বধূ কোন আলো লাগলো চোখে
লেখক #moyej_uddin
"স্ত্রী হচ্ছে বিছানার সৌন্দর্য। এদের সেভাবেই দেখবে। বাড়তি লাই দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর স্ত্রী শব্দটার ইংরেজি একটা প্রতিশব্দ আছে জানো তো? শব্দটা হচ্ছে "বেডফেলো", মানে শয্যাসঙ্গী। এদের সাথে কাহিনী ওই শয্যা পর্যন্তই রাখবে। এই স্ত্রী দের এতো লাই দিও না। দেখবে তোমাদের ভেড়া বানিয়ে রেখে দেবে। পুরুষ হয়ে জন্মেছো, পুরুষ হয়ে বাঁচো, পৌরুষ নিয়ে বাঁচো, আমার দলে আমি কোনো ভেড়া রাখবো না। ফের যদি আজকের এই ইম্পরট্যান্ট মিটিং-এর সময় কারো স্ত্রীর নাম্বার থেকে ফোন আসে তাহলে তাকে আজ এই সামিন ইয়াসার পশ্চাৎদেশে লাত্থি মেরে রুম থেকে বের করে দেবে। "
সামিন ইয়াসার কথাটা বলে শেষ করতে না করতেই মিটিং রুমের সবাই যার যার ফোন বের করে ফোনটা সাইলেন্ট করে ফেলে। তারা তাদের নেতা সামিন ইয়াসারকে খুব ভালো করে জানে। আজ সমাবেশের আগে পশ্চাৎদেশে লাত্থি খাওয়ার শখ নেই কারো।
সামিন চেয়ারের হাতলে তার বা হাতটা রেখে দুটো টোকা মেরে বলে,"চোখ কান খোলা রাখবে সবাই। পুলিশ যতই থাকুক না কেনো, নিজেদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আমি নির্বাচনের আগে আমার কোনো ছেলে হারাতে চাই না।"
"জ্বি ভাই।"
সবাই একসাথে বলে ওঠে। সামিন ইয়াসার হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে থাকে,তার দু'চোখ বন্ধ।
"ভাই আতাউরের বাচ্চার খবর শুনছেন? মনে হয়না বাঁচবে। জানিনা কাজটা কে করছে,তবে সুবিধা হইছে আমাদের। একটা বড় কাঁটা পথ থেকে সরে গেছে। বেশি ফাল পারতেছিলো হারামজাদা।"
জামিলের কথায় সামিন ইয়াসার চোখ খুলে তার দিকে চায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"ভদ্রভাবে কথা বলো জামিল। আতাউরের বাচ্চা আবার কি ধরনের কথা? মুরব্বি মানুষ। সম্মানের সাথে ডাকবে। ওনার নাম আতাউর আলম।"
জামিল থতমত খেয়ে যায়। ইয়াসার ভাইয়ের মন বোঝা বড় দায়। প্রতিদিন যে লোক এই আতাউর আলমকে তুলোধুনো করতে ছাড়ে না সে আজ মুরব্বি জ্ঞানের পাঠ পড়াচ্ছে। কি অদ্ভুত!
সামিন ইয়াসার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,"আমার তরফ থেকে একটা ফ্লাওয়ার বুকে নিয়ে গিয়ে হসপিটালে দিয়ে আসিস কেউ। বাড়ির লোকদের গিয়ে বলে আসবি "সামিন ইয়াসার পাঠিয়েছে, সে খুবই দুঃখ প্রকাশ করেছে।"
দলের দুজন তরুণ প্রতিনিধি মাথা নাড়ায়। সামিন ইয়াসার উঠে হেলতে দুলতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দলের সবাই তাদের নেতাকে অনুসরণ করে কালো পিঁপড়ার দলের মতো লাইন ধরে দলীয় মিটিং রুম থেকে বের হয়।
জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউ উপচে পরেছে আজ এই এলাকায়। সরকার দলীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য ইমতিয়াজ মির্জার বড় ছেলে সামিন ইয়াসার যে কিনা খোদ নিজেও ছাত্রনেতা সে আজ সমাবেশের ডাক দিয়েছে। মানুষটাকে দেখার জন্য উত্তপ্ত মরুভূমির মতো বিশাল মাঠটাতে ঠেলাঠেলি করে দাড়িয়ে আছে স্কুল পড়ুয়া ছাত্র থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের দল। সবাই অপেক্ষা করছে কখন নেতা তার ভাষণ শুরু করবে। সবার অপেক্ষার পালা শেষ হয়। সিংহের মতো হেলে দুলে মঞ্চে উঠে জনতার দিকে ফিরে হাত নাড়িয়ে মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বয়সের চেয়ে গম্ভীর এবং রাশভারী কন্ঠে জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,"আসসালামুয়ালাইকুম আমার প্রান প্রিয় ভাইয়েরা।"
জনসমুদ্রে মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়। সবাই সালামের উত্তর দিচ্ছে। সামিন ইয়াসার বলতে থাকে,"আপনাদের সবার জন্য প্রানঢালা ভালোবাসা নিয়ে আজ আমি সামিন ইয়াসার মির্জা এই মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছি। আপনারা আমাকে গ্রহণ করুন। আমি আমার বাবা ইমতিয়াজ মির্জার আদর্শে বেড়ে ওঠা........"
আর কিছু বলার আগেই নরম একটা মেয়েলী হাত সামিন ইয়াসারের বাহু ধরে ঘুরিয়ে দেয়,সামিন ইয়াসার কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ডান গালে স্বশব্দে একটা চড় বসিয়ে দেয় তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন তরুণী। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সামিন ইয়াসারের দলীয় তরুণ কর্মীরা। জনতার সমুদ্রে গুঞ্জন শোনা যায় মুহুর্তেই। হচ্ছে টা কি আসলে!
ডানগালে হাত দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীর দিকে বিস্ময় ও প্রচন্ড রাগ মিশ্রিত দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সামিন। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে মেয়েটিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে নেয় সে। লম্বায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির মতো হবে,পাতলা ফিনফিনে শরীর,তুলে একটা আছাড় মারা যাবে অনায়াসেই। মেয়েটি সুন্দরী, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের সুশ্রী মুখটা যেকোনো তথাকথিত ফর্সা সুন্দরীদের হারিয়ে দেবে। মেয়েটি তার দিকে ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। সামিন ইয়াসার বুঝতে চেষ্টা করে মেয়েটি কে হতে পারে। নিশ্চয়ই মেয়েটি বিরোধী পার্টির একটা গুটি। যাকে আজ সামিন ইয়াসারের সমাবেশ বানচাল করতে পাঠানো হয়েছে।
মুহুর্ত কেটে যায়,মেয়েটি একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে কান্না মিশ্রিত কিন্তু তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,"বাবার আদর্শ? একটা নিরপরাধ মানুষকে রাস্তা থেকে সরানোর জন্য তার জানের ওপর হামলা করাটাও বাবার আদর্শ? রাজনীতির পাঠে আপনার আদর্শবান পিতা বুঝি এসব শিখিয়েছে আপনাকে? নির্বাচনে জেতার এতো লোভ যে কাপুরুষের মতো পেছন থেকে ছুড়ি বসিয়েছেন। সম্মুখ সমরে নামার মুরোদ নেই তাইনা? কাপুরুষ। আপনার মুখে আমি থুতু দিলাম।"
দ্বিতীয়বারের মতো সবাইকে হতবাক করে দিয়ে মেয়েটি সামিন ইয়াসারের গাঁয়ে থুতু ছুড়ে মারে। ইয়াসার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মেয়েটির ঔদ্ধত্য দেখতে থাকে চুপচাপ। মেয়েটি ঘার ঘুরিয়ে জনতার দিকে তাকায়। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"একটা আস্ত ক্রিমিনাল এই লোকটা,জনসেবার আড়ালে লুটতরাজ, মানি লন্ডারিং,সরকারের টাকা মেরে দেওয়া,খুন খারাবি করে বেড়ায় এই লোকটা। এদের পারিবারিক ইতিহাস ভুলে গিয়েছেন আপনারা সবাই? আজ একটা অপরাধীর ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে এসেছেন সবাই? লজ্জা করে না? লজ্জা করে না আপনাদের?"
সামিন ইয়াসারের দলের ছেলেরা ক্ষেপে গিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসে। ইয়াসার তাদের হাত দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দেয়। মেয়েটি সামিন ইয়াসারের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মঞ্চ থেকে নেমে যায়। কিছুক্ষণ সেখানের সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় মেয়েটিকে ধরতে। সামিন ইয়াসার তাদের পেছন থেকে ডেকে ওঠে,"দাঁড়ান।"
সবাই দাঁড়িয়ে পরে। অবাক হয়ে সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়। ইয়াসারের দলের একটা ছেলে ছুটে এসে তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,"ভাই। আতাউর আলমের বড় মেয়ে। আলো।"
সামিন ইয়াসার চোখ তুলে মেয়েটিকে আবারো দেখবে বলে তাকায়। কিন্তু মেয়েটি ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছে। সামিনের দিকে সবাই ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। পুলিশ কনস্টেবল এসে বলে,"লেডি কনস্টেবল দের পাঠিয়ে দিয়ে ধরে নিয়ে আসি?"
সামিন ইয়াসার জনতার দিকে একবার তাকায়, তারপর পুলিশ কনস্টেবলকে বলে,"এটা আমার মামলা। আমি বুঝে নেবো।"
***
মুখমণ্ডলের ঘাম মুছতে মুছতে ওরনার এক কোনা চটচটে হয়ে গিয়েছে। আজ সূর্য্যের তাপটা অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। আলো সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগটাকে মাথার উপরে ছাতার মতো ধরে রোদের তাপ প্রতিহত করে, কিছুক্ষন ওখানে ওভাবে দাড়িয়ে থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে যায় কেবিন নাম্বার দুইশো নয়ের কাছে। কেবিনের সামনে এসে তার পা ফেলার গতি কমে যায়। শরীরটা অজানা আতঙ্কে একটু একটু করে কাঁপছে। গত একদিনে মুখে কিছু দেয়নি সে, ব্লাড প্রেশার লো হয়ে গিয়েছে,মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথাটা চক্কর দিয়ে নিচে পরে যাবে। কেবিন নাম্বার দুইশো নয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আজান এবং আয়াত। আলোর ছোটো দুই ভাই। ওরা জমজ। দু'জনেই এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে। বড় আপুকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসে দু'জনেই।
আলো হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,"জ্ঞান ফেরেনি তাই না? আরে ঘাবড়াচ্ছিস কেনো? ডাক্তার বলেছে আটচল্লিশ ঘন্টার পরে দেখা যাবে। আটচল্লিশ ঘন্টা হতে এখনো সাত ঘন্টা বাকি।"
আয়াত কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,"আম্মুকে সামলানো যাচ্ছে না আপু। তুমি কিছু একটা করো!"
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, তারপর বলে,"তোরা দুজনে এখানে তাহলে আম্মুকে দেখবে কে? আজান তুই বাড়িতে যা। আয়াত আমার সাথে থাকুক।"
_তুমি কোথায় গিয়েছিলে আপু? কোনো থানা পুলিশের ঝামেলায় গিয়েছো নাকি? আমার খুব ভয় করছে!
আজানের কথায় আলো মুখটাকে হাঁসি হাঁসি করার বৃথা চেষ্টা করে বলে,"অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করে এসেছি। যেটা না করলে আমার বিক্ষিপ্ত মন শান্ত হতো না।"
আয়াত আর আজান দু'জনেই তাদের বড় আপুর কথা কিছু বুঝতে পারছে না। আলো সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তার বাবা আতাউর আলমের কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজার কাচ দিয়ে চোখ রেখে নিজের বাবার অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ক্ষতবিক্ষত শরীরটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,"আমি ওই লোকটাকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো আব্বু।"
***
"হ্যা আমি ওই মেয়েটার সম্পূর্ণ খবরাখবর চাই। কোন কলেজে পড়ে। কোথায় কোথায় যায়। মানে ওকে নজরে নজরে রাখবে। কেনো বলছি? কারন আমার দরকার তাই, এখন ফোনটা রাখো এবং যা করতে বলেছি করো।"
সামিন ইয়াসার ফোন কেটে দিয়ে বিছানার ওপর ছুঁড়ে মারে ফোনটা। তারপর ধপ করে নিজেও বসে পরে বিছানায়। মাথা থেকে কিছুতেই ওই দৃশ্যটা সে সরাতে পারছে না। চড়ের শব্দ টা এখনো তার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ওই মেয়েটির তার গাঁয়ে থুতু ছুড়ে মারার দৃশ্যটা মস্তিষ্কে দামামা বাজিয়ে যাচ্ছে। সামিন ইয়াসার চোখ বন্ধ করে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে। কিছুক্ষণ যেতেই হুরমুর করে তার ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে তার ভাই ইলহাম। সামিন ইয়াসার মাথা তুলে তাকায়। সে কিছু বলার আগেই ইলহাম বলে ওঠে,"টিভি অন করো ভাইয়া। কুইক!"
সামিন উঠে টিভি অন করে। ইলহাম বলে,"চ্যানেল নাম্বার থার্টিন।"
"ছাত্রনেতা সামিন ইয়াসারকে জনসম্মুখে চড় মেরেছে তরুণী। কে এই তরুণী?"
সংবাদ উপস্থাপিকার মুখে বাক্যটি শুনে সামিন ইয়াসার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। তার চড় খাওয়ার ভিডিওটি খবরে বারবার দেখানো হচ্ছে। সামিন রিমোট টিপে চ্যানেল পাল্টায়। সেখানেও সেই একই খবর। সামিন ইয়াসার ক্ষুব্ধ দুটি চোখ নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে।
"ভাইয়া প্রায় প্রত্যেকটা খবরের চ্যানেলে ভিডিও ক্লিপটা ছড়িয়ে গেছে।"
পাশ থেকে আমতা আমতা করে ইলহাম বলে।
_কে করেছে ভিডিওটা?
তেজী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে সামিন ইয়াসার।
_জানার চেষ্টা করছি ভাইয়া।
"ছাত্রনেতার গালে তরুণীর চড়। এই তরুনীর সাথে কি কোনো অসভ্যতা করেছিলো ছাত্রনেতা সামিন ইয়াসার?"
সামিন আর শুনতে পারেনা, হাতের রিমোটটা ছুঁড়ে মারে টিভির দিকে।
ইলহাম ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বড় ভাইকে দেখে। সিংহ এক্ষুনি গর্জন শুরু করবে,একে সামলানো তার একার পক্ষে দায় হয়ে যাবে। সে তার বাবা ইমতিয়াজ মির্জাকে ডাকতে উদ্যত হবে তখনি ইমতিয়াজ মির্জা দরজার পর্দা সরিয়ে হনহন করে ঘরে ঢোকে সামিন ইয়াসারের।
সামিন ইয়াসার তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। ইমতিয়াজ মির্জা ধীরে ধীরে বলে,"শান্ত হও। মানহানির মামলা করবো। শান্ত হও।"
_এতে হয়ে যাবে বাবা?
ঠান্ডা গলায় বাবাকে প্রশ্ন করে সামিন। ইমতিয়াজ মির্জা তার ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন কন্ঠে অস্বাভাবিক শান্ত ভাব বজায় রেখে বলে,"এতে ওই ভিডিও ক্লিপ টা মুছে যাবে?"
_আমি ওটা সব যায়গা থেকে সরানোর ব্যবস্থা করছি।
_আর মানুষের মস্তিষ্ক থেকে? সেখান থেকে কিভাবে সরাবে বাবা? পারবে না তো। সামিন ইয়াসার জনসমক্ষে একটা মেয়ের হাতে চড় খেয়েছে, মেয়েটা তার গায়ে থুতু মেরেছে এটা তো তাদের মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছে বাবা। ওরা আজীবন মজা ওড়াবে এটা নিয়ে। আজীবন!
ইমতিয়াজ মির্জা চুপ করে থেকে বলে,"আমি মানহানির মামলা দেবো।"
_না।
ঠান্ডা গলায় বলে ইয়াসার।
_বাধা দিচ্ছিস কেনো? একটা বিহিত তো করতেই হবে।
_তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমি করবো।
ওই মেয়েটাকে এর দাম দিতে হবে। আমি ওই মেয়েটার খুব খারাপ অবস্থা করে ছাড়বো বাবা। ও আজীবন মনে রাখবে এই সামিন ইয়াসারকে।
চলবে.....?
হাসপাতালের করিডোরে একটা লম্বা ধরনের বেঞ্চিতে পা উঠিয়ে বসে আছে আলো। কিছুক্ষণ পরে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে দেয় সে। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা তার। ইচ্ছে করছে বাচ্চাদের মতো গলা ছেড়ে,হাত পা ছুড়ে কাঁদতে, কিন্তু এটা করা যাবে না। মা, দাদী, আয়াত,আজান তাকে দেখেই কিছুটা ভরসা পাচ্ছে। এখন যদি সেও ভেঙে পরে তবে তো সব ভেসে যাবে! দু'টো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনও নেই যে তাদের ভরসায় সবাইকে ছেড়ে দিয়ে সে শোকপালন করবে।
"এই আপু।"
আয়াতের গলার আওয়াজ পেয়ে আলো মাথা তুলে তাকায়। আয়াতের দিকে তাকাতেই বুকটা হুহু করে ওঠে তার। কত প্রাণোচ্ছল ছেলে দুটোর মুখ শুকিয়ে কি হয়েছে ! সহ্য করা যাচ্ছে না এসব।
"আপু একটু ডাল পুরি এনেছিলাম কিনে। মুখে দেবে একটু?"
আলোর চোখ দুটো ভিজে উঠেছে। সবসময় বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা ছেলেটা আজ খেয়াল রেখেছে বোন কিছু খায়নি। বোনকে খাওয়াতে হবে।
আলো একবার মাথা নাড়িয়ে না বলতে চেয়েও পারে না। ডালপুরির ঘ্রানে তার পেটের খিদে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সে হাত বাড়িয়ে প্যাকেট টা নিয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকে খাবার টা। আয়াত চোখের চশমা খুলে চশমাটা পরিষ্কার করতে করতে বলে,"সত্যি করে বলো তো, কোথায় গিয়েছিলে? থানায়?
_না। ওখানে যাবো কোন দুঃখে? সব তো ইয়াসারের পা চাটা চামচা।
_তাহলে?
_তোর জেনে কাজ নেই। শোন না,আমায় একটু ওয়াশ রুমের কাছে নিয়ে যা।
আয়াত উঠে দাঁড়ায়। আলো আয়াতের পিছু পিছু যাচ্ছে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারলো লোকজন তাকে দেখছে,তার দিকেই তাকিয়ে আছে আগন্তুকরা , অস্বাভাবিক লাগছে আলোর কাছে ব্যাপারটা। আলো আয়াতকে বলে,"শোন না,আমার মুখে কি কিছু লেগে আছে দেখতো!"
_না আপু। কেনো?
আলো কিছু বলে না। হাঁটতে হাঁটতে ওয়েটিং রুমের কাছে এসে সে থমকে যায়। আয়াত মাথা ঘুরিয়ে চোখ বড়বড় করে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়েটিং রুমের বড় স্ক্রিনের টিভিতে সামিন ইয়াসারকে থাপ্পর মারার ভিডিওটি চোখে পরতেই সে স্তব্ধ হয়ে যায়। লোকজন হা করে দেখছে। প্রত্যেকটা লোকাল খবরের চ্যানেলে একই জিনিস দেখানো হচ্ছে। আলো হতভম্ব হয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আয়াত আতংকিত হয়ে তার বোনকে দেখতে থাকে, বিড়বিড় করে বলে,"আপু,এটা তো তুমি!"
আলো কোনো কথা না বলে আশেপাশে তাকায়। সবার দৃষ্টি টিভির দিকে। তাকে এখনো সম্ভবত ওয়েটিং রুমে বসে থাকা মানুষ গুলো দেখতে পায়নি। কেউ দেখে ফেলার আগেই আলো তড়িঘড়ি করে হ্যান্ডব্যাগ থেকে মাস্ক বের করে পরে নেয়। আয়াতের হাত ধরে দ্রুত ওখান থেকে আড়াল হয়ে যায়।
"আপু। তুমি এটা কি করলে ! ওই লোকটাকে কেনো চড় মারলে!"
_ওটা ওই লোকটার প্রাপ্য ছিলো।
_তাহলে এখন? এখন কি হবে। দেখলে প্রত্যেকটা চ্যানেলে তোমাকে দেখাচ্ছে। এই উটকো ঝামেলার মোকাবেলা কিভাবে করবে।
_যা হয় হোক। আমার আব্বুর গাঁয়ে হাত দিয়েছে। ওই লোকটাকে এর দাম দিতে হতোই। যে এই ভিডিওটি করেছে তাকে ধন্যবাদ দিতে হবে,ওই লোকটার মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাক। বেশ হয়েছে। পশু একটা।
_কিন্তু আপু ও যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে দেয়!
_নির্বাচনের আগে কিছূ করতে পারবে না ও। ওর হাত পা বেঁধে রেখেছে ওর ক্ষমতার প্রতি লোভ। আমার কিছু হলে সবাই ভাববে ও করিয়েছে। আমার মনে হয় না ও এই রিস্ক নিতে চাইবে। তোরা চিন্তা করিস না। কিচ্ছু হবে না আমার।
***
"পুরো নাম অদ্রিতা আলো। অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী, ইংরেজি বিভাগ, স্থানীয় মহিলা কলেজে পড়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে বেড়ায়। খুবই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটা মেয়ে। সবার মুখে যেরকমটা শুনেছি তাতে মেয়েটিকে বেশ ভালোই মনে হয়েছে।"
_ভালো? ভালো না খারাপ তা দিয়ে আমার লাভ? আমি শুধু ওই মেয়ে টাকে শিক্ষা দিতে চাই।
চেঁচিয়ে কথাটি বলে সামিন ইয়াসার। তার সামনে বসে আছে তার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফুয়াদ।
সামিন বলতে থাকে,"মেয়ে মানুষের এতো ঔদ্ধত্য আমি নিতেই পারি না। ওই মেয়ের সাহস কি করে হয় ওর অহেতুক সন্দেহের বসে সামিন ইয়াসারের মুখোমুখি হওয়ার? আমি ওর বাপকে মেরেছি?
_একেবারে বাবার ফটোকপি আলো। প্রচন্ড দুঃসাহসী। তবে ওর জমজ দুটো ভাই আবার তেমন নয়। খুবই ভীতু প্রকৃতির। সদ্য এস.এস.সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। দু'জনেই সাইন্সের স্টুডেন্ট, সৃষ্টি কোচিং সেন্টারে যায় নিয়মিত। চশমা পরে, সবসময় কাঁচুমাচু মুখ করে থাকে, একেবারে মায়ের দুধের খোকা টাইপ। দু'জনেই আলোর কলিজা।
_ওর ভাই দুটোর উপরেও নজর রাখবি।
ফুহাদ বলে,"একটু মাথা ঠান্ডা কর। আংকেলের কথা মতো মান হানির মামলা দিয়ে দে। নিজে কেনো জড়াতে চাইছিস ব্যাপারটায়? একটা ব্লান্ডার হয়ে গেলে পার্টি তোকে নমিনেশন দেবে?
_ওসব পরে দেখবো, এখন আমি শুধু আর শুধু ওই মেয়েটার ভোগান্তি দেখতে চাই। এই বত্রিশ বছরের জীবনে আমার নিজের মা কখনো আমার গায়ে হাত তোলেনি আর ঐ মেয়েটা সবার সামনে দাঁড়িয়ে......!
আর কিছু বলে না ইয়াসার। রাগ,ক্ষোভ, প্রতিহিংসার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ফুঁসছে সে।
ফুয়াদের ফোনে একটা ফোন আসে, সে ফোনটা রিসিভ করে "হু হা" আওয়াজ করে উত্তর দিয়ে ফোন রেখে দেয়। ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে বলে,"আতাউর আলমের জ্ঞান ফিরেছে গতকাল রাতে। স্ত্রী কন্যা এখন হসপিটালেই আছে। তার জমজ ছেলে দুটো কোথাও বেড়িয়েছে।"
_দুটোকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আয়।
_এখন?
_হু।
_ওদের দিয়ে কি করবি? বাচ্চা ছেলে। খুবই শান্ত এবং মেধাবী দুটি ছেলে।
ইয়াসার চোখ গরম করে ফুয়াদের দিকে তাকায়। ফুয়াদ ঘাবড়ে গিয়ে বলে,"লোক পাঠাচ্ছি!"
ফুয়াদ উঠে চলে যায়। ফুয়াদ চলে যেতেই ইলহাম ঘরে ঢোকে। সামিন ইয়াসার মাথা না তুলে বলে,"ফুল এনেছিস?"
_হ্যা,আনিয়ে রেখেছি। কিন্তু কেনো? এখন ফুল দিয়ে কি করবে?
_সাংবাদিক আতাউর আলমের জ্ঞান ফিরেছে। কাউকে দিয়ে আমার নাম করে পাঠিয়ে দে। রাজনীতির মাঠে শত্রু হলেও আমরা তো উভয়ই দেশের সেবায় নিয়োজিত। একটু সহমর্মিতা প্রকাশ করা উচিৎ।
ইলহাম সামিনের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন ইয়াসার মৃদু হেসে বলে,"ছোটো ফোন করেছিলো।"
_কি বললো?
_বারবার বলেছে কোনো ঝামেলা না করতে এটা নিয়ে।
_ও বরাবর ভীতু,ছেলেটার কিচ্ছু হবে না ভাইয়া। বাবা শুধু শুধু ওকে অপছন্দ করে না। বাবার তিন ছেলের মধ্যে বাবার কাছে ও সবচেয়ে বেশি অযোগ্য।
সামিন শুকনো হাসি হাসে। বাবা পছন্দ না করলেও সামিনের কাছে তার ছোট্ট ভাইটা তার কলিজা। ভাইয়ের জন্য জান দিতেও সর্বদা প্রস্তুত থাকে সে। অথচ এই ভাইটাই বুঝতে চায় না। অভিমানে তাদের থেকে কতটা দূরে সরে গিয়েছে।
লিভিং রুমে কান্নাকাটির আওয়াজ কানে যেতেই ইলহাম এবং সামিন ইয়াসার উঠে দাঁড়ায়। কাঁদছে ইলহামের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে ইহান। তার পাশে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে ইলহামের স্ত্রী রিতু। তাকে আটকানোর চেষ্টা করছে ইশিতা,সামিন ইয়াসারের একমাত্র ছোটো বোন। রিতুকে আটকানো যাচ্ছে না,সে ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছে ইহানের উপর।
"হচ্ছে টা কি এখানে!"
গর্জে ওঠে ইলহাম। রিতু স্বামীর গলার আওয়াজ পেয়ে কিছুটা কেঁপে ওঠে।
ইলহাম লিভিং রুমের দিকে এগিয়ে যায়। তার পেছনে পেছনে যায় সামিন ইয়াসার। বড়বাবাকে দেখে ইহান দৌড়ে এসে তার কোলে উঠে যায়। সামিন ইয়াসারকে সে বড় বাবা বলে ডাকে। সামিন ইহানের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে রিতুর দিকে চায়, কপাল কুঁচকে বলে,"ওকে মারছো কেনো রিতু?"
স্বামী আর ভাসুর দু'জনকে দেখে রিতুর আত্মারাম খাঁচাছাড়া অবস্থা। একটা ঢোক গিলে বলে,"ওর দাদার মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে সব টাকা ছিঁড়ে ফেলেছে, সবগুলো একহাজার টাকার নোট ছিলো ভাইয়া।"
ইলহাম রিতুর দিকে তেড়ে যায়,"তো? তোর বাপের টাকা ছিঁড়েছে ফকিন্নির বাচ্চা?"
রিতু ইশিতার পেছনে লুকায়। ইশিতা রিতুকে আগলে নিয়ে ইলহামকে বলে,"এখন তুমি সিনক্রিয়েট করো না ভাইয়া প্লিজ।"
সামিন ইয়াসার ঠান্ডা গলায় বলে,"টাকা ছিঁড়েছে বলে ওকে মারবে তুমি? কত টাকা ছিঁড়েছে? পাঁচ হাজার? দশ হাজার? ভবিষ্যতে আমার ভাইপোর গাঁয়ে হাত তুললে তোমাকে শাস্তি পেতে হবে রিতু। এখন যাও এখান থেকে, আমি ইহানকে নিয়ে বাগানে যাচ্ছি।"
তারপর ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,"চলো চাচ্চু। ফুটবল খেলবো আমরা।"
সামিন ইয়াসার ইহানকে নিয়ে চলে যায়। রিতু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দু'চোখ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পড়েছে তার। ইলহাম গলার আওয়াজ নিচু করে বলে,"অনেকদিন গাঁয়ে মার পরেনি তাইনা? তাই এতো বাড় বেড়েছিস। তোকে আজ বোঝাবো।"
গটগট করতে করতে চলে যায় ইলহাম। ইশিতা করুণ দৃষ্টি দিয়ে তার মেজো ভাবীকে দেখে। কি সুন্দর পুতুলের মতো দেখতে ২৩ বছরের মেয়েটা। সতেরো বছরে বিয়ে,আঠেরো বছরে বাচ্চা। স্বামীর ভালোবাসা তো দূরে থাক কখনো তুই তোকারি ছাড়া কথাই বলে না মেজো ভাইয়া। এতো সুন্দর,নরম মনের একটা মেয়ের সাথে কেউ কিভাবে এতো অমানবিক আচরণ করতে পারে! ইশিতা রিতুর গায়ে হাত রেখে বলে,"ভাবী।"
রিতু কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"তুমি খুব ভাগ্যবতী আপু। তোমার বাপ ভাইদের কত টাকা দেখেছো? পাঁচ হাজার,দশ হাজার টাকা ছিঁড়ে ফেললেও তাদের যায় আসে না। তুমি অনেক ভাগ্যবতী। তাদের টাকার অভাব নেই, তাই টাকার কষ্টে, মোটা টাকার মোহরানার বিনিময়ে তোমাকে তোমার বাপ ভাইয়েরা কোনো জানোয়ারের কাছে অন্তত বিয়ে দেবে না,আমার মতো অবস্থা হবে না তোমার। তুমি খুব ভাগ্যবতী আপু।
***
রেহেনা আক্তার মেয়ের দুই বাহু ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,"বল কেনো করলি এমনটা! বল।"
আলো চুপ করে আছে। রেহেনা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,"তোর বাবার এই অবস্থা। মাথার উপর শক্ত কোনো হাত নেই। কেনো জড়াতে গেলি এই ঝামেলায়,বল আমায়। এর পরিণাম কতটা ভয়ংকর হতে পারে তুই জানিস? তোকে ওরা কি কি করতে পারে জানিস?"
_এতো কিছু জানার দরকার নেই আমার। চড় মেরেছি বেশ করেছি। ওকে জুতা দিয়ে মারা উচিৎ ছিলো।
রেহেনা মেয়ের কথা শুনে বলে,"তোর বাবার মাত্র জ্ঞান ফিরেছে। সে সুস্থ হয়ে যদি জানতে পারে তার মেয়ে এতো বড় একটা কান্ড ঘটিয়েছে কি হবে বুঝতে পারছিস?"
_বাবা আমাকে বাহবা দেবে।
রেহেনা আহত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পরে। আতাউর আলমের জ্ঞান ফিরেছে। যেটুকু স্বস্তি পাওয়ার কথা আলো তা পাচ্ছে না। সবাইকে না বুঝতে দিলেও ভেতরে ভেতরে সে খানিকটা ভয় পাচ্ছে। তবে তার নিজের জন্য না,আয়াত এবং আজানের জন্য। খুবই ভীত স্বভাবের ছেলে দুটো,ওরা বাইরের লোকজনকে ফেইস করবে কিভাবে! কিছুক্ষণ এসব কথা ভাবতে গিয়ে টের পায় তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। এই দুদিনে মোটে এক-দু'ঘন্টার জন্য চোখের পাতা বন্ধ করেছিলো সে। ক্লান্তিতে তার পুরো শরীর ছেয়ে গিয়েছে। ফোনের রিংটোন বেজে উঠলে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই তার ক্লান্তি চলে যায়। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে ওঠে,"অদ্রিতা আলো।"
_শুনছি। বলো।
_কেনো করলে ওমন? একটু ঠান্ডা মাথায় থাকা যেতো না?
_বেশ করেছি । আরো করবো। জানোয়ারের বংশধর একটা।
ওপাশের ব্যক্তি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,"তুমি তো নিশ্চিত না কাজটা যে সামিন ইয়াসারের লোকই করেছে। কেনো সন্দেহের বশে অহেতুক ঝামেলায় জরালে? যতটুকু তাদের সম্পর্কে জানি তাতে মনে হয়না তারা কাজটা করবে।"
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"কি বলো তো ইশমাম? তোমাকে সবসময় দেখেছি তুমি ওই মির্জা বাড়ির লোকজন আর ওদের পার্টিকে সাপোর্ট করে কথা বলো। একটা কথা বলো তো,তুমি কি ওই দলের ছেলে নাকি? ওদের পার্টির সমর্থক?"
ইশমাম ফোনের ওপাশে বসে একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলে,"কি যে বলো না অদ্রিতা, আমি বিদেশে থেকে দেশীয় পলিটিক্স করবো?"
আলো কিছু বলে না। ইশমাম বলে,"আচ্ছা ঠিকাছে। সামিন ইয়াসার এবং তার চৌদ্দ গুষ্টি খারাপ,খুউউব খারাপ। খুশি?
আমার তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছে অদ্রিতা। আর ওই সামিন ইয়াসারের সাথে লাগতে যেও না। আংকেলের এই অবস্থা! তুমি প্লিজ সেইফ থাকো। পরিবারের জন্য সেইফ থাকো,আমার জন্য সেইফ থাকো!"
শেষের কথাটা শুনে আলো পুলকিত হয়। শুকনো মুখে হাসির রেখা ফোটে। ইশমাম ওপাশ থেকে বলে,"লাভ ইউ!"
আলো অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়,
_মি টু।
"আপু বাবা চোখ খুলে তাকিয়েছে। দেখবে না?"
আজানের কথায় আলো ফোন রেখে এক লাফে উঠে দাঁড়ায়। দৌড়ে গিয়ে দরজা ঠেলে আতাউর আলমের কেবিনে ঢুকে পরে। আতাউর আলমের মাথার কাছে রেহেনা বসে আছে। স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তিনি। আলো ধীরপায়ে হেটে গিয়ে গিয়ে আতাউর আলমের পায়ের কাছে দাড়ায়। আতাউর আলম তার আদরের বড় মেয়ের মুখের দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। মুখে খানিকটা চেষ্টা করলো হাসি ফুটিয়ে তুলতে কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। তীব্র যন্ত্রনায় শরীরটা বিষিয়ে উঠেছে। আলো মৃদু স্বরে বলে,"খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না আব্বু!"
_না আম্মু। একটুও ব্যথা করছে না।
_ওই লোকটাকে আমি উচিত শিক্ষা দিয়েছি আব্বু।
আতাউর আলম মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"কাকে?"
_সামিন ইয়াসার মির্জাকে। ওর অকাদ বুঝিয়ে দিয়েছি। ও এখন হারে হারে টের পাচ্ছে।
আতাউর আলম কিছু বুঝতে পারছে না।
আলো ম্লান হেসে বেডে বসে বাবার হাতটা টেনে নিজের কোলের উপর রাখে। আতাউর মেয়েকে দেখতে থাকে,মুখ শুকিয়ে কি হাল হয়েছে মেয়েটার! আলো বলতে থাকে,"তুমি খুব শিগগিরই সেরে উঠবে আব্বু। তারপর ইলেকশনে লড়বে। দেখি কে তোমাকে আটকায়।"
রেহেনা আতংকিত হয়ে বলে,"পাগল হয়েছিস তুই? কিসব উল্টো পাল্টা বকছিস এই সময়ে।"
_আহা। ওকে বকছো কেনো? ঠিকই তো বলেছে। আমি এতো সহজে হার মেনে নিয়ে বসে থাকবো নাকি!
অত্যন্ত ক্ষীণ কন্ঠে বলে আতাউর আলম। রেহেনা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে অভিমানী সুরে বলে ওঠে,"ক্রাইম রিপোর্টারের স্ত্রী হয়ে পাপ করেছি পাপ। প্রতিনিয়ত সন্তানদের বিপদের কথা,স্বামীর বিপদের কথা ভেবে ভয়ে তটস্থ হয়ে থেকেছি। শেষ বয়সে এসে রিপোর্টারের পেশা ছেড়ে এখন রাজনীতির ভুত মাথায় চেপেছে তাইনা? দেখলে তো ফল কি হলো? একটুর জন্য তোমার স্ত্রী বিধবা, তোমার মা সন্তান হারা আর তোমার তিন ছেলেমেয়ে এতিম হয়নি। আর যদি কখনো এসবে জরিয়েছো তাহলে আমি কিন্তু এই সংসার ছেড়ে চলে......"
"ম্যাম পেশেন্টের সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে।"
নার্সের কথায় আলো মাথা ঘুরিয়ে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায়। কে দেখা করতে আসবে এখন!
রেহেনা বলে,"কে এসেছে?"
"আমরা।"
অচেনা পুরুষালি গলার আওয়াজ পেয়ে রেহেনা মাথায় ঘোমটা তুলে দেয়। আলো উঠে দাঁড়িয়ে যায়। পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে দুজন ছেলে। আলো হতভম্ব হয়ে চোখ কপালে তুলে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকে। এই দুজনের একজনকে সে চেনে। জামিল নাম লোকটার,সামিন ইয়াসারের ডানহাত। লোকটার হাতে একটা ফুলের তোড়া। আলো রেগেমেগে বলে,"আপনারা!"
জামিল ফুলের তোড়াটা আতাউর আলমের বেডের উপর রেখে বলে,"ইয়াসার ভাই পাঠিয়েছে। আপনার বাবা জলদি জলদি সুস্থ হয়ে যাক,এই কামনা করে সে।"
আলো একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ফুলের তোড়াটা ঠেলে মেঝেতে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে কুচলে দেয়। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে,"বেড়িয়ে যান। আর আপনার ইয়াসার ভাইকে বলে দিবেন এসব নাটক আমাদের সাথে না করে জনগণের সামনে গিয়ে করতে, দুয়েকটা ভোট পেলেও পেতে পারে।"
জামিল শীতল চোখে একবার আলো আর একবার মেঝেতে পরে থাকা ফুলের তোড়া টার দিকে তাকায়। তারপর কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
আলো মাথা ঘুরিয়ে বাবাকে দেখে, তারপর নিচু গলায় বলে,"তেলাপোকা কতগুলো!"
আতাউর আলম মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমার বাঘের বাচ্চা।"
আলো বাবার মাথার কাছে বসে পরে, বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বলে,"হুম,আর তুমি বাঘ!"
_তা তোমার মেনি বিড়াল ভাই দু'টো কোথায় গিয়েছে?
_ওদের কোচিং-এ পাঠিয়ে দিয়েছি আব্বু। বেশ কয়েকদিন ধরে যায়নি।
_ভালো করেছিস।
বাপ-বেটিতে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আলোর ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই আলো সেদিকে তাকায়। আজানের ফোন, আলো রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে আজান বলে ওঠে,"আপু।"
"এই নেংটি ইঁদুর দুটিকে কোথা থেকে ধরে আনলি রে জামিল। এদের কি করবি?"
_হুস!
ঠোঁটে আঙুল চেপে আরাফকে চুপ করিয়ে দিয়ে জামিল ফিসফিসিয়ে বলে,"কথা বলিস না। ভাইয়ের মাথা খুবই গরম আছে। কানের নিচে খাবি।"
আরাফ গলার আওয়াজ জামিলের থেকেও নিচু করে বলে,"কিন্তু এরা কারা? এই ছেলে দুটোকে আঁটকে রেখেছিস কেনো?"
_সময় আসুক। বুঝতে পারবি।
"জামিল"
ফুয়াদের ডাক শুনে দৌড়ে সেখানে চলে যায় সে। ফুয়াদ সামিন ইয়াসারের পাশে বসে আছে। ইয়াসারের মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। চুপচাপ বসে আছে সে। জামিল গিয়ে ফুয়াদকে বলে,"জ্বি ভাই বলেন।"
_হাসপাতালে ফুল নিয়ে গিয়েছিলি?
_জ্বি।
_কি হয়েছে সেখানে।
_মেয়েটা ফুলের তোড়া পায়ের নিচে ফেলে কুচলে দিয়েছে আর বলেছে সামিন ইয়াসারকে যেন বলে দেই এসব নাটক জনগণের সাথে করতে।
ফুয়াদ কথাটি শুনে সাথে সাথে সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়। সামিন বলে,"দেখলি! বলে ছিলাম না? আগা গোড়া তেজে ভরা। ওর তেজ আজকে ভাঙবো। আসুক একবার।"
রাহাত নামের একটি ছেলে পাশ থেকে বলে ওঠে,"হ ভাই। মেয়েটা ভীষণ জাঁদরেল। একটা কাহিনী বলি শোনেন। ওর কলেজের পাশে মঞ্জুর চায়ের দোকান আছে না? একদিন সেখানে আনোয়ারের গ্যাং কলেজ ছুটির সময় বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। তো আলো ওর বান্ধবীদের সাথে দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় আনোয়ারের দলের একটা ছেলে ব্যাড কমেন্ট করে । আলো এসে সরাসরি সেই ছেলের মুখোমুখি দাঁড়ায়। চোখে চোখ রেখে বলে,"নাম কি?"
ছেলেটা হাসতে হাসতে বলে,"নাম দিয়ে তোমার কাম কি? প্রেম করতে চাও কি?"
আলো ঠান্ডা গলায় বলে,"আমি এখন একটা ইট এনে তোর বিচি থেঁতলে দেবো। হসপিটালে এডমিট করার সময় তোর নাম জিজ্ঞেস করলে তখন কি নাম বলবো?"
রাহাত কথাটি বলে শেষ করতে পারে না ফুয়াদ,জামিল এবং অন্যরা উচ্চশব্দে হেসে ফেলে। সামিন ইয়াসার কটমট দৃষ্টি দিয়ে ফুয়াদের দিকে তাকাতেই ফুয়াদ অনেক কষ্টে হাসি বন্ধ করে। বাকিরাও নিশ্চুপ হয়ে যায়। সামিন ইয়াসার বিড়বিড় করে বলে,"আসুক আজ।"
জামিল বলে,"ভাই পোলা দুইটা অনেক কাঁদছে।"
_ধমকাধমকি করিস না। যা করার ওর বোনের সাথে করবো।
গম্ভীর কন্ঠে বলে সামিন ইয়াসার। তারপর বলে,"এখানে নিয়ে আয় দুটোকে।"
দু-তিন জন গিয়ে আজান আর আয়াতকে নিয়ে আসে। দু'জনেই ভয়ে কাঁপছে। তাদের এনে সামিন ইয়াসারের সামনে রাখা হয়। আয়াত কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"ভাইয়া ওনাদের বলুননা আমার চশমাটা দিয়ে দিতে। চশমা ছাড়া আমার ভীষণ অসুবিধা হয়।"
সামিন ইয়াসার গম্ভীর কন্ঠে বলে,"তোমাদের আপু আসুক। সব দিয়ে দেওয়া হবে তোমাদের।"
কয়েক মুহূর্ত কাটে,আয়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা মায়া হয় সামিনের,জামিলকে বলে,"ওর চশমা দে।"
জামিল চশমা এনে দেয়।
রিকশা থেকে নেমে আলো চারপাশে তাকিয়ে আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিংটা খুঁজে বের করে। বিল্ডিং টা আজান আয়াতের কোচিংয়ের ঠিক পাশেই। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে গেইটের ভেতরে প্রবেশ করে। নিজের দিকে তাকিয়ে গায়ের ওড়নাটা ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখে নেয়। ফোনে সব বন্ধুদের মেসেজ দিয়ে রেখেছে সে, বিপদের আভাস পেলেই একটা ফোন করবে। অসম্পূর্ণ হয়ে পরে থাকা গ্রাউন্ড ফ্লোরে উঠে সে দাঁড়িয়ে পরে, মৃদু স্বরে বলে,"আয়াত, আজান।"
আয়াত আজান আলোর কন্ঠ শুনতে পেয়ে যেন দেহে প্রান ফিরে পায়। মাথা ঘুরিয়ে আলোর কাছে একপ্রকার দৌড়ে যায়। আলো দুহাতে দুই ভাইকে আগলে নেয়। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,"কি হয়েছে? কি হয়েছে তোদের?"
_আপু ওই লোকগুলো আমাদের এখানে আটকে রেখেছে।
সামিন ইয়াসারের দিকে আঙুল তুলে বলে আজান। আলো চোখ কপালে তুলে ফেলে,আজান আয়াতকে সরিয়ে দিয়ে বলে,"আটকে রেখেছে মানে!"
দ্রুত পায়ে হেঁটে আলো সামিন ইয়াসারের মুখোমুখি দাঁড়ায়। চোখে চোখ রেখে বাজখাঁই গলায় বলে,"এসব কোন ধরনের অসভ্যতামি? আমার ভাই দুটোকে আটকে রেখেছেন কেনো?"
সামিন ইয়াসার আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো এক অজানা কারনে সে চোখ ফেরাতে পারছে না, না পারছে আলো নামের এই বিচ্ছু মেয়েটিকে কিছু বলতে। পাশ থেকে জামিল বলে ওঠে,"ভাইয়ের সাথে চোখ নামিয়ে কথা বলুন। বেয়াদবি ভাইয়ের পছন্দ না।"
আলো একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,"যার গালে দুদিন আগে চড় মেরেছি,এখন তার সাথে চোখ নামিয়ে কথা বলতে হবে?"
সামিন ইয়াসার রাগে অন্ধ হয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। ইচ্ছে করছে এই পাচ ফুটের মেয়েটার চোয়াল চেপে ধরতে। অনেক কষ্টে সে ইচ্ছে টাকে দমন করেছে। আলো জামিলের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমার ছোটো ভাই দুটোকে হেনস্থা করা হচ্ছে তাই না? আমি এক্ষুনি পুলিশ ডাকছি।"
"পুলিশ তো আমরাই ডাকতে পারি ম্যাডাম অদ্রিতা আলো। কিন্তু সেটা চাই না বলেই তোমাকে এখানে ডেকেছি।"
ফুয়াদ বলে কথাটা। আলো ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,"মানে?"
_মানে তোমার এই গুণধর দুই ভাইয়ের ব্যাগে ইয়াবা পাওয়া গিয়েছে।
আলোর মনে হলো তার সামনের পৃথিবীটা নড়ে উঠেছে। কাঁপছে সবকিছু। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"মানে।"
পাশ থেকে আজান বলে ওঠে,"আপু মিথ্যা কথা। একেবারেই মিথ্যা কথা । ওগুলো দু'টো লোক জোর করে ব্যাগে ভরে দিয়েছে আমার। বিশ্বাস করো তুমি।"
আলো একটা দম নিয়ে নেয়। বুদ্ধিমতি আলোর বুঝতে একটুও বাকি নেই ব্যাপারটা আসলে কি। সে সামিন ইয়াসারের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,"বুঝলাম। তো আপনার লোকেরা কিভাবে জানলো আমার ভাইদের ব্যাগে ইয়াবা আছে?"
জামিল বলে,"নিজেদের চোখে দেখেছি কারো সাথে আদান প্রদান করছিলো। দেখে তো মনে হচ্ছিলো না কেউ জোর করছিলো। তারপর গিয়ে ধরলাম।"
আলো সামিনের দিকেই তাকিয়ে আছে। সামিন এখনো চুপচাপ। আলো আটকে আটকে বলে,"আমার উপরে প্রতিশোধ নিতে আমার নিষ্পাপ ভাই দুটোকে ব্যবহার করলেন? আপনি কতটা জঘন্য একটা লোক।"
সামিন হঠাৎ করে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,"আমার ভাই দুটোকে ছেড়ে দিন। অনুরোধ করছি আপনার কাছে।"
_এতো সহজে না,হাতে নাতে ধরেছি। পুলিশে দেবো। আপনি থানায় গিয়ে ছাড়িয়ে আনুন।
জামিলের কথায় আলো কিছুটা ঘাবড়ে যায়। আজান আয়াতের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলে দুটোর চোখ ছলছল করছে। আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"তোরা একটু ওদিকে গিয়ে দাঁড়া আজান আয়াত। আমি কথা বলছি।"
দুজনে বাধ্য ছেলের মতো দূরে গিয়ে বসে থাকে। আলো সরাসরি সামিন ইয়াসারের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,"ক্ষমা চাইছি। আমার ভুল হয়েছে। আমার ভাই দু'টোকে ছেড়ে দিন।"
জামিল বলে,"এতো শুকনো কথায় তো চিড়ে ভিজবে না আপা। আপনার কারনে ভাইয়ের কতখানি সম্মান নষ্ট হয়েছে জানেন?"
_তো আমাকে আর কি করতে হবে? মাফ তো চাইলাম।
_হুস। আস্তে কথা বলেন আপা। গলায় তো আস্ত একটা মাইক নিয়ে ঘোরেন।
একজন ছেলে বলে ওঠে ইয়াসারের পেছন থেকে।
জামিল বলে,"তেমন কিছু না। শুধু ভাইয়ের পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে আপনাকে।"
আলো কথাটি শুনে হতভম্ব হয়ে সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়। ইয়াসার তার দিকে উপহাস এবং ক্ষোভের মিশ্র দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। আলো তেজী কন্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে,"অসম্ভব!"
_সম্ভব আপা।
আলো জামিলের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বলে,"আমি এখান থেকে এই মুহূর্তে আমার ভাইদের নিয়ে যাচ্ছি দেখি আমাকে কে আটকায়।
কথাটি বলে ঘুরে দাঁড়ায় আলো। জামিল বলে,"তার আগে এটা দেখে নিন।"
আলোর দিকে একটা ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে জামিল। আলো কপাল কুঁচকে ফোনটা হাতে নেয়। ছবিতে আজান আর আয়াত ইয়াবা হাতে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওদের দিয়ে জোর করে এসব ছবি তোলা হয়েছে। আলো দ্রুত ছবি গুলো ডিলিট করে ফেলে। জামিল হেসে বলে,"ছবিগুলো ভাইয়ের ফোনে আছে। ডিলিট করে লাভ নেই।"
আলো রেগে গিয়ে বলে,"জানোয়ারের দল। তোরা দেশের সেবা করিস? অমানুষ। ছিঃ। আজ ক্ষমতা আছে তাই করছিস,কাল তো থাকবে না! তখন?"
_আপনি ভাইয়ের পা ধরে ক্ষমা চাইবেন না তাইনা? ঠিকাছে,ভাইদের নিয়ে যান। আমরা ওদের ব্যাগ আর এই ছবিগুলো নিয়ে থানায় যাচ্ছি। ডিবি পুলিশ গিয়ে বাড়ি থেকে তুলে আনবে,পরে গিয়ে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনবেন,ভাইদের নামের পাশে আজীবনের জন্য ইয়াবাখোর ট্যাগ লেগে থাকবে।"
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন ইয়াসার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আলোকে দেখছে। চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। এই পরিস্থিতিতে একটা মেয়ে কাঁদবে না কেনো! সামিন ইয়াসার তো আলোকে কাঁদতে দেখতে চায়, কাঁদতে কাঁদতে আলো সামিন ইয়াসারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করবে এটাই তো চায় সামিন ইয়াসার। কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়,আলো কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,"ঠিকাছে। আমি মাফ চাইবো। তবে দয়া করে আমার ভাইদের এখানে আনবেন না। ওরা দেখলে কষ্ট পাবে।"
জামিল বলে,"ঠিকাছে। মেয়ে মানুষ তাই অনুরোধ টা রাখলাম , এখন মাফ চান।"
আলো সামিন ইয়াসারের চোখের দিকে একবার তাকিয়ে তার পায়ের কাছে মাথা নিচু করে বসে পরে, কাঁপা কাঁপা হাত দুটো বাড়িয়ে সামিন ইয়াসারের পা ছোঁয়। ইয়াসার এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। আলো নামের দেমাগী মেয়েটা তার পা ছুঁয়েছে অথচ তাতেও তার স্বস্তি হচ্ছে না, এই মেয়েটা ভেতরে ভেতরে যে ভাঙেনি তা ইয়াসার বুঝতে পারছে।"
"কি হলো,চুপ করে আছেন কেনো? মাফ চান!"
জামিলের কথায় আলো মাথা উঠিয়ে সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়,চোখে মুখে কাঠিন্যতা মেয়েটার অথচ তার ঘাবড়ে যাওয়ার কথা ছিলো। আলো ধীরে ধীরে বলে সে,"কি বলতে হবে?"
_বলুন যে, যা করেছি তার জন্য আমাকে মাফ করে দিন। আমি আমার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত, অনুতপ্ত, ব্যথিত।
আলো রোবটের মতো বলে,"যা করেছি তার জন্য আমাকে মাফ করে দিন। আমি আমার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত, অনুতপ্ত, ব্যথিত।"
জামিল বলতে থাকে,"আপনি অত্যন্ত ভালো মানুষ, আমি ক্ষমাপ্রার্থী।"
আলো বলে,"আপনি অত্যন্ত ভালো মানুষ,আমি ক্ষমাপ্রার্থী।"
_সামিন ইয়াসার জিন্দাবাদ
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"সামিন ইয়াসার জিন্দাবাদ।"
_হু,এখন উঠুন।
আলো উঠে দাঁড়ায়। ফুয়াদ আলোর দিকে তাকিয়ে আছে,মেয়েটিকে দেখে তার এখন খানিকটা মায়া হচ্ছে।
জামিল বলে,"এই মাফ চাওয়ার দৃশ্যটা চাইলে ভিডিও করে নেট দুনিয়ায় ছেড়ে দিতে পারতাম। আমার ভাইয়ের ইমেজ টা ঠিকঠাক হয়ে যেতো কিন্তু তা করলাম না,মেয়ে মানুষ বলে। আপনার বাবার আপনাকে বিয়ে দিতে ঝামেলা হবে । আমাদের জননেতা সামিন ভাই আবার এই এলাকার অসহায় মেয়েদের বিয়ের দায়িত্ব নেয়, সেখানে তার জন্য একটা মেয়ের ভবিষ্যতে বিয়ে দিতে ঝামেলা হোক,তা সে চায় না।"
আলো ইয়াসারের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন ইয়াসার এতক্ষনে নীরবতা ভেঙে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাহাতকে বলে,"ওর ভাইদের ব্যাগ দুটো দিয়ে দে।"
রাহাত দৌড়ে গিয়ে দুটো ব্যাগ এবং আজান আয়াতকে নিয়ে আসে। সামিন ইয়াসার বলে,"ছবিগুলো ওকে দিয়ে ডিলিট করা।"
জামিল সামিন ইয়াসারের ফোন আলোর হাতে দিয়ে বলে,"নিন ডিলিট করুন।"
আলো ছবিগুলো ডিলিট করে ফোন দিয়ে দেয়। তারপর আজান আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে,"চল।"
ওরা তিনজন ঘুরে দাঁড়িয়ে দুই কদম ফেলতেই সামিন ইয়াসার বলে ওঠে,"মেয়ে মানুষের স্বভাবে সবকিছুই থাকতে হয়,তেজ ছাড়া। ওটা বাড়তি। বিপদজনক খুব।"
আলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য দাড়িয়ে পরে। কিন্তু সে ঘুরে তাকায় না। আয়াত আর আজানের হাত ধরে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে।
ফুয়াদ সামিন ইয়াসারের দিকে চায়,"হয়েছে? খুশি এবার? কিসব জেদ যে তোর মাথায় চাপে বুঝি না। তোর মতো মাথা ভাঙার সাথে বন্ধুত্ব করে আমার হয়েছে যত জ্বালা। কিরে,বল এখন। শান্তি পেয়েছিস?"
_না।
একশব্দে সামিন ইয়াসার উত্তর দেয়।
_না মানে? মেয়েটা তোর পা ধরলো তবুও শান্তি পাসনি?
সামিন ইয়াসার ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,"ওর চোখ দেখেছিস তুই? বিন্দুমাত্র আতঙ্কিত হয়নি ওই চোখ দুটো। ও সামিন ইয়াসারকে ভয় পায়নি ফুয়াদ। পা ধরতে হবে বলে ধরেছে, ভয় পায়নি এই ইয়াসারকে। আমি তো ওর চোখে ভয় দেখতে চেয়েছি।"
ফুয়াদের মুখ হা হয়ে যায়। হতভম্ব ভাব নিয়ে বলে,"তুই কি শুরু করলি একটু বলতো।"
_কিছুইনা।
তারপর জামিলের দিকে তাকিয়ে বলে,"ওকে নজরে নজরে রাখবি। ওকে আমার চাই । ও ক্ষমতার কথা বললো না তখন? ওকে একটু একটু করে আমার ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা দেবো আমি।"
জামিল মাথা নাড়ায়। তাকে কিছুটা বিচলিত লাগছে ,রাজনীতি ছেড়ে ভাই এখন এসব করতে শুরু করলে মারা পরতে আর টাইম লাগবে না!
রাহাত ইয়াবার প্যাকেটটা নাড়িয়ে দেখছিলো। হঠাৎ করে বলে ওঠে,"ভাই এটা তো ইয়াবা না। এগুলো তো নকল।"
সামিন ইয়াসার শুকনো হাসি হাসে। পাশ থেকে সবুজ বলে ওঠে,"ওই শালা! নকলই তো থাকবে। সামিন ইয়াসার কি ইয়াবার ডিলার নাকি যে যখন তখন আসল ইয়াবা এনে দিবে?"
হাসির মৃদু গুঞ্জন শোনা যায় ওদের মাঝে। আজ ওই মেয়েটাকে বোকা বানিয়ে কার্যসিদ্ধি করেছে সবাই। খুবই মজা পেয়েছে ছোটোখাটো এই এ্যাডভেঞ্চারটি করতে পেরে তারা।
***
রিকশায় তিনজন চাপাচাপি করে বসে আছে তারা। আলো পার্স ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সময় দেখে। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। ফোনটা ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে আয়াত আর আজানের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"বাড়িতে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে,কিছু খেয়ে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় পড়তে বসবি দুজন। ভুলে যাবি গত তিন ঘন্টায় কি কি হয়েছে। আমি তোদের বাড়িতে দিয়ে এসে আব্বুর কাছে যাবো। হাসপাতালে গিয়ে আম্মুকে পাঠিয়ে দেবো। আম্মু যেন কিছু টের না পায়। ঠিকাছে?"
আজান আর আয়াত মাথা নাড়ায়। আলো বলে,"অনেক বড় হয়ে গিয়েছিস দুজনে। এখন একটু সাহসী হ, সব সময় আমি আর আব্বু থাকবো না।"
আয়াত আজান কিছু বলে না। রিকশা তাদের বাসার সামনে এসে থামে। আলো নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হনহন করে দরজার সামনে গিয়ে কলিং বেল চাপে। কাজের মেয়েটা এসে দরজা খুলে দিতেই আলো দ্রুত ভেতরে ঢুকে নিজের ঘরের দিকে যায়। আতাউর আলমের পঁচাত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধা মা আলেয়া বেগম নিজের ঘর থেকে আলোর অস্তিত্ব টের পেয়ে রিনরিনে গলায় ডাকে,"ওও আলো,তুই আইছিস? তোর বাপ কখন আইবো? আরে ও আলো,কথা কস না ক্যান।"
আলো কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে ধপ করে দরজা লাগিয়ে দেয়। এক ঝটকায় হাতের পার্স টা বিছানার উপরে ছুঁড়ে মেরে ওয়াশ রুমে ঢুকে যায় সে। কল ছেড়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে সে তার দু হাতের দিকে তাকায়। আজ এই হাত একটা জঘন্য লোকের পা ছুঁয়েছে, ঘেন্নায় আলোর গা গুলিয়ে আসে। সে সাবান লাগিয়ে হাত দুটো ডলতে থাকে। দীর্ঘ সময় কেটে যায়, ডলতে ডলতে আলো হাত দুটো লাল বানিয়ে ফেলেছে। বিছানার উপরে পার্স ব্যাগের ভেতরে আলোর ফোন বেজে যাচ্ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার,সে হাত ধুতে ভীষণ ব্যস্ত। তার এখন ইচ্ছে করছে এক স্তর চামড়া ছিলে ফেলতে হাতের। আরো কিছু সময় পরে আলো হাত ধুয়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়। ফোনটা তখনও বাজছে। তোয়ালে দিয়ে হাতে মুছে পার্স খুলে ফোনটা হাতে নেয় সে। ফোনের স্ক্রিনে তার ইশমামের নাম্বার দেখে অস্বস্তিতে পরে যায় আলো। এই মুহূর্তে ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করে না আলোর। কিন্তু ইশমাম শত ব্যস্ততার মাঝেও একটু সময় বের করে দিনের ভেতর আলোর সাথে কথা বলার জন্য। আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে ব্যাকুল কন্ঠে ইশমাম বলে ওঠে,"কোথায় ছিলে!"
আলো নিচু স্বরে বলে,"ওয়াশ রুমে।"
_আমি গত এক ঘন্টা ধরে ফোন দিয়ে যাচ্ছি। এক ঘন্টা ওয়াশ রুমে ছিলে?
আলো চুপ করে আছে। ইশমাম বলে,"ভেবেছি আংকেল হয়তোবা অসুস্থ হয়ে পরেছে।"
_নাহ। আব্বু ঠিক আছে।
ইশমাম আদর মাখা কন্ঠে বলে ওঠে,"খুব স্ট্রেস যাচ্ছে তাই না?"
আলো বলে,"এই আর কি!"
_আচ্ছা ঐ ঝামেলাটার কি হলো? মির্জারা তোমাকে কিছু বলেছিলো তারপর?
আলোর হঠাৎ চোখ দুটো ভিজে ওঠে। গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে আসছে। তার ইচ্ছে করছে ইশমামের সাথে যন্ত্রনাটা শেয়ার করতে, কিন্তু এটা করা যাবে না। ইশমাম শুধু শুধু চিন্তা করবে।
ইশমাম বলে,"তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আলো। ভিডিও কল দেই?"
_না। আমার খুব মাথা ব্যথা করছে। পরে।
ইশমাম চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ দুপাশের দু'জনেই চুপ করে থাকে। তারপর নীরবতা ভেঙে আলো বলে ওঠে,"দেশে ফিরছো কবে তুমি? কবে দেখা হবে আমাদের? তোমার পরিবারকে সব জানাবে কবে? আমাকে কেনো তোমার পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দাও না? আচ্ছা ইশমাম একটা কথা বলো তো, তুমি আমার সাথে টাইম পাস করছো না তো?"
ইশমাম ধমকের সুরে বলে,"অদ্রিতা।"
_তাহলে তোমার পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বললে তুমি চুপ করে থাকো কেনো? যেনো কোনো আগ্রহ নেই তোমার।
চেঁচিয়ে বলতে থাকে আলো।
ইশমাম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"মাথা ঠান্ডা করো। দেবো। সময় হলেই দেবো।"
"কতবার করে বলেছি ছেলেটাকে ধমকাবে না,কথা কি কানে যায়না? গণ্ডারের চামড়া নাকি তোমার গায়ে?"
ভাতের লোকমাটা ইহানের মুখের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে প্লেটে রেখে রিতু নিচু স্বরে বলে,"জোর না করলে খেতেই চায়না একেবারে।"
ইলহাম চোখ রাঙানি দিয়ে বলে,"জোর করতে হবে না। মির্জা বাড়ির ছেলেদের ওপরে জোর চলে না। তারা তাদের ইচ্ছা মর্জির মালিক। আমার ছেলের যখন মন চাইবে তখন খাবে।"
তারপর ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,"তুমি যাও বাবা। দাদার ঘরে গিয়ে খেলো।"
বাবার আস্কারা পেয়ে ইহানের ঠোঁটজোড়া প্রশস্ত হয়ে যায় হাসিতে। একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রিতু খাবারের প্লেট নিয়ে বসে আছে। ইলহাম কিছুক্ষণ রিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"হাত ধুয়ে দরজা টা বন্ধ করে আসো।"
রিতু চমকে উঠে ইলহামের দিকে তাকায়। ইলহাম নিচু স্বরে বলে,"শাড়িটা পাল্টে এসো। এই রঙটা আমার পছন্দ নয়।"
হঠাৎ করে রিতুর বুকে সুক্ষ্ম যন্ত্রনা হতে শুরু করে। একেই বোধহয় বলে পুরুষ মানুষ। নিজের প্রয়োজনের সময় এরা ঠিকই নমনীয় হয়ে কথা বলে। রিতুর মনে হচ্ছে তার জন্মই হয়েছে কারো বৌ নামের যৌন দাসী হয়ে থাকার জন্য। কারো অর্ধাঙ্গিনী হয়ে সম্মানিত হওয়ার জন্য রিতুর মতো হার হাভাতে মেয়েদের জন্ম হয়নি।
"কি হলো,বসে আছো কেনো। আমাকে ভাইয়ার সাথে পার্টি অফিসে যেতে হবে সন্ধ্যায়। তাড়াতাড়ি।"
রিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হাত ধুয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে আলমারি থেকে একটা নীল রঙের পাতলা জরজেটের শাড়ি বের করে ওয়াশ রুমে ঢুকে পরে নেয়। ধীর পায়ে স্বামীর পাশে এসে বসতেই হ্যাচকা টান মেরে তাকে নিজের কাছে নিয়ে নেয় ইলহাম। ঘোর লাগা কন্ঠে বলে ওঠে,"আজকাল খুব বার বেরেছো না তুমি? মা মারা যাওয়ার পরে পুরো সংসারের চাবি পেয়ে গিয়ে নিজেকে অনেক কিছু ভাবতে শুরু করেছো? স্বামী কাছে ডাকলে গায়ে লাগে না!"
রিতু শ্বাস নিতে পারছে না। তার বুকের যন্ত্রনাটা বেড়েই যাচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কিন্তু এই মুহূর্তে চোখে পানি দেখলে ইলহাম আরো রেগে যাবে। রিতু গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,"ভুল ভাবছেন।"
ইলহাম কোনো কথা বলে না। নিজের স্বামী হওয়ার হক আদায় করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। রিতু দুচোখ বন্ধ করে অনুভূতি শূন্য হয়ে পরে থাকে।
দীর্ঘসময় পরে ইলহাম সেই চিরাচরিত ধমকের সুরে বলে,"তোমার বাবা ফোন করেছিলো। কাল বাড়িতে আসবে। ফোন করে বলে দিও যেন ভালো জামাকাপড় পরে আসে। আচ্ছা ওনার কি ভালো জামাকাপড় নেই? মাসে মাসে তো টাকা পয়সা ভালোই পাঠাও ও বাড়িতে। কিনে নিতে পারে না? ফকিন্নির মতো ঘুরে বেড়ায়।"
রিতু নিস্তেজ কন্ঠে বলে,"ফকিন্নির মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন কেনো তবে?"
ইলহাম কপাল কুঁচকে বলে,"মুখে মুখে কথা তো ভালোই চালাতে শিখে গিয়েছো। এতো সাহস পাচ্ছো কোথায়?"
রিতু চুপ হয়ে যায়। দীর্ঘসময় কেউ কোনো কথা বলে না, তারপর রিতু মৃদু স্বরে বলে ওঠে,"মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আপনার বৌ না হয়ে আপনার ঐ সব রক্ষিতাদের মতো কেউ হলেই ভালো হতো। আপনার থেকে অন্তত একটু মিষ্টি কথা তো শুনতে পারতাম!"
***
"আতাউর আলম তো সুস্থ হয়ে উঠছে। মনে হয়না সে তার সিদ্ধান্ত থেকে সে সরে দাঁড়াবে। তোমার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু বেড়ে গিয়েছে এবং জনগণের কাছে তার অবস্থান কিন্তু বেশ শক্ত পোক্ত!"
সামিন বাবার কথায় হালকা হেসে বলে,"ভালোই তো! তা না হলে নির্বাচনের মজা টা কোথায়?"
_মানুষ তোমাকে ছাত্রনেতা হিসেবে গ্রহণ করেছে, কিন্তু এই শহরের মেয়র হিসেবে আতাউর আলমের মতো একজন বয়স্ক,জ্ঞানী এবং সাদাসিধে ব্যক্তিকে রেখে তোমার হাতে শহরের দায়িত্ব তুলে দেবে বলে আমার মনে হচ্ছে না! আমি সন্দিহান।
সামিন ইয়াসারের কলম থেমে যায় বাবার কথায়। সে কিছু পেপার্সে সাইন করছিলো।
ইমতিয়াজ মির্জা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"বলছি রাজনীতি টা একটু মন দিয়ে কর। তারপর একটু সময় গেলে,সরাসরি এমপি পদের জন্য লড়বি।"
_তুমি কি ভয় পাচ্ছো?
ছেলের সরাসরি প্রশ্নে আমতা আমতা করে ইমতিয়াজ মির্জা বলে,"সাতবছর আগে তোর মেজো ভাইয়ের অপকর্মের দাম আমি এমপি পদ খুইয়ে দিয়েছি। মানুষ জনের কাছে বর্তমানে আমার গ্রহণযোগ্যতা কতখানি তা তো নিশ্চিত না। তার উপরে সেদিনের সেই ভাইরাল ভিডিও। টাকা দিয়ে নিউজ চ্যানেল গুলোকে সামলে নিয়েছি। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে এখনো কথা হচ্ছে। তোকে সবাই ভয় পায় তাই হয়তো সামনে কিছু বলছে না।"
_সেটাই। এই ভয়টাই আমার দরকার।
তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে,"আতাউর আলম সাদাসিধে মানুষ। রাজনীতি সাদাসিধে মানুষ দিয়ে হয়না বাবা। এদের জন্য উপযুক্ত পেশা শিক্ষকতা। দীর্ঘজীবন সাংবাদিকতা করেছে,এই শহরে টিকতে পেরেছে এটাই অনেক।
ইমতিয়াজ মির্জা ছেলের সাহস এবং আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক হয়। সেও প্রচন্ড সাহসী ছিলো কিন্তু তার বড় ছেলে তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। যদি এই সাহসটা ভালো কাজে লাগাতে পারে তাহলে অনেক দূর যেতে পারবে।
সামিন ইয়াসার বলে,"নির্বাচনে হারার কথা ভেবে চিন্তা করো না,কারন জিতবো আমিই। সেটা যেভাবে হোক। "
_ঐ মেয়েটার ব্যাপারে কি করলি? বলেছি মামলা দিয়ে দে, ওর বাবাকেও একটু দমিয়ে রাখা যাবে।
_ওটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার। তুমি ওটা নিয়েও ভেবো না।
_ভীষণ সাহস মেয়েটির। বাবার জন্য সন্দেহের বশে,কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করেই সামিন ইয়াসারের গাঁয়ে হাত তোলে। আতাউর অনেক লাকি, এমন একটা মেয়ে পেয়েছে।
_তুমি মেয়েটার প্রশংসা করছো নাকি আমাকে অপমান করতে চাইছো বাবা?
_কোনোটিই না।
হঠাৎ করে সামিন ইয়াসারের ফোন বেজে ওঠে। ফোনের দিকে তাকিয়ে সে খুশি হয়। ইমতিয়াজ মির্জার দিকে তাকিয়ে বলে,"ছোটো ফোন করেছে।"
_কথা বলো। জিজ্ঞেস করো কবে ফিরবে দেশে। বাড়ির ব্যাবসা ইলহাম একা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এতটুকু দায়িত্ব তো নিতে বলো।
সামিন ইয়াসার ফোন কানে তুলে নিয়ে বলে,"বল ভাই।"
ওপাশ থেকে কেউ বলে ওঠে,"ভাইয়া।"
_হ্যা বল ভাই। ঠিক আছিস তুই?
_ঠিক আছি। ভাইয়া একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
_কি কথা? বল।
_ওই ঝামেলাটার কি হলো? তুমি মেয়েটিকে কিছু বলেছো পরে?
সামিন কিছুটা অবাক হয়ে বলে,"সব কথা রেখে ওই কথা জিজ্ঞেস করছিস কেনো?"
_না মানে,আমি চাইনা তুমি কোনো ঝামেলায় জড়াও। তাই আর কি।
সামিন শুকনো হাসি হেসে ভাইকে আশ্বস্ত করে বলে,"আরে ধূর। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করবো নাকি আমি। আমি এখন আমার ইলেকশন নিয়ে ভাবছি। মনোনয়ন পেয়ে গেছি দল থেকে !"
_অভিনন্দন ভাইয়া।
ম্লান হেসে বলে ওপাশের ব্যক্তি। সামিন বলে,"তুই ফিরে আয় ছোটো। বাবা আসতে বলছে তোকে। বাড়ির ব্যবসা সামলাবি। এখানে এলে তোকে বিয়ে করিয়ে দেবো আগে। বিদেশী বৌ নিয়ে আসিস না সাথে করে খবরদার।"
ওপাশের ব্যক্তি হেসে বলে," আর তুমি কবে করছো?"
সামিন,"তুই বিয়ে করে রিভিউ দিবি। তারপর।"
দুইভাই ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে। তারপর ফোন রেখে পুনরায় নিজের কাজে মন দেয় সামিন ইয়াসার।
***
আতাউর আলমকে গতকাল বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। তার আগমন উপলক্ষে বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের ঢল নেমেছে। দূর দূরান্ত থেকে সবাই উড়ে উড়ে আসছে। রেহেনা রান্নাঘরে চায়ের পানি বসিয়ে কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, কিন্তু রাগটা প্রকাশ করতে পারছে না সে। এই নেমক হারাম গুলোর জন্য দফায় দফায় চা বানিয়ে সে ক্লান্ত। অসুস্থ মানুষকে দেখতে এসেছে নাকি দাওয়াত খেতে এসে তা এরাই ভালো জানে। আতাউর আলমের ঘর থেকে নাটকের সংলাপ শোনা যাচ্ছে। অভিনয় করছে আতাউর আলমের চাচাতো ভাই। ভাইয়ের প্রতি দরদ যেনো উথলে উঠেছে এখন। অথচ দূর্ঘটনার দিন আলো গিয়ে এতো করে বললো তার সাথে থানায় যেতে, থানায় সাধারণ ডায়েরী করবে সে,তখন গর্তে লুকিয়ে ছিলো সরীসৃপ টা।
রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় আলোদের গৃহপরিচারিকা সীমা। রেহেনা চুলা থেকে চায়ের পাতিল নামিয়ে বলে,"উঠেছে আলো? গিয়ে বল চা খেতে ডেকেছি।"
_আপা তো বাড়িতে নেই খালা। কোথাও গিয়েছে।
রেহেনা অবাক হয়ে তাকায়। এই সাত সকালে কোথায় গিয়েছে মেয়েটা না খেয়ে !
গলির মোড়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। পরনে তার সাদা এবং নীল রঙ মিশ্রিত প্রিন্টের সালোয়ার কামিজ। হাত উঠিয়ে বারবার হাত ঘড়িতে সময় দেখছে সে। এ কদিনের ধকলে চোখের নিচে কালি জমে গিয়েছে। কিন্তু গাঁয়ের ওই উজ্জ্বল শ্যামলা ধরনের রঙের সাথে চোখের নিচের কালি বেশ মানিয়েছে। খুব একটা অদ্ভুত লাগছে না। আলো এবার বেশ বিরক্ত হয়। আধাঘণ্টা ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে অথচ কোনো খালি রিকশা খুঁজে পাচ্ছে না সে। দীর্ঘ সময় পরে একটা রিকশা পেয়ে গেলে সে উঠে পরে রিকশায়। আজ আলোর বাবা আতাউর আলমের জন্মদিন। বাবাকে সারপ্রাইজ দিতে তার জন্য অল্প কিছু আয়োজন করবে আলো, সকাল সকাল সেজন্যই বের হয়েছে সে।
কিছুদূর যেতেই রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে দেয়। কাছে কোথাও থেকে মাইকের আওয়াজ আসছে। আলো বিরক্ত হয়ে বলে,"কি হয়েছে ভাই?"
_আপা সামনের রাস্তায় জ্যাম। আইজ এইখানে সমাবেশ। পার্কের সামনের রাস্তা পুরাডা আটকা। বিরক্তিতে আলোর মুখ তেতো হয়ে যায়। ডানপাশে একটা এ্যাম্বুলেন্স তাদের মতো আটকা পরেছে। এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার বাইরে নেমে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে।
আলোর বেশ খারাপ লাগছে। নিশ্চয়ই রোগীটি পরে পরে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। সামনে নির্বাচন আর এখন সব রাজনৈতিক দল রাস্তাগুলোকে নিজেদের বাপের সম্পত্তি মনে করে আটকে রেখে ঘেউ ঘেউ করতে থাকবে। আলোর বাবা এই শহরের মেয়র হলে সে শহরের ভোল পালটে ফেলবে,আলো নিশ্চিত।
কয়েক মুহূর্ত পরে একটি গাড়ি এসে তাদের সামনে থামে। রিকশাওয়ালা অতি উৎসাহী হয়ে বলে,"ইয়াসার ভাই আসছে আপা। আইজ এইখানে ভাষণ দিবো।"
আলোর মেজাজ বিগড়ে যায়। রাস্তা আটকে মাফিয়াগিরি করা একমাত্র ইয়াসার মির্জার পক্ষেই সম্ভব। কোনো কিছু না ভেবেই আলো রিকশা থেকে নেমে পরে। ইয়াসার মির্জার দলের একটা ছেলে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিতেই সে বাইরে নেমে দাঁড়ায়। আলো বাতাসের গতিতে ইয়াসার মির্জার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। সকাল সকাল অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আলো নামের মেয়েটিকে নিজের মুখোমুখি আবিষ্কার করে ইয়াসারের চোয়াল লম্বা হয়ে যায়। সে কিছুটা অবাক হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী একজন শ্যামবতীর দিকে তাকিয়ে আছে।
"কি হচ্ছে এখানে? রাস্তাটাকে নিজেদের সম্পত্তি মনে করছেন নাকি?"
আলোর ধমকে ইয়াসারের ঘোর কাটে। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরে সে প্রচন্ড বিরক্ত হয়। সেই ফাজিল মেয়েটা সব সময় এভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসছে তার কাজে বাধা দিতে। সেদিন পা ধরেও একটু ভয় ঢোকেনি মনে, আবার চেঁচিয়ে কথা বলছে ইয়াসারের সাথে!
ইয়াসার আলোকে কিছু না বলে জামিলের দিকে তাকায়, জামিল বলে,"এই যে আপা! আপনার সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে একটু বলবেন?"
_সমস্যা কোথায় হচ্ছে মানে? রাস্তা ব্লক করে জনগণের ভোগান্তির ব্যবস্থা করে বলছেন সমস্যা কোথায় হচ্ছে?
ইয়াসারের পেছনে দাঁড়িয়ে রাহাত ফুয়াদকে বলে,"দেখছেন ভাই? এই মেয়ে ভাঙে তবু মচকায় না। সেদিনের পা ধরার কথা বেমালুম ভুলে গেছে।"
ইয়াসার আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,"ভোগান্তি কোথায় হচ্ছে? বড় গাড়ি গুলো তো চলে যাচ্ছে একটার পর একটা। রিকশা গুলোকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না,আর হবেও না। হাই-ওয়েতে রিকশা ওঠার নিষেধাজ্ঞা আছে,তা কি জানেন না আপনি? বিশিষ্ট জ্ঞানী, সুনাগরিক ভোটার!"
ইয়াসারের কটাক্ষ শুনে আশেপাশে তার ছেলেগুলো হো হো করে হাসতে থাকে। আরাফ নামের ছেলেটা ইয়াসারকে বলে,"বেডি মানুষ ভাই! ব্রেইনের ওজন কয়েক গ্রাম কম আছে।"
আলো ক্ষেপে গিয়ে বলে,"তাহলে এই এ্যাম্বুলেন্সটা এখানে আটকা পরে আছে কেনো? জবাব দিন।"
এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার আলোর চেঁচামেচি শুনে কান থেকে ফোন নামিয়ে সেদিকে যায়। এ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগীর পরিবারের একজন লোক নেমে আসে। আলোকে উদ্দেশ্য করে বলে ,"ম্যাডাম আমাদের আটকে রাখেনি। এ্যাম্বুলেন্স টা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অন্য একটা এ্যাম্বুলেন্স আসছে,একটু সময় লাগবে।"
আলো সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়। সামিন ইয়াসার কটমট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলোর দিকে তার রাগী দৃষ্টি রেখেই রোগীর পরিবারের লোককে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,"কতক্ষন লাগবে?"
লোকটি কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,"আধাঘণ্টা তো লাগবেই। আমার বৌটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। প্রেগন্যান্ট সে।"
সামিন ইয়াসার রাহাতকে বলে,"রাহাত। গাড়ি ঘোরা। ওনার ওয়াইফকে হাসপাতালে নিয়ে যা।"
রাহাত এক মুহুর্ত চিন্তা না করে মাথা নাড়িয়ে গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয়। গর্ভবতী মহিলার স্বামী এবং অন্যান্যরা ধরাধরি করে রোগীকে সামিন ইয়াসারের গাড়িতে বসায়। যন্ত্রনায় ভীষণ কাতরাচ্ছে মহিলাটি।
আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন ইয়াসারের দিকে কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে গর্ভবতী মহিলার স্বামী গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি চলতে শুরু করে।
সামিন ইয়াসার কয়েক মুহূর্ত আলোকে দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"তুমি একটা ফটকা চালাক মেয়ে।"
আলো চুপ করে থাকে। হঠাৎ করে বলে,"পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার চমৎকার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন,খুব ভালো নাটক দেখালেন আজ। আপনার মতো একটা গিরগিটির নতুন একটা দয়ালু রূপ আবিষ্কার করে আমি একটুও অবাক হইনি। এই রূপ ক্ষণে ক্ষণে বদলায়,বদলাবে। আবার কোনো গরীবকে ধরে লাথি মারবেন, অথবা কোনো মেয়ের ওড়না ধরে টান দেবেন। আপনাদের ফ্যামিলি হিস্ট্রি তো তাই বলে।"
আলো রিকশাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাস্তার ডান পাশে চাপা গলির রাস্তায় ঢুকে পরে।
সামিন ইয়াসার কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। ফুয়াদ পেছন থেকে বলে,"তুই বুনো ওল হলে ও তো দেখছি বাঘা তেঁতুল।"
_না, ও একটা মেয়ে। শুধু আর শুধু মাত্র একটা মেয়ে। দুর্বল প্রজাতির প্রাণী। এবং এটা ওকে বুঝতে হবে। আমি বোঝাবো।
সামিন ইয়াসার দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠে।
***
"ফজিলাতুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ!"
_জ্বি ভাই।
সামিন ইয়াসার নড়েচড়ে বসে,নিমন্ত্রণ পত্রটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে।
_আপনাকে অতিথি হিসেবে যেতে হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
_নিষেধ করে দে। আমি পারবো না,কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি খুব। বারবার মিছিল, মিটিং করতে হচ্ছে এখন এসব অনুষ্ঠানে গিয়ে মেয়েদের নৃত্য দেখার সময় নেই।
কথাটি বলে সামিন নিমন্ত্রণ পত্রটির একটা লেখার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
জামিল মাথা নাড়িয়ে বলে,"ঠিকাছে ভাই। আমি ফোনে জানিয়ে দিচ্ছি।"
"ওয়েট।"
জামিল দাঁড়িয়ে পরে সামিনের কথা শুনে। সামিন নিমন্ত্রণ পত্র থেকে চোখ তুলে জামিলের দিকে তাকিয়ে বলে,"এই কলেজে তো ওই মেয়েটাও পড়ে তাই না?"
_কোন মেয়েটা?
জামিল কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলে,"ওও ওই ফটকা মেয়ে আলো? হ্যা,ও এই কলেজেই পড়ে।"
_ওর নাম অদ্রিতা আলো না? ফোর্থ ইয়ার। ডিপার্টমেন্ট অব ইংলিশ?
_হু, কেনো ভাই?
সামিন নিমন্ত্রণ পত্র উঠিয়ে জামিলের দিকে তুলে বলে, স্বেচ্ছাসেবকদের লিস্টে ওর নাম। অনুষ্ঠান হোস্ট করবে সে এবার।
_তো?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জামিল ইয়াসারের দিকে তাকায়।
_প্রিন্সিপালকে বল আমি যাবো।
সামিন ইয়াসার নিমন্ত্রণ পত্রটির দিকে তাকিয়ে বলে।
জামিল খানিকটা অবাক হয়ে তাকায়। ইয়াসার তার দিকে তাকিয়ে বলে,"ওর আমার ক্ষমতা দেখার খুব শখ। ওকে একটু দেখিয়ে আসবো। কি বলিস?"
#নোটবার্তা: গল্পের প্রত্যেকটা চরিত্র কাল্পনিক,প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠান,প্রত্যেকটি স্থান এবং রাজনৈতিক দলের নামও কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে এর কোনো মিল নেই। গল্পটিকে শুধুমাত্র গল্প হিসেবেই গ্রহণ করবেন
#পর্বসংখ্যা_৫
চায়ের কাপে দ্বিতীয় বারের মতো চুমুক দিয়ে কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে শমশের ভুঁইয়া। কোন ফাঁকে একটা ক্ষুদ্রাকার মাছি এসে বসে আছে চায়ে। ঠিক বসে নয়, মরে পরে আছে। শমসের ভুঁইয়া তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে মাছিটাকে ঠেলে কাপ থেকে উঠিয়ে একটা টিস্যু পেপারের উপর রাখে। পুনরায় চায়ের কাপ উঠিয়ে মুখের কাছে নেয় চুমুক দেবে বলে। পাশে বসে শমশের ভুঁইয়ার কাণ্ড দেখছিলো তার একনিষ্ঠ কর্মী জায়েদ আলী, বাঁধা দিয়ে বলে,"করছেন কি? আরেক কাপ চা আনিয়ে দিচ্ছি। ওটা রাখুন।"
শমসের ভুঁইয়া জায়েদ আলীর কথা না শুনে চায়ের কাপে তৃতীয় চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখে। তার দৃষ্টি টিস্যু পেপারের উপরে রাখা মাছিটার দিকে। এক দৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে জায়েদ আলীকে বলে,"রাজনীতি হলো এই চায়ের কাপের অমৃত চা, তাতে দুয়েকটা মাছি এসে পরবে, স্বাভাবিক। তাই বলে চা টা খাবো না? আলবত খাবো। মাছি গুলোকে পরিষ্কার করে খাবো। যারা যারা রাজনীতি নামের অমৃত সুধা পান করতে চাইবে,তাদের মাছি পরিষ্কার করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।"
কথাটি বলেই শমশের ভুঁইয়া মুখ হাসি হাসি করে ফেলে। নিজের বলা কথাটি তার নিজেরই বেশ পছন্দ হয়। জায়েদ আলী বলে,"মাছি পরিষ্কার করার জন্য তো আপনাকে নোবেল দেওয়া উচিত। যেভাবে আতাউর আলম মাছিটাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছিলেন!"
_কি? আতাউর আলম মাছি? হা হা হা। বেশ ! বেশ বলেছো জায়েদ। ও তো একটা মাছিই।
জায়েদ আলী বলে,"পরিকল্পনা টা তো ভালোই করেছিলেন, ঠ্যাং ভেঙে ঘরে পরতে থাকতো। মেয়র হবার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত। কিন্তু বেঁচে গেলো কপালের জোরে।"
_হ্যা জায়েদ। ওর কপাল ওকে বারবার সাথ দেয়। কতবার যে বেঁচে গিয়েছে আমার হাত থেকে।
_তবে ভাই উপকারের মধ্যে একটা উপকার হয়েছে, আপনার নাম সামনে আসেনি। মাঝখান থেকে ফেঁসে গিয়েছে সামিন ইয়াসার। আতাউরের মেয়েটা চড় মেরে হুলুস্থুল কাণ্ড করে ফেলেছে দেখেননি। ভাবা যায়? কত সাহস এই মেয়ের। একেবারে বাবার কপি। একটা মামলা ঠুকে দিলেও বেশ হতো ! সময় মতো ওর কানে সামিন ইয়াসারের নামে বিষ ঢেলে কাজের কাজ হয়েছে।
_আতাউরকে যে গাড়িটা ধাক্কা দিয়েছে তার নাম্বার প্লেট দেখেনি তো কেউ?
_নাহ। সুযোগ ই ছিলো না দেখার। ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিলো, লোকজন তেমন ছিলো না।
_ওর মেয়েকে কিভাবে ম্যানেজ করেছিলি?
_আতাউর আলমের চাচাতো ভাই খোরশেদ কাজটা করেছে। তবে কিছু পয়সা খরচ করতে হয়েছে। শালা আস্ত দালাল,টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না।
তারপর জায়েদ আলী নিজের মুখটা শমশের ভুঁইয়ার কানের কাছে এগিয়ে এনে বলে,"বলতে বলেছি কিছুদিন আগে আতাউর আলম কিশোর গ্যাং-এর নামে যে আর্টিকেল লিখেছেন,সেটার জের ধরে সামিন ইয়াসার এসব করেছে।"
শমশের ভুঁইয়া পৈশাচিক হাসি হাসে। জায়েদ আলী বলতে থাকে,"মেয়েটা তেজী আর সাহসী হলেও মাথায় বুদ্ধি কম। অন্ধের মতো বিশ্বাস করে ইয়াসারকে চড় মেরে দিয়েছে। হিতে যে বিপরীত হতে পারে বুঝতে পারেনি।"
_ভিডিও করেছিলো কে?
_আমাদের দলের একটা ছেলে।
_আচ্ছা ইয়াসার এতো চুপচাপ আছে কেনো বলোতো? একটা মেয়ের হাতে চড় খাওয়ার পরে তো ওর তুলকালাম কাণ্ড বাঁধানোর কথা ! বিষয়টি বেশ অদ্ভুত লাগছে। যাই হোক ওরা যদি সাপে নেউলে হয়ে যায় তাহলে তো আমারই লাভ। মাঝখান থেকে মণিটা এই সাপুড়ে নিয়ে নেবে। সাপুড়ে শমশের ভুঁইয়া। হা হা হা।
***
আতাউর আলমের চোখ বেঁধে দিতে তার দিকে উদ্যত হচ্ছে আজান। পেছন থেকে আলো তার ভাইকে বলে ওঠে,"আরে ভীতুর ডিম তোকে আব্বুর চোখ বেঁধে ফেলতে বলেছি,কিডন্যাপ করে আনতে নয়। এতো পা টিপে টিপে এগোচ্ছিস কেনো? তাড়াতাড়ি যা।"
আজান আলোর তাগাদা পেয়ে দ্রুত গিয়ে আতাউর আলমের চোখ বেঁধে দেয়। আতাউর আলম চমকে উঠে বলে,"কি হচ্ছে!"
আলো হেসে দিয়ে বলে,"এক মিনিট আব্বু।"
তারপর দৌড়ে গিয়ে জন্মদিনের কেকটা নিয়ে এসে আতাউর আলমের বিছানার পাশে রাখে। সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে আতাউর আলমের চোখ খুলে দিয়ে আলো বলে,"ট্যান ট্যানা! সারপ্রাইজ!"
আজান আয়াত চেঁচিয়ে ওঠে,"শুভ জন্মদিন আব্বু। শুভ বায়ান্নতম জন্মদিন।"
আতাউর আলমের মুখে হাসি ফোটে তার ছেলে মেয়েদের পাগলামি দেখে। বাচ্চাদের মতো কন্ঠে বলে ওঠে,"করেছিস কি!"
আলো তার বাবার মাথায় একটা বার্থডে ক্যাপ তুলে দিয়ে আদুরে কিন্তু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,"শুভ জন্মদিন আমার জন্মদাতা পিতা। তুমি হাজার বছর বেঁচে থাকো। আমাদের আগলে রাখো।"
আতাউর আলম হেসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে। রেহেনা ঘরের পর্দা সরিয়ে অভিযোগের সুরে বলে,"হ্যারে! তোদের কি চক্ষুলজ্জা বলতে কিচ্ছু নেই? আমার থেকে টাকা নিয়ে কেক-ফেক আনিয়ে আমাকে আর দাদীকে রেখেই খাচ্ছিস! একবার তো মুখের বলাটাও বলতে পারতি!"
আলো লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। আয়াত বলে,"তোমাদের দুজনকে বলে কি লাভ? বললেই তো বলতে এইসব জন্মদিন পালন করা হারাম,হারাম।"
রেহেনা বেগম ঘরে ঢুকে আয়াতের কান মলে দিয়ে বলে,"এসব হারাম হালালের পার্থক্য যদি বুঝতি তাহলে শুধু শুক্রবার মসজিদে যেতি না জিলিপির লোভে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তি। আরেকটাকে দেখো, চুল খোলা রেখে বাইরে যায়। বেগানা পুরুষদের সব দেখিয়ে আসে। ফাজিল মেয়ে কোথাকার।"
কথাটি বলে আলোর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকায় রেহেনা।
আতাউর আলম তার স্ত্রীকে বলে,"রেহেনা তোমাকে বোধ হয় মা ডাকছে। যাও গিয়ে দেখো।"
রেহেনা বলে,"কই আমি তো শুনিনি।"
_আমি শুনেছি। যাও যাও, তারাতাড়ি যাও।
রেহেনা চিন্তিত মুখ নিয়ে শাশুড়ির ঘরের দিকে যায়। আজান বলে,"আধা ঘন্টায় থামানো যেতো না বাবা!"
আলো ছুড়ি এনে বাবার হাতে দিয়ে বলে,"নাও এবার কেক কাটো। আমার খুব খিদে পেয়েছে।"
আতাউর আলম হেসে আলোর হাত থেকে ছুড়িটা নিয়ে কেক কাটে, তারপর একে একে তার তিন ছেলেমেয়েকে কেক খাইয়ে দেয়।
***
আজ থেকে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে সামিন ইয়াসারের লোকজন। দুপুর পর্যন্ত দলের কর্মীদের নিয়ে শহরের তিনটা মহল্লায় চক্কর দিয়ে এসেছে। সূর্য্যের তাপটা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। সামিন ইয়াসারের কপাল বেয়ে টপটপ করে নোনা জল গড়িয়ে পরছে। পাঞ্জাবির বুক এবং পিঠের দিকটা ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছে। এসবের অভ্যাস তার আছে কিন্তু আজ একটু বেশিই কাহিল হয়ে পরেছে সে। বাড়ি থেকে ইশিতা বারবার ফোন দিচ্ছে। ফোনটা সাইলেন্ট করে পাঞ্জাবির পকেটে রাখতে রাখতে তার দলের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলে," কি? কি বুঝলি? জনগণের রেসপন্স কেমন?"
_ভাই এভাবে তো কিছু বোঝা যায়না। তবে আশি শতাংশ নিশ্চিত এরা আপনার দিকে ঝুঁকে আছে। আপনার মতো তরুণ জননেতাকে রেখে শমশের ভুঁইয়া আর ওই আতাউর আলমের মতো দুটো বুড়োকে কে ভোট দেবে?
সামিন ইয়াসার আরাফের কথাতে বেশ স্বস্তি পায়। একটা প্রশস্ত হাসি দিয়ে বলে,"আজ এখানেই থাকবে নাকি?"
জামিল বলে,"না ভাই। যতক্ষন শরীরে হাঁটার শক্তি থাকবে ততক্ষণ থামা যাবে না। কাল থেকে হয়তো আতাউর আলম নামবে তার লোকজন নিয়ে। এভাবে বসে থাকলে হবে না।"
_গুড। তুই আমার যোগ্য কর্মী জামিল। তোর ছেলে হলে তোকে একটা মটরসাইকেল দেবো।
"কিন্তু জামিল ভাইয়ের তো মেয়ে হবে।"
সবুজ কথাটি বলে ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইয়াসার বলে,"মেয়ে হলে ওর মেয়েকে স্বর্নের আংটি দেবো। ছেলে হলে মটরবাইক,মেয়ে হলে অলংকার।"
জামিল ইয়াসারের কথায় খুশি হয়। ইয়াসার একবার হাতঘড়িতে সময় দেখে বলে,"ঐ মেয়েটার আপডেট কি?"
সবাই ইয়াসারের কথা শুনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। রাহাত ফিসফিসিয়ে সবুজকে বলে,"ভাই দিনে যতবার ওই মেয়েটার নাম নেয় আমরা দিনে ততবার নিজেদের বৌয়ের কথাও ভাবি না।"
_হুস।
ঠোঁটে আঙুল দিয়ে রাহাতকে চুপ করিয়ে দেয় সবুজ। নিচু স্বরে বলে,"ভাইয়ের "চটকনা" খাওয়ার শখ হইছে? ওই মেয়েটার ওপর ভাই ভীষণ ক্ষ্যাপা। আমি ভাইকে আট বছর ধরে চিনি। এতো সহজে ভাই মেয়েটার পিছু ছাড়বে না।"
ইয়াসার গম্ভীর কন্ঠে বলে,"কি সমস্যা? মেয়ে মানুষের মতো গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করছিস কেনো? কি কথা হচ্ছে?"
সবুজ আর রাহাত দু'জনে মাথা নেড়ে বলে,"তেমন কিছু না। সাংসারিক কিছু আলাপ ভাই।"
_কি আলাপ? তেল লাগবে,নুন লাগবে,আটা লাগবে এসব? কতবার বলেছি এইসব স্ত্রীলোকের মামলায় জরাবি না। জীবনটা ভাজাভাজা করে দেবে। আমার মতো চিরকুমার থাকার শপথ নে। তখন শুনলি না।
জামিল কথার মাঝখানে বলে ওঠে,"ভাই মেয়েটাকে নির্বাচনের পরে দেখে নিলে হয়না? দেখার তো মেলা সময় পাবেন।"
_না। ওর খবরাখবর নিয়মিত আমি চাই। কথাটা দ্বিতীয়বার মনে করাতে চাই না আমি।
দলের ছেলে গুলো মাথা নাড়ায়। একজন মেয়র পদপ্রার্থী, বিশিষ্ট জননেতা হাত ধুয়ে একটা পাঁচ ফুটিয়া মেয়ের পেছনে পরে আছে সেটা মানতে ইয়াসারের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং কর্মীদের বেশ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ভাইয়ের কথা না শোনার মতো ভুল তারা করবে না। দলের সাধারণ সম্পাদকের পদটা যে সবার চাই!
***
মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে আলোর ঘুম কেটে যায়। পড়তে পড়তে কখন সে বইয়ের ভেতরে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পরেছিলো তা সে জানেনা। গত সপ্তাহে যত নির্ঘুম রাত সে কাটিয়েছে তার খেসারত তাকে এখন দিতে হচ্ছে। সামনে প্রথম ইনকোর্সের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে ডিপার্টমেন্ট। পড়াশোনার ভীষণ চাপ। মাথা তুলে তাকাতেই দেখে আতাউর আলম তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলো হাই তুলে বলে,"টের পাইনি আব্বু।"
আতাউর আলম একটা চেয়ার টেনে মেয়ের পাশে বসে। আলো সামনে খুলে রাখা বইটা বন্ধ করে বইয়ের সাড়িতে সাজিয়ে রেখে বলে,"কিছু বলতে এসেছিলে?"
আতাউর আলম নরম গলায় বলে,"সেদিন রাগের মাথায় অত বড় একটা পদক্ষেপ নিয়ে ফেললি আম্মু। আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।"
আলো একটা হাসি দিয়ে বলে,"তুমি ভয় পাচ্ছো? আতাউর আলম ভয় পাচ্ছে?"
_ঠিক ভয় না মা। তুই একটা মেয়ে। আর ওরা যা ভয়ংকর।
_ভয় পেও না। ভুলে যেও না তোমার মেয়ে কারাতে জানে। জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয়।
আতাউর আলম মেয়ের কথা শুনে হেসে ফেলে। হাসি থামিয়ে মেয়েকে বলে,"সব সময় গায়ের জোরে কাউকে বিপদে ফেলতে হয় না মা। বিপদে আরো অনেক ভাবে ফেলা যায়।"
আলো বাবার দিকে তাকায়। সত্যিই তো! সেদিন তো ইয়াসার তাকে গায়ের জোরে হেনস্থা করেনি। তার সাথে ছলনা করে তাকে দিয়ে পা ধরিয়েছে।
আতাউর আলম বলে,"সাত বছর আগে ওদের পরিবার নিয়ে যে আর্টিকেল টা বের করেছিলাম তার জন্য ওদের ডাউনফল শুরু হয়। ইয়াসারের মেজো ভাইটার নামে শ্লীলতাহানির মামলা হয়েছিলো। টাকা দিয়ে বিষয় টা ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছিলো ইমতিয়াজ মির্জা। গ্রাম থেকে একটা গরীব ঘরের মেয়েকে ধরে এনে ওর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় যাতে একটু শোধরায় ছেলেটা,শুধরেছে কিনা জানিনা তবে পলিটিক্স থেকে দূরে সরে গিয়েছে। এখন শুধু সামিন ইয়াসার একাই পলিটিক্সের সাথে যুক্ত। ওরা তিন ভাই এক বোন। ছোটোজনকে কখনো দেখিনি,শুনেছি বিদেশে পরে আছে। আমেরিকাতে।
ইমতিয়াজ মির্জার ছোটো ভাই নিজের ভাইয়ের নাম ব্যবহার করে পুরো শহরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে বেরাতো। আর্টিকেল টা বের হবার পরে জনগণ ভীষণ ক্ষেপে যায়। ফলশ্রুতিতে এমপি পদ হারিয়ে ঘরে বসে থাকে ইমতিয়াজ মির্জা। সবকিছুর সাথে আমি জড়িত ছিলাম। ওদের শত্রুও বলা যায়।
_জানি তো এসব কথা। আবার বলছো কেনো? আর তুমি চিন্তা করো না আমার জন্য। কিচ্ছু হবে না আমার। আচ্ছা ইমতিয়াজ মির্জার ছোটো ভাই এখন কোথায়?
_ইশতিয়াক? কোথায় আবার। পালিয়েছে কানাডা। আর দেশে ফেরেনি। এতো কিছুর পরে ইয়াসার মির্জাকে জনগণ কিভাবে গ্রহণ করে নিচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছি না।
_কেনো আবার? সবটাই তো টাকা আর জনগণের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। ছাত্রনেতা বলে কথা।
_হ্যা ঠিক বলেছিস। ওদের অনেক টাকা। রিয়েলস্টেটের বিজনেস থেকে প্রচুর উপার্জন হয়।
আলো কিছু বলবে তার আগে ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আলো অনায়াসেই বুঝতে পেরে যায় ফোনটা কে দিচ্ছে। একটা হাত বাড়িয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখে আলো। আতাউর আলম বলে,"কে ফোন দিয়েছে? কথা বল।"
_গ্রামীনফোনের অফিস থেকে। তুমি বলো।
_না,আর কি বলবো। কাল তো তোর কলেজে প্রোগ্রাম আছে। এখন ঘুমিয়ে পর। বেশি রাত জেগে পড়ার দরকার নেই। আমার কাছে সিজিপিএ ডাজ নট ম্যাটার এট অল!
আলো হেসে তার আব্বুকে শুভরাত্রি বলে। আতাউর আলম চলে যেতেই তড়িঘড়ি করে দরজা বন্ধ করে ফোন বের করে ইশমামকে ভিডিও কল দেয়। রিং বাজার সাথে সাথে ফোনটা রিসিভ করে রেখে দেয় ইশমাম। আলো লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,"মুখটা দেখাও প্লিজ। তোমার রুমের এসি দেখে কি করবো? আজ আমাদের বাসায় এসি নেই বলে শো অফ করছো নাকি?"
ইশমাম ফোনটা মুখের সামনে নেয়। অভিমানী গলায় বলে,"কোথায় ছিলে? এতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি।"
_আব্বু ছিলো পাশে।
_তো ? আব্বুকে বলতে পারতে না যে আব্বু তুমি যাও তোমার হবু জামাই ফোন দিচ্ছে,আমি কথা বলবো!
আলো হাসে। ইশমাম বলতে থাকে,"সবসময় আমাকে বলো। অথচ তুমি নিজেই তো তোমার পরিবারকে ভয় পাও। তাদের কেনো বলো না আমার কথা?"
আলো মাথা চুলকে বলে,"আম্মু জুতাপেটা করবে।"
_আচ্ছা জুতাপেটা হতে হবে না।
কিছুক্ষণ দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর আলো বলে,"আমার না তোমার চেহারাটা খুব কমন লাগে ইশমাম। কার সাথে যেন খুব মিল।"
ইশমাম মৃদু হেসে বলে,"হতেই পারে। পৃথিবীতে একই চেহারার সাতজন থাকে,জানো না?"
_একটা ব্যাপার বেশ হাস্যকর। আমাদের দুজনের সামনাসামনি কখনো দেখা হয়নি। ব্যাপার টা যুগ অনুযায়ী কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
_একটুও না। যে শুনবে সেই হাসবে। ভাববে আমরা কত বোকা।
_আচ্ছা তোমার বাবার কথা বলেছিলে টিচার। তো উনি কি রিটায়ার্ড করেছেন?
ইশমাম চুপ করে থাকে। তার গলায় কথা আটকে আটকে আসছে। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলে,"না।"
আলোকে কিছু বলতে না দিয়ে পুনরায় বলতে থাকে,"একটা কথা বলি অদ্রিতা?"
_হুম, বলো।
_নাহ কিছু না। আচ্ছা ঘুমাও এখন। কাল তো তোমার কলেজে প্রোগ্রাম হোস্ট করতে হবে। রাখছি। বাই!
ইশমাম ফোন কেটে দিলে আলো ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। অপরপাশে সুদূর ফ্লোরিডায় নিজের ডরমেটরিতে,ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে দুচোখ বন্ধ করে থাকে ইশমাম। অদ্রিতা আলো নামের মেয়েটির সাথে প্রথম পরিচয়ের দিনগুলো স্মৃতিচারণ করতে থাকে সে।
করোনা মহামারীর সময়ে একটা অনলাইন ফোরামে আয়োজিত একটা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তারা দুজনেই ছিলো প্রতিযোগী। বাংলাদেশী মেয়ে শুনেই খানিকটা কৌতুহলী হয়ে অদ্রিতা আলোর সাথে আলাপ চারিতায় জরিয়েছিলো ইশমাম। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলো সাংবাদিক আতাউর আলমের মেয়ে আলো। ততদিনে আলোর প্রতি তীব্র ভালোলাগার অনূভুতি, ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছিলো। ইশমাম বরাবর সবার কাছে নিজের পরিবার নিয়ে কথা কম বলে,নিজের বাবা-চাচাদের পরিচয় দিতে তার আত্মগ্লানি হয়। আলোর কাছে নিজের আসল পরিচয় দিতে গিয়েও দেয়না। সাংবাদিক আতাউর আলমের মেয়ে আর যাই করুক মির্জা বাড়ির ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাইবে না। এবং এটাই সত্যি,আলো মির্জাদের ঘৃণা করে, প্রচন্ড ঘৃনা করে।
যত দিন যাচ্ছে ইশমাম টের পাচ্ছে সে নিজেই নিজের মিথ্যে জালে আটকা পরছে। কি হবে সামনে? অদ্রিতা সবটা টের পেলে কি করবে? বড় ভাইয়াকে ইশমাম কিভাবে মানাবে? সবটা ভেবে ইশমামের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে ডিপার্টমেন্টের হেড প্রফেসর তৌফিকুল ইসলামের কক্ষে ঢুকে পরে আলো। তৌফিকুল ইসলাম পানির গ্লাস হাত থেকে নামিয়ে রেখে আলোর দিকে তাকায়।
"আলো? কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?"
আলো একটা ঢোক গিলে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে বলে,"স্যার অতিথি হিসেবে কে কে আসছে?"
_প্রধান অতিথি মাননীয় এমপি মহোদয় কবির আলমগীর, বিশেষ অতিথি জননেতা সামিন ইয়াসার, আইজি সাহেব, বয়েজ কলেজের প্রিন্সিপাল রয়েছে। এছাড়াও আরো অনেকে। কেনো?
আলো হতভম্ব হয়ে তৌফিকুল ইসলামের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সামিন ইয়াসার আসবে? তার মানে ওই জানোয়ার টাকে হোস্ট করতে হবে আলোর! কি সাংঘাতিক কথা। এর চেয়ে অপমান এবং অসম্মানের ব্যাপার আলোর জন্য কিছু হতে পারে না।
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে তৌফিকুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলে,"স্যার। আমি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে পারবো না।দুঃখিত।"
তৌফিকুল ইসলাম অবাক হয়ে যায়। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"মানে? আর বিশ মিনিটে অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে আর তুমি এখন এই কথা বলতে এসেছো? কি হচ্ছে কি এসব আলো?"
_স্যার।
আলো আমতা আমতা করতে থাকে।
তৌফিকুল ইসলাম বলে,"সামিন ইয়াসার কে নিয়ে সমস্যা? কিন্তু আলো ওটা তো তোমার পার্সোনাল প্রবলেম। কলেজের অনুষ্ঠানে কেনো ব্যাঘাত ঘটাতে চাইছো?"
আলো তার উত্তর না দিয়ে বলে,"স্যার সামিন ইয়াসার অতিথি হবার যোগ্য?"
_তার যোগ্যতা সম্পর্কে কতটুকু ধারণা আছে তোমার? তুমি জানো ও কত বড় মাপের একজন জননেতা?
_পুরোটাই ভণ্ডামি।
তৌফিকুল ইসলাম শীতল চোখে তাকায়, তারপর বলে,"যাও গিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করার প্রস্তুতি নাও। গলা ঠিক করো। ভলান্টিয়ারদের ডাকো। ফুলের তোড়া এসেছে?"
আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
তৌফিকুল ইসলাম ধমক দিয়ে বলে,"কথা শোনো আলো।"
_স্যার আগে কেনো জানানো হয়নি সামিন ইয়াসার আসবে?
তৌফিকুল ইসলাম রেগে গিয়ে বলে,"মানে? প্রিন্সিপাল কাকে অতিথি করবেন সেটা কি তোমাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে আলো?"
আলো ঘাবড়ে গিয়ে বলে,"না স্যার।"
_যাও আলো। বোকামি করো না। অলরেডি দুজন আসেনি ভলান্টিয়ার। অসুস্থ তারা। এখন তুমি এমন করলে প্রিন্সিপাল দারুন ক্ষেপে যাবে। যাও!
***
"এই চা-টা যে বানায়,মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তাকে নিজের বাড়িতে পারমানেন্ট চা বানানোর লোক হিসেবে নিয়োগ দেই। একেবারে বেহেস্তী চা।"
প্রিন্সিপাল শওকত হাসান কথাটি বলে চায়ে চুমুক দেয়। সামিন ইয়াসার নিজেও আগ্রহ নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,"তা বেহেস্তী চা কিভাবে বুঝলেন স্যার? বেহেস্তে কি আপনার নিয়মিত যাতায়াত হয়? আমাকেও একদিন সাথে করে নিয়ে যাবেন। ওখানে গিয়ে চা খেয়ে আসবো।"
শওকত হাসান হো হো করে হেসে ওঠে সামিন ইয়াসারের কথায়। সামিন ফোনের দিকে তাকায়। ইশমাম ফোন দিচ্ছে। সে প্রিন্সিপালের কক্ষে থাকা সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে,"এক্সকিউজ মি!"
তারপর ফোন নিয়ে বাইরে চলে আসে। তার কাছে এদের সাথে বেহুদা আলাপের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ইশমামের সাথে কথা বলা।
ফোনটা রিসিভ করতেই ইশমাম বলে,"ভাইয়া।"
_বল ছোটো।
_আজকের সেমিনার টা ক্যানসেল হয়েছে। হাতে প্রচুর ফ্রি টাইম। ভাবলাম তোমাকে ফোন দেই।
_ফ্রি টাইম তো গার্লফ্রেন্ড-কে ফোন দিয়ে কথা বল, সময়টাকে কাজে লাগা।
ইশমাম হেসে ফেলে ভাইয়ের কথায়। মনে মনে বলে,"আমার প্রেমিকার নাম জানতে পারলে আমাকে তুমি গুলি করে দেবে ভাইয়া।"
মুখে বলে,"কোথায় তুমি?"
_একটা প্রোগ্রামে এসেছি, অতিথি হয়ে।
_ওহহ আচ্ছা। তাহলে তো খুব ব্যস্ত।
_না। সবার আগে তুই। তুই বলতে থাক।
_না ভাইয়া। এখন রাখছি। আবার পরে ফোন দেবো। ঠিকাছে?
সামিন ইয়াসার হেসে বলে,"ঠিকাছে।"
আলো আতংকিত মুখ নিয়ে তৌফিকুল ইসলামের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। মেজাজ মাত্রাতিরিক্ত খারাপ হয়ে আছে। ধীরপায়ে হেটে কলাভবনের দিকে যেতে থাকে। কলেজের গেইট দিয়ে অতিথিদের গাড়ি এক এক করে ঢুকছে। আলো সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পায় সামিন ইয়াসারের লাল রঙের গাড়িটা পার্ক করা। তার মানে এসে গিয়েছে অসভ্য লোকটা। বিরক্তিতে আলোর মুখ তেতো হয়ে যায়। হঠাৎ করে তার ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ইশমামের নাম্বার দেখে সে কিছুটা অবাক হয়। এই সময়ে ইশমামের ব্যস্ত থাকার কথা । সে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ইশমাম বলে,"কি করছেন ম্যাডাম?"
_হাটছি। তুমি?
_আমি ফ্রি টাইমে আমার দুজন প্রিয় মানুষের সাথে কথা বলছি। একজনের সাথে কথা বলা শেষ করে আরেকজনকে ফোন দিলাম।
আলো অবাক হবার ভান করে বলে,"তাই? তা আপনার অন্য প্রিয় মানুষটি কে? যাকে আপনি আমাকে ফোন দেওয়ার আগে ফোন দিয়েছেন? সে কি আমার থেকেও দামী?"
_হুম কিছুটা।
_তোমার মা?
ইশমাম চুপ হয়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,"হু।"
আলো বলে,"আজ না সেমিনার ছিলো তোমার?"
_ক্যানসেল। হাতে অফুরন্ত সময় পরে আছে।
আলো হেসে বলে, "দুঃখিত জনাব। আপনার ফ্রি-টাইম টাকে নষ্ট করার জন্য। আমার অনুষ্ঠান এখন শুরু হবে। এখন তবে রাখি?
ইশমাম হেসে ফোন কেটে দেয়। আলো হাত দিয়ে কপালের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দ্রুতপায়ে হেটে কলাভবনের বিশালাকার কক্ষটিতে ঢুকে পরে। এদিক ওদিক না তাকিয়ে ভলান্টিয়ারদের কাছে গিয়ে তাদের ফুলের তোড়া এবং অতিথিদের জন্য ব্যাজ আনবার নির্দেশ দিয়ে নিজে মাইক্রোফোনের কাছে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে একটু একটু ঘামছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কমলা রঙের একটি জামদানি শাড়ি পরেছে আজ আলো। সাজের মধ্যে হালকা পাউডার লাগিয়েছিলো মুখে আজ। তা ঘামের সাথে গলে গলে নামছে মুখমণ্ডল থেকে। আলো চোখ তুলে একবার অতিথি আসনের দিকে তাকায়। কেউ এখনো এসে আসন গ্রহণ করেনি। নিশ্চয়ই প্রিন্সিপালের কক্ষে বসে জামাই আদর খাচ্ছে সবকটা।
দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়ে যায়। আলো মাইক্রোফোন অন করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনুষ্ঠানের আরম্ভ ঘোষণা করে দেয়। খেয়াল করলো তার গলা অস্বাভাবিক কাঁপছে। নিজের প্রতি নিজেই বেশ বিরক্ত হয় আলো। আসুক ঐ লোকটা,তাতে তার কি! ওই লোকটা বাঘ না ভাল্লুক যে তাকে ভয় পেতে হবে। তবে আলো ঠিক ভয় পাচ্ছে না। নিজের মুখে ঐ লোকটার নাম উচ্চারণ করতে হবে ভেবে এখন-ই অপমানিত বোধ করছে সে।
অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রতিযোগীরা সবাই এসে গিয়েছে। কলাভবনের বিশাল কক্ষ মানুষের পদচারণায় গমগম করছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রিন্সিপাল শওকত হাসান নিমন্ত্রিত সব অতিথিদের নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। সবাইকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসছে বিভিন্ন বিভাগের প্রফেসর-রা। আলো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। নিজেরা উচ্চশিক্ষিত প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তা হয়ে কতগুলো অর্ধশিক্ষিত নেতাশ্রেনীর মানুষকে তেল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কি অদ্ভুত শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে এই সমাজ। ক্ষমতা আছে তার মানে দুনিয়া তাকে তোয়াজ করে চলতে বাধ্য!
মাননীয় সংসদ সদস্য মহোদয় নিজের আসন গ্রহণ করে বসেছেন। ঠিক তার পাশের চেয়ারটিতে এসে বসে পরেছে সামিন ইয়াসার মির্জা। শুভ্র পাঞ্জাবি পরনে তার, পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রেখেছে, ক্লিন শেভ করেছে সে। আলো তার সবথেকে অপছন্দের মানুষটির মুখদর্শন করে চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। ইয়াসার মির্জার চারজন চামচা তার সাথেই এসেছে। এরা বডিগার্ডের মতো ইয়াসার মির্জাকে ঘিরে থাকে সবসময়। আলো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার হাতের কাগজটা একবার দেখে। লেখা আছে বিশিষ্ট সমাজসেবক এবং গণমানুষের নেতা সামিন ইয়াসার মির্জা। আলো লেখাটি পড়ে চোখ বড় বড় করে ফেলে,এখন তাকে ঐই অসভ্য মানুষটাকে "বিশিষ্ট" বলে সম্বোধন করতে হবে নাকি!
সামিন ইয়াসার আসন গ্রহণ করেই এদিকে ওদিকে তাকায়। তার দৃষ্টি কাউকে খুঁজছে। হঠাৎ করে স্টেজের এক কোণে দৃষ্টি যেতেই তার চোখ আটকে যায়। কিছুক্ষণ সে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। তার চিন্তাশক্তি কয়েক মুহূর্তের জন্য লোপ পেয়ে যায়। মাইক্রোফোনে হাত রেখে চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে যে তরুণী, এই তরুণী টিকে অন্যরকম লাগছে আজ। শাড়ি পরে আছে বলেই কি এমন লাগছে? সামিন চোখ ফেরাচ্ছে না। কমলা রঙ-টা সামিন ইয়াসারের বরাবর অপছন্দের একটি রঙ। এই রঙের শাড়িতে কোনো শ্যাম-তরুনীকে এতোটা মোহনীয় লাগতে পারে তা সামিনের জানা ছিলো না। স্পিকারের শব্দে সামিনের ঘোর কাটে। মুহুর্তে-ই কপাল কুঁচকে ফেলে সে। ওই অদ্রিতা আলো মেয়েটা তার দিকে তাকাচ্ছে না। সামিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। ইগনোর করে তো আজ বাঁচতে পারবে না। দেখা যাক কতদূর পারে চেষ্টা করে!
আলো মাইক্রোফোনের সামনে মুখ রেখে স্পষ্ট গলায় বলতে শুরু করে,"ইতিমধ্যে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়ে আসন গ্রহণ করেছেন সম্মানীয় সংসদ সদস্য মহোদয়,আমাদের আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। উপস্থিত আছেন বিশেষ অতিথি পুলিশ সুপার মহোদয়,শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা এবং উপস্থিত আছেন বিশিষ্ট সমাজসেবক......."
এই পর্যন্ত বলে আলো কয়েক মূহুর্ত থামে। সামিন ইয়াসার তার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিন্সিপাল শওকত হাসান আলোর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আলো চোখ মুখ শক্ত করে বলতে শুরু করে,"বিশিষ্ট সমাজসেবক ও গণমানুষের নেতা সামিন ইয়াসার মির্জা। সবাই করতালির মাধ্যমে ওনাদের অভ্যর্থনা জানাই।"
সবাই হাততালি দিতে শুরু করে। সামিন ইয়াসারের মুখে হাসি ফোটে আলো নামের মেয়েটির মুখে তার নামের আগে "বিশিষ্ট" সম্বোধন শুনে।
পেছনে বসে জামিল ফুয়াদের কানে কানে বলে,"ফান্দে পরিয়া বগা কান্দেরে ভাই! না পারছে কিছু বলতে,না পারছে কিছু সহ্য করতে মেয়েটা।"
আলো মাইক্রোফোনে বলতে থাকে,"অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণ করবে অত্র কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার, মোহাম্মদ শওকত হাসান।"
ভলান্টিয়াররা ফুলের তোড়া নিয়ে এগিয়ে যায় প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে। দুজন ভলান্টিয়ার কম বিধায় দুটো তোড়া টেবিলে-ই পরে থাকে। ইসলামের ইতিহাসের প্রফেসর জামান মাহবুব চাপা স্বরে চেঁচিয়ে আলোকে বলে,"নিয়ে যাও।"
আলো অবাক হয়ে বলে,"আমি?"
_হ্যা,তুমি। কুইক।
নিরুপায় হয়ে আলো ফুলের তোড়া দু'টো হাতে তুলে নিয়ে অতিথি আসনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সামিন ইয়াসার তার দিকে তাকিয়ে আছে । আলো একটি বার-ও তার দিকে না তাকিয়ে ফুলের তোড়া দুটো প্রিন্সিপালের হাতে দিয়ে এসে পুনরায় মাইক্রোফোনের কাছে এসে দাঁড়ায়।
সামিন ইয়াসারের মুখ কাঠিন্যতায় ছেয়ে যায়। এই মেয়েটির অবজ্ঞা সে হজম করে নিতে নারাজ। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে সে।
আলো তার হাতের কাগজটার দিকে একবার তাকিয়ে বলতে থাকে,"এবারে অতিথিদের ব্যাজ পরিয়ে দেবে প্রথম বর্ষের তিনজন শিক্ষার্থী। নুহা,প্রভা,রাবেয়া। তোমরা অতিথিদের আসনের সামনে এসো।"
তিনজনের মধ্যে থেকে দুজন চলে এসেছে। বাকি একজনকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিন্সিপাল স্যার রেগে আলোর দিকে তাকায়। প্রফেসর তৌফিকুল ইসলাম বলে," শুরুতেই ঝামেলা।"
আলো আমতা আমতা করে বলে,"আমি কি করবো স্যার? প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে কেনো চোখ রাঙাচ্ছে?"
_তোমাকে চোখ দিয়ে যেতে ইশারা করছে বেকুব মেয়ে। যাও, অতিথিদের ব্যাচ পরিয়ে দাও। কুইক।
আলো হতভম্ব হয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে,"ভলান্টিয়ার-রা আছে তো।"
_ভলান্টিয়াররা শাড়ি পরেছে কেউ?
_শাড়ি পরার সাথে ব্যাজ পরানোর কি সম্পর্ক স্যার? আর স্যার, শাড়ি পরা অনেক মেয়ে আছে। অন্য কাউকে ডেকে দেবো?
তৌফিকুল ইসলাম রাগী দৃষ্টিতে তাকায়। আলো একটা ঢোক গিলে বলে,"যাচ্ছি স্যার।"
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে,"যা আলো। ঐ পিশাচ টাকে ব্যাজ পরিয়ে দিলে মরে যাবি না তুই। পরে না হয় হাত ধুয়ে নিবি।"
"কি হলো যাচ্ছো না কেনো।"
পেছন থেকে প্রফেসরের ধমক শুনে আলো দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়। ডালা থেকে একটি ব্যাজ তুলে নিয়ে প্রথমে পুলিশ সুপারকে পরিয়ে দেয়। সামিন ইয়াসার আলোকে আড়চোখে দেখছে। তার মুখে পৈশাচিক হাসি। মনে মনে বলে,"এটাকে-ই বলে ক্ষমতা অদ্রিতা আলো।"
আলো পুনরায় আরেকটি ব্যাজ তুলে নিয়ে থমথমে মুখে সামিনের সামনে দাঁড়ায়। তারপর ধীরে ধীরে সামিনের দিকে একবার তাকায়।
পেছনে জামিল এবং অন্যরা চাপা হাসিতে ফেটে পরছে।
আলোর দৃষ্টিতে কি ছিলো সামিন জানে না। সে থমকে গিয়েছে। অপলক দৃষ্টিতে দেখছে একজন শ্যামবতীকে। আলো কপাল কুঁচকে ব্যাজ-টা সামিনকে পরিয়ে দিতে উদ্যত হয়। মনে মনে বলতে থাকে,"ওয়েট! পরাচ্ছি তোকে ব্যাজ !"
সামিন আলোর দিক থেকে চোখ ফেরাচ্ছে না। ক্ষণিকের জন্য সে ভুলে বসে আছে অদ্রিতা আলো নামের মেয়েটি তার শত্রু।
"আহহহ।"
সামিন নিজের আর্তনাদ শুনে নিজেই বেশ অবাক হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকে চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। আলো সামিন ইয়াসারের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে প্রতিশোধ নিতে পারার আনন্দ। সামিন বুকের বা পাশে হাত দিয়ে আলোর দিকে অবাক চোখে তাকায়।
প্রিন্সিপাল দাঁত কিড়মিড় করে বলে,"করলে টা কি! দিলে তো সেইফটি পিন-টা ফুটিয়ে। অদ্ভুত!"
আলো ভয় পাওয়া মুখ করে প্রিন্সিপালকে বলে,"দুঃখিত স্যার। দেখতে পাইনি।"
সামিন আলোর দিকেই তাকিয়ে আছে। আলো যে ইচ্ছাকৃত এটা করেছে তা বুঝতে বাকি নেই আর। যত দিন যাচ্ছে এই মেয়েটার কর্মকান্ড তাকে অবাক নয় হতবাক করে দিচ্ছে। আলোর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে মনে মনে বলে ওঠে,"এটার শোধও আমি তুলবো অদ্রিতা আলো।"
শুভ্র পাঞ্জাবিটার বুকের বা পাশটায় একফোঁটা লাল রক্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রিন্সিপাল ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে বলে,"তোমাকে মেডিসিন বা..."
ইয়াসার হাত উঠিয়ে থামিয়ে দেয় প্রিন্সিপালকে, আলোর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় প্রিন্সিপালকে বলে,"এসবে ইয়াসারের কিচ্ছুটি হয়না। আপনি অনুষ্ঠান কনটিনিউ করুন।"
শওকত হাসান আলোকে ধমক দিয়ে বলে,"দেখছো কি দাঁড়িয়ে! যাও মাইক্রোফোনের কাছে।"
আলো মাথা নাড়িয়ে মাইক্রোফোনের কাছে যায়, মনে মনে বলতে থাকে,"সেইফটি পিন তো খুবই নগণ্য জিনিস। তোর ওই বুকে কুড়াল বসানো উচিত ভণ্ড নেতা।"
"অতিথিদের ফুলের তোড়া এবং ব্যাজ পরানোর মধ্যে দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ হয়েছে। এখন আমি প্রতিযোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। মঞ্চে ডাকতে চাই গ্রুপ "ক" এর প্রতিযোগীদের। গ্রুপ "ক" থেকে এখন এসে নজরুল সঙ্গীত গাইবে মারুফা শাম্মী,প্রথম বর্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ।"
আলো মাইক্রোফোনের কাছ থেকে সরে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে। প্রতিযোগী মঞ্চে উঠে নজরুল সঙ্গীত গাইতে থাকে। অত্যন্ত শ্রুতিমধুর পরিবেশনা। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে, শুধুমাত্র সামিন ইয়াসারের দৃষ্টি আলোর দিকে। তার অবচেতন মন বারবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে ওই মেয়েটিকে দেখতে থাকে, যে মেয়েটি বারবার সামিন ইয়াসারকে টেক্কা দিচ্ছে। অঘোষিত নিরব যুদ্ধ করছে সামিন ইয়াসার মির্জার সাথে।
আলোর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একবার সে নিজের দিকে তাকায়। রক্তের ফোঁটা-টা ফুলের মতো লাগছে। একটা ক্ষুদ্র গোলাপ ফুল।
একের পর এক প্রতিযোগীরা তাদের পারফরম্যান্স দেখিয়ে যাচ্ছে। আলোর অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে,কখন শেষ হবে এই অনুষ্ঠান ! তার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে।
দর্শকদের প্রথম সারিতে বসে জামিল ফুয়াদকে বলে,"সাহস দেখেছেন? এমপি মহোদয়ের সামনে সুকৌশলে ভাইকে যন্ত্রনা দিয়েছে। অবাক হবার কিছু নেই। এই মেয়ে কারাতে জানে। ক্লাস সেভেনে থাকতে একবার এক ছেলে হাত ধরেছিলো জোর করে। বাড়িতে এসে কান্নায় লুটিয়ে পরতেই আতাউর আলম সাথে সাথে মেয়েকে নিয়ে কারাতে ট্রেইনিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দেয়।"
_সাহস তো দেখার মতো-ই, নয়তো সামিন ইয়াসারের গালে চড় মারে নাকি!
_বাপকে ভীষণ ভালোবাসে। সব কিছু করতে পারে বাবার জন্য।
দু'জনেই কথা থামিয়ে আলোকে দেখতে থাকে।
অনুষ্ঠান প্রায় শেষ হয়েছে। প্রতিযোগীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করছেন অতিথিরা। একটু পরেই মাগরীবের আজান দেবে। সবাই বাড়ি ফেরার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। আলো নিজের ব্যাগ উঠিয়ে তৌফিকুল ইসলামের কাছে গিয়ে আমতা আমতা করে বলে,"স্যার এবার তো অনুমতি দিন। কাজ যা বাকি আছে ভলান্টিয়ার-রা দেখে নেবে।"
তৌফিকুল ইসলাম কিছুক্ষণ ভেবে বলে,"আচ্ছা যাও। বাকিটা আমিই সামলে নিচ্ছি।"
***
"ভাই! ভাই দেখিতো কি হয়েছে!"
হাত দিয়ে জামিল সামিন ইয়াসারের পাঞ্জাবি ধরে দেখতে থাকে। রাহাত চেঁচিয়ে ওঠে,"করছে টা কি! ভাই এই মেয়েতো রক্তচোষা বাদুড়। বেয়াদ্দপ মেয়ে।"
সামিন জামিলের হাত সরিয়ে বলে,"গাড়ি স্টার্ট কর। কিচ্ছু হয়নি।"
ফুয়াদ মুচকি মুচকি হাসছে। ইয়াসার গম্ভীর কন্ঠে বলে,"সমস্যা কি? হাসছিস কেনো?"
_রক্তচোষা বাদুড় আসছে। ওই দেখ।
সামিন ইয়াসার মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। আলো ধীরপায়ে গেইটের কাছে এগিয়ে আসছে। কলেজের পাশের মসজিদে আজান দিয়ে দিয়েছে। ল্যাম্পোস্টের বাতি গুলো সব জ্বেলে ওঠে এক সাথে। আলো আজান শুনে শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় তুলে দেয়। দৃশ্যটি সামিন ইয়াসারের অবচেতন মনকে মুগ্ধ করে। কিন্তু সে বুঝতে পারে না।
রাহাত চাপা স্বরে বলে,"ভাই এখন ধরে কানের নিচে দুটো চড় লাগিয়ে দিন। কেউ দেখবে না।"
সামিন রেগে গিয়ে রাহাতের দিকে তাকায়। ঠান্ডা গলায় বলে,"ওরা এমনিতেই দুর্বল জাতি। গায়ের জোর দেখিয়ে কি হবে? ওকে চড় তো অবশ্যই মারবো। তবে অন্যভাবে।"
সেই অন্যভাবে-টা ঠিক কিভাবে তা জানতে সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সামিন কিছু বলে না, এক দৃষ্টে আলোকে দেখে।
আলো সামিন ইয়াসারের গাড়ির কাছে ওদের দলবল দেখতে পেয়ে থমকে যায়। মেইন গেইটের কাছে না গিয়ে সে পকেট গেইটের দিকে যায়।
দলের তিন-চারজন চেঁচিয়ে ওঠে,"ভয় পাইছে ভাই,ভয় পাইছে!"
আলো দাঁড়িয়ে পরে। জামিল চেঁচিয়ে বলে," শিড়ায় শিড়ায় রক্ত, আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।"
বাকি ছেলেগুলোও চেঁচিয়ে ওঠে,"শিড়ায় শিড়ায় রক্ত,আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।"
আলো এক মুহুর্ত দেরী না করে দৌড়ে পকেট গেইট থেকে বেরিয়ে যায়। একটা রিকশায় উঠে শাড়ির আঁচল টেনে কান চেপে ধরে। সামিন ইয়াসারের দলবল তখনো চেঁচিয়ে যাচ্ছে,"শিড়ায় শিড়ায় রক্ত,আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।"
"স্যার প্রশ্নপত্র কোথায়? আমরা পরিক্ষা কিভাবে দেবো?"
_প্রশ্নপত্র কি? প্রশ্নপত্র কাকে বলে? সেটা দিয়ে কি করে?
তৌফিকুল ইসলামের এমন কথায় পুরো শ্রেনীকক্ষ আলোড়িত হয়। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আলো দাঁড়িয়ে প্রতিবাদের সুরে বলে,"হচ্ছে কি এসব স্যার? আজকে আমাদের ফার্স্ট ইনকোর্স এক্সামের ফার্স্ট ডে। আমাদের প্রশ্নপত্র না দিলে লিখবো কি?"
_আচ্ছা আচ্ছা। প্রশ্ন আমি বলে দিচ্ছি। তোমরা সবাই লেখো। তোমাদের প্রশ্ন হচ্ছে "আমরা কারা?"
আলো বিরক্ত হয়ে যায়। রেগে গিয়ে বলে,"স্যার আমরা ইংলিশ লিটারেচারের স্টুডেন্ট। এসব কি ধরনের প্রশ্ন দিচ্ছেন আমাদেরকে?"
তৌফিকুল ইসলাম রেগে যায়। আলোকে ধমক দিয়ে বলে,"চুপ। যা বলছি তাই করো। লেখো, তোমরা কারা লেখো।"
আলো দাঁত কিড়মিড় করে বলে ,"এর উত্তর আমাদের জানা নেই।"
_ঠিকাছে। আমি বোর্ডে লিখে দিচ্ছি। তোমরা সবাই খাতায় কপি করে ফেলো।
সবাই "জ্বি" বলে মাথা নাড়ায়। আলো হতবাক হয়ে চারপাশে তাকায়। এসব হচ্ছে টা কি আসলে!
তৌফিকুল ইসলাম বোর্ডে লিখতে থাকে,
"প্রশ্ন : আমরা কারা?"
উত্তর: শিরায় শিরায় রক্ত। আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।"
আলো হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়ায়। ক্লাসের সবাই তড়িঘড়ি করে লিখতে থাকে। মুখে বিড়বিড় করতে থাকে,"শিরায় শিরায় রক্ত। আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত। শিরায় শিরায় রক্ত, আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত, শিরায় শিরায় রক্ত,আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।"
আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আলো চেঁচিয়ে ওঠে,"চুপ করো তোমরা।"
কেউ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। বিড়বিড় করতে থাকে,"শিরায় শিরায় রক্ত,আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।"
আলো বেঞ্চের উপরে জোরে চাপড় মেরে প্রচন্ড শব্দে চেঁচিয়ে বলে,"চুপ করো তোমরা চুপ করো। দোহাই তোমাদের,চুপ করো!"
হঠাৎ করে আলোর চোখ খুলে যায়। একলাফে উঠে বসে সে হাঁফাতে থাকে। দু'মিনিট সময় নিয়ে সে পরিস্থিতি অনুধাবনের চেষ্টা করে। সে কোথায়? এরকম ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে কেনো ক্লাসরুম। কয়েক মুহূর্ত যেতে-ই ধীরে ধীরে সে টের পায় সে এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলো। হাত দিয়ে ফোন খুঁজতে থাকে সে। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে ফ্লাশ লাইট অন করে। পুরো গা ঘামে ভিজে গিয়েছে। এখনো তার শরীর একটু একটু করে কাঁপছে। এর চেয়ে ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্ন বোধ হয় সে তার পুরো জীবনে দেখেনি। বিছানা থেকে ধীরে ধীরে নেমে লাইট জ্বেলে দেয়। টেবিলের ওপরে রাখা গ্লাসের ঢাকনা সরিয়ে গ্লাসের পানি ঢকঢক করে পুরোটা পান করে। ওয়াশ রুমে ঢুকে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়। ধপ করে বিছানার উপর বসে পরে। কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নেয়। ইশমামের নাম্বারে ফোন দিতেই সাথে সাথে ইশমাম ফোনটা রিসিভ করে বলে,"আমার হঠাৎ করে মনে হচ্ছিলো তুমি ফোন দিবে।"
"ভালো।"
ইশমাম আলোর কন্ঠস্বর শুনে বিচলিত হয়ে বলে,"কি হয়েছে অদ্রিতা ? কন্ঠস্বর এমন লাগছে কেনো?"
_হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। তাই।
_দুঃস্বপ্ন দেখেছো নাকি কোনো?
_হুম।
_কি? একজন কুচকুচে কালো দেখতে, টাক মাথার বিসিএস ক্যাডারের সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে তোমার?
কথাটি বলে ইশমাম হো হো করে হাসতে থাকে। আলো ধীরে ধীরে বলে,"তার চেয়ে বেশি ভয়ংকর।"
_তাই? আচ্ছা বলো তো শুনি! আমিও একটু ভয় পেতে চাই।
আলো ধীরে ধীরে তার দুঃস্বপ্নের কথা ইশমামকে বলে। সবটা শুনে ইশমাম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে। আলো বিরক্ত হয়ে বলে,"হাসছো কেনো তুমি?"
ইশমাম হাসি থামিয়ে বলে,"তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছো অদ্রিতা। ইয়াসার মির্জাকে কেনো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলছো না? অদ্ভুত। সারাদিন ওই লোকটার কথা ভাবতে হবে?"
_আমি কেনো সারাদিন ওই লোকটার কথা ভাবতে যাবো? ওই লোকটাই তো আমাকে প্রত্যেকটা দিন বিরক্ত করতে চলে আসে!
ইশমাম চুপ হয়ে যায়। তারপর মৃদু স্বরে বলে,"বিরক্ত করতে চলে আসে মানে? আর কিছু করেছিলো উনি?"
আলো থতমত খেয়ে যায়। নিজের কথা ফিরিয়ে নিয়ে বলে,"না মানে সারাদিন বাড়ির সামনের রাস্তায় ওর নামে মিছিল হয়। শহরের আনাচে কানাচে যেখানেই যাই ," শিরায় শিরায় রক্ত, আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।"
ইশমাম মৃদু হেসে বলে,"বাদ দাও,এসবে জড়িও না আর। তুমি শুধু লেখাপড়ায় মন দাও।"
_কাল আব্বুর সাথে ক্যাম্পেইন করতে যাবো। একদিনই যাবো।
_না। এসবের দরকার নেই। নিজের বয়স অনুযায়ী কাজ করো অদ্রিতা। সব ব্যাপারে বেশি কৌতুহল তোমার। এসবে কেন জড়াতে হবে?
_অভিজ্ঞতার জন্য। ভবিষ্যতে আমিও রাজনীতিতে নামবো।
হাসতে হাসতে আলো বলে।
_না অদ্রিতা।
ধমকের সুরে বলে ইশমাম।
আলো হাসি থামিয়ে বলে,"মজা করছি। একদিনই যাবো। প্রমিজ। আর কখনো যাবো না। কখনো না।"
***
ইহানের মুখের কাছে ভাতের লোকমা তুলে ধরতেই ইহান মুখ সরিয়ে নেয়। বাবার ফোনে কার্টুন দেখছিলো সে। রিতু একটা ধমক দিতে গিয়েও দেয়না। ইলহামের দিকে একবার তাকিয়ে অসহায়ের মতো ইশিতার দিকে তাকায়। ইশিতা চোখ দিয়ে ইশারা করে রিতুকে প্লেট সরিয়ে ফেলতে বলে। ইলহাম এবং সামিন ইয়াসার খাবার টেবিলে নিজেদের বাড়ির ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা করছিলো। রিতু প্লেট সরিয়ে রেখে সামিন ইয়াসারের প্লেটে মাংসের টুকরো তুলে দেয়। সামিন বলে,"লাগবে না রিতু।"
রিতু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"ভাইয়া আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো।"
সামিন তাকায়। ইলহাম বলে,"দেখছো না এখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছি?"
সামিন ইলহামকে থামিয়ে দিয়ে বলে,"বলো। কোনো সমস্যা?"
রিতু মাথা নাড়িয়ে নিচু স্বরে বলে,"ভাইয়া ইহানের জন্য একটা টিচার ঠিক করে দিলে ভালো হয়।"
"হুম দেবো। আর কিছু বলবে?"
রিতু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"ওর জন্য একজন হুজুর ঠিক করে দিবেন? আরবি শেখাতে চাই। বাড়িতে এসে পড়িয়ে যাবে।"
_আরবি শিক্ষা দিতে চাও মানে? এতটুকু বয়সে এতো চাপ কেনো দিতে হবে?
রিতু ইলহামের কথার জবাব না দিয়ে সামিন ইয়াসারকে বলে,"গত রাতে আমার শাশুড়ি মাকে স্বপ্নে দেখেছি। নাতী কে নিয়ে বসে আছেন। আমাকে হঠাৎ বললেন,আমার নাতীকে আলেম বানাবে।"
তারপর কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলে,"আলেম না হোক, কোরআন শরীফ পাঠ করাটা শিখে যাক অন্তত!"
ইলহাম এবং সামিন ইয়াসার দু'জনেই রিতুর মুখে মায়ের কথা শুনে তাকায়।
রিতু বলে কাল কিছু এতিম বাচ্চাদের খাওয়াতে চাই ভাইয়া। ব্যবস্থা করে দিলে ভালো হয়।
"সংসারের পুরো দায়িত্ব তোমার হাতে রিতু। ইশিতা নাক গলায় না। তুমি যা ভালো মনে করো।"
ঠান্ডা গলায় বলে ইয়াসার। কিছুক্ষণ পরে আবারো বলে ওঠে,"একজন আরবি টিচার-ও ঠিক করে দেবো। কালকের মধ্যে।"
রিতুর মুখে হাসি ফোটে।
ইশিতা ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামিন আর ইলহামকে উদ্দেশ্য করে বলে,"আমি আসছি ভাইয়া। ভার্সিটিতে যাচ্ছি।"
_গাড়ি নিয়ে যা।
_না রিকশা করে যাবো।
ইলহাম ভ্রু কুঁচকে বলে,"নিজেদের গাড়ি থাকতে রিকশা কেনো?"
_গাড়ির ভেতরে দমবন্ধ লাগে। সারাদিন তোমাদের এই বদ্ধ পরিবেশে থাকি। বাইরে গিয়েও পরিবেশ-টা একটু চেইঞ্জ করবো না?
ইশিতা চলে যায়। ইলহাম সামিন ইয়াসারকে বলে,"ইশিতা আর ইশমাম যে যমজ তা ওদের হাবভাব দেখলেই বুঝে ফেলা যায় ভাইয়া।"
সামিন ইয়াসার কিছু বলে না। চুপচাপ খেতে থাকে। ইলহাম বলে,"মা মারা যাওয়ার পরে এই সংসারটা কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে। তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে তোমার জন্য মেয়ে দেখতে পারি ভাইয়া। বাবাও চায় তুমি এখন বিয়ে করো।"
সামিন খেতে খেতে বলে,"হু দেখ। তবে আমার জন্য না। ছোটোর জন্য। ওকে বিয়ে করিয়ে দেবো দেশে ফিরিয়ে এনে। সুন্দরী এবং নম্র ভদ্র দেখে একটা মেয়ে দেখবি। রিতুর মতো। এ বাড়িতে কোনো উড়নচন্ডী টাইপ মেয়ে বৌ হয়ে আসবে না। আমার মায়ের প্রতিচ্ছবি হতে হবে, তার মতো করে নিপুণ হাতে সংসার সামলানোর দক্ষতা থাকতে হবে। দেখলে যেনো মনে হয় আমি আমার মা কেই দেখছি।"
***
"তোমাকে এমন ভাবে যত্ন করছে আব্বু মনে হচ্ছে তুমি এই শহরের মেয়র কনফার্ম।"
আতাউর আলম মেয়ের কথায় মুচকি হাসে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,"এরা আমাকে খুব ভালোবাসে।"
আতাউর আলমের চাচাতো ভাই খোরশেদ পেছন থেকে বলে ওঠে,"এইসব বস্তির লোকদের ভরসা নেই ভাইজান। এরা গিরগিটির চেয়েও দ্রুত রং বদলায়। যেদিকে ঝোঁক বেশি সেদিকে ঝুঁকে থাকতে পছন্দ করে। আপনাকে বুঝতেই দেবে না এরা আপনার বিরোধী। কিন্তু তলে তলে ঠিকই যে টাকা দিয়ে কিনতে পারবে সিলটা তার নামের ওপরেই লাগাবে।"
আলো তার চাচার বিরোধীতা করেই বলে,"মোটেই না। এদের চোখ বলে দিচ্ছে এরা কতটা স্বচ্ছ।"
খোরশেদ বলে,"তুই সেদিনের মেয়ে। তুই কি মানুষ চিনিস?"
_আপনার থেকেও বেশি চিনি চাচ্চু।
খোরশেদ থতমত খায়। এই আলো অনেক চালাক মেয়ে। এর সাথে তর্কে গেলে পয়েন্টে পয়েন্টে ধরা খেতে হয়। প্রসঙ্গ পালটে খোরশেদ বলে,"এই রোদ গরমে তুই কেন আসতে গেলি। এতো বড় মেয়ে, দৃষ্টিকটু লাগছে ব্যাপারটা। আমরা তো সবাই আছি ভাইজানের সাথে "
_বড় সেজন্যই তো এসেছি। ছোটো হলে তো আসতাম না।
খোরশেদ চুপ হয়ে যায়। আলো বলতে থাকে,"কি জানেন তো চাচ্চু? আমার ভালোমানুষ আব্বুর নতুন নতুন কিছু অদৃশ্য শত্রু হয়েছে। তাদেরকে আব্বু ডিটেক্ট করতে পারছে না। বয়সের ভারে আব্বুর দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। আমার দৃষ্টি পরিষ্কার। খুব সহজেই ডিটেক্ট করতে পারবো। তাই আব্বুর বডিগার্ড হিসেবে এসেছি।"
আতাউর আলম মেয়ের কথায় হেসে ফেলে। নিজের হাতে মেয়েকে গড়েছেন তিনি। মেয়েটা তার মতোই দুঃসাহসী। কথাবার্তাও তার মতো করেই বলে। শুনলে চমকে যেতে হয়।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আতাউর আলম বলে,"এবার রেডিও কলোনির দিকে যেতে চাচ্ছি।"
আতাউর আলমের কর্মীরা সবাই উঠে দাঁড়ায়। আলো উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,"আজ বরং থাকুক বাবা। চাচারা যাক। তুমি তো হাঁটতেই পারছো না।"
_আরে ধূর! এখনি যদি নিজে গিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের থেকে ভোট চাইতে না পারি তাহলে লোকজন আমাকে কতটুকু ভরসা করবে বলতো?
আলো বলে,"ঠিকাছে। তবে আমিও যাবো তোমার সাথে।"
***
মুখোমুখি দুটো দল। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল থেকে মনোনীত প্রার্থী সামিন ইয়াসার মির্জা, এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর আলম। রেডিও কলোনির মোড়ে এসে দুটো দল মুখোমুখি হয়।
রাস্তা পুরোটা আটকে দাঁড়িয়ে পরেছে তারা। আলো সামিন ইয়াসারকে দেখে কোন এক অজানা কারনে আতাউর আলমের পেছনে দাঁড়ায়। সামিন ইয়াসার তা খেয়াল করেছে। আতাউর আলমের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,"অনেকদিন পরে দেখা হলো আপনার সাথে! "
আতাউর আলম তাচ্ছিল্য মাখা হাসি দিয়ে বলে,"দেখে খুশি হওনি নিশ্চয়ই? তাও আবার এভাবে?"
সামিন ইয়াসার শুকনো হাসি হাসে। তার পেছন থেকে জামিল বলে ওঠে,"আমরা আগে এসেছি। কলোনীতে আমরা প্রথমে ঢুকবো।"
_মামার বাড়ির আবদার? এখানে আব্বুর কর্মীরা আগে এসেছে। আমরা আগে ঢুকবো।
আতাউর আলমের পেছন থেকে ক্ষীণ কিন্তু তেজী কন্ঠে বলে আলো। সামিন চোখ সরিয়ে আলোকে দেখে, আতাউর আলমের দিকে তাকিয়ে বলে,"মেয়েকে কেন এসব রাজনীতি শেখাচ্ছেন? পড়াশোনা করতে মন না চাইলে ওকে বিয়ে দিয়ে দিন। রাজনীতি মেয়েদের বিষয় না।"
_আমার মেয়ে কি করবে আর কি করবে না তা আমি আর আমার মেয়ে বুঝবো।
একটু থেমে আতাউর আলম বলে,"আমি বুঝতেই পারিনি তোমার মতো সেদিনের একটা ছেলেকে পার্টি নমিনেশন দেবে।"
_হুম। বারবার বলতেন আমি দিবাস্বপ্ন দেখছি।
_এখনো বলবো তুমি দিবাস্বপ্ন দেখছো। পার্টি নমিনেশন দিয়েছে শুধু,এবার ভোটে জিতে দেখাও।
_দিবাস্বপ্ন আপনি দেখছেন। আপনার মতো দুই টাকার রিপোর্টার, অতীতে দুই একটা সাহসী কাজ করে জনগনকে খুশি করেছেন, সেজন্য ভাববেন না জনগণ আপনাকে শহর দেখভালের দায়িত্ব দেবে।
_দুই টাকার রিপোর্টার মানে? কোন সাহসে আপনি আমার আব্বুকে দুইটাকার রিপোর্টার বলছেন। বেহায়া বেশরম লোক, নির্লজ্জ কোথাকার। ছেলের নারী কেলেঙ্কারির জের ধরে বাপকে সংসদ সদস্যের পদ হারাতে হয়েছে,ভুলে গেছেন সেসব কথা? সরকারের টাকা মেরে কালো টাকার পাহাড় বানিয়ে একজন সৎ লোককে দুই টাকার রিপোর্টার বলছেন?
সামিন চোখ রাঙিয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো বলতে থাকে,"এই কলোনিতে এখন আতাউর আলমের কর্মীরা ঢুকবে। দেখি কে আটকায়।"
জামিল দাঁত খিচিয়ে বলে,"সামিন ইয়াসার মির্জার লোক ঢুকবে। দেখা যাবে কাদের কত দম।"
সামিন জামিলকে থামিয়ে দিয়ে বলে,"ঢুকতে দে ওদের।"
_কিন্তু ভাই...
_কথা কম। ঢুকতে দে।
আলো তাচ্ছিল্যের সাথে বলে ওঠে,"এমনিতেও আপনারা আগে ঢুকলে ঝাটার বারি খেয়ে বের হতেন, অপজিশন পার্টির সামনে মুখ লুকানোর যায়গা পেতেন না তখন।"
আতাউর আলম আলোকে থামিয়ে দিয়ে বলে,"চল আম্মু।"
সামিন ইয়াসারের লোকজন রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ায়, স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর আলমের কর্মীরা সবাই কলোনিতে প্রবেশ করে।
যাওয়ার আগে আলো এক মুহুর্তের জন্য সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়। সামিন ইয়াসার তার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে।
"ভাই এই মেয়েটাকে আর নেওয়া যাচ্ছে না। অতিরিক্ত। অসহ্যকর।"
রেগেমেগে বলে জামিল।
সামিন ইয়াসার চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে কি ভাবছে?
***
"একটা গল্প বলি শোনো। একবার এক শকুনের বাচ্চা তার শকুন মায়ের কাছে বললো মা আমার মানুষের মাংস খেতে ইচ্ছে করছে। শকুন মা তখন এক বুদ্ধি বের করলো। এক টুকরো গরুর মাংস নিয়ে গিয়ে হিন্দু পাড়ায় ফেলে দিয়ে আসলো এবং এক টুকরো শূকরের মাংস নিয়ে এসে মুসলমানদের মহল্লায় ফেলে দিয়ে আসলো। তারপর চুপ করে নিজের ছানা নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকলো। কিছু সময় পরে গরু আর শূকরের মাংসের জের ধরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হলো। সেই দাঙ্গায় গোটা কয়েক লোক মরে লাশ হয়ে পরে থাকলো। শকুন তখন তার ছানাকে বলে,"যা বাবা। এখন ইচ্ছামতো মানুষের মাংস খা তুই।"
জায়েদ আলী শমশের ভুঁইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,"আপনি কি পরোক্ষভাবে নিজেকে ওই শকুনের সাথে তুলনা করলেন?"
শমসের ভুঁইয়া থতমত খেয়ে বলে,"না বেকুব। আমি আসলে উদাহরণ দিচ্ছি। কিভাবে ইয়াসার মির্জা আর আতাউর আলমের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি করবে তার হিন্ট দিচ্ছি।"
_কিন্তু এটা তো কোনো সাম্প্রদায়িক ইস্যু না। রাজনীতি। মাংস ছড়াছড়ি করে কি হবে।
শমসের ভুঁইয়া প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে মুখে "চ" কারন্ত শব্দ করে বলে,"তুমি এতো মাথামোটা হলে কবে থেকে জায়েদ। এখন কি হাতে কলমে শিখিয়ে দিতে হবে কিভাবে কি করবে?"
জায়েদ আলী আমতা আমতা করে বলে,"না। আমাদের ছেলেদের কাজে লাগিয়ে দিচ্ছি।"
"গুড। এখন যাও। আর ইয়াসারের ডান হাত জামিলের ব্যাপারে কি করলে?"
_সুযোগ পেলেই সরিয়ে দেবো।
***
"ভাই একটা খারাপ খবর আছে।"
সকাল সকাল পার্টি অফিসে এসে জামিলের মুখে কথাটি শুনেই ইয়াসারের কপাল কুঁচকে যায়। জামিলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সে। জামিল বলে,"উত্তরের এলাকা গুলো থেকে আতাউরের লোকজন আপনার সব সাইনবোর্ড খুলে ফেলেছে। সব নষ্ট করে ফেলেছে। আমাদের ছেলেরা ক্ষেপে গিয়ে ওদের একটাকে ধরেছে। মারামারি হয়েছে খুব। পুলিশ এসে দুই পক্ষের ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়েছে। "
সামিন ইয়াসার প্রচন্ড রেগে যায়। দাঁত খিচিয়ে বলে,"তোরা কি করছিলি? ঘাস কাটছিলি?"
_ভাই ভোরের আলো ফোটার আগে এই কাজ হয়েছে। লোকজন বলছে সব আতাউরের লোকজনের কাজ। আর মারামারির সময়ে আমি ছিলাম না। বৌয়ের শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।
সামিন উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বলে," মারামারি করার পারমিশন দিয়েছে কে ওদের? ইলেকশনের আগে আমায় কেস খাইয়ে ছাড়বে দেখছি। আমি আসছি।"
_ভাই মাথা ঠান্ডা করেন। ছেলেপুলেরা দেখছে সবটা।
_আমি দেখতে চাই জামিল। ওদের থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। উকিলকে ফোন কর।
_বাইরে বৃষ্টি পরছে ভাই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন!
_এক্ষুনি যাবো। তুই বাড়ি যা। তোর বৌকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা।
জামিল কিছু বলে না। সামিন ইয়াসার ক্ষেপে গিয়েছে। তাকে এই মুহূর্তে বাঁধা দিলে সে শুনবে না,তা জামিল জানে।
ইয়াসার রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,"সেদিন ভরা জনসভায় আমাকে থাপ্পর মেরে বলেছিলো আমি নাকি কাপুরুষের মতো ওর বাবাকে পেছন থেকে ছুরি মেরেছি। সামনাসামনি লড়ার ক্ষমতা আমার নেই। আর ওর বাবা এখন রাতের অন্ধকারে বিরোধী পার্টির সাইনবোর্ড খুলে ফেলছে। এর শেষ দেখে ছাড়বো আমি।"
***
গায়ের সাথে ভেজা পাঞ্জাবি লেপ্টে আছে। টেবিলের উপর এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা। হাতে গাড়ির চাবি। সামিন চাবিটা দিয়ে টেবিলের ওপর ঠকঠক আওয়াজ করছে। আতাউর আলম সেদিকে একবার তাকিয়ে ওসি সালামের কথায় কান দেয়। ওসি সালাম বলতে থাকে,"আপনাদের দুজনের ছেলেরাই সমানে সমান। নিজেদের ছেলেদের সামলানোর দায়িত্ব আপনাদের। এখনি এতো দায়িত্বহীনের মতো কাজ করলে মেয়র হয়ে কি করবেন?"
সামিন চায়ের কাপ উঠিয়ে চুমুক দেয়। ওসি বলতে থাকে,"এবারের মতো ছেড়ে দিচ্ছি। দুদিন পরে নির্বাচন। ছেলেদের সামলে রাখুন। ফের আমার খপ্পরে পরলে একটাকেও ছাড়বো না।"
আতাউর আলম বলে,"সরকারি দলের ছেলে গুলোর দোষ সব। সব ইয়াসারের পোষা কুকুর। তারা আগে আমার ছেলেদের উপরে হাত তুলেছে।"
_আর আপনি চোরের মতো আমার সাইনবোর্ড, পোস্টার খুলে ফেলেছেন নিজের এলাকা থেকে। এতো ভয় সামিন ইয়াসারকে? ভয়ের চোটে সব শুকিয়ে গিয়েছে তাই না?
_মুখ সামলে কথা বলো। বেয়াদব ছেলে।
_আপনিও মুখ সামলে কথা বলুন।
"আরে আরে কি হচ্ছে কি এসব! এটা থানা। ভুলে গেছেন?"
আতাউর আলম বলে,"না ভুলিনি ওসি সাহেব। আমি আমার ছেলেদের নিয়ে গ্যারান্টি দিচ্ছি। ভবিষ্যতে এমন কিছু হবে না। আপনিও ইয়াসারকে বলে দিন ও যাতে ওর কুকুর গুলোকে সামলে রাখে।"
আতাউর আলম হুমকির মতো করে কথাটি বলে চলে যায়। সামিন ইয়াসার রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে। কিছুক্ষণ বাদে সেও থানা থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট করে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পরছে বাইরে। থানা থেকে বের হতে হতে রাত হয়ে গিয়েছে। ইমতিয়াজ মির্জা অনেকবার ছেলেকে ফোন দিয়েছে,সামিন ফোনটা রিসিভ না করে রেখে দিয়েছে। এক মনে ড্রাইভিং করছে সে। থানাপাড়া রোড পাড় হয়ে মোড় নিতেই আচমকা দূর থেকে কেউ তার গাড়ি লক্ষ্য করে একটা মাঝারি সাইজের পাথর ছুড়ে মারে। সামিনের গাড়ির সামনের কাঁচে লেগে তাতে ফাটল ধরে যায়। হুট করে ব্রেক কষে সামিন। দাঁত খিচিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,"বা'স্টা'র্ড!"
গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে তাকায়। বৃষ্টির কারনে রাস্তা শুনশান হয়ে আছে। ল্যাম্পোস্টের বাতি টা পিট পিট করে জ্বলছে । সামিন বিকট শব্দে চেঁচিয়ে ওঠে,"সাহস থাকলে সামনে আয়। একেবারে পুতে দেবো। সামনে আয় বলছি।"
"মাঘের শীত বাঘের গায়,সামিন ইয়াসার মেয়ে মানুষের চড় খায়।"
তিন চারজন কমবয়সী ছেলের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সবাই একসাথে চেঁচিয়ে কথাটি বলে। সামিন আওয়াজটা কোন দিক থেকে আসছে সেদিকে লক্ষ্য করে ছুটে যায়। কিন্তু সে গিয়ে কাউকে খুঁজে পায়না সেখানে। সামিন চেঁচিয়ে বলে,"মায়ের বুকের দুধ খেয়ে থাকলে এদিকে আয় শু'য়ো'রে'রা।"
এমন সময় সামিনের ফোন বেজে ওঠে। ভেজা হাতে ফোনটা রিসিভ করতে বেশ বেগ পেতে হয়। কোনোমতে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রাহাত বলে,"ভাই। জামিল ভাইকে কেউ কু'পি'য়ে'ছে !"
আইসিইউ-র সামনে দাঁড়িয়ে আছে দলের বাকি সদস্যরা। প্রত্যেকের মুখে প্রবল উৎকণ্ঠার ছাপ। রাহাত দাঁড়িয়ে কাঁদছে। সামিন একপ্রকার দৌড়ে যায়। গিয়ে রাহাতকে ধরে বলে,"কেমন আছে ও? বল! কেমন আছে!"
কথাগুলো জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সামিনের গলা কেঁপে ওঠে। রাহাত হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। গলা থেকে কথা বের হচ্ছে না তার। সামিন মাথায় হাত দিয়ে বেঞ্চিতে বসে পরে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। জামিল শুধু মাত্র তার ডান হাত ছিলো না,জামিলের জন্য সামিনের অন্যরকম মায়া। প্রচন্ড স্নেহ করে সে এতিম ছেলেটাকে।
"ভালো আছে ভাইয়া। জামিল খুশি। আপনার জন্য জান দিতে পেরে। চিন্তা করবেন না।"
নারীকন্ঠ শুনতে পেয়ে সামিন মাথা তুলে তাকায়। তার সামনে জামিলের গর্ভবতী স্ত্রী হেনা দাঁড়িয়ে।
সবুজ এসে বলে,"হেনা ভাবী। আপনি বসুন। কেন আসলেন এখানে?"
হেনা ধীরে ধীরে বেঞ্চিতে সামিনের পাশে বসে পরে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুবই অসুস্থ। সামিন কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"তুমি ঠিক হও হেনা। কিচ্ছু হবে না ওর। আমি হতে দেবো না।"
_হু। আমি ঠিক আছি ভাইয়া। চা'ম'চা'দে'র বৌদের ঠিক থাকতে হয়। এসব পরিস্থিতি অহরহই আসে এদের জীবনে।
সামিন হেনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হেনা বলে,"সামিন ভাইয়ের জন্য জান দিয়ে দেবো। কথাটা ও সব সময় বলতো ভাইয়া। আজ সত্যি হতে চলেছে।"
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"আপনাদের আর কি ভাইয়া! একজন চা'ম'চা চলে গেলে দশজন চা'ম'চা প্রস্তুত আপনাদের সেবার জন্য।"
"ভাবী। সামিন ভাইয়ের সাথে এভাবে কেনো কথা বলছেন? সামিন ভাইয়ের কি দোষ?"
আরাফের দিকে তাকিয়ে হেনা ম্লান হেসে বলে,
_আমি তো তাকে দোষ দিইনি। কাউকে দোষ দিইনি আমি। শুধু কষ্ট হচ্ছে আরাফ। আমার সন্তান জন্মের আগেই এতিম হয়ে গেলো।
ঝরঝর করে কেঁদে দেয় হেনা। তার কান্না থামছেই না। কিছুক্ষণ শব্দ করে কেঁদে বলে,"কত বার করে বললাম। ছেড়ে দিন আমার স্বামীকে। ছেড়ে দিন। আমাকে এই অবস্থায় দেখেও একটু মায়া হলো না আতাউর আলমের লোকদের। ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে কো'প বসায় ওর গায়ে।"
সামিন হেনার দিকে তাকায়। তার চোখে মুখে বিস্ময়। বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। দলের ছেলে গুলো সব মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।
সামিন তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,"আতাউর আলমের লোক করেছে এসব?"
হেনা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ায়। অস্ফুট স্বরে বলে,"চারজন ছিলো। বলেছে আগে তোকে শেষ করবো, তারপর তোর সামিন ভাইকে। এই শহরের মেয়র হবে আমাদের আতাউর সাহেব। অন্য কেউ না।"
ফুয়াদ ইতিমধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের মাঝে। সবুজ ক্ষেপে গিয়ে শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে বলে,"ভাই চলেন। থানায় চলেন।"
সামিন কঠিন গলায় বলে,"না।"
_যাবেন না? তাহলে চলেন ল'ট'কে দিয়ে আসি।
সামিন তেজী কন্ঠে বলে,"না।"
হেনা কান্না থামিয়ে বলে,"আমায় একটা কথা দিবেন ভাইয়া? ও যদি কখনো সুস্থ হয়ে ওঠে। আপনি প্লিজ ওকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন। ও কখনো আপনাকে ছাড়তে চাইবে না ভাইয়া। আপনি ওকে প্লিজ নিজে থেকে ঘার ধাক্কা দিয়ে দল থেকে বের করে দেবেন।
সামিন হেনার কথার জবাব না দিয়ে রাহাতকে বলে,"রাহাত।"
_জ্বি ভাই।
_চল আমার সাথে।
ফুয়াদ বলে,"কোথায়? কোথায় যাবি তুই?"
সামিন ফুয়াদের দিকে তাকায়। সামিনের দৃষ্টি দেখে ফুয়াদ ভয় পেয়ে যায়। চোখ দুটো রাগে,ক্ষোভে লাল হয়ে গিয়েছে। তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,"জামিল আমার শরীরের একটা অঙ্গ ফুয়াদ। আমার ছোট ভাইয়ের মতো। ও না থাকলে আমি অনেকটাই অচল। এটা সবাই জানে। তাই ওকে রাস্তা থেকে সরিয়ে আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে ইলেকশনে জিততে চেয়েছিলো আতাউর। জামিলকে সরিয়ে দেয়া মানে আমার এক পা পঙ্গু করে দেয়া। ওই আতাউর এটাই চেয়েছে ফুয়াদ। আমি ওকে বোঝাবো পঙ্গু কিভাবে করতে হয়। ওর দুই পা আমি পঙ্গু করে দেবো।"
_তুই কি পাগল হয়ে গেলি? মাথা ঠান্ডা কর। আইন আছে দেশে। যদি ও অপরাধ করে থাকে আইন ওকে শাস্তি দেবে।
সামিন ফুয়াদের কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে হেনার দিকে একবার তাকায়। দৃঢ়ভাবে বলে ওঠে,"তোমার স্বামীর জ্ঞান ফেরার আগে আমি আমার শোধ তুলবো।"
তারপর আরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,"হেনাকে বাড়িতে নিয়ে যা। রিতু আর ইশিতাকে বলবি সামিন ভাই ওর চূড়ান্ত যত্ন নিতে বলেছে।"
হেনা কিছু বুঝতে পারছে না সামিনের কথা। আরাফ বলে,"ভাবী ওঠেন। আরে ওঠেন তো। আমার ভাস্তিকে কেনো কষ্ট দিচ্ছেন। চলেন, জামিল ভাই কাল সকালের মধ্যে ভালো হয়ে যাবে।"
সবাই একপ্রকার জোর করে হেনাকে পাঠিয়ে দেয় আরাফের সাথে।
সামিন উঠে দাঁড়ায়। সবুজের দিকে তাকিয়ে বলে,"তুই জামিলের কাছে থাকবি।"
সবুজ মাথা নাড়ায়। রাহাত বলে,"কি করবো ভাই এখন?"
_আতাউরের গুষ্টি উদ্ধার।
ফুয়াদ বলে,"তুই কি করতে চাইছিস।"
সামিন ইয়াসার রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলে,"আতাউরের মেয়ে সানশাইন কোচিং সেন্টারে পড়ায় না? "
রাহাত মাথা নাড়ায়।
ইয়াসার বলে,"এখন রাত সাড়ে আটটা বাজে। ন'টায় কোচিং থেকে বের হয় ওই মেয়েটা। সাড়ে নয়টা নাগাদ ওই মেয়েকে আমাদের পার্টি অফিসে নিয়ে আসবি।"
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। ফুয়াদ চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,"পাগল হয়েছিস তুই? আ'গু'ন নিয়ে খেলতে চাইছিস।"
সামিন ফুয়াদের কথার উত্তর না দিয়ে রাহাত এবং দলের আরো দুজন ছেলেকে বলে,"কাজটা কিভাবে করবি তোরা ভাব। কিন্তু আমি এক ঘন্টার মধ্যে আতাউরের মেয়েকে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই।"
রাহাত কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে তার নেতার কথায়। কিন্তু কাজটা তাকে করতেই হবে।
ফুয়াদ রেগে গিয়ে সামিনকে বলে,"তোকে থেমে যেতে বলছি আমি সামিন।"
_সামিন থামবে না ফুয়াদ। সেদিন চ*ড় মারার পর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রত্যেকটা দিন ওই মেয়ে তার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে এসেছে
। মেয়ে মানুষ বলে নজর-আন্দাজ করে গিয়েছি। বেশি কিছু বলিনি। দুয়েকবার ভয় পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র। কিন্তু আজ যেটা হলো তার জন্য আতাউরকে অনেক বড় খেসারত দিতে হবে। মেয়র হবার স্বপ্ন ধুলিসাৎ করে দেবো আমি। ওর থেকে অনেক বড় দাম নিয়ে ছাড়বো। তুই যদি আমার সাথে থাকতে না চাস তাহলে বাড়ি চলে যা। নয়তো আমার সাথে পার্টি অফিসে চল।
***
"ম্যাম আসসালামুয়ালাইকুম। আসি। "
"ওয়ালাইকুমুস সালাম। সবাই হোমওয়ার্ক করে নিয়ে আসবে কাল। ঠিকাছে?"
_ঠিকাছে ম্যাম।
আলো হেসে তার পঞ্চমশ্রেনীর ছাত্র ছাত্রীদের বিদায় জানায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত আট-টা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। দশমিনিট আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছে আজ। কোচিংয়ের হেড ম্যাম মিনতি দেবী এসে বলে,"ছুটি দিয়ে দিয়েছো? বেশ নিচ তলায় এসে তবে,আমার সাথে চা খেয়ে যাও।"
আলো হেসে বলে,"না ম্যাম। আমি আসছি। আমার সামনে পরিক্ষা। পড়তে বসতে হবে বাড়িতে গিয়ে।"
মিনতি দেবীকে বিদায় জানিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে আলো। ইশমাম চৌদ্দবার ফোন দিয়েছে। আলো আনমনে হাসে। এই ছেলেটা এতো অদ্ভুত কেনো।
কলব্যাক করে কানে ধরতেই ইশমাম রিসিভ করে বলে,"কি করছিলে?"
আলো হেসে বলে,"তুমি তো জানো আমি কি করছিলাম ইশমাম। এতোবার ফোন দাও কেনো? দুইবার দিয়ে বসে থাকতে পারো না?"
ইশমাম হেসে বলে,"খুব অস্থির হয়ে যাই আমি। আসলে দূরে থাকি তো। তাই মনে হয় এই বুঝি আমাকে ঠকিয়ে কোনো বিসিএস ক্যাডার বিয়ে করে নিলে।"
আলো বলে,"ঢং দেখলে আর বাঁচি না।"
ইশমাম হেসে ফেলে। বলে,"ঠিকাছে। আর ঢং করলাম না। তুমি বাড়িতে যাও, সাবধানে যেও।"
"ইশমাম শোনো।"
ইশমাম ফোনটা কেটে দিতে যাচ্ছিলো। আলোর কথায় থেমে যায়।
"হ্যা বলো অদ্রিতা।"
_লাভ ইউ।
ইশমামের ঠোঁট প্রশস্ত হয়ে যায় হাসিতে। মৃদু স্বরে বলে,"লাভ ইউ টু।"
ফোন কেটে দিয়ে আলো এদিকে ওদিকে তাকায়। ব্যস্ত রাস্তাটাও আজ কেমন শুনশান হয়ে আছে। দুদিন ধরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পরছে। গা না ভিজলেও বেশ অস্বস্তিকর। আলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রিকশার জন্য। রাস্তা দিয়ে দুই একজন লোক যাওয়া আসা করছে। আলো কিছু না ভেবেই হাটা শুরু করে। হঠাৎ করে তার সামনে একটা বাইক এসে থামে।
আলো দাঁড়িয়ে পরে। হেলমেট সরিয়ে বাইক থেকে নেমে পরে রাহাত এবং রনি। আলো চমকে ওঠে। খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,"আপনারা!"
"হু আমরা।"
স্বাভাবিক কন্ঠে রাহাত বলে। আলো রেগে গিয়ে বলে,"কি চাই? পথ আটকে দাঁড়িয়েছেন কেনো?"
রনি বলে,"আমাদের কিছু চাই না। ভাই আপনার সাথে একটু সাক্ষাৎ করতে চায়।"
_ভাই মানে! কোন ভাই?
_ভাই তো একটাই! সামিন ইয়াসার ভাই। শিরায় শিরায় রক্ত,আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।
আলো গর্জে ওঠে,"ফাজলামি হচ্ছে? সরে দাঁড়ান পথ থেকে নয়তো এক্ষুনি ট্রিপল নাইনে ফোন দেবো আমি।"
রাহাত একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। ইতিমধ্যে সামিন ইয়াসারের গাড়ি এসে থামে। গাড়ি থেকে সামিন ইয়াসার নেমে আলোর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়। আলো সামিনকে দেখেই ক্ষেপে যায়। চেঁচিয়ে বলে," অ'স'ভ্য লোক, কি চাই আপনার?"
সামিন কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে রনিকে চোখ দিয়ে ইশারা করে। রনি আলোকে বলে,"চোখ বন্ধ করেন তো আপা।"
আলো চেঁচিয়ে বলে,"মানে?"
আরাফ মুখে 'চ' কারন্ত শব্দ করে পকেট থেকে একটা ছোট বোতল বের করে । আলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্প্রে করে দেয় আলোর মুখে। অচেতন হয়ে আলো লুটিয়ে পরে যেতে নেয় মাটিতে। রাহাত ধরে ফেলে।
"সাবধানে ধর ওকে। মেয়ে মানুষ।"
গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে ইয়াসার।
রাহাত মাথা নেড়ে আলোকে ধরে ধরে সামিনের গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশের সিট-টাতে বসিয়ে দেয়। অচেতন আলো কাত হয়ে পরে থাকে। আরাফ বলে,"ভাই এই মাত্র কি আমরা কি'ড'ন্যা'প করলাম?"
সামিন কোনো কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসে। রাহাত রনির কাছে বাইকের চাবি দিয়ে নিজেও গিয়ে সামিনের গাড়িতে ওঠে। সামিন আলোর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে। রাহাত বলে,"ভাই? আপনি না বলেছেন ওকে নিয়ে আপনার পার্টি অফিসে যেতে। আপনি নিজেই চলে এলেন যে।"
"সিদ্ধান্ত পাল্টেছি। এখন আমাদের বাড়িতে যাচ্ছি।"
রাহাত অবাক হয়,"বাড়িতে গিয়ে কি হবে ভাই? তাছাড়া ওকে নিয়ে কি করবেন আপনি? না মানে আপনার খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নেই তা আমি জানি কিন্তু একটা মেয়েকে এভাবে কি'ড'ন্যা'প করে,ভাই এটা তো ঘোর অপরাধ। ধরা পরলে জামিন নেই।"
সামিন কোনো কথা বলছে না। একমনে ড্রাইভ করতে থাকে। সে নিজেও জানে সে আগুন নিয়ে খেলছে কিন্তু খেলাটা তাকে শেষ করতেই হবে। ড্রাইভিং করতে করতে একবার সে আলোর মুখের দিকে তাকায়। কপালের কাছের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে মেয়েটার। অচেতন অবস্থায় একেবারেই নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতো লাগছে অথচ মেয়েটা কি প্রচন্ড তেজী, যেই তেজ ইয়াসারের অপছন্দ, ইয়াসার হজম করতে পারে না।
রাহাত পেছন থেকে বলে,"ইচ্ছা করছে দুই গালে দুইটা চ*ড় বসাই ভাই। ওর বাপ যে এতো বড় একটা শ'য়'তা'ন । কখনো বুঝতে পারিনি। "
আরাফ বলে,"ভাই কি করে জানি না। তবে আমি হলে অবশ্যই ওকে থা'প্প'ড় মারতে মারতে সব দাঁত বের করে নিতাম।"
রাহাত বলে,"ওকে আটকে রেখে আতাউরের কাছে টাকা চাইবেন ভাই? কিন্তু আপনার তো টাকার অভাব নেই।"
আরাফ বলে,"আরে ধূর। ওকে ভাই ভয় দেখাবে। ঠিক হবে, একেবারে ঠিক হবে। ওর বাপ উচিত শিক্ষা পাবে।"
রাহাত সামিনকে বলে,"কিন্তু ভাই ওকে ছেড়ে দিতেই তো পুলিশের কাছে বলে দেবে সব,আর ওর বাবা তো বসে থাকবে না।"
_কিচ্ছু করতে পারবে না।
গম্ভীর এবং তেজী কন্ঠে বলে ওঠে সামিন।
রাহাত এবং আরাফ কিছু না বুঝে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।
আলোর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে সামিন রাহাতকে বলে,"ওর ফোনটা বের কর ব্যাগ থেকে। আতাউরকে মেসেজ দিয়ে দে। দুই ঘণ্টা অন্তত নিশ্চিন্তে থাকুক। মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা না করুক।"
_আর দুই ঘন্টা পরে? তখন কি হবে?
সামিন ইয়াসার পৈশাচিক হাসি হাসে। তারপর ড্রাইভিং-এ মন দেয়।
***
পানির গ্লাস হাতে স্বামীর পেছনে এসে দাঁড়ায় রেহেনা। আতাউর আলম স্টাডি রুমে বসে কিছু কাগজপত্র দেখছিলো। রেহেনার পায়ের শব্দ পেয়ে মাথা তুলে তাকায়। রেহেনা বলে,"শুনছো। মেয়েটা তো এখনো এলো না। আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে।"
"দুশ্চিন্তার কিছু নেই। মেসেজে বলেছে ফিরতে রাত হবে। একটু ব্যস্ত সে। তুমি আবার অযথা ফোন দিয়ে বিরক্ত করো না। রেগে যাবে।"
_তুমি সবসময় মেয়েটাকে এভাবে লাই দাও। একটা বিপদ ঘটে গেলে তখন বুঝবে। এই পৃথিবী মেয়েদের জন্য কতটা খারাপ তা জানো না?
_জানি। তবে আমার মেয়ে তো সাধারণ কোনো মেয়ে নয়। ওকে আমি সাধারণ অন্য সব মেয়েদের মতো বড় করিনি।
রেহেনা বলে,"কি কাজ? জিজ্ঞেস করো মেসেজ দিয়ে। আর তেমন হলে আয়াত-আজানকে পাঠিয়ে দাও। ওরা নিয়ে আসবে আলোকে।
"তুমি যাও তো। একটু পরে আমিই গিয়ে নিয়ে আসবো ওকে। যাও তুমি।"
রেহেনা বেগম ঘরে থেকে চিন্তিত মুখ নিয়ে বের হয়। তার শরীরটা একটু একটু কাঁপছে। বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা অঘটন ঘটতে চলেছে।
***
বাড়ির নাম "শান্তিনীড়"। আগে ছিলো "মির্জা ম্যানশন"। সামিনের মা 'হোসনে আরা শান্তির' মৃত্যুর পরে সামিন এই নাম রেখেছে। সামিনের গাড়ির শব্দ পেয়ে বাড়ির কেয়ার টেকার পোনা এসে গেইট খুলে দেয়। পোর্চের কাছে এসে গাড়ি থামিয়ে সামিন নেমে পরে গাড়ি থেকে। পোনার দিকে তাকিয়ে বলে,"পোনা চাচা,ইশিতা আর রিতুকে ডেকে আনুন।"
পোনা মাথা নাড়িয়ে একছুটে দৌড়ে যায় ভেতরে। রাহাত এবং আরাফ নেমে দাঁড়ায়। তারা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে সামিন ইয়াসারের দিকে। ঠিক কি ঘটাতে চলেছে তাদের ভাই তারা সেটাই বুঝতে পারছে না।
ইশিতা আর রিতু বাইরে চলে এসেছে। ইশিতা কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। সে চোখ ডলতে থাকে। রিতু বলে,"ভাইয়া কিছু হয়েছে?"
সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"দরজা খুলে ওকে ভেতরে নিয়ে যাও।"
_কাকে?
ইশিতা অবাক হয়ে জানতে চায়।
_ভেতরে যে আছে তাকে।
ইশিতা আর রিতু হতভম্ব হয়ে গাড়ির দরজা খুলে চমকে ওঠে। ইশিতা একপ্রকার চেঁচিয়ে ওঠে,"মাই গড! এসব হচ্ছে কি ভাইয়া? এই মেয়েটা তো সে মেয়েটা। তোমাকে চ*ড় মেরেছিলো। আতাউর আলমের মেয়ে।"
সামিন চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। ইশিতা বলে,"এ এখানে কেনো? আর এভাবে ঘুমাচ্ছে কেনো। ভাইয়া প্লিজ পরিষ্কার করে বলো তো।"
ইলহাম এবং বাড়ির দু'জন মহিলা সার্ভেন্ট এসে দাঁড়িয়েছে পোর্চের নিচে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
সামিন ধমকের সুরে বলে ওঠে,"ও ঘুমাচ্ছে না। অচেতন হয়ে আছে। এতো কথার জবাব দিতে পারবো না। একে গেস্টরুমে নিয়ে যা নিচতলার। মুখে পানির ছাট মার, হুঁশ ফিরে পাবে।"
রিতু ভাসুরের ধমকে ভয় পেয়ে ইশিতাকে বলে,"আপু আগে ওনাকে ধরো। নিয়ে যাই ঘরে।"
তারপর মহিলা সার্ভেন্টদের দিকে ফিরে বলে,"তোমরাও আসো খালা।"
সবাই ধরাধরি করে আলোকে ঘরে নিয়ে যায়। ইলহাম হতভম্ব হয়ে বলে,"হচ্ছে টা কি ভাইয়া আসলে।"
_কিছু-ই হচ্ছে না। তবে হতে চলেছে।
ইলহাম কিছু বুঝতে পারছে না ভাইয়ের কথায়। সামিন আরাফের দিকে তাকিয়ে বলে ,"রনিকে ফোন দে। ওদিকের কি অবস্থা জেনে নে।"
***
কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে রেহেনা ছুটে এসে দরজা খোলে। দরজা খুলেই সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার সামনে ছয় থেকে সাতজন অচেনা ছেলে। আতাউর আলম বসার ঘরের দিকে আসতে আসতে বলতে থাকে,"কি? আলো এসে গিয়েছে? তুমি শুধু শুধু টেনশন....."
কথা থামিয়ে দিয়ে আতাউর আলম রনির দিকে তাকায়। রনি একটা মুচকি হাসি দিয়ে দলবল নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। আতাউর আলম চেঁচিয়ে বলে,"তোরা? তোদের সাহস তো কম না!"
_সাহসের তো কিছুই দেখেননি চাচা। আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত। আমাদের শিরায় শিরায় রক্ত, গরম রক্ত।
কথাটি বলেই রনি বাকি ছেলেদের বলে,"ওই নেংটি ইঁদুর দু'টোকে ধরে আন আগে।"
আজান আর আয়াত চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়ে বসার ঘরের দিকেই আসছিলো। দলের দু'জন গিয়ে ওদের দু'জনকে ধরে ফেলে।
আতাউর আলম ঘাবড়ে গিয়ে বলে,"ছাড় ওদের। ছাড় আমার ছেলেদের।"
রনি হেসে বলে,"ছেলেদের একটু ধরেছি বলে বি*চি একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে তাই না চাচা? তাহলে শুনুন চাচা। আপনার মেয়েকে কিছুক্ষণ আগে ইয়াসার ভাই তুলে নিয়ে গিয়েছে তার বাড়িতে।"
রেহেনা আর্তনাদ করে উঠে অচেতন হয়ে লুটিয়ে পরে মাটিতে। আতাউর আলম রনির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আজান আয়াত চেঁচিয়ে উঠে বলে,"বাবা আমাদের আপু!"
***
মুখে পানির ঝাপটা পরতে-ই আলো কপাল কুঁচকে ফেলে খানিকটা। বাড়ির কাজের খালা সিতারা রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"জ্ঞান ফিরতেছে মেজো ভাবি।"
রিতু অসহায়ের মতো আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ভীষণ মায়া হচ্ছে অচেনা এই মেয়েটার জন্য। কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সে পুরো ব্যপারটায়। তার ভাসুরকে সে যতটুকু চেনে তাতে সে জানে সামিন ইয়াসারের নারীর দোষ নেই। তাহলে এই মেয়েটিকে কেনো এনেছে তুলে। তবে কি রিতুর ধারণা ভুল! এই বাড়ির সব ছেলেরা-ই কি এক!
আলো ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায়। ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে শূন্যে। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে পরিস্থিতি অনুধাবন করে সে লাফিয়ে উঠে বসে। শরীরে কোনো শক্তি খুজে পাচ্ছে না সে । তার সামনে কতগুলো অচেনা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। আলো সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"আমি কোথায়?"
"আমার বাড়িতে।"
দরজার পর্দা ঠেলে ইয়াসার মির্জা ভেতরে ঢোকে। আলো ঘৃন্য কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে তাকায়। কিছুক্ষণ আগের সবকিছু তার মনে পরতেই একলাফে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। তার গায়ে কোনো জোর সে পায়না। সামনে পা বাড়াতেই মাথা ঘুরে পরে যেতে নেয়,ইশিতা গিয়ে ধরে ফেলে। আলো তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,"জা'নো'য়া'র ! তোর মতলব কি! আমাকে যেতে দে কু**** বা**।"
সামিন হেসে ফেলে। আলোর চিৎকার তার কাছে কিছুটা বাঁশির আওয়াজের মতো লাগছে শুনতে। রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"তোমরা বাইরে যাও। ওর সাথে আমার কথা আছে।"
ইশিতা চেঁচিয়ে ওঠে,"ভাইয়া। তুমি করতে চাইছো কি। বাবা কিন্তু রেগে যাবে খুব। তুমি এবার থামো। ওকে ওর বাড়িতে পাঠিয়ে দাও।"
সামিন কঠিন গলায় বলে,"তোদের বাইরে যেতে বলেছি। তিন সেকেন্ডের মধ্যে।"
আলো ইশিতার হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,"আপনারা প্লিজ যাবেন না। ওই লোকটা প্রচন্ড খারাপ। প্লিজ যাবেন না আপনারা।"
ইশিতা নিরুপায়। আলোর থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রিতুর সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আলো কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পরে। সামিন আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা চেয়ার টেনে আলোর মুখোমুখি বসে।
তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,"আমার বাবা সৎ,আমার বাবা মহৎ। এমন টা-ই বলো না তুমি সবসময়? তোমার এই অবস্থার জন্য ফিফটি পার্সেন্ট তোমার ওই সুপার হিরো দায়ী আর বাকি ফিফটি পার্সেন্ট তুমি নিজে।"
আলো কান্না থামিয়ে বলে,"চাস কি তুই?"
সামিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। তখনি ফুয়াদ এবং রাহাত এসে ঘরে ঢোকে। তাদের পিছু পিছু ঢোকে ইলহাম এবং আরাফ।
আলো সেদিকে তাকায়। সামিন ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,"কাজী এসে গিয়েছে?"
ফুয়াদ একবার আলোর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। আলো হতভম্ব হয়ে সামিনের দিকে তাকায়। রাহাত আরাফ অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ইলহাম বলে,"ভাইয়া কাজী এসেছে কেনো? কাজী কি করবে?"
_বিয়ে পড়াবে।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন। ইলহাম হতভম্ব হয়ে বলে,"বিয়ে পড়াবে মানে? কার বিয়ে?"
আলোর দিকে নিজের তর্জনী আঙ্গুল তুলে তেজী কন্ঠে সামিন ইয়াসার মির্জা বলে,"ওর আর আমার।"
ফুয়াদ বাদে সবাই হতবাক হয়ে সামিনের মুখের দিকে তাকায়। আলো আতঙ্কিত হয়ে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায়। বিকট শব্দে চেঁচিয়ে বলে," জা'নো'য়া'রে'র বাচ্চা। তোর সাহস কিভাবে হয়...."
সবাইকে পুনরায় অবাক করে দিয়ে সামিন আলোকে একটা চ*ড় মারে। চ*রের ধাক্কা সামলাতে না পেরে আলো লুটিয়ে পরে যায় মাটিতে। গালে হাত দিয়ে, মাথা তুলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখে সামিনকে।
রাহাত কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"ভাই! এটা কেমন ধরনের প্রতিশোধ। বিয়ে করবেন কেনো?"
সামিন শুকনো হাসি হাসে। আলো তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,"কখনোই না। তোর মতো পশুকে বিয়ে করবো না আমি।"
সামিন ইয়াসার আলোর দিকে খানিকটা ঝুকে বলে,"চ*ড় খেয়েও তেজ কমেনি দেখছি। ফুয়াদ,কাজীকে ভেতরে আসতে বল।"
ইলহাম এতক্ষনে সবটা বুঝতে পেরে আনন্দিত গলায় বলে,"এক্সিলেন্ট ভাইয়া। এই না হলে আমার ভাই! সাত বছর আগে ওর বাপ আমাদের পরিবারের সাথে যা করেছে তার উপযুক্ত শাস্তি এটা। ভেরি গুড ভাইয়া।"
ইলহাম খুশি হলেও,খুশি হয়না রাহাত এবং আরাফ। তারা তাদের নেতার বৌ হিসেবে আলো নামের ওই মেয়েটিকে মানতেই পারবে না। রাহাত বলে,"ভাই । এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। বিয়ে কোনো ছেলে খেলা?"
_তোদের তো খুশি হবার কথা রাহাত, বিয়ে করেন বিয়ে করেন বলে কানের পোকা বের করে দিতি আমার।
_ভাই তাই বলে এই মেয়ে? আতাউরের মেয়ে?
সামিন গম্ভীর গলায় বলে,"হ্যা আতাউরের মেয়ে।"
আলো উঠে গিয়ে সামিনের কলার ধরে। ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,"এক্ষুনি যেতে দে আমাকে। এক্ষুনি।"
কথাটি বলে অনবরত কিল ঘুষি মারতে থাকে সামিনের বুকে। কিন্তু তাতে সামিনের বলিষ্ঠ শরীরে কোনো প্রভাব পরে না। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
ফুয়াদ কাজীকে নিয়ে ঘরে ঢোকে। কাজী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকায়। এখানে কি হচ্ছে তার বোঝার দরকার নেই। কোনোমতে বিয়েটা পরিয়ে কেটে পরবে সে। এই বাঘের গুহায় বেশিক্ষণ থাকলেই বিপদ।
কাজী বিয়ে পরাতে শুরু করে। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"কবুল বলতে বললে কবুল বলবে মা।"
_আমি কবুল বলবো না।
চেঁচাতে থাকে আলো। সামিন আলোর চোয়াল চেপে ধরে বলে,"কবুল বলবে তুমি,দেরী করলে তোমার ক্ষতি।"
আলো নিস্তেজ হয়ে পরে, অস্ফুট স্বরে বলে,"আমায় বিয়ে করে লাভ টা কি হবে আপনার?"
_সেটা পরে বুঝতে পারবে।
আলোর চোয়াল ছেড়ে দিয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,"রনিকে ভিডিও কল দে। বিয়ের আগে বাপ-বেটিতে মোলাকাত করে নিক। তারপর কখনো দেখা হয় কি না কে জানে।
আরাফ মাথা নাড়িয়ে রনিকে ফোন দেয়। রনি রিসিভ করে আতাউর আলমের সামনে রেখে দেয় ফোনটা। আলো চেঁচিয়ে ওঠে,"আব্বু।"
আতাউর আলম কাঁদছে। তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোচ্ছে না।
আলো কাঁদতে কাঁদতে বলে,"আব্বু,ওরা আমাকে।"
_তুমি কবুল বলে দাও আম্মু।
আলো আহত চোখে বাবার দিকে তাকায়। আতাউর আলম চোখ মুছে বলে,"নয়তো আজান-আয়াতকে মেরে মিউনিসিপ্যালিটির ড্রেনে ফেলে রাখবে ওরা। তুমি কবুল বলো।"
সামিন উঠে এসে ফোন কেড়ে নিয়ে আতাউর আলমকে বলে,
" সবসময় কি যেনো বলতে? আমরা সরকারি দল। আমরা ক্ষমতার অপব্যবহার করি। ক্ষমতার অপব্যবহার এটাকে বলে আতাউর আলম। চুপচাপ ওখানে বসে তোমার মেয়ে আর আমার বিয়ে দেখবে। চোখ সরিয়েছো কি তোমার ওই ছেলে দুটোকে মেরে বড় বাজারের ব্রিজের কচুরিপানার নিচে ফেলে দিয়ে আসবো।"
আলোর শরীরটা যেনো অসাড় হয়ে যাচ্ছে। সামিন ইয়াসার আলোর দিকে একবার তাকিয়ে কাজীকে ধমকে বলে,"থামলেন কেনো? বিয়ে পড়ান। পাত্র সামিন ইয়াসার মির্জা,পিতা ইমতিয়াজ মির্জা। পাত্রী অদ্রিতা আলো,পিতা আতাউর আলম।"
কাজী একটা ঢোক গিলে মাথা নাড়ায়। পুনরায় বিয়ে পড়াতে থাকে। আতাউর আলম ওপাশে বসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ইচ্ছে করছে গলায় ফাঁস নিতে। আলো শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
কাজী ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে বলে,"কবুল বলো বাবা।"
ইয়াসার আলোর দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলে,"কবুল।"
কাজী এবার আলোকে বলে,"মা কবুল বলো।"
আতাউর আলম চেঁচিয়ে ওঠে,"কেনো করছো ইয়াসার! আমি তো বলেছি আমি নির্বাচন বর্জন করবো ইয়াসার। প্রয়োজনে আমি তোমার পা ধরে মাফ চাইবো ইয়াসার। আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। ও আমার খুব আদরের।"
ইয়াসার শুকনো হাসি হেসে বলে,"জানি তো। সেজন্যই তো বিয়ে করছি। আপনার আদরের জামাই হবো বলে।"
আতাউর আলম কান্নায় ভেঙে পরে।
কাজী বলতে থাকে,"এই মেয়ে তো কবুল বলছে না বাবা।"
ইয়াসার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রনিকে বলে,"রনি। ওর দু'টো ভাইয়ের মধ্যে একটাকে রেখে আরেকটার গ'লা'য় ছু*রি বসিয়ে দে তো।"
আলো কেঁপে ওঠে। ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,"কবুল।"
স্ত্রীর মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে গালে হাত রেখে ধরা গলায় ডাকতে থাকে আতাউর আলম।
"ও রেহেনা। ওঠো। রেহেনা।"
রেহেনা সাড়া দেয় না। দীর্ঘসময় ধরে সে অচেতন হয়ে পরে আছে। আজান আয়াত মায়ের পায়ের কাছে বসে আছে। ভেতরের ঘর থেকে আতাউর আলমের মা রিনরিনে গলায় চেঁচিয়ে যাচ্ছে,"আতাউর। এতো চিল্লাচিল্লি কে করে? ও আতাউর,তোর পোলাপান এতো চিল্লাচিল্লি ক্যান করে। ওগোরে ধমক দে।"
রনি ছু'ড়ি টা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে আতাউর আলমকে বলে,"জামিল ভাইয়ের যায়গায় আইসিইউতে যদি আজ ইয়াসার ভাই থাকতো তাহলে এখানে আজ পাঁচটা লা'শ পরে থাকতো।"
আতাউর আলমের কানে সেকথা পৌঁছায় না। সে স্ত্রীর জ্ঞান ফেরাতে ব্যস্ত।
রনি তৌফ নামের ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"শাওন কই? সামান্য মিষ্টি আনতে এতো দেরি?"
শাওন একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢোকে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,"মুসলিম পাড়ায় গিয়ে একটা দোকান খোলা পেলাম। সব শা*লা বন্ধ।"
_হু,তারা তো আর জানে না আমাদের ভাই আজ বিয়ে করবে। তাহলে খোলা থাকতো।
তৌফ নামের ছেলেটা দাঁত বের করে বলে,"ভাই এই আতাউর আলম আর তার বৌ আজ থেকে আমাদের তাঐ-মাঐ।"
রনি পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বলে,"হু,আর ওই ফ'ট'কা চালাক মেয়েটা আমাদের ভাবী। আমার তো ভাবতেই রা'গ উঠে যাচ্ছে গায়ে। ভেবেছি ভাই কত মিষ্টি দেখে একটা ভাবী এনে দেবে আমাদের।"
_সুন্দর আছে তো ভাই। খারাপ না। মিষ্টিই তো দেখতে।
তৌফ হাসতে হাসতে বলে।
রনি বলে,"হু, দেখতে মিষ্টি কিন্তু ভয়ানক ঝা'ল। ভাই একে কিভাবে সামলাবে কে জানে।"
সিগারেটে এক টান দিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিচু হয়ে ঝুঁকে বসে রনি, আতাউরের চোখে চোখ রেখে বলে,"থানা পুলিশ করবেন না তা জানি তবুও বলছি। থানা পুলিশ করার চিন্তাও করেছেন তো ওখানে আপনার মেয়েকে ইয়াসার ভাই এমন যায়গায় পু*তে দেবে,মেয়ের লা'শ-ও খুঁজে পাবেন না। আর চাচা...সরি...তাঐ, আপনার ছেলে দুটো অনেক ব্রিলিয়ান্ট। ওদের ডাক্তার বানাবেন। ওরা এতো অল্প বয়সে প্রা'ন হারালে এই দেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।"
আতাউর আলম আতঙ্কিত মুখ নিয়ে রনির দিকে তাকায়, ফিসফিসিয়ে বলে,"বলবো না। কাউকে কিছু বলবো না।"
দু'চোখ বেয়ে তরল গড়িয়ে পরে আতাউর আলমের। আজ সে ভয়ানক অসহায়। একজন অসহায় বাবা।
"গুড। এবার তাহলে উঠি তাঐ? ওদিকে ভাই আর ভাবীর বাসর সাজাতে হবে গিয়ে। হাতে মেলা কাজ।"
রনি শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে সবাইকে বলে,"চল।"
তারপর আতাউর আলমের দিকে তাকিয়ে বলে,"মাঐ মা-এর জন্য একজন ডাক্তার পাঠিয়ে দিচ্ছি। ইয়াসার ভাইয়ের শাশুড়ি এভাবে অজ্ঞান হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পরে আছে,শুনলে ইয়াসার ভাই খুব রেগে যাবে। আসছি তাঐ। আসসালামুয়ালাইকুম।"
রনির পিছু পিছু দলের সবাই দাঁত বের করে ঘর থেকে বের হয়। আতাউর আলম তার স্ত্রীর মাথায় হাত দিয়ে সদর দরজার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে পাথরের মতো।
***
কাজী-কে ফুয়াদ বিদায় দিয়ে পুনরায় ঘরে ঢুকে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"হয়েছে শান্তি?"
সামিন ইয়াসার থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে। আড়চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে আলোকে দেখে। মেয়েটাকে কেমন বিধ্বস্ত লাগছে। মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।
রাহাত এবং আরাফ শুকনো মুখে তাদের নেতাকে দেখছে। তাদের পুরো ব্যাপারটা হজম করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। ইয়াসার উঠে দাঁড়িয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,"রাত সাড়ে তিনটা বেজে গিয়েছে। ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ। নয়তো জামিলের কাছে যেতাম। ওর কি অবস্থা এখন? ডাক্তার কি বলেছে?"
আরাফ বলে,"সেই একই কথা। বাহাত্তর ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।"
সামিন ইয়াসার চোখ মুখ শক্ত করে আলোর দিকে তাকিয়ে ধমকের সাথে বলে,"এইযে নিষ্পাপ বাপের নিষ্পাপ কন্যা। এদিকে তাকাও।"
আলো তাকায় না। সামিন ধমক দিয়ে বলে,"তাকাও বলছি।"
আলো এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকায়। তার সামনে সাক্ষাৎ একজন পি'শা'চ দাঁড়িয়ে। সামিনের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে আলো তাকিয়ে থাকে। সামিন ফিচেল হেসে বলে,"বাড়ির মহিলাদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। যেকোনো ধরনের অসুবিধা তাদের সাথে বলবে। তবে কোনো তিড়িং বিড়িং করবে না। কাউকে অসম্মান করে কথা বলবে না। বেয়াদবি করবে না। যদি আমার কানে আসে তাহলে কিন্তু!"
_কি করবি তুই? ক্রি'মি'না'ল একটা!
আলো কান্না মিশ্রিত কন্ঠে কথাটি বলে তেড়ে এসে সামিনকে চ'ড় মারতে চায়। সামিন হাত ধরে ফেলে আলোর। সবাই ওদের দেখছে। সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,"এতো শক্তি অপচয় করো না।"
তারপর রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলে,"আয় আমার সাথে।"
রাহাত, ইলহাম এবং আরাফ সামিনের পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ফুয়াদ আলোর দিকে তাকিয়ে আছে,আমতা আমতা করে বলে,"আলো। দেখো মেয়ে,তুমি এভাবে কেঁদো না। সামিন কিন্তু খারাপ ছেলে না।"
"তুই এখান থেকে যা কু'ত্তা"
আলো চেঁচিয়ে ওঠে। ফুয়াদ একটা ঢোক গিলে ফেলে। সামিন হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসে আবারো। চেঁচিয়ে বলে,"কি হচ্ছে ফুয়াদ? ও তোকে কু'ত্তা বললো?"
ফুয়াদ সামিনকে আটকায়,"বাদ দে। চল এখান থেকে।"
সামিন দাঁত খিচিয়ে আলোর মুখোমুখি দাঁড়ায়, পেশীবহুল শক্তিশালী হাতে আলোর থুতনি ধরে নাড়া দিয়ে বলে,"একেবারে জবান কম চালাবে। এটাই প্রথম,এটাই লাস্ট। মনে থাকে যেন।"
কথাটি বলে সামিন চলে যায়। ফুয়াদ তার পিছু পিছু বেড়িয়ে যায়।
আলো আবারো মেঝেতে বসে পরে। তার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখের সামনে তার আব্বু,আম্মু,আয়াত,আজান, দাদী এবং ইশমামের ছবি ভেসে উঠছে। ইশমামের কথা মনে পরতেই আলো ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে সে অনুভব করলো সে শ্বাস নিতে পারছে না। গলা থেকে অনেক কষ্টে ফিসফিসিয়ে একটি শব্দ বের হলো। আর সেটা হলো,"ইশমাম।"
***
লিভিং রুমে বাড়ির সব মেয়েরা দাঁড়িয়ে। সামিনকে গেস্টরুম থেকে বের হতে দেখে ইশিতা দৌড়ে যায়,ভাইয়ের দুই বাহু ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে,"কেনো করলে ভাইয়া? ছিঃ। তুমি আমার বড় ভাইয়া? যাকে আমি এতো ভালোবাসি? এ তোমার কোন রূপ ভাইয়া।"
ইলহাম বিরক্ত হয়ে বলে,"ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না। ভাইয়াকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও কেউ।"
সিতারা দৌড়ে রান্নাঘরে চলে যায়। সামিন ইশিতার দিকে তাকায়। ইশিতা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"বাবা চেন্নাই থেকে ফিরলে কি বলবে তুমি? বলো!"
সামিন ম্লান হেসে বলে,"বাবা খুশি হয়ে যাবে। মেয়ে তুলে এনে বিয়ে করা, উঠিয়ে নিয়ে আসা, এসব এবাড়ির ঐতিহ্য। আমি আমার বাড়ির ঐতিহ্য রক্ষা করেছি। ভুলে গেছিস নাকি? শুনিসনি আমার বাপ-চাচারা সবাই তুলে এনে বিয়ে করেছিলো? বাবা মাকে তুলে এনে বিয়ে করেছিলো, আমাদের দাদা ইন্তেখাব মির্জাও তো দাদীকে তুলে এনেছিলো। এ প্রজন্ম থেকে আমি না হয় এই ঐতিহ্য-টা চর্চা করলাম। "
ইশিতা আহত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়। ইয়াসার ইশিতার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"রিতু।"
রিতু ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,"জ্বি ভাইয়া।"
_তুমি এ বাড়ির কি?
_মেজো বৌ ভাইয়া।
_ঐ ঘরের ভেতরে যে আছে সে তোমার বড় জা। এ বাড়ির বড় বউ। আমার মা জীবিত থাকলে এ বাড়ির বড় বউকে বরন করে নেওয়ার জন্য যা যা করতো সে দায়িত্ব আমি তোমার কাঁধে দিলাম। আশাকরি তুমি তোমার দায়িত্ব খুব সুন্দর ভাবে পালন করবে।
রিতু বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। ইশিতার মতো প্রতিবাদ জানানোর সাহস, অধিকার,ক্ষমতা কোনটিই যে তার নেই।
_আর,ওকে কিছু খাবার দাও আগে। খেতে না চাইলে আমাকে ডাকবে। কোনো ধরনের বাজে ব্যবহার কিংবা গালাগাল দিলে দেরি না করে আমাকে ডাকবে।
রিতু আবারো মাথা নাড়ায় ভাসুরের কথায়।
ইশিতা ভাইয়ের দিকে একঝলক রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে কপাল কুঁচকে দোতলায় চলে যায়। দোতলায় উঠে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে সে।
ইলহাম হেসে সামিনকে বলে,"ওর বান্ধবী রিদিকে পছন্দ করে রেখেছিলো তোমার জন্য। সেজন্য রাগ হচ্ছে ওর তোমার উপর।"
ইতিমধ্যে হেনা এসে লিভিং রুমে দাঁড়ায়। শরীরটা অসহনীয় যন্ত্রণায় বিষিয়ে উঠেছে তার। ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,"ভাইয়া! এটা কি করলেন আপনি। একটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করে দিলেন। জামিল সুস্থ হবে এতে?"
সামিন নরম গলায় বলে,"ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও। এতসব চিন্তা মাথায় নিও না। জামিলের বাচ্চার ক্ষতি হবে।"
সিতারা এসে সামিনের সামনে পানির গ্লাস হাতে দাঁড়ায়। সামিন গ্লাসের দিকে একবার তাকিয়ে হনহন করে নিচতলার বারান্দায় চলে যায়।
রিতু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইলহাম ধমক দিয়ে বলে,"ভাইয়া কি বললো শুনতে পাওনি? খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছো যে! "
রিতু আমতা আমতা করে বলে,"কি করবো!"
_কি করবে মানে? ওকে সাজাবে। সাজিয়ে ভাইয়ার ঘরে দিয়ে এসো।
রিতু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,"মেয়েটা ভয় পেয়ে আছে । একটু ঠিক হোক।"
ইলহাম চোখ রাঙিয়ে রিতুর দিকে তাকায়। রিতু একটা ঢোক গিলে বলে,"যাচ্ছি।"
***
দরজার নব ঘোরার সাথে সাথে আলো মাথা তুলে তাকায়। তার দৃষ্টি ঘোলাটে। শরীরে বিন্দু পরিমাণ শক্তি অবশিষ্ট নেই। দরজা ঠেলে রিতু এবং বাড়ির দু'জন হেল্পিং হ্যান্ড ( সিতারা এবং ফুলির মা ) ভেতরে ঢোকে। রিতুর হাতে একটা প্যাকেট। সিতারার হাতে একটা প্লেটে কিছু খাবার। ফুলির মা ঘরের এসি অন করে দিয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"হেরে কি ডাকবো ভাবী?"
_কি ডাকবে আবার। বড় ভাবী ডাকো।
ফুলির মা আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"মাশাআল্লাহ। চেহারা সুরত তো খুবই চমৎকার। গায়ের রং টা একটু চাপা। তয় বড় ভাইজানের পাশে খুব মানাইবো।"
আলো নড়েচড়ে বসে। রিতুর দিকে তাকায়। রিতু আলোর সামনে এসে হাতের প্যাকেট-টা আলোর পাশে রেখে নিজেও মেঝেতে বসে পরে আলোর মুখোমুখি।
কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে হাত বাড়িয়ে সিতারার হাত থেকে খাবারের প্লেট টা নেয়।
আলো চোখ নামিয়ে প্লেটের দিকে তাকিয়ে রিতুর মুখের দিকে তাকায়। ফ্রিজে কাস্টার্ড রাখা ছিলো। সেখান থেকে খানিকটা নিয়ে এসেছে আলোর জন্য। এক চামচ উঠিয়ে আলোর মুখের কাছে ধরে বলে,"খেয়ে নিন।"
আলো মুখ সরিয়ে নিয়ে কঠিন গলায় বলে,"খাবো না। নিয়ে যান এসব।"
_ভাইয়া রেগে যাবে। খেয়ে নিন।
আলো এক ঝটকায় রিতুর হাত থেকে চামচ ফেলে দিয়ে কাস্টার্ডের বাটি উল্টে ফেলে।
সিতারা এবং ফুলির মা চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,"মেজো ভাবী,বড় ভাইজানরে ডাকবো?"
রিতু ওদের থামিয়ে দিয়ে বলে,"না।"
তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"ঠিকাছে। খেতে হবে না।তাহলে এই শাড়িটা পরে নিন। আপনার ফিগার মনে হলো আমার মতোই। ব্লাউজ আর পেটিকোট ফিট হয়ে যাবে।"
আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"কেনো পরবো আমি শাড়ি?"
_কারন আপনি নতুন বৌ তাই। এটা আপাতত পরে নিন। এগুলো একেবারেই নতুন,যদিও আমার। কাল আপনার জন্য শপিং করা হবে।
আলো শপিং ব্যাগটা উঠিয়ে দূরে ছুড়ে মেরে রিতুর দিকে তাকায়। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,"আপনি না একটা মেয়ে? আমাকে আপনি বুঝতে পারছেন না?"
_পারছি। আপনাকেও পরিস্থিতি বুঝতে হবে। বোকা বোকা জেদ করে কিছু হবে না। শাড়িটা পরে নিন। আপনাকে ভাইয়ার ঘরে দিয়ে আসবো।
আলো তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,"অসম্ভব। আমি ম'রে গেলেও ঐ জা'নো'য়া'রের ঘরে যাবো না। ম'রে গেলেও না।
রিতু আলোর দিকে তাকায়। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,"ম'রে গিয়ে লা'শ হয়ে গেলেও ঐ ঘরে আপনাকে যেতে হবে। এ বাড়ির বৌ হয়েছেন, এ বাড়ির নিয়ম জেনে নিন। ম'রে যান অথব বেঁচে থাকুন। স্বামীর শোবার ঘরে আপনাকে যেতেই হবে।
আলো ছলোছলো চোখে তাকিয়ে আছে রিতুর দিকে। রিতু উঠে শপিং ব্যাগটা তুলে নিয়ে এসে একটা গোলাপী রঙের সুতির শাড়ি বের করে। আলোর গলা থেকে ওড়নাটা টেনে নিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে বলে,"আমি শাড়িটা পরিয়ে দিচ্ছি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। আমি চাইনা আপনি মা'র খান। তাই বলছি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন।
***
ফজরের আজানের সময় হয়ে এসেছে। আতাউর আলম রেহেনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আজান আয়াত মায়ের পায়ের তালুতে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। রেহেনা কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ডুকরে কেঁদে ওঠে। আতাউর আলম স্ত্রীর মাথাটা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"শান্ত হও রেহেনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। সব কিছু।"
রেহেনা ফোপাতে থাকে,"কি ঠিক হবে? আমার মা'টা আমার বুকে ফিরবে? আমার প্রানটা বুঝি বেরিয়ে গেলো আলোর আব্বু। আমাকে শক্ত করে ধরো।"
মায়ের কথায় আজান-আয়াত ফুঁপিয়ে ওঠে। রেহেনা মাথা তুলে স্বামীর দিকে তাকায়,হঠাৎ করে স্বামীর বুকে কি/ল ঘু/ষি মারতে মারতে বলতে থাকে,"সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী। এতো বার বলেছি রাজনীতি নামের ম'র'ন খেলায় নেমো না,নেমো না। তোমার ক্ষমতার লোভে আমি আমার মেয়েটাকে হারালাম। তুমি দায়ী আলোর বাবা। তুমি আমার মেয়েটাকে এনে দাও।"
রেহেনা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দেয়। আতাউর আলম স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। আসলেই কি সবকিছুর জন্য সে দায়ী?
****
"ভাই!"
রাহাতের ডাকে সামিন পেছন ফিরে তাকায়। হাতের সিগারেট টা ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পি'ষে দেয়। স্বাভাবিক গলায় বলে,"রনি এসেছে?"
_হু ভাই।
_খবর কি ওদিকের?
_আতাউরের স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। রনি ডাক্তার পাঠিয়ে দিয়েছে।
_গুড, একেবারে আমার ছেলেদের মতো কাজ করেছে। এই রনিকে পুরষ্কার দিতে হবে।
রাহাত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আরাফ এবং ফুয়াদ চলে আসে। সামিন ইয়াসার বলে,"তোরা এখন এখানে থেকে যা,নিচতলায় রেস্ট নে। ভোর হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে এখান থেকে সোজা হসপিটাল যাবো। ক্যাম্পেইন করতে হবে না আর। নির্বাচনে আমিই জিতবো।"
রাহাত অনেকটা জড়তা নিয়ে বলে,"ভাই বিয়ে তো করে নিলেন এখন কি করবেন?"
_সংসার।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন ইয়াসার। ফুয়াদ বলে,"তোকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি। তুই একটা অমিমাংসিত রহস্য।"
সামিন ফিচেল হাসে। ফুয়াদ বলতে থাকে,"আজ কত বড় একটা অন্যায় করলি তুই জানিস? কোনো ক্ষ/মা নেই এর।"
_তোরাও আমাকে সাহায্য করেছিস। তোদের ও কোনো ক্ষ/মা নেই।
ফুয়াদ চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,"আমার জীবনের চরম দুর্ভাগ্য তোর মতো বন্ধু পাওয়া।"
সামিন শুকনো হাসি হাসে, তারপর ওদের সবার দিকে তাকিয়ে বলে,"আর আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য তোর মতো বন্ধু আর ওদের মতো কিছু ছোট ভাই পাওয়া। এখন পকপক না করে দুঘন্টা রেস্ট নে। শরীরে শক্তি যোগান দে। আমি মেয়র হলে খুশিতে নাচতে হবে তো!"
রাহাত,আরাফ এবং ফুয়াদ চলে যায়। সামিন নিচতলার বারান্দার রেলিং ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তার দৃষ্টি বাইরের বাগানের দিকে। এই বাগানটা সামিনের নিজের হাতে করা,নিজেই সবসময় যত্ন করে বাগানের। ফুলের গন্ধে ছেয়ে গেছে আশপাশ টা। সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়। পেছন থেকে রিতু নিচু স্বরে ডাকে,"ভাইয়া।"
সামিন বাগানের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,"বলো রিতু। কিছু বলেছে? গালাগাল করেছে তোমাকে?"
_না ভাইয়া।
_খেয়েছে? কি খেতে দিয়েছিলে?
_কাস্টার্ড। খায়নি।
_আচ্ছা না খাক, ঘরে কিছু খাবার রেখে এসো। খিদে পেলে খেয়ে নেবে।
রিতু কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে,"আপনার ঘরে যেতে চাচ্ছে না।"
সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"কে?"
_ওই মেয়েটা......মানে ভাবী।
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"তুমি যাও। ইহান হয়তো এখন উঠে যাবে। ঘরে যাও। আমি দেখছি!"
