সর প্ল্যানে ৷ অনুকে বলেছিলাম , “আজ সকালে তুই নীলের কাছে আসল চেহারা নিয়ে হাজির হবি, দেখবি সে নিশ্চিত তোকে মেনে নিবে ৷ তাছাড়া এভাবে নিজেকে ফেক চেহারাতে নীলের নিকট উপস্থিত করিয়ে কোনো লাভ হবেনা ৷ একদিন তো প্রকাশ পাবেই এটা ৷ তখন সে তোর উপর রেগে গিয়ে সম্পর্ক নষ্ট করে দিতে পারে ৷ কিন্তু এখন করবেনা ৷ কারণ সে তোর প্রতি পুরোদমে প্রেমে মজে গেছে!"
এই কথামত অনু সেদিন খুব ভোরে ফেক চেহারার মেকআপটা ধুয়ে ফেলে পুনরায় সেই ফেক চেহারার মেকআপ করে যাতে তুই তাকে দেখে নিস ৷ এটাই হলো ৷ আর এতে তুই অনুকে ভুল বুঝলি ৷ তাকে ধোঁকাবাজ ভেবে নিলি ৷ তাকে দূরে ঠেলে দিলি ৷ জানিস নীল, অনুর সাথে আমি মস্তবড় অন্যায় করেছিলাম ৷ তাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে টেস্ট করিয়েছিলাম রোগ ধরার জন্য ৷ কারণ অনুর প্রায়দিনই
ঠান্ডা লাগতো ৷ তার টেস্ট রিপোর্টে ধরা পড়ে তার পলিপাসের সমস্যা আছে সামান্য ৷ এই সমস্যার কথা অনুকে না জানিয়ে আমি বলি অনু তুই আর কখনো মা হতে পারবিনা ৷ অনু এটা বিশ্বাস করতে পারেনি ৷ এজন্য অন্য ডাক্তারের নিকট গিয়ে টেস্ট করা হয় ৷ সেই ডাক্তারের হেল্প নিই এবং তাকে মিথ্যা বলতে বলি, সেই ডাক্তারও অনুকে বলে সে আর মা হতে পারবেনা ৷ এই ঘটনাটা তুই গ্রামে যাবার ৬ মাস আগের ঘটনা ৷ তাকে আরো জঘন্য কাজ করতে বলি ৷ অনুকে বলেছিলাম, “তুই নীলের সাথে রগরগে ড্রেসে ও আবেদনময়ী ভাবভঙ্গিমায় চলবি ৷ এতে সে আকৃষ্ট হতে পারে ৷ সর্বশেষ বার তাকে বুদ্ধি দিয়েছিলাম তোর সাথে শারিরিক সম্পর্ক করার জন্য ৷ সেটা তোর ঘুমের মধ্যে ৷ এজন্য অনুর হাতে ঘুমের ট্যাবলেট দিয়েছিলাম যাতে তোকে খায়য়ে দিতে পারে ৷ অনু বাসা ছেড়ে যাবার আগের রাত্রে সে তোর সাথে শারিরিক সম্পর্ক করে ৷ এটা করতে সে রাজি হয় আমার এই কথাতে, তাকে বলেছিলাম, “দেখো অনু, ডাক্তাররা অনেক সময় ভুল রিপোর্ট বলে ৷ তুমি এক কাজ করো নীলের সাথে শারিরিক সম্পর্ক করো ৷ সমস্যা কি তাকে তো একদিন ঠিকই পাবে ৷ বিয়ের আগে এটা করলে একসময় পেটে সন্তান হবে ৷৷ আর যদি এটা হয়ই তবে
বুঝবে ডাক্তার ভুল বলেছে ৷ এখনই যদি নীলকে বলো তুমি মা হতে পারবেনা এটা শুনলে সে কষ্ট পেতে পারে ৷ কিন্তু আল্লাহ যদি তোমাকে মাতৃত্বের ক্ষমতা দেন তবে একসময় জানতেই পারবে ৷ কারণ তুমি তো নীলের সাথে শারিরিক সম্পর্ক করছো ৷ যদি পেটে বাচ্চা আসে তখন নীলকে সত্যটা বললে সে খুশি হবে!"