***
দরজা ঠেলে সামিন ভেতরে ঢোকে। পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে আছে।আলো হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে ঘরের এক কোনায় বসে আছে। সামিন সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দেয়। আলো মাথা তুলে তাকিয়ে সামিনকে দেখে।
সামিন নরম গলায় বলে,"খাওনি কেনো? সামিন ইয়াসার আর ২৪ ঘন্টা পেরোলেই এই শহরের মেয়র হবে,তার শহরে কেউ অভুক্ত থাকুক তা সামিন ইয়াসার মির্জা চায় না।"
কথাটি বলেই সামিন হাসে। তার সে হাসিতে ছিলো আলোর প্রতি বিদ্রুপ। আলো উঠে দাঁড়ায়। তার পরনে শাড়িটা এলোমেলো হয়ে আছে। রিতু কোনোমতে পরিয়ে দিয়ে গিয়েছে। আলো সরাসরি সামিনের চোখে চোখ রেখে বলে,"তুই একটা জা'নো'য়া'র। পি'শা'চ তুই একটা।"
_গলাবাজি ভালোই করতে পারো তুমি। তোমার বাবার থেকে শিখেছো। আমি তোমার বাবার কান্ডজ্ঞান দেখে অবাক হচ্ছি। নিজের পরিবারের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ অথচ সে চললো জনগনের নিরাপত্তা দিতে। মেয়রের দায়িত্ব শুধু বর্ষাকালে সিটি কর্পোরেশনের অলিতে গলিতে মশার ওষুধ স্প্রে করা অথবা শীতকালে কম্বল বিতরণ করা না। আর তার বোকা বোকা কাজ দেখে আরো অবাক হতে হয়। আমাকে না কু'পি'য়ে নিরপরাধ ছেলেটাকে কু'পি'য়ে'ছে।
_আমার বাবা কিচ্ছু করে নি। আমার বাবা কিচ্ছু করেনি।
চেঁচাতে থাকে আলো। সামিন ম্লান হেসে বলে,"ক্ষমতার লোভ কাউকে জেকে ধরলে সে কতদূর নিচে নামতে পারে তা আমি জানি। শোনো সৎ বাবার সৎ কন্যা। তুমি ঠিকই বলেছ,আমি একটা পি'শা'চ। এই পি'শা'চের আরো পৈশাচিক রূপ দেখতে চাও? জানি চাও না। ভালোয় ভালোয় বলছি ওখানে যে খাবারটা রাখা আছে চুপচাপ খেয়ে নাও,নয়তো সেই রূপটাও দেখাবো।"
আলো চুপ করে সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন বলে,"চোখ নামাও। মেয়ে মানুষের চোখ সবসময় নিচু হয়ে থাকবে।"
তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,"মাথা মোটা বাবার মাথা মোটা কন্যা। কোন সাহসে তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছিলে জানা নেই। তবে তুমি নিজেই সেদিন নিজের জন্য খাল কেটে রেখেছো । প্রত্যেকটা দিন আমাকে অপমান জনক কথা বলে সেই খালে একটু একটু করে পানি দিয়েছো, আজ কুমির তোমার খালে প্রবেশ করেছে।"
_আপনি একটা জা'হি'ল।
নিস্তেজ কন্ঠে বলে আলো।
_খাবার টা খেয়ে নাও।
_খাবো না।
_খেয়ে নাও।
_খাবো না।
_খেয়ে নাও।
_বললাম তো খাবো না।
সামিনের রাগ উঠে যায়। আলোর দিকে এগিয়ে যায় সে। আলো তেজী কন্ঠে বলে,"এদিকে এগোলে কিন্তু!"
_কি করবে তুমি?
সামিনকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে আলো সামিনের মুখের উপর থুতু ছুড়ে মারে। ক্ষোভে সামিন হাত উঠায় আলোকে চ*ড় মারবে বলে। তৎক্ষণাৎ আলো নিজের গালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে। সামিন থেমে যায়। চ*ড় না মেরে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে সে। আলো গালে হাত দিয়ে,চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
নয় ঘন্টা আগে শেষ অনলাইনে এসেছিলো অদ্রিতা। দশমিনিট পরপর ইশমাম ফোন হাতে নিয়ে চেক করে দেখেছে অদ্রিতা অনলাইনে এসেছে কিনা। কিন্তু প্রত্যেকবার ফোন হাতে নিয়ে হতাশ হয়েছে সে। ফোনটা একটা ডিভানের উপরে ছুঁড়ে মেরে ইশমাম বসে থাকে চুপচাপ। আলোর প্রতি প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। রাতে বাড়িতে এসে একটা বার ফোন দিয়ে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি সে। নিশ্চয়ই এসেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। বড্ড ঘুমকাতুরে মেয়েটা। ইশমামের সারাটা দিন কেটেছে অস্থিরতায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ইশমাম সময় দেখে, সন্ধ্যা ছয়টা। তারমানে বাংলাদেশে এখন সময় সকাল পাঁচটা। এতো সকালে অদ্রিতা ঘুম থেকে ওঠার মেয়ে নয়। কি জানি কখন ঘুম ভাঙবে মহারানীর, কি জানি কখন মনে পরবে তার যে তার একটা ফোনের জন্য কেউ অপেক্ষা করে বসে আছে।
***
সামিন আলোর মুখের দিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকে। আলো নিজের গালে কোনো চ*ড়ের অস্তিত্ব টের না পেয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায়। তাকিয়ে দেখে পি'শা'চ টা তার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে তাকে দেখছে। ঘেন্নায় আলোর গা গুলিয়ে ওঠে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে দুই কদম পিছিয়ে দাঁড়ায়। সামিনের চোখে আলোর অস্বস্তি ধরা পরে। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,"চার ঘন্টা আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে। জোর করে হোক, জুলুম করে হোক, যেভাবেই হোক, বিয়েটা হয়েছে। তুমি আমার স্ত্রী। আমার অধীনস্থ তুমি। বারবার থুতু দেওয়া,চ'ড় মারা আমি বরদাস্ত করবো না। ভদ্র হয়ে থাকতে বলেছি, ভদ্র হয়ে থাকো। তোমার এবং তোমার পরিবারের জন্য সেটাই ভালো হবে।"
কথাটি বলে সামিন ইয়াসার ঘর থেকে হনহনিয়ে বের হয়। তার শরীরের ধাক্কা লেগে দরজার কপাট বিকট শব্দে কাঁপতে থাকে। আলো ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। আশ্চর্য ব্যাপার,তার চোখে এখন পানিও আসছে না!
***
"পেশেন্টের অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। হাত পায়ের রগ কেটে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিলো। মারাত্মক ভাবে আহত সে। বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করবেন না। শুধু আল্লাহকে ডাকুন।"
সামিন ইয়াসার ডাক্তারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলে,"বাঁচবে তো?"
_আশা করা যায়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা অন্যরকম হলে আমাদের তো কিছু করার নেই।
ডাক্তার চলে যেতেই সবুজ ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে বলে,"ভাই! কতটা নি'র্দ'য় হলে কেউ হাত পায়ের রগ কে'টে জা'ন নেওয়ার কথা ভাবতে পারে!"
ইয়াসার চুপ করে থাকে। রনি বলে,"শা'লা পুরোটাই ভণ্ড! আগে তো ক্রা'ই'ম রিপোর্টার ছিলো। ক্রা'ই'ম নিয়ে রিপোর্ট করতে করতে শিখে গিয়েছে সব।"
সামিন একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,"আতাউর আলমের আপডেট কি?"
_বাড়ি থেকে কেউ বের হয়নি। কেউ বাড়িতে ঢোকেনি।
সামিন আর কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করে। রাহাত বলে,"কই যাচ্ছেন ভাই?"
_বাড়িতে। তোরা এখানে থাক। কোনো সমস্যা হলে আমায় ফোন দিবি। ফুয়াদ এবং আরাফ আমার সাথে আয়।
রাহাত এবং রনি মাথা নাড়ায়। ফুয়াদ এবং আরাফ সামিনের সাথে চলে যায়।
তৌফ রাহাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,"ঘরে নতুন বৌ রাইখা অন্য কোথাও মন টিকবে এখন?"
রাহাত চোখ রাঙানি দিয়ে বলে,"ফাজলামির কথা বলিস না। আমাদের মন মেজাজ ঠিক নেই। কাল সারারাত কেউ ঘুমাইনি।"
রনি রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলে,"কাল কিছু হয়েছিলো? ভাইয়ের বাসর?"
_কি একটা বিয়ে,তার আবার বাসর। থাপ্রা থাপ্রি আর থুতু ছোড়াছুড়ি হয়েছিল শুধু। এই মেয়ের তেজ কমে এতো সহজে? ভাইয়ের মাথায় কি চলতেছে কে জানে! বিয়ে কোন ধরনের প্রতিশোধ বলতে পারিস? এটা কি স্টার জলসা? হুদাই.... ভাইয়ের মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে । আলো যেদিন ভাইকে চ'ড় মে'রে'ছি'লো সেদিন থেকেই সমস্যা ভাইয়ের মাথায়। ভাই তো আগে এরকম ছিলো না।
তৌফ হাসতে হাসতে বলে,"ভাই আমার মনে হয় ইয়াসার ভাই এই মেয়েটাকে পছন্দ করতো। দেখেন নি? যখনই বলতেন ভাই মেয়েটাকে কিছু করেন, মেয়েটাকে কিছু করেন তখনই ভাই বলতো বাদ দে শুধু নজর রাখ,বাদ দে শুধু নজর রাখ। আর একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন,যে মানুষটা বিয়ে-ই করতে আগ্রহ দেখাতো না সে বিয়ে করে নিলো হুট করে,তাও আবার শত্রুর মেয়েকে। আশ্চর্য না বিষয়টা!"
***
ইশমামের অস্থিরতা বাড়তে থাকে। পনেরো ঘন্টার বেশি হয়ে গিয়েছে অথচ অদ্রিতা তার সাথে কোনো যোগাযোগ করছে না। আচ্ছা,অদ্রিতার ফোনটা নষ্ট হয়ে যায়নি তো! অদ্রিতা তো প্রায়ই বলতো তার ফোনটা কাজ করছে না। কিন্তু সেটা হলেও তো অদ্রিতা কোনো না কোনোভাবে তাকে ইনফর্ম করে দিতো। যত সময় যাচ্ছে, অস্থিরতা বেড়ে চলেছে ইশমামের। বারবার ফোন হাতে নিয়ে চেক করা ছাড়া আর কিছুতেই মন দিতে পারছে না সে।
ফুয়াদ গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসে। সামিন তার পাশে বসে। আরাফ পেছনের সিটে। ফুয়াদ গাড়ি স্টার্ট করার আগে সামিনের দিকে একবার তাকায়।
"সত্যিই বাড়িতে যাবি? পার্টি অফিসে যাবি না? মিটিং ডেকেছিলি তো।"
_না। আগামীকাল ভোটকেন্দ্র গুলোতে যাবো সোজা। লোক লাগিয়ে দিয়েছি,তারা সবটা দেখবে।
ফুয়াদ গাড়ি স্টার্ট করে। সামিন সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বসে আছে। কিছুদূর যাওয়ার পরে ফুয়াদ বলে,"একটা কথা বলতো? তুই তো একটা শিক্ষিত ছেলে। তাও এরকম একটা বোকামি কেনো করলি? এভাবে বিয়ে হয়?"
_হয়েছে তো, ও কবুল বলেছে,আমি কবুল বলেছি। তিন লক্ষ টাকা কাবিন ধরে বিয়ে করেছি। কিছুদিন পরে কাবিনের কপি বের হবে।
ফুয়াদ ড্রাইভ করতে করতে বলে,"সেটা বলিনি আমি। না ও তোকে ভালোবাসে,না তুই ওকে ভালোবাসিস। এই বিয়ের পরিণতি কি হবে?"
সামিন চুপ করে থাকে। ফুয়াদ বলে,"জেদ করে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করলি। ওর বাবা যদি দোষী হতো তাহলে থানায় যেতি। পুলিশে ধরিয়ে দিতি। তুই কেনো আইন নিজের হাতে তুলে নিলি?"
_ওর বাবাকে অন্য কেউ মেরেছিলো,ও কেনো থানাপুলিশ না করে, অপরাধী শনাক্ত না করে সরাসরি আমায় থাপ্পর মেরেছিলো?
_বাবার প্রতি মেয়ের ইমোশন টা বোঝার চেষ্টা কর। আলো একটু অন্যরকম মেয়ে।
_গাড়ি থামা।
গম্ভীর কন্ঠে বলে সামিন ইয়াসার। ফুয়াদ হুট করে ব্রেক কষে। সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমাকে এই মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে যাবি? অন্তত বাড়িতে দিয়ে আয় আমাকে। একটু ঘুমাবো আমি।"
সামিন ম্লান হেসে বলে,"আমার সাথে ভেতরে চল। কেনাকাটা করতে হবে।"
ফুয়াদ মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। একটা শপিং মলের সামনে তাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একবার সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"কি কিনবি? কার জন্য কিনবি?"
_আমার বৌয়ের জন্য। সামিন ইয়াসারের বৌয়ের জন্য।
তাচ্ছিল্যের সাথে বলে সামিন। তার মুখে বিদ্রুপের হাসি।
***
মাম্মার বারন স্বত্তেও ইহান বারবার এসে নিচ তলার গেস্টরুমে উঁকি দিচ্ছে। মাম্মা বলেছে বাড়িতে নাকি কেউ এসেছে। সে নাকি ইহানের বড় মা হয়। বড় বাবার বৌ। ইহান খুবই উৎসুক হয়ে আছে তার বড় মাকে দেখবে বলে। কিন্তু মাম্মা বারবার ধমক দিচ্ছে। ঘরের ভেতর যেতেই দিচ্ছে না ইহানকে। চুপচাপ লিভিং রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে আশেপাশে তাকায় ইহান। রিতু এখন রান্নাঘরে। বাড়ির সবাই দোতলায় আছে,কেউ নিচে নামেনি। ইহান সুযোগ পেয়ে গুটি গুটি পায়ে গেস্টরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ছোটো ছোটো দুটি হাত দিয়ে গেস্ট রুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে দরজা খোলে।
ঘরে ঢুকে ইহান আশেপাশে তাকায়। কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে ইহান বের হয়ে যেতে নেয় ঠিক তখনই ইহানের চোখ চলে যায় মেঝের দিকে। কেউ একজন মেঝেতে শুয়ে আছে।
ইহান গুটি গুটি পায়ে আলোর কাছে যায়। প্রচন্ড খিদে এবং ক্লান্তিতে চোখ বুজে, হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে মেঝেতে পরে ছিলো আলো। কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে আলো হকচকিয়ে উঠে বসে। সে ভেবেছিলো আবার বোধ হয় সামিন ইয়াসার নামের পি'শা'চ টা এসেছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলো ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ইহান বলে,"তুমি কি বড় মা?"
আলো তার ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে ইহানকে দেখে। ইহান বলতে থাকে," তুমি বড় বাবার বৌ?"
ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকে আলো। ইহান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। আদুরে গলায় বলে,"তুমি কি বড় মা? বলো।"
_চলে যাও এখান থেকে।
তেজী কন্ঠে বলে আলো। ইহান ভয় পেয়ে যায় আলোর কন্ঠস্বর শুনে। আলো চেঁচিয়ে ওঠে,"বললাম না চলে যাও এখান থেকে। যাও বলছি! চলে যাও,চলে যাও।"
ইহান "মাম্মা" বলে একটা বিকট চিৎকার দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় আলোর ঘর থেকে।
***
বেলা দেড়টা নাগাদ ইয়াসারের গাড়ি শান্তিনীড়ের গেইট দিয়ে ঢোকে। গাড়ি থামিয়ে নেমে পরে সে। পোনা এসে দাঁড়ায় পোর্চের সামনে। ইয়াসার গাড়ি থেকে নেমে পোনা চাচাকে বলে,"চাচা রিয়াজকে বলো গাড়ি থেকে প্যাকেট গুলো নামাতে। বাড়ির ভেতরে দিয়ে আসতে বলো।"
তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করে," বাড়িতে সব ঠিক ঠাক? কোনো ঝামেলা হয়নি তো?"
পোনা মাথা নাড়ায়। মুখে বলে,"কোনো ঝামেলা হয়নি তবে,"
_তবে কি?
_বড় মা ইহান বাবুকে ধমক দিয়েছে। বকেছে।
_বড় মা? কে বড় মা?
পোনা চাচার কথা বুঝতে না পেরে সামিন অবাক হয়ে জানতে চায়। পোনা থতমত খেয়ে বলে,"বড় বৌমা। তোমার বৌ।"
সামিন হতভম্ব হয়ে সদর দরজার দিকে তাকায়। ধমক দিয়েছে মানে। কি দুঃসাহস! সামিন ইয়াসার হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতরে যায়। ভেতরে ঢুকে রিতুকে ডাকতে থাকে। রিতু এসে সামনে দাঁড়ায়।
"আলো ইহানকে বকেছে?
কঠিন গলায় জানতে চায় ইয়াসার। রিতু আমতা আমতা করে বলে,"ভাইয়া জানেনই তো ইহান অচেনা লোক দেখলে তাদের কিভাবে বিরক্ত করে। ভাবীকে কিছু বলবেন না।"
রিয়াজ এসে প্যাকেট গুলো লিভিং রুমে রেখে চলে যায়।
রিতু সেদিকে তাকিয়ে বলে,"এগুলো কি ভাইয়া?"
ইশিতা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। সামিন বলে,"শাড়ি আছে এখানে। নতুন বৌয়ের জন্য।"
রিতু কিছুক্ষণ সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"শুধু শাড়ি?"
_হ্যা, বাইশটা আছে। কম হয়ে গিয়েছে?
রিতু আমতা আমতা করে বলে,"ভাইয়া বাইশ টা শাড়ি দিয়ে কি হবে। আর নতুন বৌয়ের জন্য শুধু শাড়ি কেনা হয় না। শাড়ির সাথে আনুষঙ্গিক অনেক কিছু কিনতে হয়।"
সামিন রিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমি তো জানি না। তুমি বললে শাড়ির কথা। তাই নিয়ে এলাম।"
তারপর আবার চুপ করে থেকে বলে,"ঠিকাছে। যা যা লাগবে তুমি আর ইশিতা গিয়ে নিয়ে এসো বিকেলে।
রিতু মাথা নাড়ায়। ইশিতা কঠিন গলায় বলে,"আমি পারবো না।"
সামিন বোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রিতুকে বলে,"ওকে নিয়ে এসো।"
_আসবে না ভাইয়া। অভুক্ত থাকায় অবস্থা কাহিল হয়ে গিয়েছে তবুও জেদ করে কিছু খাচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেছি।"
সামিন রিতুর কথা শুনে গেস্টরুমের দিকে যায়,রিতু নিচু স্বরে বলে,"ভাইয়া প্লিজ গায়ে হাত তুলবেন না।"
"ভাইয়া ভাইয়ার বৌয়ের সাথে কি করবে সেটা তুমি বলে দেবে?"
পেছন থেকে ধমক দেয় ইলহাম। রিতু মুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে থাকে। আলো নামের অচেনা মেয়েটির জন্য তার খুব মায়া হচ্ছে। তারা একই রকমের কপাল নিয়ে জন্মেছে যে।
দরজা ঠেলে সামিন ভেতরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দেয়। আলো হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে ছিলো মেঝেতে। মাথা তুলে তাকায় সামিনের দিকে। আলোর বিধ্বস্ত মুখটা দেখে হঠাৎ করে সামিনের অদ্ভুত অনুভূতি হয়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"ইহান ছোট মানুষ। ও তো আর আমার মতো পি'শা'চ না। ওকে কেনো ধ'ম'কা'লে। ও একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা।"
_এখন না হলেও একদিন ঠিকই আপনার মতো পি'শা'চ হবে ও। ওর শরীরে এই বংশের রক্ত।
সামিন একটা চেয়ার টেনে বসে বলে,"ষোল ঘন্টা না খেয়ে আছো। তারপরও গলায় কি জোর তোমার।"
_হাতেও অনেক জোর। দেখাবো?
ঠান্ডা গলায় বলে আলো। সামিন আলোর কথা শুনে বাঁকা করে হাসে। তারপর বলে,"শুনেছি তুমি কারাতে জানো। জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় হয়েছো। তবে এতেই নিজেকে অনেক কিছু ভেবে বসো না। যাদের সাথে ল'ড়ে'ছো তারা সবাই মেয়ে। দুর্বল প্রজাতি। আমি পুরুষ মানুষ। সিংহ পুরুষ। একটা মোটামুটি ধরনের চড় দিলে এখানে তিনদিন পরে থাকবে। "
আলো সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন বলে,"শোনো আত্মবিশ্বাসী বাবার আত্মবিশ্বাসী কন্যা । তোমাকে একটা সুখবর দেই। তোমার মা সুস্থ আছে। অবশ্য তার সুস্থতা তোমার উপর নির্ভর করবে। যদি এখানে বাঁদরামি করেছো তাহলে ওখানে....."
সামিন থেমে আলোর দিকে তাকায়। আলোর চোখে উৎকণ্ঠা। সামিন বলে,"আমার সাথে চলো।"
_কোথাও যাবো না। আমি শুধু আব্বু আম্মুর কাছে যাবো। আমাকে যেতে দিন।
_কেনো যাবে? তুমি এখন আমার স্ত্রী।
_এই বিয়ে আমি মানি না।
তেজী কন্ঠে বলে ওঠে আলো তারপর উঠে দাঁড়ায়। শরীরের দুর্বলতার জন্য ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছে না সে। সামিন একবার আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"চলো।"
_যাবোনা।
দাঁত খিচিয়ে বলতে চায় আলো। সামিন শীতল চোখে আলোর দিকে তাকায়। তারপর আলোর হাত ধরে টানতে টানতে গেস্টরুম থেকে বের করে আনে। আলো নিজের হাতটাকে সামিনের হাত থেকে ছাড়ানোর প্রানপন চেষ্টা করে। কিন্তু সে অপারগ।
***
রেহেনা স্বামীর মাথায় হাত রাখে। চোখ বুজে ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছে আতাউর আলম। স্ত্রীর হাতের স্পর্শে চোখ খুলে তাকায় সে। রেহেনার মুখের দিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিক ঠান্ডা গলায় বলে,"মেয়েটার মন টা এখন কেমন করছে রেহেনা! নিশ্চয়ই গলা কা'টা মুরগির মতো ত'ড়'পা'চ্ছে।"
রেহেনা কান্না আটকে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আতাউর বলে,"তুমি ঠিক বলেছিলে রেহেনা। আমার মতো মানুষদের জন্য রাজনীতি মানায় না। রাজনীতি মানায় ইয়াসারের মতো জা'নো'য়া'র'দের যারা টাকা দিয়ে কিছু মানুষ রুপী পশু পোষে। আমার যদি আজ ওরকম কিছু পশু থাকতো তাহলে আজ দিনটা অন্যরকম হতো।"
_চলো না, পুলিশের কাছে যাই। একবার ধরিয়ে দিলে কিচ্ছু করতে পারবে না ওরা।
রেহেনা ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে। আতাউর বলে,"তুমি জানো না রেহেনা। ওরা কি করতে পারে! তোমার কোনো ধারণা নেই। ইশতিয়াকের কাহিনী মনে আছে তোমার? মারুফার সাথে কি হয়েছিলো ভুলে গেলে? আমি আমার মেয়েটাকে হারাতে পারবো না।"
_আতাউর আলম ভয় পাচ্ছে? এতো সহজে হার মেনে নিলো আতাউর আলম?
_না। একজন বাবা ভয় পাচ্ছে রেহেনা।
এমন সময় ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আতাউর আলম চমকে উঠে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে কন্ঠে বিদ্রুপ নিয়ে তার চাচাতো ভাই খোরশেদ বলে ওঠে,"আগামীকাল নির্বাচন আর আজ স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর আলম নির্বাচন বর্জন করছে? খবরটা কি সত্যি?"
আতাউর আলম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"সত্যি।"
শব্দটি মুখ থেকে উচ্চারণ করেই ফোন কেটে দেয় সে।
***
সামিন ইয়াসার আলোকে টানতে টানতে এনে লিভিং রুমে দাড় করায়। আলো কিছুটা টলছে। সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"ওকে কিছু খাওয়াও।"
_আমি খাবো না। এই বাড়ির কিছু আমি মুখে দেবো না। বললাম তো।
চেঁচিয়ে বলতে থাকে আলো। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"কতক্ষন থাকবে না খেয়ে? আচ্ছা ঠিকাছে। আমিও দেখতে চাই তুমি কতক্ষন না খেয়ে থাকো।"
আলো সামিনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সিতারা এসে রিতুর হাতে একটা গ্লাস দিয়ে বলে,"বড় ভাইজানের মিন্ট লেমন ভাবী!"
রিতু গ্লাসটা সামিনের হাতে তুলে দিতে যাবে তখনি ইলহাম ধমকের সুরে বলে,"তুমি কেনো দিচ্ছো? ভাইয়ার বৌ দেবে। ওর হাতে গ্লাস দাও।"
সামিন আলোর দিকে তাকায়। রিতু আমতা আমতা করতে থাকে। ইশিতা আলোকে দেখে। আলো সবাইকে অবাক করে দিয়ে রিতুর হাত থেকে গ্লাসটা নেয়। তারপর সামিনের চোখের দিকে একবার তাকিয়ে গ্লাসের পানীয় টুকু সামিনের মুখে ছুড়ে মারে।
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই চমকে ওঠে। আলো গেস্টরুমের দিকে ছুটে যায়। তার দুর্বল শরীর নিয়ে ছুটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে নিচে পরে যাবে!
সামিন ভেজা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আলোকে দেখে। সবাই তাকে দেখছে। কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিয়ে সে নিজের ঘরে চলে যায়।
***
মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে মুখটা পরিষ্কার করে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আসে সামিন। গায়ের পাঞ্জাবিটা একটানে খুলে রকিং চেয়ারের উপরে ছুঁড়ে মেরে বিছানায় এসে বসে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখে সে। বেলা তিনটা প্রায়। হঠাৎ ইশমামের কথা মনে পরে তার। ইশমামকে তো এসবের কিছুই জানানো হয়নি। এসব জানতে পারলে নিশ্চয়ই খুব রিয়াক্ট করবে। সামিনের ভালো মানুষ ভাই বলে কথা। সামিন আনমনে হাসে, ইশমাম একেবারেই মায়ের মতো হয়েছে ,স্বচ্ছ। ফোনটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইশমামকে ফোন দেওয়ার মনস্থির করেও ফোন দেয়না। এখন নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে। শুধু শুধু বিরক্ত করে কি লাভ। এমন সময় ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে,"ফোনের স্ক্রিনে যার নাম্বার টা ভেসে উঠেছে তার নাম হলো আতাউর আলম। এখন ফোন ধরলেই "ইয়াসার আমার মেয়েটাকে একটু দেখবো,ইয়াসার আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও,ইয়াসার আমি তোমার পা ধরবো" এসব বলে বলে কাঁদবে , ইয়াসার তা জানে। সে রিসিভ করে না ফোনটা। তড়পাতে থাকুক, যতক্ষন জামিল আইসিইউতে থাকবে, ততক্ষন আতাউর আলম-ও মেয়ের সাথে কথা বলতে না পারার যন্ত্রনায় তড়পাতে থাকুক।
ফোনটা সুইচ অফ করে রেখে সামিন উঠে দাঁড়িয়ে খালি গায়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলে,"পি'শা'চ সামিন ইয়াসার মির্জা।"
এমন সময় দরজায় টোকা পরে ইয়াসারের। গম্ভীর কন্ঠে জানতে চায়,"কে?"
ফুলির মা চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"নতুন ভাবী জ্ঞান হারাইছে ভাইজান।"
#নোট_বার্তা: গল্পের প্রথম পর্বের প্রথম লাইনে সামিনের বলা প্রথম সংলাপে-ই আমি বুঝিয়ে দিয়েছি সামিনের চরিত্রটা কিরকম ত্রুটিপূর্ণ বা ওর মানসিকতা কেমন, ও এমন পরিবেশেই বড় হয়েছে। একজন রক্তগরম তরুণ ছাত্রনেতা হয়ে,একজন পুরুষ হয়ে ও সুপেরিওরিটি কম্প্লেক্সে ভুগছে। আলো ওর জীবনে এসেছে আলো হয়ে। গল্পের থিম-টাই এমন, গল্পের নামটা খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। একজন সামিন ইয়াসারকে শোধরাতে একজন আলোর দরকার। আপনারা কেউ কষ্ট পাবেন না । যারা আমার গল্পের নিয়মিত পাঠক,তাদের বলছি। আমি এই গল্পটি শেষ করে #দ্বিতীয়_ফাগুনের মতো আবারো একটি সামাজিক/ পারিবারিক জনরার গল্প আপনাদের উপহার দেবো। তাই যারা এই গল্পটি পরে কষ্ট পাচ্ছেন তারা ততদিনে এই গল্পটি চাইলে স্কিপ করে যেতে পারেন। কারন এই গল্পটির থিম বদলাবে না। সামিন-কে সবটা বুঝতে হবে, আগাগোড়া শুধরে যেতে হবে, আলোর আলোয় আলোকিত হতে হবে।
আর ইশমামের জন্য কষ্ট পাবেন না। লেখিকা কাউকে ঠকাবে না।
গায়ে একটি নেভি ব্লু রঙের পলো টি-শার্ট চাপিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে নিচ তলার গেস্টরুমের দিকে যায় ইয়াসার। আলো অ'চে'ত'ন হয়ে মেঝেতে পরে আছে। তাকে ঘিরে বসে আছে রিতু,ইশিতা,হেনা ও ফুলির মা। সামিন কে দেখে রিতু উঠে দাঁড়ায়। আতঙ্কিত মুখ নিয়ে বলে,"ভাইয়া অবস্থা খুব খা'রা'প মনে হচ্ছে। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দেই?"
_পানি ছিটানোর থেকেও পানি খাওয়ানোটা জরুরি রিতু। ওকে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দাও।
সবাই ধরাধরি করে আলোকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ইশিতা ভাইয়ের দিকে রাগী দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। সামিন ইয়াসার তার দিকে তাকিয়ে বলে, "পরীকে ফোন করে ডাক। এসে দেখুক।"
ইশিতা কপাল কুঁচকে বলে,"পরী কি ডাক্তার? ও স্টুডেন্ট। আর পরীকে-ই কেনো ডাকবো? ডাক্তার এলে তোমার অপকর্ম সব ফাঁস হয়ে যাবে সেই ভয়ে?"
_হ্যা তাই!
তেজী কন্ঠে বলে ওঠে ইয়াসার। ইশিতা আহত চোখে ভাইকে কিছুক্ষণ দেখে। তারপর পরী নামের মেয়েটাকে ফোন করে আসতে বলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,"তোমার কি হয়েছে ভাইয়া? কেনো করছো এমন তুমি?"
_বললাম না বংশের ঐতিহ্য চর্চা করছি!
ইশিতা দৃঢ়ভাবে বলে,"জোর করে বিয়ে হয়? এই বিয়েটাই হয়নি। তুমি ওকে ওর পরিবারের হাতে তুলে দাও ভাইয়া। শত্রুতার জের ধরে তুমি মেয়েটার গোটা জীবন টা এভাবে নষ্ট করো না। মনে রেখো তোমারো বোন আছে।"
_আমার বোনের জন্য আমি আছি। ভয় পাচ্ছি না তোর কথায়।
ভাইয়াকে কিছু বলা বৃথা। ইশিতা করুণ দৃষ্টিতে বিছানায় অচেতন হয়ে পরে থাকা আলো নামের মেয়েটিকে দেখে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মায়াবী মুখটা কিরকম মলিন হয়ে আছে। ভাইয়া কিভাবে পারছে এমনটা করতে। তার কেনো একটুও মায়া হচ্ছে না!
***
রেহেনার হাতের পানির গ্লাস টা হাত থেকে মেঝেতে পরে ভেঙে গিয়ে তীব্র আওয়াজ হয়। কাঁচের টুকরো গুলো গোটা মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। স্ত্রী পুনরায় অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরেছে ভেবে আতাউর আলম ছুটে আসে। এসে রেহেনার দিকে তাকিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে । রেহেনা থমথমে মুখ নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"আলোর আব্বু, মেয়েটার কি হলো আলোর আব্বু!"
আতাউর আলম এগিয়ে আসে স্ত্রীর কাছে। রেহেনা হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলে,"মেয়েটার গায়ে হা'ত তুলছে, নিশ্চয়ই মেয়েটাকে মা'র'ছে খুব।"
মায়ের চি'ৎ'কা'র শুনে আজান আর আয়াত ছুটে এসে দাঁড়ায়। রেহেনার শরীরটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। আতাউর আলম এসে স্ত্রীকে ধরে। রেহেনা অস্ফুট স্বরে বলে,"মেয়েটাকে দেখবো,কথা বলবো মেয়েটার সাথে। তুমি ঐ প'শু টাকে ফোন করে বলো আমরা সবাই মিলে ওর পা'য়ে পরবো। ও শুধু মেয়েটার সাথে একটু কথা বলিয়ে দিক। আতাউর আলম দুচোখ বন্ধ করে একটা নিরব আর্তনাদ করে ওঠে। সে তো সেই কখন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছে আলোর সাথে একটু কথা বলবে বলে। নির্দয়,প'শু, পাষণ্ড ইয়াসারের মন গলেনি।
আজান আয়াত একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। ছোটো থেকে বন্ধু মহলে সবাই তাদের ক্ষেপিয়ে এসেছে "লুজার্স টুইন" বলে। জীবনের এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তাদের এটাই মনে হচ্ছে,তারা আসলেই লুজার্স।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ হয়। আতাউর আলম স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে গিয়ে দরজা খোলে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রনি। হাতে একটা প্যাকেট তার। মুচকি হেসে আতাউর আলমের দিকে প্যাকেট টা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,"মাঐ মা-এর ব্লাড প্রেশারের ওষুধ।"
***
ধীর পায়ে গেস্ট রুমে ঢুকে পরী প্রথমে সামিনের দিকে তাকায়। সামিনের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলে সে চোখ নামিয়ে নেয়। শ্রদ্ধা করলেও সামিন ভাইয়াকে সে ভীষণ ভয় পায়, সজ্ঞানে কখনো সামিনের সামনে পরে না সে। পরীর পিছু পিছু ঘরে ঢোকে পোনা। পরী পোনার মেয়ে। দুধে আলতা গায়ের রং নিয়ে জন্মেছিল বলে পোনা খুব শখ করে মেয়েটির নাম রেখেছিলো পরী। পরী আসলেই পরীর মতো দেখতে। ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে পরী পোনার দিকে তাকায়। পোনা চোখ দিয়ে ইশারা করে পরীকে বিছানার দিকে তাকাতে বলে।
সে বিছানায় শুয়ে থাকা আলোকে একবার দেখে পুনরায় নিজের বাবার দিকে তাকায়। পোনা মৃদু স্বরে বলে,"বড় ভাবী তোর।"
আলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছুক্ষণ দেখে সে। মায়াবী মুখশ্রী। তাকালে সহজে চোখ ফেরানো যায়না। ধীরপায়ে হেটে গিয়ে বিছানার পাশটাতে বসে। আলোর পালস রেট চেক করে,ব্লাড প্রেশার চেক করে সামিনের মুখের দিকে তাকায়। সামিন তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
_শরীর অত্যন্ত দুর্বল ভাইয়া। কিছু খাওয়াতেই হবে। কতক্ষন না খেয়ে ছিলো?
_উনিশ ঘন্টা।
_উনিশ ঘন্টা না খেয়ে দিব্যি থাকা যায়। পানি না খেলে সমস্যা হবার কথা।
_পানিও খায়নি।
পরী আলোর দিকে তাকায়। সে কিছুই বুঝতে পারছে না এখানে কি হচ্ছে। কাউকে জিজ্ঞেস করবে সেই সাহস পরীর নেই। নিচু স্বরে, দৃষ্টি আলোর মুখের দিকে রেখে বলে,"পানি শূন্যতার জন্য হয়েছে। একটা চামচ দিয়ে খানিকটা পানি খাইয়ে দাও ইশিতা আপু।"
তারপর বলে,"এর হাত পায়ে ম্যাসাজ করে দাও। ধীরে ধীরে হুস ফিরে পাবে।"
সামিন পরীর কথা শুনে আলোর মুখের দিকে তাকায়। ঠোঁট বাঁকিয়ে ম্লান হাসে,মনে মনে বলে," বোকা বাবার ফ'ট'কা চালাক মেয়ে! এই রকমের যা তা স্টামিনা নিয়ে এতো তেজ দেখাও তুমি!"
ইশিতা একটা গ্লাস আর একটা চামচ এনে আলোর মাথার কাছে বসে। রিতু এবং সিতারা আলোর হাতে পায়ে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়। ফুলির মা হঠাৎ করে বলে ওঠে,"আসতে না আসতেই তোমারে দিয়া নিজের সেবা করাইয়া নিতেছে তোমার বড় জা।"
রিতু মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। ফুলির মা প্রায় ভুলে গিয়েছিলো এই ঘরে ইয়াসার রয়েছে। মনে পরতেই সে থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইয়াসার কিছু বলে না। তার দৃষ্টি আলোর দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সে আলোকে পর্যবেক্ষণ করছে। গুনে গুনে সাত সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সে চোখ সরিয়ে নেয়।
ইশিতা আলোর মাথায় হাত রেখে নরম গলায় ডাকে,"আলো।"
আলোর জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু চোখ খুলে তাকানোর শক্তি সে পায়না। নারী কন্ঠ কানে যেতেই সে কপাল কুঁচকে ফেলে খানিকটা। ইশিতা সাহস পায়। চা-চামচের এক চামচ পানি অবচেতন আলোকে জোর করে খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। খড়খড়ে কন্ঠনালীতে দুফোঁটা পানির অস্তিত্ব পেয়ে আলোর অবচেতন মন স্বস্তি পায় ঠিকই কিন্তু তার চোখ দুটো বন্ধ।
রিতু এগিয়ে বসে আলোর গালে হাত রেখে ডাকতে থাকে,"আলো...আলো...!"
দুইবার ডেকে সে থেমে যায় তারপর সামিনের দিকে একবার তাকিয়ে আবারো ডাকতে থাকে,"ভাবী....ভাবী..!"
আলো ধীরে ধীরে চোখ খুলে পিটপিট করে তাকায়। সবকিছু ঝাপসা লাগছে। সবাই জানে সে উনিশ ঘন্টা খায়নি। কিন্তু সবাই জানে না আলো গতো সাতাশ ঘন্টা ধরে কিচ্ছু খায়নি। গতকাল বেলা এগারোটার দিকে কলেজের ক্যান্টিনে একটা সিঙাড়া খেয়েছিলো, এবং ওটাই শেষ খাবার।
আলোকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে অদ্ভুত ভাবে, নিজের অজান্তেই ইয়াসার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এবং সাথে সাথে সে ভীষণ অবাক হয়ে যায়। আশ্চর্য,সে এমন অদ্ভুত কাজটা কেনো করলো!
রিতু ম্লান হেসে বলে,"ভাবীর জ্ঞান ফিরেছে।"
ইশিতা একবার ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে রিতুকে বলে," মেজো ভাবী। এক বাটি স্যুপ নিয়ে এসো। আর তোমরা সবাই এখান থেকে যাও। তিন সেকেন্ডের মধ্যে।"
ইয়াসার বোনের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে অকারণ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,"কি রে তোর ভিজিটের টাকা নিবি না হবু ডাক্তার!"
পরী মুচকি হাসে। অনেকটা সাহস নিয়ে বলে,"বিয়ের মিষ্টিও কিন্তু বাকি আছে ভাইয়া। ওটা আগে খাওয়াবেন।"
***
"আপনি আসলে করতে চাইছেন কি একটু পরিষ্কার করে বলবেন আব্বা? সারাদিন এই প্ল্যান করছেন,সেই প্ল্যান করছেন অথচ কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না।"
শমশের ভুঁইয়া নিজের ছেলে সাগর ভুঁইয়ার দিকে তাকায়। ছেলে তার রীতিমতো বাপকে ধ'ম'কা'তে শিখে গিয়েছে।
সাগর জায়েদ আলীর দিকে আঙুল তুলে আবারো বলতে থাকে,"ওনার সাথে একচেটিয়া আলোচনা করে এতদিন পণ্ডশ্রম করে গিয়েছেন শুধু। আপনার বুদ্ধি দেখে আমি অবাক হই আব্বা। কোথায় ইয়াসারকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেবেন তা না করে ওর চ্যা'লা'টাকে মারলেন। ইয়াসারের তো টিকিও নাড়ানো গেলো না। দিব্যি তার দলের লোক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।"
_আতাউর আলম তো সরে দাঁড়িয়েছে।
বাবার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সাগর বলে," ইয়াসারকে মেরে দিলে আতাউরকে সামলানো কোনো ব্যাপার-ই ছিলো না আমাদের কাছে। আর আতাউরকে ফাঁসানোর যে প্ল্যান করেছিলেন,লাভ কি হলো? ইয়াসারের তো কোনো শীত গরম দেখছি না। ও তো এতো সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। ও কেনো আতাউরের পিণ্ডি চটকাচ্ছে না? একটা ধুন্ধুমার লেগে গেলেও কিছুটা সুবিধা করা যেতো।"
শমসের ভুঁইয়া ছেলের কথায় চিন্তিত হয়ে পরে। তাইতো,ইয়াসার এতো চুপচাপ বসে আছে কি করে। বিষয় টা বেশ গোলমেলে।
সাগর বাবার দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলে,"এইবার যদি কোনো অঘটন ঘটে না আব্বা ! তাহলে আপনি ধরে নিন দলের সভাপতি পদ থেকে আপনাকে সরে দাঁড়াতে হবে।"
***
"এই স্যুপ টা এখন তুমি মুখে দেবে আলো।"
ইশিতার কথা শুনে-ই আলো মুখ সরিয়ে নেয়। ইশিতা একটু কঠিন হবার ভান ধরে আলোর থুতনি ধরে জোর করে এক চামচ স্যুপ খাইয়ে দেয়। আলো বাঁধা দিতে গেলে তার গায়ে খানিকটা পরে যায় স্যুপ। ইশিতা ধমক দিতে চেয়েও দেয়না। মায়াবী মুখশ্রীর দিকে তাকালেই মায়া লাগে তার। সে নরম গলায় আলোর মাথায় হাত রেখে বলে,"তোমার বাবা মাকে দেখতে চাও? তার চান্স কিন্তু এখনো ফিফটি ফিফটি আছে আলো। তুমি যদি এভাবে না খেয়ে মরে পরে থাকো তাহলে তো কোনো লাভ হবে না,তাই না?"
আলোর ঠোঁট কাঁপছে। ইশিতার নমনীয় ব্যবহারে তার মধ্যে জমে থাকা কান্না সব বেরিয়ে আসতে চাইছে । বেশ কয়েক মুহূর্ত চেষ্টা করেও সে আটকাতে পারে না। ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,"কেনো আপু? একটা সামান্য চ'ড়ের দাম আমাকে নিজের সর্বস্ব খুইয়ে দিতে হলো কেনো?"
ইশিতা কোনো উত্তর দেয়না। সে তো জানে না এর উত্তর। আলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কিছুক্ষণ পরে কান্না থামিয়ে কঠিন গলায় বলে ওঠে,"ওই জা'নো'য়া'রটাকে কখনো ক্ষমা করবো না আমি, কোনোদিনও না।"
***
শেষ বারের মতো ফোন টা চেক করে ইশমাম ফোনটাকে দূরে ছুড়ে মেরে হাত দিয়ে দেয়ালে সজোরে ঘুষি মেরে দেয়। তারপর এসে নিজের বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মাথা কাজ করছে না তার। এতোটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে কেনো! কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থেকে আবারো উঠে বসে। অর্গানাইজেশন থেকে বারবার ফোন দেওয়া হচ্ছে। ইশমাম কেনো তার কাজে যাচ্ছে না তাই। ভার্সিটি থেকে ক্লাসমেট-রা ফোন দিচ্ছে। কারো ফোন ধরতে স্বস্তি পাচ্ছেনা সে। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পরে সে উঠে দাঁড়ায়। স্টাডি টেবিলের কাছে গিয়ে ড্রয়ার খুলে তার পাসপোর্ট বের করে কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর গিয়ে মেঝে থেকে ফোনটা উঠিয়ে নেয়। মেঝেতে পরে গিয়ে ফোনটা সুইচ অফ হয়ে গিয়েছিলো। সে ফোনটা অন করে এ্যাম্বাসিতে ফোন লাগায়।
***
"ক্যাচক্যাচ" শব্দে দরজার নব ঘোরে। রাত প্রায় দশটা বেজে গিয়েছে। সামিন দরজা ঠেলে দুই সেকেন্ড সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। তার কপাল কুঁচকে থাকলেও চোখে অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। নিজের ওপর নিজে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে যায়। এখন এতো অস্বস্তি লাগবে কেনো! এতো কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেও তো অস্বস্তি হয়নি একটুও। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের ভেতরে এক পা ফেলে। আড়চোখে পুরো ঘরের দিকে দৃষ্টি দেয়। আলোকে কোথাও দেখতে না পেয়ে আরেক পা ঘরের ভেতরে রাখতেই সে তার ঘাড়ের উপর কোনো ভারী বস্তুর আঘাত অনুভব করে। তৎক্ষণাৎ ডানপাশে তাকাতেই দেখে আলো একটা মোটা বই হাতে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, প্রচন্ড শক্তি খাটিয়ে সামিনকে আঘাত টা করেছে তাই হাপাচ্ছে সে। আলোর প্রচণ্ড শক্তি খাটিয়ে করা আঘাতেও সামিনকে বিচলিত দেখা যায় না। বরং গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে,"এক বাটি স্যুপ খেয়ে শক্তি ফিরে পেয়েছো?"
আলো দাঁতে দাঁত চেপে আরেকটা বারি মারতে যাবে তখন সামিন তার হাত দুটো ধরে ফেলে। হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে দরজার পাশের আলমারিতে রেখে দেয়। দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে মৃদু হেসে বলে,"তুমি নাকি কারাতে জানো। অথচ এখানে আসার পর থেকে দেখছি চ'ড় মারছো, থুতু ছুড়ে দিচ্ছো, মিন্ট লেমন ছুড়ছো, বই দিয়ে আঘাত করছো। এসব কোন ধরনের বাচ্চামো? মানুষ যখন ঘোর বিপদে পরে তখন তার মস্তিষ্ক কাজ করে না জানি, কিন্তু তোমার তো পুরো মেমোরি ডিলিট হয়ে গিয়েছে। তুমি আদৌও কারাতে জানো তো নাকি তোমার সৎ এবং মহৎ বাবা আতাউর আলম টাকা দিয়ে মেডেল কিনে দিয়েছে।"
_আমার বাবার নাম মুখেও আনবি না কু'ত্তা।
আলো তেতে ওঠে।
সামিন স্বাভাবিক গলায় বলে,"কু'ত্তা বলছো কেনো বারবার? আমি তোমাকে কামড়েছি? আঁচড় কেটেছি তোমার গায়ে?"
আলো অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সামিন বলে,"বাবার নামে কিছু শুনতেই পারো না দেখছি। অন্ধের মতো বিশ্বাস করো বাবাকে। তোমার ওই গুণধর পিতা কি করেছে জানো? একজনের জান নেওয়ার চেষ্টা করেছে।"
আলো চমকে ওঠে, চেঁচিয়ে বলে," মিথ্যা কথা। সবকিছু মিথ্যা কথা।"
_হ্যা , হ্যা। দুনিয়ার সবকিছু মিথ্যা। তুমি আর তোমার বাবা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। তা সত্যবাদী বাপের সত্যবাদী কন্যা, তোমার নামটা তোমার বাবা শুধু আলো রাখলো কেনো? তোমার নাম রাখা উচিত ছিলো সত্যের আলো।
আলো বিদ্রুপ গাঁয়ে না মেখে, গলায় ঝাঁঝ বজায় রেখে চেঁচিয়ে বলে, " ভয় দেখিয়ে বিয়ে, কতগুলো মানুষকে জিম্মি করে রাখা,তাদের ব্লাকমেইল করা। জোর করে একটা মেয়ের সর্বনাশ করা। তুই তো কাফিরের থেকেও একধাপ উপরে। তোর কোনো ক্ষমা নেই পৃথিবীতে। যেদিন ধরা পরবি না, জান নিয়ে বাঁচতে পারবি না জানোয়ার।"
সামিন আলোর দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,"নিজের ঘরে এনে ভাবছিস স্বামীর অধিকার ফলাবি? তার আগে আমি প্রান ত্যাগ করবো।"
_আমি তো তোমাকে কিছুই বলিনি। তুমি আগ বাড়িয়ে এতো কিছু বলছো কেনো?
_কেনো জোর করে এই রুমে এনেছিস আমায়!
হাঁপাতে থাকে আলো। সামিন মৃদু হেসে বলে,"আমি তো জোর করিনি। শুধু বলেছি তোমার কোন ভাই এখন কি করছে, একজন দোকানে গিয়ে থার্মোমিটার কিনেছে,অন্যজন গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে,ব্যস। আর তুমি তাতেই ভয় পেয়ে চলে এলে রিতুর সাথে আমার শোবার ঘরে।"
আলো ছুটে এসে সামিনের কলার ধরে চেঁচিয়ে বলে,"পিশাচ, নমরূদ।"
সামিন আলোর হাত ছাড়িয়ে বলে,"আমার তিনটা পাঞ্জাবির বোতাম ছিড়েছো তুমি। এগুলো কিন্তু তোমাকে দিয়েই ঠিক করানো হবে।"
আলো ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। গলা থেকে আর কোনো কথা বের হচ্ছে না তার। সামিন মৃদু স্বরে বলে,"কি? একবাটি স্যুপের শক্তি ফুরর হয়ে গিয়েছে?"
_ফে'রা'উ'ন
আলো হাঁপাতে হাঁপাতে বলে।
সামিন হেসে বলে,"তাই নাকি? তাহলে তো তুমি আছিয়া হলে।"
ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে একটা চেক বের করে আলোর হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে ফেলে সামিন। চেকটা আলোর হাতের মুঠোয় পুরে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"বিয়ের কাবিনের টাকা।"
আলো হাত ছাড়িয়ে চেকটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে সামিনের দিকে ছুড়ে মারে।
সামিন বলে,"ঠিকাছে। নগদ ক্যাশ দিচ্ছি।"
_তুই মরবি। মরবি তুই খুব শিগগিরই ফে'রা'উ'ন।
_তাই নাকি! তা নীলনদ কোথায়? বাংলাদেশে তো কোন নীলনদ নেই।
আলো অহেতুক তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। সামিন আলোকে উপেক্ষা করে বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে ডিভানে রাখে। পায়ের চটি খুলে ডিভানে উঠে ওদিক ফিরে শুয়ে পরে সে, গম্ভীর কন্ঠে আলোকে বলে,"ঘুমিয়ে পরো। আমি আঁচড়াবো না,কামরাবোও না।"
পাখির কিচিরমিচির নতুন সকালের আহবান জানিয়ে দিয়েছে। জানালার থাই-গ্লাস ভেদ করে কড়া মিষ্টি রোদ এসেছে আলোর গালে আদর দিয়ে যাচ্ছে। মেঝেতে বসে বিছানার উপরে মাথা ঠেকিয়ে,ডান পাশে কাত হয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো আলো। বাম গালে রোদের উষ্ণতা তার দীর্ঘ ক্লান্তিময় ঘুমের ইতি টানে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় সে। ছোটো বেলা থেকে আলো অচেনা কোনো নতুন পরিবেশে ঘুমাতে পারে না, কিন্তু এই দুই রাত যে মানসিক ধকল আলো সামলেছে তাতে এরকম গভীর ঘুম হওয়া স্বাভাবিক। মাথা এখনো ভারি হয়ে আছে যন্ত্রনায়। হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে এদিকে ওদিকে তাকায় সে। তারপর নিজেকে দেখে,গায়ের শাড়ীটা ঠিকঠাক ভাবেই আছে। বিছানায় এক হাত রেখে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। এই অচেনা ঘরটিতে সে ছাড়া আর কেউ নেই। ওই পি'শা'চ টা উধাও। ঘরের দরজা খোলা। আলো এই সুযোগে দ্রুত পায়ে বের হয় ঘর থেকে। সে জানে এই কারাগার থেকে তার পালানোর পথ রাখেনি ওই চতুর শিয়াল টা। তবুও একবার চেষ্টা করলে তো ক্ষতি নেই। ঘরের বাইরে এসে সে নিচতলার সিঁড়ি দেখতে পায়। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত পায়ে নামতে গিয়ে থমকে যায় সে। নিচতলার লিভিং রুমে পি'শা'চ টার দুজন লোক বসে আছে। এদেরকে নিশ্চয়ই ঐ পি'শা'চ টা তার উপর নজরদারি করতে এখানে বসিয়ে রেখেছে। আলো দুমিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে সে রিতুকে দেখে। রিতু আলোর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,"পালাচ্ছিলেন নাকি ভাবী!"
আলো প্রায় দৌড়ে রিতুর কাছে যায়। রিতুর দুই বাহু ধরে আকুতির সুরে বলে,"না পালাচ্ছিলাম না। আপনি আমার একটা উপকার করবেন? একটু দয়া করবেন আমায়?"
রিতু চোখ বড় বড় করে ফেলে। সে কি উপকার করতে পারে আলোর। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে,"কি ভাবী?"
_আমাকে আপনার ফোনটা দেবেন? আব্বু আম্মুর সাথে একটু কথা বলবো। দয়া করে ফোনটা দিন। আমি আপনার পায়ে পড়ছি!
রিতু আলোর দুটো হাত মুঠি করে ধরে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,"আসুন আমার সাথে।"
***
সরকার দলীয় প্রার্থী সামিন ইয়াসার মির্জা নিজ এলাকা ১৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ভোটদান সম্পন্ন করে বেরিয়ে এসেছেন। ভোটকেন্দ্রের বাইরে গণমানুষের ভীর। রাহাত এগিয়ে গিয়ে একটা ছাতা ধরে সামিনের মাথার উপরে। সামিন হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"হাজার বার বারণ করেছি,আমার সাথে এসব করবি না। তোরা আমার চাকর?"
রাহাত লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। তারপর বলে,"না,আপনি আমাদের নেতা।"
সামিন এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলে,"বাকি কেন্দ্রগুলোতে খবর নিয়েছিস? ওদিকের অবস্থা কি?"
এমন সময় রাহাতের ফোন বেজে ওঠে। রাহাত পকেট থেকে ফোনটা বের করে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"সবুজের ফোন। ও তো পনেরো নম্বর ওয়ার্ডে আছে, নতুন কুঁড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শমশের ভুঁইয়ার এলাকা।"
সামিন বলে,"জলদি ফোন রিসিভ কর।"
রাহাত সামিনের কথামতোই ফোনটা রিসিভ করে লাউড স্পিকার অন করে দেয় , ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে ওঠে সবুজ,"রাহাত আমাদের এজেন্টদের কাজে ব্যাঘাত ঘটানো হচ্ছে। দুই দলের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে একপর্যায়ে।"
_পুলিশ কি করছে? ঘাস খাচ্ছে? সরকারি পার্টির এজেন্টদের সাথে গাইগুই করে। বুকের পাটা দেখ!
_শমশেরের ধামড়া ছেলেটা করছে এসব। কি করবো? ভাইকে বল ওসিকে ফোন দিতে।
সামিন রাহাতের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে,"ওসিকে ফোন করার দরকার নেই। আমি আসছি, তুই শু'য়ো'র গুলোকে চিহ্নিত করে রাখ।"
***
আতাউর আলম ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,"আব্বু!"
আতাউর আলম দু'চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। তার মুখে কোনো কথা আসছে না। আলো বলতে থাকে,"কার জ্বর আব্বু?"
_তোর আম্মুর। জ্বর উঠেছে, প্রেশার বেড়ে গিয়েছে।
আলো চুপ করে থাকে। আতাউর আলম বলে,"তোকে মেরেছে আম্মু? খেতে দিয়েছে তোকে?"
আলোর চোখ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরে। কন্ঠনালীতে জমে থাকা কান্না জোর করে দমিয়ে রেখে কন্ঠ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলে,"ঠিক আছি আব্বু। কেউ আঘাত করেনি। খেতে দিয়েছে আমায়।"
আতাউর আলম আর্তনাদ করে ওঠে,"মা.....আমার মা, তুই তোর অপদার্থ বাবাকে মাফ কর মা। ক্ষমা কর আমায়।"
আলো ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। আলোকে দেখে রিতুর চোখে পানি এসে যায়। কয়েক মুহূর্ত কেঁদে কান্না থামিয়ে বলে,"আজান আয়াত কোথায়।"
ওপাশ থেকে আজান আয়াতের ভাঙা গলার আওয়াজ শোনা যায়,"এইতো আপু। আমরা এইতো।"
আলো ধরা গলায় বলে,"ভাই দুটোকে সামলে রেখো আব্বু। ওরা আমার কলিজা। পি'শা'চ টা ওদের উপর নজর রাখছে।"
আতাউর আলম কাঁদতে থাকে। আলো বলে,"আমার সুপার হিরো এভাবে কাঁদতে পারে না। তুমি কেঁদো না আব্বু। ইয়াসার আমাকে আর যাই করুক জানে মা'র'বে না। তোমার মেয়ে হয়তো বেঁচে থাকবে!"
_আমি কি পাপ করেছি আম্মু!
আলো চুপ করে থাকে, তারপর বলে,"নির্বাচন বর্জন করেছো আব্বু?"
_দরকার নেই, দরকার নেই। আমার আর কিছুর দরকার নেই।
আলো মুখে হাত চেপে কিছুক্ষণ কেঁদে নেয়। তারপর কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,"রাখছি আব্বু। আম্মুকে দেখবে। এই নাম্বারে আর ফোন করবে না। একজন বিপদে পরে যাবে তাহলে।"
ফোন কেটে আলো ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। রিতু নিচু হয়ে বসে নরম গলায় বলে,"ভাবী কাঁদবেন না।"
_ডাকবে না আমায় ভাবী,আমি কারো ভাবী নই, না আমি কারো বৌ। ডাকবে না ভাবী আমায়, ডাকবে না। ডাকবে না।
গলা ছেড়ে চিৎকার করতে থাকে আলো।
***
"কিরে ভাইকে দেখে তোর সব হাওয়া বেরিয়ে গিয়েছে?"
কথাটি বলেই সবুজ সাগরকে কুৎসিত একটা গালি দেয়। সাগর তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে ইয়াসারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। ইয়াসার তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে নীরবতা ভেঙে সাগর হেসে বলে,"অনেক দিন পর তোর সাথে দেখা ইয়াসার। দেখে খুব ভালো লাগছে। আমি আনন্দিত।"
_কিন্তু আমার ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে তোর গলাটা চেপে ধরে জা'ন'টা বের করে দিতে।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় ইয়াসার। সাগর উচ্চশব্দে হাসতে থাকে। হাসি থামিয়ে বলে,"ধীরে নেতা ধীরে। ভোটকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে জনগণের জা'ন নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। কেউ ভোট দেবে আপনাকে?"
_একসময় তুই আমার অনেক ভালো বন্ধু ছিলি,তাই তোকে বরদাস্ত করে গিয়েছি সাগর। নিজের অওকাদের মধ্যে থাকবি। নয়তো খুব খারাপ হবে।
সাগর দাঁতে দাঁত চেপে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলে,"কি করবি তুই? কি করবি? শা'লা কাপুরুষ। আতাউরের মতো একটা চামচিকা যার দলের লোক মেরে দেয় সে কি করবে আমাকে?"
_তুই কিভাবে জানলি আতাউর করেছে সব?
সামিনের এমন সরাসরি প্রশ্নে সাগর থতমত খায়। আমতা আমতা করে বলে,"জানি। সব খবর আসে আমার কাছে। আচ্ছা তুই আতাউরের সাথে কি করেছিস বলতো। শা'লা বসে গিয়েছে কেনো? গলায় রামদা ধরেছিলি নাকি?"
সামিন বলে,"বেশি চালাকি করবি না সাগর। এখানে কোনো ঝামেলা করবি না। সত্যিই যদি মায়ের বুকের দুধ খেয়ে থাকিস তাহলে নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত অপেক্ষা কর। তখন মুখোমুখি হ।"
_আচ্ছা? তাই নাকি? খুব আত্মবিশ্বাস না তোর? তুই তো মেয়েদের হাতে চ'ড় খাস শা'লা। তোকে কে ভোট দেবে?
সামিন দাতে দাত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে সে মারামারি করতে চায় না। নয়তো আজ সাগরের খুব খারাপ অবস্থা করে ফেলতো।
***
রিতু একটা প্লেটে অল্প ভাত এবং একটু মাংসের তরকারি নিয়ে ইয়াসারের ঘরে ঢোকে। আলো মেঝেতে বসে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে। ঘরে রিতুর অস্তিত্ব টের পেয়ে
তার দিকে তাকায়। আলোর মুখোমুখি হয়ে মেঝেতে বসে রিতু প্লেট টা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে।
"নিন ভাবী। ভাত টা খেয়ে নিন। অল্প এনেছি।"
_বললাম না আমাকে ভাবী ডাকবে না!
রিতু ম্লান হেসে বলে," আচ্ছা ডাকবো না। আপনি খেয়ে নিন না প্লিজ। দয়া করে খেয়ে নিন।"
আলো প্লেটে হাত দেয়। কিছুক্ষণ প্লেটের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"এই খাবার কোথা থেকে আসে জানো? তোমার শশুর বাড়ির পাপের টাকায়।"
রিতু চুপ করে থাকে। এমন সময় ইশিতা ঘরে ঢোকে। সে দরজার বাইরে থেকে আলোর কথা শুনে ফেলেছে। ঘরে ঢুকে আলোকে বলে,"খাবার টা যেভাবে-ই আসুক,ওটা তোমার রিজিকে ছিলো। এখন খেয়ে নাও, কালকের মতো শুরু করো না। ভাইয়া সন্ধ্যায় বাড়িতে আসলে সিনক্রিয়েট হবে। চুপচাপ থাকো,শান্ত থাকো। আমি ভাইয়াকে বোঝাচ্ছি যাতে সে তোমার প্রতি নরম হয়।"
রিতু মাথা তুলে ইশিতাকে বলে,"ভোট দিয়েছো আপা?"
_হ্যা ভাবী। তুমি যাও,মেজো ভাইয়া অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।
রিতু উঠে চলে যায়। ইশিতা আলোর কাছে এগিয়ে এসে বিছানায় বসে। আলোর দিকে দৃষ্টি দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"খেয়ে নাও। আমি এখানে বসে আছি আলো। খেয়ে খালি প্লেট টা আমার কাছে দাও।"
***
অপজিশন পার্টির সভাপতি শমশের ভুঁইয়া পেয়েছে আটচল্লিশ হাজার তিনশ ছয় ভোট। অপরদিকে সরকারী দলের মনোনীত প্রার্থী সামিন ইয়াসার মির্জা পেয়েছে এক লক্ষ বারো হাজার সাতশো একান্ন ভোট। পঞ্চাশ হাজার ভোটার ভোট প্রদান করেনি। আতাউর আলম নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে তারাও সরে দাঁড়ায়।
২৪ টি ওয়ার্ডে ১১০ টি কেন্দ্রের ৭৩০ টি বুথের ভোট গণনা সম্পন্ন হয়েছে। ১৯ নাম্বার ওয়ার্ডের সরকারি বয়েজ কলেজের মাঠে উল্লাসে ফেটে পরছে সামিন ইয়াসারের ছেলেরা।
কলেজের বারান্দায় প্রিজাইডিং অফিসাররা সামিন কে অভিনন্দন জানায়। ম্লান হেসে সামিন ধীরপায়ে মাঠে নেমে আসে। তাকে দেখে তার দলের ছেলেরা দৌড়ে গিয়ে তাকে জাপটে ধরে। সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,"শান্ত হ সবাই,শান্ত হ!"
রাহাত প্রায় ছুটে আসে। সামিন কে জরিয়ে ধরে চেঁচাতে থাকে,"ভাই আপনি করে দেখিয়েছেন।"
সামিন ম্লান হেসে বলে,"আমরা করে দেখিয়েছি রাহাত।"
আরাফ বলে,"ভাই। ছেলেরা আনন্দ মিছিল বের করতে চাচ্ছে শহরে।"
সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,"না।"
আরাফ শুকনো মুখে বলে,"কেনো ভাই?"
_জামিল সুস্থ হোক আগে।
রাহাত একটা শুকনো হাসি দিয়ে আক্ষেপের সুরে সামিনকে বলে,"জামিল ভাই থাকলে এখন উন্মাদের মতো চেচাতো ভাই।"
***
"বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিতে এই শহরের নব নির্বাচিত মেয়র, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা এবং সুপরিচিত জননেতা সামিন ইয়াসার মির্জা।"
চ্যানেল চব্বিশ ঘন্টায় ব্রেকিং নিউজ। হেডলাইনের দিকে তাকিয়ে আতাউর আলম একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। তার স্ত্রী রেহেনা বিছানায় শুয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
লিভিং রুম থেকে শোরগোলের আওয়াজ পেয়ে আলো ধীরে ধীরে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়। সবাইকে এতো আনন্দিত লাগছে কেনো! দুমিনিট সেভাবে দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত পায়ে ইয়াসারের ঘরে ঢুকে সে টিভি অন করে।
"শহরের নব নির্বাচিত মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জা। আজ দীর্ঘ বারো বছর পরে স্থানীয় সরকার পরিচালনা করবে একজন তরুণ নেতা। জনগণ আশাবাদী এই শহরকে তিনি নতুন রূপে গড়ে তুলবেন।"
সংবাদ পাঠিকার মুখে কথাটি শুনে আলো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কয়েক মূহুর্ত। তারপর চেঁচিয়ে ওঠে,"ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে ঐ পি'শা'চ টা তোদের শহরে। তোরা বুঝলি না বোকার দল!"
রিমোট টিপে টিভি অফ করে মেঝেতে বসে থাকে সে। শরীরটা একটু একটু কাঁপছে। চোখে পানি এসে গিয়েছে। পরাজয়, অসহায়ত্ব এবং লাঞ্ছনার পানি। খানিক বাদে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, অস্ফুট স্বরে বলে,"কেনো আল্লাহ! ওই শ'য়'তা'নকে কেনো জিতিয়ে দিলে!"
***
রাত প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে। নির্বাচনী ঝামেলা সামলে জয়ী মুখ নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে সামিন। সন্ধ্যার পরে, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর থেকে একটার পর একটা ফোন তুলতে হচ্ছে তার। সবাই তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। সংসদ সদস্য কবীর আলমগীর তাকে নিজে এসে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। দলের ছেলেরা তাদের ইয়াসার ভাইয়ের সাথে ছবি তুলে সামাজিক গণমাধ্যমে আপলোড করে সামিনকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে,সব সৌজন্যতা শেষ করে হাসপাতালে গিয়ে জামিলকে দেখে এসেছে একবার।
গাড়ি থেকে নামতেই পোনা চাচা দৌড়ে এসে সামিনকে জরিয়ে ধরে অভিনন্দন জানায়। সামিন হেসে ফেলে। তারপর বলে,"বাড়ির কি অবস্থা?"
_সব ঠিকঠাক। শুধু ইলহামের সাথে তর্কাতর্কি হয়েছে বড় বৌমার। ইলহামকে বলেছে চরিত্রহীন।
সামিন বলে,"এসব কি করে হলো?"
_ইলহাম বড় বৌমাকে তোমার জেতার কথা জানাতে গিয়েছিলো। বৌমা রেগে গিয়ে বলে,"দূরে গিয়ে মর, ধর্ষণ মামলার আসামি, চরিত্রহীন কোথাকার!"
সামিন একটা বড় নিশ্বাস ফেলে ঘরের ভেতর চলে যায়।
***
দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে আলো কপাল কুঁচকে ফেলে। তার মনে তীব্র যন্ত্রনা হতে শুরু করে। ভেতরে ঢুকে সামিন আলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখে। আলো মেঝেতে বসে আছে। সামিন দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে আলমারি থেকে একটা ট্রাউজার এবং টি-শার্ট বের করে ওয়াশ-রুমে ঢুকে পাল্টে নেয়। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"তোমার তো কোনো লস হলো না। বাপ হয়নি তো কি হয়েছে। তোমার স্বামী তো মেয়র হয়েছে।"
আলো দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। সামিন আলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে আলোর মুখোমুখি হয়ে মেঝেতে বসে। আলোর ইচ্ছে করছে পি'শা'চ'টার গলায় ছুরি বসিয়ে দিতে। সামিন আলোর কপালের দিকে তাকিয়ে বলে,"ভেবেছি আজ আমার অনুপস্থিতিতে তুমি পালানোর চেষ্টা করবে। তা করোনি দেখে আমি খুশি হয়েছি। তুমি বুঝদার মেয়ে আলো।"
আলো মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সামনের মানুষটাকে দেখলেই যে তার ঘৃণা হয়।
সামিন হাতের তোয়ালেটা আলোর হাতের উপর রেখে বলে,"যাও এটা ঐ চেয়ারের উপর রেখে এসো।"
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন কন্ঠে বিদ্রুপ মিশিয়ে বলে,"তোমার স্বামী তোমাকে আদেশ দিচ্ছে।"
কথাটি শুনে ঘৃনায় আলোর গা গুলিয়ে ওঠে। তোয়ালেটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে সামিনের দিকে থুতু ছুড়ে মারে। আলোর ছুড়ে দেয়া থুতু সামিনের টি-শার্টের বুকের কাছে লাগে। সামিন কয়েক মুহূর্ত আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে টি-শার্ট টা পাল্টে নেয়। পুনরায় এসে আলোর সামনে বসে বলে,"এতো থুতু কোথা থেকে আসে তোমার? পেটে কৃমি হয়েছে? কৃমির ওষুধ খাওনা কতদিন হয়েছে?"
তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে কন্ঠস্বর গম্ভীর করে বলে,"ওই টি-শার্ট টা কাল সকালে তুমি ধুয়ে দেবে।"
কথাটি বলে সামিন উঠে দাঁড়ায়। আলো হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল চেপে ধরে বসে আছে। সামিন একবার ঘুরে তাকিয়ে বলে,"মেঝেতে ঘুমাতে হবে না। পুরো বিছানা তোমাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ।"
_আমি একটা পি'শা'চ ,জাহিল, ফে'রা'উ'ন , প'শু ,যাকে নিজের স্বামী বলে মানি না তার ঘামের গন্ধ লেপ্টে থাকা বিছানায় শোবো না। বুঝেছিস তুই?
চেঁচিয়ে বলে আলো। সামিন আলোকে কয়েক মুহূর্ত দেখে চেঁচিয়ে ওঠে,"ফুলির মা!"
ফুলির মাকে ডাকতে ডাকতে সামিন দরজার সিটকিনি খুলে দেয়। ফুলির মা নিচ তলা থেকে দৌড়ে গিয়ে সামিনের ঘরের সামনে দাঁড়ায়। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"এই বিছানায় একটা নতুন চাদর বিছিয়ে দাও। যেটার স্টিকার এখনো তোলা হয়নি।"
ফুলির মা মাথা নাড়িয়ে বিছানার চাদর পালটাতে থাকে। মাঝখানে সে একবার আলোকে দেখে আবারও নিজের কাজে মন দেয়। সামিন বলে," সুগন্ধি স্প্রে করে দাও।"
আলো থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে মেঝেতে।
ফুলির মা পুরো ঘরে সুগন্ধি স্প্রে করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
সামিন দরজার সিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"এবার আর কোনো পি'শা'চে'র গায়ের গন্ধ নেই। এবার ঘুমাও।"
কথাটি বলে সামিন বালিশ নিয়ে ডিভানের দিকে এগিয়ে যায়।
ফুলির মাকে রিতু পথে আটকায়।
"কি হয়েছে ফুলির মা? ভাইয়া কেনো ডেকেছিলো?"
ফুলির মা মুচকি হেসে বলে,"ঘর সাজাইতে ভাবী। আচ্ছা ভাবী! বাগান থেকে কিছু ফুল তুলে দিয়ে আসবো?"
রিতু একটা ধমক দিয়ে বলে,"ভাইয়ার থেকে বেশি বোঝো তুমি? যাও গিয়ে ঘুমাও।"
আলো আগের মতই মেঝেতে বসে থাকে। ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে হঠাৎ। সামিন উঠে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ইশমামের নাম্বার। তার ঠোঁট প্রশস্ত হয়ে যায় হাসিতে। ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে যায় সে। ফোনটা রিসিভ করে বলে,"ছোটো তোকে কতবার ফোন দিয়েছি। খবর শুনেছিস তুই?"
_হ্যা ভাইয়া। নিউজ দেখেছি সামাজিক গণমাধ্যমে । অভিনন্দন তোমাকে।
সামিন কপাল কুঁচকে ফেলে। বলে,"কি ব্যাপার ছোটো! তোর কন্ঠস্বর এমন লাগছে কেনো!"
_ঠান্ডা লেগেছে ভাইয়া।
দু'জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ইশমাম বলে ওঠে,"ভাইয়া! আমি দেশে ফিরছি। আগামীকাল আমার ফ্লাইট।"
সামিন আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে,"সত্যি নাকি!"
_হু ভাইয়া। ভাইয়া একটা কথা বলবো?
_হ্যা বল।
_আমি যদি তোমার কাছে কোনো আবদার করি তা মেনে নেবে তুমি? তোমার পছন্দ না হলেও।
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"যে ভাইটা কখনো আমার কাছে কোনো আবদার করেনি তার প্রথম আবদার আমি ফিরিয়ে দেবো? কখনোই না। তুই শুধু আয় ছোটো। আর,এখানে তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।"
ইশমাম শুকনো গলায় বলে,"কি ভাইয়া?"
_সেটা এলেই দেখতে পাবি!
বিছানা ছাড়তে একেবারেই ইচ্ছে করছে না তার। ঘুম ভাঙ্গার পরেও কিছুক্ষণ ম'ট'কা মেরে পরে থাকে সামিন। হুট করে আলোর কথা মাথায় আসতেই সে চোখ খুলে তাকায়। ধ'র'ফ'রি'য়ে উঠে বসে বিছানার দিকে তাকায়। কেউ নেই সেখানে। মেঝেতে পা রেখে ঘরে পরার চটি জোড়া পায়ে দেয়। ঘরের দরজা খোলা। সামিন একবার হাই তুলে ঘরের বাইরে এসে রিতুকে ডাকতে থাকে।
রিতু নিচতলা থেকে নিচু স্বরে জবাব দেয়,"জ্বি ভাইয়া!"
_আলো কোথায়?
রিতু অবাক হয়ে বলে,"জানি না তো ভাইয়া। ঘরে নেই? ভাবীকে তো নিচে নামতে দেখিনি আমি।"
সামিন চোখ মুখ শক্ত করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা সদর দরজার দিকে যায়। বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা বাড়ির দারোয়ান রিয়াজকে ডাকতে থাকে। রিয়াজ প্রায় ছু'টে আসে।
"আলোকে দেখেছিস? বাইরে গিয়েছে?"
_বড় ভাবীকে? নাতো ভাইজান! দেখিনি।
_সকাল থেকে এখানেই ছিলি?
_হু ভাইজান। সকালের বাথরুম আটকে রেখে দাঁড়িয়ে আছি। একটা মাছিও গ'ল'তে দেইনি । পোনা চাচা আসলে বাথরুমে যাবো।
বাইরের কটেজ থেকে পোনা বের হয়। সামিনকে দেখে বলে,"কি হয়েছে?"
_আলোকে পাওয়া যাচ্ছে না।
গম্ভীর কন্ঠে বলে সামিন ফোনে রনির নাম্বার ডায়াল করে ফোন লাগায়।
পোনা কপাল কুঁ'চ'কে এদিক ওদিক তাকাতেই চাঁপা স্বরে চেঁ'চি'য়ে বলে,"ওই তো বড় বৌমা। বাগানে!"
সামিন ফোন কেটে দিয়ে অবাক হয়ে ঘুরে তাকায়। আলোর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। তার ফুলের বাগানের কাছে দাঁড়িয়ে আছে আলো। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পরনে তার লাল রঙের একটা শাড়ি। তাকে একটা ফুলের থেকে কম কিছু লাগছে না। রাতে সামিন এসব কিছু খেয়াল করেনি, কিংবা খেয়াল করতে চায়ও নি সে। কিন্তু সকালের সূর্য তার চোখে আঙুল দিয়ে ওই নারী কায়ার সৌন্দর্য দেখিয়ে দিতে চাইছে।
পোনা এগিয়ে যেতে থাকে আলোর দিকে। সামিন ধীরপায়ে পোনার পিছু পিছু যায়। আলো ওদিক ফিরে দাঁড়িয়ে একটা ফুল ছোঁ'য়।
_বড় বৌমা।
নমনীয় অচেনা পুরুষ কন্ঠ শুনে আলো চ'ম'কে উঠে পোনার দিকে তাকায়। পোনা হাসি হাসি মুখ করে বলে,"আমি পোনা। এই বাড়ির আজীবন মেয়াদী কেয়ার টেকার। ভ'য় পেয়ো না মা।"
আলো একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে পোনার দিকে। সে কি বলবে!
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো পোনার থেকে চোখ সরিয়ে আবারো ফুল গাছ গুলোর দিকে তাকায়। পোনা বলে,"এই গাছ গুলো তোমার স্বামী নিজের হাতে লাগিয়েছে। তার ফুল গাছের খুব শখ। সেই ছোট থেকে। এ বাড়ির প্রত্যেকটা বাগান সে নিজের হাতে করেছে।"
আলো ঘুরে দাঁড়ায় পোনার দিকে। ঘুরে দাড়াতেই তার চোখ যায় সামিনের দিকে। সামিনকে দেখেই সে চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে। তারপর ফুলগাছের দিকে তাকিয়ে পোনা চাচাকে বলে,"এগুলো সব উ'প্রে ফেলুন। "
পোনা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। সামিনের কোনো ভাবান্তর নেই। সে জানে,আলো তাকে অপমান করে কিছু একটা বলবে এখন।
সামিনের ধারণা সত্যি। আলো তার দিকে আঙুল তুলে পোনা চাচাকে বলে,"এই অ'স'ভ্য লোকটার সাথে ফুল মানায় না। এর সাথে কাঁ'টা মানায়। এই ফুল গাছ গুলো উপ্রে ফেলে এখানে কিছু কাঁ'টা মান্দার গাছ এনে লাগিয়ে দিন। তারপর সেই গাছে দড়ি বেঁধে গলায় পেঁচিয়ে ঝুলে পরতে বলুন এই কু'লা'ঙ্গা'র টাকে।"
পোনার মুখ হা হয়ে যায় আলোর কথা শুনে। আলোর চোখ মুখ জ্ব'ল'ছে রোদে এবং রাগে। সামিন কয়েক মুহূর্ত পরে ঠান্ডা গলায় পোনাকে বলে ওঠে,"ওকে দাড় করিয়ে রেখেই ,ওর চোখের সামনে গাছ গুলো উ'প্রে ফেলে দিন পোনা চাচা। তারপর ওকে বাড়ির ভেতরে পাঠিয়ে দিন।"
সামিন চলে যায় বাড়ির ভেতরে। আলো বিড়বিড় করে বলে,"ফে'রা'উ'ন।"
পোনা আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"এমন কথা বলো না মা,এমন কথা বলে না স্বামীকে!"
আলো তেতে ওঠে,"স্বামী? কিসের স্বামী? ঐ ক্রি'মি'না'ল'টাকে আমি স্বামী বলে মানি না।"
_সামিন ইয়াসার কোনো ক্রি'মি'না'ল না মা।
আলো দাঁত খিচিয়ে বলে,"স্বেচ্ছায় অ'ন্ধ আপনারা। চো'খে পট্টি বেঁ'ধে রেখে কিভাবে দেখবেন সব। আমার সাথে যা হয়েছে তার পরেও বলবেন ও ক্রি'মি'না'ল না ?"
পোনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"দেখো মা, তোমার আর সামিনের বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাইনা। সামিন ছোটো বেলা থেকেই একটু জে'দী। জে'দের বশে করে ফেলেছে। কিন্তু মা,ও খা'রা'প ছেলে না। ওকে আমি এইটুকু বয়স থেকে চিনি। ও কয়টা এতিমখানা চালায় তুমি জানো? ও সবসময় মানুষের উপকার করে। ওর কাছে কেউ সাহায্য চাইলে বিনা প্রশ্নে ও সাহায্য করে। এমন মানুষ আর যাই হোক, ক্রি'মি'না'ল না মা। এই আমাকে দেখো। আমার মতো গরীব লোকের মেয়েকে সামিন ডাক্তারি পড়ায়। ওই যে রিয়াজকে দেখছো,ওর মায়ের হার্ট অপারেশন করিয়ে দিয়েছে সেদিন। প্রত্যেক বছর পারিবারিক ব্যবসা থেকে কত টাকা অসহায়দের মাঝে দান করে জানো?"
আলো একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। তারপর বলে,"আপনাদের কাছে ও মহৎ কারন ও আপনাদের কিছু না কিছু দিয়েছে চাচা। কিন্তু আমার কাছ থেকে তো আমার সব নিয়েছে ওই জা'নো'য়া'রটা, আমার পরিবার,আমার খুশি,আমার ভালোলাগা, আমার গোছালো একটা সুন্দর জীবন.....সব। নিঃ'স্ব করে ছেড়েছে আমায়। ওকে ক্রি'মি'না'ল বললেও তো কম হয়ে যায় চাচা!"
***
"কোথায় যাচ্ছো!"
সিঁড়ির প্রথম ধাপে এক পা দিতেই পি'শা'চ কন্ঠ শুনে আলো থমকে দাঁড়ায়। সামিন রুটি ছিঁড়ে ডালের বাটিতে ডুবিয়ে আলোকে প্রশ্নটি করে। আলো উত্তর দিবে না দিবে না করেও বলে ওঠে,"ন'র'কে।"
_খেয়ে তারপর যাও।
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন ইয়াসার। লিভিং রুমের সাথে লাগোয়া ডাইনিং টেবিলে বাড়ির সবাই সকালের খাবার খেতে বসেছে। রিতু নরম গলায় ডাকে,"খেয়ে যান ভাবী।"
আলো তেতে ওঠে,"একদম আমার সাথে সম্পর্ক পাতাবে না বলে দিলাম। বলেছি না আমাকে ভাবী ডাকবে না? বলেছি না?"
রিতু শুকনো হাসি হেসে বলে,"আচ্ছা ডাকবো না। এই শেষ বার। আপনি খেতে বসেন ভাবী। কাল রাতের খাবার খাননি।"
আলো রিতুর কথার উত্তর না দিয়ে ঘুরে আবার সিঁড়ির দিকে যেতে নেয়। সামিন বলে ওঠে,"এ বাড়ির কেউ তোমার চা'ক'রা'নী না। আমার বোন,আমার ভাইয়ের স্ত্রী, কেউ তোমার চা'ক'রা'নী না যে প্রত্যেক বেলা তোমার খাবার ঘরে নিয়ে গিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দেবে।"
_আমি তাদের বলি? আপনার বাড়ির খাবার আমার শরীরে বি'ষে'র থেকে কম প্রভাব ফেলে না।
_চুপচাপ মুখ না চালিয়ে খেতে এসো।
আলো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। টেবিলের উপর রাখা রুটির বাটি থেকে একটা রুটি উঠিয়ে নিয়ে সেটা থেকে এক টুকরো ছিঁড়ে মুখে দিয়ে এক গ্লাস পানি হাতে নেয়। তারপর রুটির টুকরো টা পানি দিয়ে গিলে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।
আলো ন'র'কে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। হ্যা,ইয়াসারের এই ঘরটা তার কাছে ন'র'কের থেকে কম কিছু না। শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে। হঠাৎ তার চোখে পরে দেয়ালে টাঙ্গানো একটা ছবি। ছবিটা আগে চোখে পরেনি তার।তিনজন ছেলে এবং একজন মেয়ে বাচ্চার ছবি। বড় ছেলেটি ওই পি'শা'চ টা তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে । চেহারায় পৈ'শা'চি'ক ছাপ স্পষ্ট। তার পরের জন ইলহাম নামের চ'রি'ত্র'হী'ন লোকটা, মেয়েটি ইশিতা নামের মেয়েটি। চেহারায় বেশ মিল পাওয়া যাচ্ছে। ছোটো এই ছেলেটি তবে কে? আলো কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটাকে আলোর কাছে খুব চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে কোথাও দেখেছে সে।
"তোমার বৌ কিন্তু বেশ বাড়াবাড়ি করছে ভাইয়া। ভাইয়ের বৌ তাই আমি কিছু বলছি না।"
_কি করেছে?
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন ইয়াসার। ইলহাম বিরক্ত হয়ে বলে,"কি করেছে মানে? আমাকে মুখের উপর রে'ই'প কেইসের আ'সা'মি বললো।"
_মিথ্যে তো কিছু বলেনি। প্রতি মাসে হাজিরা দিস এখনো।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে ইয়াসার। ইলহাম বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"তুমি জানো সব মিথ্যা ভাইয়া। ওড়না ধরে টে'নে'ছি'লা'ম শুধু।"
_তোর ওই এক টানে আমাদের পরিবারের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ডাউনফল শুরু হয়েছিলো। জেলে প'চে ম'র'তি। ভালোর মধ্যে ভালো হয়েছে রিতুর মতো একটা মেয়েকে বৌ হিসেবে পেয়েছিস।
ইলহাম নাক চোখ কুঁচকে ফেলে। কি ভালো? একটা গ্রামের মেয়ে। নেহাত ইলহামের সন্তান পেটে ধ'রে'ছে,নয়তো কবে বাড়ি থেকে নামিয়ে দিতো!
সামিন কফি শেষ করে বলে,"ইশমামের জন্য দোতলার উত্তর পাশের ঘরটা পরিষ্কার করে রাখবি ওদের দিয়ে। আমি এখন বের হবো,আজ সংবর্ধনা সভা।"
ইলহাম মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,"বাবা আসবে কবে?"
_সামনের সপ্তাহে।
সামিন উঠে দাঁড়ায়। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে তার ঘরের দরজার কাছে এসে সে থ'ম'কে যায়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
সামিন মৃদু স্বরে ডাকে,"আলো।"
বারবার ঐ পি'শা'চ'টার মুখে নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনলেই আলোর গা রিরি করে ওঠে।
সামিন কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আবারো বলে,"দরজা খোলো। শুধুমাত্র বিছানাটা তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি। এই ঘরটা না। এই ঘরটা আমার আলো। দরজা খোলো।"
আলো দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সরে গিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন ভেতরে ঢুকে একবার আলোর দিকে তাকায়। তারপর আলমারি থেকে তার পোশাক বের করে ওয়াশ-রুমে ঢুকে পাল্টে নেয়। শুভ্র সুতির পাঞ্জাবি আর তার উপরে মুজিব কোট চাপিয়েছে আজ সে। পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজের চুল ঠিক করে আয়নার মধ্যে আলোর প্রতিবিম্বের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে,"তোমার মায়ের জ্ব'র সে'রে'ছে। ভাইয়েরা আজ কলেজে গিয়েছে।"
আলো চ'ম'কে ওঠে। সামিনের দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ কন্ঠে বলে,"পেয়ে গিয়েছেন তো আমায়। হয়ে গিয়েছে না প্র'তি'শো'ধ নেওয়া? এখনো কেনো ওদের পি'ছু পরে আছেন? ছেরে দিন ওদের।"
সামিন আলোর দিকে এগিয়ে এসে শুকনো হাসি হাসে, তারপর বলে,"বাহ! এই তো! এভাবে কথা বলবে আলো। মেয়ে মানুষ ঠিক এভাবে কথা বলে, নমনীয় হয়ে। তাহলে যদি পুরুষের মন গ'লে, জে'দ দেখিয়ে কিছু বললে পুরুষ শুনবে কেনো?"
সামিনের এই কথাটিতে সামিনের প্রতি আলোর ঘৃ'ণা আরো একধাপ বেড়ে যায়। সে কিছু না বলে চোখ নামিয়ে নেয়। বলতে বলতে সে ক্লান্ত। সামিন বলে,"নজর রাখছি না ওদের উপর। দেখভাল করছি। তোমার ভাই দু'টো একেবারে যা তা লেভেলের ভী'তু। ওদের দেখভাল করতে হবে প্রচুর। যত যাই হোক,আমি ওদের দুলাভাই।"
"দুলাভাই" শব্দটা শুনে আলো দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলোর হাত ধরে। আলো এক ঝ'ট'কা'য় হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। সামিন আবারো ধরে আলোর হাত তারপর আলোর কনুইয়ের দিকটা দেখে। আলোর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"এতটা কেটেছে কিভাবে?"
আলো হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে বারান্দায় চলে যায়।
সামিন এক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ড্রয়ার থেকে একটা মলম আর তার তিনটা পাঞ্জাবি বিছানার উপরে রেখে বলে,"মলমটা লাগিয়ে নিও।আর আমার বাড়ির প্রাচীর খুব উঁচু আলো। এই প্রাচীর ট'প'কে পালাতে পারবে না তুমি। শুধু শুধু তা'র'কা'টা'য় লেগে নরম তক ক্ষ'ত'বি'ক্ষ'ত হবে। আজ প্রথম এবং শেষ। এরপর কখনো যদি দেখি তুমি বাগানে গিয়েছো তাহলে খুব খা'রা'প হবে। আজকে এই চমৎকার পা'ক'না'মি'র জন্য তোমাকে শাস্তি হিসেবে এই পাঞ্জাবি তিনটা দিয়ে গেলাম। বোতাম গুলো লাগিয়ে রাখবে।
সামিন চলে যায়। আলো চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চালাক শি'য়া'লটা ঠিক বুঝে গিয়েছে আলো বাগানে কেনো গিয়েছিলো!
***
"আমাদের সময়ানুবর্তী ভাই আজ লেইট করছে,এই ব্যাপারে তোমাদের মতামত কি ভাইলোগ?"
রাহাতের এমন প্রশ্নে সবাই ওর মুখের দিকে তাকায়। ফুয়াদ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,"কাল সারাদিন ধ'ক'ল গিয়েছে। তাই ঘুমটা একটু গভীর হয়েছে বোধ হয়।"
ফুয়াদের এমন উত্তরের বিরোধীতা করে তৌফ বলে,"না ভাই। ভাই তো এই প্রথম এতো ধকল সামলায় না। এসবে ভাইয়ের অভ্যেস আছে। আসলে নতুন বৌ রেখে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না পুরুষ মানুষের। আমাকে দেখেন,আমি তো আসতেই চাইনি এতো তাড়াতাড়ি, রনি ভাই ঘা'র ধ'রে নিয়ে আসছে।"
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আরাফ ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,"ভাই ওই মেয়েটাকে নিয়ে কিভাবে সংসার করবে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ওই মেয়েকে তো ভাই ভালোবাসে না।"
_ভালো আজ বাসে না, কাল তো বাসতেই পারে।
তৌফের এমন কথায় রাহাত বলে,"ভাই অমন মেয়েকে কখনোই ভালো বাসবে না। ওই মেয়ে আজীবন একটা জে'দ হয়ে থাকবে ভাইয়ের কাছে।"
_না ভাই, মিলিয়ে নিয়েন আমার কথা। মেয়ে মানুষ জাদু জানে ভাই। দেখবেন একদিন ঠিকই ভাই ওই মেয়েকে বু'কে টে'নে নিয়ে বলবে,"ভে'ঙে'ছো কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেবো না?"
সবাই চাপা স্বরে হেসে ওঠে তৌফের কথায়। তৌফ মুখ হাসি হাসি করে বলে,"স্ত্রীকে বি'ছা'না'র সৌন্দর্য উপাধি দেওয়া ভাই একদিন ওই মেয়েকে মাথায় তুলে নাচবে। এইটা যদি না হয়,তাহলে আমার নাম উল্টে ফেলবেন।"
রাহাত বলে,"আমি এখনি তোর নাম উল্টে ফেলছি, তোর নাম আজ থেকে ফতৌ।"
এমন সময় সামিন এসে দাঁড়ায় সেখানে। সামিনকে দেখে তৌফ চুপ হয়ে যায়। ফুয়াদ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,"দেরী হলো কেনো? প্রথম দিনেই এতো দেরী? জনগণ তো আ'শা'হ'ত হবে নেতা।"
সামিন চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,"ইশমাম আসবে কাল। ওর জন্য বাড়িটা একটু গোছগাছ করিয়েছি। লোককে বুঝিয়ে দিয়ে এলাম সবটা।"
তৌফ সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"ভাই আপনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। মুজিব কোট গায়ে আপনাকে পুরো শেখ মুজিবরের মতো লাগছে। শুধু গোঁফ এবং হাতে পাইপটা নেই।"
আরাফ পানি খেতে নিচ্ছিলো,তৌফের কথা শুনে কাশি উঠে যায় আরাফের। ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"এখন চল! বসে পরলি কেনো? আজ তোর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান , তোর কোনো শীত গরম দেখছি না।"
সামিন উঠে দাঁড়ায়। সত্যিই,কোনো এক অজানা কারনে সে আগ্রহ পাচ্ছে না কোনো কিছুতে। মন পরে আছে বাড়িতে। এর কারন কী!
***
"এই দাড়া!"
আজান আয়াত হাঁটতে থাকে। পেছন থেকে কলেজের কিছু সিনিয়র ছেলে ডাকে ওদের।
"এই তোদের দাঁড়াতে বলেছি না?"
দু'জনে দাঁড়িয়ে পরে। ছেলেগুলো ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। এদের মধ্যে একটা খুব লম্বা দেখে ছেলে ধ'ম'কে'র সুরে বলে,"নাম কি তোদের?"
আজান নমনীয় হয়ে বলে,"আমি আজান, ও আয়াত।"
_কোন ক্লাস?
_ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার।
_বড় ভাইদের দেখলে সালাম দিতে হয় জানিস না?
আজান আর আয়াত একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ছেলে গুলোর মধ্যে থেকে একটা ছেলে লম্বা ছেলেটাকে বলে,"দীপু ভাই। এখনো সালাম দিচ্ছে না। এদের মাথায় কি ঘি'লু নেই?"
দীপু কপাল কুঁ'চ'কে বলে,"হু,তাই তো দেখছি।"
তারপর আজান আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে,"এই কলেজের নিয়ম জানিস?"
আজান আয়াত মাথা নাড়ায়। দীপু বলে,"কলেজে ঢুকে বড় ভাইদের সালাম দিতে হয়।"
একটা ছেলে আজানের চো'খ থেকে চশমা খুলে নেয়। চশমা নিজের চো'খে লাগিয়ে বলে,"এতো পাওয়ার তোর চশমায়। কা'না নাকি রে তুই।"
_ওর চশমাটা দিয়ে দিন। চশমা ছাড়া ওর অসুবিধে হয়।
কঠিন গলায় বলে আয়াত। দীপু কপাল কুঁচকে আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে,"বাবা, বিড়াল তো মিউ মিউ করতে জানে দেখছি। আচ্ছা চশমা ফেরত পাবি, আগে একটু নেচে দেখা। নাচে যদি দশে দশ পাস তাহলে চশমা ফেরত পাবি।"
পাশ থেকে একটা ছেলে দাঁত বের করে বলে,"ভাই আমার পছন্দের গানে নাচবে ওরা।"
কথাটি বলেই ছেলেটা ফোনে একটা হিন্দি গান ছে'ড়ে দেয়।
আজান আয়াত ঘা'ব'ড়ে গিয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।
রনির নাম্বার দেখে সামিন ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে রনি বলে,"আপনার "দু'দু'ভা'তু" শ্যালক দু'টোকে র্যাগ দিচ্ছে অনার্সের কিছু রাম-ছাগল। কি করবো?"
_তুই ভালো করে জানিস তুই কি করবি। শুধু শুধু আমাকে ফোন দিয়েছিস কেনো?
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন। তারপর বলে ওঠে,"দাঁত গুলো নাড়িয়ে দে। একেবারে ফেলে দিস না।"
রনি ফোন কেটে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ভাইয়ের বিয়ের চক্করে রাজনীতি ছেড়ে কখনো সেলসম্যান, কখনো ওষুধের ডিলার কখনো গু'ন্ডা'গি'রি করতে হচ্ছে। কি দিন এলো তার!
***
"আলোকে কোথাও দেখছি না ভাবী। কোথাও গিয়েছে নাকি ও?"
রেহেনা মাথা ঘুরিয়ে খোরশেদের দিকে আ'ত'ঙ্কি'ত মুখ নিয়ে তাকায়। আমতা আমতা করে বলে,"ওর মেজো মামার কাছে গিয়েছে।"
_বজলুর কাছে? খুলনা গিয়েছে? ওর তো শুনেছি সামনের সপ্তাহে ইনকোর্স এক্সাম।
রেহেনা ম্লান হেসে বলে,"ওর নানী একটু অসুস্থ। দেখতে চেয়েছে। চলে আসবে।"
খোরশেদ যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না সবটা। বিষয়টা তার কাছে খুব গোলমেলে লাগছে। আতাউর আলম হুট করে নির্বাচন বর্জন করে গর্তে ঢুকে গিয়েছে এদিকে তার মেয়ে বাড়ি থেকে উধাও। বিষয়টি খুবই গোলমেলে।
দীপুর পেছনে দাঁড়িয়ে রনি বলে ওঠে,"নাচ দেখতে ইচ্ছে করছে তোদের?"
আজান আয়াত রনির কন্ঠস্বর শুনে একটা ঢোক গিলে ফেলে। এ তো সেই লোকটা, যে সেদিন রাতে তাদের গলায় ছুরি ধরেছিল। এ এখানেও চলে এসেছে!
দীপু রনিকে দেখে ঘাবড়ে যায়। সামিন ইয়াসারের খাস চ্যা'লা রনি। এ কেনো এখানে এসেছে!
রনি এগিয়ে যায় দীপুর দিকে। কঠিন গলায় বলে,"নাচ দেখবি?"
দীপু একটু সাহসী সাজতে চায় নিজের দলের কাছে। বুক ফুলিয়ে বলে,"এটা আমাদের কলেজের মামলা।"
_কিন্তু ওরা তো আমার লোক।
_আপনার লোক মানে?
_মানে আমাদের সামিন ভাইয়ের একটা নাচের গ্রুপ আছে বুঝলি। ওরা সেই দলের লোক। আমাদের লোক এভাবে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়া নাচে না,তার জন্য অনেক বড় দাম দিতে হয়।
_দাম মানে?
_হু, দাম। আপাতত তোর দাঁত গুলো দে।
দীপু কিছু বুঝে ওঠার আগে স্ব-শব্দে দীপুর ডান গালে একটা চ'ড় বসিয়ে দেয় রনি। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকে আঁ'ত'কে ওঠে।
রনি আজান-আয়াতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"ক্লাসে যাও।"
***
সারাটা দিন সামিন বাইরে কাটিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরেছে। গাড়ির পেছনের সিট দু'টো ফুলের মালায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে অলস ভঙ্গিতে হেঁটে বাড়ির ভেতরে যায়। ইহান তার বড় বাবাকে দেখে ছু'টে আসে। ইহানকে কোলে উঠিয়ে গালে চুমু খায় সামিন। লিভিং রুমে এসে দাঁড়ায় ইহানের নতুন টিচার শান্ত। ফরসা এবং সুদর্শন একজন যুবক। কাঁধে ব্যাগ উঠিয়ে নিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে সালাম দেয়। সামিন সালামের উত্তর দিয়ে বলে,"নাস্তা করেছো।"
_জ্বি ভাইয়া।
নিচু স্বরে বলে শান্ত। তারপর চলে যায়। সামিনের কাছে ছেলেটিকে বাড়াবাড়ি রকমের বোকা বোকা মনে হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে,ইশমামের বয়সী। কেমন মাথা নিচু করে হাঁটাচলা করে। মাথায় একটা ঘোমটা দিলেই পুরোপুরি মেয়ে মানুষ লাগতো। সামিনের কাছে ছেলেটির আচার আচরণ হাস্যকর লাগে। এভাবে মাথা নিচু করে হাঁটবে মেয়ে মানুষ, পুরুষ হাঁটবে বুক ফু'লি'য়ে। সিংহের মতো।
রিতু একগ্লাস লেমন ওয়াটার এনে সামিনের দিকে এগিয়ে দেয়। সামিন হাসি দিয়ে গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বলে,"সব ঠিক ঠাক?"
_না ভাইয়া। একটু সমস্যা আছে।
সামিন চুমুক দিতে গিয়েও দেয়না। রিতু বলে,"ঘরে গিয়ে দেখুন।"
সামিন গ্লাস টা রিতুর হাতে দিয়ে হনহন করে চলে যায় নিজের ঘরে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই তার চোখ ক'পা'লে উঠে যায়। পুরো ঘরে টুকরো কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। আলোর তার শখের দামী পাঞ্জাবি তিনটা খুব যত্ন করে কাচি দিয়ে কু'চি কু'চি করে কে'টে ফেলেছে।
আলোর এমন শিশুসুলভ আচরণে সামিনের খানিকটা রাগ উঠলেও সে তার অনুভূতি ব্যক্ত করেনা। বরং ঠান্ডা গলায় বলে,"বড্ড পরিশ্রমী মেয়ে তুমি আলো। পাঞ্জাবি তিনটা মাঝ বরাবর একটুখানি কেটে ফেললেই সেগুলো পরার অযোগ্য হয়ে যেতো। কিন্তু তুমি কত ধৈর্য দেখালে।"
আলো মেঝেতে চুপচাপ বসে ছিলো। সামিনের দিকে না তাকিয়ে বলে,"সুযোগ পেলে আপনার শরীর টাও এভাবে টু'ক'রো করবো আমি।"
সামিন বাঁকা হাসি হেসে আলমারি থেকে তার একটি ট্রাউজার আর টি-শার্ট বের করে আলোর দিকে না তাকিয়ে বলে,"খালি কলসি বা'জে বেশি। প্রবাদটার পারফেক্ট উদাহরণ তুমি আলো।"
কথাটি বলে ওয়াশ রুমে ঢুকে জামাকাপড় পাল্টে নিয়ে বের হয়ে সিতারা কে ডেকে ঘরটা পরিষ্কার করে দিতে বলে সামিন। সিতারা ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে চলে যায়। সামিন আলোর দিকে একবার তাকিয়ে বলে,"মেঝেতে বসে থাকো কেনো এভাবে?"
আলো তার উত্তর দেয় না। সামিন আলোকে ভালো করে লক্ষ্য করে বলে ,"ওষুধ লাগাওনি কেন হাতে?"
আলো চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। সামিন বিছানার উপর থেকে মলমটা উঠিয়ে নিয়ে এসে আলোর সামনে বসে। আলোর হাত টা ধরে কিছুক্ষণ ক্ষতটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"এরকম একটা গভীর ক্ষ'ত এভাবে খোলা রেখে ঘুরে বেরাচ্ছো। ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে, এতটুকু কমন সেন্স নেই তোমার সচেতন বাবার সচেতন কন্যা?"
_হোক ইনফেকশন, আপনার থেকে ভ'য়ং'ক'র কিছু না সেটা।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো। সামিন কিছু না বলে আলোর হাত ধরে ওষুধ লাগিয়ে দেয়ার জন্য। আলো এ ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,"এভাবে কথায় কথায় আমাকে ছোঁ'য়া'র অযুহাত বের করবেন না। জা'নো'য়া'র , জা'লি'ম কোথাকার।
সামিন ম্লান হেসে আলোর দিকে তাকায়। তারপর আলোর হাতটা তার শক্তিশালী হাতে শক্ত করে ধরে। আলো সামিনের শক্তির সাথে পেরে ওঠে না। সামিন ওষুধ টা আলোর হাতে লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,"তোমাকে ছুঁ'তে আমার কোনো অজুহাত কিংবা নাটক করতে হবে না আলো। ভুলে যাচ্ছো তুমি আমার স্ত্রী। তোমাকে ছোঁ'য়া'র ইচ্ছে হলে আমি কোনো অজুহাত খুঁজতে যাবো না।"
আলোর নিজের অসহায়ত্বের কথা সামিনের মুখে আরো একবার উচ্চারিত হতে শুনে ঠোঁট কাঁ'প'তে থাকে। সামিন আলোর ক্ষ'ত তে ওষুধ টা লেপ্টে দিয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলোর চোখে পানি দেখে তার হঠাৎ করে মনে হলো এরকম একটা কথা বলা তার ঠিক হয়নি। ভয় পেয়েছে মেয়েটা। পরক্ষনেই মনে পরলো,ভয় দেখানোর জন্যই তো বলেছে সে কথাটা।
সামিন উঠে দাঁড়ায়। আলো অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"জা'নো'য়া'র, পি'শা'চ।"
সামিন আলোর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,"আচ্ছা তোমার মুখ ব্যাথা করে না? এক কাজ করবে, বারবার কষ্ট করে আমাকে এসব না ডেকে একটা টেপ রেকর্ডারে গা'লা'গা'ল গুলো রেকর্ড করে রাখবে। তারপর আমি বাড়িতে ফিরলেই আমার কানের কাছে রেখে অন করে দিয়ে বসে থাকবে। তোমার কষ্ট হবে না।"
আলো মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সামিন বলে,"কাল সকালে আমার ছোটো ভাই আসবে আমেরিকা থেকে। তুমি এ বাড়ির বৌ তাই ভাবলাম তোমাকেও বলে রাখি কথাটা। তার সামনে কোনোরকম ঔদ্ধত্য দেখাবে না তুমি। সে খুব ভালো একটা ছেলে, তাকে অপমান করে,গা'লি দিয়ে কোনো কথা তুমি বলবে না। আমি বরদাস্ত করবো না আলো।"
"কাকে খুজছিস ছোটো? গার্লফ্রেন্ড?"
ভিড়ের মধ্যে ভাইয়ার কন্ঠস্বর শুনে ইশমামের মুখে হাসি ফোটে। সে প্রস্তুত ছিলো এই মুহূর্তের জন্য। ইশমাম জানতো ভাইয়া ছুটে চলে আসবে তাকে রিসিভ করতে। ভাইয়ার কাছে ইশমামের থেকে ইম্পরট্যান্ট কিছু নেই।
ইশমামের চোখ খুঁজতে থাকে সামিনকে। সামিন এক হাত উঁচু করে ধরে বলে,"আমি এখানে ছোটো, ডানে তাকা।"
ইশমাম ডানে তাকাতেই দেখতে পায় তার ভাইয়া তার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। সেই মুখ,সেই হাসি,সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সেই ফিট বডি, পাঞ্জাবি পরে হাতা গুটিয়ে রাখার স্টাইল, সেই পেশীবহুল শক্তিশালী হাত, সেই সিংহের মতো টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, চারবছর আগে ভাইয়াকে সে ঠিক যেরকম দেখে গিয়েছে,এই ভাইয়া আর সেই ভাইয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য ইশমামের চোখে ধরা পরছে না। সামিন হাত বাড়িয়ে আছে। ইশমাম প্রায় ছুটে গিয়ে ভাইয়াকে জরিয়ে ধরে। তারপর বলে,"তুমি আগের মতোই আছো ভাইয়া, পারফিউম টা-ও বদলাও নি। একই ফ্রেগরেন্স।"
_হ্যা,যেটা তুই চু'রি করে মাখতি গায়ে। আমায় না বলে।
সামিন হেসে বলে কথাটি। ইশমাম হেসে ফেলে। ভাইয়ের কপালের দিকে তাকিয়ে বলে,"ভেবেছি কপালের কাছে কিছু চুল উঠে গিয়ে টাক হয়ে গিয়েছো তুমি। ভিডিও কলে অন্যরকম লাগতো। ত্রিশ পেরিয়েও নায়কের মতো সুদর্শন দেখতে তুমি। একটুও বদলাও নি তুমি। ছিটেফোঁটাও না। "
_কিন্তু তুই বদলে গিয়েছিস। তোকে এখন ব্যাটা-ছেলেদের মতো লাগছে। আগের সেই বাচ্চা বাচ্চা ভাবটা নেই। সুপুরুষ লাগছে।
ইশমাম হাসে। সামিন বলে,"তখন এদিক ওদিক তাকিয়ে কাকে খুজছিলি? প্রেমিকা?"
_তোমাকেই ভাইয়া।
কথাটি বলে ইশমাম আশেপাশে তাকায়, তারপর ম্লান হেসে বলে,"আমি জানতাম আর কেউ না আসুক,তুমি আসবে।"
_বাবা চেন্নাই গিয়েছে ছোটো। ইলহাম আর ইশিতাকে আমি নিষেধ করেছি আসতে। তাদের বাড়িতে কিছু কাজ দিয়েছি।
ইশমাম চুপ করে থাকে। সামিন ইশমামের কাঁধে হাত রেখে বলে,"চল। বাড়িতে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তোর জন্য। ইহান খুব এক্সাইটেড। ওকে তো দেড় বছরের দেখে গিয়েছিলি তুই। তাকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে।"
_মেজো ভাবী কেমন আছে? ভাইয়া শুধরেছে নাকি আছে আগের মতোই?
সামিন কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ির দরজা খু'লে দেয়।
গাড়ীতে উঠে ইশমাম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"মেয়র সাহেব কোন সারপ্রাইজের কথা বলেছিলেন? কি সারপ্রাইজ?"
সামিন ড্রাইভ করতে করতে ইশমামের দিকে তাকায়। ঠান্ডা গলায় বলে,"বাড়িতে চল। দেখতে পাবি।"
_ইশুর বিয়ে ঠিক করেছো?
_আগে চল বাড়িতে।
দুজনের দৃষ্টি সামনের দিকে। সামিন কিছু সময় পরে বলে ওঠে,"কি আবদার তোর?"
ইশমামের চোখ মুখ অ'স্ব'স্তি'তে ছেয়ে যায়। সামিনের চোখে তা ধরা পরে। ঠান্ডা গলায় বলে,"আমি জানি তুই এমন কিছু চাইবি না যেটা আমি তোকে এনে দিতে পারবো না বা আমার অওকাদের বাইরে। তবুও যদি এমন কিছু হয় তাহলে জেনে রাখ তোর ভাইয়া কোন বাক্য ব্যয় না করে তোর আবদার পূরণ করবে। এতো টেনশন নেয়ার কিছু নেই।"
ইশমাম সামিনের কথায় স্বস্তি পায়না। সে তার ভাইয়াকে খুব ভালো করেই চেনে। কখনোই ভাইয়া অদ্রিতাকে মেনে নেবে না। কখনোই না। তবু এটা ইশমামের প্রথম এবং শেষ চেষ্টা।
সামিন দৃষ্টি সামনের দিকে রেখে ইশমামকে বলে,"গাজীপুরের বাগান বাড়িটা বাবাকে দিয়ে তোর নামে লিখে দিয়েছি। তোর তো নিড়িবিলি স্থান খুব পছন্দ। ওখানে গিয়ে সময় কাটাতে পারবি।"
_এসব আমার কিছু চাই না ভাইয়া। বাবার কোনো সম্পত্তির ভাগ আমি চাই না। পরে আবার কথা শোনাবে। আমি সম্পত্তির লো'ভে দেশে ফিরেছি।
_বাবার উপর তোর কেনো এতো রা'গ বলতো? বাবা তো সবকিছু থেকে বেরিয়ে এসেছে। রাগ থাকলে আমার উপর থাকার কথা, রা'জ'নী'তি আমি করছি।
ইশমাম চুপ করে থাকে। সামিন বলে,"তোর জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করে রেখেছি আমি। তোর ফুয়াদ ভাইয়ার কাজিন। ফুয়াদ আমাকে ছবি দেখিয়েছে। তোর পছন্দ হবে। মেয়েটির চৌদ্দ গুষ্টিতে কেউ রা'জ'নী'তির সাথে জড়িত নেই। একেবারে তোর মনের মতো সম্বন্ধ।"
ইশমাম ম্লান হাসে। সামিন বলে,"সিরিয়াস আমি ছোটো। একবার যখন দেশে এসেছিস আর যেতে পারবি না তুই। লেখাপড়া অনেক করেছিস।"
***
নিচতলায় শো'র'গো'লে'র আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আলো সেদিকে কান না দিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। এখান থেকে দৃষ্টি দিলেই দূরে তাদের কলেজের পাঁচতলা ভবনের কিছুটা দেখতে পাওয়া যায়। আলোর বুকটা হুহু করে ওঠে। সামনের সপ্তাহে তাদের ইনকোর্স এক্সাম শুরু হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আলো এক্সাম দিতো। এখন তো আলোর পুরো জীবনটাই অনিশ্চিত। শুধুমাত্র একটা মানুষের জে'দ আর প্র'তি'হিং'সা'র শি'কা'র হয়েছে সে।
দরজার নব ঘোরার শব্দ হয়। আলো ঘুরে তাকায় না। পি'শা'চ'টা সকাল সকাল কোথাও বেড়িয়ে গিয়েছে। নিশ্চয়ই সে ফিরেছে।
"ভাবী।"
রিতু আলোকে ডাকে। আলো কপাল কুঁ'চ'কে তাকায়। রিতুর হাতে কিছু বক্স। আলোর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,"আপনার জিনিসপত্র সব ভাইয়ার আলমারির পাশে যে আলমারি টা আছে সেটাতে গুছিয়ে রেখেছি ভাবী।"
আলো কিছু না বলে আবারও জানালার বাইরে দৃষ্টি দেয়। রিতু হাতের বক্স গুলো বিছানার উপরে রাখতে রাখতে বলে,"আমাদের শাশুড়ি মায়ের গয়না ভাবী। মা সবকিছু তিন ছেলের বৌয়ের জন্য ভাগ করে দিয়ে গিয়েছিলো। এগুলো আপনার ভাগের গয়না।"
আলোর রা'গ উঠে যায়। রিতু নামের ভী'তু মেয়েটিকে দুটো মন্দ কথা শুনিয়ে কোনো লাভ হবে না আদৌও,তাই সে চুপ থাকে। রিতু একটা বক্স থেকে দুটো সোনার বালা বের করে আলোর কাছে এগিয়ে যায়। অনেকটা সাহস নিয়ে আলোর হাত ধরে বালা দুটো পরিয়ে দিতে দিতে বলে,"এই দু'টো কিন্তু আমার শাশুড়ি মায়ের ব্যাবহার করা। এই দু'টোর কোনো ভাগ হয়নি। তিনি বলে গিয়েছেন এই দু'টো তার বড় ছেলের বৌ পাবে। তিনি পেয়েছিলেন আমাদের দাদী শাশুড়ির থেকে। দাদী শাশুড়ি পেয়েছিলো তার শাশুড়ি মায়ের থেকে।"
আলো হাত সরিয়ে নেয় না। সামিনের পো'ষ্য মানুষগুলোকে কিছু বলতে ইচ্ছে হয়না আর তার। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার হাতের দিকে। একদিকে সামিন ইয়াসার তার পায়ে শি'ক'ল পরিয়ে দিয়েছে আর আজ হাতে এই চুড়ি। একটু একটু করে আলোর অ'স্তি'ত্ব মিটে যাচ্ছে।
রিতু আলোর আলমারি খুলে একটা গোলাপী রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ি বের করে বিছানার উপর রেখে বলে,"গোলাপী রঙে বেশ মানায় আপনাকে ভাবী। এটা পরে নিন। আজ আমাদের ছোটো দেবর আসার উপলক্ষে বাড়িতে নতুন নতুন মেহমান আসবে কিছু। ভাইয়া বলে গিয়েছে আপনাকে রেডি করিয়ে রাখতে।"
***
"আজ সকাল সকাল এলেন যে।"
ইশিতার কথায় শান্ত একবার ইশিতার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। ইশিতা ভালো করে লক্ষ্য করে লোকটাকে। ঘন কালো ঝাঁকড়া চুলের সুদর্শন এক যুবক। মোটা কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে দুটো সহজ সরল চোখ, বেশিরভাগ সময় যার দৃষ্টি থাকে মেঝের দিকে। যেনো এই বাড়িতে ঢুকে সে অন্যকিছুর দিকে তাকালে সামিন ইয়াসার মির্জা তার প্রা'ন নি'য়ে নেবে। ইশিতা মৃদু স্বরে বলে,"মেঝেতে কিছু খুঁজছেন ? কিছু কি পরে গিয়েছে আপনার?"
শান্ত খুবই নিচু স্বরে বলে,"জ্বি না।"
_তাহলে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন কেনো? আপনাকে দেখলে মনে হয় আপনার কোনো অমূল্য সম্পদ মেঝেতে পরে গিয়েছে আর আপনি সেটা খু'জে বেড়াচ্ছেন মেঝেতে।"
শান্ত কিছু বলে না। মনে মনে সে প্রচন্ড বি'র'ক্ত হয়। এই বাড়িতে টিউশনি নেওয়াটা তার ভুল হয়ে গিয়েছে। এই বাড়ির কোনো লোককেই তার সুবিধার মনে হয়না। সবাই গু'ন্ডা প্রকৃতির। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটিও তাই। কথাবার্তায় কোনো আন্তরিকতা নেই। হয়তো সে গরীব শ্রেনীর কেউ তাই তাকে এমন ব্যবহার ফেইস করতে হয়।
ইশিতা শান্তকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে বলে,"আপনাকে পরপর কয়েকটি প্রশ্ন করলাম,আপনি একটারও উত্তর দিলেন না। আপনি ইহানকে পড়ান কিভাবে? যেখানে নিজের মুখ থেকেই কথা বের হয় না।"
শান্ত একবার ইশিতার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে,"সকাল সকাল এসেছি কারন রিতু ভাবী ডেকেছে। ইহানের ছোটো চাচা আসবে তাই সকাল সকাল পড়িয়ে যেতে হবে। আর আমি মেঝেতে কিছু খুঁজছিলাম না। আমার কোনো অমূল্য সম্পদ নেই যেটা মেঝেতে পরে গেলে আমি খুজবো। আমি এভাবেই হাঁটি। "
কথাটি বলে শান্ত সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়। ইশিতা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শান্তর দিকে। যতটা বো'কা আর শান্ত ভেবেছিলো,এই ছেলেটা তা নয়। শান্ত কিছুদূর গিয়ে পেছনে ফিরে ইশিতার দিকে একবার তাকায়। ইশিতার দৃষ্টি তার চোখের দিকে। ইশিতা তখনো বুঝতে পারেনি সে খুব শিগগিরই ঐ মোটা কালো ফ্রেমের চশমার নিচের শান্ত দুটি চোখের মায়ায় আটকা পরতে চলেছে।
***
ভাইকে দেখে বুকে জ'রি'য়ে ধরে ইলহাম কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। যত মান অভিমান হোক না কেনো র'ক্তে'র টান উপেক্ষা করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব।
ইশিতা পাশ থেকে বলে ওঠে,"কত জন্ম অপেক্ষা করাবি আমাকে ইশমাম,ভাইয়াকে ছে'ড়ে আমাকে দেখ। আমার গিফট দে!"
ইশমাম ইলহামকে ছেড়ে ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"আজ বুঝতে পারলাম ইশু, তোর বিয়ে কেনো হচ্ছে না। তোর যা চেহারা হয়েছে তাতে পাত্র জুটবে বলে মনে হয়না।"
ইশিতা ইশমামের বুকে আদরের সহিত কি/ল ঘু/ষি মেরে বলে,"আমার ভাইদের থেকেও দেখতে হ্যান্ডসাম, রাজপুত্রের মতো বর হবে আমার দেখিস। তোরা হা হয়ে যাবি।"
ইহান গুটি গুটি পায়ে লিভিং রুমে গিয়ে দাঁড়ায়। রিতু তাকে নিয়ে এসেছে। ইলহাম রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আরেকজন "হোসনে আরা শান্তি" দাঁড়িয়ে আছে ভাবী। মাথায় এতো বড় ঘোমটা।"
রিতু মুচকি হাসে। ইশমাম ইহানের দিকে তাকিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,"আমাকে চিনেছো তুমি? আমি ছোটো বাবা তোমার।"
ইহান অ'বা'ক চোখে তাকিয়ে থাকে তার ছোটো বাবার দিকে। ইশমাম এসে ওকে কোলে তুলে চু'মু খায়।
নিচে হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আলো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখে। গায়ে ওই লোকটার দেয়া শাড়ি,গয়না। নিজের দিকে তাকাতেই আলোর দুঃখ হচ্ছে খুব। নিচে ঐ লোকটা আনন্দ করছে। আজ তার ভাই এসেছে। তার পরিবার সম্পূর্ণ হয়েছে। লোকটাকে দেখে যতদূর মনে হয়েছে লোকটা তার পরিবারের লোকদের প্রচন্ড ভালোবাসে। অথচ এই লোকটা আলোকে তার পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে নিজের কা'রা'গা'রে ব'ন্দি করে রেখেছে।
ইশমাম এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,"ভাইয়া বলেছে সারপ্রাইজ আছে! কি সারপ্রাইজ? এখানে তো কোনো সারপ্রাইজ নেই।"
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। সামিন ইশমামকে সোফায় বসার নির্দেশ দিয়ে নিজেও বসে। ইহান তার ছোটো বাবার কাছ থেকে উঠে গিয়ে বড় বাবার কোলে বসে পরে। সামিন ইশমামের দিকে দৃষ্টি দিয়ে ঠা'ন্ডা গলায় বলে,"আমি বিয়ে করেছি ছোটো।"
ইশমাম প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি ভাইয়ার কথা। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে সে যেই না সবটা বুঝেছে অমনি চাপা স্বরে চেঁ'চি'য়ে বলে,"রিয়েলি! ভাইয়া! মজা করছো না তো!"
সামিন মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়। রিতু এবং ইশিতা একে অপরের দিকে শুকনো মুখে তাকায়। ইশমাম সামিনকে বলে,"এতো বড় একটা কথা তুমি এখন বলছো ভাইয়া? এটা কোনো কথা? আমি খুব করে চাইতাম তুমি বিয়ে করো। আর তুমি আমাকে না জানিয়েই......."
ইলহাম ইশমামকে থামিয়ে দিয়ে বলে,"তোকে সারপ্রাইজ দিয়েছে। এতো ক্ষেপে যাচ্ছিস কেনো তুই?"
ইশমাম অভিযোগের সুরে বলে,"ক্ষেপে যাচ্ছি না। আমি সবার জন্য কত গিফট নিয়ে এলাম,সেখানে নতুন ভাবীকে খালি হাতে দেখবো। কি একটা লজ্জায় ফেলে দিলে তুমি ভাইয়া। আচ্ছা নতুন ভাবী দেখতে কেমন?"
ফুলির মা পাশ থেকে বলে ওঠে,"এক্কেবারে হিন্দি সিনেমার নায়িকা দিব্যিয়া ভারতীর মতো ছোটো ভাইজান। কিন্তু গায়ের রং টা একটু চাপা এবং একটু খা'টো। তয় বড় ভাইজানের পাশে খুব মানাইছে। মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ!"
ইশমাম হেসে ফেলে,"তোমার বর্ণনা শুনে আমার তো আর তর সইছে না ফুলির মা। আমাদের দিব্যিয়া ভারতী ভাবী কোথায়? ডাকো তাকে? নাকি ভাইয়ার ঘরে গিয়ে দেখবো?"
_তুই বস। রিতু ডেকে আনছে।
সামিন ইশমামকে কথাটি বলে রিতুর দিকে তাকায়। রিতু মাথা না'ড়ি'য়ে সিঁড়ির কাছে যায়।
ইশমাম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"কবে করলে বিয়ে?"
_চার-পাচ দিন আগে।
_নির্বাচনী ঝা'মে'লা'র মধ্যে? কি এমন তাড়া ছিলো? প্রেমের বিয়ে নাকি ভাইয়া? কখনো তো বলো নি আমাকে! বাবা জানে?
"ভাবী।"
আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের থেকে চোখ সরিয়ে রিতুর দিকে তাকায় । দরজার বাইরে থেকে উঁ'কি দিয়ে ডাকছে আলোকে। নিস্তেজ কন্ঠে আলো বলে,"আবার কি? শাড়ি গয়না তো পরেছি।"
রিতু ভেতরে ঢোকে। আলোকে একবার তাকিয়ে দেখে। কি সুন্দর মুখশ্রী,তার ভাসুর এমনি এমনি দি'ও'য়া'না হয়নি। সোনার গয়না গুলো পরে একেবারে নতুন বৌয়ের মতো লাগছে আলোকে। চোখ ফেরানো দায়। আলো তার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। রিতু বলে,"নিচে চলুন ভাবী। ভাইয়া ডাকছে!"
_আমি কেনো নিচে যাবো? তার দরকার থাকলে তাকে এখানে আসতে বলো।
_আপনাকে নিচে নিয়ে যেতে বলছে। তার ছোটো ভাই এসেছে। সম্পর্কে আপনার দেবর।
_তাতে আমার কি? যাকে স্বামী বলে স্বী'কা'র করি না তার ছোটভাইকে দেবর বলছো কেনো?
কঠিন গলায় বলে আলো। রিতু বলে,"চলুন ভাবী। জে'দ করবেন না। দুমিনিট থেকেই চলে আসবেন।"
আলো একটা দী'র্ঘ'শ্বা'স ছেড়ে রিতুর পিছু পিছু সিঁড়ির দিকে যায়। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে হঠাৎ করে সে থ'ম'কে দাঁড়ায়। নিচে সবাই কথা বলছে। ইয়াসার মির্জা, ইলহাম মির্জা ছাড়াও অন্য একটি পুরুষ কন্ঠ আলোর কানে যেতে সে চ'ম'কে ওঠে। সে কি সত্যি শুনছে নাকি তার ভ্রম! রিতু আলোকে দাঁড়িয়ে পরতে দেখে বলে,"আসুন ভাবী।"
আলো কাঁ'প'ছে। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। অত্যন্ত পরিচিত ওই পুরুষ কন্ঠটি তার মস্তিষ্কে তীরের ফলার মতো আ'ঘা'ত করছে। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে সিঁড়ি থেকে নামে। লিভিং রুমে সবাই বসে আছে। আলো অচেনা পুরুষটির চেহারা দেখতে পায়না,সে ওদিকে ফিরে বসে তার ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। ক্রমে ক্রমে আলোর অস্বস্তি বেড়ে চলেছে। সামিন ইয়াসার আলোকে দেখতে পায়, হুট করে তার চোখ চলে যায় আলোর হাতের দিকে। তার মায়ের চুড়িতে এই মেয়েটার হাত দুটো সজ্জিত হয়েছে। খুবই ভালো লাগছে দেখতে। আলো ধীরপায়ে হেটে এগিয়ে যেতে থাকে। ফুলির মা চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"ছোটো ভাইজান,বড় ভাবী আইসা পরছে।"
ইশমাম উঠে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। আলো আরো দুই কদম এগিয়ে যেতেই দাঁড়িয়ে পরে। ইশমাম আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হাসিতে প্রশস্ত হয়ে থাকা ঠোঁট জোড়া হঠাৎ করে অন্য রূপ ধারণ করেছে, কাঁপছে কিছু টা। আলো ইশমামের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখ,সেই নাক,সেই ভ্রু-যুগল,সেই থুতনির নিচের টোল। আলো ভুল দেখছে না। কিছুই ভুল দেখছে না সে। তার মস্তিষ্কে অনবরত কেউ হাতুড়ি পে'টা'চ্ছে। কেউ দা'মা'মা বাজিয়ে যাচ্ছে, অদৃশ্য কেউ চিৎকার দিয়ে বলছে,"তুই ঠ'কে'ছি'স আলো,তোকে ঠ'কা'নো হয়েছিলো।"
ইশমাম বুঝতে পারছে না সে কি করবে। তার পায়ের দিক টা হঠাৎ করে অ'সা'ড় হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে পুরো শরীরে তা ছড়িয়ে পরছে। সামিন ইশমামের পাশ থেকে বলে ওঠে,"তোর বড় ভাবী। অদ্রিতা আলো। চিনিস ওকে তুই।"
ইশমাম বোকার মতো তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। তাকায় আলোর দিকে, ইশিতার দিকে, ইলহামের দিকে, রিতুর দিকে, ফুলির মায়ের দিকে,ইহানের দিকে। সে ফ্যালফ্যাল করে দেখছে প্রত্যেকের মুখ। এটা কি কোনো ষ'ড়'য'ন্ত্র! তার সাথে সবাই মজা করছে নাকি!
আলো খেয়াল করলো সে হঠাৎ করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দুই বার দেখছে। মনে হচ্ছে দুজন দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। দুজন ইশমাম,দুজন প্র'তা'র'ক, দুজন ধা'ন্দা'বা'জ, দুজন মিথ্যুক। মনে মনে বলতে থাকে,"তুই শক্ত থাক আলো। দোহাই তোর। তুই দয়া করে শক্ত থাক।"
আলোর ভেতরে যে আলো আছে। সে আলোর অনুরোধ রাখে না। তীব্র অ'ভি'মা'ন, ঘৃ'ণা, আ'ঘা'তে জর্জরিত হয়ে লুটিয়ে পরে মেঝেতে।
রিতু চেঁচিয়ে ওঠে,"বড় ভাবী!"
ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকে অ'বা'ক হয়ে মেঝেতে পরে থাকা অ'চে'ত'ন আলোকে দেখতে থাকে। কয়েক মুহূর্ত কেটে যেতেই সামিন ছুটে যায় আলোর কাছে। ঝুঁকে বসে পরে মেঝেতে। আলোর গালে আলতো করে চা'প'ড় মে'রে গম্ভীর কন্ঠে ডাকতে থাকে,"আলো.....আলো!"
ইশমাম সামিন আর আলোকে দেখতে থাকে। সে দাঁড়িয়ে আছে একটা জড়বস্তুর মতো,একটা পাথরের মতো।
সামিন এদিক ওদিক তাকায়। ফুলির মা এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে সামিনের হাতে দেয়। সামিন আলোর মুখে ছেটাতে থাকে পানি। কোনো কাজ হয় না তাতে। সামিন পাঞ্জাবির হাতা ভালো করে গুটিয়ে নিয়ে আলোকে পাঁ'জা'কো'লা করে তুলে নেয়। ইশমাম একদৃষ্টে সেই দৃশ্য দেখতে থাকে।
আলোকে উঠিয়ে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকে। রিতু,ইশিতা,ফুলির মা চিন্তিত ভঙ্গিতে সামিনের পিছু পিছু যায়।
লিভিং রুমে দাড়িয়ে থাকে ইশমাম এবং ইলহাম। ইলহাম ইশমামের কাঁধে হাত রেখে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"আমাদের বড় ভাবীর যখন তখন সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার রো'গ আছে। ঘা'ব'ড়ে যাস না। তুই ঘরে গিয়ে রেস্ট নে। ভাত খাবি তো? সিতারাকে বলছি তোর খাবার টেবিলে দিতে। তোর পছন্দের সব রান্না করে রেখেছে ইশিতা আর ইহানের মা।"
ইশমাম ইলহামের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।
***
বিছানায় আলোকে শুইয়ে দিয়ে সামিন আলোর গালে হাত রেখে আলোকে ডাকতে থাকে।
রিতু আলোর পায়ের কাছে বসে চিন্তিত ভঙ্গিতে ইয়াসারকে বলে,"ভাইয়া ডাক্তার ডাকেন, হুট করে এভাবে অ'জ্ঞা'ন কেনো হয়ে যাবে।"
সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে একবার আলোর দিকে তাকায়। হঠাৎ করে তার ফোন বেজে ওঠে। সবুজের নাম্বার,তার মানে হসপিটাল থেকে এসেছে। সামিন ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। ইশিতা এসে আলোর মাথার কাছে বসে। রিতু ইশিতার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,"কি হলো বলো তো আপা, এমন করে অ'জ্ঞা'ন হয়ে যাবে কেনো!"
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফুলির মা নিচু স্বরে বলে ওঠে,"চিন্তা কইরেন না ভাবী। অ'জ্ঞা'ন হয়নাই। বড় ভাবী নতুন নতুন জ'ন্ম'নি'রো'ধ'ক বড়ি খায় তাই হয়তো এমনি মাথা ঘুরে পরে গেছে। বিয়ার পরপর আমিও ওই সব খাইতে পারতাম না। শুধু ব'মি হইতো আর মাথা ঘুরতো সারাদিন। এখন গা সওয়া হয়ে গেছে।"
রিতু কপাল কুঁ'চ'কে ফুলির মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"চুপ করবে তুমি!"
সামিন ফোনে কথা বলে ঘরে এসে ইশিতার দিকে তাকায়। তারপর বলে,"ডাক্তার পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমাকে একটু বের হতে হবে। জামিলের অবস্থা ভালো না। একটু দেখিস।"
ইশিতা কোনো জবাব দেয়না। আলোর জন্য ভাইয়ার মধ্যে উ'ৎ'ক'ণ্ঠা দেখে সে কিছুটা অবাক হয়।
সামিন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে দেখে ইশমাম এখনো লিভিং রুমে দাড়িয়ে আছে। সে চেঁচিয়ে বলে,"তুই কি নতুন এ বাড়িতে? এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস। উত্তর পাশের ঘরটা সাজিয়ে রেখেছি। ঘরে গিয়ে রেস্ট নে। আমি এক ঘন্টার জন্য বাইরে যাচ্ছি। এসে কথা হবে। "
সামিন তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ার সময় দেখলো না সে তার আদরের ছোটো ভাইটাকে কিভাবে,কতটা জ'ঘ'ন্য ভাবে ভে'ঙে'চু'রে দিয়ে গিয়েছে। খেয়ালই করলো না সামিন ইয়াসার মির্জা।
***
হসপিটালে পৌঁছে সামিন গাড়ি থেকে নেমে দেখে ফুয়াদ দাঁড়িয়ে। সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"ইশমাম এসেছে?"
_হু। কিছুক্ষণ আগে।
_না আসলেও পারতি,আমরা দেখছি। অবস্থা স্টেবল এখন কিছুটা।
সামিন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাতের ফোনের দিকে তাকায়। তারপর একজন ডাক্তারকে ফোন করে বলে,"হ্যা আপনি পৌঁছেছেন ডক্টর? হ্যা দেখুন। আচ্ছা রাখছি।"
ফুয়াদ অবাক হয়ে বলে,"ডাক্তার কার জন্য? কে অ'সু'স্থ?"
_আলো।
_কি হয়েছে?
_হঠাৎ করে সে'ন্স'লে'স হয়ে গিয়েছে।
ফুয়াদ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,"কি যে একটা অবস্থা! তুই কি করতে চাইছিস কিছু বুঝতে পারছি না।"
_কিছু বুঝতে হবে না, জামিলের কাছে চল।
***
ডাক্তার পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগেই আলোর জ্ঞা'ন ফিরেছে। চোখ খুলে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখছে সবাইকে। রিতু নিচু স্বরে ডাকতে থাকে,"ও ভাবী! শুনতে পাচ্ছেন! আপনার কি কোথাও ক'ষ্ট হচ্ছে!"
আলো একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি ছেড়ে দেয়। ইশিতা তা খেয়াল করে বলে,"কি সমস্যা! বলো আমাদের।"
আলো উঠে বসতে চায়। ইশিতা আলোকে ধরে বসিয়ে দেয়। সিতারা এসে জানায় নিচে ডাক্তার এসেছে,তাকে উপরে পাঠাবে কিনা জানতে চায়। ইশিতা বলে,"পাঠিয়ে দাও।"
_নাহ।
তেজী কন্ঠে বলে ওঠে আলো। সবাই তার মুখের দিকে তাকায়। আলো আর্তনাদ করে ওঠে,"কেউ আসবে না। আমি একা থাকতে চাই। আপনারা বেড়িয়ে যান এই ঘর থেকে!"
ইশিতা আলোকে ধরে বলে,"তুমি অসুস্থ আলো,ডাক্তার এসে দেখে যাক একবার।"
_বললাম না কেউ আসবে না? বললাম না আপনাদের এই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে ?
আলোর কন্ঠে কিছু একটা ছিলো। সবাই চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
***
ডাক্তারের কথা শুনতে শুনতে সামিন বেশ কয়েকবার ফোনের দিকে তাকায়। ফুয়াদ তা খেয়াল করে। ডাক্তার চলে যেতে ফুয়াদ সামিনকে বলে,
"একটা লোক, যে সবসময় তার ছেলে পুলেদের বলতো জরুরি কাজের সময় বৌয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে, জরুরি মিটিং-এ বৌয়ের ফোন রিসিভ না করতে, সেই লোক বারবার বৌয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে ফোন চেক করছে কেনো? অদ্ভুত!"
সামিন কপাল কুঁচকে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,"ফাজলামি করিস না। বিয়ে করেছি, একটা রেসপনসিবিলিটি আছে। ওদের মতো লু'তু'পু'তু কথা বলার জন্য বসে নেই আমি।"
_তা এতোই যখন রেসপনসিবিলিটি তাহলে নিজেই ইশিতাকে ফোন করে জেনে নে জ্ঞান ফিরেছে কি না। ওর ফোনের আশায় বসে আছিস কেনো? নাকি যেচে ফোন দিলে তোর পু'রু'ষ'ত্ব অপমানিত হবে?
সামিন ফুয়াদের দিকে চোখ রা'ঙি'য়ে একবার তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। তারপর বলে ওঠে,"তার প্রয়োজন নেই। বাড়িতে যাচ্ছি। গেলেই দেখতে পাবো।"
***
ইশমামের দরজার সামনে এসে রিতু ইশমামকে ডেকে বলে,"খাবে না ভাইয়া?"
বেশ কিছুক্ষণ পরে ইশমাম কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দেয়,"আমি একটু ঠিক হয়ে নেই ভাবী। জার্নিতে মাথাটা খুব ধরেছে।"
হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে আলো। কিছুক্ষণ যেতেই ফুঁ'পি'য়ে ওঠে। শরীরটা একটু একটু করে কাঁ'প'ছে। জানালার থাই গ্লাস খোলা, বাইরে সম্ভবত ঝড়ো হাওয়া বইছে। বৃষ্টি নামবে হয়তো।জানালা থেকে ঝড়ো হাওয়া ঘরে প্রবেশ করে পুরো ঘরে ছড়িয়ে পরছে। বাইরে যে ঝড় বইছে তার থেকেও হাজার গুণ বেশি ঝড় আলোর মনে বয়ে চলেছে। আলোর আলগা হয়ে যাওয়া খোপা খুলে গিয়েছে। চুল গুলো বেপরোয়া উড়ছে। দরজার নব ঘোরার শব্দ হতেই আলো মাথা তুলে চোখের পানি মুছে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। ভেবেছিল ইয়াসার এসেছে। ঐ লোকটাকে সে তার চোখের পানি দেখাতে চায় না। আলোর ধারণাকে মিথ্যে করে দিয়ে ঘরে ঢোকে ইশমাম। আলো থমথমে মুখ নিয়ে ইশমামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশমাম ধীর পায়ে আলোর দিকে এগিয়ে আসে।
ব্যাকুল কন্ঠে বলে,"অদ্রিতা।"
আলো বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,"ওখানেই দাঁড়িয়ে যাও।"
ইশমাম দাঁড়িয়ে পরে। আলো ইশমামের চোখের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ধরা গলায় বলে ওঠে,"প্র'তা'র'ক, ঠ'ক, মি'থ্যু'ক, ধা'ন্দা'বা'জ।"
ইশমাম আকুতির সুরে বলে,"অদ্রিতা আই ক্যান এক্সপ্লেইন।"
_এখান থেকে বেরিয়ে যাও তুমি, বেরিয়ে যাও প্র'তা'র'ক।
হিংস্র বাঘিনীর মতো গ'র্জে ওঠে আলো।
ইশমাম আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলোর চোখ মুখ তীব্র ক্ষো'ভে ফে'টে পরতে চাইছে। ইশমাম এক কদম সামনে এগোতেই আলো দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে রাগে ফুঁ'স'তে থাকে। ইশমাম আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নরম সুরে বলে,"এসব কিভাবে হলো অদ্রিতা?"
_বেড়িয়ে যাও তুমি। বেড়িয়ে যাও।
_অদ্রিতা...
আলো ইশমামের দিকে তে'ড়ে যায়, চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"লজ্জা করে না? লজ্জা করে না ভাইয়ের বৌয়ের ঘরে পারমিশন না নিয়ে ঢুকতে?"
আলোর কথায় ইশমাম চোখ নামিয়ে নেয়। আলো একবার দেয়ালে টাঙ্গানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে ইশমামের দিকে তাকায়। বিড়বিড় করে বলতে থাকে,"সেজন্যই এতো মিল। সেজন্যই সামিন ইয়াসার মির্জার নামে কোনো বা'জে কথা শুনতে পারতে না তুমি। আমারই ভুল। আমিই বোকা। আমিই বুঝতে পারিনি।"
ঝরঝর করে কেঁ'দে দেয় আলো।
_ঘৃ'ণা করো না আমাকে অদ্রিতা। তোমাকে হারাতে চাইনি আমি। তাই বলিনি সত্যিটা।
ইশমামের এই কথায় আলো দুচোখে পানি নিয়েও তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে,তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,"হারাতে চাওনি? হারিয়ে তো ফেলেছো! বেশ হয়েছে। বেশ হয়েছে। এটাই তোমার উচিত শিক্ষা।"
ইশমাম আহত চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো বলতে থাকে,"বাবা টিচার, মা গৃহিণী। বাবা মা সম্পর্কে মিথ্যা বলতে বাঁধলো না একটুও? তুমি তো সামিন ইয়াসার মির্জার চেয়েও নি'কৃ'ষ্ট। ছ'ল'না করে পেতে চেয়েছিলে আমায়। নাকি কখনো চাওনি। ভেবেছিলে কিছুদিন টাইম পাস করে ছেড়ে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাবে। অদ্রিতা নামের বোকা মেয়েটা টেরই পাবেনা।"
_অদ্রিতা।
ইশমাম আর কিছু শুনতে চাইছে না আলোর মুখে। আলো বলতে থাকে,"ধিক্কার জানাই তোমাকে। তোমার থেকে তো সামিন ইয়াসার ঢের ভালো। যা করেছে সামনাসামনি করেছে, তোমার মতো প্রতারনা করে....."
আর কিছু বলতে পারে না আলো। পুরো শরীর ভেঙ্গে কান্না আসছে। কাঁ'দ'তে কাঁ'দ'তে মেঝেতে বসে পরে। ইশমাম আলোর দিকে অসহায়ের মতো দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। কয়েক মুহূর্ত পরে কান্নাটা দ'মি'য়ে আলো বলে ওঠে,"একেবারে সামিন ইয়াসার মির্জার হাতে গড়া পা'ষ'ণ্ড তুমি। একবারও ভাবলে না একটা মেয়ের ইমোশন নিয়ে এভাবে খেলা ঠিক না। কি উদ্দেশ্যে ছিলো বলো? তুমি ভালো করেই জানতে তুমি মির্জা বাড়ির ছেলে জানতে পারলে আমি তোমাকে বরদাস্ত করবো না তবুও কোন উদ্দেশ্য,কোন আশায় তুমি রিলেশন কনটিনিউ করেছিলে? বলো!"
ইশমাম কিছু বলে না। আলো চেঁচাতে থাকে,"বেড়িয়ে যাও, বেড়িয়ে যাও এখান থেকে। ওই মুখ আমি দেখতে চাই না। বেড়িয়ে যাও প্র'তা'র'ক।"
শেষের কথাটা অত্যন্ত উচ্চস্বরে বলে আলো। নিচতলা থেকে আলোর চি'ৎ'কা'র শোনা যাচ্ছে। ইশিতা রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"কাকে বেড়িয়ে যেতে বলছে?"
রিতু চিন্তিত ভঙ্গিতে সামিনের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইশমাম ধীরপায়ে ঘর থেকে বের হয়। রিতু অবাক হয়ে ইশমামের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশমাম রিতুর দৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
***
লিভিং রুমে ঢুকে সামিন দাঁড়িয়ে পরে। ইশিতা আর রিতু তার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"জ্ঞান ফিরেছে? ডাক্তার কি বলেছে?"
_ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন হয়নি। জ্ঞান তার আগেই ফিরেছে। একটু আগে গিয়ে দেখি জ্বর এসেছে হঠাৎ।
"ও"
শুকনো মুখে বলে সামিন সিঁড়ির দিকে যায়। তারপর দাঁড়িয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"ইশমাম কিছু খেয়েছে?"
_কি আর খাবে ভাইজান। বড় ভাবী যে ব্যাবহার টা করলো তারপর আর খাবার পেটে যায়?
"মানে?"
গম্ভীর কন্ঠে শব্দটি উচ্চারণ করে সামিন,ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ফুলির মায়ের দিকে।
ফুলির মা বলতে থাকে,"জ্ঞান ফেরার পরে মে'জা'জ দেখাইয়া আমাদের সবাইরে ঘর থিকা বাহির কইরা দিলো। ইশমাম ভাইয়া ভাবীরে দেখতে গেছিলো ঘরে,ভাবী খুব বাজে ব্যবহার কইরা ইশমাম ভাইয়ারে ঘর থেকে বের কইরা দিছে। ইশমাম ভাইয়া সেই যে ঘরের দরজা বন্ধ করছে এখনো খোলে নাই। কেউ ডাকলেও সাড়া দিতেছে না ভাইজান।"
সামিনের রাগ উঠে যায়। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলে যায়। ইশিতা ফুলির মাকে ধ'ম'ক দিয়ে বলে,"বেশি কথা বলো তুমি!"
দরজা খোলা। সামিন একবার উঁকি দিয়ে আলোকে দেখে নেয়। গুটিসুটি মেরে মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে চুপচাপ। ঘরে না ঢুকে সামিন সোজা ইশমামের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজায় টোকা দিয়ে বলে,"ছোটো।"
ইশমাম কোনো সাড়া দেয়না। সামিন জোরে ডাকতে থাকে,"ছোটো দরজা খোল।"
কিছুক্ষণ পর ইশমাম দরজা খুলে দেয়। সামিন তার ভাইকে দেখে। কেমন বিধ্বস্ত রূপ ধারণ করেছে ইশমামের মুখ। সামিন বলে ওঠে,"কি বলেছে ও তোকে? গা'লা'গা'ল করেছে?"
ইশমাম ধীরে ধীরে চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকায়। সামিন বলে,"তুই নিচে চল। খাবি।"
_ভাইয়া তুমি যাও। আমি খাবো না এখন।
নিস্তেজ কন্ঠে জবাব দেয় ইশমাম। সামিন ধমকের সুরে বলে,"খাবি না মানে? তুই কেনো খাবি না। ও অন্যায় করেছে। ওকে শাস্তি পেতে হবে। তুই নিচে চল। চল বলছি।"
সামিন ইশমামকে জোর করে নিচে পাঠিয়ে দেয়। ইশমাম রোবটের মতো হাটছে, জগতের কোনো কিছুর দিকে তার কোনো হুস নেই যেন।
ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিয়ে আলোর দিকে রা'গী দৃষ্টিতে তাকায় সামিন। আলো সামিনের অস্তিত্ব টের পায় কিন্তু মাথা তুলে তাকায় না। সামিন আলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার শক্ত হাতে আলোর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে আলোর চোখের দিকে তাকায়। আলোর চোখ দু'টো দেখে সামিন থ'ম'কে যায়। দেখেই মনে হচ্ছে কাঁদছিল এতক্ষণ। সামিনের হুট করে রা'গ পরে যায়। আলোর থুতনি থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বিছানায় একপাশে বসে পরে। ভেবেছিলো ধ'ম'কে নিয়ে যাবে কিন্তু আলোকে দেখে আর ধ'ম'কা'তে ইচ্ছে করছে না। নিচু স্বরে বলে,"আমার সাথে জড়িত সব মানুষকে তুমি ঘৃণা করো ঠিকাছে, ইশমাম নতুন মানুষ। আমার কোনো অন্যায়ের আগে পিছে ও নেই। একটু ভদ্রতা বজায় রাখা যেত না?"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন নিজেকে নিজে বলে,"কাকে কি বলছি। সোজা আঙ্গুলে এই ঘি কখনোই উঠবে না। জানা কথা।"
বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। সামিন উঠে দাঁড়িয়ে আলোর হাত ধরে। আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"চলো আমার সাথে।"
***
"আজ হঠাৎ এলি যে!"
পরী পেছন থেকে বাবার ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পরে। ছাতাটা একটু উঁচুতে তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,"ইশিতা আপু ডেকেছে। আর ক্লাসও ছিলো না আজ।"
পোনা বলে,"ও।"
পরী ধীরপায়ে হেটে সদর দরজার দিকে যায়। ছাতাটা পোর্চের নিচে পানি ঝরার জন্য রেখে দেয়। গায়ের ওড়নাটা ঠিক ঠাক করে ভেতরে ঢোকে। করিডোর পেরিয়ে লিভিং রুমে ঢুকতেই দেখতে পায় সিঁড়ি বেয়ে নামছে ইশমাম। পরী থ'ম'কে দাঁড়িয়ে পরে। চার বছর আগের দেখা ইশমাম ভাইয়ের সাথে এই লোকটার বিস্তর ফারাক। স্বাস্থ্যও কিছুটা ভালো হয়েছে। পরীর ভাষ্যমতে আগে খ্যাংরা কাঠির মতো দেখতে ছিলো। আগে গালে মাংস ছিলো না বলে চোখ দুটো বড় বড় লাগতো। এখন গাল দুটো বেশ ভরাট তাই চোখ দুটোকে ছোটো লাগছে। অবশ্য একটা জিনিস বদলায় নি। ইশমামের মুখের বিধ্বস্ত অবস্থা। এই লোকটা সবসময় মুখ এমন করেই রাখে। দেখলে মনে হয় সকাল থেকে বাথরুম আটকে রেখেছে সিরিয়াল পায়নি বলে,আর পাঁচ মিনিট দেরী হলে বিরাট বড় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সেই টেনশনে সে অস্থির!
ইশমাম নিচে নামতেই পরী অনেকটা জড়তা নিয়ে বলে,"কেমন আছেন ইশমাম ভাইয়া।"
ইশমাম পরীর দিকে একপলক তাকিয়ে শুকনো গলায় বলে,"ভালো।"
এতোটুকু বলে সে ডাইনিং-এর দিকে চলে যায়। পরী ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। সব কিছু বদলে গেলেও এই মহাশয়ের ব্যাবহার একটুও বদলায় নি। কেউ কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে তাকেও যে জিজ্ঞেস করতে হয় সেটা এই লোকটা এখনো শেখেনি। কিংবা যতটুকু জানতো আমেরিকায় গিয়ে সব খেয়ে বসে আছে। পরী কপাল কুঁচকে দোতলায় ইশিতার ঘরের দিকে যায়। সে থোরাই কেয়ার করে এসব রামগরুরের ছানাদের।
***
আলোর হাত ধরে টানতে টানতে সামিন ডাইনিং টেবিলের সামনে এনে দাড় করায়। ইশমাম মাথা নিচু করে বসে আছে। সামিন একটা চেয়ার টেনে ইশমামের পাশে বসে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"আমার ভাই এখন ভাত খাবে। তুমি ওর বড় ভাবী। ওর প্লেটে মাংস তুলে দাও।"
ইশমাম ভাইয়ের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টি এলোমেলো। আলো শুকনো মুখে সামিনের দিকে একবার তাকিয়ে ইশমামের দিকে তাকায়। সামিন বলে,"হা করে দেখছো কি? এ বাড়ির বৌ তুমি, তোমার দেবর খেতে বসেছে। তার প্লেটে মাংস তুলে দাও।"
আলো হাত বাড়িয়ে মাংসের বাটি ধরে। আবারো চোখ তুলে একবার ইশমাম, একবার সামিনকে দেখে। ঘৃণায় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় তার ভেতর থেকে। সামিনকে হতবাক করে দিয়ে আলো মাংসের বাটি উল্টে দেয় ইশমামের প্লেটে। তারপর মাছ ভাজার বাটি, তারপর রোস্টের বাটি, তারপর দইয়ের বাটি। সবকিছু ঢেলে দেয় ইশমামের প্লেটের উপর।
ইশমাম নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, হতভম্ব ভাব কাটিয়ে কিছু বলার আগেই আলো চলে যায় সেখান থেকে।
রিতু দৌড়ে এসে সামিনকে শান্ত করে বলে,"ও ভাইয়া। ভাবীর শরীর ভালো নেই। জ্বর গায়ে। খামোখা তাকে জোর করবেন না প্লিজ। আমি দিচ্ছি ইশমাম ভাইয়াকে খাবার বেড়ে।"
ইশমামের সামনে থেকে সবকিছু পরিষ্কার করে রিতু নতুন করে খাবার বাড়তে শুরু করে। ইশমাম পাথরের মতো বসে আছে। সামিন বলে,"তুই খা।"
ভাইয়ের কথায় বাধ্য ছেলের মতো ইশমাম কিছুটা খেয়ে হাত ধুয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"আমি ঘরে যাই ভাইয়া? খুব ঘুম পাচ্ছে! বড্ড ক্লান্ত আমি!"
***
ঘরে ঢুকে দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে গায়ে জ্বর বেড়েছে। আলোর দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"আমি ভুলে গিয়েছিলাম তুমি ভরা জনসভায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতার গালে চ'ড় মেরে দেওয়া মেয়ে,তোমাকে এতো সহজে পোষ মানানো যাবে না।"
_পোষ মানিয়ে কি করবেন? আপনার বাড়ি, আপনার ঘর, আপনার রাজত্ব, আপনার পোষা লোক সব, আপনার ক্ষমতা,আপনার গায়ের জোর। পোষ মানার ধার ধারেন কেনো?
আলোর কন্ঠে কিছু একটা ছিলো। সামিন আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলোর পুরো শরীর জ্ব'লে যাচ্ছে। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বলে,"কেনো বিয়ে করেছেন? চেহারা দেখার জন্য নয় নিশ্চই। কিসের অপেক্ষা করছেন আপনি। কেনো নিজের স্বার্থ হাসিল করে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন না? তাহলেই তো পুরোপুরি প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যায়। আমিও মুক্তি পাই। আমি আপনার এই কা'রা'গা'র থেকে মুক্তি চাই ইয়াসার মির্জা। না আমি আপনাকে কখনো স্বামি হিসেবে মানবো,না আপনি আমায় কখনো স্ত্রী হিসেবে পাবেন। যদি আমাকে লা'ঞ্চি'ত করার ইচ্ছে থাকে,করে আমাকে মুক্তি দিন। আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি ইয়াসার মির্জা। আলো আপনার কাছে হার স্বীকার করে নিলো আজ । আমি শুধু মুক্তি চাই। আপনি, আপনার বাড়ির প্রত্যেকটা লোকের মুখ আমি দেখতে চাই না। দয়া করে মুক্তি দিন আমায়। কথা দিচ্ছি আমার পরিবার নিয়ে আমি খুলনা চলে যাবো আজীবনের জন্য। আর কখনো আপনার সাথে লাগতে আসবো না। কখনোই না।"
উন্মাদের মত ঘোর লাগা কন্ঠে আলো বলে কথা গুলো। জ্বরে তার গা পু'ড়ে যেতে চাইছে। সামিন আলোর চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হুট করে আলোর কপালে হাত দেয়। প্রচন্ড গরম আলোর শরীর। চোখ টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে। আলো সামিনের হাত সরিয়ে দেয় নিজের কপাল থেকে। সামিন বলে,"এখন হাত সরিয়ে দিচ্ছো কেনো? এই মাত্র কতকিছু বললে। আমি যেন আমার যা ইচ্ছা করে তোমাকে ছু'ড়ে ফেলে দেই।"
আলো শাড়ির আঁচল খামচে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। অস্ফুট স্বরে বলে,"আপনি খারাপ,আপনারা সবাই খারাপ। জঘন্য আপনারা।"
_নতুন কথা না এটা। তোমার গায়ে ভীষণ জ্বর। চুপ করে বসে থাকো। আমি ওষুধ নিয়ে আসছি।
_চাই না আপনার দয়া। উপহাস করবেন না আর আমার সাথে। আল্লাহ কে ভয় করুন ইয়াসার মির্জা।
সামিন চুপ করে থাকে। আলো ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে চায়। সামিন হাত দিয়ে আলোর পথ আটকে বলে,"বিছানায় শুয়ে রেস্ট নাও। বাইরে তোমার কোনো কাজ নেই।"
আলো ঘৃণার চোখে সামিনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জে'দ দেখিয়ে ছুটে বারান্দায় চলে যায়। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি পরছে। নিমিষেই ভিজে যায় আলো। সামিন আলোর পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো একটু পর পর কেঁ'পে কেঁ'পে উঠছে, হয়তো প্রচন্ড জ্বরে, হয়তোবা কান্না করছে। কিছু সময় যেতে সামিন একটা ছাতা নিয়ে বারান্দায় যায়। গিয়ে আলোর পাশে দাঁড়িয়ে আড়চোখে আলোকে দেখে। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে আলো। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"ভেতরে চলো আলো। তোমার গায়ে জ্বর।"
আলোর নীরবতা সামিনের রাগ উঠিয়ে দেয়। সামিন ধমকে ওঠে,"আলো আমার জেদ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। কিছুই দেখাইনি তোমায় এখনো। চুপচাপ ভেতরে চলো।"
আলো নিশ্চুপ। সামিন দাঁতে দাঁত চেপে ছাতাটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ঝড়ো হাওয়া ছাতাটাকে উড়িয়ে নিয়ে বাগানে ফেলে দেয়। নিজেও ভিজে যায় সামিন।
তারপর আলোকে টানতে থাকে। আলো সামিনকে ধা'ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ক্ষেপে গিয়ে সামিন আলোকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। আলো পুরুষালি শক্তির সাথে পেরে ওঠে না। সামিনের বুকে অনবরত কি/ল ঘু/ষি মা'র'তে মা'র'তে ডুকরে কেঁ'দে ওঠে সে। সামিনের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ঘরে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দেয় আলোকে সামিন। তারপর আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে এনে আলোর হাতে দিয়ে বলে, "আমি ওষুধ আনতে যাচ্ছি। দশমিনিট পরে এসে দেখি যেন শাড়িটা পাল্টানো হয়ে গিয়েছে নাহলে আমি কি করবো আমি নিজেও জানি না আলো।"
তেজী কন্ঠে কথাটি বলে সামিন ঘরের বাইরে চলে যায়। আলো অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে হাতের শাড়িটার দিকে তাকায়।
***
জ্বর বেড়ে গিয়েছে। নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। কাঁপা কাঁপা হাতে শাড়ীর কুচি ঠিক করে আঁচল তুলে দেয় শরীরে। পেছন থেকে আঁচলের অগ্রভাগ ডান কাঁধে টেনে নেয়। প্রচন্ড শীত লাগতে শুরু করেছে। ওয়াশ রুম থেকে বের হয় বিছানায় গিয়ে কিছুক্ষণ গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। একটু পরে আর বসে থাকতে না পেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কিছু সময় চলে যেতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় আলো।
ওষুধ নিয়ে এসে সামিন দেখে আলো ঘুমিয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ওষুধের বক্সটা বিছানার সাথে লাগোয়া টেবিলে রাখে। তারপর আবারো আলোর মুখের দিকে তাকায়। জ্বরে চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সামিন মনে মনে নিজেকেই নিজে বলে ওঠে,"কি চাচ্ছো তুমি সামিন ইয়াসার! এই মেয়েটার তেজ কমিয়ে দিতে তোমার দুমিনিট সময় লাগবে না। অথচ তুমি তার সাথে এতো সভ্যতা দেখাচ্ছো। মেয়েটার কাছে নিজেকে ক্লিন রাখার এতো কেনো দায় তোমার। ও তো তোমার স্ত্রী, তোমার সম্পত্তি! জোর করে বিয়ে করেছো, তাহলে এখন কেন এতো ভদ্রতা দেখাচ্ছো!"
***
বন্ধ করে রাখা সিলিং ফ্যানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইশমাম। তারপর উঠে বসে ল্যাপটপে হাত দেয়। আমেরিকাতে তার বেস্ট ফ্রেন্ড এ্যালেক্স কে একটা মেসেজ লিখতে থাকে সে। ইংরেজীতে লেখা মেসেজটির অর্থ হলো,"ছোটো বেলা থেকে আমি সবসময় ভাইয়ার দামী টি-শার্ট,দামী জুতা,দামী ঘড়ি ভাইয়ার থেকে কেড়ে নিয়েছি এ্যালেক্স, কখনো কখনো বলার প্রয়োজনও বোধ করিনি। ভাইয়ার পছন্দের সব জিনিস আমি পছন্দ করে ফেলতাম। ভাইয়াকে না জানিয়ে সেগুলো নিয়ে নিতাম। ভাইয়া কখনো প্রতিবাদ করতো না এ্যালেক্স। ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে তাই প্রতিবাদ করতো না। আমিও ভাইয়াকে ভালোবাসি। আজ ভাইয়া সেই সবকিছুর শোধ একসাথে তুলেছে এ্যালেক্স। আমার পছন্দের মানুষটাকে আমায় না জানিয়ে নিয়ে নিয়েছে ভাইয়া। আমার কি প্রতিবাদ জানানো উচিত এ্যালেক্স?"
মেসেজটা পাঠানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে এ্যালেক্সের নাম্বার থেকে অনবরত ফোন আসতে শুরু করে। ইশমাম ফোনটা রিসিভ করে না। তার ফোন,ল্যাপটপ থেকে অদ্রিতা আলো নামের মেয়েটির সমস্ত স্মৃতি পরম যত্নে মুছে ফেলতে থাকে।
***
রাত তখন সাড়ে নয়টা। আলোর জ্বর কিছুটা কমেছে। সে বিছানায় চুপচাপ বসে আছে।
নিচে হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। অনেকদিন পরে ভাই-বোন সব এক হয়ে খাবার টেবিলে বসে খাচ্ছে। ইশমাম চুপচাপ মাথা নিচু করে খাবার নাড়াচাড়া করছে। ইলহাম ইশমামের দিকে তাকিয়ে বলে,"পাখির মতো খুটছিস কেনো? সমস্যা কোথায়? সারাদিন রুমে ম'ট'কা মেরে পরেছিলি। বাংলাদেশ ভালো লাগছে না?"
ইশমাম কিছু বলে না। সামিন কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,"ঠিকাছে। খেতে না চাইলে ঘরে গিয়ে ঘুম দে। রাতের গভীর ঘুমটা এখন প্রয়োজন তোর।"
ইশমাম সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। তারপর দোতলায় উঠে যায়। সামিনের খাওয়া হয়ে গেলে সিতারার দিকে তাকিয়ে আলোর কথা জিজ্ঞেস করে,"খেয়েছে? "
সিতারা শুকনো মুখে বলে,"না খাবার,না ওষুধ। কিছু ছুঁয়ে দেখেনি ভাইজান।"
সামিন উঠে দাঁড়ায়।
আলো বিছানা থেকে নেমে ঘর থেকে বের হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। ইশমাম নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখোমুখি দুটো ঘর। আলো ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমামের দৃষ্টি সে পড়তে পারছে না আজ । তার মুখ ভাবলেশহীন।
"এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো!"
পি'শা'চ কন্ঠ শুনে আলো ইয়াসারের দিকে তাকায়। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"খাবার খাওনি, ওষুধ খাওনি কেনো?"
আলো কিছু বলে না। সামিন তখনো ইশমামকে দেখতে পায়নি,তার সম্পূর্ণ মনোযোগ আলোর দিকে ছিলো। আলোর নীরবতা দেখে সামিন আলোর হাত ধরে ঘরে ঢুকায়। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। ইশমাম একদৃষ্টে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
ল্যাপটপের সামনে বসে এ্যালেক্সকে একটি মেসেজ লেখে,"ভাইয়ার ওপর রাগ করার আগে আমি মরতে চাই এ্যালেক্স। আমি ঐ মানুষটার ওপর রাগ করতে পারবো না কিছুতেই।"
মেসেজটি দেখতে পেয়ে এ্যালেক্স আবারো ভিডিও কনফারেন্সে ফোন দিতে শুরু করে। ইশমাম মেসেজটি ডিলিট করে ল্যাপটপটা বন্ধ করে দেয়।
***
খাবারের প্লেটটা আলোর সামনে রেখে ধমকের সুরে বলে,"খাও। খাও বলছি।"
আলো মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। সামিন বলে,"সব কিছু জোর না করলে হবে না দেখছি!"
_ওই একটা জিনিসই তো আপনি করতে জানেন। জো'র। কা'পু'রু'ষ কোথাকার।
আলোর মুখে কা'পু'রু'ষ শব্দটা শুনে সামিন আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর খাবারের প্লেট টা টেবিলে রেখে ঢাকা দিয়ে ডিভানে গিয়ে শুয়ে পরে। না খেলে না খাক। কেউ যদি স্বেচ্ছায় নিজের মন্দ করতে চায় তাহলে তার কি। যথেষ্ট মানবিকতা দেখিয়েছে সামিন। এখন কি পা ধরে খাওয়াবে নাকি!
আলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিছানায় গিয়ে বসে পরে। দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়। সামিন তখনো ঘুমায়নি। সে ওদিকে ফিরে আলোর কর্মকাণ্ড বোঝার চেষ্টা করছে। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে একবার ঘুরে তাকায় সে। আলো চুপচাপ বসে আছে। সামিন কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই দরজায় ধাক্কা দেয় ইশিতা। জোরে জোরে চেঁচাতে থাকে সে। সামিন উঠে দরজা খুলে দেয়। ইশিতা কাঁপা কাঁপা গলায় আর্তনাদ করে বলে ওঠে,"ইশমাম স্লিপিং পিলস খেয়ে নিয়েছে ভাইয়া !"
ইশিতার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সামিন। বোনের আ'ত'ঙ্কি'ত মুখ দেখে তার ভেতরটা কেঁ'পে উঠলো যেন! রুদ্ধশ্বাসে ছুটে গেলো ইশমামের ঘরে। ইশিতা ভাইয়ের পিছু পিছু ছুটে গেলো। আলো বিছানার উপর পাথর হয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি দরজার বাইরে।
ইশমাম বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। ইলহাম ওকে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। রিতু ভীত চোখে তাকিয়ে আছে ইশমামের দিকে।
সামিন গিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"কি হয়েছে! ছোটোর কি হয়েছে!"
ইলহাম আ'ত'ঙ্কি'ত কন্ঠে বলে বারোটা পিলের বারোটাই খেয়ে নিয়েছে ভাইয়া।"
সামিন গিয়ে ইশমামকে ধরে ফেলে। পিটপিট করে ভাইয়ের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে ইশমাম,চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে,তাই পারছে না তাকাতে। সামিন আঁ'ত'কে ওঠে,"এ্যা'ম্বু'লে'ন্স ডাক। কুইক।"
_আমি ঠিক আছি ভাইয়া,আই এ্যাম টোটালি ফাইন!
ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করতে থাকে ইশমাম।
ইশিতা চেঁচাতে থাকে,"কোন দুঃখে এটা করলি গ'র্দ'ভ! জবাব দে!"
_শাট আপ ইশু! চারটা খেয়েছি মাত্র। এক চ'ড় মারবো তোকে....
ইশমাম কথাটি শেষ করতে না করতেই সামিন সজোরে একটা চ'ড় মারে ইশমামের গালে। তাল সামলাতে না পেরে বিছানার ওপর গিয়ে পরে সে। সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"ওকে বমি করাতে হবে।লবণ গোলা পানি নিয়ে এসো রিতু। তাড়াতাড়ি।"
_ভাইয়া স্টপ। প্লিজ যাও তোমরা।
বিড়বিড় করতে থাকে ইশমাম।
রিতু নিচে ছুটে যায়। ইলহাম ঘুমের ঔষধের পাতাটা সামিনের হাতে দিয়ে বলে,"দেখো। হাই পাওয়ারের। বারোটার বারোটাই গিলেছে।"
_সত্যি বলছি ভাইয়া, চারটা খেয়েছি।
বিছানায় উপুড় হয়ে পরে থাকা ইশমাম অস্ফুট স্বরে বলে।
রিতু লবণ গোলা পানি এনে সামিনের হাতে দেয়। সামিন ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,"ওকে ধর শক্ত করে তোরা।"
ইশিতা আর ইলহাম ইশমামকে শক্ত করে ধরে রাখে। ইশমাম পিটপিট করে তাকাচ্ছে সামিনের দিকে। সামিন ইশমামের থুতনি ধরে জোরপূর্বক লবণ গোলা পানিটা ইশমামকে গেলাতে থাকে। কিছুক্ষণ যেতেই হড় হড় করে বমি করে দেয় ইশমাম। সামিন একটু সময় নিয়ে আবারো লবণ পানি খাইয়ে দেয় ইশমামকে। বমি করে ইশমাম পেটে যা ছিলো সব বের করে দেয়। ইশিতা আর ইলহাম ভাইকে শক্ত করে ধরে রেখেছে।
পুরোটা উগরে দিয়ে ইশমাম পুরোপুরি ভাবে নিস্তেজ হয়ে পরে। রিতু পানি এনে সামিনের হাতে দেয়। সামিন ইশমামের চোখে মুখে পানি ছেটাতে থাকে।
আলো ধীরপায়ে হেটে ইশমামের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
সামিন একটা চেয়ার টেনে ইশমামের সামনে বসে, ভাইয়ের দুই বাহু ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে,"কয়টা খেয়েছিস! বল !"
_কসম ভাইয়া। চারটাই খেয়েছি।
এখনো ঘোর কাটেনি ইশমামের। সামিন ধমক দিয়ে বলে,"পুরো পাতা খালি কেনো? বল।"
_এগুলো আমি রেগুলার নেই ভাইয়া,ডাক্তারের পরামর্শে। আগেই খেয়েছি বাকি আটটা। সত্যি বলছি ভাইয়া!
_চারটা কেনো খেতে গেলি? চারটা খাওয়ার কি প্রয়োজন ? বল। কোন মেয়ের জন্য খেয়েছিস!
ইশমাম বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলে,"কি শুরু করেছো ভাইয়া। প্লিজ যাও এখান থেকে ভাইয়া। ঘুম আসছিলো না তাই খেয়েছি। এবার যাও।"
সামিন দ্বিতীয় বারের মতো ভাইয়ের গালে এক চ'ড় বসিয়ে দেয়।
ইশমাম গালে হাত দিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকায়। সামিন গর্জে ওঠে,"আমাকে বোকা পেয়েছিস? আমি কিছু বুঝি না তাইনা? সারাদিন আমি তোকে লক্ষ্য করেছি। দেবদাস হয়েছিস তুই! দেবদাস! অ'প'দা'র্থ কোথাকার!"
_ভাইয়া প্লিজ স্টপ। এসব কিছুই না!
সামিন চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"হুট করে দেশে আসা, সারাদিন মনমরা হয়ে থাকা, ঘুমের ঔষধ নেওয়া। আবার বলছিস কোনো মেয়ের জন্য না এসব? আমি ব'ল'দ? ব'ল'দ তোর ভাই?"
ইশমাম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন নরম হয়ে যায়। কাতর কন্ঠে বলে ওঠে,"সামান্য একটা মেয়ের জন্য এরকম একটা স্টেপ নিয়েছিস। একবারও আমাদের কথা ভাবলি না তুই? কোন মেয়ে বল! কোথাকার মেয়ে! বিদেশী নাকি এদেশীয়? তুই আমায় নাম ঠিকানা দে। আমি ঐ মেয়েকে তোর পায়ের কাছে এনে রাখবো। তুই এক্ষুনি নাম বল।"
আলো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সামিনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট জোড়া তার তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে ঐ পি'শা'চ'টা'র কথা শুনে। ইশমাম ভাইয়ের চোখের দিকে তাকায়, মনে মনে বলে ওঠে,"কাকে পায়ের কাছে এনে রাখবে তুমি ভাইয়া। তুমি তো তাকে নিজে বুকে টেনে নিয়েছো!"
সামিন নরম গলায় বলে,"আমার ভাই, সামিন ইয়াসারের ভাই এতো সহজে হার মেনে নিয়েছে? বাবা ঠিকই বলে,তুই একটা অ'প'দা'র্থ।"
ইশমাম ম্লান হাসে। নিচু স্বরে বলে,"ঠিকই বলেছো ভাইয়া। আমি তাই।"
সামিন ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"কিভাবে টের পেলি ও এই অকাজ করেছে?"
_ওর ফোনটা খাবার টেবিলে ফেলে রেখে এসেছিলো। আমেরিকা থেকে এ্যালেক্স নামের ওর কোনো বন্ধু অনবরত ফোন দিচ্ছিলো। ফোনটা রিসিভ করতেই সে বলে ইশমাম নাকি সু'ই'সা'ই'ড করার চেষ্টা করছে, ওকে আটকাতে হবে। আমি আর মেজো ভাইয়া ছুটে এলাম। দেরী না করে ডুপ্লিকেইট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখি ম'রা'র মতো পরে আছে গাধাটা।"
সামিন ইশমামের দিকে তাকায়, দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"এতো দূর? এতো দূর? কোথাকার কোন এ্যালেক্স টের পেলো তোর কষ্ট আর আমরা ভেসে এসেছি? আমাদের বলা যেতো না?"
ইশমাম মাথা নিচু করে রাখে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে ইশিতাকে বলে,
"ওর ব্যাগ, জিনিস পত্র সার্চ কর । আরো স্লিপিং পিলস আছে নাকি দেখ। বাজেয়াপ্ত কর সব।"
ইশিতা মাথা নাড়িয়ে ইশমামের লাগেজ খোলে। ইশমাম বলে,"স্টপ ভাইয়া। অনেক গোয়েন্দাগিরি করেছো। ট্রাস্ট মি, আমি সু'ই'সা'ই'ড করতে চাইনি, এ্যালেক্স একটু পাগল। আর ওষুধ নিয়ে গেলে কি হবে? সুইসাইড করতে চাইলে তো সিলিংয়ের সাথে ঝুলে পরতে পারি। হাতের শি'রা কা'ট'তে পারি।"
সামিন ইশমামের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করে ইশমামের চোখে পরে যায় আলো। আলো নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ইশমাম ঠান্ডা গলায় তার ভাইকে বলে,"এখন প্লিজ তোমরা যাও। তুমি যাও ভাইয়া। বড় ভাবী বিরক্ত হচ্ছে। ভাবীকে নিয়ে ঘরে যাও। আই এ্যাম টোটালি ফাইন।"
সামিন মাথা ঘুরিয়ে আলোকে দেখে। তারপর ইশমামের দিকে তাকিয়ে বলে,"মেয়েটা কে বলবি না তো?"
ইশমাম কঠিন গলায় বলে,"না।"
_বেশ। আমি বের করে নেবো। তারপর ঘা'র ধরে আমার ভাইয়ের পায়ে এনে ফেলবো। কতবড় সাহস! আমার ভাইকে কষ্ট দেয়!
ইশমাম মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে । ইশিতা আরো দুই পাতা ঘুমের ঔষধ খুঁজে বের করে এনে সামিনের হাতে দেয়। সামিন ওষুধ গুলো নিতে নিতে ঠান্ডা গলায় বলে,"এগুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি। ঘুম না পেলে না ঘুমিয়ে থাক। দরকার নেই ঘুমের।"
সামিন হনহন করে বেরিয়ে যেতে নেয়। আলোর সামনে এসে থ'ম'কে দাঁড়িয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। ইশিতা এসে বলে,"জ্বর সেরেছে আলো? শরীর ঠিক আছে তোমার?"
আলো মাথা নাড়িয়ে সামিনের ঘরের দিকে যায়। সামিন ইশমামের দিকে আরো একবার তাকিয়ে বলে,"ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ শুয়ে থাক। সকালে কথা হবে।"
***
ঘরে ঢুকে সোজা গিয়ে ডিভানে গা এলিয়ে দেয় সামিন। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। কাল কিছু ইম্পরট্যান্ট কাজ রয়েছে। এখন একটু ঘুমিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। দু'চোখ বন্ধ করার আগে আলোর দিকে একবার তাকায় সে। থমথমে মুখ নিয়ে বিছানায় বসে আছে চুপচাপ। সামিন আনমনে হেসে ফেলে, গুটিসুটি মেরে বসে থাকার কোনো প্রতিযোগিতা হলে এই মেয়ে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করতো। মায়ের গর্ভে শিশুরা যেভাবে হাত পা গুটিয়ে রাখে। এই মেয়েটাও সেভাবেই বসে থাকে। সামিন বেশ অবাক হয়, সাইজে ছোটো খাটো একটা মেয়ে। তুলে একটা আছাড় মারা যায়, কোলে তুললে মনে হয় একটা শিমুল তুলার বালিশের সমান ওজন, সেই মেয়ের তেজ কত ! আবার সেই মেয়ে সামিনকে প্রানে মারারও হুমকি দেয়। কারন সে কারাতে জানে, তাই সে বিশ্বাস করে নিজে একটা বালিশ হয়ে ছিয়াত্তর কেজি ওজনের ইয়াসার মির্জাকে ঘায়েল করবে। কতটা আত্মবিশ্বাসী এই মেয়ে!
***
ইট পাথরের শহরের শেষ রাত জাগা পাখিটাও যখন ঘুম ঘুম চোখে ঢুলছে। তখন আলো জেগে। এতক্ষণ শুয়ে ছিলো,এখন উঠে বসে আছে সে। মাথা ঘুরিয়ে ডিভানে ঘুমিয়ে থাকা সামিনের দিকে তাকাতেই কপাল কুঁচকে ফেলে। এবার দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে পেরেছে সে। যে লোকটা নিজে একটা ক্রি'মি'না'ল,যার মেজো ভাই শ্লীলতাহানির মামলার আ'সা'মী তাদের ছোটো ভাই তো ঠ'ক , ধান্দাবাজ হবেই!
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় আলোর ভেতর থেকে! সারাজীবন ছেলেদের এক হাত দেখে নেওয়া চালাক চতুর উপাধি পাওয়া মেয়েটা কি না পরেছিলো একটা ঠকবাজের পাল্লায়! দেখে নেবে, সব ক'টাকে আলো দেখে নেবে!
আগুন জ্বলে ওঠে আলোর চোখে মুখে। আবার নিমিষেই তা নিভে গিয়ে মুখ মলিন হয়ে যায়। পেটে হাত চেপে বসে থাকে সে । প্রচন্ড খিদেয় তার পেটে ব্যাথা হতে শুরু করেছে। চোখে ঝাপসা দেখছে। জ্বর নেই আপাতত গায়ে,তাই খিদেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বেশ। আলো কিছুক্ষণ বসে থেকে আর টিকতে পারলো না। মাথা ঘুরিয়ে দেখে টেবিলের উপর প্লেটটা এখনো ঢাকা দিয়ে রাখা আছে। হাত বাড়িয়ে প্লেট টা নিয়ে ঢাকনাটা সরাতেই একটা বাজে গন্ধ আলোর নাকে লাগে । প্লেটে ভাত, মাংস এবং পাতলা ডাল দেয়া হয়েছিলো। দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ায় সেটা বাসি হতে শুরু করেছে। প্লেট টা ঢেকে আবারো টেবিলের উপরে রাখে। হঠাৎ করে মায়ের কথা মনে পরে আলোর। মা কখনোই আলোকে না খেয়ে রাতে ঘুমাতে দিতো না। কখনোই না। চোখ দিয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরতেই আলো সাথে সাথে তা মুছে সামিনের দিকে তাকায়। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"দা'ন'ব একটা।"
গা থেকে চাদর সরিয়ে নেমে পরে আলো। পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে সন্তর্পণে দরজার সিটকিনি খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে লিভিং রুম পেরিয়ে ডাইনিং রুমের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ফ্রিজের কাছে এগিয়ে গিয়ে ফ্রিজের দরজা খোলে। তেমন কোনো খাবার নেই ফ্রিজে। আছে কিছু শুকনো ভাত এবং কিছু ফল। এই মুহূর্তে আলোর ভাতের খিদে পেয়েছে তাই ভাতের বাটিটা ফ্রিজ থেকে বের করে নেয় সে। জীবনে কখনো আলো তরকারি ছাড়া শুধু ভাত খেয়ে দেখেনি, সামিন ইয়াসারের জন্য আজ সেই সৌভাগ্য তার হয়েছে। ভাত টা ঠান্ডা হয়ে আছে। কিন্তু কি আর করা,এটাই গিলতে হবে।
এদিক ওদিক না তাকিয়ে বাটিটা টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে বসে পরে সে। লবন মেখে ভাতের লোকমা তুলে মুখে দিতেই কপাল কুঁচকে ফেলে আলো। ঠান্ডা, শুকনো ভাত, পেটের ভেতর যেতে চাইছে না তবুও অনেক কষ্টে গিলে ফেলে। শুকনো ভাত তাই দ্রুত খেতে গিয়ে গলায় আটকে যায় হঠাৎ, কাশতে কাশতে আলো টেবিলের উপর দেখতে থাকে, গ্লাসের পানি শেষ। কোথাও পানির জগ দেখতে পাচ্ছে না সে। হঠাৎ করে কেউ তার সামনে একটা পানির গ্লাস রাখলো। আলো চ'ম'কে উঠে পেছনে তাকায়। সামিন তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলো উঠে দাঁড়িয়ে যায়। সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,"খেতে বসার আগে সাথে পর্যাপ্ত পানি নিতে হয়।"
সামিনকে এভাবে দেখেই আলোর কাশি থেমে গিয়েছে। সামিন আলোর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে ভাতের বাটিটার দিকে তাকায়। মৃদু স্বরে বলে,"সরাসরি বাটিতেই খাওয়া শুরু করে দিয়েছো! একটা প্লেটে তুলে নিতে!"
আলো কি বলবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। এভাবে এই লোকটার হাতে ধরা পরে তার লজ্জায় মাটির ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে।
_আমি ভেবেছিলাম পালাচ্ছো। দ্রতপায়ে সিঁড়ি ভেঙে দেখি তুমি এখানে উদরপূর্তি করছো।
আলো চলে যাওয়া ধরলে সামিন তার হাত টেনে ধরে। আলো এক ঝটকায় সামিনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। সামিন বলে ওঠে,"শুধু ভাত খাচ্ছিলে কেনো? কাউকে ডেকে তুলতে।"
আলো কোনো কথা বলে না। সামিন বলতে থাকে,"সামিন ইয়াসার মির্জা প্রতি মাসে অসংখ্য দুঃস্থ পরিবারের বাজার করে দেয় । আর এখানে তার স্ত্রী জে'দ দেখিয়ে না খেয়ে পরে এসে চুরি করে শুকনো ভাত খায়। তরকারি ফ্রিজেই রাখা। একটু খুঁজলেই পেয়ে যেতে।"
_একদম আমাকে স্ত্রী বলবেন না। অবৈধ বিয়ে ওটা। আমি আপনার স্ত্রী নই।
আলো তেতে ওঠে। সামিন আলোর দিকে এক কদম এগিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"বলবো আমি। কি করবে তুমি? কি ক্ষমতা তোমার? শোনো তাহলে বলছি, তুমি আমার স্ত্রী, তুমি আমার স্ত্রী,তুমি আমার স্ত্রী, তোমার বাপ আমার শশুর,তোমার মা আমার শাশুড়ি, তোমার ভাইয়েরা আমার শা'লা। তুমি আমার স্ত্রী।"
কথাগুলো উচ্চারণ করে সামিন এক মুহুর্ত থামে। তারপর কন্ঠে বিদ্রুপ নিয়ে বলে,"এই যে বললাম। কি করবে তুমি? করো তো দেখি! কারাতে করবে? কুংফু কারাতে?"
আলো হুট করে একদলা থুতু ছুড়ে মারে সামিনে গায়ে। সামিনের গলার কাছটায় লেগেছে । সামিন সাথে সাথে কপাল কুঁচকে ফেলে। আলো তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। সামিন দাঁতে দাঁত চেপে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে আলোকে হতভম্ব করে দিয়ে তার শাড়ীর আঁচল ধরে। আলো শি'উ'রে ওঠে। সামিন আলোর আঁচল দিয়ে নিজের গলার কাছটা পরিষ্কার করতে করতে বলে,"তুমি একটা উন্মাদ মেয়ে আলো।"
আলো নিজের আঁচল সামিনের থেকে টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,"আর আপনি একটা জা'নো'য়া'র।"
সামিন আলোর দিকে তাকায়। তেজী কন্ঠে বলে,"জ্বর চলে গিয়েছে? তোমার জ্বর তোমার তেজের মতো আলো। হুট করে আসে আবার হুট করে মিইয়ে যায়।"
আলো কিছু বলে না। সামিন বলতে থাকে,"উদরপূর্তি হয়ে গেলে ঘরে চলো। আমি রাত জেগে তোমাকে এখানে বসে পাহারা দিতে পারবো না।"
***
শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছিলো আলো। তাই আজ অনেকটা দেরী করে উঠেছে। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে বেশ কাহিল লাগছে নিজেকে। শরীর এখনো খুব ক্লান্ত। ধীরে ধীরে উঠে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে পি'শা'চ'টা ঘরে নেই। জানালা থেকে তেজী রোদ আলোর নরম ত্বক পু'ড়ি'য়ে দিতে চাইছে। দুহাতে গাল ঢেকে কপাল কুঁচকে আলো বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বিছানা থেকে নেমে সোজা ওয়াশ রুমে চলে যায়। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ওয়াশরুমের আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। আলোর গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। কিন্তু আজ তাকে আরো অনেকটা বেশী উজ্জ্বল লাগছে। সারাদিন বন্দীশালায় আ'ট'কে থাকে সে,তাকে সূর্যের বেগুনী রশ্মি ছুতে পারে কই! মাত্র ক'দিনেই গায়ের রং এতোটা বদলে গিয়েছে! হাত বাড়িয়ে তার টুথব্রাশ তুলে নিতেই চোখে পরে সামিন ইয়াসারের টুথব্রাশ। নিজে যেমন দানব আকৃতির তেমনি তার টুথব্রাশ টাও দানব আকৃতির। আলোর ইচ্ছে করছে টুথব্রাশ টাকে ওয়াশ রুমের কমোডের মধ্যে চুবিয়ে রেখে দিতে। ঐ লোকটার জন্য এর চেয়ে ভালো আপ্যায়ন আলোর জানা নেই। নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে ফেলে হাত মুখ ধুয়ে আলো বের হয়ে যায় ওয়াশ রুম থেকে। হেটে সোজা ঘর থেকে বের হয়ে দোতলার লিভিং রুমের কাছে যেতেই দাঁড়িয়ে পরে আলো। ইশমাম দাঁড়িয়ে আছে। আলো নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ইশমামকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে ইশমাম মৃদু স্বরে বলে,"অদ্রিতা।"
***
সামিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আতাউর আলম দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। সামিন ভেতরে ঢোকে। সামিনের পিছু পিছু কয়েকজন লোক ব্যাগ হাতে ঢোকে। বসার ঘরের একপাশে ব্যাগ গুলো রেখে তারা চলে যায়। রেহেনা ধীরপায়ে বসার ঘরের দিকে এসে থমকে দাঁড়ায়। চোখ মুখ আ'ত'ঙ্কে ছেয়ে যায় তার।
আতাউর আলম নিচু স্বরে কিন্তু কন্ঠে ঘৃণা নিয়ে বলে,"এগুলো কি!"
সামিন সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বলে,"প্রথম বার শশুর বাড়িতে এসেছি। খালি হাতে তো আসা যায় না। আমি সামিন ইয়াসার মির্জা!"
রেহেনা ব্যাকুল কন্ঠে বলে,"বাবা আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। আমরা কোনো থানাপুলিশ করিনি। কাউকে কিছু বলিনি। তুমি নির্বাচনেও জিতে গিয়েছো। এবার অন্তত আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। কথা দিচ্ছি আমরা সব ছেড়ে ছুড়ে অনেক দূরে চলে যাবো "
সামিন রেহেনার দিকে তাকিয়ে বলে,"কাউকে কিছু বলেন নি ভালো করেছেন, আমার বাবা চেন্নাই থেকে আসলে বড় সর রিসিপশন অনুষ্ঠান করে আমিই সবাইকে জানিয়ে দেবো আমি বিয়ে করেছি। আর আপনার মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার কথা যদি বলেন তাহলে বলবো,সামিন ইয়াসার একবার যে জিনিসটা নিজের নামে করে নেয় সেটা সে হাত ছাড়া করে না।"
রেহেনা ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। আতাউর আলম বলে,"কি চাইছো তুমি ইয়াসার। আর কি চাইছো? মেয়েটাকে অন্তত একটু কথা বলতে দাও আমাদের সাথে।"
_দেবো। জামিলের জ্ঞান ফিরুক। একেবারে নেমন্তন্ন করে নিয়ে যাবো আপনাদের আমার বাড়িতে। মেয়েকে প্রান ভরে দেখে আসবেন।
আতাউর আলম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ইয়াসারের দিকে, বলে,"জামিলের সাথে আমার কি সম্পর্ক?"
_কু'পি'য়ে'ছে'ন আবার বলছেন কি সম্পর্ক!
_কেন এক কথা বারবার বলছো ইয়াসার। আমি তো বলেছি এসবে আমি জরিত নই। থানায় হুমকি টা আমি এমনিই দিয়েছিলাম,রাগের মাথায়। কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না আমার!
ইয়াসার তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, তারপর বলে,"হেনা। জামিলের স্ত্রী। আপনার মেয়ের বয়সী। সাত মাসের গর্ভবতী। আপনার লোক তার সামনেই তার স্বামিকে কু'পি'য়ে'ছে। আচ্ছা এতো ভং ধরে থাকেন কিভাবে আপনি? মানুষের সামনে ইনোসেন্ট ফেইস নিয়ে ঘুরে বেড়ান,সিম্প্যাথি নেন তাদের!"
আতাউর থমথমে মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে ইয়াসারের দিকে। ইয়াসার বলে,"আজ উঠি। মেয়ের জন্য চিন্তা করবেন না। সে ভালো আছে। অবশ্য তার ভালো থাকা আপনাদের উপর নির্ভর করছে। চুপচাপ থাকুন এবং জামিলের জন্য দোয়া করতে থাকুন,যদি মেয়ের সাথে কথা বলতে চান তো!"
***
আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইশমাম নিচুস্বরে বলে,"সামনা সামনি তুমি বেশি সুন্দর অদ্রিতা!"
আলো অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে ইশমামের দিকে তাকায়,কন্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বলে,"আমি তোমার ভাইয়ের স্ত্রী ইশমাম। তোমার ভাবী হই।"
ইশমাম হেসে ফেলে, ঠান্ডা গলায় বলে,"আমি ভাবীকেই বলেছি কথাটা। ছোটো দেবর তোমার। একটু মশকরা করলাম!"
আলো কপাল কুঁচকে চলে যেতে নেয়। ইশমাম বলে,"ভাইয়া তোমাকে তুলে এনে বিয়ে করেছে?"
আলো দাঁড়িয়ে পরে। ইশমাম বলে," ভাইয়াকে আমি ছোটো থেকে দেখছি। এতোটা প্রতিশোধ পরায়ণ ছিলো না সে। তোমার ঐ একটা চ'ড় তাকে এলোমেলো করে দিয়েছিলো।"
আলো শীতল চোখে ইশমামের দিকে তাকায়। কন্ঠে বিদ্রুপ নিয়ে বলে,"কাল রাতে কি নাটক করেছিলে ওটা? কেনো বলে দিচ্ছো না নিজের ভাইয়াকে সব। সাহস নেই তাই না? বলে দাও সবটা, তারপর দুই ভাই সাপ আর বেজি হয়ে কা'ম'ড়া কা'ম'ড়ি করে ম'রে যাও। এটাই আমি চাই।"
ইশমাম ম্লান হাসে, নরম সুরে বলে,"সেটা কখনো হবে না অদ্রিতা। আমি ভাইয়ার জন্য নিজের জীবন দিতে পারি। তুমি তো আমার জীবনের মাত্র একটা অংশ ছিলে। ভাইয়া যখন ধরে নিয়েছে তুমি তার। তার মানে তুমি তার।"
আলো দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। ইশমাম বলে,"মায়ের পরে পৃথিবীতে আমি ভাইয়াকে বেশি ভালোবাসি। সেই ভালোবাসার কাছে সবকিছু তুচ্ছ।"
_তোমরা সবাই এক। সবাই জ'ঘ'ন্য। তোমরা ই'ব'লি'শের বিশেষায়িত বংশ। তোমাদের নাম রাখা ভুল হয়েছে। তোমাদের নামের পাশে ই'ব'লি'শ শব্দটা এফিডেভিট করে বসিয়ে নেবে।
"ইন্তেখাব ই'ব'লি'শ"
"ইমতিয়াজ ই'ব'লি'শ"
"ইশতিয়াক ই'ব'লি'শ"
"ইয়াসার ই'ব'লি'শ"
"ইলহাম ই'ব'লি'শ"
"ইশমাম ই'ব'লি'শ"
আলো কন্ঠে তেজ নিয়ে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে শব্দগুলো। ইশমাম আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে আলোর চোখে তাদের পরিবারের প্রতি ঘৃণার পরিমাণ দেখতে থাকে।
"টিচার আপনার চশমাটা আমি একটু পরি?"
শান্ত ইহানকে কোলে নিয়ে বসে আছে। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে সে ইহানকে "Z ফর Zebra" শেখানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ইহান পড়া রেখে দু'ষ্টু'মি'তে মেতে আছে। কখনো শান্তর চশমা ধরে টা'ন'ছে, কখনো মোবাইল ধরে। শান্তর ধৈর্য্যর সী'মা পেরিয়ে যাচ্ছে। এতো ছোটো বাচ্চাকে ব'শে আনা মু'শ'কি'ল। সে এই ক'দিনেই হি'ম'শি'ম খাচ্ছে।
দরজা ঠেলে ইশিতা মাথা বাড়িয়ে বলে,"আসতে পারি!"
শান্ত গ'ম্ভী'র কন্ঠে বলে,"আসুন।"
ইশিতা ঘরে ঢুকে ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,"তুমি তোমার টিচারের কোলে উঠে বসে আছো কেনো!"
ইহান কোনো কথা বলে না। শান্ত বলে,"আমি বসিয়েছি। হাতে ধরে লিখিয়ে দিতে হয়।"
_ও।
একশব্দে শান্তকে বলে ইশিতা ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমার ঘর থেকে আমার হেডফোন নিয়েছো তুমি?"
ইহান মাথা নাড়ায়।
_কোথায় রেখেছো?
_পাপার ল্যাপটপের কাছে।
ইশিতা ঘুরে দাঁড়ায়। শান্ত আদুরে কন্ঠে ইহানকে বলতে থাকে,"প্লিজ ইহান বাবু। এবার একটু লেখো!"
ইশিতা দাঁড়িয়ে পরে, শান্তর দিকে তাকায়। তারপর বলে,"পাব্লিক ভার্সিটির এক্স স্টুডেন্ট। কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চা কেনো পড়াচ্ছেন?"
_চাকরির বাজার মন্দা। আপাতত কিছু টিউশনি দরকার ছিলো। ভাগ্যক্রমে আপনাদের বাড়িতে জুটে গেলো। ছোটো বাচ্চা,চাপ কম। আমি চাকরির পড়া পড়ারও সময় পাচ্ছি। আপনারা বড়লোক, মাস শেষে টাকা দেওয়া নিয়ে গাইগুই করবেন না আর তাছাড়া বেশ ভালো এমাউন্ট দিচ্ছেন। তাই পড়াচ্ছি। এই মুহূর্তে টাকার খুব প্রয়োজন আমার।
সোজাসাপ্টা উত্তর দেয় শান্ত। ইশিতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,"বাব্বাহ! এতো বেনিফিট? আর আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন খুব ভালো ভালো নাস্তা দেওয়া হয় আপনাকে। এটা বললেন না? এটাও বলুন।"
শান্ত ইশিতার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলে,"হ্যা। সেটাও।"
ইশিতা বলে,"আচ্ছা। বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত । আপনি আপনার ছাত্রকে পড়ান।"
***
কাজ শেষ করে হসপিটালে গিয়েছিলো,সেখান থেকে সামিন সোজা বাড়িতে আসে। গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ বাগানের দিকে তাকিয়ে থেকে বাড়ির ভেতর চলে যায়। সূর্যের তাপটা প্রখর আজ। পাঞ্জাবির বুকের কাছটা ভিজে গিয়েছে ঘেমে। ইহান বড় বাবাকে দেখে ছুটে এলে ইহানকে কোলে তুলে নেয়না সামিন। আদুরে কন্ঠে বলে,"হসপিটাল থেকে এসেছি। জী'বা'ণু গায়ে বাবা। এখন না।"
ইহান দাঁড়িয়ে পরে। সামিন বলে,"আমি ফ্রেশ হয়ে নেই আগে? তারপর আমরা খেলবো। তুমি চলো আমার ঘরে।"
ইহান মাথা নাড়ায়। সে যাবে না। সামিন বলে,"কেনো? যাবে না কেনো?"
_তোমার ঘরে ঐ মেয়েটা থাকে, রাগী মেয়েটা, পঁ'চা মেয়েটা।
রিতু ধ'ম'ক দিয়ে বলে,"ইহান। এসব কি বলছো? বড় মা বলো।"
_আমি বলবো না বড় মা। ওই মেয়েটা পঁচা।
সামিন মৃদু হেসে বলে,"ঠিক বলেছো ইহান। ওই মেয়েটা পঁচা। আর আমি কি?"
_তুমি ভালো। আমার সুপার ম্যান।
সামিন হাসতে হাসতে সিঁড়ির দিকে যায়। তারপর ঘুরে রিতুকে জিজ্ঞেস করে,"ইশমাম কোথায়?"
_ভাইয়া নিজের ঘরে।
দোতলায় উঠে সামিন সোজা ইশমামের ঘরে যায়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলে,"আসবো ছোটো।"
ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ইশমাম ভাইয়ের দিকে তাকায়। তারপর বলে,"এসো ভাইয়া। পারমিশন কেনো নিচ্ছো?"
সামিন ম্লান হাসে। বলে,"ভুত নেমেছে ঘার থেকে?"
ইশমাম তার কোনো উত্তর না দিয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে বলে,"তোমার সাথে আমারো কিছু কথা ছিলো। আমি আমেরিকা ফিরে যেতে চাচ্ছি ভাইয়া। "
_এসেছিলি কেনো?
_তোমাদের দেখতে। দেখা হয়েছে। আমার ওখানে একটা আলাদা জীবন রয়েছে ভাইয়া।"
_কিসের জীবন? নয়টা-পাচটা অর্গানাইজেশনের পেছনে দৌ'ড় ঝাঁ'প। যায়গায় যায়গায় ঘুরে প্রতিবেদন লেখা। সমাজ সেবা করতে চাইলে তো দেশে বসেই করতে পারিস। এখানে কোনো সংস্থা খোল। আমি আছি।
ইশমাম মৃদু হাসে। সামিন বলে,"তোর জন্য মেয়ে দেখছি। বিয়ে করবি।"
_স্টপ ইট ভাইয়া। তুমি বাড়াবাড়ি করছো।
_আমি কিছু বাড়াবাড়ি করছি না। তুই বাড়াবাড়ি করছিস। একটা মেয়ের জন্য হে'দি'য়ে মরছিস। বারবার বলছি ঠিকানা দে,আমিও দেখতে চাই কোথাকার কোন হুর পরী।
চুপ করে থাকে ইশমাম। সামিন উঠে দাঁড়িয়ে বলে,"ফুয়াদের সাথে আমি আলোচনা করছি। বাবা দেশে ফিরলেই কথাবার্তা বলবো। ইশুর জন্যও ছেলে দেখছি। আর কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।"
ইশমাম বাঁধ সা'ধ'তে চাইলেও সামিন পাত্তা না দিয়ে চলে যায়, ভাইয়া চলে যেতেই ইশমাম একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আগে পরিস্থিতি অনুধাবনের চেষ্টা করছে সামিন। কাউকে দেখতে না পেয়ে হাত ঘড়ি টা খুলে আয়নার সামনে রাখতে গিয়ে দেখলো তার ড্রেসিং টেবিলে মেয়েদের সব প্রসাধনী। এগুলো রিতুর কাজ। ঐ মেয়েটার জন্য রেখে গিয়েছে, অবশ্য ঐ তেজী মেয়েটা এসব ছুঁয়েও দেখবে না। সামিন একমনে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর পাঞ্জাবি পাল্টে ফ্রেশ হয়ে টি-শার্ট গায়ে চাপিয়ে বারান্দার দরজার কাছে যেতেই থ'ম'কে দাঁড়ায়। অদ্রিতা আলো নামের মেয়েটা বারান্দায় রেলিং ধরে ওদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দায় একপাশে তার ভেজা শাড়িটা শুকাতে দিয়েছে। সম্ভবত এই মাত্র গোসল সেরেছে সে। ভেজা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে রেখেছে। সামিন দীর্ঘসময় আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে তার মস্তিষ্ক আ'লো'ড়ি'ত হচ্ছে। যে রহস্য সামিন ইয়াসারের কাছে অমিমাংসিত।
তার অবচেতন মন যে হুট করে অদ্রিতা আলো নামের মেয়েটির প্রেমে পরে যেতে চাইলো তা ঘুনাক্ষরেও টের পেলো না পি'শা'চ সামিন ইয়াসার মির্জা।
ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে ফোনের দিকে তাকায় সে। স্ক্রিনে ফুয়াদের নাম্বার দেখে ফোনটা রিসিভ করে। তার দৃষ্টি এখনো আলোর পিঠের দিকে। ওপাশ থেকে ফুয়াদ বলে,"কি করছিস?"
ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করে সামিন বলে ওঠে,"লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের বৌকে দেখছি।"
ফুয়াদ কিছু শুনতে না পেয়ে জোরে বলতে থাকে,"হ্যা হ্যালো! কি করছিস।"
সামিনের ঘোর কেটে যায়। গলা খাঁকারি দিয়ে ফুয়াদকে বলে,"কিছু না। বল। কি ব্যাপার।"
সামিনের কন্ঠস্বর শুনে আলো ঘুরে তাকায়।
_জামিলের জ্ঞান ফিরেছে। তুই হসপিটালে আয় তো।
ফুয়াদ ফোন কেটে দিলেও সামিন কানে ফোনটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আলোর দিকে তাকিয়ে। আলো সামিনকে দেখে কপাল কুঁচকে এগিয়ে আসে। সামিন টের পেলো ঐ মেয়েটা যত এগিয়ে আসছে তার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কেমন আলাদা এই অনুভূতি। এতো বছরের জীবনে কোনো মেয়েকে দেখে এতো অস্থিরতা কখনো কাজ করেনি তার ভেতরে। আলো সামিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সামিন কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে কান থেকে ফোনটা নামায়। জামিলের কথা মনে পরতেই তাড়াহুড়ো করে টি-শার্ট বদলে একটা ব্লু-শার্ট চাপিয়ে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে।
***
"রাগ তো ইয়াসারের উপর দেখানো উচিত। রাগটা আমাদের উপর দেখাচ্ছিস কেনো?"
শমশের ভুঁইয়ার এমন কথায় সাগর তার বাবার দিকে তাকায়। টেবিলের ওপর সজোরে চা'প'ড় মে'রে বলে,"কতবার? কতবার ওর কাছে আমি হারবো বলতে পারেন আব্বা? কতবার? রাজনীতির মাঠে, নির্বাচনে, বিজনেসে। কতবার হারবো? সবকিছু আপনার জন্য হয়েছে। ওকে রাস্তা থেকে সরাতে পারবেন না আমার কাছে বলতেন। আমি ব্যাবস্থা নিতাম। এখন লাভটা কি হলো? ভালো লাগছে? ছেলের হেরে যাওয়া মুখ দেখতে ভালো লাগছে?
পাশ থেকে জায়েদ আলী বলে,"ইয়াসারকে মা'র'লে শহর গরম হয়ে যেতো বাবা তাই শমশের ভাই চেষ্টা করেছে অন্য চাল চালতে....."
সাগর হিংস্র বাঘের মতো জায়েদ আলীর দিকে তাকায়। তারপর হুংকার দিয়ে বলে,"চাল? ওর ওই ডান হাত জামিলের জ্ঞান ফিরলে পিঠে বস্তা বেঁধে তৈয়ার থাকুন আপনারা। আর আব্বা আপনাকে বলছি। ঘোষণা দিয়ে পদ থেকে সরে দাঁড়ান। আগামী পাঁচ বছর দল আমার বুদ্ধি নিয়ে চলবে । ইয়াসারের খুব খারাপ অবস্থা করে ছাড়বো আমি।"
***
করিডোরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। অনেকদিন পরে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। সামিন দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,"আমি লেইট।"
_হু ভাই, আপনিই তো এখন লেইট থাকবেন। কারন এখন আপনার দিন।
তৌফের কথার মানে বুঝতে পারলো না সামিন। তার মস্তিষ্ক জামিলের জ্ঞান ফেরার খুশিতে উত্তেজিত হয়ে আছে। রাহাত তৌফকে খোঁচা মেরে চুপ করিয়ে দেয়। সবুজের দিকে ফিরে সামিন বলে,"কি বলেছে ডাক্তার?"
_জ্ঞান ফিরেছে। কথা বলতে পারছে না এখনো। সেরে উঠবে দ্রুতই। ভেতরে হেনা ভাবী।
কিছু সময় পরে হেনা বের হয়। সামিনের দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলে,"কথা বলছে না ভাইয়া।"
_বলবে। অনেক ধৈর্য্য ধরেছো তুমি। আরেকটু ধরো।
সামিন জামিলের কেবিনে ঢোকে। সারা গায়ে ব্যা'ন্ডে'জ জামিলের। মুখে তখনো অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। জামিলের দিকে এগিয়ে যায় সামিন। জামিল পিটপিট করে তাকাচ্ছে।
সামিন বলে,"তোকে তো পুরো মিশরীয় মমিদের মতো লাগছেরে জামিল। চল তোকে পিরামিডের ভেতর রেখে দিয়ে আসি।"
জামিল তার ইয়াসার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট দিয়ে না পারলেও চোখ দিয়ে হাসতে চাইলো যেন। ইয়াসার এগিয়ে জামিলের মাথায় হাত রাখে। নরম গলায় বলে,"আমার সব ঝামেলা নিজের মাথায় নিতি, এবার সব য'ন্ত্র'না নিজের শরীরে নিলি তুই ভাই।"
কিছুক্ষণ পরে আবারো বলে ওঠে,"আগের বার ডাক্তার ভুলভাল বলেছে। এবার বলছে তোর নাকি ছেলে হবে। মটরবাইক টা তো তুই পেয়ে গেলি রে জামিল।"
জামিল অপলক তাকিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। সামিন বলতে থাকে,"সুস্থ হ তুই। তোকে আমি আর দলে রাখবো না জামিল। তোকে সিমেন্টের ব্যাবসায় বসিয়ে দেবো আমার। বৌ বাচ্চা নিয়ে ভালো থাকবি। আর আমার ঝামেলা নিজের কাধে নিতে হবে না ভাই!"
***
ইশমামকে দেখে পরী উঠে যাবে বলে দাড়িয়ে যায়। ইশিতা হাতে টান দিয়ে পরীকে বসিয়ে দিয়ে বলে,"বারবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছিস কেনো খেতে খেতে!"
পরী দ্বিধায় ভুগতে থাকে। ইশমাম ভাইয়া কেমন মানুষ কে জানে ! এভাবে কেয়ার টেকারের মেয়েকে নিজেদের খাবার টেবিলে দেখে রিয়েক্ট করতেই পারে। ইশিতাকে বিড়বিড় করে বলে,"আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে আপু।"
ইশমাম এসে টেবিলের ওপর থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে পানি খায়। ইশিতা বলে,"একে চিনেছিস? কে বলতো।"
ইশমাম পরীর দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,"পরী। চিনেছি। পোনা চাচার মেয়ে।"
কথাটি বলে ইশমাম চলে যায়। পরী ফিসফিসিয়ে ইশিতাকে বলে,"তোমার এই ভাইয়ের কি কোনো অ'সু'খ আছে আপু? কোষ্ঠকাঠিন্য টাইপ?"
ইশিতা চোখ বড়বড় করে পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,"না তো। কেনো বলতো।"
_না মানে মুখ টা কেমন করে রাখে। কেমন খি'চ মে'রে থাকে।
ইশিতা চাপা স্বরে হেসে ফেলে। পরী চুপচাপ খাচ্ছে। ইশিতা বলে,"হতেও পারে। ওকে প্রতিদিন সকালে এক বাটি পাকা পেঁপে খাইয়ে দেবো।"
ফুলির মা খাবার টেবিল থেকে সব পরিষ্কার করতে করতে বলে,"খোজ খবর রাইখেন ইশু আপা। আজকাল কত বিদেশি পার্টি কত ধান্ধা পার্টির খ'প্প'রে পরে। ইশমাম ভাইয়ার সাথে এমন কিছু হয়নাই তো!"
ইশিতা ফুলির মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। ফুলির মা বিড়বিড় করে বলতে থাকে,"আমার এক ভাইস্তা ইতালি গেছিলো। বেশ ভালো টাকা পয়সা কামাইতেছিলো। হঠাৎ হের লগে এইদেশী এক মেয়ের ফেসবুকে পরিচয় হয়। ছবি না দেইখা,মেয়ের কন্ঠ শুইনাই পিরিতে মজে গেছিলো। টাকা পয়সা প্রচুর উড়াইছে মাইয়াটার পিছে। যখন যখন চাইতো তখন দিয়া দিতো। তারপর একদিন দেখে মাইয়াটার কোনো খোজ খবর নাই। এদিকে পোলা তো পাগল হয়ে দেশে চলে আসছে মেয়ের খোজ নিতে। আইসা বহু কষ্টে খোজ খবর নিয়ে দেখে......"
_কি দেখে? মেয়ের চেহারা ভালো না? বয়স বেশি?
পরী কথাটি জিজ্ঞেস ফুলির মায়ের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। ফুলির মা বলে,"আরে না। তাইলে তো হতোই। গিয়া দেখে ওটা কোনো মেয়েই ছিলো না। ওটা একটা ব্যাটা ছেলে।"
পরী শব্দ করে হেসে ফেলে। ফুলির মা ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"খোজ নিয়া দেখেন আপা, ইশমাম ভাইয়ের সাথে এমনটা হয়নাই তো আবার? নয়তো হুট করে দেশে আইবো ক্যান।"
পরী হেসেই যাচ্ছে। ইশিতা কপাল কুঁচকে ফুলির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"তুমি তোমার কাজ করো। আর এভাবে শুদ্ধ আর আঞ্চলিক ভাষা মিশিয়ে কথা বলা বন্ধ করো । ইশমাম শুনলে একটা ধ'ম'ক খাবে তুমি।"
***
ঘরে ঢুকে সোজা আলোর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"তোমার বাবা। কথা বলো।"
আলো সামিনের হাতের ফোনটার দিকে একবার তাকিয়ে সামিনের মুখের দিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোর ডান হাত টেনে তুলে হাতে তার ফোনটা রেখে হনহন করে চলে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় আলো কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। সে সামিনের যাওয়া দেখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই চোখ দুটো ভিজে ওঠে। স্ক্রিনে তার বাবা আতাউর আলমের নাম্বার। ফোনটা কানে ধরে চুপ করে থাকে আলো। আতাউর আলম ওপাশ থেকে নরম গলায় ডাকে,"আম্মু!"
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,"আব্বু।"
রেহেনা এসে স্বামীর হাত থেকে ফোনটা কে'ড়ে নিয়ে কানে ধরে। চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"মা। মা তুই কেমন আছিস মা।"
আলো চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। নিজেকে সামলে নিয়ে কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলে,"আমি খুব ভালো আছি আম্মু। তুমি কেমন আছো? কন্ঠ এমন লাগছে কেনো?"
_আমি ভালো নেই। একটুও ভালো নেই। তোকে ওরা মারধোর করে না তো মা?
_আমাকে কেউ কিছু করে না আম্মু। তুমি একটু ঠিক হও। তোমার বুকে ব্যাথা হবে তো।
_তুই সত্যি বল তুই কেমন আছিস।
_আমি ভালো আছি। আমাকে দেখবে? দেখবে তুমি?
আলো ফোন কেটে দিয়ে ভিডিও কল করে । রেহেনা ফোনটা রিসিভ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ভেজা চোখে। আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"এই দেখো। আমার গায়ের শাড়ীটা দেখো। কম করে হলে হাজার পাঁচেক দাম হবে, আমার গায়ের গয়না দেখো। এগুলো দেখেছো তুমি কখনো?"
সামিন ঘরে ঢুকে আলোকে কাঁ'দ'তে দেখে। রেহেনা ওদিকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁ'দ'ছে। আলো রেহেনাকে বলতে থাকে,"আমি খুব ভালো আছি আম্মু। আজান আয়াত কোথায়? কলেজ যায় তো? বাবাকে বলো নিয়ম করে ওষুধ নিতে। তুমিও তোমার ওষুধ গুলো নিও। দাদীকে দেখো। রাখছি আম্মু।"
হুট করে ফোনটা কেটে দিয়ে আলো বিছানায় বসে কাঁদতে থাকে। শরীর ভেঙ্গে কান্না আসছে তার। সামিন এক দৃষ্টে আলোকে দেখে তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেয়। আলো ভেজা চোখ তুলে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"শান্তি পেয়েছেন তো? অনেক শান্তি হচ্ছে তাই না আপনার মনে?"
_হ্যা হচ্ছে। জামিলের জ্ঞান ফিরেছে তাই শান্তি হচ্ছে।
আলো উঠে দাঁড়ায়।
"জ্ঞান ফিরেছে? বলেনি সত্যিটা? আমার বাবা যে কিছু করেইনি সেটা বলেনি?"
_কথা বলতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে।
_জানি কি বলবে। আমার বাবা নির্দোষ সেটাই বলবে। কেউ কাউকে মুখ ঢেকে কু'পি'য়ে তার পরিচয় কেনো দেবে ইয়াসার মির্জা? আমার বাবার নাম ভাঙানো হয়েছে সেটা বুঝতে পারছেন না? আপনি নাকি বিচক্ষণ! এতো টুকু বুঝতে পারলেন না বুদ্ধি খাটিয়ে? থানা পুলিশ করে বের করতেন সত্যি টা। তা করেন নি কেনো?
_এতো কথা আমি বলতে চাচ্ছি না। কথা ছিলো জামিলের জ্ঞান ফিরলে তোমাকে তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দেবো। আমি আমার কথা রেখেছি।
_এতো কথা রাখেন আপনি? এতো ভালো মানুষ? তাহলে একটা কথা দিন আমায়। জামিলের মুখ থেকে যদি জানতে পারেন লোক গুলো আমার বাবার কেউ না বরং কোনো তৃতীয় পক্ষ ছিলো তাহলে আমাকে ছেড়ে দেবেন আপনি। কথা দিন, পারবেন? আছে দম?
সামিন কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে চুপচাপ। তারপর ফোন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
***
শান্তিনীড়ের দোতলার এই লাইব্রেরীটা এ বাড়িতে ইশমামের সবথেকে প্রিয় যায়গা। বলা যেতে পারে ইশমামের জীবনের বেশ অনেকটা সময় সে এই লাইব্রেরীতে ব্যায় করেছে। লাইব্রেরীর ভেতরে ঢুকলে একটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে তার মন ছেয়ে যায়। পুরনো বইয়ের গন্ধ ইশমামের বরাবর খুব পছন্দের। আগে লাইব্রেরীতে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গল্পের বই থাকলেও ইশিতার কল্যানে পুরো লাইব্রেরীটা হুমায়ূন আহমেদ এবং সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসে ভর্তি হয়ে গিয়েছে।
লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে ইশমাম এদিক ওদিক তাকায়। ঘরটা খোলা কেনো! কিছুক্ষণ আগেও তো লক করে দিয়ে গিয়েছিলো। ভেতরে ঢুকে পুরো লাইব্রেরীতে চোখ বুলিয়ে ইশমাম তার প্রিয় শেলফের কাছে যায়। সেখান থেকে আরণ্যক উপন্যাস টা তুলে নেয়। এটা এখন সে নিজের ঘরে, বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে পড়বে। বই টা নিয়ে বের হয়ে দরজাটা লক করবে বলে হাত বাড়ায় সে।
"আটকাবেন না প্লিজ। আমি ভেতরে আছি।"
ইশমাম অবাক চোখে লাইব্রেরী ঘরের ভেতরে তাকিয়ে থাকে। নয় নাম্বার শেলফের পেছন থেকে মাথা বের করে উঁকি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে পরী। ইশমাম চোখ বড়বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,"তুমি! তুমি এখানে কি করছো!"
পরীর ফরসা মুখটা লাল বানিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,"বই নিতে এসেছিলাম। রাতে পড়বো বলে।"
_যখন লাইব্রেরীতে ঢুকলাম তখন সাড়াশব্দ করলে না কেনো? যদি আটকে রেখে চলে যেতাম?
পরী ইতস্তত করতে থাকে। ইশমাম প্রায় ধ'ম'কের সুরে প্রশ্নটি করেছে পরীকে।
কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে পরী জবাব দেয়,"ভেবেছি আপনি রেগে যাবেন আমাকে এখানে দেখলে। তাই চুপ করে ছিলাম।"
ইশমামের উত্তর টা পছন্দ হয় না। এটা কোন ধরনের অদ্ভুত আচরণ! রেগে যাবে ভেবে চোরের মতো লুকিয়ে থাকবে! এই মেয়ে নাকি আবার ডাক্তারি পড়ে!
ইশমাম গম্ভীর কন্ঠে বলে,"বই নিলে কেনো রাগ করবো? বই চুরি করলে রাগ করার কথা। তুমি তো আর বই চুরি করতে আসো নি।"
পরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইশমাম এতক্ষণে মেয়েটিকে খেয়াল করে, অতিরিক্ত ফরসা, ঘন কালো চুল, বড় বড় দুটি চোখ। এক কথায় সুন্দরী তরুণী। চার বছর আগে দেখতে কিশোরী টাইপ ছিলো, তখন সম্ভবত ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়তো, মাথায় দুই লিটার তেল দিয়ে চুল দুই পাশে বেনী করে পোনা চাচার সাথে এ বাড়িতে আসতো।
ইশমাম গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,"তা ডাক্তারি পড়া মেয়ের হাতে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস কেনো? হুমায়ূন আহমেদের রোমান্টিক থিওরি দিয়ে রোগী সুস্থ করবে?"
পরী চুপ করে থাকে। ইশমাম গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"এই বয়সটাতে বাংলাদেশী মেয়েরা হুমায়ূন আহমেদকে এড়িয়ে থাকতে পারে না। কি আশ্চর্য!"
কথাটি বলে পরীর দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে বলে,"বই নেওয়া হয়ে গেলে দরজা লক করে যেও। আর যেটা যে স্থান থেকে তুলবে,সেটা সেখানে রেখে দেবে, বুঝেছো? আমি বই অগোছালো করে রাখা পছন্দ করি না।"
পরী মাথা নাড়ায়। ইশমাম চলে যেতেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,"রামগরুরের ছানা!"
***
বাড়ির সবাই সম্ভবত ঘুমিয়ে গিয়েছে। দোতলার লিভিং রুমের বাতি নিভিয়ে রাখা। আলো একবার দরজা খুলে দেখে ইশমামের ঘরে বাতি জ্বলছে। আলো সাথে সাথে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ঐ পি'শা'চ টা এখনো ফেরেনি। বিষয়টি আলোর কাছে খুব স্বস্তির। যতক্ষন দূরে থাকে এই বন্দীশালার ভেতরেও আলোর নিজেকে খানিকটা মুক্ত , স্বাধীন মনে হয়। কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থেকে বারান্দায় চলে যায় সে। ইয়াসারের বাড়িতে কোনো এক অদ্ভুত কারনে এই খোলা বারান্দাটাকে আলোর পছন্দ হয়েছে। আলোদের বাড়িতে আলোর ঘরেও একটা খোলা বারান্দা রয়েছে। তবে সেটা এতোটা বড় নয়। এই বারান্দাটা বিভিন্ন দেশীয় ফুলের গাছে সজ্জিত। একপাশে কিছু ক্যাকটাসের টব। আলো ডানে তাকিয়ে দেখতে পায় তার শুকাতে দেয়া শাড়িটা এখনো বারান্দায় দড়িতে ঝুলছে। আলোর দাদী দেখতে পেলে এতক্ষনে আলোকে দশটা ধমক দিয়ে মাথায় গাট্টা মা'র'তো, বলতো,"মাইয়া মাইনষের গায়ের পোশাক রাইতে বাইরে রাখতে নাই। এইটাও ভুইলা যাস হতচ্ছাড়ি!"
আলো শাড়িটা তুলে নিয়ে ঘুরে দাড়াতেই থমকে যায়। বাড়ির পেছন দিক থেকে ধুপ-ধাপ শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে মাটিতে গর্ত খোঁ'ড়া'র জন্য কোদাল চালানো হচ্ছে। শাড়িটা পুনরায় দড়িতে রেখে ধীরপায়ে হেটে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায় সে। নিচু হয়ে তাকাতেই চ'ম'কে ওঠে। সামিন ইয়াসার মির্জা টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে পোনা চাচা বলে লোকটা। আরেকটা অচেনা লোক মাটি খুঁ'ড়'তে ব্যাস্ত। পাশেই একটা বস্তা,মুখ বন্ধ করে রাখা। গর্তটার দিকে তাকাতেই আলো হতভম্ব হয়ে যায় । এতো বড় গর্ত দিয়ে কি হবে! আর ঐ বস্তায় কি আছে! আলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়। তারপর দুমিনিট সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবে। তার চোখ মুখ আ'ত'ঙ্কে ছেয়ে যায়। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে ঘরের সিটকিনি খুলে নিচে নামে। ফুলির মা আর সিতারা তখনো জেগে। আলোকে দেখে ফুলির মা চেঁচিয়ে ওঠে,"আরে বড় ভাবী! দৌড়ায়া কই যান।"
আলো দৌড়ে সদর দরজার দিকে যায়। সিতারা ঘা'ব'ড়ে গিয়ে বলে,"পালাচ্ছে নাকি!"
দরজা খুলে আলো সোজা বাড়ির পেছনের দিকটাতে যায়।
"কি করছেন এখানে আপনারা?"
আলোর কন্ঠস্বর শুনে সামিন ঘুরে তাকায়। তার চোখে মুখে হতভম্ব ভাব। পোনা চাচাও অবাক হয়ে যায়। আলো বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে। ইয়াসার কপাল কুঁচকে ফেলে, গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"তুমি! তুমি এখানে এসেছো কেনো?"
_বস্তায় কি আছে?
তেজী কন্ঠে জানতে চায় আলো।
সামিন একবার বস্তার দিকে তাকিয়ে আলোর চোখের দিকে তাকায়, তারপর বলে,"তোমার কাজ কি জেনে? ভেতরে যাও আলো।"
_কার লা'শ বস্তায়? কোন মায়ের কোল খালি করেছেন আপনি?
কোদাল হাতে নিয়ে অচেনা লোকটা মুখ হা করে দাঁড়িয়ে আছে। পোনা চাচা মিনমিন করে বলে,"ভেতরে যাও বৌ মা। ইয়াসার বাবা রেগে যাচ্ছে।"
আলো পোনার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,"চাচা আপনিও? আপনাকে আমি সহজ সরল লোক ভেবেছিলাম। শেষমেশ আপনিও টাকার জন্য এই অ'মা'নু'ষ টার সাথ দিচ্ছেন?"
_বৌমা কি বলছো এসব তুমি!
সামিন পোনাকে থামিয়ে দিয়ে আলোকে বলে,"ভালোয় ভালোয় বলছি, ভেতরে যাও আলো। পাড়া প্রতিবেশী জেগে যাবে। এতো জোরে চেচিও না। সিনক্রিয়েট করো না।"
_জেগে যাক। সবাই দেখুক এখানে কি হচ্ছে। আপনার আসল রূপ টা দেখুক।
চেঁচামেচিতে এতক্ষনে বাড়ির সবাই এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। ইশমাম, ইলহাম,ইশিতা,রিতু, ফুলির মা,সিতারা, পরী,ইহান। সবাই এসেছে।
সামিন ইয়াসার দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"অবাধ্য হয়ো না আলো আমার। তুমি ঘরে যাও।"
_বস্তায় কি আছে?
আলো ইয়াসারের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে। সামিন ইয়াসার কয়েক মুহূর্ত আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে পোনা চাচার দিকে তাকায়। পোনা চাচা গিয়ে বস্তার মুখ খুলে সবটা ঢেলে দেয় মাটিতে।
আলো হা হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। বস্তায় শুকনো পাতা এবং কচুরিপানা ছিলো। আলো পোনার মুখের দিকে তাকায়। পোনা নিচু স্বরে বলে,"গাছের জন্য কম্পোস্ট বানানোর স্থান প্রস্তুত করছিলাম বৌমা! "
আলো মাথা ঘুরিয়ে চোখ তুলে ধীরে ধীরে সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়। সামিন ক'ট'ম'ট দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে তার হাত সে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে।
আলো একটা ঢোক গিলে ফেলে, মনে মনে বলে ওঠে,"সিংহের নাকে সু'ড়'সু'ড়ি দিয়েছিস আলো। আজ তোর খবর আছে!"
ইশমাম আলোর দিকে তাকিয়ে সামিন কে বলে ওঠে,"কি হচ্ছে এখানে ভাইয়া? কোনো সমস্যা?"
সামিন ইশমামের কথার উত্তর না দিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"বেশি বেশি করতে আমি নিষেধ করেছি আলো। ঘরে চলো। আজ তোমাকে এমন শি'ক্ষা দেবো তুমি আজীবন মনে রাখবে ফ'ট'কা চালাক মেয়ে!"
দরজা লক করে সামিন আলোর দিকে তাকায়। তাকে দেখে আলোর হঠাৎ খুব ভ'য় হচ্ছে। এতোটা ক্ষে'পে যেতে ইয়াসারকে সে কখনো দেখেনি। আলো প্রথম দিন থেকে ইয়াসারকে যত অপমান করেছে, গায়ে থুতু মে'রে'ছে, গায়ে হা'ত তুলেছে,ইয়াসার কখনো মে'জা'জ দেখায়নি। ঠান্ডা মাথায় আলোকে বরদাস্ত করে গিয়েছে। কিন্তু আজ সামিন ইয়াসার যেন অন্য রূপ ধারণ করেছে। আলো একটা ঢোক গিলে ফেলে কন্ঠে তেজ ফিরিয়ে এনে বলে,"ভ'য় দেখাচ্ছেন? ভ'য় দেখাচ্ছেন আপনি আমাকে? শুনুন ইয়াসার মির্জা। আমি আপনাকে ভ'য় পাই না। আমার সাথে উলটো পাল্টা কিছু করতে এলে না! ঠ্যাং খোঁ'ড়া করে দেবো আপনার!"
ইয়াসার দাঁত কিড়মিড় করে আলোর দিকে এগিয়ে যায়,
"আচ্ছা! তাই নাকি?"
আলো ভয় পেয়ে গেলেও টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইয়াসার আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আলোর হাতের কব্জি ধরে। দাঁত খিচিয়ে বলে,"বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছি না আলো? বেশি বোঝো তুমি? আজ তোমার এই হাল তোমার বেশি বোঝার কারনে তা কি তুমি জানো? কেন আমায় চ'ড় মেরেছিলে সেদিন?"
আলো ইয়াসারের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গায়ের সমস্ত শক্তি খরচ করে। ইয়াসার তার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে,"কই? তোমার অর্জন কোথায়? একটা স্টেপ দেখাও তো। দেখি কেমন কারাতে জানো তুমি!"
আলো দুমিনিট গ'লা'কা'টা মুরগির মতো ছটফট করে নিস্তেজ হয়ে পরে। নিষ্প্রাণ গলায় বলে,"রাত দশটার সময় মানুষ কম্পোস্ট বানাতে যায়? আমার যায়গায় অন্য কেউ হলে সেটাই ভাবতো, যেটা আমি ভেবে ফেলেছি!"
_সেজন্য আমাকে খু'নী বানিয়ে দেবে?
_কেন? ভুল বললাম কোথায়? আমার ভাইদের মে'রে বড় বাজারের ব্রিজের নিচে কচুরিপানার মধ্যে কিংবা মিউনিসিপ্যালিটির ড্রেনে ফে'লে দিয়ে আসবেন। বলেন নি এমন কথা?
সামিন থতমত খেয়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মিনমিন করে বলে,"ভ'য় দেখিয়েছি শুধু। করতাম না কিছু। খু'ন খারাবি কখনো করিনি।"
_রাত দশটার সময় কম্পোস্ট কে বানাবে পাগল ছাড়া?
_আমি রাত তিনটার সময় বানাবো। তাতে তোমার কি গোয়েন্দা বাপের গোয়েন্দা কন্যা?
কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে উঠল সামিন।
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন আবারো আগের মূর্তি ধারণ করে বলে,"আর যদি কখনো দেখি আমি বেশি লম্ফ ঝম্প করেছো তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে আলো। আজ কিছু বললাম না। চেয়েছিলাম শাস্তি দিতে। দিলাম না। মেয়ে মানুষ। দুর্বল প্রজাতি তাই।"
_কি করতেন? গায়ের জো'র দেখাতেন? আপনার মতো কা'পু'রু'ষে'রা আর কিই বা পারে। সব পারিবারিক শিক্ষা। নিজের মা চাচীকে দেখেছেন আজীবন বাবা চাচার পায়ের তলায় পি'ষ্ট হতে। সেটাই শিখেছেন। আপনার মতো পুরুষেরা ঐ তথাকথিত পুরুষধর্মের অনুসারী,পূ'জা'রী!
_আচ্ছা! আর তোমার বাবা কি করতো? তোমার মাকে মাথায় উঠিয়ে নাচতো সারাদিন?
ঠান্ডা গলায় বলে ইয়াসার। আলো কিছুক্ষণ চুপ করে ইয়াসারের চোখে চোখ রেখে বলে,"আমার বাবাকে দেখেছি সারাজীবন আমার মাকে বু'কে রেখেছে। না মাথায়,না পায়ের তলায়। একজন স্ত্রীর স্থান তার স্বামীর বুকে!"
আলোর এই একটা কথায় কি ছিল সামিন জানে না। কিন্তু এই কথাটিতে সামিন থ'ম'কে গিয়েছিলো। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের সমীকরণের পাঠের হাতেখড়ি হলো সামিনের, সেটা টের পেলো না কেউই।
দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়। আলো বলতে থাকে,"অবশ্য আপনি এসব বুঝবেন কি করে? আপনার বাবা আপনার সামনে কখনো আপনার মাকে বলেছে "ভালোবাসি?"
সামিন রোবটের মতো মাথা নাড়িয়ে "না" বলে। যেন সে আলোর হাতের চাবি দেয়া পুতুল হয়ে গিয়েছে। আলো বলে,"কিন্তু অসংখ্য বার আপনার সামনেই আপনার মাকে ধ'ম'কে'ছে। তাই তো? সেজন্যই তো শুধু শিখেছেন স্ত্রী ধ'ম'কে'র জিনিস,তুচ্ছ।"
কিছুক্ষণ চুপ করে আলোর দিকে তাকিয়ে সামিন হঠাৎ করে নরম গলায় বলে ওঠে,"বেশী চেঁচিয়ে কথা বলবে না আর। পাড়া প্রতিবেশী ভয়ংকর লেভেলের কু'চু'টে। উল্টো পাল্টা কথা বানাতে ছাড়বে না। আমি সেটা বরদাস্ত করবো না। অনেক রাত হয়েছে। শুয়ে পরো। আমি কোনো জোর খাটাবো না। দুর্বল জাতি তোমরা। জোর খাটানোর প্রয়োজনও নেই। আজ যে শাস্তি তোমায় দিতে চেয়েছিলাম সেটা হলো তোমার মুখে স্কচ টেপ লাগিয়ে রাখতাম। "
***
"স্যার ম্যাম এসেছে।"
ইলহাম চোখ তুলে তার পিএ সিফাতের দিকে তাকায়। তারপর হাতের ফাইলটা দেখতে দেখতে বলে,"ইহান এসেছে সাথে? পাঠিয়ে দাও।"
সিফাত বলে,"না না স্যার। আপনার বৌ ম্যাডাম না। জুঁই ম্যাডাম!"
ইলহাম হাতের ফাইলটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যায়। জুই কেবিনের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে। সিফাত চলে যায়। ইলহাম জুই এর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে, বেগুনী রঙের পাতলা জরজেটের শাড়ি,বড় গলার ব্লাউজ। ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক। ইলহাম গম্ভীর কন্ঠে বলে,"এভাবে সেজে অফিসে এসেছো কেনো?"
জুই একটা অনর্থক হাসি হেসে ইলহামের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলে,"প্লিজ ইলহাম। এসব তোমার ঐ হার হাবাতে বৌয়ের সাথে করো। আমার সাথে নয়। আমি একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওম্যান। আমার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সাজবো।"
ইলহাম হেসে গদগদ হয়ে বলে,"ওকে ওকে! রাগ করো না। আসলে তোমার এই সৌন্দর্য অন্য কেউ দেখলে আমার হিংসা হয়। কেনো বোঝো না এটা?"
জুই ইলহামের দিকে সামান্য ঝুঁকে বলে,"এসব কথায় আর চিড়ে ভিজবে না ইলহাম। আসল কথা বলো! বিয়েটা কবে করছো আমায়? কেনো তোমার ঐ বৌকে ঘার ধরে বের করে দিচ্ছো না! তোমার বড় ভাইকে কেনো এতো ভয় পাচ্ছো?"
ইলহাম একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"ভাইয়াকে ভয় পাচ্ছি না জুই। ইহানের কথা ভাবছি। মা ছাড়া কিছুই বোঝে না ও। আরেকটু বড় হোক, তারপর না হয়...."
জুই ইলহামের কথা শুনেই কপাল কুঁচকে ফেলে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"আর এক বছর সময় দিলাম। তারপর যদি ওকে না তাড়িয়ে দাও না,তাহলে আমাকে তুমি হারিয়ে ফেলবে ইলহাম।"
"ভাবী।"
ইশিতার ডাকে রিতু শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। ইশিতা এসে রিতুর কাঁধে হাত রেখে চিন্তিত হয়ে বলে,"কাঁ'দ'ছো কেন? ভাইয়ার সাথে কিছু হয়েছে?"
রিতু কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,"ঐ মেয়েটা আবার তোমার ভাইয়ের অফিসে এসেছে আপু।"
ইশিতা রেগে গিয়ে বলে,"আমি বারবার বলি,চলো বড় ভাইয়াকে বলি। চলো। তুমি কেনো আমার কথা শুনছো না?"
_ভাইয়া ওনাকে শাস্তি হিসেবে ব্যাবসা থেকে দূর করে দেবে আপু। আমি ওনার ভোগান্তি চাচ্ছি না।
"তাহলে মরো তুমি। মরে যাও।"
আলোর কন্ঠ শুনে রিতু আর ইশিতা চ'ম'কে ওঠে। আলো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রিতু চোখ মুছে ওদিকে মাথা ঘুরিয়ে নেয়।
আলো কন্ঠে বিদ্রুপ মিশিয়ে বলে,"এই যে তুমি। এদিকে তাকাও। এই বাড়ির লক্ষী মেজো বৌমা। তাকাও বলছি।"
রিতু ধীরে ধীরে তাকায় আলোর দিকে। আলো বলে,"তুমি একটা জড়বস্তু। একটা অবজেক্ট তুমি। তোমার মরে যাওয়া উচিত।"
ইশিতা আলোকে বলে,"এভাবে কথা বলবে না আলো। ভাবী এমনিতেই কষ্ট পাচ্ছে।"
আলো ইশিতা কে উপেক্ষা করে বলে,"কেনো ওকে লা'ত্থি মেরে চলে যাচ্ছো না এখনো? তোমাকে কি আমার মতো জিম্মি করে রেখেছে? রাখেনি । তাহলে কেনো একটা চরিত্রহীনের মায়ায় আঁটকে আছো। কবুল বলেছো বলে? ওর বাচ্চা পেটে ধরেছো বলে?"
_হ্যা তাই। তাই।
ডুকরে কেঁদে ওঠে রিতু। আলো কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে,"তোমাদের মতো অবজেক্ট দের মরে যাওয়াই উচিত।"
রিতু কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। ইশিতা তার পিছু পিছু ছুটে যায়।
আলো দাঁড়িয়ে আছে। ইশমাম পেছন থেকে বলে,"এখানে কি নারী মুক্তির আন্দোলন চলছে?"
আলো ঘুরে পেছনে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। ইশমাম আলোর দিকে এগিয়ে যায়। নিচু স্বরে বলে,"তোমাকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি অদ্রিতা। বেগম রোকেয়ার থেকে কোনো অংশে কম না তুমি।"
_আর আমি তোমাকে যত দেখছি তত আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। রিতুর চেয়েও বড় জড়বস্তু তুমি। একটা ক্রি'মি'না'ল ভাইয়ের হনুমান তুমি।
ইশমাম চুপ করে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো দ্রুত পায়ে হেঁটে সামিনের ঘরে চলে যায়। ইশমাম ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে বলে ওঠে,"বারবার বলেছি, এসবে জরিও না,জরিও না। কিন্তু না। তোমার তো সাহসীকতা দেখাতে হবে। তোমার আর ভাইয়ার সংঘাতে আমার অনূভুতিকে জলাঞ্জলি দিতে হলো অদ্রিতা!"
****
গাড়ি থেকে নেমে ইমতিয়াজ মির্জা শান্তিনীড়ের অন্দর মহলে প্রবেশ করে। রিয়াজ গাড়ি থেকে তার ব্যাগ নামিয়ে লিভিং রুমে রেখে চলে যায়। গায়ের ব্লেজার খুলে একটা ডিভানের উপর রেখে ইহানকে ডাকতে থাকে। রান্নাঘর থেকে রিতু বের হয়ে অবাক চোখে তাকায়,"বাবা আপনি! আপনার তো সামনের সপ্তাহে আসার কথা ছিলো।"
_ছিলো। কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে তাই আর বসে থেকে কি করতাম। ইহান দাদুর কথা খুব মনে পরছিলো। সে কোথায়?
_তার ফুপির কাছে।
রিতু আমতা আমতা করে জবাব দেয়। সে আসলে চিন্তায় পরে গিয়েছে, সামিন ইয়াসার বাড়িতে নেই। এই অবস্থায় তার শশুর যদি আলোকে দেখে তাহলে রিতু কি বলবে!
সিঁড়ি বেয়ে ইশমাম নিচে নেমে দাঁড়িয়ে পরে। ইমতিয়াজ মির্জা উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইশমামের দিকে। ইশমাম কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলে,"কেমন আছেন বাবা!"
_ভালো। তুমি হঠাৎ? কি মনে করে? আমি তো ভেবেছিলাম একেবারে আমার জানাযায় এসে উপস্থিত হবে!
ইশমাম এগিয়ে গিয়ে বাবার সাথে সৌজন্যমূলক কোলাকুলি করে নিচু স্বরে বলে,"কাজ ছিলো কিছু।"
_ও আচ্ছা আচ্ছা। আমাদের জন্য আসোনি তাহলে।
ইশমাম কিছু বলে না। ইমতিয়াজ স্বাভাবিক গলায় বলে,"এসেছো যখন,নিজের ভাগ টা বুঝে নিও আর তার সাথে নিজের দায়িত্বটাও।"
সিঁড়ি বেয়ে আলো নিচে নেমে আসে। রিতু মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলে,"এর ও ঠিক এই মুহূর্তে নিচে নামার ছিলো! ইয়া মাবুদ! আমি এখন কি করবো!"
ইমতিয়াজ মির্জা অবাক হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো '
নেমে দাঁড়িয়ে পরে লিভিং রুমে। রিতু একবার আলো আর একবার ইমতিয়াজ মির্জার দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ মির্জা আলোর দিকে তাকিয়ে ধ'ম'কে ওঠে,"এই মেয়ে! এখানে কি তোমার?"
"ও এখন এ বাড়ির লোক বাবা। তোমার বড় ছেলের বৌ।"
সামিন ইয়াসারের কন্ঠ শুনে ইমতিয়াজ মির্জা সদর দরজার দিকে তাকায়। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে সামিন। এয়ারপোর্টে নেমেই ইমতিয়াজ বড় ছেলেকে ফোন করেছিলো। সামিন তাই ছুটে এসেছে যাতে আলোকে নিয়ে কোনো ঝামেলা তৈরি না হয়।
_বড় ছেলের বৌ মানে?
হতভম্ব হয়ে যায় ইমতিয়াজ মির্জা। সামিন বলে,"মানে আমার বৌ। ওকে আমি বিয়ে করেছি।"
আলো সামিন ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে তার বাবার দিকে তাকায়। সে মনে মনে খুব চাচ্ছে এখন বাবা ছেলেতে যুদ্ধ লেগে যাক।
ইমতিয়াজ মির্জা ছেলের দিকে হা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,"তুমি কি আমার সাথে মজা করছো ?"
_তোমার সাথে মজা করতে আমি আতাউর আলমের মেয়েকে বাড়িতে এনে শাড়ি, চুড়ি পরিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাখবো বাবা?
_কোন সাহসে তুমি এই কাজটা করলে! তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো? শেষে ওই আতাউর আলমের মেয়েকে? যে আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করেছিলো? এই মেয়েটা তোমাকে চ'ড় মেরেছিলো ভরা জনসভায় সেটা ভুলে গেলে?
সামিন বাবার কথার উত্তর না দিয়ে আলোর দিকে তাকায়। তারপর বলে,"তোমার শশুর। সালাম দাও।"
আলো একবার সামিন, একবার ইমতিয়াজকে দেখে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। সামিন কোনো এক অজানা কারনে হেসে ফেলে। সে আসলে আগে থেকেই জানতো আলো ঠিক এই কাজটাই করবে। ইমতিয়াজ মির্জা বলে,"কী ঔদ্ধত্য এই মেয়ের। এটা তুই কি করলি বেটা! তাও আমাকে না জানিয়ে! গদি ছেড়েছি দেখে দাম দিচ্ছিস না দেখছি! কেনো করেছিস ওই মেয়েকে বিয়ে তুই! বল!"
_ভালো লেগেছিলো।
সামিন বাবাকে আসল কথাটা বলে না। ইশমাম ভাইয়ের কথা শুনে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায়। সামিন বলতে থাকে,"মেয়েটা একটু আলাদা তাই ভালো লেগেছিলো। আমি সংসার করতে পারলে তোমার অসুবিধে হবার কথা না বাবা! আমি যে বিয়ে করি সেটা তো তুমিও চাইতে!"
_তাই বলে আতাউরের মেয়েকে?
সামিন এক রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে,"হ্যা। আতাউরের মেয়ে অদ্রিতা আলোকে।"
***
বাসার পরিস্থিতি কিছুটা থমথমে হয়ে আছে। ইমতিয়াজ মির্জা ছেলের ওপর প্রচণ্ড অভিমান করে নিজের ঘরে বসে আছেন। ইহানকে ছাড়া কাউকে সে ঘরের ভেতর ঢুকতে দিচ্ছে না। সামিন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাওয়া দাওয়া করে দোতলায় উঠে গিয়েছে। যেন কিছুই হয়নি।
দোতলা থেকে পরী তার ব্যাগ গুছিয়ে নেমে ডাইনিং রুমে ইশিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইশমামের দিকে এক পলক তাকিয়ে ইশিতাকে বলে,"আসছি আপু।"
_আবার সামনের সপ্তাহে আসবি। বারবার ফোন দিতে আমার ভালো লাগে না।
পরী মাথা নাড়ায় ঠিকই কিন্তু মনে মনে বলে,"তোমার এই রামগরুরের ছানা ভাইটা যতদিন এখানে আছে আমি এ পথে
আসছি না।"
পরী চলে গেলে ইশমাম বলে,"মেয়েটার কি কোনো সমস্যা আছে?"
_কেনো বলতো?
_কেমন এবনরমাল। হাঁটাচলা করে অদ্ভুত ভাবে। সামান্য কথা বললেই লাফিয়ে ওঠে। অতিরিক্ত ন্যাকা মনে হয় না তোর? ও কি পোনা চাচার প্রিম্যাচিওর বেবি ছিলো?
ইশিতা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে ইশমামকে বলে,"বিদেশে থেকে থেকে ক্ষ্যা'পা মেয়েদের দেখে দেখে পরীর মতো মিষ্টি,নম্র ভদ্র মেয়েকে ন্যাকা লাগবেই। স্বাভাবিক।"
ইশমাম ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"তুই এতো ক্ষে'পে যাচ্ছিস কেনো? আচ্ছা ন্যাকা শব্দটা আমি ফিরিয়ে নিলাম। পরী হচ্ছে খাঁটি বাঙালি নারী। হয়েছে?"
ইশিতা কোনো কথা বলে না, নাক চোখ কুঁচকে খেতে থাকে। এ বাড়ির একটা ছেলেও একটু ভদ্র স'ভ্য হলো না। এটাই তার আফসোস!
***
সামিন খেয়াল করেছে সকাল থেকে আলোর মুখটা অস্বাভাবিক অন্ধকার হয়ে আছে। খেতে পর্যন্ত যায়নি নিচে। পাত্তা না দিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে জামা বদলে বেরিয়ে আসে সে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গায়ে পারফিউম মাখতে মাখতে আবারো আলোর দিকে তাকায়। আলো মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে। গাড়ির চাবি আর সানগ্লাস নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সামিন। আলো দৃষ্টি ঘুরিয়ে দরজার দিকে চায়।
ইহানকে স্কুলের জন্য বিদায় জানতে পোর্চের নিচে এসে দাঁড়ায় রিতু। পোনা চাচা ইহানকে স্কুলে আনা নেওয়া করে। রিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সামিন বলে,"একটা কাজ করে দেবে রিতু?"
_কি কাজ ভাইয়া?
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রিতু।
"ভাবী আসবো!"
রিতুর কন্ঠস্বর শুনে আলো নড়েচড়ে বসে। গম্ভীর কন্ঠে বলে,"এটা আমার ঘর না। এতো পারমিশন নেওয়ার কিছু নেই।"
রিতু ভেতরে ঢোকে। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"কাঁদছিলেন নাকি ভাবী!"
_কিছু বলার থাকলে বলে বিদায় হও এ বাড়ির লক্ষী মেজো বৌমা।
রিতু এগিয়ে গিয়ে বিছানার একপাশে বসে। আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,"আপনি কি কোনো কারনে কষ্টে আছেন?"
আলো রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছে তোমার ভাসুর। প্রতিটা দিন কতটা মানসিক যন্ত্রনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমি,আর তুমি আমাকে এই প্রশ্ন করছো?। না। আমি আনন্দে আছি। এতো আনন্দে আছি যে আনন্দে তোমাদের সবাইকে খু'ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে!"
রিতু বলে,"ঠিক সেটা না ভাবী। বলতে চাইছি শারীরিক কোনো সমস্যা? ডাক্তার ডাকবো কি না!"
আলো চুপ করে বসে থাকে। রিতু বলতে থাকে,"শারীরিক সমস্যার কথা আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন ভাবী। আমি তো আপনার বোনের মতোই।"
কয়েক মুহূর্ত পরে আলো বলে ওঠে,"ভাই দুটোর আজ জন্মদিন। প্রত্যেক বছর এই দিনে আমি কত কিছু করি ওদের নিয়ে। আজ দেখো, মুখটাও দেখতে পারছি না আমি আমার ভাইদের।"
এতটুকু বলে আলো থেমে যায়। কাদের এসব বলছে সে? এদের বলে কি লাভ! কোনো লাভ নেই! কোনো লাভ নেই!
***
আজ বৌবাজার এলাকার ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে মিটিং বসেছে। শহরের নবনির্বাচিত মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জা কাগজপত্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। পাশ থেকে চা দিতে আসা পঞ্চাশোর্ধ এক মুরব্বি সালাম দিয়ে বলে,"ভালো আছেন মির্জা সাহেব?"
সামিন কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে লোকটাকে দেখে। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে বলে,"ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি ভালো আছি। আপনি?"
_আল্লাহ যেরকম রেখেছে। আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি।
সামিন কাগজ গুলো একজন প্ল্যানিং অফিসারের হাতে দিতে দিতে বলে,"আপনি আমাকে আপনি আপনি করে বলছেন কেনো চাচা? আমি তো আপনার ছেলের বয়সী!"
লোকটা খুশি হয় সামিনের কথায়, কিন্তু বলে,"তুমি কত বড় একজন মানুষ। নগরপিতা আমাদের।"
সামিন ভ্রু কুঁচকে ফেলে, তারপর শুকনো একটা হাসি দিয়ে বলে,"আমি শুধু সেবক চাচা। এসব কথা বলবেন না। এগুলো বলা ঠিক না।"
রাহাত কোথা থেকে এসে সামিনকে বলে,"ভাই সাইডে চলেন একটু কথা আছে।"
সামিন অবাক হয়ে রাস্তার পাশে গিয়ে বলে,"কি?"
_লিজের কাগজ নিয়ে ঝামেলা করছে ভুঁইয়ার দল। লিজের মেয়াদ শেষ কিন্তু দখল ছাড়ছে না।
সামিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,"যাস্ট ক'টা দিন অপেক্ষা কর। ওদের ইচ্ছে মতো উড়তে দে। আমি দেখবো বিষয় টা।"
রনি এসে বলে,"ভাই কি কাজ বলেন। কি করতে হবে?"
_একটু বয়েজ কলেজে যা।
রনি হা হয়ে সামিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর রাগ দেখিয়ে বলে,"ভাই এর জন্য কিন্তু আমাকে আলাদা বেতন দিতে হবে বলে দিলাম। আপনার ঐ দু'দু'ভা'তু শ্যালক দু'টোকে দেখভাল করা চাট্টিখানি কথা না।"
সামিন রনির কথায় হেসে ফেলে।
***
ফুলির মা একবার আলোর দিকে তাকিয়ে আবারো নিজের কাজে মন দেয়। তারপর কিছুক্ষণ যেতেই বলে ওঠে,"বিয়ের সময় ফুলির বাপটারেও আমার পছন্দ ছিলো না ভাবী। বাপ মা এক প্রকার জোর করে বিয়ে দিছিলো। প্রথম প্রথম আমিও আপনার মতো স্বামীরে কাছে ঘেঁ'ষ'তে দিতাম না। পরে কেমনে কেমনে জানি মায়ায় পইরা গেলাম মানুষটার। আপনিও পরবেন,দেইখেন। ভাইজান আমার লাখে এক।"
আলো চোখ রাঙিয়ে ফুলির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"ঘর ঝাঁড় দেওয়া হয়ে গিয়েছে? এবার যাও।"
ফুলির মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আপন মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকে,"এই শহরের কত বড় বড় লোক তাদের মেয়ে বড় ভাইজানের কাছে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব পাঠাইতো , আমাদের বড় ভাইজানরে হেলাফেলা ভাবনের দরকার নাই।"
আলো উঠে দাঁড়িয়ে ফুলির মাকে একটা কঠিন কথা বলতে যাবে অমনি নিচতলা থেকে কেউ ডেকে ওঠে,"আপু।"
আলো থ'ম'কে যায়। একপলক ফুলির মায়ের দিকে তাকায়। ফুলির মা কিছু বুঝতে পারছে না। নিচে কেউ আবারো ডেকে ওঠে,"আপু।"
আলো কয়েক মুহূর্ত থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে ছুটে ঘর থেকে বের হয়। না,সে ভুল শোনেনি। আজান আয়াতই ডাকছে তাকে। কিছু ভুল শোনেনি সে। দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে থাকে আলো, মাঝ খানে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে নিচে তাকায়। আজান আয়াত লিভিং রুমে দাড়িয়ে আছে । আলো ছুটতে ছুটতে নিচে নামতে থাকে। সামিন ইয়াসার সিঁড়ির কাছটাতে দাঁড়িয়ে আছে। আলো দ্রুতপায়ে নামতে গিয়ে হোঁ'চ'ট খেয়ে পরে যাচ্ছিল, সামিন তাকে ধরে ফেলে। আলো বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। একপলক সামিন ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে সে কপাল কুঁচকে ফেলে ইয়াসারের হাত সরিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। আজান আয়াত বোনের দিকে ছুটে আসে। দুহাতে নিজের ভাই দুটোকে আগলে নিয়ে আলো চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। কয়েক মূহুর্ত তিন ভাইবোন চুপ করে থাকে। সামিন ওদের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে ওদেরকে।
নীরবতা ভেঙে আলো বলে ওঠে,"তোরা? তোরা এখানে কিভাবে!"
আজান আয়াত চুপ করে সামিনের দিকে ভীত চোখে তাকায়। এর মধ্যে একটা লোক এসে বেশ বড় সাইজের একটা বক্স রেখে চলে যায়। আলো আজান আয়াতের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামিনের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে। তারপর আজান আয়াতের দিকে ঘুরে বলে,"কি করেছে ঐ লোকটা তোদের সাথে? মে'রে'ছে তোদের? ভয় দেখিয়েছে? কি করেছে বল!"
আজান আয়াত কিছু বলার আগেই সামিন ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,"ওসব কিছু করিনি। শুধু কলেজের সামনে থেকে ধরে এনেছি।"
আলো হতভম্ব হয়ে সামিনের দিকে ফিরে তাকায়। রাগী গলায় বলে,"ধরে এনেছেন মানে? কেনো ধরে এনেছেন? গু'ন্ডা কোথাকার! ক্রিমিনাল।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে," যা বাবা, সকাল থেকে তো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিলে ভাইদের দেখতে পারছো না বলে। এনে উপকার করলাম তাতেও আমি গু'ন্ডা? ইয়ে তো না ইনসাফি হে!"
আলো সামিনের দিকে তে'ড়ে যায়,"সেজন্য ওদের তুলে আনবেন? সব কিছু গায়ের জোরে করবেন? ক্ষমতার জোরে?"
_তুলে আনিনি। কলেজের গেইটের কাছে আমার লোক দাঁড়িয়ে ছিলো। ওরা বের হতেই ওদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় ওরা তোমাকে দেখতে চায় কিনা। ওরা হ্যা বলেছে তারপর নিয়ে এসেছে ওদের। জিজ্ঞেস করো। ওদেরকে জিজ্ঞেস করো।"
আলো আজান আয়াতের দিকে তাকায়। আয়াত বলে,"খুব দেখতে ইচ্ছা করছিলো তোমাকে আপু।"
আলো ভাইয়ের গায়ে দুমদাম কি'ল ঘু'ষি মারতে মারতে বলে,"সেজন্য গু'ন্ডাদের সাথে চলে আসবি? তোদের বুদ্ধি হবে না? ওরা কি করেছিলো মনে নেই? যদি তোদের মে'রে দিতো? যদি ই'য়া'বা ভরে দিতো ব্যাগে? জানিস না ওরা কত ভয়ংকর। জানিস না?"
সামিন আলোকে কয়েক মুহূর্ত দেখে কন্ঠস্বর গম্ভীর করে বলে ওঠে,"ব্যস! নাটক হয়েছে অনেক। এসব এখন বন্ধ। ভাইদের নিয়ে কেক কাটো আর হ্যাপি বার্থডে খতম করো। ওদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো নয়তো তোমার বাবা স্ট্রো'ক করবে।"
সামিন বক্স খুলে একটা বিশাল সাইজের কেক বের করে একটা টেবিলের ওপর রাখে। একে একে বাড়ির সবাই লিভিং রুমে চলে এসে ওদের দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোর হাতে ক্যান্ডেল ধরিয়ে দিয়ে বলে,"নাও এটা।"
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর হাতের ক্যান্ডেল টা ছুড়ে ফেলে দেয় সে। আজান এসে আলোর হাত ধরে, নরম গলায় বলে,"থাক না আপু । চলো কেক কাটি। এমন সুযোগ যদি আর কখনো না পাই?"
আলো ভাইয়ের শুকনো মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে,"চল।"
তিন ভাইবোন মিলে কেক কা'ট'ছে। সামিন একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে আছে। ভাইদের কেক খাইয়ে দিয়ে তাদের কপালে গভীর চুম্বন এঁকে দেয় আলো। চোখ ছলছল করছে তার। ঠোঁট কাঁপছে।
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর নীরবতা ভেঙে আলো সামিনের দিকে কঠিন দৃষ্টি দিয়ে তাকায়। কন্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বলে ওঠে,"ওদেরকে সেইফলি বাড়ি পৌঁছে দেবেন। ভদ্রতার সাথে। আর কোনো গু'ন্ডা'মি নয় ইয়াসার মির্জা!"
***
রাতের খাবার খেতে আলো নিচে যায়নি। সিতারা সামিনের কথায় আলোর ঘরে দিয়ে গিয়েছে খাবার। খাবার টেবিলে ইমতিয়াজ মির্জা খেতে বসেছেন ছেলেদের নিয়ে। খেতে খেতে বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"চাচ্ছো কি আসলে তুমি? এত বড় একটা অঘটন ঘটিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছো না! শত্রুর মেয়ের সাথে আর যাই হোক সংসার হয় না, এতটুকু বোঝার ক্ষমতা নেই তোমার?"
সামিন চুপচাপ খাচ্ছে। বাবার কথার উত্তর দিতে ইচ্ছুক নয় সে। ইমতিয়াজ নিজের ছেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে
হাত ধুয়ে উঠে পরে। এখন বলে তো লাভ নেই। এসব তো তারই ভুল। নিজের হাতে ছেলে গুলোকে জেদী আর বেপরোয়া তৈরি করেছে। এখন কার কাছে অভিযোগ জানাবে সে!
অন্ধকারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলো চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু ঝরায়। কিছু সময় ভাইদের কাছে পেয়েছিলো সে, তাতে কি আর মন ভরে! মনটা কেমন অশান্ত হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে ঐ লোকটাকে খু'ন করে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয় আলো। করবে না, কখনোই ক্ষ'মা করবে না ঐ পি'শা'চ টাকে সে। কখনোই না।
কিছুসময় যেতেই আলোর কেমন অদ্ভুত ঠেকে, শুকনো পাতার মচমচ শব্দ হচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে ডানপাশে ফিরে তাকায় সে। আজ বিকেলের দিকে ঝড়ো হাওয়া বয়ে গিয়েছিলো কিছুক্ষণ। খোলা বারান্দাটা শুকনো পাতায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে। পরিষ্কার করা হয়নি। আলো মেঝের দিকে তাকায়। পাতাগুলো অমন নড়ছে কেনো! বেশ অবাক হয় আলো। খানিকটা ঝুকে তাকাতেই শি'উ'রে ওঠে সে।
বিকট শব্দে চেঁচিয়ে ওঠে,"সাপ.......!"
সামিন ঘরেই ছিলো। আলোর চিৎকারে ছুটে যায় বারান্দায়। আলোর ফ্যা'কা'শে মুখটা দেখে বারান্দার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পরে। আলো উন্মাদের মতো ছুটতে ছুটতে এসে সামিনের বুকে হুমরি খেয়ে পরে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় সামিনের চোখ দুটো রসগোল্লা সাইজের মতো বড় হয়ে যায়। আলো আ'ত'ঙ্কে এতটাই জমে গিয়েছে যে সে খেয়ালই করেনি সে কাকে আকরে ধরে রেখেছে।
কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়। সামিন আলোর মাথার দিকে দৃষ্টি রেখে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,"একটা সাপের ভয়ে ফে'রা'উ'নে'র বুকে আশ্রয় নিলে আছিয়া?"
আলো নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সরে দাঁড়ায়। সামিন একপলক আলোর নিচু করে রাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,"কোথায়? কোথায় সাপ?"
আলো সামিনের দিকে ফিরে তাকায় না। ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে তর্জনী আঙ্গুল তুলে বারান্দার ডান দিকটা দেখিয়ে নিচু স্বরে বলে,"ওদিকে ছিলো।"
সামিন সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যায়। রেলিং এর কাছে গিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে পোনা চাচাকে ডেকে বলে,"চাচা রিয়াজকে একটু পাঠিয়ে দিন তো।"
নিচ থেকে পোনা চাচা উত্তর দেয়,"তোমার ঘরে বাবা?"
_হ্যা আমার ঘরে। তাড়াতাড়ি।
কথাটি বলে সামিন আলোর দিকে এক পলক তাকিয়ে বারান্দার এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করতে লাগলো। আলো এখনো আ'ত'ঙ্ক থেকে বের হতে পারছে না। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে দাঁড়িয়ে।
রিয়াজ এসে দরজায় নক করতেই সামিন গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
তারপর বলে,"বারান্দায় একটা সাপ দেখা গিয়েছে।"
রিয়াজ বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,"কতবার বলেছি হাসনাহেনা গাছটা উ'প্রে ফেলে দেই। ওটার জন্যই এমন হচ্ছে। এই নিয়ে দুইবার। আমার কথা তো বিশ্বাস করেন না স্যার।"
_ওসব কিছু না রিয়াজ। তুমি শেষ কবে কার্বলিক এ'সি'ড স্প্রে করেছিলে বাগানে?
_দুই সপ্তাহ আগে।
_এখন আবার ছড়িয়ে দাও। ফুলির মা কে বলো বারান্দা থেকে এইসব শুকনো পাতা পরিষ্কার করে দিতে।
রিয়াজ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে চলে যায়। কোথাও কিছু নেই। ফুলির মা এসে বারান্দা সহ পুরো ঘরটাই পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। আলো তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
সামিন হালকা কেশে আলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। আলো চোখ তুলে তাকায়। সামিন বলে,"সাপ তোমার চিৎকার শুনেই মাগো বাবাগো বলে পা'লি'য়ে'ছে। আরাফ ঠিকই বলে, তোমার গলায় একটা অদৃশ্য মাইক রয়েছে। তুমি পলিটিক্স করলে মানাবে। মাইক ছাড়াই ভাষণ দিলে তিন কিলোমিটার দূরে থেকে শোনা যাবে।"
আলো খুব অপমানিত বোধ করলো কথাটায় যেন। তার কন্ঠস্বর নিয়ে এমন কু'ৎ'সি'ত মন্তব্য এর আগে কেউ করেনি। কপাল কুঁচকে ফেলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই মাত্র সে এই লোকটার কাছে একটা ভী'তু মেয়ে প্রমানিত হয়েছে।
আলোর নীরবতা দেখে সামিন ঘোর লাগা কন্ঠে বলে ওঠে,"বাহ। এই না হলে নারী। ভয় পেয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে রাখবে, মাথা নিচু করে রাখবে, তা না করে কখনো বৈশাখের বিলের নতুন কৈ মাছ কিংবা ঝিলের চিংড়ি মাছের মতো হাত পা ছুড়ে লাফা লাফি করতে থাকো। তোমাকে মানায় না আলো।"
আলো সামিনের দিকে তাকায়। কিছুটা সময় নিয়ে বলে,"আত্মবিশ্বাসী মেয়েদের পুরুষ অপছন্দ করে জানি। কারন শক্তি'শালী, আত্মবিশ্বাসী মেয়েদের পাশে তারা ই'ন'সি'কি'উ'র ফিল করে। এ দেশের পুরুষরা স্বভাব গত কারনে দুর্বল শ্রেনীর মেয়েদের পছন্দ করে এসেছে। কারন টা হলো নরম মাটিতে আ'চ'র কে'টে খুব আনন্দ পাওয়া যায়। পুরুষের পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে থাকে বোকা বোকা সুন্দরী মেয়ে, যে কথায় কথায় কুর্নিশ করবে। জেদ দেখাবে না।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"খুব কথা জানো তুমি আলো। বয়সের তুলনায় বেশি ভারি ভারি কথা বলো। তা এতো আত্মবিশ্বাসী মেয়ে একটা সাপ দেখে কেনো ভ'য় পাবে? সাপটার দিকে তে'ড়ে যেতে। কারাতে করতে সাপটার সাথে!"
কথাটি বলেই সামিন উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। আলো কপাল কুঁচকে রাখে। হাসি থামিয়ে সামিন বলে," আমি ভাবতাম পৃথিবীতে তুমি আমাকে বেশী ঘৃণা করো। এখন দেখছি ঐ সাপটা বেশি দুর্ভাগা।"
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,"সাপটাকে ভয় পাই আমি। আর আপনাকে ঘৃণা করি। দু'টো আলাদা ইয়াসার মির্জা।"
আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ডিভানের দিকে চলে যায় সামিন। কথাবার্তা যেদিক থেকেই শুরু হোক না কেন শেষ হয় সামিনের প্রতি আলোর ঘৃণার ঘোষণার মাধ্যমে। রোজ রোজ দর্শক বিহীন এই স্টেজে একই সংলাপ শুনতে শুনতে সামিনের কানে পোকা ধরে গেছে। শুধু একটাই কথা,"ঘৃণা করি ইয়াসার মির্জা! পি'শা'চ ইয়াসার মির্জা, ফে'রা'উ'ন ইয়াসার মির্জা। বিরক্তিকর মেয়ে একটা।"
ডিভানে গা এলিয়ে দিতে দিতে সামিন নিজের চিন্তাভাবনা দেখে নিজে বেশ অবাক হয়। মনে মনে বলে ওঠে,"জোরপূর্বক বিয়ে করে তুমি কি আশা করো সামিন! তোমার বৌ তোমাকে মাথায় উঠিয়ে নাচবে? তোমার কাছে এসে বলবে "প্রাননাথ" ? ঘুমের মধ্যে ঐ মেয়েটা তোমাকে বালিশ চা'পা দিয়ে মে'রে ফেলেনা,সেটাই তোমার সৌভাগ্য ইয়াসার মির্জা!"
আলো দাঁড়িয়ে আছে। সামিন এসির পাওয়ার কমিয়ে দিয়ে নিজের গায়ে একটা চাদর টেনে নিয়ে ওদিক ফিরে শুয়ে বলে ওঠে,"ঘুমোও। ঐ বেচারা সাপটা তোমার কাছে ইহজনমে আর আসবে না। মারাত্মক ভয় পেয়েছে আজ সে।"
***
ইংরেজিতে স্পষ্ট করে এ্যালেক্স বলে ওঠে,"কেনো এমন করছো ইশমাম। তোমার ভাইকে বলো সত্যিটা!"
ইশমাম স্ক্রিনে এ্যালেক্সের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলে,"সম্ভব না এ্যালেক্স। একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়ে যাবে।"
এ্যালেক্স ইশমামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশমাম বলে ওঠে,"লাভ কি কিছু হবে এ্যালেক্স? সবটা কি আগের মতো হবে? মাঝখান থেকে আজীবনের জন্য ভাইয়া আর আমার মধ্যে অদৃশ্য একটা দেয়াল তৈরি হবে। এসব করে আমি কি অদ্রিতাকে ফিরে পাবো? এতকিছুর পরে অদ্রিতা মানবে আমাকে? আর ভাইয়া! আমি চাই না ঐ লোকটা সব জেনে আত্মগ্লানিতে ভুগুক। চাই না তার মনে ঝ'ড় তুলতে। ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্কটাকে অস্বাভাবিক করতে চাই না।"
_তোমার অনূভুতি ঠিক আগের মতোই আছে ইশমাম। আমার খুব দুঃখ হচ্ছে তোমার জন্য।
_এমন কথা বলো না এ্যালেক্স। সে এখন আমার ভাবী। কোনো অনূভুতি নেই আমার। এসব ভাবাও অন্যায়। কোনো অনূভুতি নেই।
এ্যালেক্স চুপ করে থাকে। ইশমাম প্রসঙ্গ পালটে বলে,"তোমার কথা বলো এ্যালেক্স। সোফি কি রাজি হয়েছে?"
_আর বলো না । রাজি ঠিকই। কিন্তু দেখাচ্ছে সে রাজি না। এই মেয়ে মানুষ এতো অদ্ভুত কেনো ইশমাম!
ইশমাম এ্যালেক্সের কথায় হেসে বলে,"তুমি ঠিকই বলেছ এ্যালেক্স। পৃথিবীতে সবথেকে অদ্ভুত এই মেয়ে মানুষ!"
***
আজ ইহানের ইচ্ছে হয়েছে বাগানে বসে পড়াশোনা করার। তার ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে বাগানে একটা টেবিল এবং দুটো চেয়ার পেতে দেওয়া হয়েছে। শান্ত খুবই মনযোগ সহকারে ইহানের হোমওয়ার্ক দেখছে। দোতলার বেলকোনি থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে ইশিতা। ইশিতার কাছে লোকটাকে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ভদ্র মনে হয়। লোকটা নিজেকে যতটা সভ্য,স্পষ্টবাদী, শিক্ষিত জাহির করে আদৌ কি সে ততটা? কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইশিতা নিচে রান্নাঘরে চলে যায়। একটা প্লেটে কিছু খাবার সাজিয়ে সোজা বাগানে যায়। শান্ত ইহানকে রংধনু সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে। পেছন থেকে নরম গলায় ইশিতা বলে ওঠে,"আসবো!"
শান্ত মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। সে কিছুটা অবাক হয় ইশিতাকে দেখে। ইশিতা বলে,"আপনার জন্য ভাবী পাঠিয়েছে। খেয়ে নিন।"
শান্ত ইশিতার হাতের প্লেটের দিকে একবার তাকিয়ে ইহানের হোমওয়ার্ক খাতা দেখতে দেখতে বলে,"আমি এতটাও গরীব নই। তিন বেলা ভাত খেতে পারছি। এভাবে এতকিছু দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ভাবীকে বলে দিবেন। এতে আমার অভ্যাস নষ্ট হবে।"
ইশিতা শান্তর দিকে একপলক তাকিয়ে প্লেট টা শান্তর সামনে রেখে বলে,"গিটার কার?"
শান্ত টেবিলের পাশে রাখা গিটারের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমার কাছে যেহেতু। তার মানে আমার।"
_আপনি গান জানেন?
_মোটামুটি।
ইশিতা বেশ অবাক হয়। এই লোকটার সাদাসিধে ভাব দেখলে মনেই হয়না এ লেখাপড়া ছাড়া অন্য কিছু জানে। শান্ত ইহানকে লিখতে দিয়ে ইশিতার দিকে না তাকিয়ে বলে,"আপনি নাস্তা নিয়ে এলেন যে। এটা তো আপনার কাজ না।"
_দেখতে এসেছি। আপনি ইহানকে ঠিকঠাক মতো পড়াচ্ছেন কি না। মাস শেষে এতো গুলো টাকা মাইনে দেওয়া হয় আপনাকে। সেগুলো সব জলে যাচ্ছে কি না সেটাই দেখতে এসেছি।
***
ঘুরেফিরে আলো ইমতিয়াজ মির্জার সামনে পরে গেলো। একপলক তার দিকে তাকিয়ে আলো চোখ নামিয়ে নেয়। ইমতিয়াজ মির্জা ভ্রু কুঁচকে আলোকে কয়েক পলক দেখে সিঁড়ির দিকে যায়। হুবহু এই লোকটার চেহারা পেয়েছে এর তিন গুণধর ছেলে। সবগুলো একেবারে বাবার কপি। চারদিকে একই চেহারার কতগুলো পুরুষ মানুষ। যেদিকে তাকাও ইয়াসার মির্জা। রাবনের দশ মাথার মতো, কোনটা রেখে আলো কোনটা ব'ধ করবে ! আলোর জীবন টা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এদের দেখতে দেখতে।
দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে বারান্দার দিকে যায় আলো , ইয়াসার কিছু কাগজ উল্টে পাল্টে দেখছিলো। আলোকে দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"মেঝে তো কোনো দোষ করে নি। শুধু শুধু ওকে কেনো শাস্তি দিচ্ছো। ধীরে হাটো।"
আলো দাঁড়িয়ে পরে,ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে বলে,"কেনো? মেয়ে বলে? মেয়ে বলে ধীরে হাঁটতে হবে?"
_হ্যা। ওটাই নারীর সৌন্দর্য।
_হাটবো না ধীরে। আমি এমন করেই হাটবো। লাফিয়ে লাফিয়ে। আর এতোই যখন নারীর সৌন্দর্য, নারীর সৌন্দর্য করেন,তাহলে ওরকম একটা দেখে বিয়ে করে নেন। আমাকে মুক্তি দিন। আমি তো যেচে আপনার ঘাড়ে উঠিনি। আমার কাছ থেকে নারীর সৌন্দর্য আশা করতে লজ্জা করে না? আমাকে মুক্তি দিয়ে আপনাদের বাড়ীর মেজো বৌ রিতুর মতো একটা নমুনা বিয়ে করে আনুন। যে আনন্দের সাথে আপনার পায়ের তলায় পি'ষ্ট হতে চাইবে।
সামিন উঠে দাঁড়ায়। আলোর চোখে চোখ রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"রিতু পায়ের তলায় পি'ষ্ট হচ্ছে?"
আলো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। কন্ঠে বিদ্রুপ নিয়ে বলে,"না, আপনার চরিত্রহীন ভাই তাকে মাথায় তুলে রেখেছে। শুধুমাত্র সন্তান জন্ম দিয়েছে বলে দয়া করে থাকতে দিয়েছে এই বাড়িতে।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে," আপনি তো আপনি। এসব আপনার চোখে পরবে না। নিজেই যেখানে একটা আস্ত ক্রি'মি'না'ল।"
_বেশি বলে ফেলছো না আলো? কোনো প্রমাণ আছে এসবের? বলো!
_যার সাথে ঘটেছে তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। রিতুকে জিজ্ঞেস করুন। তার স্বামীর পরকীয়ার সম্পর্ক আছে।
_আমি মানছি ইলহাম কিছু অন্যায় করেছিলো অতীতে। কিন্তু ওসব এখন অতীত। ও মন দিয়ে সংসার করছে।
_আপনাকে যারা ভোট দিয়েছে তাদের জন্য খুব আফসোস হচ্ছে আমার।
কথাটি বলে আলো চলে যেতে নিলে সামিন পথ আগলে দাড়ায়। আলো ধমকের সুরে বলে,"কী?"
_ইলহামের ব্যাপারে যেটা বললে এইমাত্র সেটা যদি মিথ্যা হয়?
_মিথ্যা কেনো হবে। আমি নিজের কানে স্পষ্ট শুনেছি।
_আচ্ছা। আমি রিতুকে জিজ্ঞেস করবো। যদি মিথ্যা হয় তাহলে কি করবে তুমি?
_তাহলে আর কি,শাস্তি তো আমি পাচ্ছিই নতুন করে আর কি দেবেন? আর যদি সত্যি হয় তাহলে আমি যা বলবো সেটা শুনবেন? বলুন!
সামিন কয়েক মুহূর্ত আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"শুনবো।"
এমন সময় হঠাৎ সামিনের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। ফোনটা হাতে নিয়ে কানে ধরে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে,"আসছি আমি।"
***
"কোথায়। তোমার সেই শুভাকাঙ্ক্ষী সব কোথায়? কেউ জিজ্ঞেস করেছে তুমি কেমন আছো? সেদিনের পর থেকে খোজ নিতে এসেছে কেউ?"
আতাউর আলম বিছানায় শুয়ে শূন্যে দৃষ্টি রেখে আছে। রেহেনা চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"নির্বাচন করো, নির্বাচন করো বলে খুব উস্কেছিলো তখন। এখন কোথায় তারা?"
আতাউর আলম শোয়া থেকে উঠে বসে।
"তুমি একটা কা'পু'রু'ষ আতাউর আলম।"
স্ত্রীর এহেন কথায় আতাউর আলম আহত হয় কিন্তু প্রতিবাদে কোনো শব্দ বের হয় না তার ভেতর থেকে। ঠিকই তো। সে কা'পু'রু'ষ।
"এখন ? এখন তুই কি জবাব দিবি সামিন ইয়াসার? আমি জানতাম। জানতাম আমি এর মধ্যে একটা ঘা'প'লা অবশ্যই আছে। খালি চোখে যেটা মনে হয় সেটা সবসময় সত্যি নয় সামিন । এখন তুই জবাব দে।"
সামিন ফুয়াদের কথার উত্তর না দিয়ে জামিলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে,
"তুই কিভাবে বলছিস ওরা আতাউর আলমের লোক নয়?"
_আমি ওদের চিনি ভাই। ওদের প্রত্যেকটাকে আমি চিনি। ওদের আমি আগেও দেখেছি। ওদের কন্ঠস্বর আমার খুব চেনা। ওদের মধ্যে একজনের হাতে অদ্ভুত দেখতে কিছু আংটি ছিলো। আপনার মনে আছে শিমুল তলার সমাবেশে ঝামেলার কথা? ওরা ছিলো সেখানে। ওরা আর যাই হোক আতাউরের লোক না ভাই। ওরা ভুঁইয়ার লোক।
_হেনা বলেছে আমাকে, ওরা নিজের মুখে বলেছে আতাউর আলমকে বিজয়ী দেখতে চায়........
জামিল ক্ষীণ কন্ঠে বলে ওঠে,"আরে ধূর ভাই। আপনি আবার কবে থেকে মেয়ে মানুষের কথায় এতো গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন। ও কিছু জানে নাকি আগাগোড়া? ওকে যেটা বলা হয়েছে বিশ্বাস করে নিয়েছে।"
রাহাত দাঁত খিচিয়ে জামিলের বেডের দিকে এগিয়ে যায়,"তুমি উঠলে কেন? যেভাবে পরেছিলে পরে থাকতে! কতবার ভাই বলেছিলো সাবধান হতে , সাবধান হওনি। আজ যদি না নিজে বিপদে পরতে। তাহলে ভাই এতো বড় একটা অঘটন ঘটাতো না।"
জামিল কিছু বুঝতে পারছে না রাহাতের কথা। ফুয়াদ রাহাতকে ধমক দিয়ে বলে,"কথায় কথায় ভাইয়ের কোল টেনে কথা বলা বন্ধ কর। পুরোটা তোর ভাইয়ের বোকামি সেটা বল। আমি বারবার বলেছি রাগের মাথায় কোনো অঘটন ঘটাস না। দেশে আইন আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।"
জামিল সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"কি হয়েছে? কেউ খুলে বলো। ভাই কি করেছে?"
_তোর ভাই, রাগের মাথায়, নির্বাচনে জেতার জন্য আতাউরের মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে করেছে। আমিও ছিলাম সাথে। আমিও সাথ দিয়েছি।
হতভম্ব মুখটা নিয়ে জামিল সামিনের দিকে তাকায়। সামিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ফুয়াদ চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"কেমন লাগছে সামিন ইয়াসার? একটা নিরপরাধ ব্যক্তিকে ভুগিয়েছিস তুই।"
ফুয়াদের দিকে সামিন এক পলক তাকিয়ে হনহন করে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। ফুয়াদ পিছু পিছু ছুটে যায়।
হসপিটালের গেইটের কাছে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাত মুঠি করে সজোরে একটা ঘুষি মেরে দেয় সামিন। ফুয়াদ এসে হাত ধরে ফেলে সামিনের। চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"এখন এসব বন্ধ কর। যা হবার হয়ে গেছে। সামনে কি করবি সেটা ভাব। শাস্তি শাস্তি খেলা হয়ে গিয়েছে? শান্তি পেয়েছিস? এখন গিয়ে ক্ষমা চা ওদের কাছে। তালাক চাইলে তালাক দিয়ে দিবি। আমি তোকে চিনি সামিন। তুই স্বস্তি পাবি না! আত্মগ্লানিতে ধুকে ধুকে মরবি।"
সামিন ফুয়াদের দিকে তাকায়। ফুয়াদের বলা কথাটা তার কানে বাজছে,"তালাক দিয়ে দে।"
ফুয়াদ বলে,"এখন ভুঁইয়াদের কি করবি বল! সাগরের একটা বোন আছে,ওকে তুলে আনি? ওকে বিয়ে করবি?"
রাগ দেখিয়ে ফুয়াদ বলতে থাকে।
সামিন কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট করে। ফুয়াদ পাশের সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলে,"কথা বলছিস না কেন? জবাব দে!"
_তালাক দেবো না আমি। আর ভুঁইয়া দের উপযুক্ত শাস্তি ওরা পাবে।
সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে ঠান্ডা গলায় বলে সামিন। ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বলতে থাকে,"বিয়ে করা বৌকে বিনা কারণে কেনো তালাক দেবো।"
_মানে? তুই ওর সাথে সংসার করবি?
_হু। সেজন্যই তো বিয়ে করেছি। বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করিস কেন তোরা?
কিছুক্ষণ চুপ থাকে সামিন। তারপর হুট করে বলে ওঠে,"একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছি রে ফুয়াদ।"
_আবার কি?
চেঁচিয়ে ওঠে ফুয়াদ।
_আমি সম্ভবত আমার বৌয়ের প্রেমে পরে গিয়েছি।
ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকায়। সামিনের মুখ হাসি হাসি। সে বলতে থাকে,"কাল রাতে টের পেয়েছি। এখন আর তালাক দেওয়া সম্ভব না।"
_তাহলে মাফ চা ওর কাছে,ওর পরিবারের কাছে। ভুলটা স্বীকার করে নে নিজের।
সামিন সে কথার উত্তর না দিয়ে বলে,"খুবই আলাদা ও। কি অদ্ভুত দেখ, সামিন যে ধরনের মেয়েদের পছন্দ করতো না ও সে ধরনের মেয়ে। তবুও কি থেকে কি হয়ে গেলো!"
_শরীরের ওপর জোর চলে সামিন, মনের ওপর চলে না। ভুলে যাস না।
_আমি তো জোর করে বিয়েটাই করেছি শুধু, অন্য কোনো জোর তো দেখাইনি।
_উফফ। তুই আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বি সামিন।
সামিন বাঁকা হাসি হাসে। ফুয়াদ বলে,"ও আলো সামিন। এ জন্মে ও তোর নিয়ন্ত্রণে আসবে না। রমনীর মন, সহস্র বছর সাধনা করতে হয় পেতে হলে। আর তোর ধৈর্য নেই। তুই সামিন ইয়াসার মির্জা।"
_দেখা যাক.....
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় ইয়াসার।
***
ইশমামকে দেখে আলো কপাল কুঁচকে ফেলে। ইশমাম নিচু স্বরে বলে,"সরি। আমি ভাইয়ার কাছে এসেছিলাম। জানতাম না ভাইয়া ঘরে নেই।"
_তোমার ভাইয়ের ঘরে তোমার ভাইয়ের স্ত্রী থাকে ইশমাম। এভাবে আর কখনো নক না করে ঢুকবে না।
ইশমাম কয়েক পলক আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"আচ্ছা।"
আলো মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ইশমাম চলে যেতে নিলে আলো হঠাৎ বলে ওঠে,"একটা মানুষকে তুমি ভালোবাসতে, তার প্রতি প্রচন্ড রকমের অনূভুতি জন্মানোর পরে হঠাৎ দেখলে পৃথিবীতে সেই মানুষটার কোনো অস্তিত্বই নেই। একজন ভান ধরে থাকা ছদ্মবেশীর সাথে তোমার পরিচয় হয়েছিলো। তখন এর চেয়ে বেশি ঘৃণা করতে তুমি তাকে,যতটা আমি তোমাকে করি।"
মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইশমাম। আলো বলতে থাকে," নিজের জীবন টা গুছিয়ে নাও তুমি। এক সময়ের অধিকার বোধ থেকে বলছি, তোমার পরিবারের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ো না। দয়া করে হয়ো না।"
আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে ইশমাম বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। আলো দরজার দিকে দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
***
আজান কয়েক মুহূর্ত সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রচন্ড জোরে তার বাবাকে ডাকতে থাকে। আতাউর আলমের শরীরটা ভালো নেই। রেহেনা এসে দরজার কাছে দাড়ায়। সামিন আজানের দিকে তাকিয়ে বলে,"দুলাভাইকে ভেতরে আসতে দেবে না শা'লা?"
আজান দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। সামিন ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,"তুমি কোনটা? আজান না আয়াত"
_আজান।
_আয়াত কোথায়?
_ফার্মেসীতে গিয়েছে।
সামিন সোফায় বসে পরে। ভেতরের ঘর থেকে আতাউর আলম বলে ওঠে,"কে এসেছে রেহেনা? কে?"
_আপনার জামাই। ইয়াসার মির্জা।
আতাউর আলম সামিনের কন্ঠ পেয়ে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামে। অসুস্থ শরীর নিয়ে বসার ঘরে এসে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। আতাউর আলম সামিনের এমন অদ্ভুত আচরণে বেশ অবাক হয়। তার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,"তুমি কেনো এসেছো!"
সামিন মৃদু হাসে। তারপর জবাব দেয়,"আপনাদের দাওয়াত জানাতে। আমার বাবা ইন্ডিয়া থেকে ফিরেছে। আমার আর আপনার মেয়ের বিয়ের রিসিপশনের আয়োজন করেছি, আগামী পরশু। কার্ড ছাপানো হচ্ছে। সময় মতো পৌঁছে যাবেন। পুরো শহরের সাথে আমার শশুর শাশুড়ির পরিচয় করিয়ে দেবো আমি।"
***
সিতারা দরজা খুলে দিতেই অলস ভঙ্গিতে সামিন ঘরের ভেতরে ঢোকে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত বারোটা প্রায়। সিতারা নিচু স্বরে বলে,"টেবিলে খাবার দেবো ভাইজান?"
_না।
একশব্দে বলে সিঁড়ির কাছে গিয়ে ফিরে সিতারার দিকে তাকায় সামিন,"তোর বড় ভাবী খেয়েছে?"
সিতারা মাথা নাড়িয়ে বলে,"জ্বি।"
সামিন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। খুবই সন্তর্পনে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বিছানার দিকে তাকায় সে। আলো ঘুমিয়ে আছে। দরজা বন্ধ করে বিছানার কাছটাতে এসে বসে পরে। কিছুক্ষণ আলোর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলোকে দেখে এখন ঠিক একটা গোলাপের মতো লাগছে। যে গোলাপে কাঁ'টা আছে। ছুঁয়ে দিলেই হাতে ফুটে যাবে যার কাঁ'টা।
দীর্ঘসময় পরে মনে মনে বলতে থাকে,"তুমি ঠিক বলেছিলে আলো। আমি কা'পু'রু'ষ। ভুল স্বীকার করার সাহস নেই আমার।"
বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়। একটা মশা এসে বসে আলোর গালে। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে সামিন একটা আঙ্গুল ছুঁইয়ে দেয় আলোর গালে। হুট করে ঘুম ভেঙে যেতেই আলো লাফিয়ে উঠে বসে। সামিন কিছুটা চ'ম'কা'য়। আলো হতভম্ব ভাব কাটিয়ে তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,"আপনি আমার গালে হাত দিচ্ছিলেন কেনো?"
সামিন থতমত খেয়ে বলে,"মশা পরেছিল।"
_হাতি পরে থাকুক। আপনার কি?
চেঁচিয়ে ওঠে আলো। সামিন উঠে দাঁড়ায়। আলো বলতে থাকে,"দেখছেন ঘুমিয়ে আছি আর অমনি সুযোগ নিতে চলে এসেছেন তাই না?"
সামিন কিছু বলে না। সে জানে, রোজকার তর্কাতর্কি শুরু হতে যাচ্ছে,যার শেষ হবে "আমি আপনাকে ঘৃণা করি ইয়াসার মির্জা" কথাটির মাধ্যমে। তাই কথা না বাড়ানোই ভালো।
আলো বিছানা থেকে নামে। সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"জামিল কথা বলেছে? কি বলেছে সে?"
_ওর সাথে আমার কথা হয়নি।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন। আলো বলে ওঠে,"কেনো কথা হয়নি? কেনো কথা বলছেন না? সত্যিটা জানলে মুখে চুন'কালি মাখা হয়ে যাবে সেই ভয়ে?
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"ঘুমাও আলো।"
_কেন? আমাকে ঘুম পাড়ানোর এতো তাড়া কিসের? আমি ঘুমিয়ে গেলে সুযোগ নিতে আসবেন সেজন্য?
সামিন প্রচন্ড বিরক্ত হয় আলোর এমন আচরণে। সে তার বিরক্তি প্রকাশ না করে ঠাট্টার ছলে বলে,"নিজেকে কি ভাবো তুমি? অনেক সুন্দরী? নিজের গায়ের রং দেখেছো? ঐ সামান্য উজ্জ্বলতা টুকু সৃষ্টি কর্তা তোমায় দয়া করে দিয়েছে। ভেবো না আমি সুযোগ নেওয়ার জন্য বসে আছি।"
আলো হা হয়ে তাকিয়ে আছে। কথাটি বলে সামিন মুখ টিপে হাসে।
আলো সামিনকে অবাক করে দিয়ে বলে ওঠে,"নিজে একটু ফরসা বলে নিজেকে কি ভাবেন আপনি? অন্যের গাঁয়ের রং নিয়ে কথা শোনাচ্ছেন। আর আপনি অনেক সুন্দর? নিজের চেহারা কখনো আয়নায় দেখেছেন ? একটা সাদা মুলার মতো লাগে আপনাকে!"
"ওরা নারী জাত, পুরুষকে ঘা'য়ে'ল করতে কারাতে, মা'র'পি'ট জানতে হয় না, মুখটা একটু "মাসুম মাসুম" করে রাখলেই পুরুষ ঘা'য়ে'ল হয়ে যায়। ভাইয়ের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে।"
রনির এমন কথায় সবাই তার দিকে তাকায়। সামিন ইয়াসারের পার্টি অফিসে আজ সবাই জমায়েত হয়েছে। মাস শেষে একটা দিন তারা দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করে। আজ সেই দিন। সামিন রাহাতের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছে। এ পাশে বসে বাকিরা সবাই সামিনের সমাচার পাঠ করছে ।
আরাফ কপাল কুঁচকে বলে,"ভাই ঐ মেয়েটার মুখের ভাষা এতো জ'ঘ'ন্য। গালাগাল ছাড়া কথাই বলতে পারে না। ইয়াসার ভাই কিভাবে ওর প্রেমে পরলো বলতো!"
রনি আরাফকে থামিয়ে দিয়ে বলে,"ঐ মেয়েটা না। ভাবী বল। ভাই শুনলে কাঁচা খে/য়ে ফেলবে।"
সবুজ বলে ওঠে,"যাই বল। ভাই যে আলো ভাবীর প্রেমে পরবে তা জানতাম কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ঐ সিংহ একটা মেয়ের কাছে কাবু হয়ে গিয়েছে এটা মানতে পারছি না।"
_তোর চোখের সামনে সারাদিন চুড়ি পরে, লাল শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে একটা মেয়ে ঘুরঘুর করবে। তোর পুরুষ মনে সু'ড়'সু'ড়ি লাগবে না? তোর প্রেম প্রেম পাবে না?
রনির এই কথাটায় আরাফ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে,"হু। তাও ঠিক। ওরা নারী। ওরা সব পারে। কিছু না করেও। ওই যে নারী দিবসের একটা স্লোগান আছে না? আমরা নারী। আমরা সব পারি। কথাটা এজন্যই বলেছে।
তৌফ হাসতে হাসতে বলে ওঠে,"হু ভাই। আমরা নারী। আমরা পাথরেরও মন গলাতে পারি।"
"তোরা আমার কথা না শুনে নিজেরা কি আলোচনা করছিস?"
সবাই সামিনের দিকে তাকায়। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলতে থাকে,"দলের কাজে মন না বসলে বলবি। একেবারে বের করে দেবো ঘা'ড় ধরে।"
_তেমন কিছু না ভাই।
_সব বুঝিয়ে দিয়েছি। আমার এখন উঠতে হবে। আজ কয়েক যায়গায় বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি আছে। সেখানে যেতে হবে। কাল সবাই আসবি পরিবার নিয়ে। মনে থাকে যেন।
দলের সবাই মাথা নাড়ায়। সামিন উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বসে পরে। তার দৃষ্টি টেবিলের উপর রাখা একটি ছোটো আয়নার ভিতরে তার নিজের প্রতিবিম্বে নিবদ্ধ। কয়েক পলক সেদিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলে,"আচ্ছা বলতো। আমি দেখতে কেমন!"
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে সামিনের কথায়। রাহাত বলে,"সুন্দর। আপনি অনেক সুন্দর। কেনো ভাই?"
সামিন বলতে থাকে,"আমি ফর্সা। সেজন্য কি আমাকে সাদা মুলার মতো লাগে?"
তৌফ দাঁত বের করে বলে,"কি যে কন ভাই। আপনি কত সুন্দর। আপনি পুরো ঋত্মিক রওশানের মতো দেখতে। শুধু আপনার চোখের মনি ঘন কালো আর ঋত্মিকের চোখ বিলাইয়ের মতো। আপনিই বেশি সুন্দর ভাই।"
সামিনের কাছে তৌফের কথাটা মন মতো হয় না। এরা তার ছেলে,এরা তো তার প্রশংসা করবেই। একটা মেয়ে বোঝে কোন পুরুষ সুন্দর। আলো একটা মেয়ে। সে যখন বলেছে তাহলে হয়তবা সত্যিই সামিন কে সাদা মুলার মতোই লাগে।
***
বাড়িতে কেটারিং-এর লোকজন এসেছে। সাজাচ্ছে বাড়িটাকে। আলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সব। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার ঘরে বিছানার উপরে কিছু শাড়ি রেখে গিয়েছে কেউ। শাড়ি গুলো অনেক দামী,দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এসব কি হচ্ছে আসলে, আবার কি নতুন তামাশা করতে চাচ্ছে ইয়াসার মির্জা!
"ভাইয়া তুমি জামিলকে কেনো এপয়েন করেছো সিমেন্টের বিজনেসে? ও এসবের কি বোঝে? ও তো তোমার দলের।"
ইলহাম সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন কেটারিং-এর এক লোকের সাথে কথা বলছিলো। ইলহামের প্রশ্নে ঘুরে তাকায়। তারপর বলে,"ওকে দলে রাখছি না। ওকে ব্যাবসায় ঢুকিয়ে দেবো আমাদের।"
_ভাইয়া তুমি জামিলের জন্য একটু বেশি বেশি করছো না? ওকে কেনো পারিবারিক ব্যাবসা ধরিয়ে দেবে!
_ওকে কাজ দিচ্ছি শুধু ইলহাম। তোর ভাগের সম্পত্তি দিয়ে দিচ্ছি না। আর হ্যা,ওর জন্য আমার আলাদা দুর্বলতা আছে। বাপ মা ম'রা এতিম ছেলেটা অন্যের লাত্থি উষ্ঠা খেয়ে আমার কাছে,এই পরিবারের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলো। বরাবর বিশ্বস্ততা দেখিয়েছে। আমি ওকে স্নেহ করি। তোদের যেমন করি।
ইলহামের কাছে সামিনের কথাটা পছন্দ হয় না। একটা বাইরের ছেলেকে তাদের মতো স্নেহ করবে,এটা ইলহাম মানতে পারবে না।
রিতু কফির মগ এনে সামিনের হাতে দেয়। সামিন ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"আজকাল তুই কোথায় কোথায় যাচ্ছিস আমাকে ইনফর্ম করছিস না। কিছু উড়ো খবর আসছে আমার কাছে। ব্যাপার কি!"
ইলহাম কপাল কুঁচকে রিতুর দিকে তাকিয়ে সামিনকে বলে,"কে দিচ্ছে এসব খবর তোমাকে?"
_কেউ না। যা করবি একটু বুঝে শুনে করবি ইলহাম। ইহানের ফিউচারে প্রভাব ফেলে এমন কিছু আমি বরদাস্ত করবো না।
_ভাইয়া তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?
_না,তোকে বোঝাচ্ছি। তোর বড় ভাই আমি। বোঝাতে পারিনা?
কথাটা বলে সামিন কফির মগে চুমুক দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। ইলহাম রিতুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে যায় সেখান থেকে।
"ওগুলো তোমার। দেখো কোনটা পছন্দ হয়।"
আলোকে বিছানায় রাখা শাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পেছন থেকে সামিন বলে ওঠে। আলো ঘুরে দাঁড়ায়। সামিন বলতে থাকে,"কাল আমাদের রিসিপশন। তোমার বাবা মা আসবে।"
আলো তর্জনী আঙ্গুল তুলে শাড়ি গুলোর দিকে তাক করে বলে,"এসব পরে সং সাজতে হবে কেন আমাকে? চাচ্ছেন কি আপনি?"
সামিন মনে মনে বলে,"চাচ্ছি তোমাকেই।"
কিন্তু মুখে বলে," আপাতত চাচ্ছি এসব পরে লক্ষী বৌয়ের মতো বসে থাকবে চুপচাপ। সবাই এসে সামিনের বৌকে দেখে যাবে।"
_আপনার ভয় নেই? কাল যদি সবাইকে আমি সত্যিটা বলে দেই?
সামিন কফির মগে এক চুমুক দিয়ে বলে,"বলবে না। তুমি উন্মাদ আমি জানি। তবে এতটাও উন্মাদ নও যে নিজের ভালো বুঝবে না।"
***
হাতের কাগজটা ছিঁড়ে সাগর টুকরো টুকরো করে ছুঁড়ে মারে।
শমশের ভুঁইয়া আহাজারি করে বলে,"মোক্ষম চাল টা চেলেছে ইয়াসার। কোর্ট অর্ডার এসে গিয়েছে। তিন দিনের মধ্যে ঘাটের দখল ছেড়ে দিতে হবে। কতগুলো টাকা লস হয়ে গেলো সাগর।"
_মেয়রের ক্ষমতা দেখিয়েছে ও। ওকে আমিও আমার ক্ষমতা দেখাবো। ও আতাউরের মেয়েকে বিয়ে করেছে কেনো কিছু জানতে পারলেন? এটা কোনো স্বাভাবিক বিয়ে না জানি। আতাউর আলম কখনো ওর সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে না, না ঐ মেয়ের সাথে ইয়াসারের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। তাহলে বিয়েটা কিভাবে হলো! এর মাঝে কিন্তু আছে। কারনটা খুজে বের করেন।
ইয়াসার মির্জার সাথে আতাউর আলমের মেয়ে অদ্রিতা আলোর বিয়ে হয়েছে। খবরটা বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে গেলো সর্বত্র। আগামীকাল তাদের রিসিপশন। সবাই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করছে।
পাড়া প্রতিবেশীরা বিভিন্ন বাহানায় বাড়িতে এসে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খবর বের করার চেষ্টা করছে।
সকাল থেকেই আতাউর আলমের শরীরটা বেশ খারাপ। এমনিতেই মানসিক এবং শারীরিক ভাবে সে দিনকে দিন বেশ ভেঙে পরছে। তার উপর সকাল থেকে পাড়া প্রতিবেশীর উটকো ঝামেলা আর নেওয়া যাচ্ছে না। সবাইকে সত্যিটা সে বলে দিতেই পারে। কিন্তু মেয়েটা যে এখনো ইয়াসারের কাছে!
আরাম কেদারায় হাত পা এলিয়ে শুয়ে শুয়ে ছটফট করছে সে। বুকের ব্যাথাটা বারছে। তার সাথে হুট করে মাথা ব্যথা হচ্ছে খুব। ঘামছে সে। একটা অনিশ্চিত জীবন আদরের মেয়েটার সামনে। অথচ সে বাবা হয়ে কিছু করতে পারছে না। এক সময় নিজের জীবনের পরোয়া না করা আতাউর আলম এখন একটা দুদিনের ছেলের ইশারায় নাচছে। এর থেকে লাঞ্ছনার আর কি হতে পারে!
সন্ধ্যার দিকে শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে একটু হাঁটাহাঁটি করতে নেমেছিলো আতাউর আলম। পাড়ার বড় দোকানটার সামনে কিছু প্রতিবেশী আলো আর ইয়াসারের আলোচনায় মেতে আছে। আতাউর দূর থেকে কথাবার্তা শুনে এড়িয়ে যেতে চাইলো। সে ঘুরে দাড়াতেই পেছন থেকে কেউ তাকে ডাকে।
_আরে আলম ভাই। এদিকে আসুন। যাচ্ছেন কোথায়?
আতাউর আলম তাদের দিকে তাকায়। ব্যারিস্টার ফখরুল তাকে ডাকছে। ধীরপায়ে সে এগিয়ে যায় তাদের কাছে। সবাই তার দিকে খুবই উৎসুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। ফখরুল খুবই আন্তরিকতার সাথে আতাউর আলমকে বসিয়ে শুরুতেই যে প্রশ্নটি করে সেটি হলো,"প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো নাকি আলম ভাই? সেজন্যই কি আপনি নির্বাচন বর্জন করেছিলেন?"
আতাউর আলম সবার মুখের দিকে তাকায়। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। পাশ থেকে একজন বলে ওঠে,"শুরুতেই সন্দেহ হয়েছিলো। আপনার ভাবী তো বলাবলি করছিলো, এতদিন হয়ে গেলো মেয়েটার খোজ নেই। আচ্ছা আতাউর ভাই, আলো কি নির্বাচনের আগের দিন রাতে পালিয়েছিলো?"
***
"এই ছেলে। কি চাও তুমি।"
কড়া গলায় আলো ইহানকে বলে কথাটি । ইহান ভয় না পেয়ে উল্টো কপাল কুঁচকে বলে,"এটা আমার বড় বাবার ঘর। আমি বড় বাবার কাছে এসেছি।"
আলো মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। ইহান বলে,"তুমি খুব পঁচা।"
_হ্যা হ্যা,আমিই খারাপ। আর তোমার বাবা চাচারা এবং তুমি খুউউব ভালো।
ইহান ভেংচি কেটে বলে,"ইইইইইইই।"
আলোও হুট করে ইহানকে নকল করে বলে,"ইইইইইইই।"
সামিন ঘরে ঢুকে আলোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,"তুমি একটা বাচ্চার সাথে তর্ক করছো। এভাবে ভেংচি কাটছো! তুমি তো ভারি অদ্ভুত মেয়ে।"
আলো কপাল কুঁচকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন ইহানকে কোলে তুলে নিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,"তুমি না গুড বয়? বড়দের ভেংচি কাটতে নেই তোমাকে শেখাইনি?"
ইহান মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,"কেনো এসেছিলে?"
_খেলতে। টিচার চলে গিয়েছে।
_কিন্তু এখন তো খেলতে পারবো না। সকালে খেলি? তুমি এখন যাও বাবা। মাম্মা তোমাকে ডাকছে।
ইহান তার বড় বাবার কোল থেকে নেমে চলে যায়। সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে বিছানার উপরে রাখা শাড়িগুলো হাতে তুলে নেয়। সেগুলো আলমারিতে তুলে রেখে বলে,"একটা বাচ্চা তোমার কোনো ক্ষতি করেনি। তার সাথেও তুমি সমানে সমান তর্ক চালিয়ে যাচ্ছো। নির্ঘাত একটা পাগল মেয়ে তুমি অথবা বিয়ের পরদিন থেকে পাগল হয়ে গিয়েছো।"
কথাটি বলে কিছুক্ষণ ঠোঁট টিপে হেসে নেয় সামিন।
তারপর আলমারির দরজা চাপিয়ে ঠাট্টার ছলে বলে,"সারাদিন তো কোনো কাজই করো না। বিছানায় অলস বিড়াল ছানার মতো গুটিসুটি মেরে বসে থাকো। স্বামীর সেবা নাই বা করলে, নিজের জিনিসপত্র তো গুছিয়ে রাখতে পারো। এই শাড়ি গুলো তো তোমার।"
আলো সামিনের দিকে তে'ড়ে আসে,"এসব নাটক বন্ধ করুন ইয়াসার মির্জা। স্বামী স্বামী নাটক আমার সাথে দেখাবেন না।"
_দেখাবো। এখন থেকে তো আরো বেশি দেখাবো।
_বলে তো দিয়েছি। আপনার যা করার আপনি করে নিন। আমি আপনাকে মানবো না।
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,"জামিল মুখ খুলেছে।"
আলো উত্তেজিত হয়ে পরে। বলে,"কি বলেছে? আমার বাবা কিছু করেনি। এটাই তো তাই না? বলুন!"
_হু। সেটাই। তোমার বাবা কিছু করেনি।
আলোর মুখে হাসি ফুটে ওঠে, চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"দেখেছেন? দেখেছেন তো? এখন কি বলবেন। বলুন ইয়াসার মির্জা । বলুন। যেখানে আমার বাবা কিছু করেই নি সেখানে কিসের শাস্তি পাচ্ছি আমরা। এখন ছেড়ে দিন। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন। তালাক দিয়ে দিন আমায়।"
সামিন ম্লান হাসে। অস্ফুট স্বরে বলে,"বিয়ে করা বৌকে বিনা কারণে কেনো তালাক দেবো!"
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন ঠান্ডা গলায়,"এজন্মে তা হবে না আলো।"
_কেনো! এখনো কেনো! সবটা তো জানলেন। তবুও কেন!
_আমি তোমাকে ভালবাসি আলো।
স্পষ্ট এবং দৃঢ় ভাবে শব্দ গুলো উচ্চারণ করে সামিন। সে আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত যেতেই স্ব-শব্দে সামিনের গালে আলো এক চ'ড় বসিয়ে দেয়। সামিন মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
আলো দাঁতে দাঁত চেপে,সামিনের কলার ধরে চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"এই! এই ইয়াসার মির্জা! আবার কোন নাটক শুরু করেছেন আপনি? উদ্দেশ্য কি আপনার?"
নিজের কলার থেকে আলোর হাত দুটো ছাড়িয়ে দিতে দিতে নরম গলায় বলে,"উদ্দেশ্য তোমার সাথে সংসার করার।"
আলো চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। সামিন বলতে থাকে,"আমি স্পষ্ট কথা বলি। তাই স্পষ্ট ভাবে বলে দিলাম। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে, তোমার প্রতি আমার অনূভুতি জন্মেছে। যেটা দমিয়ে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না। বিয়েটা যেভাবেই করি না কেন, একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়তে চাই তোমার সাথে আমি। আর হ্যা, ভুল করেছি আমি। সামিন ইয়াসার ভুল করেছে। তার ভুল সে স্বীকার করে নিলো। তোমার বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চাইবো, তোমার ভাইদের কাছে ক্ষমা চাইবো। যা করতে বলবে করবো। কিন্তু তোমাকে তালাক দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।"
_জোর করেই পারবেন সব। কখনো আমি আপনাকে মানবো না। কখনো না।
নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে আলো। সামিন কিছুক্ষণ আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"আমাকে মা'রো, ঘৃ'ণা করো, জেদ দেখাও যা খুশি করো। সবকিছু আমার সীমানার মধ্যে থেকে করবে। আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা ভুলেও ভাববে না।"
ধপ করে বিছানার উপর বসে পরে আলো। কিছুক্ষণ পর ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,"এর থেকে আপনি আমাকে মে'রে ফেলছেন না কেনো? আমাকে ছেড়ে দিলে আমি আপনার নামে মামলা করবো বলে ভয় পাচ্ছেন? তবে আমাকে মে'রে দিন। সবকিছু ধামাচাপা পরে যাবে। তবু এই জ'ঘ'ন্য খেলাটা বন্ধ করুন!"
কাঁদতে থাকে আলো। সামিন কয়েক মুহূর্ত আলোকে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
অসময়ে সামিনের নাম্বার দেখে ফুয়াদ মুখে চ কারন্ত শব্দ করে, ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"তুই, তোর বৌ, তোর রাজনীতি, তোর প্রতিশোধ ছাড়াও আমার আরেকটা জীবন আছে সামিন। বাড়িতে এসেও একটু শান্তিতে থাকতে পারবো না আমি?"
_মানুষ নিজের পায়ে নিজে কু'ড়া'ল মা'রে। আমি ব্যতিক্রম তাই বিয়ে করেছি।
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন। ফুয়াদ বলে,"কি হয়েছে ঝেড়ে কাশ!"
_আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কি করবো এখন? ভালোবাসার কথা বললাম, কত নরম গলায় বললাম। চ'ড় মেরেছে, এখন কাঁদতে বসে গিয়েছে।
ফুয়াদ সামিনকে বিদ্রুপ করে বলে,
_তো? তুই আমাকে ফোন দিচ্ছিস কেনো? তুই তো ইয়াসার মির্জা। যার কাছে স্ত্রী কেবল বিছানার সৌন্দর্য। সে কেনো স্ত্রীর চ'ড় হজম করে নেবে। ওকেও চ'ড় মার। জোর জবরদস্তি কর। কত বড় সাহস ওর,তোকে ভালোবাসবে না! ইয়াসার মির্জাকে ভালোবাসবে না! ওর হাত পা বেঁধে মা'র। চ'ড় মেরে ওর মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা বের কর।
ফুয়াদ রাগে কাঁপতে থাকে কথাটি বলে। সামিন নিস্তেজ কন্ঠে বলে,"বাজে না বকে কিছু একটা সাজেশন দে ভাই। আমি পুরো এলোমেলো হয়ে আছি।"
_তুই ম'র।
ফুয়াদ ফোন কেটে দেয়। সামিন চুপচাপ নিচতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু সময় যেতেই তার কাছে রনির ফোন আসে । সামিন ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে।
ঘরের বাইরে থেকে ইশিতা উঁকি দেয়। আলো হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে। ইশিতা কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের ভেতরে ঢোকে। আলোর পাশে বসে আলোর মাথায় হাত রাখে। কান্না থামিয়ে আলো তাকায়। ইশিতা কোনো কথা বলে না। আলো চোখের পানি মোছে। তারপর ধরা গলায় বলে,"আপনার ভাইকে বলুন আমায় মে'রে ফেলতে। দোহাই আপনার।"
ইশিতা কিছু বলতে যাবে তখনি সামিন হন্তদন্ত হয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে। আলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে,"তুমি আমার সাথে চলো আলো। তোমার বাবা একটু অসুস্থ!"
***
ড্রাইভ করতে করতে সামিন আড়চোখে আলোকে দেখে। শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদছে আলো। বেশ মায়া হচ্ছে আলোর প্রতি সামিনের,সেই সাথে বুকে সুক্ষ্ম যন্ত্রনা হচ্ছে তার। আলোর এই কান্না তো তার কারনেই। কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে গাড়িটা হঠাৎ থামিয়ে দেয় সে। আলো কেঁদেই যাচ্ছে। সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে আলোর সিটবেল্ট বেঁধে দেয়। আলোর গায়ে সামিনের হাত লাগতেই এক ঝটকায় সেই হাত সরিয়ে দেয় আলো। সামিন নিচুস্বরে বলে,"সিটবেল্ট না বাঁধলে সমস্যা হতে পারে।"
আবারও গাড়ি চলতে শুরু করে এবং সোজা হসপিটালের সামনে এসে থামে। গাড়ি থেকে নেমে এসে দরজা খুলে আলোর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। আলো তাকে উপেক্ষা করে নেমে দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। সামিন ধীরপায়ে তার পিছু পিছু যায়।
করিডোরে মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মায়ের গায়ে হুমরি খেয়ে পরে আলো। আজান আয়াত এসে আলোকে ধরে। রেহেনা দীর্ঘদিন পরে মেয়েকে দেখেও তাকে বুকে টেনে নেয়না। মেয়ের মুখের দিকে থাকে শুধু। আলো কান্নাটাকে নিয়ন্ত্রণ করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"কিভাবে হলো আম্মু এসব!"
_কারন উপর ওয়ালার ইচ্ছা।
ধরা গলায় জবাব দেয় রেহেনা। খুবই ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত লাগছে তাকে। সামিন ধীরপায়ে হেটে করিডোরে এসে দাঁড়ায়,তার মুখটা খুবই শুকনো দেখাচ্ছে। রেহেনা সামিনের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে তার দিকে এগিয়ে যায়। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,"এসেছো তুমি। এখানে দাঁড়িয়ে কেনো? লোকটাকে দেখবে না? এসো আমার সাথে। এসো।"
সামিনের হাত ধরে রেহেনা টানতে টানতে আইসিইউর সামনে নিয়ে গিয়ে দাড় করায়। বলে,"দেখো। মন ভরে দেখো তুমি! শান্তি পাচ্ছো না? বলো বাবা!"
সামিন অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"আন্টি....."
সামিনকে কিছু বলতে না দিয়ে একটা চ'ড় মারে রেহেনা তাকে। গালে হাত দিয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সামিন। রেহেনা বলে ওঠে,"আর কিসে শান্তি হবে তোমার?"
ছুটে গিয়ে আজান আয়াতকে টেনে এনে সামিনের সামনে দাঁড় করায়, তারপর চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"ওদের মে'রে ফেললে হবে? নিয়ে যাও। পু'তে ফেলো ওদের।"
তারপর গিয়ে আলোকে টেনে এনে সামিনের দিকে ধাক্কা দিয়ে বলে,"ওকেও মে'রে দাও। তাহলে তো শান্তি অবশ্যই হবে।"
সামিন চোখ তুলে তাকায় না রেহেনার দিকে। রেহেনা চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"আমাকে মারো বাবা। অবশ্যই শান্তি পাবে তুমি।"
কথাটি বলে কান্নায় ভেঙে পরে রেহেনা। কিছুক্ষণ পরে মাথা ঘুরে পরে যেতে নিলে ইয়াসার এসে ধরে ফেলে। আজান আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে,"ওনাকে বসিয়ে দাও।"
আজান আয়াত তাদের মাকে ধরে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে দেয়। সামিন ঘুরে আলোর দিকে তাকায়। কান্না থামিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন তার দিকে এগিয়ে যায়। পাশে বসে আলোর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,"আলো...."
_আজ যদি আমার বাবার কিছু হয়, তাহলে জেনে রাখুন ইয়াসার মির্জা। আমার বাবার খুনী হিসেবে আমি আপনাকেই জানবো, আজীবন!"
ঘৃণা মিশ্রিত কন্ঠে কথাটি বলে ওঠে আলো।
ডাক্তার রাসেল কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। তারপর হাসিহাসি মুখ করে বলে ওঠে,"এই শহরের মেয়র সামিন ইয়াসার! আমাকে চিনতে পেরেছো?"
সামিন রাসেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়,"রাসেল। ফার্স্ট বেঞ্চার। রোল নাম্বার ৩!"
রাসেল হেসে ফেলে, অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সামিনের সাথে কোলাকুলি করে। সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"তুমি ব্যাক বেঞ্চার হলেও তোমার স্মৃতিশক্তি প্র'খ'র সামিন। এত বছর পরেও মনে রেখেছো আমাকে!"
সামিন মৃদু হাসে। রাসেল আলোর দিকে তাকিয়ে সামিনকে বলে,"ওয়াইফ?"
সামিন মাথা নাড়ায়।
_হু বুঝলাম। রোগী কে হয়? শশুর?
_হ্যা রাসেল।
রাসেল একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"আই সি!
সামিন বলে,"ওনার এখন কি অবস্থা?"
_দেখো সামিন। ওনার আগে থেকেই ডা'য়া'বে'টি'স এবং হার্টের অসুখ ছিলো। অতএব ঝুঁ'কি'টা একটু বেশিই। আর তাছাড়া ওনারা এখানে আনতে অনেকটাই দেরী করে ফেলেছে। এটা মাইল্ড স্ট্রো'ক না, মস্তিষ্কে র'ক্ত'ক্ষ'র'ণ হয়েছে। সা'র্জা'রি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
সামিন আলোর মুখের দিকে তাকায়। আলো বোকার মতো ডাক্তার রাসেলের দিকে তাকিয়ে আছে। এগিয়ে এসে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"তাহলে! করছেন না কেনো অ'পা'রে'শ'ন! করুন।"
_ভাবী সার্জারি তো মুখের কথা নয়। আর তাছাড়া....
_এ দেশে হবে না? বলো!
রাসেল সামিনের দিকে তাকায়,
_হবে! কিন্তু অনেক রি'স্কি। অন্যদিকে বেশি দেরী করাও যাবে না। আমাদের কিছু একটা করতে হবে। যদি তোমরা রাজি থাকো।
_আপনি অ'পা'রে'শ'ন করুন। প্লিজ।
আলো হা'ত'জো'ড় করে বলে ওঠে।
_আপনাদের সৌভাগ্য নাকি জানি না তবে আজকেই ডাক্তার আদনান রুহানি এসেছে। যদি ব'ন্ডে সই করে দেন তাহলে আমরা এগোতে পারি!
আলো কেঁ'পে ওঠে কথাটা শুনে। ভীত কন্ঠে বলে,"বন্ডে কেন সই করতে হবে!"
রাসেল নিচু স্বরে বলে,"বললাম না অনেক রি'স্কি! কিছু একটা হয়ে গেলে!"
রেহেনা আ'র্ত'না'দ করে ওঠে। আজান মাকে আগলে নেয়। আলো গলায় জমে থাকা কান্নাটা গিলে ফেলে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"ঠিকাছে। কোনো অসুবিধা নেই।"
_আর একটা বিষয়। অপারেশনটা খুবই ব্যয়বহুল .....
_তুমি এসব নিয়ে ভেবো না রাসেল.....আমি আছি!
সামিন কথাটি বলার সাথে সাথে আলো চেঁচিয়ে ওঠে,"নাহ!"
সামিন এবং রাসেল তার মুখের দিকে তাকায়। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"প্রয়োজন নেই। একেবারেই প্রয়োজন নেই ইয়াসার মির্জা!"
_শা'ট আ'প আলো। হাজার টাকার বিষয় না এটা।
আলো সামিনের দিকে এগিয়ে যায়,তেজী কন্ঠে বলে ,"আপনি ভাবলেন কি করে আমি আপনার টাকায় আমার আব্বুর অ'পা'রে'শ'ন করাবো!"
রাসেল একবার সামিন একবার আলোর দিকে তাকায়। সামিন আলোকে বলে,"কি করবে তুমি?"
_আমাদের যেটুকু আছে সেটাই যথেষ্ট। আপনার মতো ক্রি'মি'না'লে'র টাকায় আমার আব্বুর জীবন বাঁচলে অমন জীবনের দরকার নেই!
চোখের পানি মুছে রেহেনার দিকে তাকিয়ে বলে,"আমি আব্বুর সেভিংস থেকে টাকা তুলতে চাই আম্মু। নমিনি তো তুমি! কিন্তু মনে হচ্ছে বেশ দেরী হবে তাতে, তুমি আমার বিয়ের জন্য যে গয়না গুলো গ'ড়ে'ছি'লে ওগুলো বিক্রি করতে চাচ্ছি। আজ রাতের মধ্যে!"
সামিন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আলোর হাত ধরে টানতে টানতে ওয়েটিং রুমের পেছনের দিকটায় নিয়ে যায়। দেয়ালের সাথে ঠে'সে ধরে ধ'ম'কে'র সুরে বলে ওঠে,"বেশি বুঝবে না আলো। তুমি ঠিক নেই। আমাকে সামলাতে দাও সবটা।"
আলো সামিনকে ধাক্কা দিয়ে বলে,"কেনো? কে হন আপনি আমাদের?"
_কেউ না। একজন অ'প'রা'ধী আমি। একজন দোষী। ধরে নাও এই সবটা আমার ভুলের মা'শু'ল।
আলো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে,"ভুলের মা'শু'ল চাইনা আমি। আপনার অন্যায়ের শা'স্তি ছাড়া আমি কিছুই চাই না! দরকার নেই এসবের! যান এখান থেকে!"
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ইশমাম এসে দাড়িয়ে পরে সেখানে। তার পিছনে ইশিতা। ইশমাম আলো আর সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"ভাইয়া!"
সামিন ওদের দিকে তাকায়। ইশিতাকে দেখতে পেয়ে বলে,"ইশু এই অর্ধ উ'ন্মা'দ মেয়েটিকে ধরে রাখ। আমার কিছু কাজ আছে। আতাউর আলমের সা'র্জা'রি হবে।"
আলো চেঁচাতে থাকে,"সব যায়গায় নিজের ক্ষমতার জো'র, গায়ের জো'র,অর্থের জো'র দেখাবেন না ইয়াসার মির্জা।"
ইশমাম বলে ওঠে,"অদ্রি........"
তারপর কথাটা ফিরিয়ে নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,"ভাবী, আপনি শান্ত হোন! এখন মাথা ঠান্ডা রাখার সময়!"
আলো এক পলক ইশমামের দিকে তাকিয়ে ছুটে চলে যায় রেহেনার কাছে। সামিন কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ডাক্তার রাসেলের কাছে চলে যায়।
***
"ভাবী!"
ইশিতা হুট করে কি মনে করে আলোকে ভাবী ডেকে ফেলে। আলো রেহেনাকে আগলে ধরে বসে ছিলো। মাথা তুলে ইশিতার দিকে তাকায়। আজান আয়াত দূরের একটা বেঞ্চিতে মাথা নিচু করে বসে আছে।
ইশিতা আলোর পাশে বসে রেহেনার দিকে তাকিয়ে বলে,"আন্টির শরীরটা খুব খা'রা'প সম্ভবত। হসপিটালের পাশেই আমার এক ফ্রেন্ডের বাসা। তুমি চাইলে আমি আন্টিকে সেখানে নিয়ে যেতে পারি, আন্টি একটু রেস্ট নিতো। অপারেশন সকাল সাতটায়।"
_দরকার নেই।
নিচু স্বরে কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে রেহেনা। তারপর আজানের দিকে তাকিয়ে বলে,"তোর দাদীর খোজ নিয়েছিস?"
"হু। পপি খালা এসেছে বাসায়।"
রেহেনা দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইশিতা উঠে দাঁড়ায়। তখনি একজন নার্স এসে বলে,"এখানে আলো কে?"
_আমি।
নিস্তেজ কন্ঠে জবাব দেয় আলো।
_আপনি একটু আমার সাথে আসুন। ব'ন্ডে সই করতে হবে।
আলো একটা ধাক্কার মতো খায়। কিন্তু নিজেকে দ্রুতই সামলে নিয়ে সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। দুই কদম হেটে সামনে এগোতেই মাথা ঘুরে পরে যেতে নিলে ইশিতা ধরে ফেলে। ইশিতা নরম গলায় বলে,"আমি তোমাকে ধরে রাখছি ভাবী। তুমি চলো।"
ডাক্তার রাসেলের কেবিনে সামিন এবং ইশমাম। দুজনে দুটো চেয়ারে বসে আছে। আলো গিয়ে কেবিনের দরজার কাছে দাড়ায়। ইশমাম আলোকে দেখতে পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আলো গিয়ে চেয়ার টাতে বসে পরে। তার দৃষ্টি ডাক্তার রাসেলের দিকে। রাসেল আলোর দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে,"এটাতে সই করতে হবে ভাবী।"
কাঁপা কাঁপা হাতে আলো কাগজটা নেয়। কিছুক্ষণ কাগজটার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ তুলে একে একে সবার দিকে তাকায়। ইশিতা আলোর কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলে,"সব ঠিক হবে। কিছু হবে না তোমার বাবার!"
সামিন চুপ করে বসে আছে। আলো ধীরে ধীরে কাগজটায় সই করে ডাক্তার রাসেলের দিকে এগিয়ে দেয়। রাসেল বলে,"এখন তোমরা অপেক্ষা করো। আমরা ডাক্তাররা আগে একটা মিটিং করবো। তোমরা ধৈর্য্য ধরো। আল্লাহ্ কে ডাকো।"
আলো উঠে চলে যায়। সামিন ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"কিছু খাওয়া ওদেরকে।"
_কাজ হবে না ভাইয়া। সবাই ক'ঠি'ন পাথরের মূর্তি। যার কারিগর তুমি নিজেই।
সামিন বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশিতা উঠে আলোর পিছু পিছু চলে যায়।
***
"কোথায় যাচ্ছো!"
নরম গলায় বলে সামিন।
আলো আজানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে পরে। সামিন এসে আলোর সামনে দাঁড়ায়। আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,"রাত তিনটার সময় কোথায় যাচ্ছো তুমি?"
আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,"টাকা আনতে। আব্বুর অ'পা'রে'শ'নে'র।"
সামিন আলোকে শক্ত করে ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে রেগে গিয়ে বলে,"বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু আলো।"
আলো নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়না সামিনের থেকে। চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আলোর নীরবতা সামিনকে আরো রা'গি'য়ে দেয়। কিন্তু মুহুর্তেই নিজেকে শান্ত করে। আলোকে ছেড়ে দিয়ে নরম গলায় বলে,"ঠিকাছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি টাকা কোথায় পাবে? না ব্যাংক খোলা না স্বর্নের দোকান। কে দেবে তোমাকে টাকা? আর এই শহরে আমার জানামতে তোমাদের কোনো পরমাত্মীয় নেই যে এই মুহূর্তে তুমি চাইলেই তোমাকে এতগুলো টাকা দিয়ে দেবে।"
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বলে,"আমি টাকার ব্যাবস্থা করছি। তুমি বরং ধার হিসেবে নাও। পরে না হয় শো'ধ করে দিও। তোমার গয়না গুলো আমাকে দিও। তবু এতো রাতে অযথা পণ্ডশ্রম করো না আলো। তোমার মায়ের কাছে যাও।"
_আমি আপনার কাছ থেকে ধারও নেবো না।
সামিন এইবার প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে রে'গে গিয়ে দেয়ালে একটা ঘু'ষি মে'রে দেয়। ইশিতা এসে ভাইয়ের হাত ধরে। ইশমাম এসে দাঁড়ায়। ইশিতা আলোকে একপলক দেখে কিছু কঠিন কথা বলতে যাবে অমনি ইশমাম চোখ দিয়ে ইশারা করে তাকে কিছু বলে নিষেধ করে। নিজেকে সামলে নিয়ে ইশিতা আলোকে বলে,"ঠিকাছে ভাবী। ভাইয়ার থেকে নিতে হবে না। তুমি আমার থেকে ধার নাও। তোমার গয়না গুলো আমাকে দিও। প্লিজ!"
আলো ইশিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশিতা এসে আলোর গালে একটা হাত রেখে বলে,"আপু বলো তো তুমি আমায়। তাই না? তাহলে আমার এই কথাটা ফেলো না প্লিজ। প্লিজ ভাবী! প্লিজ আলো!"
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের গাল থেকে ইশিতার হাত টা ছাড়িয়ে দিয়ে ধীরপায়ে হেটে রেহেনার কাছে চলে যায়।
***
অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে সকাল ছয়টা বেজে গিয়েছে। আর একঘন্টা পরে অ'পা'রে'শ'ন। এর মাঝে কেউ কিছু মুখে দেয়নি। ডাক্তার আদনান রুহানি এবং রাসেল ছাড়াও আরো দুজন ডাক্তার অপারেশন রুমে ঢুকে প্রস্তুতি নিচ্ছে সবকিছুর।
রেহেনা বিধ্বস্ত মুখটা নিয়ে বসে আছে স্বামীর কেবিনের সামনে। আলো এসে মাকে একটু পানি খাইয়ে দেয়। আজান ভোর চারটার দিকে একবার বাড়িতে গিয়েছিলো। সে এইমাত্র এসে মায়ের পাশে বসে পরে। আয়াত বাইরে থেকে কিছু শুকনো খাবার কিনে এনে আলোর পাশে বসে।
সামিন ধীর পায়ে হেঁটে তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। আলো সামিনকে দেখে উঠে চলে যায়। আজান আয়াতও বোনের পিছু পিছু চলে যায়। রেহেনা বসে আছে। সামিন রেহেনার পাশে বসে। কিছুক্ষণ দু'জনেই চুপচাপ। সামিন রেহেনার দিকে একপলক তাকিয়ে তার হাত দুটো মুঠি করে ধরে। রেহেনা সামিনের দিকে তাকায়। সামিন নরম গলায় বলতে থাকে,"আন্টি। এই পৃথিবীতে আমি সবথেকে বেশি অন্যায় আপনার সাথে করেছি। একজন স্ত্রী এবং একজন মা হয়ে আপনি দ্বিগুণ ভু'গে'ছে'ন। আমি নিজের দোষ স্বীকার করে নিলাম আন্টি,আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত..আপনি আমাকে পারলে মাফ..."
সামিনকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রেহেনা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের মায়ের বয়সী এই মহিলার চোখে সামিন তার প্রতি তী'ব্র ঘৃ'ণা দেখতে পেয়ে আর কথা বলার সাহস পায় না। কয়েক মুহূর্ত বসে থেকে সেও উঠে চলে যায়।
***
আতাউর আলমকে অ'পা'রে'শ'ন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ওয়েটিং রুমে সবাই অপেক্ষা করছে একটা ভালো খবর শোনার! একজন মেয়ে অপেক্ষা করছে তার বাবার জন্য, দুজন ছেলে অপেক্ষা করছে তার বাবার জন্য, একজন স্ত্রী অপেক্ষা করছে তার স্বামীর জন্য, একজন অ'প'রা'ধী অপেক্ষা করছে একটা স্বস্তির সংবাদের যাতে তাকে আর কোনো দোষের ভাগীদার না হতে হয় তাই।
ইলহামের নাম্বার থেকে অনবরত ফোন আসছে। সামিন প্রথমে ফোনটা রিসিভ করতে চায়নি। পরে রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ইলহাম বলে,"ভাইয়া! আজকের অনুষ্ঠানের কি হবে কিছু বলছো না যে। এখানে সবকিছু আয়োজন করা হয়ে গিয়েছে!"
সামিন কিছু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,"অনুষ্ঠান হবে। লোকজনকে খাইয়ে, সবটা বুঝিয়ে বলবি। এখানে সা'র্জা'রি চলছে।"
ইমতিয়াজ মির্জা ইলহামের হাত থেকে ফোন নিয়ে সামিনকে বলে,"কি ধরনের রসিকতা শুরু করেছো তুমি! এতো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এখন বলছো আসতে পারবে না! বর বৌ ছাড়া রিসিপশন হবে?"
_হ্যা হবে। লোকজন যেন পেট ভরে খেয়ে চলে যায়। রিতুকে বলো সবটা দেখতে।
_সামিন তুমি কি শুরু করেছো একটু বলবে। ওখানে কি করছো তুমি!
_এখানে আমার একজন আত্মীয় মৃ'ত্যু'র সাথে পাঞ্জা ল'ড়'ছে। সম্পর্কে তিনি আমার শশুর। এখানে আমার থাকাটা জরুরি বাবা। লোকজনকে তুমি আর ইলহাম ম্যানেজ করো। কোনো সাংবাদিক এলে বলবে যা কথা জানার ইয়াসার মির্জার কাছ থেকে জানতে। রাখছি।
ফোনটা কেটে দিয়ে সামিন আলোর দিকে তাকায়। বেঞ্চির উপরে পা উঠিয়ে হাঁটুতে মাথা রেখে গুটিয়ে বসে আছে। একে একে আতাউর আলমের পরিবারের প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে সামিন সেখান থেকে চলে যায়। তারপর সোজা তিনতলায় নামে সে। এই হসপিটালেই জামিল এডমিট। তিনশো চার নাম্বার কেবিনের পর্দা সরাতেই দেখে জামিলের মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে হেনা। সামিনকে দেখে হেনা উঠে দাঁড়ায়। সামিন নিচুস্বরে বলে,"উঠতে হবে না। তুমি বসো!"
হেনা বসে পরে। সামিন জামিলের কাছে এগিয়ে যায়। জামিল তার ইয়াসার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্ষীণ কন্ঠে বলে,"সা'র্জা'রি শেষ হয়েছে?"
_না চলছে।
জামিল ম্লান হাসে,"কি অদ্ভুত তাই না ভাই। একসময় এই আতাউর আলমকে দুই বেলা তুলোধুনো করতেন আর এখন!"
সামিন জামিলের বেডের একপাশে বসে। জামিল হেনার দিকে তাকিয়ে বলে,"তুমি একটু বাইরে যাবে হেনা? ভাইয়ের সাথে আমার কথা আছে।"
হেনা উঠে চলে যায়। সামিন জামিলের দিকে তাকিয়ে আছে। জামিল বলতে থাকে,"সেদিন ওদের সামনে আমি আপনাকে লজ্জা দিতে চাইনি ভাই, তাই বলিনি যে আপনি ঘোর অন্যায় করেছেন। আতাউর আলম যদি দোষী থাকতো তবুও তার শা'স্তি তার মেয়ে কেন পাবে? খুব আ'হ'ত হয়েছি ভাই আমি। আপনাকে আমি এই দুনিয়ার কারো সামনে ছোট করতে পারবো না, কিন্তু সত্যিই ভাই আপনি মহা অন্যায় করে ফেলেছেন।"
সামিন জামিলের দিকে তাকিয়ে থাকে তার কথা শুনে।
***
টানা চারঘন্টা অ'পা'রে'শ'নে'র ইতি টেনে ডক্টর রাসেল অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়। সামিন তার কাছে যাওয়ার আগেই আলো ছুটে যায়। সামিন দাঁড়িয়ে পরে। আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"কি হয়েছে ডক্টর!"
মুখের উপর থেকে মাস্ক খুলে নিয়ে ডক্টর রাসেল একটা ম্লান হাসি হেসে বলে,"অপারেশন ঠিক ঠাক ভাবে হয়েছে ভাবী।"
আলো শান্ত হতে পারে না। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"বাঁচবে তো আব্বু!"
_ভাবী দেখুন আগেই বলেছি এটা রিস্কি। আপনার বাবাকে আইসিইউতে শিফট করা হবে। এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না।
আলো দুই পা পিছিয়ে গিয়ে একটা বেঞ্চিতে ধপ করে বসে পরে। ইশমাম গিয়ে ডাক্তার রাসেলকে বলে,"ওনার কন্ডিশন কিরকম মানে ধরুন আনুমানিক কখন জ্ঞান ফিরবে বলে আশা করা যায়।"
_জ্ঞান তো এতো তাড়াতাড়ি ফিরবেই না তবে হ্যা ৭০ পার্সেন্ট চান্স আছে আগামী বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে রোগী রেসপন্স করবে বাকি টা তো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।
রেহেনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাঁদছে আজান এবং আয়াত। সামিন কিছুক্ষণ তাদের দেখে ইশিতাকে বলে,"ওনাদের বাড়িতে নিয়ে চল ইশু। এখানে ওনার মেয়ে থাকবে সম্ভবত। ওনারা চলে যাক। হসপিটালে থেকে তো কোনো লাভ নেই সবার।"
তারপর আজান আয়াতের দিকে তাকিয়ে ধ'ম'কে'র সুরে বলে,"মেয়েদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছো কেনো? তোমার আপুকে দেখে কিছু শিখতে পারো না? সে সহজে কাঁদে?"
রেহেনা কান্না থামিয়ে ক'ঠি'ন গলায় বলে ওঠে,"আমি আমার স্বামীর কাছে থাকবো। তুমি কে ঠিক করার সবটা?"
সামিন রেহেনার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"আপনার জামাই আমি। আপনার মেয়ের স্বামী। এখন যেটা বলছি সেটা চুপচাপ করুন নয়তো ধরে বেঁ'ধে বাড়িতে রেখে আসবো।"
সবাই চুপ করে শোনে সামিনের কথা। কিছুক্ষণ পরে সামিন বলে ওঠে,"হসপিটালে থেকে আপনি করবেন কি? আপনি নিজে হাই ব্লা'ড প্রে'শা'রে'র রো'গী। এখন যদি একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন ভো'গা'ন্তি তো আপনার ছেলে মেয়েদের হবে। "
ইশিতা রেহেনার পাশে বসে নরম গলায় বলে,"আন্টি দোহাই আপনার। আজান আয়াতকে নিয়ে চলে যান। এখানে থাকার কোনো মানে নেই। আলো তো আছে। ও সবটা দেখবে!"
রেহেনা মাথা তুলে একপলক ইশিতাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে হেঁটে আইসিইউর কাছে গিয়ে আতাউর আলমের নিথর শরীরটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
****
পাশে বসে আড়চোখে আলোর দিকে একপলক তাকায় সে। মাথা নিচু করে বসে আছে আলো। সামিনের হাতে টিস্যু পেপারে মোড়ানো একটা স্যান্ডউইচ । কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে অনেকটা সাহস নিয়ে সে স্যান্ডউইচ টা আলোর দিকে এগিয়ে দেয়। নরম গলায় বলে ওঠে,"রাত থেকে কিছু খাওনি। এখন দুপুর দেড়টা বেজে গিয়েছে। এটা অন্তত মুখে দাও।"
আলো একপলক স্যান্ডউইচটার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"এসব এখন বন্ধ করুন। আমি কথা দিচ্ছি আমি আপনার নামে কোনো মা'ম'লা করবো না, কোনো স্টেপ নেবো না আপনার বিরুদ্ধে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনি শুধু এখান থেকে চলে যান। আমার আপনাকে দেখলে য'ন্ত্র'না হচ্ছে খুব।"
_এসব কথার সাথে তোমার এটা খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই আলো। তুমি এটা খাও।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আলো হাত বাড়িয়ে স্যান্ডউইচ টা নিয়ে নেয়। স্যান্ডউইচটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা কা'ম'ড় বসায় তাতে। সামিন আলোকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পায়। পানির বোতলটা এগিয়ে দেয় আলোর দিকে।
আলো নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে,"কি কপাল আমার , যে লোকটার জন্য আব্বু আজ মরতে বসেছে আমি তার হাতে খাবার খাচ্ছি।"
কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে সামিন বলে ওঠে,"শুধু খাবার না, তার কিনে দেওয়া শাড়ি তোমার গায়ে। তার কেনা গয়না পরে আছো, তার মায়ের হাতের বালা তোমার হাতে, তার নামের সাথে তোমার নাম জুড়ে গিয়েছে। অদ্রিতা আলো, অভিভাবক: স্বামী , স্বামীর নাম: সামিন ইয়াসার মির্জা।"
সামিনের এমন উত্তরে আলো ম্লান হাসে। সে হাসিতে সামিনের প্রতি ছিলো বিদ্রুপ।
সামিন হঠাৎ করে একটা হাত ধরে ফেলে আলোর। আলো হাত সরিয়ে নেয় না। সামিন আলতো করে সেই হাতটাকে নিজের দুহাতে আগলে নিয়ে নরম গলায় বলে,"একটা মাস নষ্ট করে দিয়েছি তোমার জীবনের। আমাকে আরো একটা মাস সময় দাও। সবটা না পারি,কিছুটা হলেও ঠিক করে দেবো আমি।"
আলো নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় না। সামিনের চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,"আপনি আমার জীবন থেকে গোটা জীবনটাই নিয়ে নিন ইয়াসার মির্জা। তবুও আপনার প্রতি আমার অনূভুতি বদলাবে না কিংবা এই সম্পর্ককে শ্রদ্ধা আমি করবো না। আপনাকে আমি সহস্র বছর সময় দিলাম। আপনাকে স্বামীর অধিকার খাটানোর অনুমতি দিলাম,আমি নিজেকে সমর্পণ করলাম। কিন্তু আপনি আমাকে পাবেন না, এই ভেতরের আমি টাকে পাবেন না আপনি। আমি আপনাকে ঘৃণা করি।"
কথাটা বলে আলো চোখ বন্ধ করে নেয়। দুই ফোঁটা তরল গড়িয়ে পরে তার দু'চোখ থেকে। সামিন আলোর হাত ছেড়ে দিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
***
অতিথিরা এসে সবাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। ইতিহাসে এই প্রথম কোনো বিয়ের রিসিপশন হচ্ছে যেখানে বর বৌ নেই। সাংবাদিকরা এসে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে। ইলহাম এবং ইমতিয়াজ মির্জা সবাইকে সবটা বুঝিয়ে বলে কোনোভাবে ম্যানেজ করে নিয়েছে বিষয় টা।
অনুষ্ঠানে জুঁই কে দেখে ইলহাম কিছু টা বিরক্ত হয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে ধ'ম'কে'র সুরে বলে,"তুমি এখানে এসেছো কেনো? পাগল হয়ে গিয়েছো নাকি তুমি!"
জুঁই চাপা স্বরে চেঁ'চি'য়ে বলে ওঠে,"ফোন ধরছিলে না কেনো আমার। জবাব দাও। বৌ কি আঁচলে বেঁ'ধে নিয়েছে নাকি!"
ইলহাম প্রচন্ড রে'গে গেলেও নিজেকে শান্ত করে বলে,"দেখো জুঁই , তুমি এভাবে হুট করে চলে আসলে সমস্যা টা তো আমার হবে তাই না? এটা কি তুমি চাও!"
_আমার ফোন লাগাতার কে'টে দেওয়ার আগে এটা মাথায় রাখা উচিত ছিলো।
_আচ্ছা ঠিকাছে। আর কাটবো না। এবার তুমি যাও। ঘর ভর্তি অতিথি। বাড়িতে বাবা আছে, সমস্যা হবে আমার। প্লিজ যাও।
জুঁই বলে,"ঠিকাছে। আগে কিছু টাকা দাও। আমি শপিং এ যাবো।"
ইলহাম জুঁই এর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তার পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে জুঁই এর হাতে একটা কার্ড দেয়।
জুঁই আহ্লাদী গলায় বলে,"বলো। কাল দেখা করবে সকালে। বলো!"
_কাল হবে না জুঁই,ইহানের মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।
জুঁই কপাল কুঁচকে বলে,"কি হয়েছে ওর? পে'ট বা'ধি'য়ে'ছে নাকি আবার! দেখো ইলহাম, যদি এমন কিছু হয় তাহলে ওর এ'ব'র'শ'ন করাবে তুমি। মাইন্ড ইট!"
ইলহাম রেগে গিয়ে বলে,"স্টপ জুঁই। এখন যাও। প্লিজ।"
জুঁই চলে যায়। ইলহাম কিছুক্ষণ ওখানে কিছুক্ষণ থেকে ঘুরে দাড়াতেই দেখে রিতু তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটো ভেজা। ইলহাম কিছু বলার আগেই রিতু চলে যায় সেখান থেকে।
***
বিকেল তিনটার দিকে রেহেনা আজান আয়াতকে নিয়ে আবারো এসেছিলো হসপিটালে। সন্ধ্যার দিকে তাদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে আলো। বলেছে সে একাই থাকতে পারবে।
সামিন এসে পেছন থেকে আলোকে ডেকে ওঠে,"আলো।"
আলো ঘুরে তাকায়। সামিন নরম গলায় বলে,"অনেক রাত হয়েছে। কাল রাত থেকে ঘুমাওনি। বাড়ি চলো, একটু ঘুমিয়ে নেবে। এখানে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। নার্স ঠিক করে রেখেছি আমি। কোনো অসুবিধা হবে না।"
_আমার আব্বুর কাছ থেকে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না।
নিচু স্বরে কিন্তু তেজী কন্ঠে বলে ওঠে আলো।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে,"ঠিকাছে। থাকো। আমি আশেপাশে আছি। প্রয়োজন হলে ডেকে নিও।"
ইশমাম এসে সামিনের পিছনে দাঁড়িয়ে বলে,"তুমিও তো ঘুমাওনি ভাইয়া। তুমি বাড়িতে যাও। আমি আছি। "
_না, তুই যা। তোদের কষ্ট করার কোনো মানে হয়না ছোট। যা।
জোরাজুরি করে ভাইয়ার সাথে পারা যাবে না। ইশমাম হাল ছেড়ে দিয়ে আলোর দিকে একপলক তাকায়। তারপর চলে যায় সে।
ঘুরেফিরে ওয়েটিং রুমে এসে দেখে আলো বসে আছে চুপচাপ। ঘুমে তার চোখ বুজে আসছে। ওয়েটিং রুমে তারা দুজন এখন । পুরো হসপিটাল নি'স্ত'ব্ধ। সামিন এগিয়ে গিয়ে আলোর পাশে বসে। আলো বসে বসে ঢুলছে। সামিনের উপস্থিতি সে টেরই পায়নি। কয়েক পলক আলোকে দেখে সামিন বলে ওঠে,"ভেতরে কেবিন রয়েছে। অন্তত সেখানে গিয়ে ঘুমাও। "
আলো লাফিয়ে ওঠে। সামিন বলে,"সরি! ভ'য় পেয়ে যাবে বুঝিনি। বলেছি ভেতরে কেবিন আছে সেখানে গিয়ে ঘুমাও। এভাবে বসে বসে তো ঘুমানো যায়না।"
আলো কপাল কুঁ'চ'কে বলে,"চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল। ঘুমাইনি। এখানেই ঠিক আছি আমি।"
সামিন কিছুক্ষণ শীতল চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে থাকে। আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন আলোর চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে আলোকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। নিজেকে ছাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে আলো ব্যর্থ হয়। সোজা হেটে একটা কেবিনে ঢুকে একটা বেডের ওপর আলোকে বসিয়ে দেয় সামিন । আলো তার দিকে রা'গী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সামিন আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে খুবই ঠাণ্ডা ভাবে বলে,"এখন এখানে চুপচাপ শুয়ে না পরলে এক চ'ড় মে'রে সামনের পাটির দাঁত সবগুলো ফেলে দেবো আছিয়া।"
"তোকে দেবদাস মুভিতে কাস্ট করা যেতে পারে। লুকটা একেবারে পারফেক্ট।"
ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে সামনের দিকে তাকায়। সামিন একমনে ড্রাইভ করছে। ফুয়াদ বলে,"সেদিন রাতে তোর সাথে খুব খা'রা'প ব্যাবহার করেছি। আসলে রাইসার সাথে ঝ'গ'ড়া হয়েছিলো। তুই কি এখনো রে'গে?"
_নাহ।
একশব্দে জবাব দেয় সামিন।
_দুই রাত না ঘুমিয়েই ছিলি?
_না। গতকাল শেষ রাতের দিকে একটু ঘুমিয়েছিলাম। তাও বসে বসে। এখন পুরো শরীর ভেঙে ঘুম আসছে। বাড়িতে গিয়ে একটু ঘুমাবো।
_আলো কি করছে? কাঁ'দ'ছে খুব?
_না প্রথমে খুব কেঁ'দে'ছি'লো। এখন স্বাভাবিক। শুধু আমাকে দেখে ক্ষে'পে যায়।
_তো যাচ্ছিস কেনো সামনে, হেল্প করলে আড়ালে থেকেও তো করা যায়।
_আমার বৌ, আমি সামনে যাবো না?
ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকায়। পরপর বলে ওঠে,"আমার দাদী তোর কপালের তিলটা দেখে সবসময় বলতো তুই নাকি বৌ পা'গ'লা হবি। দাদীর কথা মিলে যাচ্ছে।"
সামিন ম্লান হাসে। ফুয়াদের অফিসের সামনে ফুয়াদকে নামিয়ে দিয়ে সোজা শান্তিনীড়ে ছুটে যায় তার গাড়ি। ধীরপায়ে বাড়িতে ঢুকে দেখে কেটারিং সার্ভিসের লোকেরা সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ইমতিয়াজ মির্জা লিভিং রুমে ইহানকে কোলে নিয়ে বসে ছিলো,সামিনকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে,"দাঁড়াও।"
সামিন দাঁড়ায় না। একটা হাই তুলে বলে,"ঘুমাবো বাবা। দাঁড়ানোর সময় নেই।"
সিঁড়ি বেয়ে ইশমাম নামে। সামিনকে দেখে বলে,"তুমি এসে গিয়েছো। আমি হসপিটালেই যাচ্ছিলাম ভাইয়া।"
_হ্যা এসেছি। বিকেলের দিকে গিয়ে তোর ভাবীকে নিয়ে আসবো। এখন আমার একটু ঘুম প্রয়োজন। তুই যেতে চাইলে যা,তবে ওরা তোর সাথে যে খুব একটা ভালো ব্যাবহার করবে তার গ্যারান্টি দিতে পারছি না।
ইমতিয়াজ মির্জা বলে ওঠে,"এতো গুলো টাকা দিয়ে তুমি আতাউর আলমের অ'পা'রে'শ'ন করিয়েছো! তুমি!"
_হু। কেনো বাবা,এর থেকে বেশী টাকা আমি প্রত্যেক মাসে এতিম খানা গুলোতে দেই। তোমার কি কোনো অসুবিধা হয়েছে? লোকটা আতাউর আলম বলে?
_না,সেসব পুরনো কথা। তার জে'র ধরে আমি কিছু বলছি না।
_আমি ভুলের মাশুল গুনেছি বাবা।
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন।
ইমতিয়াজ মির্জা বিদ্রুপ করে বলে ওঠে,"তোমার মেজো ভাই ভুল করে এক মেয়ের ওরনা ধরে টা'ন দিলো,সেখানে মাশুল গুনলে। এখন তুমি ভুল করে এক মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে করে তার মাশুল গুনছো। আর তোমার এই ছোটো ভাই ভুল করে কি করবে? জানতে পারি?"
কথাটি বলে ইমতিয়াজ মির্জা ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম কিছু না বলে বেড়িয়ে যায় বাড়ি থেকে। সামিন বাবার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।
***
ঘরে ঢুকে অনেকটা সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ফোনের রিংটোন বেজে যাচ্ছে। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে।
_কি রে সামিন ইয়াসার। শেষমেশ আতাউর আলমের মেয়েকে!
সাগরের কন্ঠ পেয়ে সামিন ফোন কেটে দিতে যাবে তখনি সাগর বলে ওঠে,"খবরদার ফোন কাটবি না সামিন। আগে বল তুই আমাকে লিজ টা পেতে দিস নি কেনো শা'লা!"
_জামিলের গায়ে হা'ত তুলেছে তোর বাপের লোক। আমার দুর্বল যায়গায় আ'ঘা'ত করতে আসলে আমিও তার ঠিক আসল যায়গায় আ'ঘা'ত করি। তোকে আর তোর বাপকে সিটি কলেজের ছেলেপুলে দিয়ে পি'টি'য়ে মা'রা'র থেকে ভাবলাম প্রানে না মে'রে ধনে মা'রি। কেমন লাগছে এখন?
কথাটি বলে সামিন কু'ৎ'সি'ত একটা গা'লি দেয় সাগরকে। সাগর গা'লি'টা গায়ে না মেখে ঠান্ডা গলায় বলে,"তোর খুব খারাপ অবস্থা করে ছাড়বো সামিন। আমাকে তুই খুব ভালো করে চিনিস। এতো বড় ক্ষ'তি আমি হজম করবো না কিন্তু।"
সামিন একটা বাকা হাসি দিয়ে ফোন কেটে দেয়।
তোয়ালে দিয়ে মাথাটা ভালো করে মুছে তোয়ালেটা দূরে ছু'ড়ে মেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ঘুমে দু'চোখ তলিয়ে আসছে। ফ্লাইওভারের সাইট থেকে ফোন আসছে। সেখানে গিয়ে একটাবার দেখে আসা দরকার। বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে চোখ বুজে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ফোনটা আবারো হাতে নিয়ে তৌফকে ফোন দেয়। তৌফ ফোনটা রিসিভ করতেই সামিন বলে ওঠে,"তোর ভাবী কি করছে?"
_ভাবী তার মাকে খাইয়ে দিচ্ছে ভাই।
_আর সে খেয়েছে?
_তা জানি না। গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসবো?
_জিজ্ঞেস করতে গেলে চ'ড় খাবি। যাস না। ইশমাম যাচ্ছে হসপিটালে। কোনো সমস্যা হলে আমাকে ফোন করবি। আমি এখন ঘুমাবো। বিকেলে আসছি।
_জ্বি আচ্ছা ভাই।
সামিন ফোন কেটে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কিছু সময় যেতেই ঘুমিয়ে যায় সে।
***
"অদ্রিতা!"
ইশমামের কন্ঠ পেয়ে মাথা তুলে তাকায় আলো। ইশমাম আলোর পাশে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে বসে। আলো স্বাভাবিক গলায় বলে,"এলে কেনো! ভাই স্পাই হিসেবে পাঠিয়েছে বুঝি! আমি পু'লি'শ ডাকলাম কিনা! মুখ খুললাম কি না। এসব দেখতে পাঠিয়েছে তোমাকে?"
_নাহ, তোমার খেয়াল রাখতে পাঠিয়েছে।
আলো চুপ করে থাকে। ইশমাম বলে,"ভাইয়া প্রচণ্ড অনুতপ্ত।"
_তো? সে অনুতপ্ত,তাই তার বুকে ঝা'প দেবো? ভুলে যাবো সেই বি'ভী'ষি'কা'ময় রাত টা?
ইশমাম চুপ করে আলোকে দেখছে। সেই রাতটা তো তার জীবনেরও সবথেকে বি'ভী'ষি'কা'ময় রাত।
খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছে আলোকে। নরম গলায় ইশমাম বলে,"বিকেলে বাড়িতে চলে যেও প্লিজ। এখানে নার্স রা সবটা দেখবে। তোমার এমন ভোগান্তি আমাদের কারো কাম্য নয়।"
_ভোগান্তি তোমাদের কাছে। ঐ মানুষটা আমার আব্বু, আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। ভাইয়ের হনুমানগিরি করা শেষ হলে তুমি এখান থেকে যাও। প্লিজ যাও।
***
"তুমি যাবে না?"
_না।
সামিনের মুখের উপর বলে দেয় আলো। সামিন রা'গ'টা নিয়ন্ত্রণ করে বলে,"দু দুজন নার্স ঠিক করা। যেখানে থাকার প্রয়োজন নেই সেখানে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো কেনো? হসপিটাল কি একটা থাকার যায়গা? এখানে কেউ শখ করে থাকে?"
আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নরম গলায় বলে,"দেখো! তোমার বাবা ঠিক আছে। রেসপন্স করছে উনি। সম্ভবত খুব শিগগিরই জ্ঞান ফিরবে তার। তুমি বাড়িতে চলো, প্রতিদিন এসে এসে সকাল-সন্ধ্যা দেখবে। এভাবে একটানা হসপিটালে পরে থাকলে তুমি নিজেও অ'সু'স্থ হয়ে পরবে আলো। কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ থাকতে পারে এতদিন এভাবে? ঘুম নেই, গোসল নেই, খাবার খাচ্ছো না ঠিক ভাবে! "
আলোকে চুপ থাকতে দেখে সামিন আলোর হাত ধরে। খুবই নিচু স্বরে বলে,"মাত্র একমাস নিয়েছি তোমার থেকে। আজ সেই একমাসের প্রথম দিন। চলো বাড়িতে।"
আলোকে কিছু বলতে না দিয়ে সামিন আলোর হাত ধরে বের করে নিয়ে আসে হসপিটাল থেকে। আলো নিশ্চুপ হয়ে থাকে। রাত তখন সাড়ে দশটা। আলোকে গাড়িতে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করে। একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"সিট বেল্ট টা বাধো প্লিজ।"
আলো রোবটের মতো সামিনের বলার সাথে সাথে সিটবেল্ট বেঁধে নেয়। পুরো রাস্তা দু'জনে চুপচাপ। শান্তিনীড়ের গেইট থেকে গাড়ি ঢোকে। গাড়ি থামিয়ে সামিন নেমে দরজা খুলে আলোকে নামতে বলে। আলো নেমে পরে।
লিভিং রুমে ইশিতা এবং পরী বসেছিলো। আজ বিকেলে পরী এসেছে। আলো আর সামিনকে দেখে দু'জনে উঠে দাঁড়ায়। ইশিতা নরম গলায় বলে,"তুমি ঠিক আছো ভাবী?"
আলো মাথা নাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। সামিন আলোর পিছু পিছু যায়।
ঘরে ঢুকে আলো এক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আলমারির কাছটায় যায়। তারপর একটা আকাশী রঙের সুতির শাড়ি বের করে ওয়াশ-রুমে ঢোকে।
সামিন দরজা বন্ধ করে গায়ের শার্টটা পাল্টে নিয়ে একটা বালিশ এনে ডিভানে রেখে বসে পরে। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়। আলো ওয়াশ রুম থেকে বের হয় না। সামিন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আলো প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে গোসল করছে।
কিছু সময় যেতেই খট করে ওয়াশ রুমের দরজা খোলার আওয়াজ হয়। ধীর পায়ে আলো বের হয়ে আসে। মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে রেখেছে। শাড়ির আঁচল টেনে ডান কাঁধে তুলে রেখেছে। মাথা ঘুরিয়ে আলোর মুখের দিকে তাকাতেই সামিন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আলোর দিকে। আকাশী কোনো আহামরি সুন্দর রঙ নয়। অথচ এই শ্যামলা বর্ণের মেয়েটিকে কী ভীষণ মানিয়েছে! সামিন খেয়াল করেছে, সামিনের যত অপছন্দের সব রং। এই মেয়েটির গায়ে জরালেই সামিনের চোখে সুন্দর হয়ে ওঠে রং টা।
হঠাৎ করে আলো একটা হা'চি দিতেই সামিনের ঘোর কেটে যায়। আলো বিছানায় বসে মাথা থেকে তোয়ালে টেনে সরিয়ে দেয়। ভেজা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে পরে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সামিন চোখ সরিয়ে নেয়। আলো নিজের গায়ে একটা চাদর টেনে নিয়ে ওদিকে ফিরে শুয়ে পরে। সামিন মাথা ঘুরিয়ে আবারো আলোর দিকে তাকায়। একবার ভাবলো আলোকে বলবে মাথাটা ভালো করে মুছে নিতে। কিন্তু সে সাহস পেলো না। তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যাবে তাহলে, আলো শেষ পর্যায়ে বলবে,"আমি আপনাকে ঘৃ'ণা করি ইয়াসার মির্জা!"
এতো রাতে সেই বাক্যটা শুনতে ইচ্ছে করছে না সামিনের।
***
প্রচন্ড শব্দে "আহ" বলে আ'র্ত'না'দ করে ইশমাম পেটে হাত চেপে ধরে। তিনটা বই হাতে পরী পেছনের দিকে তাকাতে তাকাতে ছুটে আসছিল। যে গতি নিয়ে পরী ছুটছিল,তাতে ধাক্কা লেগে হাতের বই গুলো ইশমামের পেটে লাগে। পেটে হাত চেপে ইশমাম তিন পা পিছিয়ে যায়। মনে হচ্ছে রাতের খাবার সবটা এখনি বেরিয়ে যাবে। নিজেকে ধাতস্থ করে ইশমাম চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"চোখ কোথায় নিয়ে ছোটো? আর এভাবে ছুটছিলে কেনো? অদ্ভুত!"
যে ভ'য়ে পরী ছুটছিলো,ইশমামের ধ'ম'ক খেয়ে সেই ভ'য়ে'র কথা পরী ভুলে গিয়েছে। এখন তার ভ'য় একটাই, আগামী পাঁচ মিনিট এই লোকটার থেকে কঠিন কঠিন কিছু কথা শুনতে হবে।
ইশমাম তার দিকে চোখ রা'ঙি'য়ে তাকিয়ে আছে। পরী একটা ঢোক গিলে ফেলে। ইশমাম গম্ভীর কন্ঠে বলে,"ষাঁড় তা'ড়া করেছিলো নাকি তোমায়? অদ্ভুত মেয়ে!"
_আসলে ভ'য় পেয়েছিলাম। তাই ছুটছিলাম।
আমতা আমতা করে জবাব দেয় পরী।
_ভ'য় পেয়েছিলে মানে? কিসের ভ'য়?
_ভুতের।
পরীর মুখে ভুতের কথা শুনে ইশমাম প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে যায়। চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে,"ডিসগাস্টিং! তুমি একটা মেডিক্যাল স্টুডেন্ট হয়ে এসব কথা বলছো!"
পরী নিচু স্বরে বলে,"লাইব্রেরীর পাশের ঘর থেকে কেমন শব্দ আসছিলো।"
_শব্দ আসতেই পারে। তাই বলে ভুত ভেবে নিলে?
পরী একটা ঢোক গিলে বলে,"ঐ ঘরে কে থাকতো জানেন?"
_কে?
ইশমাম ধমকের সুরে বলে।
_আপনার দুই নাম্বার চাচী!
_দুই নাম্বার চাচী মানে?
_ইসতিয়াক মির্জার দ্বিতীয় স্ত্রী মারুফা। যাকে আপনার চাচা তুলে এনে বিয়ে করেছিলো। অনেক অ'ত্যা'চা'র করতো তাকে। এক পর্যায়ে সে বি'ষ খেয়ে ম'রে গিয়েছিলো। এসব আপনার আমার জন্মেরও আগের কাহিনী।
_তো এতদিনে তো মারুফা চাচীর ভুতও ম'রে ভুত হয়ে গিয়েছে। সেসব কথা এখন বলছো কেনো? কোন ধরনের ফাজলামি এগুলো!
ইশমাম পরীর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পরী বলতে থাকে,"সত্যি বলছি। কেমন শব্দ আসছিলো।"
ইশমাম দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"চলো আমার সাথে। যদি ভুত না বের করতে পেরেছো তাহলে ঐ ঘরে বন্ধ করে দিয়ে আসবো তোমাকে।"
_না যাবো না।
_চলো।
পরী মুখটা একটুখানি করে ইশমামের পিছু পিছু যায়।
ঘরের দরজা খোলা ছিলো। ইশমাম পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,"তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি ভুত নিয়ে বাইরে আসছি। নড়বে না এখান থেকে।"
ভেতরে ঢুকে লাইটের সুইচ টিপে দিতেই বিছানার ওপরে ইশিতার বিড়াল টাকে লেজ নাড়াতে দেখা যায়। ইশমাম এগিয়ে গিয়ে বিড়ালটাকে কোলে তুলে বেড়িয়ে আসে। পরীর সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"এই যে তোমার ভুত। স্টু'পি'ড মেয়ে।"
তখনি ইশিতা এসে দাড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,"কি হয়েছে ইশমাম!"
ইশমাম ইশিতার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"যেমন স্টু'পি'ড তোর এই বিড়াল টা,তেমন স্টু'পি'ড তোর এই সখী। দুটোকে আমার সামনে থেকে নিয়ে বিদেয় হ।"
***
রিতুর শরীরটা সকাল থেকেই খুব খারাপ। বেশ কয়েকবার ব'মি হয়েছে। এখন বিছানায় ওদিক ফিরে শুয়ে আছে। ইলহাম কিছুক্ষণ রিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"ডাক্তারের কাছে চলো। নাকি ডাক্তার বাড়িতে ডাকবো?"
রিতু ঘুরে ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,"প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি। আপনি অফিসে যান।"
ইলহাম বিছানায় একপাশে বসে পরে, কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে," এই মাসে পি'রি'য়'ড হয়েছিলো তোমার?"
রিতু কিছুক্ষণ নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ায়। ইলহাম বলে,"চলো টে'স্ট করাবে। রেডি হও!"
_কেন? এ'ব'র'শ'ন করানোর খুবই তা'ড়া বুঝি?
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে রিতু। ইলহাম কিছুক্ষণ রিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে খুব খারাপ লাগছে রিতুর কথাটা শুনে। আগে হলে অনেক ব'কা'ঝ'কা করে দিতো মুখের ওপর কথা বলার অ'প'রা'ধে। আজ পারছে না।
রিতু অ'সু'স্থ শরীর নিয়ে উঠে বসে। নিচু স্বরে বলে,"ইহান কে জন্ম দিয়ে আপনার ভালোবাসা পাইনি, দ্বিতীয় বাচ্চা পৃথিবীতে এলেই আপনি হঠাৎ আমায় ভালোবাসবেন এমনটা আমি ভাবি না। আমি নিয়মিত ও'ষু'ধ খাই। কোনো বাচ্চা আসেনি পেটে। প্রতি মাসেই পি'রি'য়'ড হতে একটু দেরী হয় আমার।"
ইলহাম উঠে দাঁড়ায়। পেছন থেকে রিতু বলে ওঠে,"ঐ মেয়েটার মধ্যে কি এমন ছিলো যেটা আপনার স্ত্রীর মধ্যে আপনি পান নি। আমাকে এক বছর পরে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার আগে এই প্রশ্নের উত্তরটা কি একটু দেবেন?"
ইলহাম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সেখান থেকে চলে যায়।
***
"তুমি রেডি হয়ে নিচে এসো। আমি অপেক্ষা করছি। তোমাকে হসপিটালে পৌঁছে দেবো।"
সামিনের কথা শুনে আলো কপাল কুঁচকে ফেলে। গম্ভীর কন্ঠে বলে,"প্রয়োজন নেই। আমি রিকশা নিয়ে চলে যাবো ।"
_রিকশা ভাড়া আছে তোমার কাছে? আমার ধারণা নেই, রিকশাওয়ালা তোমার চেহারা দেখে তোমাকে রিকশায় ওঠাবে না। অতটাও সুন্দরী নও তুমি।
সামিন কথাটি বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট টিপে হাসে। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ মুখ ফ্যা'কা'শে।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"নিচে অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি এসো। যদি হসপিটালে যেতে চাও তো।"
সামিন চলে যায়। আলো মলিন মুখে খোলা চুল গুলো খোঁপা বেঁধে নিয়ে ডান কাঁধে শাড়ির আঁচল উঠিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়।
করিডোরে সিঁড়ির কাছে ইহান বল নিয়ে খেলছে। এমাথা থেকে ওমাথা ছোটাছুটি করছে। আলো বের হতেই ইহানের বলটা এসে তার গায়ে লাগে। আলো গম্ভীর কন্ঠে বলে,"এখানে এভাবে বাঁ'দ'রা'মি করছো কেনো ছেলে? সিঁড়ি থেকে পরতে চাও?"
ইহান আলোকে দেখে চোখ মুখ কুঁ'চ'কে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। আলো তার পিছু পিছু নামছে। ইহান আলোকে দেখিয়ে দেখিয়ে ইচ্ছে করে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে। পেছন থেকে আলো গম্ভীর কন্ঠে বলে,"ঠিক ভাবে হাটো। পরে যাবে।"
ইহান বেশি করে লাফাতে থাকে। হুট করে পা পি'ছ'লে দুই ধাপ নিচে পরে যেতেই আলো দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে ইহানকে ধরতে গেলে সেও পা পিছলে পরে যায়।
বি'ক'ট একটা শব্দ হয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় সামিন উঠে দাঁড়িয়ে যায়। ইহান নিজের যায়গায় দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে আলোকে দেখছে। আলো হাত দিয়ে নিজের পা চেপে ধরে চাঁপা স্বরে কো'কি'য়ে যাচ্ছে। য'ন্ত্র'না'য় তার পুরো মুখমণ্ডল নীল রঙ ধারণ করেছে।
লিভিং রুমের থাকা সবাই ছুটে আসে। সামিন এসে নিচু হয়ে ঝুঁকে বসে, উ'ৎ'ক'ণ্ঠা নিয়ে বলে,"কোথায় লেগেছে?"
আলো কোনো উত্তর দিতে পারে না, উত্তর দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে সে নেই। য'ন্ত্র'না'র তীব্রতা বাড়ছে। ইশমাম দাঁড়িয়ে আছে, সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"সম্ভবত পায়ে ভাইয়া।"
সামিন আলোর পায়ে হাত দিলে সে উচ্চশব্দে আ'র্ত'না'দ করে ওঠে। পেছন থেকে ফুলির মা বলে,"ভে'ঙে গেছে নাকি ভাইজান!"
সামিন ইশমামের দিকে গাড়ির চাবি এগিয়ে দিয়ে বলে,"গাড়ি স্টার্ট কর। শিগগিরই।"
তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে, উঠতে পারবে? নাকি আমি উঠাবো?
আলো দু'চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে কেঁ'দে যাচ্ছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পায়ের কোনো হা'ড় ভেঙে গিয়েছে।
সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। ইশমাম গিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে। পোনা চাচা পেছনের সিটের দরজা খুলে দেয়,সামিন আলোকে বসিয়ে নিজেও বসে পরে।
পোর্চের নিচে দাঁড়িয়ে ফুলির মা দাঁত বের করে সিতারাকে বলে,"মানুষ একটা আমাদের বড় ভাইজান। কথায় কথায় ভাবীরে কোলে উঠায়। এতো মোহাব্বত আজকালকার পুরুষের মধ্যে থাকে? এই বে'টি যদি একটু বুঝতো। ভাইজানরে পাত্তাই দিতে চায় না। যদি এই বংশের পূর্বপুরুষদের হাতে পরতো তাহলে বুঝতো কত ধানে কত চাল। স্বামীর হাতে মার খেতে খেতে জীবন শেষ হয়ে যেতো!"
***
"অদ্রিতা।"
ইশমাম দরজার কাছে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢোকে। আলোর বেডের পাশে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে একটা চেয়ার টেনে বসে। আলোর ডান পায়ের গোড়ালিতে প্লাস্টার করে দিয়েছে ডাক্তার। খুব বেশি মা'রা'ত্ম'ক না হলেও বেশ কিছুদিন ভোগাবে আলোকে।
ইশমাম নিচু স্বরে বলে,"হাটো কিভাবে তুমি! সিঁড়ি থেকে যখন পরছিলে মনে হচ্ছিলো একটা পিংপং বল গড়িয়ে পরছে।"
আলো কোনো উত্তর না দিয়ে ইশমামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশমাম ম্লান হেসে বলে,"ভাইয়া তোমার খুব কেয়ার করে। অবশ্য ভাইয়া এমনই। যাদের সে আপন মনে করে তাদের সবার খুব কেয়ার করে। আমি আর ইশু যখন জন্মাই,তখন থেকেই মায়ের শরীর টা হঠাৎ খুব খারাপ হতে শুরু করে। বছরের আটমাস অসুস্থ থাকতো। ভাইয়াই আমাকে আর ইশুকে দেখভাল করতো বলতে গেলে। সেজন্য মায়ের পরে ভাইয়ার সাথে আমার সখ্যতা বেশি।"
_এসব কথা আমাকে বলছো কেনো?
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।
ইশমাম আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"দেখো, ভাইয়া তোমাকে খুব ভালো রাখবে। বোঝাই যাচ্ছে।"
_আমাকে শান্তনা দিচ্ছো?
_নাহ। নিজেকে দিচ্ছি।
আলো ইশমামের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশমাম কিছু সময় চুপ থেকে বলে ওঠে,"আমার একটা প্রিয় মানুষ আমার আরেকটা প্রিয় মানুষের কাছে ভালো থাকবে,যত্নে থাকবে,নিরাপদে থাকবে, এটা আমার কাছে অনেক বড় একটা শান্তনা অদ্রিতা।"
আলো ইশমামের কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"বিয়ে করে নাও ইশমাম। একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও।"
ইশমাম হেসে ফেলে। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"ভাবীগিরি দেখাচ্ছো?"
_তুমিও তো ভাইয়ের হনুমানগিরি করো, ভাইয়ের দালালি করো।
ইশমাম চুপ হয়ে যায়। আলো বলে,"তোমার প্রিয়, আদর্শবান ভাইয়া আমাকে একটা রাতেই গোটা এক জন্মের বি'ভী'ষি'কা দেখিয়ে দিয়েছিলো। এখন আবার আমার সাথে নতুন গেইম খেলার চেষ্টা করছে। গত একটা মাস আমাকে ভয় দেখিয়ে ব'ন্দি'নী করে রেখেছিলো,এখন আবার আমাকে মুগ্ধ করতে আমার কাছ থেকে আরো একটা মাস সময় চাচ্ছে। আমার অনূভুতি নাকি পাল্টে দেবে!..."
আলোর কথা বলার মাঝে সামিন এসে ভেতরে ঢোকে। ইশমাম উঠে দাঁড়ায়। সামিন বলে,"উঠলি কেনো। বস।"
ইশমাম নিচু স্বরে বলে,"ভাবীর বাবার এখন কি অবস্থা?"
_সব ঠিক ঠাক। কোনো কম্লিকেসি নেই। এখন শুধু জ্ঞা'ন ফেরার অপেক্ষায়।
ইশমাম ভাইয়ের দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলে,"বসো ভাইয়া,আমি আসছি।"
কথাটি বলে ইশমাম চলে যায়। সামিন মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকায়। তারপর চেয়ারে বসতে বসতে বলে,"হসপিটাল টা পুরো আমার পারিবারিক হসপিটাল হয়ে গিয়েছে। আমার ছোটো ভাই, আমার শশুর,আমার বৌ, সবাই রোগী।"
আলো মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন বলে,"কি করছিলে তখন? সিঁড়িতে দৌড় ঝাঁ'প দিচ্ছিলে কেন? ইহানকে তা'ড়া করছিলে মা'রা'র জন্য?"
আলো মাথা ঘুরিয়ে তাকায়,অবাক হওয়া কন্ঠে বলে,"আমি একটা ছোট বাচ্চাকে মা'রা'র জন্য তা'ড়া করবো?"
_তুমি যে ধরনের মেয়ে। করতেই পারো। তোমাকে বিশ্বাস কি?
ঠাণ্ডা গলায় বলে সামিন। আলো কপাল কুঁচকে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোর চোখে চোখ রেখে বলে,"তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইলে আর সৃষ্টিকর্তা তোমার ঠ্যাং ভে'ঙে দিলো। এই ফে'রা'উ'ন'টার প্রতি সৃষ্টিকর্তার কত মায়া দেখেছো আছিয়া?"
ক্রাচে ভর দিয়ে ধীরপায়ে হেটে কেবিন থেকে বের হয় আলো। একজন নার্স এসে বলে,"ঘুম ভেঙেছে আপনার? আপনাকে ব্যাথা নাশক ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিলো, তার প্রভাবেই ঘুম হচ্ছে এতো।"
আলো ম্লান হেসে বলে,"কেউ এসেছিলো? আমার মা কিংবা ভাইয়েরা?"
_হ্যা,ওনারা তো এতক্ষন এখানেই ছিলো। একটু আগে আপনার বাবার কাছে গেলো।
নার্স একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে,"মেয়র সাহেব বার বার এসে আপনাকে দেখে গিয়েছে।"
আলো নার্সের কথায় পাত্তা না দিয়ে কেবিনে ঢুকতে গেলে নার্স বলে ওঠে,"আপনার হাজবেন্ড খুব কেয়ারিং। স্ত্রীর জন্য চোখে মুখে কী ভীষণ উৎকণ্ঠার ছাপ! লাভ ম্যারেজ নাকি?"
আলো দাঁড়িয়ে পরে। নার্স বলতে থাকে,"খুবই ভালো লেগেছে দেখতে ব্যাপারটা। এখানে তো সবাই সবটা নার্সদের উপর ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। উনি এতো ব্যস্ত মানুষ হয়েও....."
_আপনার ভালো লেগেছে তাকে?
নার্স কে থামিয়ে দিয়ে আলো প্রশ্নটি করে নার্সের দিকে তাকিয়ে থাকে। নার্স আলোর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে,"মানে?"
_মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জাকে আপনার ভালো লেগেছে? তাহলে আপনি নিয়ে নিন।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো। নার্স হতভম্ব হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন এসে নার্সের পেছনে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,"আমার বৌয়ের মাথায় একটু সমস্যা আছে নার্স আপা। কিছু মনে করবেন না।"
নার্স ঘুরে তাকায় সামিনের দিকে। সামিন হাসি দিয়ে বলে,"ওর মাথায় একটু সমস্যা আপা। আপনি যান । আমি দেখছি। অসুবিধা হলে ডাকবো আপনাকে।"
হতভম্ব ভাব নিয়েই নার্স সেখান থেকে চলে যায়। সামিন আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমার দ্বিতীয় বিয়ের প্রয়োজন হলে আমি নিজে এসে তোমার কাছে বলবো। তুমি কেনো আগ বাড়িয়ে নিজের সতীন ঠিক করছো।"
আলো ঘুরে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে নিজের কেবিনে ঢোকে। সামিন আলোর পিছু পিছু ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে। আলো গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"আচ্ছা আপনার আর কোনো কাজ নেই? আপনাকে যারা মেয়র বানিয়েছে তাদের সেবা করুন গিয়ে।"
বেডের পাশে ক্রাচ টাকে রেখে আলো বসে পরে। সাইড-টেবিল থেকে গ্লাসের ঢাকনা উঠিয়ে পানি খেয়ে গ্লাস টা রেখে দিয়ে আবারো ক্রাচ হাতে তুলে নেয়। সামিন বলে,"কোথায় যাবে? ওয়াশ রুমে? নার্স ডাকবো?"
_আব্বুর কাছে যাবো আমি।
কপাল কুঁ'চ'কে জবাব দিয়ে আলো হাঁটতে থাকে। সামিন বলে,"চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।"
আলো কোনো বিরোধীতা করে না। সে জানে সে নিষেধ করলেও সামিন পেছন পেছন আসবে। শুধু শুধু কথা অপচয় করে লাভ নেই।
আইসিইউর সামনে এসে আলো দাঁড়িয়ে পরে। রেহেনা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,"তুই আসতে গেলি কেনো মা। তুই বিশ্রাম নিতি!"
আলো বলে,"আব্বুর কি অবস্থা?"
_সব ঠিক আছে। ধৈর্য ধর।
আজান এসে আলোকে ধরে বসিয়ে দেয়। আলো আজানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"আয়াত কোথায়?"
_দাদীর কাছে। বাড়িতে।
সামিন দূরে দাঁড়িয়ে আলোকে দেখতে থাকে। খোঁপা আলগা হয়ে গিয়েছে আলোর। কপালের কাছে কিছু চুল এসে বড্ড বিরক্ত করছে মেয়েটিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে আলোর চোখে চোখ পরতেই সে চোখ সরিয়ে নেয়। আলো শীতল চোখে সামিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রেহেনাকে ডাকে,"আম্মু।"
রেহেনা মেয়ের দিকে তাকায়। আলো বলতে থাকে,"গয়না গুলো আনতে বলেছিলাম,এনেছিলে?"
রেহেনা মাথা নাড়ায়।
_ওনাকে দিয়ে দাও।
সামিন আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো তার দিকে তাকিয়ে বলে,"ইশিতা আপু চেয়েছিলো গয়না গুলো। আপনার দেওয়া অর্থের সমপরিমাণ গয়না আছে ওখানে। আপুকে দিয়ে দেবেন।"
রেহেনা ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে রোবটের মতো সামিনের দিকে এগিয়ে দেয়। সামিন ম্লান হেসে প্যাকেটটা হাতে তুলে নেয়। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"আপনার ঋন শো'ধ হয়ে গিয়েছে। এর বিনিময়ে আর কোনো কৃতজ্ঞতা বোধ দেখাতে পারবো না।"
***
"তোর হাতে ওটা কিসের প্যাকেট?"
ফুয়াদ সামিনের হাতের প্যাকেট টার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন বলে,"এটা? এটা তো শশুর বাড়ি থেকে যৌ'তু'ক পেলাম।"
ফুয়াদ হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। বলে,"মানে?"
_মানে তোর ভাবীর মা মানে আমার শ্রদ্ধেয় শাশুড়ি এগুলো গড়েছিলেন তার মেয়েকে দেবেন বলে। আমার আত্মসম্মানে পরিপূর্ণ বৌ এগুলো দিয়ে আমার ঋন শো'ধ করেছে।
ফুয়াদ শুকনো হাসি হেসে বলে,"তোর জন্য এমন একটা মেয়েই ঠিক আছে। নরম কোমল টাইপ বৌ পোষাতো না।"
_এ কথা বলছিস কেনো?
_এমনিই। তুই কি যেনো বলতি? স্ত্রী হচ্ছে বি'ছা'না'র সৌন্দর্য, শুধুমাত্র শ'য্যা'স'ঙ্গী । এখন তো দেখছি তুই এই শ'য্যা'স'ঙ্গী ছাড়া একেবারেই অচল। মাত্র ক'দিনেই এই অবস্থা?
সামিন চুপ করে থাকে। ফুয়াদ বলে,"বারবার বলেছি, এমন কিছু করিস না যার জন্য আজীবন তোকে অ'নু'তা'প করতে হয়।"
_ওকে তী'ব্র ভাবে অনুভব করতে শুরু করেছি আমি। আটকে গিয়েছি, ফেরার পথ নেই।
ফুয়াদ সামিনের কাঁধে হাত রেখে বলে,"এটাই সম্ভবত তোর শা'স্তি। ওকে পাওয়ার ব্যাকুলতায় ছ'ট'ফ'ট করবি কিন্তু ও ধরা দেবে না।"
_সত্যিই দেবে না? কখনোই না?
ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বাচ্চাদের মতো আগ্রহী হয়েছে জানার জন্য।
ফুয়াদ গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে,"কি জানি! নারীর মন,বোঝা বড্ড কঠিন। তবে আমি দুই পার্সেন্ট শিওর ও তোর প্রতি নরম হবে। বাকি আটানব্বই পার্সেন্ট তোর কাজের উপর নির্ভর করছে। দেখ কি হয়!"
_মাত্র দুই পার্সেন্ট?
_অনেক বেশি বলেছি আমি। ভুলে যাস না তুই ওর সাথে কি করেছিস, প্রথমে কোন রূপে আবির্ভূত হয়েছিস ওর মনে। একটা প্রাপ্তবয়স্ক নারীর মন থেকে এসব মুছে ফেলা খুব কঠিন এবং ধৈর্য্যর ব্যাপার সামিন ইয়াসার মির্জা।
_তাহলে দুই পার্সেন্ট কেনো নিশ্চয়তা দিচ্ছিস। একেবারেই দিস না। কোন যুক্তিতে দিলি?
_অবলা জাত কখনো কখনো ঘৃ'ণা করতে করতে পুরুষকে ভালোবেসে ফেলে সেই যুক্তিতে!
***
"হুমায়ূন আহমেদ একটা কথা বলেছিলেন, ধনাঢ্য পরিবারের মেয়েরা গরীব ছেলেদের দেখলে একটা মায়া কাজ করে তাদের মনে, যে মায়া থেকে ভালোবাসা জন্মায়। তবে আমি এই অনূভুতিকে কখনোই ভালোবাসা বলে আখ্যায়িত করবো না,এই অনূভুতির নাম সহানুভূতি। ভালোবাসা নয়।"
ইশিতা কিছুক্ষণ শান্তর মেসেজটার দিকে তাকিয়ে থাকে। উত্তরে কিছু কথা সাজিয়ে লিখেও ফেলে কিন্তু ক্ষন'বাদেই তা মুছে ফেলে অফলাইনে চলে যায়।
দুমিনিট পর শান্তর ফোন আসে তার ফোনে। ইশিতা ফোনটা রিসিভ করবে না করবে না করেও রিসিভ করে কানে ধরে চুপ করে থাকে। শান্ত মৃদু হেসে বলে,"রা'গ করলে?"
_না তো। কেনো রা'গ করবো?
_তোমাকে রা'গি'য়ে দেওয়ার মতো একটা কথা লিখলাম।
_তুমি সহানুভূতি পেতে না চাইলে সাফ সাফ জানিয়ে দেবে। এতো ভনিতা করে কথা বলবে না।
শান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,"চাই। আমি সহানুভূতি পেতে চাই। অভ্যেস খারাপ করে দিয়েছো তুমি। বড্ড লো'ভী হয়ে উঠেছে মন।"
ইশিতার ঠোঁট প্রশ্বস্ত হয়ে যায় হাসিতে। শান্ত বলতে থাকে,"তবে কি জানো , দরিদ্র সুদর্শন পুরুষ, এটা একটা তরুণীর জন্য মারাত্মক বি'প'দ'জ'ন'ক। আজীবন ভুগতে হয় ঠিক সময়ে এরিয়ে না গেলে।"
_এই আমি ফোন রাখলাম।
ইশিতা রা'গ দেখিয়ে ফোন কেটে দিতে গেলে শান্ত বলে ওঠে,"ইশু। আমি এরকম একটা আদরের দুলালীকে ঠিকঠাক ভাবে ট্রিট করতে পারবো তো?"
_আগে জানো সে কতটা চায়।
_কতটা চায়? তুমি যে সানস্ক্রিন লোশন ব্যবহার করো সেটা আমার প্রত্যেক মাসের মেস ভাড়া ইশু।
ইশিতা চুপ করে থেকে বলে,"চাকরি পেলে মেস ছেড়ে দেবে। একটা বাসা নেবে, আমাকে বিয়ে করবে, মোটামুটি দামের একটা সানস্ক্রিন লোশন কিনে দেবে। এতটুকু আত্মবিশ্বাসী হতে পারছো না?"
_আমার আত্মবিশ্বাস আমি আমার বৌকে পুরো একটা স্যালন কিনে দিতে পারবো। কিন্তু সেটা স্বপ্নে।
শান্ত উচ্চশব্দে হাসতে থাকে কথাটি বলে।
ইশিতা চুপ করে থেকে বলে,"কি করছো?"
_সস্তার সিগারেট পো'ড়া'চ্ছি।
দু'পাশের দুজন নিরব থাকে। শান্ত হুট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে,"পারলে এড়িয়ে যাও ইশু। এই সিগারেট টা পু'ড়'তে যতখানি সময় নিচ্ছে, তুমি পু'ড়'তে ততখানি টাইম নেবে না। বাবার রাজকন্যা, ভাইদের আদরের বোন, পারলে এড়িয়ে যাও। বোকামি করো না।"
***
"তুমি যে বলেছিলে জ্ঞান ফিরলে আর কোনো চিন্তার কিছু নেই? তাহলে এখন এসব কি বলছো?"
সামিন রাসেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাসেল বলে,"আমি বলেছি আশংকা রয়েছে। তবে না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।"
সামিন বলে,"অ'পা'রে'শ'ন করা হলো কেন তবে?"
_ওনার জীবনটা বাঁচানোর জন্য। বেঁ'চে গিয়েছে উনি প্রানে। এখন বাকিটা পরে বোঝা যাবে।
সামিন মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকায়। আইসিইউর সামনে ক্রাচে ভর দিয়ে বাবার মুখটা আরো নিকট থেকে দেখার,বাবাকে ছোঁয়ার প্রতিক্ষায় আছে সে। দরজার কাচে চোখ রেখে ভেতরে তাকিয়ে আছে। ভেতরে রেহেনা।
রাসেল বলতে থাকে,"এ ধরনের কেস আমি যেকটা হাতে পেয়েছি তাদের মধ্যে শতকরা বিশ শতাংশ পেশেন্টের সাথে এমনটা হয়েছে তবে বাকি আশি শতাংশ কিন্তু সুস্থ হয়ে উঠেছে সামিন। অযথা দুশ্চিন্তা করো না।"
সামিন রাসেলের কথার জবাব দেয়না। রাসেল যেমনটা বলছে যদি সত্যিই তেমনটা হতে থাকে তাহলে আলো খুব ভেঙে পরবে।
রেহেনা বের হয়। একটু পরেই ডাক্তারের পারমিশন নিয়ে আলো ভেতরে ঢোকে।
আতাউর আলম কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে দু'চোখ মেলে তাকায়। আলো ধীর পায়ে বাবার দিকে এগোতে থাকে। আতাউর চোখ পিটপিট করে মেয়েকে দেখতে থাকে। তার সামনে সালোয়ার কামিজ পরিহিতা , চুলে বিনুনি করা, চ'ঞ্চ'ল,দ'স্যি মেয়েটি নয় বরং দাঁড়িয়ে আছে শাড়ি পরিহিতা, চুলে খোঁপা করা, গলায় হালকা পাতলা গয়না পরে বৌ বৌ সাজের একটি মেয়ে। আতাউর কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ হয়ে নিজের কন্যাকে দেখে। অত্যন্ত মিষ্টি একটা চেহারা মেয়েটির। একেবারে মায়ের মতো দেখতে হয়েছে। ক্লাস টেনে থাকাকালীন নানা জায়গা থেকে অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব আসতো মেয়েটির জন্য, আতাউর আলম কখনো তাদের পাত্তা দিতো না। তার ইচ্ছে ছিলো মেয়েটিকে সে নিজের পায়ে দাড় করিয়ে বিয়ে দেবে। আজ সেই মেয়েটি বৌ বৌ সাজে তার সামনে দাঁড়িয়ে। আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। আতাউর আলম অত্যন্ত ক্ষীণ কন্ঠে বলে ওঠে,"পায়ে কি হয়েছে তোর?"
_হো'চ'ট খেয়েছি।
_কিভাবে?
_তুমি পাশে নেই বলে, বারবার খাচ্ছি আব্বু।
আতাউর আলম ম্লান হাসে। আলো বলে,"তোমাকে বুড়ো বুড়ো লাগছে আব্বু।"
_তোকেও মহিলাদের মতো লাগছে। শাড়ি পরে থাকিস কেনো?
_শুধু শাড়িই কিনে দিয়েছে আমাকে।
_তা কেনো?
_আমার অবস্থান বুঝিয়ে দিতে সম্ভবত। আমি এখন কারো বৌ। এটা বারবার মনে করিয়ে দিতে।
আতাউর আলম মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,"সু'স্থ হয়ে ওঠো আব্বু। সবটা গুছিয়ে নিতে হবে। এলোমেলো হয়ে যাওয়া সবটা গুছিয়ে নিতে আমার মাথার উপরে বাবার শ'ক্ত একটা হাত দরকার। দয়া করে সুস্থ হয়ে ওঠো তুমি।"
***
জ্ঞান ফেরার আজ তিন দিন, আতাউর আলমকে জেনারেল কেবিনে শিফট করে দেওয়া হয়েছে। কাল পরশুর মধ্যে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে তাকে।
রাত অতটা গভীর নয়। বিকেলের দিকে ভাইদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে আলো নিজেও সামিনের সাথে বাড়িতে চলে আসে। তাকে দুদিন আগেই ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে ডক্টর, কয়েকদিন পরেই তার পায়ের প্লাস্টার খুলে ফেলা হবে। হসপিটালে এখন শুধু রেহেনা আছে।
বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে থাকে। তারপর চোখ মেলে ঘড়ির দিকে তাকায়। সময় রাত ১০ টা বেজে বিয়াল্লিশ মিনিট। বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ উ'শ'খু'শ করে সে উঠে বসে। আব্বুর জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে।
এখন কিভাবে যাবে সে!
সামিন হাতের ল্যাপটপ সরিয়ে আলোকে কিছু সময় ধরে দেখে। আলো চুপচাপ মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে।
ল্যাপটপ বন্ধ করে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,"হসপিটালে যেতে চাও?"
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বলতে থাকে,"যেতে চাও? তাহলে নিয়ে যাবো।"
আলো মাথা নাড়িয়ে না বলে দেয়। সামিন আবারো ল্যাপটপ হাতে নেয়। আলো বলে ওঠে,"আর তেইশ দিন পরে এমনিতেই চলে যাবো, তার আগে এতো ঘনঘন যাওয়া আসা করার কি দরকার!"
সামিন ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। কতটা দৃঢ়তার সাথে বলেছে আলো এই কথাটা। কিছু সময় চুপ থেকে সামিন বলে,"শিওর তুমি? আমাকে ছে'ড়ে তেইশ দিন পরে চলে যাবে? এতোটা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছো?"
_হ্যা।
সামিনের চোখে চোখ রেখে বলে আলো।
***
আতাউর আলম আলোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে তার সামনে তেজী, প্র'তি'হিংসাপরায়ণ, ভ'য়ং'কর ছেলেটাকে দেখে কিছুটা অবাক হচ্ছে। সামিনের চোখে মুখে আগের হিং'স্র'তা সে দেখতে পাচ্ছে না, ক'দিন আগেও যা দেখে সে কেঁ'পে উঠতো। বরং তার সামনে একজন অস্বাভাবিক বিনয়ী একজন লোককে সে দেখছে। এই পরিবর্তিত রূপ হ'জ'ম করাটা কষ্টকর। আতাউর আলম একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে। আলো উৎকণ্ঠা নিয়ে এগিয়ে আসে,"কি হয়েছে আব্বু? শরীর খারাপ লাগছে?"
আতাউর আলম মাথা নাড়ায়। নিজের মেয়েটার পাশে ঐ ছেলেটাকে মেনে নিতে পারছে না সে। বুকের মধ্যে যন্ত্রনা হচ্ছে।
ডাক্তার রাসেল এসে আতাউর আলমকে পরিদর্শন করে। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"আর দুটো দিন চাইলে রাখতে পারতে। এত দ্রুত বাড়িতে......"
_আমার আব্বু। আমি বুঝে নেবো।
গম্ভীর কন্ঠে বলে আলো, তারপর ডাক্তার রাসেলের দিকে তাকিয়ে বলে,"অসুবিধা নেই তো ডক্টর?"
ডাক্তার রাসেল মাথা নাড়ায়। একটা হাসি দিয়ে বলে,"অসুবিধা নেই তবে, খুব সাবধানে।"
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন চুপচাপ আলোকে দেখে। বাবার সুস্থ হবার খুশিতে সে ভুলে গিয়েছে তারও পায়ে চো'ট। ক্রাচে ভর করেও লাফিয়ে লাফিয়ে সবটা দেখছে।
বিকেলে আতাউর আলমকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করা হয়। হসপিটালের সামনে এ্যা'ম্বু'লে'ন্স দাঁড়িয়ে আছে। ওয়ার্ড বয়রা এসে আতাউর আলমকে ধরে ধরে নামিয়ে নেওয়ার জন্য দাড়িয়ে আছে। আলো বাবার পাশে বসে বাবাকে জরিয়ে ধরে রেখেছে। বাপ বেটিতে চোখ বন্ধ করে আছে। সামিন দূরে দাঁড়িয়ে এই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যটি দেখতে থাকে। মেয়েরা সত্যিই বাবা পাগল হয়। হুট করে তার মনেও বাসনা জাগলো তার প্রথম সন্তান যেনো মেয়ে হয়। ওই পাগল মেয়ে অদ্রিতা আলোর মতো একটা মেয়ে।
কথাটা চিন্তা করে সামিন মনে মনে ভীষণ লজ্জা পেয়ে যায়। মনে মনে নিজেকে নিজে বলে,"বৌ থাকবে কি থাকবে না তারই গ্যারান্টি নেই তুই এদিকে বাচ্চার স্বপ্নও দেখছিস সামিন ইয়াসার!"
ধীরপায়ে হেটে আতাউর আলমের পরিবারের সামনে দাঁড়ায় সামিন । সবাই তার দিকে তাকায়। সবার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে খুবই ঠাণ্ডা গলায় আলোকে বলে,"তুমি চাইলে তোমার বাবা মায়ের সাথে যেতে পারো আলো। ক'দিন ওখানে থাকবে ।"
আলো সামিনের কথায় একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। রেহেনা নরম গলায় আলোকে বলে ওঠে,"যাবি মা তুই?"
আজান আয়াত বলতে থাকে,"আপু চলো না। আমাদের সাথে চলো।"
আলো সামিনের দিকে একপলক তাকিয়ে তার মাকে বলে,"না আম্মু। আমি এখন যাবো না। আমি ঠিক বাইশ দিন পরে চলে আসবো তোমাদের কাছে । একেবারের জন্য।"
রেহেনা নিজের মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোকে দেখছে। আলো বলতে থাকে,"বাইশ দিন পর তোমাদের কাছে ফেরার আগে এই লোকটাকে বুঝিয়ে দিয়ে আসবো এই লোকটা জীবনসঙ্গী হিসেবে সম্মানের যোগ্য নয়। এই লোকটা একটা অযোগ্য নেতাই নয় বরং অযোগ্য মানুষ। এর চোখে আঙুল দিয়ে আমি বুঝিয়ে দিতে চাই আম্মু। তোমরা যাও। তোমাদের মেয়েও ফিরবে।"
***
গাড়িতে উঠে একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে সামিন গাড়ি স্টার্ট করে। হসপিটালের গেইট পেরিয়ে বাড়ির দিকে ফিরতে থাকে। আলো সিটবেল্ট বাঁধে নি। সামিন বলে,"সিট বেল্ট বাঁধতে চাও না কেনো? একটা অ'ঘ'ট'ন ঘটলে তখন বুঝবে!"
_অ'ঘ'ট'নে'র পাশে বসে অ'ঘ'ট'নে'র ভয় পাইনা আমি।
সামিন হেসে ফেলে,"আমি অ'ঘ'ট'ন? বাহ, কখনো পি'শা'চ, কখনো জা'নো'য়া'র , কখনো ফে'রা'উ'ন, কখনো আবার অ'ঘ'ট'ন!"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলে,"আমি বলেছি একমাস পরে তোমার যদি আমার প্রতি অনূভুতি না বদলায় তাহলে তুমি চলে যেতে পারো। সে কথা শুনে খুব খুশি হয়েছো তাই না? আচ্ছা যদি আর বাইশ দিন পরেও তোমাকে যেতে না দেই, জোর করে আটকে রেখে দেই? যদি জোর জবরদস্তি করি? তখন?"
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন ম্লান হেসে বলে,"ভ'য় পেয়ো না। আমি আমার কথা রাখবো। জোর করবো না তোমাকে।"
আলো সামিনের কথার কোনো জবাব দেয়না। দু'জনে দীর্ঘসময় ধরে চুপচাপ। গাড়ি শান্তনীড়ের গেইট থেকে ভেতরে ঢোকে।
গাড়ি থেকে নেমে আলো ক্রাচে ভর দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢোকে। লিভিং রুমে বাড়ির মেয়েরা সবাই দাঁড়িয়ে। একজন অচেনা বৃদ্ধ মহিলা বসে আছে লিভিং রুমের সোফাতে। আলোকে দেখে রিতু এগিয়ে এসে আলোর মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে নিচু স্বরে বলে,"সম্পর্কে আপনার দাদী শাশুড়ি। আমাদের দাদা শশুরের ছোট বোন ।"
আলো এক পলক মহিলাটিকে দেখে। মাথার চুল ধবধবে সাদা, গাঁয়ের রং টাও বেশ চমৎকার। গায়ে একটা সাদা কালো জামদানি শাড়ি। দেখে বয়স কত তা বোঝার উপায় নেই। হতে পারে সত্তরের ওপরে। ভদ্রমহিলা আলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে। সামিন লিভিং রুমে এসে মহিলাটিকে দেখে হাসি মুখে এগিয়ে যায়। তারপর কুশল বিনিময় করে। ভদ্রমহিলার নাম ইলোরা মির্জা। তিনি মাথা ঘুরিয়ে আবারো আলোকে দেখে। তারপর সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"ল্যাংড়া বৌ? কিন্তু কেউ তো কিছু বললো না!"
সামিন থমথমে মুখ নিয়ে আলোর দিকে তাকায়। তারপর তার দাদীর দিকে ফিরে বলে,"পায়ে চো'ট পেয়েছে দাদী।"
ইলোরা আবারো আলোর দিকে তাকায়। ঠাট্টার ছলে বলে,"কেনো? বেশি লাফায় নাকি তোর বৌ?"
আলো কপাল কুঁ'চ'কে সিঁড়ির দিকে যায়। এবাড়ির প্রত্যেকটা লোক এক একটা নমুনা। এই নতুন নমুনাটা আবার কোথা থেকে উদয় হলো কে জানে!
আলোকে যেতে দেখে ইলোরা বলে ওঠে,"কেমন মেয়ে! মুরব্বিদের দেখেও সালাম দেয় না!"
সামিন দাদীর হাত চেপে ধরে চুপ করিয়ে দেয়। আলো ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে।
ইলোরা সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"কি? কেমন মেয়ে এটা? বিয়ে করবি না করবি না বলে কেমন মেয়ে বিয়ে করলি!"
তুমি তো জানো সবটা। কিছু মনে করো না দাদী।
নরম গলায় ইলোরাকে বলে সামিন।
***
"ভাবী! আপনার খাবার কি ঘরে পাঠিয়ে দেবো?"
আলো ঘুরে তাকায়। সিতারা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলে। ক্রাচ টা হাতে তুলে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"দরকার নেই। আমি আসছি।"
সিতারা চলে যায়। সামিন ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে আলোর দিকে তাকায়, তারপর বলে ওঠে,"বাড়িতে যিনি এসেছেন তিনি একজন মুরব্বি। রেসপেক্ট ডিজার্ভ করে আলো।"
_রেসপেক্ট আমি মানুষের ব্যাবহার দেখে করি। ওনার কথা বার্তার ধরন দেখে মনে হয়নি তিনি ওসবের যোগ্য।
সামিন বলে,"ঠিকাছে। আর যাই করো ,গালাগাল শুরু করে দিও না অন্তত। দুদিনের জন্য ডাক্তার দেখাতে এসেছে এখানে।"
আলো কিছু না বলে নিচে নেমে আসে। খাবার টেবিলে বসতেই ফুলির মা তার খাবার বেড়ে দেয়। টেবিলে মোটামুটি বাড়ির সবাই খেতে বসেছে। আলো চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। ইলোরা কিছুক্ষণ আলোকে দেখে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"সামিন খেয়েছে?"
রিতু মাথা নাড়ায়। ইলোরা সরাসরি আলোর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"স্বামীর আগে আগে খেয়ে নেওয়ার রীতি চালু হয়েছে এই মির্জা বাড়িতে বুঝি!"
আলো সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে খেতে থাকে। এমন সময় সামিন এসে দাঁড়ায় সেখানে। একে একে প্রায় সবাই খাওয়া শেষ করে উঠে যায়। সামিন একটা খালি চেয়ার টেনে বসে পরে। একপলক আলোর দিকে তাকায় সে। ইলোরা আলোকে বলে,"স্বামীর কি লাগবে না লাগবে সেটা দেখো!"
আলো মাথা তুলে একবার সামিন আর একবার ইলোরার দিকে তাকিয়ে প্লেটে হাত ধুয়ে ক্রাচ তুলে উঠে দাঁড়ায়। তারপর চলে যায় সে সেখান থেকে।
ফুলির মা সামিনের খাবার বেড়ে দিয়ে চলে যায়। খাবার টেবিলে আপাতত সামিন এবং ইলোরা। সামিন খেতে শুরু করে। ইলোরা বলে,"যা শুনেছি তাই তো দেখছি সত্যি। তুই এটা কি বিয়ে করেছিস?"
সামিন চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। ইলোরা ধ'ম'কে'র সুরে বলে,"এখন আমাকে মির্জা বাড়ির ছেলেদের শিখিয়ে দিতে হবে কিভাবে বৌ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়?"
সামিন খাওয়া রেখে ইলোরার দিকে তাকায়। ঠান্ডা গলায় বলে,"আমি কাউকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাই না দাদী।"
_তো এটাকে দিয়ে কি করবি? সংসারে মন নেই, অহংকারী,দেমাগী মেয়ে, তোকে দামই দেয়না।
_বৌ আমার থাকবে কি থাকবে না সেই নিশ্চয়তা নেই আর তুমি বলছো দাম দেওয়ার কথা!
ইলোরা সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সামিন হেসে ফেলে। ইলোরার দিকে তাকিয়ে বলে,"সংসারে মন লাগানোর টিপস দাও তুমি। এক কাজ করো আবার আসার সময় তোমাদের বাড়ির ওখান থেকে তাবিজ নিয়ে এসো আমার বৌয়ের জন্য, সংসারে মন লাগিয়ে দাও আমার বৌয়ের। যাতে আমাকে ছে'ড়ে না চলে যায়।"
কথাটি বলে সামিন হাসতে থাকে।
ইলোরা গম্ভীর কন্ঠে বলে,"ফা'জ'লা'মি করিস না। তাবিজ লাগবে না। এসব তে'জী মেয়েদের শুরুতেই কোমড় ভে'ঙে দিতে হয়। তাহলেই সংসারে মন লেগে যায় এদের। শুরুতেই পায়ে শিকল পরিয়ে দিলে আর পালাতে পারে না।"
সামিন খেতে খেতে বলে,"তা কিভাবে? এই শিকল টা আবার কি?"
_একটা বাচ্চা দিয়ে দে পেটে। দেখবি সংসারে মন না লেগে কই যায় !
কথাটা শুনে বি'ষ'ম খেয়ে যায় সামিন। কাশতে কাশতে হতভম্ব হয়ে ইলোরার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ঘুমন্ত আলোর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার গায়ে চাদরটা টেনে দিতে যায় সামিন। হুট করে আলোর ঘুম ভেঙ্গে যায়। সামিনকে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়ে ধরফরিয়ে উঠে বসে।
সামিন হাত থেকে চাদরটা ফেলে রেখে বলে,"এতো ঘুম পাতলা মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। তুমি নাইট গার্ডের চাকরি নিলে পারো।"
আলো চাদরটার দিকে একপলক তাকিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"ওটা দিয়ে কি করতে চাচ্ছিলেন?"
_তোমায় চাদর চা'পা দিয়ে মে'রে ফেলতে চাচ্ছিলাম।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন।
আলো শাড়ির আঁচল টে'নে নিজেকে জরিয়ে নিয়ে বলে,"সেটা আপনি করতেই পারেন। আপনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্র'তি'হিংসা'প'রা'য়'ণ'তা।"
সামিন শীতল চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলে,"কি? এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? এই বংশের ছেলেদের কেচ্ছাকাহিনী আমি কিছু জানিনা ভেবেছেন? অধিকাংশ ছেলেই তো দুই তিনটা করে বিয়ে করেছে, কোনো না কোনো বৌকে মে'রে'ছে।"
_এসব কথা কে বলেছে তোমায়? তারা কি খু'ন করার সময় সাথে থাকতো আমাদের বংশের ছেলেদের?
_যা রটে তার কিছু তো ঘটে।
_যে আমলের কথা বলছো সে আমল ঘুনে ধরেছে। এখন তো হাত না তুললেও তোমরা মেয়েরা স্বামীর নামে বানিয়ে মা'ম'লা ঠুকে দাও, নারী হওয়ার সুবিধা নাও।
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলে,"উঠে পরেছো ভালো হয়েছে। দাদী এমনিতেও বেশ কয়েকবার তোমাকে ডেকে গিয়েছে।"
_উনি কেনো ডেকেছে?
_তা তো আমি জানি না। গিয়ে দেখো।
_আমি যাবো না।
_আগামী বিশ দিন তুমি এই বাড়িতে আছো,তো এ বাড়ির বৌয়ের মতো থাকো। বেশি ঘাড় ত্যাড়ামি না করে যাও নয়তো কোলে করে দিয়ে আসবো।
আলো কিছুক্ষণ সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। এবার আমিও আপনাকে একটা কথা মনে করিয়ে দেই ইয়াসার মির্জা, আপনার চেয়ে নেওয়া একমাসের আর বাকি আছে মাত্র বিশ দিন । এবং আপনার প্রতি আমার অনূভুতি একটুও বদলায় নি। একটুও না।"
কথাটি বলে আলো ওয়াশ রুমে ঢোকে। সামিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেখান থেকে চলে যায়।
***
"আজ ইহানকে পড়াতে আসলে না কেন?"
_চাকরীর ইন্টারভিউ ছিলো। একটা বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে। রিতু ভাবীকে তো বলেছি।
ইশিতা চুপ করে থাকে। শান্ত ফোনের ওপাশ থেকে বলে ওঠে,"তোমাকে বলিনি বলে মাইন্ড খেয়েছো?"
_নাহ।
একশব্দে জবাব দেয় ইশিতা। তারপর বলে,"ইন্টারভিউ কেমন ছিলো? টিকবে?"
_বুঝতে পারছি না। মনে তো হচ্ছে টিকে যাবো।
ইশিতা চুপ হয়ে শুনতে থাকে শান্তর বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে ইন্টারভিউয়ের অভিজ্ঞতা। পেছনে সামিন এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল করেনি।
"ইশু"
ভাইয়ার কন্ঠস্বর শুনে চ'ম'কে উঠে হাত থেকে ফোন ফেলে দিয়ে গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সামিন বোনের ভী'ত স'ন্ত্র'স্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে,"প্রবলেম কি? ভ'য় পেলি কেনো এভাবে?"
ইশিতা তোতলাতে তোতলাতে বলে,"হুট করে এলে তো। তাই ভাইয়া। বলো কি বলবে।"
সামিন বলে,"একটা অত্যন্ত জরুরি কথা বলতে এসেছি। তোর বিয়ের ব্যাপারে।"
_আমার বিয়ে?
হা করে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ইশিতা। সামিন বলে,"হ্যা।"
ইশিতা চোখ মুখ কুঁচকে বলে,"ইশমামকে রেখে আবার আমাকে নিয়ে পরলে কেনো ভাইয়া? আমি তো কোন ছেলের জন্য স্লি'পিং পি'ল'স খাইনি!"
সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"ডাক্তার রাসেল, আমার হাই স্কুলের ক্লাসমেট। সেদিন হসপিটালে তোকে দেখে পছন্দ করেছে। কথায় কথায় আজ বললো। সেও বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছিলো আর বাবাও তোর বিয়ের কথা বললো। খুব ভালো ছেলে রাসেল। আমাদের গোটা স্কুলে একটা ভদ্র ছেলে থাকলে সেটা ছিলো ও।"
_হসপিটালে ডাক্তারি করা বাদ দিয়ে মেয়ে মানুষ পছন্দ করে বেড়ায় সে ভদ্র? কেনো ভাইয়া আমাকে এই উটকো ঝামেলায় জড়াচ্ছো। বলছি তো বিয়ে করবো না এতো তাড়াতাড়ি। ধূর!
ইশিতা ভাইয়ের ওপর রাগ দেখিয়ে চলে যায় নিজের ঘরে। সামিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। আলো ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।আলোর পায়ের প্লাস্টার খুলে ফেলা হয়েছে গতকাল।
সামিন দাঁড়িয়ে পরে,"ক্রাচ কোথায় তোমার?"
_ওটার আর প্রয়োজন নেই। খুড়িয়ে খুড়িয়ে বেশ হাঁটতে পারি। ওটা একটা বোঝা।
আলো হাঁটতে থাকে। সামিন আলোর পিছু পিছু আসে। আলো গম্ভীর কন্ঠে বলে,"পিছু পিছু আসছেন কেনো?"
_তুমি আগে আগে যাচ্ছো তাই।
আলো চুপ হয়ে যায়। সামিন বলে,"প্লাস্টার খুলে ফেলার সাথে সাথে নিজের আগের রূপ ধারণ করেছো দেখছি। রয়ে সয়ে হাটো। আবার পরে.........."
সামিন কথাটা বলে শেষ করতে পারে না আলো পুনরায় হোঁ'চ'ট খেয়ে পরে যেতে নেয়। সামিন খ'প করে ধরে ফেলে আলোকে। আলো বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। এক মিনিট পর নিজেকে ধাতস্থ করে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় আলো। সামিন বলে,"এইবার পরে গেলে বেশ হতো, বাম পা-টাও ভেঙে হুইল চেয়ারে বসে থাকতে। আগামী ছয় মাসের জন্য যেতে পারতে না কোথাও স্বামীর বাড়ি ছেড়ে। আমার ধরাটা উচিত হয়নি। আসো তোমাকে ধা'ক্কা মে'রে ফেলে দেই।"
আলো এক মিনিট চুপ করে থেকে অতি সাবধানে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। পায়ের গোড়ালিতে এখনো বেশ য'ন্ত্র'না হয় তার। ধীরে ধীরে নেমে লিভিং রুমে দাঁড়ায়। ইলোরা মির্জার ব্যাগ পত্র গুছিয়ে রাখা লিভিং রুমে,আজ সে চলে যাবে। আলো ধীরপায়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,"আমাকে ডেকেছিলেন।"
ইলোরা মির্জা আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"হু। আমি আজ চলে যাচ্ছি। তোমাদের বেশি সময় দিতে পারলাম না।"
আলো মনে মনে বলে,"কে চেয়েছে আপনার সময়? আপনি কে'টে পরুন।"
ইলোরা নিজের পার্স ব্যাগ থেকে একটা স্বর্নের চেইন বের করে। আলো কিছু বুঝতে পারছে না। সামিন গিয়ে আলোর পেছনে দাঁড়ায়। ইলোরা আলোকে চেইনটা পরিয়ে দিতে দিতে বলে,"বৌ দেখা উপহার। যদিও তোমাকে আমার পছন্দ হয়নি খুব একটা। তবুও নাতীর মুখের দিকে তাকিয়ে দিলাম।"
আলো ইলোরার দিকে তাকিয়ে আছে। ইলোরা বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে সামিনের দিকে তাকায়। তারপর বলে,"শি'ক'ল পরানোর বিষয়টা মাথায় রাখিস সামিন। সময় থাকতে শি'ক'ল পরিয়ে দে। ওটাতেই কাজ হবে।"
আলো কিছু না বুঝে একবার সামিন আর একবার ইলোরার দিকে তাকায়। সামিন হেসে ইলোরাকে বলে,"সে দেখা যাবে। তুমি চাপ নিও না দাদী।"
ইলোরা কে বিদায় জানিয়ে ঘুরে দাড়াতেই দেখে আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"কাকে শি'ক'ল পরানোর কথা বলছিলো আপনার দাদী?"
সামিন থতমত খেয়ে যায়,বলে,"সেটা আমার এবং দাদীর কথা তুমি নাক গলাচ্ছো কেন?"
_আপনাদের বংশের মেয়ে গুলোও আপনাদের থেকে কম না কোনো অংশে। কথাবার্তা, চালচলন সব ক্রি'মি'না'ল'দে'র মতো।
_ইশিতাও কি সেরকম?
সামিন আলোকে প্রশ্নটা করে সরাসরি আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো নরম গলায় বলে,"না। ইশিতা আপু ওরকম না। ঐ একজনই ব্যাতিক্রম।"
_আমার ছোটো ভাই ইশমামও ব্যাতিক্রম। এসব পলিটিক্স, মা'র'পি'ট,গু'ণ্ডা'মি থেকে সবসময় দূরে থাকে। ওর সাথে মিশলে বুঝতে কি চমৎকার একটি ছেলে।
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে সামিনের কথাটা শোনে। সে আর কোনো কথা বাড়ায় না।
***
দুপুরে সবাই একসাথে খাবার টেবিলে খেতে বসেছে। ইমতিয়াজ মির্জা বাদে টেবিলে বাড়ির সবাই রয়েছে অথচ পুরো ডাইনিং রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ পরপর শুধু চামচের ঠো'কা'ঠু'কি'র শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছু সময় পরে ইলহাম সামিনের সাথে বাড়ির ব্যাবসার আলাপ জুড়ে দেয়। ইশমামকেও সে শুনতে তাগাদা দেয় কিন্তু ইশমাম কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। রিতু কয়েক লোকমা খেয়ে প্লেট সরিয়ে রাখে। তার একেবারেই খেতে ইচ্ছে করছে না,খুব ব'মি পাচ্ছে। আলো একপলক রিতুকে দেখে না চাইতেও নিচু স্বরে বলে ফেলে,"তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে রিতুর দিকে তাকায়। ইলহাম তাকিয়ে থাকে রিতুর দিকে। রিতু আলোকে বলে,"না ভাবী,মাথা ঘুরছে শুধু।"
কথাটা শেষ করতে পারে না রিতু,ভি'ড়'মি খেয়ে পরে যেতে নিলে আলো খপ করে রিতুকে ধরে।
এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। ফুলির মা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। পরী হাসি হাসি মুখ করে বলে,"কোথায় বাড়ির সবাই?"
_খাচ্ছে পরী আপা, ডাইনিং রুমে যাও।
পরী হেটে ডাইনিং রুমে গিয়ে দাঁড়ায়। তার হাতে একটা ফাইল। সামিন মাথা ঘুরিয়ে পরীকে দেখে বলে,"ডাক্তার আপা হঠাৎ এলি যে।"
পরী মুচকি হেসে বলে,"আজ মেজো ভাইয়ার কাছে এসেছি। মিষ্টি খেতে।"
ইলহাম অবাক হয়ে বলে,"আমার কাছে? কি হয়েছে?"
_ভাবীর টে'স্টের রিপোর্ট নিয়ে এসেছি। ইহানের ছোটো ভাই-বোন আসতে চলেছে ভাইয়া।
ইলহাম থমথমে মুখ নিয়ে রিতুর দিকে তাকায়। রিতু তার স্বামীর দিকেই তাকিয়ে আছে।
সামিন কিছুক্ষণ পর মৃদু হেসে বলে ওঠে,"ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও রিতু।"
ইশিতা এবং ইশমাম ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,"কংগ্রাচুলেশন ভাইয়া।"
ইলহাম শুকনো একটা হাসি দিয়ে প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে পরে। ইশিতা পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,"খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? খেতে বস!"
পরী একটা মুচকি হাসি দিয়ে ইশমামের দিকে একপলক তাকিয়ে ইশিতাকে বলে,"না আপু। পরে।"
***
দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ইলহাম রিতুর দিকে তাকায়। রিতু বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। মাথাটা নিচু করে রেখেছে সে। ইলহাম এগিয়ে যায়। গিয়ে বিছানার একপাশে বসে। রিতু মাথা তুলে ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,"আপনার সন্তান। আপনার যেটা ইচ্ছে হয় করতে পারেন। আমার কোনো মতামত নেই।"
ইলহাম রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"ওষুধ ঠিক ঠাক মত খাওনি কেনো?"
অনেকটা চ'ড়া গলায় বলে ইলহাম। রিতু ছলোছলো চোখে ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,"এক বছর পরে যখন তা'লা'ক দিয়ে দেবেন তখন বৌয়ের কাছে আসার কি দরকার ছিলো? বৌয়ের কাছ থেকে যা পান তা তো আপনার ঐ র'ক্ষি'তা'ই আপনাকে দেয়। গাছেরও খাবেন তলারও কুড়াবেন তাই না!"
_শাট আপ রিতু। একেবারে তেজী গলায় কথা বলবে না। মেয়েদের তেজী গলায় কথা আমি পছন্দ করি না জানো তুমি।
_সেটা বৌয়ের বেলায় শুধু, র'ক্ষি'তা'র বেলায় ঠিকই পছন্দ করেন । ওসবই ভালো লাগে আপনার।
ইলহাম চোখ রাঙিয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে আছে,বলে,"গলায় বেশ জোর এসেছে দেখছি। এসব কে শেখাচ্ছে তোমায়? তোমার বড় জা? ঐ বে'য়া'দ'ব মেয়েটা?"
রিতু তার জবাব না দিয়ে বলে,
_আপনার সন্তানকে আপনি চাইলে মে'রে ফেলতে পারেন । আপনি চাইলে ইহানকেও মে'রে ফেলুন। এমনিতেও ওরা আপনার ভালোবাসায় হয়নি। ওরা আপনার ভো'গ এবং আমার অসহায়ত্বের ফসল। ওদের মে'রে দিন, তারপর আমাকে তা'লা'ক দিয়ে আপনার র'ক্ষি'তা'কে হালাল বানিয়ে সংসার করতে একটুও অসুবিধে হবে না ইলহাম মির্জা!
রিতুর কন্ঠে কিছু একটা ছিলো। ইলহাম রিতুর দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শার্ট পাল্টে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
***
"কিহ! রিতু প্রে'গ'ন্যা'ন্ট!"
চেঁচিয়ে ওঠে জুই। ইলহাম বলে,"হু। আজ রিপোর্ট হাতে এসেছে।"
_এটা ওর চাল ইলহাম। এইসব গ্রামের মেয়েদের আমার ভালো করে জানা আছে, যেই বুঝতে পেরেছে তুমি ওকে ছে'ড়ে দিতে পারো অমনি আরেকটা বাচ্চা নিয়ে ফেলেছে। চাল'বাজ মেয়ে কোথাকার!
_শাট আপ জুই। চাল'বাজ বলবে না,রিতু খুবই সহজ সরল একটি মেয়ে।
জুই ইলহামের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে ওঠে,"বৌয়ের নামে আজকাল কিছু বললেই ধ'ম'কে উঠছো দেখছি! ভালোবাসা জন্মে গিয়েছে নাকি?"
ইলহাম কিছু বলে না। জুই ইলহামের কাছে এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চে'পে বলে,"সাফ সাফ বলো, তুমি আমাকে চাও কি চাওনা।"
_চাই।
একশব্দে বলে ইলহাম। জুই বলে,"ঠিকাছে। তাহলে ওর এ'ব'র'শ'ন করাও। আমি দুইটা বাচ্চা পালতে পারবো না।"
ইলহাম জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমার বাচ্চা আমি মে'রে ফেলবো? তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো?"
_তাহলে কি করতে চাও? শোন ইলহাম,হয় আমায় ছে'ড়ে দেবে নয়তো বাচ্চা এ'ব'র'শ'ন করাবে। তোমার কাছে দুটো অপশন। তিনবছর ধরে আমি অপেক্ষা করছি। বলেছিলে ইহান একটু বড় হলে রিতুকে ছেড়ে দেবে। এখন আরেকটা ঝামেলা তৈরি করে বসে আছো,যত্তসব!
ইলহাম চুপচাপ বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না সে কি করবে। ম'রে গেলেও সে নিজের বাচ্চা মে'রে ফেলতে পারবে না, এতটা হৃদয়হীন সে নয়, অন্যদিকে জুঁইকে ছেড়ে দিতে হবে। এখন ইলহাম কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না!
***
রিতু কাঁ'দ'ছে। একটু পর পর শরীরটা কাঁপছে তার। আলো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। এই মেয়েটা এভাবে কাঁ'দ'ছে কেন! এতো বড় সুসংবাদ পেয়েও কাঁ'দ'ছে কেন মেয়েটা!
সামিন নিজের বিছানায় গা এলিয়ে শুয়েছিলো। আলোকে দেখে দ্রুত উঠে বসে, তারপর বলে,"সরি! আমি উঠছি, তুমি বিশ্রাম নাও।"
আলো তার উত্তর না দিয়ে বলে,"আপনার ভাইয়ের বৌ কাঁদছে। আপনার চরিত্রবান ভাই একটা প্রে'গ'ন্যা'ন্ট মেয়েকে কষ্ট দিতে পর্যন্ত ছাড়ছে না। এখন আপনি কি বলবেন ইয়াসার মির্জা?"
সামিন হা হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,"রিতু কাঁদছে?"
_হু।
_কেন?
_আপনার ভাই তার এ'ব'র'শ'ন করাবে। তাকে একবছর রেখে তালাক দিয়ে পর'কীয়া প্রেমিকাকে বিয়ে করবে আপনার ভাই।
তেজী কন্ঠে আলো বলতে থাকে। সামিন বিছানা থেকে নেমে দ্রুত পায়ে হেঁটে ইলহামের ঘরের দিকে যায়।
রিতুকে ইশিতা ধরে রেখেছে। হুট করে সামিন ঘরে ঢুকে পরতেই রিতু চোখের পানি মুছতে ব্যাস্ত হয়ে পরে।
সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"মেয়েটি কে?"
রিতু চুপ করে থাকে। সামিন ধ'ম'ক দিয়ে বলে,"মেয়েটি কে রিতু!"
_এমপির ভাগ্নি। জুই।
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে রিতু।
_আমার সাথে শুরুতেই তোমার বলা উচিত ছিলো রিতু।
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"ভাইকে অ'ন্ধে'র মতো বিশ্বাস করা মানুষ কি করতো? রিতুকেই চুপ করিয়ে রাখতেন।"
সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে ফোন বের করে ইলহামকে ফোন লাগায়। ওপাশ থেকে ইলহাম ফোনটা রিসিভ করতেই সামিন বলে ওঠে,"কোথায় তুই?"
ইলহাম আমতা আমতা করে বলে,"একটা কাজে এসেছি ভাইয়া। কেনো?"
_তুই যেখানেই থাকিস আগামী এক ঘন্টার মধ্যে আমার সামনে আসবি ইলহাম।
ইলহাম অবাক হয়ে বলে,"কেনো ভাইয়া?"
সামিন সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেয়। তারপর রিতুকে বলে,"এখানে বিশ্রাম করবে তুমি। ওদিকে যাই হয়ে যাক বের হবে না।"
***
ইলহাম চিন্তিত ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ি শান্তিনীড়ের ভেতরে প্রবেশ করলে গাড়ি থামিয়ে সে নেমে পরে। হেটে লিভিং রুম পেরিয়ে সোজা দোতলার সিঁড়ির দিকে যায়। দোতলার লিভিং রুমে সামিন দাঁড়িয়ে আছে। খানিকটা দূরে আলো এবং ইশিতা দাঁড়িয়ে। তাদের পাশেই ইশমাম।
ইলহাম এগিয়ে গিয়ে বলে,"ভাইয়া কি হয়েছে....."
সামিন কিছু না বলে স্ব-শব্দে ইলহামের গালে এক চ'ড় বসিয়ে দেয়।
সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইমতিয়াজ মির্জা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
ইলহাম হতভম্ব ভাব নিয়ে বলে,"তুমি আমাকে মা'র'লে ভাইয়া?"
_জুইয়ের সাথে কি তোর?
ইলহামের মুখ শুকিয়ে যায় জুঁইয়ের নাম শুনে।
সামিন চেঁচাতে থাকে,"বলছিস না কেনো? জুঁইয়ের সাথে কি?"
_কিছু না ভাইয়া।
_কিছু না?
_না।
সামিন পুনরায় একটা চ'ড় বসিয়ে দেয় ইলহামের গালে। ইলহাম চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"তুমি আমাকে সন্দেহ করে আমার গায়ে হাত তুলছো? তাও আমার ছোটো ভাই বোনের সামনে? তোমার বৌয়ের সামনে?"
_হ্যা তুলছি। তুই যা করেছিস তাতে এটাই তোর উপযুক্ত শা'স্তি।
ইলহাম আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে ভাইকে বলে,"কে দিচ্ছে তোমায় এসব বুদ্ধি? ওই মেয়েটা তাই না? আসার সাথে সাথে ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক ন'ষ্ট করে দেওয়ার ফ'ন্দি এঁটেছে।"
সামিন ইলহামের কলার ধরে বলে,"ও তোর ভাবী। সম্মান দিয়ে কথা বলবি।"
আলো সামিনের দিকে তাকায়। ইশমামও ভাইকে দেখে।
ইলহাম ভাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ম্লান হাসে। তারপর নিজের কলার থেকে ভাইয়ের হাত ছাড়িয়ে দিতে দিতে বলে,"জুঁইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক আছে। এবং আমি তাকে বিয়ে করবো।"
চেঁচিয়ে বলতে থাকে ইলহাম। নিজের ঘর থেকে ইলহামের সব কথা শুনছে রিতু। তার দু'চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পরছে।
সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ইলহামকে ধা'ক্কা দিয়ে বলে,"বের হ এবাড়ি থেকে। এক্ষুনি!"
ইলহাম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"ভাইয়া!"
_আর কখনো যেনো আমি তোকে এই বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি। এক্ষুনি বের হ।
ধা'ক্কা'তে ধা'ক্কা'তে ইলহামকে দোতলার সিঁড়ির কাছে নিয়ে আসে সামিন।
ইলহাম কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে,"তুমি কে বের করার আমাকে?"
সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"আমিই সব। তুই বের হ ইলহাম।"
"তুমি আমার বাবাকে মা'র'ছো কেনো বড় বাবা? বাড়ি থেকে কেনো চলে যেতে বলছো?"
ইহান দূরে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। সামিন এগিয়ে গিয়ে ইহানকে কোলে তুলে নেয়। তারপর নরম গলায় বলে,"তুমি তোমার ফুপির কাছে যাও বাবা। এখানে বড়রা কথা বলছে।"
সামিন ইশিতার দিকে তাকাতেই ইশিতা এসে ইহানকে নিয়ে চলে যায়।
সামিন অগ্নি'দৃষ্টি দেয় ইলহামের দিকে। ইলহাম একপলক ইমতিয়াজ মির্জার দিকে তাকায় তারপর সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"কি ভেবেছো তোমরা? তোমরা ছাড়া আমি অচল? আমার কোনো মুরোদ নেই? থাকবো না এই বাড়িতে আমি। সবসময় তোমার কথা শুনে চলতে হবে ভাইয়া? আমি কাউকে ভ'য় পাই না। থাকবো না এই বাড়িতে।"
ইলহাম হনহন করে সিঁড়ি ভে'ঙে নিচে নামে। সামিন তার যায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরে ইলহামের গাড়ি স্টার্ট হবার শব্দ শোনা যায়। সামিন সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। ইমতিয়াজ মির্জা তার ঘরে ঢোকে।
***
শান্তিনীড়ের পরিবেশ এখন থমথমে হয়ে আছে। রিতু নিজের ঘরে শুয়ে আছে চুপচাপ। কাঁদতে কাঁদতে শরীরটা তার নি'স্তে'জ হয়ে গিয়েছে। ইহান তার ফুপির কাছে। সামিন নিজের ঘরে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিলো। মেজাজ যথেষ্ট বি'গ'ড়ে রয়েছে তার। এখন অফিসের একাউন্ট্যান্টসকে মেসেজ করে দিচ্ছে ইলহামকে যাতে কেউ কোন টাকা না দেয়। কিছুক্ষণ পরে ল্যাপটপ বন্ধ করে বারান্দার দিকে তাকায় সে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে বাইরে। বারান্দায় আলোর শাড়িটা মেলে দেয়া ছিলো। শুকনো শাড়িটা এভাবে ভিজে যাবে দেখে সামিন এদিক ওদিক তাকায়। ঘরে আলো নেই। ল্যাপটপ সরিয়ে রেখে সে নিজেই উঠে পরে বারান্দায় যায় শাড়িটা তুলে নিতে। শাড়িটা দ্রুত তুলে নিতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলো কিছু একটা নিচে পরে গিয়েছে। সামিন নিচে তাকাতেই তার চোখ মুখ ফ্যা'কা'শে হয়ে যায় লজ্জায়। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরছে,তার ভেতরেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। বোকার মতো মেয়েদের জিনিসে হাত দেয়া তার উচিত হয়নি এভাবে। কিন্তু সে কিভাবে জানবে মেয়েরা শাড়ির নিচে তাদের ব্যাক্তিগত পোশাক শুকাতে দেয়। নিচে পরে থাকা বস্তুটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে শাড়িটা জায়গামতো রেখে দেয়। যার জিনিস সে এসে নিয়ে যাবে। ভিজুক।
সামিন শাড়িটা দড়িতে রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে বারান্দার দরজার কাছে দাড়িয়ে আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে ক্ষো'ভ। সামিন একটা ঢোক গিলে ফেলে। তার ৬ষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে এক্ষুনি যু'দ্ধ লেগে যাবে।
হয়েছেও তাই। খুড়িয়ে খুড়িয়ে আলো এসে তার জিনিসপত্র তুলে নিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,"অ'স'ভ্য, অ'ভ'দ্র, জ'ঘ'ন্য,ফা'ল'তু লোক। কোন সাহসে আপনি আমার পোশাকে হাত দিয়েছেন। নূন্যতম কমনসেন্স নেই?"
সামিনের লজ্জার সীমা রইলো না। কেন যে সে আগ বাড়িয়ে শাড়িটা তুলতে এলো।
সে আলোকে সরি বলতে যাবে তার আগেই আলো তার দিকে এগিয়ে এসে তার বুকে এলোপাথাড়ি কি'ল ঘু'ষি মে'রে চেঁচাতে থাকে,"অ'স'ভ্য লোক,কোন সাহসে আমার জিনিসে হাত দিয়েছেন। জ'ঘ'ন্য লোক কোথাকার। ফা'ল'তু লোক!"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ভীষণ ক্ষে'পে গিয়েছে মেয়েটা। সে নরম গলায় বলে,"মারছো কেনো আমাকে আলো। আমি বুঝতে পারিনি। দেখছিলাম তোমার শাড়িটা ভিজে যাচ্ছে তাই....."