অনু আমার একথা শুনে সেই মোতাব্ক কাজ করেছিল ৷ কিন্তু তাকে পরবর্তিতে সহজভাবে বলে দিয়েছিলাম সে যেন নীলের জীবন থেকে সরে দাঁড়ায় ৷ অনুকে স্পষ্টভাবে বলেছিলাম আমি তাকে ছেলের বউ হিসেবে চাইনা ৷ অনু একথা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিল কিন্তু তার কষ্ট দেখে সেদিন কোনো প্রভাব পড়েনি!
নীল, অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি অনুর সাথে ৷ জানি এমন অপরাধের কোনো ক্ষমা হবেনা ৷ কিন্তু যদি তুই তাকে গ্রহণ করিস তাহলে হয়তো অপরাধের ভারটা কমতো ৷
তোর স্ত্রী তানিয়া আজ সকালে আমাকে বলেই বাসা থেকে চলে গেছে ৷ সে তার পুরোনো বয়ফ্রেন্ডের কাছে চলে গেছে ৷ কয়দিন পর সে তোকে ডিভোর্স লেটার পাঠাবে! তোর রাস্তা এখন পরিস্কার ৷ অনু তোর জন্য পথ চেয়ে বসে আছে ৷ আর শোন, সে বিয়ে করেনি ৷ পরী নামের মেয়েটা তোর ৷ ঐ রাতে তোদের ভালবাসার প্রাপ্তি সে! ভাবিস না সে অপবিত্র সন্তান বরং সে পবিত্র ৷ তোর বয়স যখন ১১ আর অনুর ৭ ৷ তখন তোর দাদা কাজী অফিসে তোদের নিয়ে গিয়ে তোদের বিয়ে পড়িয়েছিল ৷ আমরা এটা জানতাম না ৷ তোর বাবা শুধু জানতো ৷ তোর দাদা বিষয়টা গোপন রেখেছিল এবং তোর বাবাকেও বিষয়টা গোপন রাখতে বলেছিল ৷ তোর বাবাকে বলেছিল যেদিন অনু ও নীল একে অপরকে ভালবেসে আপন করে নিবে সেদিনই বিয়ের কথাটা প্রকাশ করে দিতে, এর আগে নয়!
তোর বাবা আমাকে কথাটা বলেছিল যখন তুই তানিয়াকে বিয়ে করলি তার আগের দিন! তোর বাবা কষ্ট পেয়েছিল অনুকে রেখে তানিয়াকে বিয়ে করার জন্য!
.
নীল আর দেরি করিস না বাবা, অনুকে তোর ঘরের লক্ষ্মী রমণী করে ঘরে তোল!
.
.
অনু, ও তার ভাই অমিত দুজনের সামনে অপরাধী হিসেবে দন্ডায়মান ৷ আজকে অমিত যে আমাকে কি করবে সেই ভাল জানে!
হঠাৎ অমিত রাগস্বরে বলল,
----শালা, তোরে আমি এজন্যই দেখতে পারতাম না কারণ তুই আমার বোনকে সবসময় এড়িয়ে চলতি ৷ যখন অনু ক্লাস ৭ এ পড়তো ৷ তখন সে দুষ্টুমি করে তোকে চুমু দিয়েছিল ৷৷আর এজন্য তুই ওকে থাপ্পর মেরেছিলিস ৷ এটা দেখার পর তোকে আর চাচাতো ভাইয়ের চোখে দেখিনি ৷ তোর প্রতি রাগটা আরো বেড়ে গিয়েছিল যখন অনু তোকে ক্লাস ৮ এ থাকতে চিঠির মাধ্যমে প্রোপজ করে আর তুই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলি, শুধু ফিরিয়েই দিস নি সেইসাথে তার ভালবাসা নিয়ে ঠাট্টা করেছিলি ৷ কিন্তু এতকিছুর পরও আমি অনুকে তোর হাতে তুলে না দিয়ে পারছিনা ৷ অনু তোর বিবাবিতা স্ত্রী ৷ আমার অধিকার নেই তাকে তোর থেকে ছিনিয়ে নেবার ৷ ভাবছিস এটা কেমনে জানি? তবে শোন, দাদা অনুর জন্য একটা লকেট বানিয়েছিল ৷ দুটা লকেটে দুজনের ছবি, একটা অনুর আরেকটা তোর ৷ ঐ লকেটটা রাখা ছিল দাদার সবচেয়ে প্রিয় একটি ডায়েরীতে ৷ ডায়েরীটার ভেতর একটা চিঠি ছিল ৷ ঐ চিঠিতে সমস্ত কিছু লেখা ছিল ৷ দাদু আমার হাতে ডায়েরীটা সেই ছোট থাকতেই দিয়েছিল ৷ আমার নিকট থেকে ওয়াদা নিয়েছিল যে যতদিন না অনু ও নীলের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হবে অতঃপর সম্পর্কের মধ্যে ফাঁটল না হবে ততোদিন এই ডায়েরীর মধ্যেকার চিঠিটা না খুলতে!"
আজ থেকে ২ বছর পূর্বে যখন অনুর সাথে তোর সম্পর্ক তৈরি হয় অতঃপর সম্পর্কে ফাঁটল ধরে তখনই চিঠিটা পড়ে জানতে পারি অনু ও তোর মধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে ৷৷ ৷বিয়ের সাক্ষ্মী ছিল শুধু দাদু ৷ আর দাদু সৃষ্টিকর্তার কসম দিয়ে বলেছেন যারা অনু ও নীলের বিয়েকে অস্বীকার করবে তারা যেন দাদুর তাজা মাংস খাবার মত পাপ কাজ করে!'
.
দাদুর জন্যই আমি পারছিনা অনুকে তোর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ৷ আজ থেকে সে তোর ৷ তবে একটা কথা মনে রাখিস আমার বোনকে পাগল বানিয়ে যে অন্যায়টা তার সাথে করেছিস এটার কষ্ট তোকে সারাজীবন পেতে হবে!
.
কথাটি শুনে অনু কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,
----ভাইয়া, প্লিজ থাম ৷ সে আমাকে ভালবেসেই কষ্ট দিয়েছে, স্বামীর কষ্টে আমি ব্যথিত হতে চাই্না ৷ তার দেওয়া কষ্ট আমি সারাটাজীবন সইতে পারবো ৷ শুধু তাকে বলো, আমার হাতটা যেন আর কখনো না ছাড়ে!
.
অশ্রু ঝরঝর করে ঝর্ণার পানির মত ঝরছিল আমার দু-চোখ বেয়ে ৷ আমি নিজেকে যেন শামলাতেই পারলাম না ৷ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে অনুকে বুকে জড়িয়ে নিলাম ৷ অতঃপর তার হাত দুখানা ধরে ক্রন্দনরত অবস্থায় বললাম,
----আমাকে মাফ করে দাও ৷ আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি ৷ এমন অন্যায়ের ক্ষমা হয়না ৷ অথচ আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি শুধু তোমার মুখের দিকে চেয়ে, তুমি ক্ষমা করবে এই আশা আমার অন্তরে আছে!
.
.
ছোট্ট একটা উদলা ছাউনীতে বসে আছি আমি অনু ও আমাদের পরী!
দেখতে দেখতে আমাদের মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে ৷ সে ক্লাস ১ পড়ে ৷ আমাদের দুজনের নাম বানান করে লিখতে ও পড়তে পারে সে ৷ কিন্তু কখনোই সে আমাদের দুজনের নাম আলাদা করে লিখে নি ৷ তার কলমে আমাদের নাম লিখে “অনুনীল" ৷ আমার ছোট্ট মেয়েটাকে বলি, যে, “মা তুমি এভাবে আমাদের নাম লিখো কেন?" আমাদের ছোট্ট মেয়েটা মিষ্ট করে জবাব দেয়, “তোমরা দুজনে তো সবসময় একসাথে মিলেমিশে থাকো, তাই নাম দুটাও মিলেমিশে থাকুক!"
.
মেয়ের কথা শুনে তার মা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলে,
“তোমাকে ধন্যবাদ গো স্বামী আমার, এভাবে পাশে থাকার জন্য!"
.
.
(ভাল না লাগলে গল্পটা না পড়া উত্তম]

অদৃশ্য পরী

  ----দেবর সাহেব, তো বিয়ে করবে কবে? বয়স তো কম হলোনা ৷ ----আপনার মত সুন্দরী কাউকে পেলে বিয়েটা শীঘ্রই করে ফেলতাম ৷ -----সমস্যা নাই তো, আমা...