আলো সামিনের কোনো কথা শোনে না। একটা ধাক্কা দিয়ে সে নিজের পোশাক নিয়ে ঘরের ভেতর চলে যায়। রা'গে তার গা কাঁপছে।
সামিন বোকার মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"আমার দোষ টা কোথায়?"
আলো তার পোশাক আলমারিতে তুলে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"যুগে যুগে ভদ্রলোকেরাই দোষের ভাগীদার হয়েছে। এটা আবারো প্রমানিত!"
হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে ফুয়াদের নাম্বার দেখে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে, ফুয়াদ বলে,"একবার বটতলা আসবি? আড্ডা দিতাম। কি করছিস তুই?"
_বৌয়ের হাতে মা'র খেলাম।
_মানে?
_মানে এতদিন সবকিছু গালাগাল পর্যন্ত ছিলো,আজ গায়ে হাত তুললো। উপকার করতে গিয়ে আজ এত্তোবড় একটা বাঁশ খেয়েছি।
ইলহামকে দেখে দরজা থেকে জুঁই সরে দাঁড়ায়। ইলহাম ক্লান্ত ভঙ্গিতে ভেতরে ঢোকে। তার মাথাটা ভীষণ ধরেছে। সোজা গিয়ে জুঁইয়ের বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পরে সে। জুঁই দরজা বন্ধ করে ইলহামের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,"গিয়ে আবার ফিরে এলে যে, কি হয়েছে বাড়িতে, তোমার ভাই কেনো ডেকেছিলো?"
_বাড়ি থেকে লা'থি মে'রে বের করতে ডেকেছিল।
নিচু স্বরে বলে ওঠে ইলহাম।
জুই বিছানার একপাশে বসে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"হোয়াট!"
_বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে।
জুঁইয়ের মুখে হাসি ফোটে। সে নিজের খুশি প্রকাশ না করে বলে,"দিক। যেয়ো না আর ও বাড়িতে! তোমার সম্পত্তি তুমি বুঝে নিয়ে ওদের সাথে সম্পর্ক শেষ করে দাও।"
ইলহাম চিৎ হয়ে শুয়ে জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"সম্পত্তি? কিচ্ছু পাবো না আমি,ভাইয়া সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে।"
জুই যেন আকাশ থেকে পরলো। হতবাক হয়ে বলে,"মানে টা কি?"
ইলহাম জুঁইয়ের কথার উত্তর না দিয়ে কন্ঠে এক রাশ হতাশা নিয়ে বলে ওঠে,"ইহানের জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব। ওর কথা মনে পরছে। রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি,এখন যাবো কি যাবো না ভাবছি।"
জুই প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে যায়। সে তার বিরক্তি প্রকাশ না করে বলে,"এখন? তোমাকে বলেছে সম্পত্তি দেবে না আর তুমি মেনে নিলে? অদ্ভুত!"
ইলহাম উঠে বসে, জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"আমি আমার ছেলেটার জন্য কষ্ট পাচ্ছি আর তুমি সম্পত্তি নিয়ে পরে আছো? আচ্ছা একটা কথা বলো তো জুঁই আমাকে নাকি আমার সম্পত্তিকে,কোনটাকে তুমি বেশি প্রায়োরিটি দাও?"
জুই থতমত খেয়ে বলে,"অবশ্যই তোমাকে। আমি তো তোমার ভালোর জন্য বলছিলাম।"
_আমাকে যদি প্রায়োরিটি দিতেই তাহলে আমার সন্তানকেও প্রায়োরিটি দিতে, তোমার কন্ঠে সবসময় ইহানের জন্য তুচ্ছ তাচ্ছিল্য দেখি। এসব আমি বরদাস্ত করবো না জুঁই।
জুই নরম সুরে বলে,"তুমি ভুল ভাবছো ইলহাম। আই এ্যাম সরি।"
ইলহাম বলে,"ঠিকাছে, আমার মাথাটা বেশ ব্যাথা করছে। চুল গুলো একটু টেনে দাও মাথার। কপাল টা একটু মাসাজ করে দাও।"
জুই একবার নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ইলহামের দিকে তাকিয়ে আহ্লাদী গলায় বলে,"আমি এই মাত্র নেইলপলিশ লাগিয়েছি ইলহাম। তোমাকে ওষুধ এনে দেই মাথা ব্যাথার?"
ইলহাম জুঁইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,"কিছু লাগবে না। তুমি আমার সামনে থেকে যাও!"
***
"বড় বাবা"
ইহানের ডাকে সামিন পিছু ফিরে তাকায়। ইহান তার কাছে এগিয়ে আসে। সামিন ইহানকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,"কি হয়েছে বাবা?"
_বাবা কখন আসবে বড় বাবা? বাবাকে কেনো বের করে দিলে বাড়ি থেকে?
সামিন কিছুক্ষণ ইহানের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,"তুমি যখন কোনো দুষ্টুমি করো তখন তোমার টিচার তোমাকে কিছু সময়ের জন্য ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে না ?"
ইহান মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,"তোমার বাবাও একটু দুষ্টুমি করেছে তাই তাকে একটু খানি শা'স্তি দিয়েছি।"
_বাবা কি দু'ষ্টু'মি করেছে? কারো পেন নিয়ে নিয়েছে? কাউকে খুঁ'চি'য়ে'ছে?
সামিন মাসুম বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি উত্তর দেবে? ইশিতা এসে দাঁড়ায় সেখানে। ইহানকে বলে,"চলো আমার ঘরে চলো। আমার কাছে ঘুমোবে আজ।"
_আমি মাম্মার কাছে ঘুমাবো।
সামিন ইহানের গালে হাত রেখে বলে,"মাম্মা অ'সু'স্থ সোনা। তুমি ফুপির সাথে যাও প্লিজ।"
ঘরে ঢুকে একটা দৃশ্য দেখে সামিন থ'ম'কে যায়। আলো জায়নামাজে বসে আছে।
সামিন দাঁড়িয়ে থাকে। সামনে যে দৃশ্যটি সে দেখছে এটা সম্ভবত তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর এবং চক্ষুশীতল করা একটা দৃশ্য। মাকেও সে এভাবে জায়নামাজে বসে থাকতে দেখতো। মায়ের চুড়ি পরা হাতে যে মেয়েটি মোনাজাত ধরে আছে, তার হাত দুটো অবিকল সামিনের মায়ের মতো, গোলগাল। মনে হচ্ছে সামিনের মা হোসনে আরা শান্তিই মোনাজাত ধরে বসে আছে। মাথায় তার লম্বা একটা ঘোমটা।
দীর্ঘসময় সামিন আলোকে দেখতে থাকে। নামাজ শেষ হলে আলো জায়নামাজ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জায়নামাজ ভাঁজ করে ঘুরে দাড়াতেই দেখে সামিন তার দিকে তাকিয়ে আছে।
"এতক্ষণ ধরে কি বলছিলে মোনাজাতে আছিয়া? ফে'রা'উ'নে'র মৃ'ত্যু কামনা করছিলে?"
আলো কয়েক মূহুর্ত সামিনের দিকে তাকিয়ে জায়নামাজ তুলে রাখতে যায়,সামিন হাত বাড়িয়ে আলোর পথ আটকে দেয়। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"বলো না কি বলছিলে মোনাজাতে?"
"ভাইয়া আসবো?"
রিতু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সামিন রিতুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলে,"এসো।"
রিতু ধীরপায়ে হেটে ভেতরে ঢোকে। সামিন রিতুকে বলে,"ডাক্তার ডাকতে হবে তোমার জন্য?"
রিতু মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,"ঠিকাছে। বসো এখানে । বলো কেনো এসেছো?"
রিতু একটা চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে রেখেছে। সামিন বলে,"বলো কেনো এসেছো! কি হয়েছে রিতু?"
রিতু কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,"ওনাকে বাড়িতে আনুন ভাইয়া।"
সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"না।"
রিতু আমতা আমতা করে বলে,"এভাবে তো ভাইয়া কোনো সমাধান হয় না, তাইনা?"
আলো বলে ওঠে,"এই যে মির্জা বাড়ির লক্ষী মেজো বৌমা। তোমাকে আল্লাহ তায়ালা কি দিয়ে গড়েছে একটু বলবে?"
রিতু আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে,"এভাবে কি আমার প্রতি ওনার ভালোবাসা জন্মে যাবে ভাইয়া? আপনি ওনাকে ডেকে আনুন। আমার ওনার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।"
সামিন রিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রিতু বলতে থাকে,"বাচ্চাটা জন্মালে আমি আপনাদের বাড়ির বংশধরদের আপনাদের হাতে তুলে দিয়ে চলে যাবো। আপনার ভাই স্বামী হিসেবে যেমন হোক না কেনো,সে বাবা হিসেবে অনন্য। তার প্রতি আমার কোনো রা'গ নেই।"
_বাজে না বকে যাও রিতু। তুমি বিশ্রাম নাও।
_ভাইয়া এতোটা বাধ্য থেকেও তার মনে যায়গা করে নিতে পারিনি,তার মানে আমি সত্যিই অযোগ্য। ওনাকে আপনি বাড়িতে ডাকুন। আমিই বাচ্চা জন্মালে চলে যাবো। তারপর উনি ওনার বাচ্চাদের নিয়ে পছন্দের নারীর সাথে সুখে থাকুক।
সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"খুব স্বামীর ঘর ছাড়ার কথা বলছো যে, এসব নিজের বড় জায়ের বুদ্ধিতে করছো নাকি? তোমরা বুদ্ধি করে চলে যাচ্ছো সবাই?"
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন আলোকে শুনিয়ে শুনিয়ে রিতুকে বলে,"স্বামীর ঘর ছাড়াও কোনো সমাধান না। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। স্বামী খা'রা'প হলে তাকে শুধরে নিতে হয়। নয়তো নারী কেনো বলা হয়েছে তোমাদের?"
আলোর ইচ্ছে করছে সামিনকে কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দিতে, কিন্তু সে চুপ থাকে। রিতু সামিনকে বলে,"কিভাবে শোধরাবো ভাইয়া? শোধরানোর হলে তো ইহানের জন্মের পরেই শুধরে যেতো।"
সামিন রিতুর মাথায় হাত রাখে,নরম গলায় বলে,"তুমি এই বাড়িতে আসার পর থেকে আমি জেনেছি আমার একটা বোন না, দুটো বোন। বোনের মতো সবসময় খেয়াল রেখেছো আমার। আমার ওপর ভরসা রাখো। আমি আমার বোনের সংসার এভাবে শেষ হতে দেবো না। ওকে না'কা'নি'চো'বা'নি খাইয়ে তবে এ বাড়িতে আনবো। একটু ভুগতে দাও। তোমার গুরুত্ব বুঝতে দাও। আর ঐ মেয়েরও ব্যাবস্থা করবো আমি। ভরসা করো তো আমায়? করো না?"
রিতু মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,"গিয়ে রেস্ট নাও। যাও।"
রিতু চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায়। আলো রিতু আর সামিনকে দেখে। রিতুর প্রতি সামিনের অগাধ সহানুভূতিকে সে বিচার করতে পারছে না। কখনো মনে হচ্ছে সামিন হয়তো এমনই, আবার হুট করেই মনে পরে গেলো রিতু তার বংশের বংশোধর জন্ম দিয়েছে, শুধুমাত্র এই একটা কারনেই রিতুর প্রতি এতটা নরম ভাব দেখাচ্ছে সে! নয়তো ঐ লোকটা তো সামিন ইয়াসার, একটা পি'শা'চ।
রিতু চলে যেতেই সামিন ঘুরে আলোর দিকে তাকায়। আলো চোখ সরিয়ে নিয়ে বিছানায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়।
বিছানা থেকে একটা বালিশ তুলে নিয়ে ডিভানে রেখে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"মশারী টাঙিয়ে নাও। খুব মশা পরছে। আশেপাশে সর্বত্র ডেঙ্গু।"
আলো একপলক সামিনের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁ'চ'কে বলে ওঠে,"শহরের মেয়র শহরে মশা নিধনের ওষুধ দেওয়ার ব্যাবস্থা না করে গু'ন্ডা'মি করে বেড়ায়, ওমুককে উচিত শিক্ষা দেয়, তমুকের থেকে প্র'তি'শো'ধ তোলে, ওমুকের মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে করে, তমুকের জমি দখল করে বেড়ালে শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ তো বাড়বেই।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মূহুর্ত তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"মেয়র তার সব দায়িত্ব পালন করেছে। তারপরও জনগণের সচেতন থাকা জরুরি। মশারী না টাঙিয়ে সবটা মেয়রের ভরসায় ফেলে রাখলে তো চলে না। মেয়র কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনগণের মশারী টাঙিয়ে দিয়ে আসবে এখন?"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন আলমারি থেকে মশারী বের করে সেটা টাঙিয়ে দিতে যায়। আলো সামিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,"প্রয়োজন নেই। নিয়ে যান এটা এখান থেকে, আমি মশারীর ভেতরে ঘুমাতে পারি না।"
সামিন আলোর কথা না শুনে মশারী টাঙাতে থাকে। আলো সামিনের হাত থেকে মশারী টেনে নিয়ে নেয়, চেঁচিয়ে বলে,"বললাম না প্রয়োজন নেই?"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে মশারী টেনে নেয় । আলোও তেজ দেখিয়ে নিজের দিকে টানতে থাকে। এক পর্যায়ে সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"শক্তি দেখাচ্ছো? একটা তুলে আ'ছা'ড় মারবো অবাধ্য মেয়ে।"
_এসব যত্নবান স্বামী হবার নাটক করে আপনার প্রতি আমার অনুভূতি বদলাতে চান? আমি রিতুর মতো মেয়ে নই ইয়াসার মির্জা। কাজ হবে না।
সামিন কয়েক মুহূর্ত আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কাঁচি নিয়ে এসে মশারীটাকে টুকরো টুকরো করে কে'টে ফেলে। আলো দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখে। তারপর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে। সামিন উঠে দাঁড়িয়ে গিয়ে ডিভানে উপুড় হয়ে শুয়ে পরে। রাগে তার কপালের দুপাশের রগ দপদপ করছে।
***
মাথাটা ছিঁ'ড়ে যাচ্ছে ইলহামের। জ্বর এসে গিয়েছে। বিকেল থেকে যখন মাথা ব্যথা করছিলো তখনই সে টের পেয়েছে জ্বর আসতে চলেছে। শরীরের সর্বত্র য'ন্ত্র'না করছে। একটু স্বস্তি পাচ্ছেনা সে। ইহানের সাথে কথা বলতে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলো ইশিতার কাছে। ইশিতা ফোন ধরেনি। বাড়ির কেউই ফোন ধরবে না সে জানে। বাধ্য হয়ে পোনা চাচার নাম্বারে ফোন করে জেনে নিয়েছে ইহানের খবর, রিতুর খবরও জানতে চেয়েছিলো। কেনো জানতে চেয়েছিলো তা ইলহাম বুঝতে পারছে না,রিতুর পেটে তার সন্তান শুধুমাত্র সেজন্যই কি?
ইলহাম সেদিনের কথা মনে করতে থাকে। বাবা মা জোর করে একটা গ্রামের সদ্য ক্লাস টেনে পড়ুয়া মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো। মা বাবার ধারণা ছিলো সুন্দরী,নামাজী, অল্পবয়সী বৌ পেলে ব'খে যাওয়া ইলহাম শুধরে যাবে। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি বরং একটা প্রানবন্ত ফুটফুটে ফুলে কালসিটে পরেছে তার মতো অ'মা'নু'ষে'র হাতে পরে। বিয়ের প্রথম দিন থেকে মাগনা গৃহপরিচারিকা এবং যৌ'ন'দা'সী হিসেবেই ট্রিট করে এসেছে মেয়েটিকে। কখনো উঁচু গলায় কথা বলে প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি মেয়েটি। পেটে ইলহামের দু- দুটো সন্তান ধরেও ফিরে যেতে হবে খালি হাতে, মাঝখানে স্বামীর ভালোবাসা কি সেটাই কখনো বুঝলো না।
কিছুক্ষণ এসব কথা ভেবে ইলহাম চোখ বন্ধ করে ফেলে। জ্বরের তী'ব্র'তা বাড়ছে। ইলহাম খেয়াল করেছে অসুখ বিসুখ হলেই সে ভীষণ অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে। সুস্থ থাকলে অ'মা'নু'ষ হয়ে যায়। ক'ষ্ট দেয় একটা ফুলকে। জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,"জ্বর থাকুক। আজীবন থাকুক।"
মাথা ঘুরিয়ে সে তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা জুঁইকে দেখে। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে ডেকে ওঠে,"জুঁই।"
ঘুমের মধ্যে "হু" বলে সাড়া দেয়। ইলহাম বলে,"জ্ব'র টা একটু মেপে দেখবে?"
জুই উঠে বসে, চোখ ডলতে ডলতে উঠে গিয়ে থার্মোমিটার নিয়ে এসে ইলহামের কপালে ধরে। জ্বর একশো দুই।
ইলহাম কিছুক্ষণ জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"আমি বাড়ি যেতে চাই। এক্ষুনি। এই মুহূর্তে।"
***
গাড়ি থামিয়ে ইলহাম নেমে পরে। সে ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মনে হচ্ছে এক্ষুনি পরে যাবে। রিয়াজ গেইট বন্ধ করে ছুটে এসে বলে,"আপনাকে ধরবো ভাইয়া?"
ইলহাম নিষেধ করে। কলিং বেল টিপে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। সিতারা এসে দরজা খুলে দেয়। রাত তিনটার সময় ইলহামকে দেখে সিতারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ইলহাম তাকে পাশ কাটিয়ে টলতে টলতে সিঁড়ির দিকে যায়। ফুলির মা এসে সিতারাকে ফিসফিসিয়ে বলে,"নে'শা করছে নাকি!"
_কি জানি!
_তাহলে আজ বড় ভাইজান একে মে'রে'ই ফেলবে।
দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হয়। রিতু ভাবলো ইশিতা হয়তো ইহানকে দিতে এসেছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজার সিটকিনি খুলে দেয়। দরজা খুলে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইলহাম লাল দুটো চোখ নিয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত রিতু নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে তার কপালে হাত ছোঁ'য়া'য়। ইলহাম তার স্ত্রীকে দেখতে থাকে। খুবই নিচু স্বরে রিতু বলে ওঠে,"আপনার গায়ে তো বেশ জ্ব'র।"
ইলহাম "হু" বলে ধীরপায়ে হেটে বিছানার দিকে যায়। তারপর ধপ করে বিছানায় উ'পু'ড় হয়ে শুয়ে পরে। রিতু এগিয়ে গিয়ে বলে,"ওষুধ খেয়েছেন? গা তো জ্ব'রে পু'ড়ে যাচ্ছে।"
ইলহাম কোনো উত্তর দেয়না। থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে দেখে একশো তিনের একটু উপরে। এক্ষুনি জ্বর নামানো প্রয়োজন। রিতু প্রায় ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে পরে, সামিনকে ডাকা যাবে না, ভাইয়া যদি ইলহামকে দেখে রেগে যায়! রিতু নিজেই একটা বাটিতে পানি এনে ইলহামের মাথায় জলপট্টি দিতে থাকে। ইলহাম চোখ পিটপিট করে রিতুর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,"দিও না এসব। প্রয়োজন নেই।"
রিতু ইলহামের কোনো কথার জবাব না দিয়ে চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে রিতু বলে ওঠে,"আপনার প্রেমিকা কেনো করে না এসব?"
_সে তো আর আমাকে বিয়ে করে,আমার বাচ্চা পেটে ধরে আটকে যায়নি তোমার মতো। তোমার মতো বেহায়া নয়।
রিতু ইলহামের দিকে তাকায়। ইলহাম নিচু স্বরে বলে,"ইহান কোথায়?"
রিতু বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে,"আপুর ঘরে,আমি নিয়ে আসছি।"
ইলহাম রিতুর হাত টেনে ধরে। রিতু বসে পরে, ইলহামের দিকে তাকাতেই ইলহাম বলে,"দরকার নেই। তুমি দরজা বন্ধ করে এসো। আমি ঘুমাবো।"
ধীরে ধীরে নেমে রিতু দরজা বন্ধ করে ইলহামের পাশে গিয়ে বসে। ইলহাম কাঁপা কাঁপা একটা হাত রিতুর দিকে এগিয়ে দিয়ে তার পেটে হাত রাখে। রিতু চ'ম'কে উঠে তাকায় তার স্বামীর দিকে। ইলহাম নরম গলায় বলে,"আমি এই বাচ্চাটা চাই।"
_জানি। আপনি শুধু আমাকেই চান না।
ঠান্ডা গলায় বলে রিতু। তার কন্ঠে না ছিলো কোনো ক্ষো'ভ,না ছিল কোনো হতাশা।
ইলহাম কিছু না বলে একটা ম্লান হাসি হেসে দেয়। তারপর দু'চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে চুপচাপ।
***
ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই ফুলির মায়ের কাছে ইলহামের বাড়িতে আসার খবর পেয়ে ক্ষে'পে যায় সামিন। রে'গে'মে'গে দোতলায় চলে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে রিতু দরজা খুলে দিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন বিছানায় শুয়ে থাকা ইলহামকে একবার দেখে রিতুকে ধ'ম'ক দিয়ে বলে,"কেনো ঢুকতে দিলে ওকে ঘরে? তোমাকে নিষেধ করেছিলাম না?"
পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বলে,"নে'শা করেছে নাকি বে'য়া'দ'ব টা।"
রিতু সামিনের হাত টেনে ধরে। সামিন রিতুর দিকে তাকায়। রিতু বলে,"ওনার গায়ে খুব জ্ব'র ভাইয়া। সারারাত ছ'ট'ফ'ট করেছে জ্বরে। এই মাত্র ঘুমিয়েছে। দয়া করে কিছু বলবেন না।"
***
দুপুর নাগাদ ইলহামকে হসপিটালে এডমিট করা হয়। জ্বরে অচেতন হয়ে গিয়েছিলো সে। রিতু এবং ইশিতা তার সাথে হসপিটালে আছে।
বিকেলের দিকে টেস্টে ধরা পরে ইলহাম ডেঙ্গু পজিটিভ। তাকে স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে শিফট করা হয়। অবস্থা খুবই গু'রু'ত'র।
বাড়িতে এসে সামিন পুরো বাড়িতে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা খেয়াল করে। ফুলির মা এবং সিতারাকে ডাকতে থাকে সে। কেউ কোনো সাড়া দেয়না। দোতলা থেকে ইশমাম নেমে আসে। সামিন ইশমামের দিকে তাকিয়ে বলে,"কোথায় যাচ্ছিস?"
_হসপিটালে। আমি গিয়ে ইশিতা আর ভাবীকে পাঠিয়ে দেবো। ভাবীও তো অসুস্থ।
_ফুলির মা আর সিতারা কোথায়?
_ফুলির বাবা অসুস্থ,তাই ফুলির মা চলে গিয়েছে। সিতারা নিজেই অসুস্থ। আমি দু'জনকে ছুটি দিয়েছি।
সামিন চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,"কি একটা মুশকিল হয়ে গেলো! ইহানকে কে সামলাবে! বাড়িতে কোনো মেয়ে মানুষ নেই!"
_কেনো, তোমার বৌ!
ঠান্ডা গলায় বলে ইশমাম। সামিন ম্লান হেসে বলে,"হু, তাহলে তো হতোই।"
ইশমাম বলে,"ইহানকে তোমার থেকে ভালো কেউ সামলাতে পারবে না ভাইয়া। ওকে তুমি দেখো। আমি যাচ্ছি। অসুবিধা হলে ফোন দেবো।"
ইশমাম চলে যায়। সামিন ধীরপায়ে হেটে ইমতিয়াজ মির্জার ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে পরে। ঘরের ভেতর ইমতিয়াজ মির্জা ইহানকে বই পড়ে শোনাচ্ছে। সামিন তদের বিরক্ত না করে নিজের ঘরে চলে আসে। দরজার নব ঘোরার শব্দ হতেই আলো নড়েচড়ে বসে। সে একটা বই পড়ছিলো। সামিন ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে আলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আলোর দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,"এটা নাও।"
আলো কপাল কুঁ'চ'কে প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে বলে,"কি এটা?"
_তোমার জন্য একটা ফোন। বাবা মায়ের সাথে কথা বলবে।
_আর মাত্র উনিশ দিন আছি এই বাড়িতে। উনিশ দিনের জন্য কোনো ফোনের দরকার নেই আমার।
সামিন আলোর দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করে প্রচন্ড রা'গ হচ্ছে আলোর উপরে। ঔদ্ধত্যের একটা সীমা থাকে! এই মেয়েটা দিনকে দিন সেটা ক্রস করে ফেলেছে। এত ক্ষমা চাইবার পরেও একটু নরম হবার নাম নেই।
সামিন ফোনটা বিছানার ওপর ফেলে রেখে আলোকে হতবাক করে দিয়ে আলোর হাত ধরে বলে,"চলো।"
আলো বলে,"কোথায়?"
_আগামী উনিশ দিন তো তুমি আমার বৌ? তো আগামী উনিশ দিন তুমি আমার সংসার সামলাবে।
_মানে?
হ'ত'ভ'ম্ব হয়ে যায় আলো। সামিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"রান্না করবে। চলো রান্না ঘরে।"
আলো অবাক চোখে সামিনকে দেখছে। সামিন আলোকে টানতে টানতে নিচতলার রান্নাঘরে নিয়ে আসে। আলো অবাক চোখে শুধু সামিনকেই দেখছে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"ফ্রিজে মাছ,মাংস, সবজি সব আছে। এমন কোনো রন্ধন সামগ্রী নেই যেটা এই রান্নাঘরে পাবে না। তুমি খুজে খুজে বের করে রান্না করবে। ইহানের জন্য সবজি দিয়ে খিচুড়ি, মুরগির মাংস, আমার বাবার জন্য অল্প মশলা পাতি দিয়ে একটা সবজি, তোমার এবং আমার দুজনের জন্য সাদা ভাত এবং যেকোনো একটা মাছ।"
আলো সামিনের দিকেই তাকিয়ে আছে। সামিন আলোর দিকে খানিকটা ঝুকে বলে,"তোমার হাতে সময় সাড়ে তিন ঘন্টা। প্রচুর সময়। কাজে লেগে পরো। আর হ্যা, যদি আজ এসব করতে না পারো তাহলে উনিশ দিন পর আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভুলে যাও। এমন ভাবে এই বাড়িতে আটকে দেবো কখনো যেতে পারবে না আমাকে ছে'ড়ে।"
সামিনের কন্ঠে কিছু একটা ছিলো। আলো ঘা'ব'ড়ে যায়। সামিন আলোর চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে যায় নিজের ঘরে।
আলো থম মে'রে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে,একবার চুলা, একবার ফ্রিজের দিকে তাকায়। তার মাথা ঘুরছে।
***
ঘরে ঢুকে দেয়ালে হাত দিয়ে চা'প'ড় মেরে বিছানার উপর গিয়ে বসে পরে সে। ধীরে ধীরে নিজের রা'গ'টা'কে নিয়ন্ত্রণ করে চুপচাপ বসে থাকে। দীর্ঘসময় পরে তার আলোর জন্য খারাপ লাগতে শুরু করে। এমন ব্যাবহার করাটা উচিত হয়নি। মেয়েটার এমনিতেই পায়ে চোট। কিন্তু কেন আলো এখনো এমন করছে ! এতটাই ঘৃন্য নাকি সামিন!
একটু নরম কেনো হচ্ছে না!
ফুয়াদের ফোন আসে। রিসিভ করবে না ভেবে আবার রিসিভ করে। ফুয়াদ ওপাশ থেকে বলে ওঠে,"ইলহামের কি অবস্থা?"
_স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে শিফট করা হয়েছে।
_আচ্ছা আমি যাচ্ছি। তুই কি করছিস?
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এই মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা বিস্তারিত বলতে থাকে।
ফুয়াদ সবটা শুনে বলে,"আমি জানতাম। তুই সামিন ইয়াসার মির্জা। তোর ধৈর্য হবে না। নারীর মন পেতে সাধনা করবি তুই? তাহলে তো হলোই। তুই এইমাত্র যেটা করলি তাতে ওর মনে তোর জন্য অনূভুতি পরিবর্তন হওয়া তো দূরে থাক তোর প্রতি রা'গ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিস। এখন গিয়ে সরি বলে নিয়ে আয়। যা।"
সামিন ফোন কে'টে কিছুক্ষণ থম মে'রে বসে থাকে। তারপর উঠে নিচে চলে যায়।
আলো বিরস মুখে খুন্তি নে'ড়ে পাতিলে মশলা কষাতে থাকে। মনে মনে যত ধরনের গা'লা'গা'ল রয়েছে সব সামিনকে দিয়েছে সে। মশলা কষানো হয়ে গেলে একটা প্যাকেট হাতে তুলে নেয়।
"কি মেশাচ্ছো ওটা?"
সামিন পেছন থেকে বলে। তার দৃষ্টি আলোর হাতের দিকে। আলো ঘুরে দাঁড়িয়ে সামিনের দিকে তাকায় তারপর তার হাতের প্যাকেটের দিকে তাকায়। সামিন বলে,"কি মেশাচ্ছিলে? বি'ষ জাতীয় কিছু?"
আলো থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন আলোর দিকে এগিয়ে এসে বলে,"মানুষ যদি গরু ছাগলের সাথেও বসবাস করে দীর্ঘদিন তাহলে তাদের প্রতি মায়া জন্মে মানুষের। আমার প্রতি তোমার জন্মালো না। এখন বি'ষ খাইয়ে মারতে চাইছো আমাকে? এ যুগের আছিয়া গুলো এতো নিষ্ঠুর কেনো!"
আলো চোখ তুলে সামিনের চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বলে,"টেস্টিং সল্ট। তরকারির স্বাদ বাড়াতে দিচ্ছিলাম। আমার রান্নার হাত বাজে। খেতে পারতেন না কেউ।"
সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে উচ্চশব্দে গা দুলিয়ে হাসতে থাকে। দীর্ঘ সময় পরে হাসি থামিয়ে বলে,"আই নো ওটা কি। তোমাকে ভ'ড়'কে দিতে মজা করছিলাম। তুমি ঘরে যাও, যাও এক্ষুনি। ফ্রিজে সব রান্না করা আছে। গরম করে নিলেই হয়ে যাবে।"
ট্রিটমেন্ট চলছে ইলহামের। রিতু,ইশিতা,সামিন, ইশমাম পালা করে গিয়ে হসপিটালে থেকেছে। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
একসপ্তাহ পরে ইলহাম পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক। ইলহাম সামিনের মুখোমুখি হয়নি। সামিন ও জুঁইয়ের বিষয়ে ইলহামের সাথে কোনো কথা বলেনি। সে অপেক্ষা করছে ইলহামের সুস্থতার জন্য। এর একটা হেস্তনেস্ত সে অবশ্যই করে ছাড়বে!
একটা গ্লাসে খানিকটা ফলের রস নিয়ে রিতু ঘরে ঢোকে। ইলহাম বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিলো। রিতু বিছানায় একপাশে বসে হাতের গ্লাসটা ইলহামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,"এটা খেয়ে নিন।"
ইলহাম একপলক রিতুর হাতের গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,"আমার থেকে এটা তোমার বেশি প্রয়োজন। তুমি খেয়ে নাও, তারপর আমার জন্য নিয়ে এসো।"
রিতু না'ছো'ড়'বা'ন্দা মেয়ে। সে গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরে রেখেছে। ইলহাম হাসি দিয়ে গ্লাসটা নিয়ে অর্ধেকটা খেয়ে গ্লাসটা রিতুর দিকে দিয়ে বলে,"তুমি খেয়ে নাও বাকি টা।"
রিতু মাথা নাড়ায়।
ইলহাম বলে,"কেনো? আমার উচ্ছিষ্ট খেতে তো আগে অসুবিধা হয়নি। এখন খেতে চাইছো না কেনো? খুব আত্মসম্মান হয়েছে? বড় ভাবীর মতো হতে চাইছো?"
রিতু ইলহামের দিকে একপলক তাকিয়ে গ্লাসটা খালি করে রেখে দেয়। তারপর নিচু স্বরে বলে,"প্রায় দশ বারো দিন ধরে আপনি হসপিটালে। এর মাঝে ঐ মেয়েটার সাথে আপনার একদিনও দেখা হয়নি। আগে তো প্রতিদিন দেখা না করে থাকতে পারতেন না। আপনি চাইলে বাড়িতে ডেকে নিন মেয়েটাকে। ভাইয়াকে আমি বুঝিয়ে বলবো।"
ইলহাম হেসে ফেলে। নিচু স্বরে বলে,"তোমার মতো স্ত্রীর স্বপ্নই তো পুরুষরা দেখে। নিজের স্বামীর প'র'কী'য়া'র মতো জ'ঘ'ন্য অ'প'রা'ধ'কে কতটা সাপোর্ট করছো।"
রিতু চুপ করে থাকে। ইলহাম দুর্বল হাতে রিতুকে টে'নে আস্তে আস্তে নিজের কাছে নেয়। রিতু পাথরের মতো হয়ে থাকে। ইলহাম রিতুর নিচু করে রাখা মাথার দিকে তাকিয়ে বলে,"আমাকে ঘৃ'ণা করো, রা'গ দেখাও, কাঁ'দো। এমন পাথরের মতো হয়ে থেকো না। এসব আমাকে ক'ষ্ট দেয় রিতু।"
রিতুর ঠোঁট কাঁ'প'ছে। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে,"ভাইয়েরা বিয়ে করে যার যার সংসার নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরলো, বাবা জমিজমা চাষ করে খায়। মা বাড়িতে অসুস্থ। তাকে সপ্তাহে হাজার হাজার টাকার ওষুধ খাওয়াতে হয়। আমাকে ছেলেরা রাস্তাঘাটে উ'ত্য'ক্ত করতো দেখে বাবা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পরলো।হঠাৎ বাড়িতে আপনাদের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হলো। বাবা তো হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেলো। এমপি পুত্র, ছেলে দেখতে শুনতে ভালো, বাবাকে মোটা অংকের টাকাও দেওয়া হবে। নিজের ইচ্ছে না থাকলেও বাড়ির পরিস্থিতি দেখে চুপ করে থাকি। বিয়ের ঠিক আগে আগে জানতে পারি ছেলের স্বভাব চরিত্র ভালো না,তার নামে মা'ম'লা আছে। পিছিয়ে যেতেই পারতাম। হঠাৎ মা আরো অসুস্থ হয়ে পরে, বাবা এসে আমার হাত ধরে খুব কাঁদলেন। আমি বাধ্য মেয়ের মতো কবুল বললাম। বিয়ের প্রথম রাত থেকে আমার জীবনের একটা য'ন্ত্র'না'ম'য় অধ্যায় শুরু হলো। স্বামী হিসেবে আমি কখনো স্বামীকে পাইনি। পেয়েছি একজন ধ'র্ষ'ক, একজন প্রভু, একজন অ'ত্যা'চা'রী শা'স'ক'কে। সবটা নিজের নিয়তি মেনে নিজেকে আপনার চাহিদার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম আপনার মন পেতে,আমার প্রতি আপনাকে একটু দয়াশীল বানাতে। কিন্তু আমি ব্যার্থ হয়েছি।"
এ পর্যন্ত বলে রিতু থামে। ইলহাম তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিতু একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"আমার প্রথম সন্তান ছেলে হওয়ায় আমি ভীষণ খুশি হয়েছি, আমার পেটে যে আছে, আমি চাইবো সেও ছেলেই হোক। কারন, আমার নানী বলতো বাবার কর্মফল কখনো কখনো তার মেয়েরা ভোগ করে। আপনি আমার সাথে যা যা করেছেন তা নিজের মেয়ের সাথে হতে দেখলে আপনি সহ্য করতে পারবেন না ইলহাম মির্জা। তাই আপনার ছেলেই হোক।"
রিতু কথাটি বলে অঝোর ধারায় কাঁ'দ'তে শুরু করে দেয়। ইলহাম রিতুকে চুপচাপ দেখতে থাকে। সে কি করবে? এই মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে? নাকি মেয়েটিকে কাছে টেনে নেবে? কিভাবে কা'ন্না থামাবে মেয়েটির?
কাঁদতে কাঁদতে রিতুর হিচকি উঠে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছে নিয়ে উঠে একটা ট্যাবলেট আর এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে ইলহামের দিকে দিয়ে বলে,"এটা খাওয়ার সময় হয়েছে।"
ইলহাম রিতুর দিকে তাকিয়ে ট্যাবলেট টা নিয়ে মুখে দিয়ে পানি খেয়ে নেয়। তারপর বলে,"এখানে বসো।"
রিতু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ইলহাম ধ'ম'ক দিয়ে বলে,"বসো রিতু।"
রিতু ধীরে ধীরে বসে। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"আমার ব্যার্থতা, এতো সুন্দরী হয়েও আপনাকে আমি মুগ্ধ করা তো দূরের কথা নিজের প্রতি আপনার মনে মায়া জন্মাতেই পারিনি। এতো বছর সংসার করার পরেও কত সহজে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন আমাকে তা'ড়ি'য়ে দেবেন। অথচ আমাকে দেখেন, জানি আপনি আমায় ভালোবাসেন না,আপনি একজন অ'ত্যা'চা'রী , তবুও আপনার সাথে তা'লা'ক হবার কথা কল্পনা করলেই বুকটা হু হু করে উঠছে।"
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভেজা দুটো চোখ তুলে ইলহামের দিকে তাকায় রিতু, কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,"ধর্মে তো অনুমতি আছেই, আপনি চাইলে ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেলতে পারেন। আমি আপনাকে অনুমতি দিয়ে দিলাম। তবুও আপনার দোহাই লাগে আমাকে তা'ড়ি'য়ে দেবেন না আপনি। আমি মুখে যতই বলি বাচ্চাটা হলে চলে যাবো, কিন্তু আমি নিজেকে চিনি ইহানের বাবা, আমি পারবো না। আমি পারবো না। এর থেকে আপনি আমাকে মে'রে ফেলেন।"
কাঁদতে কাঁদতে ইলহামের পায়ে পরে যায় রিতু। ইলহাম উঠে রিতুকে ধরে। আজ এই মেয়েটির চোখের কা'ন্না তার করা সমস্ত অ'প'রা'ধে'র পরিমাণ তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ইলহাম রিতুকে বুকে টেনে নিয়ে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,"আচ্ছা ঠিকাছে। এসব পরে দেখা যাবে। আগে তুমি ঠিক হও। যা করছো, তাতে আমার বাচ্চার ক্ষতি হবে। ঠিক হও রিতু।"
রিতু কান্না থামাতে পারছে না। ইলহাম তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। রিতুর কানের কাছে মুখ নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"আমার বাচ্চা না, আমাদের বাচ্চার ক্ষতি হবে রিতু। কান্না থামাও। এবার কান্না থামাও।"
***
খেতে খেতে সামিন একপলক ইশমামের দিকে তাকায়। তারপর বলে,"মেসেজে বললি কিছু বলতে চাস। এখন বল।"
খাবার টেবিলে তারা পাঁচ জন। সামিন,আলো, ইশমাম, ইশিতা এবং পরী।
ইশমাম সামিনের কথায় মাথা তুলে তাকায় সামিনের দিকে তারপর প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে বলে,"অর্গানাইজেশন থেকে ডেকেছে আমাকে। তিন মাসের জন্য যেতে হবে ভাইয়া। আমি যেতে চাচ্ছি।"
সামিন খাওয়া রেখে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলোও ইশমামকে দেখে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"অসম্ভব! তুই গেলে আর আসবি না। তোকে যেতে দেবো না।"
_ভাইয়া তুমি কি জানো তুমি বাচ্চাদের জেদ করছো? আমি এখানে আজীবন থাকার জন্য আসিনি।
_জানি,এসেছিলি প্রেমের টানে,আমাদের জন্য আসিসনি। সেই মেয়েকে তো পেলি না। এখন তুই আমেরিকাতেও যেতে পারবি না। বাড়ির ব্যাবসা দেখবি।
ইশমাম রেগে যায়। কপাল কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো মাথা নিচু করে চুপচাপ খাচ্ছে। সামিন বলতে থাকে,"আচ্ছা ঠিকাছে। যাবি তিনমাসের জন্য। যাওয়ার আগে বিয়ে করতে হবে। করবি? বল রাজী! ফুয়াদের কাজিন খুবই চমৎকার একটি মেয়ে।"
ইশমাম টেবিলে চা'প'ড় দিয়ে বলে,"বিরক্তিকর ভাইয়া। তুমি সবসময় তোমার সব সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দিতে পারো না! বলেছি তো বিয়ে করবো না আমি।"
সামিন ভাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"করবি তুই বিয়ে। আমি আজই ফুয়াদের সাথে কথা বলছি। দেবদাস হয়েছিস তুই? আলতু ফালতু মেয়েদের জন্য ক'ষ্ট পাচ্ছিস।"
আলো ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম একপলক আলোকে দেখে ভাইকে বলে,"আলতু ফালতু মেয়ে না ভাইয়া। এভাবে বলবে না। অসম্ভব রকমের ভালো একটি মেয়ে।"
আলো দ্রুত হাত ধুয়ে উঠে পরে। এখানে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে,সে চলে যায়।
সামিন বলে,"বেশ মেয়েটা অসম্ভব রকমের ভালো। আমি ওর চেয়ে কয়েকগুণ ভালো মেয়ে এনে দেবো তোকে।"
ইশমাম দাঁতে দাঁত চে'পে পানির গ্লাস আঁ'ক'ড়ে ধরে বসে থাকে। ভাইয়ার সাথে রা'গ'টা সে দেখাতে পারছে না তাই রাগটাকে হজম করার চেষ্টায় আছে সে।
সামিন বলে যাচ্ছে,"বিয়ে করবি। তুই অবশ্যই বিয়ে করবি।"
প্রচন্ড জে'দে হাতের মুঠোয় থাকা গ্লাসটাকে ভে'ঙে ফেলে। সামিন সহ সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। টপটপ করে র*ক্ত ঝরছে ইশমামের হাত থেকে।
সামিন কিছুক্ষণ পর চেঁচিয়ে ওঠে,"ছোটো!"
ইশিতা উঠে ইশমামের হাত ধরে। পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,"শিগগিরই তোর ফার্স্ট এইড বক্স টা নিয়ে আয়।"
পরী উঠে চলে যায়। সামিন প্লেটে হাত ধুয়ে ছুটে আসে ইশমামের কাছে। ইশমাম দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"আমি বিয়ে করবো না ভাইয়া।"
সামিন ভীত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,"আচ্ছা। বিয়ে করতে হবে না। শান্ত হ তুই। শান্ত হ।"
***
হাত ড্রেসিং করিয়ে দিতে দিতে পরী একপলক ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কপাল কুঁচকে আছে। পরী বেশ অবাক হচ্ছে। এই রামগরুরের ছানাও প্রেম করতো! তাও আবার মজনুর প্রেম! প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে আর বিয়েই করবে না বলে শপথ নিয়েছে। অদ্ভুত!
পুরো ব্যাপারটায় পরীর খুব হাসি পাচ্ছে। যে মেয়েটা একে ছেড়ে দিয়েছে সে ভালো কাজই করেছে। এই লোকের সাথে বিয়ে হলে দুইদিন সংসার করতে পারতো কি না সন্দেহ! বেশ করেছে মেয়েটা!
"তুমি হাসছো কেনো?"
ইশমাম পরীর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। পরী থতমত খেয়ে ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম গম্ভীর কন্ঠে বলে,"হাসছো কেনো তুমি একা একা?"
_কই না তো।
পরী ইশমামের হাতে ব্যা*ন্ডে*জ করে দিতে দিতে বলে।
_আমি স্পষ্ট দেখলাম তুমি হাসছিলে।
পরী উঠে দাঁড়ায়। ইশমাম বলে,"তোমার মাথায় নির্ঘাত কোন সমস্যা আছে। আজ নিশ্চিত হলাম।"
পরী চুপচাপ তার ফার্স্ট এইড বক্স উঠিয়ে ইশিতার ঘরের দিকে যায়। এই লোকটা কবে যে আমেরিকা যাবে কে জানে। ভয়ংকর একটা লোক!
***
জুঁইয়ের নাম্বার থেকে অনবরত ফোন আসছে। ইলহাম কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ফোনটা রিসিভ করে। জুই বলতে থাকে,"হ্যা! হ্যালো। আচ্ছা ফোন কেনো ধরো না আমার?"
_আমি অসুস্থ জুঁই। ফোন ধরতে দেরী হতেই পারে ।
_দেরী? বুঝলাম, বৌ কাছে আছে। তো বৌকে যখন ছাড়তেই পারছো না তাহলে আমায় রেখে কি লাভ? ছেড়ে দাও আমাকে। তুমি তোমার ঐ হার হাবাতে বৌ আর বাচ্চাদের নিয়ে থাকো।
ইলহাম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। জুঁই বলতে থাকে,"সরি। রাগ উঠে গিয়েছিলো তাই বললাম। আচ্ছা তোমার ভাইয়ের সাথে সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা করেছো?"
ইলহাম মৃদু স্বরে বলে,"আমার সম্পত্তি দিয়ে তোমার কি?"
_আমার কি মানে। কদিন পরে আমি তোমার ওয়াইফ হবো। অবশ্যই আমার কিছু।
_কে বলেছে তুমি আমার ওয়াইফ হবে?
ইলহাম ঠান্ডা গলায় বলে।
জুঁই চেঁচিয়ে ওঠে,"মানে?"
_মানে আমি বিবাহিত। আমার একটা ছেলে আছে। এবং আমার স্ত্রী আবারো সন্তানসম্ভবা।
_ইলহাম তুমি এসব কি বলছো? কতদিনের সম্পর্ক আমাদের!
_ওটা সম্পর্ক নয়। অ'প'রা'ধ। অ'প'রা'ধ বয়ে বেড়ানো ঠিক না।
_ইলহাম!
_আচ্ছা ঠিকাছে। সাফ সাফ কথা বলি চলো। আমার সব একাউন্ট ভাইয়া বন্ধ করে দিয়েছে। নিজের বৌ বাচ্চা নিয়ে আমার তার ঘা'ড়ে উঠে খেতে হবে। এমতাবস্থায় তোমাকে যদিও বিয়ে করি তোমাকেও কিন্তু আমার মতো ভাইয়ার দয়ায় থাকতে হবে। বলো পারবে? আমার ভাইয়াকে তুমি চেনো। তুমি পারবে?
জুঁই চুপ করে থাকে। ইলহাম বাঁকা হাসি হাসে, তারপর বলে,"তুমি হচ্ছো ভেসে আসা মেঘ জুঁই। আমার এখন আ*ত্ম*হ*ত্যা করতে ইচ্ছে করছে এটা ভেবে যে আমি রিতুর মতো একটা মেয়েকে ফেলে রেখে তোমার মতো স্বা*র্থ*প*র মেয়ের মধ্যে শান্তি খুঁজতে গিয়েছিলাম।"
***
সারাদিন শুয়ে বসে থাকতে থাকতে শরীরটা আরো খারাপ হতে শুরু করেছে। ফোনটা দূরে ছু*ড়ে মেরে ইলহাম বিছানা থেকে নামে। একটু হাঁটাহাঁটি করা প্রয়োজন। ঘর থেকে বেড়িয়ে দোতলার লিভিং রুমে এসে সে দাঁড়িয়ে পরে সে। সামিন ইহানকে কোলে নিয়ে দেয়ালের জয়নুল আবেদীনের পেইন্টিং নিয়ে বিশদ আলোচনা করছে ইহানের সাথে। মাথা ঘুরিয়ে ইলহামকে দেখতে পেয়ে সে কপাল কুঁচকে চলে যেতে নেয়। ইলহাম ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। মাথা নিচু করে ভাইয়ের হাত ধরে বলে,"সরি ভাইয়া!"
সামিন ইলহামের দিকে তাকায়, তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে,"আমাকে সরি বলছিস কেনো? আমি তোর বৌ?"
ইলহাম চুপ করে থাকে। সামিন বলতে থাকে,"তুই চব্বিশ টা বিয়ে করলেও আমার কি। আমার কিছুই না। যে মেয়েটির কিছু। তার কাছে গিয়ে মাফ চা।"
কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে সামিন বলে ওঠে,"এসব নাটক যদি সম্পত্তি পাওয়ার জন্য হয় তাহলে জেনে রাখ, কিচ্ছু পাবি না তুই। আমি বাবাকে দিয়ে তোর সবকিছু ইহানের নামে করে দিচ্ছি। তুই কিছু পাবি না।"
ইলহাম ভাইয়ের হাত ধরে বলে,"লাগবে না আমার কিছু। আমার শুধু বৌ বাচ্চা লাগবে। আর কিছুই লাগবে না!"
***
"এটা কি?"
হাতের প্যাকেট টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে ইশিতা। শান্ত তার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। বলে,"খুলে দেখো।"
ইশিতা প্যাকেটটা খুলে বেশ অবাক হয়ে যায়। তার একটা পোর্ট্রেট বাঁধিয়ে রাখা। ইশিতা চোখ বড় বড় করে বলে,"কে করেছে? তুমি?"
_না,আমার অত সময় কোথায়।
ইশিতা একপলক শান্তর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। তারপর বলে,"খুব পছন্দ হয়েছে আমার।"
শান্ত ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"মনে হচ্ছে আমি কোনো অষ্টাদশীকে দেখছি। এতো ফা'ল'তু একটা জিনিস দেখেও কেউ এভাবে মুগ্ধ হয়? অদ্ভুত মাথামোটা মেয়ে তুমি। আমার যায়গায় আজ একটা বা*ট*পা*রে*র হাতে পরলে এতদিনে নিজেকে আর খুঁজে পেতে না।"
ইশিতা মুচকি হাসে। তারপর বলে,"ঠিক তা না। আমার একটা চোখ আরেকটা চোখ থেকে একটু ছোট। সেটা তুমি খেয়াল করেছো, অবাক হচ্ছি আসলে।"
শান্ত ইশিতার কাছে এসে বলে,"তাই নাকি! কই দেখি! আমি তো জানতাম না। আমি তো ভুল করে ভুলটা করে ফেলেছি।"
ইশিতা বলে,"হুম। একটা চোখ একটু বড়, আরেকটা একটু ছোট।"
গাড়ির হর্ন বাজার শব্দ হতেই চ'ম'কে ওঠে দুজন। পার্কের বেঞ্চিতে বসেছিল এতক্ষণ। ইশিতা ঘুরে তাকাতেই দেখে সামিনের গাড়ি। লাফ দিয়ে উঠে দাড়ায় সে।
সামিন গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশিতা কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে একটা ঢোক গিলে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"আজকে আমি শে*ষ! তুমি এখান থেকে কে*টে পরো।"
শান্ত ইশিতার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে,"কেনো? কে*টে পরবো কেন? পরিচিত আমরা,কথা বলতেই পারি!"
_তুমি ভাইয়াকে চেনো? মা*র*তে মা*র*তে মে*রে*ই ফেলবে তোমাকে। তুমি কে'টে পরো। আমি কিছু একটা বুঝিয়ে বলে দেবো। যাও।
শান্ত যায়না। সামিন গাড়ি থেকে নেমে এসে ওদের সামনে দাঁড়ায়। একপলক ইশিতা এবং শান্তর দিকে তাকিয়ে শান্তকে বলে,"তোমাকে ইহানকে পড়ানোর জন্য ঠিক করা হয়েছিলো, ইশিতাকে নয়।"
শান্ত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইশিতা আমতা আমতা করে বলে,"ভাইয়া হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো তাই..."
_হঠাৎ দেখা? তাও এই পার্কে?
_ভাইয়া....!
_বাড়িতে চল।
সামিন খুবই ঠাণ্ডা গলায় বলে কথাটা।
বাড়িতে এসে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বোনের সাথে চেঁ'চা'মে'চি শুরু করে দেয় সামিন। দোতলার লিভিং রুমে বসে ইশিতা কাঁ'দ'ছে। এমন উঁচু গলায় কখনো ভাইয়া তার সাথে কথা বলেনি,ব'কে'নি। সামিন ইশিতার মুখোমুখি বসে পরে, তারপর তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,"বুদ্ধি একেবারেই চলে গিয়েছে তোর? ঐ ছেলেটাকে চিনিস তুই ঠিকভাবে? ওর পরিচয় জানিস ঠিকভাবে? কদিনের পরিচয়ে এতদূর? তুই তো টিনেজার মেয়েদের থেকেও ইমম্যাচিওরড।"
_ভাইয়া,ও খুব ভালো, শিক্ষিত,ভদ্র!
_হ্যা ভদ্র বলেই তো তোকে ঐ সব পার্কে নিয়ে যায়।
_আমি ওকে ওখানে ডেকেছি ভাইয়া।
_খুব পার্ক চিনেছো তুমি। এক চ'ড় মারবো।
চেঁচিয়ে বলে সামিন বোনের দিকে এগিয়ে যায়। ইশিতা কেঁ'পে ওঠে।
_হ্যা মা'রু'ন। থামলেন কেনো মা'রু'ন।
পেছন থেকে বলে ওঠে আলো। চেঁচামেচির শব্দে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। সামিন তার দিকে তাকায়। আলো বলতে থাকে,"মারুন। যেখানে যেখানে জোর খাটাতে পারবেন না তাদের সবাইকে মে'রে দিন। এটা তো সামিন ইয়াসারের রাজ্য। এখানে থাকতে হলে তার জো'র জু'লু'ম মানতে হবে।"
ইশিতা ভেজা চোখ নামিয়ে বসে আছে। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"ভাই বোন কথা বলছি,তুমি ভাষণ না দিয়ে যাও।"
_লজ্জা করে না? এতবড় একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিলেন ভাইয়ের অধিকারে।
_ আমার বোন। আমি যা খুশি করবো। ওরকম পার্কে আমার বোনকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। এবাড়ির কোনো মেয়ের আজ পর্যন্ত অমন পার্কে যাওয়ার প্রয়োজন পরেনি। দিনকে দিন বে'য়া'দ'ব হচ্ছে।
ইশিতা কাঁদতে কাঁদতে উঠে চলে যায় নিজের ঘরে। সামিন একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে উঠে নিজের ঘরে যায়। আলো তার পিছু পিছু যায়।
_ভাবেন কি আপনি নিজেকে? আপু কত কষ্ট পেয়েছে আপনার আচরণে দেখেছেন?
_পাক। অমন একটা ছেলেকে বোনের পাশে মেনে নেবো?
_খারাপ কি? শিক্ষিত,ভদ্র,দেখতে শুনতে ভালো, আপনার কেনো পছন্দ হচ্ছেনা? কারন আপনাদের বাড়ীর ছেলেদের মতো গু'ন্ডা মা'র'কা'টা'রি নয় বলে?
সামিন আলোর দিকে তাকায়। তারপর বলে,"ছেলেটা এই শহরের স্থানীয় নয়। এইসব মফস্বল থেকে উঠে আসা ভার্সিটির ব্যাচেলর ছেলেরা পরিকল্পনা করে নিজের ভোলাভালা চেহারা দেখিয়ে, গান শুনিয়ে বড়লোকের মেয়ে পটিয়ে নেয়। এসব অহরহ হচ্ছে আশেপাশে। তারপর নিজেদের স্বার্থে তাদের ব্যাবহার করে।"
_আর আপনারা? আপনারা কি করেন ইয়াসার মির্জা? একটা মেয়ের অমতে তাকে তুলে এনে বিয়ে করে ব্যাবহার করেন । হয়ে যান স্যা'ডি'স্ট। ওই ছেলে গুলো আর আপনাদের মধ্যে তো কোনোই পার্থক্য নেই।
সামিন আলোর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"মুখ সামলে কথা বলো আলো। স্যা'ডি'স্টে'র মানে বোঝো তুমি? একেবারে আজেবাজে কথা বলবে না।"
_বলবো। কারন আপনারা অমনই। রিতুর সাথে তো তাই হয়ে এসেছে।
_আমি স্যা'ডি'স্ট? আমার কোন আচরণে তোমার মনে হয়েছে আমি ওমন? বলো, জবাব দাও।
চেঁচিয়ে ওঠে সামিন।
_আপনিও ওমনই।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাতের কনুই ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে দাঁত খিচিয়ে বলে,"এই মাত্র যেটা বললে,সেটা ফিরিয়ে নাও আলো। প্রথম এবং শেষ বারের মতো বললাম।"
আলো সামিনের চোখে চোখ রেখে বলে,"নেবো না। আবারো বলবো, এই মির্জা বাড়ির ছেলেরা স্যা*ডি*স্ট।"
ধৈর্য্যর বাঁধ গিয়েছে সামিনের। আলোকে এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে তেজী কন্ঠে বলে,"স্যা*ডি*স্ট আমরা? তাইনা?"
আলো মাথা ঘুরিয়ে তাকায় সামিনের দিকে। সামিন বলে,"ঠিকাছে আমি স্যা*ডি*স্ট। স্যা*ডি*স্ট কাকে বলে আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি আলো।"
আলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সামিন গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। আলো নিজেকে গুটিয়ে নেয়। সামিন ঘুরে আলোর দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত আলোকে দেখে একটা একটা করে শার্টের বোতাম খুলতে থাকে। শার্ট টা খুলে দূরে ছু*ড়ে মেরে আলোর দিকে এগিয়ে যায়। বিছানায় আলোকে চেপে ধরে নিচু স্বরে কিন্তু গলায় তেজ নিয়ে বলে,"এবার বলো! সাহস থাকলে আবার ঐ শব্দটা উচ্চারণ করো আলো!"
আলো অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"স্যা*ডি*স্ট। আপনি স্যা*ডি*স্ট।"
সামিন আলোকে দেখছে। মেয়েটা নিজেকে সামিনের থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনো চেষ্টা করছে না। ঠিক একটা জড়বস্তুর মতো পরে আছে, নিস্তেজ হয়ে। হঠাৎ করে তার চোখ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরে।
সামিনের বুকে সুক্ষ্ম য*ন্ত্র*না হয়। এভাবে সে কখনোই তার স্ত্রীকে পেতে চায় না। আলো একপলক সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"থেমে গেলেন কেন? আমি তো কোনো বাঁধা দিচ্ছি না। এসবই তো আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তার জন্য যত্নবান স্বামী হবার নাটক করার তো কোনো দরকার ছিলো না। জোর করে নিয়ে নিতেন। আচ্ছা আপনাকে জোর করতে হবে না। আমি নিজেই দিচ্ছি।"
কথাটি বলে আলো কাঁপা কাঁপা হাতে বুকের উপর থেকে নিজের শাড়ির আঁচল সরিয়ে দেয়। সামিন আলোর হাত ধরে ফেলে। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"কোনোভাবেই না ইয়াসার মির্জা। না আমার সাথে ভালো স্বামী হবার নাটক করে, না আমাকে জো*র জবরদস্তি করে, কোনো ভাবেই আপনি আমার মন পাবেন না। অভিনন্দন আপনাকে, আপনি একটা মেয়ের শুধুমাত্র শরীরের দ*খ*ল*দা*র হতে চলেছেন, মনের নয়।"
কথাটা বলে কা*ন্না*য় ভে*ঙে পরে আলো। তারপর বলে,"কিচ্ছু ভুলিনি আমি। সেদিনের সেই রাত, আমার ভাইদের গলায় ছু*রি ধরা, আমার বাবা হার্টের রো*গী, কিছুদিন আগেই তার একটা এ*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছিলো, তাকে কষ্ট দেয়া, আমার মায়ের অসুস্থ হয়ে যাওয়া, আমাকে কি*ড*ন্যা*প করা। কিছু ভুলিনি। একটা গোটা রাত আমি ছট'ফট করেছি আ'তং'কে এটা ভেবে যে অচেতন অবস্থায় আমার সাথে উলটো পাল্টা কিছু হয়েছিলো কি না। নিজের স'তী'ত্ব নিয়ে একটা মেয়ের অনূভুতি আপনি বোঝেন? আমি কখনো আপনাকে আমার মন দেবো না, কোনোদিন আপনার প্রতি আমার অনুভূতি বদলাবে না। যা করতে চান করুন।"
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে আলো। সামিন বেশ কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে আলোর শাড়ির আঁচল তুলে দেয় তার বু'কে। তারপর তাকে ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে বসে। আলো বিছানায় পরে থাকে চুপচাপ। সামিন উঠে নিজের শার্ট উঠিয়ে পরে নেয়। আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে বিছানায় একপাশে বসে পরে সে। পাঁচ মিনিটের মতো চুপচাপ থেকে হঠাৎ বলে ওঠে,"আর মাত্র এক সপ্তাহ আছে। কিন্তু আমি হার মেনে নিলাম আলো। তুমি কাল সকালে ও বাড়িতে চলে যেও। তোমাকে আমি মুক্তি দিলাম।"
"অদ্রিতা।"
ইশমামের ডাকে আলো দাঁড়িয়ে পরে পেছনে ফিরে তাকায়। ইশমাম তার দিকে এগিয়ে এসে নিচু স্বরে বলে,"সত্যিই চলে যাচ্ছো?"
আলো কিছু সময় ইশমামের দিকে তাকিয়ে থেকে ম্লান হেসে বলে ওঠে,"ভালো থেকো ইশমাম।"
ইশমাম তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলো ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।
"তুমি চলে যাচ্ছো পঁচা মেয়ে?"
ইহান অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে আলোকে। আলো ম্লান হেসে ইহানের দিকে এগিয়ে যায়। ইহানের মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলে,"হ্যা ভালো ছেলে। আমি চলে যাচ্ছি।"
_আর কখনো আসবে না?
_নাহহ,কখনো না।
দৃঢ়ভাবে বলে ওঠে আলো।
সামিন মাথা তুলে আলোর দিকে তাকায়। নিচতলার লিভিং রুমে বাড়ির সবাই এসে জমায়েত হয়েছে। আলো ঘুরে ঘুরে সবাইকে একপলক দেখে নেয়। রিতু এগিয়ে গিয়ে নরম গলায় বলে,"ভাবী! ভাইয়া অনেক ভালো মানুষ। একটা সুযোগ তো দিন তাকে নিজেকে প্রমাণ করার। অনুরোধ করছি আপনার কাছে।"
আলো শুকনো হাসি হেসে রিতুর সেকথার জবাব না দিয়ে তার হাত দুটো ধরে, রিতুর চোখে চোখ রেখে বলে,"রাগের মাথায় তোমাকে প্রচুর কটু কথা শুনিয়েছি রিতু। মাফ করে দিও। তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে রিতু, সবাইকে এতো ভালোবাসা দিও না। একটু ভালো নিজেকেও বাসো। কেমন? তুমি ভালো থেকো। তোমার পেটে যে আছে, সে জন্মালে এই আগন্তুকের আদর দিয়ে দিও।"
রিতু শুকনো মুখে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। আলো ঘুরে ইশিতার দিকে তাকায়। ইশিতা এসে আলোকে জরিয়ে ধরে। আলো বলে,"আমি তোমাকে সত্যিই খুব মিস করবো আপু।"
ভাইয়ের প্রতি অভিমান থাকার পরেও ইশিতা আলোর গাল দুটো ধরে আদুরে গলায় বলে,"আরেকটু কি ভাবা যেতো না ভাবী?"
আলো বলে,"ভাবী না ইশিতা আপু। আমাকে আলো বলো তুমি।"
এমন সময় জামিল এসে শান্তিনীড়ের সদর দরজায় দাঁড়ায়। সামিন ধ'ম'কে'র সুরে বলে,"তোকে এই শরীর নিয়ে আসতে নিষেধ করেছিলাম না?"
জামিল তার ইয়াসার ভাইয়ের কথায় জবাব না দিয়ে আলোর দিকে এগিয়ে আসে। আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। জামিল বলতে থাকে,"ভাবী। সবকিছু তো আমার জন্য হয়েছে। আপনি আপনার জুতা খুলে আমাকে দুইটা দেন। আপনার বাবা মাকেও দিতে বলবেন। কিন্তু আমার ভাইকে ছেড়ে দিয়েন না। ভাই আপনাকে সত্যি খুব ভালোবেসে ফেলেছে ভাবী। সে কষ্ট পাচ্ছে। তাকে একবার সুযোগ দিন ভাবী।"
_জামিল!
চেঁচিয়ে ওঠে সামিন।
আলো জামিলের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। লিভিং রুমে ইমতিয়াজ মির্জা এসে দাঁড়িয়েছে। আলো একবার ইমতিয়াজ মির্জার দিকে তাকিয়ে ইশমাম এবং ইলহামের দিকে তাকায়। তারপর ঘুরে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"তালাকের ব্যাপারটা দ্রুত দেখবেন…..."
সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। পাশ থেকে ফুয়াদ বলে,"আলো,একটা সুযোগ দাও বোন। সামিন খুব ভালোবাসে তোমাকে।"
আলো অস্ফুট স্বরে বলে,"আপনার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি প্রথমদিন ভাইয়া। আমাকে মাফ করে দিয়েন। ভালো থাকবেন।"
জামিল এসে আলোর পথ আগলে দাঁড়ায়,"ভাবী! কথা তো শোনেন আমার। আমি ভাইয়ের অপরাধকে কোন মতেই যাস্টিফাই করছি না ভাবী। সে অবশ্যই অ'প'রা'ধ করেছে। কিন্তু এখন সে সত্যিই আপনাকে ভালোবাসে। একটু কনসিডার করেন ভাবী।"
_আমার পথ ছাড়ুন জামিল ভাই।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।
সামিন জামিলের দিকে তাকিয়ে ধ'ম'কে ওঠে,"পথ ছাড় ওর জামিল। যেতে দে ওকে।"
জামিল শুকনো মুখে সরে দাঁড়ায়। আলো এগিয়ে যেতে থাকে সদর দরজার কাছে। পরী আর পোনা চাচা দাঁড়িয়ে আছে। আলো হেসে পরীর গাল ছুঁয়ে পোনার দিকে তাকিয়ে বলে,"ভালো থাকবেন পোনা চাচা।"
পোনা নরম গলায় বলে,"থেকে যাও বড় বৌমা। সবটা দুর্ঘটনা হলেও তুমি একটা হীরা পেয়েছো মা তাকে এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না।"
আলো কিছু না বলে হাঁটতে থাকে। সামিন আলোর পিছু পিছু যায়। পোর্চের নিচে এসে দাড়াতেই দেখে দলের ছেলেরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ আলোকে দেখে বলে,"থেকে যান না ভাবী। কি হয় একটু মেনে নিতে?"
সবাই সবুজের কথা শেষ না হতেই বলে ওঠে,"থেকে যান ভাবী। দোহাই আপনার।"
আলো তাদের কিছু না বলে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"আপনি আসছেন কেনো? আমি রিকশা নিয়ে চলে যাবো।"
"তুমি আমার বাউন্ডারির মধ্যে আছো আলো। তারমানে তুমি আমার রেসপনসিবিলিটি। তোমাকে রাহাত দিয়ে আসবে আমার গাড়িতে।"
কথাটা বলে গাড়ির চাবি রাহাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,"তোর ভাবীকে..........সরি,ওকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আয়।"
রাহাত একপলক সামিন এবং আলোর দিকে তাকিয়ে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে গেইটের কাছে চলে যায়। আলো ধীরপায়ে রাহাতের পিছু পিছু যায়। সামিন অপলক দেখতে থাকে সে দৃশ্য। গেইটের কাছে গিয়ে আলো দাঁড়িয়ে পরে। আলো ঘুরে সামিনের দিকে তাকিয়ে আবারো তার দিকে আসতে থাকে। তৌফ খুশি হয়ে বলে,"ভাবী মনে হচ্ছে যাবে না ভাই।"
সামিন তাকিয়ে আছে। আলো এসে সামিনের মুখোমুখি দাঁড়ায়। তারপর তার হাত থেকে সামিনের মায়ের বালা দুটো খুলে সামিনের হাতে দিয়ে বলে,"আপনাদের বাড়ীর বড় বৌয়ের জিনিস। আপনার ভবিষ্যৎ বৌকে দেবেন।"
বালা দুটো দিয়ে দ্রুতপায়ে হেটে গেইটের বাইরে চলে যায়। গাড়িতে উঠে বসতেই রাহাত গাড়ি স্টার্ট করে। কয়েক মূহুর্ত পরে গাড়িটা চোখের আড়াল হয়ে যায়। সামিন একপলক গেইটের দিকে তাকিয়ে নিজের হাতে তার মায়ের বালা দুটোর দিকে তাকায়।
রনি সামিনের দিকে এগিয়ে এসে তাকে অবাক চোখে দেখতে থাকে। সামিন রনির দিকে তাকিয়ে বলে,"কি? কি দেখছিস?"
_এতো সহজে যেতে দিলেন ভাই?
সামিন বাঁকা হাসি হাসে। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে সবাইকে দেখতে থাকে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন হাতের বালা দুটোর দিকে একবার তাকিয়ে রনিকে বলে ওঠে,"বুঝলি রনি, তোর ভাবী কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। ওকে এই কয়টা দিন দেখে রাখিস!"
ফুয়াদ অবাক হয়ে বলে,"মানে?"
সামিন ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমি সামিন ইয়াসার মির্জা। আমার বৌকে আমি ছেড়ে দেবো? ভাবলি কি করে তোরা। ধূর!"
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। সামিন সবাইকে উপেক্ষা করে গা ছাড়া ভঙ্গিতে হেলেদুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে সোজা দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
লিভিং রুমে দাড়িয়ে থাকা সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
***
ড্রাইভ করতে করতে রাহাত একপলক মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো মাথা নিচু করে বসে আছে। কিছু সময় পরে রাহাত বলে ওঠে,"ভাবী!"
_আপনাদের ভাইয়ের কীর্তন গাইতে শুরু করবেন না রাহাত। আমি ফেলে এসেছি তাকে, অনেকটা দূরে চলে এসেছি তাকে ফেলে। এখন আর কিছু শুনতে চাচ্ছি না।
রাহাত আলোর দিকে তাকায়। কিছু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে ওঠে,"আপনি খুবই নি'ষ্ঠু'র ভাবী।"
_হ্যা। আর আপনারা খুব ভালো। যুবতী মেয়েকে কি'ড'ন্যা'প করে তাকে একটা ক্রি'মি'না'লে'র শ'য্যা'স'ঙ্গী বানিয়ে দেন। আপনারা খুব ভালো রাহাত।
রাহাত আর কোনো কথা বলে না, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ তো তার নেই। আসলেই তো তারা অ'প'রা'ধ করেছিলো।
তবুও সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"ভাইয়ের চোখে আপনার জন্য শুধু ভালোবাসা না সম্মান দেখেছি আমরা ভাবী, এত বছর ধরে ভাইকে দেখছি কখনো কোনো মেয়ের জন্য এতটা উতলা হতে ভাইকে দেখিনি ভাবী। আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি ভাইয়ের কাছে ফিরে যান।"
_গাড়ি থামান রাহাত।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো। রাহাত আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"কেনো ভাবী?"
_আমাদের বাড়ি এসে গিয়েছে। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না?
রাহাত সামনের দিকে তাকিয়ে ব্রেক কষে দেয়। আলো রাহাতের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"আবার যদি কখনো নিজের প্রিয় ভাইয়ের জন্য কোনো মেয়েকে তুলে আনতে যান তাহলে নিজের মা বোনের কথাটা একবার ভেবে নিবেন রাহাত। ভালো থাকবেন।"
আলো কথাটি বলে বাড়ির গেইটের ভেতরে চলে যায়। রাহাত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গাড়ি স্টার্ট করে।
কলিং বেল টিপে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে আলো। আজান এসে দরজা খুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক মূহুর্ত। তারপর একটা বি'ক'ট চি'ৎ'কা'র দেয়। রেহেনা ছুটে এসে থ'ম'কে দাঁড়িয়ে যায়। আলোর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আলো মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে,"এক সপ্তাহ পর ফেরার কথা ছিলো। ইয়াসার মির্জা দয়া করে এক সপ্তাহ আগেই আমাকে ছেড়ে দিয়েছে মা।"
রেহেনা ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ পরে আলো মাকে ছেড়ে সোজা হেটে আতাউর আলমের ঘরে ঢোকে। আতাউর আলম মেয়েকে দেখতে পেয়ে অপলক তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে, তার কোনো ভাবান্তর নেই । আলো দৌড়ে গিয়ে বাবার গায়ে ঝাঁ'পি'য়ে পরে। কিছুক্ষণ পরে ভেজা দুটো চোখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,"তোমার মেয়ে মুক্তি পেয়েছে আব্বু।"
***
ঘরে ঢুকে বিছানায় চিৎ হয়ে, হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে সামিন। কিছু সময় শূন্যে তাকিয়ে থেকে উঠে বসে বিছানার ওপর থেকে তার মায়ের হাতের বালা দুটো তুলে নেয়। বেশ মানিয়েছিলো আলোর হাতে বালা দুটো। অহংকারী,তেজী, মাথামোটা, গলাবাজি করা মেয়েটি ফেলে রেখে চলে গেলো নিজের জিনিস। বোকা মেয়েটা জানেই না এভাবে নিজের পরিচয় ফেলে রাখা যায়না।
সামিন উঠে গিয়ে নিজের আলমারি খুলে একটা বক্স বের করে আনে। বক্সে কিছু গয়না ছিলো, যেগুলো আলোর মা আলোর জন্য গড়েছিলো। সামিন বালা দুটো সেই বক্সটাতে তুলে রাখে । এগুলো সব ঐ তে'জী মেয়েটার। আবার যখন সামিন তার বৌকে এ বাড়িতে নিয়ে আসবে, সেদিন ভালোবাসাবাসির রাতে এগুলো নিজের হাতে পরিয়ে দেবে তার বৌকে।
ফুয়াদকে দেখে সামিন ম্লান হেসে বক্সটা তুলে রাখে। ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে পরে ফুয়াদ। সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"কি চলছে মাথায়? কি করবি?"
_সাধনা।
হাসতে হাসতে বলে সামিন।
_তাতে যদি কাজ না হয়?
_তাহলে আবার তুলে আনবো তারপর আবার চলে গেলে আবার সাধনা করবো তাতে কাজ না হলে আবার তুলে আনবো তারপর আবার চলে গেলে আবার সাধনা করবো তাতেও কাজ না হলে আবার তুলে আনবো....
_থাম থাম থাম।
ফুয়াদ চেঁচিয়ে ওঠে।
সামিন উচ্চশব্দে হাসতে হাসতে বলে,"মোটকথা ওর জন্ম হয়েছে আমার কাছে বন্দী হবার জন্য আর আমার জন্ম হয়েছে ওকে তুলে আনবার জন্য।"
_তোর কাহিনী দিয়ে একটা দূরদান্ত ড্রামা সিরিজ বানানো যাবে। লোকজন যেটা দেখে তোকে আর আলোকে গা'লা'গা'ল দেবে। তাদের মাথা খা'রা'প করার জন্য।
সামিন হাসতে থাকে। তারপর হাসি থামিয়ে বলে,"একটু গললো না ঐ আছিয়া। তুই ভাবতে পারিস? কি দিয়ে গড়েছে ওকে?"
***
ভাতের লোকমা তুলে মেয়ের সামনে ধরে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে রেহেনা। আলো হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,"ভালো লাগছে না খেতে আম্মু ,নিয়ে যাও।"
আলোকে খুবই কাহিল দেখাচ্ছে। একটু পর পর পানি খাচ্ছে শুধু।
রেহেনা প্লেট সরিয়ে রেখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"তুই ঠিক আছিস তো? এমন লাগছে কেনো?"
_ও কিছু না আম্মু। কিছুটা দুর্বল লাগছে শুধু।
আলো উঠে দাঁড়িয়ে বলে,"ঘরে এক কাপ লেবু চা দিয়ে যাবে আম্মু?"
রেহেনা মাথা নাড়ায়। আলো নিজের ঘরে চলে যায়। দীর্ঘ দিন পরে নিজের সেই চির চেনা ঘরটাতে ঢুকে আলো বেশ শান্তি পায়। কিছুক্ষণ ঘুরে পুরো ঘরটাকে দেখে আলো আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পরনে এখনো ঐ লোকটার দেয়া শাড়ি। আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে তার আলমারি থেকে এক সেট সালোয়ার কামিজ বের করে নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গোসল সেরে নেয়। শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে দেখে রেহেনা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আলো চায়ের কাপ টা উঠিয়ে একটা চুমুক দেয়। রেহেনা আমতা আমতা করে বলে,"তখন তোর বাবার সামনে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। তোকে এমন লাগছে কেনো দেখতে?"
_কেমন লাগছে?
আলো তার মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে। রেহেনা নিচুস্বরে বলে,"তোর এই মাসে পি'রি'য়'ড হয়েছিলো?"
_হু কেনো?
_না মানে, পেটে বাচ্চা এলো কি-না...
আলো তার মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,"আমাদের মধ্যে এমন কিছুই হয়নি আম্মু।"
রেহেনা অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো নিচু স্বরে বলে,"উনি কিছু করেনি আমার সাথে।"
_বিয়ের দুমাস হয়ে গিয়েছে। কিছুই হয়নি তোর সাথে?
আলো না সূচক মাথা নাড়ায়। রেহেনা বেশ অবাক হয় কথাটি শুনে।
***
"ভাইয়া আসবো।"
_আয়।
ইশমাম ভেতরে ঢুকতেই সামিন উঠে বসে। সে ইশমামের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,"হাতের ব্যাথা সেরেছে? তুই একটা অদ্ভুত মানুষ, তোর ভাবীর মতো। ঐ মেয়েটাও কখন কি করে ফেলে বোঝা মুশকিল। নিজেও জানে না আসলে। কখনো বই ছুড়ে মা'রে,বই দিয়ে বারি মা'রে, মিন্ট লেমন ছুড়ে মা'রে, বাচ্চাদের মতো থুতু দেয়, আমার পাঞ্জাবি টুকরো টুকরো করে কে'টে ফেলে।"
কথাটা বলে সামিন একা একা কিছুক্ষণ হেসে নেয়। ইশমাম ম্লান হেসে তার ভাইয়ের পাশে বসে। তারপর সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"ঐ অদ্ভুত মেয়েটাকে পেয়ে গেলে খুশি হবে খুব?"
সামিন হাসি থামিয়ে মাথা নিচু করে বলে,"সব কিছু পেয়ে গিয়েছি,এমন অনূভুতি হবে।"
ইশমাম চুপ করে তার ভাইয়াকে দেখে। তারপর বলে,"আমি চলে যাচ্ছি ভাইয়া।"
_সবাই চলে যাচ্ছিস। যাবিই তো, আমি সবাইকে জোর জবরদস্তি করি। খা'রা'প মানুষ।
ইশমাম ভাইকে দেখে। সামিনের কন্ঠে এক রাশ হতাশা। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে সে। ইশমাম পাশে বসে তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে ।
***
মোট ষোলো হাজার তিনশ ছয় টাকা। পঞ্চম বারের মতো টাকা গুলো গুনে নেয় আলো। বরাবর সে টাকা পয়সা গুনতে অদক্ষ।
টাকা গুলো মুঠির মধ্যে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। এই টাকা গুলো সে টিউশনি করিয়ে জমিয়েছিলো একটা নতুন ফোন কিনবে বলে। ইউনিভার্সিটিতে পা দেওয়ার সাথে সাথে আতাউর আলমের থেকে হাতখরচা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল আলো। সে বরাবর আত্মনির্ভরশীল মেয়ে হতে চেয়েছিলো। পেরেওছিলো। মাঝখান থেকে একটা ঝড় এসে সবটা ওলটপালট করে দিলো,সবটা!
তবে আলো নিশ্চিত,অতি দ্রুত সবটা গুছিয়ে নিতে পারবে সে। সেই আত্মবিশ্বাস আলোর আছে।
সকাল থেকে আলোর মধ্যে একটা ব্যাস্ত ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাবার সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে নিজে কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। আতাউর আলম মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠেছে। তবে কিছুটা অস্বাভাবিক লাগে তাকে, আগের মতো নেই কিছুই। কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ করেন। অবশ্য কত বড় একটা অপারেশন হয়েছে,এমন আচরণ করা স্বাভাবিক।
"যাচ্ছিস কোথাও?"
আলো গলায় ওড়না দিয়ে ঘুরে তাকায় রেহেনার দিকে। রেহেনা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে দেখেছে।
কলেজ ব্যাগ টা কাঁধে উঠিয়ে ক্যাবিনেট থেকে স্লিপার বের করতে করতে বলে,"হু। ইউনিভার্সিটি যাচ্ছি।"
_কলেজ যাচ্ছিস?
_ওমা,অবাক হচ্ছো কেন? আমি যে স্টুডেন্ট এটা ভুলে গেলে?
রেহেনা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,"পড়াশোনা টা চালিয়ে যেতে চাই। সাথে টুকটাক কাজ করবো। আব্বুর অবস্থা দেখে যা বুঝলাম, আমি ছাড়া এই সংসারের গতি নেই।"
রেহেনা কোনো কথা বলে না। আলো চলে যায়। ও ঘর থেকে আতাউর আলম ডাকছে। রেহেনার কানে সে ডাক পৌঁছায় না। কপালে তার চিন্তার রেখা। সবটা কি আদৌও আগের মতো করা সম্ভব? একজন মা হিসেবে তার কি করা উচিৎ? মেয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেয়া? নাকি সমাজের বাঁকা কথা যাতে শুনতে না হয় সেজন্য মেয়েকে সবটা মানিয়ে নিতে বলা? কোনটা?
***
"কি বুড়ি? তুমি সকাল সকাল চলে এলে?"
গম্ভীর কন্ঠে কথাটি বলে সামিন ঢোকে তার পার্টি অফিসের সামনের টং-য়ের দোকানটায়।
_তোর দাদা আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে না। কি আর করি বল!
সামিন মৃদু হেসে একটা বেঞ্চিতে বসে পরে। তার সামনে রয়েছে প্রায় সত্তর বছর বয়সী দুজন বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা। সামিন মজার ছলে বলতে থাকে,"দু'জনেই প্রত্যেক মাসে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছো তবুও তোমাদের টাকার লোভ গেলো না। এই দোকানের কি দরকার? এতো টাকা নিয়ে যেতে পারবে কবরে? কাউকে যে দিয়ে যাবে সে উপায় তো নেই,তারা তো তোমাদের খোজ নেয় না।"
মনা বিবি হেসে বলে,"তোকে দিয়ে যাবো সব।"
_আমার তোমাদের ওসব খুচরা পয়সার দরকার নেই। আমার অনেক টাকা!
_জানি তোর অনেক টাকা, তা তুই এই দোকানে চা খেতে আসিস কেনো? ঐ যে ঐ সাহেবদের ইটের দালানে যা।
শাহজাহান মিয়া সামিনের দিকে এক কাপ চা বানিয়ে দেয়। কাপে চুমুক দিয়ে সামিন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। লোকজন তাকে অবাক হয়ে দেখে। একজন মেয়র এভাবে টিনের ছাপড়া দেওয়া দোকানের বেঞ্চিতে বসে চা খেতে খেতে গল্প করছে এটা বেশ অবাক করা একটা দৃশ্য। এসব দৃশ্য নির্বাচনের আগে আগে দেখা যায়, পরে নয়।
মনা বিবি নিচু স্বরে বলে,"তোর বৌ কেমন আছে?"
_বৌ চলে গেছে।
_ভেগে গিয়েছে নাকি? কার সাথে?
_ভেগে যায়নি, চোখের সামনে থেকে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে ।
_রাগ করে? কি করেছিস?
_অনেক কিছু তোমরা বুঝবে না।
_তোর মতো মানিকের ওপর রাগ করে চলে যায়? কেমন মেয়ে মানুষ?
_অদ্ভুত মেয়ে মানুষ দাদী। অদ্ভুত মেয়ে মানুষ।
সামিন চায়ের বিল মিটিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এলোমেলো ভাবে হেটে অফিসের গেইট দিয়ে ঢোকে। আজ একটা মানববন্ধন আছে প্রেসক্লাবের সামনে। তার আগে দলের ছেলেদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা জরুরি। অফিসে ঢুকে দেখে সবাই অলস ভঙ্গিতে বসে আছে, কেউ কেউ মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যাস্ত।
সামিন নিজের চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে বসতে বসতে বলে,"কিছু মাছি এনে মা'র'তে পারতি। এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে ভালো লাগে না।"
তৌফ উঠে দাঁড়ায়। সামিন তার দিকে না তাকিয়ে একটা কাগজ দেখতে দেখতে বলে,"আপডেট বল।"
তৌফ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,"কোনটার?"
_তোর ভাবীর, আমার বৌয়ের।
_ভাবী চারঘন্টা আগে নিউ মার্কেটের বনি টেলিকম থেকে একটা নতুন মোবাইল ফোন কিনেছে এবং সাথে একটা সিমকার্ড। সেখান থেকে বের হয়ে তাদের কলেজের সামনে পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে একটা বান্ধবীর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করেছে, তারপর তাদের বাড়ির সামনের একটা ডিসপেনসারির দোকান থেকে আপনার শ্বশুরের জন্য কিছু ওষুধ নিয়েছে। এবং সবশেষে একটু আগে বাড়িতে ঢুকেছে। ওহহ হ্যা ভালো কথা, বাড়িতে ঢোকার আগে কুকুর দেখে ভ'য় পেয়ে দৌড়াতে গিয়ে একবার উষ্ঠা খেয়ে পরে গিয়েছিলো।
সবাই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে তৌফের শেষের কথাটা শুনে। সামিন ক'ট'ম'ট দৃষ্টি দিয়ে তাকায় সবার দিকে। সবাই চুপ হয়ে যায়। তৌফ বলতে থাকে,
_তার পরনে ছিলো একটা লাল রঙের সালোয়ার কামিজ, মুখটা ছিলো শুকনো। দেখে মনে হয়েছে সকালে নাস্তা করেনি।
সামিন তৌফের কথায় তার দিকে তাকিয়ে বলে,"বাহ! তুই তো একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছিস! এবার আমার বৌয়ের নাম্বার টা এনে দে।"
তৌফ তৎক্ষণাৎ তার ফোনটা বের করে সামিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে দাঁতের পাটি মেলে বলে,"কাঁচা কাজ করি না ভাই!"
***
দুমিনিট বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বইটা বিছানার উপরে ছুঁড়ে মারে আলো। সবকিছু তার কাছে নতুন মনে হচ্ছে। কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। এই ইয়ারের ফার্স্ট ইনকোর্স এক্সাম টাই দিতে পারলো না সে। মার্কস টা না পেলে মুশকিল। কিছুক্ষণ বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে। মাথাটা বেশ ব্যাথা করছে। এখন এমনিতেও পড়া হতো না। তার চেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলে ভালো হয়। বসার ঘর থেকে পাশের বাড়ির দু'জন ভদ্রমহিলার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ইনিয়ে বিনিয়ে আলোর ব্যাপারেই আলোর মায়ের কাছে বলছে তারা। জানতে চাচ্ছে আলো কদিনের জন্য এসেছে। বিরক্তিতে আলো কপাল কুঁচকে ফেলে। ইচ্ছে করছে ভদ্রভাষায় কিছু কটু কথা শুনিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। কিন্তু আলো দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে। একেবারে ডি'ভো'র্স পেপারে সাইন করে সবাইকে মাইকিং করে জানিয়ে দেবে সে। এখন কিছুদিনের অপেক্ষা।
ঘুম পাচ্ছে খুব। প্রায় ঘুমিয়েও গিয়েছিলো। হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আলো বেশ অবাক হয়। তাকে কে ফোন দেবে! কেউ তো তার নতুন নাম্বার জানেই না। রং নাম্বার ভেবে প্রথম বার ফোন টা রিসিভ করে না সে। দ্বিতীয়বারের সময় ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে বলে,"হ্যালো কে বলছেন?"
সামিনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে তার কাঙ্ক্ষিত নারীকন্ঠটি শুনে।কন্ঠে সেই চিরাচরিত তেজ। এমন ভাবে হ্যালো বলছে পুরো শহর শুনতে পেয়েছে বোধ হয়। কিছু মুহূর্ত সময় নিয়ে সে বলে ওঠে,"হ্যালো...."
আলোর হাত কেঁ'পে ওঠে। ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে কিছুটা সময় সে নেয়। তারপর বলে,"কে বলছেন?"
_আমি তোমার ফে'রা'উ'ন আছিয়া।
আলো নিশ্চুপ হয়ে যায়। সামিন বলতে থাকে,"কেমন আছো?"
_আপনি আমার নাম্বার পেয়েছেন কিভাবে?
সামিন হেসে ফেলে। হাসি থামিয়ে বলে,"কেনো বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করছো আলো? তোমার ফোন নাম্বার পাওয়া কোনো ব্যাপার আমার কাছে?"
_কি চাই আপনার? আবার কি?
_আপাতত কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই।
_ইয়াসার মির্জা।
_হ্যা বলো আছিয়া।
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"আপনার লোকজন আমাকে ফলো করে, আপনি মাঝরাতে ফোন দিয়ে বিরক্ত করেন, এর মানে টা কি? আপনি কি ভুলে গিয়েছেন সবটা শেষ হয়ে গিয়েছে?
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাঁকা হেসে বলে,"শেষ হয়নি আছিয়া। সবটা শুরু হতে যাচ্ছে।"
_মানে?
_মানে অপেক্ষা করো, ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে। তোমার মতো মাথামোটা মেয়ের ধীরে ধীরে বোঝাই ভালো!
_চরিত্রের দিক থেকে আপনি শুধু ক্রি'মি'না'ল না। একটা নির্লজ্জ মানুষও আপনি জানেন?
_হুম জানি। আমি নির্লজ্জ, আর তুমি ত্যা'ড়া। একজন ত্যা'ড়া মানুষকে কাবু করতে একটা একজন নির্লজ্জ মানুষ দরকার পৃথিবীতে। আমরা একেবারে পারফেক্ট কম্বিনেশন আছিয়া।
আজকের পর্বটা অনেক বড় তাই সবাইকে সরাসরি ফেসবুক থেকে পড়ার পরামর্শ রইলো, ফেইসবুক লাইট থেকে পড়তে অসুবিধা হতে পারে।
"আজ আবার নতুন সিমকার্ড? দুদিন আগেও তো নিলি। ঘনঘন সিমকার্ড চেঞ্জ করছিস কেনো!"
হিয়া আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো ফোনটা ব্যাগে ভরে থমথমে মুখ নিয়ে বলে,"একটা অ'স'ভ্য, নির্লজ্জ লোক খুব বিরক্ত করে। অনেক বেশি বেহায়া সে।"
_তো দুলাভাইকে বল। মেয়রের বৌকে ডিস্টার্ব করে। কত বড় সাহস! মেরে ঠ্যাং ভে'ঙে দিক।
আলো শুকনো মুখে হিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। হিয়াকে বলে দেবে সেই লোকটা ইয়াসার মির্জা নিজেই?
হিয়া কথা বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করে। আলোও গুটি গুটি পায়ে হিয়ার পিছু পিছু হাটে। কন্ঠে অভিযোগের সুর তুলে হিয়া বলে ওঠে,"একটা বার আমাদের জানাতে পারলি না ভাইয়ার কথা? বেশ অবাক হয়েছি তোর আর ইয়াসার ভাইয়ার বিয়ের কথা শুনে। মানে হুট করে? কিভাবে? বলছিস না কেনো কিছু?"
আলো আমতা আমতা করে বলে,"ওসব বাদ দে। পড়ার কথা বল। অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিস তাই না তোরা? আচ্ছা শ্রাবণী কেন আসে না? ওর কি বিয়ে হয়ে গিয়েছে?"
হিয়া মুখ মলিন করে বলে,"আর বলিস না। অনেক ঝামেলার মধ্যে আছে ও। ওদের বাড়ি প্লাস দোকান ঘরটা দখলের চেষ্টা চলছে। ওর বাবা ছোটাছুটি করে অসুস্থ হয়ে পরেছে। সবটা ওকেই দেখতে হচ্ছে।"
আলো অবাক হয়ে বলে,"পুলিশ কি করছে? পুলিশের কাছে যায়নি?"
_টাকা দিয়ে আইন কিনে নিয়েছে দখলদাররা। কিছু করার নেই। ওদের মাথার ওপর শক্ত কোনো হাতও নেই। আতাউর আংকেল যে কিছু করবে সে তো দুমাস ধরে আংকেল অসুস্থতার জন্য গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে এসব ঝু'ট ঝামেলা থেকে।
আলো মাথা নিচু করে শুনতে থাকে হিয়ার কথা। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে সে বাবার কথা শুনতেই।
_এই আলো! এই!
হিয়া আলোকে ধাক্কা দেয়। আলোর ঘোর কেটে যেতেই "হু" বলে সাড়া দেয়। হিয়া বলে,"কি ভাবছিলি?"
_কিছু না, বল।
_শ্রাবনীর কথা বলছিলাম। আচ্ছা আলো, তোকে একটা কথা বলতে চাই। কিছু মনে করবি নাতো ?
_না। মনে করবো কেনো। বল।
হিয়া আমতা আমতা করে বলে,"তুই ইয়াসার ভাইয়াকে বলে দেখবি যাতে সে শ্রাবনীদের বিষয়টা একটু দেখে দেয়? আমি নিশ্চিত সে দেখলেই হবে!
হিয়ার কন্ঠে অনুরোধের সুর। আলো অবাক চোখে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে, কিছু সময় পরে বলে,"আমি?"
_হ্যা তুই। তুই বৌ, তাই ভাইয়া তোর কথাটা গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। শ্রাবনীর বাবা অসুস্থ শরীর নিয়ে যেতে চেয়েছিল ভাইয়ার কাছে শুনেছি। প্লিজ তুই একটু দেখ! প্লিজ প্লিজ প্লিজ!
হিয়া আলোর হাত ধরে ফেলে। আলো ঘামতে থাকে। সে কিভাবে ঐ লোকটার কাছে অনুরোধ করবে! কিভাবে!
***
"আমরা কত দ্রুত বড় হয়ে গেলাম তাই না ছোটো?"
ড্রাইভ করতে করতে সামিন ইশমামের দিকে তাকিয়ে বলে কথাটা। ইশমাম মাথা নিচু করে বসে আছে। নরম গলায় বলে,"তোমার কন্ঠে আমার প্রতি রাগ ভাইয়া। তুমি শুধু শুধু রাগ করছো। আমি ফিরে আসবো।"
সামিন ম্লান হাসে। তারপর বলে,"রাগ? আমার তো উলটো টা মনে হচ্ছে ছোটো। আমার তো তোর প্রতিটা আচরণে মনে হচ্ছে তুই কোনো কারনে আমার উপর রেগে আছিস অথবা আমি তোকে কষ্ট দিয়েছি।"
ইশমাম ভাইয়ের দিকে তাকায়। স্টিয়ারিংয়ের ওপর রাখা সামিনের বাম হাতের ওপর আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলে,"ধূর! তুমি বেশি বেশি ভাবো ভাইয়া।"
_তুই সবসময় অন্যায় কাজ অপছন্দ করিস। আলোর বিষয়টা নিয়ে তুই আমার উপরে রাগ? আমি জেদের বশে সবসময় ঝামেলা করি বলে?
ইশমাম চুপ করে থাকে। তারপর বলে ওঠে,"ঝামেলা করো, আবার সবটা ঠিক ঠাকও তো করে নাও। তাই রাগ নেই।"
***
"আপনার নাম।"
_অদ্রিতা আলো।
লোকটা বাতাসের বেগে আলোর নামটা লিখে ফেলে রেজিষ্ট্রার খাতায়।
তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"বিবাহিতা?"
অজান্তেই আলোর মুখ থেকে বেরিয়ে যায় কথাটা,"জ্বি।"
তৎক্ষণাৎ আলো নিজেকে শুধরে নিয়ে বলে,"জ্বি না।"
_একবার জ্বি, আরেকবার জ্বি না। মানে কি?
পেছন থেকে হিয়া বলে,"বিবাহিতা। ও বিবাহিতা। আসলে কদিনের জন্য বাপের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে তাই সব খেয়ে বসে আছে।"
কথাটি বলেই দুষ্টুমির ছলে আলোর মাথায় গাট্টা মে'রে দেয় সে। লোকটা একটা ফরমে আলোর নাম ঠিকানা তুলতে থাকে। তারপর বলে,"স্বামীর নাম?"
আলো ঘামছে। হিয়াটা তাকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। সে আমতা আমতা করে বলে,"বাবার নাম দিলে কি সমস্যা?"
_স্বামীর নাম সামিন ইয়াসার মির্জা। এই শহরের মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জা।
হিয়া বলে দেয় দ্রুত। লোকটা হা হয়ে আলোর দিকে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে থাকে। ইয়াসার মির্জার বৌ এসেছে তাদের কাছে! আলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে ওঠে,"তোমাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেনো দেখেছি।"
"খুব ফেমাস মেয়ে। চেনা চেনা লাগতেই পারে। যেখানে যায় নিজের র'গ'চ'টা স্বভাবের জন্য একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে আসে, কিছুদিন আগে টিভিতেও উঠেছিলো। আপনি সম্ভবত দেখেন নি। আপনি তাড়াতাড়ি ফরমটা দিন আংকেল। অফিস তো বন্ধ হয়ে যাবে।"
লোকটা আমতা আমতা করে বলে,"ইয়াসার মির্জার বৌ এসেছে স্টুডেন্ট লোনের জন্য এপ্লাই করতে!"
আলো লোকটার দিকে স্থির দৃষ্টি দেয়। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে,"কেনো? আমার জন্য নিষেধ আছে রাষ্ট্র থেকে? আমাকে লোন দেওয়া যাবেনা?"
_ঠিক তা না। আপনার স্বামীর তো অনেক টাকা.....
হিয়া বলে ওঠে,"প্রবলেম কি আংকেল? স্বামীর টাকা তো কি হয়েছে? একটা মেয়ে নিজের চেষ্টায় স্বাবলম্বী হতে চাইলে সে পারে না? জানেন আমার বান্ধবীর খুব আত্মসম্মান। আর এজন্যই তো ইয়াসার ভাইয়া ওকে পছন্দ করেছে। ওর মতো মেয়ে হয় না।"
_তুই চুপ করবি??
হিয়াকে থামিয়ে দিয়ে আলো লোকটার দিকে তাকায়। তারপর নরম গলায় বলে,"আংকেল প্লিজ। আমার খুব দরকার টাকা টা।"
লোকটা মৃদু হাসে। তারপর কাগজপত্র গুলো আলোর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে,"তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে মেয়ে। আমি তোমার কথাটা মাথায় রাখবো।"
***
সামিনের দিকে একবার ঘুরে তাকিয়ে তৌফ দলের কাছে এসে চুপচাপ বসে পরে। সামিন ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে কথা বলছে। শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পরনে, চোখে সানগ্লাস, পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রেখেছে। টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে, রাশভারী পুরুষালি গলায় চমকপ্রদ কিছু বাক্য দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারদের মুগ্ধ করছে এই তরুণ মেয়র।
তৌফ দলের ছেলেদের বলে,"ভাইকে দেখছেন আপনারা? একেবারে নায়কের মতো। মনে হচ্ছে এখানে সিনেমার শুটিং চলছে, ভাই তার ডায়লোগ দিচ্ছে।"
রাহাত সামিনের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,"এতো সুন্দর, এতো উপযুক্ত স্বামী রেখে যে মেয়ে তেজ দেখিয়ে চলে যায়, সে মেয়ে মেয়েই না,সাধু সন্ন্যাসীর লেভেলে চলে গিয়েছে।"
আরাফ উঠে বলে,"ও কি সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে নাকি? মাথার তার ছিঁড়ে গিয়েছে অনেক আগেই। মনে নেই ওর কর্মকান্ড? ভাইকে এসে হুট করে চ'ড় মারা, রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের অপমান করা। কেউ পাগল না হলে ছাত্রনেতার সাথে এমন করে?"
_এই তুই "ও" বলছিস কাকে? ভাই শুনলে একটা আ'ছা'ড় মারবে তোকে।
চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে রাহাত। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে কথা বলে ওদের দিকে এগিয়ে আসে।
তৌফ আনমনে গান গাইতে শুরু করে,"প্যাহেলি প্যাহেলি বার মোহাব্বত কি হে,কুছ না সামাঝ মে আয়ে মে কেয়া কারু,
ইশ্ক নে মেরি এ্যাছি হালাত কি হে,কুছ না সামাঝ মে আয়ে মেয়ে কেয়া কারু।"
সামিন এগিয়ে এসে তৌফের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"কি হয়েছে তোর? কি গাইছিস এটা?"
_হিন্দি গান ভাই, এর অর্থ হচ্ছে, "প্রথম প্রথম বার ভালোবেসে ফেলেছি, কিছু বুঝতে পারছি না আমি কি করবো। মন আমার এমন হাল করলো, কিছু বুঝতে পারছি না আমি কি করবো!"
সামিন তৌফের দিকে শীতল চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে,"অর্থ বুঝেছি আমি। কেনো গাইছিস এটা? আমাদের দলটাকে তোর গানের পালা মনে হয়? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে গান গাই আমরা?"
তৌফ মাথা নাড়ায়। সে ভীষণ ঘা'ব'ড়ে গিয়েছে ভাইয়ের ধ'ম'কে।
সামিন চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,"কাজ শেষ আমার। বয়েজ কলেজে যাবি? কতদিন হারুন চাচার টং-য়ের দোকানের চা খাইনা। ফুয়াদকেও ডেকে নে। আর ওখানের ফুটবল টিমকে খবর দে। মন ভালো নেই আমার।"
_ইশমাম ভাইয়ের জন্য মন খারাপ?
সামিন কিছু না বলে রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলে,"বাইক স্টার্ট কর।"
আজ সামিন গাড়ি নিয়ে আসেনি। হাই ওয়ে-তে মোট ষোলো টা বাইক সাই সাই করে চলছে। সামিন রাহাতের পেছনে বসেছে। সবাই বয়েজ কলেজের সামনে গিয়ে বাইক পার্ক করে। ফুয়াদ আগে থেকেই গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। দলবল নিয়ে হারুনের দোকানে ঢুকে পরে সামিন।
চা খেতে খেতে সবুজকে বলে,"আমি কত বাজে মেয়র দেখেছিস? জনসেবা রেখে এখানে আড্ডাবাজি করছি। ব'খা'টে'দে'র মতো বাইকে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি।"
ফুয়াদ সামিনের হাবভাব দেখেই বুঝেছিলো সামিনের মন খারাপ। কিছুক্ষণ যেতেই সে আমতা আমতা করে বলে ওঠে," তোর কি মন খারাপ?"
সামিন কিছু বলে না। ফুয়াদ বলে,"কি হয়েছে নতুন করে?"
_নতুন করে কিছু হয়নি। সারাদিন ভাবীর জন্য মন খারাপ থাকে আর এখন ইশমাম ভাইয়ের জন্য।
কন্ঠে সামিনের প্রতি সহানুভূতি সবুজের। সামিন সবুজের দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে,"বেশি কথা বলবি না। আমি সারাদিন মন খারাপ করি তোর ভাবীর জন্য? কি ধরনের কথা এগুলো?"
ফুয়াদ হাসতে হাসতে বলে,"তোর মতো পুরুষ এগুলো স্বীকার করবে না জানি। তাহলে তোর পৌরুষ চলে যাবে।"
সামিন চুপ হয়ে যায়। তারপর কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,"সত্যি কথা বলতে মিস করি ওকে। ওর পাগল পাগল আচরণ গুলোকে।"
তৌফ বলে,"ভাবী কে একটা ইমোশনাল মেসেজ লিখে পাঠিয়ে দিন ভাই। মেয়ে মানুষের মন গলাতে এইসব "ভং চং" কথা বার্তা অনেক কাজে দেয়।"
সামিন তৌফের দিকে তাকিয়ে বলে,"ভং চং কথাবার্তা মানে?"
_এই ধরেন। কবিতা বা গানের দুইটা লাইন । যা একেবারে একটা মেয়েলোকের হৃদয়ে গিয়ে লাগবে। সারাদিন চিল্লাচিল্লি করে এদের কাছে মার্কেট পাওয়া যায় না,তবে এইসব "ভুগিচুগি" কথাবার্তায় এরা পটে যায়। আমিও আমার গার্লফ্রেন্ডকে এভাবে পটিয়েছি।
সামিন কিছুক্ষণ বোকার মতো তৌফের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ফোনটা তৌফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,"লিখে দে অমন একটা মেসেজ।"
তৌফ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,"ছিঃ ছিঃ ভাই। ভাবীর মেসেজ আপনি নিজের হাতে টাইপ করেন। আমি বলে দিচ্ছি।"
সবাই খুবই আগ্রহী হয়ে দেখতে থাকে তৌফ আর সামিনের কর্মকাণ্ড। তৌফ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,"লেখেন, যেদিন আমি হারিয়ে, বুঝবে সেদিন বুঝবে।"
সামিন লিখতে থাকে,"যেদিন আমি হারিয়ে যাবো, বুঝবে সেদিন বুঝবে।"
তৌফ বলতে থাকে,"অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে।"
সামিন লিখে ফেলে। তারপর তৌফের দিকে তাকিয়ে বলে,"লাইন দুটো সুন্দর। কার লেখা?"
তৌফ বলে,"কি জানি, জসীমউদ্দীন নয়তো কাজী নজরুল ইসলাম।"
রাহাত বলে,"জসীমউদ্দীনেরই হবে। কাজী নজরুল বিদ্রোহ করে কুল পেতো না এসব "ভুগিচুগি" কথাবার্তা লিখতো কখন?"
ফুয়াদ সামিনের ফোনটা নিয়ে বলে,"দেখি গুগলকে জিজ্ঞেস করে দাড়া।"
সামিনের ফোনটা হাতে নিয়ে ফুয়াদ কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে সামিনের দিকে তাকায়। হতভম্ব হয়ে সামিনকে বলে,"এসব কি লেখা তোর সার্চ হিস্ট্রিতে? কিসব জানতে চেয়ে বেড়াতি এসব! স্ত্রীর মন জয় করার উপায়!
বৌয়ের উপর রাগ উঠলে তা নিয়ন্ত্রণ কিভাবে করে!
স্ত্রীর সাথে কিভাবে কথা বলা উচিত!"
পড়তে পড়তে ফুয়াদ উচ্চশব্দে হাসতে থাকে। তার হাসি থামছেই না। সামিন থাবা মে'রে ফোনটা কেড়ে নিয়ে থমথমে মুখ নিয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে ফুয়াদ বলে,"বেচারা গুগল কে তো বেশ অত্যাচার করেছিস এই ক'দিন।"
সামিন তার দলের ছেলেদের সামনে লজ্জায় পরে যায়। ফুয়াদ বলে,"কিছু শিখতে পেরেছিস?"
তৌফ বলে ওঠে,"ভাই মেসেজ টা পাঠিয়ে দিন ভাবীর নাম্বারে। দেখবেন একটু হলেও মন গলবে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি। তমাকে এটা লিখেই পটিয়েছি আমি।"
সামিন কিছুক্ষণ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"তমা আর আতাউর আলমের মেয়ে অদ্রিতা আলো এক হলো? এই মেসেজ পাঠালে তোর ঐ ভাবী কি লিখবে জানিস? লিখবে জাহান্নামে যান। মিলিয়ে নিস। দরকার নেই। বাদ দে, বাদ দে।"
তৌফ জোর করে সামিনের ফোনটা নিয়ে বলে,"ধূর ভাই! কিছু হবে না এমন। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি মেসেজ টা।"
_না তৌফ।
_হ্যা ভাই।
_তৌফ পাঠাস না।
তৌফ দাঁত বের করে বলে,"পাঠিয়ে দিয়েছি ভাই!"
***
মেসেজের টুং টুং আওয়াজে বই থেকে চোখ সরিয়ে মোবাইল টা হাতে নেয় আলো।
"যেদিন আমি হারিয়ে যাব বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে।"
সামিন ইয়াসারের নাম্বার দেখে আলো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। নতুন নাম্বার টাও জেনে গিয়েছে লোকটা! লোকটা যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। আর কত সিমকার্ড চেঞ্জ করবে আলো!
মেসেজটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলো তার উত্তর টাইপ করতে থাকে।
সামিনের ফোনে নোটিফিকেশনের টুং টাং আওয়াজ হয়। সবাই কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সামিন আলোর নাম্বার দেখে খুশি হয় কিন্তু পরক্ষনেই মেসেজটি দেখেই তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ফুয়াদ বলে,"কি লিখেছে আলো?"
সামিন থমথমে মুখ নিয়ে বলে,"লিখেছে Go to hell!"
ফুয়াদ ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। অবশ্য সে জানতো আলো এমন কিছুই বলবে। তৌফ বলে ওঠে,"ভাই আপনি তো বলেছিলেন ভাবী লিখবে জাহান্নামে যান কিন্তু ভাবী লিখেছে Go to hell, আপনার কথা পুরোপুরি মিলে নাই ভাই।"
সামিন শীতল চোখে তৌফের দিকে তাকায়, তারপর রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলে,"এই ওর কানের নিচে একটা ঠাঁটিয়ে চ'ড় মেরে দে তো।"
কিছুক্ষণ বিরক্ত হয়ে বসে থাকে আলো। আবার ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। শ্রাবনীর নাম্বার দেখে তৎক্ষণাৎ রিসিভ করে কানে ধরে।
ফোনটা কানে চেপে ধরে আলো চুপ করে আছে। ওপাশ থেকে শ্রাবনীর কান্নার শব্দ আসছে। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আলো বলে ওঠে,"কাকার কি অবস্থা?"
_আছে। খুবই ভেঙে পরেছে বাবা।
আলো আমতা আমতা করে বলে ওঠে,"আমাকে কি করতে হবে?"
_তুই একটু ইয়াসার মির্জাকে বলে দেখনা। আমি জানি সে পারবে। তার অনেক ক্ষমতা।
আলো অস্বস্তিতে পরে যায়। শ্রাবনীকে কিভাবে মানা করে দেবে সে! কিন্তু ঐ লোকটাকে আলো কি বলবে! এমনিতেই লোকটা আলোর পিছু ছাড়ছে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা চিন্তা করে আলো তারপর শ্রাবনীকে আশ্বস্ত করে নিচু স্বরে বলে,"আচ্ছা। তুই রাখ। আমি দেখছি। তোকে জানাবো।"
***
কলিং বেলের আওয়াজ আলো পেয়েছে। বিছানায় অলস ভঙ্গিতে উপুড় হয়ে শুয়ে একটা বইয়ে মুখ গুঁজে ছিলো সে। একেবারেই উঠতে ইচ্ছে করছে না। দুমিনিট পরে নিচু গলায় রেহেনাকে ডেকে বলে,"মা কে এসেছে?"
"আমি"
ইশিতার গলার আওয়াজ পেয়ে আলো হকচকিয়ে উঠে বসে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। আলোর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ইশিতা। তার মুখ হাসি হাসি।
বিছানা থেকে ওড়নাটা তুলে গলায় পেঁচিয়ে ইশিতার দিকে ছুটে যায় আলো। ইশিতার হাত ধরে আনন্দিত গলায় বলে,"তুমি!"
ইশিতা হেসে বলে,"খুব কষ্ট করে খুঁজে বের করলাম তোমাদের বাড়ি।"
আলো ইশিতাকে টেনে এনে নিজের বিছানায় বসিয়ে দেয়। ইশিতা আলোকে কয়েক মুহূর্ত দেখে বলে,"সালোয়ার কামিজে তোমাকে ভালো লাগে না ভাবী।"
আলো ইশিতার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে নিচু স্বরে বলে,"ভাবী ডেকো না আমায়।"
ইশিতা হাই তুলে বলে,
_ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত তো ডাকতেই পারি।
আলো বিছানার একপাশে বসে। ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"রিতু কেমন আছে?"
_খুব একটা ভালো নেই। সারাদিন বমি হতে থাকে।
_তোমাদের দু'জনকে খুব মিস করি।
_আদৌও করো? মনে তো হয়না আমার।
আলো ম্লান হাসে। ইশিতা বলতে থাকে,"আর কাউকে করো না?"
_আর কাউকে করার কথা আপু? কেনো এসব অযৌক্তিক কথা বলছো।
ইশিতা চুপ করে থাকে। আলো বলে,"এভাবে এসো মাঝে মাঝে। আমার ভালো লাগবে।"
ইশিতা আলোর কথার জবাব না দিয়ে বলে,"বাড়িটা একেবারে আগের মতো হয়ে গিয়েছে। তুমি চলে এসেছো, ইশমামও আমেরিকা চলে গিয়েছে। আবার সেই আগের রূপ। সময় কাটে না আমার। তাই খুঁজতে খুঁজতে তোমার কাছে এলাম।"
_ইশমাম চলে গিয়েছে?
আলো জানতে চায়। ইশিতা মাথা নাড়িয়ে বলে,"গত পরশু।"
আলো আর কথা বাড়ায় না। প্রসঙ্গ পালটে বলে,"শান্ত ভাইয়া কেমন আছে?"
_ভালো।
_সব ঠিক আছে? আর কিছু বলেছে তোমাকে তোমার ওই গুণধর ভাইয়া?
ইশিতা মাথা নাড়িয়ে বলে,"ভাইয়া আমার সাথে কথা বলে না সেদিনের পর থেকে।"
***
হুট করে ব্রেক ক'ষে দিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ ফেলে সামিন। কিছুক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। সাগর তার নিজের গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। সামিন এগিয়ে গিয়ে দাঁত খিচিয়ে সাগরকে কুৎসিত একটা গা'লি দেয়। সাগর মুচকি হেসে বলে,"মেয়রের মুখে এসব গালি মানায়?"
_সর এখান থেকে। এটা তোর বাপের রাস্তা না।
ধ'ম'কে ওঠে সামিন।
সাগর হেসে ফেলে,বলে,"কোনটা আমার বাপের তা আমি ভালো করেই জানি। শুনলাম তোর বৌ চলে গিয়েছে বাপের বাড়ী! এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে চলে গেলো? শা'লা তোর সাথে আসল জিনিস নেই নাকি!"
কথাটা বলে খিক খিক করে হাসতে থাকে সাগর। সামিন শীতল চোখে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাগর হাসি থামিয়ে বলে,"সমস্যা নেই। আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি। তুই আর আমি তো একই।"
সামিন সাগরের কলার ধরে চেঁচিয়ে ওঠে,"একেবারে জিভ টে'নে ছিঁ'ড়ে ফেলবো বা'স্টা'র্ড!"
সাগর সামিনের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলে,"দুই কোটি টাকা উসুল করবো আমি তোর থেকে। যেভাবে হোক ইয়াসার মির্জা।"
কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলে,"অবশ্য তোর বৌকে আমার কাছে দিলে একটু চিন্তা ভাবনা করে দেখতাম...."
কথাটি বলে সাগর শেষ না করতেই সামিন সাগরের নাক বরাবর একটা ঘু'ষি মে'রে দেয়। সাগর নাক চেপে ধরে মাথা ঘুরিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। সামিন দৃঢ় ভাবে বলে,"তোর সাথে কথা অপচয় করে লাভ নেই। আমি ক্ষে'পে গেলে এই দেশে ভিক্ষা করেও খেতে পারবি না এই কথাটা শুধু মাথায় রাখিস।"
সামিন গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট করে। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায়।
মেজাজ যথেষ্ট বিগ'ড়ে রয়েছে তার। পার্টি অফিসের সামনে গাড়ি থামিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢোকে। ছেলেরা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। যেদিন সামিনের মেজাজ গরম থাকে সবাই খুব ভয়ে ভয়ে থাকে। আজ সম্ভবত সেই দিন। কোনো কথা বললেও দুবার ভেবে কথা বলতে হবে আজ।
***
সামিন ইয়াসারের পার্টি অফিসের সামনে সিএনজি থামে। আলো তার দুইপাশে বসে থাকা হিয়া এবং শ্রাবনীর দিকে তাকায়। তারা শুকনো মুখে আলোর দিকেই তাকিয়ে আছে। আলো বেশ ঘা'ব'ড়ে আছে। সারাদিন যাকে সে তুলোধুনো করে এখন কিনা তার কাছেই হেল্প চাইতে এসেছে সে। এর থেকে লাঞ্ছনার আর কি হতে পারে!
সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে তিনজন নেমে পরে। ধীরপায়ে হেটে ইয়াসার মির্জার পার্টি অফিসের গেইটের ভেতরে প্রবেশ করে এদিকে ওদিকে তাকায়।
রাহাত চুপচাপ বসেছিলো। সে আলোকে খেয়াল করেনি। মাথা নিচু করে ফোনে কিছু দেখছিলো।
"রাহাত!"
অবাক হয়ে রাহাত মাথা তুলে তাকায়। আলোকে দেখে তার মুখ হা হয়ে গিয়েছে। আলো কিছু সময় চুপ করে থেকে বলে,"আপনার ভাইয়ের সাথে দরকার ছিলো। তার একটা এপয়েনমেন্ট পেতে পারি?"
রাহাত উঠে দাঁড়িয়ে যায়। বাকি ছেলেরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
হতভম্ব ভাব কাটিয়ে রাহাত বলে ওঠে,"ভাই আপনার জন্য অলটাইম ফ্রী। চলুন আমার সাথে।"
_ভাই।
রাহাত ডাকতেই সামিন ধ'ম'কে'র সুরে বলে ওঠে,"বলেছি আগামী একঘন্টায় কেউ আসবি না এখানে।"
_ভাই ভাবী এসেছে।
_কোন ভাবী? আমার কোনো ভাবী নেই।
_ভাই আমাদের ভাবী।
সামিন কিছু কাগজ দেখছিলো। রাহাতের কথায় মাথা তুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
রাহাত পেছনের দিকে তাকিয়ে বলে,"ভাবী আসুন।"
সামিন উঠে দাঁড়িয়ে যায়। ধীরপায়ে হেটে আলো সামিনের অফিসে ঢোকে। তার পেছনে হিয়া এবং শ্রাবনী।
আলো একপলক সামিনের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নেয়। সামিন এখনও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আলো নিচু স্বরে বলে,"আমি এখানে একজন মেয়রের কাছে এসেছি। আপনার সাথে কিছু দরকার ছিলো।"
আলোর কথায় সামিনের ঘোর কেটে যায়। সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ঠান্ডা গলায় বলে,"ঠিকাছে। আগে বসো।"
হিয়া এবং শ্রাবনী সামিনকে সালাম দেয়। সামিন সালামের উত্তর দিয়ে ওদেরকেও বসতে বলে।
সামিন রাহাতের দিকে তাকায়। রাহাত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"বলো। কি সমস্যা তোমার।"
আলো কাট কাট ভাবে বলে,"সমস্যা আমার না। সমস্যা আমার বান্ধবীর।"
সামিন শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে বলে,"তুমি শ্রাবনী না? শ্রাবনী দাস। সুজন দাসের মেয়ে? ভালো গান করো।"
শ্রাবনী মাথা নাড়িয়ে বলে,"জ্বি ভাইয়া।"
_কি সমস্যা তোমার?
_ভাইয়া আমার বাবার দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের ছেলেরা জোর পূর্বক আমাদের বাড়ি দখল করেছে, সাথে আমাদের দোকান ঘরটাও , যেটা আমাদের পরিবারের একমাত্র ইনকাম সোর্স ছিলো। এমতাবস্থায় পুরো পরিবার নিয়ে খুব বিপদে পরে আপনার কাছে এসেছি।
_পুলিশের কাছে গিয়েছিলে? সুজন কাকা কোথায়?
শ্রাবনী মাথা নেড়ে বলে,"গিয়েছিলাম। বহুবার। আমাদের থেকে টাকাও নিয়েছে অনেক কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আর বাবা অসুস্থ। তাই আমিই আলোকে রিকোয়েস্ট করে আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। "
সামিন শ্রাবনীর কথা শুনতে শুনতে আলোর দিকে তাকাচ্ছে বারবার। আলো তার দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে।
সামিন চোখ সরিয়ে নিয়ে শ্রাবনীকে বলে,"এটা লিখন দাসের কাজ? যে লিখন দাসের ডান হাতে ছয়টা আঙ্গুল?"
শ্রাবনী মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,"বিপদের মাঝ সমুদ্রে পরেছি ভাইয়া। পাশে কেউ নেই, না আছে একটা ভাই। ওরা অনবরত আমাদের চার বোনের ক্ষতি করবার থ্রেট দিয়ে যাচ্ছে।"
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"হুম বুঝলাম। আচ্ছা আমি বিষয়টা দেখবো। জমির দলিল কোথায়?"
_বাবার কাছেই।
সামিন মাথা নাড়িয়ে বলে,"আঙ্গুল টা বাঁকা করতে হবে। তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। আর তোমাদের বোনদের কিছু হবে না। দুশ্চিন্তা করো না।"
আলো তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ফেলে। নিজে একটা মেয়ে উঠিয়ে নেওয়া লোক হয়ে অন্য মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে,কি হাস্যকর! খুব হাসি পাচ্ছে আলোর। সামিনের চোখে তা পরে যায়। সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে বলে,"খুব ভালো গান করো তুমি। গত বছর শুনেছিলাম। জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় হয়েছিলে। তোমরা সব বান্ধবীরাই বেশ গুনী দেখছি। কেউ কারাতে জানো,কেউ গান। আর তুমি কি জানো?"
হিয়ার দিকে তাকিয়ে সামিন বলে। হিয়া হেসে বলে,"আমি শুধু পৃথিবীর অক্সিজেন নষ্ট করতে জানি ভাইয়া। আমি ওদের মতো গুনী নই।"
সামিন হেসে ফেলে। তারপর শ্রাবনীর দিকে তাকিয়ে বলে,"তোমার গান শুনেছি। তোমার বান্ধবীর কারাতে এখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি।"
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন প্রসঙ্গ পালটে বলে,"কি খাবে বলো? ঠান্ডা কিছু আনতে বলি?"
হিয়া মাথা নাড়িয়ে বলে,"না না ভাইয়া। আমাদের ক্লাস আছে আমরা উঠি।"
সামিন বাঁধা দিতে গিয়েও দেয়না। দেখে আলো সবার আগে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আছে।
শ্রাবনী কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে বলে,"ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করতে চাইবো না ভাইয়া।"
সামিন হাসে। তারপর বলে,"দুদিনের মধ্যে ঝামেলা শেষ করে দেবো আমি। চিন্তা করো না।"
হিয়া বলে,"আসি ভাইয়া?"
_হ্যা। তোমরা গিয়ে নিচে দাঁড়াও। তোমাদের বান্ধবী পাঁচ মিনিট পর যাচ্ছে।
আলো বলে,"মানে টা কি?"
হিয়া আলোর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে,"চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক এখানে। আমরা নিচে আছি।"
আলো বেড়িয়ে যেতে চাইলে হিয়া ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে নিচে চলে যায় শ্রাবনীকে নিয়ে।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো একপলক দেখে চোখ সরিয়ে নিয়ে কপাল কুঁ'চ'কে বলে,"কি? কি সমস্যা?"
সামিন ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বলে,"আমার কাছে তো তুমি এসেছো! আমি তো যাইনি। সমস্যা তো তোমার।"
_সমস্যা আমার বান্ধবীর। আমি একজন মেয়রের কাছে এসেছি।
_মেয়রের কাজ তো এগুলো নয়। এগুলো একটা গুন্ডার কাজ। আমি তো গুন্ডা। গুন্ডার কাছে আসতে আপনার আত্মসম্মানে বাঁধলো না আছিয়া?
আলো ক'ট'ম'ট করে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"হ্যা। গুন্ডা দেখেই এসেছি। এবার দয়া করে কাজ টা করে দিয়েন। এসব তো আপনি ভালোই পারেন।"
আলো চলে যেতে নিলে সামিন আলোর হাত টেনে ধরে। টেনে একেবারে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায়। আলো কিছুটা ঘা'ব'ড়ে যায়। অস্ফুট স্বরে বলে,"আপনি আমাকে হ্যা'রা'স করছেন ইয়াসার মির্জা।"
সামিন আরেকটু এগিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,"তুমি তো নিজেই এসেছো হ্যা'রা'স হতে।"
_আমি কিন্তু চেঁচাবো। আপনার গায়ে হাত তুলবো বলে দিলাম।
_চেঁচাও। গায়ে হাত তোলো। তোমার কি'ল ঘু'ষি আমার কাছে কাতুকুতুর মতো লাগে।
আলো চেঁচাতে পারে না। কেনো পারে না সে নিজেও জানে না। সামিন আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিচুস্বরে বলে,"সালোয়ার কামিজে বিশ্রী লাগে তোমাকে। শাড়ি পরবে। আর এভাবে কিশোরী মেয়েদের মতো দুটো বেনী করেছো কেন চুলে? বয়স কমানোর চেষ্টা? খোঁপা করবে।"
_আপনি আমাকে যেতে দিন।
_তোমার বান্ধবীদের থেকে পাঁচ মিনিট নিয়েছি। মাত্র দু মিনিট হয়েছে। আর তিনমিনিট পরে ছেড়ে দেবো।
আলো বুঝতে পারছে সে নিজের পা নাড়াতে পারছে না। সামিন আলোর ঘাবড়ে যাওয়া মুখটা দেখে মুচকি হাসে। তারপর কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,"এতো বড় উপকার করবো তোমাদের? কি দেবে বিনিময়ে?"
_আপনার ছেলেদের নাস্তা-পানির ব্যাবস্থা করে দেওয়া হবে। এর বেশি তো কিছু দেওয়ার নেই। সবটা তো বোঝেন।
_ওসব তো ওরা পাবে! আমি কি পাবো?
আলোর অস্বস্তি বেড়ে যায়। সে দূরে সরে যেতে চাইলে সামিন আবারো তার হাত ধরে টেনে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায়। ঘোর লাগা কন্ঠে বলে ওঠে,"আজ সকাল থেকে মেজাজ টা প্রচুর গরম ছিলো। তুমি এসে ঠান্ডা করে দিলে। তার জন্য তোমাকে একটা ধন্যবাদ দিতে চাই আছিয়া।"
কথাটা বলে সামিন বাঁকা হাসি হাসে। আলো কিছু বুঝে ওঠার আগে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পরে। আলো পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তার শরীর একটুও নড়ছে না। সামিন কিছু কাগজ উল্টে পাল্টে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। যেন এই মাত্র কিছুই হয়নি। কিছু সময় পরে আলোর দিকে না তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,"পাঁচ মিনিট শেষ হয়েছে। যাও।"
আলো সামিনের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। সামিন একবারও আলোকে দেখছে না। একমনে কিছু কাগজে সই করে যাচ্ছে। কিছু সময় চলে যেতে আলো দৌড়ে সামিনের অফিস রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ছুটতে ছুটতে গেইটের কাছে আসতেই সবাই অবাক হয়ে আলোকে দেখে। রাহাত চেঁচিয়ে বলে,"ভাবী কিছু হয়েছে?"
আলো দাঁড়ায় না। ছুটতে থাকে। হিয়া গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো। আলোকে ধরে বলে,"কিরে ছুটছিস কেন?"
আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"আমি বাড়ি যাচ্ছি।"
_কেন ক্লাস করবি না?
আলো কিছু না বলে একটা রিকশা থামিয়ে উঠে পরে। হিয়া আর শ্রাবনী একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
রাহাত সামিনের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকটা জড়তা নিয়ে বলে,"ভাবীর কিছু হয়েছে ভাই? কেমন ছুটতে দেখলাম।"
সামিন রাহাতের সেকথার জবাব না দিয়ে বলে,"লিখন দাস আর সৃজন দাসকে বিকেলে আমার এখানে নিয়ে আসবি। এখন সবাই যা। আমি কিছুক্ষণ একা থাকবো।"
রিকশায় উঠে ওড়নার কোনা কপালে চেপে ধরে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর কপালের যে স্থানে সামিন ঠোঁ'ট ছুঁইয়েছে,সে স্থান ঘ'ষ'তে থাকে। তার ঠোঁ'ট কাঁপছে। বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে কোনো মতে ভাড়া মিটিয়ে বাড়িতে ঢোকে। বসার ঘরে থাকা সবাইকে উপেক্ষা করে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। ব্যাগটাকে বিছানার উপরে ছুঁড়ে মেরে ওয়াশ রুমে ঢুকে ঝর্না ছেড়ে দিয়ে ওয়াশ রুমের মেঝেতে বসে পরে আলো। একটু পর পর সেই দৃশ্যটা আলোর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কেনো সে প্রতিবাদ করতে পারলো না এহেন কাজের! নিজের প্রতি প্রচন্ড রা'গ হচ্ছে তার।
***
"স্টুডেন্ট লোন!"
_জ্বি ভাই। বিদূষী কল্যান সমিতিতে এপ্লাই করেছে।
সামিন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। রনি বলে,"ওনারা তো গ্রাহকদের ডিটেইলস বলে না। আমার এক বন্ধু আছে ওখানে জব করে। তার থেকে জানলাম। ভাবী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের একটা ব্যাবসা শুরু করবে সম্ভবত। উনি ওখান থেকে বছর খানেক আগে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলো।"
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"খুব আত্মপ্রত্যয়ী মেয়ে। প্রথম প্রথম ফ'ট'কা আর ফাঁকা কলসিই মনে হতো। যত দিন যাচ্ছে অবাক হচ্ছি। দম আছে আমার বৌয়ের।"
রনি চুপ করে থাকে। সামিন বলে,"লোনটা কি পেয়েছে?"
_না। তাকে দেওয়া হচ্ছে না ভাইয়া।
সামিন বলে,"ঠিকাছে। যা। ওখানকার ব্যাবস্থাপনা পরিচালকের সাথে আমার কথা বলিয়ে দিবি।
_ভাই, ভাবী জানতে পারলে কিন্তু আবার সিনক্রিয়েট করবে।
সামিন ম্লান হেসে বলে,"জানতে যদি পারে,তবে। আর শোন, সাগরকে সুবিধার মনে হয়না। ইশিতা আর আলোর দিকে একটু খেয়াল রাখবি।"
রনি মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। সামিন ফোনে আলোর একটা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। ছবিটা আলোর কলেজের অনুষ্ঠানে আলো যখন উপস্থাপনা করছিলো তখনকার। আলোর কলেজের ফেসবুক পেজে দেখতে পেয়ে সেইভ করে রেখেছে ফোনে। ছবিটা জুম করে আলোকে ভালো করে দেখতে থাকে। মনে পরে যায় সেদিনের কথা , ব্যাজ পরাতে গিয়ে সামিনের বুকে সেইফটি পিন ফুটিয়ে দিয়েছিলো ঐ মেয়েটা। সামিন আনমনে হেসে ফেলে। আলোর ছবিটার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে,"কখনো কি দরদ দিয়ে আমাকে দেখবেই না বাঘিনী?"
***
"কিরে কাজ হয়েছে?"
হিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। আলো শুকনো মুখে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
হিয়া নরম বলে,"হয়নি তাইনা? তুই যে সামিন ইয়াসারের বৌ এই ইনফরমেশন টা সেদিন দেওয়া উচিত হয়নি। ঘে'টে গিয়েছে সবটা।"
আলোর মুখে হাসি ফোটে। সে হাতের কাগজটা উঁচুতে তুলে ধরে বলে,"পেয়ে গিয়েছি। কাল টাকা হাতে পেয়ে যাবো ইনশাল্লাহ!"
হিয়া খুশি হয়ে যায়। আলো বলে,"টাকা টা হাতে পেয়ে গেলেই কাঁচামাল আর মেশিন কিনে ফেলবো। পিছু ফিরে দেখার সময় নেই আমার আর। খুব ব্যাস্ত থাকতে চাই আমি।"
হিয়া বলতে থাকে,"ভাইয়া খুব সাপোর্টিভ তাই না?"
আলো চোখ মুখ শক্ত করে হিয়ার দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,"সবসময় ভাইয়া ভাইয়া করবি না। এতোই যখন পছন্দ ভাইয়াকে। তুই নিয়ে নে।"
হিয়া হতভম্ব হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"এসব কি বলছিস তুই? আচ্ছা ভাইয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই তুই এমন হয়ে যাস কেনো? তোদের মধ্যে কি কিছু হয়েছে?"
আলো কঠিন গলায় বলে,"না। কিছু হয়নি। তবে হবে।"
_কি ?
_ডি'ভো'র্স।
ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে আলো।
হিয়া অবাক চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
***
কলেজের গেইটের বাইরে পা রেখে নৌশিন এদিকে ওদিকে তাকায়।হাতে তার দুটো বই। লাইব্রেরী থেকে নিয়েছে বই দুটো। কলেজের সামনের ব্যাস্ত রাস্তাটা পুরো ফাঁকা। কলেজ দেড়টায় ছুটি হয়, কিন্তু আজ সে লাইব্রেরীতে গিয়েছিলো তাই আধাঘণ্টা দেরী হয়েছে নামতে। চোখের চশমাটা ঠিক করে সামনে দু'পা ফেলতেই থ'ম'কে দাঁড়িয়ে যায়। ডানদিক থেকে দুটো বাইক বাজপাখির মতো এসে তার সামনে থামে। নৌশিন এদিক ওদিক তাকিয়ে পালানোর পথ খোঁজে। রাস্তায় কোনো লোকজন নেই। এখন কি হবে!
সামনের বাইক থেকে একটা লম্বা,ঝাঁকড়া চুলের ছেলে নেমে নৌশিনের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়। নৌশিন ভয়ে একটা ঢোক গিলে নেয়।
_ফোন ধরবে না? সম্পর্ক রাখবে না আমার সাথে? তাই না? বলো।
ছেলেটা ধ'ম'কে ওঠে। নৌশিন কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,"দেখো সৈকত। তুমি এমন করতে পারো না। তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।"
সৈকত নৌশিনের হাত ধরে ফেলে। নৌশিন কেঁদে দেয়। সৈকত দাঁতে দাঁত চেপে বলতে থাকে,"ছাড়বো না। তুই কি করবি? একবছর কেনো প্রেম করেছিস আমার সাথে তবে?"
_তুমি একটা ড্রা'গ এ'ডি'ক্ট সৈকত। আমি কোনো ড্রা'গ এ'ডি'ক্টে'র সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইনা। প্লিজ লিভ মি!
কাঁদতে কাঁদতে বলে নৌশিন।
"ছাড় ওকে।"
সৈকত নৌশিনের হাত ছেড়ে দিয়ে পেছনে তাকায়। আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। সৈকত হাত দিয়ে নিজের চুল ঠিক করে বলে,"তোমার কথায়?"
_হ্যা। আমার কথায়। ও কি বললো শুনতে পাসনি? একটা মেয়ে যখন "না" বলে তখন সেই "না" টাকে গ্রহণ করতে শেখ জা'নো'য়া'র ।
চেঁচিয়ে ওঠে আলো। সৈকত আলোর দিকে এগিয়ে যায়। হিয়া ঘা'ব'ড়ে গিয়ে আলোকে বলে,"আলো চল। ওদের ব্যাপার। ওরা বুঝবে।"
আলো হিয়ার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে সৈকতের চোখে চোখ রাখে। সৈকত আলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,"আমি জা'নো'য়া'র? তা তুই কোন দেশের সতী সাবিত্রী এসেছিস? সামিন ইয়াসারের দুই মাসের লীজ নেয়া বৌ।"
আলো চ'ম'কে ওঠে কথাটা শুনে। সৈকত সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলে,"শোন মেয়রের দুই মাসের বৌ। এখান থেকে কেটে পর। এটা ওর আর আমার ব্যাপার।"
আলো মাথায় আগুন ধরে যায় "মেয়রের দুই মাসের বৌ" কথাটা শুনে। পায়ের জুতা খুলে হাতে নিয়ে ইচ্ছামত পে'টা'তে থাকে সৈকতকে। নৌশিন ভয়ে তটস্থ হয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
রনির নাম্বার দেখে সামিন ফোনটা রিসিভ করে বলে,"ব্যস্ত আছি রনি।"
_ভাই। ভাবী।
_কি হয়েছে আলোর?
_কিছুনা ভাই। আমাদের ভাবী আগের ফর্মে ফিরেছে।
_মানে?
_মানে ছক্কার উপর ছক্কা। একজনকে পে'টা'চ্ছে।
সামিন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। চেঁচিয়ে বলে,"মানে? কাকে?"
_সৈকত। সাগরের ছোটো ভাই। কেইসটা কি গিয়ে দেখছি। আপনি রাখেন।
_ওকে থামা। আমি আসছি।
ফোন কেটে রনি লম্বা লম্বা পা ফেলে হট্টগোলের দিকে এগিয়ে যায়। আলো জুতা রেখে চ'ড় থা'প্প'র মারতে থাকে সৈকতকে। সৈকত একসময় আলোর হাত ধরে ফেলে। ক্ষ্যা'পা কন্ঠে বলে,"মেয়ে মানুষ বলে চুপ করে আছি আলো।"
রনি গিয়ে একটা ঘু'ষি মেরে দেয় সৈকতকে। নাক বেয়ে র'ক্ত ঝরছে সৈকতের। রুমাল চেপে ধরে রনির দিকে তাকিয়ে আলোকে বলে,"তোর কন্ট্রাক্টের স্বামী দেখছি তোর পেছনে বডিগার্ডও লাগিয়ে রেখেছে।"
আলো আবার তে'ড়ে যায় সৈকতের দিকে। পেছন থেকে হিয়া জাপটে ধরে রাখে তাকে। সৈকত একবার রনি, একবার আলো, একবার নৌশিনের দিকে তাকায়। তারপর নৌশিনকে উদ্দেশ্য করে বলে,"খুব ভুল করলে তুমি নৌশিন।"
লোকজন জড়ো হয়ে গিয়েছে রাস্তাটায়। রুমাল দিয়ে নাক মুছে র'ক্তা'ক্ত রুমালটা ছুঁ'ড়ে মারে রাস্তায়। তারপর বাইকে উঠে চলে যায় সেখান থেকে।
রনি আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"ভাবী। ও কি আপনাকে ডিস্টার্ব করছিলো?"
_আমাকে ডিস্টার্ব করার জন্য আপনার ভাই রয়েছে রনি। ও নৌশিনকে ডিস্টার্ব করছিলো। জো'র'পূ'র্ব'ক নৌশিনের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় ও। ঠিক আপনার ভাইয়ের মতো।
রনি চুপ করে থাকে। আলো আশেপাশে তাকিয়ে লোকজনকে বলে,"আপনারা যান। প্লিজ যান।"
লোকজন চলে যায়। আলো রনির দিকে তাকিয়ে বলে,"এই পুরুষ গুলো নারীর ইচ্ছার ধার ধারে না কেন বলতে পারেন রনি?"
হঠাৎ সেখানে সামিনের গাড়ি থামে। তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে আলোর দিকে তাকিয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,"কি হয়েছে আলো? ওরা কি করেছে তোমাকে?"
আলো মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তারপর রনির দিকে তাকিয়ে বলে," আপনাদের যদি কেউ হায়ার করে থাকে আমাকে দেখেশুনে রাখার জন্য। তাহলে জেনে রাখুন, আমার কোনো বডিগার্ড লাগবে না। তাকে বলে দিবেন।"
আলো সামিনের দিকে না তাকিয়ে চলে যায়। রাস্তাটা পুরোপুরি খালি হয়ে যায়। সামিন একবার রনির দিকে তাকিয়ে বলে,"ওর কোথাও লাগেনি তো?"
রনি মাথা নাড়িয়ে বলে,"শরীরে কোথাও লাগেনি। তবে মনে লেগেছে ভাই। ভাবীকে আপনার দুই মাসের লীজে নেয়া বৌ বলেছে ওই সৈকত।"
***
বাড়ি ফেরার তাড়া নেই কোনো তার। আগে ইশিতা সামিনের একটু দেরী হলেই ফোন দিয়ে দিয়ে ব্যস্ত করে ফেলতো। তারপর আলো আসার পর থেকে সামিন ইচ্ছে করেই আগেভাগে বাড়িতে ফিরতো। গিয়ে দেখতো একটা ছোটোখাটো, দেখতে ভারি মিষ্টি কিন্তু তেজী মেয়ে বিড়ালছানার মতো তার বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। এখন তো কিছুই নেই সামিনকে তাড়াতাড়ি বাড়ি টেনে নেয়ার, না আছে আলো, না ইশিতার ফোন। ভাইয়ার সাথে ঠান্ডা যু'দ্ধ চলছে বোনের। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
পার্টি অফিসের সামনে গাড়িটা পার্ক করে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে থাকে সে। মনটা ভারি হয়ে আছে তার। আলোকে আজ তার জন্য মানুষের বাজে কথা শুনতে হচ্ছে। সবকিছুর জন্য সে দায়ী। মস্ত বড় একজন অ'প'রা'ধী সে। সবকিছু এলোমেলো লাগছে তার কাছে। না পারছে আলোর প্রতি জন্মানো অনূভুতিকে দমিয়ে রাখতে,না পারছে আলোর মনে যায়গা করে নিতে। এসব জোর জ'ব'র'দ'স্তি ভালোবাসা দেখিয়ে কোনো মেয়ের হৃদয় পাওয়া যায়না সামিন জানে। কিন্তু সে কি করবে?
কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে সামিন। তারপর একটা রিকশা থামিয়ে উঠে পরে।
***
বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে এপাশ ওপাশ করছিলো। তারপর উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত বারোটা সাতাশ মিনিট। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরছে সম্ভবত। উঠে গিয়ে জানালার কাচ টেনে দেয়। পুনরায় এসে বিছানায় বসে পরে। পুরো মহল্লা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। রাত গভীর। আলো দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তারপর নিজেকে ভালোভাবে দেখতে থাকে। শ্যামলা মেয়েদের এই একটা সুবিধা। চোখের নিচে কালি পরলে সহজে ধরা পরেনা। বেশ মানিয়ে যায়। আলো আজ একটা শাড়ি পরেছে। গোলাপি জমিনে সাদা রঙের সুতার কাজ। বেশ মানিয়েছে আলোকে শাড়িটায়। হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দ হতেই ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে ফোনটা তুলে নেয়। সামিনের ফোন। অন্যসময় হলে কপাল কুঁ'চ'কে ফেলতো কিন্তু এখন আলোর কোনো ভাবান্তর নেই। সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে। সামিন দ্বিতীয় বারের মতো ফোন দিলে আলো ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে চুপ করে থাকে, ওপাশ থেকে সামিনের বেহায়া কন্ঠস্বর শোনা যায়।
"কি করছিলে আছিয়া?"
_আপনার মৃ'ত্যু কামনা।
কাটকাট জবাব দেয় আলো।
সামিন ম্লান হেসে বলে,"তুমিই আমার নীলনদ আছিয়া। এই ফেরাউন তোমাতেই ডুবে ম'রে গিয়েছে। কার মৃত্যু কামনা করছো তুমি?"
আলো চুপ করে থেকে বলে,"কেনো পিছু ছাড়ছেন না আমার?"
_বেহায়া, নি'র্ল'জ্জ তাই।
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"আপনি আমার জীবনের একটা অভি'শাপ জানেন?"
_জানলাম। এখন দরজাটা একটু খোলো আলো। ভিজে যাচ্ছি আমি।
আলো অবাক হয়ে বলে,"মানে?"
_মানে আমি তোমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
আলো দ্রুতপায়ে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে কাচ সরায়। সামিন বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আলো চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে,"চলে যান এখান থেকে। এখানে কি এতো রাতে?"
_তোমার কাছে এসেছি। জরুরি দরকারে। নিচে এসে দরজা খোলো।
_পারবো না। আপনি চলে যান। কোনো দরকার নেই আপনার সাথে আমার।
_ডি'ভো'র্সের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি আলো। দরজা টা খোলো না।
আলো মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে,"যা বলার ফোনে বলুন।"
সামিন বলে,"ফোনে এতো কথা বলা যাবে না। আর তাছাড়া নেটওয়ার্কে ঝামেলা হচ্ছে খুব। হ্যালো....হ্যালো.... হ্যা আলো, কিছু বললে? আমি শুনতে পাচ্ছি না। দেখলে আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না। তুমি দরজা খোলো।"
হুট করে ফোন কেটে দিয়ে সামিন গেইটের ভেতরে ঢুকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। আলো কিছুক্ষণ ঘরে থম মে'রে দাঁড়িয়ে থেকে ঘর থেকে বের হয়। তারপর সোজা হেটে সদর দরজার কাছে যায়।
দরজা খোলার শব্দ হতেই সামিন মাথা তুলে তাকায়। তার সামনের নারীটিকে দেখে তার হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে যায়। আলো তার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। সামিন কিছু সময় আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।
আলো নিষ্প্রাণ গলায় বলে,"বলুন কি? কতদূর এগিয়েছে?"
সামিন এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,"বলবো। আগে এক গ্লাস পানি খাওয়াও।"
আলো দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন বলে,"পানি চেয়েছি আলো। তৃষ্ণার্ত ব্যাক্তিকে পানি খাওয়ানো সওয়াবের কাজ।"
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে এক গ্লাস পানি এনে দেয় সামিনকে। সামিন সবটুকু পানি খেয়ে গ্লাসটা আলোর হাতে দেয়। আলো বলে,"বলুন এবার।"
সামিন গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে,"খিদে পেয়েছে খুব। আজ সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। খালি পেটে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আমি করতে পারি না। আগে কিছু খেতে দাও। ভাত থাকলে ভাত দাও।"
আলো অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকায়। আ'প'দ টাকে বাড়িতে ঢুকিয়ে সে ভুল করেছে। এখন কতক্ষন জ্বা'লি'য়ে মারবে কে জানে!
সামিনের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলে,"ভাত আছে। তরকারি নেই। সব শেষ। তাড়াতাড়ি ডিভোর্সের কথা বলে আপনি আপনাদের বাড়িতে গিয়ে খান।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"তো? তরকারি শেষ হয়েছে তো কি হয়েছে? একটা ডিম ভেজে দাও। এতটুকু সাংসারিক বুদ্ধি নেই?"
_আমি এখন আপনার জন্য ডিম ভাজবো?
_হ্যা।
_কেন? কোন দুঃখে?
_আমি তোমাকে আমাদের বাড়িতে ভালো ভালো খাইয়েছি সেটার শোধ দাও। যাও একটা ডিম ভেজে আনো।
আলো সামিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"যাচ্ছি। চুপচাপ খেয়ে,আসল কথা বলে বিদায় হবেন।"
সামিন দাঁড়িয়ে থাকে। আলো রান্নাঘরে চলে যায়।
গরম তেলে ডিমটা ছেড়ে দিতেই তা শব্দ করে ফুলে ফেঁপে ওঠে। আলো একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছিলো ডিমের মধ্যে এক থা'বা লবণ ঢেলে দিতে। কিন্তু নিজের বাড়িতে আসা কোনো অভুক্তকে এভাবে নাজেহাল করতে আলোর বিবেকে বাধা দিয়েছে। ডিম ভাজা হয়ে গেলে টেবিলে একটা প্লেটে ভাত বেড়ে বসার ঘরের দিকে যায়। সামিনের দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"খেতে আসুন।"
সামিন উঠে দাঁড়ায়। আলোর পিছু পিছু তাদের ডাইনিং রুমের দিকে যায়। নিচু স্বরে আলোকে বলে,"শাড়ি পরেছো কেনো? তুমি জানতে আমি আসবো?"
আলো দাঁড়িয়ে পরে। সামিনের দিকে একপলক তাকিয়ে খাবার টেবিলের দিকে তর্জনী আঙ্গুল তাক করে বলে,"চুপচাপ খেতে বসুন।"
সামিন কোনো কথা না বলে চেয়ার টেনে বসে পরে। আলো চলে যেতে নিলে সামিন নরম গলায় বলে,"যেওনা প্লিজ। আমি একা একা খেতে পারিনা। আগে মা তিনবেলা আমার পাশে বসে থাকতো আমি যখন খেতাম। মা মারা যাওয়ার পরে ইশিতা অথবা রিতু কেউ না কেউ থাকতো।"
আলো কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন চুপচাপ একটা ডিম ভাজি দিয়ে ঠান্ডা খরখরে ভাতটা খেয়ে নেয়। প্লেটে হাত ধুয়ে টিস্যু পেপার খুঁজতে থাকে হাত মুখ মুছতে। আলো ঘুরে দাঁড়ায় , সামিন টিস্যু পেপার না পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আলোর আঁচল টেনে ধরে। আলো থ'ম'কে দাঁড়িয়ে যায়। মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে সামিন তার আঁচলে নিজের হাত মুছে নিচ্ছে।
নিজের আঁচল ছাড়িয়ে নিয়ে তিনলাফে আলো পিছিয়ে যায়,চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"ছিঃ নোংরা লোক!"
সামিন আলোকে কিছু না বলে সোজা হেটে আলোর ঘরের দিকে যেতে থাকে। আলো চেঁচিয়ে ওঠে,"ওদিকে কি? কোথায় যাচ্ছেন?"
_তোমার ঘরে।
_কেন?
_বিশ্রাম নিতে।
_খাওয়া হয়ে গিয়েছে,এখন জরুরি কথা বলে বের হন ইয়াসার মির্জা।
সামিন হাঁটতে থাকে। আলো পিছু পিছু যেতে যেতে বলে,"বাড়াবাড়ি করছেন। লোক ডাকবো?"
_ডাকো।
সামিন সোজা আলোর ঘরে ঢোকে। আলো বলে ওঠে,"আপনি কিভাবে জানলেন এটা আমার ঘর?"
সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"আমি গন্ধ শুঁকে বলতে পারি কোনটা কার ঘর। এই ঘর থেকে তোমার ইগো, আত্মসম্মান, রাগ, ঘৃ'ণার তীব্র গন্ধ আসছিলো। তাই বুঝে গেলাম।"
সামিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আলো। তারপর সামিনকে ঠেলতে ঠেলতে ঘরের দরজার কাছে নিয়ে যায় আলো,"বের হন। এক্ষুনি বের হন বলছি। যা বলার বসার ঘরে বসে বলবেন।"
সামিন বাঁকা হাসে। তারপর খানিক বাদে কাঁচুমাচু মুখ করে বলে,"বৃষ্টি পরছে বাইরে আলো। দেখছো না তুমি? এভাবে বের করে দেবে বাড়ি থেকে? এতো রাতে? আমি গাড়ি আনিনি সাথে।"
আলো সামিনের চোখে চোখ রেখে বলে,"ডিভোর্সের কথা বলুন।"
_ও হ্যা। আসল কথা বলতেই ভুলে গিয়েছি। দুই সপ্তাহ দেরী হবে।
_কেন? দেরী কেন হবে?
_তা তো আমি জানি না। তিনজন উকিলের কাছে গিয়েছিলাম। তিনজনই একই কথা বলছে। এটা একটা লম্বা প্রসেস।
আলো দাঁত কিড়মিড় করে বলে,"আমি অশিক্ষিত? আমাকে মুর্খ মেয়ে মনে হয়? এসব সম্পর্কে আমার কিছুটা হলেও ধারনা আছে। আপনি মিথ্যা বলছেন।"
_এতো মাথা ঘামাচ্ছো কেনো ডিভোর্স নিয়ে? এই বিয়েটাই তো তুমি মানো না। সেখানে ডিভোর্স হলো কি হলো না তাতে কি যায় আসে?
_যাতে আপনি কখনো ঝামেলা না করেন বিষয়টা নিয়ে।
আলো তেজী কন্ঠে বলে।
_ঠিকাছে। তাহলে তুমি গিয়ে কথা বলো উকিলের সাথে।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন।
আলো সামিনের কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়। সেটাই ভালো হবে। কাল সে যাবে উকিলের কাছে।
সামিন ঘরের এদিক ওদিক তাকায়। আলো বলে,"কি দেখছেন?"
সামিন মনে মনে বলে,"আমার বাচ্চাদের নানা বাড়িটা সুন্দর।"
মুখে বলে," ঘুমাবো আমি। প্রমিজ। কাল সূর্য ওঠার আগে চলে যাবো। পাক্কা। প্লিজ এতো রাতে বের করে দিও না। একটু দয়া করো।"
আলো সামিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,"ঠিকাছে। আপনি ঘুমান।"
কথাটা বলে আলো ঘর থেকে বের হয়ে যেতে নেয়। সামিন আলোর হাত টেনে ধরে বলে,"কোথায় যাচ্ছো?"
আলো তার হাতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"আমার দাদীর ঘরে।"
সামিন আলোর হাত ছেড়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলে,"এই গভীর রাতে একটা বৃদ্ধা মানুষকে বিরক্ত করা ঠিক আলো? তুমি এখানেই থাকো।"
_এক বিছানায়? আপনার সাথে? খুব শখ তাই না?
সামিন লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায় তারপর বলে,"আমি মেঝেতে ঘুমাবো।"
আলো দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,"বুঝতে পেরেছি। তুমি ভাবছো তুমি আমার সাথে এক ঘরে থাকলেই আমার প্রেমে পরে যাবে। সেই ভয়ে পালাচ্ছো। তাই না?"
_এমন কিচ্ছু না।
আলো চেঁচিয়ে ওঠে। সামিন বলে,"বেশ তাহলে থাকো এই ঘরে। প্রুভ দাও।"
সামিন কথাটি বলে বিছানা থেকে একটা চাদর উঠিয়ে নিয়ে মেঝেতে বিছিয়ে নেয়। তারপর একটা বালিশ নিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পরে। আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পরে সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"এই বৃষ্টির মধ্যে আমাকে বের করে দিলে নির্ঘাত মা'রা পরতাম আমি।"
আলো নিচু স্বরে বলে,"ভালোই হতো। আমি বেঁচে যেতাম।"
সামিন আলোর দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে ওঠে,"বেঁচে যাওয়ার চান্স কিন্তু সামনে আছে আছিয়া। বললাম না আমার জন্য তুমি নীলনদ? তুমি দিন দিন যেভাবে আমাকে ডুবাচ্ছো। দেখবে একদিন আমি মা'রা পরবো।"
চলমান.....
সামিনের কথার কোনো জবাব না দিয়ে আলো ধীরপায়ে হেটে গিয়ে নিজের বিছানায় বসে পরে। সামিন উঠে বসে। তারপর আলোর দিকে তাকায়। নরম গলায় বলে ওঠে,"আমার ম'রা'র কথা শুনে হার্ট হয়েছো আছিয়া?"
_বাজে কথা বন্ধ করুন। ঘুমান।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো রেগেমেগে বলে,"এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। চোখ সরান।"
সামিন চোখ সরিয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বলে,"তোমার আসলে ভ'য় হচ্ছে আমার চোখে চোখ পরলে তুমি প্রেমে পরে যাবে তাইনা?"
আলো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই লোকটা সত্যি ই অসহ্যকর পর্যায়ের ধৈর্যশীল বেহায়া।
কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে আলো বলে ওঠে,"আমার একজনের সাথে গভীর প্রনয় ছিলো ইয়াসার মির্জা। গভীর বোঝেন? তীব্র অনুভূতি। সে আমার সাথে মিথ্যাচার করেছিলো বলে তাকে আমার মন ও মস্তিষ্ক থেকে ঝে'ড়ে ফেলতে সময় নিইনি আমি। আমি মেয়েটাই এমন ইয়াসার মির্জা। আর আপনি ভাবছেন আপনি এমন ছ্যা'চ'ড়া'মি করবেন আর আমি পটে যাবো? এতো সোজা? আমার প্রাক্তন ছলনা করে আমাকে পেতে চেয়েছিলো আর আপনি জো'র করে চাচ্ছেন। দুটোই আমি ঘৃ'ণা করি। কাজ হবে না।"
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আলোর থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। আলোর কথার জবাবে সে কিছু বলে না। বাইরে ঝড়ের বেগ বাড়ছে। বজ্রপাত হচ্ছে। কিন্তু আলোর সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। চুপচাপ বসে আছে বিছানায়। সামিন এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে ওঠে,"ওগুলো কি?"
আলো মাথা ঘুরিয়ে ডানপাশে তাকায়। তারপর সামিনের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"এগুলো আমার বিজনেসের কাঁচামাল।"
_বিজনেস?
_একটা বিজনেস শুরু করতে যাচ্ছি। হোমমেড আচার,হেয়ার ওয়েল এবং মশলার।
_বক্সগুলোতে কি?
_মেশিনপত্র।
সামিন অবাক হয়ে আলোর দিকে তাকায়। তারপর বলে,"একা একা এতকিছু কিভাবে করবে?"
_লোক নিয়েছি। দুজন তৃতীয় লিঙ্গের আপু রয়েছে, একজন বিধবা রয়েছে আর আমার দুজন বান্ধবী। আপাতত আমাদের বাড়িতে থেকেই কাজ টা করবো। তারপর ধীরে ধীরে একটা স্টোর নিতে চাচ্ছি।
সামিন আলোর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার মুগ্ধতার রেশ কাটছে না। সামিনের চোখে আলোর চোখ পরতেই সামিন চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর আমতা আমতা করে বলে,"বাহ। বেশ ভালো। হেল্প লাগলে বলবে আমাকে।"
_আপনার হেল্প কেনো লাগবে? আপনি ছাড়া কেউ চলতে পারে না ভেবেছেন? সংস্থা আমাকে লোন দিয়েছে।
সামিন চুপ হয়ে যায়। আলো বলতে থাকে,"বকর বকর না করে ঘুমান। আর আমি আপনাকে এতো কথা বলছি কেনো। আশ্চর্য। শুনুন ফজরের নামাজ পরতে পাড়ার চাচারা বের হবার আগে আপনি কেটে পরবেন। আমি গিয়ে কাল উকিলের সাথে কথা বলবো।"
কথাটা বলে আলো গাঁয়ে চাদর টেনে ওদিক ফিরে শুয়ে পরে। সামিন জেগে থাকে। দীর্ঘ সময় সে আলোর পিঠের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সামিন সত্যি সত্যি কেউ উঠে পরার আগেই উঠে চলে যায়। এর ভিতরে এক মিনিটের জন্য সে দু'চোখ বন্ধ করেনি। অপলক দৃষ্টিতে ঘুমন্ত আলোর দিকে তাকিয়ে ছিলো।
রেহেনার চেঁ'চা'মে'চি তে আলোর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফজরের নামাজ আদায় করার জন্য উঠে রেহেনা দেখতে পায় বাড়ির সদর দরজা লক করা নেই। শুধু ভেজিয়ে রাখা। চোর এসেছিলো ভেবে চেঁ'চামেচি করতে থাকে রেহেনা। আলো উঠে বসে ঘরের এদিক ওদিক তাকায়। সামিন চলে গিয়েছে। চাদরটা ভাজ করে পায়ের কাছে রেখেছে আলোর। বালিশটাও ঠিক যায়গায় রাখা। আলো মাথা ঘুরিয়ে দেখে তার বিছানার মাথার কাছে একটা কাগজ। সে হাত বাড়িয়ে কাগজটা হাতে নেয়।
"রাতের দয়াটুকুর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে এইবার ধন্যবাদ তোমার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিইনি। মন থেকে দিয়েছি। যতটা নি'ষ্ঠু'র তোমাকে ভেবেছি। অতটা নি'ষ্ঠু'র মেয়ে তুমি নও।"
আলো কিছুক্ষণ চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থেকে চিঠিটা দলা পাকিয়ে ঝুড়িতে ছু'ড়ে মারে। তারপর গায়ের চাদর সরিয়ে রেহেনার কাছে যায়। রেহেনা আজান আয়াতকে ধমকাচ্ছে। আলো গিয়ে বলে,"ওদের ধমকাচ্ছো কেন? দরজা আমি খুলেছি কিছুক্ষণ আগে। ছাদে গিয়েছিলাম। পরে আর লাগাইনি। চিন্তা করো না,চোর আসেনি।"
***
সামিনকে দেখে রিতু এগিয়ে যায়। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,"কাল রাতে বাড়িতে আসেননি ভাইয়া। আপনার ফোন বন্ধ ছিলো। কোথায় ছিলেন?"
সামিন ধীরপায়ে হেটে সিড়ির কাছে যেতে যেতে বলে,"শশুর বাড়ি রিতু।"
রিতু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। সামিন সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে। ইলহাম সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে। সামিনকে দেখে মাথা নিচু করে নেয়। সামিন বলতে থাকে,"ঠিক ঠাক মতো অফিসে বসবি। তোর বৌ বাচ্চা আমি খাওয়াতে পারবো না।"
কথাটা বলে সামিন মৃদু হেসে ঘরে চলে যায়। সারারাত নির্ঘুম ছিলো তাই মাথাটা বেশ ব্যাথা করছে। একটু কফি খেতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু কাউকে ডেকে বলতেও ইচ্ছে করছে না। সামিন বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পরে। তার ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
***
"মানে টা কি তুই আসতে পারবি না? এসব কি বলছিস। আজ কাজ শুরু করবো আমরা। প্রথমদিনেই অনুপস্থিত?"
আলোর মে'জা'জ গরম হয়ে গিয়েছে। হিয়া ফোনের ওপাশ থেকে আমতা আমতা করে বলে,"ওর সাথে ঘুরতে বেরিয়েছি। চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছে ও।"
আলোর বিরক্তিতে কপাল কুঁ'চ'কে যায়। হিয়া বলে,"প্লিজ রা'গ করিস না। আজকে তোরা ম্যানেজ কর। আমি কাল থাকবো। প্লিজ প্লিজ।"
আলো ফোন কেটে দিয়ে সবার দিকে তাকায়। ওদের দলের শেফালী বলে ওঠে,"আপু রা'গ করো না। চলো আমরা কাজ শুরু করি। এসো।"
অয়নের কাঁধে মাথা রেখে হিয়া বসে আছে। অয়ন হিয়ার একটা হাত ধরে চু'মু খায়। হিয়া মন খারাপ করে বলে,"আবার কবে আসবে তুমি?"
_ভার্সিটি বন্ধ দিলেই।
হিয়া চুপ করে বসে থাকে। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না । তারপর অয়ন বলে,"এখন উঠতে হবে হিয়া। জায়গা টা ভালো ঠেকছে না। আজেবাজে ছেলেরা আসছে। চলো ওঠো।"
হিয়া ওঠে না। অয়নকে ধরে বসে থাকে সে।
"ভাই দেখেছিস। ওখানে কি হচ্ছে?"
হিয়াদের থেকে কিছুটা দূরেই একদল বসে ই'য়া'বা খেয়ে বুদ হয়ে পরে ছিলো। তাদের মধ্যে ছিলো সৈকত। রিয়াদ নামের ছেলেটার কথায় মাথা তুলে অয়ন আর হিয়াকে দেখে। তারপর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জরানো গলায় বলে,"দুটোকে ধরে এখানে নিয়ে আয়।"
হাসি মজার ছলে বেশ ভালোই চলছিলো আলোদের প্রথম দিনের কাজ। আজ তারা শুধুমাত্র আচার বানানোর কাজে হাত দিয়েছে। বাকি দু'টো কাজের বেশ কিছু অর্ডার করা কাঁচামাল এসে পৌঁছায় নি। সবাই মিলে গল্প করছে। নিজেদের জীবনের গল্প। আলোদের বাড়ির ছাদের ঘরটাকে আলো তার কাজের জায়গা হিসেবে ঠিক ঠাক করে নিয়েছে।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠতেই আলো হাত মুছে উঠে ফোনটা হাতে নেয়। স্ক্রিনে হিয়ার নাম্বার টা দেখে আলো রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে হিয়ার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আলো উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,"কি হলো?"
হিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,"আমাকে আটকে রাখা হয়েছে আলো।"
_মানে?
চেঁচিয়ে ওঠে আলো।
হিয়া বলতে থাকে,"যেখানে ঘুরতে এসেছিলাম সেখানের একটা গ্যাং আমাকে আর অয়নকে এসে হ্যা'রা'স করে। পরে অয়নের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। ওকে চ'ড় থা'প্প'র মে'রে ওর থেকে টাকা চায়। ওর কাছে টাকা নেই দেখে আমাকে আটকে রেখে ওকে বলে টাকা নিয়ে আসতে। অয়ন এখনো ফেরেনি আলো। আমার খুব ভয় করছে। ওরা খুব বাজেভাবে আমার গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ওদের দলের লিডার সৈকত। সবকটা নেশা করে আছে আলো।
আলোর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে। সে ঘামছে,হিয়াকে বলে,"আংকেল কে ফোন করে বলি?"
_না আলো। বাবা আমাকে মেরেই ফেলবে। তুই প্লিজ দশ হাজার টাকা নিয়ে আয়। প্লিজ। তাহলেই ছেড়ে দেবে ওরা।
আলো চিন্তায় পরে যায়। এখন আর কোনো উপায় নেই। এই লোকাল গ্যাং গুলো বেশ ভ'য়ং'ক'র। একবার পুলিশের কথা মাথায় আসে আলোর। পরক্ষনেই সিদ্ধান্ত পাল্টে নেয়। হিয়ার বাবাকে সে চেনে। জ'ল্লা'দ একটা। এসব জানাজানি হয়ে গেলে একেবারে পুঁ'তে ফেলবে মেয়েকে।
নিজেদের ব্যাবসার ক্যাশ থেকে দশহাজার টাকা নিয়ে আলো বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে।
সৈকত হিয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে থাকে। হিয়ার প্রচন্ড ভ'য় করছে। ঘোর লাগা কন্ঠে সৈকত বলে,"কেমন বয়ফ্রেন্ড তোর? তোকে বাঘের মুখে ফেলে দিলে পালিয়েছে। তোরা সতী সাবিত্রী মেয়েরা খুজে খুজে এসব বা'ঞ্চো'দ কোথায় পাস?"
হিয়ার চোখ বেয়ে পানি পরে। অয়নের থেকে এটা আসা করেনি সে। কষ্টে বুকটা ফে'টে যাচ্ছে।
রিয়াদ সৈকতকে বলে,"সতী কাকে বলছিস? সতী হলে কেউ বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঝো'পে ঢোকে? চল এটাকে খে'য়ে ছে'ড়ে দেই।"
হিয়া আ'ত'কে ওঠে। ঝরঝর করে কেঁ'দে দেয়। সৈকত রিয়াদকে বলে,"না। আমার ওর বান্ধবীটাকে লাগবে। সেদিন আমাকে জুতাপেটা করেছিলো। আজ আসুক। কত ধানে কত চাল দেখিয়ে দেবো।"
***
"আপনার কাছে শুধু রিকোয়েস্ট থাকবে এসব কথা ঘুনাক্ষরেও যেনো অদ্রিতা আলো জানতে না পারে। প্রত্যেক মাসে লোনের টাকা পরিশোধ করতে এলে চুপচাপ নিয়ে নেবেন। তারপর আমার একাউন্টে পাঠিয়ে দেবেন।"
বিদূষী কল্যান সমিতির ম্যানেজিং ডিরেক্টর অতীশ পালের দিকে তাকিয়ে সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে।
অতীশ পাল মাথা নাড়িয়ে বলে,"অবশ্যই। অবশ্যই। বুঝতে পেরেছি আমি। আপনি চিন্তা করবেন না।"
সামিন উঠে দাঁড়ায়। তার আজ কিছু জরুরী কাজ রয়েছে উকিলের কাছে,তাকে সেখানে যেতে হবে এখন।
"হিয়া"
আলোর কন্ঠস্বর শুনে হিয়া দেহে প্রান ফিরে পায়। দৌড়ে গিয়ে আলোকে জরিয়ে ধরে। আলো হিয়াকে সরিয়ে দিয়ে সৈকতের দিকে তাকায়। সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াচ্ছে সে বসে বসে। আলো এগিয়ে এসে ভদ্রভাষায় বলার চেষ্টা করে,"তোদের টাকা এনেছি। এখন ওকে ছাড়।"
সৈকত গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে,"টাকা দে আগে।"
আলো পার্স ব্যাগ থেকে টাকাটা বের করে সৈকতের দিকে এগিয়ে দেয়। সৈকত টাকা টা গুনে নিয়ে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,"তুই যা। তোর বান্ধবী আমাদের কাছে থাকুক।"
আলো দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"মানে?"
সৈকত হাসে। বলে,"আমার ভাইয়া আসুক। মানে টা পরে বোঝাবো।"
এমন সময় অয়ন এসে পরে সেখানে। হিয়া রেগেমেগে বলে ওঠে,"দেরী করছিলে কেনো?"
_টাকাটা ম্যানেজ করতে দেরী হয়েছে!
_সামান্য দশ হাজার টাকা ম্যানেজ করতে চৌদ্দ বছর লাগে ই'ডি'য়'ট?
সৈকত হেসে ওঠে। অয়নের দিকে তাকিয়ে বলে,"দে, টাকা টা দে।"
অয়ন টাকা টা দিয়ে দেয়। তারপর সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলে,"এখন আমাদের যেতে দিন।"
সৈকত আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বলে,"তোরা যা। আলো এখানে থাকবে।"
অয়ন ঘা'ব'ড়ে যায়। আলো ক'ট'ম'ট দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সৈকতের দিকে। সৈকত বলে,"চোখ নামা। আমার ভাইয়া আসছে এখানে। সেদিনের মা'রে'র জবাব আজ তোকে দেবো।"
অয়ন আর হিয়া আলোকে ছেড়ে যায়না। তারাও বসে আছে।
কিছু সময় পরে সেখানে সাগরের গাড়ি থামে। সৈকত এগিয়ে যায়। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে সাগর বলে,"কি হয়েছে এখানে?"
_সামিনের বৌ টাকে বাগে পেয়েছি। আজ এমন শিক্ষা দেবো। ও পা ধরবে আমাদের। সেটা সামিনকে ভিডিও করে পাঠিয়ে দেবো।
সৈকতের মুখে আলোর কথা শুনে সাগর আলোর দিকে তাকায়। তারপর পা থেকে মাথা পর্যন্ত আলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। সাগরের দৃষ্টি দেখে আলো নিজের ওড়না ঠিক করে নেয়।
আলোকে দেখে সাগর একটা পৈশাচিক হাসি দেয়। নাহ, সামিনের টেস্ট বরাবরই বেশ ভালো। সত্যিই ভীষণ সুন্দরী!
সৈকত বলে,"সেদিন কি মারটাই না মেরেছে আমাকে।"
সাগর সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলে,"নে'শা করেছিস তুই? আচ্ছা এখন শোন, যেটা চাইছিস সেটা ভুলেও করিস না। সামিন জিন্দা ক'ব'র দিয়ে দেবে। আমি ওকে চিনি। ওদের ছেড়ে দে। প্রতিশোধ পরে নেয়া যাবে।"
সৈকত ক্ষেপে গিয়ে বলে,"না। আজ একটা হেস্তনেস্ত করবে তুমি। আমার ভাইয়া এতো ভী'তু জানতাম না।"
তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"তুই এখন আমার আর আমার ভাইয়ার পা ধরবি। নাকে খত দিবি। তারপর তোদের ছাড়বো।"
_আর যদি এসব কিছু না করি?
_তাহলে তোর বান্ধবী আর বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ডের চু'ম্মা'চা'টির ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবো।
আলোর মুখটা শুকনো হয়ে যায়। হিয়া কাঁ'দ'তে শুরু করে। অয়ন ভীত চোখে তাকিয়ে আছে সৈকতের দিকে।
সাগর সৈকতের হাত টেনে নিয়ে ওপাশে নিয়ে যায়,ধ'ম'কের সুরে বলে,"মাথা ঠান্ডা কর। ও সামিন। যে সে কেউ না।"
_কি করবো? ওর বৌকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবো? তুমি ওর থেকে প্রতিশোধ চাও না?
_চাই। এভাবে না। এভাবে ফে'সে যাবো। সময় আসুক।
তারপর নিজের ফোনটা বের করে সাগর বলতে থাকে,"যা হয়েছে এ পর্যন্তই। আজ শুধু সামিনকে একটু ভয় দেখাই। ওর বৌকে কিছু করিস না। ঠিকাছে?"
সৈকত চুপ করে থাকে। সাগর আলোর দিকে আরো একবার তাকিয়ে সামিনের নাম্বারে ফোন লাগায়। ওপাশ থেকে সামিন ফোনটা রিসিভ করতেই সাগর বলে ওঠে,"সামিন ইয়াসার!"
_ফোন দিয়েছিস কেনো আমাকে?
_তোর একটা জিনিস আমার কাছে। এসে নিয়ে যাবি না?
_মানে? কি বলতে চাইছিস?
_তোর বৌ। আমার কাছে এসেছে। নিয়ে যা এসে।
_মুখ সামলে কথা বল।
_বিশ্বাস হয়না? শোন তোর বৌয়ের গলায় একটা চমৎকার তিল আছে দেখলাম, তুই তো ভালো করেই জানিস সেকথা।
সামিন উঠে দাঁড়িয়ে যায়। সাগর বলতে থাকে,"আধাঘণ্টার মধ্যে দিঘির পাড়ে এসে নিয়ে যা। নয়তো উল্টো পাল্টা কিছু হয়ে গেলে আমায় দোষ দিবি না। আর হ্যা, টু টা সাউন্ড করবি না কোনো।"
ফোন কেটে দিয়ে সামিন পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয়। তার মাথা কাজ করছে না।
***
আলো থা'বা মেরে সৈকতের ফোনটা নিয়ে হিয়ার ভিডিওটা ডিলিট করতে চেষ্টা করে। সৈকত ফোনটা নিয়ে নিতে যায়।
সাগর আলোকে দেখতে থাকে,সামিনের বৌ একেবারে সামিনের মতোই ক্ষ্যা'পা। ক্ষ্যা'পা মেয়েরা সাগরকে বরাবরই মুগ্ধ করে।
সৈকত চেঁচিয়ে ওঠে,"তোর বি'ষ কমবে না তাই না?"
রিয়াদ এসে পেছন থেকে আলোকে ধরে হাত থেকে ফোন নিয়ে নেয়। রিয়াদের স্পর্শ পেয়ে আলো প্রচন্ড ক্ষে'পে গিয়ে ঘুরে রিয়াদের তলপেটের খানিকটা নিচে লা'ত্থি বসিয়ে দেয়।
বিকট চিৎকার দিয়ে রিয়াদ বসে পরে। তারপর গো'ঙা'তে থাকে।
সাগর হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে।
সৈকত বলে,"দেখেছো ভাইয়া? তেজ দেখেছো?"
আলো সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলে,"ফোন দে কু'ত্তা।"
"আগে তোমার স্বামী আসুক।"
আলোর দিকে তাকিয়ে সাগর ঠান্ডা গলায় বলে।
ত্রিশ মিনিটের রাস্তা দশ মিনিটে পাড় করেছে। দিঘির পাড়ে গাড়ি থামিয়ে দ্রুতপায়ে সামিন এগিয়ে যায়। সে তার নার্ভ ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে।
সাগর সামিনকে দেখে একটা পৈশাচিক হাসি দেয়। সামিন এগিয়ে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"ম'র'তে চাস তুই? ম'রা'র শখ হয়েছে আমার হাতে? তাহলে বল এখানেই গে'ড়ে দিয়ে যাই!"
সাগর সামিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,"তোর বৌ একটা জিনিস। একে তুই সামলাতি কিভাবে? দারুন। আমি ইমপ্রেসড!"
সামিন হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। সাগর জোরে বলে,"আচ্ছা শোন,মাইন্ড করিস না। ভাবীর প্রশংসা করলাম। নিয়ে যা।"
সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। সৈকত হিয়া এবং অয়নকে বলে,"তোরা কে'টে পর।"
হিয়া কেঁ'দে দিয়ে বলে,"ভিডিও টা!"
সামিন সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলে,"কোন ভিডিও? কিসের ভিডিও?"
_তোর বৌয়ের বান্ধবী আর তার বয়ফ্রেন্ড এখানে অ'নৈ'তি'ক কাজ করছিলো। তার ভিডিও। তোর বৌ এসেছিলো টাকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে নিতে।
সামিন আলোর দিকে ক'ট'ম'ট দৃষ্টি দিয়ে একপলক তাকায়। তারপর সাগরের দিকে তাকিয়ে বলে,"ওদের টাকা ওদের ফেরত দে!"
সাগর সৈকতকে ইশারা করতেই সৈকত টাকা গুলো দিয়ে দেয়।
সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,"ভালোয় ভালোয় ভিডিওটা ডিলিট কর। এক্ষুনি।"
সাগর সৈকতকে বলে,"ঐ মেয়েটার কাছে দে ফোন।"
সৈকত হিয়ার হাতে ফোন তুলে দেয়। হিয়া দ্রুত ভিডিওটা ডিলিট করে চোখের পানি মোছে।
সাগর বলে,"তুই আমাকে যতটা খারাপ ভাবিস সামিন,আমি অতটাও খারাপ না। বুঝলি? ভাবীকে অনেক সম্মান দিয়ে কথা বলেছি। জিজ্ঞেস কর তোর বৌকে।"
সামিন সাগরের সাথে কোন কথা না বলে ঠান্ডা গলায় আলোকে বলে," তোমরা তিনজন গাড়িতে ওঠো।"
_আমরা যেতে পারবো।
_আমি বলছি গাড়িতে ওঠো বে'য়া'দ'ব মেয়ে।
বিকট শব্দে চেঁচিয়ে ওঠে সামিন। তার চিৎকারে যেন সবার কানে তালা লেগে গেলো।
হিয়া অয়ন ভয় পেয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। আলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন সাগরের দিকে তাকিয়ে বলে,"তোর ভাইকে সাবধান করে দে। ও অনেক বার বেড়েছে , একদিন দেখবি খবরে হেডলাইন আসবে "পুলিশের সাথে ব*ন্দু*ক যু*দ্ধে সাবেক মেয়র শমশের ভুঁইয়ার ছোট ছেলে সৈকত ভুঁইয়া নি*হ*ত।"
এবং সেই ব্যাবস্থাও আমি করবো।"
সাগর সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন ওদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে আলোর কাছে গিয়ে খ*প করে আলোর হাত ধরে ফেলে। তারপর আলোকে টানতে টানতে গাড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বসিয়ে দেয় সামনের সিটে। দরজা লাগিয়ে দিয়ে ঘুরে সে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে পরে।
এদিক ওদিক না তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে সোজা হাই ওয়ে তে ওঠে। সবাই চুপচাপ,মাঝে মাঝে হিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁ*দে উঠছে। সামিন কপাল কুঁচকে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে গম্ভীর কন্ঠে অয়ন আর হিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,"তোমাদের কোথায় নামিয়ে দেবো?"
_রেডিও কলোনির মোড়ে ভাইয়া।
সামিন হিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,"শুরুতেই আমাকে ফোন দিলে পারতে। এতটা সা*ফা*র করতে হতো না।"
হিয়ার কান্নার বেগ বাড়ছে। অয়ন হিয়াকে শান্তনা দেবার জন্য তার হাতের উপরে একটা হাত রাখে। হিয়া অয়নের হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"ছোবে না আমাকে ভীতুর ডিম কোথাকার। আরেকটু হলে আমি দম আটকে মরে যেতাম।"
অয়ন বেলুনের মতো চুপসে যায়। সামিন আড়চোখে আলোর দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকায়। আলো ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে চুপচাপ। রেডিও কলোনির মোড়ে এসে সামিন গাড়ি থামিয়ে দেয়। অয়ন হিয়াকে নিয়ে নেমে পরে।
সামিনের গাড়ি আবারো চলতে শুরু করে। দু'জনেই চুপচাপ। কিছুদূর যেতেই একটা নির্জন যায়গা দেখে সামিন ব্রেক ক'ষে দেয়। আলো মাথা ঘুরিয়ে সামিনের দিকে তাকায়। আলোর দিকে না তাকিয়ে সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"যেখানেই ঝামেলা সেখানেই আলো নাকি যেখানেই আলো সেখানেই ঝামেলা? মাথার ঘি'লু কি বাসায় রেখে এসেছো? কমনসেন্স নেই? একা একা চলে যাচ্ছো ড্রা*গ এডি*ক্ট*দের কাছে। কোনো রকম প্রটেকশন ছাড়া! নিজেকে কি ভাবো তুমি?"
_আমি নিজেকে একটা মানুষ ভাবি। আমার বান্ধবীর বিপদ,তাই চুপ করে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।
_চুপ করে বসে থাকতে কে বলেছে? পু'লি'শ ছিলো না?
_পু'লি'শকে দিয়ে ব্যাপারটা সামলাতে গেলে জানাজানি হতো। যেটা হিয়ার জন্য মঙ্গলজনক নয়। আর পুলিশের ওপর আমার ভরসাও নেই,নয়তো কবেই আপনার নামে কম্প্লেইন করতে থানায় ছুটতাম।
সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"আপনি আমাকে এতটা ব্রেইনলেস মেয়ে মনে করেন! আমি কি আ'হা'ম্মক নাকি একা একা চলে যাবো নে'শা'খো'র'দের কাছে। আমার ইজ্জতের ভ'য় আছে। আমি লোক ঠিক করে রেখে গিয়েছিলাম। তারা চলে যেতো সময় মতো।"
সামিন অবাক হয়ে বলে,"কোন লোক?"
এমন সময় আলোর ফোন বেজে ওঠে,আলো ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে বলে,"হ্যা শেফালী আপু। না,আসতে হবে না আপনাদের। আমরা ঠিক আছি। হ্যা বাড়ি যাচ্ছি।"
ফোন কেটে দেয় আলো। সামিন বলে,"শেফালী কে?"
_আমার সাথে কাজ করে। তৃতীয় লিঙ্গের আপু। ও সময় মতো ওর পুরো গ্যাং নিয়ে চলে আসতো। উলটো ঐ সৈকতের ই'জ্জ'ত লুট করে নিয়ে যেতো আজ।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। সে অনেক কষ্টে তার হাসি চাপিয়ে রেখেছে আলোর কথা শুনে।
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তারপর কিছুক্ষণ পরে স্বাভাবিক গলায় বলে,"বেশ বুদ্ধিমতি তুমি। ভালো লাগলো। তা নিজে ওখানে কি কি করেছিলে? ঐ সৈকতের চামচা টা ওভাবে কা'ত'রা'চ্ছিল কেন? কোথায় মে'রে'ছো ওর?"
_যায়গা মতো।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।
সামিন হতভম্ব হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে ওঠে,"তুমি সত্যিই অ'মা'ন'বি'ক।"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলতে থাকে,"তোমার কারাতে দেখা হলো না। এতো এ'গ্রে'সি'ভ তুমি আমার বেলায় কখনো হওনি। আমার সৌভাগ্য। আমাকে ভয় পেতে বুঝি! আমি ওদের থেকেও ভ'য়'ঙ্ক'র?
_হ্যা। কারন ওরা কেউ আমার ভাইদের গলায় ছু'রি ধরেনি। তাই আমার মনোবল ভাঙেনি।
সামিন আলোকে দেখতে থাকে। কপালের কাছে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে মেয়েটার। মুখটা লাল হয়ে আছে। গায়ের ওড়নাটা চাদরের মতো করে জরিয়ে রেখেছে। মেয়েটার এই ব্যাপারটা সামিনের বেশ পছন্দ। শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ যাই পরুক না কেনো, খুবই শালীন ভাবে পরবে। শরীরের ভাজ সম্পর্কে অবগত হওয়ার সাধ্যি কোনো পুরুষের নেই। যখন শাড়ি পরতো আঁচল টেনে সবসময় ডান কাঁধে তুলে রাখতো। নিজেকে মোহনীয় করে উপস্থাপন করার প্রয়াস নেই তার। সে আদর্শ নারীর না'রী'ত্বে ব'লী'য়া'ন।
কিছু সময় চুপ করে থেকে সামিন গাড়ি স্টার্ট করে। তারপর ড্রাইভ করতে করতে ঠান্ডা গলায় বলে,"আর কখনো এমন সিচুয়েশনে পরলে এতো পা'ক'না'মি করবে না। ভুলে যাবে না তুমি একটা মেয়ে, যতই নিজেকে শক্তিশালী ভাবো না কেনো, পুরুষালি শক্তির সাথে পেরে উঠবে না তুমি। তাই যা করবে ভেবে চিন্তে করবে, হটকারীতায় না।"
আলো কপাল কুঁ'চ'কে থাকে। সামিনের এতো জ্ঞান সে হজম করতে পারছে না। কিছুক্ষণ পরে সামিন বলে ওঠে,"শ্রাবনীদের বিষয়টা দেখে দিয়েছি । আশা করছি আর কোনো প্রবলেম হবে না।"
_ধন্যবাদ।
কাটকাট বলে দেয় আলো।
সামিন মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"এতো শুকনো ধন্যবাদ?"
আলো কপাল কুঁ'চ'কে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"ভেজা ধন্যবাদ কিভাবে দেয়?"
সামিন কোনো জবাব দেয়না। একমনে ড্রাইভ করতে থাকে। আলো বলে,"আমার কপাল। যেদিন থেকে আপনি আমার জীবনে এসেছেন। ঐদিন থেকে শনির দশা কাঁ'ট'ছে না। কবে আপনার থেকে পিছু ছাড়াতে পারবো কে জানে!"
অ্যাডভোকেট শাহজাহান শিকদারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আলো। শাহজাহান শিকদার টিস্যু পেপার দিয়ে নিজের চশমার কাঁচ পরিষ্কার করতে করতে নরম গলায় বলে,"দেখো মামুনি। মিউচুয়াল ডি'ভো'র্স , এটা একটা লম্বা প্রসেস। কাগজ পত্র রেডি করতে একটু টাইম লাগবে। এতদিন যখন অপেক্ষা করতে পারলে, আরেকটু না হয় করো।"
আলোর মুখ শুকিয়ে যায়। সে বলে,"এমন কথা আমি জীবনেও শুনিনি আংকেল।"
শাহজাহান শিকদার মৃদু হাসে। তারপর বলে,"আইন তো আর মুখের কথা না মা। যে আইন দুটো মানুষকে একে অপরের সাথে সারাজীবনের জন্য জু'রে দেয় সে আইন তো একদিনে ভাঙা সম্ভব না তাইনা? অনেক নিয়ম আছে। আমি কাগজ পত্র রেডি করছি। তারপর তোমাদের ডাকবো। তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও।"
আলোর কাছে শাহজাহান শিকদারের জবাব পছন্দ হয়না। তার ৬ষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে এই লোকটা কারো শিখিয়ে দেওয়া কথা বলছে। কিন্তু এখন আলোর করনীয় কি!
শাহজাহান শিকদারের চেম্বার থেকে বের হয়ে আলো বিরসমুখে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটছে। আজকের অর্ডারের ভেলিভারি সকাল বেলাতেই ভেলিভারি বয়কে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে। আপাতত হাতে কোনো কাজ নেই তার।
"অদ্রিতা আলো?"
পুরুষ কন্ঠ শুনে আলো চ'ম'কে ওঠে, তারপর ঘুরে তাকায়। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার একজন ব্যাচমেট।
আলো মুখ হাঁসি হাঁসি করার চেষ্টা করে বলে,"রাকিব!"
_তুমি তো নিখোঁজ হয়ে গিয়েছো বিয়ে করে। সোস্যাল মিডিয়ায় পাওয়া যাচ্ছে না, ফোন নাম্বার নেই। কেমন আছো তুমি?
আলো ম্লান হাসে।
_ভালো। তুমি?
রাকিব বলে,"আমি আছি আরকি। তা তোমার স্বামী কোথায়? সমাজ সেবা করছে? আর মেয়রের বৌ এভাবে রাস্তায় রাস্তায় হাটছো কেনো? গাড়ি কোথায়?"
আলো কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। রাকিব বলে,"চলো এক যায়গায় বসে কথা বলি। বেশ লম্বা সময় পরে দেখা হলো আমাদের।"
ইহান আজ বেশ খুশি। কারন তার বড়বাবা অনেকদিন পরে তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। গাড়ির ব্যাক সিট টা পুরোটা খেলনা দিয়ে ভর্তি করে ফেলেছে । তার চোখে মুখে খুশি চকচক করছে। সামিন ড্রাইভ করতে করতে বারবার ইহানের দিকে তাকাচ্ছে। সে নিজেও মজা পাচ্ছে ইহানের আনন্দ দেখে।
"বড় বাবা দেখো পচা আন্টি!"
গাড়ির জানালার বাইরে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ইহান। সামিন অবাক হয়ে বলে,"কোথায়?"
ইহান হাত তুলে দেখায়,"ওই যে দেখো।"
সামিন হুট করে গাড়ির ব্রেক কষে। তারপর ইহানের হাত লক্ষ্য করে সেদিকে তাকাতেই তার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায় রা'গে। দূরেই আলো একটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করছে, হাসাহাসি করছে। সামিনের মস্তিষ্ক থেকে সেই রা'গ পুরো শরীরে ছড়িয়ে যেতে মিনিট খানেক সময় নিলো না। পুরো শরীর জ্ব'লে যাচ্ছে রাগে। সে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘদিন পরে আলোর মুখে সে হাসি দেখছে। কে ঐ ছেলেটা! আলোর প্রাক্তন নাকি! তাড়াতাড়ি সামিনকে ডিভোর্স দিয়ে ঐ প্রাক্তনকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করছে বুঝি!
সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলে,"খাওয়াচ্ছি তোমাকে আইসক্রিম আছিয়া!"
***
"স্যার এগুলো কিসের কাগজ?"
সিনথিয়া অতীশ পালের দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে তাকিয়ে আছে।
অতীশ ফাইলটার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,"জরুরি কাগজ। সামিন ইয়াসারের বৌয়ের লোনের পেপার।"
_কিন্তু স্যার। তাকে তো লোন টা দেওয়া হয়নি। তার পরিবর্তে একজন দিনমজুরের মেয়ে পেয়েছে।
_জানি। কাগজ গুলো রাখো। প্রত্যেক সপ্তাহে অদ্রিতা আলো লোন পরিশোধ করতে এলে, তার সই আর টাকাটা রেখে দেবে।
সিনথিয়া হা হয়ে থাকে।
_স্যার আমি কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না।
_ইয়াসার মির্জা আমাদের মাধ্যমে তার স্ত্রীকে টাকাটা দিয়েছে। এসব কথা তার স্ত্রীকে জানাতে নিষেধ করেছে। তাই তার স্ত্রী লোনের টাকা ভেবে প্রত্যেক সপ্তাহে টাকা পরিশোধ করতে এলে টাকা টা চুপচাপ রেখে দেবে। ইয়াসার মির্জা ওনার বৌয়ের নামে একটা একাউন্ট খুলেছে। সেখানে টাকা ট্রান্সফার করতে হবে।
সিনথিয়ার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না। সে হতভম্ব হয়ে বলে,"স্যার হচ্ছে কি আসলে! আমাদের কাজ কি এখন মিথ্যাচার করা? এটা তো ধোঁকাবাজি একপ্রকার।"
অতীশ পাল বলে,"ধোঁকাবাজি কোথায়? স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসা দেখলে না? এমন দেখেছো কোথাও? এখন যাও, নিজের মুখ বন্ধ রাখো। আমাদের এজেন্সির আইনের ঝামেলা যেভাবে সামিন ইয়াসার মির্জা সামলায় তেমনি তার এই ঝামেলা টাও একটু সামলে দাও। আর হ্যা নতুন এম্প্লয়ি দুটোকে বলে দিও। তারা যাতে গণ্ডগোল না করে বসে!
***
ছাদে সবাই চুলের তেলের কাঁচামাল গুছিয়ে নিচ্ছে। আজ শুধু এক্সপেরিমেন্ট হবে। আলো একপাশে একটা চেয়ারে বসে আছে চুপচাপ। আজও হিয়া আসেনি। অনেকটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সেদিন। ফোনে বলেছে গায়ে জ্বর এসেছে।
শেফালী আর বিউটি হাতে হাতে সবটা গুছিয়ে নিচ্ছে। সানজিদা বড় একটা স্টোভের ওপর বৃহৎ আকারের একটা কড়াই রেখে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"মাত্র চারদিন ভেলিভারি দিয়েছি আচার। এখনি বেশ ভালো ভালো রিভিউ পাচ্ছি। আমার মতে আচার টা নিয়ে এগোনোই ঠিক হবে। তেল নিয়ে এগোতে রিস্ক আছে।"
_বিজনেসে রিস্ক না নিলে এগোনো যায়না সানজিদা আপু। আমাদেরকে রিস্ক টা নিতেই হবে।
সেফালী আর বিউটি আলোর কথায় সায় দেয়। এমন সময় আজান আসে। আলো আজানের দিকে তাকিয়ে মজার ছলে বলে,"যখন তখন আমাদের ফ্যাক্টরিতে ঢুকবি না, আমাদের প্রোডাক্টের সিক্রেট ইনগ্রিডিয়েন্ট সম্পর্কে আমরা কাউকে জানাতে চাইনা।"
আজান বলে,"আপু নিচে একজন ভেলিভারি বয় এসেছে।"
_ডেলিভারি বয়?
আলো অবাক হয়ে যায়। তারপর বলে,"আমাদের সব অর্ডার তো হাতে পেয়েছি! আবার কি!"
_তা তো জানি না আপু। তুমি নিজে এসেই দেখো।
আলো গাঁয়ে ওড়না জড়িয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। দেখতে পায় সদর দরজার কাছে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। আলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় লোকটার দিকে,বলে,"কিসের পার্সেল? আর পার্সেল কোথায়?"
মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলে লোকটা বলে,"ম্যাম গেইটের বাইরে।"
আলো কিছু বুঝতে পারছে না। লোকটা বলে,"আসুন। দেখে নিয়ে যান!"
আলো লোকটার পিছু পিছু যায়। গেইটের বাইরে বিশাল বড় একটা আইসক্রিমের ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে।
আলো হতভম্ব হয়ে যায়। লোকটা বলে,"আপনার হাজবেন্ড আপনার জন্য পাঠিয়েছেন।"
আলো এদিক ওদিক তাকায়। তার মুখে কোনো কথা আসছে না। এমন সময় আলোর ফোন বেজে ওঠে। সামিনের নাম্বার থেকে ফোন। আলো ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে সামিন বলে,"পার্সেল পেয়েছো? এখন যত ইচ্ছা ততো আইসক্রিম খাবে বাড়িতে বসে বসে। বাইরের ছেলেদের সাথে রাস্তায় বসে হা হা হিহি করা, আইসক্রিম হাতে তাদের গায়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছরে পরা এসব আর যেন করতে না দেখি। ওসব বে'হা'ল্লা'প'না আমার সাথে ডি'ভো'র্স হয়ে গেলে করবে। যতদিন কাগজে কলমে তুমি আমার বৌ, আমি যদি দেখি আমার বৌ ভ্র'ষ্টা'চা'রী হচ্ছে তাহলে উল্টো পাল্টা কিছু করে দিতে এই ফে'রা'উ'নে'র হাত কাঁপবে না আছিয়া।"
সামিন ফোন কেটে দেয়। আলো পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। পাশ থেকে লোকটা বলে,"ম্যাম আমি আসি।"
আলো শুকনো মুখে আইসক্রিমের ভ্যানটার দিকে তাকিয়ে থাকে। পেছন থেকে শেফালী বলে,"করবে কি এখন? আইসক্রিমের ব্যাবসাও শুরু করবে তুমি?"
আলো নিস্তেজ কন্ঠে বলে,"সানজিদা আপুকে বলো তাদের বস্তিতে খবর দিতে। বাচ্চারা এসে তাদের পছন্দ মতো নিয়ে যাক। আর তোমরাও নাও। এখান থেকে নিয়ে যাও যার যা লাগে।"
আজান আমতা আমতা করে বলে,"আপু থানারোডের এতিম খানায় কিছু দিয়ে আসবো?"
_যা ইচ্ছা কর।
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে আলো বাড়ির ভেতর চলে যায়। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পরে সে।
ফোন কেটে সামিন ফোনটাকে আ'ছা'ড় মারে। সে প্রানপন চেষ্টা করেছে আলোকে কোনো কঠিন কথা না শোনাতে, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তার উ'গ্র রা'গ'টা আবারো একবার আলোর কাছে তাকে ঘৃ'ণা'র পাত্র করে দিলো। কিন্তু সে কি করবে, সহ্য করতে পারেনি আলোর সাথে ঐ ছেলেটাকে!
***
"কি করছো আব্বু?"
আলো ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আতাউর আলমের দিকে তাকিয়ে আছে। আতাউর আলম মাথা তুলে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"ও আলো। আয়!"
আলো ভেতরে ঢোকে। আতাউর আলম বলে,"কি আর করবো। একটা নিবন্ধ লেখার চেষ্টা করছিলাম। একটা বেসরকারি নিউজ এজেন্সি থেকে রিকোয়েস্ট পেয়েছি। টাকা দেবে।"
আলো বাবার বিছানায় বসে,"মস্তিষ্কে চাপ পরে এমন কিছু তোমাকে করতে হবে কেন? বাদ দাও তো। টুক টাক চলছে তো সব। আজান আয়াতের স্কলারশিপের টাকা, তোমার দেশের বাড়ির জমি চাষের টাকা, আমার টিউশনির টাকা। চলে যাচ্ছে তো আব্বু। ব্যাবসা টা একবার দাঁড়াতে দাও আমার।"
আতাউর আলম ম্লান হাসে। তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"কোথাও যাচ্ছিস?"
আলো উঠে দাঁড়ায়।
"হ্যা আজ লোনের টাকা পরিশোধ করতে হবে। মাসে চারটা কিস্তি। এজেন্সিতে যাচ্ছি।"
আলো উঠে চলে যায়। আতাউর আলম মেয়ের যাওয়া দেখে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। কতটুকু বয়স মেয়েটার। অথচ এই বয়সে কতটা বুঝদার। নিজের কাধে কত দায়িত্ব তুলে নিয়েছে। মুখে একটা ক্রিম পর্যন্ত মাখে না। এই সাধারণ কিন্তু অসাধারণ মেয়েটির জীবনটা কেমন অগোছালো হয়ে গিয়েছে! গুছিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। কেউ না।
***
আলো এদিক ওদিক তাকিয়ে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে যায়। আজ এজেন্সি এতো ফাঁকা কেনো! আজ তো কিস্তির তারিখ। ক্যাশ কাউন্টারে একটা অচেনা মেয়ে বসে আছে। আলোকে দেখে একটা হাসি দিয়ে বলে,"হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ ম্যাম?"
_আমার লোন পরিশোধের প্রথম দিন।
_আচ্ছা, আপনি আমাকে আপনার আইডি নাম্বার দিন ম্যাম। এবং কাগজ গুলো।
আলো তার হাতের কার্ড টা মেয়েটার দিকে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ ডেস্কটপে তাকিয়ে থেকে মেয়েটা বলে,"ম্যাম আপনি ভুল কার্ড দিয়েছেন। এই নামে কাউকে লোন দেওয়া হয়নি।"
আলো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তারপর বলে,"মানে? অদ্রিতা আলো আমি।"
_জ্বী ম্যাম। এটা তো আপনার নাম। কিন্তু আমাদের লিস্টে যে তিন জন মেয়েকে লোন দেওয়া হচ্ছে তাদের নাম, শাহিনুর ইসলাম, রুমানা মুক্তি এবং জান্নাতুল ফেরদৌস। আপনি চেক করে দেখতে পারেন।
আলো বোকার মতো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ক্যাশ কাউন্টারের মেয়েটাকে দূর থেকে সিনথিয়া হাত নে'ড়ে ইশারা করছে কিছু না বলতে কিন্তু মেয়েটা কোনোদিকে না তাকিয়ে গড়গড় করে কথা বলেই যাচ্ছে আলোর সাথে। আলো অসহায়ের মতো একবার হাতের ফাইল, একবার টাকা, একবার ক্যাশকাউন্টারের মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে।
***
"ভাই একটা গান শুনবেন?"
সামিন তৌফের কথায় তার দিকে না তাকিয়ে বলে,"দূর হ। ব্যাস্ত আমি।"
সব ছেলেরা চুপ হয়ে যায়। সামিন কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,"তোর ভাবীর কোনো খবর আছে?"
_জ্বী। আজ সকালে দেখলাম কোথাও যাওয়ার জন্য রিকশা ঠিক করছে। রিকশা ওয়ালার সাথে রিকশা ভাড়া নিয়ে দশমিনিট ঝগড়া করলো। রিকশা ওয়ালা ত্রিশ টাকা ভাড়া চাচ্ছিল কিন্তু ভাবী পঁচিশ টাকার উপরে এক টাকাও দেবে না।
সব ছেলেরা হেসে ফেলে। সামিন রাগী দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,"হাসার কি আছে? সব কটাকে চ'ড় মারবো। কতটা হিসেবী আমার বৌ দেখেছিস? এমন মেয়েই তো সংসারের উন্নতি করে। আমি আমার বৌকে নিয়ে গর্ব করি।"
সবাই চুপ হয়ে যায়। সামিন তৌফের দিকে তাকিয়ে বলে,"তারপর কি হয়েছে? ঐ রিক্সাওয়ালা জিতেছে নাকি আমার বৌ?"
_আপনার বৌ ভাই।
***
বৃদ্ধা রিকশা ওয়ালা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকায়। তারপর নরম গলায় বলে,"কাদতেছো কেনো মা?"
আলো তার জবাব দেয় না। ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরে কেঁদে যাচ্ছে।তার শরীরটা একটু পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে। রিকশা ওয়ালা আমতা আমতা করে বলে,"কোথায় নামায়া দিমু মা?"
আলো কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করে বলে,"সামিন ইয়াসারের পার্টি অফিসে।"
সামিন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। এখন তাকে বের হতে হবে। তার দলের ছেলেরাও সামিনের দেখাদেখি উঠে দাঁড়ায়। এমন সময় সবুজের ফোন আসে। সামিন ফোনটা রিসিভ করতেই সবুজ বলে,"ভাই ভাবী উপরে যাচ্ছে। কাঁদছে সে।"
ফোনটা রাখার সাথে সাথে দরজা ঠেলে আলো ভেতরে ঢোকে। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো প্রায় ছুটে গিয়ে সামিনের শার্টের কলার ধরে।
"আর কতবার? কতবার আপনি আমাকে অসম্মান করবেন ইয়াসার মির্জা?"
গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না আলোর। সে হাঁপাচ্ছে। সামিন নরম গলায় বলে,"কি হয়েছে আলো, আমি কখন তোমাকে অসম্মান করলাম?"
আলো সামিনকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,"নাটক বাজ লোক। জুতো মেরে গরু দান করা হচ্ছে? খুব টাকা আপনার তাইনা? সেটাই দেখাচ্ছেন সব খানে? আমাকে ধোকার মাধ্যমে টাকা দেওয়ার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? বলুন! কে দিয়েছে?"
সামিন ঘামতে থাকে। আলো জেনে গিয়েছে সবটা,এখন এই জেদী মেয়েটাকে সে কিভাবে সামলাবে!
আলো আবারো কলার ধরে,"সাহস কি করে হয় আমাকে ছোট করার? দয়া করার!"
সামিন আলোর নরম ছোটো দুটো হাত তার কলার থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আলোর চোখের দিকে তাকায়, নরম গলায় বলে,"সরি আলো। আমি তো সবটা ঠিক ঠাক করতে চেয়েছি তোমার লাইফের।"
আলো চেঁচিয়ে ওঠে,"কি ঠিক করতে পেরেছেন? আমার বাবা একটা পঙ্গু লোকের মতো বাড়িতে পরে আছে, পেরেছেন ঠিক করতে? লোকজন রাস্তা ঘাটে আমাকে আপনার "খে'য়ে ছে'ড়ে দেওয়া মাল" বলে, পেরেছেন ঠিক করতে?"
কান্নায় ভেঙে পরে আলো। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পরে। সামিন কিছুক্ষণ আলোকে দেখে হাঁটু গেড়ে তার মুখোমুখি বসে পরে। আলো বলতে থাকে,"এখন আপনি সবাইকে ভালো মানুষী দেখাচ্ছেন আপনার। সবাইকে নিজের অর্থ,ক্ষমতা,নাটক দিয়ে মুগ্ধ করতে চাইছেন তাইনা?"
সামিন নরম গলায় বলে,"এভাবে আমার অনুভূতির ভুল ব্যখ্যা দিও না আলো। আমি অনুতপ্ত, যা যা করেছি সবটা নিজের অনুশোচনা থেকে।"
_অনুশোচনা? সামিন ইয়াসারের অনুশোচনা হয়েছে কখনো?
সামিন আলোর চোখে চোখ রাখে। তারপর বলে,"তুমি দেখতে পাওনি বলে হয়নি,এমন টা তো নয় আলো। আমি তো নিজে নিজেকে জানি। আমি কতটা অন্ধকার মানুষ ছিলাম তা আমি জানি আলো। তুমি আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছিলে। মানলাম সবটা আমার অ'প'রা'ধ। আমি অ'প'রা'ধী। কিন্তু একজন অ'প'রা'ধীও যে কখনো শুধরে নিতে পারে নিজেকে সেটা কেন তুমি মানতে পারছো না?"
_শুধরেছেন? কি শুধরেছেন আপনি? যে ভয়ংকর অ'প'রা'ধ আপনি করেছেন তার শাস্তি আপনি জানেন? পেয়েছেন শাস্তি? বুক ফুলিয়ে সমাজে মহান সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অবৈধ ভাবে প্রতিপক্ষকে বসিয়ে রেখে ভোটে জিতেছেন, লজ্জা করে না এই চেয়ারে বসতে? তারপর সবকিছুর উপরে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন আপনি।সবকিছু আপনার নিয়ন্ত্রনে চলছে, আমাদের বিয়ে, আমাদের ডি'ভো'র্স, উকিল, আমার জীবন। সবকিছু আপনিই নিয়ন্ত্রণ করছেন। শুধরেছেন টা কি আপনি? পাক্কা নাটকবাজ আপনি।
সামিন আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলোর কান্নার বেগ বাড়ছে। সে উঠে দাঁড়ায়। সামিন নরম গলায় বলে,"ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে আলো। আমার অনূভুতি গ্রহণ করতে না পারো কিন্তু অসম্মান করো না অন্তত।"
আলো সামিনের দিকে তাকায়।
"ভালোবাসা? চাই না আপনার ভালো বাসা। চাই না আমি।"
উন্মাদের মতো ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে থাকে আলো। আলোর গায়ের ওড়না নিচে পরে যায়। সামিনের দলের ছেলেরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সামিন গিয়ে আলোকে ধরে ফেলে। ওড়না উঠিয়ে আলোর শরীর ঢেকে দিয়ে আলোর চোখের দিকে তাকায়। আলো উন্মাদের মতো বিড় বিড় করে সামিনের চোখে চোখ রেখে বলে,"আপনার শাস্তির আসা আমি করিনা। আপনি রাজ করতে দুনিয়ায় এসেছেন, মন ভরে রাজ করুন। মেয়র হন,এমপি হন, অর্থবান হন। যা ইচ্ছা হন। শুধু আমাদের ছাপোষা পরিবার টাকে ছেড়ে দিন।
একটা কথা আপনাকে বলে দেই। আজ থেকে কখনো যদি আমি দেখতে পাই আপনি আমাকে আপনার ক্ষমতা,অর্থ দিয়ে দয়া দেখিয়ে,আমার আত্মসম্মানে আঘাত করছেন তাহলে আমি সু'ই'সা'ই'ড করবো সামিন ইয়াসার মির্জা। আমি মানুষের কাছ থেকে আপনার "খেয়ে ছে'ড়ে দেওয়া মা'ল" অপবাদ মাথায় নিয়ে বাঁচতে পারবো কিন্তু আপনার থেকে দয়া নিয়ে নয়। এর থেকে ভালো আমি আ'ত্ম'হ'ত্যা করব।"
কথাটা শুনে সামিন আলোকে ছেড়ে দেয়। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে হাঁপাতে থাকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তার ব্যাগ টা কাঁধে তুলে নেয়। তারপর যতখানি তেজ নিয়ে এসেছিল সামিনের সামনে ঠিক ততখানি নিস্তেজ হয়ে চলে গিয়েছে ।
সামিন দাঁড়িয়ে থেকে তার ছেলেদের মুখের দিকে তাকায়। সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে,"শেষমেশ ঐ আছিয়া ফে'রা'উ'ন'কে ডু'বি'য়ে'ই ছাড়লো রে রাহাত।"
***
বেশি রাত হয়নি। গলির রাস্তায় এখনো বড় ট্রাক চলছে। রিকশার বেল বাজছে। আলো মাথা তুলে উঠে বসতে চায় কিন্তু পারে না। মাথা ভারি হয়ে আছে তার। বেলা বারোটায় বাড়ি ফিরে সেই যে ঘরে ঢুকেছে এখনো বের হয়নি। রেহেনা এসে বারবার ডেকে গিয়েছে। বলেছে একটু একা থাকবে সে। মাথা ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত আট-টা বেজে গিয়েছে। এখন না উঠলে আব্বু আম্মু বেশ চিন্তায় পরে যাবে। তাই কষ্ট হলেও উঠে বসে আলো। ওয়াশ রুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দিয়ে বের হয়। আজ কোনো অর্ডার নেয়নি সে। সেই মানসিক পরিস্থিতিতেও আলো ছিলো না।
হুট করে আলোর ঘরের দরজা ঠেলে আয়াত ভেতরে ঢোকে। আলো মাথা ঘুরিয়ে আয়াতের দিকে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আয়াত হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,"আপু ইয়াসার ভাইয়া!"
আলো কপাল কুঁ'চ'কে ফেলে। আয়াত বলতে থাকে,"শিগগিরই বসার ঘরে এসো।"
আলো দ্রুত পায়ে হেঁটে বসার ঘরে যায়। বসার ঘরে আতাউর আলম, রেহেনা, আজান দাঁড়িয়ে টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। আলো তাদের থেকে চোখ সরিয়ে টিভির দিকে তাকাতেই থ'ম'কে যায়। একটা লোকাল চ্যানেলে খবরের হেডলাইনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সে,
"নবনির্বাচিত তরুণ মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জা তার পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন।"
সংবাদ পাঠিকা বলতে থাকে,"আজ সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ তিনি নিজের বাসভবনে বসে সাংবাদিকদের কাছে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।"
আলো খবরটা শুনে টিভির স্ক্রিনে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। স্ক্রিনে একটু পরপর সামিন ইয়াসারের একটা শুভ্র পাঞ্জাবির উপরে মুজিব কোট পরা হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখানো হচ্ছে। আলো কিছু বুঝতে পারছে না বিষয়টা। সে তার আব্বু আম্মুর দিকে তাকাচ্ছে।
টিভির রিমোট হাতে নিয়ে সে পরপর কয়েকটি চ্যানেল পাল্টাতে থাকে। প্রত্যেকটা লোকাল চ্যানেলে একই খবর। একটা চ্যানেলে দেখাচ্ছে জনগণের প্রতিক্রিয়া। সবাই সামিনের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে নারাজ। দলের ছেলেগুলো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলছে।
আলো টিভি অফ করে দেয়। কলিং বেল বেজে ওঠে। আজান গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ইশিতা আর রিতু ভেতরে ঢোকে। রিতু কাঁদছে। ইশিতা এসে আলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় কান্না আটকে রেখে বলে ওঠে,"ভাইয়া পুলিশ কা'স্ট'ডি'তে আলো। সে সবকিছুর জবানবন্দি দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে পুলিশের কাছে।"
আলো বোকার মতো ইশিতার দিকে তাকিয়ে আছে। রিতু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তারপর ধরা গলায় বলে ওঠে,"তুমি জিতে গেলে ভাবী।"
আলো চুপ করে রিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে একটা নাম্বার দেখে সে বুঝে যায় ওটা কার নাম্বার। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ইশমাম বলে ওঠে,"অদ্রিতা।"
থানার নতুন অফিসার সমীর দত্ত সামিনের দিকে ক/ট/ম/ট দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। কয়েক মূহুর্ত পরে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"বাড়াবাড়ি করছিস সামিন।"
_বাড়াবাড়ি তুই করছিস সমীর। একজন দায়িত্ববান পুলিশ অফিসার হয়ে নিজের দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখাচ্ছিস। কনস্টেবল কে বল আমাকে ল/কা/পে দিতে।
ভাইয়ের পাশে থেকে ইলহাম মির্জা চেঁচিয়ে ওঠে,"হোয়াট আর ইউ ডুয়িং ভাইয়া। পাগল হয়েছো তুমি? বাবা ওদিকে অসুস্থ হয়ে পরেছে। এসব শুনলে তো শেষ হয়ে যাবে। বাবার অবস্থা ভালো নেই ভাইয়া।"
_পাগল কেনো হবো ? অন্যায় করেছি, শাস্তি পাওয়া উচিৎ।
ইলহাম ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে । সমীর দত্ত মাথা ঠান্ডা রেখে বলে,"আচ্ছা বুঝলাম। শুরু থেকে বল আবার। কি করেছিস তুই ঐ মেয়েটার সাথে।"
সামিন ক্ষে/পে গিয়ে বলে,"কতবার বলবো আমি ওকে
কি/ ড / ন্যা /প করেছি, জোরপূর্বক বিয়ে করে ওকে জি/ম্মি করে রেখেছি এবং ওর পরিবারের লোকজন কে মে/রে ফেলার হুমকি দিয়েছি। এখন আমাকে এ্যা/রে/স্ট কর।"
সমীর বলে,"হুম বুঝলাম। তো তুই এসব যার সাথে করেছিস সে কোথায়? কম/প্লেইন কোথায়? প্র/মান কোথায়? কিসের ভিত্তিতে আমি তোকে এ্যা/রে/স্ট করবো?"
_আমি কি থা/নায় এসে তোর সাথে ম/স্ক/রা করছি এতো রাতে? আমি নিজে স্বীকার করেছি সবটা সেটা কি যথেষ্ট নয়?
ওসি সমীর দত্ত সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইলহাম অসহায়ের মতো তার বড় ভাইকে দেখছে। থানার বাইরে শো/র/গো/লে/র আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সামিনের দলের ছেলেরা সবাই থা/নার বাইরে থেকে সামিনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। সামিনের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
সমীর বেল টি/পে একজন কন/স্টেবল কে ডাকে। কন/স্টেবল এসে দাড়াতেই সমীর বলে,"বাইরে কি হচ্ছে?"
_স্যার। ইয়াসার মির্জার ছেলেরা।
সামিন চুপচাপ বসে আছে। তার দৃষ্টি টেবিলের ওপর একটা পেপার ওয়েটে নি/বদ্ধ।
সমীর সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"তুই যা করতে চাইছিস তাতে তোর পুরো লাইফ, তোর রাজনৈতিক লাইফ যাস্ট ধ্বং/স হয়ে যাবে। তুই কি বুঝতে পারছিস না?"
_পদ/ত্যাগ পত্র জমা দিয়েছি। রাজনৈতিক লাইফ বলে তো আর কিছু নেই আমার। আর লাইফের কথা যদি বলিস। ওটা এমনিতেও ন/ষ্ট।
ইলহাম আকুতির সুরে বলে ওঠে,"ভাইয়া কেনো এমন পা/গ/লা/মী করছো!"
সামিন কোনো জবাব না দিয়ে সমীরের চোখে চোখ রেখে বলে,
"এ্যা/রে/স্ট কর আমাকে।"
***
আলো ফোনটা কানে ধরে চুপ করে থাকে। ওপাশ থেকে ইশমাম বলে ওঠে,"অদ্রিতা, ভাইয়া আমাদের জন্য কতটা ইম্পরট্যান্ট তা তুমি নিশ্চই এতদিনে বুঝতে পেরেছো।"
_তো আমি কি করবো ইশমাম? আমি তো কোনো কম/প্লেইন করিনি। তোমার ভাইয়া নিজে থেকে এসব করছে।
_সেটাই অদ্রিতা। ভাইয়া নিজে থেকেই করছে।
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"তোমরা আমার সাথে এমন কেনো করছো ইশমাম? তোমাদের পরিবারের সবার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় আসল অপ/রাধী আমি। তোমার ভাইয়া নয়। আমার অ/ন্যায় টা কি? অপ/রাধ কি আমার বলো!"
ইশমাম স্বাভাবিক গলায় বলে,"অপ/রাধ করোনি এমন টা তো নয় অদ্রিতা। ভাইয়াকে ভুল বুঝে চ/ড় মে/রে/ছো, হে/ন/স্থা করেছো একজন মানুষকে।"
আলো অবাক হয়ে ইশমামের কথা শোনে,বলে,"তার জন্য কি আমি যথেষ্ট শা/স্তি পাইনি ইশমাম? তোমার ভাইয়া নিজের হাতে আমাকে শা/স্তি দিয়েছে। আমি তার পা ধরেছি তুমি জানো? সেদিন তোমাকে বলিনি সেসব কথা। শা/স্তি যথেষ্ট পেয়েছি, উল্টো আমার বাবা যা করেইনি তার জন্য আমার জীবন টা ন/ষ্ট করে দিয়েছে তোমার ভাইয়া।"
ইশমাম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,"আমার পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের ভালো থাকা ঐ মানুষটার সাথে জরিয়ে আছে অদ্রিতা। প্রত্যেকটা মানুষের খুশি ঐ মানুষটার ওপর নির্ভর করে। এখন তুমি কি করবে সেটা তোমার বিবেচনা। অ/ন্যা/য় আবদার বলো বা যাই বলো, মনে হলো তোমাকে বলতে পারি, তাই বললাম। আর হ্যা,আমি তোমাকে অপ/রাধী বলছি না অদ্রিতা, কোনো অবস্থাতেই না। আমার শুধু আমার ভাইয়ার জন্য কষ্ট হচ্ছে, যেমনটা তোমার জন্য হতো।"
ইশমাম ফোন কেটে দেয়। আলো ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরের দিকে যায়। রিতু সোফায় বসে আছে, শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"দয়া করো ভাবী! নিজের ভাইদের ভালোবাসা স্নেহ আমি পাইনি। ঐ মানুষটা দিয়েছে আমাকে সেসব। আমি দয়া চাইছি তোমার কাছে আমার ভাইয়ের জন্য।"
***
রাহাতের ফোন বাজছে। থা/নার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সে। ভেতরে এই মাত্র জামিল গিয়েছে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাহাত ফোনটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে সাগর ভুঁইয়ার কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। খিক খিক করে হাসতে হাসতে বলে,"কিরে সামিনের চা/ম/চা। তোদের ভাইয়ের হাওয়া বেড়িয়ে গিয়েছে দেখলাম। এখন কেমন লাগছে তোদের?"
রাহাত চুপ করে থাকে। সাগর বলতে থাকে,"শা/লা ভ/য় পেয়ে মাঠ ছেড়েছে নাকি? কোথায় তোর ভাই? কোথায়?"
রাহাত এদিক ওদিক তাকিয়ে গলার স্বর নিচু করে দাঁত খিচিয়ে বলে,"শোন শু/য়ো/রে/র বাচ্চা। হাতী বাঁচলেও লাখ টাকা,ম/র/লেও লাখ টাকা। তুই এতো উড়িস না।"
_আচ্ছা তাই নাকি! তাহলে......
টুট টুট শব্দ হয়। রাহাত ফোন কেটে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফুয়াদ থানার সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে এগিয়ে যায়। রাহাত বলে,"ভেতরে আছে। জে/দ ধরে বসে আছে। কারো কোনো কথা শুনছে না। আপনি তাড়াতাড়ি যান ভাই।"
জামিল সামিনের হাত ধরে রেখেছে। উ/ৎ/ক/ণ্ঠা নিয়ে বলে,"ভাই সাংবাদিক এসে ভীড় করেছে। আপনি চলেন এখান থেকে। দোহাই লাগে।"
_তোর বৌ অ/সু/স্থ। বাড়িতে যা জামিল।
গম্ভীর কন্ঠে বলে সামিন।
সমীর সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফুয়াদ ছুটে এসে সামিনকে ধরে। ঝা/কুনি দিয়ে বলে,"কি? কি শুরু করেছিস এসব?"
_শে/ষ করছি সবটা।
নিস্তেজ কন্ঠে জবাব দেয় সামিন। তারপর সমীরের দিকে তাকিয়ে বলে,"এ্যা/রে/স্ট মি।"
_বাড়াবাড়ি করছিস সামিন।
ফুয়াদ চেঁ/চি/য়ে ওঠে। সমীর কিছুক্ষণ সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে একজন কনস্টেবলকে বলে,"নিয়ে যাও ওকে।"
সামিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কন/স্টেবল এসে নিয়ে যায় তাকে।
ইলহাম আহত চোখে তাকিয়ে থাকে। ফুয়াদ সমীরের দিকে অসহায়ের মত তাকায়। সমীর বলে,"ওকে শান্ত করার জন্য পাঠিয়েছি ল/কা/পে। ক/ম্প্লে/ইন না পেলে আমার বাপের সাধ্যি নেই ওকে আ/টকে রাখার। চিন্তা করিস না।"
***
বাড়ির জামাটা পাল্টে একটা শাড়ি পরে নেয় আলো। পার্স ব্যাগের মধ্যে ফোনটা ঢুকিয়ে নিয়ে বসার ঘরের দিকে যায়। ইশিতা উঠে দাঁড়ায়। রেহেনা কন্ঠে উ/ৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,"কোথায় যাচ্ছিস?"
আলো তার উত্তর না দিয়ে ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"রিতুকে নিয়ে বাড়িতে যাও আপু। ও এমনিতেই অসু/স্থ।"
_আর তুমি কোথায় যাচ্ছো?
ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে ইশিতা। আলো কিছু না বলে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে।
অনেক খুজে একটা রিকশা পেয়েছে অবশেষে। থা/নার সামনে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। থা/নার বাউন্ডারির ভেতরে সামিনের ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। আলোকে দেখে তৌফ সবাইকে নিচু স্বরে বলে,"কে এসেছে দেখ।"
সবাই মাথা তুলে আলোর দিকে তাকায়। আলো ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে তাদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে থানার দালানের ভেতর ঢোকে।
"স্যার একজন মেয়ে এসেছে আপনার সাথে কথা বলতে।"
কন/স্টে/ব/লের কথা শুনে সমীর দত্ত তার দিকে তাকিয়ে বলে,"একটু অপেক্ষা করতে বলো তাকে। অভি/যোগ থাকলে নাও। আমি ব্যাস্ত ইউসুফ।"
_স্যার, মেয়েটির নাম অদ্রিতা আলো।
সমীর ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,"এই সে নয়তো?"
ফুয়াদ বলে,"সম্ভবত।"
সমীর দত্ত কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে বলে,"ভেতরে নিয়ে এসো।"
নীল রঙের একটা শাড়ি। জমিনে নেভি ব্লু সুতোর কাজ। আঁচল টেনে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। চেহারায় সাজ সজ্জা নেই কোনো। একেবারেই সাদামাটা। সমীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে খুবই ভদ্রভাবে বলে,"বসুন।"
আলো ঘরে থাকা প্রত্যেকের দিকে একবার করে তাকিয়ে চেয়ার টেনে বসে পরে। তারপর সরাসরি সমীরের চোখের দিকে তাকায়। সমীর বলতে থাকে,"বলুন।"
_ইয়াসার মির্জা কোথায়?
নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে আলো।
_ল/কা/পে।
আলো চ/ম/কে ওঠে। সমীর বলে,"আমরাই কন/স্টে/বল পাঠাতে যাচ্ছিলাম আপনাদের বাড়িতে।"
আলো সমীরের দিকে তাকিয়ে আছে। সমীর বলতে থাকে,"ইয়াসার মির্জা তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন ,"তিনি আপনাকে জোর/পূর্বক তু/লে নিয়ে বিয়ে করেছেন, জি/ম্মি করে রেখে আপনার এবং আপনার পরিবারের প্রান/না/শের হুমকি দিয়েছেন। এসব আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই। এসব ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে ইয়াসার মির্জার সর্বোচ্চ শা/স্তির ব্যাবস্থা করবো। আপনি নির্ভয়ে বলুন।"
আলো মাথা ঘুরিয়ে ফুয়াদের দিকে তাকায়। ফুয়াদ অসহায়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে।
সমীর বলে,"বলুন। তিনি আপনাকে জোর/পূর্বক বিয়ে করেছেন? কি/ড/ন্যাপ করেছেন আপনাকে?"
আলো কিছুক্ষণ চুপ চাপ বসে থেকে অস্ফুট স্বরে বলে,"না।"
_কোনো শা/রী/রিক, মা/ন/সিক আ/ঘা/ত করেছেন কিংবা আপনার শ্লীল/তা/হানির চেষ্টা?
আলো মাথা নাড়ায়।
_উনি যা যা বলছেন সবটা মিথ্যা?
আলো মাথা নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"জ্বি।"
ওসি সমীর দত্ত আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,"লিখিত ব/য়ান দিন।"
আলো একটা কাগজে ব/য়ান লিখে নিচে সই করে দেয়। তারপর কাগজটা সমীর দত্তের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিচু স্বরে বলে,"আমি একটু ইয়াসার মির্জার সাথে দেখা করতে চাই।"
সমীর দত্ত এক জন কন/স্টেব/লের দিকে তাকায়। কন/স্টেবল আলোকে উদ্দেশ্য করে বলে,"আসুন আমার সাথে।"
***
হা/র্টে রিং পরানো। চেন্নাই গিয়ে প্রত্যেক ছয় মাস অন্তর চেক আপ করতে হয়। একটু আধটু চা/প পরলেই অবস্থা খুবই খা/রা/প হয়ে যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা করছে ইমতিয়াজ মির্জা। কাজের মেয়ে দুটো ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। শা/রী/রিক অবস্থার ক্রমেই অব/নতি হচ্ছে। এই মুহূর্তে যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে কেউ টেরও পাবে না। হঠাৎ খুবই ভ/য় হতে থাকে ইমতিয়াজ মির্জার। তার সময় কি তাহলে শে/ষ? কিন্তু সে এভাবে ছেলে মেয়ের মুখ না দেখে ম/র/তে চায় না। কখনোই না। নীচু গলায় সিতারাকে ডাকতে থাকে। সিতারা এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলে,"জ্বি খালুজান।"
_ওদিকের কোনো খবর পেলি? কেউ কিছু জানাচ্ছে না কেনো?
পোনা এসে দাঁড়ায়। ইমতিয়াজ মির্জার বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে বলে,"খবর পাইনি ভাইজান। আপনি এতো উ/ত/লা হবেন না। সামিন বাবার কিছু হবে না।"
***
দু'জনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে লো/হার শি/ক। সামিন আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে চুপ করে থাকে। আলো শীতল চোখে সামিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা শি/ক ধরে বলে ওঠে,"খুব ভালো লাগছে আপনাকে এখানে দেখতে। এটাই আপনার উপযুক্ত স্থান। "
সামিন চুপ। আলো বলতে থাকে,
" কি ভেবেছেন আপনি? দয়া শুধু আপনিই দেখাতে পারেন? খুব সুপরিওরিটি কমপ্লেক্সে
ভো/গেন তাই না? নিজেই সর্বেসর্বা, আপনিই সবকিছুর নিয়/ন্ত্রক এটাই ভাবেন? সবার প্রতি দয়া দেখানোর ক্ষমতা রাখেন? আজ আমি আপনার প্রতি দয়া দেখালাম ইয়াসার মির্জা। এই আলো নামের মেয়েটার দয়ায় এ যাত্রায় আপনি বেঁ/চে গেলেন।"
সামিন আলোর দিকে তাকায়। ঠান্ডা গলায় বলে,"কেনো দেখিয়েছো দয়া?"
_কেন দেখিয়েছি? আপনার বোনের জন্য, আপনার বাবার জন্য, আপনার ভাইদের জন্য, আপনার ভাইয়ের বৌ এবং ভাইপোর জন্য। আমারও একটা পরিবার আছে। তাই আমি আপনার পরিবারের
ভো/গা/ন্তি চাইনি। নূন্যতম হলেও তো দুই বছর জেলে প/চে
ম/র/তে/ন , আমি আপনার মতো নি/র্দয় না যে বাবা মায়ের
বু/ক থেকে সন্তান কে/ড়ে নিয়ে জি/ম্মি করে রাখে। আপনার বাবা হা/র্টের সিরি/য়াস পে/শেন্ট তাই দয়া দেখিয়েছি।
সামিন চুপ করে থাকে। আলো বলতে থাকে,"অবশ্য এসব আমি এমনি এমনি করিনি। এসবের বিনিময়ে আমি একটা জিনিস চাইবো। আর সেটা হচ্ছে আপনার থেকে মুক্তি। যা বরাবরই চাইতাম।"
সামিন আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।
একটু পরে সমীর দত্ত এসে ল/কা/পের সামনে দাঁড়ায়। একজন কন/স্টে/বল লকা/পের তালা খুলতে থাকে। সমীর দত্ত বলে,"ইচ্ছে করছে আইনের লোককে বি/ভ্রান্ত করার অপরাধে তোর নামে চা/র্জ লাগিয়ে দেই, কিন্তু তোর এই মাসুম চেহারাটা দেখে মায়া হচ্ছে।"
সামিন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সমীর বলে,"ভাবী সুন্দরী। তোর পাশে মানিয়েছে।"
সামিন ল/কা/প থেকে বের হয়। সমীর দত্ত বলে,"প্র/বলেম কি? খুলে বল। পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছিস কেনো? পাগ/লামি করছিস কেনো?"
"স্যার স্যার!"
একজন কন/স্টেবল তড়িঘড়ি করে ছুটে আসে। সামিন আর সমীর দত্ত তার দিকে তাকায়। সমীর বলে,"কি হয়েছে?"
_খবর এসেছে, স্যার ইয়াসার মির্জার বাবা হস/পিটালে।
***
দৌড়াতে দৌড়াতে হস/পিটালের ভেতরে ঢোকে সামিন। করিডোরে ইশিতা,পরী,রিতু এবং দলের কিছু ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ।
সামিন এবং ইলহাম এগিয়ে যায়। ইশিতা ভাইকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে জরিয়ে ধরে কাঁ/দ/তে থাকে। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে এদিক ওদিক অস/হায়ের মতো তাকাতে থাকে সামিন। আরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,"কখন হয়েছে এসব?"
পরী এগিয়ে আসে। কা/তর সুরে বলে,"আমি হোস্টেল থেকে বাড়িতে গিয়ে দেখি পুরো বাড়ি ফা/কা। বাবা কটেজে এসেছিলো।দোতলায় উঠে দেখি মেঝেতে পরে আছে।"
সামিন ইশিতাকে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে যায়। ইলহাম তার পিছু পিছু যায়। কেবিন থেকে ডক্টর বের হয়ে এদিকে আসে। সামিন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ডক্টর নরম গলায় বলে ওঠে,"আই এ্যাম সরি। অনেক দেরি করে ফেলেছেন আপনারা।"
সামিন ডক্টরের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। এমন সময় ধপপ করে শব্দ হয়। পেছনে মাথা ঘুরিয়ে সামিন দেখে ইশিতা ফ্লোরে পরে গিয়েছে অ/চে/ত/ন হয়ে।
***
"মাম্মা, দাদুভাই ওখানে কেনো ঘুমাচ্ছে?"
ইহান প্রশ্নটি করে রিতুর দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। রিতু নিশ্চুপ চোখের পানি ফেলছিলো। সংসারের সব তি/ক্ত মিঠা অভিজ্ঞতা একপাশে রেখে লোকটা তার শশুর। তার স্বামীর বাবা। রিতুর জীবনে তার ভূমিকা ছিলো। ইলহামের হাতে যখন অ/ত্যা/চা/রি/ত হতো, ঐ খাটি/য়ায় শুয়ে থাকা লোকটা শান্তনা দিতে আসতো। লোকটা আদর্শবান কোনো লোক না, যথেষ্ট ত্রু/টি তার রয়েছে, কিন্তু রিতুর কাছে খা/রাপ কিংবা অসম্মানেরও কেউ না। লোকটার জন্য রিতুর কান্না পাচ্ছে খুব।
ছেলের কথার জবাব না দিয়ে রিতু মাথা ঘুরিয়ে লিভিং রুমের আশেপাশে তাকায়। ইশিতা আর্ত/নাদ করে কেঁ/দে যাচ্ছে। খা/টিয়ার দুইপাশে তার দুজন ছেলে বসে আছে। যেন বাবা কিছু বলছে তাদের। চুপচাপ শুনছে তারা।
ভোর চারটা প্রায়। ইমতিয়াজ মির্জার লা/শ কিছুক্ষণ আগেই হস/পিটাল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে।
আত্মীয় স্বজনের ভীর জমে গিয়েছে শান্তিনীড়ে।
জামিল এগিয়ে গিয়ে মেঝেতে সামিনের পাশে চুপ করে বসে পরে। সামিনের দৃষ্টি মেঝের দিকে। জামিল মৃদু স্বরে বলে,"ভাই। ইশমাম ফোন দিচ্ছে বারবার। ওকে জানাবো?"
সামিন অনূভুতি শূন্য দৃষ্টিতে জামিলের দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ কন্ঠে বলে,"আমাকে দে ফোনটা।"
"ভাইয়া।"
ইশমামের কন্ঠে উৎ/কণ্ঠা। সামিন অস্বাভাবিক ঠান্ডা গলায় বলে,"চিন্তা করিস না ছোট। থা/নায় কিছুই হয়নি। আমি বাড়িতে।"
ইশমাম একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর বলে,"বাবা ঠিক আছে? সন্ধ্যায় শুনলাম অ/সু/স্থ।"
সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"ঠিক আছে কি নেই তা তো জানি না ছোট।"
_মানে?
_কাল সকাল দশটায় বাবার জা/না/জা।
***
"কেমন মেয়েরে তুই? স্বামীর ঘর করবি না ঠিকাছে। তাই বলে একটা মানুষ ম/রে গিয়েছে তবুও একটু সহানুভূতি আসছে না তোর?"
আলো মাথা ঘুরিয়ে প্রফেসর শিবলীর ওয়াইফের দিকে তাকায়। প্রফেসর শিবলীর ওয়াইফ বলতে থাকে,"একটা মানুষের বাবা মা/রা গিয়েছে। তোরও তো বাবা আছে। আতাউর ভাইয়ের কিছু হলে তোর কেমন লাগে? ঐ লোকটারও তো এখন তেমন লাগছে। তবুও তোর দিল নরম হচ্ছে না?"
_খালা, ওনার মৃ/ত্যু/তে আমি খুশি হইনি। এভাবে বলো না।
_তাহলে বসে আছিস কেন? সমবেদনা জানা।
আলো আবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
প্রফেসর শিবলীর ওয়াইফ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসার ঘরের দিকে যায়। আলো উঠে আতাউর আলমের ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়, টুপিটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে আতাউর আলম আলোর দিকে তাকায়। আলো মৃদু স্বরে বলে,"যাচ্ছো তুমি?"
আতাউর আলম নিচু স্বরে বলে,"না গেলে কেমন দেখায় না মা? আমরা সামাজিক জীব।"
আলো চুপ করে থাকে । আতাউর আলম আমতা আমতা করে বলে,"আর তাছাড়া ইয়াসারের সাথে ব্যাক্তিগত শ/ত্রু/তা থাকতেই পারে। কিন্তু ও একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক। এতগুলো এতিমখানা, এজেন্সি চালায়। সাংবাদিক এসোসিয়েশনের সবাই যাচ্ছে। এটা আমাদের এসোসিয়েশনের নী/তি। আমার না যাওয়াটা দৃষ্টি/কটু।"
আলো বাবার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,"জা/না/জা কয়টায়?"
_দশটায়। পারিবারিক ক/ব/র/স্থা/নে দা/ফ/ন হবে।
***
রিকশা থামিয়ে গেইটের বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তাটা মানুষে গিজগিজ করছে। অবশ্য বিশিষ্ট সমাজসেবকের বাবা মা/রা গিয়েছে , একসময় সেও এমপি ছিলো। এতো লোকজন তো থাকবেই। আলোর অস্বস্তি বারছে। সবাই কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকে দেখেছে। এখনো কোনো চেনা লোকের চোখে আলো পরেনি। এদিক ওদিক তাকিয়ে গেইটের ওপরে লেখা "শান্তিনীড়" কথাটার দিকে আলোর চোখ পরে। তারপর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে পা বাড়ায়। যে বাড়িটাকে একবার ছেড়ে চলে গিয়েছে পুনরায় প্রকৃতি তাকে সেখানে টে/নে এনেছে।
কিন্তু কিসের জন্য? চোখের সামনে বাবা হারা ইশিতার কান্না/মাখা চেহারাটা ভেসে উঠছে সেজন্য? আতাউর আলমের অপা/রেশ/নের সময় যেভাবে আলোকে মানসিক সাপোর্ট দিয়েছে মেয়েটা,আলোর কি একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিৎ নয়? এতটাও ক/ঠি/ন মেয়ে আলো নয়।
ধীরপায়ে হেটে গেইটের ভেতরে পা রাখতেই সে দাঁড়িয়ে পরে। ইলহাম এবং দলের ছেলেরা পোর্চের ডানপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইলহাম কাঁ/দছে। এমপি মহোদয় ইলহামের কাঁধে হাত রেখে কিছু একটা বলছে। মনে হচ্ছে শান্তনা দিচ্ছে। সবার মাথায় টুপি। সম্ভবত এক্ষুনি সবাই দা/ফন কার্য শেষ করে এসেছে।
অবচেতন মনে আলোর চোখ দুটো একজন কে খুঁজছে। হুট করে আলো চেতনা ফিরে পেতেই নিজের কাজে নিজেই প্রচন্ড অবাক হয়।
জড়তা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই ইলহাম এবং দলের ছেলেদের সামনে পরে যায় আলো।
সবাই কয়েক মুহূর্ত আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে চুপচাপ হেঁটে চলে যায় সেখান থেকে।
আলো শান্তিনীড়ের অন্দরমহলে প্রবেশ করে।
করিডোর পেরিয়ে লিভিং রুমের দিকে এগোতেই কেউ চেঁ/চি/য়ে বলে ওঠে,"দাঁড়াও।"
আলো দাঁড়িয়ে পরে। ইলোরা মির্জা আলোর সামনে এসে দাঁড়ায়। আলো তার দিকে তাকায়।
_কেন এসেছো তুমি?
আলো কি বলবে বুঝতে পারছে না। সত্যিই তো। সে কেনো এসেছে তার সঠিক কোনো ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। তবুও কথা গুছিয়ে নিয়ে বলে,"ইশিতা আপু।"
ইলোরা মির্জা আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে সরে দাঁড়ায়। নিচতলার লিভিং রুম থেকে চাপা আর্ত/নাদের শব্দ শোনা যাচ্ছে। লিভিং রুম ভর্তি মানুষ। আলো ইলোরা মির্জার দৃষ্টি উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়। ভীর ঠেলে দেখতে পায় ইশিতা মেঝেতে বসে বি/লাপ করে যাচ্ছে উ/ন্মাদের মতো। দৃশ্যটা দেখে আলোর বুকটা
মো/চ/ড় দিয়ে ওঠে। কিছু বছর পূর্বে মাকে হারিয়েছে,আর এখন বাবাকে। পুরোপুরি এতিম মেয়েটা। আলোর বুকে য/ন্ত্রনা হচ্ছে খুব। এই পরিস্থিতিতে তো সেও পরতে পারতো!
রিতু মাথা তুলে আলোর দিকে তাকাতেই থম/কে যায়। আলোকে সে আশা করেনি। পরী উঠে আলোর দিকে ছুটে এসে আলোর হাত ধরে ইশিতার কাছে নিয়ে যায়। ইশিতা হাউ/মাউ করে কেঁ/দে যাচ্ছে। আলো গিয়ে ইশিতার মুখোমুখি বসে পরে মেঝেতে।
ইশিতা কাঁদতে কাঁদতে আলোর দিকে তাকায়। আলো খুবই সংকোচের সাথে ইশিতার গালে একটা হাত রাখে। একটা মমতাময়ী হাতের স্পর্শ পেয়ে ইশিতা দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে। জরিয়ে ধরে আলোকে। তারপর ফোপাতে থাকে।
রিতু পাশে বসে নিশ্চুপ কেঁ/দে যাচ্ছে। লিভিং রুমে যত মহিলা আছে সবাই শান্তনাবানী শুনিয়ে যাচ্ছে।
আলো ইশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
ইলোরা মির্জা এগিয়ে গিয়ে ইশিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,"কাকে জরিয়ে ধরে আছিস তুই? ও মজা পাচ্ছে মজা।"
আলো কপাল কুঁ/চ/কে ফেলে, ক/ঠিন গলায় বলে,"বাজে কথা বন্ধ করুন। একজনের মৃ/ত্যু/তে আমি মজা পাবো কেনো?"
_একজনের মৃ/ত্যু/তে না। এই পরিবারের ভো/গান্তিতে মজা পাচ্ছিস তুই হত/চ্ছাড়ি।
সব মহিলারা হতভম্ব হয়ে যায় ইলোরার কথা শুনে। আলো ।
ধ/ম/কে/র সুরে বলে,"কথা বুঝে শুনে বলবেন। মুখ সামলে বলবেন।"
"দাদী"
নরম গলায় সামিন ইলোরাকে ডাকে। ইলোরা ঘুরে তাকায়। সিঁড়ির কাছটাতে দাঁড়িয়ে আছে সামিন। সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরনে তার, মাথার টুপিটা খুলে হাতে নিয়েছে। আলো ইশিতাকে রেখে উঠে দাঁড়ায়। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সামিনকে দেখে। যে লোকটা তাকে একদিন বাবা হারা করে দিতে পারতো,আজ নিজের বাবা হারিয়ে কতটা পরিবর্তন এসেছে চেহারায় সেটা দেখতে থাকে।
সামিন একবারের জন্যও আলোর দিকে তাকায় নি। সে নি/স্প্রা/ন গলায় ইলোরাকে বলে,"কেউ মৃ/ত ব্যক্তির বাড়িতে সমবেদনা জানাতে আসলে তাকে এভাবে অপ/মান করতে নেই।"
কথাটি বলে সামিন দোতলার ওঠার জন্য পা রাখে সিঁড়ির প্রথম ধাপে। পেছন থেকে আলো বলে ওঠে,"দাঁড়ান।"
সামিন দাঁড়িয়ে পরে, কিন্তু আলোর দিকে ঘুরে তাকায় না,আলো এগিয়ে এসে সামিনের পেছনে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে,"জানি এই সময়ে এসব কথা বলা উচিত না, তবুও বাধ্য হয়ে বলছি। আমার দাদুর দেয়া একটা চেইন বিক্রি করে টাকা নিয়ে এসেছি আমি। টাকা গুলো নিয়ে আমাকে ঋণ মুক্ত করুন।"
_রিতুর কাছে দিয়ে যাও। টাকা গোনার পরিস্থিতিতে আমি নেই।
অস্ফুট স্বরে বলে সামিন।
আলো বলতে থাকে "জানি এই সময়ে এসব কথা আপনাকে বলা ঠিক হচ্ছে না, আচ্ছা একটা কথা বলুন তো। আপনার বাবার মৃ/ত্যু/টা কি কোনোভাবে আমার জন্য হয়েছে? আমি দায়ী?"
সামিন নিচু স্বরে কিন্তু তেজী কন্ঠে বলে,"মোটেই না। অবান্তর কথা।"
আলো বলতে থাকে,"কাল সন্ধ্যার ঘটনার পর থেকে আপনাদের বাড়ির লোকজন আমাকে অপ/রাধী সাজিয়ে আমার দিকে আঙুল তুলেছিলো, অপ/রাধী তার অ/পরাধ স্বীকার করে স্বেচ্ছায় শা/স্তি পেতে গেলো সেজন্য ভি/ক্টি/মকে দো/ষী সাব্যস্ত করা হলো কেন সে অপ/রাধীকে আটকাচ্ছে না, সেটা কি উচিত ছিলো?"
_উচিৎ হয়নি। ওদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইছি।
_আজ আমি এখানে ইশিতা আপুকে সমবেদনা জানাতে এসেছি সেটা কি ভুল হয়েছে?
_ভুল হয়নি। তুমি মহৎ।
_তাহলে আপনার বাড়ির লোকজন এভাবে কেনো অপ/মান করবে যেন আমি একজন অ/প/রা/ধী। যেখানে আমার কখনো কোনো দো/ষ ছিলোই না। আপনি যা করেছেন তার বিনিময়ে অতটুকু রিয়াক্ট করা কি স্বাভাবিক না আমার? ঠান্ডা মাথায় বলুন!
সামিন নিচু স্বরে বলে,"স্বাভাবিক।"
_তাহলে সবাই বরাবর আমাকে দোষা/রোপ করছে কেনো, যেন আমি সর্ব/নাশী।
সামিন ওদিকে ফিরেই স্বাভাবিক গলায় বলে,"দাদী বৃদ্ধা মানুষ তাই এমন করছে। দাদীর হয়ে আমি ক্ষ/মা চাইছি। সমবেদনা জানানো হয়ে গেলে তুমি বাড়ি চলে যাও। কোনো কিছুতে তোমার কোনো দোষ নেই। তুমি নি/র্দোষ ছিলে, আছো এবং আমার কাছে বরাবর নি/র্দোষ থাকবে।"
আলো সামিনের মাথার দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন একবারের জন্যও আলোর দিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়..
#পর্বসংখ্যা_৩৩ (বোনাস পর্ব)
"বাতাসে নির্বাচন নির্বাচন গন্ধ পাচ্ছি।"
চোখ বন্ধ করে একটা প্রশান্তির গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সাগর বলে।
শমশের ভুঁইয়া ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সাগর চোখ মেলে তাকিয়ে বলে,"বিষয়টা পুরোটা মাথার উপর দিয়ে গেলো আব্বা।"
_বিষয়টা যাই হোক না কেনো। লাভ তো আমাদেরই হচ্ছে। এরকম অনাকাঙ্খিত সুযোগ হাতে চলে আসলো।
_কিন্তু হ/জম করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে আমার। মানে আপনি ভাবতে পারেন? সিংহ তার সাধের রাজত্ব স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছে।
শমশের ভুঁইয়ার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"সিংহ রাজত্ব ছেড়েছে শুধু, তার উপাধি না। ওকে আন্ডারস্টিমেট করিস না বাপ। অতীতে বহুবার ওকে আন্ডারস্টিমেট করে কো/প খেয়েছি।"
বাবার কথায় সাগর মাথা নাড়ে, তারপর বলে,"ঠিক বলেছো। ওর মতিগতি বোঝা মুশকিল। নজরে নজরে রাখতে হবে ওকে।"
***
"ভাইয়া "
দরজার বাইরে রিতু দাঁড়িয়ে আছে। সামিন দোতলার বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। রিতুর কথায় মাথা ঘুরিয়ে তাকায়।
" ভাইয়া আত্মীয় স্বজনরা বাড়িতে খাবার দিতে চাচ্ছে। তাদের কি বলবো? "
_এসব কেনো?
_নিয়ম নাকি! ভুলে গেলেন?
_নিয়ম?
সামিন অন্যমনষ্ক হয়ে প্রশ্ন করে। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই রিতুকে বলে,"যা মন চায় করো।"
রিতু দাঁড়িয়ে থেকে কয়েক মূহুর্ত পরে বলে," এ/তি/ম/খানায় খাওয়ানোর ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু আমি চাচ্ছি বাড়িতেও মিসকিন ডেকে খাইয়ে দিতে। আপনার কাছ থেকে অনুমতি চাচ্ছি। "
_অনুমতির কি আছে রিতু। তুমি যেটা ভালো মনে করো। জামিলকে টাকা দিয়ে সব বুঝিয়ে দাও।
তারপর কিছুক্ষণ পরে চুপ করে থেকে বলে,"তুমি এই অবস্থায় দৌড়াদৌড়ি করো না। খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করো। ইহানকে খাওয়াও। ইশিতাকে খাওয়াও। তোমরা না খেয়ে থাকলে বাবা ফিরে আসবে না।"
_আর আপনি? আপনি খাবেন না? গতকাল রাত থেকে কিছু খান নি।
_খাবো। এক গ্লাস পানি পাঠিয়ে দাও কাউকে দিয়ে।
রিতু চলে যাওয়ার আগে নিচু স্বরে বলে,"ভাবী আমার কাছে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছে। কোথায় রাখবো ভাইয়া?"
_বিছানার ওপর রেখে যাও।
***
রেহেনা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বারবার ভেতরে উঁকি দিচ্ছে। আলো খেয়াল করেছে কিন্তু কিছু বলছে না। হিয়া মাথা ঘুরিয়ে রেহেনার দিকে তাকিয়ে বলে,"আন্টি আসুন না। ভেতরে আসুন।"
রেহেনা ভেতরে ঢোকে। আলো তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"কিছু বলতে চাইলে বলতে পারো।"
রেহেনা আমতা আমতা করে বলে," ও বাড়িতে ভাত-তরকারি দেওয়া টা উচিত নয় কি? "
_কোন বাড়িতে?
_ম/রা বাড়িতে!
আলো মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, "কেনো? তুমি কি সত্যি সত্যি বেয়াই বাড়ি ভাবছো ও বাড়িকে?"
রেহেনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"পাড়া প্রতিবেশীরা বাঁকা কথা শুনিয়ে যাচ্ছে।"
_কোন জন্মে পাড়া প্রতিবেশীর কথা আমি গায়ে লাগিয়েছি? এখন ভাত-তরকারি রেধে পাঠাবে। কাল ঐ সামিন ইয়াসার এসে তোমার কাছে জামাই আদর খেতে চাইবে। খাওয়াবে তুমি?
"আলো এভাবে কথা বলিস না। লোকটার বাবা মা/রা গিয়েছে। এখন অন্তত চুপ কর। শুনতে ইচ্ছা করছে না আর।"
হিয়া চেঁচিয়ে বলে ওঠে। আলো চুপ হয়ে যায়। রেহেনা বলতে থাকে,"তোর বাবাও বলছিলো। তোর মত থাকলে পাঠাবো। এক সমাজে চলতে গেলে শ/ত্রু/র বাড়িতেও তো মানুষ এসব দেয় সামাজিকতার খাতিরে।"
_হ্যা তোমরা এখন মেয়ের কি/ড/ন্যা/পা/র আর ছেলেদের গলায় চা/কু ধরা লোকের ম/র/মে ম/রি/য়া হয়ে উঠেছো। যাও পাঠিয়ে দাও। আমাকে বলছো কেনো? পাড়া প্রতিবেশীর থেকে অনুমতি নাও।
রেহেনা কিছুক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যায়। হিয়া আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"তোকে কি দিয়ে বানিয়েছে আল্লাহ?"
_আমার সেদিন রে/ই/প হতে পারতো হিয়া।
_হয়নি তো তাই না? তোকে বিয়ে করেছে। রোজ কত শত প/লি/টি/শি/য়া/ন/রা মেয়েদের রে/প করে বনে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে যায়। কেউ খবর রাখে না, এমন কিছু তো তোর সাথে হয়নি। তোকে বিয়ে করেছে। শেষমেশ ভুল বুঝতে পেরে তোর জন্য নিজের ক্যারিয়ারের ব/লি চড়িয়েছে।
_তোরা যে দৃষ্টিকোণ থেকেই অ/ন্যা/য়টাকে দেখবি না কেনো হিয়া ওটা অ/ন্যা/য়ই থেকে যাবে। একটা ঘোর অ/ন্যা/য়।
_হ্যা। অ/ন্যা/য় অ/ন্যা/য়ই থাকবে, কিন্তু একজন অ/প/রাধী যে সারাজীবন অ/প/রাধীই থাকবে তোকে এমন কথা মাথার দিব্যি দিয়ে কে বলেছে? জবাব দে আমাকে।
_না সে হজ্ব করে হাজী হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি তার কাছে যাবো না। কি করবি এখন আমাকে তোরা? মে/রে ফেলবি? মে/রে ফেল।
হিয়া চুপ করে আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো বলে,"তোদের কাছে সে ফে/রেস্তা সম মানুষ কিন্তু আমার কাছে সে একটা অপ/রাধীই থাকবে। অপ/রাধীকে ক্ষমা করা যায়, তার প্রতি সহমর্মিতা দেখানো যায় কিন্তু সংসার করা যায় না হিয়া। আমি কোনো সমঝোতার সংসার চাইনা হিয়া, আমি চাই একটা ভালোবাসার সংসার। ওনাকে আমি কখনো ভালোবাসতে পারবোনা রে। বুঝবি না তোরা। আমাকে কেউ বুঝবি না।"
***
"শরীর খা/রা/প?"
ফুয়াদ ঘরের ভেতর ঢুকে সামিনের বিছানায় বসে। সামিন আধশোয়া হয়ে ছিলো। মৃদু স্বরে বলে," মাথা ব্যা/থা। মে/ডিসিন নিয়েছি। "
_ইশিতার জন্য ডাক্তার ডাকা হয়েছে। অবস্থা খা/রা/প করে ফেলেছে নিজের।
_পরী আছে। দেখবে।
_ইশমামের সাথে কথা হয়েছে?
_হুম। বিকেলে হয়েছে। ভেঙে পরেছে খুব। ওকে সামলানোর কেউ নেই ওখানে।
_আর তোকে?
ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে। তারপর বলতে থাকে,"তোকে সামলানোর কেউ আছে? তুই নিজেকে দেখেছিস?"
_তুই আছিস। জামিল আছে। আর কাকে লাগবে আমার?
সামিন ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়।
কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ। তারপর সামিন বলতে থাকে,"বাবা সবসময় আফসোস করতেন। তার মৃ/ত্যু/শ/য্যায় ইশমাম পাশে থাকবে না। আজ দেখ ভাগ্যের কি নি/র্ম/ম পরিহাস। তার একটি সন্তানও থাকতে পারলো না। সবকিছু ঘেটে দেই আমি ফুয়াদ। তুই ঠিক বলিস, আমি বড্ড অযোগ্য। "
ফুয়াদ তার বন্ধুর কাঁধে হাত রাখে। সামিন দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। ফুয়াদ প্রসঙ্গ পালটে বলে,"আতাউর আলমের বাড়ি থেকে ভাত-তরকারি পাঠানো হয়েছে। "
সামিন চুপ করে থাকে। ফুয়াদ বলে, " হঠাৎ কি হয়েছিলো ? কেনো এতো বড় সিদ্ধান্ত নিলি? "
_ও আমাকে বললো ওর লাইফে আমার অস্তিত্ব টের পেলে ও সুই/সা/ইড করবে। এতো বড় একটা কথা বললো। তুই ঘৃ/ণার পরিমাণ দেখেছিস? কতটা ক্ষত দিয়েছি আমি ওকে। কিচ্ছু সারাতে তো পারবো না। ভাবলাম একটু স্বস্তি দেই ওকে। ও মনে করে আতাউর আলম ভোটে দাঁড়ালে জিতে যেতো। তাই আমি সেই ব্যাবস্থা করে দিলাম। এতো টুকু স্বস্তি তো আছিয়াকে দেওয়ার ক্ষমতা এই ফে/রা/উ/ন রাখে। ও স্বস্তি পাক।
***
ডেলিভারি বয় এসে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আলো আর শেফালী হাতে হাতে আচারের বৈয়ম গুলো নামিয়ে নিচ্ছে। সানজিদা,বিউটি,হিয়া, শ্রাবনী মশলা প্রক্রিয়াজাত করছে।
ডেলিভারি বয়কে দোকানের লিস্টগুলো বুঝিয়ে দিয়ে আলো ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে ছাদে যায়। ছাদে গিয়ে একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলে,"আজকের মতো কাজ শেষ। শেফালী আপু আর বিউটি আপু। তোমরা যাও। তোমাদের তো কাজ রয়েছে আরো। বাকি কাজ আমরা হাতে হাতে করতে পারবো। "
_সত্যি বলছো? যাবো আলো ?
আলো হেসে বলে," হু যাও। "
শেফালী আর বিউটি চলে যায়। আলো বসে যায় বাকিদের সাথে মশলা প্রক্রিয়াজাত করতে। কিছুক্ষণ পরে নিচে চেঁ/চা/মে/চি/র শব্দ শোনা যায়। সবাই সবার মুখের দিকে তাকায়। আলো উঠে গায়ে ওড়না জরিয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে বাড়ির আঙিনায় চলে আসে। আশেপাশের বাড়ির বেশকিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। আলোর বাবা মাও আছে।
আলোকে দেখে ব্যাবসায়ী জালালউদ্দিন বলে ওঠে,"এই যে এসে গিয়েছে আসল লোক।"
আলো বলে,"কি হয়েছে আংকেল?"
_কি হয়েছে? তোমার জন্য তো এই পাড়ায় শান্তিপূর্ণ ভাবে কেউ থাকতে পারবে না দেখছি।
_কি করেছি আমি?
_কি করেছো? আজকাল হি/জ/ড়া/দের সাথে চলাফেরা করো। তোমার ঐসব পোষা হি/জ/ড়া রা কি করে জানো? মহল্লার দোকানে দোকানে চাঁ/দা/বা/জি করে। ভদ্রলোকদের হয়রানি করে বেড়ায়। এইতো গতকাল আর্কিটেক্ট সাহেবের তিন মাসের নাতীর মুখ দেখবে বলে বাড়িতে ঢুকেছিলো। উল্টো করে ঝু/লি/য়েছিলো শিশুটাকে। আরো কত ধরনের অ/ত্যা/চার ওরা করে তুমি জানো?
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"শেফালী আর বিউটি আপু কি কিছু করেছে? করেনি তো তাইনা?"
_ওরা করেনি কিন্তু তোমার আশকারা পেয়েই তো ওর স্বজাতিরা মহল্লায় ঢুকে এমন করছে।
_স্বজাতি মানে? আমরা সবাই একই জাতি। সবাই মানুষ। শেফালী আর বিউটি আপু যদি কিছু করে থাকে তাহলে আমাকে বলুন। বাকিদের তো আর আমি লিড করিনি। থানায় ক/ম্প্লে/ইন করুন।
জালাল উদ্দিনের পাশ থেকে তার স্ত্রী বলে,"বাদ দাও তো। এই মেয়েকে তুমি চেনো না? কোনো মুরব্বি জ্ঞান নেই এই মেয়ের। এর সাথে কি কথা বলছো তুমি?"
তারপর আতাউর আলমের দিকে তাকিয়ে বলে,"শুনুন ভাই। আপনি সজ্জন ব্যক্তি তাই আপনাকে বলছি। একটু রয়ে সয়ে চলাফেরা করতে বলুন মেয়েকে। আর পারলে একটু ভদ্রতাও শেখাবেন!"
***
" আংকেল আমার কিছু করার নেই। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। "
_সামিন। দেখো। ঐদিন সন্ধ্যার পর থেকে তোমার প্রতি আমি যথেষ্ট বিরক্ত ছিলাম। এখন আমি যথেষ্ট ম/র্মা/হত। তাই তোমাকে ধমকাচ্ছি না। কিন্তু তুমি তোমার সিদ্ধান্ত বদলে নাও। বারবার বলছি।
_না আংকেল। আমি গুটিয়ে নিয়েছি সবকিছু থেকে।
_সামিন তুমি কি ভুলে গিয়েছো নমিনেশন পাওয়ার জন্য তুমি কি কি করেছিলে? ভুলে গিয়েছো তুমি? কতটা পরিশ্রম করে তুমি এই পর্যায়ে এসেছো, কোনো টাকা পয়সা ইনভেস্ট না করে, কোনো অ/বৈ/ধ উপায় অবলম্বন না করে। ভুলে গেলে সব?
_কিচ্ছু করার নেই আংকেল।
_চাইছো টা কি সামিন তুমি?
_পুনঃনির্বাচন আংকেল।
কথাটি বলে কবির আলমগীরের মুখের ওপর ফোন কেটে দেয় সামিন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই সামিন ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে, ওপাশ থেকে রনি বলে,"ভাই মহল্লার কিছু লোকজনের সাথে ভাবী হা/ঙ্গা/মা করছে। "
_ওকে ওর মতো ছেড়ে দে রনি। ও সামলে নিতে পারবে। বিরক্ত করিস না ওকে।
***
"আমি নির্বাচনে দাড়াবো? আবার?"
আতাউর আলম হতভম্ব হয়ে যায়। আলো বাবার দিকে তাকিয়ে তেজী কন্ঠে বলে,"হ্যা। দাঁড়াবে।"
আতাউর আলম উঠে দাঁড়ায়। আ/তং/কিত মুখ নিয়ে বলে,"অসম্ভব। আমি আবার ঐ ম/র/ন খেলায় নামতে চাইনা। একেবারেই না। তুই বাদ দে।"
_কেন বাদ দেবো? বাদ দেবো না আব্বু। আবার নির্বাচন হবে। তুমি দাড়াবে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে। ভোট হবে। তুমি জিতবে। আর কেউ তোমাকে দ/মিয়ে রাখতে পারবে না আব্বু।
আতাউর আলম মেয়ের মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলে,"এতো জে/দ বড় খারাপ জিনিস মা। এতো জেদ করিস না। আমি আগের বার ভুল করেছিলাম। আমার মতো লোকের রাজনীতি মানায় না মা। আমার মতো ছাপোষা লোক যার কোনো লোকবল নেই,অর্থ নেই, তার রাজনীতি মানায় না।
_কিন্তু তোমার দেশ সেবা করার মতো একটা উদার মন আছে আব্বু। ওটাই যথেষ্ট আব্বু। সবটা যখন অগোছালো হয়েই গিয়েছে আর একবার এই খেলাটা আমি খেলে দেখতে চাই। তুমি একটা সুযোগ পেয়েছো আব্বু। তুমি দাড়াবে। তুমি অবশ্যই নির্বাচনে দাড়াবে। এবং ঐ ইয়াসার মির্জাকে তুমি জিতে দেখিয়ে দেবে। অবশ্যই দেখিয়ে দেবে।
***
ত্রিশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। যে কোচিং সেন্টারে আলো পড়ায় সেখানের হেড ম্যাম এখনো এসে পৌঁছায়নি। চাবি তার কাছে। কোচিং সেন্টার টা গলির মেইন রোডের ধারে। আলো পোর্চের নিচে কপাল কুঁ'চ'কে দাঁড়িয়ে আছে। আজ পি/রি/য়/ড হয়েছে তাই মেজাজ টা একটু বেশিই বি/গ/ড়ে গিয়েছে। মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই আলোর চোখ মুখ ভ/য়ে শুকনো হয়ে যায়। কিছু ক্ষ্যা/পা কুকুর এদিকে ছুটে আসছে। আলো ডানপাশে একটা বাইক রাখা ছিলো, সে ভয় পেয়ে বাইকের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। আলোর দুর্ভাগ্য, কুকুর গুলো তার সামনে এসেই দাঁড়িয়ে আছে। আলোকে দেখছে সবকটা। এমনিতেই এই মাসে সব কুকুর ক্ষ্যা/পা হয়ে যায়। তার উপর এইগুলো কেমন ভ/য়ং/কর মুর্তি ধারন করেছে। জিভ বের করে আছে। আজ আলোর বারোটা বেজে গেলেও যেতে পারে। সে ঢোক গিলে এদিক ওদিক অসহায়ের মতো তাকাচ্ছে।
মেইনরোডের অপজিটে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আলোকে দীর্ঘসময় ধরে লক্ষ্য করছিলো সামিন। সামিনের চোখে মুখে সং/কোচ। সে জানতো না আলো এখানে পরায়। তাহলে সে আসতো না কখনোই। তার ফোনের রিংটোন বেজে যাচ্ছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইশিতা উদাসী গলায় বলে,"ভাইয়া। তাড়াতাড়ি এসে নিয়ে যাও আমাকে। "
_আসছি।
শুকনো গলায় বলে সামিন ফোন কেটে দেয়। কোনো উপায় না দেখে আলোর দিকে এগিয়ে যায় সামিন।
কুকুরের ভ/য়ে দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো আলোর। ছুটতেও পারছিলো না সে। অসহায়ের মতো ডান দিকে তাকাতেই সে থ/মকে যায়। নেভি ব্লু রঙের শার্ট গায়ে, অগোছালো চেহারায়, ক্লান্ত ভঙ্গিতে সামিন তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আলো দাঁড়িয়ে থাকে সামিনের দিকে তাকিয়ে। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে বাবার মৃ/ত্যু/র পরে আর শেভ করেনি। ফরসা মুখে খোচা খোচা দাড়ি। বাহুবলীর মতো শরীরটাকে রো/গা লাগছে বেশ।
সামিন আলোর একেবারে কাছে গিয়ে নিচু স্বরে বলে,"আমার বাইক।"
আলো অবাক হয়ে বাইক টার দিকে তাকায়। সে এতক্ষন সামিনের বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিলো। মুখ ভর্তি সং/কোচ নিয়ে সে সরে দাঁড়ায়। সামিন বাইকে উঠতে যাবে তখন আলো নিচু স্বরে বলে ওঠে,"কুকুর গুলোকে তাড়িয়ে দিয়ে যান।"
সামিন দাঁড়িয়ে পরে। আলোর নিচু করে রাখা মুখটার দিকে একপলক তাকিয়ে নিচু হয়ে একটা ইটের টুকরো তুলে নিয়ে দূরে ছু/ড়ে মারে। কুকুর গুলো দৌড়ে সেদিকে যায়।
সামিন বলতে না চেয়েও বলে ওঠে,"আমার কাছে হেল্প চাইতে তোমার আত্মসম্মান অসম্মানিত হলো না?"
_আপনার যায়গায় একজন পথচারী হলেও আমি হেল্প চাইতাম।
নিচু গলায় বলে আলো। সামিন কিছু না বলে আবারও বাইকে উঠতে যাবে। তখন আলো বলে ওঠে,"আমার বাবা আবারও নির্বাচনে দাড়াবে।"
_ভালো।
একশব্দে জবাব দেয় সামিন। আলো বলতে থাকে,"এই বার সে জিতে দেখাবে নির্বাচনে। "
_আচ্ছা ঠিকাছে।
সামিনের ঠান্ডা জবাব কোনো এক অদ্ভুত কারনে আলো মেনে নিতে পারছে না। সে সামিনকে উ/ত্তে/জিত করতে বলে ওঠে,"আপনার দয়া ছাড়াও মাথা উঁচু করে বাচা যায়। সেটা এবার আমি দেখিয়ে দেবো।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে," আমি পদত্যাগ করেছি। তার জন্য আবার নির্বাচন হবে। এটাও কিন্তু একপ্রকার দয়া আলো। দয়াটুকু নিতে তোমার আত্মসম্মানে বাঁ/ধলো না!"
আলো শীতল চোখে সামিনের দিকে তাকায়। তারপর ক্ষে/পে গিয়ে বলে,"না। কারন আপনি গতবার অ/বৈধ ভাবে ভোটে জিতেছেন। আপনার পদত্যাগ করা উচিত। এটা দয়া নয়।"
সামিন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। সে হাসি আলোকে পী/ড়া দেয়। সে দাঁত খি/চিয়ে বলে,"খুব আত্মবিশ্বাস আপনার নিজের প্রতি তাই না? খুব আত্মবিশ্বাস? তাহলে একটা বা/জি ধরবেন আমার সাথে?"
_কি বা/জি?
_আপনি আবার ভোটে দাঁড়াবেন।
সামিন আলোর দিকে সরু চোখে তাকায়। তারপর বলে,"আমার যদি ভোটে দাঁড়ানোর থাকতো তাহলে আমি পদত্যাগ করলাম কেন? "
আলোর মাথায় জে/দ চেপে গিয়েছে। গম্ভীর কন্ঠে বলে,"আপনার অহংকার আমি ভাঙতে চাই। আপনি পদত্যাগ করেছেন। এবং পুনরায় আপনি নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন। তবে এইবার কোনো দল থেকে টিকিট নিয়ে নয়। আমার বাবার মতো একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে। বলুন রাজী? আছে দম? অনেক তো দলের নাম ভা/ঙিয়ে খেলেন। এখন নিজের ক্ষমতা দেখান পারলে।
সামিন আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,"বাচ্চামো করো না। "
কথাটি বলে সামিন আবারো বাইকে উঠতে যাবে অমনি আলো বলে ওঠে," ঠিক জানতাম। আপনার ক্ষ/মতা আসলে ঐ দল। নিজের কিছু নেই। ভয় পাচ্ছে ইয়াসার মির্জা। "
সামিন দাঁড়িয়ে পরে। আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে," আচ্ছা ধরলাম বা/জি। তো মনে করো যদি তোমার বাবা জিতে যায় তাহলে কি হবে? "
_তাহলে আপনি আমার আব্বুর পায়ে নাক খ/ত দেবেন।
সামিন চুপ করে আলোকে দেখে। তারপর বলে,"তাই? আর যদি আমি জিতি? আমি যেটা বলবো সেটা শুনতে পারবে? "
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলে," দম তো তোমার নিজের নেই আলো। তাই আমার দম নিয়ে প্রশ্ন করো না। বাড়িতে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ঘুমাও। তোমার বাবার জন্য অগ্রীম শুভকামনা।"
আলো দাঁতে দাঁত চে/পে বলে ওঠে,"আমি রাজি।"
সামিন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, তারপর বলে, "তাই? ভেবে দেখো আলো। বেশি কনফিডেন্স ভালো না।"
_আমি রাজি। কি চান আপনি? আমাকেই তো চাইবেন তাই না? ঠিকাছে। আমি রাজি আপনার শর্তে। কারন আমি জানি আপনি জিততে পারবেনই না।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"এই আলো ভ/য় পাওয়ার মেয়ে না সামিন ইয়াসার। আমি রাজি। বাবা জিতলে আপনি আমাদের কথা শুনবেন আর আপনি জিতলে আমি আপনার কথা শুনবো। চ্যা/লে/ঞ্জ এ্যাক্সেপ্টেড।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে," নিজের কথায় নিজে জরিয়ে যাবে আলো, পরে আমাকে দো/ষ দিও না।"
আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট করে চলে যায়।
আলো হাত মুষ্টি/বদ্ধ করে রেখেছে। গা এখনো জে/দে কাঁ/পছে। যা হয় হোক। ঐ লোকটাকে ওর ক্ষমতা দেখিয়ে ছাড়বে আলো। ওর দলের জন্য লোকজন ওকে ভোট দেয় এটা হা/ড়ে হা/ড়ে টের পাবে এইবার নির্বাচনে হেরে ঐ সামিন ইয়াসার মির্জা।
***
কোচিং সেন্টারের হেডম্যাম রিকশা থামিয়ে আলোর সামনে দাঁড়ায়। অ/প/রাধী গলায় বলে,"সরি এক ঘন্টা দাড় করিয়ে রাখলাম তোমায়। সরি আলো।"
আলো ম্যামের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলে," আপনার কি হয়েছে? আপনি এভাবে কাঁপ/ছেন কেন?"
_আর বলো না, গলির ওই মাথায় মেইনরোডে এক ভয়াবহ এ/ক্সি/ডে/ন্ট হয়েছে। একটা নীল রঙের আর ওয়ান ফাইভ কে একটা বালুভর্তি ট্রাক রাস্তায় পি/ষে দিয়ে গিয়েছে। লোকটার মাথা থেঁতলে গিয়েছে। আমি দূর থেকে দেখেছি লোকের ভীর। র/ক্তের ব/ন্যা বয়ে গিয়েছে। সদর হস/পিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। লোকটা মনে হয় না বাঁ/চবে আলো।
একনাগাড়ে বলে ওঠে হেড ম্যাম। আলো কেঁ/পে ওঠে। নীল রঙের আর ওয়ান ফাইভে তো সামিন গিয়েছে এই মাত্র। আলো এদিক ওদিক তাকিয়ে বড় বড় নি/শ্বাস নিতে থাকে। হেড ম্যাম বলে ওঠে,"তোমার কি হয়েছে আবার আলো? "
আলো একটা ঢোক গিলে নিয়ে বলে,"ম্যাম আজকে আমাকে ছুটি দিন। সরি।"
আলো কথাটি বলে মেইন রোডে নামে। একটা রিকশা থামিয়ে উঠে পরে বলে,"সদর হস/পিটাল চলুন।"
আলো বুঝতে পারছে না তার এতো অ/স্থির লাগছে কেনো। ফোনে বারবার ইশিতাকে ফোন দিচ্ছে আলো। ইশিতা ফোনটা ধরছে না ।
আলোর অ/স্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। হসপিটালের সামনে রিকশা থামিয়ে কোনোমতে ভাড়া মিটিয়ে সোজা ইমা/র্জেন্সি ইউনিটে চলে যায় আলো। প্রচুর লোকজন সেখানে। সরাসরি ইউনিটে ঢুকতেই একজন নার্স এসে তাকে থামায়,"আরে আরে। কোথায় যাচ্ছেন?"
আলো এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁ/পাতে হাঁ/পাতে বলে,"এই মাত্র ঝিলবাড়ির এ/ক্সি/ডেন্ট স্পট থেকে একজনকে নিয়ে আসা হয়েছে। "
_আর ওয়ান ফাইভের আরোহী? অবস্থা খুবই খা/রাপ তার।
আলো আ/তংকিত মুখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে নার্সের দিকে। নার্স বলে,"বাঁ/চবে কি না বলা যাচ্ছে না। "
আলো কেঁ/পে ওঠে। নার্স আলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে,"তার পরিবার থেকে এখনো কেউ আসেনি। আপনি কে? ভি/ক্টিম কি হয় আপনার?"
আলো বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে নার্সের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"স্বামী।"
নার্সটি আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক মূহুর্ত পরে বলে ওঠে,"আপনি ভি/ক/টি/মের ওয়াইফ?"
আলো চ/ম/কে ওঠে! অবচেতন মনে এইমাত্র সে সামিনকে নিজের স্বামী বললো?
তার পুরো মুখ অ/স্ব/স্তি/তে ছেয়ে যায়। পেছন থেকে হঠাৎ একজন ডাক্তার বলে ওঠে," কী হয়েছে লিপি?"
_স্যার এ/ক্সি/ডে/ন্টের ভি/ক/টি/মের ওয়াইফ বলছে।
ডাক্তার মুখের মাস্ক খুলে বলে আলোর দিকে তাকায়। আলো কাঁ/পা কাঁ/পা গলায় বলে,"ওনার এখন কি অবস্থা?"
ডাক্তার কিছু বলতে যাবে তখন একজন ওয়ার্ডবয় এসে বললো,"স্যার সুমন বলে লোকটার ওয়াইফ এসেছে।"
ডাক্তার ওয়ার্ডবয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"সুমন কে?"
_স্যার ঝিলবাড়ি এ/ক্সি/ডে/ন্টের ভিকটিম। মানিব্যাগে আইডি কার্ড ছিলো। কিছুক্ষণ আগে যাকে আনা হলো।
ডাক্তার মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে," আপনি কে তবে?"
আলো এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা ঢোক গি/লে নিয়ে বলে,"ভুল হয়ে গিয়েছে। দুঃখিত।"
কথাটি বলে ঘুরে করিডোরের উল্টো পথে হাঁটতে থাকে আলো। ক্লা/ন্ত ভঙ্গিতে অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটছে। হুট করে এক মহিলার সাথে ধা/ক্কা খে/য়ে নিচে পরে যায় আলো। মহিলা চেঁচিয়ে ওঠে,"কানা নাকি? চোখ কোথায় নিয়ে হাটো?"
আলো কোনো জবাব না দিয়ে আবারো উঠে হাঁটতে থাকে। তার নিজের প্রতি নিজেরই বেশ অবাক লাগছে । হচ্ছেটা কি আসলে! ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দ হতেই ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে ইশিতা শুকনো গলায় বলে,"ফোন দিয়েছিলে ভাবী? ভাইয়ার সাথে বাইকে ছিলাম। দেখতে পাইনি।"
_হ্যা, ওই আর কি তোমার শরীরের খোজ নিতে। কেমন আছো তুমি? রিতু কেমন আছে?
_ভালো আছি আমরা।
ইশিতার কথা শুনে আলোর বেশ খারাপ লাগে। অনেক ভেঙে পরেছে মেয়েটা। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কেটে দেয়। ইশিতার একটা ব্যাপার আলোর বেশ ভালো লাগে। তারা যখন কথা বলে তখন ইশিতা কখনোই সামিনের প্রসঙ্গ টে/নে আনে না।
***
"মানে? নিজে পদ/ত্যাগ করলে। এখন যখন পুনঃনির্বাচন হবে এখন আবার ভোটে দাঁড়াবে? স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে? কেন? দল তোমার কি ক্ষতি করেছে সামিন? ইমতিয়াজ ভাইয়ের মৃ/ত্যু/র শো/ক কাটিয়ে উঠতে পারোনি জানি, তাই বলে এমন উ/ন্মাদের মতো কেন আচরণ করছো? "
কবির আলমগীর ধ/ম/কের সুরে বলে কথা গুলো। সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"একজনের আবদার পূরণ করতে।"
"হোয়াট! তুমি এসব কি বলছো? তোমাকে কি পাবনা শিফট করতে হবে? রাজনীতি ছেলে খে/লা? এমনিতেই তোমার হঠাৎ পদ/ত্যাগে পার্টি গ/রম হয়ে আছে। সবাই আমাকে চা/প দিচ্ছে তোমাকে বের করে দিতে। আমি সবাইকে মানিয়ে যাচ্ছি। তুমি আর আমাকে
ভু/গিও না সামিন। পদ/ত্যাগ পত্র ফেরত নাও। এখনো সময় আছে। "
_না আংকেল। আপনি খন্দকারকে দিয়ে দিন নমিনেশন। আমি স্বতন্ত্র লড়তে চাই।
কবির আলমগীর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"লাভ কি হবে ? দল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কি করতে পারবে তুমি? পদ/ত্যাগ যখন করেই ফেলেছো আর ল/ড়ো না। এইবার আতাউর আলম, শমশের ভুঁইয়া, খন্দকার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিপন মজুমদার। এদের সাথে টেক্কা দিয়ে গো হারা হারবে তুমি। তামাশা কেনো চাইছো? "
_হা/রতেই চাচ্ছি আংকেল।
_কেন?
_একজনের মুখে হাসি ফোটাতে। সে অনেকদিন হয় হাসে না।
_সামিন... তোমার আন্টি তোমার জন্য টেনশন করছে।
_আসবো, আন্টিকে দেখা দিয়ে যাবো ভোটের আগে। রাখছি।
ফোন কেটে দিয়ে সামিন দীর্ঘসময় চুপ করে বসে থাকে। ইশমাম অনবরত ফোন দিয়ে যাচ্ছে। এখন একটুও ইচ্ছে করছে না তার কথা বলতে। ফোনটা দূরে সরিয়ে রেখে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পরে।
***
"মানে? ইয়াসার আবার কেন ভোটে লড়বে? ও তো নিজেই পদত্যাগ করেছে।"
আলো শাড়িগুলো ভাজ করে আলমারিতে তুলে রেখে আতাউর আলমের দিকে তাকায়। তারপর বলে," যোগ্যতা প্রমাণ করতে। তুমি বাচ্চাদের মতো কিছুক্ষণ পর পর আমাকে প্রশ্ন করবে না। যাও।"
আতাউর আলম মেয়ের ঘরে ঢোকে। নরম গলায় বলে," মা। তুই ঠিক আছিস তো? এমন কেনো করছিস? ও তো ওর ভুলটা স্বীকার করেছে। এখন এসব বাদ দে। "
আলো বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে যায়। রেহেনা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। বিড়বিড় করে বলে, "এই মেয়ে দেখবে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবে একদিন। মেয়ে মানুষের এতো জে/দ ভালো? যথেষ্ট কি হয়নি? রা/গ তো আমাদের ও ছিলো। ও এখন ওর বাবা মায়ের থেকেও বেশি বুঝতে শুরু করেছে। ফল ভালো হবে না,দেখো।"
আলোর নাম্বার থেকে ফোন দেখে সামিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনের দিকে। তারপর ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই আলো বলে ওঠে,"রুলস নাম্বার এক...."
সামিন আলোকে থামিয়ে দিয়ে বলে,"রুলস নাম্বার এক, আমি কোনো ক্যাম্পেইন করিনি আলো। কারো কাছে যাইনি। কাউকে টাকা দেইনি। প্রচারনার জন্য শুধু পোস্টার লাগানো হয়েছে।"
আলো চুপ করে থাকে, সামিন বলতে থাকে,"রুলস নাম্বার দুই। আমার দলের ছেলেরা আমাকে কোন সাহায্য করছে না। এবং,
রুলস নাম্বার তিন, আমি আগামী পরশু পর্যন্ত বাড়ি থেকে বের হচ্ছি না।"
আলো এখনো নিশ্চুপ। সামিন বলতে থাকে,"সবকিছু মনে আছে আমার আলো। তুমি নিশ্চিন্তে তোমার কাজ করো।"
কথাটা বলে সামিন ফোন কেটে দেয়। স্ক্রিনে আলোর ছবিটার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"কি অবুঝ তুমি আছিয়া। "
সামিনের দলের ছেলেরা সবাই কপাল কুঁ/চ/কে আছে। সামিন ম্লান হেসে বলে, " তোদের একটা সুখবর দিই। আমি দ্বিতীয় বিবাহ করতে যাচ্ছি। তোরা আমার জন্য মেয়ে দেখবি। "
দলের সবাই সামিনের এমন র/সিকতায় সাড়া দেয় না। রাহাত
বি/রক্ত ভঙ্গিতে বলে, " ভাই। সবকিছুর কিন্তু একটা লিমিট থাকে!"
সামিন শুকনো হাসি হেসে বলে,"তোরা তোদের ভাবীর উপর শুধু শুধু রা/গ করছিস। ও ওর যায়গায় ঠিক।"
_হ্যা। সে তার যায়গায় ঠিক, আপনিও আপনার যায়গায় ঠিক। এখন আমরাও আমাদের যায়গায় ঠিক থাকবো। জিন্দেগীতেও ওই মেয়েকে আমরা আপনার জীবনে আসতে দেবো না ভাই। ঐ মেয়ে আপনার মতো কাউকে ডিজার্ভই করে না। ওর জন্য হিট/লার বেস্ট।
আরাফ চেঁচিয়ে বলে ওঠে। সামিন তার দিকে তাকিয়ে বলে,"শান্ত হ। তো বিপি হাই হচ্ছে। ওই মেয়ে আমার জীবনে আসবেও না। আমি নির্বাচনে হারবো। তোরা চা/প নিস না।"
জামিল অসহায়ের মতো একবার সামিন, একবার দলের ছেলেদের দিকে তাকায়। সামিন জামিলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে," তোকে কাজ দিতাম না। কিন্তু তোর ভাবীর দেওয়া রুলস মোতাবেক আমার দলের ছেলেরা আমার কোনো সাহায্য করতে পারবে না। তাই তোকে বলা, থানারোডের এ/তি/ম/খা/নায় চারটা খাসি পাঠানোর ব্যাবস্থা কর। আজ মাসুদের জন্মদিন। ওকে প্রমিজ করা, বিরিয়ানি খাওয়াবো । "
***
"আংকেল আমি ফুয়াদ। আপনি হয়তোবা চেনেন।"
আতাউর আলম ফুয়াদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ায়। ফুয়াদ বলতে থাকে," আলোর সাথে আমার একটু দরকার ছিলো। কাইন্ডলি একটু ডেকে দেবেন?"
আতাউর আলম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অস্ফুট স্বরে বলে,"বসো তুমি। দিচ্ছি।"
পর্দা সরিয়ে বসার ঘরে ঢুকে আলো অবাক হয়ে যায়। ফুয়াদ উঠিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, "তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি আলো।"
***
"তুই চিন্তা করিস না ছোট। কিছু হয়নি। কাল সব ঠিক হয়ে যাবে। "
ইশমাম কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, " তুমি অবুঝ শিশুদের মতো করছো ভাইয়া। "
_জানি না কিসের মতো করছি তবে করা উচিত নয়কি? ও স্বস্তি পাচ্ছে।
ইশমাম ক্ষে/পে যায়। চেঁচিয়ে বলে ওঠে, "ভাইয়া তুমি ভুলে যেও না আমরাও তোমার লাইফে আছি। আমাদেরও ইম্পর্ট্যান্স দাও। তুমি ছাড়া কেউ নেই আমাদের।"
সামিন ম্লান হেসে বলে,"আগামীকালের পর থেকে সবটা নিজের হাতে শে/ষ করবো। তুই টেনশন করিস না।"
***
"আত্মগড়িমা আর আত্মসম্মান দুটোই আলাদা জিনিস আলো। তুমি গুলিয়ে ফেলছো।"
_আপনি কি এসব বলার জন্য এসেছেন ফুয়াদ ভাই? চা খাবেন না? বন্ধুর শশুরবাড়িতে এসেছেন। আগামীকালের পর থেকে তো আর সেই অধিকারে আসতে পারবেন না।
ফুয়াদ আলোর সেকথার জবাব না দিয়ে বলে," সামিন তোমার জন্য উপযুক্ত কি না জানি না, কিন্তু তুমি সামিনের জন্য উপযুক্ত নও আলো, এইমাত্র বুঝতে পারলাম। সামিনকে প্র/তি/হিংসা পরায়ণ বলো না? আসল প্র/তি/হিংসা পরায়ণ তুমি। সামিনের চরিত্রে কিছু ত্রু/টি ছিলো, ও শুধরে নিয়েছে সেসব। কিন্তু তোমার চরিত্রে যেসব ত্রু/টি রয়েছে আলো, তুমি শোধরাতে পারবে না। কারন নিজের ত্রুটি বুজতে পারার মতো বোধশক্তি তোমাকে আল্লাহ দেয়ইনি। নিজের প্র/তি/শোধের ষোলো আনাই উশুল করে ছারলে আমার বন্ধুর থেকে। তাতেও তোমার মন ভরলো না, ওকে কথার মা/র/প্যাঁ/চে ফেলে ভো/গাচ্ছো এখন। তিনদিন হলো নিজেকে বাড়িতে ব/ন্দি করে রেখেছে শুধু তোমার ফা/ল/তু আবদার রাখতে।"
আলো চুপচাপ ফুয়াদের কথা শোনে। ফুয়াদের কথার জবাব সে দেয় না। ফুয়াদ বলতে থাকে," এনি ওয়ে, যা যা চাইছো সব হবে। আমিও তৈরি। যেমন দাঁড়িয়ে থেকে তোমাদের বিয়েটা দিয়েছিলাম। তেমন দাঁড়িয়ে থেকে ডি/ভো/র্স করিয়ে দেবো। আমার বন্ধুর জন্য একটা খা/রা/প মেয়ে এনে দেবো। তোমার মতো ভালো মেয়ের প্রয়োজন নেই আমার বন্ধুর লাইফে।"
কথাটা বলে ফুয়াদ উঠে চলে যায়। আলো চুপচাপ বসেই থাকে।
***
পদ/ত্যাগ করে সামিনের পুনরায় ভোটে দাঁড়ানোর থেকেও গোটা শহরের কাছে সবথেকে চাঞ্চল্যকর বিষয় হচ্ছে জামাই শশুর উভয় উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী। এমন ঘটনা বিরল। সবাই কৌতুহলী পুরো ব্যাপারটায়।
ভোটের দিন সকাল থেকেই শহরে টান টান উ/ত্তে/জনা বিরাজ করছে।
মার্কেটের বিভিন্ন স্থানে ছয় প্রার্থীর পোস্টার লাগানো।
আতাউর আলম ভোটকেন্দ্র থেকে ফিরেই অ/সু/স্থ হয়ে পরেছে কিছুটা। অপা/রেশনের পরে এতোটা চাপ এই প্রথম নিয়ে ফেলেছে। তাই অস্থির লাগছে বেশ। আলো আতাউর আলমের সাথে গিয়ে ভোট দিয়ে এইমাত্র ফিরলো। তার মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। চুপচাপ অপেক্ষা করে আছে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার, অপেক্ষা করছে ফলাফলের।
"আব্বা ইয়াসার মনে হয় আমাদের সাথে কানামাছি খেলা খেলছে। নিজে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে আবার নিজেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ল/ড়/ছে। ও কি পাগল হয়ে গিয়েছে আব্বা?"
সৈকত কথাটি বলে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। শমশের ভুঁইয়া বলে," বুঝতে পারছি না। তবে এইবার ওর জেতার চান্স নেই সেটা লিখে নে। মানুষ নিজের পায়ে নিজে কু/ড়া/ল বসায়। এই পা/গল তো বুল/ডোজার বসিয়ে দিলো। "
সাগর বলে ওঠে," সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারছি না। ওর কনফিডেন্স দেখ। দল ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়ছে।"
শমশের ভুঁইয়া অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে,"চিন্তা করিস না। এইবার আমরাই জিতবো।"
বরাবরের মতো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে জানিয়েছে জনগণ। লোকাল সাংবাদিকেরা তার উপরে একটি ডকুমেন্টরি তৈরি করে লোকাল নিউজ চ্যানেল গুলোতে দেখাচ্ছে।
শান্তিনীড়ের নিচতলার লিভিং রুমের মেঝেতে সবাই আসন পেতে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পর ফলাফল প্রকাশ হবে। সবার মধ্যে টান টান উ/ত্তে/জ/না। সামিন ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে চুপচাপ, যেন ফলাফল নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। সে আগেই জানতো ফলাফল কি হবে।
টিভিতে কিছুক্ষণ পর ফলাফলের চার্ট প্রকাশ করা হয়। নব্বই হাজার ভোট পেয়ে সামিন প্রথম বারের মতো কোনো দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই দ্বিতীয় বারের মতো প্রথম স্থানে রয়েছে। এরপর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থী ইউনুস খন্দকার, সে পেয়েছে পঞ্চাশ হাজার ভোট, এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে আতাউর আলম, পেয়েছে আটচল্লিশ হাজার ভোট। চতুর্থ স্থানে শমশের ভুঁইয়া ছত্রিশ হাজার এবং পঞ্চম স্থানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিপন মজুমদার পয়ত্রিশ হাজার ভোট পেয়েছে।
লিভিং রুমে থাকা ছেলেরা কিছুক্ষণ নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বিকট চিৎকার দিয়ে ওঠে। সামিন টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। সংবাদ পাঠকের মুখ থেকে আবারো তার জয়ের খবর শুনছে সে। নিজের জয়ে নিজেই কিছুটা অবাক সামিন। কিন্তু যেখানে তার খুশি হবার কথা সেখানে সে খুশি হতে পারছে না। কোনো এক অজানা উৎ/কণ্ঠা ভীর করেছে তার মনে। ওদিকে আলো কি করছে? মেনে নিতে পেরেছে তো এই হার? যে ভ/য়ং/কর সেন/সিটিভ একটা মেয়ে কিছু উল্টো পাল্টা করে না বসে আবার।
সবুজ সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে," যান ভাই। এখন আবার ভাবীকে তুলে আনেন। খুব বা/জি ধরেছিলো , এখন বুঝুক। "
সামিন কিছুক্ষণ সবুজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। দলের ছেলেরাও সামিনের সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়।
সামিন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে," তোরা কোথায় যাচ্ছিস? "
_আপনার সাথে ভাই।
_প্রয়োজন নেই। আমি একা যাবো।
***
টিভির স্ক্রিনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আলো। আতাউর আলম স্বাভাবিক। সবসময় ঠান্ডা মাথার লোক সে। এমন পরিস্থিতির জন্য সে মানসিকভাবে তৈরিই ছিলো যখন শুনেছে ইয়াসার আবারো ভোটে দাঁড়াবে। একজন জিতে যাওয়া লোক পুনরায় জিতবে এটাই তো স্বাভাবিক। মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে দাঁড়িয়েছিল ইলেকশনে। তাই তার কোনো ভাবান্তর হয়নি। এই পরিস্থিতিতে নিজের অসম্মান নয় বরং আলোর কথা ভাবছে সে। তার মেয়েকে সে চেনে। এতো কিছু সহজে গ্রহণ করার মেয়ে আলো নয়।
কিন্তু আলো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কিছুক্ষণ টিভির দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়। আতাউর আলমের ওষুধ এনে দেয় তাকে। আতাউর আলম ওষুধ নিয়ে মৃদু স্বরে বলে," নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে মা। আমার কোনো আক্ষেপ নেই। মাথা ঠান্ডা কর। "
আলো বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে," মাথা
গ/র/ম হয়নি আমার আব্বু। "
তারপর ধীরপায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
কলিং বেলের শব্দ হয়। রেহেনা গিয়ে দরজা খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,"আসতে পারি?"
রেহেনা এদিক ওদিক তাকিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। দ্রুতপায়ে হেটে সামিন আলোর ঘরের দিকে যায়। আলোর ঘরের দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সামিন উচ্চশব্দে চেঁচিয়ে ওঠে,"আলো দরজা খুলে দাও।"
কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে সামিন দরজায় ধাক্কা দিতে যাবে অমনি খট করে দরজা খোলার আওয়াজ হয়।
সামিন আলোকে কয়েক পলক দেখে ঘরে ঢুকে দরজার সিটকিনি তুলে দেয়।
আলো নি/স্তেজ কন্ঠে বলে,"অভিনন্দন!"
সামিন ঘুরে আলোর দিকে তাকায়।
আলো একটু থেমে আবারও বলে,"অভিনন্দন আপনাকে জেতার জন্য, ইলেকশন এবং বা/জি দুটোই।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো নিচু স্বরে বলতে থাকে,"বসার ঘরে গিয়ে বসুন। ব্যাগ গোছানো হয়ে গিয়েছে। আমি শাড়িটা পাল্টে আসছি।"
_কোথায় যাবে তুমি?
আলো মাথা তুলে সামিনের দিকে তাকায়। তারপর বলে,"আপনার সাথে। সংসার করতে। বা/জিতে জিতেছেন আপনি।"
সামিন ম্লান হাসে। তারপর নিচু স্বরে বলে,"কোথাও যেতে হবে না তোমাকে আলো। "
আলো সামিনের দিকে দীর্ঘক্ষণ উদাস দুটি চোখ নিয়ে তাকিয়ে থেকে তে/জী কন্ঠে বলে ওঠে," আপনার দয়া দেখাতে হবে না। আমি ভীতু মেয়ে নই , আমি যাবো, আমি আমার কথা রাখবো। করবো আমি সংসার আপনার সাথে। "
কথাটি বলে আলো আলমারির কাছটায় যেতে নেয়, মুহুর্তেই হাতে সামিনের হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুরে তাকায়। ততক্ষণে সামিন আলোকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছে। আলো সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন ম্লান হেসে আলোর কপাল থেকে অগোছালো চুল কানে গুজে দিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
"অবুঝ আছিয়া। আমার ভালোবাসাকে বরাবরের মতো ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছো তুমি। দয়া আমি তোমাকে করিনি। কখনোই করিনি। এটাও দয়া না। যেটুকু আমি তোমাকে দিলাম তার নাম ভালোবাসা। "
আলো চুপ করে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে, "তোমাকে কখন ভালোবেসে ফেলেছি তা আমি জানি না। কিন্তু যখন তুমি সা/পের ভ/য়ে আমাকে এসে আ/ক/রে ধরলে। তখন থেকে বুঝতে পেরেছি আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তখন থেকে প্রতিটা মূহুর্ত আমি যা তোমাকে দিয়েছি সেটা আমার ভালোবাসা। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড উলটে গেলেও ঐ অনুভূতি ভালোবাসাই থাকবে, তুমি যতই ভুল ব্যাখ্যা দাও না কেন। তোমার মতো ক্ষুদ্র আছিয়ার অপব্যাখ্যায় আমার ভালোবাসা বদলে যাবে না।"
আলো নিশ্চুপ। সামিন বলতে থাকে, " তুমি আমার না পাওয়া একটা প্রশান্তি। তোমায় আমি আমার মনে আটকে রাখবো, কাগজে কলমে না পারি। যা যা আবদার করেছো, পূরন করেছি। বা/জিতে জিতেছি। শর্ত হিসেবে তুমি আমার কথা শুনবে। আর আমার কথা হচ্ছে, তুমি ভালো থাকো। তোমাকে ভালোবাসার উপহার স্বরূপ দু এক দিনে ডি/ভো/র্স লেটার সাইন করে পাঠিয়ে দেবো। সাইন করে বাঁধিয়ে ঐ দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখবে। আমি চাই তুমি আমার ভালোবাসা প্রতিদিন দেখো। "
আলো কিছু বলতে যাবে, সামিন আলোর মুখ চেপে ধরে, তারপর বলে,"চুপ। আমি এতো এতো তোমার হৃদয় প্রশান্ত করা কথা বলে যাচ্ছি। তোমার কান কি শান্তি পাচ্ছে না? বলো? কেন এখন আমাকে য/ন্ত্র/না দিতে কথা বলতে চাইছো। কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি তোমার থেকে, আমি পারবো না, আমার ক্ষমতা নেই। উল্টোপাল্টা কথা বলে আর আমাকে য/ন্ত্র/না দিও না আছিয়া।"
কয়েক মূহুর্ত পরে আলোর মুখ থেকে সামিন হাত সরিয়ে নিয়ে আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর আলোর গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে তার কপালে লম্বা সময় ধরে একটা চু/মু খায়। আলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
সামিন আবারো আলোর চোখে চোখ রেখে মৃদু স্বরে বলতে থাকে, " সব কিছু অনেক বেশি সুন্দর হতে পারতো আছিয়া, অনেক বেশি রঙিন। কিন্তু তুমি ব/র্ণা/ন্ধ। রঙের গুরুত্ব তুমি বুঝতেই চাচ্ছো না। তোমার নারী স্বত্তার অনূভুতিকে সম্মান জানাতে আমি আমার জীবনের সবথেকে বড় ত্যা/গ স্বীকার করলাম। নয়তো সামিনের জিনিস সামিন ইহ/জনমে ছাড়ে না। "
কথাটা বলে সামিন আলোকে ছেড়ে দেয়। আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সামিনের দিকে তাকিয়ে। সামিন আলোর ঘরের দরজা খুলে চলে যায়। দীর্ঘসময় আলো নিজের স্থানে দাঁড়িয়ে থেকে বিছানায় ধপ করে বসে পরে।
" আপনার স্ত্রীকে আপনি ডি/ভো/র্স দেবেন? "
কাজী সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে । সামিন একটা চেয়ার টে/নে বসে গম্ভীর কন্ঠে বলে, " প্রথমত আমাকে "আপনি" করে বলবেন না। আমি আপনার ছেলের বয়সী। "
কাজী বিনয়ী হয়ে বলে," তুমি কেন ওকে তা/লা/ক দিতে চাচ্ছো? "
_জরুরি তা/লা/ক দেওয়া টা। আপনি কাগজ পত্র রে/ডি করবেন। কত সময় লাগবে? বেশি দেরী হবে?
কাজীর হতভম্ব ভাব কাটছে না। সে বলে, কিছুক্ষণ আগে তুমি পুনরায় মেয়র নির্বা/চিত হলে। আর তুমি এখন এসেছো বৌকে
তা/লা/ক দিতে? কেনো? কি করেছে তোমার বৌ?
_ও কিছু করেনি। আমি করেছি।
_কি করেছো?
_ওকে বিয়ে করেছি।
কাজী সামিনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। সেই সামিন আর এই সামিনের মধ্যে বি/স্তর ফারাক। এই সামিন ইয়াসারের চোখে সেদিন হিং/স্র/তা দেখেছিলো। আজ দেখছে উদাসীন দুটি চোখ।
সামিন বলে ওঠে, " বেশি দেরী হবে আংকেল? "
কাজী মাথা নাড়িয়ে বলে,"দু দিন লাগবে। "
সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর কাজীর টেবিলের ওপরে একটা ঢেকে রাখা পানির গ্লাসে চোখ যায় তার। কাজীর দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলে,"পানি টা কি ভালো? আমি খেতে পারি?"
কাজী মাথা নাড়িয়ে গ্লাসটা সামিনের দিকে এগিয়ে দেয়। সামিন ঢকঢক করে গ্লাসটা খালি করে উঠে দাঁড়ায়। কাজীর দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ কন্ঠে বলে,
"কাগজ পত্র রেডি রাখবেন। চেয়েছিলাম মিউ/চুয়াল ডি/ভো/র্স দিতে। কিন্তু অত সময় অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে না। ওর কষ্ট হবে।"
কথাটা বলে সামিন ধীরপায়ে হেঁটে কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে আসে । কাজী ফ্যাল/ফ্যাল করে সামিন ইয়াসারের যাওয়া দেখে।
বসার ঘরে রিতু সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে ছিলো। সামিনকে দেখে তড়ি/ঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে তার কাছে আসে। সামিনের দৃষ্টি দেখে সে থ/ম/কে যায়। উৎ/কণ্ঠা নিয়ে বলে,"কি হয়েছে ভাইয়া? শরীর খা/রা/প আপনার? চোখ এমন লাগছে কেনো?"
_কেমন লাগছে?
_সারাদিনে কিচ্ছু খাননি। আমি আপনার জন্য বসে আছি। আসুন খাবেন।
সামিন ম্লান হেসে রিতুর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বলে,"খেয়ে নাও তুমি। চুনু কাকার দোকান থেকে একটা ভেজি/টেবল রো/ল খেয়েছি আমি।"
রিতু থম/থমে মুখ নিয়ে সামিনের যাওয়া দেখে। ঐ শুভ্র পাঞ্জাবি গায়ে, ব/লি/ষ্ঠ শরীরের মানুষটার জন্য তার ভীষণ ক/ষ্ট হচ্ছে। ভীষণ।
***
উত্তপ্ত দুপুর। গরমে ঘে/মে নেয়ে একাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওড়না দিয়ে মুখ মুছে এদিকে ওদিকে তাকায় আলো। হিয়া বলে,"চল রিকশার জন্য দাড়িয়ে থেকে লাভ নেই। আজ বো/র্ড পরিক্ষা,সবাই হাই স্কুলের সামনে গিয়ে বসে আছে বোধহয়। মাত্র পনেরো মিনিটের রাস্তা। চল হেঁটেই যাই।"
আলো ক্লান্ত চোখে হিয়ার দিকে তাকিয়ে নি/ষ্প্রা/ণ গলায় বলে,"চল।"
দু'জনে হাঁটতে থাকে। কিছু পথ যেতেই নীরবতা ভেঙে হিয়া বলে ওঠে,"শেষ পর্যন্ত তোর সিদ্ধান্তই থাকলো। কি বলিস।"
আলো চুপ করে থাকে। হিয়া বলে ওঠে,"মা সবসময় আমাকে বলতো, "একটু আলোর মতো হতে পারিস না?" । তখন আমিও ভাবতাম, ইশশশ আমি যদি তোর মতো হতে পারতাম। কিন্তু এখন আমি মোটেও তোর মতো হতে চাই না। ভ/য় হয় আমার তোকে দেখলে। "
আলো এখনো নিশ্চুপ। হিয়া আলোর নীরবতা দেখে তার দিকে তাকায়। কলেজের গেইটের ডানপাশে সৈকত নৌশিনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নৌশিন কোনো নড়া/চড়া করছে না কিন্তু তার চোখে মুখে ভ/য়ে/র ছা/প স্পষ্ট। আলো সেদিকে তাকিয়ে আছে। হিয়া পাশ থেকে বলে,"এই এই আলো? তুই কি এখন আবার ঝামেলা করবি? দেখ, ওরটা ও বুঝে নেবে । তখন এতো করে নি/ষে/ধ করলাম প্রেমের প্র/স্তা/ব গ্রহণ না করতে। শুনলো না। আমার আর ভালো লাগছে না তোকে ঝামেলায় পরতে দেখতে। চল গেইটের ভেতর চল।"
হিয়া আলোকে তাগাদা দেয়। সৈকতের সাথে দিঘির পাড়ের ঘটনার কথা মনে পরলেই তার পুরো শরীর এখনো অ/সা/ড় হয়ে যাচ্ছে। ঐদিন কেউ না পৌছালে তার অবস্থা খুব খা/রা/প হতে পারতো। সে ইহ/জনমে সৈকতের চোখের সামনে পরতে চায় না।
"কিরে বিয়ে ঠিক হয়েছে নাকি তোর? তা তোর হবু স্বামীকে বলে দেবো? আমি তোর কোথায় কোথায় ছু/য়ে/ছি? বলে দেবো তোর কোথায় কোথায় তিল আছে?"
জ/রানো কিন্তু তে/জী কন্ঠে নৌশিনের হাতের ক/ব্জি চে/পে ধরে সৈকত বলতে থাকে। নৌশিনের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরা দু ফোঁ/টা তরল দেখে বোঝার উপায় নেই সে ভেতরে ভেতরে গ/লা/কা/টা মুরগির মতো ত/র/পা/চ্ছে। আবেগের বশে একটা ভুলের জন্য তার জীবনের চরম প্রতিদান দিতে হচ্ছে, হবে। তার নি/স্তার নেই এই
জা/নো/য়া/র/টা/র থেকে। নৌশিন চেচাতেও পারছে না। ঝা/প/সা চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কানের কাছে সৈকতের বলা কথাটা প্রতি/ধ্বনিত হচ্ছে, "বলে দেবো নৌশিন? বলে দেবো?"
আলো হিয়ার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে সৈকতের দিকে এগিয়ে যায়। গিয়ে সৈকতের হাত থেকে নৌশিনের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নৌশিনকে আগলে নেয়। তারপর নৌশিনকে ধম/কের সুরে বলে,"চেঁ/চা/তে পারিস না স্টু/পিড?"
নৌশিন ভ/য়ে গুটিয়ে গিয়েছে। সৈকত একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"তুই আবার এসেছিস। তোর সমস্যা কি?"
_এখান থেকে যা।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো। সৈকত বলে ওঠে,"স্বামীর মতো বেশ সাহস না তোর? "
_আমি এক দুই তিন গুনবো। এখান থেকে যাবি সৈকত। নয়তো আজ ভ/য়া/ব/হ কিছু হবে।
_তাই নাকি? কি হবে? দেখা?
নৌশিন খ/প করে আলোর হাত ধরে বলে,"ও নে/শা করে আছে আলো।"
আলো নৌশিনের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সৈকতের দিকে কিছু মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে থেকে পায়ের জুতা খুলে মা/র/তে শুরু করে।
মুহুর্তেই ভীড় জমে যায় কলেজের সামনের রাস্তাটায়। কিছু ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েরাও এসে আলোর সাথে সমান তালে পে/টা/তে থাকে সৈকতকে।
নৌশিন একটু সাহস পায়। তীব্র ঘৃ/ণা নিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"পে/টা। আ/রো পেটা।"
সৈকতের কানে নৌশিনের সে চিৎ/কার পৌঁছায়। হিং/স্র হা/য়ে/না/র মতো নৌশিনের দিকে তাকিয়ে থাকে সৈকত। নৌশিনের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পরতে থাকে।
অবস্থা বেগতিক দেখে হিয়া এসে আলোকে পেছন থেকে জা/প/টে ধরে সরিয়ে নেয়। বেশ কিছু লোক এসে পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করে,তবে উচ্চ/বাচ্য বলে না সৈকতকে। সবাই খুব ভ/য় পায় নতুন এই ত্রা/স/কে। সৈকত গা ঝাড়া দিয়ে নৌশিনের দিকে তী/ক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে এক পলক তাকিয়ে থেকে বাইক স্টার্ট করে চলে যায়।
***
"ভাইজান!"
সামিন কিছু কাগজপত্র দেখছিলো। সিতারার ডাকে তার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,"হু।"
_ঘর গোছাতে এসেছিলাম।
_অগোছালো তো কিছু নেই আমার জীবন ছাড়া।
ঠান্ডা গলায় সামিন কথাটি বলে নিজেই বেশ অবাক হয়। এসব কি ধরনের কথা বলছে সে সিতারাকে!
সিতারা মৃদু স্বরে বলে,"ঝুল ঝা/ড়/তে পাঠিয়েছে মেজো ভাবী।"
"ঝা/ড় তাহলে।"
সামিন আবারো কাগজে মন দেয়। সিতারা ঘর গোছাতে গোছাতে সামিনের ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকটা সং/কোচ নিয়ে নিচু স্বরে বলে,"এগুলো এখান থেকে সরিয়ে ফেলবো ভাইজান?"
"কোনগুলো?"
সামিন না তাকিয়েই জিগ্যেস করে। সিতারা আগের থেকেও নিচু স্বরে বলে ওঠে,"বড় ভাবীর সাজার জিনিস।"
সামিন মাথা তুলে তাকায়। তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে এখনো আছিয়ার অব্যবহৃত প্রসা/ধনী অযত্নে পরে আছে। যা কখনো ঐ মেয়েটা ছুঁ/য়ে/ও দেখেনি।
সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"না। ওগুলো ওখানে থাকুক। দেখতে ভালো লাগছে।"
সিতারা আর কিছু বলে না। ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে চলে যায়। সামিন আবারো কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকায়। অপলক তাকিয়েই থাকে সেদিকে।
***
"কু/কু/র ভাগ্য" বলে যদি কিছু থাকে তাহলে আলোর ক্ষেত্রে শব্দটা প্রযোজ্য। তার কু/কু/রে ভীষণ ভ/য়। ক্লাস ফাইভে একবার
কা/ম/ড়ে আলোকে বে/হুঁ/শ বানিয়েছিলো তখন থেকে এই প্রানীটাকে জ/মের মতো ভ/য় পায় সে। কিন্তু রাস্তাঘাটে এই প্রানীটার সাথেই আলোর হুট হাট দেখা হয়ে যায়।
আলো একটা ঢোক গি/লে এদিক ওদিক তাকায়। কিছুক্ষণ আগে হিয়া সাথে ছিলো। তখন আসতে পারলো না অ/স/ভ্য গুলো। এখন আলোর সাথে কেউ নেই। আলোর বুকটা ধর/ফরিয়ে উঠছে। দুই পায়ের কু/কু/র গুলোকে তো জুতা/পে/টা করে সামলানো যায় , চার পায়ের কুকুর গুলোকে সে কিভাবে সামলাবে? মনে হচ্ছে এক্ষুনি কা/ম/ড়ে দেবে। ঝাঁ/পি/য়ে পরে ছিন্ন/ভিন্ন করে দেবে আলোকে। এক পা সামনে এগোতেই একটা কুকুর ঘেউ/ঘেউ করে ওঠে।
আ/তং/কে আলো জমে যায়। ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে আরো দুটো কু/কু/র এসে বাকি তিনটার সাথে যোগ দিয়েছে। সবকটা ঘেউ/ঘেউ করতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে এরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে কে আগে প্রথম কা/ম/ড় বসাবে। আলো এক লাফে পেছনে আগায়। আশে পাশে ত্রিসীমানায় কেউ নেই। সব লোক কোথায়! পাশের মসজিদে যোহরের আজান দিয়ে দিয়েছে। কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে সে ঘুরে দৌড়াতে শুরু করে এদিক ওদিক না তাকিয়ে। কু/কু/রে/র কামড় খেয়ে ম/র/তে সে ইচ্ছুক নয়। প্রান হাতে নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে হুট করে তার পায়ের সাথে একটা ভাঙ্গা ই/টের ধা/ক্কা লেগে যায়। ঘটনার আক/স্মিক/তায় আলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই নাকে তী/ব্র পি/চের গন্ধ অনুভব করে। রোদের তাপে রাস্তার পিচ গ/লে গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে। নাকের কাছে তী/ব্র য/ন্ত্র/না অনুভূত হয়। ধীরে ধীরে মাথা তুলে ওপরে তাকাতেই দেখে একটা ব/লি/ষ্ঠ হাত তার দিকে কেউ বাড়িয়ে ধরে রেখেছে। আলোর হাটুর কাছটায় য/ন্ত্র/না হচ্ছে। ছি/লে গেলে যেমন হয়। ধীরে ধীরে হাতের মালিককে দেখবে বলে সে মাথা তুলে তাকাতেই থ/ম/কে যায়।
অসহায়ের মত এদিক ওদিক তাকিয়ে কি মনে করে হু/ট করেই সামিনের হাতে হাত রাখে। সামিন গ/ম্ভী/র মুখে টেনে তোলে আলোকে। নাকে বা/রি খে/য়ে নাকের ডান পাশের ছিদ্র থেকে র/ক্ত ঝ/র/ছে। হাঁটুর কাছটা ছিলে গিয়েছে, নতুন চুড়িদার টা রক্ষা পায়নি। লজ্জায় আলো গুটিয়ে যায়। প্রকৃতি তাকে ক্ষণে ক্ষণে মুখ থু/ব/ড়ে পরার ব্যাবস্থা করে দিচ্ছে।
সামিন আলোর দিকে না তাকিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কু/কু/র গুলোর দিকে এগিয়ে যায় দুকদম। কু/কু/র গুলো উল্টোপথে দৌ/ড়ে যায়। আলো ব্যা/থা/তু/র শরীরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সামিন যেন আলোর মনের কথা বুঝে যায়।
নিচু স্বরে বলে ওঠে," ওরা আমার স্বজাতি তো। আমাকে খুব মানে। "
আলো মাথা তুলে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়। আলো চোখ নামিয়ে নেয়।
সামিন তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,"তোমাকে ফলো করছিলাম না। আমাকে অপ/বাদ দিও না। এখানে কাজ ছিলো।"
_কাজ? মহিলা কলেজের সামনে?
হুট করে আলো নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে বসে। সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,"না, মহিলা কলেজের পাশে। কাজী অফিসে। "
আলো পুনরায় মাথা তুলে তাকায়। কৌতুহলী হয়ে না চাইতেও বলে ওঠে,"কাজী অফিসে কী? বিয়ে করছেন নাকি!"
সামিন একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"আমাদের ডি/ভো/র্সের কাগজ পত্র গোছানো হয়েছে কিনা খোজ নিতে এসেছি। কাজীর নাতী হস/পি/টালে। আজ হবে না। তোমার দূ/র্ভা/গ্য।"
আলো সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোর দৃষ্টি উ/পে/ক্ষা করে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়।
হঠাৎ করে আলোর ভীষণ রা/গ হতে শুরু করে। এতটা আ/ঘা/ত পেয়েছে আলো, লোকটা ভদ্রতা করেও একবার জিজ্ঞেস করলো না আলোর ব্যা/থা করছে কিনা! আগে তো আলো না চাইতেও ব্যা/থা পেলে কোলে নিয়ে দৌড়া/দৌড়ি করতো! খুব রা/গ হচ্ছে। কেনো হচ্ছে তার উত্তর আলোর জানা নেই।
***
"পে/ই/ন কি/লা/র নিয়েছিস?"
রেহেনা এসে আলোর মাথার কাছে বসে। আলো চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"নিয়েছি। জ্ব/র আসছে সম্ভবত।"
রেহেনা কিছুক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে," একটাবার ভেবে দেখবি ম/না? শেষ বারের মতো?"
রেহেনা যখন আলোর কাছে বিশেষ কোনো আবদার করতে চায় তখন ম/না বলে সম্বোধন করে।
আলো নিশ্চুপ হয়ে থাকে। রেহেনা বলতে থাকে,"তুই রে/গে যাস না মা। অশিক্ষিত বাঙালি মায়ের মন তো, তাই মানছে না।"
কথাটা বলে রেহেনা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মো/ছে। তারপর বলে ওঠে,"কোনো মানুষ কি আবেগ,রা/গ,জে/দ, প্র/তি/হিং/সা প/রা/য়/ণ/তা, ভুলের উর্ধ্বে? তুই আমাকে দেখা এমন একটা মানুষ?"
আলো চুপ করে মায়ের কথা শুনতে থাকে। রেহেনা আলোর নি/র্জী/ব/তা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। দরজার বাইরে আতাউর আলম দাঁড়িয়ে ছিলো। রেহেনা নিজের স্বামীকে দেখে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়ায়। তারপর চলে যায়।
***
" আজকের ভেলিভারি দিয়ে আর কাজ নেই। আমি অ/র্ডা/র নেইনি। আমার সে/কে/ন্ড ইন/কো/র্স এ/ক্সা/ম কাল। আজ ইউ/নিভা/র্সিটি যাচ্ছি। তোমরাও চলে যাও। "
সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আলো নি/স্তেজ কন্ঠে বলে সবাইকে। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে হিয়া আলোকে ডাকতে থাকে,আলো ঘুরে তাকায়। হিয়া বলে,"আজ মশলা ভেলি/ভারি দেওয়ার ছিলো। তুই আচার দিয়েছিস কেনো? সব খেয়ে বসে আছিস?"
_তাই তো। ডেলিভারি বয় চলে গিয়েছে? দাড়া আমি চে/ঞ্জ করে দিচ্ছি।
_তুমি থাকো,আমরা যাচ্ছি। শরীর ভালো নেই তোমার।
বিউটি বলে ওঠে। সবাই কাজে ব্য/স্ত হয়ে পরে। হিয়া এগিয়ে আলোর সামনে এসে দাঁড়ায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আলোকে দেখে বলে ওঠে,"কি ব্যাপার বল তো। কি হয়েছে তোর?"
_কি হবে।
আমতা আমতা করে আলো। হিয়া বলে ওঠে,"দুদিন ধরে বেশ খেয়াল করছি অন্য/মনষ্ক থাকিস তুই। কেমন কেমন করে কথা বলিস। আংকেল হে/রে/ছে বলে?
আলো মাথা নাড়িয়ে বলে,"আব্বুর হার নিয়ে আমার আ/ক্ষে/প নেই। সে তো তৃতীয় হয়েছে।"
হিয়া অলস ভঙ্গিতে একটা চেয়ার দখল করে টেনে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,"তোকে একটা সি/ক্রে/ট বলি? আমি আতাউর আংকেলকে ভোট দিইনি। ইয়াসার ভাইয়াকে দিয়েছি।"
আলো হিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
হিয়া বলতে থাকে,"আ'ম প্রি/টি শিওর আমাদের ক্লাসের সব মেয়ে ইয়াসার ভাইয়াকে ভোট দিয়েছে। ইন/ফ্যা/ক্ট তরুণের দল ইয়াসার ভাইয়াকেই বেছে নিয়েছে। আর বাকিরা তো সব বুড়ো লোক।"
একটু থেমে হিয়া হাই তুলতে তুলতে বলে,"আমাদের ক্লাসের অধিকাংশ মেয়ের ক্রা/শ তোর স্বামী। তারা কি বলাবলি করে জানিস, বলে ইয়াসার ভাইয়া তাদের তুলে নিয়ে বিয়ে করলে তাদের জীবন ধ/ন্য হয়ে যেত।"
কথাটা বলে হিয়া উচ্চ/শব্দে হাসতে থাকে। তারপর বলে,"ইতিহাসে তোর কে/স টাই বোধ হয় প্রথম যেখানে ভি/ক/টি/মের প্রতি বিরক্তি এবং অপ/রাধীর প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছি আমরা।"
আলো হিয়ার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নিচু হয়ে আচারের বৈয়ম গুলো সরিয়ে রাখে। হিয়া বকবক করতে থাকে। একটু পরে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"চুপ করে আছিস কেনো?"
_কি বলবো?
_অন্যসময় হলে তো আমাকে কাঁ/চা খে/য়ে ফেলতি, আজ ইয়াসার ভাইয়ার নামে এতো এতো কথা বলছি আর তুই চুপচাপ শুনছিস? আমাকে ঝা/ড়ি মা/র/ছি/স না কেন? । ব্যাপার কি বলতো? প্রেমে টেমে পড়লি নাকি আমার দুলাভাইয়ের? দেখ প্রেমে পরলে আমাকে কানে কানে বলে দে সময় থাকতে......
"আপু তোমার জন্য নো/টিশ এসেছে।"
আলো চ/ম/কে উঠে দাঁড়ায় আয়াতের কথা শুনে। আয়াত দাঁড়িয়ে আছে। আলোর অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সে কাঁ/পা কাঁ/পা গলায় বলে,"কাজী অফিস থেকে?"
আয়াত অবাক হয়ে বলে,"কাজী অফিস থেকে নো/টিশ আসবে কেন? ব্যাং/ক থেকে এসেছে। তোমার ডি/পো /জি/টে/র ।"
আলো একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছা/ড়ে। হিয়া আলোর অ/স্বা/ভাবিক আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
***
"মা/স্ক পর। একটু ভুল হলে আজ গন/পি/টু/নি/তে ম/র/বি।"
ফিসফিসিয়ে রবিকে বলে সাদিক। রবি বিরক্ত ভঙ্গিতে মা/স্ক পরে নেয়। রোদের তাপে কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম বেয়ে নামছে। মে/জা/জ যথেষ্ট খা/রা/প। মুখে চ কা/রন্ত শব্দ করে বলে ওঠে,"কি বলতো, এতো দেরী করছে কেন? আসেনি নাকি?"
_না এসেছে, ভাই নিজে ইন/ফর/মে/শন দিয়েছে।
সাদিকের কথা শেষ হলে রবি এদিক ওদিক তাকায়। কলেজের গেইটের বাইরে এতো গুলো পাখির মধ্যে তাদের টা/র্গে/ট/কে খুজে বের করা ভীষণ ক/ষ্ট সাধ্য ব্যাপার। হাতের ছোটো বো/ত/লটার দিকে একপলক তাকিয়ে বো/ত/লটা আবারো আ/ড়াল করে ফেলে সে। তারপর মোবাইলে একটা হি/ন্দি গান ছেড়ে তী/ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গেইটের দিকে তাকিয়ে থাকে।
"এই এই। ম/র/তে চাস নাকি?"
আলোকে ধা/ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় নৌশিন। হু/স করে পাশ দিয়ে একটা মি/নি ট্রা/ক চলে যায় আলোর। বু/কে হাত দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে সে। নৌশিন আলোর হাত ধরে রেখেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে আলো নৌশিনের দিকে তাকিয়ে শু/ক/নো গলায় বলে,"থ্যাংকস।"
নৌশিন আলোর হাত ধরে বলে ,"কি হয়েছে তোর? পুরো ক্লাসে অন্য/ম/নস্ক ছিলি। একটু হলে আজ ট্রা /কে /র নিচে পরে ম/র/তি। সমস্যা কোথায়? "
আলো মাথা নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,"কিছু না।"
নৌশিন হুট করে আলোর কপালে হাত দিয়ে বলে,"গা গ/র/ম তোর। চল তোকে রিকশায় তুলে দেই মো/ড়ের মা/থা থেকে। চল!"
দু'জনে হাঁটতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে আলো বলে ওঠে,"সৈকত তোকে আর বি/র/ক্ত করেছিলো?"
নৌশিন বলে," না। আমিও অবাক হচ্ছি আলো। ও এত সহজে আমার পিছু ছে/ড়ে/ছে। খুবই অবাক হচ্ছি।"
_এসব কু/কু/র/কে এভাবেই সোজা করতে হয়।
শুকনো গলায় বলে ওঠে আলো।
সাদিক আর রবি তী/ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আলো আর নৌশিনের দিকে তাকিয়ে আছে। রবি অবাক হওয়ার মতো করে বলে, "আসল কোনটা? দুটোর চেহারা তো এক।"
_নে/শা করেছিলি সকালে? লাল জামায় নৌশিন, হলুদ জামায় সামিনের বৌ।
_এখন কি করবো? দু'টো আ/ঠা/র মত লে/গে আছে কেন? দু'টোকেই দেবো নাকি?
_মাথা খা/রা/প? সামিন তোকে তোর বাপ মা সহ ক/ব/রে পাঠাবে। ভাই যা বলেছে সেটা কর। চল বাইক স্টা/র্ট দে। এখানে ভী/র। মনে হচ্ছে মো/ড়ে/র মাথায় যাচ্ছে। চল ,চল।
নৌশিন এদিক ওদিক তাকিয়ে রিকশা খুঁজতে থাকে। আলো পাশে অন্য/ম/ন/স্ক হয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ করে নৌশিনের পা/র্স ব্যাগ টা হাত থেকে নিচে পরে যায়। নৌশিন ব্যাগটা তোলার জন্য ঝু/কে যেতেই হু/স করে তাদের পাশ দিকে একটা মটর/সাইকেল চলে যায়।
ক্ষণবাদেই একটা বি/ক/ট চিৎকার শোনা যায়। যে চিৎকারে কেঁ/পে ওঠে মহিলা কলেজের পুরো এড়িয়া। থ/ম/কে যায় পথচারীরা।
কাঁ/প/তে থাকে আকাশ এবং পাতাল।
***
"এখান থেকে একটা ক/পি আমরা সি/টি ক/র্পো/রেশ/নের চেয়ার/ম্যা/নের কাছে পাঠাবো এবং ন/ক/ল তোমার স্ত্রীর কাছে। নব্বই দিনের আগে কার্যকর হবে না।"
কাজীর থেকে চোখ সরিয়ে সামিন তার হাতের কাগজ গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে বলে,"আমি কি কাগজপত্র গুলো দেখতে পারি?"
_জ্বী অবশ্যই।
কাজী কাগজ গুলো এগিয়ে দেয়। সামিন কাঁ/পা কাঁ/পা হাতে কাগজ গুলো নিয়ে দেখতে থাকে উল্টে পাল্টে। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"কোথায় সা/ইন করতে হবে?"
ফুয়াদ পাশের চেয়ারে বসে সামিনের দিকে এক/দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কাজী একটা কলম এগিয়ে দিয়ে বলে,"এই যে নিচের দিকে।"
সামিন কাজীর থেকে কলমটা নিয়ে ফুয়াদের দিকে তাকায়। তারপর ম্লান হেসে কাগজে সা/ইন করতে যায়। পর/ক্ষনেই কাজীর দিকে তাকিয়ে বলে,"আংকেল আরেকটা কলম দিন। এটাতে সম্ভবত
কা/লি নেই।"
কাজী মাথা নাড়িয়ে ড্রয়ার খোলে। ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"তোর ফোন বাজছে।"
_পরে কথা বলবো।
_আরে রিসিভ কর। ইম্প/র/ট্যান্ট কিছু হবে।
সামিন ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করে। রনি ফোন দিচ্ছে। সামিন ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রনি কাঁ/পা কাঁ/পা গলায় বলে ওঠে," ভাই ভাবী!"
_রনি। আমি তোদের বলেছি ওকে ওর মতো ছে/ড়ে দে। কেনো বিরক্ত করছিস।
রনি একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বি/ক/ট চিৎ/কা/র দিয়ে বলে,"ভাই ভাবীর গায়ে কেউ
এ/সি/ড ছু/ড়ে/ছে।
" ম্যাম পে/শে/ন্টে/র কষ্ট হচ্ছে ওনার হাতের বাঁ/ধ/ন খুলে দেই!? "
ডাক্তার রুবি হে/ড নার্স শিলার দিকে তাকিয়ে বল,"হোক । তুমি পা ধরে রাখো। ও/য়া/শ করাটা জরুরি। এ্যা/ফে/ক্টে/ড এরিয়া গুলো ইমে/ডি/য়েট/লি ক্লি/ন করতে হবে। ওর জামা কা/টো, কাঁচি কোথায়? ধরে রাখো ওকে।"
দুজন এ্যা/সি/স্ট্যা/ন্ট নার্স পা ধরে। তারা দুজনেই সদ্য জয়েন করেছে চাকুরীতে। বাচ্চা বয়সী। এটাই তাদের জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। দৃশ্য টা তাদের ভেতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে। নিশ্চুপ চোখ দিয়ে পানি ঝরাচ্ছে তারা।
ইমা/র/জে/ন্সি ইউনিটের লোহার দরজা ভেদ করে গগন/বিদারী চিৎ/কারে পুরো হসপিটালে থাকা প্রত্যেকটা স্তন্য/পায়ীকে কাঁ/পি/য়ে দিচ্ছে।
সামিন ধীরপায়ে এক কদম এগিয়ে যায়। পেছন থেকে ফুয়াদ শক্ত করে জা/প/টে ধরে রাখে তাকে।
" সামিন যাস না।"
সামিন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে যায়। দলের ছেলেরা জাপটে ধরে ,"ভাই দোহাই লাগে যাবেন না।"
কিছুক্ষণ ওদের সাথে ধস্তা/ধস্তি করে সামিন নি/স্তেজ হয়ে ফুয়াদের গায়ে এলিয়ে পরতে চায়। শক্ত করে ফুয়াদ সামিনকে আঁ/কড়ে ধরে রেখেছে।
কান্নার তীব্রতা ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে যাচ্ছে। দীর্ঘসময় পরে একেবারে নিস্তব্ধ হয় যায় পুরো ইমা/র্জেন্সি ইউনিট। সামিন অনুভূতি শূন্য হয়ে পরে থাকে করিডোরের মেঝেতে। তার থেকে দূরেই লা/শের মতো পরে আছে আতাউর আলম। এবারও তারা দুজন দুজনের প্রতি/দন্দ্বী। কে কতটা ক্ষ/ত/বি/ক্ষ/ত হতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে যেন।
ডাক্তার রুবি দ্রুতপায়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। ফুয়াদ এগিয়ে যায়। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই রুবি বলে ওঠে,"হাই ডো/জের
ইন/জে/ক/শ/ন দেওয়া হয়েছে। জ্ঞা/ন নেই। ট্রি/ট/মেন্ট শুরু করবো এখন।"
কথাটা শেষ করে রুবি রনির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"তুমি কি অশিক্ষিত? জানো না এ/সি/ড এ্যা/ফে/করে/ড এরিয়ায় পানি ঢালতে হয় তৎক্ষণাৎ ? নাকি বুঝতে পারোনি? অবুঝ নাকি?"
রনি উৎ/কণ্ঠা নিয়ে বলে,"ম্যাম পানি ঢেলেছি। মুখে পানি ঢালতে ঢালতে আনা হয়েছে।"
_হোয়াট নন/সে/ন্স! এ/সি/ড গায়ে লেগেছে আর তুমি মুখে পানি ঢেলেছো? গায়ে পর্যাপ্ত পানি ঢালা উচিত ছিলো।
রনি মিইয়ে যায়। দূরে বসে মিহি সুরে কেঁ/দে যাচ্ছে নৌশিন।
সামিন ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। রুবির দিকে তাকিয়ে নি/ষ্প্রাণ গলায় বলে,"ওকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন আন্টি। কথা বলুন। বো/র্ড বসান। এক্ষুনি। এই মুহূর্তে।"
রুবি সামিনের দিকে তাকিয়ে ধীরে সুস্থে বলে,"শান্ত হও। আই ক্যান ফিল ইউ। ট্রিট/মে/ন্ট বিদেশে যেটা হবে, এখানেও ওকে সেটাই দেয়া হবে। এটা একটা লম্বা সময়ের ব্যাপার। ট্রিট/মে/ন্টের শেষে বুঝতে পারবো সা/র্জা/রি লাগবে কি না। শান্ত হও তুমি। শরীরের বেশ কিছু স্থান এ্যা/ফে/ক্টে/ড হয়েছে। তার ওপর বোকামি করে কেউ পর্যাপ্ত পানি ঢালেনি গাঁয়ে। পিঠ, পেটের ডানপাশ, ডান হাতের কনুই ..."
"শুনতে চাচ্ছি না আন্টি।"
নি/স্তেজ কন্ঠে বলে সামিন। রুবি হাতের গ্লাভস খুলে বলে,"যাস্ট প্রে ফর হার সামিন। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।"
রুবি চলে যেতেই সামিন উঠে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেয়ালে হাত দিয়ে অনবরত ঘু/ষি মারতে থাকে। ফুয়াদ গিয়ে ধরে ফেলে তাকে। সামিন ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলতে থাকে,"আমার জন্য। যা যা হয়েছে সব আমার জন্য, ওর লাইফে আমি একটা অ/ভি/শা/প ফুয়াদ।"
_এসব কি বলছিস? তোর জন্য কেনো হবে?
চেঁ/চিয়ে ওঠে ফুয়াদ।
_এসব আমার শ/ত্রু/রা করেছে। আমি দায়ী ফুয়াদ। কতটা ক/ষ্ট হচ্ছে ওর। আচ্ছা রাস্তায় ও কেমন করছিলো? নিশ্চয়ই গ/লা/কা/টা মুরগির মতো ছটফট করছিলো।
কথাটা বলে সামিন শেষ করতে পারে না। রনি এগিয়ে এসে বলে,"ভাই ছেলে দুটোকে ধরা হয়েছে। পুলিশের হেফা/জতে আছে। "
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকায় সে। আতাউর আলম একই ভাবে পরে আছে । সামিন ইমা/র্জে/ন্সি ইউ/নিটের দরজার দিকে একপলক তাকিয়ে শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। ফুয়াদ বলে,"কোথায় যাচ্ছিস?"
কোনো জবাব না দিয়ে সামিন বেড়িয়ে যায় হসপিটাল থেকে।
***
ভেতর থেকে কান/ ফা/টা/নো আর্ত/নাদে পুরো দালান ভারি হয়ে উঠেছে। কিন্তু কারো সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যে যার মতো কাজ করে যাচ্ছে। কম্পিউটার অপা/রেটর একমনে ডেস্কটপে কিছু একটা দেখে যাচ্ছে।
থানার কন/স্টে/বল সুধীর দাশ রি/ম্যা/ন্ড রুমের দরজার বাইরে
ব/ন্দু/ক মেঝেতে ঠে/কিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ ভাবলেশহীন।
"সামিন স্টপ। স্টপ সামিন। ম/রে যাবে ও।"
পেছন থেকে গাঁয়ের সর্বোচ্চ শক্তি খাটিয়ে সামিনকে ফেরানোর চেষ্টা করছে সমীর। সাদিক ল/কা/পের একপাশে মেঝেতে গুটিয়ে বসে আছে, ভ/য়া/র্ত চোখে সে সামিনের তা/ন্ড/ব দেখছে। রবিকে বোধ হয় শে/ষ করে ছাড়বে। এরপর তার পালা।
সামিন রবির মাথা পা দিয়ে পি/ষে দিতে চায়। রবি তী/ব্র আর্ত/নাদ করে ওঠে, সামিন চেঁচিয়ে বলতে থাকে, "কি ক্ষ/তি করেছি আমি তোর? কোন জন্মের প্রতি/শোধ নিলি তুই? বল। ম/রা/র আগে বলে যা।"
সমীর সামিনকে জা/প/টে ধরে,"সামিন ছেড়ে দে ভাই। সামিন এটা অন্যায়। আমার চাকরি চলে যাবে। বোঝার চেষ্টা কর।
ওর র/ক্ত/ব/মি হচ্ছে। "
সমীর কে ধা/ক্কা দিয়ে সামিন রবির দিকে তাকিয়ে বলে," জবাব দে তোর কি ক্ষ/তি করেছি আমি।"
_ভাই, ভাই আল্লাহর ক/স/ম আমরা আপনার বৌকে কিছু করতে চাইনি। আমাদের টা/র্গে/ট নৌশিন ছিলো। হুট করে নৌশিন নিচু হয়ে যাওয়ায় আপনার বৌয়ের গায়ে লেগে গিয়েছে। ভাই আপনার বৌকে কিছু করতে চাইনি।
সামিন দাঁতে দাঁত চেপে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে রবির মাথাটা চে/পে ধরে। সমীর কোনো দি/শা খুঁজে না পেয়ে কনস্টেবল ডেকে সামিনকে ছাড়িয়ে নেয়।
সামিন হাপাচ্ছে। সমীর একটা চেয়ার টেনে সামিনকে বসিয়ে দেয়। গায়ের হালকা আকাশি রঙের শার্টে র/ক্তে/র ছো/প ছো/প দাগ । এক গ্লাস পানি খেয়ে নিস্তেজ হয়ে বসে থাকে।
সমীর গিয়ে সাদিককে মা/র/তে থাকে,"নৌশিনকে কেনো এ/সি/ড মা/র/তে চেয়েছিলি? কার কথায়? জবাব দে।"
_স্যার সৈকত ভাই। শমশের ভুঁইয়ার ছেলে।
কেঁ/দে ফেলে সাদিক।
সামিন সাদিকের দিকে তাকিয়ে আছে হিং/স্র দুটি চোখে। এমন সময় সাদিকের ফোন বেজে ওঠে। সমীর গম্ভীর কন্ঠে বলে,"কে ফোন দিয়েছে? "
সাদিক কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে বলে,"সৈকত ভুঁইয়া ফোন দিয়েছে স্যার!"
_রিসিভ কর। আর যা যা শিখিয়ে দেবো সেটা বলবি। স্পি/কার অন কর।
সাদিক মাথা নাড়ায়।
ফোনটা রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে সৈকত বলে,"কিরে শা/লা। ফোন ধরছিলি না কেনো? কাজ হয়েছে? ত/ড়/পেছে ও? রাস্তায় রাস্তায় লাফিয়েছে তাই না? গড়াগড়ি খেয়েছে ওর সুন্দর মুখ চেপে ধরে? "
সাদিক একটা ঢোক গিলে বলে,"ভাই একটা ভুল হয়ে গিয়েছে ।"
"ভুল মানে? কি ভুল?"
_ভাই, এ/সি/ড নৌশিনের মুখে ছুঁ/ড়/তে গিয়ে ভুল করে সামিন ইয়াসারের বৌয়ের গায়ে লেগেছে।
_হোয়াট! আলোর গাঁয়ে?
_হু ভাই।
_কি হয়েছে? ওর মুখ পু/ড়ে গিয়েছে?
_না ভাই। গায়ে লেগেছে। পিঠে।
ওপাশ থেকে সৈকতের পৈ/শা/চিক হাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে বলে," মাত্র? এতো কম শা/স্তি! এটা কিভাবে মানা যায়। এ/সি/ড না, ওকে তো রে/ই/প করতে চেয়েছিলাম আমি। গ্যাং রে/ইং/প। ওর মতো মেয়ের সাথে ওটাই করা উচিত, ওর তেজ ওভাবেই ভাঙা উচিত। ওর জুতার ময়লা মাখিয়ে দিয়েছিলো আমাকে। আমি ওর শরীরে ক/লং/ক মাখিয়ে দিতাম। সামিন ইয়াসার হাত কামড়াতো। শুনেছি ওকে ছে/ড়ে দিচ্ছে সামিন। তাহলে ভালোই হবে। আমরা আমাদের কাজ নি/র্বি/ঘ্নে করতে পারবো। আচ্ছা তোরা চলে আয়। আমাদের ক্লা/ব/ঘরে, নতুন দুটো বোতল আনিয়েছি। একেবারে আসল টা। নৌশিনকেও পরে দেখে নেবো।"
সৈকত ফোন কেটে দেয়। সামিন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায়। সমীর আবারও সামিনকে ধরে ফেলে,"কোথায় যাচ্ছিস?"
সামিন শীতল চোখে তাকায় সমীরের দিকে। সমীর চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"না। তুই একটুও বাড়াবাড়ি করবি না সামিন। আমি ফো/র্স পাঠাচ্ছি। আমি নিজে যাচ্ছি। তুই কিচ্ছু করবি না। তোর বৌ হসপিটালে সামিন,ডোন্ট ফরগেট দ্যাট!"
সামিন পুনরায় চেয়ারে ধপ করে বসে পরে, বিড়বিড় করে বলে," শু/য়ো/রে/র বা/চ্চা গুলো বুঝতেও পারছে না, ওরা আ/ঘা/ত সামিনের বৌকে নয়। সামিনকেই করেছে।"
***
চোখ খুলে রেহেনা বিড়বিড় করে আলোর নাম ধরে ডাকতে থাকে। ইশিতা এগিয়ে এসে রেহেনার হাত ধরে বলে,"আন্টি ভাবী ঠিক আছে। ভাবী একেবারে ঠিক আছে। ঘুমাচ্ছে ভাবী। আপনি শান্ত হোন।"
রেহেনা দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখের কার্নিশ বেয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে। ঠোঁ/ট কে/পে ওঠে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"জানো মা, জীবদ্দশায় আমি এক ওয়াক্ত নামাজ ছাড়িনি। কখনোই রবকে কৃতজ্ঞতা জানাতে কার্পণ্য করিনি। সব প্রার্থনাতে আমি শুধু স্বামী সন্তানের ভালো চেয়েছি। মেয়েটা আমার কিসের
শা/স্তি পাচ্ছে বলো তো। জীবনে কখনো একটা পিঁপড়াকে ক/ষ্ট দেয়নি। একটা মি/থ্যা কথা বলে নি। অ/ন্যা/য়ের সাথে আ/পো/ষ করেনি। তবুও এতো ক/ষ্ট কেন ওর।"
ইশিতা চুপ করে রেহেনার দিকে তাকিয়ে আছে। রেহেনা অঝোর ধারায় কেঁ/দে যাচ্ছে।
সামিন উদাস চোখে মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখতে থাকে। এখানে। এই স্থানেই শুরু হয়েছিলো সবকিছুর। এখানে একটা বিশাল মঞ্চ ছিলো। জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউ ছিলো । মুখের সামনে ছিলো
মা/ই/ক্রো/ফোন। হঠাৎ গালে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে সামিন ঘুরে তাকাতেই দেখে চোখে পানি নিয়ে অগ্নি/মূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে এক শ্যাম-সুন্দরী। ছোটো খাটো দেখতে। মায়াবী আয়তাকার চোখ দুটো রসগোল্লা সাইজের মতো বানিয়ে সামিনের দিকে ঘৃ/ণা নিয়ে তাকিয়ে ছিলো।
চোখের সামনে সে দৃশ্য পুনরায় ভেসে উঠতেই সামিন আনমনে হেসে ওঠে। সেদিন কি পরিমান রা/গ জন্মেছিল ঐ তে/জী মেয়েটার প্রতি। ইচ্ছে করছিলো খু/ন করে ফেলতে। আর আজ সেই মেয়েটির জন্য তাকে খু/ন হতে হচ্ছে। অনূভুতিরা গ/লা টি/পে সামিন ইয়াসারের সত্তাকে খু/ন করছে প্রতিনিয়ত।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামিন এগিয়ে যায়। পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকে চুপচাপ। হসপিটালে এখন যাবে না সে। তার আছিয়ার সাথে বোঝাপড়া আছে আজ। এতো লোকের ভীড়ে সে তার আছিয়াকে ক/টু কথা শোনাতে পারবে না।
ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। সমীরের ফোন। সামিন রিসিভ করে।
"কি ব্যাপার? কন/স্টে/বল পাঠিয়ে দিলি কেন মাঝ রাস্তায়? তুই হসপিটাল যাসনি?"
_যাবো। কি করেছিস তুই?
সামিন তেজী কন্ঠে বলে ওঠে।
"অন দ্যা ওয়ে সামিন।"
সামিন একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে,"লা/শ হলেও চাই।"
***
ডাক্তার রুবি এসে ফুয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,"সামিন কোথায়? "
_কোথায় যেন বেড়িয়েছে আন্টি।
রুবি বলে,"ট্রিট/মে/ন্ট চলছে। চিন্তা করতে বারণ করো। সবাই আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাও যে মুখের কিছু হয়নি ফুয়াদ। একটা মেয়ের মৃ/ত্যু হওয়া ভালো তার থেকে।"
ফুয়াদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ায়। সামিন কোথায় গেলো বুঝতে পারছে না সে। কোনো অ/ঘ/টন ঘটায়নি তো আবার। থানায় ফোন দিয়েও কিছু জানতে পারলো না। ফোন বের করে আবার সামিনের নাম্বার ডায়াল করে সে। সামিন ফোনটা রিসিভ করে। ফুয়াদ বলে,"কোথায় গিয়েছিস তুই? কি উল্টো পাল্টা করছিস। হসপিটালে আয়।"
_রাতে আসবো।
_তুই কোথায় সামিন?
_আন্ডার কন/স্ট্রা/ক/শন টা/ও/য়ার টার নিচে।
_ওখানে কি করছিস?
ফুয়াদ অবাক হয়ে জানতে চায়। সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,"স্মৃতি নাড়াচাড়া।"
_মানে?
_মানে কিছু না। আমার শাশুড়ির জ্ঞা/ন ফিরেছে?
_হু।
_অদ্ভুত ফ্যামিলিতে জুরে গিয়েছি ভাই। একটা লোকও স্বাভাবিক না। কথায় কথায় জ্ঞা/ন হারায়, কথায় কথায় স্ট্রো/ক করে। আর আমার বৌয়ের কথা কি বলবো। সে তো কাঁ/ধে অলটাইম ঝামেলা নিয়ে ঘোরে।
ফুয়াদ চুপ করে থাকে। সামিন বলে,"ওনাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দে। বলে দে ফ্রম নাউ আলো ইজ হার হাজব্যান্ড'স রেসপনসিবিলিটি।"
ফোন কেটে সামিন চুপ করে বসে থাকে। সে এখন যে স্থানে আছে এখানে একদিন ভয় দেখিয়ে আলোকে ডেকে এনে নিজের পা ধরিয়েছিলো সামিন। রা/গ, এই রা/গ মানুষকে দিয়ে কতটা নিচু কাজ করিয়ে নেয়।
চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায় সে। মাগরীবের আজান দিয়ে দিয়েছে। পরি/ত্যাক্ত আন্ডার কন্স/ট্রাক/শন টাওয়ার টা থেকে বেরিয়ে এসে মেইন রোডে দাঁড়িয়ে পরে। আশেপাশের লোকজন তাকে অদ্ভুত চোখে দেখছে। মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জা এমন আলুথালু বেশে এখানে কি করছে! এখানে তার কাজ কী?
***
"পুলিশের সাথে ব/ন্দু/ক/যু/দ্ধে বিরোধীদলীয় নেতা শমসের ভুঁইয়ার ছোট ছেলে সৈকত ভুঁইয়া নি/হ/ত। আজ বিকাল পাঁচটা নাগাদ, পুলিশের এক স্পেশাল টি/ম তার ক্লা/বে খোজ চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মা/দ/ক/দ্রব্য ও অ/স্ত্র উদ্ধার করে। পুলিশের থেকে বাঁচতে সে পুলিশের দিকে গু/লি ছো/ড়ে এবং পুলিশ আ/ত্ম/রক্ষায় পাল্টা গু/লি ছু/ড়/লে সে মা/রা যায়। তার লা/শ পো/স্ট/ম/র্টে/মর জন্য সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
জানা গিয়েছে সে আজকের মহিলা কলেজ রোডের এ/সি/ড কান্ডের মুল হোতা। ছেলের আ/ক/স্মিক মৃ/ত্যু/র শো/ক না সইতে পেরে হৃদ/রো/গে আ/ক্রা/ন্ত হওয়ায় সাবেক মেয়র শমশের ভুঁইয়াকে গ্রীনলাইফ মেডিকেয়ার হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। এখনো তার বড় ছেলে সাগর ভুঁইয়া এই ব্যাপারে মুখ খোলেনি। "
হসপিটালের ওয়েটিং রুমে হাত বেঁধে টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে সামিন। তার মুখ ভাবলেশহীন। সৈকতের মৃ/ত্যু/র খবরে লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। কোনো না কোনো কারনে সবাই খুশি হয়েছে খবরটায়। কম ত্রা/স সৃষ্টি তো করেনি গত ছয় মাসে। কিশোর গ্যাং-এর গ/ড ফাদার ছিলো। কত অভিভাবকের অভিযোগ ছিলো ওর নামে। এতো অল্প বয়সেই মা/দ/কের সাম্রাজ্য বিস্তার করে বসেছিলো।
ঘুরে ফিরে সবাই সামিন ইয়াসার মির্জাকে দেখছে। পরনে জিন্স প্যান্ট, গায়ে হালকা আকাশী রঙের শার্ট। শার্টে ছোপছোপ কালো কালো দাগ। বলিষ্ঠ দেহে শার্ট টা আঁট/সাঁট হয়ে আছে। পুরো বিধ্বস্ত লাগছে সামিনকে। সব আগন্তুকেরা সামিনের দিকে ঘুরে ফিরে তাকাচ্ছে। মেয়র সাহেবের এই অবস্থা কেন সেটা জিজ্ঞেস করার সাহস নেই তাদের।
"ভাইয়া।"
ইশিতার ডাকে সামিন ঘুরে দাঁড়ায়।
_যাসনি তোরা? ইলহাম রিতু কোথায়?
_ভ/মি/ট হচ্ছে ভাবীর। ওয়াশ রুমে নিয়ে গেছে মেজো ভাইয়া।
_তোরা চলে যা। আমি থাকবো এখানে।
_ইশমাম বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে ভাইয়া। ওকে বলবো?
_নাহহ। শুধু শুধু টেনশন করবে। এমনিতেই মন খারাপ করে থাকে সারাদিন।
ইশিতা একটা প্যাকেট সামিনের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে,"শার্ট টা পাল্টে নাও। তোমাকে বিশ্রী লাগছে।"
সামিন চুপচাপ প্যাকেট টা নিয়ে পাশের একটা বেঞ্চিতে রেখে দেয়। দূরের একটা বেঞ্চিতে আতাউর আলম চুপচাপ বসে আছে। সবাইকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে সেও থেকে গিয়েছে । হাত বেঁ/ধে দৃষ্টি মেঝের দিকে দিয়ে রেখেছে।
সবাই চলে যায়, জামিল চুপচাপ করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সামিন জামিলের দিকে তাকিয়ে বলে," তোর বৌ কে কথা দিয়েছিলাম তোকে দিয়ে চা/ম/চা/মি করাবো না। কিন্তু তুই জন্মগত চা/ম/চা। তোর মধ্যে থেকে চা/ম/চা ভাবটা গেলো না। যা এখান থেকে।
জামিল কিছুক্ষণ তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যায়।
হসপিটালে থেকে গিয়েছে দু'টো লোক। আতাউর আলম এবং সামিন ইয়াসার মির্জা।
আতাউর আলমের মাথাটা বেশ ব্যাথা করতে শুরু করেছে। কপালের দুপাশের রগ দপদপ করছে। হঠাৎ তার সামনে কেউ একটা ওয়ান টাইম চায়ের কাপ এগিয়ে ধরে। মাথা তুলে সামিনকে দেখে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ টা নেয়। সামিন নিজের জন্যও এক কাপ চা এনেছে। চায়ের কাপ হাত আতাউর আলমের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে পরে।
দু'জনেই কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর সামিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে, "এখানের ক্যা/ন্টি/নের চা একেবারে বি/শ্রী। খুবই সস্তা চায়ের পাতা দেয়। মনে হয় যেসব চায়ের পাতা লা/শে/র ক/ফি/নে দেওয়া হয় সেটা। এই চা টা বাইরে থেকে আনলাম।"
আতাউর আলম চায়ের কাপে চুমুক দেয়।
সামিন একপলক তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"আপনার সাথে কখনোই খোলামেলা আলোচনা করা হয়নি।"
_কি আলোচনা?
আতাউর আলম সামিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
_আমি আপনার এ/ক্সি/ডেন্ট করাইনি। কান ভাঙানো হয়েছিলো আপনার মেয়ের।
_আমিও জামিলকে কো/পা/নোর ব্যবস্থা করিনি। কান ভাঙানো হয়েছিলো তোমার।
দু'জনে আবার চুপচাপ। সামিনের দিকে তাকিয়ে আতাউর আলম বলে,"তোমার ধারনা তুমি আমার মেয়েকে ভালোবাসো?"
_হু।
_তা আমার মেয়েকে কতটা ভালোবাসো তুমি?"
_আপনি যতটা আপনার মেয়েকে ভালোবাসেন তার থেকে একটু কম।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন।
আতাউর আলম বলে,"লাভ কি। তুমি একটা গুন্ডা।"
সামিন ম্লান হাসে। আতাউর আলম সামিনের গায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,"গায়ে র/ক্ত কেনো। কাকে কু/পি/য়ে এসেছো আবার।"
সামিন মৃদু হেসে চায়ের কাপটা বিনে ছু/ড়ে মে/রে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ক্লান্ত ভঙ্গিতে আলোর কেবিনের দিকে যায়।
দরজার বাইরে থেকে দুমিনিট ভেতরে তাকিয়ে থেকে পা বাড়ায় সামিন। পেছন থেকে ডাক্তার রুবি ডেকে ওঠে,"সামিন।"
সামিন ঘুরে তাকায়।
রুবি বলে,"কোথায় যাচ্ছো?"
_ভেতরে। ওর কাছে!
রুবি সামিনকে ভালো করে লক্ষ্য করে বলে,"নো ওয়ে সামিন। ইন/ফেক/শনের ঝামেলা আছে। তুমি নিজেই জী/বা/ণু নিয়ে ঘুরছো। কি অবস্থা তোমার।"
_আন্টি,শার্ট পাল্টে আসছি আমি। একবার। প্লিজ।
রুবি বলে,"ঠিক আছে। চলো আগে সা/র্জি/ক্যা/ল পোশাক পরে নাও। তারপর ঢুকবে।"
***
হাই ডো/জের ইন/জেকশন দেওয়া হয়েছে। পিঠের ক্ষতটা সবচেয়ে বেশি। যখন এ/সি/ড ছোঁ/ড়া হচ্ছিলো তার কয়েক মুহূর্ত আগে একটা বালুভর্তি ট্রা/ক চলে গিয়েছিলো ওদের পাশ দিয়ে।
পে/ট্রোলের তীব্র গন্ধে আলো মুখে ওড়না চে/পে ধরে ঘুরে গিয়েছিলো। এ/সি/ড ছিটকে লেগে যায় তার পিঠে।
আলোকে কাত করে রাখা হয়েছে। চুল গুলোতে দুটো বেনী করে দিয়েছে নার্স। পুরো শরীর একটা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
ধীরপায়ে হেটে গিয়ে সামিন কিছুটা দূরত্ব রেখে একটা চেয়ার টেনে বসে পরে।
দীর্ঘ সময় ধরে আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মুখটা এখন অতিরিক্ত ফরসা লাগছে। আলো যদি এখন নিজেকে দেখতো তাহলে নিজেই নিজেকে বলতো "সাদা মুলা।"
চুলে বাচ্চাদের মতো দুটো বেনী করে রাখা। ছোটোখাটো গোলগাল মুখটাকে আরো ছোটো লাগছে। এখন আলোকে দেখে চব্বিশ বছরের কোনো ভদ্রমহিলা নয় বরং সতের বছরের কিশোরী মেয়েদের মতো লাগছে। ঐ পাতলা দু'টো ঠোঁট দেখে কে বলবে ঐ ঠোঁট নেড়ে এই অভদ্রমহিলা কত কুৎ/সিত কুৎ/সিত গালি দেয় সবাইকে। চেহারার সাথে স্বভাব আচরণ কিচ্ছু যায়না মেয়েটার। চেহারা দেখে কতটা অবলা লাগে আর আচরণ দেখে মনে হয় জে/ল ফেরত লেডি ড্রা/গ মা/ফি/য়া।
সামিন আনমনে হেসে ফেলে। তারপর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"কি বলেছিলে সেদিন? বলেছিলে,ইয়াসার মির্জা। চলুন তাহলে একটা বা/জি ধরা যাক। যদি ইলেকশনে আমরা জিতি তাহলে আমি যা বলবো তাই আপনি শুনবেন, আর যদি আপনি জেতেন তাহলে আপনি যা বলবেন আমি সেটা শুনবো। এটাই বলেছিলে তাই না ? তারপর কি হলো, আমি জিতলাম। বাজিতে জিতে শর্ত মোতাবেক তোমার আমার কথা শোনার কথা ছিলো তাইনা? আর আমি কি বলেছিলাম তোমাকে? তুমি ভালো থাকো এটাই তো তাইনা? এটাই তো শর্ত ছিল। তুমি আমার শর্ত মানলে কই? কেনো ভালো থাকলে না তুমি?"
এ পর্যন্ত বলে সামিন থামে। তারপর আবার বলতে শুরু করে,"শর্ত ভা/ঙ/লে কি হয় জানো তো আছিয়া? যে শর্ত ভা/ঙে তাকে শা/স্তি পেতে হয়। তোমাকেও শা/স্তি পেতে হবে। তোমাকে তোমার স্বামী শাস্তি দেবে আছিয়া।"
কথাগুলো বলে সামিন চুপ হয়ে যায়। চাদরের ফাঁক দিয়ে আলোর বা হাতের আঙ্গুল বের হয়ে আছে। সামিন তার হাত বাড়িয়ে আলোর একটা আঙ্গুল ছোঁ/য়। তারপর তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।
কেবিনের দরজার বাইরে থেকে সামিনের দিকে আতাউর আলম তাকিয়ে আছে। তিনি ঐ ছেলেটার ব্যা/কু/ল/তাকে বিচার করতে পারছে না। তিনি শুধু দেখছে তার মেয়ের জন্য কেউ উৎ/কণ্ঠা নিয়ে বসে আছে, তার মতো। তার সাথে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে থাকতে চাইছে। প্রতিযোগীতার ফলাফল কি হবে? কে এগিয়ে থাকবে? কে?
আঙুলের ওপর থেকে হাত সরিয়ে আলোর মাথায় হাতটা আলতো করে বুলিয়ে দিয়ে বলে,"খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হও তুমি। তোমার
শা/স্তি/র জন্য প্রস্তুত হও। আমি অপেক্ষা করছি আছিয়া।"
[আজকের পর্বটা বড়,সবাইকে ফেসবুক লাইট থেকে না পড়ে সরাসরি মেইন ফেসবুক থেকে পড়ার পরামর্শ রইলো]
"আলো? তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আলো? আলো?"
কানের কাছে কথা গুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বারবার। অপরিচিত নারীকন্ঠটি খুবই চমৎকার। কিন্তু তাকে ডাকছে কেন?
চোখের পাতা মেলে তাকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তবুও সে হাল ছাড়লো না।
রুবির দিকে তাকিয়ে হে/ড নার্স শিলা বলে ওঠে,"ম্যাম চোখ খুলছে। বাড়ির লোককে ডাকবো? যদি চেঁচামেচি শুরু করে দেয়? সামলাতে পারবে।"
_না। কাউকে দরকার নেই। সামিন বলেছে সি ইজ আ স্ট্রং ওম্যান। দেখি কথাটা কতটুকু সত্যি।
অবশেষে সফল হলো সে, দু'চোখ মেলে আলো পিট পিট করে তাকাচ্ছে। নাকে কেমন ওষুধের তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ এসে লাগে। কোথায় সে? কিচ্ছু বুঝতে পারছে না সে। মাথার ওপর সি/লিং ফ্যানটা চলছে না,কিন্তু পুরো ঘর শীতল। আলো ঘার ঘুরিয়ে দেখতে পায় দুজন অপরিচিত ভদ্রমহিলা তার দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। দুজনে এমন সবুজ রঙের একটা পোশাক পরা কেন? আলো কাত হয়ে ছিলো, চেষ্টা করলো চিৎ হবার। তখনি যন্ত্রনায় তীব্র আর্ত/নাদ করে উঠলো।
দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে সামিন সাথে সাথে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে আলোর আর্ত/নাদ শুনে।
"রিল্যাক্স আলো। রিল্যাক্স। ইটস্ আ মাইনর ইন/জুরি। যাস্ট রিল্যাক্স।"
রুবি আরো ঝুঁকে যায় আলোর দিকে। আলো চাদর খা/মচে ধরে। যন্ত্রনায় পুরো মুখ নীল রঙের হয়ে আছে। দু'চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরে। নাকের ডগা লাল হয়ে গিয়েছে। রুবি শিলাকে বলে,"ইন/জেক/শন টা দিয়ে দাও। ওয়াশ করতে হবে।"
শিলা মাথা নাড়ায়। আলো বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। দৃশ্য গুলো তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার গায়ে কিছু একটা পরেছিল। মূহুর্তেই শরীরটা যন্ত্রনায় পুরে যেতে শুরু করলো, সে উন্মাদের মতো লাফাচ্ছিলো। রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। এরপর আর কিচ্ছু মনে আসছে না।
তারপর হঠাৎ করে মনে আসে,কেউ বলছিলো,ওর জামা কা/টো। ওর পা ধরে রাখো।
হুট করে আলো চোখ মেলে চোখ দুটো বড়বড় করে ফেলে। শরীরটা যেন শির/শির করে উঠলো।
রুবি আলোর কাছে এগিয়ে যায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,"আমি ডাক্তার রুবি। তুমি আমাকে আন্টি বলো।"
আলো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। রুবি বলতে থাকে,"তোমার শরীরের ব্যাথা কমে গিয়েছে? এই ইন/জেক/শন টা ইউএস থেকে অর্ডার করে আনা হয়েছে। একটুও ব্যাথা করবে না দেখো । অনেক আরাম পাবে তুমি।"
আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"আমাকে কি ওটা এ/সি/ড ছোড়া হয়েছিলো?"
_হ্যা আলো।
রুবি ঠান্ডা গলায় বলে। মুহুর্তেই আলো আর্ত/নাদ করে ওঠে,"নাহহ। আমার মুখ! আমার মুখ!"
রুবি আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,"কিছু হয়নি তোমার মুখে আলো। যাস্ট রিল্যাক্স!"
আলো উন্মাদের মতো হয়ে ওঠে,ব্যাথা/তুর শরীরে ছটফটও করতে পারছে না সে। বা হাত দিয়ে পুরো মুখ হাতিয়ে যাচ্ছে। উন্মাদের মতো কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে,"আমার মুখ। আমার মুখ। আমার মুখ।"
"কিচ্ছু হয়নি আলো। আয়না দেখবে তুমি? বোকা মেয়ে কিচ্ছু হয়নি।"
নার্স শিলা দৌড়ে গিয়ে একটা ছোট আয়না তুলে আলোর মুখের সামনে ধরে। রুবি বলে,"দেখো আলো। একটু তাকাও । শান্ত হও। শান্ত হও তুমি।"
আলো শান্ত হতে পারে না। বা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে তড়/পাতে থাকে। রুবি জোর করে আলোর হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,"দেখো। দেখো বলছি। দেখো তুমি।"
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে পিটপিট করে চোখ মেলে আলো আয়নায় নিজের মুখটা দেখে।
রুবি মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,"দেখলে তুমি? দেখলে?"
ফ্যালফ্যাল করে আয়নার দিকে তাকিয়ে আলো বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। রুবি আয়নাটা সরিয়ে বলে,"তুমি কার মতো দেখতে জানো? পুরো অম্রিতা রাও এর মতো দেখতে। ভারি মিষ্টি। কিন্তু তোমার কন্ঠটা বড্ড ফ্যাসফেসে আলো। এতো বি/কট চিৎকার দিও না। আমার কান ফেটে যাচ্ছে।"
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। তার পুরো শরীর কাঁপছে। রুবি আলোর গায়ের চাদর টা সরিয়ে দিয়ে বলে,"পেটে, ডান হাতের কনুই, পিঠে একটু খানি লেগেছে তোমার। এগুলো পুরোপুরি সেরে যাবে। "
আলো কাঁদছে। নিশ্চুপ কাঁদছে। রুবি ক্ষ/ত ওয়াশ করতে করতে বলে, "আমরা বেশিদিন এই প্রানোচ্ছল পাখিটাকে আটকে রাখবো না। তুমি খুব শিগগিরই উড়তে পারবে। "
"কেন? আমার সাথেই কেন?"
ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে ওঠে আলো।
রুবি কোনো উত্তর দেয়না। আলো বলে ওঠে,"আমি খারাপ মেয়ে। আমি খারাপ মেয়ে বলে।"
একই কথা বিড়বিড় করতে থাকে আলো। রুবি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শিলাকে বলে,"ঘুমের ইন/জেক/শন টা দিয়ে দাও।"
***
সামিন চুপ করে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। দূরে রেহেনা মিহি সুরে কাঁদছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে হিয়া,নৌশিন, শ্রাবনী। আজান আয়াত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাদের পাশে।
দরজা খোলার শব্দ হতেই সামিন সেদিকে তাকায়। রুবি বেরিয়ে আসে। সামিনকে দেখে বলে,"যাবে তুমি? দেখবে? "
সামিন মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,"আমার শাশুড়ি যাবে।"
_উনি তো নিজেই ভেঙে পরেছে। উনি কি করবে গিয়ে?
সামিন চুপ করে থাকে। তার ভয়,আলো যদি এই অবস্থায় তাকে দেখে উত্তে/জিত হয়ে পরে। যদি রে/গে যায়। তাহলে তো আলোর ক্ষ/তি।
রুবি মৃদু স্বরে বলে,"ঘুমিয়ে পরবে এক্ষুনি। দেখে আসতে পারো। এরপর ট্রিট/মেন্ট চলবে। তখন যেতে দেবো না কাউকে।"
সামিন কিছুক্ষণ উ'শ'খু'শ করে ভেতরে ঢোকে। আলোকে ওদিকে ফিরিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে। পা টিপে টিপে সামিন আলোর কাছে যায়। ঘুম ঘুম চোখে আলো বিড়বিড় করতে থাকে,"আমি খারাপ মেয়ে। আমার সাথে এটাই হওয়া উচিত। আমি খারাপ মেয়ে। আমি খারাপ মেয়ে। "
সামিন থমকে যায়। আর এগোনোর সাহস নেই তার। একই কথা আলো বিড়বিড় করতে করতে অচেতন হয়ে যায় কিছু সময় পরে।
সামিন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে ওঠে,"তুমি খারাপ মেয়ে নও। তুমি আমার দেখা সবথেকে শুদ্ধতম মেয়ে আলো। সবথেকে বিশুদ্ধতম মেয়ে।"
***
"শেভ করছিস না কেনো?"
ফুয়াদ একপলক সামিনের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলে। সামিন ড্রাইভ করতে করতে বলে," সময় হয়ে ওঠে না। আজ করবো।"
_দাড়ি রাখলে রেখে দিতে পারিস। তোকে অনেক হ্যান্ডসাম লাগবে। পলিটিশিয়ানদের সাথে দাড়ি মানায়।
সামিন চুপ করে থাকে। হসপিটাল রোডের মোড় ঘুরে সামিন গেইটের ভেতর ঢুকে পার্কিং লটে গাড়িটা পার্ক করে রাখে। তারপর গাড়ি থেকে নেমে হসপিটালের ভেতরে ঢোকে।
আজ পনেরো দিন হয়ে গিয়েছে। ট্রিটমেন্ট শেষ হয়েছে। আলোকে আজ রিলিজ করে দেয়া হবে। ক্ষ/ত প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে।
আলোর কেবিনের বাইরের করিডোরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সামিন দ্রুতপায়ে হেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। আজান মাথা তুলে তাকিয়ে বলে,"আম্মু গিয়েছে ভেতরে। আপু কথা বলছে।"
মাথা ঘুরিয়ে সামিন আলোর কেবিনের দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
তারপর হেটে ডাক্তার রুবির কেবিনে যায়।
"মেয়েদের এতো গলাবাজি করা ঠিক না আম্মু। বেশি গলাবাজি করার পরিনতি দেখলে?"
আলো নিস্তেজ কন্ঠে বলে। রেহেনা মেয়ের হাত ধরে চু/মু খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,"একদমই না আম্মু , একদমই না,এমন কথা বলবি না।"
আলো কোনো কথা বাড়ায় না। মাথা ঘুরিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার কেবিনের জানালার বাইরে একটা চমৎকার জারুল গাছ আছে। তার ডালে কিছু পাখি বসে আছে। সে এক দৃষ্টে পাখি গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
***
" শরীরের যেসব জায়গায় লেগেছে। সা/র্জা/রি করাটা অনেকটাই সহজ। মুখ হলে আমরা রি/স্ক নিতে চাইতাম না। এখন তোমার সিদ্ধান্ত, আই মিন আলোর সিদ্ধান্ত বাকি টা।"
সামিন রুবির দিকে তাকিয়ে আছে। রুবি বলতে থাকে,"আজ নিয়ে যেতে পারো। আর যেটা ইম্পরট্যান্ট নোট দিতে চাই সেটা হলো, ওর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখবে। আই থিংক তুমি বুঝেছো।"
সামিন মাথা নাড়ায়। রুবি বলতে থাকে,"একটার পর একটা দূর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে তাই ওর মনে হচ্ছে সবকিছু যেহেতু ওর সাথেই হচ্ছে তাহলে নিশ্চয়ই ওর দোষ। ও আসল অপ/রাধী। এটা থেকে ভবিষ্যতে ভয়াবহ মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। ওকে খুব দ্রুত কোনো সাই/ক্রিয়া/টিস্টের কাছে নিয়ে যেও। ডাক্তার ফজলে রাব্বী বেস্ট এই ব্যাপারে।"
সামিন উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে। রুবি বলতে থাকে," হুট হাট অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ করলে ভয় পেয়ো না। কি বলো তো, মেয়েরা নিজের শরীর, ত্বকের ব্যাপারে খুব সেন/সেটিভ। ওর কাছে মনে হতে পারে ও এখন কুৎসিত হয়ে গিয়েছে অনেকটা, ওর সৌন্দর্য কমে গিয়েছে। তাই ডি/প্রে/শ/নে হুট হাট কান্নাকাটি করতে পারে, রা/গ দেখাতে পারে।"
রুবি সামিনের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,"খেয়ে নাও।"
সামিন পানিটা খায়। রুবি বলতে থাকে,"কি অবস্থা করেছো নিজের। "
ম্লান হেসে হাতের গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে সামিন উঠে দাঁড়ায়। তারপর সোজা হেটে আলোর কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। কিছুক্ষণ কেবিনের বাইরে জড়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দরজা ঠেলে পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে।
কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে আলো মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে সামিন। সামিন তার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আলো বেডে আধশোয়া হয়ে ছিলো। কয়েক পলক সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঘুরিয়ে আবারো জানালার বাইরে চোখ রাখে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা চেয়ার টেনে সামিন বসে পরে। তারপর আলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে গলা খাঁকারি দেয়। আলো তাকায় না। ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেই নিস্তেজ কন্ঠে বলে,"সবসময় অন্যের ভুলের মাশুল কেনো আমাকে গুনতে হয় বলতে পারেন?"
সামিন আলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে,"চা খাবে? হসপিটালের বাইরে একটা ছোট চায়ের দোকান আছে। ওদের চা চমৎকার। আমি ফ্যান হয়ে গিয়েছি। এখানে এসে রোজ খাই।"
আলো মৃদু স্বরে বলে ওঠে,"কেনো আসেন?"
সামিন একটা হাই তুলে বলে ওঠে,"চা খেতে।"
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
_ডি/ভো/র্সের নোটিশ পাঠানোর কথা ছিলো সেদিন। পাঠিয়েছিলেন?
সামিন মাথা নাড়ায়। আলো কাঁ/পা কাঁ/পা গলায় বলে,"কেনো?"
_কেউ আটকে দিয়েছিলো।
_কে?
_কলম। কলমের কালি শেষ হয়ে গিয়েছিলো।
_আর কোনো কলম নেই পৃথিবীতে?
_আছে। কিন্তু কোনো কলমের ক্ষমতা নেই।
আলো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"আপনার প্রতি আমার রা/গ নেই। যত রা/গ সব নিজের প্রতি। আপনি চলে যান।"
সামিন নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,"আর আমার হিসেব?"
আলো ঘুরে তাকায়। অবাক হয়ে বলে,"কিসের হিসেব?"
মুহুর্তেই সামিন চোখ মুখ কুঁচকে বলে ওঠে,"শর্ত মানোনি। শা/স্তি পেতে হবে তোমাকে।"
_শর্ত? শা/স্তি? কি বলছেন আপনি।?
_বাজিতে কি শর্ত ছিলো?
আলো আমতা আমতা করে বলে,"আমরা জিতলে আপনি আমার কথা শুনবেন আর আপনি জিতলে আমি আপনার কথা শুনবো।"
_কে জিতেছে?
_আপনি।
_হ্যা, আমি জিতেছি। আর শর্ত অনুযায়ী তোমাকে ভালো থাকতে বলা হয়েছিলো। ভালো থেকেছো তুমি?
আলো চুপ করে থাকে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"শর্ত ভে/ঙে/ছো তুমি। শা/স্তি পেতে হবে তোমায়। "
আলো সামিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন বলতে থাকে,"আর তোমার শা/স্তি হচ্ছে তুমি বাধ্য মেয়ের মতো তোমার স্বামীর ঘরে ফিরবে।"
আলো বলে ওঠে,"অসম্ভব। অসম্ভব। বাজি। শর্ত। এসব ভুলে যান। আমি কোথাও যাবো না।"
সামিন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আলোর দিকে। আলোর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরে। অস্ফুট স্বরে বলে,
_প্রত্যেকটা পুরুষের কাম্য তার স্ত্রীর নিখুঁত একটা শরীর। আমি কোনো পুরুষকে গ্রহণ করার পরিস্থিতিতে নেই। আপনার দয়া দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমি কারো চোখে আমার জন্য দয়া দেখতে চাইনা। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন।
সামিন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আলোর দিকে। আলো চোখের পানি মুছে নিয়ে বলে,"কি হলো। বলেছি তো চলে যান।"
_যাবো। তবে আমার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে।
_ইয়াসার মির্জা।
আলো রা'গ দেখিয়ে বলে ওঠে।
_হ্যা বলো আছিয়া।
_বাড়াবাড়ি করছেন।
সামিন অদ্ভুত ভাবে হাসতে থাকে। আলো চেঁ/চিয়ে ওঠে,"আব্বু। আব্বু তুমি কোথায়?"
আতাউর আলম কেবিনের ভেতরে ঢোকে। তার পিছু পিছু ঢোকে রেহেনা, আজান আয়াত, আলোর বান্ধবীরা, ফুয়াদ, ইশিতা, জামিল, দলের ছেলেরা। সবাই।
আলোর গায়ে হসপিটালের পোশাক। চুলে দুটো বেনী করা। আতাউর আলমকে দেখে আলো বলে ওঠে,"উনি কি বলছে? "
"কি বলছে?"
আতাউর আলম গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে।
আলো চেঁচিয়ে বলে,"আমাকে নিয়ে যেতে চাইছে।"
_হ্যা। তো?
নিচু স্বরে বলে আতাউর আলম।
আলো অবাক হয়ে বলে,"হ্যা তো মানে?"
আতাউর আলম অবাক আলোকে হতভম্ব করে দিয়ে বলে,"তোমার স্বামী তোমাকে নিয়ে যাবে, আমাকে বলছো কেনো আম্মু? আমি কে তোমাদের মধ্যে কথা বলার।?"
আলো ঘুরে ঘুরে কেবিনের মধ্যে থাকা প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে," ওও সবাই একজোট হয়েছো? "
সবাই চুপ করে থাকে। আলো বলে,"আমি যাবো না। আমি কোথাও যাবো না। চাই না কারো দয়া। যাস্ট লিভ মি অ্যালোন। আমি ক্লান্ত।"
সামিন মুখে চ কারন্ত শব্দ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে," আমি এখন আমার বৌকে আমার সাথে আমার বাড়িতে, তার স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। এখানে যদি কারো আপত্তি থাকে তাহলে সে তিন সেকেন্ডের মধ্যে আমার সামনে আসুক।"
তিন সেকেন্ড অতিবাহিত হয়। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ একটা হাসি দেয়। তারপর বলে,"দেখলে কারো আপত্তি নেই।"
তারপর শার্টের হাতা ফোল্ড করতে থাকে সে। আলো বলে ওঠে,"কি করতে চাইছেন আপনি?"
সামিন ফুয়াদের দিকে গাড়ির চাবি দিয়ে বলে,"স্টার্ট কর গিয়ে।"
ফুয়াদ হেসে বলে,"জো হুকুম মেরে আকাহ!"
আলো বলতে থাকে,"কি করতে চাইছেন আপনি?"
_ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে সামিন।
_মানে?
_মানে তোমার মতো ত্যা/ড়া মেয়েদের সাথে যেটা করা উচিৎ। যেটা না করলেই নয়।
সামিন আলোর দিকে এগিয়ে যায়। আলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবার সামনে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় সামিন। আলো বাঁধা দিতে চেয়েও পারছে না। সেই শক্তি তার গাঁয়ে অবশিষ্ট নেই। সামিন এগিয়ে যায়। পেছনে না ফিরে রাহাত আর জামিলকে উদ্দেশ্য করে বলে,"হসপিটালের সবাইকে পেট ভরিয়ে মিষ্টি খাইয়ে বাসায় আসবি। সবাইকে বলে দিবি, আজ সামিন ইয়াসার মির্জার বিয়ে। পাত্রী তার স্ত্রী।"
ইশিতা রেহেনা আর আতাউর আলমের থেকে বিদায় নিয়ে ভাইয়ের পিছু পিছু যায়।
আগন্তুকেরা সবাই অবাক চোখে সামিনকে দেখছে। মেয়র তার স্ত্রীকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে কেনো! ভীড় জমে গিয়েছে করিডোরে।
আলো নিশ্চুপ চোখের পানি ফেলে সামিনের বুকে কি/ল ঘু/ষি মারতে থাকে। দোতলা থেকে সিড়ি বেয়ে নেমে সামিন হসপিটাল থেকে বের হয়। ফুয়াদ গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সামিন এসে দাড়িয়ে ফুয়াদকে বলে,"নেতা হিসেবে আমাকে সবসময় তুই জিরো দিস, স্বামী হিসেবে কত দিতে চাস।"
_দশে আট।
_কেন? আর দুই মার্কস কা/টা কেন?
_মাত্র একতলা সিঁড়ি বেয়ে নেমেছিস। আর এতেই হাঁপিয়ে গিয়েছিস!
সামিন ম্লান হেসে বলে,"হাপাবো না? এক হাজার পঞ্চাশ কেজি বয়ে নিয়ে এসেছি।"
"এক হাজার পঞ্চাশ কেজি মানে?"
ফুয়াদ অবাক হয়ে জানতে চায় ।
সামিন হেসে বলে,"পঞ্চাশ কেজি ওর শরীরের আর এক হাজার কেজি ওর আত্মসম্মানের ওজন। তুই বক বক না করে গাড়ির দরজা খোল নয়তো এটাকে এখানেই ফেলে দেবো। ওহহ হো, ভুল বলেছি। ওজন মনে হচ্ছে সত্তর কেজির কাছাকাছি। হাই ডো/জের ওষুধ খেয়ে খেয়ে বিশ কেজি বাড়িয়েছে। হাত ব্যাথা হয়ে গেলো!"
ফুয়াদ হেসে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। আলোর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। বিড়বিড় করে বলতে থাকে,"দয়া চাই না। চাইনা।"
সামিন আলোকে বসিয়ে দিয়ে আলোর পাশে বসে পরে। ফুয়াদ ড্রাইভিং সিটে, ইশিতা তার পাশে। গাড়ি চলতে শুরু করে। আলোর ছট/ফটানি কমছে না। তেজ নিয়ে বলতে থাকে,"কি ভেবেছেন? আলো দয়া নেওয়ার পাত্রী? লাগবে না। আমাকে আমার বাবা মায়ের কাছে দিয়ে আসুন। আসুন বলছি।"
সামিনকে ধাক্কাতে থাকে আলো। সামিনের বলিষ্ঠ শরীরে তার কোন প্রভাব পরে না। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"চুপ করে বসে থাকো। ব্যাথা লাগবে তোমার।"
আলো থামেনা। সামিনের হাত খা/মচে ধরে বলে,"গাড়ি থামাতে বলুন। বলুন।"
সামিন আলোর কথা না শুনে ডান হাত দিয়ে আলোর দুহাত আকরে ধরে রেখেছে।
আলো নিজের হাত ছাড়ানোর প্রানপন চেষ্টা করে। কিন্তু সে অপারগ। হুট করে আলো এক কান্ড করে বসে। সামিনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াতে না পেরে সামিনের হাতে
কা/মড় বসিয়ে দেয় । ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে সামিন আর্তনাদ করে ওঠে। ফুয়াদ গাড়ির ব্রেক কষে দেয়। মাথা ঘুরিয়ে সামিন চোখ বড় বড় করে আলোকে দেখতে থাকে। আলো তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে ক'ট'ম'ট দৃষ্টি দিয়ে। ফুয়াদ বলে ওঠে,"ভাই আমি গাড়ি ঘুরাচ্ছি। এটাকে মেন্টাল হসপিটালে দিয়ে আসবো। তোর এর সাথে সংসার করার দরকার নেই। খুব রিস্কি হয়ে যাবে ভাই, তোর প্রান/নাশের ভয়।
সামিন হতভম্ব হয়ে আলোর দিকে তাকিয়েই থাকে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর ফুয়াদকে ঠান্ডা গলায় বলে,"পাগলের চিকিৎসা আমি দিতে জানি। তুই গাড়ি স্টার্ট কর।"
তারপর ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"ফোন করে ওদিকে জানিয়ে দে।"
ইশিতা মাথা নাড়িয়ে ফোনে রিতুর নাম্বার ডায়াল করে। ফোন রিসিভ হতেই বলে ওঠে,"মেজো ভাবী। মির্জা বাড়ির বড় বৌ ফিরছে। বধূবরণের তৈয়ারি করো।"
নিস্তেজ শরীরটা নিয়ে সিটে হেলান দিয়ে চোখের পানি ফেলতে থাকে আলো। ইশিতা মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলে,"ভাবী স্টপ। অনেক হয়েছে। অনেক করেছো তুমি, অনেক।"
_আমি খুব খারাপ আপু। আমাকে একা ছেড়ে দাও। কারো দয়া চাই না আমার। কারো দয়া না।
***
"তুমি আমার দেখা সবথেকে সুন্দর বিয়ের কনে। আকাশী রঙের হসপিটালের ড্রেস। চুলে দুটো বেনী। তোমাকে পুরো অপ্সরার মত লাগছে বড় ভাবী।"
আলোকে জরিয়ে ধরে রিতু বলে। আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের পানি শুকিয়ে গালে লেপ্টে আছে। ইশিতা ভেতরে ছুটে গিয়ে একটা বড় ফুলের তোড়া নিয়ে এসে আলোর সামনে দাঁড়ায়। তারপর খুশি খুশি গলায় বলে,"ওয়েলকাম ব্যাক ভাবী। আমার বড় ভাবী, আমাদের বড় ভাবী।"
আলো ইশিতার দিকে তাকিয়ে আছে। ইশিতা আলোকে আগলে নিয়ে বলে,"তোমার বাড়িতে পদধূলী দাও এবার। আমাদের বাঘিনী তুমি, একটু কথা শোনো আমাদের।"
সামিন আলোর পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলে,"কোলে করে নিতে হবে?"
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বাড়ির সবার দিকে তাকায়। পরী এসে আলোর হাত ধরে বলে,"এসো আমাদের সাথে ভাবী। এসো বলছি!"
টানতে টানতে আলোকে সামিনের ঘরে নিয়ে যায় ওরা।
রিতু দাঁড়িয়ে পরে, সামিনের দিকে তাকায়। সামিন ফিসফিসিয়ে রিতুকে বলে,"আগে মাথার স্ক্রু ঢিলা ছিলো। এখন পুরো পুরি খুলে গিয়েছে। একটু সামলে রাখো। আমি রে/ঞ্জ নিয়ে আসছি।"
কথাটা বলে সামিন ফুয়াদকে নিয়ে বেরিয়ে পরে। সবকিছুর ব্যাবস্থা করতে হবে তাকে।
আলো বিছানার উপর গুটিয়ে বসে আছে। ইশিতা,পরী দুজনে তার সামনে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। বিছানার ওপরে একটা শাড়ি। কিছুক্ষণ আলোর দিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে ইশিতা মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে,"বড্ড বেশি সাফার করাচ্ছো ভাবী তুমি আমাদের। এরপর যখন রাই বাঘিনী ননদিনী হয়ে শো/ধ তুলবো তখন কিছু বলতে পারবে না বলে দিলাম।"
আলো নিশ্চুপ। ইশিতা বলে,"ভাইয়া কোথাও বেরিয়েছে। চুপচাপ শাড়িটা পরে নাও। নয়তো এসে আমাদের কথা শোনাবে।"
আলোর কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ইশিতা বলে,"দাঁড়াও। ভাইয়াকে ডেকে আনছি।"
পরী আর ইশিতা চলে যায়। আলো ঘরে চুপচাপ বসে থাকে। তার দৃষ্টি ঘুরে ফিরে ঘরের চারপাশটা দেখতে থাকে। সবকিছু ঠিক আগের মতোই আছে। সে যেমনটা রেখে গিয়েছিলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে তার জন্য রাখা প্রসাধনী। ঘরের এক কোণে তার ব্যাবহার করা তিনটা শাড়ি আলনায় ঠিক সেরকম রাখা আছে যেরকম সে রেখে গিয়েছিলো। সামিনের টেবিলের ওপর আলোর রেখে যাওয়া কিছু বই,যা সে এ বাড়ির লাইব্রেরী ঘর থেকে এনেছিলো, সেগুলো ঠিক সেভাবেই রাখা আছে যেভাবে সে রেখে গিয়েছিলো। তবে কি লোকটা জানতো আলো এবাড়িতে ফিরবে? কেনো রেখে দিয়েছে এখনো এসব? কিসের জন্য?
***
"শাড়িটা পরে আসো"
আলোর সামনে বসে আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে সামিন। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন নরম গলায় বলে,"পরে এসো। তোমার প্রতি ক/ঠিন হতে ইচ্ছে করে না আছিয়া। একদম করে না।"
"ক/ঠিন হয়ে কি করবেন? মা/র/বেন আমাকে?"
আলো দৃঢ় ভাবে বলে। সামিন ম্লান হাসে। তারপর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিচু স্বরে বলে,"না। নিজের হাতে শাড়িটা পরিয়ে দেবো।"
আলো চ'ম'কে ওঠে। সামিন বলতে থাকে,"আমি তোমার জীবনের একটা ক্ষ/ত। আমাকে না হয় ক্ষ/ত হিসেবেই রাখো। তবুও রাখো। ধীরে ধীরে না হয় মিলিয়ে যাবো আছিয়া। সময় দাও,সুযোগ দাও।"
আলো চুপচাপ তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। সামিন আলোর একটা হাত মুঠি করে ধরে আলোর চোখে চোখ রেখে ব্যাকুল কন্ঠে বলে ওঠে," সুযোগ প্রার্থী আমি। আমাকে ভোট নয়, আপনি একটাবার সুযোগ দিন আছিয়া। আপনার একটা সুযোগে একজন অপ/রাধী আলোর পথে ফিরতে পারবে। রাষ্ট্রের প্রতি কি এতটুকু দায় নেই আপনার? অপ/রাধ সংশোধনের সুযোগ দিন, তরুণ সমাজ বাঁচান।"
আলো কোনো কথা বলে না। কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ থাকে। সামিন বলে,"দশ মিনিট সময় তোমাকে দিলাম। যদি এই শাড়িটা পরো, তাহলে ধরে নেবো তুমি একটা অপ/রাধীকে সুযোগ দিচ্ছো।"
_আর না পরলে?
ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করে আলো।
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"তাহলে বার বার আপনার কাছে সুযোগ চেয়ে যাবো। আমি বড্ড বেহায়া আছিয়া। ইউ নো দ্যাট!"
কথাটা বলে সামিন চুপচাপ চলে যায়।
***
বাড়ির সবাই আয়োজনে ব্যাস্ত। শান্তিনীড়ে আলোর ফেরা উপলক্ষে ছোটো খাটো একটা অনুষ্ঠান হবে।
লিভিং রুমে কাজী বসে আছে। তার পাশেই আতাউর আলম। সামিন এসে খুবই বিনয়ী হয়ে আতাউর আলমের পাশে বসে। তারপর আতাউর আলমের দিকে তাকিয়ে বলে,"তিন লক্ষ টাকা কাবিন ছিলো। আপনি চাইলে সংশোধন করে আরো বাড়াতে পারি।"
আতাউর আলম ম্লান হাসে, তারপর বলে,"আমি পেশায় একজন সাংবাদিক। ব্যবসায়ী নই।"
কাজী কাগজ পত্র রেডি করে আতাউর আলমের সামনে রাখে। বিয়ের কাগজে সা/ক্ষী সংশোধন করে মেয়ের বাবাকে দিয়ে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছে। আতাউর আলম সাইন করে চুপচাপ বসে থাকে। সামিন এক দৃষ্টে বিয়ের কাগজের দিকে তাকিয়ে আছে। আতাউর আলম বলে,"আমার মেয়েকে আনো। ওকে দেখতে চাই।"
সামিন হাতের ঘড়ির দিকে তাকায়। দশমিনিটের যায়গায় পনের মিনিট হয়ে গিয়েছে। সে উঠে দাঁড়ায়। তারপর দোতলায় চলে যায়।
ঝর্না ছেড়ে দিয়ে তার নিচে দাঁড়িয়ে আছে আলো। সামিনের দেওয়া শাড়িটা ওয়াশ রুমের সাথে লাগোয়া একটা আয়নার সামনে রাখা। শাড়িটার রং কমলা।
পানির ঝর্না বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। তারপর হাত বাড়িয়ে শাড়িটা নিয়ে গায়ে জরিয়ে নিতে থাকে। কুচি গুলো কোমরে গুজে নিয়ে আঁচল বুকে তুলতে যাবে তখনই আয়নায় চোখ যায় তার। পেটের ডানপাশটা দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শরীরটা ধীরে ধীরে অ/সাড় হয়ে যাচ্ছে। ভেজা ঠোঁট দুটো কাঁপছে। চোখের কার্নিশে পানি জমেছে। কাঁপতে কাঁপতে অনেকটা সাহস নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় সে। আঁচল টা হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে পিঠের দিকটা দেখার চেষ্টা করে আয়নায়। থমকে যায় সে। কিছু সময় চুপ থেকে বিকট শব্দে চিৎকার দিয়ে ওঠে।
সামিন ঘরের ভেতর পা রাখতেই থ/মকে যায়। ওয়াশ রুমের ভেতরে আলো উন্মাদের মতো আর্তনাদ করে যাচ্ছে। দ্রুতপায়ে ওয়াশ রুমের দরজার কাছে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে থাকে। আলো কেঁদেই যাচ্ছে। সামিন কিছুক্ষণ দরজায় ধাক্কা দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পরে। তারপর থেমে যায়। নরম গলায় ডাকতে থাকে,"প্লিজ বেরিয়ে এসো। কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার। আমি জানতে চাই। আমার জানার অধিকার আছে আলো। আমার হাতে সেই অধিকারের সনদ।"
আলো কাঁদতেই থাকে। সামিন ব্যাকুল হয়ে বলে ওঠে,"অত টুকু
পু/ড়ে গিয়েছে বলে কষ্ট পাচ্ছো? আছিয়া, তুমি তো পু/ড়ে গিয়েছো। এখন আমাকে পো/ড়াচ্ছো। আর পু/ড়িও না আমাকে। দরজা টা খুলে দাও। বেরিয়ে এসো। আমায় দয়া করো এবার।"
বেশ কিছুক্ষণ সামিন ওয়াশ রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। আলো তখনও কেঁদে যাচ্ছে। কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছে না সে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পরেছে। সামিন এদিকে ওদিকে অসহায়ের মতো একবার তাকিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি খরচ করে দরজায় বেশ কয়েকবার ধা/ক্কা দিতেই সিটকিনি ভে/ঙে দরজা খুলে যায়। একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে সামিন ওয়াশ রুমের ভেতর পা রাখে। আলো ওয়াশ রুমের একপাশে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে। তার শরীর কাঁপছে। ভেজা চুল বেয়ে পানি পরছে। শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটিয়ে পরে আছে। সামিন এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। আলোর দিকে খানিকটা ঝুকে তার আঁচল উঠিয়ে তার গায়ে জড়িয়ে দেয়। ক্রন্দনরত আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,"চলো ওঠো।"
আলোর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সামিন কিছু সময় আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিয়ে আলোকে তুলে নেয়। বিছানায় এনে আলোকে বসিয়ে দিয়ে সামিন আলোর মুখোমুখি বসে। আলোর কান্না থেমেছে। কেমন নির্জীব হয়ে বসে আছে এখন। সামিন খানিকটা ঝুকে আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,"সমস্যা কোথায়?"
আলো মুখটা সরিয়ে নেয়। সামিন কিছুক্ষণ আলোকে দেখে। কাঁদতে কাঁদতে নাকের ডগা লাল বানিয়ে ফেলেছে। সামিনের ইচ্ছে করছে হাত দিয়ে ঐ নাকের ডগা ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু অযাচিত আহ্লাদী স্পর্শ দিয়ে এই মেয়েটার গালাগাল খেতে সে ইচ্ছুক নয় এখন। হাজার হলেও সে এই শহরের মেয়র। তার একটা গাম্ভীর্য নিয়ে চলা উচিত, কথায় কথায় পুঁচকে বৌয়ের গালাগাল খাওয়া তার শোভা পায় না।
সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"ওয়াশ রুম কাঁদার যায়গা? এতো সুন্দর পরিপাটি রুম আমার। কত সুন্দর একটা টানা বারান্দা। কোথায় রুমের এসি অন করে এই নরম বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদবে,তা না! এসব রেখে ওয়াশ রুমে ঢুকে কাঁদছো কেনো? সত্যিই তোমার মাথার স্ক্রু খুলে কোথাও পরে গিয়েছে। "
আলো দৃষ্টি বিছানার চাদরের ফুলকাটা নকশায় দিয়ে আছে। সামিন উঠে আলোর আলমারি থেকে একটা নতুন তোয়ালে বের করে আনে। আলোর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,"মাথা মুছে নাও। ঠান্ডা লেগে যাবে।"
আলো চুপ। সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদু স্বরে বলে,"তুমি আমাকে দিয়ে বড্ড খাটাও। এটা ঠিক না আলো।"
কথাটা বলে সামিন নিজের হাতে আলোর চুল মুছিয়ে দিতে থাকে। আলো পাথরের মতো বসে আছে। সামিন কি করছে সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। চুল মুছিয়ে আলোর মাথায় তোয়ালেটা সুন্দর করে জরিয়ে দেয় সামিন।
সামিনের দরজার বাইরে এসে আতাউর আলম দাঁড়িয়ে পরে। মেয়ে জামাইয়ের ব্যক্তিগত রুমে সে আসতে ইচ্ছুক ছিলো না। ইশিতা আর রিতু জোর করে নিয়ে আসে তাকে। ঘরের ভেতরে সামিনের বৌয়ের সেবা করার দৃশ্য দেখে সবাই থতমত খেয়ে যায়। ইশিতা আর রিতু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দুজনে দুদিকে কে/টে পরে আতাউর আলমের পেছন থেকে। আতাউর আলম বোকার মতো কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ঘুরে সিঁড়ির দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পেছন থেকে সামিন বলে ওঠে,"আসুন।"
আতাউর আলম দাঁড়িয়ে পরে। সামিন ঘরের বাইরে এসে বলে," আপনার মেয়ের আপনাকে প্রয়োজন। তার কাছে থাকুন। আমি আপনাদের দুজনের খাবার উপরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
সামিন চলে যায়। আতাউর আলম মাথা ঘুরিয়ে আলোকে দেখে তার কাছে যায়। আলো মাথা নিচু করে নিস্তেজ হয়ে বসেছিল। আতাউর আলম গিয়ে মেয়ের পাশে বসে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে একটা হাত মেয়ের মাথায় রাখতেই আলো ঝাঁপিয়ে পরে তার বুকে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে আলো বাবার শার্ট খামচে ধরে। আতাউর আলম মেয়ের মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আলো কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,"আমি কুৎসিত হয়ে গিয়েছি আব্বু। কুৎসিত হয়ে গিয়েছি।"
নিচ তলার লিভিং রুমে মেহমান রা চলে এসেছে । মেহমান বলতে ফুয়াদ, জামিল এবং সামিনের দলের ছেলেরা। সবাই খাওয়া দাওয়া করছে। আজান আয়াত বোনের শ্বশুরবাড়িতে এই দ্বিতীয় বারের মতো এসেছে। সামিনের সাথে জড়তা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। মাথা নিচু করে রোস্ট থেকে মাংস খুটে খেতে ব্যস্ত তারা। সামিন দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের পাশেই একটা চেয়ার টেনে বসে। তারপর বলে ওঠে ,"বোনের শ্বশুরবাড়ি, বেশি বেশি খাবে শা'লারা।"
আজান আয়াত খেতে খেতে সামিনের দিকে তাকায়। দুলাভাই মজা করলে কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হয় তারা জানে না।
সামিন বলে,"খাও।"
পাশ থেকে রনি বলে ওঠে,"হ্যা খাও। না খেলে আমি আছি তো। গলায় ছু/রি বসিয়ে দেবো।"
আয়াত বিষম খেয়ে কাশতে থাকে রনির কথায়। খাবার টেবিলে সবাই হেসে ফেলে। সামিন আয়াতের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। পানি খেয়ে আয়াত ধাতস্থ হয়।
কিছুক্ষণ পরে সামিন পরিবেশ টা স্বাভাবিক করতে আজানকে বলে,"কলেজে উঠেছো। গার্লফ্রেন্ড হয়নি কোনো?"
আজান লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়ায়। সামিন আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে,"আর তোমার?"
আয়াত ও ভীষণ লজ্জা পায়। নিচু স্বরে বলে,"না।"
সামিন বলে,"কাউকে মনে ধরলে বলবে। প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে পেছনে ঘুরঘুর করতে হবে না। তুলে এনে বিয়ে পড়িয়ে দেবো।"
আজান আয়াত চুপ করে থাকে। ফুয়াদ আজান আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"হ্যা। ওই একটা কাজই তোমাদের দুলাভাই পারে। মেয়ে তুলে আনা।"
সামিন ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। ফুয়াদ গম্ভীর কন্ঠে বলে,"বাচ্চাদের ভালো পরামর্শ দিতে হয়। দুলাভাই তুই ওদের। ভাগ্যিস আলো নেই এখানে,নয়তো তোর বারোটা বাজিয়ে দিতো এসব শুনলে।"
সামিন অপরাধী গলায় বলে,"এখন মজাও করতে পারবো না? কি অদ্ভুত!"
***
"আপনার ফোন বাজছে। ম্যানেজার ফোন দিচ্ছে।"
বিছানার দিকে তাকিয়ে রিতু বলে। ইলহাম ওয়াশ রুমে শেভ করছিলো,ওয়াশ রুমের দরজা খোলা, মাথা ঘুরিয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"রিসিভ করে কথা বলো। বলো ব্যস্ত আছি।"
রিতু অবাক হয়ে বলে,"আমি?"
_হ্যা। রিসিভ করো।
রিতু আমতা আমতা করে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করে কথা বলে রেখে দেয়। আগে হলে ইলহাম তার ফোনে হাত দেওয়ার অপরাধে খুব বকে দিতো। এখন কি না তাকে দিয়ে অফিসের কল উঠাচ্ছে।
রিতু আলমারি থেকে ইলহামের একটা পাঞ্জাবি বিছানার উপর রেখে বলে,"সাদা পাঞ্জাবি বের করেছি। পরবেন?"
ইলহাম ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আসে। রিতুর শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে নিয়ে বলে,"কেনো নয়।"
রিতু মুচকি হেসে চলে যেতে নেয়। ইলহাম শক্ত করে রিতুর হাত ধরে ফেলে,হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের কাছে টেনে আনে। রিতু চ'ম'কে ওঠে। বিছানায় একপাশে বসে রিতুকে কোলের ওপর বসিয়ে তার ডান হাত টেনে নিজের কাঁধের ওপর রাখে। রিতু অস্ফুট স্বরে বলে,"কি করছেন।"
ইলহামের দিক থেকে কোন জবাব আসে না। সে তার স্ত্রীর ঘারে আদর মাখিয়ে দিতে ব্যস্ত। রিতু ছ'ট'ফ'ট করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়। তার অস্বস্তি বুঝতে পেরে ইলহাম জরানো কন্ঠে বলে,"চুপ করে বসো। শুধু চু/মুই খাবো। ভ/য় পেয়ো না।"
রিতু চুপ করে থাকে। ইলহাম রিতুর ঘার থেকে মুখ উঠিয়ে রিতুর লাজুক মুখখানার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"কেমন আছে আমাদের ছোটো সোনা? তোমাকে কষ্ট দেয় আমার মতো?"
রিতু মাথা নাড়ায়। ইলহাম রিতুর গালে একটা চু/মু খায়, তারপর বলে,
_এইবার আমাকে একটা মেয়ে দেবে তুমি। আমি মেয়ে চাই।"
রিতু অস্ফুট স্বরে বলে,"আর যদি না দিতে পারি?"
ইলহাম সাথে সাথে বলে ওঠে,"তাহলে পরের বার দেবে।"
রিতু লজ্জা পেয়ে যায়। ইলহাম বলে,"পরের বার না হলে তার পরের বার। তার পরের বার না হলে তার পরের বার। মোটকথা হাল ছাড়া যাবে না।"
রিতু চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। ইলহাম মুগ্ধ চোখে এই নমনীয় মেয়েটির লাজুক মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতো মুগ্ধতা সে আগে কেনো খুঁজে পেলো না?
***
সামিন হাত ধুয়ে উঠে পরে। আজান বলে,"ভাইয়া। আপুর জিনিসপত্র যা চেয়েছিলেন,সব এনেছি।"
সামিন বলে,"কোথায়?"
আজান আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়। সিঁড়ির কাছে একটা ট্রলি ব্যাগ রাখা।
ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"এগুলো কি?"
সামিন মৃদু হেসে বলে,"শশুর বাড়ি থেকে যৌ/তুক নিয়েছি।"
কথাটা বলে সামিন ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে। তার ঘরের দরজার কাছে এসে সে একটা দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পরে। আলো তার বাবার কোলে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে আছে। আতাউর আলম তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গল্প করছে। যেন বাবা তার ছোটো অবুঝ মেয়েকে রূপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে।
সামিন দৃশ্য টা দেখে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছে যে মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে,"বাহ! কি সুন্দর! আমাকেও যেন আল্লাহ কন্যাসন্তান দেয়।"
ভেতরে ঢুকে বাবা মেয়ের এতো সুন্দর মুহূর্ত সে নষ্ট করতে চায় না। তাই ট্রলি ব্যাগটা সে দরজার কাছে রেখেই চলে যায়।
***
হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে আলো। বাবা যতক্ষন ছিলো,মনটা ভীষণ শান্ত ছিলো। আতাউর আলম, আজান, আয়াত রাত নয়টার দিকে বাড়িতে চলে গিয়েছে। আবারো ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছে মন টা। খুব কান্না পাচ্ছে।
সামিন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু মুহূর্ত, ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা প্রায়। সারাদিনের ধকল শেষে সেও বেশ ক্লান্ত । একটু ঘুম দরকার।
মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে সে,"আল্লাহ ওই পাগল মেয়েটা যদি আজ আমার মেজাজ খারাপ করে দেয় তবুও যেন আমার রা/গ না ওঠে আজ। প্লিজ আল্লাহ,একটু সুবুদ্ধি দিও ঐ আছিয়াকে আর আমাকে দিও ধৈর্য্য।"
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে সে। কয়েক পলক আলোকে দেখে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার সিটকিনি তুলে দেয়। আলো মাথা তুলে তাকায় না।
সামিন ওয়াশ রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে গায়ের পাঞ্জাবিটা পালটে একটা টি শার্ট পরে নেয়। তারপর বেরিয়ে এসে পুনরায় আলোর দিকে তাকায় । একই ভাবে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে গুটিয়ে বসে আছে। সামিন ভাবে, ঘুমিয়ে পরলো না তো! পরতেই পারে, এই মেয়ের সবকিছু অগোছালো।
আলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সামিন শব্দ করে ঘরের জানালার গ্লাস টেনে বন্ধ করে দেয়, বারান্দার দরজা ধপ করে লাগিয়ে দেয়। আলো ধীরে ধীরে মাথা তুলে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,"সরি।"
আলো কিছু বলে না। মাথা ঘুরিয়ে বিছানায় চোখ রাখে। ইশিতা আর পরী রাত নয়টার দিকে এসে বিছানার উপর কিছু ফুল আর ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। বিরক্তিতে আলো কপাল কুঁ'চ'কে রেখেছে। ইশিতা আপু কিভাবে এতো অবুঝের মতো কান্ড করতে পারে!
সামিন আলোর দৃষ্টি অনুসরণ করে বিছানার দিকে তাকায়। কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে বলে,"পরিস্কার করে দিচ্ছি।"
বাড়ির কাউকে না ডেকে সামিন ফুলগুলো সরিয়ে নেয় বিছানা থেকে, তারপর ঝুড়িতে ফেলে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলে,"আমিও আমার বৌয়ের কাছে অবহেলিত আর তোরাও, চিমটি।"
ঘুরে আবারও আলোর দিকে তাকায়। তারপর গিয়ে আলমারি খুলে একটা বক্স বের করে সেটার ভেতর থেকে আরেকটা ছোট বক্স বের করে এনে আলোর মুখোমুখি বসে। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন হাতের ছোটো বক্সটা খুলতে খুলতে আলোর চোখের দিকে তাকায়। বক্সে সামিনের মায়ের সেই বালা দুটো।
আলো বালা দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে, এগুলো সে খুলে সামিনের হাতে দিয়ে গিয়েছিলো সেদিন। সামিন আলোর ডান হাত ধরে একটা বালা পরিয়ে দিয়ে অপর হাতেও আরেকটা বালা পরিয়ে দিয়ে বলে,"আমার চোখে দেখা সবথেকে বিশুদ্ধ একজন নারীর স্মৃতিচিহ্ন আমার চোখে দেখা আরেকজন বিশুদ্ধ নারীর হাতে পরিয়ে দিলাম।"
এ পর্যন্ত বলে একটু থেমে আবারও বলতে শুরু করে,"এই দু'টো কখনো খুলবে না হাত থেকে, অনুরোধ তোমার প্রতি।"
আলো কিছুক্ষণ হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে সামিনের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। সামিন এক পলক আলোকে দেখে মজা করে বলে ওঠে,"কি ব্যাপার! অস্বাভাবিক চুপচাপ কেনো? রেঞ্জ দেখছি স্ক্রু বেশ ভালো করে টা/ইট দিয়ে গিয়েছে।"
আলো অবাক হয়ে বলে,"মানে? কিসের রেঞ্জ?"
_রেঞ্জ। তোমার বাবা, আমার শশুর। তাকে এনেছিলাম তোমার স্ক্রু টা/ইট দিতে। সে তার কাজ ঠিকমত করেছে দেখছি।
আলো অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে সামিনের কথায় পাত্তা না দিয়ে। সামিন বলতে থাকে,"মন খারাপ করে থাকবে দেখে বাবাকে, ভাইদের এনে দিলাম, একটা ধন্যবাদ তো পেতেই পারি।"
"ধন্যবাদ "
আলো কপাল কুঁ'চ'কে কাটকাট বলে।
সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"এভাবে দিলে? একটা চ/ড় মেরে দিতে এর বদলে নাহয়!"
আলো গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"মন পেতে এসব করছেন?"
সামিন ম্লান হাসে, তারপর বলে,"না, মন চুরি করতে এসব করছি। চুরি করতে না পারলে ডাকাতি করবো।"
_হ্যা, ওই একটা জিনিসই আপনি ভালো পারেন। লুটতরাজ।
কাট কাট বলে ওঠে আলো।
ব্যস,এই কথাটাই সামিনের মেজাজ খারাপ করে দিতে যথেষ্ট। কিন্তু সামিন হাত মুঠি করে চোখ বন্ধ করে ফেলে,বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে বিড়বিড় করে নিজেকে নিজে বলতে থাকে,"ক/ন্ট্রোল সামিন ইয়াসার মির্জা ক/ন্ট্রোল! প্লিজ রা/গ উঠাস না।"
আলো অবাক হয়ে সামিনকে দেখে বলে,"বিড়বিড় করে কি বলছেন! কাকে গালাগাল দিচ্ছেন?"
_গালাগাল? ওসব তো তুমি ভালো জানো।
আলো চুপ হয়ে যায়। সামিন আলোকে দেখতে থাকে। কমলা রঙের শাড়িটা কত সুন্দর লাগছে মেয়েটির গায়ে। শাড়িটার সৌন্দর্য মেয়েটিকে সুন্দর করে তুলেছে নাকি মেয়েটির সৌন্দর্য শাড়িটার গাঁয়ে ছেয়ে গিয়েছে বুঝতে পারছে না সামিন। আলো কপাল কুঁ'চ'কে সামিনের দিকে তাকাতেই সামিন চোখ সরিয়ে নেয়। আলো দৃঢ় ভাবে বলে,"সুযোগ চেয়েছেন, সুযোগ দিয়েছি। আগে নিজেকে প্রমাণ করে দেখান। মনে রাখবেন, স্ত্রীর মন পাওয়ার আগে তার শরীর কা/মনা করা পুরুষদের আমি ঘৃ/ণা করি।"
সামিন কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে যে তার স্ত্রীর শুধুমাত্র শরীর কা/মনা করে না, তার যে তার স্ত্রীর মনটাও পেতে হবে এই কথাটা এখনো ঐ অবুঝ মেয়েটা বুঝলো না। এতো যু/দ্ধ তবে কেন করলো সামিন? শরীর তো বহু আগেই পেতে পারতো। কিভাবে মুখের ওপর কাট কাট বলে দিলো ঐ অভদ্রমহিলা। সামিন কি তাকে ছুঁ/য়ে ফেলতো নাকি আজ? খুবই অ'ভ'দ্র এই মহিলা। মুখে কোনো লাগাম নেই!
আলো বলতে থাকে,"বুঝতে পেরেছেন?"
সামিন কিছু না বলে মাথা নাড়ায়। তারপর নিচু স্বরে বলে,"জ্বী।"
_তাহলে নিজেও সময় নিন এবং আমাকেও সময় দিন।
আলো কথা গুলো বলে শেষ করার আগেই সামিন বলে ওঠে,"সিম্পল কথা, সিম্পল ভাবে বলো,ধ/মকে কেনো বলছো।"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,"বলছিলাম, আমি কি ডিভানে শোবো মানে..."
আলো রা/গী চোখে তাকিয়ে আছে। সামিন একটা ঢোক গিলে ফেলে, তারপর কাঁচুমাচু মুখ করে বলে,"দুমাস ডিভানে শুয়ে শুয়ে মেরুদন্ড বাঁকা হয়ে গিয়েছে আমার!"
আলো সামিনের দিকে কিছুক্ষণ কপাল কুঁ'চ'কে তাকিয়ে থাকে। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে, বিছানার মাঝামাঝি দু'টো কোলবালিশ দিয়ে বিছানা ভাগ করে নিন।
"অনেক উদার তুমি আছিয়া"
বিড়বিড় করে বলে সামিন বাধ্য ছেলের মতো আলমারি থেকে বিশাল সাইজের দুটো কোলবালিশ বের করে এনে বিছানার মাঝখান টাতে রাখে। তারপর আলোকে বলে,"তুমি কোন পাশটা নিতে চাও।"
আলো বিছানার দিকে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ। যেন সে বুঝে উঠতে পারছে না তার কোন পাশটা নেওয়া উচিত। সামিন বলে,"তাড়াতাড়ি বলো, আমার ঘুম পাচ্ছে। "
আলো ডানপাশটা দেখিয়ে বলে,"আমি এই পাশে থাকবো।"
"ওকে"
উত্তর দিয়ে সামিন অপর পাশে গিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পরে। আলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আলমারি থেকে একটা নরমাল সুতি শাড়ি বের করে ওয়াশ রুমে ঢোকে। শাড়িটা পাল্টানোর সময় তার কানে হাসির শব্দ পৌঁছায়, ঘরের ভেতর সামিন হাসছে। অদ্ভুত! এতো বিশ্রীভাবে রা/ক্ষসের মতো ঘর কাঁপিয়ে হাসছে কেন!
শরীরে শাড়ির আঁচল জরিয়ে সে বেরিয়ে আসে। সামিন গা দুলিয়ে হাসছে। মনে হচ্ছে বিছানাটাও কাঁপছে।
আলো কৌতুহলী হয়ে তাকে দেখছে। সামিনের হাতে কিছু একটা আছে। সেটার দিকে তাকিয়ে বারবার পাগলের মতো হাসছে। আলো তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। স্বভাবে বদ হলেও লোকটার হাসি সুন্দর, হাসলে মনে হয় যেন কত মাসুম একটা লোক, কত সহজ সরল একটা লোক!
সামিন আলোকে দেখতে পেয়ে আরো জোরে জোরে হাসতে থাকে। আলোর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ধ/মকের সুরে বলে,"রা/ক্ষসের মতো হাসছেন কেনো?"
সামিন বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে তার হাতের ছবির অ্যালবাম টা আলোর দিকে তুলে ধরে।
ওটা আলোর ছোটোবেলার ছবির অ্যালবাম। আলো তার ছোটো বেলার ছবি দেখে লজ্জায় কুঁ/কড়ে যায়। একটা ছবিতে তার নাক বেয়ে সর্দি পারছিলো। আরেকটা ছবিতে আলোর বেল মাথা। আতাউর আলম মজা করে ছবি দুটো তুলে রেখেছিলো।
সামিন আবারো হাসতে থাকে। আলোর লজ্জা রা/গে পরিনত হয়। রেগেমেগে বলে,"কোথায় পেয়েছেন এগুলো?"
_আনিয়েছি তোমার ভাইদের দিয়ে। তোমার সব প্রয়োজনীয়,প্রিয়, গোপনীয় জিনিস। সবকিছু এখন আমার হেফাজতে।
অ্যালবামের আরেকটা পাতা উলটে আবারো হাসতে শুরু করে সামিন । এই ছবিতে আলো মুরগির ঠ্যাং চিবুচ্ছিলো। ভ/য়ংকর পর্যায়ের কুশ্রী একটা ছবি।
সামিন বুকে হাত দিয়ে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বুকে ব্যাথা হয়ে গেলো।
আলো তে/ড়ে যায়,"দিন ওটা। দিন বলছি।"
সামিন অ্যালবামটা পিছনে সরিয়ে হাসতে হাসতে বলে,"দেবো না।"
_ইয়াসার মির্জা ওটা আমার পার্সোনাল জিনিস।
ধমকের সুরে বলে ওঠে আলো।
_এটা আমার পার্সোনাল বৌয়ের পার্সোনাল জিনিস।
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন।
আলো থা/বা মে/রে নিতে যায় অ্যালবাম টা। সামিন দিতে নারাজ। একপ্রকার হাতা/হাতি লেগে যায় দুজনের মধ্যে। একসময় আলো কিছুটা সফল হয় অ্যালবামটা নিজের দিকে টেনে নিতে কিন্তু তৎক্ষণাৎ সামিন হ্যাচকা টা/ন মা/রতেই অ্যালবাম সহ আলো পরে যায় সামিনের গায়ে। হুট করে আলো পরে যাওয়ায় সামিন টাল সামলাতে না পেরে নিজেও পরে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় সামিনের চোখ দুটো রসগোল্লা সাইজের মতো বড় বড় হয়ে যায়। আলোর মাথা তার বুকে ঠেকে গিয়েছে। চুলের খোঁপা খুলে সামিনের মুখের ওপর ছড়িয়ে আছে।
ধীরে ধীরে হাত দিয়ে আলোর চুল গুলো সরিয়ে দেয়। আলো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কানে সামিনের হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে উঠে বসে ছবির অ্যালবাম আকরে ধরে মাথা নিচু করে বসে থাকে আলো। সামিন ধীরে ধীরে উঠে বসে আলোর নিচু করে রাখা মুখটার দিকে একপলক তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আলোকে আর অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না তাই সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে হন হন করে বারান্দার দরজা খুলে সেখানে চলে যায়।
বিছানার ওপর আলো কিছুক্ষণ থ/ম মেরে বসে ছিলো। ধীরে ধীরে সেও উঠে দাঁড়ায়। অ্যালবামটা আলমারিতে তুলে রেখে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে গায়ে চাদর টেনে।
দীর্ঘক্ষণ বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। একটু আগের ঘটনা মনে করে এখন মুচকি মুচকি হাসছে। সৃষ্টিকর্তা তার প্রতি বরাবরই সদয়। বৌ না চাইতেও বুকে এসে পরে। আহা কি কপাল তার!
একা একা কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে আবারো চেহারায় গাম্ভীর্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে সামিন, তারপর ঘরের ভেতরে গিয়ে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দেয়। ঘুরে বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে আলো ওদিকে ফিরে শুয়ে আছে। সম্ভবত ঘুমিয়ে গিয়েছে। সামিনও ধীরে ধীরে নিজের যায়গায় শুয়ে পরে। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে আবারও উঠে বসে। আশ্চর্য জনক ভাবে এই ঘরে ঢোকার আগে চোখে গোটা রাজ্যের ঘুম ছিলো। এখন সেই ঘুম নেই। বুকে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার আছিয়া তার বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। মাঝখানে দুটো কোলবালিশ একটার উপর আরেকটা সাজিয়ে রাখা। এই দুটো মাঝখান থেকে সরতে কতটা সময় নেবে কে জানে! তবে সামিন ইয়াসার মির্জা তার ধৈর্যের চূড়ান্ত পরিক্ষা দিতে প্রস্তুত। তার জীবনে আপাতত একটাই স্বস্তির ব্যাপার, আছিয়া তাকে তার মন জিতে নেওয়ার নমিনেশন দিয়ে দিয়েছে। এখন তাকে জিততেই হবে মন জয় করার নির্বাচন! কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াই নির্বাচন, তবুও জেতাটা সহজ নয়। এমন ভাবে সে জিততে চায় আছিয়াকে যে আছিয়া যেন নিজে এসে তাকে জয়ী ঘোষণা করে জয়ের মালা পরিয়ে দেয় তাকে।
সামিন কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মৃদু হাসে। আবারও তার কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পরে যায়। কতটা নাস্তানাবুদ হয়েছে ওই মেয়েটা। চেহারা টা দেখার মতো ছিলো! মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,"আজকের জন্য অতটুকু যথেষ্ট আছিয়া। আমি কৃতজ্ঞ তোমার প্রতি!"
[আজকের পর্বটা অনেক বড়, সবাইকে ফেসবুক লাইট থেকে না পড়ে সরাসরি মেইন ফেসবুক থেকে পড়ার পরামর্শ রইলো]
"কলিং বেল টিপে চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামিন। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে দেয় আলো। সামিন মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে,"বড্ড কেয়ার/লেস তুমি। স্বামীর বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে আর তুমি স্টার জলসা নিয়ে ব্যস্ত। এতো করে কলিং বেল টিপছি দরজা খোলার নামই নেই!"
আলো সামিনের থেকেও বিরক্ত হয়ে বলে,"ফালতু কথা বলবেন না। কে স্টার জলসা নিয়ে পরে আছে? আমার জীবন টা কি স্টার জলসার সিরিয়ালের থেকে কম কিছু? জীবন টা বরবাদ হয়ে গিয়েছে আমার আপনার মেয়েদের কে সামলাতে গিয়ে।"
সামিন আলোকে সরিয়ে দিয়ে বলে,"সরো তুমি সামনে থেকে। কই দেখি আমার প্রিন্সেস রা কোথায়!"
দূর থেকে ছোট ছোট দুজন পরীর মতো নয় বরং দুটো পরীই দৌড়ে এসে তাদের বাবাকে আঁকড়ে ধরে।
দু'জনের চোখে পানি ছলছল করছে। ঠোঁট উল্টিয়ে রেখেছে। সামিনের মাথায় রা/গ উঠে যায়, উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,"ও মা। আমার মায়েরা কাঁদছে কেন? কে কি বলেছে ওদের? কার এতো বড় সাহস!"
আলো পাত্তা না দেওয়ার মতো করে বলে,"আমি। আমার এতো বড় সাহস।"
_তুমি? তোমার সাহস কি করে হয়? কি করেছো ওদের?
_মে/রেছি। ঠাস ঠাস করে। দুই গালে দুটো। দুটোর গালে মোট চারটা।
কাট কাট বলে আলো।
সামিন চোখ রাঙিয়ে বলে,"সাহস কি করে হয় তোমার! কোন সাহসে এমন কাজ করলে?"
_যে সাহসে আপনাকে চ/ড় মেরেছিলাম একদিন।
সামিন তার মেয়েদের আগলে নিয়ে তাদের চু/মু দিতে থাকে। তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"কি করেছিলো ওরা? কেন মেরেছো?"
_একজন আরেকজনের চুল ছিড়ছিলো টেনে, থুতু দিচ্ছিলো।
সামিন তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,"এসব তো তোমার থেকেই পেয়েছে। এখন আমি তোমার দুই গালে দুটো দেই?"
আলো ভেংচি কেটে কপাল কুঁ'চ'কে চলে যায়। সামিন বিড়বিড় করে বলে,"বেয়া/দব মহিলা। স্বামীকে একটু মান দিতে চায় না।"
বাচ্চাদের কোল থেকে নামিয়ে আলোর দিকে এগিয়ে যায় সামিন। কপাল কুঁচকে আলো টেবিলে খাবার বাড়ছিলো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মৃদু স্বরে সামিন বলে,"রা/গ করলে?"
_না। ছাড়ুন আমায়। বাচ্চাদের সামনে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার হু/মকি দিচ্ছেন। খারাপ লোক।
সামিন আলোকে ঘুরিয়ে নেয়। দুই গালে হাত রেখে বলে,"কখন তোমাকে মা/রার কথা বললাম?"
_এই মাত্রই তো বললেন। বলেছেন আমার দুই গালে দুটো দেবেন।
সামিন হাসে, তারপর বলে,"দুই গালে দুটো দেবো বলেছি। কি দেবো তা তো বলিনি।"
আলো সরু চোখে তাকিয়ে বলে,"কি দেবেন?"
সামিন কয়েক পলক আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"দেখাচ্ছি।"
কথাটি বলেই সামিন ঠোঁ/ট বাড়িয়ে দেয়। আলো লজ্জা পেয়ে মুখ ঢেকে ফেলে।
ঝনঝন আওয়াজে সামিন চোখের পাতা মেলে তাকায়। চোখে রাজ্যের ঘুম। শব্দটা কানের ভেতরে যন্ত্রনার সৃষ্টি করছে। কিছু মুহূর্ত সময় নিয়ে সে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিলো তবে! বিরক্তিতে সামিন মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। তখনও ঝনঝন শব্দ হচ্ছিলো। এতো সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলো সামিন, মাঝ পথে ভেঙে গেলো, চু/মুটাও দিতে পারলো না। বিরক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। দেখে আলো আলমারির কাছে দাঁড়িয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।
সামিন ঘুম ঘুম কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলে,"এতো সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। তোমার কোনো অধিকার নেই এভাবে অন্যের স্বপ্ন
ভা/ঙার। ভাঙচুর করছিলে কেনো?"
আলো সামিনের দিকে একপলক তাকিয়ে ঝুঁকে নিচে পরে থাকা স্টিলের বক্সটা হাতে তুলে নেয়।
সামিন বলতে থাকে,"কি হলো? কি করছো?"
আলো হাতের বক্সটার দিকে তাকিয়ে বলে,"এটা কি?"
_ওটার মধ্যে তোমার গয়না।
আলো বক্সটার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন বিরক্ত হয়ে বসে থাকে। আড়চোখে আলোকে দেখে বিড়বিড় করে বলে,"আমার সুখ দেখতে পারে না এই ভদ্রমহিলা!"
আলো সামিনের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলে,"বিড়বিড় করে কি বলছেন?"
_তোমাকে গালাগাল দিচ্ছি। এতো সুন্দর একটা স্বপ্ন ভেঙে দিলে তাই।
বক্সটা আলমারিতে তুলে রেখে গম্ভীর কন্ঠে আলো বলে ওঠে,"তা কি এমন স্বপ্ন দেখছিলেন আপনি যে সেটা ভেঙে যাওয়াতে আমাকে এতো কথা শোনাচ্ছেন?"
গা থেকে চাদর সরিয়ে মেঝেতে পা রাখে সামিন। হাই তুলে ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যেতে বলে," বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড কা/প জিতেছে। ট্রফির গায়ে অধিনায়ক চু/মু খেতে যাচ্ছিলো। এটাই দেখেছি। তুমি
চু/মুটা আর খেতে দিলে না তাকে। কত অমানবিক তুমি। ভালো কিছু তোমার সহ্য হয়না।"
কথাটা বলে সামিন হেলে দুলে ওয়াশ রুমে ঢোকে। আলো চুপচাপ কপাল কুঁ'চ'কে দাঁড়িয়ে থাকে। কি আজব এই লোক। বাংলাদেশ সেদিন ম্যা/চ হেরে বাড়ি ফিরেছে। আর সে এখনো ওয়ার্ল্ড কাপের স্বপ্ন দেখছে!
"ভাবী আসবো?"
ফুলির মা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
আলো ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে," এসো।"
ফুলির মা আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে বলে,"আপনি তো গোসল করেননি। গোসল করে নিচে আসেন ভাবী। মেজো ভাবী আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। তার বাপের বাড়ি থেকে লোক এসেছে। আপনাকে দেখবে।"
আলো তৎক্ষণাৎ বলে,"চলো। আমি ফ্রেশ হয়েছি।"
ফুলির মা অবাক হয়ে বলে,"গোসল করবেন না?"
আলো বিরক্ত হয়ে বলে,"গোসল করানোর জন্য উঠে পরে লেগেছো কেন সকাল সকাল?"
পরক্ষনেই ফুলির মায়ের কথার অর্থ ধরতে পেরে আলো তে/তে ওঠে,"চলো নিচে চলো। বেশি কথা বলবে না।"
ফুলির মা মুখ অন্ধকার করে চলে যায়। বড় ভাইজান এ কোন মেয়েকে এনেছে সেই ভালো জানে। এই মেয়ের কোনো কান্ডজ্ঞান নেই।
***
নিচ তলার লিভিং রুমে রিতুর বাবা মোফাজ্জল করিম বসে আছে। সে একটা কাজে শহরে এসেছিলো। তাই মেয়ের বাড়িতে এসেছে। আলো নিচে নেমে লিভিং রুমের দিকে এগিয়ে যায়,রিতু উঠে দাঁড়িয়ে আলোকে বলে,"ভাবী আমার বাবা।"
আলো মুখ হাসি হাসি করে বিনয়ী ভঙ্গিতে সালাম দেয় । মোফাজ্জল করিম সালামের জবাব দিয়ে আলোকে বলে,"মা বসো!"
আলো "জ্বি" বলে বসে পরে। মোফাজ্জল করিম বলে,"তোমাকে রিতুর মায়ের দেখার খুব শখ ছিলো মা। ইয়াসার বাবার জন্য কত প্রস্তাব দেখেছি আমাদের এলাকায়। ইয়াসার বাবাকে রাজি করাতে পারিনি কখনোই। তাই রিতুর মা খুবই আগ্রহী ইয়াসারের বৌ দেখার জন্য। কিন্তু কপাল, বরাবরের অসুস্থতা তার। তাই আসতে পারেনি। কখনো আসবেও না।"
আলো চুপ করে থেকে বলে,"বাড়িতে গিয়ে রিতুকে ভিডিও কল দিবেন। আমি ওনার সাথে কথা বলবো চাচা।"
মোফাজ্জল করিম খুশি হয়। বড়লোকের বৌ, ভেবেছিলো কথাবার্তায় অহংকারী হবে। আলোকে যথেষ্ট বিনয়ী মনে হচ্ছে। সে তার পাশ থেকে একটা প্যাকেট উঠিয়ে আলোর দিকে ধরে বলে,"তোমার জন্য একটা শাড়ি এনেছি মা। গরীব মানুষ তো,স্বর্ন উপহার দেবার সামর্থ তো নেই।"
আলো কিছুটা অস্বস্তিতে পরে যায়, মুহুর্তেই কাটিয়ে নিয়ে বলে,"আমি খুব খুশি হয়েছি চাচা। আমি শাড়ি খুব পছন্দ করি।"
খাবার টেবিলে মোফাজ্জল করিমকে নিজের হাতে পরিবেশন করে খাওয়ায় আলো। রিতু যথেষ্ট স্বস্তি পাচ্ছে আলোর এমন স্বাভাবিক আচরণে। এখন ভাইয়াকে পুরোপুরি মেনে নিলেই হয়। রিতু তাহলে অনেক বড় চিন্তা থেকে মুক্তি পাবে।
সামিন এখনো নিচে নামেনি। শেভ করে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় মটকা মে'রে পরে ছিলো। আজ নতুন হাইস্কুল নির্মাণের প্রকল্প সংক্রান্ত ঝামেলা সামলাতে হবে। অথচ শরীরটা অলস হয়ে পরে আছে। নিচে নাস্তা করতে পর্যন্ত যায়নি। আলো সেই কখন নিচে গিয়েছে। এখনো ফেরেনি। নিশ্চয়ই এখনো খাচ্ছে। অনেক খায় এই মেয়ে। কিন্তু এর ওজন এতো কম কেন! খাবার গুলো কোথায় যায়!
কিছুক্ষণ বসে থেকে সামিন বারান্দায় চলে যায়। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে অলসতা কাটাবে সে।
ঘরে ঢুকে আলো হাতের শাড়ির প্যাকেট টা আলমারিতে তুলে রাখতে যাবে তখনি পেছন থেকে রিতু বলে ওঠে,"ভাবী।"
আলো ঘুরে তাকায়। রিতু এগিয়ে গিয়ে বলে,"একটা আবদার করবো?"
আলো অবাক হয়ে বলে,"কি আবদার?"
_যদি কিছু মনে না করো,বাবা যে শাড়িটা তোমাকে দিয়েছে সেটা একটু পরবে? বাবা দেখে গেলে খুব আনন্দিত হতো। শাড়িটার দাম পনেরো শ টাকা। বাবা আসলে হীনমন্যতায় ভুগছে এতো কমদামি শাড়ি দিয়ে। কি বলো তো, মাকে সপ্তাহে যে ইনজেকশন টা দিতে হয় তার দামই পনেরো শত টাকা।
আলো কিছুক্ষণ রিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"তুমি গিয়ে চাচার সাথে গল্প করো। আমি শাড়িটা পরে আসছি।"
রিতু কৃতজ্ঞ চোখে আলোকে দেখে চলে যায়। আলো এদিক ওদিক তাকিয়ে শাড়িটা বের করে ওয়াশ রুমে ঢোকে।
সকালের রোদ পেয়ে সামিনের অলসতা কেটে যায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বাগানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দোতলার বারান্দা থেকে পোনা চাচাকে ডেকে বাগানের ফুল গাছে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে ঘরে চলে যায়। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে দরজা ভেজিয়ে রাখা। আছিয়া এখনো ফেরেনি।
" নিজেই খাচ্ছে, স্বামী নাস্তা করুক বা না করুক তাতে তার কি! সুযোগ দিয়েছে এটাই তো অনেক। জগৎ উদ্ধার করে দিয়েছে মহারানী!"
বিড়বিড় করে বলে সামিন আলমারি থেকে নতুন একটা পাঞ্জাবি বের করে ওয়াশ-রুমে দিকে এগিয়ে যায়। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। আলো তার দিকে বোকার মত তাকিয়ে আছে। সামিন ও কয়েক মুহূর্ত বোকার মতো তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে আসে।
শাড়ির আঁচল ঠিক করে আলো রেগে/মেগে বেরিয়ে এসে সামিনকে বলে,"কমন সেন্স নেই কোনো?"
_তুমি দরজায় সিটকিনি লাগিয়ে নিতে পারোনি ? সিটকিনি কেনো থাকে দরজায়?
আলো ক্ষে/পে যায়,"সিটকিনি টা যে কাল লা/থি মে/রে ভেঙে ফেলেছিলেন সেটা ঠিক করেছিলেন? দরজা ঠিকভাবে লাগানো যাচ্ছে না।"
সামিন থতমত খায়। তাই তো। সেটা তো ঠিক করাই হয়নি। তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"সিটকিনির ব্যাপারে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলে না? আমি এই শহরের মেয়র। একটা মাথায় কত কিছু মনে রাখবো?"
আলো বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বলে,"নিজের ভুলের দোষ আমার ঘারে দেবেন না। সকালে ওয়াশ রুমে গিয়ে দেখেন নি সিটকিনি তে সমস্যা?"
_তখন তো ঠিক ছিলো।
_ছিলো না,আলগা হয়ে যাচ্ছিলো।
_হয়েছে। নাউ স্টপ। চেঁচিয়ে কথা বলো না, সবাইকে জানিয়ে দিও না আমি তোমাকে শাড়ি চেঞ্জ করার সময় দেখে নিয়েছি।
আলোর গায়ে আগুন ধরে যায় কথাটি শুনে। আলোর অগ্নি/মুর্তি দেখে সামিন ভয় পেয়ে বলে,"কিছু দেখিনি আমি। কিছুনা। আমি বলতে চাইছি চেঁচিয়ে এসব বললে মানুষ অমন ভাববে। প্লিজ রাগ করো না।"
_আপনি সাংঘাতিক লোক। আপনাকে যদু মধু ভাবলে ভুল হবে।
আলো ঠান্ডা গলায় বলে।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো বলতে থাকে,"আপনার আচরণ দেখে মনেই হয়না আপনার বয়স বত্রিশ বছর।"
_কেন? কি আচরণ করি আমি?
আলো কিছু না বলে চলে যেতে নিলে সামিন খপ করে আলোর হাত টেনে ধরে। আলো সামিনের মুখের দিকে তাকায়। সামিন বলতে থাকে,"শুধু আমাকেই দোষী করবে তুমি। তোমার যায়গায় আজ আমি ওয়াশ রুমে থাকলে, তুমি যদি এক্সিডেন্টলি ওভাবে ঢুকে যেতে তাহলে তো বলতে আমি ইচ্ছে করে ওয়াশ রুমের দরজা খোলা রেখেছি যাতে তুমি আমার সবকিছু দেখে যাও।"
আলো সামিনের কথায় হতভম্ব হয়ে যায়। সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"তোমার স্বভাবের ভুলটা ধরিয়ে দিলাম আছিয়া। শুধু অন্যের দোষ টাই দেখো তুমি। যাই হোক, আজ সত্যিই আমার ভুল ছিলো,ওয়াশ রুমে ঢোকার আগে নক করে বলা উচিত ছিলো,"শুনছেন কেউ কি ওয়াশ রুমে আছেন?"
নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা গুলো বলে সামিন।
আলো কিছু বলতে নেয়। সামিন আলোকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পাঞ্জাবি হাতে ওয়াশ রুমে ঢোকে। আলো চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মোফাজ্জল করিমের কাছে যায়।
***
নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ মোফাজ্জল করিমের সাথে কথা বলে সামিন রুমের দিকে পা বাড়ায়। বাইরে যাওয়ার আগে একটু বৌয়ের মুখ দেখবে না? কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ঝগড়া লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ঝগড়া করতে চায় না।
ঘরে ঢুকে চুপচাপ নিজের টেবিলের কাছে গিয়ে ল্যাপটপ বের করে কিছুক্ষণ কিছু একটা দেখে।
আলো বিছানায় চুপচাপ বসে ছিলো। সামিন আড়চোখে বেশ কয়েকবার আলোকে দেখে। তারপর আয়নার সামনে গিয়ে গায়ে পারফিউম মাখতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সামিনকে অবাক করে দিয়ে আলো বলে ওঠে,"সরি।"
সামিন অবাক, অবাক এবং অবাক হয়ে যায় আলোর মুখে সরি শব্দটা শুনে। সে অবাক চোখে আলোর দিকে তাকায়। আলো নিচু স্বরে বলে,"তখন ওভাবে আপনাকে ব্লেইম করা ঠিক হয়নি। দোষ আসলে কারো ছিলো না।"
সামিন আনন্দিত হয়ে যায় তার ঝগড়ুটে বৌয়ের এমন নমনীয় রুপ দেখে। কিন্তু সে কন্ঠ গম্ভীর রেখে বলে,"ইটস্ ওকে।"
আলো চুপচাপ বসে থাকে। কথা আগে বাড়াতে সামিন গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,"তোমার বইয়ের লিস্ট টা দিও। আনিয়ে দেবো। সেমিস্টার ড্র/প দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না। সবাই বলবে সামিন ইয়াসার মির্জার বৌ ফেলু, আদুভাইয়ের ছোটো বোন আদুরি আপা, এটা কিভাবে মানা যায়।"
আলো চুপচাপ। সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"এভাবে গুটিয়ে নেয়া টা তো কোনো সমাধান না আলো। দূর্ঘটনা সবার সাথে হয়। তাই বলে বারবার হতেই থাকবে এমন তো কোনো কথা নেই তাই না?"
আলো নিশ্চুপ। সামিন কয়েক মুহূর্ত আলোকে দেখে তার মুখোমুখি বসে। তারপর মৃদু স্বরে বলে," লাইফে নেগেটিভ ঘটনা ঘটতেই থাকবে আলো, জীবনের একটা অংশ সেসব। আমরা এড়িয়ে যেতে পারবো না , না আমাদের সেই ক্ষমতা আছে। যেটা আমাদের ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে সেটা হলো ঐ সকল নেগেটিভ জিনিসগুলোর মধ্যে থেকে পজিটিভ কিছু বের করে নিজেকে স্বস্তি দিয়ে লাইফটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।"
আলো সামিনের দিকে মুখ তুলে তাকায়, অস্ফুট স্বরে বলে,"এ/সি/ড এ্যা/টাকের মধ্যে কি পজিটিভ ছিলো?"
_পজিটিভ ছিলো না। ভাবতে হবে। এ/সি/ড তোমার মুখে পরেনি। গায়ে লেগেছে মাত্র । এটাই পজিটিভ কিছু।
_ঠিক যেমন সেদিন আমার বিয়ে হয়েছিল, রে/ই/প তো হয়নি, তেমন পজিটিভ কিছু?
সামিনের মাথায় প্রচন্ড রা/গ উঠে গেলেও সে চেহারায় তা প্রকাশ করে না । ম্লান হেসে আলোর একটা গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলে,"না কেউ আমার লাইফে শ/ত্রু হিসেবে এসে আমার জীবন টা আলোকিত করে দিয়েছে তেমন পজিটিভ কিছু।"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন গাল থেকে হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
আলো বসে বসে ভাবে, এই মাত্র সে সামিনের মেজাজ খারাপ করে দেওয়ার মতো একটা কথা বলে ফেলেছে, এই লোকটা কোনো রিয়াক্ট করলো না কেন!
ডক্টর রুবি ফোনটা রিসিভ করে বলে,"হ্যা সামিন বলো।"
_আন্টি সেদিন সাই/ক্রিয়া/টিস্টের কথা বলেছিলেন ওনার কাছে একটা এ্যাপয়েনমেন্ট চাই। কাইন্ডলি ব্যবস্থা করবেন?
_কেন নয়। তবে বলো তো কি হয়েছে?
_তেমন কিছু না আন্টি,আপনি যেরকম বলেছিলেন তেমন আচরণ করছে। গুটিয়ে থাকছে।
_সময় দাও ওকে, হয়তো সেরে উঠবে।
_না আপনি এপয়েনমেন্টের ব্যবস্থা করুন। আর হ্যা, আমি আলোকে নিয়ে ওনার বাসায় যেতে চাই, চেম্বারে নয়।
_কেন?
_আমার বৌ যদি জানতে পারে তাকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছি আমি তাহলে আমার নতুন সংসারে আগুন লেগে যাবে। ঐ মেয়েকে আপনি চেনেন না আন্টি। খুব আত্ম অহংকারী। সাইজে অতটুকু হলে কি হবে ওর আকাশ ছোঁয়া আত্মসম্মান।
রুবি হাসতে থাকে সামিনের কথায়। তারপর বলে,"ঠিকাছে। তেমনটাই হবে। আর ভালো কথা, সিঙ্গাপুরের ডক্টরদের সাথে কথা হয়েছে। তারা বলছে যত তাড়াতাড়ি যেতে পারো ততোই ভালো। আলোর পাসপোর্ট করা আছে?"
_বলতে পারছি না আন্টি।
_আচ্ছা ব্যাবস্থা করো। আমাকে তোমাদের সুবিধা মতো জানিও, আমি আবার কথা বলবো।
***
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে আলো ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। মাত্র গোসল সেরেছে সে, ভেজা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে রেখেছে। গায়ে একটা হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি। ইশিতা খেতে খেতে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"আমি এখন বুঝতে পারছি ভাবী, ভাইয়া কেনো তোমার জন্য পাগল হয়েছে।"
আলো কিছু না বলে চুপচাপ বসে পরে চেয়ার টেনে। ইশিতা বলতে থাকে,"এতো সুন্দরী হয়েও তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিলো না? বেশ অবাক লাগে।"
আলোর চোখ মুখ ফ্যা/কাশে হয়ে যায়। সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"খাবে না তুমি?"
রিতু মাথা না'ড়ি'য়ে বলে,"ভাইয়া আসুক। আমি ভাইয়ার সাথে খাবো।"
আলো অবাক হয়ে বলে,"প্রেগ/ন্যান্ট তুমি! বেলা আড়াইটার কাছাকাছি। এখনো বসে আছো?"
_ভাইয়া একা একা খেতে পারেন না।
_তাই বলে প্রেগ/ন্যান্ট অবস্থায় অনিয়ম?
"তুমি তো প্রেগ/ন্যান্ট না। তুমি অপেক্ষা করো। ভাইয়া আসলে খাও ভাবী।"
ইশিতা খেতে খেতে বলে। আলো ইশিতার দিকে তাকিয়ে থাকে, ইশিতা হাত ধুয়ে উঠে পরে, আলোর দিকে না তাকিয়ে বলতে থাকে, "সকাল থেকে কিছু খাইনি। তাই আমি জলদি জলদি খেয়ে নিলাম। নয়তো আমি অপেক্ষা করতাম। এখন তোমরা দুই ভাবী মিলে ডিসাইড করো কে অপেক্ষা করবে। দেখো সাফ সাফ বলে দিলাম,একজনকে অপেক্ষা করতেই হবে।"
আলো ইশিতার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে দোতলায় চলে যায়। রিতু ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"এতে কাজ হবে? স্বামীর পাশে বসে খেলেই কি স্বামীর প্রতি ভালোবাসা জন্মায়?"
_নাহ,অভ্যাস জন্মায়। অভ্যাস থেকে কখনো কখনো ভালোবাসা জন্মায়।
ইশিতা কথাটি বলে দোতলায় চলে যায়। রিতু বসে খেতে থাকে।
***
অতি সতর্কতার সাথে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে সামিন। ঐ মেয়েটার অন্যকে যেভাবে দোষারোপ করার স্বভাব আবার কি না বলে বসে,"এভাবে হুরমুর করে ডা/কাতের মতো ঘরে ঢুকছেন কেন? কি লু/ট করতে চান?"
ঘরে ঢুকে আড়চোখে একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে সামিন ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে হাত ঘড়ি খুলে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে দেয়। আলোর সাথে কথা বলার বাহানা খুঁজতে থাকে সে। একমনে একটা বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে আলো। কিছুক্ষণ উ'শ'খু'শ করে বলে ওঠে,"সিটকিনি ঠিক করে দিয়েছে মিস্ত্রী?"
"হ্যা!"
তৎক্ষণাৎ এক শব্দে জবাব দিয়ে দেয় আলো। সামিন এখন কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। মেয়েটা নিজে থেকে দুটো কথা বলে না, যেটুকু বলে তা সামিনের হৃদয় পো'ড়া'তে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামিন আবারও বলে,"আবার সিটকিনিতে ঝামেলা হলে বলবে!"
আলো অবাক হয়ে বই থেকে মুখ তুলে সামিনের দিকে তাকায়,"সিটকিনি নিয়ে পরেছেন কেন?"
সামিন থতমত খেয়ে যায়। আলো বই সরিয়ে রেখে বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে,"হাত মুখ ধুয়ে আসুন।"
_কোথায় আসবো?
_নিচে, খাবার টেবিলে!
_হ্যা তো? তাতে তোমার কি? আমার ইচ্ছা মতো আমি যাবো।
আলো চুপ করে সামিনকে কিছু সময় দেখে বলে,"ধেরে খোকা বানিয়ে রেখেছে না আপনাকে আপনার মা? একা একা খেতে পারেন না, ঢং! "
_তোমাকে দেখতে কে বলেছে। তুমি তোমার মতো খাও দাও আরাম করো।
_আপনার বোনের হুকুম। কাউকে না কাউকে অপেক্ষা করতে হবে। রিতুকে প্রেগ/ন্যান্ট অবস্থায় কিভাবে অপেক্ষা করতে দিই।
সামিন আলোর দিকে এগিয়ে এসে আলোকে ভালো করে দেখে, তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,"বাবা! এতো ভালো হলে কবে!"
আলো কপাল কুঁ'চ'কে বলে,"বাজে না বকে খেতে আসুন।"
কথাটি বলে আলো ঘুরে দাড়াতেই সামিন খপ করে আলোর হাত ধরে ফেলে। আলো সেদিকে তাকায়। সামিন আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,"আমি কেউ পাশে না থাকলে খেতে পারি না। খেয়ে দেয়ে আমার পাশে বসে থাকবে। আমার জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করার দরকার নেই।"
কিছুক্ষণ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো ধীরে ধীরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিচে চলে যায়। সামিন তার পিছু পিছু যায়।
***
কতক্ষন ঘুমিয়েছে তা সে জানে না। অনিচ্ছাকৃত ভাবে ভাতঘুম হয়ে গিয়েছে আজ। বিকেলে ঘুমিয়ে উঠলে কম-সে-কম একঘন্টা তার লেগে যায় এটা বুঝতে যে এখন সকাল নাকি রাত। মাথার মধ্যে অদৃশ্য কোনো পোকা ভো ভো করে। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দিয়ে ঘর থেকে বের হয়। ইয়াসার মির্জা কোথাও বেরিয়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলার লিভিং রুমে দাড়িয়ে পরে আলো। ইশিতা,রিতু, সিতারা, ফুলির মা লিভিং রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে কিছু একটা দেখছে। আলো এগিয়ে যায় ওদের কাছে।
"কি হয়েছে আপু?"
ইশিতা আলোর ডাকে পিছু ফিরে তাকায়। আলো এগিয়ে যায়। শান্তিনীড়ের পশ্চিম পাশের বাগানে লোকজন জড়ো হয়েছে। গোল করে কিছু চেয়ার পাতা। তার একটাতে বসে আছে সামিন ইয়াসার মির্জা। তার পাশে কিছু মুরব্বি শ্রেনির লোক। প্রচুর লোকজন জড়ো হয়েছে। দুজন অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
আলো ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"কি হচ্ছে এখানে?"
_ সালিশ বৈঠক।
আলো অবাক হয়ে যায়,"কিসের সালিশ?"
_ঐ ছেলে মেয়ে দুটোকে দেখছো? ওরা স্বামী স্ত্রী। ওই মেয়েটা নিয়মিত স্বামীর হাতে মা'র খায়। অথচ ওদের প্রেমের বিয়ে।
_তাহলে ডি'ভোর্স নিয়ে নিক। এখানে মেয়রের কাছে কি? মেয়র কি ডি'ভোর্স লইয়ার?
ইশিতা আলোর দিকে তাকায়। তারপর বলে,"মেয়ে তার স্বামীকে ছাড়বেও না।"
আলো অবাক হয়ে যায়। ইশিতা বলতে থাকে,"ওদের দুজনের বাবা মা এসেছে ভাইয়ার কাছে একটা বিহিত করে দেওয়ার জন্য।"
_তোমার ভাইয়া কি বিহিত করবে?
_দেখোই না।
আলো তী'ক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। সামিন গলা উঁচু করে ছেলেটাকে ধ'ম'কে যাচ্ছে। মিইয়ে গিয়েছে ছেলেটা।
"এতো কথা কেন বলছেন, অমন স্বামীর কান মলে দিন লোকের সামনে, ল'জ্জা দেওয়া দরকার উজবুকটাকে।"
আলো কথা টা বলে শেষ করতে পারে না, ইশিতা আলোর মুখ চেপে ধরে।
সামিন সহ সালিশে থাকা প্রত্যেকটা লোক অবাক হয়ে দোতলার বারান্দার দিকে তাকায়। ইশিতা আলোকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে যায়।
সালিশে উপস্থিত থাকা মুরব্বিরা সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"বৌমা তো তোমাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।"
***
"অমন স্বামী বলতে তুমি কি বোঝাতে চেয়েছো?"
সামিনের কথায় ঘুরে তাকায় আলো। তারপর নিচু স্বরে বলে,"সালিশে কি বিচার হয়েছে?"
_মা'রতে উঠেছিলাম। বৌ এসে বাংলা সিনেমার লক্ষী বৌয়ের মতো স্বামীকে রক্ষা করেছে। শেষ বারের মতো মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে দু'জনকে।
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলে,"বললে না তো,অমন স্বামী বলতে কি বুঝিয়েছিলে তখন?"
_খা'রাপ স্বামী!
আলো অস্ফুট স্বরে বলে ।
সামিন আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,"খারাপ স্বামীদের কান মলে দেওয়া উচিত , আর খারাপ বৌদের কি করা উচিত?"
আলো চোখ তুলে তাকায়। সামিন আরেকটু এগিয়ে এসে বলে,"বলো কি করা উচিত খারাপ বৌদের সাথে?"
আলো চুপ করে থেকে সামিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় সামিনের কথার জবাব না দিয়ে।
সামিন একা একা কিছুক্ষণ হেসে বিড়বিড় করে বলে,"খারাপ বৌদের শা'স্তি দেওয়া উচিত। ভালোবাসার শা'স্তি!"
***
পিঠের কিছু কিছু স্থানে ঘা পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি। একটা মলম হাতে আলো দাঁড়িয়ে আছে। একা একা মলমটা লাগানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
আচমকা সামিন ঘরে ঢুকতে আলো ঘুরে দাঁড়ায়। তার পুরো মুখ অস্বস্তিতে ছেয়ে গিয়েছে। সামিন একপলক আলো আর তার হাতের মলম টা দেখে নিচু গলায় প্রশ্ন করে,"কাউকে ডেকে দেবো?"
_হু। ইশিতা আপুকে।
অস্ফুট স্বরে বলে আলো।
সামিন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইশিতাকে পাঠিয়ে দেয়।
ইশিতা আলোর ঘরে এসে বলে,"ডেকেছিলে ভাবী?"
_হু, মলমটা পিঠে লাগিয়ে দাও।
ইশিতা এগিয়ে যায়। মলম লাগিয়ে দিতে দিতে হুট করে বলে বসে,"ভাইয়াকে বললেই তো পারতে। সে লাগিয়ে দিতো।"
আলো কপাল কুঁ'চ'কে ইশিতার দিকে তাকায়। ইশিতা হাসতে হাসতে বলে,"রাগলে তোমাকে আরো আরো বেশি সুন্দর লাগে ভাবী। এখন ভাইয়ার সামনে যেও না। ভাইয়া আরো পাগল হয়ে যাবে।"
ইশিতা হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়। আলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বারান্দায় চলে যায়।
সামিন ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে আলোকে দেখতে না পেয়ে আলমারির কাছে যায়। আলমারি থেকে কোলবালিশ বের করে এনে বিছানার মাঝখানটাতে রাখতে রাখতে বিরবির করে কোলবালিশ দুটোকে উদ্দেশ্য করে বলে,"স্বামী স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় পক্ষ হয়ে ঢুকতে তোদের লজ্জা করে না?"
আলো বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে সামিনের কান্ড দেখে অবাক হয়। বলে,"কাকে কি বলছেন?"
সামিন থতমত খেয়ে বলে,"নিজেকে।"
আলো কিছু না বলে বিছানায় শুতে যাবে অমনি সামিন বলে,"তোমার পা/স/পো/র্ট আনিয়ে রেখেছি নিজের কাছে।"
আলো তার দিকে তাকিয়ে বলে,"কেনো? কোন কাজে?"
_সা/র্জা/রির জন্য সিঙ্গাপুর যাবো আমরা। তোমার ওখানে সা/র্জারি হবে।
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলে,"তোমার শরীরের ক্ষ/ত ভ্যানিশ হয়ে যাবে। খুব শিগগিরই।"
_আর মনের ক্ষ/ত?
প্রশ্নটি করে আলো তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে।
সামিন কিছুক্ষণ পরে বলে,"মনের ক্ষ/ত? তার দায়িত্ব আমি নিলাম। দেখি কি করা যায়, ভাবতে দাও, সামিন ইয়াসার মির্জাকে সময় দাও আছিয়া।"।
[বড় পর্ব অতএব সবাই সরাসরি মেইন ফেসবুক থেকে পড়বেন]
বসার ঘরের সর্বত্র শৌখিনতার ছোঁয়া। আলো মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখছে। বোঝাই যাচ্ছে বসার ঘরটি যে সাজিয়েছেন সে বেশ রুচিশীল একজন ব্যক্তি। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরের সবটা দেখছে আলো আর সামিন দেখছে আলোকে। একসময় দু'জনের চোখাচোখি হয়ে গেলে সামিন চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজের ফোন ঘাটতে শুরু করে । আলো গম্ভীর কন্ঠে বলে," সাত সকালে কোথায় এনেছেন আমায়?"
_আমার পরিচিত এক লোকের বাসায়। বন্ধু হয়।
_এখানে আমার কাজ কি?
_তুমি আমার স্ত্রী। তাই আমার সাথে এসেছো।
আলো আবারো কক্ষ পরিদর্শনে মনোযোগী হয়। হঠাৎ দেয়ালের একটা পেইন্টিং -এ চোখ পরতেই আলো চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে। পেইন্টিং-এ চুম্বনরত এক প্রেমি যুগলের অবয়ব ফুটিয়ে তুলেছে শিল্পী তার রং তুলির কারসাজি দিয়ে। এতক্ষণ বাড়ির মালিককে আলো মনে মনে যত প্রশংসা করেছিলো তার রুচিবোধ নিয়ে, পেইন্টিং টা দেখে সাথে সাথে সব ফিরিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করে আলো বলে,"অ'স'ভ্য।"
সামিন আলোর পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পেরে ঠোঁট টিপে হাসে। আলো চুপচাপ বসে থাকে। ভেতর থেকে একজন পঞ্চাশোর্ধ লোক এসে সামিনের সাথে হ্যান্ডশেক করে কিছু সৌজন্য আলাপ করতে থাকে। আলো লোকটাকে ভালো করে লক্ষ্য করে, লোকটার মাথার সমস্ত চুল সাদা হয়ে গিয়েছে কিন্তু চেহারায় এখনো তারুণ্য ধরে রেখেছে বেশ।
লোকটা আলোর মুখোমুখি বসে আলোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ইংরেজিতে আমেরিকান উচ্চারণে বলে,"হ্যালো আলো, আমি ফজলে রাব্বী। তোমার হাসবেন্ডের বন্ধু।"
আলো বেশ অবাক হয়। এতো বুড়ো লোক ইয়াসার মির্জার বন্ধু!কপাল কুঁ'চ'কে লোকটার হাতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"আসসালামুয়ালাইকুম।"
সামিন মুগ্ধ চোখে তার বৌকে দেখে দেখতে থাকে। সে আবারো নতুন করে তার বৌয়ের প্রেমে পরে গিয়েছে।
আলোর আচরণে লোকটার ঠোঁট প্রশ্বস্ত হয়ে যায় হাসিতে। নিজের হাত ফিরিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,"ওয়ালাইকুমুস সালাম।"
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন তাকে কেনো এখানে এনেছে বুঝতে পারছে না সে। কিন্তু সে প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে।
লোকটা মৃদু স্বরে বলে ওঠে,"তুমি ভীষণ সুন্দর একজন মেয়ে আলো। সামিন খুবই লাকি।"
আলো চোখ বড় বড় করে লোকটাকে দেখে, পেইন্টিং টা দেখেই বাড়ির মালিকের চরিত্র সম্পর্কে ধারণা হয়েছিলো তার। এখন তো দেখছে সত্যিই এই লোকের ছুক ছুক ভাব আছে।
আলো বিড়বিড় করে বলে,"বুড়ো ভাম।"
সামিন চ'ম'কে উঠে আলোর দিকে তাকায়। ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,"স্টপ আলো। এখানে শুরু হয়ে যেও না।"
লোকটা ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,"তোমরা নিজেরা নিজেরা কি বলছো? দেখো রো'মা'ন্স করতে চাইলে আমাকে বলতে পারো আমি তোমাদের প্রাইভেসির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।"
আলো লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়, চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"আপনি এসব কি বলছেন?"
সামিন আলোর হাত টেনে ধরে বসিয়ে দেয়। লোকটা মৃদু হেসে "আলিজা" সম্বোধনে কাউকে ডাকতে থাকে। ভেতর থেকে একজন চল্লিশোর্ধ বিদেশি মহিলা বেরিয়ে আসে। ফজলে রাব্বী তার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বলে,"তোমাকে বলেছিলাম না হানি আমার বন্ধু সামিনের কথা? ও হচ্ছে সামিন এবং ও তার সহধর্মিণী আলো।"
আলিজা নামের ভদ্রমহিলা মুচকি হেসে আলোর দিকে তাকিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,"হ্যালো এ্যালো।"
সামিন ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,"মিসেস রাব্বী ওটা এ্যালো নয়, আলো। আলো মানে লাইট।"
আলিজা নিজেকে শুধরে নিয়ে আবারো আলোর সাথে কুশল বিনিময় করে। ফজলে রাব্বী আলোকে উদ্দেশ্য করে বলে,"আলো,এই হচ্ছে আমার সহধর্মিণী আলিজা। আমেরিকা থেকে যাকে চুরি করে এনেছি আমি।"
আলিজা রাব্বির গাল টেনে দুষ্টুমির সুরে বলে,"ওও হানি, কি যে বলো না তুমি।"
আলো আর সামিন দুজনে চোখ বড়বড় করে রাব্বী আর আলিজা দম্পতির লুতু পুতু আলাপচারিতা দেখতে থাকে। এতো বুড়ো বয়সেও দুজনে কত রোমান্টিক । ফজলে রাব্বী সামিন আর আলোর দিকে তাকিয়ে একটা প্রশ্বস্ত হাসি দেয়। তারপর আলোকে বলে,"সামিনের সাথে আমার কিছু কথা আছে আলো। অনেক দিন পরে দেখা তো, তুমি বরং আলিজার সাথে যাও। ও তোমাকে আমাদের গার্ডেন টা ঘুরিয়ে দেখাবে।"
আলো ভাবে,সেটাই ভালো। এখানে থাকার চেয়ে। তাই সে আলিজার সাথে চলে যায়।
সামিনকে সোফায় বসার নির্দেশনা দিয়ে ডক্টর ফজলে রাব্বী নিজেও বসে পরে। সামিন চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,"ওর সাথে আলাদা করে কথা....."
_প্রয়োজন হবে না।
_তাছাড়া বুঝবেন কিভাবে সমস্যা?
_বুঝে ফেলেছি।
সামিন অবাক হয়। ডক্টর ফজলে রাব্বী বলে,"যখন ফোনে তুমি সমস্যার কথা জানিয়েছিলে আমি তখনই ধরে ফেলেছি।"
_তাহলে ওকে নিয়ে আসতে বললেন যে?
ডক্টর ফজলে রাব্বী মৃদু হেসে বলে,"আমি আর আলিজা রুবির মুখে তোমার এতো এতো প্রশংসা শুনেছি যে, আমাদেরও খুব ইচ্ছে হলো ঐ ভাগ্যবতীকে দেখার যে সামিন ইয়াসার মির্জার মন চুরি করেছে। তাই তোমাদের দুজনকে ডেকে নিলাম!"
সামিন ম্লান হাসে। ডক্টর ফজলে রাব্বী বলে,"শোনো সামিন,অযথা চিন্তা করবে না। তোমাকে যেটা করতে হবে তা হলো তোমার স্ত্রীকে জীবনমুখী করতে হবে।"
_জীবনমুখী?
_ওকে বোঝাতে হবে ও কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। প্রতি মুহূর্তে ওর গুরুত্ব ওর চোখে দেখিয়ে দেবে তুমি। বুঝতে পেরেছো আমার কথা?
সামিন কিছুক্ষণ ডক্টর ফজলে রাব্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ায়।
***
"এখানে কেনো এনেছিলেন? এখানে কি কাজ?"
সামিনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আলো। সামিন ড্রাইভ করতে করতে বলে,"একটা বিশেষ কাজে। আমার ঐ বন্ধুটি একজন সোস্যাল এক্টি/ভিস্ট। সে একটা এজেন্সি খুলতে চাচ্ছে নারীদের কল্যাণে সে ব্যাপারেই কথা বলতে। ভাবলাম তুমি গৃহবন্দী হয়ে পরে আছো তোমাকে কোথাও নিয়ে যাই। তা গার্ডেন কেমন লাগলো? বসে বসে দোল খাচ্ছিলে দোলনায় দেখলাম।"
_ভালো লেগেছে।
শুকনো গলায় জবাব দেয় আলো। সামিন বলতে থাকে,"একজন পঞ্চাশোর্ধ বুড়ো আমার বন্ধু কিভাবে হলো, অস্বাভাবিক লাগছে না তোমার কাছে বিষয়টা?"
_না।
আলো ঠান্ডা গলায় বলে।
সামিন বলে,"কেনো?"
_কারন আপনিও তো বুড়ো।
সামিন হুট করে গাড়ির ব্রেক কষে দেয়। আলো ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে। সামিন হতবাক হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"আমি বুড়ো?"
_হ্যা। বত্রিশ বছর কি কম নাকি? বুড়োই তো। আপনার আর আমার বয়সের ব্যবধান জানেন? ছয় বছর। আমার বার্থ সার্টি/ফিকেটের বয়স ধরলে আটবছর।
_ছয় বছর কোনো ব্যাবধান না। এটা পারফেক্ট।
সামিন দৃঢ় ভাবে বলে।
_তাই না ছাই। আপনি বুড়ো, আর আমি এখনো ছয় বছর পর বুড়ি হবো। ব্যাবধান না? অনেক ব্যাবধান।
সামিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে,"তোমার কোন এ্যাং/গেল থেকে মনে হয়েছে আমি বুড়ো? আমার চুল পেকেছে? আমার শ্বাস/কষ্ট রোগ আছে? আমার স্কিন কুঁচকে গিয়েছে? তুমি জানো এখনো ক্লাস ইলেভেনের মেয়েরা আমাকে সপ্তাহে দুটো প্রেমপত্র পাঠায়। তোমাদের কলেজেরই তো ওগুলো।"
আলো সরু চোখে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"খুব আনন্দ হয় তখন তাই না? নিজের পুরুষ মন গর্বে ভরে যায়? শুনুন,ঐ সব মেয়েদের রুচিতে সমস্যা।"
সামিন হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে আছে। সব মেনে নেয়া যায় কিন্তু সামিন বুড়ো এটা সে কোনোভাবেই মানবে না। এতো বড় কথা বলে অপমান করে দিলো এই মেয়েটা! বুকে সুক্ষ্ম যন্ত্রনা হচ্ছে সামিনের। মুখ ভার করে স্টি/য়ারিং-এ হাত দিয়ে বসে আছে।
আলোর এখন বেশ হাসি পাচ্ছে সামিনের অবস্থা দেখে। সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে।
বরাবরের মতো অপমান হজম করে নিয়ে সামিন গাড়ি স্টার্ট করে। আলো কিছুক্ষণ ঠোঁট টিপে হেসে নিয়ে হুট করে বলে ওঠে,"পাঁচ বছরের ব্যাবধান। ভুল বলেছি।"
সামিন কপাল কুঁচকে ড্রাইভ করতে থাকে। এতো বড় অপমান করে এখন সেধে সেধে কথা বলতে এসেছে।
আলো মনে মনে ভাবে,লোকটা হয়তো বেশিই অপমানিত হয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"চার বছরের ব্যবধান।"
সামিন নিশ্চুপ। আলো বলতে থাকে,"না না, তিন বছরের ব্যাবধান, না দুই বছরের ব্যাবধান, আরে না না এক বছরের!"
সামিন চুপ করেই থাকে। আলো বলে ওঠে,"আরে কোনো ব্যাবধানই নেই। আমার বয়সও বত্রিশ বছর।"
সামিন আবারো ব্রেক কষে আলোর দিকে তাকায়। আলো চুপচাপ বসে থাকে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"চুপ করে বসে থাকবে একেবারে। ঐ ঠোঁট নেড়ে আর একটা কথা বলে আমাকে কষ্ট দিলে আজ ভয়ংকর কিছু হয়ে যাবে।"
অন্যসময় হলে আলো মুখে মুখে উত্তর দিয়ে দিতো, কিন্তু এইমাত্র সামিনের কথায় সে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছে। তাই চুপচাপ বসে থাকে। সামিন গম্ভীর মুখে আবারো গাড়ি স্টার্ট করে।
***
সকাল থেকেই বৃষ্টি। আলো বৃষ্টি খুব একটা পছন্দ করতো না কিন্তু এখন বৃষ্টিময় দিন তার খুব একটা খারাপ লাগেনা। সারাদিন শাড়ি চুড়ি পরে ঘরেই তো পরে থাকে সে। জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে তার বেশ লাগে।
"ভাবী আসবো?"
সিতারা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, আলো ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,"এসো।"
সিতারা একটা ঝুড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"ভাইজানের জামাকাপড় কি কি ধুতে হবে দিন ভাবী। ওয়াশিং মেশিনে দেবো।"
আলো অবাক হয়ে বলে,"তোমার ভাইজানের কি কি ধুতে হবে তা আমি কিভাবে জানবো?"
সিতারা আলোর থেকেও বেশি অবাক হয়ে যায়। আলোকে সে দায়িত্ব জ্ঞানহীন স্ত্রী হিসেবে জানে কিন্তু স্বামীর প্রতি এতোটাই উদাসীন যে সামান্য তথ্য টুকুও দিতে পারছে না।
ইশিতা ঘরে ঢোকে। একবার সিতারা আর একবার আলোর দিকে তাকিয়ে সবটা বুঝতে পেরে সিতারা কে বলে,"ভাইয়ার যা ধুতে হবে তা ডানপাশের আলমারিতে রাখে। ভুলে বসে আছো নাকি?"
সিতারা সামিনের জামাকাপড় নিয়ে যায়। আলো দাঁড়িয়ে আছে। ইশিতা আলোর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"ভাইয়া স্বামী হিসেবে তোমার মন জয় করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে, আর এদিকে তুমি নিজেকে কারো বিবাহিতা স্ত্রীই ভাবছো না। ভাইয়া একা একা সম্পর্কটাকে কি সুন্দর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কতটা যত্ন করে তোমাকে।আমি আমার ভাইয়াকে নিয়ে গর্ব করি।"
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুকনো গলায় বলে,"আচ্ছা কাল থেকে তার জামাকাপড় আমি ধুয়ে দেবো।"
ইশিতা কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যায়।
আলো বিছানায় চুপচাপ বসে থাকে,"আসলেই কি সে ভুল করছে?"
কবির আলমগীরের বাস ভবনে পার্টির মিটিং বসেছে আজ। পার্টির সভাপতি কবির আলমগীর সবার সাথে আলোচনা শেষ করে এসে সামিনের সামনে বসে। সামিন তার দিকে তাকিয়ে আছে। কবির আলমগীর বলে,"তুমি কি বুঝতে পেরেছো কতটা নাকানিচোবানি খাইয়েছো তুমি আমাদের। তোমার মতো একজনের কাছ থেকে এমন অপেশাদারের মতো আচরণ আশা করিনি সামিন।"
সামিন চুপ করে থাকে। অন্যরাও সবাই চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরে গম্ভীর কন্ঠে সামিন বলে ওঠে,"দলে আমার স্থান আছে কি নেই সেটা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হোক। এমনিতেও আমার কাছে দেশের সেবা করাটা মূখ্য বিষয় কোনো দলের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকাটা নয়।"
কবির আলমগীর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"দল তোমাকে রেখেছে। তোমার মতো ডেডিকেটেড লোক কজনই বা আছে!"
সামিন চুপ করে বসে আছে, কবির আলমগীর বলতে থাকে,"এসব কি বৌয়ের জন্য হয়েছে তোমার? আতাউর আলমের মেয়ে? আমাদের বৌমার জন্য?"
সামিন কোনো কথার জবাব না দিয়ে তাকিয়ে আছে শুধু, কবির আলমগীর বলে,"মেয়ে মানুষকে দুর্বল প্রজাতি ভাবা সামিন ইয়াসারের এহেন পরিণতি খুবই অবাক করছে আমাকে। বৌয়ের প্রতি অল্প কদিনেই বেশ দুর্বল হয়ে গিয়েছো দেখছি! বেশ বৌ পাগলা হয়েছো।"
সামিন ম্লান হেসে বলে,"সবকিছু আপনাদের দেখেই তো শিখেছি আংকেল!"
কবির আলমগীর থতমত খেয়ে যায়। সামিন সালাম জানিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পার্কিং লটে এসে দেখা হয়ে যায় কবির আলমগীরের ভাগ্নী জুঁইয়ের সাথে। খুবই ছোটোখাটো একটা পোশাক পরে উ/শৃঙ্খল ভাবে হেঁটে আসছে। সামিন কপাল কুঁচকে চোখ সরিয়ে নেয়, রিতুর পায়ের নখের যোগ্যতা নেই এই মেয়েটার। ফালতু মেয়ে!
দুপুরে সামিন কাকভেজা হয়ে বাড়িতে ফেরে। ঘরে ঢুকে আলমারি থেকে তোয়ালে বের করে মাথা মুছতে থাকে। আলো দাঁড়িয়ে যায়। সামিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমতা আমতা করে বলে,"গাড়ি থাকতে এতো ভিজেছেন কিভাবে?"
সামিন আলোর প্রশ্ন শুনে অবাক হয়, এ আবার আগ বাড়িয়ে সামিনের কথা জানতে চাইছে কেনো! সূর্য কোনদিকে উঠেছে আজ! সারাদিন তো এমন ভাব করে যেন সামিনকে সে দেখতেই পায়না, সামিন অদৃশ্য কেউ!
স্বাভাবিক গলায় সামিন বলে," আজ বৃক্ষ রোপন কর্মসূচী ছিলো। দলের সাথে ভিজে ভিজে গাছ লাগিয়েছি শহরের বিভিন্ন সড়কের পাশে। "
আলো চুপ করে থাকে। সামিন নরম গলায় বলে,"খেয়েছো?"
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন হাঁচি দিতে দিতে তোয়ালে রেখে ওয়াশ রুমে ঢোকে।
বিকেলের দিকে বৃষ্টি চলে গিয়েছে, আকাশ টা ভীষণ সুন্দর হয়ে উঠেছে। আলো বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের ঐ সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকে।
সামিন অসময়ের বৃষ্টিতে যখন ভিজছিলো তখনই বেশ বুঝতে পেরেছিলো গায়ে জ্বর আসতে চলেছে। সামিনের ধারণা ঠিক, তার গায়ে বিকেলের দিকে জ্বর এসেছে। আজ বিকেলে পার্টি অফিসে মিটিং ছিলো, সে যেতেই পারেনি। বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে বসে, আলোকে কোথাও দেখতে না পেয়ে সামিন বিছানা থেকে নামে। খুবই বিরক্তিকর এই বৌটা। সামিনকে এড়িয়ে থাকতে পারলেই যেন বাঁচে। কেন? সামিন কি তাকে খেয়ে ফেলবে নাকি?
শরীর কাঁপছে। চোখ জ্বালা করছে, নাক দিয়ে গরম নিঃশ্বাস বের হচ্ছে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে ড্রয়ার থেকে একটা প্যারাসিটামল বের করে খেয়ে নেয়। ইশিতা বাড়িতে নেই! রিতুকে ডাকবে? কিন্তু মেয়েটা নিজে অসুস্থ হয়ে কতদিক সামলাবে!
হঠাৎ করে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলে সামিনের হাত থেকে গ্লাস টা পরে যায় নিচে।
মেঝের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সামিন ঝুঁকে বসে, নিজেই পরিস্কার করতে থাকে কাঁচের টুকরো গুলো।
আলো কিছু একটা ভাঙার আওয়াজ শুনেও দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর কি মনে করে হন হন করে ঘরের দিকে যায়।
বারান্দার দরজা থেকে আলোর আকস্মিক আগমনে সামিন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ততক্ষণে আলো কাঁচের টুকরাতে পা দিতেই যাচ্ছিলো।
হঠাৎ মৃদু আর্তনাদ শোনা যায়।
কয়েক মূহুর্ত কেটে যায়। আলো চোখ বড় বড় করে সামিনের দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে। যন্ত্রনায় ফরসা মুখ টা নীল রঙের হয়ে গিয়েছে সামিনের। ধীরে ধীরে আলো বুঝতে পারে তার পা সামিনের হাতের উপর। মেঝের দিকে তাকিয়ে কাঁচের টুকরো গুলো দেখতে পেয়ে লাফিয়ে পিছিয়ে যায় আলো।
সামিন নিজের ডান হাতের পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁচের টুকরো ঢুকে ক্ষত/বিক্ষত হয়ে গিয়েছে হাত টা। র/ক্ত ঝরছে খুব। আলো যখন কাঁচের টুকরোতে পা দিতে যাচ্ছিলো তার আগে সামিন নিজের হাত রেখে দেয়। আলোকে সতর্ক করার সময়টুকু যে তখন ছিলো না।
বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ আলো। সামিন গায়ে জ্বর নিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়।
আলোর দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলে,"জংলি বিড়ালের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে হাটো তুমি আছিয়া।"
আলো এগিয়ে আসে, হতভম্ব হয়ে সামিনের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ। তারপর নরম গলায় বলে,"আমাকে সতর্ক করলেই তো পারতেন!"
_সময় দিয়েছো?
_তাই বলে নিজের হাত রেখে দেবেন? কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন বলুনতো।
সামিন চুপ করে থাকে। আলো আলমারি থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে সামিনকে বলে, বিছানায় বসুন।
সামিন চুপচাপ বাধ্য ছেলের মতো বিছানায় বসে। তীব্র যন্ত্রনা হচ্ছে তার হাতে। আলো সামিনের ক্ষতটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"আমার মনে হচ্ছে একজন ডক্টর ডাকলেই ভালো হবে।"
সামিন কিছু বলছে না, বলতে পারছে না, যন্ত্রনার তীব্রতা বাড়ছে বেশ।
আলো উঠে গিয়ে রিতুকে ডেকে আনে। ইলহাম ততক্ষণে বাড়িতে ফিরেছে। খুব কাছে থেকে একজন ডক্টর ডেকে আনলে সে এসে সামিনের হাত ড্রে/সিং করিয়ে দিয়ে চলে যায়।
ইশিতা এসে ভাইয়ের এমন ক্ষ/ত দেখে উৎকণ্ঠা নিয়ে কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে। তারপর আলোর সামনে এসে দাড়িয়ে নিচু স্বরে বলে,"তুমি করোনি তো কিছু ভাবী?"
আলো অবাক হয়ে বলে,"আমি একজনের হাতে কাচের টুকরো ঢুকিয়ে দেবো?"
_দিতেও পারো, তোমাকে বিশ্বাস নেই, আমার ভোলাভালা ভাইটা মুখ ফুটে কিছু বলবেও না।
আলো খুব বিরক্ত হয় ইশিতার এমন বাচ্চাসুলভ কথা বার্তায়। ইদানিং বেশ কোল টেনে কথা বলে ভাইয়ের, বাংলার তথাকথিত ননদ গুলোর রূপ ধারণ করেছে, কোনদিন না জানি আলোর চুলের মুঠি ধরে!
ইশিতা গিয়ে একটা প্লেটে ভাত এনে তার আদরের ভাইয়াকে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে চলে যায়। আলো দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে সেসব। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে, সব দোষ ভাইয়ার আদরের বোন তার ঘারেই ফেলতে চাইলো! তার কি দোষ? সে কি বলেছিলো ইয়াসার মির্জাকে হাত রাখতে? আর এই বদ লোকটা সবসময় মাসুম প্রমানিত হয় সবার কাছে। যত দোষ শেষে হয় আলো ঘোষের।
***
রাত তখন দেড়টা ছাড়িয়ে গিয়েছে। মৃদু কোনো আওয়াজে আলোর ঘুম ভেঙ্গে যায়। অন্ধকারে কিছু বুঝতে না পেরে সুইচ টিপে বেড সাইডের টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিয়ে উঠে বসে। পাশে ফিরে সামিনের দিকে তাকাতেই থ'মকে যায় সে। লম্বা মানুষটা কেমন গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। কিছু একটা বিড়বিড় করছে। আলো কিছুক্ষণ সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে সংকোচের সাথে বলে ওঠে,"শুনছেন! কোনো সমস্যা?"
সামিন কোনো সাড়া দেয়না। বিড়বিড় করতে থাকে। আলো অনেকটা জড়তা নিয়ে ধীরে ধীরে হাত টা বাড়িয়ে এক আকাশ সমান সংকোচ দমিয়ে রেখে সামিনের কপালে রাখে। মুহুর্তেই চ'মকে ওঠে সে, আগুনের থেকে কম নয় তাপমাত্রা। কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে ঘরের দরজা খুলে ইলহামের ঘরের দিকে যায়।
দরজা খুলে রিতু অবাক চোখে আলোকে দেখে। আলো নরম গলায় বলে,"ওনার গায়ে অনেক জ্বর।"
রিতু চুলে খোপা করতে করতে সামিনের ঘরে যেতে যেতে বলতে থাকে,"বিকেলেই অনেক জ্বর ছিলো। যখন হাত কে/টেছে তখনই বুঝেছি জ্বরের বাপ আসতে চলেছে।"
থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে রিতুর চক্ষু চড়কগাছ । আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"কি সাংঘাতিক!"
আলো কিছুটা ঘা'বড়ে গিয়ে সামিনের মুখের দিকে তাকায়। রিতু ছোটাছুটি করে একটা বাটি এনে সামিনের মাথায় জলপট্টি দিতে থাকে। কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,
"এই বডি দেখলে ভেবো না এরা শক্তপোক্ত। এরা সব ভাই-বোন খুবই নাজুক। জ্বর হলে খুব সহজেই কাবু হয়ে যায়, পুরো বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। আমাদের শাশুড়ি মা/রা যাওয়ার পরে প্রত্যেক বার এক একজনের জ্বর হলে আমি হিমশিম খেয়ে যাই, আমি কত যে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বাচ্চাদের মতো সামলাতে হয় এদের।"
আলো চুপচাপ রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"তুমি খুব ভালো মেয়ে রিতু। একেবারে মহীয়সী । "
রিতু লজ্জা পেয়ে যায়। ইশিতা ঘুম ঘুম চোখে সামিনের ঘরে ঢুকে আলোকে বলে,"মেজো ভাবীকে দিয়ে এসব করাচ্ছো কেন? স্বামী টা কার?"
আলো চুপ করে তাকিয়ে থাকে ইশিতার দিকে। তারপর বলে ওঠে,"তুমি ইদানীং আমার সাথে এমন কেনো ব্যবহার করো ইশিতা আপু?"
ইশিতা হাসি চাপিয়ে রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"সম্পর্ক টা ভুলে গিয়েছো? ননদ হই তোমার।"
তারপর রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"ইহান উঠে গিয়েছে ঘুম থেকে। কাঁ/দছে। তুমি যাও মেজো ভাবী। বড় ভাবী করবে এসব।"
রিতু কিছুক্ষণ আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যায়। ইশিতা ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আলোকে বলে,"ওখানে কে শুয়ে আছে জানো? আমার মা,বাবা। তুমি তার প্রতি একটু দরদ দেখাও। আমি তোমাকে আজীবন মাথায় তুলে রাখবো ভাবী।"
ধীরপায়ে ইশিতা চলে যায়। আলোর ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় কিছুক্ষণ বসে থেকে সামিনের দিকে তাকায়। তখনও প্রলাপ বকে যাচ্ছে সামিন। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে আলো তার দিকে এগিয়ে যায়। মাথার কাছে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে বসে সামিনের মাথায় জলপট্টি দিতে থাকে। এইবার বেশ ভালো করে সামিনকে লক্ষ্য করে আলো। বেশ সুদর্শন লোকটা, ক্লাস ইলেভেনের মেয়েরা এমনি এমনি লাভ লেটার দেয়না তাকে। অবশ্য এরা চার ভাই বোনই দেখতে শুনতে ভালো। এদের মধ্যে ইশমাম একটু বেশি সুন্দর। ইশমামের কথা মনে পরতেই আলোর চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
সামিনের মুখের দিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থেকে ভাবে, এই লোকটা তার ভাইবোনদের নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে, জান বের করে দেয় ভাই বোনদের জন্য। এই লোক যদি কখনো জেনে যায় সে তার আদরের ছোটোভাইয়ের প্রেমিকাকে বিয়ে করেছে তাহলে নিশ্চয়ই বেশ কষ্ট পাবে লোকটা, আলোর হঠাৎ খুব আফসোস হচ্ছে সামিনের কথা ভেবে।
জলপট্টি দিতে দিতে সামিনকে ভালো করে দেখতে থাকে আলো। লোকটা যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেনো একটা কথা আলোর স্বীকার করতেই হবে,লোকটা একজন পারফেক্ট ফ্যামিলি ম্যান। এতো অল্পবয়সেই একটা সংসারের সবার নিরাপত্তা, নির্ভরতার যায়গা। এদের ভাই বোনদের বন্ডিং সত্যিই প্রশংসনীয়।
সামিন বিড় বিড় করে কিছু বলছে, আলো কৌতুহল বশত একটু ঝুঁকে যায় সামিনের দিকে। সে স্পষ্ট শুনতে পায় সামিন বিড়বিড় করে তার মাকে ডাকছে।
আলো বেশ অবাক হয়, এতো বড় একজন লোক অথচ এখন মনে হচ্ছে এর বয়স আট বছর।
চোখ ঘুরিয়ে আলো সামিনের হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকায়। লোকটা অমন কান্ড করে তখন কি প্রমাণ করতে চাইলো আলো জানে না, আলোর যায়গায় অন্য কোনো মেয়ে থাকলে তখনই সামিনের প্রেমে পরে যেতো।
হুট করে কিছুটা সংকোচ নিয়ে আলো সামিনের ব্যান্ডেজের ওপর দিয়ে হাত ছুঁয়ে দিতেই সামিন জ্বরের ঘোরে আলোর হাত আকরে ধরে।
আলো চ'মকে উঠে তাকায় সামিনের দিকে। লোকটা কি স্বাভাবিক তবে?
সামিন স্বাভাবিক না, আলোর হাত নিজের বুকের সাথে আকরে ধরে বিড়বিড় করে যাচ্ছে। ভাবছে হয়তো মায়ের হাত আঁকড়ে ধরেছে।
আলো হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে সামিন ছাড়ে না। কিছুক্ষণ সামিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে খানিকটা ঝুঁকে আলো অস্ফুট স্বরে বলে,"শুনছেন। আমি আপনার মা নই। হাতটা ছাড়ুন।"
সামিন ছাড়ে না। আলো দেখতে পায় জ্বরের তীব্রতায় সামিনের বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরছে।
হঠাৎ কেন জানি আলোর নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে মন সায় দিলো না। সামিনের উত্তপ্ত শরীরের উষ্ণতায় আলোর হাত গরম হয়ে গিয়েছে। তবুও আলো চুপচাপ বসে রইলো সামিনের মুখের দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ পরে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"আপনি আসলে কেমন লোক ইয়াসার মির্জা? আমার কি আপনাকে আগ্রহ নিয়ে জানা উচিত?"
***
ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সামিন ধীরে ধীরে উঠে বসে। শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা শেষ হয়েছে। কাল রাতের জ্বরে বেশ কাহিল লাগছে শরীরটা। গায়ে এখন আর জ্বর নেই। তবে হাতের যন্ত্রনাটা বেরেছে। খুব কষ্ট দিচ্ছে সামিনকে ব্যাথাটা, তবে আছিয়ার থেকে কম কষ্ট দিচ্ছে।
ঘরের মধ্যে আলো নেই। মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখে বেড সাইডের টেবিলে জলপট্টি দেওয়ার বাটি রাখা। নিশ্চয়ই ইশিতা নয়তো রিতুর কাজ ওসব।
বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে টি শার্ট পালটে ক্লান্ত শরীরে বারান্দায় চলে যায় সে। সকালের রোদে স্নান করে নিতে হবে।
আলো ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে সামিনকে দেখতে না পেয়ে ভাবলো বারান্দায় গিয়েছে। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সামিনের আলমারির দিকে এগিয়ে যায় । কিছুক্ষণ আগে ইশিতার সাথে আলোর একটা ঠান্ডা যু/দ্ধ গিয়েছে। রিতু মাঝখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিলো রেফারি হয়ে। যুদ্ধের কারন আলোর সামিনের প্রতি উদাসীনতা। কেনো আলো সামিনের জামাকাপড় ওয়াশিং মেশিনে এনে রাখে না, কেনো যত্ন করে না!
আলোর বিরক্ত লাগছে খুব। এই ইশিতা আপু কি এখন আলো আর রিতুর শাশুড়ির যায়গা নিতে চাইছে? ইদানিং হাবভাব দেখলে তো তাই মনে হয়। কি হবে সামিনের জামাকাপড় ধুলে? সামিনকে রাতারাতি পতি দেবতা ভাবতে শুরু করবে? এতো তাড়াতাড়ি? আরে বাবা একটু সময় দে সবাই! আলোরানী তো আর ম'রে যাচ্ছে না, এরা জোর জবরদস্তি করে সংসার সংসার খেলিয়েই ছাড়ছে আলোকে দিয়ে।
আজ আলো সামিনের জামাকাপড় ধোবে। সবার কলিজা ঠান্ডা করে দেবে আলো। সবাই তো এই টেনশনে খাবার খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে যে কেনো আলো তাদের ভোলা ভালা কলিজার টুকরা চোখের মনি বড় ভাইয়ার জামা কাপড় ধোয় না!
আলো আলমারি খুলে একটানে সামিনের ব্যবহৃত জামাকাপড় বের করতে গিয়ে সব ফেলে দেয় নিচে।
মুখে চ কারন্ত শব্দ করে সবকিছু একটা একটা করে তুলতে থাকে সে । হঠাৎ করে সামিনের ব্যাক্তিগত ছোটো প্যান্ট দেখে চোখ বড় বড় করে লাফিয়ে দুই পা পিছিয়ে যায় আলো।
বড় বড় দু'টো নিঃশ্বাস ফেলে সে। অসম্ভব,ওসব আলো ধুতে পারবে না। বেঁচে থাকতেও না, ম'রে গেলেও না। কারো আলোকে শূলে চ'ড়ানোর থাকলে এসে চ'ড়াক।
ওসব আলো ধরতে পারবে না। কখনোই না।
কিছুক্ষণ ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে থেকে কাঁচুমাচু মুখ করে আপন মনে বলে ওঠে,"এ আমাকে কোথায় ফাঁ'সিয়ে দিলে আব্বু আম্মু! স্বামী নামের পুরুষের ওসব ছোট প্যান্ট ধোওয়ার জন্যই কি একটা মেয়ের জন্ম হয়েছে? "
"তোমাকে ওসব ধুতে হবে না।"
সামিন ক্লান্ত শরীরে আলোর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আলো চ'ম'কে উঠে ঘুরে তাকায়।
সামিন তার দিকে তাকিয়ে আছে, স্বাভাবিক গলায় বলে,"স্বামী নামের পুরুষের ওসব ধোওয়ার জন্য একটা মেয়ের অবশ্যই জন্ম হয়নি। তুমি ওসব রেখে নিজের কাজ করো।"
_তা কি করে হয়, আপনার বোন তো আমাকে কাঁ'চা খেয়ে ফেলবে।
_তুমি তো কাউকে ভয় পাও না। তাহলে এতো মাথা ঘামাচ্ছো কেনো? ইশিতা আপুর চোখে এতো ভালো হবার প্রয়োজন কি? সাফ সাফ জানিয়ে দাও এসব তুমি পারবে না।
আলো চোখ ঘুরিয়ে সামিনের দিকে তাকায়। তাইতো,সে সাফ সাফ জানিয়ে দিলেই তো পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সে আপত্তি জানাতে পারছে না, সে কেনো আপত্তি জানাতে পারছে না? কেনো? কোথাও তার অবচেতন মনও কি এটা ভাবে এগুলো স্ত্রী হিসেবে তার কর্তব্য? ঐ একটা কাগজের জন্য হলেও তার এসব করা উচিত? এমন কিছু কি?
"আজ কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?"
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে। সামিন একমনে ড্রাইভ করতে থাকে। মৃদু স্বরে বলে,"একটা নতুন যায়গায়।"
_আপনি একজন মেয়র হয়ে এতো ঘোরাঘুরি করেন কেন এভাবে একা একা। আপনার তো শত্রু অনেক।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"তুমি আমার কথা ভাবো?"
আলো চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে সামিনের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,"ব্যা*থা সেরেছে? ব্যা/ন্ডেজ খুলে ফেললেন যে?"
_হ্যা সেরেছে।
একবাক্যে জবাব দেয় সামিন। তারপর বলে,"দু চারদিনে আমরা সিঙ্গাপুর যাচ্ছি। প্রস্তুতি নাও। একসপ্তাহ কিংবা দশ বারো দিন লাগবে।"
_আর এখানকার কাজ?
_আমার ছেলেরা আছে। ওরা নিজেরাই এক একজন সামিন ইয়াসার মির্জা।
আলো কয়েক মূহুর্ত পরে বলে,"ভাগ্য করে কিছু মানুষ পেয়েছেন আপনি। আপনার ভাই, বোন, ভাইয়ের বৌ, আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড, জামিল ভাই, দলের ছেলেরা। সবাই খুব ভালোবাসে আপনাকে।"
সামিন চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে আলোর দিকে তাকায়, তারপর বলে,"হ্যা ভাগ্য করে সবাইকেই সেরা পেয়েছি, শুধু বৌ ছাড়া। বৌ টা পঁ*চা খুব।"
_সেটা তো আপনার দো*ষে।
কাট কাট জবাব দেয় আলো। সামিন আর কথা বাড়ায় না। ঝ*গড়া শুরুর পূর্ব লক্ষণ দেখা দিয়েছে। কথাবার্তা এখানেই থামিয়ে দেওয়া ভালো। সামিন শান্তি পছন্দ করে। সামিন ম*হাত্মা গান্ধীর ফ্যান।
গাড়ি থেমে গেলে আলো অবাক চোখে আশেপাশে তাকায়। সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"কোথায় এনেছেন? এখানে কি?"
_কাজ আছে। নামো।
সামিন গাড়ি থেকে নামে। আলো শাড়ির আঁচল টেনে লম্বা একটা ঘোমটা টেনে নেয়। তারা এসেছে থানা*রোডের এতিম*খানায়।
গাড়ি থেকে নামতেই সামিন আলোকে দেখে থমকে যায়। ঘোমটায় কত সুন্দর স*ভ্য শান্ত লাগছে মেয়েটিকে। এর মুখ দেখে বোঝার উপায় আছে এই মেয়েটা কি সাং*ঘাতিক?
আলো সামিনের দৃষ্টি দেখে অস্বস্তিতে পরে যায়। লোকটা এভাবে কি দেখছে!
কয়েক মূহুর্ত পরে সামিন বলে," এসো আমার সাথে।"
গেইটের কাছে দুজন লোক দাঁড়িয়ে সামিনকে স্বাগত জানায়। তারপর তাদের নিয়ে ভেতরের দালানে প্রবেশ করে। চারতলা বিশিষ্ট এই দালানটিতে মোট একশ নয়জন অ*নাথ শিশু থাকে।
সামিন এগিয়ে যেতে যেতে তার সামনে থাকা লোকটাকে বলে,"আজ আমি সাথে করে কিছু আনিনি। আপনাকে টাকা দিচ্ছি। ওদের জন্য কিছু কিনে আনুন কাইন্ডলি।"
_সমস্যা নেই। আজ আপনি দাতা নয়। একজন গেইস্ট। আজ ওরা আপনাকে আর ভাবীকে আপ্যায়ন করবে।
হেসে জবাব দেয় লোকটা। তারপর সামিন আর আলোকে নিয়ে চলে যায় বড় একটা খোলা মাঠে। সেখানে তাদের অপেক্ষায় বসে আছে একঝাঁক প্রজাপতির দল।
সামিনকে দেখে একশ নয়জন বাচ্চা একসাথে চেঁচিয়ে ওঠে। আলো চ'ম'কে যায়। সবাই দৌড়ে এসে সামিনকে ঘিরে ধরে। সামিনকে পেয়ে তাদের চোখে মুখে আনন্দের ছটা।
আলো পাশে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখতে থাকে। হঠাৎ করে তার মনটা ভালো হয়ে গিয়েছে। বাচ্চাগুলো কি প্রানবন্ত! কি বিনয়ী! কি চমৎকার!
বাচ্চাদের মধ্যে দুজন দলনেতা সামিনকে টেনে একটা টেবিলের কাছে নিয়ে যায়। সামিন আলোকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আলো হাত নেড়ে মুখ হাসি হাসি করে সবাইকে "হাই" বলে।
সে যায়গা থেকে নড়ছে না। সামিন আবারো আলোর কাছে এগিয়ে এসে বলে,"কই এসো। ওদের কাছে এসো!"
আলো অস্ফুট স্বরে বলে,"এখানে আনলেন যে আমাকে!"
সামিন ম্লান হেসে বলে,"ঐ যে নীল ফ্রক পরা ছোট পরীটাকে দেখছো? ওর নাম খুকুমণি। বয়স চার বছর হয়েছে আজ। তার বহুদিনের ইচ্ছা একটা পরী দেখবে, তাই তাকে দেখানোর জন্য একটা পরী আনলাম।"
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে ,"খুব সুন্দর চেষ্টা ছিলো। এমন সংলাপ বলে ক্লাস ইলেভেনের মেয়েদের পটানো যায়। একজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ভদ্রমহিলাকে নয়।"
সামিন হেসে ফেলে, তারপর বলে,"আপাতত কাউকে পটাতে চাইছি না। এসো খুকুমণির সাথে পরিচিত হবে।"
তারপর আলোর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় বাচ্চাদের কাছে।
হাসি মজার ছলে পুরো সকালটা বেশ কেটে গেলো আলোর বাচ্চা গুলোর সাথে। যখন আলো বাচ্চাদের সাথে দুষ্টুমিতে মত্ত ছিলো তখন সামিন মুগ্ধ চোখে আলোকে দেখেছে। যখন সামিন বাচ্চাদের সাথে খেলছিলো তখন আলো সামিনকে দেখেছে। সে না জানলেও তার অবচেতন মনে মুগ্ধ হয়ে দেখেছে সামিনকে।
একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সামিন। তার দৃষ্টি আলোর দিকে। হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছে বাচ্চাদের সাথে। হঠাৎ সামিনের চোখে চোখ পরতেই সামিন চোখ সরিয়ে নেয়। আলো ধীরপায়ে এগিয়ে আসে।
"ধন্যবাদ আপনাকে।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো অত্যন্ত সাবলীল ভাবে বলে,"আজকের দিনটা খুবই সুন্দর করে দিয়েছেন আমার। আপনি ধন্যবাদ ডিজার্ভ করেন।"
সামিন নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,"তাই? আমি সার্থক।"
আলো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সামিনকে বলে," আচ্ছা, কোনটা আসল আপনি বলুন তো? সেদিনের সেই সামিন ইয়াসার মির্জা নাকি এই সামিন ইয়াসার মির্জা? কোনটা সত্যি? সেদিনের সেই আতং*কিত রাত নাকি আজকের এই সকাল। আমি যতদূর জানি একটা খা*রাপ মানুষ বাচ্চাদের কখনোই পছন্দ করবে না। কোনটা সামিন ইয়াসার মির্জার আসল রূপ?
সামিন ম্লান হেসে আলোর দিকে এগিয়ে যায়। আলো সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আলোর গালে হাত রেখে সামিন অস্ফুট স্বরে বলে,"তোমার কোনটা মনে হচ্ছে?"
আলো চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলে,"জানি নাহ।"
সামিন আলোর গাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বলে,"জেনে যাবে। ধীরে ধীরে জেনে যাবে। মনের উপর একদম চাপ দিও না আছিয়া!"
***
"ইশিতা আপু"
আলোর ডাকে ইশিতা চ'ম'কে উঠে ঘুরে দাঁড়ায়। তার হাত থেকে ফোনটা নিচে পরে যায়।
আলো অবাক হয়ে যায় ইশিতার এমন আচরণে। ইশিতা বুকে হাত দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে," ও তুমি।"
_তুমি এভাবে ভয় পেয়ে গিয়েছো কেন? কার সাথে কথা বলছিলে? শান্ত ভাইয়ার সাথে?
ইশিতা আলোর মুখ চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,"চুপ চুপ। ভাইয়া বাড়িতে। শুনতে পেলে আমি শেষ।"
আলো অবাক হয়ে যায়।
"কেনো তোমার ভাইয়া শান্ত ভাইয়ার কথা জানে না? সে তো জানে!"
ইশিতা মুখ কাচুমাচু করে বলে,"ভাইয়াকে বলেছি রিলেশন নেই আর। সব শে*ষ।"
_কিন্তু এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কতদিন? একদিন তো জানাতেই হবে।
_ও একটা চাকরী পেলেই জানাবো। প্লিজ ভাবী তুমি এখন কিছু বলবে না ভাইয়াকে প্লিজ। ভাইয়া ওকে এখন একদম পছন্দ করছে না।
আলো ইশিতার হাত ধরে হেসে বলে,"ঠিকাছে বলবো না। তুমি একটু শান্ত হও এখন।"
ইশিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে," কেন এসেছিলে বলো।"
_ওই, তোমার ভাইয়ের জামাকাপড় ধুয়েছি আজ। সেটাই তোমাকে জানাতে এসেছি। এবার সবাই শান্তিতে ঘুমাতে পারবে।
স্বাভাবিক গলায় বলে আলো।
ইশিতা হেসে ফেলে, তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,"আমি,মেজো ভাবী,মেজো ভাইয়া, ইশমাম,ইহান,পরী, সিতারা, ফুলির মা,পোনা চাচা,দাড়োয়ান রিয়াজ ভাই, এমনকি মেজো ভাবীর পেটের মধ্যে থাকা পুচকু, সবাই তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ ভাবী। আমরা ধন্য হয়ে গিয়েছি। আমাদের উদ্ধার করে দিলে তুমি আজ।"
আলো চুপ করে ইশিতার দিকে তাকিয়ে আছে। ইশিতা তাকে বিদ্রুপ করছে।
আলোর থুতনিতে হাত রেখে ইশিতা হাসতে হাসতে বলে,"ইশশশ! তুমি যে কি মিষ্টি ভাবী! এখন প্লিজ ভাইয়ার সামনে যেও না। ভাইয়া তোমাকে মিষ্টি ভেবে খে*য়ে ফেলবে। ভাইয়া মিষ্টি খুব পছন্দ করে।"
আলো ইশিতার হাত নিজের থুতনি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একপ্রকার ছুটে যায় নিজের ঘরে। সামিন তখন ঘর থেকে বের হচ্ছিলো। দু'জনের ধা*ক্কা লেগে যায়। সামিনের ব*লিষ্ঠ বুকের সাথে বারি খেয়ে আলো দুই পা পিছিয়ে যায়। সামিন নিজের যায়গায় দাঁড়িয়ে আছে টানটান হয়ে। অবাক চোখে আলোকে দেখতে থাকে সে, কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলে বলে ওঠে,"কি আশ্চর্য। তুমি সবসময় এতো ছোটা*ছুটি করো কেন? কোথাও আ*গুন লাগেনি। একটু ধীরস্থির হও।"
আলো চুপ করে সামিনকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢোকে। সামিন নিচে নামে।
জামিল আর হেনা লিভিং রুমে বসে আছে। জামিলের মুখ শুকনো হয়ে আছে। হেনা উঠে দাঁড়াতে গেলে সামিন ওকে হাত দিয়ে ইশারা করে দাঁড়াতে নিষেধ করে। সিতারা হেনার ব্যাগ পত্র নিচতলার গেস্ট রুমে নিয়ে যায়।
সামিন জামিলকে বলে,"নিচতলায় থাকুক। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে না। আর তুই এতো ঘা*বড়ে যাচ্ছিস কেনো? এখনো তো একসপ্তাহ সময় আছে হাতে। তুই তো আগামী পরশু চলে আসবি। আমরা তো আছি। হেনা যত্নে থাকবে এখানে।"
জামিল আমতা আমতা করে বলে,"তা জানি ভাই, কেনো জানি মন সায় দিচ্ছে না যেতে।"
_উনি তোর চাঁচা জামিল, চাঁচার জা*নাজায় থাকবি না? এক্ষুনি বেরিয়ে পর। হেনার কিচ্ছু হবে না। তুই যা।
জামিল শুকনো মুখে হেনার দিকে তাকায়। হেনা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দুজন দুজনের থেকে দূরে থাকতে পারে না। কেউ কাউকে কাছ ছাড়া করতে চাচ্ছে না, কি সুন্দর একটা দৃশ্য। সামিন মুগ্ধ চোখে ওদের দেখতে থাকে। জামিল চোখের ইশারায় হেনার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। হেনা কিছুটা জড়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রিতু এসে তাকে গেস্ট রুমে নিয়ে যায়। ইশিতা সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বলে,"তুই কাইন্ডলি হেনার সাথে দু'দিন নিচতলার গেস্ট রুমে থাকবি? জামিল খুবই টেন্সড!"
_নিশ্চই থাকবো।
একবাক্যে রাজি হয়ে যায় ইশিতা। সামিন বোনকে দেখে বলে,"তুই কোথাও বের হচ্ছিস?"
_না ওই রিদি আসবে বাড়িতে আজ। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
_রিদি? হঠাৎ কি মনে করে? আমি তো বিয়ে করে নিয়েছি।
হাসতে হাসতে বলে সামিন। ইশিতা কপাল কুঁচকে বলে," এ ধরনের মজা ভুলেও তোমার বৌয়ের সামনে করো না। তীরে এসে তরী ডুববে। "
ইশিতা বাড়ির বাইরে যায়। সামিন দোতলায় ওঠে। আলো বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে একটা বই পরছিলো। কি বই পড়ছে তা বুঝতে পারছে না সামিন,চোখে মুখে মুগ্ধতা মেয়েটার। এই মেয়েটা সামিন বাদে পৃথিবীর সবকিছুর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকায়। সামিনের দিকে তাকালে মনে হয় ভ*ষ্ম করে দেবে।
গলা খাঁকারি দিয়ে সামিন বলে,"ও বাড়িতে যেতে চাও?"
আলো বই থেকে মাথা তুলে সামিনের দিকে তাকায়। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,"হ্যা।"
_নিয়ে যাবো।
_আমি তো যেতে পারি। পথ চিনি আমি।
_ওটা আমার শশুর বাড়ি। তাই আমিও যাবো।
কাটকাট বলে সামিন।
আলো আপত্তি জানিয়ে কোনো কথা বলে না আর । আবারও বইয়ের পাতায় চোখ রাখে। সামিনের ইচ্ছা করছে ঘর থেকে বই গুলো সব বের করে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঐ মেয়েটার মুখোমুখি গিয়ে বসতে। তারপর থুতনি ধরে বলতে,"এই মেয়ে! একটু আমাকেও দেখো। একপলক দেখো।"
ইচ্ছাকে দমিয়ে রেখে সামিন বারান্দায় চলে যায়। আলো মাথা তুলে পেছন থেকে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে । সামিন তা দেখলো না।
***
দোতলার লিভিং রুমে হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আলো ঘর থেকে বেরিয়ে একবার উঁ*কি দিয়ে দেখে। ইশিতা আর একটা মেয়ে বসে গল্প করছে । আলো মেয়েটিকে চেনে না। ইশিতার বন্ধু হবে হয়তো । ইশিতার চোখে আলো পরতেই ইশিতা উঠে এসে আলোকে টেনে নিয়ে যায় ।
মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে আলোকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে থাকে। ইশিতা বলে,"ভাবী ও হচ্ছে আমার বান্ধবী রিদি। তোমাকে দেখতে এসেছে ।"
আলো রিদির দিকে তাকায়। লম্বা,ফরসা, সুন্দরী একটা মেয়ে। আলোকে বিনয়ের সাথে সালাম দেয়। আলো সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে ওদের। টুকটাক কথা বলে চা বানাতে আলো নিচতলায় নেমে আসে।
রান্নাঘরে সিতারা আর ফুলির মা ছিলো। ফুলির মা অবাক হয়ে বলে,"আপনি রান্নাঘরে আসছেন?"
_হ্যা। কেনো? আসতে পারি না?
_অবশ্যই পারেন ভাবী। আসলে কখনো আসেন না তো তাই বললাম।
আলো মৃদু হেসে চায়ের পানি বসিয়ে দেয় চুলায়, তারপর বলে,"আসলে ইশিতা আপুর বান্ধবী এসেছে আমাকে দেখতে, এখন আমি যদি আপ্যায়ন না করি তাহলে ইশিতা আপুর মুখ থাকবে না।"
আলোর হঠাৎ এমন কর্তব্য জ্ঞান দেখে সিতারা এবং ফুলির মা দুজনেই অবাক হয়। হেনা এসে পেটে হাত দিয়ে রান্নাঘরে দাঁড়ায়। আলো হেসে তাকেও বলে,"তুমি চা খাবে? বানাই?"
হেনা মাথা নাড়ায়। আলো চায়ের পানি বারিয়ে দেয়। টুকটাক কথা বার্তা বলতে থাকে সবার সাথে। হুট করে ফুলির মা বলে বসে,"আপনি রিদি আপার জন্য চা বানাতে আসছেন, খুবই অবাক করা বিষয়।"
আলো অবাক হয়ে বলে,"তা কেনো? ওনার সাথে কি আমার শত্রুতা আছে যে চা বানাতে পারবো না?"
_শত্রুতা না ঠিক...
ফুলির মা আমতা আমতা করে বলে,"আপনি কি কিছু জানেন না?"
আলো ঘুরে দাঁড়ায়,"কি? কোন ব্যাপারে কথা বলছো?"
সিতারা ফুলির মাকে ইশারা করে চোখ দিয়ে কিছু না বলতে। আলো সিতারাকে ধ*মক দিয়ে বলে,"ওকে বলতে দাও।"
ফুলির মা এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,"রিদি আপা বড় ভাইজানরে ভালোবাসতো। ইশিতা আপা তো ঠিক করেও রাখছিলো বড় ভাবী বানাবে ঐ রিদি আপাকে। মাঝখান থেকে বড় ভাইজান আপনাকে বিয়ে করে ফেলছে।"
সিতারা ধ*মকের সুরে ফুলির মাকে বলে,"হ্যা তো? এসব কথা বড় ভাবীকে বলছিস কেন? পছন্দ করতেই পারে । আমাদের বড় ভাইজান তো কিছু করেনি তাই না। সে তো ইশিতা আপুর সব বান্ধবীকে বোনের নজরে দেখেছে।"
ফুলির মা বলতে থাকে,"আমি নিশ্চিত। ঐ মেয়ে এখনো বড় ভাইজানকে ভালোবাসে। তখন দেখলি না বড় ভাইজানকে দেখার সাথে সাথে চোখে মুখে কি আনন্দ!"
আলোর মুখটা হঠাৎ থম*থমে হয়ে যায়। কাপে চা ঢেলে সিতারাকে বলে,"এগুলো উনাদের দিয়ে এসো সিতারা।"
সিতারা ট্রে নিয়ে চলে যায়। ফুলির মা আমতা আমতা করে বলে,"আপনি কি মন খারাপ করলেন ভাবী? বড় ভাইজান কিন্তু কিছু করেনি। সে বোনের নজরে দেখে। মন খারাপ করবেন না।"
আলো কয়েক পলক ফুলির মায়ের দিকে তাকিয়ে তাকে দেখে চলে যায়। ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভে*ঙে দোতলায় উঠে লিভিং রুমের দিকে দৃষ্টি যেতেই থ'ম'কে দাঁড়ায়।
সামিন আর রিদি হেসে হেসে কথা বলছে। ইশিতা কোথাও নেই। আলো একদৃষ্টে ওদের দেখে। সামিনকে দেখে মনে হচ্ছে সে জীবনে হাসেনি, আজ সব হাসি হেসে নিতে হবে। আর হাসির কি ছি*ড়ি!
যেন একজন আরেকজনের গায়ে পরে যাবে! বোনের নজরে না ছাই! যতসব ফালতু কথাবার্তা! কেউ কাউকে বোনের নজরে দেখলে এভাবে গায়ে হে*লে পরে? আরে এতো দূরে বসে আছিস কেনো? কোলে নিয়ে কথা বল! যত্তসব পুরুষ মানুষ! ছাগলের মতো শুধু ছুক ছুক ভাব! যেই এক যায়গায় সহজে চান্স পেলো না অমনি আরেক জায়গায় চান্স মা*রতে বসে গিয়েছে!
আর এই মেয়েরাও আছে, যে পুরুষের বৌ আছে সেই পুরুষটাকে বেশি মধু মনে হয় এদের কাছে, কোনো অবিবাহিত পুরুষ এদের চোখে পরে না। ফা*লতু!
শাড়ির আঁচল শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আলো। সামিন আর রিদি হেসেই যাচ্ছে। আলোর কপালে সূক্ষ্ম রেখা দেখা দিয়েছে। হঠাৎ সামিনের চোখে চোখ পরতেই গুটিয়ে যায় আলো। চোখ সরিয়ে নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে ঘরে ঢোকে, মুখটা থম*থমে। সামিন কিছু টা অবাক হয়ে যায়, বিড়বিড় করে বলে,"যা বাবা! এর আবার কি হলো!"
***
ঘরে ঢুকে দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে একবার ড্রয়ার খুলে কিছু একটা রাখে। আলোর দৃষ্টি বইয়ের দিকে থাকলেও মনোযোগ সামিনে।
আলমারির কাছে গিয়ে একটা কোলবালিশ বের করে এনে বিছানার মাঝখান টাতে রাখে, তারপর আলোকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,"ভুল বলতাম আমি, স্ত্রী বেডফেলো নয়, স্ত্রী হচ্ছে Bed o*ccupier । স্ত্রী শয্যাসঙ্গী নয়,স্ত্রী হচ্ছে শয্যা দখলকারী। পুরো খাট টা দখল করে বসে আছে।"
আলো একপাশে চুপচাপ সরে বসে। সামিন টান টান হয়ে শুয়ে পরে। আলোর মন সেই কখন থেকে উ'শ'খু'শ করছে সামিনকে কথা শোনানোর জন্য। এখনি সুযোগ। আজ এই লোককে শান্তিতে ঘুমাতে দেবে না আলো।
"এখানে এখন কি?"
আলোর কথা শুনে সামিন চোখ মেলে তাকায়, তারপর বলে,"ঘুমাবো বলে। বিকেলে ঘুমানো বারণ আছে নাকি?"
_আচ্ছা আপনার আর কোনো কাজ নেই? আপনি কি আদৌও প*লিটিশিয়ান?
_কেন? এমন কথা বলছো কেনো? প*লিটিশিয়ান বলে সারাদিন রাজ*পথে থাকবো? বাড়িতে এসে নিজের বিছানায় আরাম করবো না?
_না না, তা করবেন না কেনো। পলিটিশিয়ান তো আপনি নামে, আপনার একটা কাজও প*লিটিশিয়ানদের মতো নয়।
_কেনো? কি করেছি আমি? দেখো ঘুরে ফিরে আবার তোমাকে তুলে এনে বিয়ে করার কাহিনীতে যাবে না বলে দিলাম।
_না না, চোখের সামনে আপনার এতো কান্ড দেখতে পাচ্ছি। শুধু শুধু অতীত ঘে*টে কথা শোনানোর দরকার কি!
_কি কান্ড করেছি আমি?
_কি কান্ড? একজন মেয়র একটা বাইরের মেয়ের সাথে কিভাবে কথা বলে জানেন না? কোনো ফরমাল বিহেভিয়ার মেইন*টেইন করেন না। ওভাবে কোলে নিয়ে কি কথা বলছিলেন এতো?
সামিন হা করে আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আমতা আমতা করে বলে,"রিদির কথা বলছো? কোলে কখন নিলাম? এভাবে কেনো বলছো?"
_আরেকটু হলেই তো নিয়ে নিতেন।
কাটকাট জবাব দেয় আলো। সামিন কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে,"তুমিও দু'টো হেসে কথা বলবে না, অন্য কাউকেও বলতে দেবে না। এটা তো জু*লুম আলো।"
আলো সামিনের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। তারপর ক*ঠিন গলায় বলে,"নামুন।"
_মানে?
_মানে বিছানা থেকে নামুন।
_ওমা! কেনো? এই বিছানা আমার। বেডটাকে নগদ চৌষট্টি হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি।
আলো সামিনকে অবাক করে দিয়ে তাকে ঠেলতে থাকে,"নামুন, নামুন । ঘর থেকে বেরিয়ে যান।"
_কোথায় যাবো?
_মহিলা কলেজের সামনে, ওখানে ক্লাস ইলেভেন থেকে শুরু করে মাস্টার্স, সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে আপনার সাথে হেসে হেসে কথা বলার জন্য।
_কিন্তু এখন তো বিকাল চারটা। কলেজ তো ছুটি হয়ে গিয়েছে।
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন দাঁত বের করে হাসতে থাকে কথাটি বলে। আলো ঠান্ডা গলায় বলে,"বেশ তবে রিদির কাছেই যান। দাঁড়ান আমি ইশিতা আপুকে বলছি আবারও তাকে ডেকে নিতে।"
কথাটি বলে আলো উঠে পরতে যায়, তখনই সামিন হুট করে শাড়ির আঁচল টেনে ধরে আলোর।
আলো চ'ম'কে উঠে সামিনের দিকে তাকায় । সামিন আলোর মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তার শাড়ির আঁচল ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। টেবিলের ড্রয়ারের কাছে গিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা বিয়ের কার্ড বের করে আলোর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,"রিদির বিয়ের কার্ড। পাত্র এখানকার এসিল্যান্ড আসিফুল হক। মাথায় চুল কম, মানে টাকলা। সেটা নিয়েই ওকে ক্ষে*পাচ্ছিলাম। হাসাহাসি করছিলাম। এখন বলো, একজন মেয়র তার ছোটো বোনের সমতুল্য কারো সাথে মজাও করতে পারবে না?"
আলো বিয়ের কার্ড টার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন আলোর দিকে খানিকটা ঝুঁকে চোখ সরু করে বলে,"আচ্ছা একটা কথা বলো! তুমি এতো ক্ষে*পেছো কেন? ভালো টালো বেসে ফেললে নাকি আমাকে?"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন হাসতে থাকে, হাসি থামিয়ে বলে, "তোমার মধ্যে কেমন বৌ বৌ একটা ভাব এসেছে। রিদিকে একটা ধন্যবাদ দিতে হবে।"
আলোর পুরো মুখ অ*স্বস্তিতে ছেয়ে গেছে। খুবই আশ্চর্য জনক ভাবে সে এই লোকটাকে ক*ড়া কথা শোনাতে পারছে না।
সামিন উঠে দাঁড়ায়। নরম গলায় বলে,"মজা করছিলাম। দুঃখিত। এতো তাড়াতাড়ি আমাকে ফিল করতে শুরু করবে সেটা আমি আশা করি না। টেইক ইউর টাইম আছিয়া। শুধু আমাকে হারিয়ে দিও না। "
কথাটা বলে সামিন চলে যায় । আলো তখনও তার হাতের কার্ড টার দিকে তাকিয়ে থাকে।
***
"ভাই এই জাবিরের ব্যাপারে অনেক অভিযোগ শুনছি। পার্টির নাম ডোবাবে।"
সামিন কিছু কাগজ দেখছিলো। সেগুলো থেকে চোখ না সরিয়েই রাহাতকে বলে,"কবির আংকেল জানে। সে ব্যবস্থা নিবে।"
_কি ব্যবস্থা? ভাগ্নে বলে সবসময় ছাড় পেয়ে যায়। পার্টির ক্রিড়া স*ম্পাদক অথচ কোনো যোগ্যতা নেই। খালি মেয়েলী যত ব্যাপারে আছে। সেদিন স্থানীয় সরকার দিবসের অনুষ্ঠানে কোথা থেকে দুটো মেয়ে এনে নাচিয়েছে। ছিঃ লজ্জায় মাথা কা*টা যাওয়ার মতো অবস্থা!
_এগুলো হলো খু*জলির মতো বুঝলি রাহাত। একটা চুলকে শেষ করবি। আরেকটা উঠবে। চাপ নিস না। সময় মতো ঝে*রে ফেলবো। আচ্ছা ওর বোন জুঁইয়ের ব্যাপারে আপডেট থাকলে বল। ইলহামের অফিসে যায় নাকি?
_না ভাই, খবর তো পাইনি। তবে শুনেছি ইদানিং এন আর এইচ এন্টার*প্রাইজের মালিকের সাথে খুব ভাব। ভাই ইদানিং সমাজ টা গোল্লায় গিয়েছে একেবারে, অল্পবয়সী মেয়ে গুলো কোথায় ক্যারিয়ার গড়বে তা না করে কখনো বিবাহিত পুরুষ কখনো সু*গার ড্যা*ডি নিয়ে পরে আছে। ন*ষ্ট পুরো। এদিক থেকে আমাদের আলো ভাবী সেরা, কতটা আত্মনির্ভরশীল, পরিশ্রমী, একটা বা*জে রেকর্ড নেই, শুধু মাথায় একটু সমস্যা।
সামিন ম্লান হাসে। তারপর বলে,"ভুল বললি। একটু নয়, মাথায় পুরোটাই সমস্যা!"
***
"এভাবে লাইট জ্বে*লে বসে আছেন কেনো? নিজে না ঘুমাতে না চাইলে ঘুমাবেন না। আমাকে ঘুমাতে দিন।"
ধ*মকের সুরে বলে আলো।
সামিন বাঁকা হাসি হেসে মনে মনে বলে,"বিকেলে আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দাওনি। এখন আমিও তোমাকে ঘুমাতে দেবো না।"
মুখে বলে,"আমার বাতি। নগদ বারো হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি। আমি জ্বে*লে রাখবো।"
আলো কপাল কুঁ'চ'কে শুয়ে থাকে। সামিন ঠোঁট টিপে কিছুক্ষণ হেসে নেয়। সে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে ছিলো। হুট করে আলোর মাথায় আলতো করে হাত রাখে।
আলো ধরফরিয়ে উঠে বসে সামিনের দিকে তাকায়,"এভাবে মাথায় হাত বুলাচ্ছেন কেন?"
_আমার বৌ। নগদ তিন লক্ষ টাকা এবং ধীরে ধীরে একসমুদ্র ভালোবাসা জমা রেখে কিনেছি । আমি হাত বোলাবো।
_কার কাছ থেকে কিনেছেন?
_সাংবাদিক আতাউর আলমের কাছ থেকে।
_হ্যা, ঠিকই। আমরা মেয়েরা তো গরু ছাগল। বাপ আর স্বামী কেনা বে*চা করে।
সামিন আলোর কথায় পাত্তা না দেওয়ার ভান করে নকল হাই তুলে গুনগুন করে কিছু একটা বলে তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"গান শুনবে আছিয়া?"
_না। ঘুমাবো।
_আমি তো গান গাইবো।
কথাটা শেষ করেই সামিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাবে গাইতে শুরু করে,
"চান্দ ছুপা বাদাল-মে, শারমা-কে মেরি জানা,
ছিনে-ছে লাগ-যা তু, বালখা-কে মেরি জানা।"
আলো কান চেপে ধরে বলে,"থামুন। কি বাজে গান করেন আপনি!"
সামিন উচ্চশব্দে হেসে ওঠে, তারপর বলে,"ঠিক বলেছো। আমি রাজনীতি আর গান দুটোতেই অদক্ষ। খুব বাজে করি।"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলতে থাকে,"একটা মজার ঘটনা বলি তোমাকে আছিয়া। সবুজ তো পলি*টিশিয়ান। তো ওদের বাসর রাতে ওর বৌ ওকে একটা গান গাইতে বলেছিলো। ও গলা খাঁকারি দিয়ে গাইতে শুরু করে,"যদি রাত পোহালে শোনা যেতো, বঙ্গবন্ধু মরে নাই।"
আলো জানপ্রাণ লাগিয়ে চেষ্টা করেও তার হাসি আটকে রাখতে পারলো না। বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হাসতে থাকে। সামিন মুগ্ধ চোখে আলোকে দেখছে। এমন ক*ঠিন মেয়েটার হাসি কি ভয়ং*কর সুন্দর!
সামিনের দৃষ্টি দেখে আলো হাসি থামিয়ে চোখ মুখ ক*ঠিন করে অস্ফুট স্বরে বলে,"আমি ঘুমাবো।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলতে থাকে,"রাজনীতি আর গান আমি দুটোই বাজে করি। কিন্তু একটা জিনিস খুব ভালো করি আছিয়া। আমি অনেক ভালো আদর করতে পারি দেখবে?"
আলো চ'ম'কে ওঠে। চোখ মুখ ফ্যা*কাশে হয়ে যায় তার। সামিন একটা বাকা হাসি দিয়ে হুট করে আলোর কপালে একটা চু*মু দিয়ে দেয়। আলো চুপচাপ বসে থাকে।
সামিন ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,"ভয় পেয়ে গিয়েছিলে বুঝি? ভয় পেয়ো না, আমি কথার বরখেলাপ করবো না। যতক্ষন না তুমি অনুমতি দেবে, যতক্ষন না তোমার মন সায় দেবে, আমি আমার অধিকার ফলাবো না। কিন্তু এতো সুন্দর হাসি দেখার পরে , এই চু*মু টা না দিতে পারলে আজ আমি ছটফট করতাম সারা রাত। আত্মার উপর এতো জুলুম করা ঠিক নয় আছিয়া।"
আলো একবারের জন্যও সামিনের চোখের দিকে তাকালো না। যদি তাকাতো তাহলে দেখতে পেতো কতটা মুগ্ধতা সামিনের চোখে তার জন্য। মাথায় গোবর ঠাসা আলো থ'মকে গেলেও যেতে পারতো।
নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে পরে সে।
সামিন আনমনে হাসে। এভাবে হুট করে গুটিয়ে নিলো কেনো মেয়েটা? কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সামিন বুঝবে কিভাবে রাগ করেছে নাকি লজ্জা পেয়েছে নাকি ভ'য় পেয়েছে!
সম্ভবত ভ'য় পেয়েছে। সামিন মনে মনে ভাবে আর ভয় দেখিয়ে কাজ নেই। কোনো বাক্য ব্যয় না করে সুইচ টিপে বাতি নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পরে।
কিছুক্ষণ যেতেই দরজায় ধা'ক্কা পরে। ইহান বাইরে থেকে তার বড় বাবাকে ডাকছে। সামিন উঠে বসে আবারও বাতি জ্বেলে দেয়। আলোও উঠে বসে।
দরজা খুলে দেখে ইহান দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে। সামিন অবাক হয়ে ইহানকে কোলে তুলে নেয়। রিতু আর ইলহাম দাঁড়িয়ে আছে। সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"হয়েছে কি? কাঁ'দছে কেনো? হাত তুলেছো গায়ে?"
রিতু মাথা না'ড়ি'য়ে বলে,"বকেছি।"
_কেন?
_হোমওয়ার্ক করেনি।
_রাত এগারোটা প্রায়। এখন হোমওয়ার্ক করার সময়?
_সন্ধ্যা থেকে ওর বাবার ফোনে কার্টুন দেখেছে। বলেছে ঘুমানোর আগে করে দেবে। এখন ত্যা'ড়া'মি কেন করছে?
_ত্যা'ড়া'মি তো তুমি করছো রিতু।
ধ*মকের সুরে বলে সামিন। ইলহাম ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,"ঠিকাছে বাবা,তুমি পাপার কাছে এসো। হোমওয়ার্ক করতে হবে না আর।"
_না ,আমি যাবো না। মাম্মার মতো তুমিও ব*কেছো।
কাঁদতে কাঁদতে বলে ইহান।
_তুই যাবি না? চল বলছি!
ইহানকে টানতে থাকে রিতু। সামিন ধ*মকে ওঠে,"কি হচ্ছে কি এসব। আমি বাচ্চাদের সাথে তুই তোকারি পছন্দ করি না রিতু। যাও এখান থেকে। যাও বলছি। ও আজ আমার কাছে থাকবে।"
রিতু আমতা আমতা করে বলে,"আপনাদের বড্ড বিরক্ত করবে ভাইয়া। ভাবীকে ঘুমাতে দেবে না।"
"অসুবিধা নেই রিতু। তুমি যাও।"
আলো রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে। রিতু আর ইলহাম দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। সামিন একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে কোনো বাক্য ব্যয় না করে ইহানকে নিয়ে ঘরে ঢুকে রিতু আর ইলহামের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়।
ইহান মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে তাকে স্বাগত জানায়। একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে সামিন ইহানের দিকে তাকিয়ে আলোকে শুনিয়ে বলে,"বাবা,আজ রাতে তুই আমাদের কোলবালিশ ওরফে ব্যারিকেড।"
ইহান বড় বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু বুঝতে পারছে না তার বড় বাবার কথা। আলো চুপচাপ বিছানায় বসে থাকে।
বিছানা থেকে কোলবালিশ সরিয়ে ইহানকে শুইয়ে দেয় সামিন। তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"ও খুব লক্ষি বাচ্চা। একটুও হাত পা ছো*ড়ে না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। "
আলো গিয়ে একপাশে চুপচাপ গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে। সামিন বাতি নিভিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে ইহান উঠে বসে। সামিন উঠে বসে আবারও বাতি জ্বেলে দেয়।
আলো ওপাশ ফিরে দু'জনের কান্ডকারখানা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। মনে হচ্ছে আজ রাতে আর ঘুমোতে দেবে না এই দুজন।
"বড় বাবা গল্প বলো।"
সামিন অবাক হয়ে ইহানের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর বলে,"এতো রাতে? মানুষকে বসতে দিলে শুতে চায় আর তোমাকে শুতে দিয়েছি,তুমি গল্প শুনতে চাচ্ছো বাবা!"
ইহান জোর করতে থাকে। সামিন বলে,"গল্প আসছে না বাবা।"
"না তুমি বলবে।"
সামিন কোনো গল্প খুজে পাচ্ছে না বলার মতো। মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলবে? নাকি শেখ মুজিবুরের জীবনী বলবে? নাকি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর গল্প?
এসব ছাড়া তো সে গল্প জানে না।
ইহান আগ্রহী হয়ে তার বড় বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন বলে,"মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনবে?"
_না রাজা রানীর গল্প।
_বাবা এমন করলে কিন্তু তোমাকে তোমার পাপা মাম্মার কাছে দিয়ে আসবো।
_তুমি বলবে বলবে বলবে।
সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ছেলেটা একেবারে তাদের স্বভাব পেয়েছে, একরোখা।
ইহানের দিকে তাকিয়ে সামিন বলে,
"এক ছিলো রাজা, আরেক ছিলো রানী, তারা দুজন ম*রে গিয়েছে, খতম কাহিনী। এখন ঘুমাও বাবা।"
আলো শাড়ির আঁচল মুখে চেপে নিশ্চুপ হয়ে হাসছে সামিনের এমন অদ্ভুত গল্প শুনে।
ইহান জেদ দেখিয়ে বলে,"পঁ*চা গল্প, এখন মিমিক্রি করো।"
_এখন?
_হ্যা মিমিক্রি করো।
_ইহান বাড়াবাড়ি হচ্ছে বাবা।
_মিমিক্রি করো করো করো।
সামিন দ্বিতীয় বারের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,"একটু আস্তে কথা বলো বাবা, বড় মা ঘুমাচ্ছে। আচ্ছা বলো। কার মিমিক্রি করবো?"
_ফুপ্পির।
_ইশিতার?
_হু।
মাথা নেড়ে ইহান বলে।
সামিন গলা খাঁকারি দিয়ে গলার স্বর মেয়েদের মতো করার চেষ্টা করে বলে,"ভাইয়া! এতো দেরি কেন করলে! ভাইয়া এটা খাচ্ছো না কেন! ভাইয়া ভিজেছো কেনো, ভাইয়া এই শার্ট টা পরেছো কেনো!"
ইহান কুটি কুটি হয়ে যায় হেসে। বড় বাবা অবিকল ফুপির মতো বলছে।
আলো অবাক হয়ে সামিনের কথাবার্তা শুনতে থাকে। এই লোক নাকি একজন নামী প*লিটিশিয়ান! এ তো আস্ত একটা জোকার! বাচ্চাদের থেকেও বাচ্চা!
সামিন ইহানকে বলে,"হয়েছে? খুশি? এখন আমি ঘুমাই?"
_না। এখন বড় মার মিমিক্রি করে দেখাও।
_ইহান..
_মিমিক্রি করো বড় বাবা।
সামিন তৃতীয় বারের মতো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আলো ওপাশে ফিরে ঘুমানোর ভান ধরে আছে। সে ভীষণ কৌতুহলী। ইয়াসার মির্জা তাকে নকল করবে!
সামিন আলোর দিকে এক পলক তাকিয়ে ইহানকে বলে তোমার বড় মাকে নকল করা একটু কঠিন বাবা, আমি চেষ্টা করছি।
একটু থেমে কন্ঠস্বরে আবারও মেয়েলী সুর এনে সামিন বলতে থাকে,"ঘৃণা করি ইয়াসার মির্জা, আপনি খারাপ ইয়াসার মির্জা, ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, ঘৃণা করি...."
আলো ধরফরিয়ে উঠে বসে। সামিন চ'ম'কে ওঠে। দুজন দুজনের দিকে হত*ভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ যেতে আলো ক*ঠিন গলায় বলে,"আপনি একটা বাচ্চার সাথে এসব কি বলছেন!"
_মিমিক্রি করছি তোমার।
আমতা আমতা করে বলে সামিন।
_এসব কেনো বলছেন? ও এসবের কি বোঝে?
_কমন ডায়লোগ বলছি তোমার। আপাতত এটা মাথায় এসেছে।
আলো সামিনের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে । সামিন নরম গলায় বলে,"কি জালা! আচ্ছা সরি।"
আলো বিড়বিড় করে বলে,"নিজের কোনো ভালো স্বভাব তো নেই। আর বাচ্চাটাকেও ভুলভাল কথা বলছেন।"
সামিন লজ্জিত ভঙ্গিতে বসে আছে। ইহান আলোকে বলে,"ব*কছো কেনো বড় বাবাকে তুমি? জানো বড় মা, বড় বাবা খুব ভালো মিমিক্রি করতে পারে।"
_আমিও খুব ভালো মিমিক্রি করতে পারি। দেখবে তুমি?
ইহান উৎসাহী। আনন্দের সাথে মাথা নাড়ায়। আলো বলে,"তোমার বড় বাবার মিমিক্রি করে দেখাই?"
ইহান মাথা নাড়াতে থাকে। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে খুবই উত্তেজিত। সামিন একদৃষ্টে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো গলা খাঁকারি দিয়ে একটু নড়েচড়ে বসে, তারপর ইহানের দিকে তাকিয়ে কন্ঠে গম্ভীর পুরুষালি ভাব এনে বলতে থাকে,"আমি সামিন ইয়াসার মির্জা, যেটা নিষেধ করছি সেটা করবে না, তাহলে আমি একদম বরদাস্ত করবো না আলো। ওটা করবে না,তাহলে আমি একদম বরদাস্ত করবো না আলো। বাড়াবাড়ি করবে না তাহলে আমি একদম বরদাস্ত করবো না আলো!"
অবিকল সামিনকে নকল করে কথা গুলো বলে চুপ হয়ে যায়। ইহান চোখ বড় বড় করে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
সামিন বলে ওঠে,"কিন্তু আমি সব কিছুই বরদাস্ত করে গিয়েছি বরাবর। তোমার সব জে*দ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, তোমার গালা*গাল, তোমার বাড়াবাড়ি। এতো হম্বতম্বি করেও তোমাকে দেখলেই কেমন মিইয়ে যেতাম, ইচ্ছে করতো না কঠোর হতে। একেবারেই না।"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলতে থাকে,"একটা সামিন ইয়াসারের জন্য একটা অদ্রিতা আলোর দরকার ছিলো সম্ভবত। থ্যাংকস এ্যালো, আমার জীবনে লাইট ফিরিয়ে আনার জন্য।"
শেষের বাক্যটা বলে সামিন মৃদু হাসে। আলো কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে ইহানকে বলে,"চলো শুয়ে পরো। কাল সকালে আমি তোমাকে একটা রাজার গল্প বলবো। একটা দু*ষ্টু রাজার।"
ইহানকে আগলে নিয়ে আলো শুয়ে পরে। সামিন বলে ওঠে,"সেই রাজার নাম কি সামিন ইয়াসার মির্জা?"
আলো কোনো কথা বলে না। ইহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। সামিন বলতে থাকে,"তাহলে প্লিজ ছয়টা রানী রেখো গল্পে। ছোটো রানীর নাম থাকবে আলো।"
_বাকি রানীদের নামও বলে দিন।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।
_বড় রানীর নাম আলো, মেজো রানীর নাম আলো, সেজো রানীর নাম আলো, চতুর্থ রানীর নাম আলো, পঞ্চম রানীর নামও আলো।
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"ইহান ঘুমিয়েছে। বাতিটা প্লিজ নিভিয়ে দিন।"
সামিন বাতি নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পরে। আলো বলতে থাকে,"সামান্য একটা গল্প জানেন না? কখনো কোনো গল্প শোনেননি?"
_শুনেছি, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর গল্প, বঙ্গবন্ধুর গল্প, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের গল্প। আমি এনাদের গল্পই শুনেছি।
আলো নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,"তাই? তাহলে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক জীবনে এদের আদর্শ মেনে চলেন।"
সামিন একটু ভাব নেওয়ার চেষ্টা করলো, খুশি খুশি গলায় বলতে থাকে,"অবশ্যই অবশ্যই।"
_তা এদের মধ্যে কোন নেতা মেয়ে তুলে এনে বিয়ে করেছে? বঙ্গবন্ধু? সুভাষ চন্দ্র বসু? নাকি ফজলুল হক?
ভাগ্যিস অন্ধকার ছিলো। নয়তো আলো সামিনের বেলুনের মত চুপসে যাওয়া মুখটা দেখতে পেয়ে খুব হেসে নিতো।
সামিন কোনো কথা বাড়ায় না, মনে মনে বলে,"হ্যা। ঘাট হয়েছে আমার। তোমাকে জব্দ করতে গিয়ে এখন নিজে ফেঁ*সে বসে আছি। এই একটা অপবাদ আমাকে তুমি মৃ*ত্যুর আগেরদিন পর্যন্ত দিয়ে যাবে সম্ভবত। মৃ*ত্যু শয্যায় যখন আমাদের নাতি নাতনি আমার মুখে পানি দিতে আসবে তখনও তুমি এই কথা গুলো জপ করতে থাকবে। যদি আগে জানতাম তুমি কি চি*জ তাহলে সেদিন তুলে আনা তো দূরে থাক একশো হাত দূরে থাকতাম তোমার থেকে। এখন কিছুই করার নেই, ভালোবেসে ফেঁ*সে গিয়েছি আছিয়া।"
***
রাত দেড়টার কাছাকাছি। হঠাৎ গায়ে কারো হাত পরতেই আলো ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে। অন্ধকারে টের পেলো ইহান তাকে আকরে ধরে রেখেছে। সামিনেরও হুট করে ঘুম ভেঙে যায়। সুইচ টিপে বাতি জ্বেলে আলোর দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অস্ফুট স্বরে বলে,"মা ভেবে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছে হয়তো। দাও আমার কাছে।"
_থাকুক।
ইহানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আলো বলে। সামিন বলে,"তুমি শিওর? অসুবিধা নেই তো?"
_না,আপনি ঘুমান।
কথাটা বলে ইহানকে জরিয়ে ধরে আলো দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে। সামিন বাতি নিভিয়ে আবারও শুয়ে পরে। দিন দিন এ বাড়ির সবার প্রতি এই ক*ঠিন মানবীর দরদ দেখতে পাচ্ছে সে। ইশিতার বিড়াল টাও এর কাছে খুব আদর পায়। শুধু তাকেই দরদ দিয়ে দেখে না। তার হাতের ক্ষতটার দিকে দূর থেকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,"ব্যাথা সেরেছে?"
কেন? একটু কাছে এসে হাতটা ছুঁয়ে দেখলে কি হয়? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়?
বিরক্তিকর একটা নারী। উপন্যাসের সবথেকে বিরক্তিকর নায়িকা।মনে দয়া মায়া দেয়ইনি সৃষ্টিকর্তা।
ভোর রাতের দিকে ইহানের ঘুম ভেঙ্গে যেতেই উঠে বসে। চোখ ডলে একবার আলোকে আরেকবার সামিনকে দেখে সামিন কে ডাকতে থাকে। দু'জনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সামিন কোনো সাড়া দেয়না। ইহান বিছানা থেকে নেমে পরে। গুটি গুটি পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দেখে দরজার সিটকিনি তোলা। একটা চেয়ার টেনে সেটার উপর উঠে দরজাটা খুলে ফেলে ইহান। তারপর মাম্মা পাপার ঘরে চলে যায়।
ঘুমের মধ্যে আলো টেরও পেলো না সে সামিনের একেবারে কাছে চলে এসেছে। ইহান ভেবে সামিনকে আকরে ধরেছে এক হাত দিয়ে। হুট করে সামিনের ঘুম ভেঙে যায় গায়ের ওপর নরম স্পর্শ পেয়ে। চোখ মেলে তাকাতেই চোখ দুটো ছানা*বড়া হয়ে যায় তার। একবার তার গায়ের উপর আলোর হাত টার দিকে, আরেকবার আলোর মুখের দিকে তাকায়। মেয়েটার কপালের কাছের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সামিন সংকোচের সাথে চুল গুলো সরিয়ে দেয়। এখন কি করবে সে? এই ভদ্রমহিলাকে ঘুম থেকে তুলে দেখিয়ে দেবে তার কীর্তি? খুব তো সারাদিন সামিনকে দোষা*রোপ করে। এখন সামিনের এই মহিলাকে লজ্জা দিয়ে শো*ধ তোলা উচিত।
সামিন ডাকতে গিয়েও ডাকে না। মনে মনে বলে,"না সামিন ইয়াসার। এই ভুল করিস না। এই মহিলা দেখলে উল্টো তোকেই বলবে যে তুই ওর হাত এনে নিজের গায়ে রেখেছিস। ওর কোনো দোষ নেই।"
কিছুক্ষণ চুপ চাপ থেকে সামিন আলোকে না ডেকে ধীরে ধীরে হাতটা সরিয়ে দেয়।
****
কলিং বেলের আওয়াজে আলো এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে নিজেই এগিয়ে যায়। দরজা খুলে দেখতে পায় সামিন ইয়াসারের দলের ছেলেরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আলোকে দেখতে পেয়ে সবাই আহ্লাদে আটখানা হয়ে একে একে বলতে থাকে,"আসসালামুয়ালাইকুম ভাবী।"
সাতজন পর পর সালাম দেয়। আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সালামের উত্তর দেয়। রাহাত মুখ হাসি হাসি করে বলে,"বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না ভাবী?"
আলো দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। ভদ্রতার সাথে বলে,"আপনারা বসুন।"
_ভাই কি ঘুমাচ্ছে ভাবী?
আরাফ জানতে চায়। আলো কিছু বলার আগেই আরাফ বলে,"প্লিজ একটু ডেকে দিন।"
আলো মাথা নাড়িয়ে দোতলায় চলে যায়। ঘরের মধ্যে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। বারান্দা থেকে সামিন ঘরে ঢুকতেই আলো বলে ওঠে, "নিচে আপনার 'পাশে আছি ভাইরা' এসেছে।"
সামিন অবাক হয়ে বলে,"পাশে আছি ভাই মানে?"
_আপনার দলের ছেলেরা। সারাক্ষণ আপনার পেছনে পেছনে পাশে আছি ভাই, সহমত ভাই, রাজপথ ছাড়ি নাই ভাই এসব বলে ঘুরে বেড়ায় যারা।
সামিন শীতল চোখে আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,"সবসময় খোঁ*চা মেরে কথা বলো কেন বলোতো? এই যে শহরে কোনো প্রসূতি মায়ের র*ক্তের প্রয়োজন পরলে কারা ছুটে যায়? আমার ছেলেরা। দিন নেই রাত নেই সবার বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত। আর আমার প্রতিনিধিরা সবথেকে বিবেচক এবং যোগ্য।"
আলো কিছু না বলে আলমারি থেকে সামিনের একটা পাঞ্জাবি বের করে বিছানার উপর রেখে বলে,"এটা পরুন।"
সামিন পাঞ্জাবি টা তুলে নিয়ে আলোর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে,"ব্যপার কি বলো তো। হঠাৎ এতো কর্তব্য পরায়ণ হয়ে গেলে যে?"
আলো বলে,"এসব আপনার বোন গুছিয়ে রেখে গিয়েছে। আপনাকে এটা পরিয়ে নতুন জামাই সাজিয়ে ও বাড়িতে নিতে বলেছে। তার কড়া আদেশ। এতো বিরক্তিকর আপনার এই বোনটা!
ভাইয়ের প্রতি কি আহ্লাদ! সারাক্ষণ ভাইয়ের এটা কেন গুছিয়ে রাখোনি, এটা কেন ধুয়ে রাখোনি,
কোনদিন না জানি বলে বসে," আমার বুড়ো ধা*মরা ভাইয়ের সর্দি কেনো মুছিয়ে দাও নি!"
সামিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে আলোর দিকে। আলো সামিনের দৃষ্টি উপেক্ষা করে চলে যেতে যেতে বলে,"তাড়াতাড়ি নিচে যান, আপনার র*ক্ত সৈনিকেরা বসে আছে তাদের প্রানপ্রিয় অভিভাবকের জন্য!"
***
রাশিয়া আর ইউ*ক্রেন কবে চূড়ান্ত শান্তি চুক্তি সই করবে? তাদের শান্তিচুক্তির কথা জানা নেই। কিন্তু আলোর সামনে সে এক রাশিয়া আর ইউ*ক্রেনকে বসে খাবার খেতে দেখছে। তাও আবার রাজ*নৈতিক আলোচনা করতে করতে। আলো নিজের প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে একবার আতাউর আলম, একবার সামিন ইয়াসার মির্জার দিকে তাকাচ্ছে ।
খাবার টেবিলে তারা পাঁচ জন খেতে বসেছে। আজান,আয়াত, আতাউর আলম এবং আলো। রেহেনা সবার প্লেটে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে।
রাজ*নৈতিক আলোচনা বেশ রসালো মনে হচ্ছে। সামনে এতো ভালো ভালো খাবার রেখে এরা বর্তমান সরকারের পক্ষে বিপক্ষে বিতর্ক করছে। আরে এটা খাবার টেবিল নাকি ট*কশো?
আতাউর আলম খুব সুন্দর ভাবে সামিন ইয়াসার মির্জাকে বর্তমান সরকারের খারাপ দিকগুলো বলছে। জবাবে সামিন ইয়াসার তার দলীয় সরকারের ভালো ভালো দিক গুলো তুলে ধরছে।
আলোর রীতিমতো মাথা ধরে গিয়েছে। হুট করে গলায় মাছের কাঁ*টা বিঁধতেই সে বি*ষম খেয়ে কাশতে শুরু করে। আতাউর আলম এবং সামিন উভয়েই আলোচনা থামিয়ে,একই সাথে,একই মুহূর্তে দুটো পানির গ্লাস আলোর দিকে এগিয়ে দেয়।
আলো কাশি থামিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সবাই অবাক হয়ে আতাউর আলম এবং সামিন ইয়াসার মির্জাকে দেখছে। তারা নিজেরাও একে অপরের হাতের পানির গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে।
আলো তাদের কারো গ্লাসই নেয়না। নিজে একটা গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়ে নেয়।
দুজনে গ্লাস নামিয়ে রেখে আবারও বিতর্কে মেতে ওঠে। রেহেনা সামিনের প্লেটে মাংস তুলে দিতে যায়। সামিন বাধা দিতে গেলে আ*চমকা সামিনের গায়ে পরে যায়। তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে সামিন। সাদা রঙের পাঞ্জাবিটা মাংসের ঝোল লেগে একেবারে শেষ।
আতাউর আলম বিরক্ত হয়ে রেহেনাকে বলে,"তুমি জামাইয়ের প্লেটে মাংস না দিয়ে গায়ে দিচ্ছো যে?"
রেহেনা কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। কি একটা লজ্জার ব্যাপার। আলো ফিক করে হেসে ফেলে। রেহেনা দূর থেকে চোখ রাঙানি দেয় আলোকে। আতাউর আলম আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"ওকে ঘরে নিয়ে যাও আম্মু। আমার একটা নতুন পাঞ্জাবি বের করে দাও।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। কতটা ছেলে মানুষ হলে অন্যের বিপদে এভাবে হাসতে পারে! এই মেয়েটা সত্যিই দুর্বোধ্য!
আলো হাসি থামিয়ে সামিনের রাগান্বিত দৃষ্টি দেখে কিছুটা ঘা*বড়ে যায়। তারপর হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলে,"আসুন।"
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে সামিন। শশুরের পাঞ্জাবি গায়ে তাকে খুব একটা খারাপ লাগছে না। আলো তার পেছনে দাঁড়িয়ে তার কর্মকান্ড দেখছে। সামিন একপলক আলোকে দেখে নিয়ে পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে, " একেবারে শশুরের জামাই লাগছে না বলো?"
আলো ঠান্ডা গলায় বলে,"আমার আব্বুকে বেশি সুন্দর লাগে এই পাঞ্জাবি টাতে।"
সামিন ম্লান হেসে বলে,"জানি, প্রত্যেকটা মেয়ের কাছে নিজের বাবাই সবথেকে হ্যান্ডসাম পুরুষ, তুমি আর তোমার আব্বু একে অপরের জন্য জান বের করে দাও।"
_এই অনুভূতির আপনি কি বুঝবেন এখন? নিজে যখন মেয়ের বাবা হবেন তখন বুঝবেন।
সামিন আলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,"আমি মেয়ের বাবা হবো? তাহলে তো তুমিও মেয়ের মা হবে।"
আলো থতমত খেয়ে যায়। তার মুখ দেখে কিছুক্ষণ তাকে বুঝতে চেষ্টা করলো সামিন। লজ্জা নাকি জড়তা? কোনটা ছেয়ে আছে তার সামনের নারীটির মুখমণ্ডলে?
কিছু সময় তাকিয়ে থেকে আলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে মৃদু স্বরে বলে,"তোমার মুখে ফুলচন্দন পরুক আছিয়া।"
***
তলপেটের নিচটা কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে বারবার। আবার হঠাৎ করে অসহ্য যন্ত্রণায় বি*ষিয়ে উঠছে কখনো কখনো। পেটে হাত দিয়ে বসে আছে হেনা। জামিল ফিরছে, নিজে বাইক চালিয়ে এতো দূরের রাস্তা পাড়ি দিচ্ছে। যাত্রাপথে চিন্তায় ফেলতে চাচ্ছে না লোকটাকে হেনা,তাই তাকে কিছু বলেনি।
ইশিতা ফোন থেকে চোখ সরিয়ে হেনার দিকে তাকিয়ে বলে,"কোনো সমস্যা ভাবি? কেমন অস্বাভাবিক লাগছে তোমাকে।"
হেনা মাথা নাড়িয়ে বলে,"কিছুনা ইশিতা, ফলস পে*ইন সম্ভবত।"
ইশিতা আবারও নিজের কাজে মন দেয়। তার তো এসব ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই। মেজো ভাবীর আছে। কিন্তু মেজো ভাবী বাড়িতে নেই। ভাইয়াকে নিয়ে তার অসুস্থ মাকে দেখতে গিয়েছে।
ব্যাথাটা বারছে হেনার, মুখমণ্ডল নীল হয়ে আছে। ইশিতা ফোন নিয়ে উঠে দাঁড়ায়,শান্ত ফোন দিচ্ছে। গেস্ট রুমের বেলকোনিতে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে নিয়ে ফিরে এসে হেনাকে দেখে । তার ভালো ঠেকছে না হেনার এই অবস্থা। কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,"এক গ্লাস দুধ এনে দেই?"
হেনা হাঁপাতে থাকে। ইশিতা রান্নাঘরের দিকে যায়। গ্লাসে দুধ ঢেলে নিয়ে এসে ঘরের দরজায় দাঁড়ায়। তারপর গ্লাস টা রেখে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে যায়।
সামিন ঘরের বাতি নেভাতেই যাচ্ছিলো এমন সময় দরজায় ইশিতা ধা*ক্কা দিতে থাকে। দরজা খুলে বোনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সামিন। ইশিতা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,"হেনা ভাবীর পেইন হচ্ছে!"
আলো কথাটা শুনে দৌড়ে নিচে চলে যায়। ইশিতা তার পিছু পিছু যায়। সামিন সাথে সাথে সিটি হসপিটালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে নিয়ে নিচে যায়।
ব্যা*থায় কা*তরাতে থাকে হেনা। হাঁটু গেড়ে বসে হেনার হাত ধরে রাখে আলো। খুব মায়া লাগছে মেয়েটির জন্য। একটা আপন মানুষও কাছে নেই। তাই সম্ভবত ভরসা করতে পারছে না কাউকে। হেনার ফোনে বারবার জামিল ফোন দিয়ে যাচ্ছে। ইশিতা ফোনটা ধরে জামিলকে হেনার সুস্থতার কথা জানায় হেনার অনুরোধে। আসলে তো নিজেই দেখবে, এখন টেনশন দেবার প্রয়োজন কি!
আলো কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়, দ্রুতপায়ে লিভিং রুমে গিয়ে সামিনকে বলে,"কি করবেন?"
"অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছি। আসছে, পথে।"
আলো অবাক হয়ে বলে,"গাড়ি আছে তো আপনার। গাড়ি টা কোন কাজে ব্যাবহার করবেন শুনি? শুধু মেয়ে তুলে আনার জন্য? চলুন বের হই। অ্যাম্বুলেন্স আসতে আসতে অনেক সময় লেগে যাবে। আপনার শহরে ফুট*পান্ডার ডেলিভারি ম্যান আপনার ঐ সিটি হসপিটালের অ্যা*ম্বুলেন্স সা*র্ভিসের থেকে ফাস্ট।"
সামিন শীতল চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে, এই পরিস্থিতিতেও মেয়েটা তাকে খোঁ*চা মেরে কথা বলতে ছারছে না!
ঠান্ডা গলায় বলে,"গাড়িটা গ্যারেজে আছে। বাইক নিয়ে বের হবো? বলো? "
আলো কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায়। কিন্তু সে নিজের ভুল স্বীকার করবে না,তাকে তো জিততেই হবে,তাই বলে ওঠে,"আরেকটা গাড়ি কিনতে পারেন না? এতো টাকা দিয়ে কি করবেন?"
সামিন বোকার মত তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। তারপর আলোকে জব্দ করার জন্য বলে ওঠে,"তোমার ডেলিভারির আগে কিনে ফেলবো। যাতে একটা গাড়ি গ্যারেজে থাকলে অন্যটাতে করে তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে পারি। এখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে অ্যা*ম্বুলেন্সের অপেক্ষা করো, বেশি ঠোঁট না*ড়ালে চুপ করিয়ে দেওয়ার অনেক উপায় আমার কাছে আছে।"
কোনো রকমে বাইকটাকে সিটি হসপিটালের সামনে দাঁড় করিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ভেতরে ছুটে যায় জামিল। তার শরীরের সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে আসছে যেন। দোতলার থ্রি ব্লকের অ'পা'রেশন থিয়েটারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে।
অপারেশন থিয়েটারের সামনে পায়চারি করছে সবাই। জামিলকে দেখে দাঁড়িয়ে পরে সামিন।
ধীর পায়ে জামিল এগিয়ে যায়। ইশিতা নরম গলায় বলে,"ওয়াটার ব্রে'ক হয়েছে হঠাৎ, সি-সেকশন ছাড়া পসিবল ছিলো না জামিল ভাই।"
জামিল ক্লান্ত ভঙ্গিতে একটা বেঞ্চিতে ধপ করে বসে পরে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,"একটু পানি খেতে চাই।"
আলো পানির বোতল এগিয়ে দিতেই পুরো বোতল খালি করে ফেলে। সামিন জামিলকে দেখছে। একটা সময় এসব সামিনের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতো। এখন বেশ মায়া হচ্ছে জামিলের প্রতি।
অ'পারেশন থিয়েটার থেকে একজন নার্স বের হয়ে আসে। তার হাতে কাপড়ে মোড়ানো ছোটো একটা প্রান। দোতলার ব্লক থ্রির পুরো এরিয়া কাঁপিয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে জানান দিচ্ছে,"আমি এসে গিয়েছি।"
জামিল নার্সের দিকে তাকিয়ে আছে বোকার মতো। নার্স সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,"বাচ্চার বাবা কে?"
সামিন নার্সকে ইশারা করে দেখিয়ে দেয় জামিলকে। নার্স এগিয়ে গিয়ে আনন্দিত গলায় বলে,"ধরুন। আপনার ছেলে। আপনার ওয়াইফ ঠিক আছে। একটু পরে কেবিনে শিফট করা হবে।"
জামিল উঠে দাঁড়ায়। কাঁপা কাঁপা হাতে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বাচ্চাটার মুখের পানে তাকিয়ে থাকে। এ তার ছেলে! সে বাবা হয় এই ছেলেটার।
সামিন গলার স্বর উঁচু করে বলে,"হেনাকে স্বর্ণের চেইন দেওয়া হবে জামিল।"
জামিলের চোখে পানি ছলছল করছে। সে মুখ হাসি হাসি করে মজার ছলে বলে,"কিন্তু ছেলে হলে আমাকে নতুন বাইক দেওয়ার কথা ছিলো ভাই।"
_যে ওই প্রানটাকে দশমাস নিজের ভেতরে ধারণ করেছে,তাকে উপহার দিতে হয়। তুই কোথা থেকে উড়ে এসে এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে বাইক হা'তিয়ে নিবি? উপহার হেনা পাবে, একজন মা পাবে।
আলো দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে সে জানতে চাইছে। ঠিক ঠিক ভাবে জানতে পারছে কি? সবকিছু কি এতটাই পরিষ্কার?
***
আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে আলো সামিনের দিকে এগিয়ে যায়। তার হাতে একটা গ্লাস। করিডোরে এখন কেউ নেই। ইশিতা এবং জামিল হেনার কেবিনে।
সামিন একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। আলো গিয়ে সামিনের পাশের চেয়ারটাতে বসে। সামিন মাথা তুলে আলোর দিকে তাকায়।
আলো জড়তা কাটিয়ে তার হাতের গ্লাসটা ধীরে ধীরে সামিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,"এটা খেয়ে নিন।"
সামিন অবাক হয়ে বলে,"কি এটা?"
_ডাবের পানি। হেনাকে র'ক্ত দিয়েছেন। তারপর কিছু মুখেও দেননি।
সামিন ম্লান হেসে বলে,"আমিও র'ক্ত সৈনিক। এসবে আমার অভ্যাস আছে। বাড়িতে গিয়ে এক প্লেট ভাত আর রিতুর হাতের শিং মাছের ঝোল খাবো, সব ঠিক হয়ে যাবে।"
_আপনার দ'ম আছে।
_হ্যা, তা ঠিক বলেছো। নয়তো তোমার সাথে সংসার করার স্বপ্ন দেখি?
_কেনো আমার সাথে সংসার করা ভ'য়ংকর ব্যাপার নাকি? যে দ'ম থাকতে হয়?
_না, সাধনার ব্যাপার।
আলো নিশ্চুপ । মাথা নিচু করে গ্লাসটা ধরে রেখেছে। সামিন আড়চোখে একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে আনমনে হেসে গ্লাসটা নেয়। ডাবের পানি টা খেয়ে নিচু স্বরে বলে,"এখন তো সব ঠিক আছে। বাড়িতে যেতে চাও? ক'ষ্ট হচ্ছে তোমার? তাহলে ইশিতা আর তোমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেই!"
"আর আপনি?"
"আমি পরে যাবো। সকালে।"
"আমরাও সকালে যাবো।"
আলো অস্ফুট স্বরে বলে।
সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলো মাথা নিচু করে বলে,"হসপিটালে থাকতে কোনো অসুবিধা হয়না আমার। বেশিরভাগ সময়ই তো হসপিটালে থাকতে হয়েছে আমাকে।"
চুপচাপ বসে থাকে দুজন। কিছুক্ষণ পরে সামিন বলে,"বাড়িতে গিয়ে সকালে সবকিছু গুছিয়ে নেবে। সবকিছু বুক করে রেখেছি। পরশু সকালে ফ্লাইট।"
***
নিজের জিনিস পত্র গুছিয়ে নিতে গিয়ে আলো চিন্তায় পরে গিয়েছে। শাড়ি, প্রয়োজনীয় জিনিস সবকিছু নিয়েছে। আর কি নেবে? আলো কখনোই দেশের বাইরে যায়নি। তার কোনো ধারণাও নেই।
সামিন আড়চোখে একবার আলোকে দেখে বলে,"ওদেশে গিয়েও কি শাড়ি পরবে?"
আলো সামিনের দিকে তাকায়।
হঠাৎ সামিন বলে ওঠে,"রেডি হও।"
আলো অবাক হয়ে বলে,"কেনো?"
_বাইরে যাবো এখন আমরা।
_কিন্তু কোথায়?
_ভুলে গিয়েছিলাম। তোমাকে শুধু শাড়িই কিনে দেওয়া হয়েছে। তোমার জন্য কিছু ড্রেস কিনবো চলো।
আলো আমতা আমতা করে বলে,"ড্রেস মানে?"
_সালোয়ার কামিজ।
_দরকার নেই। শাড়ি পরতে পরতে আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।
আলো লাগেজ রেখে উঠে দাঁড়ায় । সামিন ওয়ালেট আর ফোনটা হাতে নিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"রেডি হবার দরকার নেই , ঠিকই লাগছে তোমাকে, এখনই চলো।"
আলো বাধ সাধবার আগেই সামিন আলোর হাত ধরে । আলো চ'মকে ওঠে সামিনের এমন আচমকা স্পর্শে।
আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে সামিন বলে,"চলো।"
নিজে পছন্দ করে কিছু স্টিচড সালোয়ার কামিজ কিনে নেয়। আলো শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সামিনের পাশে, সংকোচ নিয়ে।
শো-রুমের মালিক সামিনের সাথে হেসে হেসে কিছু পার্সোনাল কথাও বলছে। বিল মেটানোর আগে সামিন আলোকে বলে, ট্রা'য়া'ল রুমে গিয়ে দেখতে চাও?
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,"দরকারও নেই। আমার পছন্দ বরাবর খুবই ভালো। সেটা পোশাক থেকে শুরু করে বৌ, যাই পছন্দ করি না কেনো, বেস্ট হয়ে থাকে।"
আলো দাঁড়িয়ে আছে। সামিন শপিং ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে আলোকে বলে,"চলো বাড়ি ফেরা যাক, তার আগে হেনাকে দেখে যাবো। ভালো কথা,ওর জন্য একটা স্বর্ণের চেইন কিনতে চাচ্ছি। এবার তুমি আমাকে হেল্প করো। এসো।"
একটা গয়নার শো রুমে ঢুকে হেনার জন্য চেইন পছন্দ করতে থাকে আলো। চেইন পছন্দ করার দায়িত্ব আলোকে দিয়ে সামিন চারপাশটা দেখতে থাকে। মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে যায় একটা লকেটে। অনেক সিম্পল একটা লকেট। কিন্তু ভারি চমৎকার। ঐ জেদী মেয়েটার গলায় ভীষণ মানাবে। আড়চোখে আলোকে একবার দেখে সামিন বলে,"পছন্দ করা হয়ে গিয়েছে চেইন?"
_জ্বি। এটা।
_এবার তুমি ঐখানে গিয়ে বসো। আমি বিল মিটিয়ে আসছি।
***
গাড়ির হর্নের শব্দে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম। এ শহরের লোকজনের ধৈর্য্য এতো কম কেনো? মাত্র দুমিনিট হয়েছে রাস্তাটায় জ্যাম লেগেছে, বিরক্ত হয়ে সবাই হর্ন বাজাতে শুরু করেছে। আলো ঘাড় ঘুরিয়ে সামিনের দিকে তাকায়। লোকটা সিটে হেলান দিয়ে আরাম করছে। যেনো জ্যামের মধ্যে পরে থাকতে তার বেশ ভালো লাগছে, এভাবে কয়েক বছর বসে থাকতে পারবে সে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে কেউ যদি এখন বলে,আপনাকে আজ সারাদিন জ্যামে বসে থাকতে হতে পারে। এই লোকটা তখন ম্লান হেসে বলবে,জ্বি আচ্ছা, আমি বরং একটু ঘুমিয়ে নেই। জ্যাম কেটে গেলে ডেকে দেবেন।"
অবশ্য এই লোকটার প্রচুর ধৈর্য্য। তার প্রমাণ আলো পাচ্ছে। ২০২৩ সালের সেরা ধৈর্য্যশীল পুরুষের অ্যা'ওয়ার্ড টা একে দিয়ে দেওয়া উচিত। সামিনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় আলো। একটা গাড়িও সামনে এগোচ্ছে না।
সামিন স্টিয়ারিং-য়ে হাত রেখে আড়চোখে আলোকে দেখছে। মেয়েটা এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছে বাইরে? গাড়ির নাম্বার প্লেট?
এই মেয়েটার মধ্যে একটা গোয়েন্দা গোয়েন্দা ভাব আছে। অথচ এ একজন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। এর সাথে এর সাব'জেক্ট বড্ড বেমানান। এর উচিৎ ছিলো পু'লিশে জয়েন করা, যা গালাগালি জানে! এর একটা গালি শুনলেই আসামী লজ্জায় সব বলে দিতো, রি'ম্যা'ন্ডে নিতে হতো না।
হঠাৎ গাড়ির জানালায় টোকা পরে। সামিন জানালার কাঁচ নামিয়ে দেয়। একটা আট-দশ বছর বয়সী ময়লা ফ্রক পরা বালিকা সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে কিছু বেলী ফুলের মালা। বালিকাটি নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে,"মালা নিবেন ভাইয়া? তাজা ফুল।"
সামিন একপলক মেয়েটির হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,"স্কুলে যাওনা?"
_যাই, আজ তো বন্ধ।
ঘাড় ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে আবারও মেয়েটির দিকে তাকায়। তারপর বলে,"সবগুলো দাও।"
মেয়েটি খুশি হয়ে সবগুলো মালা সামিনকে দিয়ে দেয়। সামিন জিজ্ঞেস করে,"কত হয়েছে?"
_একশো বিশ টাকা ভাইয়া।
একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে সামিন মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,"রেখে দাও।"
ফুলওয়ালি মেয়েটা বিস্ময় নিয়ে তার হাতের নোটটার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন জানালার কাঁচ তুলে দেয়।
আলো সামিনের হাতের মালা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন ঘুরে আলোর দিকে তাকাতেই ঘাবড়ে যায় কিছুটা। হঠাৎ করে তার মধ্যে অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে। সে তার বত্রিশ বছরের জীবনে কাউকে ফুলের মালা দেওয়া তো দূরে থাক, একটা ফুলের পাপড়িও দেয়নি।
আলো একদৃষ্টে মালার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন গাড়ির ড্যাশ'বোর্ডের ওপর মালা গুলো রেখে আমতা আমতা করে বলে,"গাড়িটা সাজাতে কিনেছি।"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন মনে মনে বলে,"ওগুলো তোমার স্টুপিড মেয়ে।"
আলো আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি দেয়। বিরক্তিতে সামিনের কপাল কুঁ'চ'কে যায়। এদেশে একটা মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে বেলী ফুলের মালা পছন্দ করে না। অথচ এই মেয়ে ছুঁ'য়েও দেখছে না। এটা কি ধরনের নারী!
সামিনের ইচ্ছা করছে আলোর ঘাড় ধরে কাছে টেনে এনে মালা গুলো খোঁপায় লাগিয়ে দিতে। কিন্তু ধৈর্য্যশীল সামিন নিজেকে সংযত করে চুপ করে বসে থাকে।
***
"হ্যা আন্টি সব গুছিয়ে নিয়েছি। আপনি ওনাদের বলে রাখুন।"
এক হাত দিয়ে ফোনটা কানে ধরে রেখে অন্য হাতে কোলবালিশ এনে বিছানার মাঝে রাখে সে। প্রতিদিন রাতে এই জড়বস্তুটাকে আলমারি থেকে বের করে নিজের অধিকারের কিছুটা দিয়ে দেওয়া খুবই কষ্টের ব্যাপার সামিনের কাছে। কিন্তু নিজের বৌয়ের নারীবাদী অনূভুতির প্রতি সম্মান জানাতে সে এই কাজটা খুবই আনন্দের সাথে করে। মুখটা এমন করে রাখে যেন এই কাজটা করে তার একটুও বিরক্তি লাগছে না,সে খুবই আনন্দিত।
বুকের যন্ত্রনা বুকে চেপে রেখে মনে মনে কোলবালিশটার দিকে তাকিয়ে বলে,"একবার বৌয়ের মনে যায়গা করে নিতে দে। তারপর প্রথমেই তোকে কে'টে টু'করো টু'করো করবো আমি।"
ফোনের ওপাশে ডক্টর রুবি ছিলো। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার ব্যাপারে কথা হচ্ছিলো দুজনের। ফোন কে'টে দিয়ে সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলমারির মধ্যে কিছু একটা খুঁজছে।
"কিছু খুজছো?"
সামিনের প্রশ্নে আলো ঘুরে তাকায়। অস্ফুট স্বরে বলে,"আম্মু বলেছে স্বর্ণের গয়না গুলো সাথে করে না নিয়ে যেতে। সেগুলো রেখে দেবো।"
সামিন আলোর হাতের দিকে তাকায়। আলো নিজের হাতের বালা দুটো খুলতেই যাচ্ছিলো। সামিন নরম গলায় বলে,"ঐ দু'টো থাকুক প্লিজ!"
আলো থেমে যায়। কিছু মুহূর্ত সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আলমারির দরজা বন্ধ করে বিছানার কাছে যায়। বেড সাইডের টেবিলের ওপর বেলী ফুলের মালা গুলোকে দেখতে পেয়ে সামিনের দিকে তাকায়।
সামিন বিছানায় চুপচাপ বসে আছে আলোর দিকে তাকিয়ে। আলো নিজের যায়গায় শুতেই যাচ্ছিলো তখনই সামিন বলে ওঠে,"আরেকটা আবদার রাখবে।"
আলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। সামিন তার বালিশের নিচে থেকে একটা ক্ষুদ্রাকার বক্স বের করে তার মধ্যে থেকে সেই লকেট টা বের করে। আলো নিশ্চুপ হয়ে সামিনের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
একপলক আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে আলোর দিকে এগিয়ে যায়। আলো সামিনের পদক্ষেপ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে নিজের যায়গায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকে।
আলোর খুব কাছে গিয়েও দূরত্ব বজায় রেখে লকেট টা আলোকে পরিয়ে দিতে দিতে বলে,"এটাও থাকুক।"
লকেট টা পরিয়ে আলোকে মুগ্ধ চোখে দেখছে সামিন। আলো তার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বসে থাকে। পর পর সামিন বলে ওঠে,"একটা শেষ আবদার রাখবে?"
আলো জড়তা কাটিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"বলুন।"
সামিন ডান হাত বাড়িয়ে বেলী ফুলের মালা গুলো নিয়ে নেয়।সবগুলো একসাথে পেঁচিয়ে নিয়ে আলোর খোঁপায় বেঁধে দেয়। নির্দিষ্ট দূরত্বে বসে হাত বাড়িয়ে মালাটা খোঁপায় লাগাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সামিন ভেবেছিলো আলো রিয়্যাক্ট করবে। আলোর নীরবতা সামিনকে স্বস্তি দিলেও আলোর চোখে মুখে ছেয়ে থাকা সংকোচ সামিনের মন খারাপ করে দেয় মুহুর্তেই।
খোঁপা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে বলে,"এগুলোও থাকুক। আজ রাতের জন্য। গাড়ির ড্যাশ'বোর্ডের উপর পরে থাকলে এতো সুন্দর ফুলগুলোর অপমান হতো, তাদের সঠিক এবং উপযুক্ত যায়গায় রেখে দেওয়াটা আমার দায়িত্ব। মেয়র তার দায়িত্ব পালনে অলসতা করে না আছিয়া।"
আলো চেহারায় সংকোচ নিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। সামিন নরম গলায় বলে ওঠে,"একটা সর্বশেষ আবদার রাখবে?"
আলো এইবার সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোর গালে একটা হাত রেখে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে," তুমিও প্লিজ থেকো। তবে এক রাত্রি কিংবা দু রাত্রির জন্য না, আরব্য রজনীর মতো হাজার রাত্রি থেকো, আমি তোমার উপযুক্ত স্থান হবার চেষ্টা করবো। যে স্থানে থাকলে তুমি কখনও অসম্মানিত কিংবা অপমানিত হবে না আছিয়া।"
কথাটা শেষ করেই সামিন আলোর গাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরে টানটান হয়ে। তার চোখে মুখে ছেয়ে থাকা তার কাঙ্ক্ষিত নারীটাকে একান্তে পাওয়ার জন্য তার পুরুষ মনের ব্যাকুলতা, চাদরে মুখ না ঢেকে নিলে ঐ নারীটা বুঝে নেবে, সামিন তাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না।
আলো অদ্ভুত চোখে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের গলায় সামিনের পরিয়ে দেওয়া লকেট টা ছোঁয়। দীর্ঘসময় বসে থেকে ধীরে ধীরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরে সে, তার হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে লকেট টা।
***
ফ্লাইট সকাল সাড়ে সাতটায়। তারা ভোর সাড়ে চারটার সময় এয়ারপোর্টে পৌঁছে যায়। ইলহাম সামিন আর আলোকে নামিয়ে দিয়ে আসে এয়ারপোর্টে।
সিকিউরিটি চেকিং হয়ে গেলে সামিন আলোকে নিয়ে একটা ফুডশপের দিকে যায়। সেখান থেকে হালকা কিছু স্ন্যাকস কিনে নিয়ে আলোকে একটা বেঞ্চিতে বসতে বলে নিজেও পাশে বসে। হাতের প্যাকেট টা আলোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,"হালকা কিছু খেয়ে নাও।"
আলো রোবটের মতো হাত বাড়িয়ে প্যাকেট টা নিয়ে নেয়। সামিন নিজের প্যাকেট খুলে স্যান্ডউইচ খেতে থাকে।
পাশে, কিছুটা দূরেই এক বৃদ্ধ দম্পতি তাদের দেখছিলো। মহিলা কৌতুহলী হয়ে সামিনকে বলে,"তুমি সামিন ইয়াসার মির্জা না?"
সামিন তার দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সাথে উত্তর দেয়,"জ্বি। "
_আমাকে চিনতে পেরেছো? আমি কলাম রাইটার নাফিসা কালাম, তোমার দিগন্ত ফা'উন্ডেশনের একটা প্রতিবেদন লিখেছিলাম আমি।
সামিন কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে,"জি।"
_সাথে কে? তোমার ওয়াইফ?
_জি।
_সিঙ্গাপুর কেনো যাচ্ছো? হানিমুনে?
সামিন থতমত খেয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো খাওয়া রেখে বসে আছে চুপচাপ। মুহুর্তেই অস্বস্তি কাটিয়ে সামিন বলে ওঠে,"চিকিৎসার জন্য।"
বৃদ্ধ লোকটা বলে ওঠে,"তোমরা ই'য়াং কাপল যাচ্ছো চিকিৎসার জন্য আর আমরা বুড়ো বুড়ি যাচ্ছি হানিমুনে। হা হা হা।"
"হ্যা, র'স উপচে পরছে তো আপনাদের।"
আলো বিড়বিড় করে বলে ওঠে।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে,"মুরব্বি মানুষ, বেয়াদবি করবে না আলো।"
_উনারা এতো পার্সোনাল কথা জানতে চাচ্ছে কেনো? মুরব্বিদের মতো থাকতে পারে না?
ফিসফিসিয়ে বলে আলো।
সামিন কোনো কথা বলে না। বৃদ্ধ মহিলা বলে ওঠে,"চিকিৎসার জন্য যাও বা বিজনেস ট্রিপ, বৌ নিয়ে যখন যাচ্ছো সেটাকে হানিমুনই বলতে হবে।"
সামিন বিরস মুখে স্যান্ডউইচে একটা কা'মড় বসিয়ে মনে মনে বলে,"হানিমুন ? মধুচন্দ্রিমা? সে আর এ জীবনে হচ্ছে আমার!"
***
"সিটবেল্ট বেঁ'ধে নাও।"
আলো চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকিছু দেখছিলো। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"কখনো প্লেনে ওঠোনি?"
আলো মাথা নাড়ায় ।
_পাস*পোর্ট করেছিলে কেনো তবে?
_আব্বু আমাদের সবার পাস*পোর্ট করিয়ে রেখেছিলো। আব্বুর খুব শখ ছিলো মোটামুটি একটা এমা*উন্টের টাকা জমে গেলেই কাছের কোনো দেশে ট্যুর দেবে। কিন্তু সেই মোটামুটি এমা*উন্টের টাকা কখনোই জমতো না।
সামিন ম্লান হাসে। তারপর বলে,"সৎ মানুষদের সাথে এমনটা হয়।"
আলো বলে,"আপনি কোন কোন দেশে গিয়েছেন?"
_আমি? মোট তিনটা দেশে, ইন্ডিয়া, ইউএসএ,সিঙ্গাপুর।
_সিঙ্গাপুর কেনো গিয়েছিলেন?
_দুইহাজার চৌদ্দ সালে গিয়েছিলাম,তখন আমার তেইশ বছর বয়স। আমি,সাগর আর আমার কিছু বন্ধু। তখন বাবা এমপি ছিলো, আমি পলি*টিক্স করতাম না।
_সাগর মানে,সাগর ভুঁইয়া?
_হু।
_ও আপনার বন্ধু ছিলো? শ*ত্রু কিভাবে হলো? বিরোধী দল করে?
_না অন্য কারনে। সেসব তোমার না জানলেও চলবে। দেখি সিট বেল্ট বাধো।
সামিন নিজেই আলোর সিটবেল্ট বেঁধে দেয়। আলো সামিনের দিকে তাকায়। দু'জনের চোখাচোখি হতেই আলো চোখ সরিয়ে নেয়।
"এক্সকিউজ মি স্যার।"
অতি সুমিষ্ট নারীকন্ঠটি। সামিন আর আলো তাকায়। তাদের সামনে অতিমাত্রায় সুন্দরী একজন বিমানবালা দাঁড়িয়ে আছে।
সামিন বলে,"ইয়েস?"
_স্যার আপনাদের মিল।
তাদের সামনে খাবার সাজিয়ে রেখে বিমানবালা চলে যায়। আলো মেয়েটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। বয়স সাতাশ-আঠাশ হবে। শারীরিক গঠন খুবই চমৎকার। অত্যন্ত সুশ্রী চেহারা এবং অতিরিক্ত ফরসা। ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক দিয়েছে,দেখে মনে হচ্ছে একটা গোটা লিপস্টিক ঘষে ঘষে লাগিয়েছে। গাঁয়ের শাড়িটা পরেছে আঁট*সাঁট ভাবে। যেখানেই যাচ্ছে পুরুষ লোক গুলো হা করে গিলে খেতে চাইছে তাকে। আলো বিরক্তিতে কপাল কুঁ*চকে ফেলে, তারপর সামিনের দিকে তাকায়! লোকটা একমনে তার হাতের একটা ম্যা'গা'জিনের দিকে তাকিয়ে আছে। চারদিকে কি হচ্ছে সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
সামিনের থেকে চোখ সরিয়ে আলো ম'নি'টরে চোখ রাখে। সামিন ম্যা'গা'জিন রেখে তার দিকে তাকিয়ে বলে,"কোনো অসুবিধা? ব'মি পাচ্ছে?"
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন আলোর দৃষ্টি অনুসরণ করে মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমরা এখন মিয়ানমার হয়ে যাচ্ছি।"
আলো কোনো কথা বলে না, আবারো আশেপাশে দেখতে থাকে। সামিন আলোর বাচ্চামো আড়চোখে দেখে মনে মনে হাসছে। মেয়েটার চোখে মুখে কৌতুহল।
একটা পঞ্চাশোর্ধ পেটমোটা লোক এক বিমানবালার বু'কের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আলোর পুরো শরীর জ্বলে ওঠে, বিড়বিড় করে বলে ওঠে "আরে লু'চু আংকেল মুখটা বন্ধ করুন, মাছি ঢুকে যাবে তো।"
সামিন তৎক্ষণাৎ আলোর মুখ চেপে ধরে এদিক ওদিক তাকায়।
সামনের সিটের একজন মহিলা ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হয়ে আলোকে একবার দেখে আবারও সামনে তাকায়।
আলো ছ'ট'ফ'ট করছে। সামিন আলোর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই আলো একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলে,"মে'রে ফেলবেন নাকি! অদ্ভুত।"
_সব যায়গায় মুখ চালাতে হবে তোমার? খোদা আমি এই মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় যাবো!
চাঁপা স্বরে চেঁ'চি'য়ে বলে সামিন।
_ঐ লোকটা কিভাবে দেখছিলো ঐ বিমানবালাকে, পুরো গা ঘিনঘিনে ব্যাপার। এসব দেখলে আমার মুখ নিশপিশ করে।
_তুমি একটা সা*ইকো আলো। এটা ক্লি'য়ার হয়ে গিয়েছে আজ।
আলো মুখ ভার করে ফেলে। কিছুক্ষণ পরে সামিন হঠাৎ হাসতে থাকে। আলো অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,"হাসছেন কেনো?"
_একটা কথা মনে পরে গিয়েছে। সেদিন একটা নি*উজে দেখলাম বাংলাদেশী একটা লোক বিমানে উঠে বিমান বালাকে জোরপূর্বক চু*মু দেওয়ার অপরাধে জে'ল জরি'মানা হয়েছে। আমি ভাবছি কতটা অসহায়, তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত হলে একটা অ*ধম শেষমেশ এতো সিকি*উরিটির মধ্যেও একজন বিমানবালার সাথে এসব করে। লোকটার জন্য করুণা হচ্ছে।
_এসব বাংলাদেশেই হয়, স্বভাবে খুব ভালো জাতি কি না।
_এভাবে বলো কেনো? আমি গর্বিত আমি বাঙালী।
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"দেখলাম এখানের সবগুলো পুরুষ মানুষ একবার না একবার ঐ সুন্দরী বিমানবালার দিকে তাকিয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করেছে। তা আপনি কেনো তাকাচ্ছেন না? নিজেকে কেনো ব*ঞ্চিত করছেন? এখানে কেউ তো আপনাকে নিষেধ করার মতো নেই।"
সামিনের মাথায় হুট করে রা*গ উঠে যায়। আলোর দিকে রা*গান্বিত দৃষ্টি দিতেই আলো মিইয়ে যায়। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"সব পুরুষ এক?"
_আমার তো মনে হয়, সবাই সৌন্দর্যের পাগল।
আমতা আমতা করে বলে আলো।
সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, মেয়েটা যদি বুঝতো সামিনকে সে তার ঐ সীমিত সৌন্দর্য দিয়ে কতটা মুগ্ধ করে রেখেছে!
বুঝবে না! এই মাথা মোটা মেয়ে কখনোই বুঝবে না!
দ্বিতীয় বারের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামিন বলে,"চুপচাপ বসে থাকো,আর মাত্র ঘন্টা দুয়েকের ব্যাপার। কোন লোক কোন বিমানবালাকে চোখ দিয়ে খে*য়ে নিলো সেটা তোমার দেখতে হবে না। বেশি দেখাদেখি করতে ইচ্ছে হলে আমাকে দেখো বসে বসে, মোটামুটি হ্যান্ডসামই আছে তোমার স্বামী।"
[পর্ব টা পেজ থেকে ডিলিট হয়ে গিয়েছে ভুলবশত,তাই রিপোস্ট করা]

"ওয়েলকাম টু হোটেল গ্রান্ড প্যালেস।"
রিসিপশনের বা দিকটায় একটা স্ট্যাচু হোটেলের নেমপ্লেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে ইংরেজির পাশাপাশি আরো দু'টো ভাষায় হোটেলের নাম লেখা। আলো লবিতে দাঁড়িয়ে স্ট্যাচুটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, স্ট্যাচুটির লি'ঙ্গ আলো বুঝতে পারছে না। এটা পুরুষ নাকি মহিলা? ভীষণ অদ্ভুত শ্বে'ত পাথরের ঐ মূ'র্তিটা। ঘাড় ঘুরিয়ে সামিন ইয়াসার মির্জাকে দেখে নেয় সে। সামিন হোটেলের রিসিপশনিস্টের সাথে কথা বলছে। রিসিপশনে মোট তিনজন লোক। দুজন মহিলা এবং একজন পুরুষ। মহিলা দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে চাইনিজ। একজন সামিনের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। বারবার মাথা নেড়ে কি বলছে এতো?
আলো দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে। তার পাশে তাদের দু'টো লাগেজ অনাদরে পরে আছে মেঝেতে। কিছুক্ষণ পরে সামিন চেক ইন এর ঝামেলা সামলে আলোর কাছে চলে আসে। তার হাতে রুমের চাবি। আলোর কাছে এসে লাগেজ দু'টো তুলে নেয় সে। তারপর বলে,"এসো।"
"দু'টো আপনি একা বহন করবেন কেনো? আমাকে একটা দিন।"
আলো একটা লাগেজ তুলে নিতে উদ্যত হয়। সামিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
_ধন্যবাদ। আপনি একজন স্বনির্ভর মেয়ে সেটা আমি জানি। তবে আমি একজন দায়িত্বশীল এবং কেয়ারিং হাসবেন্ড সেটাও আপনাকে জানাতে চাচ্ছি।
আলো চুপচাপ সামিনের পিছু পিছু যায়। তাদের রুমটা ছয়তলাতে। সামিন আর আলোর রুম নাম্বার হলো "এল টুয়েন্টি ফোর"।
আরো কিছুদূর যেতেই ডানে মোড় নিলে তাদের রুম। আলো চারপাশে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে লোকজনকে দেখছে। বিভিন্ন দেশের লোকজন। মেয়েগুলো বেশ খোলামেলা পোশাক পরে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হেঁটে যাচ্ছে। আলোর হঠাৎ রেহেনার কথা মনে পরলো, আলোর গা থেকে ও'ড়না সরে গেলেই রেহেনা কান ম'লে দিতো আলোর, আম্মু এই দৃশ্য দেখলে তো নির্ঘাত এই মেয়েগুলোকে ঝা'টা নিয়ে দৌ'ড়ানি দিতো।
রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে লাগেজ দু'টো একপাশে দাড় করিয়ে রেখে সামিন পুরো রুমটা দেখে নেয়।
আলো সামিনের পিছু পিছু ঘরে ঢোকে।
ডাবল বেডের রুম। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে মুখ হাসি হাসি করে বলে,"প্রথমে ডাবল বেড এভেইলেবল ছিলো না। ভীষণ দুশ্চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম এখানে কোলবালিশ পাওয়া যাবে কি না ভেবে, নাহলে তো বিছানায় আমাকে এলাউ করতে না তুমি। মেঝেতে থাকতে হতো আমার। সৌভাগ্য আমার ডাবল বেড পেয়ে গিয়েছি।"
আলো চুপচাপ একটা বিছানা দখল করে বসে পরে। সামিন ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায়। এখান থেকে কিছুটা দূরেই মার্লিওন পার্কের স্ট্যাচুটা । সামিন আলোকে ডেকে স্ট্যাচুটা দেখিয়ে বলে, এটা কখনো দেখেছো কোথাও?
আলো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,"হ্যা । মুভিতে দেখেছি।"
_কথিত আছে যখন সিঙ্গাপুর আবিষ্কার হয়েছিলো তখন একটা অদ্ভুত প্রানী দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। যার অর্ধেক সিংহ এবং অর্ধেক মৎস্যকন্যা। এই স্ট্যাচু টা সেই পৌরাণিক কাহিনীর আদলে তৈরি।
আলো এবার বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে স্ট্যাচুটাকে।
সামিন হেসে বলে,"আজ রেস্ট নাও। কাল ডক্টরের কাছে আমাদের এপয়েন'মেন্ট আছে। তৈরি থেকো।"
কথাটা বলে সামিন রুমের দরজার দিকে যায়।
"কোথাও যাচ্ছেন?"
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন মাথা ঘুরিয়ে আলোকে দেখে বলে,"দু'টো সিম*কার্ড কিনবো এবং মা'নি এক্স*চেঞ্জ করবো। কিছুক্ষণ পরে আসছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে তৈরি থেকো, আমরা লা*ঞ্চ করবো।"
_এখানে পশ্চিম দিক কোনদিকে বুঝতে পারছি না। একটু জেনে আসবেন?
সামিন আলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আঙ্গুলের তর্জনী তুলে বলে ওঠে,"ঐ দিকে। আমি জেনে এসেছি রিসিপশন থেকে।"
সামিন বেরিয়ে যায়, বাইরে থেকে দরজা লক করে রেখে গিয়েছে। আলো বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার দু'চোখ বন্ধ।
বিদেশে, সম্পূর্ণ অচেনা একটি শহরে, একটা সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের সাথে, তাকে ভরসা করে এসেছে সে। হ্যা, মানুষ টা অচেনাই তো। এই ইয়াসার মির্জাকে আলো চিনতে পারছে না যেনো। এই ইয়াসার মির্জা তার প্রতিটা পদক্ষেপে আলোকে চ'মকে দিচ্ছে। এই লোকটাকে আলো উপেক্ষা করতে পারছে না কেন? ঐ একটা কাগজের জো*র এতো?
আলোর নিজের মনের ওপর নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ খুঁজে পাচ্ছে না। কখনো তার ভেতর থেকে একজন স্ত্রী সত্তা বলছে,"আলো তুই বাড়াবাড়ি করছিস, সবকিছুর একটা সীমা থাকে, পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নে, তুই চাইলে সবটা সুন্দর হতে পারে। ইয়াসার মির্জা নিজেকে প্রমাণ করছে। তুই তো সুযোগ দিয়েছিলি, সে নিজেকে প্রমাণ করে দিয়েছে, তোকে ভোগ*বস্তু হিসেবে দেখেনি, তোকে সম্মানিত করছে, আর কি চাস তুই? "
আবার কখনো মনের মধ্যে থেকে একজন কঠিন নারী সত্তা বলছে,"কিভাবে? কিভাবে? সত্যিই কিভাবে?"
মাথার মধ্যে সূক্ষ্ম য*ন্ত্রণা হচ্ছে। শেষমেশ কে কাকে হা*র মানাবে? তার কঠিন নারীসত্তা একজন স্ত্রী সত্তাকে নাকি একজন স্ত্রী সত্তা একজন কঠিন নারী সত্তাকে?
অনেকটা সময় নিয়ে গোসল সেরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। ভেজা চুল গুলো মুছতে থাকে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ তার গলায় সামিনের দেওয়া লকেট টা চোখে পরে আলোর। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে সে। সে একটা মেরুন রঙের জামদানি শাড়ি পরেছে। সাথে মেরুন রঙের ব্লাউজ। প্রথম প্রথম বিরক্তি লাগলেও বর্তমানে শাড়ি আলোর অন্যতম প্রিয় পোশাক। সামিনের কিনে দেওয়া সালোয়ার কামিজ সেভাবেই আছে। ওসব আলোর পরতে ইচ্ছে করছে না। নিজেকে বৌ বৌ দেখতে তার খুব একটা খারাপ লাগছে না। বরং লজ্জা লাগছে , যেন শাড়িতে তার সৌন্দর্য বেড়ে গিয়েছে।
***
দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে পরে সামিন। আলো নামাজ আদায় করছে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আলোকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। নিজে গোসল সেরে বেরিয়ে এসে দেখে তখনও আলো জায়নামাজে বসে আছে। ভদ্র ছেলের মতো চুপচাপ ডিভানে বসে আলোকে দেখতে থাকে। মোনাজাতে এতো কি চাইছে মেয়েটা?
নামাজ আদায় করে উঠে দাঁড়াতেই সামিনকে দেখে থ'মকে যায় আলো। এভাবে এতো দেখার কি আছে আলোকে? অস্বস্তি ছেয়ে যায় আলোর মুখে।
সামিন চোখ সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নরম গলায় বলে,"তোমাকে জায়নামাজে দেখলে খুবই নিষ্পাপ মনে হয়, মনেই হয়না তুমি এতো চমৎকার গালা*গাল জানো। একই সাথে দুটো মেইন*টেইন কিভাবে করো?"
আলো জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে বলে," আপনি নিজের কথা ভাবুন। শুধু মাত্র শুক্রবার দলের ছেলেদের সাথে মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজ আদায় করে আসেন। তার মুখে এতো বড় বাতেলা মানায় না।"
_তোমার মতো গালি তো দেই না।
ক্ষে*পানোর উদ্দেশ্যে বলে আলোকে।
_আপনার মতো একটা অপকর্ম করে তারপর একটা মহৎ কাজ করে ব্যা*লেন্স করে তো চলিনা। আপনার দুই কাঁধের ফে*রেস্তা হিমশিম খেয়ে যায় আপনার কর্মকাণ্ড দেখলে। একবার দশ নেকি লেখে, পরক্ষনেই দশ নেকি কে*টে দেয়। আবার লেখে, আবার কে*টে দেয়।
_আর তোমার? তোমার তো দুই কাঁধে ফে*রেস্তাই নেই সম্ভবত। তোমার মুখের গা*লি শুনে ভেগে গিয়েছে।
আলো থম*থমে মুখে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। সামিন কথার সুর পাল্টে নিয়ে বলে,"আচ্ছা ঠিকাছে। রিলিজিয়াস ব্যাপার গুলো নিয়ে এভাবে কথা না বলি। "
_শুরুটা তো আপনিই করেছেন।
_ভুল হয়ে গিয়েছে, ক্ষ'মা করে দেন।
নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে সামিন। তারপর ওয়ালেট হাতে নিয়ে বলে,"ঝ'গ'ড়া না করি। চলো আগে খেয়ে নেই। খালি পেটে ঝ'গ'ড়া ভালো হয় না।"
***
করিডোরে বিভিন্ন ধরনের মানুষের আনাগোনা। সামিনের পিছু পিছু আলো লিফটের কাছে এগিয়ে যাচ্ছে।
লিফটের কাছে এসে বোতাম টিপে দাড়িয়ে থাকে দুজন। এখন আশপাশটায় কোনো লোকজন নেই। কেমন অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা।
হুট করে লিফটের দরজা খুলে যেতেই, দুজনেই সামনে পা বাড়ায়। কিন্তু মুহুর্তেই লিফটের ভেতরের দৃশ্যটি দেখে আলো আর সামিনের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।
পঁচিশোর্ধ বিদেশি কোনো কাপল লিফটের মধ্যে একে অপরকে আ*লিঙ্গন করে চু*ম্বনরত অবস্থায় আছে। আশে পাশে কি হচ্ছে তাদের কোনো হু*স নেই।
সামিন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আলো হতভম্ব ভাব কাটিয়ে চেঁ*চিয়ে ওঠে,"নাউজুবিল্লাহ।"
সামিন চ'ম'কে উঠে আলোর দিকে তাকায়। আলো অসম্ভব জোরে চেঁ*চিয়ে কথাটি বলেছে যে লিফটের মধ্যে থাকা জুটির কানে তালা লেগে গিয়েছে। তারা হতভম্ব হয়ে আলোর দিকে তাকায়। চোখে মুখে আ*তঙ্ক ছেয়ে গিয়েছে তাদের।
সামিন আলোর হাত ধরে টেনে নিজের পেছনে নিয়ে আড়াল করে বিদেশী কাপলদের উদ্দেশ্যে বলে,"ডোন্ট মা*ইন্ড, প্লিজ ক্যারি অন।"
বিদেশীদের চোখে মুখে হত*ভম্ব ভাব। লিফটের দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় পুনরায়।
সামিন আর আলো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। আলো মাথা নিচু করে রেখেছে। কি একটা অ*সভ্য সমাজে এসেছে। লিফটের মধ্যেই? এরা কি রুম বুক করেনি!
সামিন ঘা*ড় ঘুরিয়ে আলোকে এক পলক দেখে। দু'জনেই ভীষণ বিব্রত।
কিছু সময় পরে সামিন বলে ওঠে,"এখানে এসব অহরহ দেখতে পাবে আলো। এভাবে রি*য়্যাক্ট করো না। চুপচাপ ইগনোর করে যেও। মাত্র কটা দিন আছি।"
_তাই বলে লিফটে? লিফট টা পাবলিকের জন্য, ওনাদের বেড*রুম না।
_আচ্ছা ঠিকাছে। মাথা ঠান্ডা করো, এবার চলো, খিদে পেয়েছে আমার।
***
পুরো রাস্তায় সামিন হেসেছে। রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাবার অর্ডার করেও হাসছে। আলো চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে হাসি থামিয়ে সামিন বলে ওঠে,"যেভাবে চেঁ*চিয়ে নাউ*জুবিল্লাহ বলেছো, তাতে ওদের আত্মা খাঁচা*ছাড়া হয়ে গিয়েছে। কতটা আত*ঙ্কিত লাগছিলো ওই বিদেশিদের। ওরা সম্ভবত তোমাকে পাগল ভেবেছে।"
আলো চুপ করে বসে আছে।
টেবিলে গরম গরম খাবার পরিবেশন করে ওয়েটার হাসিমুখে চলে যায়। আলো খাবারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আশেপাশে দেখতে থাকে, সবাই চুপচাপ খাচ্ছে।
সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,"খাচ্ছো না কেন?"
আলো টেবিলের দিকে তাকিয়ে একটা খাবারের দিকে তর্জনী আঙ্গুল তুলে বলে,"এটা কি?"
_এটা সাউথ ই*ন্ডিয়ান ফুড। আমরা একটা ইন্ডিয়ান রেস্টু*রেন্টে এসেছি।
আলো আবারও আশেপাশে তাকায়। সেজন্যই সবাইকে বাঙালি মনে হচ্ছে।
প্লেটের খাবারটা নাড়াচাড়া করে আলো বলে,"দেখে তো চিতই পিঠা আর শুকনো মরিচ ভর্তার মতো লাগছে।"
সামিন হেসে ফেলে। তারপর বলে,"এটা ইডলি। আর পাশের তরল টা সাম্বার। খেয়ে দেখো এটা খুবই মজার একটা খাবার। ইন্ডিয়া গেলে এটা আমি খাই, কেনো জানি খুব ভালো লাগে আমার কাছে।"
আলো খাবার টা টেস্ট করার জন্য একটু ভেঙে মুখে দেয়। তারপর চোখ মুখ কুঁচকে বলে,"অতটাও ভালো না। এটার দাম কতো?"
_বাংলাদেশী টাকায় তিনশো পঞ্চাশ টাকা ।
আলো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তারপর বলে ওঠে,"তিনশো পঞ্চাশ? দুটো চিতই পিঠার মতো ইডলি না ফিডলি তিনশো পঞ্চাশ? আর আমাদের ঝিলবাড়ি মোড়ের সোবাহান কাকার চিতই পিঠা আর শুটকি ভর্তা এই খাবারটার থেকেও মজা, পঞ্চাশ টাকায় পেট ভরে খাওয়া যায়।"
সামিন হেসে ফেলে। আলোর দিকে তাকিয়ে শুধু হাসতেই থাকে। আলো সামিনের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছে।
হাসি থামিয়ে সামিন বলে,"ঠিকাছে ইডলি ফিডলি খেতে হবে না। ওটা পছন্দ না হলে ফ্রাইড রাইস খাও,নয়তো এটা খাও, এই কাবাবটা খুব মজা।"
_এতো খাবার অর্ডার করেছেন কেন? খেতে পারবেন? এতো অপচয় আমি পছন্দ করি না।
কপাল কুঁচকে গৃহিণীদের মতো বলে আলো।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। এতোটা সরলতা লুকিয়ে ছিলো কা*ঠিন্যতার আড়ালে সেটা এতদিন সে বুঝতেই পারেনি। কঠিন মনের মেয়েটির আড়ালে একটা সাদাসিধে নারী।
***
খাওয়া দাওয়া শেষ করে তারা আবারও হোটেলে ফিরে যায়।
সামিন তার বেডে বসে ডক্টরদের সাথে কথা বলছে। আলো জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে।
কথা বলা শেষ করে উঠে দাড়ায় সামিন, আলোর দিকে চোখ যেতেই থ'ম'কে যায় সে। খোলা চুল গুলো পিঠে ছড়িয়ে রেখেছে। এই মেয়েটার চুলগুলো সুন্দর। সামিন বারবার মুগ্ধ হয় দেখলে।
আলোর দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে বলে ওঠে,"কি দেখছো?"
আলো ঘুরে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,"কিছুনা।"
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সামিন বলে,"একঘেয়েমি লাগছে?"
আলো আবারও সামিনের দিকে তাকায়। সামিন জানে আলো রাজি হবে না, তবুও বলে বসে, "চলো,তোমাকে একটা যায়গা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।"
আলো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সামিন ভেবেছে আলোর সম্মতি নেই তাই সে ঘুরে বিছানার দিকে যাচ্ছিলো তখনই আলো অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"অ'স'ভ্য কোনো যায়গা না হলে যেতে পারি। যেখানে এসব অ'স'ভ্য লোকজন থাকবে না।"
***
আলো চোখ বড় বড় করে চারপাশে দেখছে। সামিন আড়চোখে একপলক আলোকে দেখে বলে,"এটা গার্ডেন অব বে।"
বাচ্চাদের পার্ক। এখানে অ'স'ভ্য লোকজন নেই। ভালো লাগছে বাচ্চাদের দেখে?"
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন ম্লান হেসে বলে,"কাল সেন্তোসা আইল্যান্ড নিয়ে যাবো। সিঙ্গাপুরের সবথেকে জনপ্রিয় টু*রিস্ট প্লেস।"
আলো কিছু না বলে চুপচাপ হাঁটছে। এমন জায়গা বাংলাদেশে নেই। প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি একটা আর্টি*ফিশিয়াল জঙ্গল। মুগ্ধ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
হাঁটতে হাঁটতে একেবারে জঙ্গলের গহীনে চলে যায় তারা। এখানে লোকজনের ভীড় নেই খুব একটা। আলো চারপাশে তাকিয়ে বলে,"ঘোলাটে কেনো চারপাশ?"
_এগুলো ফেইক ফগ।
আলো অবাক হয়ে আবারও আশেপাশে তাকায়। সামিন বলে,"রাইডে চ*ড়তে চাও কোনো? দারুন কিছু রাইড আছে এখানে।"
_আমি বাচ্চা নাকি?
কথাটা বলে আলো সামনে এগিয়ে যায়। পার্কের একজন কর্মচারী একটা অদ্ভুত দেখতে নীল রঙের প্রানী কোলে নিয়ে তাদের দিকে আসছে। আলো কৌতুহলী হয়ে ইংরেজিতে তাকে জিজ্ঞেস করে,"এটা কি? এই প্রানীটার নাম কি?"
কর্মচারী মজার ছলে বলে,"আপনিই বলুন।"
সামিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রানীটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,"এটা একটা কুকুর। আপনারা পশম তুলে ফেলে,রং মাখিয়ে, মেডি*সিন দিয়ে এমন করে রেখেছেন। এটা এক প্রকার অপ*রাধ। লজ্জা হওয়া উচিত আপনাদের।"
কর্মচারী ভী*ত চোখে সামিনের দিকে তাকায়। আলোও সামিনকে নকল করে কর্মচারীকে বলে,"লজ্জা হওয়া উচিত। একটা প্রানীকে এভাবে ক*ষ্ট দিচ্ছেন।"
কর্মচারী বোকার মতো কুকুরটাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন আর আলো সামনে এগিয়ে যায়। কিছুদূর যেতেই তারা প্রযুক্তি দিয়ে নির্মিত কিছু আর্টি*ফিশি*য়াল পশু দেখতে পায়। বাচ্চারা সবাই বিস্ময় নিয়ে সেসব দেখছে। সামিন হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে,আড়চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় আলোও বাচ্চাদের মতো চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে দেখছে পশুগুলোকে, যেন ভাবছে ওগুলো আসলই। সামিন মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।
সামিনের ফোন বেজে ওঠে। রাহাত ফোন দিয়েছে। বাচ্চাদের শোরগোলের শব্দে অসুবিধা হচ্ছিলো তাই কিছুটা দূরে গিয়েই সামিন কথা বলে নেয়। হঠাৎ আলোর চিৎকারে সামিন চ'ম'কে ওঠে। তাড়াতাড়ি ফোন কে'টে দিয়ে সামনে এগিয়ে যায় ছুটে। আলো আতংকিত মুখ নিয়ে তার দিকেই ছুটে আসছিলো। ছুটতে ছুটতে এসে সামিনের পেছনে নিজেকে লুকিয়ে নিয়ে তার পিঠের দিকের শার্ট খা*মচে ধরে হাঁপাতে থাকে। সামিন আশেপাশে তাকিয়ে নরম গলায় আলোকে প্রশ্ন করে,"কি হয়েছে?"
_সাপ......ওখানে সাপ।
কাঁ*পা কাঁ*পা গলায় বলে ওঠে আলো। সামিন দূরে তাকায়, তারপর হেসে ফেলে, আলোকে আশ্বস্ত করে বলে,"ওটা আর্টি*ফিশিয়াল সাপ আলো।"
আলো কাঁপছে, ধাতস্থ হতে পারছে না, ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে," আসল হোক বা আর্টি*ফিশিয়াল। প্রানীটা সাপ তো।"
বাচ্চাগুলো আলোর বাচ্চামো দেখে হাসতে থাকে। তাদের অভিভাবকরাও হাসছে। আলো আবারও সামিনের পেছনে লুকিয়ে ফেলে নিজেকে,নিজের আ*তংকিত মুখটাকে।
সামিন হাসতে গিয়েও হাসে না। মহারানী যদি রে*গে যায়!
পর পর বলে ওঠে,"আচ্ছা চলো। আমরা বের হই এখান থেকে। বে-এর সাইড থেকে ঘুরে আসি। সন্ধ্যায় ডিনার সেরে একেবারে হোটেলে ঢুকবো।"
***
দু'জনে চুপচাপ হাঁটছে। বে-এর সাইডেও প্রচুর লোকজন। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আলোর গা শিরশির করতে শুরু করে। কিছুক্ষণ আগেই সন্ধ্যা হয়েছে। যত অন্ধকার নেমে আসছে সিঙ্গাপুর সিটি ততো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। উন্নত দেশটার সৌন্দর্য যেন অন্ধকারেই বেশি ফুটে উঠছে।
সব হাজবেন্ড ওয়াইফ কিংবা প্রেমী যুগল হাত ধরে,একে অপরকে আগলে নিয়ে হাঁটছে। সেসব ঘুরে ঘুরে দেখতে গিয়ে হঠাৎ আলোর গায়ের সাথে একটা লোকের ধা"ক্কা লেগে যায়। লোকটা আলোকে সরি বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সামিন দাঁড়িয়ে পরে, আলোর হাত ধরে টেনে তার সামনে নিয়ে বলে,"এবার আমার সামনে সামনে হাটো, নয়তো কিছুক্ষণ পরে দেখবো কেউ তোমাকে পকেটে ভরে নিয়ে গিয়েছে।"
আলো লজ্জা পেয়ে যায়। এবার সে সামিনের সামনে সামনে হাঁটছে। সামিন তার বডি*গার্ডের মতো তার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পিছু পিছু হাঁটছে।
***
একটা ইটালিয়ান রেস্টু*রেন্ট। একটা অল্পবয়সী মেয়ে চিকন গলায় কিছু একটা গাইছে, ওটা কোনো গান কি না আলো সেটাই বুঝতে পারছে না। কেমন অদ্ভুত শুনতে। মনে হচ্ছে শব্দ করে আড়মোরা ভা*ঙছে, একটা লম্বা আড়মোরা।
সামিন খাবার অ*র্ডার করে আলোর দিকে তাকায়, তারপর বলে,"খিদে পেয়েছে খুব?"
আলো মাথা নাড়ায়। দীর্ঘ সময় দু'জনে চুপচাপ বসে থাকে। রাত তখন বেশ হয়েছে। রেস্টুরেন্ট পুরো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যায় দুজনে বে-এর পাশে অনেকটা সময় নিয়ে ঘোরাঘুরি করেছে।
ওয়েটার এসে তাদের টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেয়। তারপর তাদের সামনে দু'টো গ্লাসে একটা পানীয় ধরনের কিছু রাখতেই সামিন কপাল কুঁ'চকে বলে ওঠে,"ওয়েট। এটা কি?"
ওয়েটার হাসিমুখে বলে,"ও'য়া'ইন স্যার।"
আলো হ'তভম্ব হয়ে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। সামিন শান্তভাবে ওয়েটারকে বলে,"আমি কি অ'র্ডার দিয়েছি?"
ওয়েটার হেসে বলে,"না স্যার। এখানে রাত দশটার পরে যারা আসে তাদের আমরা দিয়ে থাকি। আপনারা স্পে'শাল গেইস্ট।"
সামিন কোনো সি'ন'ক্রিয়েট না করে ওয়েটারকে বলে,"ঠিকাছে। এটা নিয়ে যান। আমাদের প্রয়োজন নেই। "
"খাবো না, আমি এই রেস্টুরেন্টে খাবোই না।"
চেঁ'চিয়ে ওঠে আলো। সামিন আলোর দিকে তাকায়। ওয়েটার অবাক চোখে আলোকে দেখছে। আলো চেঁ'চাতেই থাকে,সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"বলেছি না খাবোনা? উঠুন। চলুন এখান থেকে।"
সামিন বুঝতে পেরেছে আলোকে শান্ত করা যাবে না। চুপচাপ বিল মিটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ওয়েটার ইংরেজিতে বলে,"অসুবিধা কি হয়েছে স্যার? এই খাবার গুলো কি করবো?"
"আপনি গি'লুন বোকারাম।"
কপাল কুঁ'চকে ওয়েটারকে কথাটি বলে সামিন আলোকে নিয়ে বেরিয়ে আসে।
শহরের একটা ব্যাস্ত রাস্তা ধরে হাঁটছে দুজন । এখানে এখনো প্রচুর লোকজন, রাতের সিঙ্গাপুর উপভোগ করছে সবাই।
সামিন আড়চোখে আলোকে দেখে বলে,"এই আছিয়া! স্ট্রিট*ফুড খাবে? এখানে খুব ভালো চাইনিজ,কোরিয়ান স্ট্রিট*ফুড পাওয়া যায়।"
_হ্যা ঐ ব্যাঙ সে*দ্ধ আর সা*পের কাবাব? না ভাই, মাফ করুন।
সামিন হেসে ফেলে। তারপর বলে,"না না, ওসব না। ভেজ কিছু। খেয়ে মুগ্ধ হবে।"
_আমি কিছু খাবোই না। আমার ব*মি পাচ্ছে।
_আচ্ছা চলো একটা ইন্ডিয়ান রেস্টু*রেন্টেই ঢুকি। প্লিজ চলো। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।
আলো সামিনের দিকে তাকায়, লোকটার জন্য খুব মায়া হচ্ছে হঠাৎ। অনেকটা সা*ফার করছে আলোর জন্য। অথচ কতো শান্ত এবং স্বাভাবিক আচরণ করছে। এতো ধৈর্য্য পুরুষের থাকে?
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলো নরম গলায় বলে ওঠে,"চলুন।"
একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট খুজে বের করে দু'জনেই রাতের খাবার খেয়ে নেয়। এখন হোটেলে ফিরতে হবে। কাল সকালে ডক্টরের কাছে এপয়েন*মেন্ট।
দু'জনে হাঁটছে। আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"আমি সবকিছু নিয়ে একটু বেশি সিন*ক্রিয়েট করি তাই না?"
সামিন আলোর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায়, তারপর বলে,"না তো। তবে গালা*গাল টা বেশি দাও।"
আলো নিশ্চুপ । সামিন একটা ক্যা*ব বুক করতে চায়। আলো সামিনকে থামিয়ে দিয়ে বলে,"আমি হাঁটতে চাচ্ছি। পরিবেশ টা ভালো লাগছে।"
সামিন হাসে। দু'জনে আবারও হাঁটতে থাকে। এই রাস্তাটা নিড়িবিলি। এখান থেকে তাদের হোটেলে যেতে বিশ মিনিট সময় লাগবে।
চারপাশে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আলো দাঁড়িয়ে পরে। রাস্তার একপাশে কিছু মেয়েরা অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েগুলো অল্পবয়সী, দৃষ্টিকটু পোশাক পরে, মেইক আপ করেছে। সামিন আলোকে দাঁড়িয়ে পরতে দেখে নিজেও দাঁড়িয়ে পরে। তারপর আলোকে বলে,"কি দেখছো?"
_ওরা এভাবে সেজেছে কেনো? এভাবে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে কেনো? কোনো ফেস্টি*ভ্যাল ওদের আজ?
সামিন আলোর কথায় মেয়েগুলোর দিকে তাকাতেই থতমত খেয়ে যায় । আলো কৌতুহলী দৃষ্টিতে দেখছে মেয়েগুলোকে। সামিন নিচু স্বরে বলে ওঠে,"ওরা ব*দ মেয়ে আলো, চলো এখান থেকে।"
আলো অবাক হয়ে বলে,"ব*দ মেয়ে মানে? কেমন ব*দ মেয়ে?"
_প্র*স্টি*টিউট।
গলার স্বর আরো নিচু করে সামিন বলে। আলো চ'ম'কে ওঠে। এতো সুন্দর সুন্দর মেয়েগুলো বাজে মেয়ে! কত হবে বয়স , আলোর বয়সী মনে হচ্ছে। আলোর হতভম্ব ভাব কাটছে না। সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"ওরা এই কাজ করে কেনো, ওরা পড়াশোনা করে না?"
আলোর শিশুসুলভ প্রশ্নে সামিন আলোর চোখের দিকে তাকায়। তারপর বলে,"পড়াশোনা করে সম্ভবত, পড়াশোনার পাশাপাশি এসব করে।"
_পড়াশোনার পাশাপাশি এসব করবে কেনো? আরো অনেক কাজ আছে। এতোই যখন টাকার দরকার, এরা উদ্যোক্তা হতে পারে না?
সামিনের বড্ড হাসি পাচ্ছে। সে তার হাসি চাপিয়ে রেখে বলে,"উদ্যোক্তা হয়ে কি করবে? তোমার মতো জলপাই আর চালতার আচার বানিয়ে বিক্রি করবে? কিন্তু সিঙ্গাপুরে আচারের চাহিদা নেই আলো।"
_তাহলে অন্যকাজ করবে, খেটে খাবে। সম্মানের কোনো কাজ করবে।
_ওরা এসব করেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে আলো, কেউ কেউ শখের বসেও করে।
আলো চুপ করে থাকে। তার মাথা ব্যাথা হয়ে গিয়েছে ঐ সব মেয়েদের এমন বি*কৃ*ত রুচিবোধের কথা শুনে।
সামিন বলে,"চলো হোটেলে ফেরা যাক, আরেক সময় ওদের সাথে দেখা হলে তুমি উদ্যোক্তা হবার পরামর্শ দিও ওদের।"
হাঁটতে হাঁটতে দু'জনে অনেক দূরে চলে যায়। প্রায় হোটেলের কাছাকাছি। রাস্তায় কোনো লোকজন নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র তারা দূজন। দূরে কিছু চাইনিজ লোক দাঁড়িয়ে আছে তাদের দিকে তাকিয়ে।
আলোর দিকে কেমন লোভা*তুর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। আলো নিজেকে সামিনের পেছনে লুকিয়ে হাঁটতে থাকে। সামিন বুঝতে পেরে হাতের ফোনটা বন্ধ করে আলোর হাত ধরে, আলো চ'ম'কে উঠলেও শান্ত হয়ে থাকে। তারা দুজন চাইনিজ গ্যাং অতিক্রম করতেই যাচ্ছিলো , তখনই তাদের মধ্যে থেকে একজন ইংরেজিতে বলে ওঠে,"দাঁড়াও।"
সামিন আর আলো দাঁড়িয়ে যায়। লোকগুলো দ্রুতপায়ে হেঁটে সামিনদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে । ওদের মধ্যে যে দলপতি সে সামিনকে ইংরেজি তে বলে,"কোথা থেকে এসেছো।"
_তাতে তোমাদের কি? পথ ছাড়ো।
দলপতির চামচা গুলো আলোকে দেখছে, সবার চোখে মুখে লা*লসা। আলোর গা ঘিন*ঘিন করছে, দাঁতে দাঁত চেপে বাংলায় বলে,"চোখ উ*পড়ে একেবারে গুলতি খেলবো ইঁদুর খেকো লা*ফা*ঙ্গার দল।"
সামিন আলোর দিকে তাকায়। চাইনিজ গ্যাং এর দলপতি কৌতুহলী হয়ে ওঠে, সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"কি বলছে তোমার ওয়াইফ? বলো বুঝিয়ে।"
_ও বলছে, ভাইয়ারা আমাদের যেতে দিন।
দলপতি বলে,"দেবো, যেতে দেবো। আগে ক্যা*শ বের করো।"
সামিন দাঁত খিচিয়ে এগিয়ে দলপতির মুখোমুখি দাঁড়ায়, তারপর বলে,"এখান থেকে কে*টে পর। এক্ষুনি।"
সামিনের হুমকিতে সবাই হাসতে শুরু করে। সাথে সাথে পকেট থেকে চা*কু বের করে আলো আর সামিনকে দেখাতে থাকে।
আলো চ'ম'কে ওঠে।
দলপতি সামিনকে বলতে থাকে,"এটা কি তোমার ওয়াইফ? নাকি কিনেছো আজ রাতের জন্য? কোন দেশের? দাম কত পরেছে?"
কথাটা বলে দলপতি শেষ করতে পারে না সামিন তৎক্ষণাৎ তার নাক বরাবর একটা ঘু*ষি মে*রে দেয়।
দলপতির নাক দিয়ে র*ক্ত ঝরছে। তার সাঙ্গপাঙ্গরা এসে সামিনকে ধরে ফেলে, আলো আ'ত'ঙ্কে জমে যায়, চেঁচিয়ে বলে,"ছেড়ে দাও । ছেড়ে দাও ওনাকে।"
_দেবো। তোমার গোল্ড গুলো আমাদের দিয়ে দাও।
সামিন দুজনের সাথে ধস্তাধস্তি করছে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। আলোর ভ*য়ার্ত দৃষ্টিতে দলপতির দিকে তাকিয়ে থাকে। দলপতি বলে,"গোল্ড গুলো দাও। তোমার গলার ওই লকেট টা দাও।"
আলো আ*তঙ্কিত মুখে এদিক ওদিক তাকিয়ে লকেট টা খুলে দেয়। সামিন তখনও ধস্তাধস্তি করে যাচ্ছে। দলপতি বিরক্ত ভঙ্গিতে আলোকে বলে,"তোমার স্বামী শুধু শুধু এতো পরিশ্রম করছে, আমাদের গোল্ড গুলো দিয়ে দিলেই আমরা চলে যাবো।"
আলো সামিনের দিকে তাকায়। দলপতি বলে,"তোমার হাতের গোল্ড গুলো দাও।"
আলো অসহায়ের মতো একবার সামিনকে, একবার দলপতিকে দেখে, তারপর নিজের হাতের বালা দুটোর দিকে তাকায়।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,"এগুলো নিবেন না প্লিজ, এগুলো আমার শাশুড়ি মায়ের। এই দুটোর সাথে আমার স্বামীর ইমোশন জরিয়ে আছে।"
আলো শুকনো মুখে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন তার দিকে তাকিয়ে আছে, মনে মনে বলে ওঠে,"তুমি আমার ইমোশন নিয়ে ভাবছো আছিয়া?"
আলো বারবার রিকোয়েস্ট করতে থাকে চাইনিজ লোকটাকে। সামিন ধস্তা*ধস্তি বন্ধ করে আলোকে ঠান্ডা গলায় বলে,"একদম ওর কাছে অনুরোধ করবে না। একদম না।"
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিনকে অস্বাভাবিক শান্ত লাগছে এখন। এমন সময় সেখানে একটা পুলিশ ভ্যান চলে আসে।
চাইনিজ লোকগুলো সামিনকে ছেড়ে দিয়ে আ'ত'ঙ্কি'ত মুখ নিয়ে আশেপাশে তাকায়। কপস গুলো বের হয়ে আসে, চাইনিজ গ্যাং পালানোর পথ খুঁজে পায় না। এসে সব কটাকে ধরে ফেলে কপস গুলো।
অফিসার সামিনের দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সাথে বলে,"এক্স*ট্রিমলি সরি ম্যান! আপনার লোকেশন টা বুঝতে একটু সময় লেগেছে।"
সামিন গায়ে ঝারা দিয়ে বলে,"আপনাদের দেশে এসব হচ্ছে? সিরি*য়াসলি? অবিশ্বাস্য!"
পুলিশ অফিসার লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,"স্যার এখানের চায়না টাউনের কিছু লোক খুবই উগ্র, এদের ক*ন্ট্রোল করা মুশকিল। আর তার উপরে এখন ট্যুরিস্টদের চাপ একটু বেশি। এই যে এগুলোকে দেখছেন, এরা পেশায় মেছো, লুকিয়ে লুকিয়ে মি*থের বিজনেস করে, এরা রিসেন্টলি জেল থেকে বেরিয়েছে। সবগুলো হা*রামজাদা। আমরা লজ্জিত।"
সামিন হেসে পুলিশ অফিসারকে বলে,"ইটস্ ওকে।"
তারপর ঘুরে চাইনিজ দলপতির মুখোমুখি দাঁড়ায়, দলপতির হাত থেকে থা*বা মেরে আলোর লকেট টা নিয়ে বলে,"এটা আমার বৌয়ের।"
আলো অবাক হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। চাইনিজ গ্যাং-কে ভ্যানে তোলা হয়। আলো সাহস পেয়ে এক নাগাড়ে কিছু গালা*গাল দিয়ে দেয় চাইনিজ গুলোকে। পুলিশের লোক গুলো আলোর দিকে অবাক চোখে একপলক তাকিয়ে চলে যায়।
সামিন ঘুরে আলোর দিকে তাকায়,বলে,"ওদের বাংলায় গা*লি দিচ্ছো কেনো? ওরা তো কিছুই বুঝলো না!"
আলো প্রায় ছুটে এসে সামিনের ডানহাত ধরে উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে,কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,"আ*ঘাত লাগেনি তো চা*কুর?"
সামিন চুপচাপ আলোকে দেখতে থাকে। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"পুলিশ কিভাবে টের পেলো?"
সামিন মৃদু হেসে পকেট থেকে ফোনটা বের করে আলোকে দেখিয়ে বলে,"ওরা যখন আমাদের দিকে আসছিলো,তখনই কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে এই অ্যা*পসে ঢুকে কাছের চেক*পোস্টে আমার লোকেশন পাঠিয়ে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে ছিলাম। সাবধানের মা*র নেই। সিঙ্গাপুরের নিয়ম শৃঙ্খলা আইন সম্পর্কে তোমার কোনো আইডিয়া নেই। মোস্ট ডেভেলপড এ্যান্ড সেফেস্ট কা*ন্ট্রি।"
আলো শুকনো গলায় বলে,"কিসের সেফেস্ট? রাত এতোটাও গভীর না অথচ কতটা বিপদে পরতে যাচ্ছিলাম আমরা।"
_এরকম টুকটাক অপরাধী সব যায়গায় ঘুরে বেড়ায় আলো। আর তাছাড়া ড্রা*গ এ*ডিক্ট ওরা, ওরা এতো কিছু ভেবে অ*পরাধ করতে নামে না। জেলে যাওয়া আসা লেগে থাকে ওদের। তাই ভয় পায়না সহজে।
আলো চুপ করে সামিনের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন বলে,"হাতে কিছু হয়নি আমার। রিল্যাক্স।"
আলো চোখ সরিয়ে নেয়। সামিন রেগে রেগে বলে,"ওই চাইনিজটার কাছে তুমি রিকোয়েস্ট করছিলে কেনো এতো? আমি তো ভেবেছি তুমি কারাতে করবে। কতদিনের শখ আমার তোমার কারাতে দেখার!"
আলো অবাক চোখে সামিনের দিকে তাকায়,বলে,"আমি এখনো আ*তঙ্ক থেকে বের হতে পারছি না আর আপনি মজা করছেন? ওদের চারজনের হাতে চা*কু ছিলো। আমি কটা চা*কু সামাল দিতাম? আমি অতটাও মাথামোটা নই।"
সামিন হেসে ফেলে,বলে,"অতটাও মাথা মোটা নও? কতটা মাথামোটা তাহলে? আচ্ছা তুমি তাহলে স্বীকার করলে একটু না একটু হলেও তুমি মাথামোটা?
আলো লজ্জিত মুখটা নামিয়ে রেখেছে। সামিন মুচকি মুচকি হাসছে। কিছুক্ষণ পরে আলো বলে ওঠে,"পুলিশ আসবে জেনেও এতো মারা*মারি করার কি দরকার ছিলো? শান্ত হয়ে থাকতে পারতেন না?"
_শিওর ছিলাম না আমার সিগ*ন্যাল পৌঁছেছে কি না। আর ভয় হচ্ছিল। ভেবেছি তোমার গায়ে হাত দিয়ে ফেলবে।
আলো চোখ তুলে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন আলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আলোর কাছে চলে যায়। হাতের লকেট টা আলোকে পরিয়ে দিতে দিতে বলে,"শাশুড়ি মায়ের বালার জন্য এতোটা উৎকণ্ঠা?"
আলো নিশ্চুপ। সামিন নরম গলায় বলতে থাকে,"জা কে জা ভাবতে পারছো, ননদকে ননদ ভাবতে পারছো, দেবরকে দেবর ভাবতে পারছো, শাশুড়িকে শাশুড়ি ভাবতে পারছো, শুধু স্বামীকেই..........."
চুপ হয়ে যায় সামিন। আলো সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
সামিন প্রসঙ্গ পালটে বলে,"চলো। এখন একটু ধাতস্থ হও,কিছুই হতো না আমাদের।"
***
গলার লকেটটা হাতে ধরে রেখে আলো চুপচাপ নিজের বিছানায় বসে আছে। তার দৃষ্টি সামিনের দিকে। সামিন তার নিজের বিছানায় বসে ইশমামের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলছে।
আলোর দৃষ্টি সামিনের থেকে সরছে না। লোকটা তার নিজের সবকিছুর প্রতি কতটা কেয়ারিং। এইযে আলোকে নিয়ে সিঙ্গাপুর এসেছে অথচ ঠিকই ভাই,বোন,বেস্টফ্রেন্ড,সবার সাথে সময় করে কথা বলছে, পাশাপাশি দলের কাজ সবকিছু সামলে যাচ্ছে। একটু বিরক্তি নেই।
হঠাৎ সামিন উচ্চশব্দে হেসে ওঠে, আলোর ঘোর কেটে যায়। কিছু একটা নিয়ে ইশমামের সাথে হাসাহাসি করছে।
আলো দেখতে থাকে, এই লোকটা নিজেও অতটা বড় নয় অথচ ভাইকে সবসময় বাচ্চা ছেলেদের মতো আহ্লাদ করে, ভাই খেয়েছে কিনা, ঠান্ডা লাগিয়েছে কিনা, মে*ডিসিন নিয়েছে কিনা।
ইশমামের সাথে কথা বলতে বলতে সামিন একবার আলোর দিকে তাকায়, তারপর নিচু স্বরে বলে ওঠে,"তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে?"
আলো মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে বলে,"মোটেও না। আপনি কথা বলুন।"
সামিন আবারো কথা বলতে শুরু করে। আর আলো দেখতে থাকে সামিনকে।
***
সকাল সকাল আবারও সেই একই বিব্রতকর পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি। সামিন এবার বেশ বিরক্ত হয়। লিফট কি চু*মু খাওয়ার যায়গা?
চু*মু খেতে থাকা নতুন দম্পতি নিজেরাও বিব্রত হয়ে তাকিয়ে থাকে আলো আর সামিনের দিকে।
সামিন চোখ সরিয়ে নেয়। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আলো সামিনের পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো। সামিন ঘাড় ঘুরিয়ে আলোকে দেখে। গাল দুটো লাল হয়ে আছে লজ্জায়। সামিন নিচু স্বরে বলে,"আজ চেঁচালে না যে?"
_সবাই আমাকে জংলি ভাবতো। এখানে আসার পর থেকে আপনাকে আমি বিব্রত করেই যাচ্ছি। গতকালের লিফটের ঘটনা, রেস্টুরেন্টের ওয়াইনের ঘটনা। আসলে আমি এই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারছি না। কখনো নিজের শহরের গন্ডির বাইরে যাইনি তো। যা দাপিয়ে বেড়ানোর নিজের শহরেই বেড়িয়েছি। বিদেশী এসব কালচার সম্পর্কে ধারণা আমার আছে, তবে চোখের সামনে দেখে সহজে নিতে পারার মতো মানসিকতা আমার তৈরি হয়নি এখনো, সময় লাগবে হয়তো। তাছাড়া আমার একাডেমিক নলেজও খুব কম। আপনি ঠিকই বলেছিলেন,আমি খালি কলসি।
আমাকে ম্যানার*লেস মনে হচ্ছে তাই না? মনে হচ্ছে আমি গ্রাম থেকে উঠে এসেছি তাই না?
সাবলীল ভাবে বলে আলো। সামিন আলোর দিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থেকে বলে,"হীনমন্যতায় ভোগার কিছু নেই, তুমি যথেষ্ট স্মার্ট মেয়ে, এ ধরনের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারাকে স্মার্টনেস বলে কি না জানা নেই, তবে আমার তোমাকে সবদিক থেকেই স্মার্ট মনে হয়।"
আলো চুপ করে থাকে, সামিন বলে,"এসো লিফট এসে গিয়েছে।"
তারা দু'জনে ব্যাতীত অন্য কেউ লিফটে নেই। সামিন আড়চোখে একবার আলোকে দেখে, মেয়েটার মুখটা এমন থমথমে কেনো? নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে? কিন্তু সামিনের তো ওর সবকিছুকেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এটা ঐ মেয়েটাকে কিভাবে বোঝাবে।
হঠাৎ আলো সামিনের দিকে তাকায়। দু'জনের চোখে চোখাচোখি হতেই আলো চোখ নামিয়ে নেয়। সামিন ধীরে ধীরে আলোর দিকে এগিয়ে যায়। আলো কিছুটা ঘা*বড়ে যায়। সামিন আলোর অনেকটা কাছে গিয়ে বাকা হাসি হাসে, তারপর আলোর শাড়ির আঁচল টেনে আলোর ডান কাঁধে তুলে দিতে দিতে নরম গলায় বলে,"আমার কাছে স্মার্টনেসের সংজ্ঞা ভিন্ন আলো, আমার জীবন সঙ্গিনী হিসেবে যেটুকু স্মার্টনেস থাকা দরকার তার পুরোটাই তোমার মধ্যে আছে, এবার তুমি বলো তোমার স্বামী হিসেবে আমি যথেষ্ট স্মার্ট কি?"
আলো একপলক সামিনের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। সামিন আলোর থেকে কোনো উত্তর আশা করে না। সে বলতে থাকে," এই সিঙ্গাপুর সিটি, এই কালচার, এ দেশীয় ম্যা*নারস দিয়ে আমাদের দরকার কি আলো? আমরা তো ফিরে যাবো আমাদের ছোটো শহরে, তুমি সেখানেই দাপিয়ে বেড়িও। শাড়ির আঁচল ডান কাঁধে তুলে গলাবাজি করো কিংবা সালোয়ার কামিজের ওড়না গাঁয়ে জরিয়ে নিয়ে হম্বিতম্বি করো।
আমার তোমার বর্তমানের জড়তা কিংবা নাদানের মতো জংলি আচরণ গ্রহণ করতে একটুও অসুবিধে হচ্ছে না। আমি উপভোগ করছি। প্রকাশ্যে চু*মু খাওয়া, ও*য়াইন দেখলে যেকোনো মুসলিম মেয়ে ওভাবেই রিয়াক্ট করতো সম্ভবত। তাই বলে তুমি জংলি হয়ে যাওনি। একটা জংলি মেয়ে কখনোই লোন তুলে, কিছু তৃতীয় লি*ঙ্গের মানুষ নিয়ে রীতিমতো বিজনেস দা*ড় করানোর চিন্তা করবে না। একজন অসম্ভব স*ভ্য, মুক্তচিন্তার অধিকারী এবং অদম্য সাহসিকতার মেয়েই করবে।"
আলো থমকে দাঁড়িয়ে থাকে সামিনের কথা গুলো শুনে। এই লোকটা খুব সুন্দর করে কথা বলে। জনগণকেও কি এভাবেই পটিয়ে নেয় এই মেয়র সাহেব?
সামিন আলোর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। আলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, মনে মনে বলে,"আমি নিজেকে এতোটা অনুভব করতে পারিনি যতটা আপনি পেরেছেন, তবুও কেনো আপনাকে গ্রহণ করে নিতে আমার এতো জড়তা। তবে কি আমিই ত্রুটিপূর্ণ ইয়াসার মির্জা?"
***
ডক্টর এনজি হুই ওয়েন। প্লা*স্টিক, পুনর্গঠন এবং নান্দনিক সা*র্জারি। ট্যা*ন টক সেং হসপিটাল, সিঙ্গাপুর।
সামিন ম্যাগাজিনটা উলটে পালটে দেখছে। আলো চুপচাপ বসে আছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,"ডক্টর কি মহিলা?"
_হ্যা, মহিলা। কেনো?
সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলো মাথা নেড়ে বলে,"এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। নাম দেখে বুঝতে পারছি না।"
সামিন আবারও ম্যাগাজিনে চোখ রাখে। আলো আড়চোখে সামিনকে দেখছে। আজ সামিন একটা কালো রঙের শার্ট পরেছে। সুন্দর লাগছে, হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে।
সামিন ম্যাগাজিনটা রেখে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"খাবে কিছু? কোনো পানীয়? নিয়ে আসি?"
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন আলোর হাতের ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলে,"যা যা বলেছি, নিয়েছো ব্যাগে?"
আলো মাথা নেড়ে বলে,"হ্যা।"
সামিন আলোকে নিয়ে আজ সেন্তোসা আইল্যান্ডে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। সেখানে গিয়ে একটা মোটেল বুক করে বিশ্রাম নিতে যা যা প্রয়োজনীয় জিনিস লাগবে সবকিছুই গুছিয়ে নিয়েছে আলো। সামিনের অতিরিক্ত শার্ট, কিংবা তার শাড়ি। সবই নিয়েছে ব্যাগে।
রিসিপশনের মেয়েটি এসে সামিন আর আলোকে ডেকে নেয়। তারা মেয়েটির পিছু পিছু ডক্টরের কেবিনে যায়।
ডক্টর এনজিকে দেখে মনেই হচ্ছে না তার বয়স আটচল্লিশ বছর এবং একুশ বছরের ডাক্তারি ক্যারিয়ার। বরং তার বয়স ছত্রিশ কি আটত্রিশের কাছাকাছি মনে হচ্ছে। সামিনের দিকে তাকিয়ে একটা প্রশ্বস্ত হাসি দিয়ে বলে,"তুমিই সামিন? তোমার সাথেই কথা হয়েছিলো আমার?"
সামিন মাথা নাড়ায়। এনজি আলোর দিকে তাকিয়ে সামিনকে বলে,"তোমার স্ত্রী একজন অতি রূপবতী নারী সামিন।"
সামিন ম্লান হাসে। এনজি বলতে থাকে,"সা*র্জারির আগে আমি তোমার স্ত্রীর ক্ষ*তটা সম্পর্কে ধারণা নিতে চাচ্ছি। আজ ওকে দেখবো। তারপর তোমাকে জানিয়ে দেবো কখন সা*র্জারি হবে।"
সামিন সম্মতি জানায়। এনজি উঠে দাঁড়ায়, আলোকে বলে আমি তোমার ক্ষ*তটা দেখতে চাচ্ছি আলো।
সামিন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,"আমি বাইরে অপেক্ষা করছি ম্যাম।"
এনজি অবাক হয়ে বলে,"তুমি তো হাজবেন্ড সামিন, থাকতে পারো। ও কিছুটা মনের জোর পাবে।"
আলো আর সামিন একে অপরের মুখের দিকে অস্বস্তি নিয়ে তাকায়। কিছু সময় পরে সামিন বলে,"আপনি দেখুন ম্যাম,আমি আসছি।"
"সা*র্জারি কখন হবে?"
প্রশ্নটি করে আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বলে,"আমাদের ইন*ফর্ম করা হবে।"
আলো সংকোচ নিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। সামিন বুঝতে পেরে বলে,"কি? অসুবিধে কোনো?"
_ওয়াশ রুমে যেতে চাচ্ছি।
সামিন আলোর হাত থেকে তার ব্যাগটা নিয়ে নেয়। তারপর বলে,"ওদিকটায় যাও, আমি এখানে অপেক্ষা করছি।"
মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে আলো ডানদিকে তাকায়। তার বয়সী একজন নারী চেহারায় নতুন করে মেইকআপ লাগাচ্ছে। মহিলা আলোকে একপলক দেখে বলে,"কোন দেশ?"
_বাংলাদেশ।
_ব্যাংলাদেশ? কেনো এসেছো?
আলো কিছু বলতে যাবে তার আগেই বলে,"স্ত*ন ছোট বড় করার জন্য ডক্টর এনজি খুবই ভালো। আমি এসেছি স্ত*ন ছোটো করাতে। বেবিকে ব্রে*স্ট ফিডিং করিয়ে আমার সৌন্দর্য সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে।"
আলোর কান গরম হয়ে গিয়েছে ভদ্রমহিলার কথা গুলো শুনে। সে কোনো জবাব না দিয়ে টিস্যু পেপার দিয়ে নিজের ভেজা মুখটা মুছে নিতে থাকে। মহিলা বলতে থাকে,"আমার কয়েকজন বান্ধবী বেশ ভালো ফল পেয়েছে। তুমিও নির্বিঘ্নে করাতে পারো।"
_সবাই এখানে ওসব করাতে আসে না ম্যাম।
নিচু স্বরে বলে আলো।
কৌতুহলী ভদ্রমহিলা বলে,"তুমি কেনো এসেছো তবে? নাক নাকি লিপসের সা*র্জারি। কিন্তু তুমি তো দেখতে খুবই চমৎকার।"
আলো কোনো জবাব না দিয়ে বেরিয়ে যায়।
সামিন দাঁড়িয়ে আছে তার ব্যাগ হাতে। মেয়র সাহেবের এই রূপ দেখে খুবই হাসি পাচ্ছে আলোর।
বৌয়ের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন গুরুগম্ভীর নেতা। সাহেবদের মতো পোশাক পরে হাতে বৌয়ের ভ্যানিটি ব্যাগ, কি এক অদ্ভুত দৃশ্য!
আলো এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে নেয়।
***
সবগুলো থিমপার্ক ঘুরে শেষমেশ সামিন আর আলো সেন্তোসা বিচের দিকে যায়। সামিন আড়চোখে আলোকে একপলক দেখে। আজ উড়ন*চন্ডী আলোকে খুবই শান্ত লাগছে, কোনো ব্যাপারেই সিন*ক্রিয়েট করছে না। অযথা প্রশ্ন করছে না, আপত্তি জানাচ্ছে না।
আলো সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখছে। সামিন বলে,"তুমি কখনও ঘোরাঘুরি করোনি তাইনা খুব একটা?"
আলো মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,"সবসময় নিজের লেখাপড়া, বিভিন্ন প্রতিযোগীতা এসব নিয়েই থেকেছি। ঘোরাঘুরি বলতে ছুটি পেলে মামাবাড়ি যেতাম। আমাদের আর কোনো রিলেটিভ নেই তেমন।"
_তোমার রুমে দেখেছি একটা আলমারি ভর্তি তোমার পুরস্কার। এতো পুরস্কার কিসের জন্য ?
_ওগুলো সব রচনা লেখা,বিতর্কের জন্য পেয়েছি। আমার আর কোনো গুণ নেই। ক্লাস সিক্স থেকেই আমি বিতর্ক করি।
_তুমি বিতার্কিক? ইশমামও বিতার্কিক। ওর-ও এসবের জন্য অনেক পুরস্কার আছে বাড়িতে।
আলো অস্বস্তিতে পরে যায় ইশমামের কথা শুনে। বিতর্ক প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই তো তাদের দুজনের আলাপ হয়েছিলো।
সামিন আলোর নীরবতা দেখে বলে,"চলো ওদিকটায় যাই।"
হাঁটতে হাঁটতে বিচের একটা ফাঁকা জায়গায় এসে তারা দাঁড়িয়ে পরে। পরিবেশ টা খুব ভালো লাগছে আলোর।
বিচে স্বামী স্ত্রী সবাই ঘনিষ্ঠ হয়ে হাঁটছে। আলো টের পেলো তার হঠাৎ করে খুব ভালো লাগছে এই দৃশ্যটাও।
"এখানে থাকবে?"
আলো সামিনের দিকে তাকায় তার কথা শুনে। সামিন বলতে থাকে,"চলো মোটেলে ঢুকি। তোমার বিশ্রাম দরকার। আমরা এখন ফিরছি না, সন্ধ্যার পরে সূর্যাস্ত দেখে ফিরবো।"
***
লিফটের দরজা খুলে যেতেই সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,"আজ চু*মুখোর কোনো কাপল নেই।"
আলো লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। সামিন বলে,"শুরুতে আমিও তোমার মতোই খুবই বিরক্ত হয়ে যেতাম। প্রথম যখন ইউএসএ গিয়েছিলাম ইশমামের কাছে। তখন ইশমামের সামনে এমন পরিস্থিতিতে পরে গিয়েছিলাম আমি। দুই ভাই ভীষণ লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলাম। ইশমাম প্রায় পালিয়ে গিয়েছিলো আমার পেছন থেকে। লিফট বন্ধ হতে পেছনে ঘুরে দেখি আমার ভাই নেই।"
আলো ফিক করে হেসে দেয়। সামিনের কাছে সে হাসি বড় মধুর লাগে। এই মেয়ে যখন হাসে তখন একে পুরো অন্যরকম লাগে।
রুমে ঢুকে সামিন ব্যাগপত্র রেখে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পরে। আলো ধীরপায়ে হেটে আয়নার সামনে যায়। নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে, হঠাৎ গলার কাছটায় তার চোখ যেতেই মুখটা ফ্যা*কাশে হয়ে যায়।
ঘুরে সামিনের দিকে তাকায়। তারপর ছুটে গিয়ে পার্স ব্যাগ খুলে ব্যাগের সব জিনিসপত্র ঢেলে দেয় বিছানায়। সামিন উঠে বসে, অবাক হয়ে বলে,"কি হয়েছে? কি খুজছো?"
আলো আতংকিত মুখ নিয়ে বলে ওঠে,"আমি সম্ভবত....!"
_তুমি সম্ভবত কি?
_আমি সম্ভবত আপনার দেওয়া লকেট টা মোটেলে ফেলে এসেছি।
_হোয়াট!
শব্দটা উঁচু গলায় বলে সামিন। আলো মুখ শুকনো করে বসে আছে।
_মোটেলে কিভাবে ফেলে এসেছো?
_ওয়াশ রুমে, গোসলের সময় খুলে রেখেছিলাম মিররের সামনে।
সামিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। আলোর খুব অস্বস্তি হচ্ছে।
সামিন উঠে দাঁড়ায়। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"কিছুক্ষণ একা থাকতে পারবে?"
"কোথায় যাচ্ছেন আপনি?"
_সেই মোটেলে।
_এখন? এতো রাতে?
সামিন কিছু বলে না। দরজার দিকে যেতে নেয়। আলো বলে,"থাক না, বাদ দিন।"
সামিন ঘুরে তাকায় আলোর দিকে, গম্ভীর কন্ঠে বলে,"শুধু তোমার ঐ হাতের বালা দুটো না, ঐ লকেট টার সাথেও আমার অনেকটা ইমোশন জরিয়ে আছে। আমি ওটা এতো সহজে হারিয়ে ফেলতে চাচ্ছি না।"
আলো সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন চুপচাপ রুম থেকে চলে যায়।
***
তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে আলো একই ভাবে বসে থাকে। তার নিজের ওপর নিজের প্রচন্ড রা*গ হচ্ছে। কতটা কেয়ারলেস সে! সামিনের সেই দৃষ্টি আলোকে অস্বস্তি দিচ্ছে। যাওয়ার সময় তাকে দেখে মনে হয়েছে সে আলোর উপর রা*গ করেছে তার দেওয়া উপহার এভাবে কেয়ারলেসের মতো যেখানে সেখানে ফেলে আসার জন্য। আলো বেশ অবাক হচ্ছে, সামিন তার ওপর বিরক্ত হয়েছে তাতে তার এতো খারাপ লাগছে কেনো!
জড়তা কাটিয়ে নিয়ে আলো ফোনটা হাতে নেয়। সামিনের নাম্বার ডায়াল করতেই একজন নারী কন্ঠ বলে ওঠে,"দ্যা নাম্বার ইউ আর ট্রাইং টু কল ইজ কারেন্টলি সুইচস্টপড!"
মোটেলের রিসিপশনিস্ট সামিনের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"আমি চে*ক করে দেখতে চাই।"
_কিন্তু স্যার, এটা তো সম্ভব না। নতুন গেইস্ট উঠেছে ওই ঘরে। আর তাছাড়া আপনাদের জিনিস,আপনাদের রেসপনসিবিলিটি ছিলো।
সামিন পকেটে থেকে কিছু ক্যাশ বের করে রিসিপশনিস্টকে দিয়ে বলে,"এখনো সম্ভব না ?"
রিসিপশনিস্ট এদিকে ওদিকে তাকিয়ে টাকাগুলো নিয়ে নেয়, তারপর বলে,"দেখছি স্যার।"
ওয়াশ রুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও লকেট টা খুজে পাওয়া গেলো না।
রুমের নতুন গেইস্ট বিরক্ত ভঙ্গিতে মোটেলের ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যানেজার ফিসফিসিয়ে বলে,"উনি একজন ডি*টেক্টিভ। ওনাকে ওনার কাজ করতে দিন।"
অতিথি লোকটা অবাক চোখে সামিনকে দেখে। সামিনের চেহারা, বডি দেখে তাকে ডি*টেক্টিভই মনে হচ্ছে, চেহারায় পুরো শার্লক হোমস ভাব আছে। তাই নিজের বিরক্তি প্রকাশ না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
লকেট টা কোথাও খুজে না পেয়ে সামিন বিরস মুখে বের হয়। ম্যানেজার সামিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,"খুজে পেয়েছেন স্যার?"
সামিন তার কথার জবাব না দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে,"আমরা যাওয়ার পরে রুম ক্লিন করার জন্য যে রুম বয় এসেছিলো তার সাথে আমি কথা বলতে চাই।"
_কিন্তু স্যার এভাবে....
ম্যানেজার মিনমিন করতে থাকে। সামিন ওয়ালেট থেকে আরো কিছু ক্যাশ বের করে ম্যানেজারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,"নিয়ে আসুন ওকে।"
***
আরো একঘন্টা অতিবাহিত হয়। আলোর মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। ফোনটা লাগাতার বন্ধ। আলোকে কেয়ারলেস ভাবে, আসল কেয়ারলেস তো সে নিজে! আসুক আজকে। আজ এতো এতো এতো কথা শোনাবে, ঐ ইয়াসার মির্জার জনমের শিক্ষা হয়ে যাবে!
উঠে দাঁড়ায় আলো, ফোনটা হাতে নিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে রুম ল*ক করে। তারপর হেটে লিফটের দিকে যায়।
"তুমিই মিনজো?"
উনিশ বিশ বছরের একজন ছেলে সামিনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। তার চেহারা ভাবলেশহীন।
সামিন বলে,"দেখো মিনজো। আমি স্পষ্ট কথা এবং কাজ পছন্দ করি। তোমাকে আমি ঐ লকেটটার সমপরিমাণ মূল্য দিয়ে দেবো, তুমি আমাকে লকেট টা দাও।"
মিনজো এমন ভাবে সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
সামিন বলে," বিশ্বাস হচ্ছে না?"
কথাটা বলে সামিন নিজের কার্ড বের করে বলে,"চলো এক্ষুনি দিচ্ছি। তুমি শুধু আমাকে লকেট টা দাও মিনজো। এবং আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি এই ব্যাপারে তোমার মালিক কিছুই জানবে না।"
সামিনের হাতের কার্ড টার দিকে তাকিয়ে মিনজো আবারও সামিনের দিকে তাকায়, তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,"আমার কাছে কোনো লকেট নেই স্যার!"
সামিনের মাথায় প্রচন্ড রা*গ উঠে যায়, কিন্তু সে তার নার্ভ ঠান্ডা করার চেষ্টা করে বলে,"দেখো মিনজো, ওটা আমি আমার ওয়াইফের জন্য খুব ভালোবেসে কিনেছি, ওটা আমার কাছে খুব ইম্পরট্যান্ট। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। আচ্ছা আমি তোমাকে বাড়িয়ে দেবো টাকা।"
কন্ঠে আকুলতা সামিনের। সেই আকুলতা খুবই রহস্য জনক ভাবে উনিশ বছরের ছেলেটি বুঝতে সক্ষম হলো।
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে আপন মনে মিনজো বলে,"কেনো যে আমি এতো ভালো হলাম!"
তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে পকেট থেকে সেই লকেট টা বের করে সামিনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,"এখন কে*টে পরুন হিরো। আমার চাকরি যাওয়ার আগে।"
সামিন আনন্দিত চোখে লকেট টার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মিনজোর দিকে কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলে,"অসংখ্য ধন্যবাদ মিনজো। তুমি চাইলে আমি তোমাকে কিছু ক্যাশ..."
সামিন ওয়ালেট থেকে কয়েকটা নোট বের করতে থাকে। মিনজো সামিন কে থামিয়ে দিয়ে বলে,"দরকার নেই।"
তারপর কয়েক মুহূর্ত কিছু একটা ভেবে বলে,"আচ্ছা অর্ধেক দিন, ভালোমানুষীর একটা দাম আছে। ফ্রিতে ভালোমানুষী দেখানো ঠিক না।"
একটু থেমে তারপর আবার বলে,"আমার ছোটো বোনের জুতো কিনবো।"
সামিন হেসে পুরো টাকাটা মিনজোর হাতে দিয়ে বলে,"পুরোটাই নাও। তোমার নিজের জন্যও কিনে নিও।"
***
গভীর রাত, সবাই আলোর দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। আলো সরাসরি রিসিপশনে চলে যায়, রিসিপশনিস্ট মেয়েটি আলোর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,"বলুন ম্যাম, কিভাবে সাহায্য করতে পারি।"
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"আমার স্বামী পাঁচ ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে হোটেল থেকে বের হয়েছে, তার ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। অন্য কোনো উপায় নেই তার সাথে যোগাযোগ করার। না আমার কাছে কোনো ক্যাশ আছে, না কার্ড। আমি কিভাবে তার সাথে যোগাযোগ করবো কিছু বুঝতে পারছি না।"
_ম্যাম আপনার স্বামী কোথায় গিয়েছে?
_সেন্তোসা আইল্যান্ড থেকে খানিকটা দূরে, হাইওয়ে সংলগ্ন এসেম্বলি পার্ক মোটেলে। আমি ঠিকভাবে বলতেও পারছি না, আমি খেয়াল করিনি অতকিছু।
আলোর গলা কাঁপছে। হাত পা কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে। রিসিপশনের লোকগুলো আলোর উৎকণ্ঠা বুঝতে পেরে বলে,"ম্যাম, আপনি বসুন।"
আলো বসে না, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেনো তার বুকে সূক্ষ্ম যন্ত্রনা হচ্ছে! কেনো!
রিসিপশনের লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করে, তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"ম্যাম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরামর্শ দিচ্ছি আপনাকে। তারপর যদি আপনার মন সায় না দেয় আমরা পুলিশকে ইনফর্ম করবো! মাত্র পাঁচ ঘন্টা হয়েছে।
_মাত্র? পাঁচ ঘন্টা আপনাদের কাছে মাত্র মনে হচ্ছে? এখান থেকে সেন্তোসা আইল্যান্ড যেতে কতক্ষন লাগে? কতক্ষন!
আলোর গলা কাঁপছে! এখন সে দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছে না। গতকাল রাতের ঘটনা মনে করে আ*তঙ্কে ভেতরটা জমে যাচ্ছে।
"তুমি সামিনের বৌ না?"
বাংলা ভাষা শুনে আলো ঘুরে তাকায়। নাফিসা কালাম আর তার হাজবেন্ড আলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
আলোর আ'ত'ঙ্কি'ত মুখ দেখে তারা এগিয়ে যায়।
"আমাকে চিনতে পেরেছো? এয়ারপোর্টে দেখা হয়েছিলো? তোমরা এই হোটেলে উঠেছো? তোমার স্বামী কোথায়?"
আলো অসহায়ের মতো এদিকে ওদিকে তাকিয়ে তাদের কথার জবাব না দিয়ে রিসিপশনে ছুটে যায়। চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"প্লিজ পুলিশকে ইন*ফর্ম করুন প্লিজ।"
নাফিসা কালাম এগিয়ে যায়। আলোর কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলে,"কি হয়েছে বেটা? কোনো সমস্যা? আমাদের বলো!"
আলোর চোখের কার্নিশ ভিজে গিয়েছে। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,"উনি পাঁচ ঘন্টা আগে এখান থেকে বেরিয়েছেন। এখনো ফেরেননি। আমারই ভুল, আমার ওনাকে অত রাতে যেতে দেওয়া উচিত হয়নি। আমার ভুল।"
কাঁ*পতে থাকে আলো। কিছুতেই ধাতস্থ হতে পারছে না। না পারছে চোখের পানি আটকাতে।
রিসিপশনের লোকগুলো শুকনো মুখে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
আলো ধপ করে একটা সোফায় বসে পরে, বিরবির করে বলে,"কেনো! আমার সাথেই এরকম হচ্ছে কেনো!"
নাফিসা আলোর কাঁধে হাত রেখে বলে,"শান্ত হও মেয়ে, শান্ত হও। পাঁচ ঘন্টা.."
_পাচ ঘন্টার ব্যাপার নয় আন্টি। উনি এমন কখনোই করবেন না, আমি ওনাকে চিনি।
কথাটা কোনো মতে বলে শেষ করে এবং শেষমেশ কেঁদেই ফেলে পাথরকন্যা আলো।
সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। রিসিপশনের ভদ্রমহিলা পুলিশকে ইন*ফর্ম করার সিদ্ধান্ত নেয়।
"কি হয়েছে আলো।"
আলোর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সামিন। সামিনের কন্ঠস্বর শুনে আলো মাথা তুলে তাকায়।
তাদের আশেপাশের লোকজন তাদের দেখতে থাকে। লবিতে একটা সোফাতে আলো বসেছিলো।
সামিন দ্রুতপায়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,"তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? কি হয়েছে?"
আলো ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। তার ভেজা দুটি চোখের দৃষ্টি সামিনের চোখের দিকে।
সামিন আলোর মুখোমুখি দাঁড়ায়।
_কি হয়েছে আলো বলো তুমি এভাবে কাঁদছো কেন?
আলো চুপ করে সামিনের চোখের দিকেই তাকিয়ে থাকে।
সামিন রাগী গলায় বলে,"উত্তর দাও, কাঁদছো কেনো মেয়ে! কি হয়েছে তোমার?"
আলো কোনো জবাব দেয়না, পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে এবং পরক্ষনেই সামিনকে অবাক, হতবাক, হতভম্ব এবং চমকে দিয়ে হুট করে সবার সামনে সামিনকে জরিয়ে ধরে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব সামিন। বোকার মতো চারদিকে তাকাচ্ছে।
সামিনের পেটের কাছের শার্ট খামচে ধরে রেখেছে আলো। হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সামিনের। সামিনের চোখ বড়বড় হয়ে আছে। সে কি স্বপ্ন দেখছে! স্বপ্ন এতোটা স্পষ্ট হয়? এতোটা রঙিন?
মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকায় সামিন। সবাই তাদের দেখছে। রিসিপশনে লোক জড়ো হয়ে গিয়েছে। আলো তখনও সামিনের বুকের সাথে নিজের মাথাটা ঠেকিয়ে রেখেছে। কোনো নড়াচড়া করছে না, সামিনের মনে হচ্ছে আলো নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিচ্ছে না। চঞ্চল, উড়ন*চন্ডী মেয়েটাকে কেমন অদ্ভুত শান্ত, নমনীয় লাগছে।
অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের তীব্র অনূভুতির ঘোর কাটে না। সামিন যথাসম্ভব চেষ্টা করে নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। না এটা কোনো স্বপ্ন নয়। সে চোখ নামিয়ে আলোর মাথার দিকে তাকায়। দৃষ্টি আলোর সিঁথিতে নিবদ্ধ রেখে নরম গলায় বলে,"কি হয়েছে আলো?"
আলো কোনো কথা বলে না। একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, নিশ্চুপ হয়ে,সামিনের বুকে মাথা ঠেকিয়ে।
পাশ থেকে নাফিসা কালাম বলে ওঠে,"তুমি এলে শেষমেশ সামিন! কোথায় গিয়েছিলে এতো রাতে? এদিকে তোমার স্ত্রী কেঁ*দে কে'টে একাকার হয়ে গিয়েছে, ভেবেছে তার পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির, সু-স্বাস্থ্যবান স্বামীকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছে, অথবা হারিয়ে গিয়েছে তার স্বামী। এক্ষুনি পুলিশ নিয়ে তোমাকে খুঁজতে যাচ্ছিলো তোমার বৌ।"
সামিন অবাক হয়ে নাফিসার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আশেপাশের লোকজন নিজেরা নিজেদের কাজে মন দেয়। স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত মুহূর্তে তারা নাক গলাতে ইচ্ছুক নয়।
আলো সেই যে মুখ লুকিয়েছে সামিনের বুকে এখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। সামিন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আলোর বাহু ধরে ধীরে ধীরে আলোকে নিজের থেকে আলগা করে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আলোর মুখের দিকে তাকায়। আলো চোখ নামিয়ে রেখেছে। সামিন একহাত দিয়ে আলোর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে আলোর চোখে চোখ রাখে। চোখের কার্নিশ এখনো ভেজা মেয়েটার।
সামিন নরম গলায় জানতে চায়,"কি হচ্ছিলো এসব?"
সামিনের প্রশ্নের জবাব আলো দেয়না। আত*ঙ্কিত, ভী*ত, কান্নাভেজা মুখটা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে এক ঝটকায় সামিনের হাত সরিয়ে দেয় নিজের থুতনি থেকে, তারপর ছুটে যায় লিফটের কাছে।
সামিন বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। নাফিসা বলে,"দেখছো কি দাঁড়িয়ে, যাও!"
সামিন নাফিসার দিকে তাকিয়ে বলে,"আন্টি আপনারা!"
_আমাদের রুম নাম্বার আর থার্টি সেভেন। কাল দেখা হবে! এখন যাও ছেলে, তোমার বৌয়ের মান ভাঙাও। যাও। দেখে মনে হচ্ছে প্রচুর ক্ষে*পেছে তোমার বৌ।
***
"আলো, দাঁড়াও বলছি। আলো ! কথা শোনো।"
আলো দাঁড়ায় না। পিছু ফিরে তাকায় না। লিফটে উঠে পরে।
যে লিফট টাতে আলো উঠেছে, সেটাতে ঢোকার চান্স পেলো না সামিন। জলদি জলদি পাশের লিফটে উঠে পরে সে। ছয়তলায় উঠে আলোর পিছু নেয়। পেছন থেকে ডেকেই যাচ্ছে আলোর নাম ধরে। আলো রাগান্বিত চেহারা নিয়ে ছুটতে থাকে এল টুয়েন্টি ফোরের দিকে। এ যেনো দৌড় প্রতিযোগিতা চলছে!
সামিন চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"আলো স্টপ! মানুষ আমাকে স্ট*কার ভেবে গন*পিটুনি দেবে। দেশের সূর্য সন্তান বিদেশের মাটিতে গন*পিটুনি খাবে,এটা চাও তুমি?"
দৌড় প্রতিযোগিতায় সামিন ইয়াসার মির্জা তার সহধর্মিণীর কাছে হেরে যায়।
নিজেদের রুমে ঢুকে আলো দরজা লক করে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে সে।
সামিন এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পরে। হাঁপাতে থাকে সেও। কিছু সময় পরে নরম গলায় বলে,"দরজা খোলো আলো!"
আলো চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সে খুলবে না দরজা। খুলবেই না। এটাই ঐ দায়িত্ব জ্ঞানহীন পুরুষটার উপযুক্ত শা*স্তি।
সামিন দরজায় আলতো করে চাপড় মে*রে বলে,"প্লিজ আলো, দরজা খোলো। দেখো সবাই আমাকে দেখে হাসছে! খুলে দাও দরজাটা।"
আলো নিশ্চুপ। সামিন বলতে থাকে,"বড্ড অবিচার করো তুমি আমার সাথে। দোষ কি করেছি সেটা না জানিয়েই শাস্তি দিচ্ছো।"
_গত ছয়ঘন্টায় আপনি লকেট উদ্ধারের পাশাপাশি আর কোন কোন রাষ্ট্র উদ্ধার করে এসেছেন সেটার বিবরণ দিন ইয়াসার মির্জা, আপনার হাতে সময় পাঁচ মিনিট। এই পাঁচ মিনিটে গত ছয় ঘন্টার প্রত্যেকটা মিনিটের হিসেব আপনাকে দিতে হবে।
চেঁ*চিয়ে বলে ওঠে আলো।
সামিনের শার্টের বুক পকেটে একটা ক্ষুদ্রাকার সাদা রঙের ফুল ছিলো, সেটায় হাত বুলিয়ে সামিন হেসে ফেলে। পরক্ষনেই বলতে থাকে,"এখান থেকে ভিভোসিটি মলে যেতে চল্লিশ মিনিট লেগেছে আলো, ক্যাব পাচ্ছিলাম না। তারপর ওখান থেকে বিশ মিনিটে ঐ মোটেলে পৌঁছালাম। এই গেলো এক ঘন্টার হিসেব। পেয়েছো?"
_পেয়েছি।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।
_তারপর মোটেলের রিসিপশনিস্টের সাথে কথা বলে,ম্যানেজারকে মানিয়ে তন্নতন্ন করে খুজেছি তোমার লকেট টা সেই ওয়াশ রুমে। এতে চলে গিয়েছে প্রায় দুঘন্টা। তিন ঘণ্টার হিসেব পেয়েছো?
_পেয়েছি।
_তারপর যখন লকেট টা খুঁজেই পাইনি, তখন ঐ রুমের রুম বয়কে ডেকে আনিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে লকেট টা উদ্ধার করতে করতে আরো এক ঘন্টা চলে যায়। চার ঘন্টার হিসেব পেয়েছো?
_পেয়েছি।
_মোটেল থেকে লকেট টা নিয়ে বের হওয়ার পরে একটু হালকা হতে একটা পাবলিক টয়*লেটে ঢুকেছিলাম। বেরিয়ে দেখি সেন্তোসা টু ভিভোসিটি মলের রাতের শেষ বাসটা তিন মিনিট আগে চলে গিয়েছে। কপাল আমার! ওখানে দাঁড়িয়ে থাকি আধাঘণ্টার মতো। একটাও ক্যাব পাচ্ছিলাম না। ফোনটা ডে*ড হয়ে পরে ছিলো। তারপর বাধ্য হয়ে হাঁটতে শুরু করি, শর্ট*কাট রাস্তা ধরে। আরো বিশ মিনিট চলে যায়। চার ঘন্টা পঞ্চাশ মিনিটের হিসেব পেয়েছো?
_পেয়েছি।
_তারপর ভিভোসিটি মল থেকে বেরিয়ে সৌভাগ্য ক্রমে একটা ক্যাব পেয়ে যাই। এখানে এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরো চল্লিশ মিনিট লেগে যায়। পাঁচ ঘন্টা ত্রিশ মিনিটের হিসেব। পেয়েছো?
_পেয়েছি।
_বাকি আধাঘণ্টার শেষের পনের মিনিট তো তুমি আমাকে জরিয়ে ধরেই ছিলে আলো।
নরম গলায় বলে সামিন ।
_ঐ আধা ঘন্টার প্রথম পনেরো মিনিটের হিসেব দিন।
তে*জী কন্ঠে আলো বলে।
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,"সেন্তোসা টু ভিভোসিটি মলের রাতের শেষ বাসটা, যেটা আমি মিস করেছিলাম, সেটা এক্সি*ডেন্ট করেছে আলো। হোটেলের সামনে এসে খবরটা শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলাম পনেরো মিনিট।
আলো কেঁ*পে ওঠে। সামিন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
ধীরে ধীরে দরজার নব ঘোরার শব্দ হয়। দরজা খুলে আলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন কয়েক মুহূর্ত আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লক করে ঘুরে আলোর দিকে তাকায়। চোখের কার্নিশ এখনো ভেজা আলোরানীর। সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,"আমি এখানে আমার সা*র্জারির জন্য এসেছি, আপনার জন্য দুশ্চিন্তা করে রাত পার করে দিতে নয় ইয়াসার মির্জা।"
সামিন কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে আলোর দিকে। তারপর হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,"রাত পার করলে কই ? সকাল হতে এখনো দুঘন্টা দেরী।"
কথাটা বলে শেষ করতে পারে না সামিন, আলো এলোপাথাড়ি সামিনের বুকে কি*ল ঘু*ষি মারতে থাকে, দাঁতে দাঁত চেপে। সামিন উচ্চশব্দে হেসে ফেলে, হাসতে হাসতে আলোর দুহাত শক্ত করে ধরে ফেলে। ধীরে ধীরে আলো শান্ত হয়। তার দৃষ্টি সামিনের চোখের দিকে। সামিনও তার স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, ঐ চোখে আজ কোনো ঘৃ*ণা নয়, বরং তার জন্য অনূভুতি দেখতে পাচ্ছে সে। তবে কি সামিন ইয়াসার নির্বাচনে জয়ী হয়েছে?
অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে সামিন,"স্বামীর গায়ে হাত তুলতে নেই মূর্খ মেয়ে, তোমার মা তোমাকে সহবত শেখায়নি?"
আলো চুপ করে থাকে।
আলোকে টেনে নিজের অনেকটা কাছে নিয়ে গিয়ে সামিন ধ'ম'কে'র সুরে বলে,"ইররেস্পনসিবল লেডি। তোমার জন্য আজ আমি মা*রা পরতে যাচ্ছিলাম। ঢং করে লকেট টা খুলে কেনো রেখেছিলে? বেশ হতো, ঐ বাসে যদি আমি থাকতাম......"
কথাটা বলে সামিন শেষ করতে পারে না,আলো তার মুখ চেপে ধরে ডান হাত দিয়ে। সামিন চোখ বড়বড় করে রেখেছে। আলো ধরা গলায় বলে,"বলবেন না, বলবেন না এমন কথা।"
ঠোঁট কাঁপছে আলোর। সামিন বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের মুখের ওপর থেকে আলোর হাতটা ধীরে ধীরে সরিয়ে দেয়। আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতটা মুঠি করে শক্ত করে ধরে সামিন বলতে থাকে,"ফে*রাউন ম*রে গেলে তোমার কি আছিয়া।"
_ছিঃ এসব আর কখনো যেনো না শুনি। ফে*রাউনের সাথে নিজের তুলনা দেবেন না, মজা করেও না, জা*লিমের সাথে নিজের তুলনা দিতে নেই।
চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে আলো।
সামিন ম্লান হাসে, নরম গলায় বলে,"তুমিই তো বলতে আমাকে এটা।"
_রাগ ছিলো, ঘৃ*ণা ছিলো....
_ছিলো?
শব্দটা উচ্চারণ করে আলোর চোখে চোখ রাখে সামিন। আলো চোখ নামিয়ে নেয়।
সামিন বলতে থাকে,"ছিলো? রাগ ছিলো, ঘৃ*ণা ছিলো? অতীতকাল। তার মানে এখন নেই? রাগ নেই ঘৃ*ণাও নেই?"
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"নাহ।"
_কোথায় গিয়েছে সেসব?
_জানিনাহ।
_আচ্ছা ঠিকাছে, রাগ নেই, ঘৃ*ণাও নেই। তাহলে তো এখন অন্যকিছু একটা আছে। সেটা কি?
_জানিনাহ।
সামিন মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে,"জানো কি তুমি?"
_আমি কিচ্ছু জানিনা।
আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে।
সামিন আলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে,"এই যে মাথামোটা মেয়ে, আমার ভুল হয়ে গিয়েছে তোমাকে ভালোবাসা, অনেক বড় ভুল হয়েছে আমার। তোমাকে কিচ্ছু জানতে হবে না। তুমি এখানে জানিনাহ জানিনাহ জপ করতে থাকো, আমি বাইরে গেলাম। দরজা লক করে দাও। "
দরজা খুলে সামিন বেড়িয়ে যেতে নেয়, পেছন থেকে আলো সামিনের হাত ধরে ফেলে, সামিন আলোর দিকে তাকায়, বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"কি? কি সমস্যা? কি চাও?"
আলো অপলক সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন ধ'ম'কে'র সুরে বলে,"কি? বলবে না কি চাও? নাকি কি চাও সেটাও জানোনা?"
_জানি!
অস্ফুট স্বরে বলে আলো।
_কি? কি চাও?
_সংসার করতে। আপনার সাথে সংসার করতে চাই ইয়াসার মির্জা!
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে আলো ধরা গলায় বলে।
সামিন একদৃষ্টে তার বৌয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,"আমি, আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করতে চাই!"
কথাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বললেও আলোর দু'চোখ বেয়ে নিশ্চুপে তরল গড়িয়ে পরে। দীর্ঘক্ষণ সামিন সেই গড়িয়ে পরা তরলের দিকে তাকিয়ে থেকে,চোখ সরিয়ে নিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। তার ইচ্ছে করছে এক্ষুনি, এই মুহূর্তে তার বৌকে কোলে তুলে নিয়ে পুরো সিঙ্গাপুর সিটিতে আনন্দ মিছিল করতে। আজ সে জিতেছে, জিতেছে সে। ঐ পাথর কন্যা অমানবিক নয়, তাকে জিতিয়ে দিয়েছে।
নিজের ভেতরটা উত্তেজনায় তোলপাড় করে দেওয়া অনূভুতিকে দমিয়ে রেখে সে আলোর কাছে এগিয়ে যায়। দুহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে আলোর চোখের কার্নিশ মুছিয়ে দেয়। আলো নিস্তেজ কন্ঠে বলতে থাকে,"যু*দ্ধ চলছিলো। ভীষণ ভয়া*বহ যু*দ্ধ। কেউ কারো কাছে হার স্বীকার করতে রাজি নয়। কিন্তু শেষমেশ একটা তু*খোড় আত্মগড়িমায় ভরপুর নারী সত্তা দুর্বল প্রমানিত হয়েছে, সে হার স্বীকার করে নিয়েছে অদম্য শক্তিশালী একজন স্ত্রী সত্তার কাছে, যে স্ত্রী সত্তার কাছে একটা কাগজ অনেক বড় গুরুত্ব বহন করে।"
গলা থেকে আর কোনো কথা বেরোতে চাইছে না, তবুও একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে আলো বলে ওঠে,"এখন আমি কি করবো মেয়র সাহেব?"
একটু থামে আলো, তারপর আবার বলতে থাকে,"একজন কঠিন নারীসত্তার পরাজয়ের আনন্দ করবো, নাকি একজন স্ত্রী সত্তার জয়ের আনন্দ করবো? কি করবো মেয়র সাহেব?"
তাকিয়ে আছে আলো তার স্বামীর দিকে। সামিন চুপ করে দেখছে আলোকে। আলো বলতে থাকে,"আমি জানিনা। আপনি বলে দিন। তার আগে প্লিজ আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিন। গত ছয়ঘন্টায় অনেক বড় একটা যু*দ্ধ শেষ হয়েছে আমার ভেতরে। আমি একটু প্রশান্তি চাচ্ছি মেয়র সাহেব। যু*দ্ধ বিধ্বস্ত শরীরটা একটু স্বস্তি চাচ্ছে।"
সামিন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আলোকে বুকে টেনে নেয়। আলোর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
দীর্ঘসময় দু'জনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ আলো অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"কেনো বলুন তো! অনুভূতিরা এতো অবুঝ কেনো? এরা কেনো একজন অপ*রাধীর জন্য জড়ো হয়েছে? বলুন না!"
আলোকে নিজের থেকে আলগা করে সামনে দাঁড় করিয়ে তার মুখটা উঁচু করে ধরে, চোখে চোখ রেখে সামিন বলে,"আমিও জানিনাহ।"
আলো কিছু সময় সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন ওয়ালেট থেকে লকেট টা বের করে আলোর গলায় পরিয়ে দিতে দিতে বলে,"তৃতীয় এবং শেষ বারের মতো পরিয়ে দিচ্ছি এটা তোমায়, যদি আর কখনো কেয়ার*লেসের মতো এটা হারিয়ে ফেলো তাহলে শা*স্তি দেবো তোমাকে।"
লকেট টা ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আলো। সামিন অনেকটা কাছে চলে যায় তার,একহাতে আগলে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,"তুমি আমাকে জিতিয়ে দিলে আছিয়া। ধন্যবাদ স্বরূপ আমি কি আমার বৌকে একটা চু*মু দিতে পারি?"
আলো চোখ নামিয়ে নেয়। কিছুটা সময় নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"এর আগেও তো দিয়েছেন। কখনো তো অনুমতি নেন নি।"
সামিন ম্লান হেসে ঠান্ডা গলায় বলে,"কারন আমি চু*মুটা কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে যাওয়া তোমার ঐ নাকের ডগায় দিতে চাচ্ছি ।"
আলো নিচু মাথাটা আরো নিচু করে ফেলে। ধীরপায়ে খানিকটা পিছিয়ে যায় সংকোচে, লজ্জায়। সামিন ম্লান হেসে এগিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলোকে পাঁজা*কোলা করে তুলে নেয়। আলো চ'ম'কে ওঠে। লজ্জার আতিশয্যে সামিনের বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে। তখনি দেখতে পায় তার বুক পকেটে একটা ক্ষুদ্র সাদা রঙের অচেনা ফুল। এটা এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি। আলো ফুলটার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। যেন জানতে চাইছে,"তুমি আমার স্বামীর বুকে কি করছো!"
সামিন আলোকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেও পাশে বসে। দৃষ্টি আলোর দিকে রেখে বুক পকেট থেকে ফুলটা বের করে আলোর খোঁপায় গুঁজে দিতে দিতে আলোর কানের কাছে মুখ নিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
"সাদা ফুলের ভাগ্য ভালো,
আমার আছিয়ার খোঁপা পেলো।"
আলো চুপচাপ বসে থাকে। দীর্ঘসময় মুগ্ধতা নিয়ে সামিন তার স্ত্রীকে দেখতে থাকে। তারপর উঠে দাঁড়ায়, নিচু স্বরে বলে,"ধন্যবাদ স্বরূপ চু*মু টা দিতে দিলে না, ধন্যবাদ স্বরূপ এক কাপ কফি বানিয়ে খাওয়াতে চাই, খাবে?"
আলো নিশ্চুপ, সামিন বলে,"একটা গোটা রাত নির্ঘুম, বেশ মাথা ধরেছে আমার। সাথে আমিও খাবো।"
আলো উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,"আমি বানিয়ে দিচ্ছি....!"
_চুপচাপ বসে থাকো!
আলোকে থামিয়ে দেয় সামিন। আলো বসে পরে। ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি গরম করতে দিয়ে সামিন ফোনটাকে চার্জে বসিয়ে দেয়।
কফি বানাতে বানাতে আলোকে বলে,"কয় চামচ চিনি?"
_এক চামচ।
অস্ফুট স্বরে বলে আলো।
কফির মগটা আলোর সামনে ধরে। আলো মগটা নিয়ে নেয়। সামিন আলোর পাশে বসে পরে।
দু'জনের মধ্যে দীর্ঘসময় পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। হঠাৎ সামিন নিজের হাতের মগটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"সামিন ইয়াসার মির্জা তার বৌয়ের জন্য কফি বানিয়েছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার!"
আলো মুচকি হাসে। তারপর অস্ফুট স্বরে বলে,"এই একমগ কফির জন্য আজকে আমাকে ছয় ঘণ্টা টেনশনে রাখার অপরাধ ক্ষ*মা করা হলো।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে চুমুক দেয় কফির মগে। তারপর বলে,"ঐ হাসিটার জন্য তোমার আজকের লকেট হারানোর অপরাধ ক্ষ*মা করা হলো।"
আলো কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে,"মনে করে ফোনে চার্জ না দেওয়ার অপরাধও ক্ষমা করা হলো।"
সামিনও কফিতে চুমুক দিয়ে বলে,"ঠিকাছে, তবে শুরু থেকেই শুরু হোক.......আমাকে ভুল বুঝে জনসভায় চ'ড় মারার অপরাধ ক্ষ*মা করা হলো।"
আলো হেসে ফেলে, তারপর মগে চুমুক দিয়ে বলে,"আমার ভোলা ভালা ভাই দুটোকে ফাঁ*সিয়ে আমাকে দিয়ে পা ধরানোর অ'প'রা'ধ ক্ষ*মা করা হলো।"
সামিন ম্লান হাসে,কফিতে চুমুক দিয়ে বলে,"সবখানে, সবার সামনে আমাকে উল্টো পাল্টা কথা শোনানোর অ'প'রা'ধ ক্ষ*মা করা হলো।"
আলো মগে চুমুক দেয়, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"ভয় দেখিয়ে আমাকে জোরপূর্বক বিয়ে........"
থেমে যায় আলো। সামিন আলোর দিকে তাকায়। হাতের কফির মগটা পাশে রেখে আলোর হাত থেকেও কফির মগটা সরিয়ে রাখে। তারপর আলোর হাত দুটো মুঠি করে ধরে নিজের হাতে, চোখ রাখে আলোর চোখে, নরম গলায় বলে,"করতে হবে না ক্ষমা, তুমি বরং...."
_করা হলো, ক্ষ*মা করা হলো!
মৃদু স্বরে বলে ওঠে আলো ।
সামিন তাকিয়ে থাকে তার স্ত্রীর দিকে,আলো বলতে থাকে," যথেষ্ট শা*স্তি আপনাকে দিয়েছি। ঐ অপরাধটাও ক্ষ*মা করা হলো।"
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আলোর হাতে চু*মু খায়। আলো নরম গলায় বলে,"সম্ভবত আমার জন্যই আপনার বাবার মৃ*ত্যু হয়েছে। আমিই পরোক্ষভাবে দায়ী। আপনি আমাকে ক্ষ*মা করতে পেরেছেন কি?"
কথাটা বলে আলো শেষ করতে পারে না, সামিন আলোকে টেনে নিজের বুকে নেয়। আলো চুপটি করে থাকে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সামিন বলে,"সব খারাপ স্মৃতি আমি এই কফির সাথে গিলে নিয়েছি। আর কিছু বাকি নেই, কিছুই নেই।"
_আমিও গিলে নিয়েছি।
ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে আলো।
কথাটি বলে ধীরে ধীরে মাথা তুলে আলো সামিনের চোখে চোখ রাখে। সামিন আলোর গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,"ভালোবাসি, আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি। আমার কাছে স্ত্রী কেবল বিছানার সৌন্দর্য নয় আলো, তুমি আমার জীবনের সৌন্দর্য। তোমার অনুপস্থিতিতে আমি কুৎসিত। তুমি আমার আলো।"
অনূভুতিকে দমিয়ে রাখতে না পেরে অবশেষে সামিন ইয়াসার অনুমতির অপেক্ষা না করেই তার স্ত্রীর নাকের ডগায় চু*মু খেয়ে বসে। আচমকা পরম স্পর্শ পেয়ে আলো লাজুক মুখটা নামিয়ে রেখে বসে থাকে চুপচাপ।
অন্ধকার কে*টে যেতে শুরু করেছে। আলো কিছু সময় পরে সামিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আশেপাশে তাকায়। তারপর উঠে গিয়ে ওযু করে, ফজরের নামাজ আদায় করে নেয়। সামিন বসে বসে আলোকে দেখতে থাকে। তারপর উঠে গিয়ে বিছানায় বালিশ টা ঠিক করে রাখে।
মোনাজাত শেষ করে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে সামিনকে দেখে আলো। ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছে, তার গায়ে একটা কালো রঙের পাঞ্জাবি। লোকটাকে পাঞ্জাবিতেই বেশ মানায়। তোয়ালে খুঁজে না পেয়ে সামিন আলোর মাথা থেকে ঘোমটা নামিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে শুরু করে। আলো লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। সামিন বলে ওঠে,"তুমি কি জানো, লজ্জা পেলে তোমাকে তিনগুণ বেশি সুন্দর লাগে।"
_না, জানিনা।
নিচু স্বরে বলে আলো।
সামিন আলোর আঁচল তার ডান কাঁধে টেনে দিয়ে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়, গায়ে চাদর টেনে দিয়ে নিচু স্বরে বলে,"এখানে,এই সিঙ্গাপুরে যতখুশি আমাকে দিয়ে নিজের সেবা করিয়ে রাখো, বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে একেবারে স্বামীর বাধ্য বৌ হয়ে যেতে হবে। একচুলও ছাড় পাবে না তুমি আছিয়া।"
আলো তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। সামিন নিজের বিছানায় শুয়ে গায়ে চাদর টেনে আলোর দিকে ফিরে শোয়। দু'জনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। দু'টো আলাদা বিছানায় শুয়ে আছে, দু'টো বিছানার দূরত্ব এক কি দুইগজ, দুটো শরীরেরও দূরত্বও তেমন। কিন্তু দু'টো মনের? সেখানে যে আর কোনো দূরত্ব নেই। সামিন ইয়াসার মির্জা এক সমুদ্র ধৈর্য্য ব্যায় করে সেই দূরত্ব কা*টিয়ে উঠেছে অবশেষে! দুটি মন একে অপরকে আলিঙ্গন করে রেখেছে।
"কি দেখছো না ঘুমিয়ে?"
আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে সামিন প্রশ্ন করে। আলো মৃদু স্বরে বলে,"আপনাকে।"
_ঘুমিয়ে পরো। দু রাত ঠিকভাবে ঘুমোতে পারোনি। এখন পুরো সিঙ্গাপুর সিটি জেগে উঠবে। আর আমরা ঘুমাবো।
কথাটা বলেই সামিন হাই তোলার ভান করে। আলো আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। সামিন দেখতে থাকে আলোকে, অপলক দৃষ্টিতে।
" সা'র্জা'রি করাবে না? এসব কি বলছো সামিন? মজা করছো?"
_না আন্টি।
রুবির কথার জবাবে সামিন বলে। রুবি হতভম্ব হয়ে যায়। ফোনটা বা কান থেকে ডান কানে ধরে বলে,"কেনো?"
_আন্টি, ওর ঐ ক্ষ'ত নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার মধ্যে কোনো দ্বি'ধা নেই। আমি ওকে বোঝাতে চাচ্ছি ঐ ক্ষ'ত নিয়েও ও আমার কাছে নিখুঁত। তাই চাচ্ছি না।
রুবি হেসে ফেলে। পর পর বলে ওঠে,"তোমার ছেলেমানুষীকে আমি সাধুবাদ জানাতে পারলাম না সামিন। এটা ওর ভালোর জন্য করা হবে। সেটা তুমিও জানো। ও তোমার চোখে নিজেকে দেখবে সেকথা ঠিক, কিন্তু কখনো কখনো তো নিজেও নিজেকে দেখবে তাই না?"
সামিন চুপ করে থাকে। রুবি হাসতে হাসতে বলে,"তোমাকে দেখলে অবাক হতে হয় সামিন। একটা মেয়ে তোমাকে এভাবে দখল করে নিয়েছে! সত্যিই মেয়েটির মধ্যে কিছু তো আছে! "
একটু থেমে রুবি বলতে থাকে,"সিঙ্গাপুর গিয়েছো, সব রেডি, এখন সা'র্জা'রি টা করিয়ে ভালোয় ভালোয় ফিরে আসো। বোকা বোকা কথা বলে নিজেকে মহাপুরুষ সাজানোর প্রয়োজন নেই। তুমি তাকে ভালোবাসো,তার ক্ষ'ত নিয়ে তোমার আপত্তি নেই তাই বলে একটা মেয়ে শরীরে ক্ষ'ত নিয়ে ঘুরবে? বোকা ছেলে। রাখো এখন! "
রুবি ফোন কেটে দেয়। সামিন খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশেপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে থাকে। এখন দুপুর। তার চোখের পাতা এক মিনিটের জন্যও লাগেনি।
ঘাড় ঘুরিয়ে রুমের ভেতরে বিছানায় ঘুমন্ত আলোকে দেখে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আলো। ধীরে ধীরে আলোর বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে একপাশে চুপচাপ বসে। তারপর আলোর মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কপালে একটা চু*মু বসাতেই যাচ্ছিলো তখনই আলো চোখ খুলে পিটপিট করে তাকায়।
সামিন থতমত খেয়ে যায়, আলো ধীরে ধীরে উঠে বসে আশেপাশে তাকায়। সামিন বলে,"দুপুর হয়ে গিয়েছে তাই ডাকতেই যাচ্ছিলাম তোমাকে, খিদে পেয়েছে খুব।"
আলো চোখ ডলে সামিনের দিকে তাকায়। মানুষটা সম্ভবত এই মাত্র গোসল সেরেছে, চুলগুলো ভেজা।
ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে ওঠে,"আমাকে একটু সময় দিন। আমি রেডি হচ্ছি।"
চোখ থেকে এখনো ঘুম সরে যায়নি আলোর, উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলতে থাকে। সামিন শক্ত করে ধরে ফেলে। মাথা ঘুরিয়ে আলো তাকায় সামিনের দিকে, তারপর ওয়াশ রুমে ঢোকে।
আলোর লাগেজ থেকে একটা শাড়ি বের করে বিছানার উপর রেখে সামিন নিজেও রেডি হয়ে নেয়।
মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশ রুম থেকে বের হতেই আলোর চোখ চলে যায় বিছানার উপরে রাখা শাড়িটার দিকে। মাথা ঘুরিয়ে সামিনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সে। হাতঘড়িটা হাতে পরে নিয়ে সামিন বলে,"ঐ শাড়িটা পরো।"
আলো এগিয়ে গিয়ে শাড়িটা হাতে তুলে নিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"কমলা আমার অপ্রিয় একটি রং।"
_আমারও অপ্রিয়, কিন্তু কমলা রঙের শাড়িতে তুমি আমার প্রিয়।
আলো শাড়ি হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন বলে,"তৈরি হয়ে থাকো। আমি নাফিসা আন্টির কাছে যাচ্ছি কথা বলতে। একটু পর এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।"
সামিন চলে যায় দরজা লক করে। আলো নিজেকে জরিয়ে নেয় কমলা রঙের সিল্কের শাড়ি টাতে। বুকে আঁচল তুলে সে বুঝতে পারলো সামিনের কথা মিথ্যে নয়, এই রংটাতে তাকে মানায়, শ্যামলা ধাঁচের মেয়েদের উচিত এই রঙটা পরে দেখা। নিজেরাই নিজেদের মুগ্ধ হয়ে দেখবে।
ফোনের রিংটোন বেজে উঠলে আলোর ঘোর কেটে যায়। ওটা সামিনের ফোনের রিংটোন। ফোনটা ফেলে রেখে গিয়েছে ওই লোকটা।
রিংটোন বাজতে বাজতে কে'টে যায় প্রথমবার। আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। পরক্ষনেই আবার বেজে ওঠে রিংটোন।
অনেকটা দ্বিধা নিয়ে সে ফোনটা হাতে তুলে দেখতে পায় ইশমামের ফোন। চোখে মুখে অস্বস্তি ছেয়ে যায় তার। ফোনটা রেখে দেয় সে। কিন্তু ইশমাম অনবরত ফোন দিয়েই যাচ্ছে। শেষমেশ আলো সংকোচের সাথে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে ইশমাম বলে ওঠে,"ভাইয়া!"
_আমি।
আলো অস্ফুট স্বরে বলে। ইশমাম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,"ভাইয়া কোথায়?"
_একটু বাইরে গিয়েছেন।
_আসলে বাবার ডে'থ সার্টি*ফিকেটটা দরকার ছিলো। মেজো ভাইয়াকে ফোন দিয়েছিলাম, সে আউট অব দ্যা সিটি, ইশিতা ভার্সিটিতে। আমার জানামতে ভাইয়ার ল্যাপটপে কপি আছে। একটু বলে দেবে ভাইয়াকে? ইটস্ আর্জেন্ট!
_আচ্ছা আসলেই বলবো।
দু'জনেই চুপচাপ হয়ে যায়। ক্ষনবাদে ইশমাম বলে ওঠে,"ওখানে ঘুরতে যাওনি কোথাও?"
_নিয়ে গিয়েছিলেন উনি কাল সেন্তোসা আইল্যান্ড।
_ছবি তোলোনি দুজন?
_না।
_আচ্ছা আজ ছবি তুলবে, ভাইয়াকে বলবে আমাকে পাঠিয়ে দিতে। আমার বন্ধুরা তোমাদের দেখতে চেয়েছে।
আলোর অস্বস্তি হচ্ছে, ফোনটা রাখতেও পারছে না। ইশমাম খুবই আগ্রহ নিয়ে কথা বলছে।
সামিন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে আলো তার ফোন কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"কে ফোন দিয়েছে?"
আলো ফোনটা এগিয়ে দিতে দিতে বলে,"আপনার ভাই।"
_কে ইলহাম?
_না ইশমাম।
ফোনটা নিয়ে সামিন কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে ল্যাপটপ নিয়ে বসে, তারপর তার বাবার ডে*থ সার্টি*ফিকেটের কপি ইশমামকে পাঠিয়ে দেয়।
আলো আমতা আমতা করে বলে,"আপনার পারমিশন না নিয়ে আপনার ফোন ধরেছি, আসলে ও বারবার ফোন দিচ্ছিলো। আপনি কি মাইন্ড করলেন?"
সামিন অবাক হয়ে আলোর দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,"অবশ্যই মাইন্ড করেছি। এতো মাইন্ড করেছি যে আমার তো রাগে তোমাকে চু*মু দিতে ইচ্ছে করছে!"
আলো বুঝতে পেরে যায় সামিন মজা করছে, সে ঘুরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে খোঁপা বেঁধে নেয়।
সামিন উঠে দাঁড়িয়ে আলোর কাছে চলে যায়, পেছন থেকে আলোকে জরিয়ে ধরে আয়নায় আলোর প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। আলোর কাঁধে থুতনি ঠেকাতেই পুরুষালি রুক্ষ গালের স্পর্শে আলো শি*উরে ওঠে, চোখ নামিয়ে নেয়। জানালা দিয়ে রোদ এসে আলোর মুখে পরেছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে চিনামাটির কোনো পুতুল। সামিন মুগ্ধ হয়ে তার স্ত্রীকে দেখতে থাকে। ঘোর লাগা কন্ঠে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
"বধূ কোন আলো লাগলো চোখে,
বুঝি দ্বীপ্তি রূপে ছিলে সূর্যলোকে!"
আলো একপলক সামিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে,"খেতে যাবেন না?"
সামিন আলোকে ছেড়ে দিয়ে বলে,"ভালো কথা মনে করালে, ভুলেই বসেছিলাম। চলো, নাফিসা আন্টিরা ওয়েট করছে , তাদের সাথে লাঞ্চের ইনভিটেশন রয়েছে আমাদের।"
আলো সামিনের পিছু পিছু রুম থেকে বের হয়। দরজা লক করে ঘুরে দাড়িয়ে সামিন আলোকে দেখতে থাকে। আলো সামিনের থেকে চোখ সরিয়ে নিজেকে দেখে, তারপর আবার সামিনকে বলে,"কিছু কি অসুবিধে হয়েছে?"
সামিন ম্লান হাসে, তারপর আলোর আঁচল টেনে ডান কাঁধে তুলে দিয়ে বলে,"এইবার ঠিকাছে!"
***
চামচ নাড়ার টুং টাং আওয়াজ হচ্ছে। আলো প্লেটের খাবারটা নাড়াচাড়া করতে করতে বারবার সবার দিকে তাকাচ্ছে। সামিন নাফিসা কালাম এবং তার হাজবেন্ডের সাথে গল্প করছে।
আলো নাফিসা কালামকে দেখে, ভদ্রমহিলা শার্ট প্যান্ট পরেছেন। গলায় একটা স্কার্ফ পেঁচিয়ে রেখেছে ।
তারা গল্প থামিয়ে তিনজনই আলোর দিকে তাকায়। নাফিসা বলে,"কি ব্যাপার, চুপচাপ যে? বোর হচ্ছো নাকি?"
আলো মাথা নাড়ায়, বিনয়ের সাথে বলে,"না আন্টি। আমি খেতে খেতে কথা বলতে পারি না।"
_খাচ্ছো কই?
সামিনের প্রশ্নে আলো তার দিকে তাকায়। সামিন আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে দৃষ্টি নামিয়ে তার প্লেটে রাখে। তারপর আলোর প্লেটে খাবার সার্ভ করে দিতে দিতে নাফিসার সাথে কথা বলতে থাকে।
আলো নিজের প্লেটের দিকে বিরস মুখে তাকিয়ে আছে। এতো খাবার সে কিভাবে খাবে! সে কি রাক্ষস নাকি!
তারা এসেছে বে সংলগ্ন একটা ফাইভস্টার রেস্টুরেন্টে। কিছুক্ষণের মধ্যে নাফিসা কালামের বেশ কিছু চাইনিজ এবং ইন্ডিয়ান বন্ধু এসে তাদের সাথে অংশ নেয়। নাফিসা কালাম তাদের আলো আর সামিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে,"কোনো অসুবিধা হচ্ছে?"
আলো মাথা নাড়ায়। খেতে খেতে চুপচাপ দেখতে থাকে সামিনকে। যথেষ্ট সামাজিক একজন লোক। যেভাবে বিদেশিদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে কে বলবে এই লোক পেশায় একজন পলি*টিশিয়ান! কেমন ফুরফুরে মেজাজে কথা বলছে সবার সাথে।
"আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?"
দলের থেকে পিছিয়ে পরায় সামিনের দিকে তাকিয়ে আলো প্রশ্ন করে। সামিন বলে,"আর্ট মিউজিয়াম সেখান থেকে আরো বেশ কয়েকটি যায়গা। কেন, অসুবিধে আছে?"
আলো মাথা নাড়ায়। সবাই হাঁটছে জোড়ায় জোড়ায়। স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের কোমর জড়িয়ে হাঁটছে। ওসব দেখে আলোর মুখটা লজ্জায় টকটকে লাল হয়ে যাচ্ছে। তাদের থেকে কয়েক গজ সামনে হাঁটছে নাফিসা কালাম এবং তার হাজবেন্ড। তার হাজবেন্ড তাকে যেভাবে জরিয়ে ধরে হাঁটছে তাতে মনেই হয়না তাদের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। পোশাকে,চাল চলনে খুবই আধুনিক এই জুটি।
হাঁটতে হাঁটতে সামিন আড়চোখে একপলক আলোকে দেখে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে নিজের ডানহাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুল দিয়ে আলোর বা হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুল জরিয়ে রাখে। আলো চ'ম'কে উঠে তাদের হাতের দিকে তাকায়। তারপর ধীরে ধীরে সামিনের চোখের দিকে তাকায়। সামিন সামনের জুটিদের দিকে তাকিয়ে আলোকে বলে,"ওটা সুন্দর।"
তারপর নিজেদের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,"তবে এটা বেশি সুন্দর!।"
আলো চুপ করে হাঁটতে থাকে। আড়চোখে বার বার নিজেদের হাতের দিকে তাকাচ্ছে, মনে মনে বলে ওঠে,"এটা আসলেই সুন্দর, এটা সবথেকে সুন্দর মেয়র সাহেব!"
আর্ট মিউজিয়াম পৌঁছে যে যার বেটার হাফকে নিয়ে আলাদা হয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে সবকিছু।
সামিনের পাশে আলো চুপচাপ হাঁটছে। হঠাৎ একটা স্ট্যাচুর পাশে সামিন দাঁড়িয়ে পরে। আলো মুখ তুলে সামিনের দিকে তাকায়। আলোর দিকে তাকিয়ে সামিন বলে,"এখানে দাঁড়াও।"
_কেন?
_ছবি তুলবো তোমার।
আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন আলোর ছবি তুলতে তুলতে বলে,"ইশিতা পাগল বানিয়ে ফেলেছে তোমার ছবি দেখবে বলে। কই, হাসো!"
আলো মুচকি হাসে। সামিন তখনই আলোকে ক্যামেরা বন্দী করে ফেলে। তারপর সেলফি ক্যামেরা অন করে বলে,"চলো আমরা ছবি তুলি, ইশমাম চেয়েছে আমাদের দুজনের ছবি। ওর বন্ধুরা দেখবে।"
আলোর গোটা মুখে অস্বস্তি ছেয়ে যায়। সামিন আলোর ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুলে নেয়। তারপর বলে ওঠে,"এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি ওকে। ইশমাম তোমাকে খুবই পছন্দ করে। তুমি জানো না, যখন তোমার সাথে আমার শত্রুতা ছিলো তখন ফোন করেই বলতো, ভাইয়া মেয়েটাকে শাস্তি দিওনা, মেয়েটাকে কিছু করো না। "
আলোর অস্বস্তি বাড়ছে,সে প্রসঙ্গ পালটে বলে,"ঐ দিকে নিয়ে যান আমাকে। ঐ দিকটা ঘুরে দেখবো।"
সামিন হেসে আলোর হাত ধরে। তারপর সামনে এগিয়ে যায়।
***
ঘোরাঘুরি শেষ করে সবাই এসেছে শপিং মলে। সামিন আলোকে একপলক দেখে বলে,"যাও। ঘুরে দেখো, কিছু পছন্দ হলে আমাকে বলবে। আচ্ছা থাক, তুমি বরং কার্ড টা নিয়ে যাও।"
আলো অবাক হয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমি কি কিনবো? আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই আর। গতকালই তো কতকিছু শপিং করলেন! "
_বিদেশে মানুষ রোজ রোজ আসে না আলো। যাও দেখো কিছু পছন্দ হয় কিনা, আর নিজের জন্য না হলে বাড়ির সবার জন্য দেখতে থাকো, তোমার আমার উভয়ের শশুর বাড়ির জন্য, খালি হাতে দেশে ফিরলে ইশু আমাকে ছাড়বে না, আর আমার শ্যালক দুটো মনে মনে ভাববে ওদের দুলাভাই কিপ্টে ।"
আলো হাসে,নিচু স্বরে বলে,"ঠিকাছে আপনিও আসুন।"
সামিন আ'ত'ঙ্কি'ত গলায় বলে,"ক্ষেপেছো? মহিলা পার্টির মধ্যে আমি ঢুকবো না!"
আলো ঘাড় ঘুরিয়ে নাফিসাদের দিকে তাকায়, তারা আলোর জন্য দাড়িয়ে আছে। সামিন বলতে থাকে,"ওনাদের সাথে গিয়ে দেখো সবকিছু আমি এখানে বসে কফি খেতে থাকি।"
আলো মাথা নেড়ে ধীরপায়ে চলে যায়। নাফিসা কালাম এবং তার বান্ধবীদের সাথে ঘুরে ফিরে সবকিছু দেখতে থাকে।
একটা লেডিস শপে ঢুকে সবাই পোশাক দেখতে থাকে। এখান থেকে নেওয়ার মতো আলো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না, এমন ধরনের পোশাক তাদের বাড়ির কেউ পরে না, ইশিতা আপু এতো বড়লোক বাড়ির মেয়ে হয়েও এগুলো কখনো পরে না। এখান থেকে কি কিনবে সে! তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নাফিসা কালামের একজন বান্ধবী যার নাম লি শিনতা সে একটা না*ইটি পছন্দ করে নিজের গায়ে রেখে মিররে নিজেকে দেখছে মানাবে কি না। আলোর হঠাৎ খুব হাসি পাচ্ছে, সে কিছুতেই নিজের হাসি চেপে রাখতে পারছে না। লি শিনতা আবার তার অন্য একজন ইন্ডিয়ান বান্ধবী শামা পোদ্দারের দিকে তাকিয়ে বলে,"দেখো তো আমাকে মানাবে কি না?"
শামা পোদ্দার কপাল কুঁ'চ'কে দেখতে থাকে শিনতাকে। আলো হেসে ফেলে। সবাই অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। নাফিসা কালাম বলে,"তুমি হাসছো কেনো? এসো। দেখো এখানে কিছু পছন্দ হয় কিনা!"
আলো হাসি থামিয়ে নিচু স্বরে বলে,"এখানে পছন্দ করার মতো কিছু নেই আন্টি।"
_নেই মানে? এতো ভালো ভালো কালেকশন। এই না*ইটি গুলো দেখো, এখান থেকে একটা নাও।
আলোর কান গরম হয়ে যায়। নাফিসা বলে,"এসব পরো না? বেডরুমেও কি এভাবে চাচী আম্মাদের মতো শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে থাকো? সামিন আপত্তি করে না?"
আলোর যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে এক্ষুনি সে মেঝে ফাক করে ঢুকে যেতো নিচে। কিন্তু তার সেই ক্ষমতা নেই, তাই সে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ!
নাফিসা কালাম এবং তার বান্ধবীরা এগিয়ে আসে আলোর দিকে, নাফিসা জ্ঞান দেওয়ার মতো করে বলতে থাকে,"শা*লীনতা এক জিনিস । তুমি পুরো দুনিয়ার কাছে থাকো শালীন। কে নিষেধ করেছে? তাই বলে হাসবেন্ডের কাছে নিজের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলবে না? বেডরুমে পরবে এসব। আজকালকার ছেলেদের এসব চাচী আম্মাদের মতো লুক মনে ধরে? তোমাকে আসলে গ্রু*মিং করাতে হবে। তুমি বাংলাদেশ ফিরে গিয়ে অবশ্যই অবশ্যই অবশ্যই আমার সাথে যোগাযোগ করবে, আমার বোনঝি আছে। তার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবো।"
আলোর এতো অস্বস্তি হচ্ছে। সে পালাতেও পারছে না। লি শিনতা একটা টকটকে লাল রঙের নাইটি এনে আলোর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,"এটা নাও, আজকে তোমার হাজবেন্ডকে চ'ম'কে দাও!"
আলো হাত থেকে নাইটি টা ফেলে দেয়। লজ্জায় তার মুখ ফ্যা*কাশে হয়ে আছে। নাফিসা হেসে বলে,"ঠিকাছে। পরতে হবে না এসব। অন্তত আঁচল পেঁচিয়ে থেকো না প্লিজ।"
আলোর ডান কাঁধ থেকে নাফিসা শাড়ির আঁচল টেনে নামিয়ে দেয়। শামা পোদ্দার একটা মেরুন রঙের নাইটি এনে বলে,"আলো তুমি এটা ট্রাই করে দেখতে পারো, এটা ম্যাক্সি টাইপ, তোমার টাইপ, শালীন নাইটি হা হা হা।"
আলো আর দাঁড়াতে পারে না, ছুটে ঐ শপটা থেকে বেরিয়ে যায়। নাফিসা তার বান্ধবীদের সাথে হাসতে থাকে।
"এভাবে ছুটছো কেনো?"
সামিন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। আলো থ'মকে যায়। সামিন বলতে থাকে,"মনে হচ্ছে কেউ তাড়া করেছে তোমায়। এভাবে ছুটছো কেনো?"
_এমনি , আলো অস্ফুট স্বরে বলে।
সামিন আলোকে কয়েক পলক দেখে তার দিকে এগিয়ে যায়, এবং আবারও তার আঁচল টেনে ডান কাঁধে উঠিয়ে দেয়। আলো সামিনকে দেখছে। সামিন নিচু স্বরে বলে,"আন্টি আর তার বান্ধবীরা কোথায়?"
আলো আঙুল তুলে ইশারা করে সামিনকে দেখিয়ে দেয়,"ঐ দোকান টাতে।"
_তো তুমি এখানে কেনো? যাও ওখানে! কিছু পছন্দ করো।
আলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন বলে,"আমার যেতেই হবে? আচ্ছা চলো যাচ্ছি।"
সামিন উদ্যত হয়, আলো সামিনের হাত টেনে ধরে বলে,"এই না! ওখানে আপনার যাওয়ার দরকার নেই।"
সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলো আমতা আমতা করে বলে,"চলুন অন্য কোনো শপে ঢুকি!"
"এক্সকিউজ মি!"
ঘুরে দাঁড়ায় সামিন আর আলো। একজন তেইশ-চব্বিশ বছর তরুণী তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সামিন আর আলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটি সামিনকে একটি উড়ন্ত চু*মু দিয়ে বলে,"এটা আপনার জন্য হ্যান্ডসাম।"
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে সামিন আর আলো। বিদেশি মেয়েটি আরো কাছে চলে আসে, মেয়েটির বান্ধবীরা এসে তাদের ঘিরে ধরে। মেয়েটি চেঁচিয়ে বলে,"ইয়েস! আমি জিতে গিয়েছি।"
সামিন ঘাবড়ে গিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে। আলোও তাকায় তার দিকে, চোখ মুখ শক্ত করে ফেলেছে সে।
বিদেশী মেয়েটি সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। এটা ডেয়ার ছিলো, ঐ যে দেখছেন ক্যামেরা হাতে লোকটি! উনি একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর এবং ব্লগার। শপিং মলে সবাইকে কিছু না কিছু টাস্ক দিচ্ছে, জিততে পারলে ১০ ডলারের একটি শপিং কার্ড পেয়ে যাবো। আমার টাস্ক ছিলো এখানের সবথেকে সুদর্শন কোনো পুরুষকে তার স্ত্রীর সামনে ফ্লাইং কি*স দেওয়া। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড!"
সামিন কি বলবে কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছে না। সে মনে মনে প্রার্থনা করছে আলো যাতে চুপ থাকে। কিন্তু তার প্রার্থনা কেউ শোনে না। আলো চেঁচিয়ে বাংলায় বলে ওঠে,"চুলের মুঠি ধরে একটা চট*কনা মারবো শাকচুন্নীর দল।"
সামিন চোখ বড় বড় করে আলোর দিকে তাকায়। বিদেশী মেয়েটি কৌতুহলী হয়ে আলোর দিকে তাকায়। তারপর সামিনকে বলে,"কি বলছে আপনার স্ত্রী? সে কি রা*গ করেছে?"
_না , আমার স্ত্রী বলছে ইটস ওকে। আমরা কিছুই মনে করিনি। আপনারা যান।
মেয়েটি কৃতজ্ঞ চোখে আলোর দিকে তাকায়,বিনয়ে মাথা নুইয়ে বলে,"থ্যাংক ইউ ম্যাম। থ্যাংক ইউ সো মাচ!"
কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এগিয়ে এসে বিদেশি মেয়েটির হাতে তার পুরস্কার তুলে দেয়। সামিন দাঁড়িয়ে আছে বোকার মত,আলো দাঁড়িয়ে আছে কঠিন হয়ে।
কন্টেন্ট ক্রিয়েটর সামিনদের দিকে তাকিয়ে মুখ ভর্তি প্রশ্বস্ত হাসি দিয়ে বলে,"হ্যালো! আমার ইউ টিউব চ্যানেলের নাম বেস্ট এভার সিঙ্গাপুর। আপনারা কি আমার সাথে একটি খেলা খেলতে চান? জিতলে আপনাদের জন্য থাকছে একটি ১০ ডলারের শপিং কার্ড আর........"
আলোর ইচ্ছে করছে ঐ উ*ল্লুক টার মাথাটা দেওয়ালে ঠেকিয়ে দিতে। নিজেকে সংযত করে উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে। সামিন তার পিছু পিছু চলে যায়।
ব্লগার পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"ম্যাম আপনাদের খুব সোজা টাস্ক দেবো,ঘাবড়াবেন না দাঁড়ান।"
আলো চোখ মুখ অন্ধকার করে হাঁটছে । সামিন আড়চোখে আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে নরম গলায় বলে,"আলো......"
_এটা ফরেইন কান্ট্রি। এখানে এগুলো স্বাভাবিক। জানি, নতুন কিছু বলুন।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় আলো। সামিন বলতে থাকে,"আমার সাথে খচ*খচ কেনো করছো? আমি কি মেয়েটিকে বলেছি এসো এসো আমাকে উড়ন্ত চু*মু দিয়ে যাও?"
_কোনো রিয়াক্ট কেনো করলেন না? আমি করলাম,সেটাও ছাপিয়ে গেলেন। খুব সুখ সুখ লেগেছে তাইনা? বজ্জাত পুরুষ লোক!
সামিন থতমত খেয়ে বলে,"আলো এভাবে কেনো বলছো? অনেক বার মাফ চেয়েছে তো! এখন কি আমি থানা পুলিশ করবো?"
আলো কোনো উত্তর দেয়না, হাঁটতে থাকে। সামিন বলে," ঠিকাছে ঐ মেয়েটার চু*মুটা ওকে ফেরত দিয়ে আসছি দাঁড়াও।"
সামিন ঘুরে উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে। আলো পেছন থেকে সামিনের হাত টেনে ধরে।
সামিন নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,"ঐ মেয়েটার মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে আসছি চু*মু টা। কতবড় সাহস আলো রানীর স্বামীকে উড়ন্ত চু*মু দেয়!"
আলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে,সামিন আলোর হাত মুঠি করে ধরে বলে,"রিয়াক্ট কেনো করলাম না তার জন্য যা শাস্তি দেবে সব মাথা পেতে নেবো, এখন চলো এখান থেকে, ঐ যে দেখো আরো দুজন ব্লগার। পালাও!"
আলো হেসে ফেলে। সামিন আলোকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। আলো অস্ফুট স্বরে বলে,"চলুন।"
দু'জনে পাশাপাশি হাঁটছে, নীরবতা ভেঙে সামিন বলে,"আমি ভেবেছি বাংলাদেশেরই অলিতে গলিতে ব্লগার। সেদিন দেখলাম একজন ব্লগার একটা ছেলেকে টাস্ক দিচ্ছে, ভিড়ের মধ্যে থেকে সাদিয়া নামের কাউকে খুঁজে বের করে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে হবে, তাহলেই পাঁচশ টাকা, এক রিকশা ওয়ালা মামাকে টাস্ক দিচ্ছে তার স্ত্রীকে ফোন করে বলতে হবে সে দ্বিতীয় বিবাহ করেছে, তাহলেই পাঁচশ টাকা!
এখানে এসে দেখছি বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। এখানে পরপুরুষ কে চু*মু দেবার টাস্ক দেওয়া হয়।"
আলো হেসে ফেলে, তারপর বলে,"ঠিকাছে। চলুন, আন্টিদের বলে হোটেলে ফিরি। এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার।"
রাতের ডিনার শেষ করে তারা একটি ক্যাব নিয়ে নেয়। হোটেলের কিছুটা দূরেই ক্যাব থেকে নেমে দু'জনে হাঁটতে থাকে। চমৎকার একটা মুহূর্ত। সামিন কিছুসময় যেতেই ধীরে ধীরে আলোর একটা হাত ধরে। আলো মাথা নিচু করে মুচকি হাসে। সামিন আশেপাশে তাকিয়ে বলে,"ক্যাব থেকে নেমে পরা উচিত হয়নি আলো!"
_কেন? আপনিই তো বললেন হাঁটতে চান।
_হ্যা চেয়েছি, কিন্তু এখন বৃষ্টিতে ভিজতে হবে!
কথাটা বলে সামিন শেষ করতে পারে না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরতে শুরু করে। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে তার আঁচল টেনে মাথায় তুলে দিয়ে বলে,"চলো। দ্রুত।"
দু'জনে এক ছুটে হোটেলের লবিতে পৌঁছে হাঁপাতে থাকে। ততক্ষণে বৃষ্টি তাদের অনেকটাই ভিজিয়ে দিয়েছে। রুমে ঢুকে আলো তোয়ালে বের করে নিজের মাথা মুছে নিতে থাকে। সামিনের ফোনে তখন ফোন আসে এনজির ক্লিনিক থেকে। ফোনটা রিসিভ করে কথা বলতে থাকে সামিন। আলো তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে থাকে সামিনকে তোয়ালে টা দেবে বলে। ক্লিনিকে কথা বলে ফোন কে*টে দিতেই রাহাতের ফোন আসে। সামিন পুনরায় কথা বলায় ব্যাস্ত হয়ে পরে। আলো তোয়ালে টা দিতে গিয়েও দেয়না। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আলো জড়তা কাটিয়ে নিজেই সামিনের মাথা মুছে দিতে থাকে।
সামিন ফোন কে*টে অবাক হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। দু'জনের চোখাচোখি হতেই আলো চোখ সরিয়ে নেয়। সামিন অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"বাবা! কেয়ারিং ওয়াইফ!"
আলো লজ্জা পেয়ে যায়। সামিন আলোর হাত ধরে তোয়ালে টা নিয়ে নেয়। আলোকে কাছে টেনে আলোর হাতে চুমু খেয়ে বলে,"তখন শপিং মলে শুধু শুধু আমার ওপর ক্ষে*পেছিলে কেন?"
_আমি ঐ মেয়েটিকে বকা দিতে চাইলাম, আপনি আমাকে থামিয়ে দিলেন কেন?
_বকা দেওয়ার অনেক ধরন থাকে। তুমি আরো ভালোভাবে বুঝিয়ে বললেই হতো।
আলো কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,"ওখানে আজ যদি ঐ মেয়েটা না হয়ে কোনো ছেলে হতো, আর আমাকে উড়ন্ত চু*মু দিয়ে যেতো তাহলে আপনিও আমার মতো রিয়াক্ট করতেন।"
_না, করতাম না।
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন।
আলো অবাক হয়ে বলে,"করতেন না?"
সামিন আলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে,"রিয়াক্ট কেনো করতাম? আমিতো ছেলেটাকে পুঁ*তে ফেলতাম।"
আলো চ'ম'কে ওঠে। সামিন বাঁকা হাসি হাসে। পরক্ষনেই আলোকে ক্ষে*পানোর জন্য বলে,"কি হয়েছে মেয়েটা আমাকে একটা উড়ন্ত চু*মু দিয়েছে তাতে? তুমি তো কখনো দেবে না, অন্য কেউ দিলেও এতো সমস্যা হচ্ছে কেন? আমি তো ভাবছি সিঙ্গাপুর যে কটা দিন আছি প্রতিদিন একবার করে ঐ মলে যাবো। এই ব্লগার গুলো আমাদের মতো অসহায় পুরুষদের কপাল খুলে দিচ্ছে!"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,"শুধরে যাও মেয়ে। নয়তো সত্যিই যাবো কিন্তু।"
লজ্জায় আলো মাথা নিচু করে রাখে, কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ওয়াশ রুমে ঢোকে। সামিন একা একা হাসতে থাকে,এই মেয়েটা যতটা চঞ্চল,তেজী, ঠিক ততটাই লাজুক। বাড়াবাড়ি পর্যায়ের লাজুক!
***
আলো কপাল কুঁচকে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। একজন সিস্টার তার চুলে বেনী করে দিচ্ছে। সামিন কেবিনের ভেতরে অন্য একজন সিস্টারের সাথে কথা বলছে। হেসে হেসে কথা বলছে। সিস্টার অল্পবয়সী এবং সুন্দরী।
আলো চোখ মুখ কঠিন করে তাকিয়ে আছে সেদিকে। এতো কথা বলছে কেন ঐ সিস্টারের সাথে!
সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলোর দৃষ্টি দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বাংলায় বলে,"কি হয়েছে?"
_কি বলছেন ওর সাথে? এতো রসিয়ে রসিয়ে কি বলছেন?
সামিন অবাক হয়ে যায় আলোর কথা শুনে, তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,"তোমাকে সা*র্জারির পরে পাঁচদিন এখানে থাকতে হবে, তাই ঐ সিস্টারের নাম্বার নিচ্ছিলাম। আমি হোটেলে ফিরে একা একা কি করবো? ওকে ফোন করে কথা বলবো। সেও ইন্টারেস্টেড....."
আর কিছু বলতে পারে না সামিন, তৎক্ষণাৎ আলো বেডের কুশন উঠিয়ে সামিনের মুখের উপর ছুড়ে মারে।
কেবিনের মধ্যে থাকা সিস্টার দুজন হতভম্ব হয়ে যায়। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো এদিক ওদিক তাকিয়ে আরেকটা কুশন উঠিয়ে সামিনের গায়ে ছুড়ে মারে। সামিন নার্স দুজনকে চোখ দিয়ে ইশারা করতেই তারা চলে যায়। তারপর সে আলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বসে, আলো মুখ ভার করে রেখেছে। সামিন আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,"ভুলেই গিয়েছিলাম তোমার মাথার স্ক্রু যখন তখন খুলে পরে যায়, রেঞ্জটাকে সাথে করে নিয়ে আসা উচিৎ ছিলো।"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলে,"তোমার সা'র্জারির ব্যাপারেই টুকটাক ইনফরমেশন জেনে নিচ্ছিলাম।"
_এতো হেসে হেসে জিজ্ঞেস করছিলেন কেন?
_কারন আমার কান্না আসছিলো না তাই।
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন।
আলো তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। সামিন হুট করে আলোর কপালে একটা চু*মু দিয়ে দেয়। তারপর গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলে,"ভয় হচ্ছে?"
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,"এটা খুবই সাধারন একটা সা*র্জারি। কোনো রিস্ক নেই। থাকো তুমি। আমি বাইরেই আছি।"
সামিন চলে যেতে নিলে আলো সামিনের হাত টেনে ধরে। সামিন ঘুরে তাকায় আলোর দিকে। আলো মৃদু স্বরে বলে,"ধন্যবাদ। ধন্যবাদ সবকিছুর জন্য!"
সামিন তাকিয়ে আছে। আলো আশেপাশে তাকিয়ে লাজুক মুখটা নিচু করে রেখে সামিনের ডানহাতের পিঠে কাঁচ ঢুকে যাওয়া ক্ষ*তর দাগটার উপরে চু*মু খায়। তারপর নিচু স্বরে বলে,"আমি এতো টাও অকৃতজ্ঞ নই মেয়র সাহেব!"
আলো মাথা নিচু করে রেখেছে। সে জানেনা আর কিভাবে,কতটা আন্তরিক ভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয়। নিজের সমস্ত লাজুকতা ঠেলে সরিয়ে রেখে স্বামীর হাতে চু*মু খেয়েছে হ্যাংলার মতো। চু*মু খেয়ে ধন্যবাদ জানানো! এটা তো ঐ মেয়র সাহেবের কাছ থেকেই শিখেছে সে।
সাহস করে চু*মু টা তো খেলো। কিন্তু ঐ পুরুষটির চোখে চোখ রাখার সাহস তার নেই।
সামিন অবাক হয়ে আলোর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর নিজের ডান হাতের পিঠে তাকায়। তার চোখে মুখে বিস্ময়।
আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। মনে মনে চেঁচিয়ে বলছে,"পেয়েছেন তো ধন্যবাদ? এবার যান, যান এখান থেকে মেয়র সাহেব।"
সামিন যেন লাজুক লতা আছিয়ার মনে মনে দেওয়া ধমক শুনতে পেলো। ধীরপায়ে হেটে সে কেবিন থেকে বের হয়। আলোকে নিয়ে যাওয়া হয় সা*র্জারি রুমে। সামিন ডান হাতটাকে উঁচু করে ধরে পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে বোকার মতো,ঐ পা*ষণ্ডী আছিয়ার থেকে এতোটাও আশা করেনি সে।
"কি দেখছো হাতে সামিন? হাতে কি হয়েছে?"
নাফিসার ডাকে সামিনের ঘোর কাটে। নাফিসা তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"না আন্টি, কিছু না।"
ওয়েটিং রুমে বসে আছে সবাই।
বৌয়ের থেকে প্রথম চু*মু পেয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জা।
***
"কি করছো!"
পেছন থেকে রিতুকে জরিয়ে ধরে ইলহাম বলে ওঠে। রিতু নিচু গলায় বলে,"ভাবীর সা*র্জারি হলো কিনা জানতে ফোন দিয়েছি ভাইয়ার কাছে। ভাইয়া ফোনটা ধরছে না।"
_কথা হয়েছে আমার। সা*র্জারি হয়েছে।
রিতু ইলহামের দিকে তাকায়। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"জানেন ভাইয়া আর ভাবীকে একসাথে দেখতে কত যে ভালো লাগে আমার! হৃদয়টা প্রশান্তিতে ভরে যায়। যখন ভাবী ভাইয়াকে ছেড়ে চলে গেছিলো তখন ভাইয়ার উদাস মুখটা দেখে খুব কষ্ট পেতাম। ভাইয়া ভাবীকে খুব ভালোবাসে। আগে জানতাম পুরুষ মানুষ ভালোবাসতেই জানে না। কিন্তু ভাইয়াকে দেখে ধারণা বদলে গেলো, পুরুষের ভালোবাসা ভ*য়ানক সুন্দর। ভাইয়া ভাবীকে যতটা ভালোবাসে ভাবী কখনোই অমন করে ভালো বাসতে পারবে না ভাইয়াকে।"
রিতুর কথা শুনে ইলহাম তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঐ সুন্দর, মায়াবী দুটি চোখের দিকে তাকালেই ইলহামের মনের মধ্যে তীব্র অনুশোচনা হয়। নিজের নিন্দিত দিন গুলোর কথা সে নিজেই ভুলতে পারে না। এই মেয়েটা কত সহজে ভুলে গিয়েছে। অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে ঘুম থেকে তুলে অত্যা*চার, রিতুকে দেখিয়ে দেখিয়ে অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলা , রিতুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে মিলিত হওয়া, কথায় কথায় অপমান করা, বাপ তুলে গালি দেওয়া, ভোগ*বস্তুর মতো ব্যাবহার করা। এতো জ'ঘ'ন্য দিনগুলোর কথা কিভাবে মেয়েটি ভুলতে পেরেছে! নাকি কখনো ভোলেনি!
রিতু ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,"কি হলো? কি ভাবছেন?"
ইলহাম মাথা নাড়ায়। রিতুকে টে'নে নিজের কাছে নিয়ে কানের লতিতে চু"মু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,"পুরুষ ভালোবাসতে পারে কিনা জানিনা, তবে আমি জানি নারীর ভালোবাসা সুন্দর, ভ*য়ানক সুন্দর। আমার কাছে এমন একটি নারী আছে, আমি পেয়েছি। যার ভালোবাসার তল খুঁজে বের করা আমার মতো পুরুষের সাধ্য নয়।"
***
"তোমার ভাই এবং ভাবীকে ভীষণ সুন্দর লাগছে ইশমাম। এদের দেখে মনে হচ্ছে মেইড ফর ইচ আদার!"
শার্লিনের কথায় ইশমাম ম্লান হাসে। ইশমামের ফোনে তার সব বন্ধুরা আলো আর সামিনের ছবিটা দেখছে। ইশমামের মুখে সবাই এতো শুনেছে সামিনের কথা তাই তার বৌ দেখতে সবাই খুবই আগ্রহী।
ক্যান্টিন আপাতত ফাঁকা। তারা বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে। এ্যালেক্স ছবি দেখায় কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না,সে শীতল চোখে তার বেস্টফ্রেন্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশমাম ঠান্ডা গলায় বলে,"তুমি এভাবে কি দেখছো এ্যালেক্স? "
এ্যালেক্স একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"মারিয়া তোমাকে ডেটের অফার দিয়েছে। তুমি রাজি কেনো হচ্ছো না? সে তোমাকে খুবই পছন্দ করে, ডেটে তো যেতেই পারো!"
_আমি ইন্টারেস্টেড নই এ্যালেক্স।
_তাহলে কিসে ইন্টারেস্টেড তুমি? এভাবে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোয়? কেনো ঝেরে ফেলছো না মেয়েটাকে নিজের মন আর মস্তিষ্ক থেকে।
_শাট আপ এ্যালেক্স! এমন কিছুই নেই। এমনটা ভাবাও আমাদের ধর্মে গর্হিত পাপ। সে আমার ভাবী। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। ভাইয়া তাকে কতটা ভালোবাসে জানো? তাদের একসাথে দেখতেই আমার শান্তি।
_ওকে তাহলে অন্য মেয়েদের সাথে ডেটে যেতে কি সমস্যা?
ইশমাম নিচু স্বরে বলে,"হবে না। হবে না আমার দ্বারা। সম্ভবত কখনোই হবে না।"
***
"এই আছিয়া! গল্প শুনবে?"
আলো পিট পিট করে তাকাচ্ছে। চোখের পাতা মেলে রাখতে পারে না কয়েক মুহূর্তের বেশি। সামনে ক'জন মেয়র সাহেব? দুজন নাকি তিনজন? এতো গুলো মেয়র সাহেব দিয়ে সে কি করবে! একটা মেয়র সাহেবই জীবনটা তেজপাতা করে দিলো! এতগুলো সে সামাল দেবে কিভাবে!
সামিন ঝুঁকে আলোকে দেখছে, নিচু স্বরে বলে ওঠে,"তুমি হাসছো কেনো? মাথা কি পুরোপুরি ন*ষ্ট হয়ে গিয়েছে?"
আলো ম্লান হেসে বলে,"দেখছিলাম আমার সামনে তিনজন মেয়র সাহেব। আর দুজন কোথায় গেলো!"
সামিন একটা চেয়ার টেনে বসে। আলো ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,"ভ*য় পেয়েছিলে?"
_নাহ।
মৃদুস্বরে বলে ওঠে আলো। পরপর বলে,"আপনি কিভাবে ঢুকলেন? চব্বিশ ঘন্টার আগে তো কেউ ঢুকতে পারবে না।"
_চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে পঁচিশ ঘন্টা হতে চলেছে মহারানী।
আলো অবাক হয়ে যায়। সামিন বলতে থাকে,"কোথাও কোন অসুবিধে হচ্ছে?"
আলো মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,"ঐ দাগগুলো আর দেখতে পাবো না তো?"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকটা উ*ৎকণ্ঠা মেয়েটার কন্ঠে, বেশ ভুগিয়েছে ক্ষ*তর দাগগুলো। সামিন আলোর একটা হাত ধরে বলে,"কিছুটা থেকে যাবে! তারজন্য নেক্সট ইয়ার আরো একবার আসবো ভাবছি। তবে যেটুকু পুনর্গঠন হয়েছে তাতে যেসব টিস্যু শক্ত হয়ে গিয়েছিলো তার স্বাভাবিক সঞ্চালন হবে।"
আলো চুপ করে থাকে, তারপর বলে ওঠে,"ঐ নার্সটার সাথে কথা হয়েছিলো? খুব সুন্দর করে কথা বলে তাইনা? আমার মতো গালি*গালাজ করে না!"
সামিন হেসে ফেলে। তারপর বলে,"স্ত্রী হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে স্বামীকে কথায় কথায় সন্দেহ করা। তুমি আমার উপযুক্ত স্ত্রী হতে পারবে আছিয়া। বুঝতে পেরেছি আমি।"
আলো ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। তারপর বলে ওঠে,"কি বলুন তো! পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস নেই। এরা কখন পল্টি খাবে এরা নিজেরাও আগে ভাগে জানে না। কার প্রতি কখন মন উঠে যায়, কাকে মনে ধরে যায় তা বলতে পারে না এরা! তাই এদের সন্দেহের উপর রাখলে এরা চাপে থাকে।"
সামিন মৃদু হেসে আলোর নাক টিপে দেয়। তারপর নরম গলায় বলে,"পল্টি খাওয়া? সেটা কি জানি না তো আছিয়া। আমি সেই যে একটা মায়াবী নারীতে আটকে গিয়েছি এখন আমার নিজেকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তুমি আমার এমন হাল না করলেও পারতে!"
আলো নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। সামিন বলতে থাকে,"কলেজের প্রোগ্রামের সেই দিনটার কথা মনে আছে? আমার বুকে সেইফটি পিন ফু*টিয়ে দিয়েছিলে তুমি দস্যি মেয়ে!"
আলো ম্লান হাসে। সামিন বলতে থাকে,"আচ্ছা আমাদের বাচ্চারা যখন আমাদের বিয়ের গল্প জানতে চাইবে তখন নিশ্চয়ই এটা বলা যাবে না যে আমি তাদের মাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছি। আমার ইমেজ ন*ষ্ট হয়ে যাবে বাচ্চাদের কাছে।"
_তাহলে বলে দেবেন আমাদের পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিলো। আপনার বাড়ি থেকে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল ঘটক আমাদের বাড়িতে। আপনি আপনার চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে গিয়ে আমাকে দেখেছেন। আপনাদের বাড়ির মেয়েরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার চুল লম্বা কিনা দেখেছে, আমার নখ কেমন দেখেছে, আমি ট্যা*রা কিনা দেখেছে। এসব বানিয়ে কিছু একটা বলে দেবেন।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।
_না না,সেটা কিভাবে হয়, পারিবারিক ভাবে বিয়ে! বাচ্চারা শুনলে ব্যাকডেটেড ভাববে।
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেসে ফেলে। তারপর অপলক সামিনকে দেখতে থাকে। বাচ্চাদের কাছে কি জবাব দেবে ভেবে লোকটা কি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পরে গিয়েছে! কি অদ্ভুত একটা লোক। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,"তাহলে মিথ্যা প্রেমের কাহিনী বলবেন।"
_সেটা ঠিক বলেছো! বলবো, তোমাকে প্রথম দেখায় আমি প্রেমে পরে গিয়েছি। কি ভীষণ মিষ্টি যে ছিলে তুমি। দিন রাত তোমাকে নিয়ে ভাবতাম, তারপর আমি একদিন তোমাকে অনেক ভদ্রভাবে প্রেমের প্রস্তাব দেই। আর তুমিও রাজি হয়ে যাও সাথে সাথে.....!
এই পর্যন্ত বলে সামিন থামে, তারপর বলতে থাকে,"আমি আর বানাতে পারছি না গল্প। তুমি একটু হেল্প করো।"
আলো হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসছে। হাত সরিয়ে জবাব দেয়,"তাড়াহুড়ো করতে হবে না। ধীরে সুস্থে বানান গল্প। আমাদের বাচ্চা নেই।"
_এখন নেই,হতে কতক্ষন?
স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে সামিন।
আলোর গাল লাল হয়ে যায় লজ্জায়। মুখ ঘুরিয়ে সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটা ভীষণ বাড়াবাড়ি করে। মুখে লাগাম নেই এই লোকটার!
***
মাত্র সাতদিন দিন হয়েছে আলো ক্লিনিকে ছিলো, দুই দফায় সা*র্জারি হয়েছে। অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে কতবছর ধরে সে ঐ মেডিসিন দেয়া কেবিনটাতে ছিলো। মনটা পুরো বি*ষিয়ে উঠেছিল।
হোটেলের এই ঘরটা কিছুটা শান্তিনীড়ের ঘরটার মতো, একটা হোম সুইট হোম ফিল পাওয়া যায়। বিছানায় বসে আলো একটা লম্বা শ্বাস নেয়। সামিন আলোর ব্যাগপত্র যায়গামতো রেখে তার দিকে ঘুরে তাকায়। আলো দৃষ্টি জানালার বাইরে দিয়ে রেখেছে। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। সেদিন রাতের পর থেকে অনবরত খুব বৃষ্টি হচ্ছে সিটিতে।
সামিন আলোর কাছে এগিয়ে যায়। আলো ঘুরে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"বৃষ্টি থামছে না কেনো!"
_তা তো আমি জানি না।
আলো আবারও মাথা ঘুরিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকে। তারপর বলে,"এখানে আর কতদিন থাকতে হবে? আমার আর ভালো লাগছে না।"
_অনেকের ক্ষেত্রে একাধিকবার সা*র্জারির প্রয়োজন পরে, যাদের মুখমণ্ডল পু*ড়ে যায়, তোমার হয়নি, আমরা খুব শিগগিরই ফিরবো। দুই একদিনে।
আলো চুপ করে থাকে।
সামিন বলে,"কফি খাবে?"
_আপনি বানিয়ে খাওয়ালে খাবো।
আলো লাজুক হাসি হেসে বলে।
সামিন কফি বানাতে বানাতে বলে,"খুব অলসতা ঢুকেছে শরীরে তাই না? বাংলাদেশ নিয়ে গিয়ে সব বের করে দেবো। সকাল থেকে রাত শুধু সংসারের কাজ করবে তুমি। প্রথম থেকে যত ফাঁকি দিয়েছো, সবকিছু ওভার টাইম করে পুষিয়ে দেবে।"
আলো হেসে সামিনের দিকে তাকায়, মৃদু স্বরে বলে,"এ কদিন আপনি খাওয়া দাওয়া ঠিকভাবে করেননি।"
সামিন কিছু না বলে কফি বানাতে মনযোগী হয়ে ওঠে। আলো উঠে দাঁড়ায়। রুম টা পুরো অগোছালো হয়ে আছে। বিছানার ওপরে কিছু শপিং ব্যাগ। সেগুলো হাতে তুলে নিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"এসব কি? আবার শপিং!"
_আমি করিনি। সেদিন নাফিসা আন্টিকে যে গিফট দিয়েছিলে তার জন্য রি*টার্ন গিফট পাঠিয়েছে।
আলো কৌতুহলী হয়ে শপিং ব্যাগ থেকে গিফট টা বের করে। সামিন দুহাতে দুটো কফির মগ নিয়ে এগিয়ে আসে।
গিফট দেখে আলো রানীর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো। সামিন হতভম্ব হয়ে আলোর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো লজ্জায় নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছে না, নড়াচড়া তো দূরের কথা!
হাত থেকে নাইটিটা পুনরায় শপিং ব্যাগে ভরে চুপচাপ বিছানায় রেখে দেয় আলো। সামিন বিরবির করে বলে,"এসব আমি কিনিনি বিশ্বাস করো।"
আলো চুপ করে নিজের একটা শাড়ি বের করে ওয়াশ রুমে ঢোকে। সামিন নিজের হাতের কফির মগ দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ বোকার মতো। তারপর চেঁচিয়ে ওঠে,"কফিটা খেয়ে তারপর লজ্জা পেতে!"
***
দীর্ঘসময় ধরে আলো শাওয়ার নিয়ে তারপর ওয়াশ রুম থেকে বের হয়। সামিন বিছানা থেকে শপিং ব্যাগগুলো সরিয়ে রেখেছে। কফির মগ দুটো টেবিলের ওপর রাখা।
বিছানা ঠিকঠাক করে সামিন জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখে, বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে।
ঘাড় ঘুরিয়ে আলোকে দেখে সে থমকে যায়। হালকা গোলাপী রঙের শাড়িতে, ভেজা চুলের লাজুক মুখটা বড্ড টানছে সামিন কে।
আলো একপলক কফির মগের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় সামিনকে বলে,"নতুন করে বানিয়ে দেই?"
সামিন কোনো কথা বলে না। চুপচাপ আলোকে দেখছে। বাইরে বি*দ্যুৎ চ*মকাচ্ছে। সামিন বিরস মুখে সেদিকে তাকায়। কি সুন্দর, ভ'য়ং'ক'র রোমান্টিক আবহাওয়া। এটা হচ্ছে বৌকে বুকে জরিয়ে নিয়ে ঘুমোনোর আবহাওয়া। কিন্তু তাতে তার কি, ঐ মেয়েটা তো ভুল করে তার বুকে আসে, স*জ্ঞানে নয়।
আলো ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি ফুটতে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ সামিনের মাথায় একটা দু*ষ্ট বুদ্ধি খেলে যায়। আজ ঐ আছিয়া তাকে আবারও জরিয়ে ধরবে! কিছুক্ষণ ঠোঁট টিপে হেসে নিয়ে বেশ শব্দ করে বলে ওঠে,"তেলাপোকা।"
আলো ঘুরে তাকায় সামিনের দিকে। সামিন ভাবলো, হয়তো এক্ষুনি আছিয়া এসে তার বুকে হু*মরি খেয়ে পরবে। কিন্তু সে গুড়েবালি । আলো পা থেকে ঘরে পরার চপ্পল খুলে হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,"কোথায় তেলাপোকা?"
সামিন আলোর দিকে বিরসমুখে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,"কোথায় তেলাপোকা?"
কয়েক মূহুর্ত চুপ থেকে সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"স্ত্রী হবার দ্বিতীয় শর্ত হলো তেলাপোকার কথা শুনলে ছুটে এসে স্বামীকে জরিয়ে ধরতে হয়, হাতে চপ্পল তুলে নিতে হয়না।"
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সবটা বুঝতে পেরে হাত থেকে চপ্পল ফেলে দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। মনে মনে বলতে থাকে,"ওভাবেই মাথা নিচু করে রাখো আছিয়া। আমার দিকে ভুল করেও তাকাবে না। আমি ভ'য়ং'ক'র কিছু করে ফেলবো তবে, কোনো পবিত্র অ'প'রা'ধ! "
আলো যেন সামিনের ব্যাকুলতা শুনতে পেলো, সে চোখ তুলে তাকায় না সামিনের দিকে। আলোর অনেকটা কাছে গিয়ে সামিন ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,"ভয় হচ্ছে? ভয় পাওয়ার কিছু নেই আছিয়া, আমাদের বাসর হবে বাংলাদেশে, আমার নিজের ঘরে, এই সিঙ্গাপুরে নয়। সবকিছু সাজিয়ে হবে আমাদের বাসর। আমার ঘরটাকে সাজিয়ে এবং আমার বৌটাকেও।"
আলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের শাড়ির আঁচল চেপে ধরে রেখেছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছটফটে এই পুরুষটি তাকে কথা শুনিয়ে লজ্জা দিয়ে মে*রে ফেলবার পরিকল্পনা করছে সম্ভবত।
সামিন আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"উহু, চোখ নামিয়ে রাখো। চোখ তুলে তাকাবে না আজ।"
আলো চোখ নামিয়ে রাখে। সামিন কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,"একটা গান শুনবে?"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন ফিসফিসিয়ে গাইতে শুরু করে,
"ওগো, তোমার আকাশ দুটি চোখে, আমি হয়ে গেছি তারা,
এই জীবন ছিলো, নদীর মতো গতি হারা।"
আলো আবারও সামিনকে থামিয়ে দিয়ে নিচু স্বরে বলে,"খুব বাজে গান করেন আপনি।"
সামিন হেসে ফেলে। চুপচাপ আলোকে কিছুক্ষণ দেখে ইলেকট্রিক কেটলির সুইচ অফ করে রাখে। তারপর মৃদু স্বরে আলোকে বলে,"কফি খেতে হবে না। চুপচাপ নিজের বিছানায় গিয়ে চাদর টেনে শুয়ে পরো। ভুল করেও আমার দিকে তাকাবে না। একদমই না।"
আলো বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে ওপাশ ফিরে,গায়ে চাদর টেনে।
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সামিন বিরক্ত ভঙ্গিতে জানালার দিকে তাকায়,এই বৃষ্টি শেষ হচ্ছে না কেনো! অদ্ভুত।
***
"ঐ মেয়েটা আপনার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো?"
সামিন ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে আলোর দিকে তাকায়। কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,"স্ত্রী হবার তৃতীয় শর্ত হচ্ছে বোকা বোকা কথা বলে স্বামীর মাথার খু*লি গরম করে দেয়া। যেটা তুমি খুব ভালোভাবে করতে জানো। ঐ মেয়েটা আমার দিকে কেনো তাকিয়ে আছে কেনো তা আমি কি করে জানবো? ওকে জিজ্ঞেস করো।"
আলো মুখ ভার করে ফেলে। সামিন ম্যাগাজিন রেখে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"কি হয়েছে? সমস্যা কোথায়? মুখ ভার করে ফেললে কেনো?"
আলো ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,"স্ত্রী হবার চতুর্থ শর্ত হচ্ছে স্বামী ধ*মক দিয়ে কথা বললেই তার সাথে আর কথা না বলা, যেটা আমি অনেক ভালো করে করতে পারি। দেখবেন?"
সামিন হেসে ফেলে। আলোর হাত মুঠি করে ধরে বলে,"না দেখতে চাই না। মাফ করুন। আচ্ছা বলছি, ঐ মেয়েটা আমার দিকে ওভাবে কেনো তাকিয়ে আছে, আসলে ও আমার প্রাক্তন। তাই আমাকে দেখে ওর পুরনো দিনের কথা সব মনে পরে গিয়েছে।"
আলো সামিনের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন হাসতে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"স্ত্রী হবার পঞ্চম শর্ত হচ্ছে স্বামী যখন চুপ করে থাকতে বলবে, স্ত্রী তখন চুপ করে থাকবে। এখন তুমিও চুপ করে থাকো। প্লেনে ওঠার পর থেকে আজগুবি সব প্রশ্ন করেই যাচ্ছো। এখন থামো, আমরা একটু পরে বাংলাদেশ পৌঁছে যাবো।
***
ঘরে ঢুকে আলো চারদিক ভালো করে দেখতে থাকে। ঘরটাকে আজ অন্যরকম লাগছে। নতুন রং করানো হয়েছে, আসবাবপত্র এদিক সেদিক করা হয়েছে।
ইশিতা পেছন থেকে বলে,"দেখছো কি ভাবী! "
আলো মাথা ঘুরিয়ে বলে,"ঘরটা এমন রং করা হয়েছে কেন? আগের রং টা তো একেবারে নতুন ছিলো।"
_কি জানি! ভাইয়া ফোন করে মেজো ভাইয়াকে বলেছে ঘরটা রং করিয়ে রাখতে।
আলো অবাক হয়ে সবকিছু দেখতে থাকে, আগের থেকে বেশ ভালো লাগছে ঘরটা।
নিজের জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে ইশিতাকে বলে,"তোমার গিফট পছন্দ হয়েছে?"
ইশিতা মাথা নাড়ায়। আলো নিচু স্বরে বলে ওঠে,"তোমার ভাইয়া কোথায় গিয়েছেন? বাড়িতে ঢুকে পাঁচ মিনিটও বসলেন না।"
_ভাইয়া কোথায় গিয়েছে এটা এখনো আমার কাছে জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে কেন? উল্টো আমারই তো তোমাকে জিজ্ঞেস করার কথা ভাইয়া কোথায় গিয়েছে।
আলো চুপ করে থাকে। ইশিতা বলে,"ভাইয়া পার্টির মিটিং এ গিয়েছে। জরুরি আলোচনা।"
_দুপুরে ফিরবেন না?
_সেটা তো জানি না। তুমি জিজ্ঞেস করো।
_আমি?
_হ্যা তুমি।
আলোর দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে ইশিতা আবারও বলতে থাকে,"অনেক তো ভাইয়ার পরীক্ষা নিলে, এখন তুমিও পরীক্ষা দাও, তুমি বৌ হিসেবে কতটা উপযুক্ত।"
আলো লাজুক মুখটা নামিয়ে রাখে। ইশিতা আলোর ফোন থেকে সামিনের নাম্বার ডায়াল করে বলে,"এই নাও। কথা বলো।"
দুইবার রিং হতে সামিন ফোনটা রিসিভ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"বলো।"
_কোথায় আপনি?
_মিটিং এ।
_দুপুরে ফিরবেন না?
_না রাতে ফিরবো, দুপুরে এখানে খাবো। বিকেলে প্রেসক্লাবে যেতে হবে। রাতেও সম্ভত খেয়ে আসবো।
আলো কি বলবে আর, বুঝতে পারছে না। তার মাথায় আসছে না। ইশিতা আলোর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,"ভাইয়াকে বলো আমি আপনাকে খুব মিস করছি। আমার মনটা কেমন করছে।"
আলো ইশিতাকে চোখ রাঙানি দেয়। ইশিতা মুখে ওড়না চেপে হাসছে।
সামিন আলোর ফোন পেয়ে অসম্ভব খুশি হয়েছে,কিন্তু অনেক সিনিয়র পার্সন আশেপাশে রয়েছে তাই একটু ভালো করে কথাও বলতে পারছে না, শুধু মুখে হু হা করে যাচ্ছে।
আলো বলতে থাকে,"ইশিতা আপু আপনাকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে বলেছে, একসাথে ক্রিকেট ম্যাচ দেখবে।"
_আর তুমি? তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলবে না?
সামিন জানতে চায়।
আলো ঠান্ডা গলায় বলে,
_না, আমি তো ক্রিকেট খেলা দেখিনা।
সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"ঠিকাছে, তোমার ইশিতা আপুকে বলে দিও আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো, আর তোমার ইশিতা আপুর বড় ভাবীকেও বলে দিও সে যেনো গোলাপী রঙের শাড়িটা পরে থাকে।"
আলোর মুখটা লাল হয়ে যায় লজ্জায়। ইশিতা আড়চোখে তাকিয়ে বলে,"কি বলেছে? ভাইয়া আই লাভ ইউ বলেছে?"
আলো মাথা নাড়ায়।
_তাহলে?
_বলা যাবে না।
অস্ফুট স্বরে বলে আলো ছুটে ঘর থেকে বের হয়।
***
পার্টির মিটিং শেষ করে কবির আলমগীর সামিনকে কাছে ডাকে। সামিন গিয়ে তার পাশের চেয়ারে বসতেই কবির আলমগীর বলে ওঠে,"সরকারি ফান্ড সিন্ডি*কেটের ব্যাপারটা বানোয়াট, তোমার শশুর মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিউজ লিখছেন।"
_বানোয়াট নাকি সত্যি সেটা তো উনি লেখেননি, উনি তো খবরটা তুলে ধরেছেন আংকেল, জনগণের মুখে যা শুনেছে। স্কুল টা অনেক বছর ধরে নির্মাণাধীন পরে আছে।
_খুব শশুর ভক্ত হয়েছো দেখছি! এতে যে তুমিও ফেঁসে যেতে পারো সেটা জানো? নেবে তুমি অপবাদ? দলের সুবিধা নিলে কিন্তু দলের অপবাদও মাথা তুলে নেবার সাহস থাকতে হয়।
সামিন কবীর আলমগীরের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"প্রথমত উনি শুধু আমার শশুর নয়, একজন সাংবাদিক। দ্বিতীয়ত, আমি এমন কোনো কাজ করিনি যাতে আমি ফেঁসে যাবো। তৃতীয়ত, দল করলে দলের অন্যায় সমর্থন করার মতো ছেলে আমি নই আংকেল।
কবীর আলমগীর সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে । ছেলেটা বরাবর বেপরোয়া, এখন যদি এর খামখেয়ালির জন্য পার্টি ফেঁসে যায় সেটাই কবীর আলমগীরের ভ*য়। সে নিচু স্বরে বলে,"আরে, অন্যায় সমর্থন করতে কে বলেছে তোমাকে? তুমি শুধু তোমার শশুর কে বলবে অযথা এতো লেখালেখি যাতে সে না করে। এতে কত শত্রু তৈরি হয় বলো তো।"
সামিন ম্লান হাসে, তারপর বলে,"আমি আছি। শত্রু হলে আমি উ*প্রে ফেলতে জানি আংকেল। এটা বিশ্বাস করেন তো? আপনি অযথা চিন্তা করবেন না, অন্যায় তো আর আপনি করেননি।"
***
কলিং বেলের আওয়াজে রিতু দরজা খুলে দেয়। সামিন হাসি দিয়ে বলে,"ইহান ঘুমিয়েছে?"
রিতু মাথা নাড়ায়। সামিন এদিকে ওদিকে তাকিয়ে আলোর উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। আলো লিভিং রুমে নেই। নিশ্চয়ই খেয়ে দেয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আসলে সামিন একটু বেশি বেশি আশা করে ফেলছে ঐ মেয়েটার থেকে। নিজের মাকে যেমন দেখে আসছে, রিতুকে যেমন দেখে আসছে তাতে সে ভেবেছিলো বৌ মানুষ বুঝি এমনই হয়। আলোর মতো অলস বৌ যে পৃথিবীতে থাকতে পারে তা সে বুঝতে পারেনি।
রিতু সামিনের হাতের শপিং ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বলে,"কি এটাতে?"
সামিন মুচকি হাসে। রিতু হেসে বলে,"বুঝেছি! ভাবীর জন্য!"
সামিন লাজুক মুখটা নিয়ে উপরে চলে যায়। ছোটো ভাই-বোন গুলো এভাবে লজ্জা দিলে সে কোথায় যাবে!
ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে বিছানায় কেউ নেই। তাহলে সম্ভবত বারান্দায়। জোরে জোরে শব্দ করে আলমারি খুলে টিশার্ট বের করে। শব্দ করে ওয়াশ রুমের দরজা খোলে। আলো রানীর কোনো পাত্তা নেই।
আলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদ দেখছিলো,আজ আকাশে এতো বড় একটা রূপালী চাঁদ! শব্দ পেয়ে সে বুঝতে পেরেছে সামিন এসেছে। কয়েক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে থেকে সে হেঁটে নিচতলায় চলে যায়। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে সামিন বারান্দায় উঁকি দেয়, বারান্দায় কেউ নেই। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে আলো দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা গ্লাসে মিন্ট লেমন।
সামিন আলোর হাতের গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে বলে,"মুখে ছু*ড়ে মারবে নাকি!"
আলো হেসে ফেলে। সামিন গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দেয় তাতে। আলোকে একপলক দেখে নিচু স্বরে বলে,"ইশিতার বড় ভাবীকে গোলাপী রঙের শাড়ি পরতে বলা হয়েছিলো।"
আলো অন্যদিকে ফিরে বলে,"আপনি বললেই সে শুনবে কেনো?"
সামিন শীতল চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,"ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাবেন না? ইলহাম ভাইয়া আর ইশিতা আপু অপেক্ষা করছে আপনার জন্য দোতলার লিভিং রুমে। আপনি যান, আমি ঘুমিয়ে পরছি। দরজাটা চাপিয়ে রেখে যাবেন।"
সামিন কিছুক্ষণ আলোকে দেখে দরজার কাছে যায়। তারপর দরজার সিটকিনি তুলে ঘুরে দাঁড়ায়।
আলো মাথা নিচু করে রেখেছে। সামিন আলোর দিকে এগিয়ে যায়, তারপর নিচু স্বরে বলে,"দোতলার লিভিং রুমে আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে বসে নেই। আমার জন্য সম্ভবত দোতলার দক্ষিণ পাশের এই ঘরটাতে কেউ অপেক্ষা করেছিলো।"
আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,"মিথ্যা কথা। কেউ অপেক্ষা করে ছিলো না।"
_কেউ ছিলো না?
সামিন আলোর দিকে খানিকটা ঝুকে জিজ্ঞেস করে।
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন বলে ওঠে,"ঠিকাছে। আমি লিভিং রুমে যাচ্ছি। আজকের ম্যাচটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেখতে হবে । তুমি ঘুমিয়ে পরো।"
সামিন ঘুরে দাড়াতেই আলো তার হাত টেনে ধরে। ঘাড় ঘুরিয়ে আলোকে দেখে, মাথা নিচু করে রেখেছে। সামিন বলে,"কথায় কথায় মাথা নিচু করে ফেলো কেন?"
_আপনি তো এটাই পছন্দ করতেন, আপনার বৌ মাথা নিচু করে থাকবে।
সামিন হাসে। বিছানা থেকে একটা শপিং ব্যাগ আলোর হাতে দিয়ে বলে,"এটা পরে আসো। তোমার পছন্দের লাল শাড়ি।"
আলো কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগটা নিয়ে নেয়। সামিন অবাক হয়ে বলে,"এভাবে কাপছো কেন!"
আলো এক ছুটে শাড়িটা নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে যায়। সামিন চুপচাপ বসে থাকে। কিছু সময় পরে আলো শাড়িটা পরে বের হয়। শব্দ পেয়ে সামিন ঘুরে তাকাতেই থ'মকে যায়। আলো ওয়াশ রুমের দরজার বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এগোনোর মতো শক্তি যেন সে খুজে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে সামিন তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়, আলোর কাছে এসে নিচু স্বরে বলে,"কোলে তুলতে হবে?"
আলোর ইচ্ছা করছে এই লোকটাকে খুব করে ব*কে দিতে। ইচ্ছে করে লজ্জা দিচ্ছে আলোকে। সামিন আলোর নীরবতা দেখে বাঁকা হাসি হেসে আলোকে পাঁজা কোলা করে তুলে নেয়। আলো জমে যায় এক অদ্ভুত অনুভূতিতে। চোখ তুলে মানুষটার দিকে তাকাতে পারছে না সে।
বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আলমারি খুলে আলোর গয়না গুলো এনে আলোকে নিজের হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বলে,"আমি অনেক ভালো বৌ সাজাতে পারি। দেখবে তুমি নিজেই নিজের থেকে চোখ সরাতে পারবে না।"
_তা কজন বৌ সাজিয়েছেন যে এতো ভালো অভিজ্ঞতা?
নিচু স্বরে বলে আলো।
সামিন হাসে। আলোর গলায় একটা হার পরিয়ে দেয়। আলো বলতে থাকে,"এতো দেরী করে ফিরলেন যে!"
_তোমাকে দিয়ে একটু অপেক্ষা করাতে ইচ্ছে হলো।
_আমার বয়েই গিয়েছে আপনার জন্য অপেক্ষা করতে। ঘুম আসছিলো না দেখে পুর্নিমার চাঁদ দেখছিলাম।
সামিন কয়েক পলক আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়। আলো বলে,"কোথায় যাচ্ছেন?"
_একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি আছে।
আলমারি খুলে কোলবালিশ বের করে একটা কাঁচি দিয়ে কেটে সমস্ত তুলা বের করে ফেলে। আলো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ক্ষনবাদে বলে ওঠে,"এসব কি করছেন? মাথা ঠিক আছে আপনার?"
_তুমি বুঝবে না,এটা আমার জীবনের চরম শত্রু। সামিন ইয়াসার মির্জা শত্রুর শেষ রাখে না। এটাকে কে*টে টুকরো টুকরো করার আমার অনেক দিনের ইচ্ছা আছিয়া,তুমি বাঁধা দিও না।
কোলবালিশ টাকে ছিন্ন*ভিন্ন করে আলমারির মধ্যে ছুড়ে ফেলে রাখে। আলো হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। এই লোকটা এতো পাগল কেনো!
সামিন গিয়ে আবারও আলোর মুখোমুখি বসে। আলো অস্ফুট স্বরে বলে,"আপনি পাগল!"
_তুমি বানিয়েছো।
মুগ্ধ চোখে আলোকে দেখতে থাকে সামিন। আলো নিচু স্বরে বলে,"আজকের চাঁদ টা খুব সুন্দর। দেখবেন?"
সামিন নকল হাই তোলার ভান করে বলে,"আমার অত ফালতু সময় নেই। আগে নিজের চাঁদটাকে দেখি।"
আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সামিন দীর্ঘসময় তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"এতোটা সুন্দর না হলেও পারতে। আমার বুকে যন্ত্রনা হচ্ছে খুব।"
আলো মাথা নিচু করে ফেলে। সামিন আলোর হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে হাতে চু*মু খায়।
যত সময় যাচ্ছে আলোর হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে,ভ*য় হচ্ছে,খুব পানির তৃষ্ণা পাচ্ছে।
বাতির কৃত্রিম আলোয় আলোর মুখটা আরো বেশ কিছুক্ষণ দেখে সামিন ঘরের বাতি নিভিয়ে দেয়।
আধো অন্ধকারে আলো টের পেলো তার স্বামী তাকে বুকে টেনে নিয়েছে। সে টের পেলো এখন তার কোন ভয় করছে না। বরং নিজেকে খুবই নিরাপদ মনে হচ্ছে এই বুকে।
সামিন ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,"ভালোবাসি আছিয়া।"
আলো নিশ্চুপ। সামিন বলতে থাকে,"তুমি ?"
আলো কোনো সাড়া দেয়না না। সবকিছুর জবাব যে মুখে দিতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। সামিন তাকে বুক থেকে আলগা করে উঠে গিয়ে খোলা জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে আসে। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"অন্ধকার করে দিলেন যে!"
আলোকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে সামিন ঘোর লাগা কন্ঠে বলে,"অন্ধকার কোথায়? আমার কাছে তো আমার আলো আছে।"
আলো কিছু বলে না আর, সামিন বলতে থাকে,"এই রাত টা একান্তই আমার। আমি চাইনা তোমার ঐ স্টুপিড ধূসর রঙের চাঁদটা তার আলো দিয়ে আমাকে বিরক্ত করুক। আজ আমি কারো বিরক্ত মেনে নেবো না। কেউ নাক গলাবে না আমাদের মাঝে। কাউকে বরদাস্ত করবো না আমি, ঐ পূর্নিমার চাঁদ কেও না।"
আলো তখনই চুপ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সে টের পায় সে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে তার স্বামীর ভালোবাসায়। পুরুষালি প্রতিটা স্পর্শে শুধু কামনা নয় বরং মিশে আছে একজন স্ত্রীর প্রতি একজন স্বামীর স্নেহ,দরদ,সম্মান এবং সীমাহীন ভালোবাসা।
চোখ মেলে আবিষ্কার করলো কেউ একজন তাকে আগলে ধরে রেখেছে। এমন ভাবে আগলে ধরে রেখেছে যেন আলো পালিয়ে যাবে, তাই সে তাকে ধরে রেখেছে। তার থুতনি ঠেকেছে আলোর মাথায়। নড়াচড়ার চেষ্টা করতে গিয়েও করে না আলো। নিচু স্বরে বলে,"শুনছেন,আমি চোর নই, ছেড়ে দিন, পালাবো না।"
সামিন সম্ভবত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আলো নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গিয়েও ছাড়িয়ে নেয়না। বেশি নড়লেই ঐ লোকটা উঠে যাবে, জ্বা*লাতে শুরু করবে আলোকে।
অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছে না আলো। এখন রাত কত? ফজর হতে কত দেরী! হুট করে ঘুমটা ভেঙে যাওয়াতে মুশকিল হলো। রাতে আলোর যদি একবার ঘুম ভেঙে যায় তাহলে দু'চোখে আর ঘুম আসে না। একা একা কতক্ষন জেগে থাকবে এখন! আজান কেন দিচ্ছে না! ওঠার জন্য একটা বাহানা তো চাই!
হঠাৎ করে টের পেলো সামিন তাকে আরো শক্ত করে ধরে ফেলেছে। ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে ওঠে,"বাহানা খুজছো উঠে পরার? এখনো আজান দেয়নি । আরো আধাঘণ্টা পরে দেবে!"
আলো চ'ম'কে ওঠে। অবাক হয়ে বলে,"আপনি কিভাবে বুঝলেন? অন্ধকারে সময় দেখলেন কিভাবে?"
_ঘড়ির ঘণ্টার শব্দে, এখন সম্ভবত সাড়ে চার টা। যখন ঘণ্টা বাজছিলো তুমি ঘুমাচ্ছিলে।
_আপনি জেগে ছিলেন?
_হু।
আলো চুপ হয়ে যায়। সামিন বলতে থাকে,"স্ত্রী হবার ষষ্ঠতম শর্ত জানো আছিয়া?"
_না।
আলো অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়।
সামিন আলোর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,"স্বামী ভালোবেসে আগলে ধরলে, আটকে রাখলে আনন্দের সাথে তার বুকে বন্দিনী হয়ে যাওয়া।"
_আমাকে বন্দিনী করেছেন?
_হু। তুমি বুঝতে পারোনি।
_বন্দিনী করে কি করবেন?
_ভালো বাসতে হাসতে জীবনটা অতিষ্ঠ করে দেবো তোমার।
অন্ধকারে সামিন দেখলো না লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া আলোর মুখটা। নিচু স্বরে আলো বলে ওঠে,"ওসব নেতারা প্রথম প্রথম একটু ঢ*প দেয়। এই করবো, সেই করবো, তারপর ক্ষমতায় গেলে নাকে সরিষার তেল লাগিয়ে ঘুমায়।"
সামিন ফিক করে হেসে ফেলে। কাছের মসজিদে আজান দিয়ে দিয়েছে। আজান শেষ হলে সামিন বলে ওঠে,"স্ত্রী হবার সপ্তম শর্ত শুনবে?"
_শুনবো। নামাজ আদায় করে শুনবো। আপনি কি অনুগ্রহ পুর্বক আমার গা থেকে আপনার আড়াই কেজির হাতটা সরাবেন মেয়র সাহেব? আপনার ভালোবাসার ওজন সইতে পারবো, ঐ হাতের নয়।
***
শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে দৌড়ে দৌড়ে কাজ করছে আলো। সবাই রান্নাঘরের দরজায় উঁকি দিচ্ছে। সিতারা আর ফুলির মা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। রিতু চেঁচিয়ে বলে,"ভাবী পারবে না একা তুমি। আজ অনেকজন আসবে নাস্তা করতে, এতজনের খাবার তুমি একা একা কিভাবে তৈরি করবে?"
_পারবো আমি।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।
রিতু আর কথা বাড়ায় না, এই মেয়ে কারো কথা শোনার মেয়ে নাকি! অযথা কথা খরচ!
টেবিলে রুটির বাটি, সবজি, ডিমের পোচ সাজিয়ে রেখে আলো কোমর থেকে আঁচল সরিয়ে ডান কাঁধে টেনে দোতলায় চলে আসে। সামিন তখনও ঘুমাচ্ছে। আলো বিরবির করে বলে ওঠে,"রাতে ঢং করে জেগে থেকে এখন মটকা মে'রে ঘুমাচ্ছে।"
_ঢং করে জেগে থাকিনি।
আলো চ'ম'কে উঠে সামিনের দিকে তাকায়, সামিন চোখ বন্ধ করে বলতে থাকে,"বৌকে প্রথম জরিয়ে ধরে ঘুমানোর যে আনন্দ, সেই আনন্দে আমার ঘুমটাই কেটে গিয়েছে। তোমাকে এই অনূভুতি বলে বোঝাতে পারবো না আছিয়া, এই অনুভূতি বুঝতে গেলে তোমাকে পুরুষ হতে হবে।"
আলো চুপচাপ জানালার পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দেয়। বাইরের মিঠা রোদ এসে সামিনের মুখে পরে। আলো নিচু স্বরে বলে,"আপনার ছেলেরা এসে বসে আছে, আপনার সাথে নাস্তা করবে বলে, আর আপনি এখানে শুয়ে শুয়ে বাজে বকতে থাকুন।"
সামিন উঠে বসে। চোখ ডলে আলোর দিকে তাকায়। আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলে,"খুব চেষ্টা করছো চাল চলনে গিন্নি গিন্নি ভাব ফুটিয়ে তুলতে, কিন্তু হচ্ছে না। তুমি রিতুর কাছ থেকে কিংবা আমার শাশুড়ির কাছ থেকে ট্রেনিং নিও।"
আলো দাঁড়িয়ে থাকে, সামিন উঠে আলোর দিকে এগিয়ে এসে তার গালে একটা হাত বুলিয়ে বলে,"এখনও অনেক কিছু শেখা বাকি আছিয়া, গ্রো আপ!"
তারপর হুট করে আলোর কপালে একটা চু*মু খায়।
সিতারা এসে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,"আসবো ভাবী?"
_এসো।
আলো সামিনের থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে সিতারাকে আসতে বলে। সিতারা ঘরে ঢুকে মেঝের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। সে এসেছে ঘর ঝাড়ু দিতে। অবাক চোখে আশেপাশে তাকিয়ে বলে,"এতো তুলা পরে আছে কেন ভাইজান পুরো ঘরে?"
প্রশ্নটি করে সে আলমারি খুলতে যায়। সামিন থামিয়ে দিয়ে বলে,"উহু, আলমারি খুলিস না সিতারা।"
_কেন ভাইজান?
_ওখানে একটা লা*শ পরে আছে।
গম্ভীর কন্ঠে বলে সামিন। আলো কপাল কুঁ'চ'কে সামিনকে থামিয়ে দিয়ে সিতারাকে বলে,"কিছুনা সিতারা আপা, মজা করছে। তুমি তোমার কাজ করো ।"
***
নাস্তার টেবিলে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। সবাই সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে খুবই কৌতুহলী হয়ে। সামিন দলের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমাকে এভাবে কেনো দেখছিস?"
কেউ কোনো জবাব দেয়না।
সামিন রুটি ছি'ড়ে সবজি নিয়ে মুখে পুরে সবার দিকে তাকায়। এইবার সে বুঝতে পেরেছে সবাই খাওয়া রেখে কেনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন খাবারটা না পারছে ফেলতে,না পারছে গিলতে।
আলো রান্নাঘরে চলে যায়। সামিন মুখ থেকে খাবারটা ফেলে দিয়ে ছেলেদের গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"সবসময় তরকারিতে লবণ থাকতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও লেখা আছে তরকারিতে লবণ দিতেই হবে? লবণ ছাড়াও বেশ খাওয়া যায়।
তৌফ উ'শ'খু'শ করছিলো, হুট করে বলে ওঠে,"আপনি কেন থু'তু মে'রে ফেলে দিলেন ভাই!"
আলো আরো একবাটি সবজি নিয়ে এসে সবার মুখের দিকে তাকায় , অবাক হয়ে বলে,"খাচ্ছেন না কেনো আপনারা? সব তো সেভাবেই আছে!"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"তুমি ওদের জন্য চা বানাতে বলো। ওরা এখন আর কিছু খাবে না।"
আলো বোকার মতো সবার দিকে তাকাচ্ছে। সবাই আলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে, তারপর উঠে লিভিং রুমে চলে যায়। আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন মৃদু হেসে বলে,"স্ত্রী হবার সপ্তম শর্ত হচ্ছে স্বামীর জন্য কিছু রান্না করলে,আগে নিজে লবণ চেখে দেখা।"
আলো হতভম্ব হয়ে বলে,"লবন বেশি হয়েছে?"
_তোমার মাথায় যেমন ব্রেইন নেই তেমন রান্নায়ও লবন নেই।
সামিন মজার ছলে ফিসফিসিয়ে কথাটি বলে চলে যায়।
***
টেবিলের ওপর স্তুপ করে রাখা আলোর বই। কোমরে হাত দিয়ে বই গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে সে। সামিন গিয়ে পেছন থেকে আলোকে জরিয়ে ধরে বলে,"কি ব্যাপার! কি ভাবছো!"
_আজ কোন কোন ক্লাস বুঝতে পারছি না। ইউনিভার্সিটি যাবো।
_হিয়াকে ফোন করে জেনে নাও।
_ভালো বলেছেন, ওকেই ফোন করে দেখি।
আলো ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। সামিন দেখতে থাকে আলোকে। একটা গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরেছে। চুলে একটা লম্বা বেনী। সামিন কাছে গিয়ে বেনী খুলে দেয়। আলো ফোন রেখে অবাক হয়ে সামিনকে বলে,"খুললেন কেনো?"
_খোপা বাঁধো।
_আচ্ছা আপনার কাজ নেই? আজ পার্টি অফিসে যাবেন না?
_যাবো। তোমাকে ইউনিভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে।
আলো চুলে খোঁপা বেঁধে নিতে নিতে বলে,"নামিয়ে কেনো দিতে হবে? আমি কি বাচ্চা? ইহানের বয়সী?"
_না তবে ইহানের মতো আদুরে আমার কাছে।
_আপনার আহ্লাদ দেখে আমার হাড় জ্বলে যাচ্ছে। ওসব আপনার ভাই-বোনদের সাথে দেখান। আমি একা একা যাবো ভার্সিটিতে, মোড়ের মাথায় নৌশিন আর শ্রাবনী অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
সামিন একহাত দিয়ে আলোকে আগলে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলে,"এখন এমন ধুরছাই করছো তো! যখন থাকবো না তখন....!"
সামিনের মুখ চেপে ধরে আলো তার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,"কি হচ্ছে এটা? এতো জ'ঘ'ন্য টাইপের মজা কেন করতে হবে?"
সামিন আলোর হাত সরিয়ে নিয়ে হাসতে থাকে।
আলো আলমারি থেকে সামিনের পাঞ্জাবি বের করে বিছানার উপর রাখতে রাখতে বলে,"আজ ও বাড়িতে যেতে চাচ্ছি আমি ক্লাস শেষে। আজান আয়াতের গিফট গুলো দিয়ে আসবো।"
_হ্যা,যাবে। অসুবিধা কোথায়?
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"আজ রাত টা দাদীর কাছে থাকবো। ফিরবো না এ বাড়িতে। দু'দিন থাকবো ওখানে ভাবছি! "
সামিন আলোর দিকে তাকায় । আলো নিচু স্বরে বলে,"থাকবো?"
কয়েক মূহুর্ত সময় নিয়ে সামিন বলে,"কেনো থাকবে না! তোমার ইচ্ছে হলে অবশ্যই থাকবে। আমার কোনো অসুবিধা নেই।"
আলো ভেবেছিলো সামিন বলবে,সেও যেতে চায়। কিন্তু সামিন বলেনি। আলো ভাবলো হয়তো তার এখানে খুব কাজ আছে। নয়তো সামিন যেতে চাইতো।
সামিনের ফোন বেজে ওঠে হঠাৎ। ইশমাম ফোন দিচ্ছে, ফোনটা রিসিভ করে বারান্দায় চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে মুখ হাসি হাসি করে ঘরে ঢোকে। আলো বলে,"হঠাৎ এতো খুশি?"
_ইশমাম আসছে।
আনন্দের সাথে বলে সামিন। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে অস্বস্তি।
সামিন হঠাৎ আলোকে বলে ওঠে,"এক মিনিট, দাঁড়াও তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।"
আলো দাঁড়িয়ে পরে। সামিন তার ফোন থেকে দু'টো মেয়ের ছবি বের করে আলোকে দেখিয়ে বলে,"দেখো তো, এই দু'টো মেয়ের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী?"
আলো অবাক হয়ে সামিনের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। অস্ফুট স্বরে বলে,"কারা এরা?"
_আগে বলো।
আলো ছবি দুটোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা মেয়েকে দেখিয়ে বলে,"এই মেয়েটা।"
সামিন হেসে বলে,"ঠিক বলেছো, আমারও এটাই মনে হয়েছে। এটাই বেস্ট হবে ইশমামের জন্য।"
আলো অবাক হয়ে বলে,"ইশমামের পাত্রী?"
_হু, আরো কয়েকজন দেখেছি। এবার দেশে ফিরলেই ধরে বেঁধে বিয়ে করিয়ে দেবো।
আলো আমতা আমতা করে বলে,"ওর পারমিশন না নিয়ে এভাবে মেয়ে দেখা ঠিক হচ্ছে? রে*গে যাবে যে আপনার ওপর!"
_আর কি করবো? সারাদিন দেবদাসের মতো ঘুরে বেড়াবে এটা দেখবো? কি জানি কোথাকার এক শাক*চুন্নীর পাল্লায় পরেছিল। কত ভালো ভাইটা আমার, খুব ভালোবাসতো ঐ শাক*চুন্নীকে, দেশে এসেছিলো আমাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেবে বলে, এসে দেখে শাক*চুন্নী বিয়ে করে নিয়েছে।
আলো চুপচাপ তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। সামিন বলতে থাকে,"আমার ঐ মেয়েটাকে একবার দেখার খুব ইচ্ছা। আমার ভাইকে রিজেক্ট করে বিয়ে করে নেয়! নিশ্চয়ই আরো বড়লোক ছেলে পেয়েছে, তাই বিয়ে করে নিয়েছে, আজকালকার মেয়েগুলো প্রচন্ড লোভী।"
আলোকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সামিন তাকে কাছে টেনে নেয়, প্রসঙ্গ পালটে বলে,"কি হয়েছে? কি ভাবছো?"
_কিছুনা।
অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় আলো।
সামিন আলোর কপালে একটা চুমু একে দিয়ে পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে ঘর থেকে বের হয়। আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আলো কখনোই এতো বড় সত্যিটা এই লোকটাকে জানতে দিতে চায় না, ভুল করেও না, সহ্য করতে পারবে না এই লোকটা।
***
সামিনকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে পার্টি অফিসের সবাই খুশি হলেও খুশি হয়না জাবির। সে একপলক তাকিয়ে আবারও ফোন ঘাঁটতে থাকে। পার্টির জরুরী আলোচনায় আজ উপস্থিত নেই কবীর আলমগীর। সামিন এগিয়ে যেতেই জেনারেল সেক্রেটারি ইসহাক খাঁ বলে ওঠে,"এতো দেরী? আগে তো তোমাকেই আগে পেয়ে যেতাম মিটিং এ।"
সামিন ম্লান হেসে কিছু একটা বলতে যাবে তখনি জাবির পাশ থেকে বলে ওঠে,"কাউকে বেশি প্রশংসা করলে তার এভাবেই অবনতি হয় ইসহাক আংকেল।"
সামিন শীতল চোখে জাবিরের দিকে তাকায় , তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,"তুই হঠাৎ এলি যে! মেয়ে নাচিয়ে সময় পাস পার্টির কাজ করার?"
ফোন রেখে জাবির সামিনের দিকে তাকায়। তারপর বলে ওঠে," মামা তোকে একটু বেশি লাই দেয়। নিজেকে খুব যোগ্য মনে করিস!"
_ভুল বললি। আমি নিজেকে কিছুই মনে করি না। এটা তো জনগণের কাজ, তারাই আমাকে হয়তোবা কিছু একটা মনে করে তাই আমি মেয়র, আর তুই দলের ক্রীড়া সম্পাদক হয়ে দলের ফান্ড থেকে টাকা সরিয়ে বাজারী মেয়েদের মুজরা দেখিস! থাই*ল্যান্ড যাস!
জাবির কিছু বলতে যেয়েও পারে না, সামিনকে সে চেনে, এখানে তর্কাতর্কি করলে কিছুই হবে না উল্টো তার মুখোশ খুলে যাবে!
সামিন ইসহাকের দিকে তাকিয়ে বলে,"একজন মেয়রের অনেক কাজ থাকে আংকেল, ফান্ড থেকে কে কখন টাকা সরালো সেটা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করলে তো হবে না! সেসব করার জন্য পুলিশ আছে, সাংবাদিক আছে , তাদেরকেই কাজ টা করতে দিন না।"
ইসহাক চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,"এতো গুলো টাকা সামিন। একেবারে দলের নাম ডুবে যাবে, বলছিলাম তোমার শশুর কে বলে একটু বুঝিয়ে নিউজ টা! এখন রিটায়ার্ড করেছে, কোথায় হজ্ব করতে যাবে। তা না করে এখনো খাটছে! "
সামিন ইসহাকের দিকে তাকাতেই ইসহাক একটা ঢোক গিলে ফেলে। ঘুরে ঘুরে মিটিং এর প্রত্যেকটা লোককে একবার দেখে নিয়ে সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,"যে যে অকাজ টা করেছে, তাদের সবাইকে দাম দিতেই হবে। অকাজ টা করার আগে দ্বিতীয় বার ভাবা উচিত ছিলো।"
সামিন চলে গেলে জাবির বিরক্ত ভঙ্গিতে ইসহাকের দিকে তাকিয়ে বলে,"নিজেও খাবেনা, আমাদেরও খেতে দেবেনা। এটাকে দলে রেখে কত বড় ভুল করলেন তা আপনারা আর মামা খুব শিগগিরই বুঝতে পারবেন আংকেল। তখন না পারবেন গিলতে, না পারবেন উ*গ্রে ফেলতে।"
***
ফোনের দিকে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে আছে সামিন। মহারানীর কোনো পাত্তা নেই। অবশ্য বাপের বাড়ি গেলে মেয়েরা এমন করে। তখন স্বামী কে! স্বামী দিয়ে কি করে!
যাওয়ার সময় একবার সামিনকে যাওয়ার জন্য সাধলোও না। সামিন কি হ্যাংলা নাকি! প্রত্যেক বার সামিনই সেধে সেধে যাবে? কখনোই না। সামিন ইয়াসারের আত্মসম্মান আছে।
ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই সামিন ফোনের দিকে তাকায়, ভেবেছিলো আলোর ফোন। কিন্তু ফোন এসেছে সিম কোম্পানি থেকে। বিরক্ত ভঙ্গিতে সামিন মুখে চ কারন্ত শব্দ করে ।
সামিনের কোলে জামিলের ছেলে জাহিন। সে এসেছে জামিল আর হেনার বাড়িতে।
হেনা এসে জাহিনকে সামিনের কোল থেকে নিয়ে নেয়। সামিন ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ উ'শ'খু'শ করে আলোকে ফোন দেয়। ফোনটা রিসিভ করে আলো কানে ধরে চুপ করে থাকে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,"খেয়েছো?"
_হ্যা। আপনি?
_খেয়েছি জামিলের বাড়িতে।
_কেমন আছে জামিল ভাইয়ের ছেলেটা?
_ভালো।
আলো চুপ হয়ে যায়। সামিন প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে। দু'টো রোমান্টিক কথা বলতে জানেনা এই মেয়ে। হয় চুপ করে থাকবে নয়তো এমন কথা বলবে যাতে সামিনের কলিজা পর্যন্ত পু*ড়ে যায়।
কয়েক মূহুর্ত পরে আলো বলে ওঠে,"কি হলো! চুপ করে আছেন যে।"
_কিছুনা। রাখছি।
সামিন ফোন কেটে দেয়। আলো চুপচাপ বসে আছে। এমন অদ্ভুত আচরণ করলো কেনো লোকটা!
কিছুক্ষণ পরে আবারও ফোন দেয় সামিন। আলো আবারও ফোন রিসিভ করে বলে,"কি হলো! বলবেন তো কি হয়েছে! এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন!"
_কিছু না রাখছি।
ফোন কেটে দেয় সামিন। আলোর এবার প্রচন্ড মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছে! কিছু বলছেও না, এমন উদ্ভট আচরণ করছে! শাশুড়ি মা এই লোকটাকে পেটে নিয়ে কি খেয়েছিলো! আপাদমস্তক পাগল একটা লোক!
সন্ধ্যা থেকে কিছুক্ষণ পরপর সামিন আলোকে ফোন দিচ্ছে। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিচ্ছে। আলো না পারছে বাপের বাড়িতে আসা কোনো অতিথিকে সময় দিতে, না পারছে একটু পড়াশোনা করতে। এমন ব্যাক্তিত্ববান মানুষের থেকে এমন উদ্ভট আচরণ মেনে নেয়া যায় না। একবার ইচ্ছা করলো ফোনটা সুইচ অফ করে দেবে, কিন্তু ঐ লোককে বিশ্বাস নেই, দেখা যাবে আব্বু আম্মুর নাম্বারে ফোন দিতে শুরু করবে!
কিছুক্ষণের জন্য ফোন দেওয়াটা থেমেছে। রাত তখন প্রায় বারোটা। আলোদের বাড়ির সবাই রাত দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পরে। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। আলোর চোখ দুটোও বেশ লেগে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করে ফোনটা বেজে ওঠে আবার ।
"হায় খোদা" বলে আলো ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করে কানে ধরে বলে,"এখনো ঘুমাননি?"
সামিন চুপ করে আছে। আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,"আপনি কি কাল আসতে চাচ্ছেন মেয়র সাহেব?"
সামিন কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বলে ওঠে,"দরজা খোলো। আমি এসে গিয়েছি।"
আলো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বসে। ঐ পাগল লোকটার এমন আচরণে আলো একটুও অবাক হয়নি। চুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে দ্রুতপায়ে হেটে গিয়ে সদর দরজা খুলে দেয়। সামিন আলোকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে কিছু না বলে সোজা হেটে আলোর শোবার ঘরের দিকে যায়। সদর দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে আলো সামিনের পিছু পিছু যায়।
ঘরে ঢুকে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পরে সামিন। আলো নিচু স্বরে বলে,"আগেই তো আসতে পারতেন! এতো ঢং করলেন কেন?"
_আমাকে তো কেউ দাওয়াত করেনি। আমি কি হ্যাংলার মতো চলে আসতাম? মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জা হ্যাংলা?
_হ্যাংলার মতো আসেননি, কিন্তু চোরের মতো ঠিকই এসেছেন। পাড়ার কুকুর গুলো এজন্যই ঘেউ ঘেউ করছিলো, আপনাকে দেখে। চোর ভেবেছিলো ওরা আপনাকে।
সামিন চুপ করে থাকে। আলো সামিনের হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে বলে,"গাড়ি কোথায়?"
_মোড়ের মাথায়।
_জামান কাকার গ্যারেজে রাখতে পারলেন না? এটা আপনাদের মতো ভিআইপি এলাকা না, কাল সকালে গিয়ে দেখবেন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু গাড়ির ভেতরে কিছু নেই।
_মেয়রের গাড়ি কেউ ধরবে না।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন।
তারপর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়।
আলো বিছানা ঠিক করতে করতে বলে,"অমন অদ্ভুত আচরণ করছিলেন কি জন্য? আপনার জন্য কাউকে সময় দিতে পারছিলাম না আমি। আপনি কি অবুঝ?"
_স্ত্রী হবার আট নাম্বার শর্ত হচ্ছে মিনিটে মিনিটে স্বামীকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করা, সে কোথায় কি করছে। আমার দলের ছেলেদের দেখি, ওদের প্রেমিকা কিংবা বৌ রা ফোন দিতেই থাকে,দিতেই থাকে।
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"আট নাম্বার শর্তের কথা জানতাম না, এরপর থেকে করবো।"
তারপর সামিনের হাত থেকে তোয়ালে টা নিয়ে আলো বলতে থাকে,"নিন, এবার দরজা বন্ধ করে শুয়ে পরুন। আমি আসছি।"
_আমি আসছি মানে?
অবাক হয়ে সামিন জানতে চায়। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"আমি তো দাদীর কাছে থাকবো বলে এসেছি এক রাত। দাদীর ঘরে যাচ্ছি আমি।"
সামিন বাচ্চাদের মতো কাঁচুমাচু মুখ করে বলে,"তো সারাদিন থাকোনি তুমি দাদীর কাছে? রাত বিরাতে ওনাকে অসুবিধায় ফেলার দরকার কি?"
আলোর ভীষণ হাসি পাচ্ছে সামিনের মুখের অবস্থা দেখে। সে হাসি চাপিয়ে রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"তাকে সময় দিতে দিয়েছেন আপনি? সারাদিন ফোন দিয়ে দিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছেন। এখন ঘুমান। আমি আসছি।"
আলো সত্যি সত্যি চলে যায়। সামিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ দরজার দিকে। তারপর মুখ ভার করে বিছানায় শুয়ে পরে।
ঘর থেকে বের হয়ে দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে আলো শাড়ির আঁচল মুখে চেপে হাসতে থাকে। মেয়র সাহেবের ভোঁতা হয়ে যাওয়া মুখটা মনে করে বেশ কিছুক্ষণ হেসে নেয়। বেশ হয়েছে! সন্ধ্যা থেকে হা'ড় জ্বালিয়ে খেয়েছে। এখন একটু শাস্তি পাক!
দীর্ঘসময় সময় কেটে যায়। সামিন পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ঘরের বাতিটা জ্বলছে, দরজাও খোলা। কিছুক্ষণ পরে খট করে দরজা বন্ধ করার শব্দ হয়। সামিন ঘুরে তাকায় না। দুমিনিট পরে আলো এসে তার পাশে গুটিসুটি মে'রে শুয়ে পরে।
_এলে কেনো?
আলোর দিকে ঘুরে না তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে জানতে চায় সামিন। আলো নরম গলায় বলে,"দাদী বকে পাঠিয়েছে।"
সামিন কোনো কথা বাড়ায় না। আলো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,"মজা করছিলাম, আমি দাদীর ঘরে যাই-ই নি।"
সামিন নিশ্চুপ। আলো উঠে বসে,বলে,"ঠিকাছে! আমি এবার সত্যি সত্যি যাচ্ছি।"
আলো বিছানা থেকে নেমে পরতে নিলে সামিন ঘুরে খপ করে আলোর হাত টেনে ধরে। আলো সামিনের দিকে তাকাতেই সামিন আলোকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে কপাল কুঁ'চ'কে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো কিছু বলার আগেই সামিন বলে ওঠে,"স্ত্রী হবার নবম শর্ত জানো? স্বামী কোনো কারনে রেগে গেলে তার রাগ ভাঙাতে হয়। রাগ না ভাঙিয়েই চলে যাচ্ছো?"
আলো চুপ করে কিছুক্ষণ সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"স্ত্রী হবার এতো এতো শর্ত। স্বামী হবার শর্ত নেই? স্বামীদের বুঝি সাত খু*ন মাফ! বুঝি কাবিনের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করে দিলেই আর কোনো শর্ত থাকে না তাদের জন্য?"
কপালের কাছের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে আলোর। সামিন মৃদু হেসে চুল গুলো কানের পাশে গুজে দিয়ে আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,"আছে তো। শর্ত আছে। তবে স্বামী হবার শর্ত একটাই। সেটা হলো সারাজীবন স্ত্রীকে আগলে রাখা, ভালোবাসা,আদর,যত্ন,আহ্লাদে। নিজের কাছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধরে রাখা, মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে যাওয়া স্ত্রী ছেড়ে যেতে চাইলেও কখনোই তাকে যেতে না দেওয়া।"
এতটুকু বলে সামিন থামে , তারপর আবার বলে ওঠে,"স্ত্রীকে কখনোই বিছানার সৌন্দর্য মনে না করা, বরং স্ত্রীকে বিছানার কোলবালিশ মনে করা।"
শেষের কথাটা বলে সামিন হেসে ফেলে। আলো তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। সামিন হাসতে হাসতে আলোকে আগলে নেয়। আলো মিছিমিছি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায় এই পাগল লোকটার থেকে। সামিন আলোকে আরো আগলে নিয়ে আলোর কানে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,"স্ত্রী হবার দশম শর্ত জানো আছিয়া? স্বামী যখন ভালোবাসতে চাইবে তখন তাকে ভালোবাসতে দেওয়া। নড়াচড়া না করা। তুমিও করবে না। চুপচাপ থাকো।"
কথাটি বলে সামিন তার বৌয়ের কপালে চু*মু খায়, তারপর বলে," এই হচ্ছে মেয়র সাহেবের ভালোবাসা, দিয়েছে তার ভালোবাসার আছিয়ার কপালে।"
ঘরের বাইরে থেকে রেহেনা ডেকে যাচ্ছে। এর আগেও তিনবার তিনি ডেকে গিয়েছেন। চতুর্থ বারের মতো দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়, রেহেনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সামিন নিচু স্বরে সালাম দেয় তার শাশুড়িকে।
রেহেনা সালামের উত্তর দিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই সামিন বলে ওঠে,"আলো ফজরের নামাজ পরে ঘুমাচ্ছে।"
রেহেনা অবাক হয়েই তাকিয়ে থাকে। সামিন ওয়াশ রুমে ঢোকে।
রেহেনা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আলো বিছানায় ঘুমাচ্ছে। রেহেনা এগিয়ে গিয়ে চেঁচাতে থাকে,"এই মেয়ে! এই গাধা মেয়ে! ওঠ!"
আলো পিট পিট করে তাকায়। কপাল কুঁচকে ঘুম ঘুম কন্ঠে বিরক্তির সাথে বলে,"কি হচ্ছে আম্মু? আমি নামাজ পরেছি। চেচিও না।"
_জামাই কখন এসেছে?
_রাত সাড়ে বারোটায়।
_রাত সাড়ে বারোটায় এসেছে, তুই আমাকে ডাকবি না?
হতভম্ব হয়ে যায় রেহেনা।
_ডাকলে কি করতে? দই মিষ্টি খাইয়ে বরণ করতে?
_খেতে কি দিয়েছিলি?
ধমকের সুরে বলে রেহেনা।
_কি খেতে দেবো? উনি তো রাতে খেয়ে এসেছেন।
রেহেনা মেয়ের গা ছাড়া ভাব দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হয়। চাঁপা স্বরে চেঁ'চি'য়ে বলে,"তোর বয়স এক দুই করে ছাব্বিশ বছর হয়েছে, তোর মাথায় কি এখনো বুদ্ধি হবে না? হালকা পাতলা নাস্তা দিসনি?"
আলো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,"নাস্তা দেবো মানে? রাত বারোটা নাস্তা করার সময়?"
রেহেনা এবার দাঁত খিচিয়ে মেয়ের দিকে তে*ড়ে যায়। মাথায় গাট্টা মেরে বলে,"হোক রাত তিনটা। তুই আপ্যায়ন করবি না? নতুন জামাই! "
আলো উঠে দাঁড়িয়ে বলে,"নতুন জামাই বলে আপ্যায়ন করতে হবে? আর পুরাতন জামাইদের কি করে আম্মু? দরজা থেকে ফিরিয়ে দেয়?"
রেহেনা এইবার রে*গে মেয়ের চুল ধরে। সামিন ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে রেহেনাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। রেহেনা লজ্জা পেয়ে মেয়ের চুল থেকে হাত সরিয়ে নেয়। সামিন বলতে থাকে,"ভালো করে দু'টো লাগিয়ে দিন। আমি দিলে আবার নারীর প্রতি স*হিংসতা রটে যাবে। এই কাজটা আপনিই করুন মা।"
রেহেনা ম্লান হাসে, তারপর দ্রুতপায়ে হেঁটে রান্নাঘরে চলে যায়, জলদি জলদি করে এখন জামাইয়ের জন্য নাস্তা বানাতে হবে। তার এখন দম ফেলবার সময় নেই।
সামিন আলোর কাছে এসে বলে,"শেষমেশ একজনকে পেলাম, যে আলো রানীর চুলের মুঠি ধরার ক্ষমতা রাখে! বাহ বাহ! যখন যখন তোমাকে শা*স্তি দিতে ইচ্ছে করবে, তখন এ বাড়িতে নিয়ে আসবো ভাবছি।"
স্টাডি রুমে সামিনের মুখোমুখি বসে আতাউর আলম তার জীবনে অর্জিত সকল মেডেলের বিশদ বিবরণ দিচ্ছে। খুবই উৎসাহের সাথে নিজের জীবনের সাহসিকতার দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করছে। সামিন মাথা ঘুরিয়ে সবকিছু দেখে হাতে একটা আর্টি*কেল তুলে নেয়। আতাউর আলম বলে ওঠে,"ওটাও আমার লেখা।"
কাগজটায় চোখ বুলিয়ে সামিন বলে ওঠে,"আপনি বই বের করলেই পারতেন। আপনার লেখায় সাহিত্যিক একটা টাচ আছে। অবশ্য আমি এসব কম বুঝি। পলিটি*ক্যাল সাইন্স নিয়ে ঠেলে ঠুলে মাস্টার্স শেষ করেছি। পড়াশোনায় বরাবর অমনযোগী ছিলাম। এসব পলি*টিক্সই আমাকে টানতো বেশি। বাকিটা তো বাবাকে দেখেই আগ্রহ পেতাম।"
আতাউর আলম ম্লান হেসে বলে,"তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ধ্বস কিন্তু আমার জন্য নেমেছিলো। জানো তুমি?"
_না, এটা ভুল কথা। বাবার পিঠ পিছে তার ভাইয়ের কু-কীর্তি আর ইলহামের জন্য বাবা তার পজিশন খুইয়েছে,আমি বরাবর এটাই মেনে এসেছি। আপনি সাংবাদিক, আপনার কাজই তো সত্যি তুলে ধরা।
আতাউর আলম বলে,"আসল কথায় আসি। সরকারি ফান্ড সিন্ডি*কেটের আর্টিকেল টা আমি লিখেছি, ছাপিয়েছি। এই ব্যাপারে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে?
সামিন আতাউর আলমের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,"আপত্তি কেনো থাকবে? আপনি কি ভাবছেন সিন্ডি*কেটের সাথে আমি জড়িত? মেয়ে জামাই হিসেবে ছাড় দিতে চাচ্ছেন?
_ঠিক তা নয়।
আমতা আমতা করে বলে আতাউর আলম।
সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,"পুলিশ তদন্ত করবে, উপর মহল থেকে লোক আসবে, সত্যিটা সামনে আসবে। তেরো কোটি টাকা জনগণের জন্য ছিলো, আমার দলের কর্মীদের জন্য নয়। আমিও চাই এর একটা সুরাহা হোক।"
***
"আসতে গেলে কেন? আমি কি বাচ্চা? পথ চিনে আসতে পারিনা?"
ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ইশমাম। সামিন চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে বলে,"আমি তোদের তেমনটাই মনে করি!"
ইশমাম চুপ করে বসে থাকে। সামিন বলে,"আমিও তখন খুব ছোটো, মাকে দেখতাম তোদের ডায়াপার চেঞ্জ করে দিতে। আমি দুদিন ভালো করে লক্ষ্য করলাম, তারপর নিজেই চেষ্টা করলাম। সেই থেকে তোর আর ইশুর ডায়াপার চেঞ্জ করেছি। আমার কাছে এখনও মনে হয় তোরা অমনই।"
সামিনের কথায় ম্লান হাসে ইশমাম। তারপর বলে ওঠে,"বাড়িতে কে কে আছে এখন ?"
_তোর বড় ভাবী, মেজো ভাবী, ইহান। ইলহাম চিটাগাং গিয়েছে, ইশিতা ইউনিভার্সিটিতে।
_গাড়ি ডানে ঘোরাও ভাইয়া।
সামিন অবাক হয়ে বলে,"কেনো?"
_আগে বাবার কবর জিয়ারত করতে যাবো।
দুই ভাই চুপচাপ। ইশমাম বলে ওঠে,"বাবা বলতেন,আমি যেন তার জা*নাজায় অন্তত থাকি। সেটাও তো হয়নি। আমি কিন্তু বাবার অপদার্থ ছেলেই প্রমানিত হলাম ভাইয়া। বাবা খুব একটা মিথ্যা বলতেন না।"
সামিন কোনো জবাব দেয়না। গাড়ি ঘুরিয়ে তারা গ্রামের বাড়ির দিকে যায়। সেখানে দুই ভাই গোটা সকালটা কাটিয়ে আসে, তাদের বাবার সাথে।
গাড়ি শান্তিনীড়ের গেইট দিয়ে ভেতরে ঢোকে। কলিং বেল টিপে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আলো এসে দরজা খোলে, ইশমাম নিচু স্বরে আলোকে সালাম দিলে আলো সালামের উত্তর দেয়।
সামিন হাসতে হাসতে আলোকে বলে,"রান্না বান্না হয়েছে?"
আলো মাথা নাড়ায়।
_রান্নায় লবণ হয়েছে কিনা দেখেছো?
মাথা নাড়িয়ে আলো অস্ফুট স্বরে বলে,"দেখেছি।"
সামিন বলে,"ঠিকাছে,ও ফ্রেশ হলে ওকে খেতে দিও। প্লেনে কিছু খায়নি।"
আলো মাথা নাড়িয়ে ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম চুপচাপ সোজা হেটে সিঁড়ির কাছে যায়।
আলো রান্নাঘর থেকে সবকিছু নিয়ে এসে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখে। অনেক সময় নিয়ে সে এসব রান্না করেছে।
হুট করে সামিন তাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে। আলো চ'ম'কে ওঠে, নিচু স্বরে বলে,"ইহান বাড়িতে ছোটাছুটি করছে।"
সামিন হেসে আলোকে ছেড়ে দিয়ে মুখোমুখি দাঁড় করায়। তারপর আলোর চোখে চোখ রেখে বলে,"আজ তোমাকে একটু একটু গিন্নিদের মতো লাগছে।"
_একটু একটু? পুরোপুরি নয় কেনো?
সামিন হেসে আলোর আঁচল টেনে মাথায় তুলে দিয়ে বলে,"কারন,এটা ছিলো না।"
***
"আমি আজ ও বাড়িতে একটু যেতে চাচ্ছি আবার। কিছু ঘন্টা থেকে চলে আসবো। জরুরি কিছু কাজ আছে।"
সামিন পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে আলোর দিকে তাকায়। আলো বলতে থাকে,"বিজনেস যেটা শুরু করেছিলাম সেটা আম্মুকে বুঝিয়ে দিয়ে আসবো। আরো দুজন লোক নেওয়া হয়েছে।"
_আমার শাশুড়ি হবে কোম্পানির নতুন ব্যাবস্থাপনা পরিচালক? বাহ , বেশ ভালো!
আলো হাসে। তারপর বলতে থাকে,"টিউশনি টা ছেড়ে দিয়ে খারাপ লাগছে খুব। দিদিমণি আজকেও ফোন দিয়েছিলেন।"
সামিন আলোর দিকে এগিয়ে আসে। জরিয়ে ধরে বলে,"খুব উপার্জন করতে ইচ্ছে করে?"
_হু।
আলো মৃদু স্বরে বলে। তারপর বলে ওঠে,"কতগুলো টাকা বেতন পেতাম জানেন? সাড়ে ছয় হাজার টাকা।
সামিন অবাক হওয়ার ভান ধরে বলে,"সাড়ে ছয় হাজার টাকা? বাবা! এতগুলো টাকা!"
আলো বুঝতে পেরে যায় সামিন তাকে খোঁচা মারছে, সে মুখ ভার করে বলে,"আপনার কাছে সাড়ে ছয় হাজার টাকা কিছু না কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছু। সপ্তাহে পাঁচদিন সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ছোটো ছোটো বাচ্চাদের পড়িয়ে মাস শেষে যখন টাকাগুলো পেতাম, তখন অন্যরকম একটা আনন্দ হতো মনে। ঐ সাড়ে ছয় হাজার টাকায় ভাই দুটোকে কত কি যে কিনে দিতাম! আব্বু তো ওদের এক একটা সাবজেক্টের টিউশন ফি দিতে দিতেই হিমশিম খেয়ে যেত, ওদের শখ পূরণ করতো কখন! "
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। কপালের কাছে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলে,"আমার কাছে একটা চাকরির অফার আছে। একটা এজেন্সি চালাতে হবে। সপ্তাহে তিনদিন, সন্ধ্যা ছয়টা থেকে-রাত আটটা বসলেই হবে। বেতন আট হাজার টাকা। করবে চাকুরী টা? নতুন এজেন্সি তাই মালিক এর থেকে বেশি বেতন দিতে পারবে না।"
আলো অবাক হয়ে তাকায় সামিনের দিকে। তারপর বলে,"এজেন্সি?কি এজেন্সি? কোথাকার এজেন্সি?"
সামিন মৃদু হেসে তার ল্যাপটপ নিয়ে বসে, আলোকে কাছে টেনে পাশে বসিয়ে বলতে থাকে,"একটা এজেন্সি খুলেছি নতুন। প্রতিবন্ধী ও বিধবা নারীদের উন্নয়নে কাজ করবে। এছাড়াও গরীব স্টুডেন্ট যারা তুখোড় মেধাবী কিন্তু যাদের মেডিকেল কোচিং, ভার্সিটি কোচিং করার সামর্থ্য নেই তাদেরকে সাহায্য করা হবে। প্রাথমিক ভাবে এই দুটো প্র*জেক্ট হাতে নিয়েছি। এর বাইরে সামর্থ্য কিংবা অর্থায়ন নেই।"
আলো অবাক হয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক মূহুর্ত সময় নিয়ে বলে,"এসব কখন করলেন?"
_এই দুদিন এসব নিয়েই ছোটাছুটি করেছি।
আলো তাকিয়ে থাকে। সামিন হেসে বলে,"আট হাজার টাকার বেশি কিন্তু দিতে পারবো না। যদি অফারটা পছন্দ হয় তবে আমাকে তোমার সিভি দিও।"
_এতোকিছু কিভাবে ম্যানেজ করবেন? পারিবারিক ব্যাবসার টাকা তো আপনার একার না। আপনার ভাই বোনদের ও । এমনিতেই বেশ কিছু এজেন্সিতে দিচ্ছেন টাকা, এতিমখানা চালাচ্ছেন। নিজেকে কি রাজা রাম মোহন রায় ভেবে বসে আছেন?
সামিন হেসে ফেলে। তারপর হাসি থামিয়ে বলে,"কে বলেছে আমি সব টাকা দেবো। আমিও দেবো, তবে সামান্য। বাকিটা তুমি ম্যানেজ করবে।"
_আমি কিভাবে?
_প্রত্যেক মাসে এজেন্সি থেকে ক্যাম্পেইন করা হবে বিভিন্ন যায়গায়। কলেজ, ইউনিভার্সিটি তে। সেখান থেকে লোকজন যা দেবে, সেটাই ব্যায় হবে ।
আলো সবটা বুঝতে পেরে চুপ করে থাকে। সামিন বলে,"করবে চাকুরী টা? আমি বিশ্বস্ত আর পরিশ্রমী একজন কর্মী চাচ্ছি।"
_কিন্তু এভাবে সরাসরি নিজের বৌকে চাকুরী দেওয়া কি ঠিক? অন্যান্য বেকারদের তো হক আছে।
_স্বজনপ্রীতি করলাম। মাঝেমাঝে মেয়র একটু দূর্নীতি করবে না? একেবারে সৎ থাকলে কেমন দেখায়?
আলো হেসে ফেলে, তারপর বলে, "নাম কি আপনার এজেন্সির? আমি কাল সিভি জমা দেবো।"
সামিন কয়েক পলক আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"এজেন্সির নাম ইয়াসার-আলো ফাউন্ডেশন।"
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন তার স্ত্রীর হাতে চু*মু খেয়ে বলে,"শাহজাহানের মতো স্ত্রীর জন্য তাজমহল তো গড়তে পারবো না। আমি একটা চাকুরী দিলাম। তুমি খুশি আছিয়া?"
***
খাবার টেবিলে চার ভাইবোন মিলে হাসাহাসি করতে করতে খাচ্ছে। কতদিন পরে আবার তারা এক সাথে খেতে বসেছে।
আলো রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে। তার ইচ্ছে করছে না ভাই বোনদের মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে ঢুকতে। ভাইবোনদের নিজেদের কত কথা থাকতে পারে। সে বরং সবার খাওয়া হয়ে গেলেই খাবে।
সামিন আশেপাশে তাকিয়ে আলোকে ডাকতে থাকে। আলো ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। ইশিতা মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"তুমি রান্নাঘরে ঘাপটি মে'রে আছো কেনো ভাবী? এখানে আমরা কত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছি। তুমি শুনবে না?"
আলো কিছু বলতে যাবে তখন সামিন বলে,"বসো এখানে, রিতু খেয়েছে, আমরাও খাচ্ছি। তুমি অপেক্ষা করছো কিসের?"
আলো বাধ সাধতে যাবে তখন সামিন একটা চেয়ার টেনে বলে,"বসো।"
আলো বসে পরে। ইশমাম খাবার নাড়াচাড়া করতে থাকে। হঠাৎ সামিন সবার মুখের দিকে তাকিয়ে খেতে খেতে বলে ওঠে,"এখানে সবাই যখন আছি তাহলে আমি কথাটা বলি। তোদের সবাইকে তো সবসময় পাওয়া যায় না।"
আলো মাথা তুলে তাকায়। এই লোক এখন কি বলবে! ইশমামের বিয়ের কথা নাকি! তাহলে তো এখানে আবার ঠান্ডা যু*দ্ধ লেগে যাবে! আলো অনুমানের উপর ভিত্তি করে সামিন কে থামিয়ে দিয়ে বলে,"খাওয়া শেষ করে বলুন।"
সামিন আলোর কথা গায়ে না মেখে বলতে থাকে,"আমি আর ইলহাম একটা মেয়ে পছন্দ করে রেখেছি ইশমামের জন্য।"
ইশমাম খাওয়া থামিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকায়। ইশিতা আনন্দিত গলায় বলে,"তাই নাকি! ঐ ফিহা বলে মেয়েটা তাই না? সি ইজ ঠু মাচ কিউট ভাইয়া। বেশ মানাবে ওদের।"
সামিন খুশি খুশি গলায় বলে,"হ্যা তোর বড় ভাবীও ওকে পছন্দ করেছে।"
ইশমাম আলোর দিকে তাকায়। আলো মাথা নিচু করে ফেলে। চোখ ঘুরিয়ে ইশমাম বড় ভাইয়ের দিকে তাকায়। সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,"কি? এভাবে দেখছিস কি? গ্লাস ভেঙে হাত কা*টবি?"
একটা গ্লাস ইশমামের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,"নে, এটা ভেঙে ফেল।"
ইশমাম ঠান্ডা গলায় বলে,"কেনো? আমাকে নিয়ে পরেছো কেনো? ভাইয়া, ইশিতা মেয়ে, ওর বিয়ের ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে আমাকে নিয়ে পরেছো কেনো?
ইশিতা চেঁচিয়ে ওঠে,"তুই নিজে বাঁচতে আমার কথা ওঠাচ্ছিস কেনো ভাই? আমার সাথে তোর কোন জন্মের শ*ত্রুতা?"
_তো তুই এতো খুশি কেনো আমার বিয়ে নিয়ে? তোর এতো আনন্দ কিসের?
মুহুর্তেই ঝ*গড়া লেগে যায় দুজনের মধ্যে। আলো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। এরা এখনো এভাবে চুলো*চুলি করে! কি অদ্ভুত!
ঝগড়ার এক পর্যায়ে ইশমাম ইশিতাকে বলে ফেলে,"এখনো তো তুই বেকার বেকার ভাইদের ঘাড়ে খাচ্ছিস। না চাকরির চেষ্টা করছিস! না বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছিস! তুই আমার লাইফ নিয়ে এতো মাথা ঘামাচ্ছিস কেন!"
সামিন ইশমামকে ধ*মক দিয়ে থামিয়ে দেয়। ইশিতা কিছুক্ষণ ইশমামের দিকে তাকিয়ে থেকে পানির গ্লাস উঠিয়ে ইশমামের মুখে ছুড়ে দেয় পানি। তারপর গটগট করে হেঁটে দোতলায় উঠে যায়। ইশমাম চুপচাপ খেতে থাকে ভেজা অবস্থাতেই। তারপর খাওয়া শেষ করে উঠে চলে যায়, ইশমামের পিছু পিছু উঠে চলে যায় ইলহাম। খাবার টেবিলে বসে থাকে আলো এবং সামিন।
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"কি দরকার ছিলো?"
সামিন হাত ধুয়ে উঠে পরতে পরতে বলে,"আমি হাল ছাড়বো না।"
টেবিল পরিষ্কার করে আলো দোতলায় উঠে দেখে ইশমাম আর ইশিতা বসে বসে ক্রিকেট ম্যাচ দেখছে! আলো বেশ অবাক হয়। এই মাত্রই তো দুটোতে হাতা*হাতি, মারা*মারি করছিলো! এরই মধ্যে মিল হয়ে গেল!
এরা চার ভাইবোন খুবই অদ্ভুত!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আলো ঘরে চলে যায়। বিছানায় বসে বই টা মাত্র হাতে নিয়েছে একটা ড্রামায় চোখ বুলাবে বলে, তখনই সামিন বারান্দা থেকে এসে আলোর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। চোখ দু'টো বন্ধ করে রেখেছে সে। আলো নাক কুঁ'চকে বলে,"সিগারেট খেয়েছেন? বাহ! এই চমৎকার গুন সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম না!"
_রা'গ করলে? বছরে দুই টা খাই। এই আজ একটা খেয়েছি, আরেকটা ছয়মাস পরে খাবো।
আলো ঠান্ডা গলায় বলে,"না রাগ করবো কেনো? আমার তো এতো খুশি লাগছে, এতো খুশি লাগছে যে খুশিতে ইচ্ছে করছে আপনাকে ঘর থেকে বের করে দেই।"
সামিন মৃদু হেসে বলে,"মাথার চুল টেনে দাও।"
_মামার বাড়ির আবদার গুলো করতে বেশ পারেন মেয়র সাহেব।
_আবদার নয়, স্ত্রী হবার এগারো তম শর্ত। নাও, চুল টেনে দাও। বত্রিশ বছর হয়ে গিয়েছে আমার, আর দু'বছর পরেই টাকলা হতে শুরু করবো। তখন স্বামীর চুল টেনে দেওয়ার জন্য মেঝেতে শুয়ে গড়াগড়ি করে কাদলেও চুল পাবে না। এখন মন ভরে টেনে রাখো বৌ !
***
কমলা রঙের শাড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকে আলো মুচকি হেসে শাড়িটা হাতে তুলে নেয়। লোকটা একটা আস্ত পাগল। আলমারি ভর্তি শাড়ির প্রায় অর্ধেক শাড়িই কমলা রঙের। কি পেয়েছে এই রঙটাতে সে! আর কোনো রঙে বুঝি আলোকে মানায় না!
আঁচল গাঁয়ে জরিয়ে নিয়ে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়। সামিন বিছানায় আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কিছু টাইপ করছিলো। আলো সামিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মৃদু আওয়াজ করে গলা খাঁকারি দেয়। সামিনের কোনো হেলদোল নেই। সে একমনে ল্যাপটপে কিছু একটা দেখছে। আলো মাথা থেকে তোয়ালে খুলে ফেলে বলে,"শুনছেন। আমাকে কেমন লাগছে?"
সামিন আলোর দিকে না তাকিয়েই ল্যাপটপে টাইপ করতে করতে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলে ,"হু, সুন্দর লাগছে।"
_আরে দেখে বলুন না!
_ব্যস্ত আলো। পরে দেখবো, যাও।
আলো মাথা ঘুরিয়ে সামিনের দিকে তাকায়। তারপর কন্ঠে এক রাশ অভিমান মিশিয়ে বলে ওঠে,"এমনটা তো আমি শুরুতেই আন্দাজ করেছিলাম। বাংলাদেশের ছেলেদের এটা একটা নীতি, শখের নারী প'টে গেলে তখন আর পাত্তা দিতে ইচ্ছে করে না।"
সামিন কিছুক্ষণ কিবোর্ডে টাইপ করে আলোর দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"আমি পাত্তা দেয়া শুরু করলেই তো বলে দেবে, ছাড়ুন ছাড়ুন তরকারি পু'ড়ে যাচ্ছে, ইহান আসছে, জাপানে টর্নেডো হচ্ছে, পৃথিবী উল্টে যাচ্ছে। এখন ড্রামা না করে যাও। আমি সত্যিই ব্যাস্ত আছিয়া!"
আলো শীতল চোখে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোর দিকে না তাকিয়েই বলতে থাকে,"স্ত্রী হবার বারো তম শর্ত হচ্ছে, স্বামী ব্যস্ত থাকলে তার জন্য চমৎকার এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এসে তাকে দেওয়া। তার পাশে বসে তার কাঁধে মাথা রাখা, এবং অবশ্যই মুখে তালা লাগিয়ে রাখা যাতে স্বামীর কাজে কোনো অসুবিধা না হয়।"
আলো বিরস মুখে রান্নাঘরে ঢুকে কফির জন্য পানি গরম করতে থাকে। সিতারা অবাক হয়ে বলে,"কি হয়েছে ভাবী? মুখ শুকনো কেনো আপনার? কিছু হয়েছে?"
আলো কপাল কুঁচকে বলে,"বলো তো সিতারা পৃথিবীতে সবথেকে পল্টিবাজ প্রানী কোনটা? মানে দ্রুত রং বদলায় কারা?"
সিতারা বলে,"গিরগিটি ভাবী।"
আলো মাথা নাড়িয়ে বলে,"হয়নি।"
সিতারা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে,"তবে কি বাংলাদেশের নেতা-খাতারা?"
_হয়নি,তাদের থেকেও পল্টিবাজ।
সিতারা বলে,"বুঝতে পারছি না ভাবী। আপনি বলেন।"
_সেই প্রানীর নাম হলো স্বামী। এরা প্রথম প্রথম একরকম থাকে, পরে রূপ বদলে ফেলে।
সিতারা মাথা ঝাঁকিয়ে আলোকে সমর্থন করে বলে,"ঠিক বলেছেন ভাবী,এরা মিনিটে মিনিটে পল্টি নেয়। ঘরভর্তি মানুষের সামনে বৌকে ধ'ম'ক দিয়ে বীরপুরুষ সাজে আর রাত বারোটার পরে এসে বৌয়ের হাত পা ধরে মাফ চায়। আমি ভুক্তভোগী ভাবী!
আলো শুকনো মুখে বলে,"হু, আমারো সেদিন আসতে চলেছে সম্ভবত!"
***
অফিস ঘর টা বেশ পছন্দ হয়েছে আলোর। সামিন সম্ভবত তার জন্যই এতোটা শৌখিন ভাবে সাজিয়েছে ঘরটাকে। নয়তো লোকটা তো পুরো অগোছালো একটা লোক।
সপ্তাহে তিনদিন তাকে এজেন্সির এই অফিসে বসতে হয়। রবি,মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার, এই তিনদিন হচ্ছে তার অফিস টাইম। আলো প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিলো। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে আটটা কোনো অফিস টাইম নাকি! পরে জেনেছে সামিন তারজন্য এমন একটা নিয়ম করে রেখেছে। যাতে সে ইউনিভার্সিটি যেতে পারে এবং অফিসেও থাকতে পারে। বড় কথা হচ্ছে সামিন নিয়মিত আলোকে এজেন্সি থেকে নিয়ে যায়।
আপাতত চারজন ছাত্র ছাত্রীকে মেডিকেলের এডমিশন যু*দ্ধে অংশ নিতে কোচিং করার যাবতীয় খরচ দেওয়া হয়েছে, সবাই চাষাভুষা পরিবারের, ঠিকমতো খেতে পারে না। এবং এটা সম্পূর্ণ সামিন দিয়েছে। তাদের ফান্ডে এখনো দানের অর্থ জমা হতে শুরু করেনি।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আলো উঠে দাঁড়ায়। প্রায় রাত আটটা বেজে গিয়েছে। সামিনের এখনো আসার নাম নেই। হয়তো কোনো কাজে আটকে গিয়েছে। সামিনের পার্টি অফিস থেকে এজেন্সির দূরত্ব পায়ে হেঁটে দশ মিনিট। আবাসিক এলাকা তাই জায়গাটা একটু নির্জন। অফিসের সহকারী মেয়েটিকে বিদায় দিয়ে আলো দাড়োয়ান চাচাকে বলে তালা লাগিয়ে দেয় অফিস ঘরটিতে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ সে গিয়ে সামিনকে চ'ম'কে দেবে পার্টি অফিসে। ছাতা হাতে নেমে পরে আলো, বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। লোকজন নেই কোন রাস্তায়। দূরে একটা মাইক্রো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আর মাঝে মাঝে দুয়েকটা ট্রাক চলে যাচ্ছে।
আলো এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনে দুই পা বাড়াতেই হঠাৎ মৃদু গোঙানির আওয়াজ শুনতে পায়। মনে হচ্ছে কারো মুখ চেপে ধরা হয়েছে। হঠাৎ আলোর ভেতরটা কেমন কেঁ*পে ওঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে ভালো করে দেখতে থাকে সে। কোথাও কিছু নেই একটা মাইক্রো গাড়ি ছাড়া। হঠাৎ একটা যাত্রীবাহী অটোরিকশা চলে গেলো আলোর সামনে দিয়ে। আলো ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে ঘুরে আবারও সামনে পা বাড়ায়। আবারও সেই গোঙানির আওয়াজ শুনতে পায় সে।
থেমে যায় আলো, মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে কোথা থেকে একজন লোক ছুটে এসে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মাইক্রো গাড়িতে উঠে পরে। ল্যাম্পোস্টের ঘোলাটে আলোতে একপলকের জন্য আলো লোকটার মুখটা দেখতে পেলো। কিছু একটা অনুমান করার আগেই গাড়িটা সাই সাই করে আলোর সামনে দিয়ে চলে যায়। তখনই কোনো মেয়েলি কন্ঠের কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় সে।
আলো হতভম্ব হয়ে তাকায় সেদিকে। মাথা কাজ করছে না তার। ফোন বের করে গাড়িটার নাম্বার প্লেটের ছবি তুলে এদিকে ওদিক তাকিয়ে লোকজন ডাকতে থাকে আলো। খুব কাছেই কুরিয়ার সার্ভিসের একটা অফিস। সেখান থেকে দাড়োয়ান সহ বেশ কিছু কর্মচারী ছুটে আসে।
আলো কাউকে পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় না। হাল ছেড়ে দিয়ে অটোতে উঠে সামিনের পার্টি অফিসে চলে যায়।
সামিন ইয়াসারের পার্টি অফিসে সালিশ বৈঠক বসেছে আজ। দু'টো ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষ নিয়ে সালিশ বিচারের বৈঠক।
আলো গেইট থেকে দ্রুতপায়ে বৈঠক খানা হয়ে সোজা সামিনের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সামিন সালিশ রেখে উঠে দাঁড়িয়ে আলোকে নিয়ে নিজের ঘরটাতে আসে, ধ'ম'কে'র সুরে বলে,"সাহস ভালোই তোমার। বলেছি না আমি না যাওয়া পর্যন্ত বের হবে না একদম। এতো তা*ড়া ছিলো ফোন দিতে গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।"
_আমি ফোন দিয়েছি আপনি ফোন ধরছিলেন না।
সামিনের মনে পরে যায় সে সালিশের জন্য ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলো। তারপর বলে ওঠে,"তো? ইশমামকে ফোন দিতে, ও এসে নিয়ে যেতো।"
আলো সামিনের কথার জবাব না দিয়ে বলে ওঠে,"বাদ দিন। আমার কথা এখন মন দিয়ে শুনুন। আমার সাথে একটু থানায় যাবেন চলুন।"
সামিন অবাক হয়ে বলে ,"থা*নায় কেনো?"
আলো সব ঘটনা খুলে বলে সামিনকে। সব শুনে সামিন পাত্তা দেয়না প্রথমে, মজার ছলে বলে,"হয়তো কোনো অদ্রিতা আলোকে কোনো সামিন ইয়াসার তুলে নিয়ে গেছে। "
আলো রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। চেঁচিয়ে উঠে বলে,"আমি মজা করছি না, এই দেখুন গাড়ির নাম্বার প্লেট।"
সামিন আলোর ফোনে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,"এটা তো জাবিরের গাড়িটা,ও এই গাড়িটা ব্যাবহার করে।"
আলো চাঁপা স্বরে চেঁ'চি'য়ে ওঠে,"হ্যা হ্যা। আমার মনে পরেছে। ঐ লোকটার মুখ আমি দেখেছি। ঐ লোকটা জাবির ছিলো। জাবিরই ছিলো।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,"চলুন মেয়র সাহেব। আমার মনটা কেমন কু গাইছে। আমি স্পষ্ট শুনেছি সেই নারীকন্ঠের আর্তনাদ!"
"কি'ড'ন্যা'পিং কেইস মনে হচ্ছে?"
আলো সমীর দত্তের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলে,"জি। আমি স্পষ্ট শুনেছি। একটা মেয়ের চাঁপা আর্তনাদ।"
সমীর সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বলে,"গাড়িটা জাবিরের।"
সমীর দত্ত চিন্তায় পরে যায় । কপাল কুঁচকে বলে,"কিন্তু আমাদের কাছে না কোনো মিসিং ডায়েরি এসেছে, না অন্যকোন অভিযোগ। এভাবে আন্দাজের বশে কাউকে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা, তাও কবীর আলমগীরের ভাগ্নে! তোরা মানহানির মা'ম'লা খেয়ে যাবি! "
সামিন মাথা নেড়ে বলে,"বুঝতে পেরেছি ব্যাপারটা! আমি শুধু তোকে ব্যাপারটা ইনফর্ম করতে এসেছি।"
সমীর দত্ত মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দেয়,"বেশ করেছিস! বিষয় টা মাথায় থাকলো। তেমন কিছু টের পেলে আমি অবশ্যই এ'ক'শন নেবো।"
থানা থেকে রাত সাড়ে নয়টায় বের হয় সামিন এবং আলো। আলো মাথায় শাড়ির আঁচল তুলেছে। গাড়ির কাছে এসে সামিন আলোর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ক'ট'ম'ট দৃষ্টি দেয় আলোর দিকে। আলো ঘা'ব'ড়ে যাওয়া মুখ করে বলে,"কি হয়েছে? আমি আবার কি করলাম? এখন আমাকে চোখ রা'ঙা'চ্ছে'ন কেন?"
_আর যদি কখনও আমি দেখি বেশী পাকনামি করে আমাকে না বলে অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। আমি খুব রেগে গিয়েছি তোমার উপর আলো। আমি ছাড়া অফিস থেকে একপাও বাইরে দেওয়া যাবে না। এমনটা কথা ছিলো না? সব সময় একটু বেশি বুঝতেই হবে?
আলো বলে,"আমি তো আপনার দেরী হচ্ছিল দেখে!"
সামিন প্রচন্ড রে'গে গাড়িতে উঠে বসে। আলো চুপচাপ পাশে বসে সামিনের দিকে তাকায়। মানুষ টা অস্বাভাবিক রে'গে গিয়েছে। এখন কিভাবে রা'গ ভাঙাবে তার!
বাড়িতে এসেও প্রচন্ড গম্ভীর হয়ে থেকেছে সামিন। খাবার টেবিলে চুপচাপ খেয়ে উঠে গিয়েছে। আলোর এবার খুবই বিরক্তি লাগছে। সামান্য অ'প'রা'ধের এমন শা'স্তি হতে পারে না!
বিছানায় বসে কিছু কাগজপত্র দেখছিলো সামিন। আলো সামিনের রাগ ভাঙানোর জন্য এসে তার পাশে বসে কাঁধে মাথা রাখে। সামিন কোনো কথা বলে না। আলো নরম গলায় বলে,"সরি! আর করবো না এমন পাকনামি!"
_সরি বলার কিছু নেই। কাল থেকে এজেন্সিতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যা টাকা লাগবে আমাকে বলবে, ঐ টাকা দিয়ে ইচ্ছামত ভাইদের এটা সেটা কিনে দেবে।
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিনের গালে হাত রেখে মুখটা আলোর দিকে ঘুরিয়ে বলে,"আচ্ছা সে দেখা যাবে। আগে আপনি মুড ঠিক করেন প্লিজ! এভাবে দেখতে ভালোলাগছে না আপনাকে!"
সামিন আলোর দিকে তাকায় ঠিকই কিন্তু মুখটা এখনও গম্ভীর করে রেখেছে। আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিচু স্বরে বলে,"রাগ কিভাবে কমবে? কি করতে হবে?"
সামিন চুপচাপ তাকিয়ে থাকে আলোর দিকে। আলো মাথা নিচু করে বলতে থাকে,"বলুন? কি করতে হবে? কমলা রঙের একটা শাড়ি পরে আসলে রা'গ কমবে?"
সামিন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"কমবে।"
***
শান্তিনীড়ের পরিবেশ টা থমথমে হয়ে আছে। একটা বড় সর ঝড় চলে গেলে প্রকৃতি যেমন নিস্তব্ধ হয়ে যায়, ঠিক তেমনি হয়ে আছে পরিবেশ। ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছে দোতলার লিভিং রুমে, ইশমাম নিজের ল্যাপটপে প্র'জেক্ট নিয়ে কাজ করছিলো। সামিন এসে তাকে জানায় আজ বিকেলে একজন মেয়ের সাথে দেখা করতে যেতে হবে তাকে। রেস্টুরেন্টে টেবিল বুক করে রেখেছে সে। ইশমাম কিছু না বলে উঠে যেতে নিচ্ছিলো তখনই সামিন রাগের মাথায় এটা ওটা ভা'ঙচুর শুরু করে দেয়। ভাইয়ের প্রতি পাল্টা রা'গ দেখাতে না পেরে ঘরে ঢুকে নিজেও জিনিস পত্র ভাঙতে শুরু করে ইশমাম। সামিন চেঁচিয়ে যাচ্ছে,"তোর সমস্যা কোথায় আমি দেখেই ছাড়বো। আজকে তুই যাবি রেস্টুরেন্টে। যাবিই।"
দুই ভাই তাদের নিজেদের ঘরে বসে মে'জা'জ দেখাচ্ছে। আলো এবং বাকিরা দোতলার লিভিং রুমে দাড়িয়ে আছে অপ্রয়োজনীয় রেফারি হয়ে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আলো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে। সামিন শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে,"বলে দিও তোমার দেবরকে। বিকাল চারটায় দেখা করতে হবে। মেয়ের সাথে মেয়ের বড় ভাই আর ভাবী থাকবে। আর ইশমামের সাথে তুমি আর ইশিতা যাবে। আমি কিছুক্ষণ পরে জয়েন করবো সময় বের করে। আমি ওনাদের ফোন করে ফাইনাল করে দিচ্ছি।"
আলো আমতা আমতা করে বলে,"এভাবে ওর পারমিশন ছাড়াই ফাইনাল করে দেবেন? ও যদি না যায় তাহলে তো আপনার সম্মান ন'ষ্ট হবে।"
_যাবে, ওর ঘাড় যাবে।
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,"বলছিলাম। আমি একটু কথা বলে দেখবো?"
সামিন ওয়ালেট আর ফোন হাতে তুলে নিয়ে আলোর গালে হাত বুলিয়ে যেতে যেতে বলে,"দেখতে পারো। তবে ওকে বলে দিও। যেতে কিন্তু হবেই!"
***
আপাতত কোনো ভাঙচুরের শব্দ শোনা যাচ্ছে না। আলো পা টিপে টিপে ইশমামের ঘরের দিকে অগ্রসর হয়। দরজা ভেজিয়ে রাখা। হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দেয় সে। ইশমাম কপালে একটা হাত রেখে ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে ছিলো। কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে ঘুরে তাকাতেই আলোকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। আলো ইশমামের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশমাম চেঁচিয়ে ওঠে,"স্বামীর হয়ে ওকালতি করতে এসেছো? যাও এখান থেকে!"
আলো চলে যায় না। একটা চেয়ার টেনে বসে পরে, ইশমামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশমাম রাগী গলায় বলতে থাকে,"শোনোনি আমার সিদ্ধান্ত? যাও, তোমার স্বামীকে গিয়ে বলে দাও।"
_কেন করছো এমন?
আলো ঠান্ডা গলায় জানতে চায়। ইশমাম কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলে,"বিয়ে করতে আগ্রহী নই। কতবার বলবো?"
_তোমার ভাইয়া তোমার ভালো চায় ইশমাম।
_ভাইয়া ভালো চায়,তুমি ভালো চাও,ইশু ভালো চায়,মেজো ভাইয়া ভালো চায়, মেজো ভাবী ভালো চায়। তোমরা সবাই ভালো চাও? শুধু আমিই আমার ভালো চাই না তাইতো? এটাই বলতে চাইছো?
_সেরকমই মনে হচ্ছে। নয়তো বিয়েতে আপত্তি করার কোনো কারণ দেখছি না।
ইশমাম আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে ,"একটা মেয়েকে চিনিনা জানিনা হুট করে তাকে বিয়ে করে নেবো? এটা ২০২৩ অদ্রিতা.......সরি ভাবী।"
আলো কয়েক মূহুর্ত চুপ থেকে বলে,"তো? চিনবে, জানবে, এজন্যই তো দেখা করতে বলা হচ্ছে। আগে কথা বলে দেখবে তারপর ভালো না লাগলে জানিয়ে দেবে, অন্য মেয়ে দেখা হবে।"
_পারবো না। আমার ইন্টারেস্ট নেই।
_পারবে। তোমার ভাইয়ার জন্য পারতে হবে।
_ভাইয়ার জন্য? ভাইয়ার খুশির জন্য আমি মনের বিরুদ্ধে একটা কাজ করবো?
_কেন? ভাইয়ার খুশির জন্য এর আগে তো অনেক কিছুই করেছো। তাহলে এখন এতো নাটক করছো কেনো?
কথাটা বলে আলো থামে, তারপর বলে ওঠে,"মেয়ের ফ্যামিলিকে আজ দেখা করার কথা জানিয়ে দিয়েছে তোমার ভাইয়া। বিকেলে তৈরি থেকো। আমি আর ইশিতা যাবো তোমার সাথে।"
_যা মন চায় করো।
কথাটা বলে ইশমাম হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরীর দিকে যায়।
পরী ছুটে আসছিলো, এবং কাকতালীয় ভাবে ইশমামের সাথেই ধাক্কা খেয়ে যায়। চোখ তুলে ইশমামকে দেখে একটা ঢোক গিলে নেয় পরী। তার কপাল এতোটা খারাপ কেন?
ইশমাম প্রচণ্ড রে'গে বলে ওঠে,"চোখ দুটো নিজে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারো না। ওই দু'টো দান করে দিলেই তো পারো কোনো অ'ন্ধকে!"
"কি হচ্ছে কি ইশমাম।"
পেছন থেকে ইশিতা ধ'ম'কে ওঠে। আলোও এসে সেখানে দাঁড়ায়। ইশমাম কাউকে পাত্তা না দিয়ে চুপচাপ চলে যায় সেখান থেকে। পরী দাঁড়িয়ে থাকে বোকার মতো। আলো এসে বলে,"ছুটছিলে কেনো? সবসময় এতো ছোটাছুটি করো কেন?"
_আমি ছাদে ছিলাম, বাবা তার কটেজ থেকে ডাকছিলো, ছুটে আসতে গিয়ে ধাক্কা লাগলো। বুঝতে পারিনি রামগরুরের ছানা বাড়িতে আছে, নয়তো ভুলেও দোতলায় উঠতাম না ভাবী।
মুখ কাঁচুমাচু করে বলে পরী। আলো মেয়েটিকে দেখে, অতিমাত্রায় সুন্দরী একটা মেয়ে। এমন সুন্দরী মেয়ে সে এই শহরে খুব কমই দেখেছে। পুরো কাশ্মীরের মেয়েদের মতো গাঁয়ের রং। সবদিক থেকে পারফেক্ট। শুধু একটু সরল আর ভীতু প্রকৃতির। আচ্ছা একে ইশমামের পাশে কেমন লাগবে?
কথাটি ভেবে আলো নিজেই নিজেকে শুধরে নেয়। তার মনে হওয়াতে কি যায় আসে! ইশমামের ভাইয়েরা আছে ইশমামের জন্য। তার আগ বাড়িয়ে এসব ভাবার দরকার কি!
***
ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে চলে যায়। আলো তার মুখোমুখি বসে থাকা মেয়েটিকে দেখতে থাকে। ইশমাম মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। মেয়ের ভাই আর ভাবী নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।
ইশিতা আলাপ চারিতা সহজ করার জন্য মেয়েটিকে বলে ওঠে,"তোমার সাবজেক্ট কি ফিহা?"
ফিহা বলে মেয়েটি মাথা তুলে তাকায় না। মাথা নিচু করেই অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়,"ইকোনমিক্স!"
_ইকোনমিক্স? আমিও তো ইকোনমিক্সের ছাত্রী!
আলো মেয়েটির থেকে চোখ সরিয়ে ইশমামের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,"কিছু জিজ্ঞেস করো।"
ইশমাম চোখ তুলে আলোর দিকে তাকায় । কোনো জবাব না দিয়ে আবারও মাথা নিচু করে বসে থাকে।
দীর্ঘসময় ধরে মেয়ের ভাই আর ভাবীর সাথে আলো এবং ইশিতা গল্প করতে থাকে। না ইশমাম মেয়েটিকে দেখছে না মেয়েটি ইশমামকে দেখছে। এমন সময় সামিন চলে এসে তাদের সাথে জয়েন করে। মেয়ের ভাই ভাবীর সাথে আড্ডা দিচ্ছে সে।
রেস্টুরেন্টের বিল মিটিয়ে দিয়ে সামিন ফিহার ভাই সুমনের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমার মনে হচ্ছে ওদের দুজনের নাম্বার এক্সেঞ্জ করা উচিৎ।"
_হ্যা অবশ্যই।
সুমন মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।
দু'জনের নাম্বার এক্সেঞ্জ করা হয়ে গেলে ফিহাকে নিয়ে তার ভাই ভাবী উঠে চলে যায় সামিনদের থেকে বিদায় নিয়ে।
কিছুক্ষণ পরে সামিনরাও উঠে পরে।
গাড়িতে সবাই প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। নীরবতা ভেঙে ইশিতা আলোকে বলে ওঠে,"ছবিতে যতটা মনে হচ্ছিল ততটা সুন্দর না তাই না বড় ভাবী?"
_তুমি এমন পাশের বাড়ির আন্টিদের মতো কথা বলছো কেনো ইশিতা আপু?
শুকনো গলায় আলো বলে ওঠে।
ইশিতা চুপ হয়ে যায়, আলো বলতে থাকে,"তেমন হলে তো আমিও সুন্দরী নই। গাঁয়ের রং তোমার ভাইয়ার মতো সুন্দর নয় আমার। আমাকে কিভাবে মেনে নিলে?"
সামিন ড্রাইভ করতে করতে আলোর দিকে তাকায়। ইশিতা চেঁচিয়ে ওঠে,"মোটেই না। আমার বড় ভাবী সুন্দরী। ভাইয়ার থেকেও সুন্দর তুমি।"
আলো ম্লান হাসে। সামিন, ইশিতা, আলো গাড়িতে ফিহা মেয়েটির সম্পর্কে টুকটাক আলোচনা করতে থাকে। ইশমাম গাড়ির জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে চুপচাপ। তার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে!
***
দোতলার লিভিং রুমের বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে আলো দৃষ্টি বাইরের দিকে দিয়ে রেখেছে। বাগানের ফুলগাছে ফুল ধরেছে, এখান থেকে বেশ লাগছে দেখতে। বাগানের উত্তর পাশের বিশাল আম বাগানে সব বারোমাসি আমগাছ। আমের মুকুল ধরেছে গাছগুলোয়।
হঠাৎ কোমরে পুরুষালি হাতের উষ্ণতা পেয়ে গোলগাল মায়াবী মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। আলো পেছন ফিরে না তাকিয়েই অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"কি চাই?"
কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে সামিন নরম গলায় বলে ওঠে,"পাত্তা দিতে চাই বৌকে।"
আলো বলে ওঠে,"কিন্তু বৌ এখন পাত্তা চাচ্ছে না।"
সামিন মৃদু হেসে আলোকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। লজ্জা পেয়ে আলো সামিনের শার্ট খামচে ধরে । অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"ইহান....."
_ইহান গার্ডেনে পোনা চাচার সাথে বল খেলছে, চুলায় কোনো তরকারি বসিয়ে আসোনি, জাপানে টর্নেডো হচ্ছেনা, পৃথিবীও উল্টে যাচ্ছে না।
আলোকে থামিয়ে দিয়ে বলে সামিন।
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে,সামিন আলোকে নিয়ে ঘুরে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই থ'ম'কে যায়। লিভিং রুমে ইশমাম,ইলহাম , ইশিতা,পরী চারজন খেলা দেখবে বলে বসেছিলো। তারা চারজন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। সামিন ভাই বোনদের সামনে থতমত খেয়ে আলোকে কোল থেকে ফেলে দেয়। মেঝেতে পরে মৃদু আর্ত*নাদ করে ওঠে আলো।
ইলহাম আর ইশমাম মাথা নিচু করে দুজনে দুদিকে চলে যায়। সামিন এদিক ওদিক তাকিয়ে আলোকে টেনে তোলে। আলো কাতরাচ্ছে। ইশিতা পরী এগিয়ে আসে আলোর কাছে। সামিন চুপচাপ ঘরের দিকে চলে যায়।
ইশিতা কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,"ব্যা*থা পেয়েছো ভাবী?"
লজ্জামাখা এবং যন্ত্র*নায় ফ্যাকাশে মুখটা তুলে ইশিতার দিকে তাকায় না আলো। মাথা নাড়িয়ে ঘরের দিকে যায়।
ইশিতা আর পরী একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উচ্চশব্দে হেসে ফেলে।
আলো ঘরে ঢুকতেই সামিন একটানে আলোকে আগলে নিয়ে ঘরের সিটকিনি তুলে দিয়ে নরম গলায় বলে,"ব্যা*থা পেয়েছো?"
আলো এক ঝটকায় সামিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে*মেগে বলে,"না আমি খুব আরাম পেয়েছি, ছাড়ুন আপনি।"
সামিন আহ্লাদী গলায় বলে,"সরি।"
আলো কোমরে হাত রেখে কাতরাচ্ছে। সামিন চিন্তিত মুখে আলোকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে,"সব ওদের কারনে, আমার ভাইবোন গুলোর কোনো কান্ডজ্ঞান নেই বুঝলে, দুপুর টাইমে কেউ টিভি দেখতে আসে? দুপুরে সবাই নিজেদের ঘরে একটু বিশ্রাম নেবে তা না!"
আলো চাঁপা স্বরে চেঁ'চি'য়ে বলে ওঠে,"ওদের কান্ডজ্ঞান নেই নাকি আপনার কান্ডজ্ঞান নেই? আচ্ছা আপনি কি এই প্রথম আমাকে কোলে তুলেছেন ওদের সামনে? এভাবে ফেলে দিলেন কেন ঢং করে।"
কা'তরাচ্ছে আলো। সামিন আমতা আমতা করে বলে,"আগেও কোলে তুলেছি তবে তখনকার সিচুয়েশন অন্য ছিলো। তখন তো রোমান্টিক হয়ে কোলে তুলিনি!"
আলো ক'ট'ম'ট দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। সামিন নরম গলায় বলে,"রাগ করো না প্লিজ। আমি হট ওয়াটার ব্যাগ নিয়ে আসছি।"
***
হন্তদন্ত হয়ে জাবির তার মামা কবীর আলমগীরের কক্ষে প্রবেশ করে। কবীর আলমগীর তখন খাদ্যমন্ত্রীর সাথে ফোনালাপে ব্যাস্ত ছিলো।
জাবির গম্ভীর মুখে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। জাবির এবং জুঁই নিঃসন্তান কবীর আর তার স্ত্রীর খুবই আদুরে।
কবীর জাবিরকে খেয়াল করেছে। খাদ্যমন্ত্রীর সাথে দীর্ঘ ফোনালাপ শেষ করে কবীর জাবিরের দিকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে কি হয়েছে তা জানতে চায়। জাবির চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"মামা তোমার পোষ্য সামিন ইয়াসার কি শুরু করেছে এসব? আমার মাথা গরম হয়ে গেলে কিন্তু ওর খুব খারাপ অবস্থা করে ছাড়বো ওকে বুঝিয়ে বলো।"
_কি করেছে?
ঠান্ডা গলায় জানতে চায় কবীর আলমগীর।
_কি করেছে? থানা থেকে এসআই নুরুল ফোন দিয়েছে, ও আর ওর বৌ গিয়েছিলো থানায় আমার নামে অভিযোগ করতে আমি নাকি কোন মেয়েকে তুলেছি আমার মাইক্রোতে।
_হোয়াট!
কবীর আলমগীর উঠে দাঁড়িয়ে যায়।
জাবির বলতে থাকে,"ঐ সমীর দত্তের কাছে গিয়েছিলো। মামা তোমাকে শুরু থেকে বলে এসেছি ওকে বের করো বের করো,তুমি শুনলে না, এখন ওর শশুর তোমার কাছা ধরে টান দিচ্ছে আর ওর বৌ আমাকে ফাঁসাতে চাইছে। তুমি ঐ সামিন কালসাপটাকে কেন এখনো গলাধা*ক্কা দিয়ে বের করছো না পার্টি থেকে।
কবীর আলমগীর চুপ করে থাকে। জাবির চেঁচাতে থাকে,"মেয়র মাই ফুট! ওকে বের করো, গতবার দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনের পরে যখন ওর পার্টি থেকে বের হবার কথা ছিলো তখন সবাই দরদ দেখিয়ে রেখেছিলে,এখন বোঝো। বোঝো ঠ্যালা!
_আচ্ছা বুঝবো, আগে বলো তুমি এমন কিছু করোনি তো?
জাবির থতমত খায়, চেঁচিয়ে বলে, "মামা প্লিজ!"
_আচ্ছা ঠিকাছে যাও! আমি দেখছি।
***
"আজ এতো তাড়াতাড়ি ফিরলেন যে।"
আলোকে পেছন থেকে আগলে ধরায় সামিনের উদ্দেশ্যে আলো বলে ওঠে। আলোর কানের কাছে মুখ নিয়ে সামিন অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"হঠাৎ খুব চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করছিলো বাড়িতে এসে।"
_কিন্তু এখন তো অমাবশ্যা, চাঁদ কোথায় পেলেন?
আলোর কথা শুনে সামিন হেসে ফেলে, আলোর নাক টিপে দিয়ে বলে,"তোমার ঐ স্টুপিড ধূসর রঙের চাদ দেখার আমার কোনো আগ্রহ নেই, আমি যে চাঁদের কথা বলছি তার নাম আলো, আমার আছিয়া।"
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"ইশশশ! এসব নব্বই দশকের বস্তা*পচা ডায়লোগ গুলো মুখস্থ করে রেখেছেন। আপনার ফ্লার্টিং স্কিল নেই বললেই চলে মেয়র সাহেব।"
_ভদ্র ভাবে প্রেম নিবেদন করেছি। একজন মেয়র কি সরাসরি বৌকে বলে দেবে আমি বৌটাকে চু*মু খেতে এসেছি ? এভাবেই তো বলবে। ভদ্রভাবে, মার্জিত ভাবে।
আলো লাজুক মুখটা নামিয়ে রাখে। সামিন থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে বলে,"বিশ্বাস করো। তোমাকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখলে আমার বুকে সূক্ষ্ম যন্ত্রনা হয়। আমি ম*রে যাই এক অদ্ভুত অনুভূতিতে।"
আলো প্রসঙ্গ পালটে বলে,"আজ জামিল ভাই আমাকে একটা শাড়ি পাঠিয়েছে ওনার ছেলেকে যে উপহার দিয়েছিলাম তার রি*টার্ন গিফট হিসেবে।"
_বেশ ভালো।
আলো একটু থেমে বলে ওঠে,"আপনি আমাকে কতকিছু দেন। আমি আপনাকে কিছুই দিতে পারি না। খারাপ লাগে।"
সামিন হেসে ফেলে, তারপর বলে,"দিও কিছু একটা কিনে, দিতে ইচ্ছে করলে ! "
_টাকা জমাচ্ছি আপনাকে উপহার কিনে দেবো বলে, স্বস্তা কিছু দেবো না।
_দামী কিছু দিতে চাও?
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে। আলো মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, "হু। আপনার পছন্দ মতো কিনে দেবো, কি দেবো বলুন।"
_কত টাকা জমিয়েছো এখন পর্যন্ত?
_আড়াই হাজার টাকা।
_কিন্তু আমার যা লাগবে তা তো এই টাকা দিয়ে কেনা যাবে না। অনেক দামী।
আলো অবাক হয়ে সামিনের দিকে তাকায় , তারপর বলে,"অনেক দামী কিছু? কি সেটা?"
সামিন তার স্ত্রীকে আগলে নিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,"একটা বাচ্চা।"
আলো মাথা নিচু করে রেখেছে। দীর্ঘসময় ধরে সে চুপচাপ। সামিন আলোর দিকে ঝুঁকে আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,"দেবে? অনেক দামী কিন্তু। বলো দেবে?"
লজ্জায় লাল হয়ে আলো শাড়ির আঁচল চেপে ধরে। সামিন আলোর কপালে একটা চু*মু খায়। তারপর ঘোর লাগা কন্ঠে বলে ওঠে,"স্ত্রী হবার তেরো তম শর্ত স্বামী এমন আবদার করলে তা আমলে নেওয়া। আশা করি আপনিও আমলে নেবেন।"
আলো ছুটে যেতে চাইলেও পারেনা। সামিন তার বলিষ্ঠ হাতে আলোকে ধরে রেখেছে । মৃদু স্বরে বলে,"লজ্জা পাও, আমার সামনে পাও। তোমার এই লাজুক মুখটা শুধু আমিই দেখবো।"
হঠাৎ সামিনের ফোন বেজে ওঠে , পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে সমীর দত্ত বলে ওঠে,"একটু থানায় আসতে পারবি ভাবীকে নিয়ে?"
_এখন? কেনো কি হয়েছে?
অবাক হয়ে জানতে চায় সামিন।
_আগে আয় তারপর বলছি।
সমীর ফোন কেটে দেয়। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"চলো। থানায় যেতে হবে আমাদের।"
***
সমীর দত্তের কক্ষে ঢুকে অবাক হয়ে আলো আশেপাশে তাকায়। দুজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা বসে আছে। ভদ্রমহিলা শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরে কাঁদছে। সমীর সামিন আর আলোকে বসতে বলে। সামিন বসে সমীরের দিকে তাকিয়ে বলে,"কি হয়েছে?"
_ওনারা এসেছে মি*সিং কম্প্লেইন করতে, ওনাদের মেয়ে কাল সন্ধ্যা থেকে মিসিং।
আলো আ'ত'ঙ্কিত মুখে ভদ্রমহিলার দিকে তাকায়। এই ভদ্রমহিলার মনের উপর দিয়ে কি বয়ে যাচ্ছে সে বেশ বুঝতে পারছে।
সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে সমীরের দিকে তাকায়। সমীর বলতে থাকে,"ওনার মেয়ে তোর এজেন্সির পশ্চিমে বয়েজ কলেজের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের গোপাল স্যারের কাছে টিউশন নিতে যেতো, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে সাড়ে সাতটা।"
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"আলোর ধারণা কি তবে ঠিক বলে মনে হচ্ছে?"
সমীর মাথা নাড়িয়ে বলে,"এখনো বলতে পারছি না। এভাবে অনুমানের ভিত্তিতে কিছু করাও যায়না। তবে ঐ মেয়ের বান্ধবীর থেকে একটা ক্লু পেয়েছি। জাবির মেয়েটাকে বিরক্ত করতো। আমার খুব রাগ উঠছে সামিন, জাবির আমাদের বয়সী। আর ঐ মেয়েটা, নাম অন্তরা, ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে। বাচ্চা বয়সী! "
আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"আমি একটু মেয়েটার ছবি দেখতে চাই।"
সমীর ছবি দেখায়। আলোর বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে, এই মেয়েটা ছিলো তবে! বাঁচার জন্য আকুতি করছিলো এই মেয়েটা! কী ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে!
অন্তরা নামের মেয়েটির মা কেঁদে যাচ্ছে। আলো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না শান্তনা দেওয়ার।
সমীর সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"তোরা বাড়ি যা। আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করবো এখন। তবে ভাবীকে আসতে হতে পারে আবারও। আমি কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস গেইটের সিসিটিভি ফু'টেজ চেক করেছি, ভাবী সত্যি বলছে ,ফু'টেজে ভাবীর মধ্যে অস্থিরতা দেখতে পেয়েছি। তবে মাইক্রো গাড়িটাতে কেউ ছিলো কিনা বোঝা যায়নি। মেয়েটাকে সম্ভবত গলির ভেতর থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে!"
সামিন মাথা ঝাঁকায়,বলে,"এনি টাইম! তুই শুধু ফোন দিস!"
***
সামিন আড়চোখে আলোর দিকে তাকায়। মেয়েটা পুরো রাস্তায় বিষন্ন থেকেছে। ঘরে এসেও চুপচাপ। আলোকে টেনে কাছে নিয়ে সামিন নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"খুব খারাপ লাগছে মেয়র সাহেব।"
_বুঝতে পেরেছি আমি।
আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সামিন বলে।
_ওনাদের মনের মধ্যে এখন কি বয়ে যাচ্ছে বলুন তো!
সামিন চুপ হয়ে থাকে। এমন পরিস্থিতির স্বীকার তো আলোও হয়েছিল, মেয়েটা হয়তোবা সেদিনের কথা মনে করে ভয়ে আরো তটস্থ হয়ে আছে।
পরম স্নেহে আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,"দোয়া করো তুমি মেয়েটির জন্য। কিছু হবে না।"
মনটা কেমন অশান্ত হয়ে আছে আলোর। সামিন বাতি নিভিয়ে দিয়ে আলোকে নিয়ে শুয়ে পরে। একটা অচেনা মেয়ের জন্য আলোর অস্বাভাবিক উৎ'কণ্ঠা দেখে তারও কষ্ট হচ্ছে খুব। মনে মনে সেও প্রার্থনা করছে মেয়েটির যাতে কিছু না হয়।
সমীর দত্তের মুখোমুখি বসে আছে কবীর আলমগীর। তার সামনে একটি চায়ের কাপ। সমীর ফাইল দেখতে দেখতে বলে,"কোনো প্রমাণ যে নেই এমনও তো না তাই না? প্রমান আছে। মেয়েটিকে আপনার ভাগ্নে বিরক্ত করতো, উ'ত্যক্ত করতো,হু'মকি দিতো। আর তাছাড়া একজন সাক্ষী পাওয়া গিয়েছে, যার চোখে কি'ড'ন্যাপিং এর আলামত ধরা পরেছিল।"
_কে সামিন ইয়াসারের বৌ? ওই মেয়েটা একটা উ'ন্মাদ তুমি জানো সমীর? কতটা প্রতি'হিংসা পরায়ণ একটা মেয়ে। ওর বাপ আমার পিছু লেগেছে আর ও অযথা ফালতু কথা র'টিয়ে যাচ্ছে। আর এতে মদদ দিচ্ছে আমার পোষ্য সামিন। হাহ, সামিন! কতবড় বেইমান। ওকে তো আমি পরে দেখে নেবো আগে তোমাকে কিছু কথা বলি সমীর। সামিনের কথায় তোমাকে আমি এই থানায় এনেছি। আমার মাথা গরম হয়ে গেলে কিন্তু তোমাকে সুদূর বান্দরবান ট্রান্স'ফার করে দেবো!
সমীর হালকা হাসে, তারপর বলে,"ভগবানের কৃপায় এ পর্যন্ত এসেছি আংকেল! তিনি যদি চান আমার নেক্সট পোস্টিং বান্দরবান হবে তাহলে আমি খুশি খুশি চলে যাবো। কিন্তু এখন আমাকে আমার কাজ করতে দিন। সমীর দত্ত এসবে ভ'য় পায় না।"
গভীর রাত। নিস্তব্ধ গোটা কলোনি। হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই সামিন চোখ খোলে। বুকের ওপর থেকে আলোর মাথাটা সরিয়ে বালিশে রেখে হাত বাড়িয়ে বেড সাইডের বাতি জ্বেলে দেয়। ড্রয়ারের ওপর থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে দেখে আতাউর আলমের ফোন। ফোনটা রিসিভ করতেই আতাউর আলম বলে ওঠে,"এতো রাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু জরুরি কথা ছিলো।"
_বলুন।
সামিন নিচু স্বরে বলে।
_আমার ধারণা ঠিক, পালের গোদা কবীর আলমগীর। নিজের পকেটে পুরেছে সাড়ে পাঁচ কোটি।
_প্রমান?
_হাতে আছে আমার। সামলে রেখেছি। তুমি বললে থা'নায় পাঠিয়ে দেই? কিংবা উপরমহলে?
_না, ওগুলো আপনার কাছে রাখুন। আমি সময় মতো চেয়ে নেবো।
আতাউর আলম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"আমার মেয়েটা কেমন আছ?"
_কেমন রেখেছি বলে মনে হচ্ছে?
আতাউর আলম হাসে। তারপর বলে,"একেবারে ভুলে গিয়েছে আমাদের। খুব হিংসা হচ্ছে। আচ্ছা রাখছি, ঘুমাও।"
আতাউর আলম ফোন কেটে দেওয়ার পাচ মিনিটের মধ্যে কবীর আলমগীরের ফোন আসে সামিনের ফোনে। আলোর মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে যায় , রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে কবীর আলমগীর বলে ওঠে,"দেখিয়ে দিলে অওকাদ। পেছন থেকে ছু'রি মারা। কিন্তু আমার আফসোস হচ্ছে সামিন, আমার পিঠে ছু'রি মারতে তোমাকে তোমার শশুর এবং বৌকে ব্যবহার করতে হচ্ছে। "
_ভুল বললেন আংকেল। আমি কাউকে ব্যবহার করে আপনার পিঠে ছু'রি মারিনি। ওটা আপনিই করেছেন। তেরো কোটি থেকে কয় কোটি পেয়েছেন ভাগে বলুন তো।
_শাট আপ সামিন । তোমার জন্য আমাকে টানা তিন ঘণ্টা থা'নায় কাটাতে হয়েছে, তোমার ঐ স্টুপিড বৌয়ের অযথা কৌতুহলের জন্য আমার ভাগ্নেকে জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে।
আলো কখন ঘুম থেকে উঠে সামিনের পেছনে দাঁড়িয়েছে সামিন টের পায়নি। সামিনের হাত থেকে ফোনটা কে'ড়ে নিয়ে লাউড স্পিকার অন করে দেয় আলো। কবীর আলমগীর বলতে থাকে,"সবসময় তোমাকে একটা সুযোগ দিয়ে এসেছি আমি। আজকেও দিতে চাচ্ছি। তোমার আন্টি তোমাকে খুব পছন্দ করে তাই। শোনো, কাল সকালে বৌ নিয়ে এসে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে। এবং থানায় গিয়ে তোমার বৌয়ের জবানবন্দি উঠিয়ে নেবে। নয়তো সামিন মনে রেখো খুব খারাপ হতে চলেছে সামনে। এবং প্রমিজ করছি, আই উইল ডেস্ট্রয় ইওর হোওল পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার। মেয়র তুমি পাঁচ বছরের জন্য, তারপর? দল ছাড়া ভাত পাবে কোথাও? কোথাও পাবে না। রাজনীতি একটা নোংরা নর্দমা সামিন। এখানে নামলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, বেশি নড়াচড়া করলে গন্ধ ছড়ায়, বিষাক্ত গন্ধ।"
আলো হুট করে ফোনটা কে'টে দিয়ে সামিনের দিকে তাকায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"তো? মেয়র সাহেব কি সিদ্ধান্ত নিলেন? বৌকে নিয়ে মাফ চাইবেন? দলে নিজের পজিশন টিকিয়ে রাখতে কত নেতা তো নিজের বৌকে বড় নেতার বিছানায় পর্যন্ত পাঠায়। আপনি না হয় মাফই চাইবেন।"
_আলো।
ধ'মকে ওঠে সামিন।
আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"সকালের অপেক্ষায় আছি আমি। একটু একটু করে যার প্রতি আস্থা জন্মেছে আমার মনে । যাকে নিজের অনূভুতির রক্ষক ভাবতে শুরু করেছি, আমিও দেখতে চাই সে কি স্টেপ নেয়। তার কাছে নিজের পজিশন বড় নাকি একটা অসহায় তুচ্ছ নির্দোষ মেয়ের ন্যায়বিচার। দেখতে চাই আমি!
ব্রেকফাস্ট টেবিলে সামিন শুধুমাত্র একটা রুটির অর্ধেক এবং কিছুটা সবজি খেয়ে উঠে পরে। আলো চুপচাপ পাশে বসে খাচ্ছিলো, সামিন কে দেখে বলে,"কফি টা খাবেন না?"
_ইচ্ছা করছে না। তুমি খাওয়া হয়ে গেলে ঘরে এসো, কথা আছে।
আলো সামিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন উঠে চলে যায়।
কি কথা আছে! সামিন কি তাকে ঐ কবীর আলমগীরের কাছে ক্ষমা চাইতে নিয়ে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে! খাবার টা আলোর গলা দিয়ে নামে না আর। হাত ধুয়ে উঠে পরে, দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে যায়।
ঘরে সামিন বিছানায় চুপচাপ বসে ছিলো। আলোকে দেখে বলে,"চলো।"
আলো অস্ফুট স্বরে বলে,"কোথায় যাবো?"
সামিন উঠে দাঁড়ায়,ওয়ালেট টা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে বলে,"কবীর আলমগীরের বাসভবনে।"
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,"তৈরি হও।"
_আপনি? আপনি শেষে....
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে আলো চুপ হয়ে যায়।
সামিন বলে,"এতো কথা না বলে তৈরি হও। এরপরে থানায় যেতে হবে আমাদের।"
_কি করবেন? মাফ চাইয়ে থানায় গিয়ে আমার স্টেটমেন্ট উঠিয়ে নেবেন? আমি সেদিন রাতে কিছু দেখিনি, কিছু শুনিনি, সব মিথ্যা?
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে, "রেডি হও।"
আলো দীর্ঘসময় ধরে সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে অভিমানী গলায় মৃদু স্বরে বলে,"চলুন। আমি তৈরি।"
গাড়িতে আলো নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে দৃষ্টি সামনের দিকে রেখে। সামিন আড়চোখে আলোর দিকে একপলক তাকায়। গাড়ি কবীর আলমগীরের বাসভবনের গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
লিভিং রুমে কবীর আলমগীর তার দলীয় সদস্যদের নিয়ে বসেছিলো। দাড়োয়ান এসে কানে কানে বলে,"স্যার! ইয়াসার মির্জা তার ওয়াইফ নিয়ে এসেছে।"
কবীর আলমগীরের মুখে হাসি ফোটে। দলের কর্মীদের দিকে তাকিয়ে গদগদ হয়ে বলে,"দেখেছো কত বাধ্য আমার পোষ্য সামিন? তোমরা শুধু শুধু ওকে নিয়ে টেনশন করো।"
তারপর দাড়োয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,"যাও । ওদের এখানে আসতে বলো।"
সামিন আলোর হাত ধরে হাঁটছে। আলো অভিমানী দৃষ্টিতে শুধু তার স্বামীকেই দেখছে। মানুষটাকে কি সে ভুল চিনলো তবে? এতোটাই ভুল?
সামিনকে দেখে কবীর আলমগীর একটা প্রশ্বস্ত হাসি দেয়। সামিন আলোর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে । কবীর আলমগীর বলে ওঠে,"এসো সামিন। নাস্তা করেছো? তোমার আন্টি আজ মাটন ভুনা আর পরোটা করেছে তুমি আসবে বলে, খেয়ে দেয়ে তারপর নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করবো। এসো, বৌমাকে নিয়ে এসো।"
_সমঝোতা মানে?
সামিন ঠান্ডা গলায় জানতে চায়। কবীর আলমগীর সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"এই কদিন যা পাগলামি করেছো তারজন্য মাফ চাইতে হবে। অনেকটা ইমেজ ন'ষ্ট হয়েছে আমার ।"
_কে মাফ চাইবে?
_তোমার বৌ।
সামিন বাঁকা হাসি হেসে বলে ওঠে,"মাফ? আমার বৌ কারো কাছে মাফ চাইবে না। "
আলো সামিনের দিকে মাথা তুলে তাকায়। কবীর আলমগীর শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। সামিন বলতে থাকে,"না আমার বৌ কারো কাছে মাফ চাইবে না স্টেটমেন্ট উঠিয়ে নেবে। ও যা দেখেছে, শুনেছে সবটা সত্যি। ও সেভাবেই সাক্ষী দেবে।"
_সামিন তুমি কিন্তু.....
_বললাম না আমার বৌ কারো কাছে মাফ চাইবে না? কথা কি কানে যায়নি?
চেঁচিয়ে ওঠে সামিন। দলীয় কর্মীরা সবাই আ'ত'ঙ্কি'ত মুখ নিয়ে সামিন ইয়াসারের হিং'স্র মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে।
জাবির তে'ড়ে আসে, দাঁত খিচিয়ে বলে,"তুই মামার সাথে এভাবে কথা বলছিস!"
_ওখানেই দাঁড়িয়ে যা, পুঁ'তে ফেলবো আমি।
ধমকে বলে ওঠে সামিন।
জাবির দাঁড়িয়ে পরে। সামিন কবীর আলমগীরের দিকে তাকিয়ে তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,"আমার বৌ তার স্টেটমেন্ট ফিরিয়ে নিয়ে মাফ চাইবে না, কারন মেয়েটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। আপনার গুণধর ভাগ্নের গাজীপুরের ফার্মহাউস থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তাকে। মেয়েটা বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে। আর দশমিনিটের মধ্যে পুলিশ আসছে আপনার ভাগ্নেকে এ্যা'রেস্ট করতে।"
কবীর আলমগীর জাবিরের দিকে তাকায়। জাবির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সামিন কবীরকে বলতে থাকে,"কি যেনো বলেছিলেন কাল রাতে? দল থেকে বের করে দেবেন, হ্যান করবেন ত্যান করবেন। আপনার নামে তো কেইস ফাইল হচ্ছে আংকেল। আগে নিজের গদি সামলান। "
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সামিন বলে ওঠে,"নিয়ে যাচ্ছি আমি আমার বৌকে দিয়ে পুনরায় সাক্ষী দেওয়াতে। কারো বুকের পাটা থাকলে সে যেনো সামিনের বৌকে কিছু করে। "
কবীর আলমগীর উঠে দাঁড়িয়ে যায়। সামিন আলোর হাত ধরে যেভাবে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিলো সেভাবেই টানতে টানতে নিয়ে চলে যায়।
পুরো রাস্তায় আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। সামিন গম্ভীর মুখে ড্রাইভ করছিলো। থানায় গিয়ে লিখিত বক্তব্য দিয়ে বেরিয়ে সোজা বাড়িতে যায় তারা। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সামিন আলোর দিকে তাকায়, গম্ভীর কন্ঠে জানতে চায় সামিন,"কি ভেবেছিলে? বৌকে দিয়ে মাফ চাওয়াবে সামিন ইয়াসার?"
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলতে থাকে,"আমার ভেবে খারাপ লাগছে তুমি এটাই বিশ্বাস করেছিলে। কাল রাত থেকে ঠেশ মে'রে মে'রে কত কথা শুনিয়েছো আমায়।"
_সরি।
আলো অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে। সামিন ধমক দিয়ে বলে,"কিসের সরি? দুম করে যা মুখে আসবে বলে দেবে, তারপর আবার সরি? দরকার নেই তোমার সরির।"
রাগে কাঁপতে কাঁপতে সামিন বারান্দায় চলে যেতে নিলে আলো সামিনের হাত টেনে ধরে। সামিন মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"কি?"
_কিছু বলতে চাচ্ছি আপনাকে মেয়র সাহেব।
সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে আলো অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে। সামিন তাকিয়ে আছে,বলে,"বললাম তো সরি বলতে হবে না, আপনার সাত খুন বরাবরই মাফ।"
আলো কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে মাতা নাড়িয়ে বলে,"না অন্যকিছু বলবো।"
তারপর আলো যে কাজটা সচারচার করে না সেটাই করে ফেলে। শক্ত করে সামিন কে জরিয়ে ধরে। সামিনের বুকে মুখ গুজে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,"আজ একটা কথা না বললেই নয় মেয়র সাহেব। কথাটা হচ্ছে,
শিরায় শিরায় রক্ত, আমি ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।"
***
"স্যার আপনার জামাই এসেছে।"
আতাউর আলম কলম থামিয়ে দেয়। মাথা তুলে তার জুনিয়রের দিকে তাকায়। জুনিয়র বলতে থাকে,"আপনার জামাই মানে মেয়র এসেছে।"
_ঠিকাছে। ভেতরে আসতে বলো।
জুনিয়র চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে সামিন ভেতরে ঢোকে। আশেপাশে তাকিয়ে সবকিছু দেখতে থাকে। আতাউর আলম বলে ওঠে,"বসো।"
সামিন একটা চেয়ার টেনে বসে পরে। আতাউর আলম বলে,"কি খাওয়াবো মেয়রকে? চা না কফি। দেখো জামাই হিসেবে আপ্যায়ন পেতে হলে তোমাকে আমার বাড়ি যেতে হবে।"
সামিন ম্লান হেসে বলে,"এক কাপ কফি।"
আতাউর আলম কফি আনতে বলে পিয়ন ছেলেটাকে। তারপর সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"রিটায়ারমেন্টের পরে এতো ভালো একটা চাকুরী পেয়ে যাবো আশা করি নি।"
সামিন ঘরের আশেপাশে তাকিয়ে বলে,"কাজ টা কি আপনার?"
_কাজ সামান্য, ছেলেপুলেরা চারিদিক থেকে খবর এনে দেবে। আমি সাজিয়ে লিখবো।
কফি এসে যায়। সামিন কফিতে চুমুক দিতেই আতাউর আলম বলে ওঠে,"তেরো কোটির তদন্ত এখনও চলছে। এই দেশের এই বিচার ব্যবস্থা দেখলে ইচ্ছে করে উ'গান্ডা যাই। প্রমান সব হাতে অথচ পিবিআই কানা কানা করছে। কবীরের থেকে পয়সা খেয়েছে কিনা! যাই হোক, ওর পদত্যাগ টা আমাকে শান্তি দিয়েছে। এখন তোমার চাচার মতো কানাডা যাওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই। তা ইলেকশন নিয়ে কিছু ভাবলে? মাসখানেক হয়ে গিয়েছে।"
_বুঝতে পারছি না। আমি কনফিউজড আসলে।
_আমার মতে তোমার এমপি ইলেকশন ল'ড়া উচিত। জনগন তোমাকে খুব করে চায়।
একটু থেমে আতাউর আলম বলতে থাকে,"তুমি রাজনীতির জন্য উপযুক্ত। আমি উপযুক্ত এইসব লেখালেখিতে। সবাইকে সবজায়গায় মানায় না। আমার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত টা ভুল ছিলো।"
সামিন চুপ। আতাউর আলম বলে ওঠে,"যাই হোক, একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই তোমায়। তুমি আমার মেয়েটিকে বেশি লাই দিও না। ভালোবাসো ঠিকাছে, তবে ওর মতো অপ্রতিরোধ্য জেদী মেয়েদের মাথায় ওঠানো ঠিক না। আমি লাই দিয়ে অনেকবার বিপদে পরেছি। তুমিও পরবে, ওর চালচলনে একটু লাগাম টানো।"
সামিন হেসে ফেলে, কিছুক্ষণ হেসে বলে ওঠে,"আপনি লাই দিয়ে বিপদে পরেছেন, ওকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারেননি সেটা বাবা হিসেবে আপনার ব্যার্থতা, আমি ওকে কোনো বিপদে পরতেই দেবোনা সেটা স্বামী হিসেবে আমার আত্মবিশ্বাস।"
আতাউর আলম ম্লান হেসে বলে,"খোঁচা মারছো?"
_মোটেও না।
মাথা ঝাঁকিয়ে বলে সামিন। আতাউর আলম বলে,"যাই হোক, তোমার শাশুড়ি মা টেনশন করে সবসময়। তাই তোমাকে বলা।"
_দ্যা গ্রেট সাহসী সাংবাদিক আতাউর আলম ছেলে মেয়ের বেলায় খুবই ভীতু।
মজার ছলে সামিন বলে। আতাউর আলম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,"সাহসী সাংবাদিকদেরও কখনো কখনো ভীতু হতে হয়। এটা তুমি এখন বুঝবে না, যখন বাবা হবে তখন বুঝতে পারবে।
কথাটা শুনে সামিন লজ্জায় গদগদ হয়ে যায়। মনে মনে বলে,"আমি তো সেটা বোঝার জন্য হলেও বাবা হতে চাই শশুর বাবা, আপনার পাষণ্ডী মেয়েই তো আমার চাওয়ার কোনো দাম দিচ্ছে না। সবসময় স্বামীর থেকে এক লাইন বেশী বোঝে এই মেয়ে।"
****
খোলা চুলে হাত বুলিয়ে সামিন বলে ওঠে,"আছিয়া!"
কয়েক মূহুর্ত পরে আলো অস্ফুট বলে,"হু।"
সামিন বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"তখন থেকে হু হা কি করছো?"
আলো কোনো জবাব দেয় না। তার হাতে একটা গিফট বক্স। সামিন উঠে বসে আলোর হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,"এটা কি?"
_ফুয়াদ ভাইয়া দিয়েছে আমাকে।
গিফট বক্সটা খুলে আলো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। একটা শোপিস। সাথে একটা চিঠি, চিঠিতে লেখা,
"ফুয়াদের তরফ থেকে এক উগ্রমেজাজী দম্পতিকে উপহার। ঝগড়া ঝাটি, মারামারি যাই করো না কেনো, দুজনে এটা কখনো ভেঙে ফেলো না। খবরদার!"
চিঠি পড়ে খিলখিল করে হাসছে আলো। আলোর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সামিন। আলো হাসি থামিয়ে বলে ওঠে,"এই ফুয়াদ ভাইয়াকে একটা রিটার্ন গিফট পাঠাতে হবে না মেয়র সাহেব?"
সামিন আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলোকে কাছে টেনে নেয়। বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বলে,"সবাইকেই রিটার্ন গিফট পাঠাচ্ছো দেখছি, এই যে আমি এতো গিফট দিয়েছি। আমার রিটার্ন গিফট কবে পাবো শুনি।"
আলো লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,"সত্যিই। আপনার গিফটের পরিবর্তে কিছুই দেয়া হয়না। নেক্সট মান্থের স্যালারি পেয়েই দেবো। একটা একটা করে সবগুলোর রিটার্ন গিফট দেবো। এই আলো কখনো কারো ঋন রাখে না মেয়র সাহেব।"
"বাবা,সব কিছু ফেরত দেবে?"
নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে সামিন।
_হুম।
মাথা নাড়ায় আলো।
_গিফটের বদলে রিটার্ন গিফট দেবে না হয় বুঝলাম। আর ভালোবাসার বদলে?
সামিন আলোর চোখে রেখে বলে। আলো অস্ফুট স্বরে বলে,"সেটাও তো ফেরত দেয়ার চেষ্টা করছি মেয়র সাহেব।"
_আর আদরের বদলে?
আলো মাথা নিচু করে ফেলে। সামিন তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,"আদরের বদলে একটা বেবী দেয়া যায় না?"
আলো সামিনের মুখ চেপে ধরে বলে,"চুপ করুন। সবসময় এমন অ'সভ্য অ'সভ্য কথা শুনতে ইচ্ছে করে না আমার।"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে তার মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে,"অ'স'ভ্য কথা কই বললাম? আচ্ছা ঠিকাছে , ভদ্রভাবে, মার্জিত ভাবে, সুশীল ভাবে বলছি।"
এতটুকু বলে সামিন থামে, তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,
" প্রিয়তমা বৌ, আমার চক্ষুশীতলকারিনী, আমার আছিয়া। আমি নিজের জীবনের পরিপূর্ণতা আনিবার লক্ষ্যে আপনার গর্ভস্থলে দশমাসের জন্য আমার একটি কন্যাসন্তান রাখিতে চাই। অনুগ্রহ পূর্বক যদি আমাকে অনুমতি দিতেন তাহলে আমি খুবই বাধিত থাকিতাম।"
আলো শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে বসে আছে। সামিন তাকে কাছে টেনে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে,"হয়েছে? ভদ্রতা বজায় থেকেছে? এখন আমার কথা টা একটু ভেবে দেখেন। প্রমিজ করছি, দশমাস পরে আমি বা আমার মেয়ে, আপনাকে একটুও জালাবো না।"
আলো চুপ করে থাকে স্বামীর বুকে মাথা রেখে। কয়েক মূহুর্ত সময় নিয়ে বলে,"কিন্তু আমি একটু সময় চাচ্ছি।"
সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কাতর কন্ঠে বলে,"এতেও অপেক্ষা করাবে? আমি আর কত ধৈর্য্য ধরবো?"
আলো নিশ্চুপ। সামিন আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,"ব্যাপার না। অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট হয়।"
দরজায় ধাক্কা পরে হঠাৎ। আলো সামিনের বুক থেকে মাথা তুলে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন উঠে বসে। ইলহাম বাইরে থেকে জোরে জোরে ডাকতে থাকে। সামিন বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"বয়স উনত্রিশ বছর হয়ে গিয়েছে এখনো ওর কান্ডজ্ঞান হলো না। কেমন বেয়াদব দেখো!"
আলো চোখ রাঙিয়ে বলে,"এভাবে বলছেন কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে হয়তো।"
কথাটি বলে আলো চুলে খোঁপা বেঁধে নিয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজার বাইরে ইলহাম দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনে ইশিতা।
সামিন উঠে দাঁড়ায়, অবাক হয়ে বলে,"কি হয়েছে? ইশিতা কাঁদছে কেন?"
ইলহাম চেঁচিয়ে বলে,"তোমার আদরের বোন আবার সেই ছেলের সাথে রেস্তোরাঁয় দেখা করেছে। আর আমাদের সাথে কি বলেছিলো? বলেছিলো রিলেশন নেই। বেয়াদব মেয়ে একটা।"
ইশিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সামিন ইশিতার দিকে তাকায়। ইলহাম বলতে থাকে,"ওর ফোনটা কেনো নিয়ে নিলে না। যারা বোঝালেও বুঝতে চাইবে না তাদের সাথে এমনটাই করা উচিৎ।"
সামিন ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,"ফোন দে।"
ইশিতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে,"ভাইয়া..."
সামিন ইশিতার হাত থেকে ফোনটা কে'ড়ে নিয়ে সজোরে মেঝেতে ছু'ড়ে মারে।
আলো চ'ম'কে ওঠে। রিতু এসে ইশিতার পাশে দাঁড়ায়। ইশমাম নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
সামিন হুট করে যে কাজটা কখনো করেনি সেই কাজটাই করতে যায়। আলো গিয়ে সামিনের হাত ধরে ফেলে, চেঁচিয়ে উঠে বলে,"ছোটো বোনকে শাসন করবেন ঠিকাছে, আপনার অধিকার আছে, তাই বলে আমার আর রিতুর সামনে এভাবে ওর গায়ে হাত তুলতে চাইবেন? আমরা কে?"
ইশিতা কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে যায়। সামিনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আলো। ইলহাম বলে ওঠে,"ওকে একবার আর দুই বার বুঝিয়েছি আমি আর ভাইয়া? কি জানি কি দেখেছে ঐ ছেলেটার মধ্যে, কি যোগ্যতা ঐ ছেলের? শুধু চেহারা সুন্দর।"
আলো ইলহামের দিকে তাকায়। সামিন বলে ওঠে,"ঐ ছেলেকে ডেকে আন। কতটা সাংঘাতিকভাবে এতো বড় একটা মেয়ের ব্রেইন ওয়াশ করেছে নিজের সিম্প্লিসিটি দেখিয়ে, খুবই প্রো লেভেলের লোক। ওর সাথে আমি বোঝাপড়া করতে চাই।"
ইশমাম এগিয়ে এসে বলে,"ভাইয়া ছেলেটার সাথে আমি পারসোনালি কথা বলেছি। আমার খারাপ মনে হয়নি।"
সামিন ক'ট'ম'ট দৃষ্টি দিয়ে ইশমামের দিকে তাকায়, রাগী গলায় বলে,"তুই মানুষ চিনিস? মানুষ চিনলে তো আজ কোনো মেয়ে তোকে ঠকিয়ে যেতো না। তুই চুপ কর।"
আলো মাথা নিচু করে ফেলে। ইশমাম কয়েক মুহূর্ত সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যায় নিজের ঘরে।
সামিন দ্রুতপায়ে নিজের ঘরে ঢোকে। আলো সামিনের পিছু পিছু যায়।
বিছানায় একপাশে চুপচাপ বসে পরে সামিন। কপালে চিন্তার ভাঁজ পরেছে তার। আলো এগিয়ে গিয়ে রাগী গলায় বলে,"এটা তখন কি করতে যাচ্ছিলেন আপনি হ্যা? আমরা ইশিতা আপুর ভাবী হলেও ইশিতা আপুর থেকে বয়সে ছোটো। রিতু তো অনেকটাই ছোটো। আমাদের সামনে ওর গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিলেন?"
সামিন চুপ করে থাকে । আলো পাশে বসে বলে,"সমস্যা কোথায়? ঐ ছেলের মধ্যে সমস্যা কি? শিক্ষিত, দেখতে শুনতে ভালো, এখন তো মোটামুটি ভালো চাকুরীও করছে। সবদিক থেকে ভালো। ছেলে গরীব পরিবার থেকে উঠে এসেছে এটাই আপনার চোখে বিঁধছে তাইতো? আচ্ছা আমি বুঝলাম না, আপনারা গরীব পরিবার থেকে মেয়ে বিয়ে করে আনতে পারলে ইশিতা আপু কেন পারবে না? সামাজিক অবস্থান শুধু ছেলেদেরই উঁচু থাকতে হবে? ডমিনেট করতে সুবিধা হয় যাতে?"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"আমি তোমায় ডমিনেট করেছি?"
আলো মাথা নাড়ায়। মুখ ফসকে এমন একটা কথা বলে ফেললো,এখন এই লোক ক্ষে'পে গেলে সে কি করবে।
সামিন উচ্চবাচ্য না করে নিচু গলায় বলতে থাকে,"আবেগী কথা বলবে না আলো, বোনটাকে চিরকাল আদরে রেখেছি, ওর এক একটা প্রসাধনী সামগ্রীর দাম জানো? সে কিভাবে মানিয়ে নেবে সবকিছু? এখন আবেগের বশে বুঝতে পারছে না।"
আলো তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে,ক্ষনবাদে বলে ওঠে,"সে তো ছোট বাচ্চা মেয়ে নয়, মানিয়ে নিতে হবে ভেবেই তো পা বারিয়েছে। "
_এই আলো,প্লিজ চুপ করো। এটা বাংলা নাটক নয়, বাস্তববাদী হও। আবেগী কথা বলো না। অবশ্য তোমাকে বলে লাভ কি। তোমাদের এই বয়সটাই আবেগের।
বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে সামিন।
****
"কিহ! ভাইয়া শান্তকে ডেকেছে? কেনো? কিসের জন্যে?"
বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলো ইশিতা,উঠে বসে আলোর দিকে তাকায়। তার ঘরে আলো,রিতু আর পরী।
ইশিতা পুনরায় চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"কেনো ? কেনো ডেকেছে?"
_শান্ত হও ইশিতা আপু। বড় ভাইয়া সম্ভবত কথা বলার জন্যই ডেকেছে!
পরী নিচু স্বরে বলে। ইশিতা উঠে দাঁড়ায়, রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"তোমরা জানো না কেনো ডেকেছে? তোমাদের দুজনের স্বামীরা বলেনি?"
রিতু মাথা নাড়ায়। আলো বলে,"সম্ভবত কথা বলতেই ডেকেছে। ভয় পেয়ো না। তোমার ভাইয়া উল্টোপাল্টা কিছু করবেন না।"
আলো স্বামীর সাফাই গাইতে শুরু করে। ইশিতা একবার আলো আর একবার রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,"তোমাদের স্বামীদের আমার বিশ্বাস নেই। নিশ্চয়ই মা'রবে বলে ডেকেছে।"
আলো তাকিয়ে আছে ইশিতার দিকে। পরপর বলে ওঠে,"কিছু করবে না। দেখো একসময় না একসময় তাদের মুখোমুখি হতেই হবে, তো সেটা আজই হোক।"
ইশিতা ধপপ করে বিছানার উপর বসে পরে। পরী আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"ভাইয়ার সাথে তুমি গিয়ে কথা বলো না ভাবী। তোমার সব কথাই তো ভাইয়া শোনে।"
আলো পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,"বলেছি। আমি কথা বলেছি। আমিও চাই তারা সামনাসামনি হোক,তোমরা চিন্তা করো না, বাড়াবাড়ি কিছু হবে না। আমি হতে দেবো না।"
ধীরে ধীরে ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে আলো। ঢুকে দরজা চাপিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। সামিন খালি গাঁয়ে আলমারিতে কিছু একটা খুঁজছিলো। আলো বলে,"কিছু খুঁজছেন?"
_আমার ব্ল্যাক শার্ট টা কোথায় রেখেছো, এখানে তো সব তোমার শাড়ি দেখতে পাচ্ছি ।
আলো এগিয়ে গিয়ে ব্ল্যাক শার্ট বের করে সামিনের হাতে দেয়। সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে শার্ট টা হাতে নিয়ে বলে,"খেয়েছে তোমার ননদ?"
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন শার্ট টা গায়ে চাপিয়ে বলতে থাকে,"না খেলে না খাক। ইশমাম আর ইশিতা, এই দু'টো এতো জেদী হয়েছে! ওদের বলে দিও ওদের থেকে আমার জেদ কোনো অংশে কম না।"
আলো এগিয়ে গিয়ে সামিনের ঘ'নিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে তার শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে আহ্লাদী গলায় বলে,"শুনুন না!"
সামিন আলোর কথার সুর শুনে আলোর দিকে কয়েকপলক তাকিয়ে একই সুরে বলে,"বলুন না।"
আলো সামিনের চোখে চোখ রাখে, তারপর নরম গলায় বলে,"আপনি শান্ত ভাইয়াকে মা'রবেন না তো ডেকে আনিয়ে?"
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু সময় পরে বলে ওঠে,"কিছু প্রশ্ন করবো। উত্তর গুলো ঠিকঠাক ভাবে দিতে পারলে ভালো। নয়তো...."
আলো চ'ম'কে ওঠে। সামিন কথাটা খুবই কঠিন ভাবে বলেছে।
***
গেইটের ভেতরে পা রাখতেই শান্ত এদিক ওদিক তাকায়। শান্তিনীড়ের দারোয়ান রিয়াজ দূরে একটা চেয়ারে বসে তার দিকে কপাল কুঁ'চ'কে তাকিয়ে আছে। শান্ত দাঁড়িয়ে পরে, রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে,"রিয়াজ ভাই একটু ভেতরে গিয়ে বলে দেবেন শান্ত এসেছে। ইয়াসার মির্জা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।"
_আপনে ভেতরে যান,বলাবলির কিছু নাই, সবাই আপনার জন্যে বসে আছে। অপেক্ষা করতেছে আপনার জন্য।
শান্ত ধীরপায়ে এগিয়ে যায় শান্তিনীড়ের সদর দরজার দিকে। সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে মানে! সবাই বলতে কারা!
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে করিডোর পেরিয়ে লিভিং রুমের দিকে পা বাড়াতেই শান্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে পরে। সামিন তার দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। বাড়ির মেয়ে বৌরা দোতলা থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে, ইশিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তার আ'ত'ঙ্কি'ত মুখটা নিয়ে। আলো ইশিতা কে ফিসফিসিয়ে বলে,"টেনশন নিও না। উল্টোপাল্টা কিছু আমি হতে দেবো না। ইয়াসার মির্জার মুখোমুখি আমি হবো। অন্যের বোনকে তুলে এনে বিয়ে করতে পারে আর নিজের বোনের জন্য ভাইভা বোর্ড বসায়! দু মুখো সা'প কোথাকার। শান্ত ভাইয়াকে কিছু বললে আজ আমি ওনার সাথে বোঝাপড়া করবো!"
কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে আলো।
সামিন শান্তর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে। শান্ত গলার টাইয়ের নট ঠিক করে নেয়। অফিসের ফরমাল পোশাকেই সে এসেছে। তাকে কয়েক পলক দেখে নিয়ে সামিন বলে ওঠে,"ঠিক চারটার সময় থাকার কথা ছিলো। তুমি তো দশমিনিট দেরী করে এলে।"
শান্ত কোনো জবাব না দিয়ে আশেপাশে দেখতে থাকে। সে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে পুরো। লিভিং রুমে সামিন,ইলহাম,ইশমাম ছাড়াও রয়েছে জামিল,ফুয়াদ,রাহাত,আরাফ,রনি,সবুজ,তৌফ এবং দলের সব ছেলেরা। সবাই শান্তর দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। সামিন শান্তর হতভম্ব দৃষ্টি দেখে বলে ওঠে,"ইশিতা শুধু আমাদের তিন ভাইয়ের বোন না, ওদেরও বোন। ওরাও তোমার সাথে কথা বলবে।"
শান্ত চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ দেখে একটা ঢোক গিলে নেয়, রূপকথার গল্পে সে সাত ভাই চম্পার কথা শুনেছে। কিন্তু তার পারুলের এতগুলো চম্পা ভাই সে বুঝতে পারেনি! এরা তাকে এখন কি করবে!
"ভাবী শান্ত ভাইয়ার মুখটা দেখো। প্রচন্ড ঘা'বড়ে গিয়েছে।"
উৎকণ্ঠা নিয়ে রিতু নিচের দিকে তাকিয়ে বলে। আলো শান্তর দিকে তাকিয়ে আছে। আল্লাহ জানেন আজ কি হতে চলেছে। ইয়াসার মির্জার এতো শীতল ভাব তাকেও চিন্তিত করছে।
শান্ত সামিনের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় তাকে সালাম দেয় শুরুতেই। সামিন সালামের উত্তর দিয়ে তাকে পুনরায় বলে,"তুমি দশমিনিট লেইট।"
_জ্যাম ছিলো রাস্তায় ভাইয়া।
নিচু গলায় বলে শান্ত।
_ঠিকাছে বসো।
শান্তকে বসার নির্দেশ দিয়ে সামিন বসে পরে। অন্যরাও সবাই বসে পরে। শান্ত তার মুখোমুখি বসে থাকা মানুষটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। যতটা বাজে আচরণ করার কথা সে করছে না। কেমন থমথমে হয়ে আছে মুখটা। লিভিং রুমের প্রত্যেকে তাদের পাঞ্জাবি কিংবা শার্টের হাতা গুটিয়ে রেখেছে। কি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা? মারবে নাকি শান্তকে। কিন্তু তার জন্য তো ইয়াসার মির্জা একাই যথেষ্ট। এতো লোকের কি দরকার!
সামিন শান্তর দিকে তাকিয়ে বলে,"পানি খাবে?"
চোখের চশমা ঠেলে শান্ত মাথা নাড়ায়। তৌফ এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয় শান্তর দিকে। গ্লাস টা খালি করে শান্ত এদিক ওদিক তাকায়। ইশিতাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না সে। কি করছে এখন সে! বাংলা সিনেমার মতো আটকে রেখেছে নাকি তাকে ঘরে!
সামিন শান্তর দিকে তাকিয়ে বলে,"তোমার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু কখনোই জানা হয়নি, জেনেছি ভালো পড়াও, মেধাবী এতটুকুই। পুরো নাম কি?"
_সোহানুর ইসলাম শান্ত।
নিচু স্বরে জবাব দেয় শান্ত। সামিনের পাশ থেকে ফুয়াদ বলে ওঠে,"দেশের বাড়ি কোথায়?"
_বরিশাল।
আগের থেকেও নিচু স্বরে বলে শান্ত। জামিল পাশ থেকে চেঁচিয়ে সামিনকে বলে ওঠে,"বরিশাল! ভাই বরিশালের ছেলে! বরিশালের মানুষ চি'টার বাটপার হয় শুনেছি।"
শান্ত অবাক চোখে তাকিয়ে আছে জামিলের দিকে। সামিন জামিলকে থামিয়ে দিয়ে শান্তকে বলে,"তোমাকে আমি এখন কিছু প্রশ্ন করবো, প্রশ্নের উত্তর গুলো যদি আমার মন মতো হয় তাহলে আমি বিবেচনা করবো আমার বোনকে তোমার সাথে বিয়ে দেবো কি না।"
শান্ত একটা ঢোক গিলে নেয়। চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে দিতে শেষ, এখন প্রেমিকার ভাইদের কাছেও ইন্টারভিউ!
সামিন ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,"তুই কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে কর।"
ইলহাম কপাল কুঁচকে বলে,"আমার কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। তুমি যেটা জিজ্ঞেস করবে ওটাই আমার জিজ্ঞাসা।"
সামিন ঘুরে ফুয়াদ আর দলের ছেলেদের দিকে তাকায়,সবাই সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন মাথা ঘুরিয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই তৌফ বলে ওঠে,"ভাই আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই।"
সবাই তৌফের দিকে তাকায়। সামিন বলে ওঠে,"আচ্ছা কর।"
শান্ত তৌফের দিকে তাকিয়ে আছে। তৌফ কন্ঠে গাম্ভীর্য এনে শান্তকে বলে ওঠে,"আপনার চশমার পাওয়ার কত?"
শান্ত অবাক চোখে তৌফকে দেখতে থাকে। দোতলা থেকে পরী উচ্চশব্দে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। সবাই দোতলার দিকে তাকাতেই আলো পরীর মুখ চেপে ধরে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। পরীর মাথায় গাট্টা মে'রে বলে,"ইয়াসার মির্জা এমনিতেই ক্ষে'পে আছে। এসব করো না।"
ইশমাম মাথা তুলে অবাক চোখে পরীর বাচ্চাসুলভ আচরণ দেখে। শুধু শুধু ঐ মেয়েটাকে সে অস্বাভাবিক বলে না।
সামিন তৌফের এমন বেহুদা প্রশ্নে রাগান্বিত হয়ে তাকায় তৌফের দিকে। সামিনের দৃষ্টি দেখে তৌফ মিইয়ে যায়, মিনমিন করে বলে,"না মানে, চোখের অবস্থা টা জানতে জিজ্ঞেস করেছি ভাই, ভবিষ্যতে কানা হয়ে গেলে আমাদের ইশুর বিপদ।"
শান্ত সবাইকে দেখতে থাকে। আজ এখানে তার ধোলাই হবে কিনা সে নিশ্চিত না কিন্তু এরা সবাই যে তার মানসম্মানের পিন্ডি চ'টকাবে এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
সামিন গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,"আমার বোনকে পছন্দ করেছো কেন? সুন্দরী এবং বড়লোক বাড়ির মেয়ে, এই দু'টো কারন বাদে কোনো কারণ থাকলে বলো।"
শান্ত দুমিনিট চুপ করে থেকে বলে ওঠে,"সে খুবই কাইন্ড হার্টেড এবং বোকা।"
সামিন বলে,"এক্সাক্টলি। আমার বোন বোকা। আর তোমাদের মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ছেলেদের কাছে সুন্দরী, ভালো মানুষ, বোকা বড়লোক মেয়েরা হচ্ছে একটা জ্যাকপট। ঐ যে ওকে দেখছো, ও আমার বন্ধু ফুয়াদ। খুবই বড়লোক পরিবারের ছেলে, ওর বড় আপুও ভালোবেসে তোমার মতো একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেকে বিয়ে করেছিলো। যারা আপুকে সবসময় মই হিসেবেই দেখেছে।"
আলো দোতলার রেলিং ধরে কপাল কুঁ'চ'কে নিচতলার লিভিং রুমে সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। খুবই বিরক্ত হচ্ছে সে তার মেয়র সাহেবের উপরে, এই লোকটা অবিকল বাংলা সিনেমার বড়লোক চৌধুরী সাহেবদের মতো আচরণ করছে। সে ইশিতার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"তোমার ভাইয়া কি বাংলা সিনেমা দেখতেন প্রচুর?"
পরী বলে ওঠে,"ঠিক বলেছো ভাবী । হয়তোবা দেখতেন। দেখো কেমন গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চৌধুরী সাহেবদের মতো, শুধু গায়ে স্যুট আর হাতে পাইপ টা নেই। আচ্ছা শান্ত ভাইয়ার এখন কি বলা উচিত ভাইয়াকে? চৌধুরী সাহেব! আমি গরীব হতে পারি কিন্তু লোভী নই। এই ডায়লোগ টা?"
কথাটি বলে পরী নিজেই হাসতে থাকে।
শান্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন বলে ওঠে,"ভেবো না আমি তোমায় অপমান করছি। আমি শুধু আমার ধারণাটা তোমাকে জানালাম। এবং এখন পর্যন্ত কেউই আমার ধারণা ভুল প্রমান করতে পারেনি। তাই আমি আমার বোনকে নিয়ে চিন্তিত।"
_বুঝতে পেরেছি।
শান্ত অস্ফুট স্বরে বলে। সামিন বলে,"আমার বোন চিরকাল তার পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে স্বার্থহীন ভালোবাসা পেয়েছে। এবং ও যা অন্যদের দিয়েছে তাও নিঃস্বার্থ সেখানে বড় ভাই হিসেবে যদি দেখি কেউ আমার বোনটাকে ক্যালকুলেট করে ভালোবাসছে তাহলে আমার তাকে মে'রে ফেলতে ইচ্ছে করবে।"
শান্ত নিশ্চুপ। সামিন বলতে থাকে,"আমার বোনটা বাসে চ'ড়তে পারে না...."
_অফিস থেকে লোন নিয়ে বাইক কিনেছি।
সামিনকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে শান্ত।
_আমার বোন একবেলাও মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারে না।
_আমি মাছ খাই না। আমার ভাগের টাও আপনার বোনকেই খাওয়ানো হবে।
সামিন চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে ওঠে,"এখন একটা কারন বলো তোমার হাতে আমার বোনকে তুলে দেওয়ার পেছনে। কেনো তোমার কাছে আমার বোনকে বিয়ে দেয়া উচিত। বলো। কেনো তুমিই উপযুক্ত।"
কয়েক মূহুর্ত সময় নিয়ে শান্ত বলে,"শুধুমাত্র আমিই উপযুক্ত এমন কথা আমি বলছি না ভাইয়া। কিন্তু সম্ভবত আপনার আদরের বোনের ওজন সহ্য করার ধৈর্য্য আমাকে সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন।"
সামিন ঘুরে সবার দিকে তাকায়। ফুয়াদ বলে ওঠে,"নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে আমাদের বোন বিয়ে দিতে চাই না কেনো জানো? নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মা-বাবাদের মানসিকতার জন্য। এদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটা অদ্ভুত, এরা মনে করে এরা যেহেতু অতি কষ্টে সন্তানদের বড় করেছে তাই সন্তানদের উপর শুধুই তাদের অধিকার এবং খবরদারি চলবে। সেখানে ছেলের বৌরা বরাবর তৃতীয় পক্ষ তাদের কাছে, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই দেখে, এবং আস্তে আস্তে এই দৃষ্টিভঙ্গি ভ'য়ং'ক'র বি'ষে পরিনত হয়। তুমি ভেবো না এখানে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার প্রেমিকার ভাইয়েরা সব যুক্তিহীন এবং জাজমেন্টাল কথাবার্তা বলছে, সবটাই আমাদের বোনের জন্য আমাদের ইমোশন। ভাইদের ইমোশন।"
শান্ত কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে,"আপনাদের কোনো কথা যুক্তিহীন নয়। আমি আপনাদের ইমোশনকে রেসপেক্ট করি। কিন্তু ফ্যাক্ট হচ্ছে আমি এতিম। ছোটো বেলায় আমার বাবা মা'রা গিয়েছেন, মা অনেক কষ্টে আমায় বড় করেছে, এবং ছেলে আর ছেলের বৌয়ের মধ্যে খবরদারি করার জন্য তিনিও রইলেন না, কিছুমাস আগে তিনিও মা'রা গিয়েছেন।"
কথাটা খুবই শান্ত ভাবে বলে শান্ত। সামিন মাথা তুলে শান্তর দিকে তাকায়। লিভিং রুমের সবাই শান্তর দিকে তাকিয়ে আছে। সবার চোখে মুখে নিমিষেই একটা অ'প'রা'ধবোধ দেখা দিয়েছে,এভাবে একটা লোককে আ'ঘাত করে ফেললো তারা!
আলো প্রচন্ড ক্ষে'পে যায়। বিড়বিড় করে বলে ওঠে,"এভাবে ডেকে এনে এতো কথা শোনানো হচ্ছে। আজ এই লোকটার সাথে বোঝাপড়া আছে। "
সামিন ঘুরে সবার দিকে একবার তাকিয়ে শান্তর দিকে তাকায়। তারপর নরম গলায় বলে,"সরি! আমরা জানতাম না আসলে। নয়তো এই প্রসঙ্গ তুলতাম না।"
শান্ত চুপ করে থাকে। সামিন কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলে,"এই শহরে কোনো আত্মীয় স্বজন আছে?"
শান্ত মাথা নাড়ায়।
_বন্ধু বান্ধব?
_আছে কিছু।
_তাদের ফোন করে ডেকে নাও। আমি কাজী ডাকছি, একটুপর ইশিতা আর তোমার রেজিস্ট্রি হবে।
শান্তর মনে হলো সামিন তার সাথে মজা করছে। সে বোকার মতো সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
আলো দোতলা থেকে কয়েক মুহূর্ত সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘুরে ইশিতার দিকে তাকায়। ইশিতা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে নিচে পরে যাবে। পরী এসে সজোরে একটা চিমটি কেটে দেয় ইশিতাকে। আনন্দিত গলায় বলে ওঠে,"তুমি স্বপ্ন দেখছো না।"
***
সামিন ঘরে ঢুকতেই আলো ছুটে এসে তাকে জরিয়ে ধরে বলে,"থ্যাংক ইউ,থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ মেয়র সাহেব। অনেক থ্যাংক ইউ।"
সামিন হাসে। আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,"এতো খুশি হচ্ছো মনে হচ্ছে বিয়েটা তোমার ই।"
আলো মাথা তুলে সামিনের দিকে তাকায়। তারপর বলে,"রাজি কেনো হয়েছেন এতো সহজে বলুন তো? আমার খটকা লাগছে।"
_রাজি কেনো হয়েছি তা নিজেও জানি না, হঠাৎ খুব মায়া হলো, মায়া থেকে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছি, নয়তো আজ উত্তম মধ্যম দিয়ে দিতাম আমার আদরের বোনের দিকে হাত বাড়ানোর অপ'রাধে। আর এমনিতেও ভাই বোনের ভালোবাসার গল্পে ভিলেন হবার কোনো শখ নেই আমার। এটাও একটা কারণ রাজি হবার পেছনে।
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে, " আচ্ছা ওগুলো কেমন ধরনের প্রশ্ন ছিলো? আর কেমন ধরনের কথা ছিলো ওগুলো? ইশিতা আপু মাছ খায়, বাসে চ'ড়তে পারে না। আপনি একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি হয়ে এসব উদ্ভট প্রশ্ন করছিলেন কেনো? "
সামিন হেসে আলোর নাক টিপে দেয়, তারপর নরম গলায় বলে,"কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলেই কি মানুষ সম্পর্কে ধারণা করা যায় আছিয়া? আমি প্রশ্নের উত্তর গুলো জানতে প্রশ্ন করিনি। আমি ছেলেটার ধৈর্য্য দেখছিলাম। ইয়াসার মির্জার বোনকে বিয়ে করতে হলে তাকে ধৈর্য্যশীল হতে হবে। একেবারে ইয়াসার মির্জার মতো ধৈর্য্য শীল।"
আলো হেসে ফেলে। সামিন বলে,"যাই হোক, কাজী আসছে। তুমি একটু রান্নার দিকটা দেখবে? নতুন জামাইকে ভালোমন্দ না খাইয়ে কিভাবে পাঠাই? "
_পাঠাই মানে? কোথায় পাঠাবেন?
_বিয়ে পরিয়ে ওর বাসায় পাঠিয়ে দেবো। ইশিতা আমার কাছে থাকবে। একমাস পরে ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে ইশিতাকে নিয়ে যাবে।
আলো তাকিয়ে আছে। বিরস মুখে বলে,"অ্যা?"
_অ্যা নয় হ্যা। বিয়েটা পরিয়ে রাখছি। সামনে ইশুর পরিক্ষা, সংসার একমাস পরে করলে কি অসুবিধে? এতটুকু ধৈর্য্য ধরতে পারবে না কেউ? পৃথিবীর সব ধৈর্য্য সামিন ইয়াসার মির্জা একাই ধরবে?
ইশিতা এসে ঘরের বাইরে দাঁড়ায়। সামিন ঘুরে তাকায় বোনের দিকে। ঠান্ডা গলায় বলে ,"কিছু বলবি?"
ইশিতা ছুটে গিয়ে ভাইকে জরিয়ে ধরে।
দুই ভাইবোন চুপ করে থাকে দীর্ঘসময়।
আলো মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে সে দৃশ্য, একটু পরে বলে "ঠিকাছে আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। আপনারা কথা বলুন।"
সামিন মজার ছলে বলে,"হ্যা যাও। আর শোনো কোনো মাছের আইটেম রেধো না। তোমার ননদাই মাছ খায়না।"
ইশিতা হেসে ফেলে,আলোর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"ভাবী তুমি রেধো। আমি মাছ খাই, ওর ভাগের টাও আমিই খাবো।"
***
"এতো লাফালাফি করছো কেনো? এখন লাফালাফি করার সময়? নেক্সট মান্থে ভেলিভারি। শান্ত থাকো।"
রিতুর হাত দুটো শক্ত করে ধরে ফেলে ইলহাম। ইলহামকে দেখে রিতু ধ'মকের সুরে বলে ওঠে," কেমন প্রশ্ন করা হচ্ছিলো ওগুলো?"
ইলহাম রিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে ওঠে,"আস্তে বলো না। ভ'য় পেয়ে গেলাম যে।"
রিতু বলে,"একটা মানুষকে ডেকে এনে সব ভাইয়েরা মিলে এভাবে ধরেছিলেন, শুরুতে আমি ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।"
_ধরবো না? আমাদের আদরের বোনের দিকে হাত বাড়িয়েছে। এমনি এমনিই দিয়ে দেবো বোনকে?
_হু, নিজের বোনের বেলায় আঁটি শুটি,পরের বোনের বেলায় দাঁত কপাটি! বাংলাদেশের পুরুষদের মানসিকতা।
রিতুর এমন কথায় ইলহাম রিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ক্ষনবাদে বলে ওঠে,"তুমি এখনও আমাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারোনি তাইনা?"
রিতু চুপ করে থাকে। ইলহাম রিতুর দুই বাহু ধরে বলে ওঠে,"শা'স্তি কেনো দিলে না ? বড় ভাবীর চ্যালা হয়েছো, তার কাছ থেকে শিখে নাও দোষীকে শাস্তি কিভাবে দিতে হয়।"
রিতু ইলহামের চোখের দিকে তাকায়, ধরা গলায় বলে,"আলো আলোই, রিতু রিতুই। রিতুরা চাইলেও আলোদের মতো হতে পারে না।
ইলহাম চুপ করে থাকে। রিতু বলে ওঠে,"একটা সত্যি কথা বলবেন? যদি কখনও জুঁই আপনাকে আমার বাচ্চা এ'ব'র'শ'নের কথা না বলতো তাহলে কখনও ওর প্রতি মুগ্ধতা কাটতো আপনার? নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলতে হবে শুনেই তো ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন, নয়তো কখনো দিতেন না। আমি এও জানি, আমার এই সন্তান জন্মানোর পরে আপনি আগের বারের মতোই শুধুমাত্র বাচ্চা নিয়েই মেতে থাকবেন। আমি চলে যাবো আমার আগের যায়গায়। সেবিকা, শুধুমাত্র একজন সেবিকা আপনার আমি।"
ইলহাম রিতুর দিকে তাকিয়ে আছে। রিতু চোখ নামিয়ে নেয়। ইলহাম বলে ওঠে,"এটা তুমি একদম ঠিক বলেছো। তোমাকে আমি আমার সেবিকা হিসেবে দেখি। তবে তুমি কি জানো, তোমার মতো সেবিকা দ্বিতীয়টি আমি খুজে পাবো না এই পৃথিবীতে। তোমার বিকল্প কেউ নেই দেখেই আমি তোমার দ্বারস্থ হয়েছি। এখন আমাকে স্বার্থপরও ভাবতে পারো।"
রিতু চুপ করে থাকে। ইলহাম রিতুকে কাছে টেনে নিয়ে নরম গলায় বলে,"শা'স্তি দিতে চাইলে দিতেই পারতে। মাথা পেতে নিতাম।"
চোখ তুলে রিতু ইলহামের দিকে তাকায়। চোখে চোখ রেখে কান্না মিস্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,"ওই যে বললাম রিতুরা কখনো আলো হতেই পারে না। চেষ্টা আমিও করেছিলাম আলো হতে। ব্যর্থ হয়েছি। বলতে পারেন রিতুদের আলোদের মতো আত্মসম্মান নেই, কিংবা আত্মসম্মান মায়ার কাছে হেরে যায়।"
***
মাগরিবের পরে ইশিতা এবং শান্তর রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়। শান্তর তরফ থেকে শান্তর দুজন বন্ধু সাক্ষী হয়,আর ইশিতার তরফ থেকে তার ভাইয়েরা।
বিয়ে সম্পন্ন হলে সবাই নতুন বিবাহিত দম্পতির জন্য মোনাজাত তুলে দোয়া চায়। ইশিতা সালোয়ার কামিজ পরে আছে, ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা, শান্ত তার অফিসের ফরমাল পোশাকে।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে লিভিং রুমে বাড়ির পুরুষেরা কথা বলতে থাকে।
ইশিতা নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছে। তার এখনও হাত পা কাঁপছে। মনটা এখনও অস্থির। সবটা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
আলো একটা বাটিতে কিছু ডেজার্ট নিয়ে ঘরে ঢোকে,ইশিতাকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে মুচকি হেসে বলে,"তখন লজ্জায় কিছু খেতে পারোনি, এখন এটা খাও, তোমার পছন্দের ডেজার্ট।"
পরী আর রিতু আলোর পিছু পিছু ঘরে ঢোকে।
ইশিতা লাজুক মুখটা নামিয়ে নেয় । ক্ষনবাদে মিছিমিছি রাগ দেখিয়ে আলোকে বলে,"আমার বিয়ে নিয়ে কত প্ল্যান ছিলো ভাবী জানো, তোমার ঐ পাগল স্বামীর জন্য সব ভেস্তে গেলো, দুম করে বিয়ে পরিয়ে দিলো। সালোয়ার কামিজ পরে বিয়ে করলাম।"
আলো হাসে। রিতু পেটে হাত চেপে ধীরে ধীরে বিছানায় বসে। পরী আলোকে বলে,"এখন কি করবো ভাবী? বাসর সাজাতে হবে না?"
আলো মাথা নেড়ে বলে,"উহু। তোমার ভাইয়া বারণ করেছে । সামনের মাসে অনুষ্ঠান করে তারপর।"
কথাটি বলে আলো ইশিতার দিকে তাকায়। তারপর বলে,"আপত্তি আছে?"
ইশিতা মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়। পরী বিরস মুখে তাকায় সবার দিকে, এটা আবার কেমন বিয়ে! ঘটা করে বিয়ে পরানোর কি দরকার ছিলো তবে!
***
শান্তিনীড়ের গেইট থেকে কিছুটা দূরেই একটা চায়ের দোকান। বন্ধুদের বিদায় দিয়ে শান্ত দীর্ঘসময় সেই চায়ের দোকানটাতে বসেছিলো। এর মাঝে চা খেয়েছে চার কাপ। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত প্রায় সাড়ে দশটা। ইশিতার নাম্বার অনবরত বন্ধ পেয়ে যাচ্ছে সে। বিকেল থেকে তার সাথে যা যা হয়েছে তাতে এমনিতেই সে কথা হারিয়ে ফেলেছে।
শান্তর বেশ মেজাজ খারাপ হচ্ছে সামিন ইয়াসার মির্জার ওপর, যদি বৌয়ের কাছে না-ই যেতে দেবে তবে ঘটা করে বিয়ে কেনো পরিয়ে দিলো? অবশ্য শান্ত অনুমান করেছে, এটা হচ্ছে শান্ত আর ইশিতার শা'স্তি। বুদ্ধিমান ইয়াসার মির্জা খুবই ঠাণ্ডা মাথায় শান্তর থেকে প্রতি'শোধ নিয়েছে। বিরস মুখে দূর থেকে শান্তিনীড়ের গেইটের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে সে বলে ওঠে,"আপনার কোনো তুলনা হয় না ইয়াসার মির্জা!"
চায়ের দোকানের বিল মিটিয়ে উঠে পরে শান্ত। তারপর দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চুপচাপ হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। চায়ের দোকানের লোক গুলো খুবই কৌতুহলী হয়ে দেখতে থাকে স্যুট বুট পরিহিত এই সুদর্শন যুবকটিকে।
শেষ বারের মতো শান্ত ইশিতার নাম্বার ডায়াল করে নাম্বার টা বন্ধ পায়। বিরক্তিতে শান্ত কপাল কুঁচকে ফেলে। এই ভাই বোন গুলো তাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে। খাবার টেবিলে পাতে খাসির আস্ত রান দিয়ে কত জামাই আদর করলো, তারপর "একমাস পরে ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে ইশুকে উঠিয়ে নিয়ে যেও" বলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো। শান্তর কপাল যে বরাবরই ভাঙা, আজ নতুন করে তার প্রমাণ পেলো, শশুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে বৌটার মুখটা পর্যন্ত দেখতে পেলো না!
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার মিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মিশনের নাম "বৌয়ের মুখ দেখা"!
হাতের ফোনটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত পরীকে ফোন দেয়। ওপাশ থেকে পরী ফোনটা রিসিভ করেই আনন্দিত গলায় বলে,"বলুন দুলাভাই। আমি আপনার ফোনেরই অপেক্ষা করছিলাম। "
_সবাই ঘুমিয়েছে?
_হ্যা ঘুমিয়েছে।
_তোমার ইশিতা আপুর ফোন বন্ধ কেন?
_আপুও ঘুমাচ্ছে, কি বলুন তো দুলাভাই, গত দু'দিন টেনশনে আপুর ঘুম খাওয়া কিছুই হয়নি। আপনি গেইটের বাইরে এসে গিয়েছেন?
_হ্যা এসে গিয়েছি। এখন কি করবো?
_রিয়াজ ভাই গেইট খুলে দিলে সোজা অন্দরমহলে ঢুকবেন, ফুলির মা সদর দরজা খুলে রেখেছে। তারপর সোজা দোতলায় উঠবেন,আমি সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছি দোতলার।
_আচ্ছা।
অস্ফুট স্বরে শান্ত বলে ফোন কেটে দেয়, তার নিজেকে এখন চোর চোর মনে হচ্ছে।
পরী চুপচাপ সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। এখন যদি বড় ভাইয়া কোনো কারনে ঘুম থেকে উঠে পরে তাহলে তার খবর আছে। চ'ড় মেরে পরীর সব দাঁত ফেলে দেবে ইয়াসার মির্জা!
আলো এখনো ঘরে আসছে না দেখে সামিন বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দোতলার লিভিং রুম সংলগ্ন বেলকোনির দিকে যায়। তার অনুমান ঠিক, আলোকে সেখানেই পাওয়া গিয়েছে। বেলকোনির গ্রিল ধরে ওদিক ফিরে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে।
সামিন গিয়ে পেছন থেকে জরিয়ে ধরতেই চ'ম'কে উঠে ফোন টা হাত থেকে ফেলে দেয়। ঘুরে সামিনের দিকে তাকিয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে হিয়ার সাথে কথা বলে কল কেটে সামিনকে বলে,"আপনি!"
_তুমি কি ভেবেছিলে? ভুত?
_না, আমি ভেবেছি পাগল। আমার অনুমান সত্যিই।
_এখানে এসে ফোনে কথা বলার কি আছে?
_আপনি দলের লোকজনের সাথে কনফারেন্স কলে ছিলেন ভাবলাম অসুবিধা হবে।
শান্ত পা টিপে টিপে দোতলায় উঠতেই পরী একটা প্রশ্বস্ত হাসি দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ,"চলুন,আমার পিছু পিছু আসুন।"
শান্তকে নিয়ে ইশিতার ঘরের দিকে উদ্যত হতেই পরী থ'ম'কে দাঁড়িয়ে পরে। তাদের সোজাসুজি লিভিং রুমের বেলকোনি। সেখানে সামিন আর আলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার আত্মা খাঁচাছাড়া অবস্থা। এখন এদের পাশ কাটিয়ে ইশিতা আপুর ঘরে কিভাবে যাবে সে! বিরবির করে বলে ওঠে,"আল্লাহ এই দুজন এই সময়ে এখানে কি করছে!"
সামিন পরীদের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাই পরী আর শান্তকে দেখতে পায়নি। কিন্তু আলো দেখতে পেয়েছে, পরীর সাথে শান্তকে পা টিপে টিপে ইশিতার ঘরের দিকে যেতে দেখে সে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। সামিন আলোকে ভালো করে লক্ষ্য করে বলে ,"কি হলো থম মেরে গেলে কেন?"
_কিছুনা। বলুন।
তোতলাতে তোতলাতে বলে ওঠে আলো। সামিন বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,"বলবো মানে? ঘরে চলো। ঘুমাবে না?"
শান্ত দ্রুত পায়ে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পরে যায়। তার চশমা খুলে দূরে ছিটকে পরে।
আলো চোখ বড় বড় করে ফেলে। পেছনে কিছু পরে যাওয়ার শব্দ হতেই সামিন মাথা ঘুরিয়ে দেখতে যাবে অমনি আলো দুহাতে তার গাল আগলে ধরে চাঁপা স্বরে চেঁ'চি'য়ে বলে ওঠে,"এই না ওদিকে তাকাবেন না।"
_ওদিকে তাকাবো না মানে?
অবাক হয়ে বলে সামিন।
আলো আমতা আমতা করে বলে,"মানে আমার দিকে তাকান। শুধু আমাকে দেখুন আপনি। আমি কত সুন্দর।"
সামিন অবাক চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে, এই মেয়েটা এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেনো!
পরী শান্তর চশমা এনে হাতে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,"ঘুমিয়ে পরেছেন নাকি মেঝেতে? উঠছেন না কেনো দুলাভাই?"
শান্ত উঠে দাঁড়ায়, এটাই বাকি ছিলো। শ্যালিকার সামনে মানসম্মানের ছিটেফোঁটাও রইলো না। উঠে দাঁড়িয়ে চশমা চোখে দিয়ে পা টিপে টিপে আবারও হাঁটতে থাকে সে।
সামিন আলোকে বলে,"চলো ঘরে চলো। ঘরে গিয়ে খুব ভালো করে দেখবো তোমায়।"
ঘরের দিকে যেতে গেলেই বিপদ। শান্ত একেবারে সামিনের সামনে পরে যাবে।
তাই আলো বলে ওঠে,"এই না,এখন ঘরে যাওয়া যাবে না।"
_এখন ঘরে যাওয়া যাবে না মানে।
_মানে আপনি আমাকে এখানে দেখুন। আমার চোখের দিকে তাকান। আমার চোখের ভাষা পরুন তো মেয়র সাহেব!
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"আচ্ছা পড়লাম।"
_কি লেখা?
_কিছু গালাগাল লেখা।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন।
আলো চুপ করে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরী শান্তকে নিয়ে চুপচাপ ইশিতার ঘরে ঢুকে পরে।
ইশমাম নিজের ঘরের বাইরে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ পরীর কান্ডকারখানা সে খুবই মনোযোগ দিয়ে দেখেছে, সে সেই তখন থেকে নিশ্চুপ হেসে যাচ্ছে । এমন হাসি সে অনেকদিন হাসেনি!
শান্তরা চোখের আড়াল হলেই আলো কপাল কুঁ'চ'কে সামিনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"চলুন ঘরে চলুন।"
সামিন অবাক হয়ে বলে,"এইমাত্র কত আহ্লাদী গলায় কথা বলছিলে, এর মধ্যে কথার সুর পাল্টে গেলো?"
আলো ভেংচি কেটে দ্রুতপায়ে নিজেদের ঘরে ঢুকে যায়। সামিন বিরসমুখে আলোর পিছু পিছু যায়। মেয়েদের মুড সুয়িং বোঝা তার মতো তুচ্ছ সামিনের সাধ্য নয়।
***
দরজা চাপিয়ে পরী বিছানার কাছে গিয়ে ইশিতাকে ঘুম থেকে তোলে। ইশিতা উঠে বসে চোখ ডলে নিয়ে শান্তকে দেখে প্রথমে হতভম্ব হয়ে যায়, তারপর চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"তুমি!"
শান্ত এগিয়ে এসে বিছানার একপাশে বসে নরম গলায় বলে,"কিছু সময় থেকেই চলে যাবো। পাক্কা!"
ইশিতার হতভম্ব ভাব কাটছে না। পরী মুচকি হেসে মৃদু স্বরে বলে,"আচ্ছা তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।"
পরী চলে যেতেই শান্ত দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে ঘুরে তাকায়। ইশিতা গম্ভীর কন্ঠে বলে,"মতলব কি তোমার?"
শান্ত কিছুক্ষণ ইশিতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"তোমাদের চার ভাইবোনের সবসময় এটা কেন মনে হয় আমি মতলব নিয়ে ঘুরি, আশ্চর্য! আমি গরীব হতে পারি মতলবি নই।"
_ভাইয়া কি বললো শোনোনি? একমাস পরে....!
লজ্জামাখা মুখে বলে ওঠে ইশিতা।
শান্ত ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"আমি বৌটাকে দেখতে এসেছি শুধু!"
দোতলার পশ্চিমপাশের টানা বারান্দার দরজা ঠেলে ইশমাম বারান্দায় পা বাড়াতেই থমকে যায়। পরী তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ইশমাম ক্ষনবাদে বলে ওঠে,"ওহহ তুমি। আমি ভেবেছি মারুফা চাচীর ভুত।"
পরী ইশমামের মশকরা গাঁয়ে না মেখে তার হাতের দিকে তাকায়। সামিন ইয়াসার মির্জার ভোলাভালা ছোটোভাইয়ের হাতে সিগারেট! খুবই অবাক করা বিষয়।
ইশমাম পরীর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে সিগারেট টা ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পি'ষে দেয়।
পরী চুপচাপ বারান্দা থেকে চলে যেতে নিলে ইশমাম বলে ওঠে,"বুদ্ধিটা ভালো ছিলো। আমার আসলে ভাইয়াকে বলতে লজ্জা লাগছিলো। শান্তকে এনে ভালোই করেছো তুমি, ইশুর ভালো লাগবে।"
পরী দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক মূহুর্ত। তারপর চুপচাপ হেঁটে দোতলার লিভিং রুমে গিয়ে বসে পরে। তাকে আরো কিছুক্ষণ পাহারাদার হয়ে থাকতে হবে।
ইশমাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। পড়াশোনা ছাড়া সবকিছুই করতে দেখা যায় এই মেয়েকে। এ ডাক্তারি পাশ করবে কিভাবে! মুন্না ভাই এমবিবিএস এর ফিমেল ভার্সন।
বিছানার ওপর দু'জনে বসে আছে। একজনের পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে রেখে আরেকজন। কেউ কারো মুখ দেখছে না। চুপ করে আছে দুজন। কিছুক্ষণ পরে শান্ত বলে ওঠে,"ঘুমিয়ে পরলে নাকি?"
_না বলো।
ঘুমঘুম কন্ঠে বলে ইশিতা। শান্ত ম্লান হেসে বলে,"আমাকে বিয়ে করতে যতটা আগ্রহী ছিলে বিয়ে করে ততটাই নির্লিপ্ত লাগছে তোমাকে।"
_তো কি করবো? আপনাকে মাথায় উঠিয়ে নাচবো?
কাটকাট বলে ইশিতা।
শান্ত হেসে ফেলে,বলে,"একেবারে ভাইদের মতো হয়েছো। কথাবার্তা শুনলে গলা শুকিয়ে যায়।"
ইশিতা ঠোঁট টিপে হেসে বলে,"দুঘন্টা হয়েছে। এখন যাও। কাল অফিস আছে না? অফিস যেতে না পারলে চাকুরী থাকবে না, চাকুরী না থাকলে কিন্তু বৌও থাকবে না।"
শান্ত মৃদু হেসে হুট করে ইশিতার মুখোমুখি বসে পরে ইশিতাকে আগলে নেয়। ভালোবাসার মানুষের আচমকা স্পর্শে ইশিতা লজ্জায় মিইয়ে যায় । শান্ত নিচু স্বরে বলে,"যাবো। খালি হাতে কিভাবে যাই। বৌকে একটা চু'মু খেয়ে যাবো। নয়তো সারারাত ঘুম হবে না, ঘুম না হলে অফিসে গিয়ে কাজ করতে পারবো না,কাজ করতে না পারলে বস চাকুরী থেকে বের করে দেবে, চাকুরী না থাকলে বৌও থাকবে না।"
কথাটা বলে শান্ত ইশিতার কপালে চু'মু খেতে নেয় তখনই বিকট শব্দে ইলহামের চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়।
শান্ত ইশিতার দিকে তাকিয়ে আছে। বিরবির করে বলে ওঠে,"রূপকথার সাত চম্পা ভাই ঘুমিয়ে থাকে, আর তোমার চম্পা ভাইয়েরা রাত সাড়ে বারোটার সময়টাতেও জেগে আছে! কি বিপদ! এরা কি আর্লি টু বেড এ্যান্ড আর্লি টু রাইজ প্রবাদটা জানে না?"
ইশিতা শান্তর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়, তারপর উঠে গিয়ে দরজার সিটকিনি খোলে।
ইলহামের চিৎকার শুনে সামিন আর আলো একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। চিন্তিত ভঙ্গিতে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে ইলহামের ঘরের দিকে যায়। ঘরের দরজা খোলা, ইহান ভীত চোখে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, ইলহাম ওয়াশ রুম থেকে রিতুকে পাঁজাকোলা করে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। পেটে হাত চেপে রিতু তীব্র আর্তনাদ করে যাচ্ছে। সামিন ইলহামের দিকে তাকায়,রিতুকে কোলে তুলে নেয়ায় ইলহামের শার্টে র'ক্ত লেগে গিয়েছে।
আলো হতভম্ব হয়ে ছুটে যায় রিতুর কাছে। কপাল কে'টে রক্ত ঝরছে রিতুর। পেটে তীব্র যন্ত্রনায় কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছে না সে।
সামিন গিয়ে ইহানকে আগে কোলে তুলে নেয়। ইলহাম উৎকণ্ঠা নিয়ে বলতে থাকে,"হঠাৎ কিভাবে পরে গেলো জানিনা। ওয়াশ রুমের দরজা ভেঙে বের করেছি।"
সামিন একপলক রিতুর দিকে তাকিয়ে ইলহামকে বলে,"সময় নেই, ওকে তোল। আমি গাড়ি বের করছি।"
ইলহাম গায়ের রক্তাক্ত শার্ট না পাল্টেই রিতুকে তুলে নেয়। সামিন ইহানকে আলোর কাছে দিয়ে গাড়ির চাবি নিতে ঘর থেকে বের হয়ে লিভিং রুমে আসতেই দাঁড়িয়ে পরে।
শান্ত আর ইশিতা তার সামনে দাঁড়িয়ে। শান্ত চোরের মতো মুখ করে রেখেছে। সামিন হতভম্ব হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো ইহানকে কোলে নিয়ে বের হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। পরী কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। সামিন ঘুরে রাগী দৃষ্টিতে পরীর দিকে তাকায়। এ ধরনের বুদ্ধি যে এই মেয়েটার মাথা থেকে বের হতে পারে তা সে জানে। পরী ছুটে গিয়ে আলোর পেছনে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। ইশমাম কিছুক্ষণ সামিনের দৃষ্টি দেখে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,"আমি ডেকেছি শান্তকে ভাইয়া।"
সামিন ইশমামের দিকে তাকায়। আলো পাশ থেকে বলে ওঠে,"চলুন না, এখন এসব থাক, শিগগিরই গাড়ি বের করুন।"
সামিন দ্রুতপায়ে হেঁটে ঘরে ঢুকে গাড়ির চাবি আনে। এখন এতকিছু দেখার সময় নেই তার।
রিতুর অবস্থা আরো খারাপ হতে শুরু করেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে যাচ্ছে। পেছনের সিটে বসে ইলহাম শক্ত করে রিতুকে ধরে রেখেছে।
আলো ইহানকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে সামিনের পাশের সিটে বসেছে।
শান্তিনীড়ের গেইট থেকে রাত সাড়ে বারোটায় দু'টো গাড়ি বের । পেছনের গাড়িতে রয়েছে ইশমাম,ইশিতা,শান্ত ও পরী।
ইশমাম ড্রাইভ করতে করতে মাথা ঘুরিয়ে শান্তকে বলে,"তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাই? কাল তো তোমার অফিস আছে।"
_তোমাদের বাড়ির এতো বড় বিপদে আমি বাসায় চলে যাবো? আমিও যাবো হসপিটাল। রিতু ভাবী আমাকে অনেক পছন্দ করতেন। আমিও করতাম। চলো সোজা হসপিটাল চলো।
দৃঢ় ভাবে বলে শান্ত।
ইশিতা মিনমিন করে বলে ওঠে,"ভাইয়া কি মনে করেছে কে জানে! আমি ভাইয়াকে মুখ দেখাবো কি করে? আসতে গেলে কেন তুমি? যত্তসব।"
শান্তকে ধমকে ইশিতা পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,"সবকিছুর মূলে তুই তাই না?"
পরী চুপ করে থাকে। ইশমাম ইশিতাকে বলে ওঠে,"এখন এসব কথা বলার সময়? মেজো ভাবীর জন্য প্রে কর। ভাইয়াকে ম্যানেজ করা যাবে। তোরা কোনো অন্যায় করিসনি।"
***
"বাচ্চা ইমিডিয়েটলি বের করতে হবে, নয়তো একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। মা ও বাচ্চা দুজনের লাইফ রিস্ক।"
ইলহাম ডক্টরের দিকে তাকিয়ে আছে। আ'তঙ্কিত লাগছে তাকে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"কিন্তু এখনও যে সময় হয়নি!"
_কিচ্ছু করার নেই ইলহাম মির্জা, দূর্ঘটনার জন্য প্রি-টার্ম লেবার পে'ইন উঠেছে। আমাদের হাতে সময় কম। সি-সেকশন ছাড়া উপায় নেই। আপনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত হন। বন্ডে সই করতে হবে!
ইলহাম চ'ম'কে ওঠে। চাঁপা স্বরে চেঁ'চি'য়ে বলে ওঠে,"বন্ডে সই করতে হবে মানে?"
_মানে বললাম তো, রিস্কি। শুধু উপরওয়ালাকে ডাকুন।
ইহান অবাক চোখে সবার মুখের দিকে তাকায়। তার অবুঝ মনে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, কিন্তু সে বুঝতে পারছে না কে তার প্রশ্ন গুলোর উত্তর দেবে, শেষমেশ সে তার বড় বাবার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে। সামিন ইহানের মুখের দিকে তাকায়। ইহানের চোখ দু'টো ছলছল করছে, কান্নামিশ্রিত কন্ঠে সে বলে ওঠে,"মাম্মার কি হয়েছে বড় বাবা?"
সামিন কোনো জবাব দেয়না। শুধু আদুরে মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো এসে ইহানকে কোলে তুলে নিয়ে বলে ওঠে,"মাম্মা পায়ে ব্যাথা পেয়েছে বাবা। ডক্টর আন্টি ব্যা'ন্ডেজ করার জন্য নিয়ে গিয়েছে।"
কাঁপা কাঁপা হাতে ইলহাম বন্ডে সই করে দেয়। হঠাৎ করে তার বুকটা মো'চড় দিয়ে উঠলো যেন। এতটা উতলা নিজেকে কখনও মনে হয়নি। রিতুর কি দেখা উচিত না ইলহামের এই অবস্থা? একটু হলেও তো খুশি হতো সে। তৃপ্ত হতো সে!
এদিক ওদিক অসহায়ের মতো তাকিয়ে বিরবির করে ইলহাম বলে ওঠে,"শুধু আমার বাচ্চার জন্য নয় রিতু। তোমার জন্যও আমি কষ্ট পাচ্ছি। সত্যিই পাচ্ছি।"
রিতুকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাইরে ওয়েটিং রুমে সবাই দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। শুধু আলো ঘুমন্ত ইহানকে বুকের সাথে আগলে নিয়ে বসে আছে। ইলহাম করিডোরের এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করছে।
সামিন মাথা ঘুরিয়ে শান্তর দিকে তাকায়। শান্ত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু সময় পরে সামিন বলে ওঠে,"তুমি গেলেই পারতে। কাল অফিস আছে।"
_ভাবীর একটা ভালো খবর শুনে যাবো ভাইয়া।
নিচু স্বরে বলে শান্ত।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। অপারেশন থিয়েটার থেকে একজন ডক্টর বের হয়। ইলহাম তার দিকে এগিয়ে যায়, ডক্টর মাস্ক খুলে ইলহামের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলে,"আপনার ছেলেকে ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হচ্ছে, প্রিম্যাচিউর বেবী তো, তবে চিন্তা করবেন না বত্রিশ সপ্তাহেই আপনার ছেলে বেশ হাট্টা কাট্টা। আপনার ওয়াইফের স্টি'চিং চলছে। জ্ঞান নেই তার। যাস্ট প্রে ফর হার ।"
মা ও বাচ্চাকে দু'টো আলাদা কেবিনে শিফট করা হয়েছে অবজারভেশনের জন্য। নার্স ব্যতীত অন্য কেউই ঢুকতে পারবে না আপাতত। ইলহাম কিছুক্ষণ পর পর একবার রিতুর কেবিনের সামনে গিয়ে দরজার কাচ দিয়ে উঁকি মেরে রিতুকে দেখছে, একবার নিজের ছেলের কাছে যাচ্ছে।
ইহান তার বড়মার বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে।
কিছু সময় পরে সামিন ইশমামের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"এখানে এতো লোক থাকার দরকার নেই এখন। আমি, ইলহাম আর তোর বড়ভাবী থাকবো। তুই ইহান আর বাকিদের নিয়ে বাড়িতে যা। "
_কিন্তু ভাইয়া,ভাবীর অবস্থা....
_ফোনে জানাবো তোদের। সকালে চলে আসবি। এখন যা, সবার থাকার প্রয়োজন নেই। এটা হসপিটাল।
ইশিতা যেতে চাচ্ছিলো না শুরুতেই । সামিন সবাইকে জোর করতে থাকে।
শান্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সামিন তার দিকে তাকিয়ে বলে,"তোমার বাসা তো এখান থেকে অনেকটা দূরে। তুমি বরং আমাদের বাড়িতে যাও।"
শান্ত মাথা তুলে সামিনের দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সাথে বলে,"না ভাইয়া। আমি আমার বাসায় যাচ্ছি।"
রিতুর কেবিনের দরজার বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ইলহাম। সামিন এক পলক ইলহামকে দেখে আলোর পাশে গিয়ে বসে পরে। আলো মাথা তুলে সামিনের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলে,"এই মুহূর্তে একটা শাশুড়ি মায়ের অভাব বোধ করছি খুব। সব কিছুর প্রে'শার আমার উপর দিয়ে যাবে এখন।"
সামিন হেসে ফেলে। আলোর ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে ওঠে,"এই হাত দুটো একেবারে আমার মায়ের হাতের মতো জানো? গোলগাল, সুন্দর।"
আলো কোনো জবাব না দিয়ে ইলহামের দিকে তাকায়। একবার নিজের ছেলের কাছে যাচ্ছে, একবার এসে স্ত্রীকে দেখছে। ইলহামকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত একজন পুরুষ মনে হচ্ছে।
মাথা ঘুরিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"রিতু যদি ইলহামের এই দরদ টুকু দেখতো তবে খুব স্বস্তি পেতো।"
সামিন বলে,"একেবারেই ঠিক বলেছো।"
আলো চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই আবার বলে ওঠে,"আমাদের বিবাহিত জীবনের বেশিরভাগ রাতই আমরা হসপিটালে কাটি'য়েছি মেয়র সাহেব। "
সামিন হেসে ফেলে, প্রসঙ্গটা সরিয়ে বলে ওঠে,"আমি ভাবছি অন্য কথা। চোখের সামনে ছোটো ভাই গুলো একটা একটা করে বাবা হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যর্থ পুরুষ মনে হচ্ছে। ধি'ক্কার জানাই নিজেকে।"
আলো মাথা নিচু করে ফেলে। একটা বাচ্চার জন্য লোকটার কত পাগলামি! কত ছটফটানি! কত উন্মাদনা!
জ্ঞান ফিরতেই স্বামীর মুখটা দেখতে পেয়ে রিতু আবেশে আবারও দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইহানের জন্মের সময়টার কথা মনে পরে যায় তার, তার শশুর,শাশুড়ি, ভাসুর,ননদ সবাই ছিলো তার পাশে। ছিলোনা শুধু এই লোকটা। আজ এই মানুষটা দু'চোখে দরদ নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কি প্রমাণ করতে চাইছে? রিতু খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেউ তার কাছে?
ইলহাম রিতুর দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। পুনরায় চোখ মেলে রিতু অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"ছেলেকে দেখেছেন?"
_হ্যা। দূর থেকে। ছুঁতে পারিনি, কোলে নিতে পারিনি।
রিতু চুপচাপ ইলহামকে দেখতে থাকে। ইলহাম একটা চেয়ার টেনে বসে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"রিতুদের আত্মসম্মান থাকে না বলেছিলে। রিতুরা যে এতোটা স্ট্রং তা তো বলোনি।"
রিতু ইলহামের কথার জবাব না দিয়ে বলে,"দুঃখিত। আপনাকে মেয়ে দিতে পারিনি।"
ইলহাম হেসে রিতু্র মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বলে,"পরের বার।"
রিতু ম্লান হাসে। ইলহাম রিতুর মাথা থেকে হাতটা সরিয়ে নিতে যায় তখনই রিতু বলে ওঠে,"হাত টা সরিয়ে নেবেন না। কিছুক্ষণের জন্য থাক। জীবনে কখনই মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি আমার। এর অনুভূতি আমার জানা ছিলো না। কেমন প্রশান্ত লাগছে নিজেকে ইলহাম মির্জা।"
"কি দেখছেন?"
সামিন আলোর কন্ঠ পেয়ে ঘুরে তাকায়। রিতুর কেবিনের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সে। আলো এগিয়ে গিয়ে বলে,"ভাই আর ভাইয়ের বৌয়ের ব্যাক্তিগত মুহুর্তে নাক গলানো অভদ্রতা মেয়র সাহেব। চলুন।"
সামিন হেসে ফেলে। তারপর বলে,"জানি, তবে বোনের আনন্দ দেখে আনন্দিত হবার অধিকার আমার আছে।"
***
ঘুম থেকে উঠে ইহান নিজেকে ফুপির পাশে শুয়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করলো। তাকে মাম্মার কাছে যেতে দেওয়া হয়নি দেখে অভিমানে ছোট্টো মনটা ভরে গেলো। বিছানা থেকে নেমে উচ্চশব্দে কাঁদতে শুরু করলো সে। ইশিতা ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠে বসে, পরী একটু বাইরে গিয়েছিলো, দৌড়ে ইহানের কাছে আসে। ইহানের গালে হাত বুলিয়ে বলে,"কাঁদছো কেনো ইহান?"
_আমি মাম্মার কাছে যাবো, পাপা কোথায়? বড় বাবা কোথায়? কাঁদতে কাঁদতে জানতে চায় ইহান।
ইশিতা ইহানকে আগলে নিয়ে বলে,"একটু পরে তোমাকে নিয়ে যাবো আমরা সোনা। তুমি জানো তোমার একটা ছোট ভাই হয়েছে। খুব সুন্দর একটা ছোট ভাই।"
ইহানের ছোটো ভাইয়ের কথা শুনে অভিমান হয় খুব। ছোটো ভাই হলে মাম্মা পাপারা তাকেই আদর করে শুধু,তাদের ক্লাসের রাফি বলেছে। রেগে মেগে ইহান ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়।
ইহানের পিছু পিছু ছুটে আসছিলো পরী।
হঠাৎ সামনে ইশমামকে দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পরে। একটুর জন্যে ইশমামের সাথে ধাক্কা লাগেনি তার। ইশমাম কিছু সময় পরীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলে ওঠে,"আজ গায়ে পরলে না যে! "
পরী কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। এভাবে বলার কি আছে! পরী কি ইচ্ছে করে গায়ে পরে? নিজের দোষ কখনো দেখে না! পরীও তো বলতে পারে সবসময় সে-ই পরীর রাস্তায় এসে পরে ঠেলাগাড়ির মতো।"
পরীর নীরবতা দেখে ইশমাম হেসে ফেলে।
মাথা তুলে ইশমামকে একপলক দেখে ইহানকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে যেতে থাকে পরী। ইশমাম দাঁড়িয়ে পরীকে দেখতে থাকে। কিছুটা দূরে গিয়ে পরী পিছু ফিরে তাকায়। ইশমামের দিকে অনর্থক দৃষ্টি দিয়ে সামনে পা বাড়াতেই দরজার কপাটে সজোরে মাথায় বারি খায় ।
ইশমাম চোখ বড় বড় করে ফেলে, তারপর পরীর দিকে এগিয়ে যাবে তার আগেই কপালে হাত চেপে ধরে পরী আড়াল হয়ে যায়। রা'গে তার ইচ্ছে করছে মাথায় আরেকটা বারি দিতে। সবসময় তার সাথেই এমনটা হবে কেন!
ইশমাম দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ হাসতে থাকে দীর্ঘসময় ধরে।
***
ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে ইশমাম ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ফোনটা হাতে নেয়। ফিহা নামের মেয়েটি ফোন দিচ্ছে তাকে। নাম্বারটা তার ফোনে সেইভ করে দিয়েছিল ইশিতা। এর আগে ভাইয়ার চাপে পরে দুবার কথা হয়েছিলো মেয়েটির সাথে। টুকটাক সৌজন্য আলাপ হয়েছিল শুধুমাত্র। এখন এতো রাতে মেয়েটির ফোন দেখে সে অনেকটাই অবাক হয়েছে। ফোনটা রিসিভ করতে গিয়েও করে না সে। এখন একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
মির্জা বাড়ির নতুন সদস্যের নাম রাখা হয়েছে "ইরফান"। তাকে ঘিরেই মির্জা বাড়ির লোকের যত আহ্লাদ,যত আনন্দ। সবাই তাকে পেয়ে অসম্ভব খুশি, মুখ ভার করে থাকে শুধু একজন। তার নাম ইহান। মুখ ভার করে স্কুলে যায়, স্কুল থেকে ফিরে মুখ ভার করে বড় মা আর বড় বাবার ঘরে বসে থাকে। মাম্মা পাপার রুমে সে যাবে না, ওখানে ভাইকে বেশি আদর করা হয়। তারও ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে ভাইকে আদর করে দিতে, কিন্তু তার কোলে ভাইকে দেওয়া হয়না । তাই সে যাবে না।
আলোর কাছে আজকের দিনটা সবচেয়ে ব্যস্ততম দিন। আজ ফুলির মা এবং সিতারা দু'জনেই ছুটিতে আছে। ইশিতা আর শান্তর রিসিপশনের তোড়জোড় চলছে বাড়িতে। হাতে রাজ্যের কাজ। ইরফানের বয়স এক মাস হয়েছে, রিতু তাকে নিয়ে চূড়ান্ত ব্যস্ত। বাড়ির সব ব্যাপার এবং ইহানকে আলোই দেখে। অবশ্যি তার মেয়র সাহেব সবসময় চেষ্টা করে তার কাঁধ থেকে কিছু দায়িত্ব সরিয়ে নিজের কাঁধে নেয়ার, কিন্তু সামনে এমপি ইলেকশন নিয়ে সেও ভীষণ ব্যস্ত। দুপুরে প্রায়শই খেতে আসে না সামিন। একেবারে রাত করে বাড়িতে ফেরে এবং নিয়ম করে বৌয়ের ঝাড়ি খে'য়ে ঘুমিয়ে যায়। আবার ঘুম থেকে উঠে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। আলো একদিন হু'মকিই দিয়ে বসে," এমন করলে আমি কিন্তু বাপের বাড়ি চলে যাবো মেয়র সাহেব।"
সামিন হেসে বলে,"লাভ কি? রাত বারোটায় তো ঠিকই দরজা খুলে স্বামীকে ঘরে ঢোকাবে। শুধু শুধু কষ্ট করে ও বাড়িতে কেনো যাবে! রাগ করতে হলে এ বাড়িতে বসেও দিব্যি রাগ করা যায়।"
আলো শাড়িগুলো আলমারিতে তুলে রাখতে রাখতে আনমনে হেসে ফেলে কথা গুলো ভেবে। আলমারিতে আরো নতুন ছয়টা শাড়ি যোগ হয়েছে। চারটার রং কমলা। কি অদ্ভুত একটা লোক। প্রত্যেক মাসে কিছু নির্দিষ্ট দিনে একটা করে শাড়ি নিয়ে এসে আলোর হাতে দেয়। যখনই তাকে জিজ্ঞেস করা হয় আজ কেন শাড়ি দিলেন? গম্ভীর কন্ঠে ভাষণ দেওয়ার মতো করে বলবে,"আজ অমুক দিন, এই দিনে বৌকে একটা শাড়ী কিনে না দিলে স্বামীত্বের অপমান হয়।"
গত শুক্রবার একটা শাড়ি এনে একই ভাবে হাতে তুলে দিয়েছিল মেয়র সাহেব। আলো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,"আজ কেন? আজ তো শোক দিবস।"
সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"সেটাই। আজ শোক দিবস। শাড়ির রং এজন্যই কালো। শোক দিবসে বৌকে কালো রঙের শাড়ি দিতে হয়।"
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,"আপনাদের পলি*টিশিয়ানদের সবকিছু জুড়েই দেখছি বঙ্গবন্ধু ও দেশ। একজন বাসর ঘরে বৌকে বঙ্গবন্ধুর গান শোনায়। আর তাদের লিডার শোক দিবসে বৌকে কালো রঙের শাড়ি উপহার দেয়।"
আলো উচ্চশব্দে হেসে ফেলে সেদিনের কথা মনে করে। ইহান বিছানায় বসে ড্রয়িং করছিলো, মাথা তুলে বড়মার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"তুমি হাসছো কেনো বড় মা?"
আলো কিছু বলতে যাবে তখনই সামিন হনহন করে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে পরে। আলো অবাক হয়ে যায় অসময়ে সামিনকে এভাবে বাড়িতে দেখে । সামিনের দৃষ্টি দেখে ঘা'বড়ে গিয়ে বলে,"কি হলো? বাইরে ঝামেলা করে এলেন নাকি? আবার কোন মেয়েকে তুলে আনলেন? না মানে এর আগেও তো ইলেকশনে জিততে মেয়ে তুলে এনেছিলেন। তাই বললাম। এমনিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। একা হাতে সংসার টা সামলাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছি। দু একজন সঙ্গী থাকলে বেশ হতো। "
শেষের কথাটা বলে আলো হাসছে।
সামিন আলোর দিকে তাকায়। বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,"ফিহা মেয়েটি বয়'ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়েছে।"
আলো স্তব্ধ হয়ে যায়। সামিন বলে,"বয়ফ্রেন্ড আছে! পরিবারের মতে বিয়ে করতে ইচ্ছুক নয় সেটা আগে বললে কি হতো? আজ ওদের বিয়ের কথা পাকা করতে চাচ্ছিলাম। কি একটা কান্ড ঘটে যেতো তবে!"
আলো সামিনের পাশে বসে বলে,"ভালোই তো হয়েছে, বিয়ের দিন পালিয়ে গেলে ব্যাপারটা বিশ্রী লাগতো।"
সামিন আলোর দিকে তাকায়,বলে "আমি ভাবছি অন্য কথা। আমার ভাইয়ের কপালে কি বৌ নেই? কি অদ্ভুত। সব মেয়েরই বয়ফ্রেন্ড আছে। কোন মেয়েকে বিশ্বাস করে ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেই! বিয়ের দু'দিন পরে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে পালিয়ে গেলে?"
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর আমতা আমতা করে বলে ওঠে,"আমি একটা কথা বলবো?"
_বলো।
_পরীকে কেমন লাগে? কত সুন্দরী,ডাক্তারি পড়ছে, ভদ্র, আমরা চিনি, ওকে জানি, ওকে ইশমামের পাশে মানায়?
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"আচ্ছা থাক বাদ দিন। আমি এমনিই বললাম। বাদ দিন !"
সামিন বলে ওঠে,"গ্রেট! গ্রেট আছিয়া! এমনটা তো কখনও মাথায় আসেনি আমার! দারুন ব্যাপার হবে। খুব মানাবে! একশো বার মানাবে! হাজার বার মানাবে! "
আলো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সামিনকে খুবই উচ্ছসিত লাগছে।
সামিন বলতে থাকে,"এক মুহুর্তও দেরী করবো না আমি, একমুহুর্তও না। এক্ষুনি পোনা চাচার সাথে আলাপ করবো আমি!"
_আগে ওদের দুজনের সাথে আলাপ করে নিন।
অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে আলো।
সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলো বলতে থাকে,"দু'জনের সাথে আগে আলাদা আলাদা হয়ে কথা বলে দেখুন। দুজনের থেকে মতামত নিন। তারপর কথাবার্তা আগান। হুট করে কিছু করা ঠিক হবে না।"
সামিন আলোর দিকে তাকায়,কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে ওঠে,"তোমাকে অনেক বুঝদার এবং সংসারী লাগছে, একেবারে হোসনে আরা শান্তির মতো। এসো আমি একটা থ্যাংক ইউ দেই তোমাকে।"
আলো মাথা ঘুরিয়ে ইহানের দিকে তাকিয়ে সামিনের দিকে তাকায়, চোখ পাকিয়ে বলে,"কি এগুলো? ইহান রয়েছে!"
সামিন অবাক হওয়ার ভান করে বলে,"কি? আমি কিছু খারাপ বলেছি? আমি বলেছি থ্যাংক ইউ দিতে চাই! সরাসরি চু'মুর কথা তো বলিনি।"
আলো কান চেপে ধরে চাঁপা স্বরে চেঁ'চি'য়ে বলে ওঠে,"চুপ করুন। মুখে কি কিছু্ই আটকায় না আপনার?"
_না, তোমার মুখে যেমন গালাগাল আটকায় না। তেমন।
_বাচ্চার সামনে যতসব উল্টো পাল্টা কথাবার্তা!
সামিন আলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে,"তো এটাই তো উচিত। ওদের শেখাতে হবে না বৌকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়?"
আলো শাড়ির আঁচল কাঁধে তুলে দ্রুতপায়ে হেঁটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। এই লোকটা একবার শুরু হলে সহজে চুপ করে না,তারই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত।"
সামিন পেছন থেকে আলোকে কিছুক্ষণ ডাকে। তারপর হেসে আপন মনে বলে ওঠে,"আশ্চর্য! সচেতনতা মূলক কথাবার্তা বললে জনগণ এভাবে ক্ষে'পে যায় কেন! নারীর প্রতি সহিংসতা নয়, নারীকে ভালোবাসার বিভিন্ন টেকনিক শেখাতে হবে এই প্রজন্মকে। এই প্রজন্মকে ভালো ভালো শিক্ষা না দিলে এরা দেশ এগিয়ে নিয়ে যাবে কি করে! স্মার্ট বাংলাদেশ কিভাবে হবে তাহলে! "
লাইব্রেরীতে চুপচাপ বসে আছে ইশমাম। তার সামনে একটা কফির মগ। অর্ধেকটা পরিমান কফি রয়েছে মগে যা কিছুক্ষণ আগেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে, খাওয়ার অযোগ্য। কিন্তু ইশমাম ডান হাতে মগটা তুলে নিয়ে চুমুক দেয়।
তার চোখ মুখের কোনো ভাবান্তর নেই। অবশ্য কিছুক্ষণ আগে তার সাথে যা ঘটে গিয়েছে এতে এই ঠান্ডা কফি তার গলা দিয়ে দিব্যি নেমে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ আগের ঘটনায় আলোকপাত করা যাক। ইশমামের জন্য পছন্দ করে রাখা পাত্রী পালিয়ে গিয়েছে, এটা ইশমামের জন্য একটা স্বস্তির খবর হলেও ইয়াসার মির্জার জন্য একটা দুঃসংবাদ। ইশমাম খবরটা পেয়েই লাইব্রেরীতে ঢুকে বসে থাকে বই হাতে নিয়ে। সামিন একটু আগে লাইব্রেরীতে এসে ইশমামের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে কাশি দিয়ে ইশমামের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। ইশমাম বই সামনে থেকে সরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার ভাইয়ের দিকে তাকায়।
সামিন নড়েচড়ে বসে বলে ওঠে,"তোর সাথে একটা কথা ছিলো।"
_দুইটা বলো।
_কিছু মনে করিস না। মেয়ের পরিবারও জানতো না মেয়ের সম্পর্ক আছে কোনো ছেলের সাথে।
ইশমামের বিরক্তি চরম পর্যায়ে পৌছায়। ভাইয়া এমন করে কথা বলছে যেন ইশমাম বিয়ে ভাঙার কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছে!
সামিন ইশমামের দিকে তাকিয়ে থাকে তার জবাবের অপেক্ষায়। ইশমাম ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,"কিছু মনে করিনি। ইটস অলরাইট।"
সামিন চুপ হয়ে যায়। ইশমাম বুঝতে পারছে তার ভাই শুধুমাত্র এটা বলার জন্য আসেনি, তাই নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করে,"বলো? আবার কি? আরেকজনকে দেখতে যেতে হবে? কাকে? আমি যাবো। এখন যাও এখান থেকে।"
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,"পরীকে তোর কেমন লাগে ইশমাম?"
ইশমাম হতভম্ব হয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন বলতে থাকে,"তোর জন্য পরীকে পছন্দ করেছে তোর বড় ভাবী ।"
ইশমাম দ্বিতীয় বারের মতো আবাক হয়। অবাক চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে,"বড় ভাবী?"
_হু। আমারও খুব পছন্দ পরীকে। এসব কথা আগে মাথায় আসলে কখনোই এখানে সেখানে পাত্রী দেখে বেড়াতাম না। তুই যদি আপত্তি না করিস তাহলে আমি পোনা চাচার সাথে কথা বলি? দেখ এখন তোর যদি মনে হয় পোনা চাচা এ বাড়ির কেয়ারটেকার তাহলে আমার আর কিছুই বলার নেই, আমি পোনা চাচাকে কখনোই কেয়ার টেকারের মতো দেখিনি তুই জানিস, সে আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী, বাবার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। কখনোই তাকে আমি ঐ চোখে দেখিনি। বাবাও না ।"
ইশমাম ভাইকে থামিয়ে দিয়ে বলে,"এতো ফরমালিটি করে কথা বলছো কেনো? পোনা চাচাকে আমিও ওই চোখে কখনও দেখিনা। যে লোকটার কাঁধে চড়ে বড় হয়ে ওঠা তাকে ঐ চোখে দেখবো?"
_তাহলে আমি কথা বলবো পরী আর তোর ব্যাপারে? চাইবো তোর জন্য পরীর হাত? অমন ভালো মেয়ে, মেধাবী, ভদ্র। তোর বড়ভাবীর নাকি বেশ মনে ধরেছে পরীকে।
ইশমাম ভাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে,"বড় ভাবীর বেশ মনে ধরেছে?"
_হু।
_তোমারও বেশ মনে ধরেছে?
_হু।
_ঠিকাছে, তুমি আর বড়ভাবী যা ভালো মনে করো। তোমরা খুশি হলে আমারও ভালো লাগবে। এখন যাও আমি বই পরছি।"
ইশমাম সামিনকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাতের বইটার পাতা ওল্টাতে থাকে।
সামিন ভাইয়ের থেকে মৌন সম্মতি পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ সে ছুটে যায় পরীর কাছে।
ইশমাম সেই থেকে লাইব্রেরী ঘরে বসে আছে ভাবলেশহীন হয়ে। ঠান্ডা কফিটা পুরোটাই গিলেছে, তাকিয়ে থেকেছে হাতের বইটার দিকে অনর্থক। একবার পরীর কথা ভাবলো সে, ঐ মেয়েটাকে বিয়ে করতে হবে? ঐ অদ্ভুত মেয়েটাকে? সামিনের কাছে আপত্তি জানালে অবশ্যই সামিন ইশমামের কথা শুনতো। কিন্তু কি লাভ! পরী না হলে অন্যকেউ , অন্যকেউ না হলে অন্যকেউ। আর কত! এভাবে আর কত!
কারো পায়ের আওয়াজে ইশমাম মাথা তুলে তাকায়। ভেবেছিলো ভাইয়া এসেছে, পুনরায় বইয়ের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলে ওঠে,"বললাম তো আমি রাজি। আবার এলে কেনো। যাও।"
"আমার আপনার সাথে কথা ছিলো।"
পরীর গলার আওয়াজে ইশমাম চ'ম'কে উঠে তাকায়। সে এই মেয়েটাকে একেবারেই আশা করেনি। পরী মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইশমাম নড়েচড়ে বসে বলে,"বলো।"
"এই বিয়েতে আমি রাজি নই। ভাইয়াকে প্লিজ বুঝিয়ে বলবেন একটু আপনি? আমার আপত্তি জানানোর সাহস নেই ভাইয়াকে।"
ইশমাম পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে বোকার মতো। কিছু সময় পরে নিচু স্বরে বলে,"আচ্ছা ঠিকাছে বলবো। যাও।"
পরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ইশমাম বলে,"কি হলো যাও!"
_আপনি কি কিছু মনে করেছেন?
_মনে কেনো করবো? তুমি একজন শিক্ষিতা এবং প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে। ভাইয়া ভাবীর খেয়াল খুশিতে তোমার জীবন চলতে পারে না। আমি ভাইয়াকে বুঝিয়েই বলবো, তুমি যাও।
পরী যায়না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বলে ওঠে,"আপনার মধ্যে কোনো খুঁত নেই। যেকোনো মেয়েই আপনাকে স্বামী হিসেবে পেতে চাইবে। দয়া করে এই প্রত্যাখ্যান আপনি অপমান হিসেবে নিবেন না।"
ইশমাম খুব ভালো করে পরীকে দেখতে থাকে। অসম্ভব রকমের সুন্দরী এই মেয়েটাকে এখন যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক লাগছে। কথাবার্তা বলছে বড় মেয়েদের মতো। আচরণ স্বাভাবিক এবং সহজাত। কোনো ধরনের ন্যাকামী নেই সংলাপে। ইশমামের খুবই আগ্রহ জাগে মেয়েটি কেনো তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তা জানতে । লাজুক এবং নমনীয় দেখতে মেয়েটির কি কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে? থাকতেই পারে। জিজ্ঞেস করবে না করবে না করেও ইশমাম মুখ ফসকে বলে ফেলে,"বয়ফ্রেন্ড আছে?"
পরী মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে দেয়। ইশমাম বলতে থাকে,"বেশ। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। এটা বিয়ে করার সময়ও নয়। ভাইয়াকে ম্যানেজ করবো।"
"আমি আসলে কারো জীবনে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে থাকতে চাইনা।"
ইশমামের কথা শেষ না হতেই পরী বলে ওঠে। ইশমাম কপাল কুঁচকে বলে ওঠে,"সান্ত্বনা পুরস্কার? হোয়াটস দ্যাট?"
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পরী নিচু স্বরে বলতে থাকে,"প্রথম প্রেম হচ্ছে একজন পুরুষের কাছে একটা ট্রফির মতো। যেটা জিতলে নিজের জন্ম সার্থক মনে হয় তাদের কাছে আর হারলে জীবনে যতই বিকল্প নারী আসুক না কেনো, তারা মনে করে ওটা তাদের সান্ত্বনা পুরস্কার। আমি কোনো সান্ত্বনা পুরস্কার হয়ে থাকতে চাই না কোন পুরুষের কাছে।"
ইশমাম পরীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। মেয়েটার বয়স কত! বাইশ কি তেইশ বছর! তার থেকে চার-পাঁচ বছরের ছোটো। কিন্তু বাস্তবতা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান তার হয়েছে,বোঝাই যাচ্ছে।
পরী ইশমামকে হাসতে দেখে মাথা তুলে তাকায় ইশমামের দিকে। ইশমাম হাসতে হাসতে বলে,"অনেক বড় বড় কথা বলতে পারো দেখছি! আচ্ছা যাও ভাইয়া আর ভাবীকে আমি খুব করে বলে দেবো তোমাকে যাতে সান্ত্বনা পুরস্কার না বানানো হয়। তুমি অবশ্যই ট্রফি হবে কারো না কারো লাইফে, যে তোমাকে পেয়ে ধন্য হয়ে যাবে, ট্রফির মতো সাজিয়ে রাখবে তোমাকে, তোমার অনুভূতিকে। এখন যাও। মন দিয়ে পড়াশোনা করো।"
_ভাইয়া যদি জানে আমি আপনাকে রিজেক্ট করেছি তবে ভাইয়া খুব কষ্ট পাবে,আমি কোনো অবস্থাতেই ভাইয়াকে কষ্ট দিতে চাইনা...
আমতা আমতা করে বলে ওঠে পরী।
_ঠিকাছে যাও, ভাইয়াকে বলবো আমার তোমাকে পছন্দ হয়নি।
পরী চুপচাপ ইশমামের ঘর থেকে বের হয়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সে ঘুরে আবারও ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম তার দিকে তাকিয়ে ছিলো, ম্লান হেসে পুনরায় বই হাতে নেয়। পরী দ্রুতপায়ে হেটে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
ইশমাম বই হাতে নিয়ে মুচকি হাসে । যতটা ন্যাকা মনে হয়েছিলো ততটা ন্যাকা নয় এই মেয়েটা।
***
সামিনের চেঁচামেচিতে পরীর ঘুম ভেঙে যায়। এই সপ্তাহে সে হোস্টেলে যায়নি। ইশিতার অনুরোধে বাড়িতেই ছিলো। অবশ্য সামিন বরাবর তাকে ধমকাতো বাড়িতে না থেকে হোস্টেলে কেন থাকে সেজন্য। চেঁচামেচির আওয়াজ টা আসছে ইশমাম মির্জার ঘর থেকে। ঘরের বাইরে আলো ইরফানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল টা মুখে দিয়ে খুব মজা করে চুষছে ছোটো প্রান টা। আলো সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও তার কান শুনছে দুই ভাইয়ের কথোপকথন।
পরী ইশিতার ঘর থেকে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়।
ইশমাম ল্যাপটপে কিছু একটা টাইপ করে যাচ্ছে। সামিনের দিকে সে মাথা তুলে তাকায় না। সামিন গলার স্বর উঁচু করে বলতে থাকে,"প্রথমে কেনো রিজেক্ট করলি না? আমি যখন পরীর সাথে কথা বলে সব ঠিক করে ফেলেছি তখনই কেনো রিজেক্ট করলি? এখন আমি পরীকে,পোনা চাচাকে কি জবাব দেবো? তুই কেন করছিস এমন ইশমাম!"
_তোমার কোনো জবাব দিতে হবে না। আমি পোনাচাচা আর পরীর কাছে মাফ চেয়ে নেবো।
কি-বোর্ডে টাইপ করতে করতে ঠান্ডা গলায় বলে ইশমাম। সামিন কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ইশমামের হাত থেকে ল্যাপটপ ছিনিয়ে নিয়ে দূরে ছু'ড়ে মারে।
ভাঙচুরের আওয়াজে পরী কেঁ'পে ওঠে। মানুষটা তার জন্য এতো কথা শুনছে ভাইয়ার। পরী ঠিক করলো সে ভাইয়াকে সত্যিটা বলে দেবে, ইশমামকে সে রিজেক্ট করেছে, ইশমাম নয়।
ইশমাম চুপচাপ বসে আছে। তার যে একটা ল্যাপটপ ভেঙে গিয়েছে সেদিকে তার কোনো হেলদোল নেই। সামিন কয়েক মুহূর্ত ইশমামের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ঘরের বাইরে বেরিয়ে পরীর সামনে পরে যায় সামিন,পরী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, একপলক পরীকে দেখে সামিন নিজের ঘরে চলে যায়,আলো ইশমামের ঘরের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইরফানকে কোলে নিয়ে সামিনের পিছু পিছু চলে যায়।
পরী ইশমামের ঘরের বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ইশমাম বিছানার ওপরে চুপচাপ বসে থাকে, তার দৃষ্টি ভাঙা ল্যাপটপের দিকে।
***
ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে এগারোটার ঘরে। পরী হাতের বইটা পাশে সরিয়ে রেখে ইশিতার দিকে তাকায়। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে শান্তর সাথে কথা বলছে সে। এদের কথা ফুরাতেই চায়না। পরী বুঝতে পারে না,এরা এতো কি কথা বলে সারাদিন, কোথা থেকে খুঁজে পায় এতো কথা? তিনদিন পরে শান্ত ভাইয়া ইশিতা আপুকে অনুষ্ঠান করে নিজের বাসায় নিয়ে যাবে। তার অফিসের কাছেই দুই বেডরুমের চমৎকার দেখতে একটি ছোটো ফ্ল্যাট ভাড়া করেছে শান্ত। সেদিন শান্তিনীড়ে এসে আলো আর পরীকে নিয়ে গিয়েছিলো ফ্ল্যাট সাজাতে। আলো আর পরী খুব সুন্দর করে ইশিতার নির্দেশ মতো গোটা ফ্ল্যাট সাজিয়ে দিয়ে এসেছিলো।
ওড়নাটা উঠিয়ে গাঁয়ে জরিয়ে নিয়ে পরী পশ্চিমের টানা বারান্দার দিকে যায়। হঠাৎ তার মনে হলো ইশমাম সেখানে আছে। দরজা ঠেলে দেখতে পেলো তার অনুমান ঠিক, ইশমাম দাঁড়িয়ে আছে। কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকাতেই পরীকে দেখে আবারও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তার হাতে একটা সিগারেট, এবং আজ সে সিগারেটটা পা দিয়ে পি'ষে দেয়না। হাতে ধরেই দাঁড়িয়ে থাকে। পরী ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। ইশমাম চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরে পরী বলে ওঠে,"সরি! আমার জন্য আপনাকে এতো গুলো কথা শুনতে হয়েছে। ভাইয়া রা'গ করে আছে আপনার উপর আমার জন্য। আপনার সাথে কথা বলছে না!"
ইশমাম ম্লান হাসে, তারপর বলে,"ঐ লোকটা আমার ভাইয়া। দেখবে কাল সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে ফল কেনো খাচ্ছি না বলে বকাঝকা করছে।"
পরী মাথা নিচু করে মৃদু হেসে বলে,"আপনার জীবনে ভাইয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাইনা?"
_মনে করো ভাইয়াই আমার জীবন, আমার জুতার ফিতে বেঁধে দেওয়া থেকে শুরু করে আমার সব দোষ নিজের মাথায় নিয়ে বাবার কাছে বকা শোনা, মায়ের হাতে মা'র খাওয়া, সবসময় আমাকে, আমাদের আগলে রেখেছে। এবাড়ির সবার জীবনই সামিন ইয়াসার মির্জা কেন্দ্রিক।
_আমার আর বাবার জীবনও কিছুটা ভাইয়া কেন্দ্রিক। ভাইয়া শুধু আমাদের দিয়েই গিয়েছেন, প্রতিদানে কখনও কিছু চায়নি, আজ ভাইয়াকে একপ্রকার ঠকিয়েছি আমি তাইনা?
প্রশ্নটি করে পরী ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম দুমিনিট চুপ করে থেকে বলে,"ছোটো মানুষ এতো কিছু মাথায় নিতে হবে না। ভাইয়া তোমাকে যা যা দিয়েছে তার বিনিময়ে ভাইয়া আর তার পরিবারকে ফ্রিতে চিকিৎসা দিও। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার এক্সাম কবে?"
_নেক্সট মান্থে।
_প্রস্তুতি ভালো? না মানে তোমাকে সব ধরনের বাঁদ'রামি করতেই দেখা হয়, শুধুমাত্র একাডেমিক বই ধরতে দেখিনা।
পরী হেসে ফেলে। হঠাৎ করে তার মনে হলো,তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা অবিকল ইয়াসার মির্জার মতো। একটুও রামগরুরের ছানা নয়।
ইশমাম একপলক পরীর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। পরী রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে বলে ওঠে,"আপনার প্রাক্তন অনেক সুন্দরী ছিলো?"
ইশমাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,"হু।"
পরী চুপ হয়ে যায়। ইশমাম বলে ওঠে,"সৌন্দর্য বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ দুধরনের । বাহ্যিক সৌন্দর্যের কথা যদি বলি, তার গায়ের রং টা একটু চাপা ছিলো। আর অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের কথা যদি বলি তবে তার মন ছিলো একেবারে সাদা, কোনো ভেজাল নেই, ফকফকা। তোমার গাঁয়ের রং-এর মতো ফকফকা।"
পরী ইশমামের কথায় খিলখিলিয়ে হেসে ফেলে। ইশমামের কাছে পরীর বাচ্চাসুলভ আচরণ হঠাৎ করে বিরক্তিকর লাগছে না। যেন পরীকে হাসাতে পেরে তার নিজেরই খুব ভালো লাগছে।
পরী হাসি থামিয়ে চুপ হয়ে যায়। ক্ষণবাদে পরী বলে ওঠে,"তাকে মিস করেন?"
ইশমাম পরীর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,"অন্যের স্ত্রীকে মিস করবো কেনো? আমাকে কি তোমার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের নিব্বা মনে হয়? আমি যথেষ্ট বাস্তববাদী একজন লোক। বাস্তবতাকে খুব সহজে হজম করে নেই, তোমার কোনো ধারণা নেই! সে সবসময় একটা রেসপেক্টের যায়গা হয়ে থাকবে আমার কাছে। আর কিছুই নয়।"
পরী চুপ করে থাকে, হঠাৎ করে এই লোকটার কথা শুনতে খুব ভালো লাগছে তার। আগে কত হেসেছে লোকটার দেবদাসের মতো অবস্থা নিয়ে, এখন পরী নিজের কাছে নিজেই বেশ লজ্জিত।
ইশমাম চুপ করে থেকে বলে ওঠে,"তা তুমি কখনও কাউকে পছন্দ করোনি?"
পরী মাথা নাড়িয়ে নিচু স্বরে বলে,"করেছিলাম আমার এক ক্লাসমেটকে। তেরো দিনের জন্য পছন্দ করেছিলাম। প্রথমে আমাকে ইয়াসার মির্জার আপন বোন ভেবেছিলো, তাই একটু ঘুরঘুর করেছিলো আমার পিছু পিছু। পরে যেই শুনেছে আমি কেয়ারটেকারের মেয়ে, কে'টে পরেছে!"
হাসতে হাসতে বলে পরী।
ইশমাম পরীর দিকে তাকায়। তারপর বলে,"তোমারও মনের মানুষ ছিলো? তো এখন তো এটা বলাই যায় তুমিও তোমার হাজবেন্ডকে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে দেখবে। আমাদের যদি বিয়ে হতো তাহলে আমরা দুজন দুজনের সান্ত্বনা পুরস্কার হতাম। কি আশ্চর্য!"
পরী হেসে ফেলে। ইশমাম দীর্ঘ সময় পরীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,"আচ্ছা যাও। ঘুমাও। তোমার জন্য অনেক শুভকামনা,আশা করি জীবনে এমন একজন সঙ্গী পাও,যে তোমাকে ট্রফি হিসেবে দেখবে,কোনো সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে নয়।"
_আপনিও এমন কাউকেই খুঁজে পাবেন। আশা করি।
অস্ফুট স্বরে বলে পরী বারান্দা থেকে চলে আসে। আসার সময় ঘুরে সে আবারো একপলক ইশমামকে দেখে। রেলিং ধরে ওদিকে ফিরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।
***
সামিন একটু নড়তেই আলো টের পেয়ে যায় সামিন ঘুমায়নি। হাত বাড়িয়ে বেড সাইডের বাতি জ্বেলে আলো উঠে বসে। সামিন কপালে হাত দিয়ে শুয়ে ছিলো, আলোর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,"ঘুমাওনি?"
আলো সামিনের কাছে এগিয়ে বসে তার কপাল থেকে হাত সরিয়ে দেয়। একটু ঝুঁকে সামিনের চুলের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে মাসাজ করে দিতে দিতে বলে,"মাথা ধরেছে খুব? এজন্য বুঝি জেগে আছেন? ডাকলেন না কেনো?"
সামিন হেসে আলোর ডানহাত টেনে হাতের পিঠে চু'মু খায়। তারপর নিজের গালে আলোর হাতটা বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,"কি অবস্থা করেছো নিজের। কেমন অসুস্থ লাগছে তোমাকে। আমার দোষ, এতো ব্যস্ততায় তোমার একটু খেয়াল রাখতে পারিনা। সামনে ইলেকশনের চাপ, এজেন্সির কাজ, দলের কাজ, ভাই-বোনকে সময় দিতে গিয়ে তোমাকে খুব কম সময় দিয়ে ফেলি আমি। তুমি কি রা'গ করো? "
আলো হেসে ফেলে, তারপর বলে ওঠে,"এই সবকিছু আপনার জীবনের অংশ। এদের প্রাপ্য সময়টুকু আপনি অবশ্যই দেবেন। আমি কেন রাগ করবো? তাছাড়া আমি কি ছোটো বাচ্চা যে আমার খেয়াল রাখতে হবে?"
সামিন উঠে বসে। আলোকে বুকে টেনে নিয়ে বলে,"না তুমি ছোটো বাচ্চা নও। শুধুমাত্র মা বাবার আদরের দুলালী, আমার শশুর বিশিষ্ট সাংবাদিক আতাউর আলম দুই বেলা আমাকে ফোন করে নালিশ করছে তুমি তাদের ঠিকমতো ফোন করে কথা বলো না। এমনটা কেনো হচ্ছে?"
_মিথ্যা কথা, সন্ধায় আব্বুর সাথে কথা বললাম। ওনারা আপনার কাছে বানিয়ে বলছে।
সামিন আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,"একটু ফ্রি হলেই ও বাড়িতে নিয়ে যাবো তোমাকে। ঠিকাছে?"
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন বলতে থাকে,"আলোদের শুরুতে আন্ডারস্টিমেট করা হয়,আলোরা কিন্তু খুব ভালো বৌ হয়। "
আলো হাসে। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"ভালো বৌ কিনা জানিনা, তবে বুঝতে পারছি আমার শিকড় ছড়িয়ে যাচ্ছে এই বাড়িতে, একটু একটু করে জরিয়ে যাচ্ছি আমি, আমার অস্তিত্ব এই বাড়ির প্রত্যেকটা ইটের সাথে মিশে যাচ্ছে।"
সামিন দুমিনিট আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে আরো নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করে। সামিনের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে আলো দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে। সে হঠাৎ টের পাচ্ছে, তার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। ইদানিং সে ভালো করে লক্ষ্য করেছে,সামিন তাকে কাছে টানলেই তার খুব অস্বস্তি বোধ হয়। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত অবসন্ন লাগে, রাজ্যের অবসাদ ঘিরে ধরে তাকে। কিন্তু এর সঠিক কারন সে জানে না, জানলে সামিনকেও ব্যখ্যা করতে পারতো। অবশ্য সামিন কখনোই আলোর অনুমতি ব্যতীত আলোকে গভীর ভাবে স্পর্শ করে না। কখনোই নিজের পুরুষ মনের ইচ্ছাটাকে বড় করে দেখে না, আলোর অনুভূতি পড়ার চেষ্টা করে আগে, কিভাবে যেন এই লোকটা আলোকে পড়ে ফেলে খুব সহজেই।
আলোর অস্বস্তি টের পেয়ে সামিন থেমে যায়। শক্ত বাহুডোর থেকে আলোর পাতলা ফিনফিনে শরীরটা আলগা করে আলোর চোখে চোখ রাখে।
স্বামীকে উপেক্ষা করার অপরাধবোধে ভুগছে আলো। তার চোখের দৃষ্টি সেটাই বলছে। সামিন তাকে ভুগতে না দিয়ে কপালে প্রগাঢ় এক চুম্বন এঁকে দেয়। আবেশে দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে আলো। সামিন এমন ভাবে বালিশে শুইয়ে দিয়েছে তাকে যেন আলো কোনো ছোটো বাচ্চা, আলোকে সন্তর্পনে রাখা উচিত,নয়তো তার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
সামিনের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আলো। প্রতিদিন কি একটা লোকের প্রেমে পড়া যায়? অনুভূতির এমন নিয়ম আছে নাকি? তাহলে হয়তো আলো প্রতিদিন এই মানুষটার প্রেমে পরে। যত দিন যাচ্ছে,আলোর অস্তিত্ব মিটিয়ে দিয়ে এই মানুষটা যে তার কথাবার্তা, চালচলন, জীবনবোধ দিয়ে আলোকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিচ্ছে এই মানুষটা জানে না। সামিন সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র পুরুষ যে একজন সঠিক মানুষ হয়ে ভুল সময়ে, ভুল ভাবে আলোর জীবনে প্রবেশ করেছে। চেষ্টা করছে স্ত্রীর প্রতি নিজের সর্বোচ্চ ভালোবাসা,যত্ন, বিশ্বস্ততা ঢেলে দিতে।
আলোকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সামিন নরম গলায় বলে,"জালাবো না আজ, ঘুমাও।"
আলো লাজুক হাসি হাসে। সামিন বাতি নিভিয়ে শুয়ে পরে। দু'জনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। সামিন হঠাৎ বলে ওঠে,"বুকে আসতে চাচ্ছো আমার?"
আলো দ্বিতীয় বারের মতো লজ্জা পায়। সে কখনোই নিজে থেকে সামিনের বুকে মাথা রাখে না,এই কাজটা সামিনই করে। আজ খুব ইচ্ছে করছিলো আলোর সামিনের বুকে মাথা রাখতে। সামিন কিভাবে যেন টের পেয়ে গেলো।
আলোকে টেনে আলোর মাথাটা নিজের বুকে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিচু স্বরে বলে ওঠে,"তোমার এক্সাম শেষ হলেই আমরা একটা বেবী নেবো, আর তোমার কোনো কথা শুনবো না আমি। আমার বেবী লাগবে।"
আলো চুপ করে থাকে,সে তার স্বামীর হৃদস্পন্দন শুনতে ব্যস্ত। সামিন আলোকে বলে,"ইশমাম খেতে গিয়েছিলো টেবিলে?"
_হু।
_খেয়েছে ঠিকমতো?
_হু।
_কি একটা কান্ড করে ফেললাম আলো, রাগের মাথায় ল্যাপটপ টা ভেঙে ফেললাম। ও দীর্ঘদিন যাবত একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছিলো। সব নষ্ট করে দিলাম।
কন্ঠে অনুশোচনা নিয়ে বলে সামিন।
আলো স্বাভাবিক গলায় বলে,"আমার হঠাৎ মনে হলো পরী মেয়েটা বেস্ট হবে। সেজন্যই বলেছিলাম। প্লিজ দুই ভাই ঝামেলা করবেন না আর। আপনাদের ঝামেলা দেখতে একটুও ইচ্ছে করে না আমার। ওর যদি ইচ্ছা না থাকে তাহলে আর দরকার নেই মেয়ে দেখার।"
_ঠিক বলেছো। বড় হয়ে গিয়েছে না। আমার পছন্দে শার্ট কেনে বলে কি আমার পছন্দে বিয়ে করে নেবে! কি অদ্ভুত আমি।
আলো বলে,"বাদ দিন। কাল ছোট ভাইয়ের কাছে সরি বলে ওকে একটা ল্যাপটপ কিনে দিবেন। একটু বেশিই বকাবকি, চেঁচামেচি করেন আপনি। পরে তো ঠিকই ওদের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দেন।"
কিছুক্ষণ আলো বকবক করে চুপ হয়ে যায়,সামিন ভারি নিঃশ্বাস ফেলছে, ঘুমিয়ে পরেছে সে। আলো অন্ধকারে সামিনের বুক থেকে মাথা তুলে সামিনের কপালে ছোট করে একটা চু'মু একে দিয়ে আবারও স্বামীর বুকে মাথা রাখে।
***
বারংবার অলোর নাম্বার থেকে ফোন আসছে। সামিন ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলো। কিন্তু ফোনটা টেবিলের ওপর রাখা ছিলো,তাই স্ক্রিনে আলোর "Aachiaa" নামটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। মিটিং এ কথা বলতে বলতে না চাইতেও চোখ যাচ্ছে ফোনটার দিকে।
তৌফ রনির পেটে খোঁচা মে'রে ফিসফিসিয়ে বলে,"এখন ভাইকে কিছু বললেই তো আমাদের চিবিয়ে খাবে। সবসময় বলতো বৌ বাড়িতে রেখে আসতে। এখন নিজেই বৌয়ের যন্ত্রণায় অস্থির।"
সামিন কথা থামিয়ে তৌফের দিকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"কি বললাম এতক্ষণ,বলতো?"
তৌফ থতমত খায়। আমতা আমতা করে বলে,"শিক্ষা, শান্তি,প্রগতি। তিনটা আমাদের মূলনীতি।"
দলের সবাই উচ্চশব্দে হেসে ওঠে।
সামিন চোখ রাঙানি দিয়ে আবারও আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পরে।
আজ সামিন দলের ছাত্রনেতার পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করেছে রাহাতকে। সাধারণ সম্পাদক রনি।
সেজন্য আজ পার্টি অফিসে ছোটোখাটো একটা গেট টুগেদার এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
সামিন দলের ছেলেদের উদ্দেশ্য বক্তৃতার মাধ্যমে তাদের সবাইকে সবার দায়িত্ব পুনরায় বেশ ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
বক্তৃতার শেষ অংশে সামিন বলে ওঠে,"তো এটাই সবাই মনে রাখবে, শিক্ষা,শান্তি,প্রগতি। তিনটাই আমাদের মূলনীতি। এই তিনটা মূলনীতিকে সামনে রেখে আমরা আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবো এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। এবং আমি আশাবাদী,আমি যেভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি, তোরাও দিবি।"
সবাই মাথা নাড়ে। সামিন বক্তৃতা শেষ করেও খুবই ইনফরমাল ভাবে বলতে থাকে,"এখন তোদের উদ্দেশ্যে কিছু সতর্কতা মূলক কথা, বড় ভাই হিসেবে বলতে চাই। যারা এখনো অবিবাহিত আছিস,যেমন রাহাত,আরাফ, রনি তারা আমার কথাটা মাথায় রাখবি। মন দিয়ে দলের কাজ করবি। শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি, শুধুমাত্র এই তিনটাই আমাদের মূলনীতি। কোনো মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে করা আমাদের মূলনীতি নয়। তো যদি নিজে জীবনে শান্তি নিয়ে বাঁচতে চাও তাহলে ভুলেও অমন কাজ করবে না বাছাধনেরা।"
সবাই চুপ করে আছে। সামিন এইবার ফোনটা হাতে নেয় । আলোর নাম্বার থেকে সতের টা মিসড কল। আজ সামিনকে রিমান্ডে নিয়ে তিনঘন্টার জিজ্ঞাসাবাদ করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই শাস্তি প্রদান করা হবে তা সামিন বেশ টের পাচ্ছে।
তাই আগেভাগেই প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। পকেট থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে শাওনের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজের বাইকের চাবি দিয়ে বলে,"যতীন কাকার ফুলের দোকান থেকে এক্ষুনি গিয়ে একটা ফুলের মালা বানিয়ে নিয়ে আয়। বেলী,কদম, বকুল, রজনীগন্ধা যেকোনো একটা হলেই হবে। শিগগিরই।"
তৌফ বলে ওঠে,"ভাই কদম ফুল এই সিজনে পাবেন না, আর পেলেও কদম ফুল দিয়ে মালা হয়না।"
_আরে কথার কথা!
তারপর শাওনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"যা এক্ষুনি।"
সবুজ শাওনকে থামিয়ে দিয়ে বলে,"দাড়া। আমার থেকেও টাকা নিয়ে যা।আমার জন্য ও নিয়ে আসবি।"
সবুজের দেখাদেখি বিবাহিত সবাই শাওনের হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে ফুলের মালা আনতে নির্দেশ দেয়।
শাওন বোকার মতো হাতের টাকা গুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। আর কতদিন এভাবে বড় ভাইদের বৌয়ের জন্য ফুল কিনতে হবে! তার একটা প্রেম হচ্ছে না কেনো!
সাংগঠনিক কাগজপত্র গুলো গুছিয়ে নিয়ে সামিন টেবিলের লকার খুলে সেগুলো রেখে দিতে গিয়ে একটা প্যাকেটে চোখ যায় তার। প্যাকেট টা হাতে তুলে নিয়ে সেটার ভেতর থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করে রাহাতের দিকে তাকায়। রাহাত সামিনের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,"ওও এইটা। এইটা তো ভাবীর সেই ফোনটা ভাই। মনে নেই? আপনিই নিজেই তো রেখেছিলেন।"
সামিনের মনে পরে যায়। সে ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে। রাহাত বলতে থাকে,"এটা তো একটা ডেডবডি এখন। দিন ফেলে দিচ্ছি।"
সামিনের হঠাৎ মনে পরে যায়,আলো সেদিন এটার ভেতরে থাকা সিমকার্ডের কথাই বলছিলো। ফোনের ভেতর থেকে সিমকার্ড টা বের করে সামিন নিজের ফোনে ঢুকিয়ে নেয়। তখনই শাওন ফুলের মালা নিয়ে এসে পরে, রজনীগন্ধার মালা।
রাহাত বলে ওঠে,"ভাই মেঘ ডাকছে। আপনি গাড়ি আনেননি আজ। ভিজে যাবেন। আপনি যান। আমি আরাফ আর রনি কিছুক্ষণ ক্যারাম খেলে অফিস বন্ধ করে যাবো।"
সামিন উঠে পরে, দেরী করলে বৃষ্টিতে পেয়ে বসবে আজ। রিমান্ড তিনঘন্টার বদলে সারারাত চলবে তাহলে। আগে ভাগে উঠে পরাই ভালো।
ছেলেদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সামিন বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট করে।
***
দরজা খুলতেই আলোর থমথমে মুখটা দেখে একটা বড়সড় ধাক্কা খায় সামিন। মুখটা অমাবশ্যার রাতের মতো অন্ধকার করে রেখেছে।
সামিন ভেতরে ঢুকতেই আলো দরজা বন্ধ করে চুপচাপ ডাইনিং রুমে চলে যায় টেবিলে খাবার সাজাতে।
সামিন ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। সে মহাচিন্তায় পরে গিয়েছে, এখন যদি আলোকে বলে সে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে তাহলে বিশ্বযু'দ্ধ লেগে তো যাবেই সাথে নিজেও খাবে না। তার কি করা উচিৎ! দলের ছেলেদের সাথে পেটপুরে বিরিয়ানি খেয়েছে,পেটে আর যায়গা নেই কোথাও!
তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে বিরবির করে বলে,"বুদ্ধি দিয়ে কাজ করো সামিন। কিছু একটা বুদ্ধি বের করো।"
খাবার টেবিলের কাছে গিয়ে দেখে আলো তার জন্য থমথমে মুখে অপেক্ষা করছে। সে একটা চেয়ার টেনে বসে না খাওয়ার বাহানা দিতে যাবে তখনই দেখতে পায় টেবিলে সরষে ইলিশ। যবে থেকে আলো জেনেছে সামিন সরষে ইলিশ পছন্দ করে তখন থেকে বৃষ্টি দেখলেই আলো এটা তার জন্য রাধবে। সামিন আলোর মুখের দিকে তাকায়, মেয়েটার জন্য মায়া হচ্ছে খুব। এখন যদি শোনে সামিন খাবে না তাহলে খুব কষ্ট পাবে। সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে প্লেটে সামান্য কিছু ভাত তুলে নেয়।
আলো দু পিস মাছ তুলে দিয়ে নিজেও চুপচাপ খেতে শুরু করে। এখন অবধি একটা শব্দও সে উচ্চারণ করেনি সামিনের সাথে।
সামিন মাছ খুঁটে মুখে দিয়ে আড়চোখে আলোর দিকে তাকায়। পেটে একদমই যায়গা নেই সামিনের। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।
আলো দুই লোকমা ভাত মুখে দিয়ে হাত ধুয়ে উঠে পরে। সামিন মাথা তুলে আলোর দিকে তাকায়। আলো নিস্তেজ কন্ঠে বলে,"নাটক করতে হবে না। খেতে না চাইলে উঠে পড়ুন।"
সামিন হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়ায়। নরম গলায় বলে,"আমি তখন মিটিং এ ছিলাম আলো। রাগ করো না আছিয়া, সেজন্য ফোনটা ধরিনি।"
আলো চুপচাপ টেবিল পরিষ্কার করে দোতলায় উঠতে থাকে। সামিন পিছু পিছু এসে বলে,"ও আছিয়া। আর দেরী করবো না। সবসময় এমন করি বলো?"
আলো ঘরে ঢোকে, সামিন ডাকতেই থাকে,"আছিয়া! শোনোনা, প্লিজ শোনো না।"
আলো কোনো জবাব না দিয়ে বিছানা ঠিক করে দেয়। সামিন চুপচাপ আলোকে কিছুক্ষণ দেখে পেছন থেকে শক্ত করে জাপ্টে ধরে আলোর গালে চুমু খেতে থাকে,আলো হাত পা ছুড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। কিন্তু অমন বলশালী পুরুষের সাথে পেরে ওঠার মতো শক্তির কিছুটা ঘাটতি যে রয়েছে তার নারী কায়ায়। সামিন এক নাগাড়ে অনেকগুলো চু'মু দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে, তারপর বলতে থাকে,"শান্ত হও আমার বাঘিনী! শান্ত হও।"
আলো তীব্র রাগে ফুঁ'সছে। সামিন ধীরে ধীরে আলোকে ছেড়ে দিয়ে বেড সাইডের টেবিলের ওপর থেকে রজনীগন্ধার মালাটা এনে আলোর খোঁপায় লাগিয়ে দেয়। আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। সামিন আলোকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলে,"ভুল করেছি, বরাবরের মতো শাস্তি মাথা পেতে নেবো। "
_দরকার নেই তো। আপনার যা ইচ্ছে করুন। বাঁধা দিচ্ছে কে!
_আচ্ছা যা ইচ্ছে করবো তো। আগে একটু শান্ত হও।
আলো ক'ট'ম'ট দৃষ্টি দিয়ে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বলে,"পারফেক্ট! পারফেক্ট একেবারে! এই তো আগের ফর্মে ফিরেছো। তোমাকে এভাবেই বেশ মানায়।"
হুট করে আলো হেসে ফেলে। সামিন বলে,"এইতো হেসে ফেললে। এখন যাও। আমাদের দুজনের জন্য দুই কাপ কফি নিয়ে এসো। ব্ল্যাক কফি। কফি খেয়ে আজকের কৃতকর্মের জন্য খুব ভালোভাবে, আয়োজন করে মাফ চাইবো আমি। যাও। প্লিজ যাও আছিয়া!"
কয়েক মূহুর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আলো ঘর থেকে বের হয়। সামিন দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হেসে বিছানায় ধপ করে বসে পরে। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। সাই সাই করে বাতাস বইছে। জানালা থেকে বৃষ্টির ছাঁট এসে ভেতরে পরছে। সামিন উঠে জানালা বন্ধ করে দেয়।
বিছানা থেকে ফোনটা তুলে হাতে নিতেই আলোর সিম কার্ডটার কথা মনে পরে যায়। ফোনের লক খুলতেই টুং টাং আওয়াজে একটার পর একটা মেসেজের নোটিফিকেশন আসতে শুরু করে। সামিন বেশ অবাক হয়ে যায়। নয়শো বাহাত্তর টা অপঠিত বার্তা। যা বিগত কয়েক মাসে হয়তো সিমকোম্পানি থেকে এসেছে বন্ধ হয়ে পরে থাকা এই নাম্বারটিতে। সামিন নোটিফিকেশন গুলো ডিলিট করার জন্য আঙুল চালাতেই একটা নাম্বার দেখে থ'মকে যায়। সেই নাম্বার থেকেই অসংখ্য মেসেজ করা হয়েছে আলোকে।
সামিন ভাবলো সে ভুল দেখছে। তাই ফোনটা চোখের সামনে তুলে ধরে নাম্বারটা ভালো করে দেখে।
তার হাত কাঁ'পছে। দৃষ্টি ইনবক্সে জমে থাকা মেসেজ গুলোতে নিবদ্ধ।
বাইরে ঝড় উঠছে, প্রকৃতিতে তান্ডবলীলা চালানোর মতো শক্তিশালী ঝড়, ঝড় উঠছে একজন মানুষের মনেও। কে জানে প্রকৃতি ঝড়ের তান্ডব সইতে পারবে কিনা, কে জানে সেই মানুষটা সইতে পারবে কিনা, কে জানে!
টগবগ করে পানি ফুটতে শুরু করেছে। আলো দাঁড়িয়ে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছিলো। বাইরে সম্ভবত ঝ'ড় উঠেছে। অথচ বিকেলেও আবহাওয়াটা একেবারেই ঠিকঠাক ছিলো। হাত বাড়িয়ে আলো কফির ক্যানটা ক্যাবিনেট থেকে নামাতে গিয়ে টের পায় আলোর মাথাটা হঠাৎ করে চক্কর দিয়ে উঠতে চাইছে । কিচেন ক্যাবিনেট ধরে চুপচাপ কয়েক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে আলো কফি বানিয়ে দু'টো মগে ঢেলে নেয়। কিছু মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে হাত দিয়ে নিজের খোঁপা ছোঁয়, রজনীগন্ধার মালাটা ছুঁতেই ঠোঁট প্রশ্বস্ত হয় হাসিতে তার, কফির মগ থেকে নিঃসৃত ধোঁয়ার সাথে উবে যায় তার অভিমান। লোকটা একটা চতুর লোক, আস্ত একটা ধুরন্ধর লোক। ঠিক জানে কি করলে আলোকে সামলানো যাবে। এভাবেই জনগণকে সামলায় এই লোকটা। তবে এতে কাজ হবে না আজ, অনেক ভুগিয়ে ছাড়বে আজ ঐ লোকটাকে আলো। তারপর সব অনূভুতি উগ্রে দেবে আজ সারাদিন বসে যা জড়ো করেছিলো।
শাড়ির আঁচলটা ডান কাঁধে তুলে দুই হাতে দুটো মগ তুলে নিয়ে ধীরপায়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে যায়। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে সে। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ, বাইরে বিদ্যুৎ চম'কাচ্ছে, বি'কট শব্দে মেঘ প্রকৃতিকে হু'মকি দিচ্ছে। লিভিং রুম পেরিয়ে দুই কদম পা ফেলতেই কিছু একটা ভাঙার আওয়াজ পায় সে। আওয়াজ টা তাদের ঘর থেকে আসছে। বিচলিত হয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে চাপিয়ে রাখা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সে থ'মকে যায়।
সামিন আলোর দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। তার হাতে একটা ফুলদানি। পুরো মেঝেতে ঘরের আসবাবপত্র টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে। আলো তৎক্ষণাৎ কিছু চিন্তা না করে কফির মগ দুটো রেখে ছুটে গিয়ে সামিনের হাত থেকে ফুলদানি নিয়ে নেয়। সামিনের অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে কন্ঠে উ'ৎ'ক'ণ্ঠা নিয়ে বলে,"কি হয়েছে? পার্টির সাথে গ্যা'ঞ্জাম করেছেন আবার? কতবার বলেছি রাজনীতি ঘরের বাইরে ফেলে রেখে ঢুকবেন প্রতিদিন। এখন শান্ত হোন। বাচ্চাদের মতো ভাঙচুর করছেন!"
সামিন কি করে শান্ত হবে। কি করে!
আলোকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেয়ালে লাগাতার প্রহার করতে থাকে। আলো একটা বি'কট চিৎকার দিয়ে সামিনের হাত আগলে নিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"পাগল হয়েছেন? মাথা খা'রাপ হয়ে গিয়েছে?"
সামিন আলোর দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে কিছু মুহূর্ত। তারপর আলোর দুই বাহু ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলতে থাকে,"কেনো? বললে না কেনো? আমাকে শুরুতেই বললে না কেনো? বলো, কেনো?"
আলো ভীত চোখে সামিনের দিকে তাকায়,কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,"কি বলিনি? কি উল্টোপাল্টা বকছেন মেয়র সাহেব।"
সামিন শক্ত করে ধরে আলোকে বলতে থাকে,"যদি সবটা বলতে আমায়, সবটা ঠিক করে দিতাম আমি। সেই ক্ষমতা আমার ছিলো। কেনো বললে না। কেনো?"
আলো অবাক দুটি চোখে তাকিয়ে থাকে শুধু। সামিন আলোকে ছেড়ে দিয়ে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে শুরু করে আবারও, বেড সাইডের টেবিল ল্যাম্প উঠিয়ে সজোরে মেঝেতে ছু'ড়ে মে'রে চেঁচাতে থাকে,"কেনো বললে না, বললে না কেনো!"
আলো ছুটে গিয়ে পেছন থেকে সামিনকে জরিয়ে ধরে, সামিনের বুকের কাছের শার্ট শক্ত করে খামচে ধরে রেখেছে সে। সামিন নিস্তেজ হয়ে পরে, নিষ্প্রাণ গলায় বলে ওঠে,"করুণা করলে আমায় সবাই! করুণা! সবথেকে বড় শা'স্তি এটা আলো। একজন অপরাধী জানে।"
আলো শক্ত করে সামিনকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে রাখে, সামিনের কথার জবাবে বলে ওঠে,"একটু খুলে বলুন না। আমিও যে ভীষণ অস্থির হয়ে পরছি তা কি উপলব্ধি করতে পারছেন না। একটা সমস্যা হলে সেটা আলোচনা করে ঠিক করা যায় মেয়র সাহেব।"
কন্ঠে আকুতি নিয়ে বলতে থাকে আলো।
সামিন আলোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আলোর মুখোমুখি দাঁড়ায়,আলোর চোখে চোখ রেখে বলতে থাকে,"কিসের আলোচনা করে ঠিক করবো? সবকিছু ধ্বংস করে কি ঠিক করবো আমি?"
আলো তাকিয়ে থাকে। সামিন আবারও হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেয়ালে এলোপাথাড়ি প্র'হার করতে থাকে। চেঁচিয়ে বলতে থাকে,"আমি জঘন্য। জঘন্য আমি।"
আলো সামিনের হাত আগলে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়, কান্নাভেজা কন্ঠে বলে ওঠে,"এভাবে আপনি আমায় ব্যাথা দিচ্ছেন যে।"
সামিন আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলোর দুচোখের কার্নিশে পানি জমেছে। ধরা গলায় বলে,"বলে দিন কি দোষ করেছি। শাস্তি দিন। নিজেকে কষ্ট দিয়ে আমাকে য'ন্ত্রণা কেনো দিচ্ছেন?"
বিদ্যুৎ চম'কানোর সাথে সাথে বিকট শব্দে কাছে কোথাও বজ্রপাত হয়। আলো আর সামিন স্থির হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে। আলো গলায় কান্না চাপিয়ে রেখে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"অসুস্থ বোধ করছি আমি। দোহাই লাগে আমাকে সবটা খুলে বলুন। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপনার অস্থিরতা লাঘব করার।"
সামিন ঘরের মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,"ঠিক এভাবে । হ্যা এই টুকরো গুলোর মতোই আদরের ভাইটাকে ভেঙেচুরে দিয়েছি আমি। কে'ড়ে নিয়েছি তোমাকে তার থেকে।"
আলো চ'ম'কে উঠে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকায়। ধরা গলায় বলে,"আমি এমন কেনো আলো?"
আলো সামিনের হাত ধরে ফেলে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে , "মেয়র সাহেব শুনুন আপনি। ওটা অতীত। ওই অতীতকে টেনে এনে আমাদের দুজনের বর্তমান অনূভুতিকে আপনি অসম্মান করবেন না। আমি আশা করিনা এমন কিছু আপনার থেকে।"
সামিন আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার দিকে যায়। হুট করে ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে দেখতে পায় সামিন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আলো পেছন থেকে ডাকতে ডাকতে ছুটে এসে লিভিং রুমে সামিনকে আবারও জরিয়ে ধরে পেছন থেকে। কেঁদে ফেলে বলে,"আপনি কথা শুনুন। যেদিন থেকে আপনাকে আমি স্বামী বলে স্বীকার করেছি, প্রতিজ্ঞা করেছি আমৃত্যু আপনাকেই নিজের অস্তিত্ব হিসেবে মনে করার। আমার এই অনুভূতিকে আপনি আঘাত করছেন মেয়র সাহেব।"
সামিন আলোর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে যায়। আলো ছুটে গিয়ে পুনরায় জরিয়ে ধরে, ফুঁপিয়ে বলে ওঠে, "আজকের দিনটা আমার মাটি করে দেবেন না আপনি। কতটা আবেগ, অনূভুতি সাজিয়ে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেটা না শুনে কোথায় যাচ্ছেন। এমন করলে আমি কাল সকালেই ও বাড়িতে চলে যাবো। আর ফিরবো না। পরে আফসোস করবেন।"
সামিন এক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আলোর হাত ছাড়িয়ে দিয়ে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামে। আধো অন্ধকারে দু'চোখ ভর্তি পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলো। ওখানে পাথরের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মেঝেতে ধপ করে বসে পরে। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দের মাঝে আলো হঠাৎ গাড়ি স্টার্ট হবার শব্দ শুনতে পায়। এতো ঝ'ড় বৃষ্টির রাতে কোথায় যাচ্ছে মানুষটা! নিজের অস্থিরতা দূর করতে মরিয়া হয়ে কোথায় ছুটছে। নিজের অস্থিরতা নিয়ে এতটাই বিচলিত যে পিছু ফিরে দেখলো না আলোকে কতটা ভোগান্তি দিয়ে যাচ্ছে সে। কি স্বার্থপর মানুষটা!
***
ফোনের রিংটোনের শব্দে রেহেনার ঘুম ভেঙে যায়। রাত সাড় নয়টা থেকে একটা লম্বা ঘুম হয়েছে তার। চোখ খুলে উঠে বসে সে, পাশের টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে আলোর নাম্বার। চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোনটা রিসিভ করে রেহেনা। ওপাশ থেকে আলো কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,"আম্মু।"
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে আলো বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলছে সে। রেহেনা মেয়ের গলা শুনে উৎকণ্ঠা নিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"কি হয়েছে আম্মু! কি হয়েছে!"
আতাউর আলমের ঘুম ভেঙে গিয়েছে। উঠে দ্রুত স্ত্রীর হাত থেকে ফোন টা নিয়ে বলে,"আম্মু কি হয়েছে? তুমি কাঁ'দছো কেনো?"
আলো চুপ করে থাকে। রেহেনা বলে,"জামাইয়ের সাথে ঝ'গড়া করেছিস? দে ওকে ফোনটা দে। কথা বলবো। নিশ্চয়ই তুই কিছু করেছিস না রে? ও তো শুধু শুধু ঝ'গড়া করার ছেলে না।"
আলো দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে, দু'চোখের কার্নিশ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরে তার।
আতাউর আলম বলে ওঠে,"বলো আম্মু।"
_কিছুনা আব্বু, কিচ্ছু হয়নি। উনি ঘুমাচ্ছেন। আমার হঠাৎ করে খুব অস্থির লাগছে। আমি তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে চাই। আম্মুর কাছে নিয়মটা জানতে ফোন দিয়েছি। আমি বিস্তারিত জানি না।
আতাউর আলম মেয়ের কথায় আশ্বস্ত হয়না। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,"আমি আসবো মা? এখন আসবো?"
_কাল এসো।
অস্ফুট স্বরে বলে আলো। রেহেনা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের নিয়মটা আলোকে বুঝিয়ে দেয়। আলো হুট করেই ফোন কেটে দেয়।
বাড়ির ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। কিন্তু বাইরে ঝড়ের ভয়াবহতা বেড়েছে।
আলো একুশ বারের মতো সামিনের নাম্বার ডায়াল করে। নাম্বার টা বন্ধ। আলো ফোন রেখে উঠে দাঁড়ায়,মাথাটা আবারও চক্কর দিয়ে ওঠে। দেয়ালে ভর দিয়ে কিছুক্ষণ কাঁচের জানালায় দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
কিছু সময় পরে মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে ওয়াশ রুমে ঢুকে ওযু করে বের হয়। মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায়ের জন্য দাড়িয়ে যায়।
আতাউর আলম উঠে গাঁয়ে শার্ট চাপিয়ে নেয়। রেহেনা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,"কোথায় যাচ্ছো এই ঝ'ড় বৃষ্টির রাতে?"
ফোন আর ওয়ালেট পকেটে ঢুকিয়ে ক্যাবিনেট থেকে একটা ছাতা বের করে ঠান্ডা গলায় বলে,"মেয়ে মিথ্যা কথা বলেছে। নিশ্চয়ই দুটোতে খুব বিশ্রীভাবে ঝ'গ'ড়া করেছে,মিলিয়ে দিয়ে আসি।"
***
ওষুধটা হাতের ক্ষ'ততে লাগাতেই যন্ত্রনায় ফরসা মুখ টা নীল রঙের হয়ে যায়। কিন্তু সামিন যন্ত্রনাটুকু হজম করে নেয় দ্রুত। কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি।
ফুয়াদ ডান হাতটা ব্যা'ন্ডেজে মুড়িয়ে দিতে দিতে আড়চোখে বেশ কয়েকবার সামিনকে দেখে।
ব্যান্ডেজ করা হয়ে গেলে ফার্স্ট এইড বক্সটা সরিয়ে রেখে সামিনের চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,"বল । সমস্যা কোথায়। আলোর সাথে ঝ'গড়া করেছিস?"
সামিন চুপ করে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফুয়াদ বলতে থাকে,"বল! কি হয়েছে? কে কি করেছে?"
_কেউ কিছু করেনি। যা করার আমিই করেছি।
নিস্তেজ কন্ঠে জবাব দেয় সামিন।
ফুয়াদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে দাঁতে দাঁত চেপে সামিনের কলার ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে,"শোন, ভুগতে চাইলে একা একা ভুগবি। আমাদের এতো ভো'গান্তি দিবি না খবরদার!"
সামিন ফুয়াদের থেকে চোখ নামিয়ে নেয়, তার দৃষ্টি এখন মেঝেতে নিবদ্ধ। কিছুটা সময় নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,"আমি সব ঘে'টে দেই ফুয়াদ। তুই ঠিকই বলিস, আমি বড্ড অযোগ্য।"
ফুয়াদ সামিনের মুখোমুখি বসে পরে। সামিনকে বলে,"দেখ কি হয়েছে তা তো আমি জানি না। বলছিসও না, তাহলে আমার কাছে এলি কেন? আমার মাথা খা'রাপ করার জন্য?"
_দুনিয়া আমাকে করুণা করে ফুয়াদ।
_আমি তো করি না। তোকে দেখলে আমার রা'গ হয়। করুণা আসে না।
_আমি দুনিয়ার কাছে ভালো সাজতে পারবো, নিজের কাছে ভালো সাজার যে কোনো অপশন নেই। কোনো অপশন নেই!
ফুয়াদ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। আবারও তার ফোন বেজে ওঠে, এই নিয়ে চৌদ্দবার আলো তাকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। এইবার বেচারীর জন্য মায়া হচ্ছে ফুয়াদের। সামিনের বারণ সত্তেও ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে আলোর কান্নাভেজা কন্ঠ ভেসে আসে।
ফুয়াদ স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,"ও আমার কাছে আছে। চিন্তা করো না।"
আলোর কন্ঠনালী থেকে অনেক কষ্টে কথা বের হয়,"ভাইয়া,উনি ঠিক আছে?"
_হ্যা ঠিক আছে।
আলো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধরা গলায় বলে,"আজ আমার জীবনের সবথেকে বিশেষ, সবথেকে আনন্দের একটা দিন ছিলো ভাইয়া । আপনার বন্ধু কত সুন্দর ভাবে, আয়োজন করে ন'ষ্ট করে দিলো সেসব। সকাল থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে কাটিয়েছে, এর মাঝে আমার ফোন পর্যন্ত রিসিভ করেনি, আর বাড়িতে এসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছে। ভেঙেচুরে দিয়ে গিয়েছে ঘরের সব জিনিসপত্র, ভেঙেচুরে দিয়েছে আমাকে। এটাই তো চেয়েছিলো উনি তাইনা? প্রতিশোধ নিয়েছে অবশেষে, আমার করা সব অপমান, অবহেলার প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। কি মোক্ষম সময়ে, যখন আমি পুরোপুরি ওনার উপর নির্ভরশীল হয়ে পরেছি তখনই আসল রূপটা উনি দেখিয়ে দিয়েছে। আপনার বন্ধু একজন চালবাজ লোক।"
_তুমি ঠিক ভাবে কথা পর্যন্ত বলতে পারছো না আলো। শান্ত হও, আমি দেখছি , শান্ত হও তুমি।
_ওনার কাছে একটু ফোনটা দেবেন? নয়তো লাউড স্পিকারে দিন ।
ফুয়াদ ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে রাখে। সামিন চুপচাপ মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে।
আলো বলতে থাকে,"সুযোগ শুধু আপনাকেই দেওয়া হবে,আপনি কাউকে দেবেন না? আমাদের দুজনের অস্থিরতা কাটিয়ে তোলার সুযোগ চাইছি আমি মেয়র সাহেব, আমাকে দয়া করে সুযোগ দিন। সাদাকালো বিষাদের পরে সবটা কিন্তু রঙিন। আপনি নিজে রাঙিয়েছেন আমায়। এই রং টুকু আপনি কে'ড়ে নেবেন না। এতো বড় অন্যায় আমার সাথে করবেন না। আপনি বাড়িতে আসুন, আপনার জন্য আমি কত আনন্দময় সূচনা নিয়ে বসে আছি, আপনি জানেন না। দয়াকরে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না, আমাকেও বঞ্চিত করবেন না।"
আলো ফোন কে'টে দেয়। ফুয়াদ হাঁটু গেড়ে বসে পরে, ধ'মকের সুরে বলে,"অসুস্থ হয়ে পরেছে মেয়েটা। তোর কোনো অধিকার নেই এভাবে ওকে কষ্ট দেওয়ার।"
সামিন চুপ করে থাকে, ফুয়াদ বলে,"আমি জানি না তোদের মধ্যে কি হয়েছে। আমার জানার ইচ্ছেও নেই। শুধু এতটুকু বল, যা হয়েছে তা শুধুমাত্র তোর জন্য হয়েছে তাইতো?"
_হু।
_এখানে আলোর কোনো দোষ নেই তাইতো?
_না। নেই, ছিলোনা, কখনোই ছিলোনা।
_তাহলে ওকে কেনো শা'স্তি দিচ্ছিস?
সামিন নিশ্চুপ। ফুয়াদ বলতে থাকে,"যা হয়েছে,মানে তুই যা করেছিস তা কি শুধরে দিতে পারবি? আছে তোর সেই ক্ষমতা?"
সামিন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে বলে,"না। নেই।"
_এর পেছনে কারন কি? কেনো পারবি না।
_সময়। সময় সময়ের সাথে সবকিছু বয়ে নিয়ে এসেছে। এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে সবাইকে,অনেকটা পথ।
_তো? তাহলে তুই শুধরে দিতে না পারলে সাজানো গোছানো সবটা কেন বি'গড়ে দিচ্ছিস? নিজে থমকে দাঁড়িয়েছিস দাঁড়িয়েছিস ভালো কথা, তুই আলোকে কেনো ধা'ক্কা দিয়ে পিছু ঠেলে দিচ্ছিস। ও কি এইটা ডিজার্ভ করে? দেখ ট্রুলি আন্সার করবি। ও ডিজার্ভ করে এমন কিছু?"
সামিন মাথা নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,"না।"
_সেটাই ,ও এসব ডিজার্ভ করে না। ও ডিজার্ভ করে সামিনকে, যে সামিনকে ও নিজের সমস্ত জড়তা পাশে সরিয়ে দিয়ে গ্রহণ করেছিলো, সেই সামিনকে। আচ্ছা এখন বল,যা হয়েছে তা কি আদৌও তোর সজ্ঞানে হয়েছে? জেনেবুঝে করেছিস তুই?
_নাহ।
শব্দটার সাথে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় সামিনের ভেতর থেকে।
তারপর বলে ওঠে,"জানলে আমি কখনো এমন কিছু করতামই না।"
_বুঝলাম করতি না। এখন শোন, জেনে বুঝে আলোকে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছিলি,ওটা অন্যায় ছিলো, অপরাধ ছিলো। অন্যায় আর অপরাধ করলে শা'স্তি পেতে হয়। শাস্তি পেয়েছিস, আলো শাস্তি দিয়েছে, নিজে নিজেকে দিয়েছিস, কাহিনী খতম। আর তুই তোর যেই গ্লানির কথা ভেবে মরমে ম'রে যাচ্ছিস, তোরই ভাষ্যমতে সেটা তোর অজান্তে করেছিস। অজান্তে মানে ওটা ভুল। ভুলের সংশোধন হয় , কিন্তু কিছু কিছু ভুলের সংশোধন হয়না জানি। তখন অন্য উপায় বের করতে হয়। এখন তোকে একটা জিনিস দেখাই আমি।"
এই পর্যন্ত বলে ফুয়াদ থামে, উঠে গিয়ে একটা কাঁচের মগ নিয়ে এসে সামিনের সামনে বসে পরে। সামান্য উচু থেকে ফেলে মগটা পাঁচ ছয় টুকরো করে ফেলে। সামিন ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে। ফুয়াদ বলে,"দেখ মগটা ভেঙে গেলো। ধরে নে নিজের অজান্তে ভাঙলাম, এখন কি এই মগটা জোড়া লেগে যাবে? জোড়া লাগলেও এর আগের রূপ ফিরে পাবে? বল? দেখ চুপ করে থাকবি না,বল।"
সামিন মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে বলে,"না।"
ফুয়াদ বলে,"হ্যা। আমার ধারণা মতে তোর ভুলটাও হচ্ছে এমন কিছু। এখন তোর করনীয় কি জানিস? দাড়া আরেকটু আসছি।"
ফুয়াদ উঠে গিয়ে তার আলমারির ভেতর থেকে একটা কারুকার্য খচিত মগ নিয়ে এসে সামিনের সামনে রাখে। তারপর বলে চিনতে পেরেছিস এটাকে?
সামিন মাথা নাড়ায়। ফুয়াদ বলে,"তোর মনে আছে? ক্লাস ফোরে থাকাকালীন বন্ধুদের পাথে পাড়ার ফুটবল ম্যাচে সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে একটা মগ জিতেছিলাম। আপু যেটা ভেঙেছিলো,আমি কান্না করেছিলাম দেখে মা অবিকল দেখতে একটি মগ কিনে দিয়েছিলো আমাকে?"
সামিন মাথা নেড়ে বলে,"মনে আছে ।"
ফুয়াদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,"মা তার পরেরদিন এ্যাক্সি'ডেন্টে মা'রা যান। এবং এটাই মায়ের থেকে আমার সর্বশেষ গিফট। আমি সবসময় আগলে আগলে রাখতাম। ইন্টামিডিয়েটে পড়াকালীন সময়ে ভুল করে ধাক্কা লেগে মেঝেতে পরে গিয়ে ভেঙে যায়। ভুল করে কিন্তু, নিজের ইচ্ছায় করিনি। তাই নিজেকে দোষারোপ না করে আমি কি করেছি জানিস? যেহেতু এটাকে আগের রূপে ফেরাতে পারবো না, ফেলে দিতেও পারবো না, এবং এর ভাঙাচোরা অবস্থাটাকেও চোখের সামনে দেখতে পারবো না তাই বুদ্ধি বের করে নিজেই এটা দিয়ে ক্রাফট বানিয়ে ফেলেছি। তুই ভাবতে পারবি এটা সেই মগটা? আমি নিজেও চিনতে পারিনি। "
সামিন চুপ করে থাকে। ফুয়াদ বলে,"জীবনের কিছু কিছু ভুল হচ্ছে এমন। না সংশোধন হয়, না ফেলে দেওয়া যায়, না ভুলটা চোখের সামনে ওভাবেই ভুল হয়ে পরে থাকতে দেখতে পারা যায়। সেই ভুলগুলো নিয়ে এমন একটা ক্রাফট বানিয়ে ফেলতে হয়। একটা অতি সুন্দর ক্রাফট। এই মাত্র যে মগটা ভাঙলাম, এটা দিয়েও চমৎকার একটা ক্রাফট বানিয়ে দেখাবো আমি তোকে।"
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফুয়াদ সামিনের পিঠে চা'পড় মে'রে বলে,"তুইও পারবি। আমার বিশ্বাস, তোর হাতে গড়া ক্রাফট টা হবে অতি চমৎকার। তুই আমাদের সামিন।"
সামিন ফুয়াদের দিকে মাথা তুলে তাকায়। ফুয়াদ বলে,"যা বলছি তাই কর। আলোর কাছে যা! কতটা দ'ম দেখেছিস মেয়েটার। কতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছে দুজনের অস্থিরতা কাটিয়ে ফেলবে। তুই ওর আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিস না। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর আত্মবিশ্বাসকে সম্মান জানা। ওকে সুযোগ দে। নিজেকেও দে । যে ভুলটা তোর অজান্তে হয়েছে সেটা নিয়ে আত্মগ্লানিতে ভো'গা অন্যায়। নিজের আত্মাকে কষ্ট দেওয়া অন্যায়, সেই সাথে আত্মার সাথে জরিয়ে থাকা মানুষ গুলোকে কষ্ট দেওয়াও ঘোর অন্যায়, আর অন্যায় করিস না, এবার থাম।"
সামিন চুপ করে বসে থাকে। ফুয়াদ সামিনের হাত টেনে ধরে তোলার চেষ্টা করে বলতে থাকে,"ওঠ! ওঠ বলছি! চল তোকে বাড়িতে দিয়ে আসি। চল। চল বলছি।"
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামিন বলে,"তুই থাক। কাল সকালে তোর ফ্লাইট। আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি। যেতে পারবো!"
সামিনের কথা শুনে ফুয়াদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। সামিনের কাঁধে হাত রেখে বলে,"যা। মেয়েটা অপেক্ষা করছে তোর জন্য। গিয়ে প্রথমেই ওর কাছে ক্ষমা চাইবি। যা বলছি। নয়তো ঘা'ড় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেবো বাসা থেকে।"
***
বৃষ্টি থেমে এখন হু হু করে বাতাস বইছে। বারান্দার খোলা দরজাটা বাতাসের জন্য দেয়ালের সাথে বিকট শব্দে ধাক্কা খাচ্ছে বারবার। আলো বিছানায় বসে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোনটা হাতে তুলে নেয়। সময় রাত তিনটা সাতাশ মিনিট। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবারও ফুয়াদের নাম্বার ডায়াল করে। ফুয়াদ ফোনটা রিসিভ করে বলে,"ওকে পাঠিয়েছি আমি। তুমি তোমার ইচ্ছামতো শাস্তি দিও ওকে। বুঝেছো? এখন শান্ত হও।"
আলো ফোনটা কেটে চুপ করে বসে থাকে। চোখ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরতেই ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,"আমি শুধু আপনার স্ত্রী। স্বামীর কাছে সব অনূভুতি জমা দেওয়া হয়ে গিয়েছে আমার। আপনাকে নিয়ে সামনে এগোতে চাচ্ছি আমি। আপনি কেন ধাক্কা দিয়ে পেছনে সরিয়ে দিতে চাইলেন। আমি শুধু আপনারই স্ত্রী মেয়র সাহেব। আপনার সাথেই থাকবো আমি।"
গাড়ি হাইওয়েতে উঠেছে। ঝড়ের মধ্যে সাঁইসাঁই করে ছুটে চলেছে । শেষ রাত তাই হাইওয়েতে খুব একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে না, বানিজ্যিক কিছু বড় ট্রাক ছাড়া। যেগুলো মূলত কাঁচা সবজি নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের উদ্দেশ্য রওনা হচ্ছে। সামিন গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। হঠাৎ চোখের সামনে আলোর কান্নাভেজা মুখটা ভেসে ওঠে, সামিনকে শান্ত করার জন্য কতটা উতলা হয়ে উঠেছিলো, সামিন সেই উৎকণ্ঠার দাম না দিয়ে একপ্রকার উপেক্ষা করে চলে এসেছে। ঠিক করেনি সামিন। একেবারেই ঠিক করেনি। ঐ মুখটা দেখার জন্য ভেতরটা তীব্র ভাবে ছ'ট'ফ'ট করতে শুরু করেছে, কোলে মাথা রেখে অসহায়ের মতো বলতে ইচ্ছে করছে,"আমাকে অনুপ্রেরণা দাও আলো, মানসিক শক্তি বাড়ানোর অনুপ্রেরণা দাও আমায়।"
গাড়ির গতি আরো কিছুটা বাড়িয়ে ডানদিকে মোড় ঘুরতে ব্যাস্ত সামিন। ছটফটানি তার মনে,তার মস্তিষ্কে। মস্তিষ্ক তোলপাড় করা ঝড়ের ঝাপটা সামলাতে গিয়ে সে খেয়াল করেনি ডানদিক থেকে ছুটতে ছুটতে আসা বিশাল ট্রাক টাকে ।
যখনই সম্বিৎ ফিরে পেলো ততক্ষণে বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে। একদৃষ্টে বোকার তাকিয়ে ছাড়া আর কিছু করার নেই তার। কানের কাছে শুধুমাত্র আলোর কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
"ফিরে আসুন মেয়র সাহেব। আপনার জন্য আমি এক আনন্দময় সূচনা সাজিয়ে বসে আছি। আপনি শুনবেন না?"
***
হঠাৎ করে আলো নিজের অজান্তে কাঁচের টুকরোর উপরে পা ফেলে দেয়। রক্তে ভরে যায় পায়ের তলা। একটু ঝুঁকে দু'চোখ বন্ধ করে, দাঁতে দাঁত চেপে কাচের টুকরো টা টেনে বের করে। কলিং বেলের শব্দ হয় হঠাৎ। কলিং বেলের আওয়াজে আলো আলুথালু বেশে ছুটতে ছুটতে নিচে নামে। শরীর তাকে সমর্থন না করলেও মনের সমস্ত শক্তি খরচ করে পাগলের মতো ছুটে যায় সদর দরজার কাছে। দরজা খুলে তাকিয়ে থাকে সে। আতাউর আলম কাকভেজা হয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে আলোর দিকে তাকিয়ে কন্ঠে উ'ৎ'ক'ণ্ঠা নিয়ে বলে,"কি হয়েছে আম্মু। তুই ঠিক আছিস তো?"
সামিনকে না দেখতে পেয়ে আলোর বুকটা হঠাৎ হু হু করে ওঠে। মাথা নাড়িয়ে বাবাকে অস্ফুট স্বরে বলে,"হঠাৎ এতো রাতে এলে যে। বললাম তো সব ঠিক আছে ।"
আতাউর আলম বলে,"আচ্ছা ঠিক আছে। ঠিক থাকলে সামিনকে ডাক। ওর সাথে একটু কথা বলে চলে যাই। ডাক।"
আলো ডাকে না। শুধু বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।
***
"হ্যা হ্যা,হ্যালো। আরে ফোন দিও না। আমি অন ডিউটি তে। আরে এখানে একটা এ'ক্সিডেন্ট হয়ে গিয়েছে। ট্রাকের সাথে প্রাইভেট কারের সংঘর্ষ। আমাদের মেয়র ইয়াসার মির্জার গাড়ি। তাকে হসপিটালাইজড করা হয়েছে।
না গাড়িতে সে একাই ছিলো, আমি দেখিনি। শুনেছি আশঙ্কাজনক । ট্রাক ড্রাইভার পালিয়েছে। আরে রাখো তো,এতো কথা বলার সময় নেই।"
ফোন কেটে দিয়ে লোকটি নিজের অধিনস্ত কনস্টেবল কে ধমক দেয়,"আরে কি করছো মনসুর, গাড়িটাকে সরানোর ব্যবস্থা করো এখান থেকে। সকাল হতে না হতেই রাস্তায় তো জ্যাম লেগে যাবে।"
***
আতাউর আলম ধমকের সুরে বলে,"কি হলো! ডাক সামিনকে। কথা বলে চলে যাই।"
আলো মাথা নিচু করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"আব্বু উনি......"
ধুপধাপ শব্দ হয়। সিঁড়ি ভেঙে ছুটে নামতে থাকে ইশমাম, ইলহাম,ইশিতা।"
আলো মাথা ঘুরিয়ে তাকায় তাদের দিকে। ইশমাম এসে হাঁপাতে হাঁপাতে আলোর মুখোমুখি দাঁড়ায়। আলোর চোখে চোখ রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,"ভাইয়া....!"
হসপিটালের সামনে দলের ছেলেদের ভিড়। সবাই এমন ভাবে দাড়িয়ে আছে যেন এখান থেকে একটা স্বস্তির খবর না নিয়ে তারা যাবে না।
ধীরপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে আলো, আতাউর আলম মেয়ের হাত ধরে রেখেছে। কিছুক্ষণ পরে আলো বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,"হাত ছাড়ো আব্বু। আমি হাঁটতে পারি।"
আতাউর আলম হাত ছেড়ে দিয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। মুখটা কেমন কাঠিন্যতায় ছেয়ে আছে।
কেবিনের বাইরে করিডোরে দাঁড়িয়ে ইশমাম আর ইলহাম ডক্টরের সাথে কথা বলছে।
পাশে দাঁড়িয়ে ইশিতা মুখে ওড়না চেপে কেঁ'দে যাচ্ছে। তাকে শান্তনা দিচ্ছে শান্ত।
আলো এগিয়ে যায়। সবাই করুণ দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে তাকায়। তাকাবেই তো অমন করে, স্বামীর এক্সি*ডেন্ট হয়েছে, সবাই ভাবছে আলো ভে'ঙে পরেছে। কিন্তু ওরা কেউ জানে না আলো ঠিক কি।
ডাক্তার আলোকে দেখে কিছু বলার আগেই আলো স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,"জ্ঞান ফিরতে কতক্ষন লাগবে? না না, জ্ঞান না, উনি ঠিক কতক্ষনে কথা বলতে পারবে বলতে পারেন?"
আলোর কন্ঠের দৃঢ়তা ডাক্তারকে খুব অবাক করেছে। ইশমাম আর ইলহাম তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। কিছু সময় পরে ডাক্তার বলে ওঠে,"আটচল্লিশ ঘন্টার আগে তো জ্ঞান ফিরবে না ধারণা করছি, কথা বলার মতো পরিস্থিতি কবে হবে তা বলতে পারছি না। খুবই বিশ্রী ভাবে ইনজ্যুরড। আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে প্রাণে রক্ষা পেয়েছে।"
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,"ঠিকাছে। বুঝতে পেরেছি।"
কেবিনের দরজার দিকে একপলক তাকিয়ে ডাক্তারকে আবারও বলে ওঠে,"একটু যেতে চাচ্ছি আমার স্বামীর কাছে। কিছুক্ষণের জন্য। অনুগ্রহ পূর্বক অনুমতি দিন।"
ডাক্তার প্রথমে রাজি হতে না চাইলেও আলোর শীতল আচরণ দেখে রাজি হলেন। যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক মনে হচ্ছে মেয়েটাকে। কোনো চেঁচামেচি, কান্নাকাটি হয়তো করবে না।
মাথা ঝাঁকিয়ে আলোকে বলে,"হ্যা। যাও। কান্নাকাটি করো না।"
আলো ম্লান হাসে। ক্লান্ত অবসন্ন দুটি চোখে করিডোরে থাকা প্রত্যেকের দিকে একবার করে তাকিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে সামিনের কেবিনে ঢোকে।
***
একটা চেয়ার টেনে বেডের একদম পাশে বসেছে আলো। যদিও ডক্টর আলোকে দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে বলেছিলো।
সামিনের মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। সাদা রঙের চাদর দিয়ে গা ঢেকে রাখা। মাথায় ব্যান্ডেজ। ডান গালে একটা চোখে লাগার মতো ক্ষ'ত। ফরসা মুখটাতে বুঝি পার্মানেন্টলি একটা দাগ বসে গেলো। চোখ ঘুরিয়ে বেডের পাশে মনিটরে চোখ রাখে আলো। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে সামিনের দিকে তাকায়।
অনেকটা সাহস নিয়ে চাদর সরিয়ে সামিনের হাতের ওপর হাতটা হাতটা রাখে। উষ্ণ হাতটার আঙুলের ফাঁকে আঙুল রেখে সামিনের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"আমাদের গল্পে একমাত্র আপনিই বাকি ছিলেন হসপিটালে এডমিট হওয়ার। আজ ষোলকলা পূর্ণ করে দিলেন। যাই হোক, আপনাকে এভাবে একদম মানায় না। আপনাকে পাঞ্জাবি পরে,হাতা গুটিয়ে রাখলে বেশ সুন্দর লাগে।"
একটু থেমে আলো সামিনের দিকে ঝুঁকে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে ওঠে,"জীবনের এই পরিস্থিতিতে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি আপনাকে আজীবন ঘৃ'ণা করবো মেয়র সাহেব। আজীবন।"
মাথা তুলে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। ইচ্ছে করছে সামনে শুয়ে থাকা মানুষটার বুকে মাথা রাখতে। ইচ্ছে করছে সমস্ত যন্ত্রনার ভর ঐ মানুষটার গায়ে ছেড়ে দিতে।
গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে উঠতে চেয়েছিলো। আলো রানী তা পাত্তা না দিয়ে ঠান্ডা গলায়, দৃঢ়তার সাথে বলে ওঠে,"আমার আপনাকে লাগবে লাগবে লাগবে, বুঝতে পেরেছেন আপনি? আমার শুধু আমার স্বামীকে চাই।"
***
ডক্টর ভিজিট করে চলে গিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে। আলো একটা লম্বা বেঞ্চিতে বসে বসে ঝিমুচ্ছিলো। কিছুক্ষণ আগে বেশ কয়েকবার বমি হয়েছে তার। শরীরটা অসম্ভব ক্লান্ত। মাথা ঘুরিয়ে দেখে ইলহাম আর ইশিতা মুখোমুখি একটা বেঞ্চিতে মাথা নিচু করে বসে আছে। শান্ত আর পরী এতক্ষণ ছিলো। শান্ত অফিসে চলে গিয়েছে, পরী ক্লাসে। আতাউর আলম তখন থেকে করিডোরের এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করছে।
সকাল পেড়িয়ে প্রায় দুপুর হতে চলেছে। হঠাৎ তার সামনে এসে ইশমাম একটা টিস্যু পেপারে মোড়ানো স্যান্ডউইচ ধরে। আলো মাথা তুলে ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম ঠান্ডা গলায় বলে,"আমরা সবাই খেয়েছি। শুধু তুমিই বাকি আছো। খেয়ে নাও।"
আলো দৃষ্টি নামিয়ে ইশমামের হাতের স্যান্ডউইচের দিকে তাকায়। কিচ্ছু মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না এখন। কিন্তু তাকে খেতেই হবে, ঐ অপদার্থ লোকটার চিন্তায় চিন্তায় তার ভেতরের ছোট্ট প্রানটাকে সে একদম কষ্ট দেবে না, কখনোই না। একমিনিট কিছু একটা চিন্তা করে ইশমামের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,"এসব খাবো না। তুমি ক্যান্টিন থেকে আমার জন্য দুটো ডিম,এক বোতল দুধ আর কিছু ফল নিয়ে এসো।"
ইশমাম আলোর দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। আলোর এতো স্বাভাবিক আচরণ সবার কাছেই বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। আতাউর আলম এসে আলোর সামনে দাঁড়িয়ে পরে, নরম গলায় বলে ওঠে,"কি আম্মু? কি লাগবে?"
_দুটো সেদ্ধ ডিম,এক বোতল দুধ, আর কিছু ফল। যাও কেউ নিয়ে এসো।
ইশমাম দ্বিতীয় বারের মতো আলোর আদেশ শুনে কোনো বাক্য ব্যয় না করে ক্যান্টিনে চলে যায়।
ডিম দু'টো মনের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে আলো খেয়েছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি আবার বমি এসে যাবে। ডিম দু'টো শেষ করে একটা খেজুর খেয়ে দুমিনিট বিরতি নিয়ে দুধের বোতলটা হাতে তুলে নেয়। ছিপি খুলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বাম হাতে নাক চেপে ধরে ঢকঢক করে পুরো বোতল খালি করে।
দূরে বসে সবাই হা হয়ে আলোর কান্ডকারখানা দেখতে থাকে। আতাউর আলম মেয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছে। মেয়েটাকে স্বাভাবিক লাগছে না।
সামিনের অবস্থা একই রকম। সন্ধ্যায় আলো কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে দরজার কাচ দিয়ে কিছুক্ষণ দেখে ঘুরে দাঁড়ায়। ধীরপায়ে হেঁটে ইলহামের কাছে গিয়ে বলে,"তোমরা কে থাকবে এখানে ভাইয়া? আমি রাত জাগতে পারবো না। কে থাকতে চাচ্ছো?"
আলোর কথা শুনে সবাই বারবার শুধু অবাক হতে থাকে। ইশিতা উদ্বিগ্নতার সাথে বলে,"তুমি কি অসুস্থ ভাবী? শরীর খারাপ তোমার?"
_না আমি অসুস্থ নই, শুধু আমার শরীরটা একটু বিশ্রাম চাচ্ছে।
ইশিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,"তুমি মেজো ভাইয়া আর ইশমামের সাথে বাড়িতে যাও তবে। আজ আমি থাকবো। যাও।"
_আচ্ছা।
আলো অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে।
আতাউর আলম প্রথমে যেতে চায়নি,ইশিতা জোর করে তাকে আর রেহেনাকে পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়িতে। দরজার কাচ দিয়ে ভাইকে একপলক দেখে গিয়ে বেঞ্চিতে বসে থাকে চুপচাপ।
হসপিটাল রোড থেকে মোড় ঘুরতেই হাইওয়েতে জ্যামে পরেছে ইলহামের গাড়ি। বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে আছে সে।
আলো গাড়ির জানালার বাইরে চোখ রাখে। গতকাল ভয়াবহ ঝড়ের পরে আজকের রাতের আকাশটা বেশ নীলাভ কালো।
দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকিছু দেখতে দেখতে হঠাৎ দূরের সিগন্যালে চোখ যায়। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঘুরিয়ে ইশমাম আর ইলহাম দুই ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে,"তোমরা কেউ ঐ সিগন্যালের ওখান থেকে কদবেল কিনে আনো। আমার খুব কদবেল ভর্তা খেতে ইচ্ছে করছে।"
ইশমাম আর ইলহাম একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। তারা এবার মোটামুটি নিশ্চিত আলোর মাথা খারাপ হয়েছে। কয়েক মূহুর্ত সময় নিয়ে ইশমাম বলে ওঠে,"আর ইউ শিওর?"
_হু।
ইশমাম গাড়ি থেকে নেমে চারটা কদবেল কিনে গাড়িতে উঠে বসে আলোর হাতে দেয়।
বাড়িতে এসে আলো প্রথমেই গোসল করে নামাজ আদায় করে নেয়। তারপর বিছানায় বেশ আয়েশ করে বসে হাতের পেয়ালা থেকে কদবেল ভর্তা খেতে থাকে।
রাত প্রায় এগারোটা বেজে গিয়েছে। আলোর ঘুম প্রয়োজন। তার রাত জাগলে চলবে না। বিছানা ঠিক করে টান টান হয়ে শুয়ে পরে সে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকে ধীরে ধীরে ডানহাত টা নিজের তলপেটের ওপর রাখে। ধরা গলায় বিরবির করে বলে ওঠে,"আজকেও তোর বাবা তোর কথা জানলো নারে।"
একটু থেমে আবারও বলতে থাকে একা একা,"সবার মতো তুইও ভাবছিস আমি কাঁদছি না কেনো তাইনা? আমি আসলে স্ত্রী হবার পনেরো তম শর্ত পালন করছি।"
***
শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে সামিনের ব্যবহৃত জামাকাপড় ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে ঘরে এসে ঘরটা একটু গোছগাছ করতে থাকে। রিতু ইরফানকে নিয়ে এসে দরজার কাছে দাড়ায়। সে এই মাত্র হসপিটাল থেকে এসেছে।
আলো রিতুকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে ইরফানকে কোলে তুলে নিয়ে ইরফানের সাথে একা একা কথা বলতে থাকে। রিতু আলোকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। সামিনের এক্সি*ডেন্টের পরে একটুও ভে*ঙে পরেনি। কিন্তু এখন একটু বেশিই অস্বাভাবিক লাগছে আলোকে। এতোটা কাঠিন্যতা একজন স্ত্রীর সাথে যায়না।
ইশমাম এসে দরজার বাইরে দাঁড়ায়। আলোর দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে,"হসপিটাল যাচ্ছি। তুমি যাবে ভাবী?"
আলো ইশমামের দিকে তাকিয়ে বলে,"তোমার ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে? কথা বলতে পারছে?"
_নাহ।
_তাহলে আমার গিয়ে কাজ নেই। গিয়ে ঐ ভ*ন্ড লোকটার মুখ দেখবো বসে বসে? আমার তো ওনার সাথে বোঝাপড়া আছে। যখন কথা বলার অবস্থায় ফিরবে তখন আমাকে বলবে।
ইশমাম চুপচাপ চলে যায়। রিতু অবাক চোখে আলোকে কিছুক্ষণ দেখে ইরফানকে নিয়ে চলে যায়।
আলো আবারও ঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পরে। বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে দেয়। ইদানিং সবকিছু নিয়ে মনটা কেমন খুঁতখুঁতে হয়ে গিয়েছে। অবশ্য সে জানে এই সময়ে হরমোনাল ইমব্যালেন্সের জন্য এমনটা হয়ে থাকে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, অবসাদ ঘিরে ধরে। মন ভালো রাখার জন্য একটা পরিপাটি সুন্দর শোবার ঘর, কিছু ভালো বই এখন খুব জরুরি। ঘরটাকে গুছিয়ে নিয়ে লাইব্রেরী থেকে বেছে বেছে কিছু বই আনতে হবে।
হুট করে বমি ভাব হতেই আলো দৌড়ে বেসিনের কাছে যায়। হরহর করে বমি করে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে এসে গোছানো বিছানাটা অগোছালো করে শুয়ে পরে। শরীরটা বিছানার সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে যেন!
চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘসময় । চোখের কার্নিশে হঠাৎ দুফোঁটা তরল জমা হয়। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে ফেলে মনে মনে বলে ওঠে,"কল্পনা করে রেখেছিলাম আপনাকে খবরটা দিতেই আপনি পাগলের মতো চিৎকার দিয়ে আমাকে আগলে নেবেন। কোলে তুলে উন্মাদের মতো আনন্দ করবেন। আদরে ভরিয়ে দেবেন আমার কপাল। আজ খবরটা জানার আটচল্লিশ ঘন্টা হয়ে গিয়েছে। অথচ আপনিই এখনও জানলেন না।খুব ফাকা ফাকা লাগছে আমার মেয়র সাহেব। খুব। আপনার আছিয়া কেমন আপনার আদর শূন্য হয়ে পরে আছে দেখুন।"
***
দলের ছেলেরা কিছুক্ষণ পরপর তাদের ভাইয়ের খোঁজ নিতে ছুটে আসছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সাংবাদিক এসোসিয়েশনের লোকজন থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা ছুটে আসছে। ফুয়াদ, জামিল সবার সাথে কথা বলছে। আতাউর আলম আর রেহেনা বেঞ্চিতে বসে আছে। রেহেনা সেই তখন থেকে রাগে কাঁ*পছে। আতাউর আলম একটু পর পর স্ত্রীকে শান্ত থাকবার পরামর্শ দিচ্ছে।
"কি শান্ত হবো আমি? ওটা কেমন মেয়ে? দিল এত শক্ত। স্বামীর প্রতি কোনো দরদ নেই। ওর শশুরবাড়ির লোক কি ভাবছে বলোতো ?"
_শরীর টা হয়তো খারাপ।
আমতা আমতা করে বলে ওঠে আতাউর আলম।
_কেমন মেয়ে জন্ম দিয়েছো তুমি? না আছে কোনো সহবত, না জানে কোনো আদব কায়দা। শরীর ভর্তি শুধু জেদ, স্বার্থপরতা।
_আমাকে বলছো কেনো? জন্ম কি আমি একা দিয়েছি?
রেহেনা চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,"বিপদে স্বামীর পাশে না থেকে বাড়িতে গিয়ে আয়েশ করছে। অমন মেয়ে আমার ছেলের বৌ হলে কবে ঘার ধা*ক্কা দিয়ে বের করে দিতাম।"
ফুয়াদ দূর থেকে রেহেনা আতাউরকে দেখে ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে ,"ওনাদের কি হয়েছে?"
_ভাবী কেনো হসপিটালে আসছে না এজন্য আন্টি আংকেলকে রাগারাগী করছে।
ফুয়াদ বলে,"কথা হয়েছে আলোর সাথে? কেনো আসছে না? অসুস্থ?"
ইলহাম পাশ থেকে উঠে বলে,"না সুস্থ। জানি না কেনো আসে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে জ্ঞান ফিরলে খবর দিও। আজ সকালে ইশমাম খাবার টেবিলে বসে জানতে চেয়েছে, জবাব না দিয়ে আচারের বৈয়ম নিয়ে উঠে গিয়েছে।"
ইশিতার সামান্য খটকা লাগলেও কিছু চিন্তা করার আগেই ফুয়াদ বলে ওঠে,"ডক্টর কি বলছে?"
_স্টেবল । আল্লাহ সহায় হয়েছেন।
***
চালতা, কাঁচা আম, তেঁতুল, আমড়া, জলপাই । সবধরনের আচারের বৈয়ম সাজিয়ে রাখা। সবগুলো একটু একটু করে টেস্ট করে হাতে চালতার আচারের বৈয়ম টা তুলে নেয়। টেবিলের ওপর থেকে হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি বইটা নিয়ে বিছানায় এসে বসে পরে।
সারাদিন বই পরে, আচার খেয়ে কাটে তার। মনটা সারাক্ষণ উতলা হয়ে থাকে মেয়র সাহেবের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু সাহেবের জ্ঞান এখনো ফিরছে না। আলোর ধৈর্য্য পরিক্ষা করছে আসলে। ধৈর্য্যের পরিক্ষা কি ইয়াসার মির্জা একাই দেবে? এখন আলোও একটু দিক।
উপন্যাসটা তাকে টানছে না। বইটা যথাস্থানে রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই থ'মকে যায়। মাথাটা ঘুরছে। কপালে কিছুক্ষণ হাত চেপে রেখে হাত টা ধীরে ধীরে তলপেটে রাখে। বিড়বিড় করে বলে,"তুই ছেলে না মেয়ে? প্লিজ ছেলে হোস না। আমি দু'টো ইয়াসার মির্জাকে সামলাতে পারবো না।"
রাত প্রায় অর্ধেক ফুরিয়ে গিয়েছে, ঘুম আসছিলো না দেখে আলো ওযু করে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করলে তার মনের সমস্ত অস্থিরতা দূর হয়ে যায়। মোনাজাত শেষ করে উঠে দাড়াতেই দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হয়। জায়নামাজ যথাস্থানে রেখে দরজা খুলে দেখে ইশমাম দাঁড়িয়ে। হাত ঘড়ি টা হাতে পরে নিতে নিতে তাড়াহুড়ো করে বলে,"ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে চলো।".
_কথা বলতে পারছে?
_জ্ঞান ফিরেছে,কথাও বলতে পারবে।
_যাও তুমি, যখন কথা বলতে পারবে তখন এসে আমাকে নিয়ে যেও।
ইশমাম কিছুক্ষণ অবাক চোখে আলোকে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আলো দরজা বন্ধ করে জলপাইয়ের আচারের বৈয়ম টা হাতে নিয়ে বিছানার ওপর বসে পরে।
***
গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে দেখে পরীও দরজা থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হচ্ছে। ইশমাম ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করে,"কোথায় যাচ্ছো?"
পরী বিনয়ের সাথে বলে,"হসপিটালেই। ভাইয়াকে দেখতে।"
ইশমাম হুট করে বলে ওঠে,"এসো,আমি পৌঁছে দিচ্ছি। আমিও ওখানেই যাচ্ছি।"
পরী লাজুক হেসে সম্মতি দেয়। গাড়িতে ওঠার আগে দাঁড়িয়ে পরে, ইশমাম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। পরী বলে,"ইশিতা আপুর ফোনের চার্জার টা নিতে ভুলে গিয়েছি।"
_ঠিকাছে যাও। আমি অপেক্ষা করছি।
পরী মাথা নাড়িয়ে অন্দরমহলে চলে যায়। ইশমাম চুপচাপ বসে আছে গাড়িতে।
কিছুক্ষণ পরে পরী বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। মিররে ইশমাম পরীকে দেখছে। তাড়াহুড়ো করে হেঁটে আসছে মেয়েটা। ইশমামের হঠাৎ মনে হলো এক্ষুনি হুমরি খেয়ে পরবে পরী। কথাটা ভেবেই মিরর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত পরে আবারও মিররে চোখ রাখে। তখন দেখে পরী নেই। আশ্চর্য! মেয়েটাকে তো এইমাত্র আসতে দেখলো সে। দরজা খুলে বাইরে নেমে ইশমাম হতভম্ব হয়ে যায়।
সে যেমনটা কল্পনা করেছিলো পরী ঠিক সেভাবেই হুমরি খেয়ে পরে আছে। ইশমাম না চাইতেও উচ্চশব্দে হেসে ফেলে। পরী মাথা তুলে ইশমামের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মুখটা এমন করে রেখেছে যেন সে কোনো অপরাধ করে ফেলেছে।
ইশমাম হাসতে থাকে,হাসতে হাসতে বলে ওঠে,"তুমি কারো লাইফে শান্তনা পুরস্কার হবে কি না জানি না। তবে তুমি পৃথিবীতে এক পিসই। তোমার মতো শান্তনা পুরস্কার কোনো পুরুষ আর কোথাও খুঁজে পাবে না।"
পরী ইশমামের কথায় রিয়াক্ট করে না। উল্টো তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই লোকটার হাসি অসম্ভব সুন্দর।
ইশমাম হাসি থামিয়ে পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,"সরি হাসার জন্য!"
পরী নিচু স্বরে বলে ওঠে,"আপনি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবেন? আমি সালোয়ার কামিজটা বদলে আসছি!"
***
ভাইবোনের মুখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে সামিন। সবাই চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে আছে। ফুয়াদ নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে,"তোর বিয়ের পর থেকে সবগুলো ভ্যাকেশন ট্রিপ আমার ক্যান*সেল করতে হয়েছে। তুই আমার সাথে এমন কেনো করিস?"
_সরি।
মৃদু স্বরে বলে ওঠে সামিন।
ইশিতা বলে,"আমার আর শান্তর রিসিপশন টা ভেস্তে দিলে। তুমি এতো খা'রাপ কেন ভাইয়া?"
সামিন হেসে বলে,"সরি।"
মাথা ঘুরিয়ে ইশমামের দিকে তাকায় সামিন, ইশমাম পকেট থেকে সামিনের কার্ড বের করে বলে,"ল্যাপটপ টা ভে'ঙে ফেলেছো। সব টাকা আমি ঐ প্রজেক্টে লাগিয়েছিলাম। আপাতত এই কার্ড টা আমার কাছে থাকবে। আমার যখন ইচ্ছা হবে তখন দেবো।"
মৃদু হেসে সামিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথা ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকায়। ইশিতা বলে,"ভাবীকে খুজছো? ভাবী আসেনি।"
সামিন আলোকেই খুঁজছিলো। তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে আলো কি বলতে চেয়েছিলো সেদিন রাতে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে। ইশিতার দিকে তাকিয়ে সামিন বলে ওঠে,"তোদের ভাবী তোদের কিছু বলেছে?"
_কি বলবে?
_কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা?
ইশিতা মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,"কিছুই বলেনি? আমার ব্যাপারে কিছুই বলেনি?"
_বলেছে।
ফুয়াদ বলে ওঠে। সামিন উৎসাহের সাথে বলে ওঠে,"কি বলেছে?"
_বলেছে তুই একটা ভ'ন্ড। অপ*দার্থ।
সামিনের মুখটা শুকিয়ে যায়। ঠিক তখনই ইলহাম কেবিনে ঢুকে বলে,"ভাবীকে নিয়ে এসেছি। তোরা বাইরে যা। "
মৃদু বাতাসে কেবিনের জানালার পর্দা নড়ছে। আলো সেদিকে একবার তাকিয়ে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন একদৃষ্টে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে খুবই অসুস্থ দেখাচ্ছে।
ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে আলো একটা চেয়ার টেনে সামিনের বেডের পাশে বসে। সামিনের চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বলে, "স্বামী হবার একটাই শর্ত। সেটা হলো সারাজীবন স্ত্রীকে আগলে রাখা, ভালোবাসা,আদর,যত্ন,আহ্লাদে। নিজের কাছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধরে রাখা, মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে যাওয়া স্ত্রী ছেড়ে যেতে চাইলেও কখনোই তাকে যেতে না দেওয়া।
এমন বড় বড় কথাই বলছিলেন না সেদিন? তারপর? তারপর কি করলেন? নিজেই ছেড়ে যাচ্ছিলেন? এতটা অতিষ্ঠ করে দিয়েছিলাম আপনাকে আমি!"
সামিন ম্লান হাসে। আলো বলতে থাকে,"নির্লজ্জ লোক! লজ্জা করে না এখন হাসতে? ইচ্ছে করছে আপনাকে...."
_স্বামীর গায়ে হাত তুলতে নেই আছিয়া।
মৃদু আওয়াজে বলে সামিন। আলো চুপচাপ তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ সামিনের দিকে, কঠিন দৃষ্টি দিয়ে। ক্ষণবাদেই সামিনের ডান হাতটা টেনে নিয়ে অসংখ্য চু'মু খেতে থাকে সেই হাতে। চুমু খেতে খেতে চাপা কান্নায় ভে'ঙে পরে আলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় সামিন। কয়েক মূহুর্ত আগের কঠিন রূপটা হঠাৎ এমন হয়ে গিয়েছে কেনো! কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে সামিন বলে ওঠে,"থামো। থামো আলো।"
আলো থামেনা, উন্মাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে সামিনের হাতটা দুহাতে আগলে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলতে থাকে,"শুনতে চাই না কি হয়েছিলো। জানতে চাই না কি হচ্ছে। শুধু দেখতে চাই আমি। আমাদের আগামীর দিনগুলো আপনাকে পাশে নিয়ে দেখতে চাই আমি।"
সামিন বাম হাতটা উঠিয়ে আলোর হাতের উপর রেখে নরম গলায় বলে,"ভে*ঙে পরেছিলে এভাবে?"
আলো মাথা নেড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,"মোটেও না। স্ত্রী হবার পনেরো তম শর্ত হচ্ছে স্বামীর বিপদে মনের জোর হারাতে নেই। সেটাই পালন করছিলাম। আর তাছাড়া,আমি ভেঙে পরলে আমাকে সামলাতো কে? আপনি যে ছিলেন না। আমার তো নিজেকে সামলাতে কেবল আপনাকেই প্রয়োজন।"
_তবে এখন কাঁদছো কেন?
_আপনাকে সুস্থ দেখে একটু ভে'ঙে পরতে ইচ্ছে হলো।
সামিন ম্লান হাসে। আলো সামিনের চোখে চোখ রেখে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,"ভেঙে পরলে আরেকজনের যে খুব কষ্ট হতো। তখন তো আপনিও কষ্ট পেতেন।"
সামিন আলোর কথা বুঝতে না পেরে বলে,"মানে?"
আলো চোখের পানি মুছে লাজুক হাসি হাসে। সামিনের ডানহাত টা টেনে নিজের পেটে চেপে ধরে বলে ওঠে,"কেউ আসতে চলেছে মেয়র সাহেব। আপনি যাকে খুব করে চাইতেন।"
সামিন বোকার মতো আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। তার এখন কি করা উচিত!
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"খুব ইচ্ছে করছে তাইনা আমাকে কোলে নিয়ে আদর করতে? কি লাভ! সে পথ তো নিজেই বন্ধ করে দিয়েছেন! পা দুটোর কি হাল করেছেন। আপনার পা ঠিক হতে হতে আমাদের বাচ্চা হাঁটতে শিখে যাবে সম্ভবত মেয়র সাহেব।"
সামিনকে খোঁচা মেরে কথা বলতে বলতে আলো খেয়াল করলো না তার সামনে বেডে বসে থাকা মানুষটা কতটা আবেগী হয়ে উঠেছে। কতটা ছ'ট'ফ'ট করছে তার ভেতরটা আলোকে জরিয়ে ধরার জন্য। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,"কি?"
সামিন গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,"এদিকে এসো!"
আলো চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বেডের একপাশে বসে। সামিন বলতে থাকে,"আমাকে জরিয়ে ধরো । শক্ত করে।"
আলো সামিনকে জরিয়ে ধরে। কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ থাকে। সামিন নরম গলায় বলে ওঠে,"আমি আর ওভাবে গাড়ি চালাবো না কখনও।"
আলো চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ তারপর বলতে শুরু করে,"কি বলেছি বুঝতে পেরেছেন? শুধু ভবিষ্যত নিয়ে ভাববো আমি। আপনি এমপি ইলেকশন ল'ড়বেন। স্ত্রী হিসেবে সবসময় আমি আপনার পাশে থাকবো। রাজনীতি করবেন,আমাকে সময় দেবেন,বাচ্চাকে সময় দেবেন, ভাই-বোনকে দেখবেন।
সামনে আমাদের কত কাজ। ইশিতার রিসিপশন, ইশমামের জন্য মেয়ে দেখা, ইহানের সুন্নতে খৎনা, আমার শ্বশুরের মৃত্যুবার্ষিকী। কত কাজ সামনে আমাদের দুজনের। ঐ বাড়ির অভিভাবক আমরা দুজন। আমাদের ঠিক থাকতে হবে না? বলুন?"
এপর্যন্ত বলে আলো থেমে দুহাতে সামিনের গাল আগলে ধরে সামিনের চোখে চোখ রেখে বলে,"বলুন! আমাদের ঠিক থাকতে হবে না? আমরা কি ও বাড়ির অভিভাবক নই?"
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামিন মাথা নাড়ায়। আলো আবারও সামিনকে জরিয়ে ধরে। সামিন আবেশে দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে। আলো বলতে থাকে,"এবার আমার সাথে শপথ বাক্য পাঠ করতে থাকুন মেয়র সাহেব।"
সামিন দু'চোখ বন্ধ করেই বলে ওঠে,"কেমন শপথ বাক্য?"
_যা বলবো সাথে সাথে বলবেন। বলুন আমি সামিন ইয়াসার মির্জা শপথ করিতেছি যে।
_আমি সামিন ইয়াসার মির্জা শপথ করিতেছি যে।
_আমি আমার বৌয়ের একান্ত বাধ্য স্বামী হয়ে থাকিব এবং জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে তার কাছ থেকে মতামত নেবো।
সামিন হেসে আলোকে রিপিট করে।
আলো বলতে থাকে,"আমি ইয়াসার মির্জা এও শপথ করিলাম যে আমার দুই ভাই, ইলহাম এবং ইশমাম । বাবা মায়ের অবর্তমানে আমিই তাদের একমাত্র অভিভাবক। আমার যথাসাধ্য চেষ্টা থাকিবে তাদের জীবনকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে দেওয়া এবং তাদের আগলে রাখার। তাদের জীবনের সামনের পথগুলো পাড়ি দিতে তাদের পথপ্রদর্শক হওয়া।"
সামিন বা হাতে আলোকে আগলে ধরে রিপিট করে কথাগুলো।
আলো বলে,"আমার ছোটো বোন ইশিতা এবং ভগ্নিপতির সহিত আজীবন সুসম্পর্ক বজায় রাখিবো।"
সামিন হেসে রিপিট করে।
আলো থেমে গিয়ে সামিনের দিকে তাকায়। কপাল কুঁচকে বলে,"হাসছেন কেনো আপনি? আমি মজা করছি?"
সামিন মাথা নেড়ে বলে,"না।"
সকালের কড়া মিষ্টি রোদ এসে জানালা থেকে সরাসরি কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করে। সামিনের গালে রোদের স্পর্শ লাগতেই চোখ নাক কুঁচকে ফেলে সে। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"যাও তো। গিয়ে জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিয়ে এসো তো।"
আলো বলে,"কেনো। আলোটা ভালো লাগছে তো।"
সামিন ম্লান হেসে আলোর হাত ধরে বলে,"আমার জীবনে আলো আছে তো। আমার আর ঐ আলোর প্রয়োজন নেই।"
চলমান.....
#নোট: পুরো গল্পটি জুড়ে আমি কখনোই ধর্মকে অবমাননা করিনি। যেটুকু গালাগাল, অশালীন কথাবার্তা লিখেছি তা শুধুই চরিত্রের প্রয়োজনে। আমি চরিত্রটিকে ওভাবে সাজিয়েছি। ত্রুটি দিয়েছি,গুন দিয়েছি। আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি কখনোই গল্পে ফুটিয়ে তুলিনি। গল্পটি শুধুমাত্র একটা গল্প। এখন যদি ফেরাউন,ইবলিশ,নমরূদ এইসব শব্দ ধরে পুরো গল্পটিকে মূল্যায়ন করেন তাহলে সেটা অনুচিত।
আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে চাই। অনেকেই আপত্তি তুলেছেন ইশমাম আলোর কথা সামিনকে জানানো উচিত হয়নি। পাঠক হিসেবে আমিও ওটাই মনে করি,সামিনের ওপর মায়া থেকে আমারও ওটাই মনে হয়। কিন্তু একজন লেখিকা হিসেবে আমার মত হচ্ছে, ঐ ব্যাপারটা আমার গল্পের একটা সত্যি। আর সামিনের আজীবনের অস্বস্তির কথা যদি বলেন তাহলে বলবো সামিনের জীবনে বহু মানুষ রয়েছে ধীরে ধীরে তার অস্বস্তি কাটিয়ে তোলার। ইতিমধ্যে সেই ব্যাপারটা আমি করে দেখানোর চেষ্টাও করেছি। সামিন ইজ আ লাকি ম্যান।
আরেকটা ব্যাপার, কাহিনী এতো ঘোরানো হচ্ছে কেনো? কেনো সামিনের এক্সিডেন্ট হলো? এতো প্যাচ কেন?
উত্তর হচ্ছে, "অনূভুতি" অন্যান্য লেখিকারা তাদের শব্দভাণ্ডার খরচ করে ফুটিয়ে তোলে। আমার ঐ গুণ নেই, আমি করি কি, এক একটা ইন্সিডেন্ট ঘটিয়ে মানুষের ইমোশন ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি। এগুলো আমার একটা টেকনিক। আজ এই সিক্রেট টা আমার পাঠকদের জানিয়ে দিলাম।
যাই হোক,গল্পটি আমি ৪৮ পর্বেই শেষ করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমার ইচ্ছে হলো সামিন আর আলোর সন্তানের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার।
আগামীকাল গল্পটির অন্তিম পর্ব আসতে চলেছে। সবাই ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করবেন।
আর হ্যা আবারও বলছি, নিজের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পাঠকদের প্রভাবিত করিনি আমি। আমি একটা গল্প বলেছি মাত্র। যা করার গল্পের চরিত্র গুলো করেছে। আমি নই।
যদি গল্পটি ভালো লেগে থাকে তবে কৃতজ্ঞতা, যদি গল্পটি গ্রহণ করতে কষ্ট হয়ে থাকে তবুও বলবো যতটুকু পড়েছেন ,তার জন্য কৃতজ্ঞতা 

#পর্বসংখ্যা_৫৮ [অন্তিম পর্ব]
[৫৮ পর্বের ২য় অংশ]
শান্তকে দেখে ইশিতা কপাল কুঁ'চ'কে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শান্ত ঘাবড়ে যাওয়া মুখ করে বলে,"কি? কি করলাম আমি?"
_তুমি আবার লুঙ্গি পরেছো?
দাঁত খিচিয়ে বলে ইশিতা।
_হ্যা পরেছি , তো? আচ্ছা তোমার এই লুঙ্গির সাথে কি সমস্যা একটু বলো তো!
_লুঙ্গি একটা অ'শ্লীল পোশাক। দেখলে আমার হাড় জ্বলে যায়।
_লুঙ্গি অ'শ্লীল পোশাক!?
শান্ত যারপরনাই অবাক হয়ে যায়। তারপর আবার বলে ওঠে,"এটা একটা ঐতিহ্যবাহী পোশাক বাঙালির। তুমি অ'শ্লীল বানিয়ে দিলে? তোমার পূর্বপুরুষ রা অ'শ্লীল পুরুষ?"
_আমার পূর্বপুরুষ রা লুঙ্গি পরতো না।
_কিন্তু আমার পূর্বপুরুষ পরতো। তাই আমিও পরবো। আর তাছাড়া আমি উঠে এসেছি গ্রাম থেকে। তোমার ভাইদের মতো সাহেব নই, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি!
_এক্ষুনি এটা পাল্টে এসো বলছি। নয়তো আমি বিছানায় উঠতে দেবো না তোমাকে।
_কাম অন ইশু, এপ্রিলের গরম। তোমাদের এসিতে কাজ হয় না। এটা পরে ঘুমালে একটু আরাম লাগে,হাওয়া বাতাস ঢুকতে পারে।
_ছিঃ কি কথা বার্তার ছি'ড়ি!
কান চেপে ধরে ইশিতা শান্তকে ধ'মক দেয়।
বাইরে সামিনের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যায়। ইশিতা শান্তর দিকে তাকায়। শান্ত বলে,"ঐ যে শুরু হয়ে গেলো! আমি আজ ভাবীকে খানিকটা অসুস্থ দেখেই বুঝেছি আজ কিছু হবে! চলো এবার, আমাদের হসপিটাল ছুটতে হবে। তার আগে লুঙ্গি টা পাল্টে আসি আমি!"
পরী সামিনের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। সামিন এগিয়ে যায়, পরী বলে ,"আমাদের এক্ষুনি বেরোতে হবে ভাইয়া। চলুন।"
***
"তুমি কি পাগল হলে নাকি সামিন? বলেছি তো নরমাল ডেলিভারি পসিবল। তারপরেও সি-সেকশন নিয়ে পরে আছো। এটা কোন ধরনের শখ?"
_আপা ওর কষ্ট হবে।
নরম গলায় বলে ওঠে সামিন।
_আলে আলে! কি কথা! পৃথিবীতে ভূরিভূরি মেয়েরা মা হচ্ছে! তাদের তো আর কষ্ট হচ্ছে না! যাও, যাও গিয়ে বাইরে অপেক্ষা করো। আমাদেরকে আমাদের কাজ করতে দাও।
ডক্টর আফসানা ভেলিভারি রুমে আলোর প্রেশার চেক করতে করতে বলে। আলো চাপা আওয়াজে আর্তনাদ করে যাচ্ছে। পরী তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সামিন করুণ দৃষ্টি দিয়ে তার বৌয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিনের চোখে আলোর চোখ পরতেই আলো চেঁচিয়ে উঠে ডক্টর আফসানাকে বলে,"আপা আপনার আল্লাহর দোহাই লাগে এই আ'হাম্মক লোকটাকে এখান থেকে সরান। উনি আমাকে টেনশন দিচ্ছে। ওনাকে প্লিজ বাইরে বের করে দিন।"
সামিন দাঁড়িয়ে থাকে । ডক্টর আফসানা ধ'ম'ক দিয়ে বলে,"যাও সামিন। বের হও।"
সামিন তবুও দাঁড়িয়ে থাকে। পরী প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে এসে সামিনের হাত ধরে টেনে ভেলিভারি রুম থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
বিশাল ওয়েটিং রুমে মির্জা বাড়ির সব লোক এবং আতাউর আলমের পরিবার বসে আছে। রেহেনা একপাশে বসে দু'চোখ বন্ধ কর তাসবিহ পাঠ করছে। সামিন গিয়ে চূ্পচাপ তার পাশে মাথা নিচু করে বসে থাকে। রেহেনা মাথা ঘুরিয়ে একপলক তাকে দেখে বলে,"শান্ত থাকো। আল্লাহ সহায় হবেন।"
তারপর আবারও তাসবিহ পাঠ করতে থাকে। ভেলিভারি রুম থেকে মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে, যা খুবই অস্পষ্ট!
হঠাৎ কোনো পুরুষালি নাকি কান্নার আওয়াজ কানে যেতেই সামিন মাথা তুলে তাকায় । ওয়েটিং রুমে দূরেই তার মুখোমুখি বেঞ্চিতে বসে আছে আতাউর আলম। টিস্যু পেপার হাতে নিয়ে চোখ চেপে ধরে কেঁদে যাচ্ছেন তিনি। আর কিছুক্ষণ পরপর এক একটা দীর্ঘশ্বাস বের করে বলে যাচ্ছে,"আমার মা! আমার মা!"
আজান আয়াত বাবার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।
সামিন আতাউর আলমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে ওঠে,"এই কেউ ওনাকে এখান থেকে নিয়ে যাও তো! ওনাকে দেখে আমার টেনশন বেড়ে যাচ্ছে!"
আতাউর আলম কান্না থামিয়ে সামিনের দিকে একপলক তাকায়। তারপর আবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে,"আমার মা । মা রে!"
সামিন ঘার ঘুরিয়ে রেহেনার দিকে তাকিয়ে বলে,"ওনাকে আপনি বিয়ে করেছিলেন কি দেখে মা?"
রেহেনা সামিনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে,"তখন আমার বাবাকে বোঝানোর জন্য যদি তুমি থাকতে!"
***
ইশিতার হাতে পরীর ফোন। ইশমাম ফোন দিচ্ছে। ইশিতা ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইশমাম বলে ওঠে,"হ্যা হ্যালো! তোমরা কোন ফ্লোরে একটু বলবে? আমি তো ভুল করে শিশু ওয়ার্ডে চলে গিয়েছিলাম!"
_আমরা সেকেন্ড ফ্লোরে ইশমাম। ওখানের রিসিপশনিস্ট কে বললেই দেখিয়ে দেবে।
ইশমাম ইশিতার গলার আওয়াজ পেয়ে চুপ হয়ে যায়। ইশিতা বলতে থাকে,"পরী ছাড়াও আমরা এখানে আছি। আমাদেরকেও ফোন দিয়ে প্রশ্নটা করা যায়। আমার বড় ভাই দু'টো না হয় এখন বৌ পাগল হয়েছে। তুই তো বিয়ের আগেই দেখিয়ে দিচ্ছিস! বৌ ছাড়া চোখে কিছু দেখিস না।"
ইশিতার কথা শুনে ইশমাম ফোনটা কেটে দেয়।
***
"আপা আর কতক্ষন লাগবে! আমার দম বেরিয়ে যাচ্ছে!"
আলোর আর্তনাদে রুম ভারি হয়ে যাচ্ছে। দুজন নার্স আলোর হাতে পায়ে মাসাজ করে দিচ্ছে।
আফসানা খুবই ধৈর্য্য ধরে তার কাজটা করে যাচ্ছে। ঘড়ি ধরা একঘন্টা তের মিনিটের চেষ্টার পরে সামিন ইয়াসার মির্জার কন্যা তার মায়ের কষ্ট আর না বাড়িয়ে অবশেষে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন।
পৃথিবীতে এসেই তিনি সবার কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে। গলার আওয়াজ টা তার একেবারেই মায়ের মতো উঁচু। হম্বিতম্বি একেবারেই বাবার মতো।
নার্স এসে কাপড়ের পুঁটলিতে মোড়ানো ছোট্টো পুতুলটাকে তার বাবার কোলে দিয়ে বলে,"অভিনন্দন। আপনার ওয়াইফ ঠিক আছে।"
কাঁপা কাঁপা হাতে সামিন তার কন্যাকে কোলে তুলে নেয়। চারপাশ থেকে মৌমাছির মতো ছুটে আসে সবাই সামিন ইয়াসারের কন্যাকে দেখবে বলে।
সামিন কতটা আবেগী হয়ে গিয়েছে তা কেবল পৃথিবীতে যে প্রানীগুলো বাবা হয়েছে তারাই বুঝতে পারবে। অন্য কেউ বুঝতে পারবে না। কাউকে কন্যার মুখ দেখতে না দিয়ে হেঁটে একটা নিড়িবিলি স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়ে কন্যার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। চোখের কোণে পুরুষালি অনূভুতি জমা হয়েছে,যা অন্য কেউ দেখে ফেলে হেসে ফেলবে।
আতাউর আলম পেছন থেকে বলে ওঠে,"আমাকে দাও।"
সামিন ঘুরে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,"আপনাকে কেন দেবো?"
_আমার নাতনি! আমি আজান দেবো ওর কানে।
_আমার মেয়ে। আমি আজান দিতে জানি। আপনি আপনার মেয়ের কাছে যান।
আতাউর আলম কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলে ওঠে,"ও তুমি আজান দিতে জানো? আমি তো জানতাম তুমি শুধু ভাষণ দিতেই জানো।"
সামিন শশুরের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। আতাউর আলম চলে যায়। সামিন মাথা ঘুরিয়ে আবারও মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পরে। মাথা নিচু করে কানের কাছে মুখ নিয়ে আজান দিয়ে মেয়ের কপালে চু'মু খায়।
দু'চোখের কোণে দুফোঁটা পিতৃত্বের অনূভুতি নিয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে,ধরা গলায় বলে ওঠে,"আমার আম্মা তুমি। তুমি ইনশিরাহ বিনতে সামিন। তুমি কষ্টের পরে স্বস্তি।"
ইনশিরাহ চোখ দুটো পিটপিট করছে। হাত দুটো মুঠি করে রেখেছে। সামিন আবেগতাড়িত হয়ে বলে ওঠে,"নাকটা একেবারে মায়ের মতো পেয়েছো।"
দু'চোখ বন্ধ করে আবারও চু'মু খায় মেয়ের কপালে। তারপর হাত দিয়ে ভেজা চোখের কোণ মুছে ইনশিরাহকে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,"আমার দুর্বলতা শুধু তোমাকেই দেখালাম। তুমি ছাড়া পৃথিবীতে কেউ কখনও সামিনের চোখে পানি দেখেনি। তুমি কাউকে বলে দিওনা লজ্জার কথা! ঠিকাছে আম্মা?"
***
পরী রুম থেকে বেরিয়ে একপলক ইশমামের দিকে তাকিয়ে ইশিতার কাছে এসে ফোনটা হাতে নেয়।
ইশিতা বলে ওঠে,"তোকে না বলে তোর ফোনের কল রিসিভ করেছি। আসলে কলটা আমার ভাইয়ের নাম্বার থেকে ছিলো তাই ভাবলাম আমার রিসিভ করার অধিকার আছে।"
পরী লাজুক মুখটা নামিয়ে রাখে। ইশিতা বলতে থাকে,"প্রথমে কে আগে প্রস্তাব দিয়েছে? তুই না ও?"
_উনি।
_হু। জানতাম। ছেলেরা একটু এগিয়ে থাকবে স্বাভাবিক। তা তুই রাজি হলি কেনো?
পরী একপলক ইশমামের দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে ইশিতাকে বলে ওঠে,"কেউ আশ্রয় চাইলে, ফিরিয়ে দিতে নেই।"
***
সামিনকে দেখে নার্স দুজন কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আলো একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে সামিন এগিয়ে এসে বেডের একপাশে বসে পরে। আলোর ক্লান্ত দুটি চোখে জড়ো হচ্ছে বাবা মেয়ের প্রতি মুগ্ধতা!
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলে ওঠে,"মেয়ে একেবারে তোমার গায়ের রং পেয়েছে আছিয়া। আমার মতো সাদা মুলা হয়নি।"
আলো হাসতে থাকে। সামিন এক হাত বাড়িয়ে আলোর মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,"তুমি অসম্ভব স্ট্রং একটা মেয়ে। আমার এতো মানসিক শক্তি নেই। মেয়েটা তোমার মতোই হোক।"
***
অক্টোবর শেষ হতে না হতেই বেশ শীত পরতে শুরু করেছে। সামিন মেয়ের যত্নে আগে ভাগেই শীতকে মোকাবেলা করার সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
নরম,গরম পোশাক পরিয়ে মাথায় খুব সন্তর্পনে একটা টুপি পরিয়ে দিতে দিতে আলোর দিকে তাকায়। আলো বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। পরক্ষনেই বলে ওঠে,"এভাবে প্যাকেট করছেন কেন ওকে? ও কি আপনাকে বলেছে ওর শীত লাগছে?"
সামিন ইনশিরাহকে কোলে তুলে নিতে নিতে বলে,"বলতে হবে না। আমি বুঝি।"
আলো রোদ থেকে তুলে আনা কাপড় গুলো ভাজ করে আলমারিতে তুলে রেখে দিতে দিতে বলে,"এখন আপনার ব্যস্ততা কোথায়? সারাদিন বাড়িতে মেয়ের কাছে বসে থাকেন। এখন সব ব্যস্ততা কোথায় গেলো?"
সামিন আলোর কথায় কোনো জবাব না দিয়ে ইনশিরাহকে নিয়ে ইশমামের ঘরে যায়। ইশমাম জরুরি কাগজ পত্র সব গুছিয়ে নিচ্ছিলো। সামিনকে দেখে বলে,"কিছু বলবে?"
_তোর ফ্লাইট কখন?
_সকাল সাড়ে আটটায়।
সামিন চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলে ওঠে,"পরীর এক্সাম আজ শেষ হয়েছে। ভনিতা না করে বলি, যদি আংটি পরিয়ে রেখে যেতে চাস তাহলে আংটির অর্ডার দিচ্ছি আমি। যদি রেজিস্ট্রি করে রেখে যেতে চাস তাহলে কাজী ডাকবো। তোকে পাচ মিনিট সময় দিলাম ভাববার জন্য। ভেবে আমাকে জানা।"
ইশমাম বোকার মতো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন ইনশিরাহর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ইশমাম বলে ওঠে,"তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?"
_অবশ্যই না।
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে ইশমামকে বলতে থাকে,"সিদ্ধান্ত জানা। আমার হাতে সময় কম। তোর হাতেও সময় কম। আংটি না রেজিস্ট্রি? কোনটা?"
ইশমাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অস্পষ্ট ভাবে বিরবির করে বলে ওঠে,"রেজিস্ট্রি করলেই তো ভালো হয়,নয়তো আবার দেখা যাবে অন্য কেউ এসে এটাকেও তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেললো।"
সামিন মেয়ের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিলো,ইশমামকে বলে,"কিছু বললি?"
_না না, না ভাইয়া, না। কিছুই বলিনি।
সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,"কাজী ডাকবো?"
_তোমার ইচ্ছা।
সামিন চুপচাপ ইনশিরাহকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। রিতু আর আলো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। চাপা স্বরে রিতু বলে ওঠে,"কি বললো?"
সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে ওঠে,"পরীকে সাজাও।"
তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,"পাঞ্জাবি বের করে দাও আমার। কাজী আনতে যাচ্ছি!"
***
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ কাজী ডেকে ইশমাম আর পরীর রেজিস্ট্রি সেরে ফেলেছে সামিন ইয়াসার মির্জা।
পরী বোকার মতো সবার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে সাইন করে দিয়েছে পেপারে। বিয়ের ঠিক পাঁচ মিনিট আগে রিতু একটা শাড়ি নিয়ে পরীর ঘরে ঢুকে বলে,"এটা পরো।"
পরী কিছু বুঝতে না পেরে বলে ওঠে,"শাড়ি কেনো?"
_কারন তোমার বিয়ে।
_কার সাথে?
_যার সাথে হলে খুশি হবে তারই সাথে। চটজলদি পরে নিচে এসো,কাজী এসেছে নিচে।
গায়ের শাড়ীটা ভারি খসখসে। পরীর ইচ্ছে করছে এক টানে খুলে ফেলে সালোয়ার কামিজ পরতে। কিন্তু সে ভদ্র মেয়েটির মতো গুটিসুটি মেরে ইশমামের বিছানায় বসে আছে। বিছানার পাশের একটা টেবিলে রিতু একটা দুধের গ্লাস রেখে গিয়েছে। পরী গ্লাসটি থেকে চোখ সরিয়ে পুরো ঘরে চোখ বোলাতে থাকে। এই ঘরে সে কখনো আসেনি এর আগে। এখন থেকে এটা তার স্বামীর ঘর। কথাটা ভাবতেই পরীর অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।
যেমন অগোছালো লোক,যার যেমন অগোছালো জীবন,তার ঠিক তেমন অগোছালো ঘর।
ইশমাম এসে দরজার বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢোকে।তখন রাত প্রায় বারোটা।
পরী ইশমামের পায়ের আওয়াজ পেয়ে মাথা তুলে তাকায়। ইশমাম ম্লান হেসে বলে ওঠে,"ভাইয়া অমন পাগল। আমি নিজেও জানতাম না এমনভাবে বিয়ে হবে আমাদের! সবকিছু মাথার ওপর দিয়ে গিয়েছে।"
পরী হেসে ফেলে। তারপর বলে,"আপনার ঘরটা এতো অগোছালো কেন? কি বিশ্রী!"
ইশমাম হাত থেকে হাতঘড়ি খুলতে খুলতে বলে ওঠে,"আমার সবকিছুই অগোছালো হয়ে পরে আছে। তুমি গুছিয়ে দাও।"
মাথামোটা পরী ভেবেছে ইশমাম তার ঘর গোছানোর কথাই বলেছে, সে বিছানা থেকে নেমে,মাথার ঘোমটা সরিয়ে আচল কোমরে গুজে ঘর গোছাতে শুরু করে। ইশমাম মাথা ঘুরিয়ে পরীর কান্ড দেখে হা করে পরীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
***
আলোর শুরুতে বড্ড ঘুম পাচ্ছিলো। কিন্তু বাবা মেয়ের কান্ড দেখে ঘুম কে'টে গিয়েছে তার। সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সামিন আর ইনশিরাহকে দেখছে।
মেয়েকে কোলে নিয়ে সামিন ঘুম পা'ড়ানি গান গাওয়ার চেষ্টা করছে। আলোর কাছে সে দৃশ্য বড় মধুর লাগছে।
"খুকু ঘুমালো,পাড়া জুড়ালো,বর্গী এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসে?"
এতো টুকু গেয়ে সামিন থামে। তারপর আহ্লাদী গলায় মেয়েকে বলে ওঠে,"বাংলাদেশ একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র আম্মা! এখানে ধান বেঁচে খাজনা দিতে হয়না।"
ইনশিরাহ চোখ পিটপিট করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আলো
শাড়ির আঁচল মুখে চেপে হাসছে সামিনের দিকে তাকিয়ে। এই লোকটা এতো পাগল কেনো!
সামিন আবারো গাইতে শুরু করে,
"খুকু ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গী তো নেই দেশে....."
_আপনি খুব বাজে গান করেন মেয়র সাহেব।
আলো মৃদু আওয়াজে বলে। সামিন মেয়েকে মৃদু দোলাতে দোলাতে জবাব দেয়,"জানি। তবে আমি খুব সুন্দর আদর জানি। মেয়ে ঘুমিয়ে গেলে দেখাচ্ছি!"
***
"আমরা বোধ হয় পৃথিবীর প্রথম স্বামী স্ত্রী যারা বাসর ঘরে ঘর গোছাচ্ছি।"
ইশমামের বইয়ের তাক গোছাতে গোছাতে বলে ওঠে পরী। ইশমাম নিজের অগোছালো জামাকাপড় সরিয়ে নিয়ে একটা আলমারি ফাঁকা করে পরীকে বলে,"এটা তোমার। তোমার জামাকাপড় এটাতে রাখবে।"
পরী এসে ইশমামের ব্যাগ গুছিয়ে দিতে দিতে বলে,"আপনার ফ্লাইট কয়টায়?"
_সকাল সাড়ে আটটায়।
_আপনার তো ঘুম প্রয়োজন। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি আপনার সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছি।
ইশমাম পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,"সবকিছু গুছিয়ে দেবে?"
পরী ইশমামের ব্যাগে তার শার্ট গুলো সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলে,"হ্যা! সব। কি কি গোছাতে হবে বলুন।"
ইশমাম পরীর দিকে তাকিয়ে আছে। অসম্ভব রূপবতী নারীর পরনে একটা কফি কালারের বেনারসী। খুবই মোহনীয় লাগছে তাকে।
পরী মাথা তুলে ইশমামের দিকে তাকায়। তারপর বলে,"কি হলো! বলুন কি কি গোছাতে হবে,ব্যাগ ছাড়া?"
_জীবন।
ইশমাম অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে। পরী ইশমামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশমাম বলতে থাকে,"একটা জীবন গোছাতে হবে।"
***
রাত দেড়টার কাছাকাছি। ইনশিরাহ বাবার কোলে ঘুমিয়ে গিয়েছে। সামিন খুবই সন্তর্পনে মেয়েকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো সামিনের দৃষ্টি দেখে লজ্জা পেয়ে যায়। সবসময় মেয়েকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ঘুমায় মানুষটা, কিছু কিছু রাত শুধু আলো থাকে তার বুকে। আজ সম্ভবত সেই রাত ।
আলো বিছানা থেকে নেমে নিচু স্বরে বলে,"কমলা রঙের শাড়ি পরতে হবে?"
সামিন চুপ করে থাকে। আলো শাড়ি পাল্টে চুলে খোঁপা করে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। সামিন এক দৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থেকে এগিয়ে যায়, পেছন থেকে আলোর কোমর জড়িয়ে ধরে আলোর কাঁধে থুতনি ঠেকায়। আলো ধীরে ধীরে সামিনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে ওঠে,"শরীরে মেদ জমছে আমার।"
_এতোটুকু জরুরী। নয়তো কৃত্রিম লাগে সে সৌন্দর্য। এখন আমি তোমার দুধরনের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই। একজন স্ত্রীর সৌন্দর্য, আমার সন্তানের মায়ের সৌন্দর্য।
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলে ওঠে,"আমারও তো ভুড়ি বেড়ে যাচ্ছে। মাথার চুল উঠে যাচ্ছে।"
আলোও নিচু স্বরে বলে ওঠে,"এতো টুকু জরুরী। নয়তো কৃত্রিম লাগে। এখন আমি আপনার অসংখ্য সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই। একজন অসাধারণ স্বামীর সৌন্দর্য,স্নেহপরায়ন বাবার সৌন্দর্য, একজন দায়িত্বশীল বড় ভাইয়ের সৌন্দর্য,একজন ন্যায়পরায়ণ নেতার সৌন্দর্য।"
সামিন মৃদু হেসে আলোকে কোলে তুলে নেয়। আলোর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে ওঠে,"মেদ বেরেছে,সাথে ওজনও।"
আলো হেসে ফেলে। সামিনের কাছে সে হাসি বড় মধুর লাগে। আলোকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কপালে চু*মু খায়। তারপর ঘোর লাগা দুটো চোখে আলোর মুখের দিকে একপলক তাকায়। বরাবরের মতো লজ্জায় লাল হয়ে আছে মুখটা। বাতি নিভিয়ে স্ত্রীকে কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসতে চায় তাকে, অনুমতি চায় বরাবরের মতো। দু'জনের অনূভুতি যখন একে অপরকে সম্মতি দিলো , ঠিক সেই আবেগী মুহুর্তে ইনশিরাহ গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয়।
সামিন উঠে বাতি জ্বেলে আলোর দিকে তাকায়। আলো তার দিকেই তাকিয়ে আছে, সামিন বলে ওঠে,"এটা আমার মেয়ে না শ'ত্রু। এর থেকে তো বিরোধী দল আমাকে বেশি মায়া করে।"
আলো মুখে শাড়ির আঁচল চেপে হাসছে। সামিন উঠে গিয়ে ইনশিরাহকে আবারও কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামায়। আলো শুয়ে শুয়ে বাবা মেয়েকে দেখতে থাকে।
সামিন মৃদু দুলতে থাকে মেয়েকে কোলে নিয়ে,
"খুকু ঘুমালো,পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে......"
থেমে আবারও বলতে থাকে,"মা একটা নতুন গান বাঁধতে হবে বুঝলে। এখন দেশে বর্গী নেই। বাংলাদেশ একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র।"
মেয়ের সাথে যতরাজ্যের গল্প জুড়ে দেয় সামিন ইয়াসার মির্জা। তবে কোন রূপকথার গল্প নয়! রাজ*নীতির গল্প। ইনশিরাহ চোখ ছোট ছোট করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আলো দেখছে তাদের দুজনকে।
ইনশিরাহ ঘুমিয়ে যায়, ঘুমিয়ে গিয়েছে আলোও। সামিন ইনশিরাহকে আলোর পাশে শুইয়ে দিয়ে দু'জনের দিকে তাকিয়ে থাকে চোখে এক সমুদ্র মুগ্ধতা নিয়ে।
তার চোখে চকচক করছে পবিত্র কোনো আলো। যে আলো লেগেছিল তার বধূকে দেখে।
~~~~~~~~~সমাপ্ত~~~~~~~
No comments:
Post a Comment